গিয়ােভানি বােকাসিও-র ডেকামেরন টেলস এর বাংলা অনুবাদ।
দিন বসে থাকে না। পঞ্চম দিন আরম্ভ হল। ফিয়ামমেত্তা নতুন কুইন মনােনীত হয়েছে। এবার গল্পের বিষয়বস্তু হল প্রণয়পীড়িত যুবক-যুবতীদের দুঃসাহসিক ঘটনা, নিপীড়ন বা দুঃখ-দুর্দশার পর তাদের মিলন।
পুব আকাশ লাল হল। লাল রং ফিকে হতে হতে সাদা হল। সূর্যদেব একটু একটু করে উঁকি দিতে দিতে উঠে এলেন। প্রথমে গাছের আগায় রােদ দেখা দিল, সেই রােদ ক্রমশ সারা প্রকৃতির ওপর ছড়িয়ে পড়ল। সকাল হল। চারদিকে কচি রােদ ঝলমল করবার অনেক আগে পাখি ডাকার সঙ্গে সঙ্গে নতুন কুইন কিয়ামমেত্তা শয্যাত্যাগ করে সকলকে জানিয়ে দিল। তাদের কলকাকলি পাখির কলকাকলি ছাপিয়ে বাগানবাড়িতে মুখরিত করলাে। নিদ্রার আলস্য দূর করে বেশ পরিবর্তন করে সকলে বাগানে এলাে। শিশির ভেজা ঘাসের ওপর পায়চারি করতে করতে, ফুলের গন্ধ শুকতে শুকতে, পাখির গান শুনতে শুনতে, ভােরের বাতাসের কোমল স্পর্শ অনুভব করতে করতে তারা সুললিত কণ্ঠে গান গাইতে আরম্ভ করলাে। ইতিমধ্যে স্টুয়ার্ড তার নিয়মাফিক কাজ শেষ করেছে। প্রাতরাশের জন্যে মুখরােচক সুখাদ্য তৈরি করে রেখেছে। সকলে ঘরে ফিরে সরস ভােজ্য গ্রহণ করে তৃপ্ত হল। তারপর নানারকম অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবাভােজন পর্যন্ত সময় অতিবাহিত করলাে। ভােজনের পর কিছুক্ষণ দিবানিদ্রা। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়বার আগে কুইন সকলকে তুলে দিয়ে বাগানে এনে জড়াে করলাে। বাগানের একটা সুন্দর অংশ বেছে নিয়ে তারা গুছিয়ে বসলাে। ফোয়ারার কাছাকাছি একটা জায়গা তাদের পছন্দ।
নতুন কুইন তার নির্ধারিত আসনে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে বলল, আর দেরি কেন? প্যানফিলাে আজকের প্রথম গল্পটা তুমিই আরম্ভ করা। প্যানফিলাে আপত্তি করলাে না।
প্রথম গল্প
ইফিজেনিয়ার প্রেমে পড়ে হাবাগােবা চাইমন রীতিমতাে চালাকচতুর হয়ে উঠল। পরে সমুদ্রে একটা জাহাজ থেকে ইফিজেনিয়াকে চাইমন অপহরণ করলাে। রােডসে কিছুদিন কারাদণ্ড ভােগ করার পর লাইসিমেকাস তাকে মুক্ত করলাে। ইফিজেনিয়া ও ক্যাসাজার বিবাহ অনুষ্ঠান পালিত হবার সময় যুবক দু’জন ওদের অপহরণ করলাে ও দুই যুবতীকে নিয়ে ক্রিট দ্বীপে পলায়ন করলাে। ওদের বিবাহ হল এবং নবদম্পতিকে নিজ নিজ গৃহে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল।
প্যানফিলাে একটু মজা করেই গল্প আরম্ভ করলাে। বলল, বুঝলে সুন্দরীদের দল আজকের দিনটা যেমন চমৎকার আমারও তেমনি ইচ্ছে করছে মজাদার না হলেও তােমাদের ভালাে লাগে এমন একটা গল্প আমি তােমাদের শােনাব। শুধু তাই নয়, আমাদের কুইন যেমন গল্প বলতে বলেছেন। আমার গল্পটা আশা করি সেইরকম হবে। তােমরা দেখবে বিশুদ্ধ প্রেম কত তীব্র হতে পারে, প্রেমের জন্য মানুষ কি না করতে পারে। তােমরাও তাে কারও-না-কারও প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত তাই তােমরা মর্যাদা বুঝবে। তাহলে শােন : কিম্বদন্তীও হতে পারে আবার সত্যকাহিনীও হতে পারে, অনেকদিন আগে সাইপ্রাস দ্বীপে অ্যারিস্টিপাস নামে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বাস করতেন। তার তুল্য বিষয়সম্পদ আর অর্থ দ্বীপে আর কারও ছিল না। অতুলনীয় ধনসম্পদের অধিকারী অতএব তার সুখের সীমা থাকা উচিত ছিল না কিন্তু সামান্য একটা ব্যাপার তাকে মাঝে মাঝে অসুখী করতাে। ছেলেমেয়েগুলির মধ্যে একটি ছেলে সুদর্শন, দীর্ঘদেহী ও বলিষ্ঠ, বয়সও হয়েছে, যুবক বললেই হয় কিন্তু তার বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারেই নেই, যাকে বলে জড়বুদ্ধি। যাতে সে একটু বুদ্ধিমান হয় এজন্য তার বাবা অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন, ছেলের বুদ্ধির বিকাশ একটুও হয়নি। সে বােবাই রয়ে গেল। শিক্ষক রেখে অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল, শাস্তিও দেওয়া হয়েছিল কিন্তু কোনাে ফল হয়নি।
ছেলেটির আসল নাম ছিল গ্যালেসাম কিন্তু তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যে তাকে চাইমন বলে ডাকা হতাে। শেষ পর্যন্ত ঐ নামটাই বহাল হয়ে গেল। সাইপ্রাসের ভাষায় শব্দটার অর্থ হাঁদারাম। ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে বাবা সর্বদা চিন্তিত থাকতেন। তিনি ভাবলেন ছেলেকে তাঁর ব্যবসা বা বিষয় সম্পত্তি তদারকির কাজে যখন দায়িত্ব দেওয়া যাবে না, তখন ওকে ক্ষেতে পাঠান হােক। চাষীদের সঙ্গে থাকবে, চাষবাসের কাজ যদি কিছু শিখতে পারে তাহলেও কিছু কাজ তাে হবে।
এই কাজের ভার পেয়ে চাইমন খুশি। গ্রামের চাষাভুষাে বা মুটেমজুরদের সে বেশি পছন্দ করে। তাদের সঙ্গে ওর মেলে ভালাে। শহরের জীবন অপেক্ষা ওর গ্রামের জীবন বেশি পছন্দ। সে গ্রামেই চলে গেল। মনের আনন্দে ভালােই আছে।
মনের আনন্দে কাধে একটা লাঠি নিয়ে বাবার জমিদারির এক অংশে ঘুরতে ঘুরতে সে ছােটখাটো একটা বনে এলাে। বনটার শােভা বড় চমৎকার। গাছগুলাে বেশ ঝাকড়া, সবুজ। তখন মে মাস তাই পাতার বাহারও দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এই বনের মধ্যে নানা রঙের পাথরঘেরা এক ঝরনা আছে।
এই ঝরনার ধারে ঘাসের ওপর সুন্দরী একটি তরুণী শুয়ে আছে। দূর থেকে চাইমনের মনে হয়েছিল তরুণী বুঝি নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু কাছে এসে দেখল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। নগ্ন নয়, যে পােশাকটি দিয়ে সে দেহ আবৃত করেছে তা এতই পাতলা যে তার দেহের প্রতিটি রােমকূপ বা ক্ষুদ্র তিলটিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এত সুন্দরী ঢেউখেলানাে তরুণী মূর্তি চাইমন দেখে নি। তরুণীর পায়ের কাছে দু’জন যুবতী ও একজন পুরুষ শুয়ে পড়েছে। তারাও ঘুমােচ্ছে, বােধহয়, বােধহয় তরুণীর পরিচারিকা ও সেবক।
ঘুমন্ত হলেও প্রায় নগ্ন এমন তরুণীকে লুকিয়ে দেখা যে অন্যায় সে বােধ চাইমনের নেই। সে তার লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তরুণীকে এক দৃষ্টে দেখতে লাগল। কাব্য করে বলা যায় রূপসুধা পান করতে লাগল। দেখতে দেখতে তার মনে হল তার হৃদয়ে ও মনে যেন একটা পরিবর্তন আসছে, অনেক বন্ধ দরজা খুলে যাচ্ছে। বিবসনা নারী মূর্তি আর একগুচ্ছ ফুলের মধ্যে কোনাে তফাৎ নেই। দুই-ই সুন্দর, দুইয়ের রূপ প্রশংসার যােগ্য, দুইয়েরই তারিফ করতে হয়। রূপ হােক আর কুরূপ হােক এই দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা বােঝার ক্ষমতা চাইমনের ছিল না। কিন্তু তখন তার মনে হল সে যেন প্রকৃতির সৌন্দর্য, ফুলের নয়নভােলানাে রং, পাখির সুমধুর কলধ্বনি এসব বুঝতে পারছে। ভালােমন্দর পার্থক্য করার একটা বােধ তার মধ্যে জেগে উঠছে।
তার হৃদয় মন যেন খুলে যাচ্ছে। বাঃ এ ফুল তাে সে আগে কতবার দেখেছে কিন্তু তা সুন্দর সে জানত না। নগ্ন নারীমূর্তিও দেখেছে কিন্তু তারও যে একটা আলাদা রূপ আছে, সেও যে ফুলের
মত ভালাে তা তাে সে জানত না।
তরুণীর কেশ কি সােনার? তার গ্রীবা, নাক, চোখ, মুখ, ঠোট এসব কি কোনাে শিল্পী নিপুণ হাতে তৈরী করে দিয়েছে। তার বক্ষযুগল এখনও অপরিণত। শিল্পী বােধহয় এখনও নির্মাণ শেষ করতে পারে নি। সে যেন শিল্পরসিক হয়ে উঠছে।
মেয়েটি ও তার সাথীরা অঘােরে ঘুমােচ্ছ। ঘুম ভাঙবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অথচ এমনই
তরুণীর আকর্ষণ যে সে ছেড়ে চলে যেতেও পারছে না, তাই সে অপেক্ষা করতে লাগল। তরুণীর পরিচয় জানতে হবে।
তরুণীর একসময়ে ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে লাঠিতে ভর দিয়ে এক যুবককে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখল। যুবককে তরুণী চিনতে পারল। চাইমনকে এ অঞ্চলে সবাই (মন। হাঁদাভােদা নিরীহ যুবকটির কোনাে শত্রু নেই। তাকে নিয়ে সকলে মজা করে। তার সুন্দর সুঠাম চেহারার জন্যে মেয়েমহলে তার জনপ্রিয়তা আছে। এছাড়া সে যে একজন বিশিষ্ট ও ধনী ব্যক্তির পুত্র তাও তাে সকলে জানে।
তরুণীর নাম ইফিজেনিয়া। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, কিরে চাইমন, তুই এখন এখানে কি করছিস?
ছেলেটা হাদাভােদা হলেও যেভাবে তার দিকে চেয়ে আছে তা দেখে ইফিজেনিয়ার গা ছমছম করে উঠল। ছোঁড়া যদি এখনি তাকে জড়িয়ে ধরে! ওকে ভালােয় ভালােয় বিদেয় করে দেওয়া ভালো। তাই ইফিজেনিয়া ওকে বলল, চাইমন তুই এখন এখান থেকে যা।
চাইমনের মধ্যে নতুন চেতনা জেগেছে। সে বলল, আমি তােমার সঙ্গে যাব ইফিজেনিয়া।
আমার সঙ্গে তুই কোথায় যাবি? গিয়ে কার কি হবে? কি করবি? ইত্যাদি নানাভাবে ইফিজেনিয়া তাকে বিরত করবার চেষ্টা করলাে কিন্তু চাইমন কিছুতেই নিবৃত্ত হল না। সে সঙ্গে থাকবেই। কোনাে কথা শুনল না। সে ইফিজেনিয়াদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত তার সঙ্গে গেল।
বাড়ি ফিরে চাইমন তার বাবাকে বলল যে, সে আর ক্ষেতে ফিরে যাবে না। সে কি? ফিরে যাবে না কেন? না না সে কিছুতেই আর ক্ষেতে ফিরে যাবে না। তার বাবা ও ভাইয়েরা ও আর সকলে তার কণ্ঠে অন্য সুর শুনল। চাইমন যেন এখন অন্য ছেলে। তাই সকলে একমত হল। ও বাড়িতেই থাকুক, দেখা যাক ওর মতলব কি। যদিও তারা চাইমনের সিদ্ধান্তে মনে মনে অসন্তুষ্ট হয়েছিল।
উপযুক্ত বয়স হলেও চাইমন এখনও পর্যন্ত কোনাে তরুণীর প্রতি আকৃষ্টি হয়নি। সে বােধও
তার ছিল না কিন্তু সে হঠাৎ ইফিজেনিয়ার প্রেমে পড়ে গেল। তার মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন দেখা গেল। সে একের পর এক বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে লাগল। প্রশ্ন করতে লাগল যা এতদিন তর স্বভাবিরুদ্ধ ছিল। তার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে তার বাবা ও আর সকলে অবাক।
চাইমন তার বাবাকে বলল, তার ভাইয়েরা যে পােশাক পরে এখন সে একই পােশাক পরবে, কোনো পার্থক্য থাকলে চলবে না। তার বাবা খুশি হয়েই পােশাক তৈরি করিয়ে দিলেন। চাইমন তার বয়সী লেখাপড়া জানা ও কেতাদুরস্ত যুবকদের সঙ্গে বিশেষ করে যার প্রণয়িনী আছে এমন যুবকদের সঙ্গে মেলামেশা করে চলতি পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয়, যে ছেলে একদা মূর্খ বলে পরিচিত ছিল সে দ্রুত শিক্ষিত বুদ্ধিমান বলে পরিচিত হল। সাধারণত এমন তাে দেখা যায় না, চাইমন সকলের বিস্ময় উদ্রেক করলাে।
তার উচ্চারণ এখন গ্রাম্য নয়, রীতিমতাে পরিশীলিত। কথা বলার ও প্রশ্ন করার ভঙ্গিও রীতিমতাে সুশিক্ষিত ভদ্র ব্যক্তিদের মতাে। সে এখন রীতিমতাে সভ্য ও শিক্ষিত। বহু জিনিস জানে। খবরও রাখে প্রচুর। সে অশ্বারােহণে এখন পটু, সঙ্গীতের সমঝদার। নিজেও উত্তম গায়ক ও কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারে। অসি চালানাে শিখেছে, সাহসী হয়েছে। ঘােড়া চালানাের মতাে জাহাজ চালাতে শিখেছে। সে এখন বহুবিদ্যা ও গুণের অধিকারী, যার মূলে আছে প্রেম, যা পুরুষকে শুধু সাহসী করে না, নানা বিদ্যায় পারদর্শী করতেও পারে। এই পর্যায়ে পৌছাতে তার মাত্র চার বছর লেগেছিল। সাইপ্রাস দ্বীপে চাইমন এখন একজন বিশিষ্ট ও জনপ্রিয় ব্যক্তি।
ছেলের এই অসাধারণ পরিবর্তনের মূলে কি আছে খোঁজ করতে গিয়ে অ্যারিস্টিপাস আবিষ্কার করলেন যে, ইফিজেনিয়া নামে একটি মেয়ের প্রতি প্রেম তার সন্তান চাইমনকে অন্ধকার থেকে আলােকে এনেছে, গাধাকে মানুষ করেছে। পিতা ছেলেকে উৎসাহ দিতে লাগলেন।
চাইমন তার এই নামটা এখন আর পছন্দ করে না। নামের অর্থ সে এখন জানে। ইফিজেনিয় যদিও তাকে এখনও ঐ নামে ডাকে কিন্তু ডেকে মুচকি হাসে। সে গ্যালিসাম নামটাই এখন পছন্দ করে এবং ঐ নামেই নিজের পরিচয় দেয় কিন্তু যে নাম একবার চালু হয়ে যায় সে নাম বদলানাে সহজ নয়।
চাইমন এখন সাহসী ও প্রেমিক। ইফিজেনিয়ার বাবা চিপসিয়াসের কাছে ইফিজেনিয়াকে সে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু চিপসিয়াস রাজি নয় কারণ তার মেয়ে বাগদত্ত। রােডসের এক বিশিষ্ট যুবক প্যাসিমােনডাসের সঙ্গে তার বিবাহের কথা পাকা হয়ে গেছে। তিনি কথার খেলাপ করতে পারবেন না।
চাইমন এখন সাহসী ও বুদ্ধিমান যুবক। এমন উত্তর শুনে সে হতাশ হবার পাত্র নয় সে। ইফিজেনিয়ার সব খবর রাখছে। ইফিজেনিয়ার বিবাহের সমস্ত আয়ােজন ও ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে। রােডসে তাকে নিজের প্রাসাদে আনবার জন্য তার হবু স্বামী প্যাসিমােনডাস জাহাজ পাঠিয়েছে। সেই জাহাজ ইফিজেনিয়াকে সাইপ্রাস থেকে রােডস নিয়ে যাবে। রােডসে ওদের বিবাহ হবে।
চাইমন স্থির করলাে সে পথে ঐ জাহাজ আক্রমণ করে ইফিজেনিয়াকে উদ্ধার করে প্রমাণ করবে ইফিজেনিয়া একমাত্র তারই এবং তাকে সে গভীরভাবে ভালবাসে। এই ইফিজেনিয়ার জন্যে সে নতুন মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সেই ইফিজেনিয়াকেই সে যদি উদ্ধার করে নিজের করতে না পারে তাহলে সে কিসের মানুষ এবং প্রণয়িনীকে উদ্ধার করে সে দেবতাদের ভুল গৌরব অর্জন করবে।
এইরকম স্থির করে চাইমন যথাসম্ভব দ্রুত বিশিষ্ট কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় গােপনে একটা জাহাজ যুদ্ধোপযােগী করে সাজাল। তারপর যথাযথ সময় বুঝে জাহাজ ছেড়ে দিল। ইতিমধ্যে ইফিজেনিয়াকে নিয়ে তার জাহাজও সমুদ্রে ছাড়া হয়েছে। তাকে আনতে বাগদত্তা স্বামীর বন্ধুরা সাইপ্রাসে গিয়েছিল। চিপসিয়াস তাদের যথাযথ ভাবে আপ্যায়ন করে ও উপঢৌকন দ্বারা সাজিয়ে মেয়েকে জাহাজে তুলে দিয়েছিল। জাহাজ অনুকুল বাতাস পেয়ে রােডসের দিকে তরতর করে ঢেউ কেটে এগিয়ে চলেছে।
চাইমনের জাহাজও পাল ফুলিয়ে লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়ে চলেছে এবং পরদিন ইফিজেনিয়া বাহিত রােডসগামী জাহাজের সঙ্গে মােলাকাত হয়ে গেল। ঐ জাহাজের সামনে চাইমন তার জাহাজকে নিয়ে গিয়ে নিজে জাহাজের মাথায় দাঁড়িয়ে যতদূর সম্ভব চিৎকার করে বলল, ওহে তেরাে ভালাে চাও তাে এখনি জাহাজের সব পাল নামাও, নইলে আমরা তােমাদের জাহাজ ডুবিয়ে দেব। আদেশ জারি করে চাইমন অস্ত্রশস্ত্র বার করে প্রস্তুত থাকতে বলল, কিন্তু রােডসগামী হাজ চাইমনের আদেশ অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলল। চাইমন বােধহয় এজন্যে প্রস্তুত ছিল। সে ত্য নাবিকদের বলল ঐ জাহাজের পিছনদিকে একটা লােহার শেকল ছুঁড়ে দিয়ে জাহাজ আটকে দিতে। নাবিকরা আদেশ পালন করলাে। জাহাজ আটকে গেল।
চাইমন অপেক্ষা না করে হাতে খােলা তলােয়ার নিয়ে সিংহের বিক্রমে জাহাজে লাফিয়ে পড়ে যাকেই সামনে পেল তাকে আক্রমণ করতে লাগল। মূল প্রেরণা কিন্তু তার প্রাণেশ্বরী। চাইমনের অমিত তেজ দেখে রােডেসিয়ার জাহাজের নাবিকরা ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করলাে। বৃথা লােক্ষয়ের দরকার কি?
চাইমন তাদের বলল, ভাইসব আমার উদ্দেশ্য তােমাদের সঙ্গে লড়াই করা নয়, লুটপাট করাও নয় এবং তােমাদের প্রতি আমার কোনাে বৈরী মনােভাবও নেই। আমার উদ্দেশ্য ভিন্ন। এই জাহাজে এমন একজন আছে যাকে আমি আমার জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করি। তার নাম ইফিজেনিয়া এবং পৃথিবীতে আমি আর কাউকে তার চেয়ে এককণাও বেশি ভালবাসি না। তাকে আমি আমার ঘরণী করবার জন্যে প্রস্তাব দিয়েছিলুম। কিন্তু আবেদন নিবেদেন কোনাে ফল হল না। আমার প্রেম প্রবল থেকে প্রবলতর হল তাই আমি স্থির করলুম যে ভাবে পারি তাকে ছিনিয়ে নেব, বীরের ধর্মও তাই। আর এই প্রেমের জন্যেই আমি তােমাদের জাহাজ আক্রমণ করেছি। তােমরা প্যাসিমােনডাসের পরিবর্তে তাকে আমার হাতে তুলে দাও এবং তারপর তােমরা তােমাদের জাহাজ নিয়ে ফিরে যাও, ভগবান তােমাদের মঙ্গল করুন।
রােডেসিয়ার জাহাজের কর্তারা দেখল তারা তাে পরাজয় বরণ করেছেই। লড়াই করা বৃথা, শক্তিঃ কম, বৃথা প্রাণহানি হবে তার চেয়ে চাইমন যা চাইছে তা দিয়ে দেওয়া ভালাে। ইফিজেনিয়া তখন তার ঘরে বসে কাদছিল। কেন কাদছিল তা সেই বলতে পারে। ক্রন্দনরত যুবতীকে তারা চাইমনের হাতে তুলে দিল।
অশ্রুসিক্ত ইফিজেনিয়াকে দেখে চাইমন বলল, সুচরিতা মুখ তােললা, অশ্রু সম্বরণ করাে, দেখ তােমার সামনে তােমারই চাইমন। আমি তােমাকে সেই প্রথম দিন থেকেই ভালবেসে আসছি এবং আজও আমার ভালবাসা একটুও ম্লান তাে হয়নি উপরন্তু উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই ভালবাসার জোরে আমি তােমাকে দাবি করছি। প্যাসিমােনডাসকে তুমি দেখ নি, জান না চেন না। তার অপেক্ষা আমি কি তােমার যােগ্য নই?
ইফিজেনিয়া কোনাে কথা বলল না। তাকে চাইমনের জাহাজে তােলা হল। রােডেসিয়ার জাহাজ ছেড়ে দেওয়া হল।
প্রার্থিত সম্পদটি লাভ করে চাইমন যারপর নাই সুখী। এত সুখী মানুষ তখন পৃথিবীতে বােধহয় দ্বিতীয় কেউ ছিল না। ইফিজেনিয়াকে শান্ত করে চাইমন তার সঙ্গীদের বলল, আমরা এখন সাইপ্রাসে ফিরে যাব না, আমরা আনন্দ করতে করতে ক্রিটদ্বীপে যাব। শুনে অনেকে আনন্দিত হল কারণ ক্রিটদ্বীপে অনেকের ঘরবাড়ি বা আত্মীয় বন্ধু আছে, কারও আবার নতুন বন্ধু-বান্ধবী আছে। চাইমনের আনন্দ তাে সবচেয়ে বেশি কারণ তার সঙ্গে আছে ইফিজেনিয়া, তার অনিন্দ্যসুন্দরী প্রেয়সী।
কিন্তু ভাগ্যদেবী তখন অন্য মতলব আঁটছিলেন। ইফিজেনিয়াকে চাইমনের হাতে তুলে দিয়ে তিনি মনে মনে বললেন, খুব আনন্দ না? এবার তােমাদের মজা দেখাচ্ছি।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কখন রাত্রি হবে অধীর আগ্রহে চাইমন দণ্ড পল গুনছে, তখন সে প্রেয়সীকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করবে কিন্তু আকাশে যে কালাে মেঘ জমছে এবং ক্রমশ ঘন হচ্ছে তা কেউ জানতে পারে নি। তারা উল্লাসে মগ্ন। চমক ভাঙল চোখ ধাঁধানাে বিদ্যুৎ চমকে ও বুক কাঁপানাে বজ্রের শব্দে। সোঁ সোঁ করে ঝড় উঠল, সমুদ্র উত্তাল হল। জাহাজের বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যাকে বলে ? সচিভেদ্য অন্ধকার তাই। জাহাজ সামলানাে ক্রমশ মুশকিল হয়ে উঠছে।
ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে চাইমন বলতে লাগল, তুমি একি করলে ভগবান? আমি চেষ্টা করে আমার প্রার্থিত প্রেয়সীকে লাভ করে যখন তার সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছি আর ঠিক সেই সময়ে তুমি আমাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছ? এই কি তােমার বিচার? চাইমনের বন্ধু ও নাবিকরাও ভয় পেয়েছে, জাহাজ বুঝি বাঁচানাে যাবে না কিন্তু সবচেয়ে ভয় পেয়েছে বেচারী ইফিজেনিয়া। সে কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বুক ভিজিয়ে ফেল্পল। সে ভয় তাে পেয়েছে। মৃত্যু নিকট মনে করে সে ভগবানের কাছে প্রার্থনা না করে চাইমনকে দোষ দিতে লাগল। চাইমন তাকে জোর করে কেন জাহাজ থেকে নামিয়ে আনল। ভগবান কুপিত হয়েছেন। তার ইচ্ছে নয় চাইমনের সঙ্গে তার বিবাহ হোক নইলে তিনি এমন ঝড় তুলে জাহাজ ডুবিয়ে দেবেন কেন? ঝড়ের তীব্রতা যত বাড়ছে ইফিজেনিয়ার বিলাপও তত বাড়ছে আর শাপ-শাপান্ত করছে চাইমনকে।
জাহাজ নাবিকদের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। উত্তাল সমুদ্রে যে কোন দিকে চলে যাচ্ছে সূচিভেদ্য অন্ধকারে তারা তা বুঝতে পারছে না। যাই হােক ঝড় উপেক্ষা করে জাহাজ কোথায় এক জমিতে আটকে গেল। পরে জানা গেল সেটা রােডস দ্বীপ। তারা বােধহয় বেঁচে গেল। জাহাজখানা একটা সরু খাড়িতে ঢুকে পড়েছিল।
রােডস দ্বীপের যে জাহাজখানায় ইফিজেনিয়াকে আনা হচ্ছিল সেই জাহাজখানা রােডস দ্বীপে আগেই পৌছে গেছে; লােকজনও জাহাজ থেকে নেমে গেছে। এ তাে তাদের নিজের দ্বীপ, অন্ধকারেও এদের অসুবিধে হয়নি।
সকাল হতে চাইমনের জাহাজের নাবিকরা বুঝল তারা রােডস দ্বীপে এসে পড়েছে আর যে জাহাজে
ইফিজেনিয়া ছিল সেই জাহাজখানা খুব কাছেই রয়েছে। এত কাছে যে একটা ঢিল ছুঁড়লে ঐ জাহাজে ও পড়বে।
চাইমন বুঝল সামনে বিপদ। ঐ জাহাজের লোেক টের পেলে ছেড়ে দেবে না। চাইমন তখনি তার নাবিকদের বলল যেভাবে পারাে এখান থেকে এখনি বেরিয়ে চলাে, নইলে সকলকে মরতে হবে। তারপর ভাগ্যে যা আছে তা হবে।
কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। নাবিকরা যখন জাহাজখানা আবার ছাড়বার উপক্রম করছে ঠিক সেই সময়ে বিপরীত দিক থেকে প্রবল তুফান এসে ওদের বাধা দিল। এই ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব। তাই তাদের আবার ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিতে হল।
প্রবল ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজখানা ডাঙায় আটকে গেল; বেরােবার কোনাে উপায় রইল না। রোডসের লােকেরাও জাহাজখানা চিনতে পারল। তারা নিকটবর্তী শহরে গিয়ে খবর দিল যে চাইমনের জাহাজ তাদের জাহাজের মতােই ঝড়ের মুখে পড়ে খাড়িতে আটকে গেছে। জাহাজে ইফিজেনিয়াও আছে।
ইতিমধ্যে চাইমন তার লােকজন ও ইফিজেনিয়াকে নিয়ে অতি কষ্টে জাহাজ থেকে নেমে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় কাছে একটা বনের দিকে যাবার চেষ্টা করছে কিন্তু বনে পৌছাবার আগেই চাইমন ও ইফিজেনিয়া সমেত সকলে ধরা পড়ে গেল। তাদের বন্দী করে শহরে নিয়ে যাওয়া হল।
খবর পেয়ে শহর থেকে প্রধান শাসক লাইসিমেকাস এসে সকলকে কারাগারে আটক করলেন। প্যাসিমোনডাসের কানে খবর পৌছাবার সঙ্গে সঙ্গে সে চাইমনের বিরুদ্ধে সংসদে অভিযােগ করলাে এবং কারাগারে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করলাে।
চাইমনের দুর্ভাগ্য। প্রণয়িনীকে উদ্ধার করেও কাছে রাখতে পারল না। তাকে নিয়ে রাত্রে শােবার আগেই ঝড় উঠল। কেবল দু’-একটি চুম্বন বিনিময় করেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। রােডস দ্বীপে কয়েকজন মহিলা ইফিজেনিয়াকে আশ্রয় দিয়েছিল। তারা তাকে যত্নে রেখেছিল এবং আবার যাতে সে স্বাভাবিক হতে পারে, মুখে আবার হাসি ফোটে সেজন্যেও তার যত্নের ত্রুটি করেনি। শীঘ্র তারা বিবাহ হবে এ খবর তারা শুনে আনন্দিত হল।
প্যাসিমোনডাস যদিও তার বাগদত্তাকে ফিরে পেয়েছিল তথাপি সে প্রতিহিংসা নিয়ে বদ্ধপরিকর হয়েছিল। চাইমন ও তার নাবিক বন্ধুদের যাতে মৃত্যুদণ্ড হয় সেজন্যে সে আন্দোলন শুরু করেছিল কিন্তু যেহেতু চাইমন রােডেসিয়ার জাহাজের সকলকে হাতে পেয়েও কাউকে হত্যা তাে করেই নি উপর সকলকে মুক্তি দিয়েছিল এজন্যে শাসক মশাই চাইমন ও তার নাবিকদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে আজিবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলাে। চাইমন ও তার সঙ্গীরা একেবারেই মুষড়ে পড়ল। তারা কি আর কোনাদিন – সুখের মুখ দেখতে পাবে? এই জেলেই তাদের পচে মরতে হবে।
ভাগ্যদেবী যে কখন কার ওপর প্রসন্ন হন, কখন মত পালটান, কখন রাজাকে ভিখারি আর ভিখারিকে রাজা করেন সে খবর কে রাখতে পারে! চাইমনকে তিনিই বন্দী করেছেন। তার প্রেয়সীকে তার বাহুবন্ধু থেকে কেড়ে নিয়েছেন, আবার কি দু’জন মিলন ঘটিয়ে দেবেন? দেখা যাক কি হয়।
প্যাসিমােনডাসও তার বাগদত্তাকে ফিরে পেয়ে উল্লসিত। বিবাহের জন্যে সকল আয়ােজন আরম্ভ করলাে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে তার বধূকে ঘরে আনবে।
প্যাসিমােনভাসের এক ভাই ছিল। উপযুক্ত ভাই, কোনাে অংশে দাদার চেয়ে হীন নয়। তার নাম অরমিসভাস। ঐ শহরেই ক্যাসান্ড্রা নামে এক সম্ভ্রান্ত বংশের একটি সুন্দরী মেয়ে ছিল। সেই মেয়েটিকে অরমিসডাস বিয়ে করবে, কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে কিন্তু কোনাে কারণে সম্ভবত বড় ভায়ের বিয়ের জন্যে তারিখ পেছিয়ে গেছে।
এদিকে আর এক কাণ্ড। ঐ যে প্রধান শাসক লাইসিমেকাস সে ক্যাসান্ড্রাকে গভীরভাবে ভালবাসে এবং তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। বড় ভাই প্যাসিমােনডাস স্থির করলাে দুই ভাই একই তারিখে বিয়ে করবে তাতে খরচ অনেক কম হবে, উৎসব ও ভােজের জন্যে দু’বার খরচ করতে হবে না।
ক্যাসান্ড্রার বাপমায়ের সঙ্গে কথা বলে প্যাসিমােনডাস তার নিজের বিয়ের তারিখেই ছােট ভায়ের বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলল এবং সমস্ত আয়ােজন চূড়ান্ত করে ফেলল।
এই খবর যখন লাইসিমেকাসের কানে উঠল তখন বেচারা খুবই দুঃখ পেল, ক্যাসান্ড্রাকে বিয়ে করার তার আর আশা নেই, সে তার দুঃখ কারও কাছে প্রকাশ করলাে না। যাই হােক ইসিমেকাস বােকা নয়, শাসক এবং বিচারক। সে স্থির করলাে ক্যাসান্ড্রাকে বিয়ে করতে হলে তর কুমারীত্ব হৃত হবার আগেই তাকে অপহরণ করতে হবে।
লাইসিমেকাস যে পদের অধিকারী সেই পদের বলে সে হয়ত অরমিসডাসকে মিথ্যা অজুহাতে বন্দী করে ক্যাসান্ড্রাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসতে পারে কিন্তু সে কাজটা তার পক্ষে সন্মানজনক হবে না। প্রেমের শক্তি অসীম, সে ন্যায় অন্যায়ের বিচার করে না। প্রেম ও যুদ্ধে কিছুই অন্যায় নয়। অনেক চিন্তা করে লাইসিমেকাস স্থির করলাে যেভাবে হােক ক্যাসাভ্রাকে ঘরে তুলতেই হবে।
কি করে কাজ উদ্ধার করবে চিন্তা করতে করতে তার চাইমনের কথা মনে পড়ল। চাইমন ও তার দলবল তাে তার বন্দী। চাইমনকে লাগিয়ে দিতে পারলে এক ঢিলে তিনটে পাখি মারা বে। চাইমন নিজের প্রেমিকা ইফিজেনিয়াকে, লাইসিমেকাসের প্রেমিকা ক্যাসান্ড্রাকে ছিনিয়ে নতে পারবে।
এতএব রাত্রে লাইসিমেকাস চাইমনকে বন্দীশালা থেকে তার খাসকামরায় গােপনে নিয়ে এলাে। তারপর তাকে উত্তেজিত করবার জন্যে বিরাট এক ভূমিকা পেশ করে বলল, তােমার প্রেমিকাকে ও ভাই আর আমার প্রেমিকাকে ছােট ভাই বিয়ে করবার দিন স্থির করে ফেলেছে। এ বিয়ে হতে দেয়া হবে না। তুমি যদি আমার সঙ্গে যােগ দাও তাহলে আমরা ইফিজেনিয়া ও ক্যাসান্ড্রাকে নিয়ে আনতে পারবাে এবং দলবল সমেত তুমিও মুক্তি পেয়ে বৌ নিয়ে দেশে ফিরতে পারবে। আমার প্রস্তাবে তুমি নিশ্চয় রাজি নইলে তােমাকে জেলখানাতেই পচে মরতে হবে।
লাইসেমেকাসের প্রস্তাব শুনে চাইমন সঙ্গে সঙ্গে রাজি। এর চেয়ে উত্তম প্রস্তাব আর কি হতে পারে? আমি রাজি, আমাকে কি করতে হবে বলাে। তুমি আমার সাহস ও কাজ করবার ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে যাবে। আমি তােমার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবাে।
লাইসিমেকাস বলল, আর ঠিক দু’দিন পরে জোড়া বিয়ে। জোড়া কনে গােধূলির সময়ে জোড়া বরের বাড়ি পৌছবে। তুমি তােমার সমস্ত দলবল নিয়ে আর আমি আমার বিশ্বাসী ও সশস্ত্র অনুচরদের নিয়ে প্যাসিমােনসের বাড়ি চড়াও হয়ে দুই কনেকে ছিনিয়ে এনে জাহাজে তুলব। জাহাজ প্রস্তুত রাখা হবে এবং সেখানেও একদল সশস্ত্র পাহারা মােতায়েন রাখা হবে। জাহাজের করেও একদল সাহসী ও সশস্ত্র যােদ্ধা রাখা হবে। কেউ বাধা দিতে এলে তাদের কচুকাটা করা হবে।
পরামর্শ ও কার্যক্রম চূড়ান্ত হবার পর চাইমনকে আবার বন্দীশালায় ফিরিয়ে দেওয়া হল। এই পর ষড়যন্ত্রের কথা কেউ জানল না।।
প্যাসিমােনডাস ও অরমিসডাস তাে কোনাে সন্দেহই করল না, তারা তখন নতুন বৌকে ঘরে সবার চিন্তাতেই ভরপুর।
দুটো দিন তাে দেখতে দেখতে কেটে গেল। বিয়ের দিন সে কি জাকজমক আর সে কি আনন্দোৎসব। এমন বড় একটা দেখা যায় না। জোড়া বিয়ে, তাই আড়ম্বরও প্রচুর। টেবিলের ওপর সুখাদ্যের পাহাড় জমে উঠেছে আর পানীয়ের ফোয়ারা খুলে দেওয়া হয়েছে। রং-বেরঙের পেশ পরে নরনারী যুবক-যুবতী আর তরুণতরুণীর দল ফুলের বাগান বসিয়েছে। সুমধুর সঙ্গীতে আকাশ বাতাস ভরপুর। আনন্দের বন্যা বইছে, হাসির তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে।
দুই কনে যখন বরের বাড়ি প্রবেশ করতে যাবে ঠিক সেই সময়ে একদল যােদ্ধাকে বাইরে রেখে চাইমন আর লাইসিমেকাস বিশ্বস্ত ও দক্ষ অনুচরদের নিয়ে মুক্ত অসি হস্তে ঝাপিয়ে পড়ল এবং একরকম বিনা বাধায় দুই কন্যাকে অপহরণ করে জাহাজে এনে তুলল। প্যাসিমােনডাস, তার ভাই বাধা দেবে কি, তারা হতভম্ব।
চাইমন ও লাইসিমেকাস অনুচরদের ছেড়ে পলায়ন করে নি। তাদের শেষ অনুচর জাহাজে নিরাপদে না পৌছনাে পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করছিল। দু’জনকে একা দেখে প্যাসিমােনডাস সাহস সঞ্চয় করে চাইমনকে আক্রমণ করলাে কিন্তু আঘাত করবার পূর্বেই তার মুণ্ডু তে লুটিয়ে পড়ল। ভাইকে সাহায্য করতে অরমিসডাস ছুটে এসেছিল। তারও মুণ্ড স্কন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভূমি স্পর্শ করলাে। আরও কিছু লােক বাধা দিতে এসেছিল কিন্তু চাইমন, লাইসিমেকাস ও তাদের অনুচরদের তরবারির আঘাতে সকলেই ভূলুণ্ঠিত। সে এক বীভৎস দৃশ্য, নরমুণ্ড, নর অঙ্গ ও রক্তের পিণ্ড। দুই তরুণীকে তাে আগেই জাহাজের নিরাপদ আশ্রয়ে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এখন ওরা প্যাসিমােনডাসের প্রাসাদে ঢুকে মূল্যবান সামগ্রী যা পারলাে লুটপাট করে জাহাজে এনে তুলল।
সবশেষে চাইমন ও লাইসিমেকাস তাদের অনুচরদের নিয়ে জাহাজে উঠল। ইতিমধ্যে শহরবাসীরা অস্ত্রশস্ত্র যােগাড় করে জাহাজ আক্রমণ করতে ছুটে এসেছিল কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছ। জাহাজ কূল ছেড়ে দূরে চলে গেছে।
ওরা দু’জন নিজ নিজ প্রেয়সীদের নিয়ে ক্রিট দ্বীপে পৌছল। তরুণী দু’জন প্রথমে কান্নাকাটি করেছিল কিন্তু পরে নিজ ভাগ্য মেনে নিয়ে শান্ত হয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছিল। ক্রিট পৌছাবার পর ওদের বন্ধু ও আত্মীয়রা সাদর অভ্যর্থনা জানাল। শুভক্ষণ দেখে একদিন ওদের বিবাহও হয়ে গেল।
সাইপ্রাস ও রােডস দ্বীপে কিছু প্রতিবাদ হয়েছিল কিন্তু সময়ে তা থেমে যায়। উপযুক্ত সময় বুঝে চাইমন ও লাইসিমেকাস নববধূকে নিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে যায় এবং বাকি জীবন তারা পরমানন্দে ও সুখেই অতিবাহিত করেছিল।
দ্বিতীয় গল্প
গােস্তঞ্জা শুনতে পেল তার প্রেমিক মারতুচিও গােগিতা মারা গেছে। বেচারী শোকে মুহ্যমান হয়ে একাই একটা নৌকোয় চেপে সমুদ্রে পড়ল। ভাসতে ভাসতে সে পৌছল সুসা-তে। সেখানে পৌঁছে গােস্তাঞ্জা খবর পেল যে, তার প্রেমিক টিউনিসে বেঁচে তো আছেই উপরন্তু দেশের রাজাকে কিছু পরামর্শ দেওয়ায় সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত। গােস্তাঞ্জা প্রেমিক মারতুচিওর সঙ্গে দেখা করলাে। পুনর্মিলন হল এবং তারা বিবাহ করে প্রচুর সম্পদ নিয়ে লিপারিতে ফিরে এলাে।
প্যানফিলাের গল্প শেষ হল। কুইন ও আর সকলে প্যানফিলােকে বাহবা দিল। এবার গল্প বলার দায়িত্ব পরল এমিলিয়ার ওপর। আর সকলের মতাে এমিলিয়াও রাজি এবং দেরি না করে সে বলতে আরম্ভ করলাে :
কুইন এবার ভালাে বিষয় নির্বাচন করে দিয়েছেন। প্রেমের পদ কদাচিৎ কুসুমাস্তীর্ণ হয় কিন্তু যখন বিপদ আপদ ঝড়জঞ্ছা কাটিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা মিলিত হয়ে সুখের জীবন যাপন করে, তাদের বাগানে ফুল ফোটে, পাখি গান গায়, আর প্রেমিকযুগল হাত ধরাধরি করে নৃত্য করে তখন আমাদের ভালাে লাগে। বিপরীতটা হলে আমরাও ব্যথা পাই। এখন দেখা যাক আমার গল্পটা কেমন উতরােয়, তােমাদের ভালাে লাগে কিনা :
তােমরা তাে সকলে জানাে যে সিসিলির কাছে লিপারি নাম ছােট একটা দ্বীপ আছে। সেই
দ্বীপে অত্যন্ত সম্রান্ত পরিবারের অতি সুন্দরী একটি কন্যা বাস করত। তার নামটি ছিল গােস্তাঞ্জা। আর সেই দ্বীপেই বাস করতাে নজরকাড়া চেহারার সুদেহী ও সুদর্শন এক যুবক, যার নাম মারতুচিও গােমিতাে। গােমিতাে নানা কাজে কুশলী ছিল আর তার ব্যবহারটিও ছিল মিষ্টি-মধুর। আর এই দু’জনেই একদা প্রেমে পড়ল। গােস্তঞ্জা বেচারী তাে তার প্রেমিকটিকে ছেড়ে এক দণ্ডও থাকেত পারত না। মারতুচিও তার প্রেমিকাকে কিছু কম ভালবাসত না। তাই মারতুচিও একদিন সাহস সঞ্চয় করে গােস্তাঞ্জার বাবাকে বলল সে তার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।
গােস্তাঞ্জার বাবা কিন্তু তাকে হাঁকিয়ে দিল। বলল, চালচুলােহীন যুবকের হাতে সে তার মেয়েকে দিতে পারে না। স্রেফ ভালবাসায় পেট ভরে খেতে পাওয়া যায় না, ভালাে জামা-কাপড় পরা যায় না, গলায় সােনা দূরের কথা একটা পুঁতির মালাও জোটে না।
বেচারা মারতুচিও! দরিদ্র বলে তাকে বাতিল করা হল। হতাশ হয়ে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে এক জাহাজে চেপে দেশ ত্যাগ করলাে। প্রতিজ্ঞা করলাে যদি কোনাে দিন ধনী হতে পারে তবেই দেশে ফিরবে নচেৎ বিদেশেই জীবন কাটাবে।
জাহাজখানার কর্তা ছিল সে। সে-ই জাহাজখানা পরিচালনা করতাে। জাহাজের মাঝিমাল্লা সকলে তার বাধ্য ছিল, বন্ধুরাও তার পরামর্শ গ্রহণ করতাে। মারতুচিও বােম্বেটেগিরি আরম্ভ হলাে বারবারি কোস্ট বরাবর তার জাহাজের চেয়ে ছােট জাহাজ দেখলে লুটপাট করতাে। কিন্তু একদিনন সারাসেনদের একটা বড় জাহাজের পাল্লায় পড়ে মারতুচিওর সব গেল। জাহাজ ডুবলাে, লোক মরল , তার জাহাজের লুটের মাল ওদের জাহাজে বােঝাই হল। মারতুচিও কোনােরকমে বেঁচে টিউনিস পেীছল। সেখানে পৌছেও কি তার নিস্তার আছে? ভাগ্যবিড়ম্বিত মারতুচিওকে জেলে পোরা হল। কে জানে তার বােম্বেটেগিরির খবর হয়ত টিউনিসে পৌছেছিল। ওদিকে তার জাহাজের যে ক’জন নাবিক ডােবে নি এবং প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছিল তারা প্রচার করলাে মারতুচিও জলে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে।
খবর শুনে গােস্তাঞ্জা বেচারী শােকে বিহ্বল হয়ে পড়ল। একেই তাে মারতুচিও চলে যাওয়ায় সে
মনে মনে খুবই কষ্ট পাচ্ছিল। এখন তার মৃত্যুসংবাদ শুনে সে স্থির করলাে সে আর প্রাণ রাখবে না। মারতুচিও সমুদ্রে মরেছে সে-ও সমুদ্রেই মরবে।।
মারতুচিও যে সত্যিই জলে ডুবে মরেছে এ বিষয়ে গােস্তাঞ্জার মনে হয়ত সন্দেহ জেগে থাকবে অথবা প্রেমিকের মৃত্যসংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাপ দিয়ে মরবার মতাে তার সাহসেরও অভাব হয়ে থাকতে পারে তাই এইরকম অবস্থায় সে একদিন রাত্রের অন্ধকার বেপরােয়া হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। জাহাজঘাটায় এসে দেখল কিছুদূরে একটা মাছ ধরা ছােট নৌকো পড়ে আছে। অবস্থা দেখে মনে হল নৌকোর কেউ মালিক নেই তবে নৌকোটা চালু আছে।
গােস্তাঞ্জা ভাবল এরকম একটা ছােট নৌকোয় চেপে সমুদ্রযাত্রা করলে তার মৃত্যু অবধারিত। সে তাে মরতে চায় তবে এমনও তাে হতে পারে যে সে হয়ত মারতুচিওর দেখা পেয়ে গেল।
ওরা জাহাজঘাটার কাছেই থাকত, তাই ওরা নৌকো চালাতে পারত। এ বিদ্যা তাদের অল্পস্বল্প জানা ছিল। নৌকোটার পাল ও মাস্তুল অটুট ছিল, দাঁড়ও ছিল। নৌকোয় পানীয় জলও ছিল। নৌকোর হাল একবার দেখে নিয়ে গােস্তাঞ্জা নৌকোয় উঠে পড়ল এবং দাঁড় টেনে কিছু দূরে গিয়ে পাল খাটিয়ে দিল।
পালে বাতাস লেগে নৌকো তরতর করে এগিয়ে চলল। গােস্তাঞ্জা মােটেই উদ্বিগ্ন নয়, যেদিকে ইচ্ছে নৌকো ভেসে চলুক। নৌকো ঝড়তুফানে পড়ে ডুবে যাক বা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণবি হয়ে যাক সে গ্রাহ্য করে না। মরবার জন্যে সে প্রস্তুত। তবে এ কথা সে ভাবে নি, জলদস্যুরা তাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে!
যাই হােক আপাদমস্তক আবৃত করে সে নৌকোয় শুয়ে পড়ে মারতুচিওর জন্যে চোখের জল ফেলতে লাগল। কিন্তু তার সব অনুমান বানচাল হল। সমুদ্র একবারও উত্তাল হল না, শান্তই রইল। উত্তুরে বাতাস পাল ছিড়েও ফেলল না, ধীরগতিতে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। ভাসতে ভাসতে পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ তার নৌকো টিউনিস থেকে শ’খানেক মাইল দূরে সুসা নামে একটি শহরের তীরে ভিড়ল।
নৌকো যে তীরভূমি স্পর্শ করে থেমে আছে গােস্তাঞ্জা তা জানতেও পারল না, কারণ সেই যে সে শুয়েছে তারপর আর মাথা তােলে নি। যা হয় হবে এই ভেবে নিজেকে প্রকৃতির হাতে সপে দিয়েছিল।
নৌকোটা যেখানে ভিড়ল সেখানে কাছেই জেলেদের জাল শুকোচ্ছিল। একজন দরিদ্র রমণী সেই জাল তুলতে এসে নৌকোটা দেখতে পেল। সে ভাবল পালতােলা অবস্থায় নৌকোটা পড়ে আছে কেন? মাঝি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
রমণী তখন নৌকোর কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখল নৌকোয় একটি যুবতী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কয়েকবার ডাকাডাকির পর যুবতীর ঘুম ভাঙল। যুবতী উঠে বসলাে। তার পরিচ্ছদ দেখে বােঝা গেল যুবতী খ্রিস্টান। রমণী তখন যুবতীকে প্রশ্ন করলাে সে একটা একা নৌকো করে এখানে কি করে এলাে? প্রশ্ন ইটালিয়ান ভাষায় করলাে।
ইটালিয় ভাষায় প্রশ্ন শুনে গােস্তা ভাবল সে বুঝি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে আবার লিপারিতেই ফিরে এসেছে। হাওয়ায় কখন কি মতিগতি হয় কে বলতে পারে। গােস্তাঞ্জা তখন উঠে চারিদিক চেয়ে দেখল। সে দেখল যে তার নৌকো সমুদ্রের তীরে ডাঙায় আটকে গেছে। তখন সে রমণীকে প্রশ্ন করলাে সে কোথায় এসেছে? রমণী উত্তর দিল, মেয়ে তুমি বারবারি উপকলে সুসা শহরের কাছে এসেছ।
গােস্তাঞ্জা হতাশ হয়ে মনে মনে বলল, হা ভগবান তুমি এ কি করলে? আমার এখনও মৃত্যু হল না? না জানি আমার কপালে এখন কত দুঃখ আছে! নৌকায় বসে পড়ে সে কাদতে লাগল।
তাকে কাঁদতে দেখে সেই সৎ ও দয়ালু রমণী পাশে বসে সান্ত্বনা দিল। তারপর অনেকবার অনুরােধ করে তাকে তার কুটিরে নিয়ে গিয়ে, পরিচর্যা করে, তার ক্লান্তি দূর করে, জিজ্ঞাসা করলাে সে এইভাবে এখানে কি করে এলাে?
কিন্তু গােস্তাজ্ঞা তখনও অবসন্ন এবং ক্ষুধার্ত। বুঝতে পেরে রমণী তাকে শুকনাে রুটি ও কিছু মাছ খেতে দিল। এ ছাড়া তার ঘরে আর কিছু ছিল না। সত্যিই তার ক্ষিধে পেয়েছিল, সেই সঙ্গে তৃষ্ণা। ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর করে গােস্তাজ্ঞা সুস্থ বােধ করলাে। তারপর সে রমণীকে তার পরিচয় এবং ইটালিয়ান ভাষা জানার কারণ জিজ্ঞাসা করলাে।
রমণীটি তার পরিচয়ে বলল যে তার বাড়ি ত্রাপানিতে, তার নাম কারাপ্রেসা, সে খ্রীস্টান এবং একজন ধীবরের চাকরি করে।
গােস্তজ্ঞা নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছিল। ভাবছিল তার কপালে অনেক দুঃখ কষ্ট আছে কিন্তু শ্রেণীর নাম কারাপ্রেসা শুনে সে মনে কিছু সান্ত্বনা পেল কারণ নামটির অর্থ শুভ, যাকে বলে পয়া। নামটির অর্থ অসীম বা মূল্যহীন লাভ, অমূল্য কিছু পাওয়া যেতে পারে। যে ধীবরের অধীনে রমণী চাকরি করে তারাও খ্রীস্টান। (সেই সময়ে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক ভালাে ছিল না)। তার মনে আশার উদয় হল। কি আশা তা সে বলতে পারে না কিন্তু মরবার ইচ্ছে এখন আর প্রবল নয়।
রমণী আবার তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলাে কিন্তু গােস্তাজ্ঞা তার প্রশ্ন এড়িয়ে গেল এবং রমণীকে অনুরােধ করলে তাকে আশ্রয় দিতে। সে যুবতী, নিপীড়িত হবার সম্ভাবনা আছে, রমণী যেন তাকে রক্ষা করে।
রমণী অত্যন্ত দয়ালু। গােস্তাজ্ঞাকে অপেক্ষা করতে বলে সে বালির ওপর থেকে মাছ ধরবার জাল গুটিয়ে ঘরে এনে গােস্ত জ্ঞাকে আপাদমস্তক আবৃত করা যায় এমন একটি পােশাক পরিয়ে তাকে সুসা শহরে নিয়ে চলল। শহরে পৌছে রমণী বলল, গােস্তাজ্ঞা আমি তােমাকে অত্যন্ত দয়াবতী এক সারাসেন মুসলমান রমণীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। তিনি আমাকে মাঝে মাঝে কিছু কাজ দেন। তার বয়স হয়েছে। কোমল হৃদয়। তােমার বিষয় আমি তার কাছে যত দূর সম্ভব ভালাে করেই বলবাে। আমার বিশ্বাস তিনি তোমাকে নিজের মেয়ের মতাে যত্নে রাখবেন এবং তােমাকেও অনুরােধ করবাে যে, তুমি যথাসাধ্য তাকে শ্রদ্ধা করবে ও তার সেবা করবে। তার সহানুভূতি পেলে তােমার ভালাে হবে। ঈশ্বর দয়া হয় তােমার ভাগ্য ফিরে যেতে পারে।
গােহাজ্ঞা মহিলাকে দেখল। দেখে ভক্তি হয়। কারাপ্রেসা কিছু বাড়িয়ে বলে নি। মহিলার মাথার প্রায় সব চুল পেকেছে। তিনি গােস্তাজ্ঞাকে ও তার চােখ দুটি ভালাে করে দেখলেন, তার নয়ন সিক্ত হল। তিনি গােস্তাজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুম্বন করলেন। তারপর তিনি তার হাত ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। এই বাড়িতে মহিলা আরও কয়েকজন মহিলার সঙ্গে বাস করেন। বাড়িতে কোনাে পুরুষ নেই। মহিলারা সিল্ক, তালপাতা ও চামড়া সহযােগে কিছু শিল্পদ্রব্য তৈরী করেন।
গােস্তা একটা আশ্রয় পেল। কয়েকদিনের মধ্যে মহিলারা তাকে কাজ শিখিয়ে দিল। সকলেই দয়ালু ও স্নেহপ্রবণ। তারা তাদের ভাষাও শিখিয়ে দিল।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। লিপারির লােকেরা গােস্তাঞ্জার কোনাে খবর না পেয়ে ধরে নিয়েছেন সে বাড়ি থেকে বিরাগী হয়ে বেরিয়ে গিয়ে কোথাও মরে গেছে। বেঁচে থাকলে নিশ্চই তার খবর পাওয়া যেত। এদিকে মারতুচিরও জন্যে সর্বদা মনে মনে কষ্ট অনুভব করলেও গােস্তাঞ্জা ভালােই আছে। মহিলারা তাকে ভালােও বাসে, যত্নের ত্রুটিও করে না আর গােস্তাজ্ঞা তাদের খুব বাধ্য।
এদিকে এক কাণ্ড হল। টিউনিসের রাজার নাম মুলে আবদাল্লা। কাছেই গ্রানাডা দেশ আছে। সে দেশের যুবক রাজা বড়ই অহংকারী ও পররাজ্যলােভী। সে দাবি করলাে টিউনিস তার রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত। আবদাল্লা সেই রাজ্য অন্যায়ভাবে দখল করে বসে আছে। ঐ রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই মতলব করে গ্রানাডার সেই যুবক রাজা প্রচুর সৈন্যসামন্ত নিয়ে টিউনিসের প্রান্তে এসে পড়ল।
মারতুচিও গােমিতাে তখনও জেলে বন্দী কিন্তু তার রক্ষী ও অন্যান্যদের মারফত কথাটা কানে এলাে যে, গ্রানাডার রাজা টিউনিস রাজ্যের প্রান্তে শিবির ফেলেছে এবং টিউনিস আক্রমণ করতে উদ্যত। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্যে টিউনিস-রাজ যথাসম্ভব তৈরী হচ্ছেন।
মারতুচিও তার রক্ষীকে বলল, আমি যদি রাজামশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারতুম তাহলে যুদ্ধে তিনি কি করে জয়লাভ করতে পারবেন আমি তার পথ বাতলে দিতে পারতুম।
মারতুচিওর কথা রক্ষী তার ওপরওয়ালাকে বলল। ওপরওয়ালা সে কথা রাজামশাইকে বললেন। রাজামশাই অহংকারী নন তিনি বুদ্ধিমান। তিনি ভাবলেন কার মধ্যে কি প্রতিভা লুকিয়ে আছে কে জানে, বন্দী কি বলে একবার শােনাই যাক না। রাজদরবারে মারতুচিওর ডাক পড়ল।
আভূমি নত হয়ে প্রণাম করে মারতুচিও বলল, মহারাজ আমি এই দেশে এক সময়ে কিছুকাল অতিবাহিত করেছিলুম। সারাসেনদের ভাষা ও রীতিনীতি আমি জানি। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে, যুদ্ধের সময় আপনারা তীরন্দাজদের ওপর বেশি নির্ভর করেন। যুদ্ধরত এক পক্ষ অপর পক্ষের নিক্ষিপ্ত তীয় ব্যবহার করে কিন্তু কোনাে পক্ষের তীর যদি ঘাটতি পড়ে যায় তাহলে সে পক্ষ নিশ্চিত পরাজিত হবে।
রাজা বললেন, এক পক্ষের তীর কি করে ঘাটতি পড়বে? আমি তাে বুঝতে পারছি না।
তাহলে শুনুন মহারাজ। আপনি তাে জানেন যে এদেশে যুদ্ধের সময় ধনুকে যে ছিলা ব্যবহার করা ২ সেগুলি সমান পুরু। তীরের তলার খাজ যা ছিলায় লাগানাে হয় তাও সব তীরের সমান। কিন্তু আপনি যদি আপনার ধনুকে সরু ছিলা লাগিয়ে দেন এবং তীরের তলায় খাজ ছিলা অনুযায়ী সরু করা হয় তাহলে সেইসব তীর যা নাকি শত্রুপক্ষে নিক্ষিপ্ত হবে তা তাদের ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত করা যাবে না ; কে তাদের ধনুকের ছিলা তাে মােটা অথচ তাদের তীর আপনি ব্যবহার করতে পারবেন এবং ইভাবে শত্রুপক্ষের তীরের ভাণ্ডার ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকবে। এইভাবেই যুদ্ধে জয়লাভ আপনার পক্ষে সহজ হবে। কিন্তু মহারাজ তীর ও তীরের ছিলা আপনাকে খুব গােপনে করতে হবে। শত্রুপক্ষের চর ঘুণাক্ষরে টের না পায়।
রাজা বুঝলেন ছােকরা বাজে কথা বলেনি, ওর কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি মারতুচিওর পরামর্শ অনুসারে তীর ও ছিলা তৈরি করিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করলেন। যুদ্ধ শেষ তিনি মারতুচিওকে মুক্তি দিয়ে উচ্চপদে নিয়ােগ করলেন। মারতুচিও প্রভূত সম্মান ও অর্থ উপার্জন করলাে।
মারতুচিওর জয়জয়কার পড়ে গেল। সারা দেশ জানাল যে তারই পরামর্শ শুনে রাজা যুদ্ধে জয়লাভ হর গ্রানাডার সৈন্যদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
গােস্তাঞ্জা তাে এতদিন অনেক চেষ্টা করেও মারতুচিওর কোনাে খবর না পেয়ে তাকে মৃত মনে করছিল এবং তাকে সর্বদা মনে রাখলেও তার প্রতি প্রেমের গভীরতা হ্রাস পাচ্ছিল কিন্তু জনৈক মারভুচিও গােমিতাের নাম শুনে তার মনে আশা জাগল। যা শুনছে তাতে তার মনে হচ্ছে এ তারই ভালবাসাের ধন মারতুচিও। যে মহিলার আশ্রয়ে গােস্তাঞ্জা বাস করছিল তার কাছে এতদিন সে তার আসল পরিচয় গােপন ছিল কিন্তু এখন সে তার পরিচয় দিল এবং এখানে কিভাবে এসেছে ও হৃদয়ে কি আশা পােষণ সহ সেব কথা সবিস্তারে বলল।
গােস্তাঞ্জার সঙ্গে মহিলা নিজের কন্যার মতাে ব্যবহার করতেন, তাকে সেই রকমই ভালবাসতেন। এ শুনে তিনি গােস্তাঞ্জাকে নিয়ে টিউনিস গেলেন। সেখানে তার এক আত্মীয়ার বাড়িতে উঠলেন। সেই আত্মীয়া দুজনকে সাদরে গ্রহণ করলেন, তাদের থাকবার সবরকম সুবন্দোবস্ত করে দিলেন।
মহিলা কারাপ্রেসাকেও সঙ্গে এনেছিলেন। কারাপ্রেসাকে মহিলা শহরে পাঠিয়ে এই মারতুচিও গেমিতা সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করে আনতে বললেন। কারাপ্রেসা যেসব খবর সংগ্রহ করে আনল তা শুনে গােস্তাঞ্জার বিশ্বাস হল এ তারই হারানাে মারতুচিও। মহিলাও একমত হলেন। তিনি নিশ্চষ্ট হয়ে বসে রইলেন না। তিনি স্বয়ং গিয়ে মারতুচিওর সঙ্গে দেখা করে তাকে বললেন তােমার এক অতি পরিচিত মানুষ লিপারি থেকে আমার বাসায় এসেছে। সে তােমার সঙ্গে দেখা করতে অত্যন্ত আগ্রহী। তুমি যদি সময় করে আমার সঙ্গে চলাে তাে আমি কৃতজ্ঞ থাকব এবং তােমারও লাভ হবে লােকসানের ভয় নেই।
মহিলা কষ্ট করে তার বাসায় আসার জন্যে মারতুচিও তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তখনি তার সাথে চললেন। তার বাসায় মারতুচিওকে দেখে গােস্তঞ্জা এতদূর অভিভূত হল যে সে বুঝি মারাই যাবে মারতুচিওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে তাকে চুম্বন করতে লাগল। মারতুচিওর তার প্রণয়িনীকে চিনতে বিলম্ব হয়নি। প্রথমে তাে সে কথা বলতেই পারে নি তারপর তার কথা বুঝি আর শেষ হয় চায় না।
সে বলল গােস্তাঞ্জা আমার কি সৌভাগ্য। আমি তাে শুনেছিলুম তুমি লিপারি থেকে কোথায় চলে গেছ। চেষ্টা করেও তােমার কোনাে খবর আমি পাই নি। তবে আমি এখানে অনেকদিন বন্দী ছিলাম এবং শীঘ্র তােমার জন্যে লিপারি যাবার ব্যবস্থা করছিলুম। এমন সময়ে দয়াময় ঈশ্বর আমাদের মিলিয়ে দিলেন।
মারতুচিওর জন্যে সে কি কষ্ট সহ্য করেছে এবং সেখানে কিভাবে এলাে সে সবের বিস্তৃত বিবরণ গােস্তাঞ্জা শশানাল। তারপর কারাপ্রেসা এবং তার আশ্রয়দাত্রী মহিলা তার যে কি যত্ন করে কথা অত্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে বলল।
মরতুচিও মহিলা ও কারাপ্রেসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং গােস্তাজ্ঞার কাছে বিদায় নিয়ে রাজার কাছে ফিরে গিয়ে তার নিজের ও গােস্তাঞ্জার কথা বলল। গােস্তাজার জন্যেই যে সে দেশ ছেড়ে এসে সে কথা বলতে ভুলল না।
রাজা সহানুভূতির সঙ্গে সব শুনলেন। মারতুচিও বলল সে গােস্যাজাকে নিয়ে দেশে ফিরে খ্রিস্টান মতে তাকে বিয়ে করতে চায়। তাকে ছুটি দিতে হবে।
এমন একটি যুবতী যে তার প্রেমিকের জন্যে এত কষ্ট সহ্য করেছে তাকে দেখবার জন্যে রাজা আগ্রহী হয়ে উঠলেন। গােস্তাঞ্জার মুখে সব শুনে রাজা প্রীত হলেন। মারতুচিও একই কথা বলেছে। রাজা সন্তুষ্ট হয়ে মারতুচিওকে বললেন, নিশ্চই, এই মেয়ে তােমাকে বিবাহ করবার অধিকার অর্জন করেছে। তােমার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা ভােগ করেছে। তারপর তিনি প্রেমিযুগলের সম্মানে বিরাট এক প্রীতিভােজের আয়ােজন করলেন ও তারপর তারা যাতে দেশে গিয়ে বিবাহ করতে পারে সেজন্যে ছুটি তাে মঞ্জুর করলেনই উপরন্তু তাদের যাবার জন্যে যৌতুক ও উপঢৌকনসহ একটা জাহাজই সাজিয়ে দিলেন।
জাহাজে ওঠবার আগে মারতুচিও এবং গােস্তাঞ্জা উভয়ে মিলে আশ্রয়দাত্রী মহিলা ও কারাপ্রেসার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাদের উপযুক্ত অনেক উপহার দিয়ে সাশ্রনয়নে বিদায় নিল। মহিলার ও কারাপ্রেসারও চক্ষু শুষ্ক ছিল না। তারাও ওদের কিছু উপহার দিয়ে ঈশ্বরের কাছে ওদের জন্য প্রার্থনা করলাে। শেষ মুহূর্তে গােস্তাঞ্জা কারাপ্রেসাকে জাহাজে তুলে নিল। তাকে ও নিজের কাছে রাখবে। পালে বাতাস লাগার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ ছেড়ে ছিল। লিপারি পৌছে জাহাজ থেকে নামার পর শহরবাসীর মধ্যে সে কি উল্লাস। যাদের তারা মৃত মনে করেছিল তারা আবার ফিরে এসেছে।
মারতুচিওকে তারা বাহবা দিল, ছােকরা কথা রেখেছে, সাবাস! বলেছিল ধনী না হয়ে দেশে ফিরবে না।
তারপর একদিন জাজমকের সঙ্গে ও সাড়ম্বরে তাদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হল। বাকি জীবন তারা অত্যন্ত সুখে কাটিয়েছিল।
তৃতীয় গল্প
অ্যাগনােলেলাকে নিয়ে পিয়েত্রো বােক্কামাজা বাড়ি থেকে পালবার পথে দস্যুদ্বারা আক্রান্ত হয়ে দু’জনে দু’দিকে ছিটকে পড়ল। মেয়ে ঢুকলাে বনের ভেতরে, পরে এক ক্যাসেলে। ছেলেটা দস্যুর কবল থেকে পালাল এবং কিছু বিপদ কাটিয়ে সেই ক্যাসেলে হাজির, যেখানে মেয়ে আশ্রয় পেয়েছে। উভয়ে মিলিত হল, বিয়ে হল ও দু’জনে রােমে ফিরে এলাে।
দলে এমন একজনও রইল না যে এমিলিয়ার গল্প শুনে বলল না যে গল্পটা তাদের খারাপ লেগেছে। এমিলিয়ার পর এলিসাকে কুইন গল্প বলতে বলল। দেখা যাচ্ছে যে গল্প বলতে পারলে মেয়েরা আর কিছু চায় না। এলিসা যেন বর্তে গেল। আরম্ভ করলাে :
গল্পের গােড়াটা শুনে তােমরা হতাশ হােয়াে না। অল্প একটু বিচারবুদ্ধির দোষে এক জোড়া তরুণ তরুণী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। তারপর আশা নিরাশায় ও বিপদে আপদে কিছুদিন কাটিয়ে অভাবিতভাবে আবার মিলিত হয়ে সুখের জীবনে ফিরে এলাে। তাই বুঝি কথায় বলে, কভু যে আশায় কভু নিরাশায় দিল বয়ে যায়।
বেশিদিনের কথা নয়। রােমাঞ্চময় রােম নগরীতে এক যুবক বাস করতাে যার নাম ছিল পিয়ের্তাে বােক্কামাজা। পিয়েত্রো ছিল রােমের নামী বংশের ছেলে কিন্তু প্রেমে পড়েছিল এক অতি সাধারণ ঘরের একটি মেয়ের। মেয়েটি অবশ্যই রূপসী ছিল। তার নাম অ্যাগনােলেলা আর তার বাবার নাম গিগলিওজো সলাে। নামী বংশের মানুষ না হলেও সমাজে তার যথেষ্ট সমাদর ছিল। মেয়েটিও পিয়েত্রোকে খুবই ভালবাসত।
পিয়েত্রো একদিন অ্যাগনােলেলার বাবার কাছে বলল, সে তার কন্যাকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু কথাটা জানাজানি হয়ে গেল। পিয়েত্রোর বাবা ও অন্যান্যরা তাকে তাে যথেষ্ট ভৎসনা করলেই উপরন্তু মেয়ের বাপকেও সাবধান করে দিল যে, তােমার মেয়ে যেন আমাদের ছেলের সঙ্গে মেলামেশা না করে তাহলে তারা তাদের ছেলে পিয়েত্রোকে ত্যাজ্য পুত্র করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে।
পিয়েত্রোর মাথায় বুঝি বাজ পড়ল তবুও সে ভাবল অ্যাগনােলের বাবা যদি তাদের বিয়েতে মত দিত তাহলে সে সবকিছু তুচ্ছ করে তার প্রিয়তমাকে বিয়ে করতাে কিন্তু মেয়ের বাবা ভয় পেয়ে গেছে। কিছুতেই রাজি হল না। মেয়ে অবশ্য রাজি আছে। বিয়ের পর যত দুঃখ কষ্ট আসুক না সে হাসিমুখে বক করবে। পিয়েত্রোও ঠিক করলাে তারা দুজনে রােম থেকে পালাবে তারপর যা হয় হবে।
অ্যাগনােলের সঙ্গে লুকিয়ে পরামর্শ করে সে দিনক্ষণ ঠিক করে রাখল। তারপর নির্দিষ্ট দিনে শেষ রাত্রে সে দুটো ঘােড়া সাজিয়ে নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দেখল অ্যাগনােলেলা অপেক্ষা করছে। পিয়েত্রে তখনি তাকে ঘােড়ায় তুলে নিয়ে যাত্রা করলাে। প্রথমে ভেবেছিল আনুষ্ঠানিক একটা বিয়ে কোথাও সেরে নেবে কিন্তু তার ভয় ছিল তার বাড়ির কেউ যদি টের পেয়ে ওদের অনুসরণ করে ধরে ফেলে তাহলে তাদের আশা ব্যর্থ হবে, মিলনের দরজায় তালা পড়বে। তাই তারা আপাতত ঈশ্বকে সাক্ষী রেখে ‘তােমার হৃদয় আমার হউক আমার হৃদয় তােমার হউক’ বলে পরস্পর ওষ্ঠে চুম্বন করে ঘােড়া ছুটিয়ে দিল।
পিয়েত্রোর দুটো ভয় ছিল। এক তার বাড়ির লােক যদি তাড়া করে আর পথে যদি দস্যুর হাতে পড়ে বাড়ির লােক টের পায়নি তবে অপর বিপদটা সে এড়াতে পারে নি।
রােমের বাইরে পথঘাট পিয়েত্রোর ভালাে চেনা ছিল না তাই মনে ভয়ও আছে। একটা মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছে, হাত পা ঠিক চলছে না তারপর অন্ধকার। আট মাইল পর্যন্ত ঠিক পথে চলল তারপর দুইটা রাস্তার মুখে এসে পড়ল। ডান দিকে রাস্তা ধরবার বদলে ভুল করে বাঁ দিকের রাস্তা ধরলাে।
মাইল দুই যাবার পর ওরা অদূরে একটা ক্যাসেল দেখতে পেল। ক্যাসেলের কাছে ওরা যেতে না যেতে ক্যাসেল থেকে জনা বারাে সৈনিক ওদের দিকে তেড়ে এল। অ্যাগনােলেলা ওদের আগে দেখতে পেয়ে পিয়েত্রোকে ডেকে সতর্ক করে দিয়ে নিজে জোরে ঘােড়া ছুটিয়ে দিল। সামনে ছিল একটা বন। সে সেই বনের দিকে চলল। হাঁটু দিয়ে ঘােড়র পেটে বার বার জোরে আঘাত করতে লাগল। ঘােড়াও বেগে ছুটে গভীর বনে প্রবেশ করলাে।
পিয়েত্রো তার প্রিয়তমার ডাক শুনতে পায়নি, সে তখন এদিক ওদিক চেয়ে দেখছিল। তারপর সে যখন দেখল অ্যাগনােলেলার ঘােড়া জোর ছুটছে, কি কারণ? জানবার আগেই ক্যাসেলের সেই বালােজন সৈন্য এসে তার ওপর চড়াও হল। তাকে ঘােড়া থেকে নামিয়ে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলাে।
পরিচয় শুনে ওরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলাে, ছোঁড়াটা অরসিনিদের বন্ধু অতএব আমাদের শত্রু। ওর ঘােড়া কেড়ে নাও, তারপর ওর জামাকাপড় খুলে নিয়ে ওক গাছের ডালে ঝুলিয়ে দাও। আমাদের শত্রুকে এর চেয়ে ভালাে শিক্ষা আর কি দেওয়া যেতে পারে।
একজন হেসে বলল, শিক্ষা কি বলছ হে, উপহার বলাে। সকলে তখন একমত হয়ে পিয়েত্রোকে উলঙ্গ হতে বলল। পিয়েত্রো প্রেমিক হতে পারে তা বলে সে যোদ্ধা নয় আর খালি হাতে বারােজনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেই বা কি করে? সে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল তবুও মনে মনে একুট সান্তনা অ্যাগনােলেলা পালাতে পেরেছে, এরা তাকে পেলে ছিড়ে খেত।
যাই হােক পিয়েত্রে কি আর করে, ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে জামা কাপড় খুলতে আরম্ভ করলাে আর একই সময়ে কোথা থেকে ডজন দুই সশস্ত্র অশ্বারােহী সৈন্য এসে হাজির। ব্যাপার দেখেই অশ্বারােহীরা মার বলে তলােয়ার খুলে ওদের তাড়া করলাে। তাড়া খেয়ে ওরা আর কিছু করার চেষ্টা না করে য লতি স জীবতি’ নীতি অবলম্বন করে প্রাণপণে ছুটে পালাল।
পিয়েত্রো এই সুযােগে তার জামাকাপড় পড়ে ঘােড়ায় চড়ে সেখানে থেকে পালাল। অ্যাগনােলেলাকে দিকে যেতে দেখেছিল পিয়েত্রো সেইদিকেই ঘােড়া ছােটাল। কিছুদূর যাবার পর দেখল বনের মধ্যে পথ শেষ হয়ে গেছে। কোনাে পথ নেই, ঘােড়ার খুরের কোনাে ই চিণ্হই নেই, কোনাে আওয়াজও শােনা যাচ্ছে না। অ্যাগনােলেলার নাম ধরে সে কতবার ডাকল কোনাে সাড়া পেল না।
বনের মধ্যে অ্যাগনােলেলাকে খুঁজতে খুঁজতে সে নিজেই পথ হারিয়ে গেল। সে নিজের জন্য যত না ভয় পেল তার চেয়ে বেশি ভয় পেল অ্যাগনােলেলার জন্যে। কি খাবে কি পান করবে সে সমস্যা তাে হই উপরন্তু হিংস্র বন্যজন্তুর ভয় আছে। সে জানে একটা ভালুক হয়ত তাকে টিপে ধরে দম বন্ধ করে তাকে মেরে ফেলেছে কিংবা একটা বা একাধিক নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলেছে।
পিয়েত্রে সারাদিন ধরে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ালাে। যখন সে ভাবছে যে সে সােজা একটা হ ধরে যাচ্ছে তখন আসলে সে গভীর অরণ্যের মধ্যে পথ বা গাছ চিনতে না পেরে একই যে বৃত্তাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্রমশ দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন ফুরিয়ে এলাে। অন্ধকার অরণ্যকে আগেই গ্রাস করেছে। বাইরে অন্ধকার নামলে বনের ভেতর কিছুই দেখা যাবে না। যেটুকু দৃস্টি চলছে। তাতে রাতের মতাে আশ্রয় নেবার জন্যে সে বড় একটা ওক গাছ খুঁজে নিল। দের থেকে নেমে ঘােড়াটাকে এক জায়গায় বাঁধল তারপর নিজে সেই গাছের ওপরে উঠল। নিচে থাকা মমাটেই নিরাপদ নয়, বন্যজন্তুর আক্রমণের সম্ভাবনা আছে।
দুশ্চিন্তায় তার ঘুম হল না। সারাদিন পেটেও কিছু পড়ে নি, তৃষ্ণার জলও পাওয়া যায় নি সারাদিন ঘুরে বেড়ানাের ফলে ক্লান্তি, অবসাদ। অ্যাগেননালেলার জন্যে দারুণ দুর্ভাবনা, দুই চোঝে। পাতা এক করতে পারল না।
অ্যাগনােলেলার জন্যে পিয়েত্রোর যে পরিমাণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল সে মেয়ে কিন্তু বিপদে পড়ে নি। বলতে গেলে সে একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিল।
পিয়েত্রোর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অ্যাগনােলেলা দস্যুভয়ে ভীত হয়ে জোরে বনের দিকে ঘােড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল। সে ভেবেছিল পিয়েত্রো তার অনুসরণ করেছে। কিছুক্ষণ পরে তার ভুল ভাঙল, পিয়েত্রোর কোনাে চিহ্নও নেই। সে ততক্ষণে বনের এত গভীরে ঢুকে পড়েছে যে চেষ্ট করেও সে আর বেরােতে পারল না। পিয়েত্রোর মতােই বনের মধ্যে বৃথাই ঘুরতে লাগল।
তারপর যখন অন্ধকার হল তখন সে ভয় পেয়ে গেল। একটাও মানুষের দেখা পেল না। মাঝে মাঝে বন্যজন্তুর ডাক শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষুধা তৃষ্ণাতেও কাতর। দেহমনে দল অবসাদ।
একটা যেন সরু পায়ে চলার পথ দেখা গেল। ঘােড়াও যেন কিসের গন্ধ পেয়ে সেই পথ ধরে চলল। সেই পথ অনুসরণ করে ঘােড়া এসে থামল একটি কুটিরের সামনে। ঘােড়া থেকে নেমে দরজায় ধাক্কা দিতে একজন বৃদ্ধ স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি দরজা খুলে দিল। মাথার চুল দাড়ি গোঁফ সব সাদা কিন্তু বৃদ্ধের চওড়া কাঁধ, চওড়া কজি ও দীর্ঘ দেহ দেখে বােঝা যায় যে বয়স যতই হােক না সে বেশ স্বাস্থ্যবান। পাশে এসে দাঁড়াল এক মহিলা। সম্ভবত তার স্ত্রী, যদিও বয়সের তফাৎ লক্ষণীয়।
অ্যাগনােলেলার মুখ থেকে কিছু শুনে ও তার অবস্থা দেখে বৃদ্ধ স্বভাবতই কিছু প্রশ্ন করলাে উত্তর না দিয়ে অ্যাগনােলেলা জিজ্ঞাসা করলাে : আনাগনি কত দূর?
আনগনি তাে বেশ দূর, বারাে তেরাে মাইল হবে। তাছাড়া এখান থেকে সেখানে যাওয়া সােজা কোনাে পথও নেই।
কাছে কোথাও এমন বাড়ি নেই যেখানে আমি আশ্রয় পেতে পারি?
না, সেরকম বাড়ি নেই আর থাকলেও এই অন্ধকারে কোথাও যাওয়া অসম্ভব। অ্যাগনােলের চোখে তখন জল এসে গেছে। হতাশ হয়ে সে বলল, তাহলে কোথাও যখন যাবার সম্ভাবনা নেই তখন কি আপনি দয়া করে আমাকে আপনার কুটিরে আজ রাতের মতাে আশ্রয় দিতে পারেন? ঈশ্বরের দোহাই!
বৃদ্ধ বলল, তুমি রাত্রে আমাদের সঙ্গে থাকবে এর চেয়ে আনন্দের কিছু হতে পারে না। তুমি বিপদে পড়েছ, তােমাকে আশ্রয় দেওয়া আমাদের অবশ্য কর্তব্য কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে এমন কতকগুলাে পাজি বদমাশ লােক আছে যারা ছােরাছুরি নিয়ে রাত্রে হঠাৎ আমাদের আক্রমণ করে বসে। যা পারে লুটপাট করে নিয়ে যায়, ভাঙচুরও করে কিন্তু মা তােমার জন্যে আমার ভয়, তুমি রূপসী যুবতী। তােমাকে যদি তারা দেখতে পায় তাহলে নিশ্চই ধরে নিয়ে যাবে। তুমি ভেতরে এসে তবে এইরকম যদি কিছু ঘটে তাহলে মা আমাদের দোষ দিয়াে না।
অ্যাগনােলেলা বলল, বাইরে বনে তাে আরও বিপদ, তার চেয়ে আপনাদের আশ্রয়ে থেকে কুঁকি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।’
ঐ স্বামী স্ত্রী তার যত্নের ত্রুটি করলাে না। গরম জল করে দিল। হাত পা গা গরম জলে মুছে পােশাক পালটে অ্যাগনােলেলা সুস্থ বােধ করলাে তারপর যা ছিল তাই তাদের সঙ্গে খেয়ে ক্লান্তি দূর করলাে। সে বার বার বৃদ্ধ দম্পতিকে ধন্যবাদ দিতে লাগল। ঐ দম্পতি তার জন্যে শােবার ব্যবস্থা করে দিল। দুশ্চিন্তা না থাকলে অ্যানগনালেলা বিছানায় শােওয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ত কিন্তু সেও পিয়েত্রার মতাে দুশ্চিন্তায় চোখের দু’পাতা এক করতে পারল না। সেও ভাবছে। পিয়েত্রো হয়ত বন্যজন্তু বা দস্যুর কবলে পড়েছে।
ভাের হবার কিছু আগে কয়েকটা ঘােড়ার খুরের আওয়াজ পেয়ে অ্যাগনােলাে প্রথমে উঠে বসল। সে আশংকা করলাে বােধহয় লুটেরার দল আসছে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পিছনে চলে গেল। এটা ওদের গােলাবাড়ি। এক জায়গায় দেখল অনেক শুকনাে ঘাস ও খড় উঁচু করে জমা করে রাখা রয়েছে। সে সেই শুকনাে ঘাস-খড়ের স্কুপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল।
অ্যাগনােলেলা বাইরে গােলমাল ও দরজায় করাঘাত শুনতে পেল। বৃদ্ধকে বাধ্য হয়ে দরজা খুলে দিতেই হল। ঘােড়াটা দেখতে পেয়ে ওরা জিজ্ঞাসা করলাে, কার ঘােড়া? এখনও সাজ পরানাে রয়েছে কেন?
বৃদ্ধকে স্বীকার করতেই হল এটি একটি যুবতীর ঘােড়া। সেই যুবতী কাল রাত্রে ওদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। সে গেল কোথায়? তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
ওরা লুটপাট ও ভাঙচুর আরম্ভ করলাে। বাইরেও গেল। খড়ের স্তুপে একজন তার বর্শা গুজে রাখল। বর্শাটা আর একটু হলেই অ্যাগনােলেলার পায়ে বিধত। ভাগ্যিস তখনও অন্ধকার ছিল আর অ্যাগনােলেলাও নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপ করে পড়েছিল।
মেয়েটাকে পাওয়া গেলে ফুর্তি করা যেত কিন্তু যখন পাওয়া গেল না তখন ওরা খাসি কেটে মাংস রান্না করে রুটি ও সুরা সহযােগে খেল। তারপর পা পারলাে লুটপাট করে অ্যাগনােলেলার ঘােড়াটা নিয়ে চলে গেল।
ওরা চলে যাবার পর বাড়ির কর্তা গিন্নিকে জিজ্ঞাসা করলাে, আচ্ছা মেয়েটি গেল কোথায়? ঘরের ভেতরেও কোথাও লুকিয়ে নেই। ডাকাতরা তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। যাই হােক তাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ডাকাতের দল চলে গেছে বুঝতে পেরে অ্যাগনােলেলা খড়ের স্তুপ থেকে বেরিয়ে এলাে। তাকে দেখে বৃদ্ধ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
সকাল হতেই বৃদ্ধ বলল, এখন তাে সকাল হল। তুমি যদি বলাে তাে আমরা তােমাকে মাইল পাঁচ দূরে একটা ক্যাসেল পৌছে দিতে পারি। সেখানে তুমি নিরাপদ আশ্রয় পাবে। তােমাকে কিন্তু হেঁট যেতে হবে কারণ বদমাশগুলাে যাবার সময়, তােমার ঘােড়াটা নিয়ে গেছে।
অ্যাগনােলেলা বলল কি আর করা যাবে, ঘােড়া যখন নেই তখন হেঁটে যেতেই হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। সূর্য মাথার ওপর ওঠার আগেই ওরা সেই ক্যাসেলে পৌছে গেল।
অরসিনি পরিবারের জনৈক লিয়েলাে ডি কামপাে ডি ফিয়াের এই ক্যাসেলেব মালিক। তাঁর পত্নী অতিশয় সহৃদয়, ভক্তিমতী ও সুগৃহিনী। মহিলা এই সময়ে ক্যাসেলেই ছিলেন। ত্যাগনােলেলাকে দেখে মহিলা চিনতে পারলেন এবং সঙ্গে তাকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সে এখানে কি করে এলাে? কি হয়েছে? অ্যাগনােলেলা কিছুই না লুকিয়ে সবিস্তারে সবই বলল।
মহিলা পিয়েত্রোকে চিনতেন। পিয়েত্রে তার স্বামীর বন্ধু তবে পিয়েত্রো যেখানে ধরা পড়েছে সেখানে থেকে সে যে বেঁচে পালাতে পেয়েছে এ বিষয়ে তঁাব সন্দেহ আছে। তিনি অত্যন্ত ব্যথা পেলেন। মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি আপাতত তাকে কাছে রাখলেন। অ্যাগনােলেলাকে তিনি বললেন, দেখা যাযক চেষ্টা করে পিয়েত্রোর কোনাে খবর পাওয়া যায় কিনা। পেলে ভালােই নচেৎ উপযুক্ত সময় হলেই তনি অ্যাগনােলেলাকে রােমে পাঠিয়ে দেবেন। অ্যাগনােলেলা বাজি হয়ে মহিলার কাছে থেকে গেল। বুদ্ধকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বিদায় নিল।
পিয়েত্রো গাছের ডালে বসে নবকণ’ ভােগ করতে করতে এক সময়ে সভয়ে লক্ষ্য করলো এক পাল নেকেড়ে তার গাছের দিকে এগিয়ে আসছে। অন্ধকারে তাদের চোখ জ্বলছে। নেকড়ের পাল ঘােড়াকে দেখতে পেয়ে তাদের জিভ লকলক করে উঠল। ঘােড়াও তাদের দেখতে পেয়ে ভয় পেয়েছিল। সে তার সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে দড়ি ছিড়ে পালাল। শিকার পালাচ্ছে দেখতে পেয়ে নেকড়ের পাল তাকে ঘিরে ধরলাে। ঘােড়া তার পা ছুঁড়ে খুরের আঘাতে তাদের বাধা দেবার চেষ্টা করলাে কিন্তু পারল না। নেকড়ের পাল তাকে মাটিতে ফেলে দিল তারপর তার গলা কেটে রক্ত পান করতে লাগল। কেউ কেউ বাবা মেরে তার শরীর থেকে তাল তাল মাংস তুলে খেতে আরম্ভ করলাে। নেকড়ের পাল তাকে ছেড়ে যখন চলে গেল তখন শুধু কংকালটাই পড়ে রইল। প্রিয় সঙ্গীর এমন শােচনীয় মৃত্যুতে পিয়েত্রোর চোখে জল এসে গেল। তাছাড়া সে এখন ঘােডার অভাবে বন থেকে বেরােবে কি করে?
রাত্রি এগিয়ে চলেছে। গাছের ওপর বসে থাকতে পিয়ােত্রার খুবই কষ্ট হচ্ছে তার ওপর ভীষণ শীত পড়েছে। সে ঠকঠক করে কাঁপছে। হাত পা অবশ ও অসাড়। বসে থাকতে রীতিমতাে কষ্ট হচ্ছে। এমন সময়ে তার মনে হল গাছের ফাক দিয়ে সে যেন আলাে দেখতে পেল।
ঠিকই দেখেছে। আলাে নয়, একদল মেষপালক হাত পা গরম করবার জন্যে আগুন জ্বালিয়েছে। পুব আকাশ ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত পিয়ােত্রা গাছ থেকে নামল না। যখন সে আগুন দেখতে পেয়েছিল তারপর সকাল হতে দেরিও ছিল না।
গাছ থেকে নেমে সে সেই আগুনের কাছে গিয়ে দেখল একমাল মেষপালক আগুন ঘিরে বসে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা তামাসা করছে। বিপর্যস্ত একটা মানুষকে দেখে তারা পিয়েত্রোকে আগুনের ধারে বসিয়ে হাত পা সেঁকে দিয়ে কিছু খেতে দিল। তাদের সঙ্গে রুটি, মধু ও ভাজা মাংস ছিল। আহা! যেন অমৃত। প্রচণ্ড ক্ষুধা নিবৃত্ত করে ও হাত পা গরম করে মেষপালকের দয়ায় পিয়েত্রো যেন নতুন জীবন ফিরে পেল।
এবার তাকে প্রশ্নর পালা, সে একা এই বনে কি করছে? রাত্রিটাই বা সে বনে কি করছিল? তার মতলব কি?
পিয়েত্রো তাদের দুঃখের কাহিনী বলে জিজ্ঞাসা করলাে কাছে কোনাে গ্রাম বা শহর আছে কিনা।
তারা বলল, গ্রাম বা শহর কাছে কোনােটাই নেই তবে অরসিনি পরিবারের লিয়েলাে ডি কামপাে ডি ফিয়াের-এর ক্যাসেল এখান থেকে মাইল তিন দূরে। তার স্ত্রী বর্তমানে সেই ক্যাসেলে বাস করছেন।
অরসিনি পরিবারের ক্যাসেল ? লিয়েলাের বউ এখানে আছে? শুনেই তাে পিয়েত্রা আহ্লাদে নেচে উঠল কিন্তু তখনি প্রেয়সীর কথা মনে হতেই বেচারা মুষড়ে পড়ল। সে তাে শীঘ্রই একটা আশ্রয় পেতে চলেছে কিন্তু এই গভীর শ্বাপদসংকুল অরণ্যে সে কি এখনও বেঁচে আছে? তারও হয়ত তার ঘােড়ার মতাে অবস্থা হয়েছে।
পিয়েতােরা মেষপালকদের অনুরােধ করলে তাকে কেউ সেই ক্যাসেলে পৌছে দিতে পারবে কিনা। দু’জনে তার সঙ্গী হতে রাজী হল।
ক্যাসেলে পৌছে সে দেখল সেখানে তার কয়েকজন পরিচিত ব্যক্তি রয়েছে। সে তাদের নিজের ও অ্যাগনােলেলার কাহিনী বলে দু’চারজনকে অনুরােধ করলাে তার সঙ্গে বনে গিয়ে মেয়েটির খােজ করতে।
তারা যখন বেরােবার উপক্রম করছে সেই সময় একজন এসে পিয়েত্রোকে বলল, ম্যাডাম লিয়েলাে তাকে ডাকছেন। পিয়েত্রো তখনি ম্যাডামের কাছে গিয়ে সুসংবাদটি শুনল, অ্যাগনােলে ইষ্ট হয় রয়েছে। খবরে শুনে পিয়েত্রোর মনে হল তার চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
অ্যাগনােলেও খবর পেয়ে তখন সেখানে পৌঁছেছে। তাকে দেখে পিয়েত্রোর ইচ্ছে ঙ্গ তাতে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে, কিন্তু মহিলার উপস্থিতিতে ব্যাপারটা শােভন হবে না তাই বিz , অ্যাগনােলেলারও একই ইচ্ছা হয়েছিল কিন্তু তারও ঐ একই সমস্যা।
ম্যাডাম লিয়েলো অ্যাগনােলেলার কাহিনী তাে আগেই শুনেছিলেন এখন পিয়েরে কাহিনী শুনলেন কিন্তু গুরুজনদের আদেশ উপেক্ষা করে গৃহত্যাগ করার জন্যে ভৎসনা করলেন। দুজনের যে অনুতপ্ত তা মনে হল না। তাই মহিলা ভাবলেন, আমি কেন ওদের বাধাস্বরূপ হবো? ওরা পরস্পরকে গভীরভাবে ভালবাসে তাছাড়া ঈশ্বর ওদের সহায় নচেৎ পিয়েত্রোকে তো ওক গাছের তালে তাদের হতাে আর অ্যাগনােলেলা হয়ত দস্যুদের বর্শার আঘাতে খড়ের স্তুপের মধ্যে মারা যেত এবং দূরে বন্যপশুর কবলে পড়তে পারত। ঈশ্বর তাদের রক্ষা করে আসছেন।
মহিলা তখন তাদের বললেন, তােমরা যদি হৃদয় বিনিময় করে থাক এবং পতি-পত্নী হয়েছে হয়ে থাক, তাহলে তােমাদের জন্য আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা তাে রইলই উপরন্তু আমি এতে তােমাদের বিবাহের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, বিবাহের সব ব্যয় আমাদের। বিবাহের পর আমি নিজে তােমাদের বাপ মায়ের কাছে রােমে নিয়ে যাব এবং তােমরা নিশ্চিন্ত থাক যে, আমি তাদের বিয়ে শান্ত করতে পারবাে। তারা তােমাদের স্বীকার করে নেবেন ও সাদরে ঘরে তুলে নেবেন।
মহিলা অগ্রণী হয়ে, দু’জনের বিবাহ দিলেন। সেই ক্যাসেলে যতদূর আড়ম্বর করা সম্ভব তিনি তার কোনাে ত্রুটি রাখলেন না।
তারপর একদিন মহিলা নবদম্পতিকে সঙ্গে নিয়ে রােমে চললেন। সঙ্গে একদল সশস্ত্র সংহে চলল। পথে অনেক বিপদ। রােমে পৌছে মহিলা শুনলেন পিয়েত্রো যা করেছে তার জন্যে তও গুরুজনরা বিরক্ত হয়ে আছেন। কিন্তু মহিলা তাদের এমনভাবে বােঝালেন যে তারা আর কোনাে আপতি করতে পারলেন না। সব মিটমাট হয়ে গেল। পিয়েত্রোর গুরুজনরাও দেখলেন যে তাদের সন্তান উপযুক্ত বধুই নির্বাচন করেছে। সংসারে নতুন বধূর কল্যাণে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি আবার ফিরে এলাে।
চতুর্থ গল্প
লিজিও দ্যা ভালবােনা হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তাঁর অবিবাহিত কন্যা রিচিয়ারডো মানারডির সঙ্গে আলিঙ্গনাবস্থায় শুয়ে আছে। পরে দু’জনে বিবাহ হল। পিতার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপিত হল।
এলিসা ভালাে গল্পই বলেছে। সে নীরব থাকলেও সকলে তার তারিফ করলাে। এবার কুইন ফিলােস্ট্রাটোকে গল্প বলতে বললেন। ফিলোেস্ট্রাটো হাসতে হাসতে বলল, তােমাদের কতকগুলি নিস্ঠুর কাহিনী শােনাতে বাধ্য করেছিলুম, সেজন্যে তােমরা আমার ওপর বিরক্ত হয়ে আছ মনে হচ্ছে। যাই হােক আমি এখন ক্ষতিপূরণ বাবদ একটা মজার গল্প শােনাবার চেষ্টা করবাে। গল্পটা তােমাদের আনন্দ দেৱে। মাঝে কিছু ভয় ও উৎকণ্ঠা থাকলেও পরিণতি কিন্তু সুখের। তাহলে আরম্ভ করা যাক, কি বলে?
বেশিদিনের কথা নয়। রােমানা শহরে সদগুণসম্পন্ন ধার্মিক একজন বিশিষ্ট ভদ্রমহােদয় বাস করতেন। তার নাম ছিল লিজিও দ্য ভালবােনা। তার কোনাে সন্তান ছিল না, তিনি প্রায় বৃদ্ধত্বের পর্যায়ে পাঁছেছিলেন এবং যখন একটি সন্তানের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ে তার পত্নী ম্যাডােনা জিয়াকোমিনা তাকে একটি কন্যা সন্তান উপহার দিলেন। বৃদ্ধ বয়সে সন্তান খুবই আদরের হয় তাই মেয়েটিকে তারা খুব বেশি ভালবাসতেন, খুবই যত্ন করতেন আর তার সকল আবদার হাসিমুখে সহ্য করতেন এতএব অবারিত প্রশ্রয় পেয়ে মেয়েটি আদুরে হয়েছিল। মেয়েটির নাম রাখা হল ক্যাটেরিনা।
বড় হওয়ার সঙ্গে কিন্তু তার রূপের ছটায় ঘর আলাে হল এবং সারা শহরে তার তুল্য সুন্দরী মেয়ে আর একটিও ছিল না। মেয়েটি তার বাপ মায়ের নয়নের মণি। তাকে তারা চোখের আড়াল করতে সাহস করতেন না। তারা চাইতেন না যে মেয়ে অবাঞ্ছিত কোনাে ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করুক কারণ তাদের একান্ত ইচ্ছা যে মেয়েকে উচ্চ বংশের কোনাে ছেলের হাতে সমর্পণ করবেন।
রিচিয়ারডাে দ্য মানারডি দ্য ব্ৰেতিনরাে নামে সুদর্শন ও সপ্রতিভ এক যুবক তাদের বাড়িতে আসত। কর্তা লিজিও এবং গৃহিণী ম্যাডােনার সঙ্গে রিচিয়ারডাে গল্পগুজব করতাে। যুবকটিকে তারা সন্তানতুল্য ভালবাসতেন, তাই তার ওপর তারা বিশেষ কোনাে নজর রাখার প্রয়ােজন মনে করেন নি।
এই বাড়িতে যাওয়া আসার ফলে রিচিয়ারডাে ক্যাটেরিনাকে দেখত এবং তার রূপের প্রতি আকৃষ্ট হতাে। এ তাে স্বাভাবিক ব্যাপার। ক্যাটেরিনা শুধু রূপসী ছিল না। তার নানা সদগুণ ছিল। তার লাবণ্য ও কমনীয়তা, স্নিগ্ধ দৃষ্টি ও মনভােলানাে হাসির তাে কোনাে তুলনাই ছিল না। রিচিয়ারডাে যে এমন প্রেমে পড়বে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
রিচিয়ারডডা তার প্রেম গােপন রেখেছিল কিন্তু ক্যাটেরিনার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে নি। বিচিয়ারডােও নানা সদগুণে ভূষিত সুদর্শন ও উপযুক্ত যুবক। ক্যাটেরিনাও তাকে ভালবেসে ফেলল। একদিন দু’জনের শুভদৃষ্টি হয়ে গেল। ওদের চোখের ভাষা বলে দিল, আমি তােমাকে ভালবাসি। এ ক্ষেত্রে পুরুষকেই অগ্রণী হতে হয় কিন্তু রিচিয়ারডাের সাহস থাকলেও মুখচোরা ছিল।
একদিন একটা সুযােগ জুটে গেল। রিচিয়ারডাে সাহস করে ক্যাটেরিনাকে বলেই ফেলল, ক্যাটেরিনা আমি তােমাকে মিনতি করে বলছি যে, তােমাকে ভালবাসার জন্যে আমাকে যেন মরতে না হয়।
ক্যাটেরিনাপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলল, কি বলছ তুমি? তােমাকে ভালবাসার জন্যে আমাকে যেন না আগে মরতে হয়।
রিচিয়ারডাে আশা করেনি এমন উত্তর সে শুনবে। সে অভিভূত। হাতে যেন স্বর্গ পেল। ক্যাটেরিনাকে বলল, তােমাকে আমার অদেয় কিছু নেই তবে আমরা যাতে সকলের অজানতে কথা বলতে পারি সে ব্যবস্থা তােমাকে করতে হবে।
ক্যাটেরিনা হেসে বলল, শুধুই কথা আর কিছু নয়? যাক, তুমি শােননা, আমার ওপর সর্বদা নজর রাখা হয়, কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। বাবা মা তােমাকে পছন্দ করলেও করলেও তােমার সঙ্গেও ওদের সামনে কথা বলতে পারি না। তুমিই একটা উপায় বার করাে না? তবে দেখতে হবে আমরা যেন ধরা পড়ে না যাই। দুজনে অনেক আলােচনা করলাে কিন্তু কোনােটাই মনঃপূত হয় না। অবশেষে রিচিয়ারডাের মাথায় একটা বুদ্ধি এলাে। সে বলল, আচ্ছা প্রিয়তমা তােমাদের বাগানের দিকে একটা ভােলা করলে আছে না? রাত্রে তুমি যদি সেই বারান্দায় আসতে পারাে চাই কি যদি বারান্দায় ঘুমােতে পার তাে তার চেয়ে ভালাে আর কিছু হয় না। রাতের অন্ধকারে আমি বারান্দায় উঠে যাব।
বিচিয়ারডাে তুমি যদি সাহস করে বারান্দায় উঠতে পারাে তাে আমি নিশ্চই ঘরে না শুয়ে ছলছুতে। করে বারান্দাতে শােব।
ক্যাটেরিনা ডার্লিং তােমার জন্যে আমি কি না করতে পারি? বারান্দায় ওঠা তাে কিছুই নয়, তুমি। বললে বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিতে পারি।
ক্যাটেরিনা বলল, থাক ঢের হয়েছে।
সেদিন তারা একটিমাত্র চুম্বন করে কথা পাকা করে নিল। সেদিন আর একটু দেরি হলেই ওরা ধর পড়ে যেত।
তখন মে মাস শেষ হয়ে আসছে।
রিচিয়ারডাের সঙ্গে যেদিন ক্যাটরিনার কথা হল তার পরদিন সকালে ক্যাটেরিনা তার মাকে বলে, ঘরে কি গরম, কাল সারারাত্রি আমি ঘুমােতে পারি নি।
তার মা বলল, কি বলছিস মা? গরম কোথায়? আমার তাে ঘুমের কোনাে অসুবিধে হয়নি।
ক্যাটেরিনা চুমকুড়ি কেটে বলল, তুমি কি যে বললাে মা, তােমার বয়স আর আমার বয়স এক হল? আমার বয়স কি তােমার কোনােদিন ছিল না? তুমি জান যে আমাদের বয়সে শরীর গরম হয়?
তাের কথা বুঝলুম কিন্তু আমি কি করতে পারি? আমি তাে ইচ্ছেমতাে ঘর গরম বা ঠাণ্ডা করতে পারি না। আবহাওয়া যেমন তােমাকে তেমন সহ্য করতে হবে। আজ রাত্তিরে ঠাণ্ডা হতে পারে তাে, তােমার ভালাে ঘুমও হতে পারে।
ক্যাটেরিনা ঠোট উলটে বলল, তােমার কথা যেন সত্যি হয় কিন্তু মা এখন গ্রীষ্মকাল এগিয়ে আসছে, রাত্রে তুমি ঠাণ্ডা আশা করতে পারাে না।
মা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, তাহলে আমি কি করতে পারি বললা! যেমন ঋতু হবে তেমন সহ্য করতে হবে।
ক্যাটেরিনা বলল, তােমাকে বিরক্ত হতে হবে না মা মণি। একটা কাজ করা যায়। বাবা আর তুমি যদি রাজি হও, তাহলে বাবার ঘরের সামনে বাগানের ধারে বারান্দায় আমি একটা খাট নিয়ে গিয়ে বিছানা পেতে রাত্রে ঘুমােতে পারি। সারারাত কেমন হাওয়া বয়, নাইটিঙ্গেল ঘুমপাড়ানি শিস দেয়, বেশ ভালাে ঘুম হবে।
তা বটে, আমার ঘর গরম হলেও বারান্দা ঠাণ্ডা। বেশ তােমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করি, দেখি তিনি কি বলেন? মা বলল।
বাবা লিজিওর এখন বয়স হয়েছে। বয়সের ধর্ম যাবে কোথায়? আজকাল চট করে চটে ওঠে। মেয়ের প্রস্তাব শুনে প্রথমে রেগে গিয়েছিলেন, এ সব আবার কি? তােমার মেয়ে কি কবিতা লিখছে নাকি? মলয় বাতাস আর পাখির গান তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, পাতার মর্মর ধ্বনি শুনবে, ভােরে পাখি গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, প্রজাপতি উড়ে এসে হালকা ডানা বুলিয়ে দেবে। আমাদের কি ঘরের ভেতর ঘুম হয় না?
বাবার কথা শুনে বােঝা গেল তার মত নেই। আদুরে মেয়ে তার জেদী। সেদিন রাত্রে নিজে ঘুমলাে – মাকেও ঘুমােতে দিল না। মাকে ডাকে, উসখুস করে বলে বাতাস করাে।
পরদিন সকালে মা বাবাকে বলল, কাল সারারাত মেয়ে নিজে তাে ঘুমােয়নি, আমাকেও ঘুমােতে যে নি। তুমিও বাপু আচ্ছা মানুষ, ও ঘরেই ঘুমােক আর বারান্দাতেই ঘুমােক আমাদের তাতে কি? ” এই বয়সের মেয়েদের গরম একটু বেশি, পাখির গান, বাতাস, এসব ভালাে লাগে। আমাদের তাে ওই একটাই মেয়ে, ওর বালিশের তলায় না হয় একটা ক্রুশ রেখে দেব।
বাবা বললেন, বেশ বাবা বেশ, তােমার দুলালী মেয়ে যা ভালাে বুঝবে করবে। তবে একটা মশারি ঙিয়ে দিয়ে। আর কিছু না হােক তােমাকে তাে বিরক্ত করবে না তােমার ঘুম হবে। তবে আমি ভাবছি। ত্রে মেয়ে না আবার ভয় পেয়ে চিৎকার করে।
মায়ের মুখে যখন ক্যাটেরিনা শুনল বাবা রাজি, তখন তাে সে মাকে ধরে একটা ঘুরপাক খেয়ে “লে চুমাে খেল। তারপর নিজেই লােক ডেকে একটা খাট বারান্দায় নিয়ে গেল তারপর সন্ধ্যাবেলায় বিছানা করে রাখল।
রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে বারান্দায় গিয়ে শােবার পর মা মশারি টাঙিয়ে দিল। মেয়ে এমন ভান পরে ঘুমে তার চোখে জড়িয়ে আসছে। মা চলে গেল। বাবাও নিজের ঘরে বিছানায় শােবার আগে বারান্দার দিকের দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ওদিকে বাগানে পাচিলের ধারে বিচিয়ারডাে এসে গেছে। ক্যাটেরিনার সংকেত পেলেই চলে
আসবে। সে খালি অপেক্ষা করছে তার বাবা কখন ঘুমােবে। সে জানে বাবা বিছানায় শোবার একটু পরেই নাসিকা-গর্জন আরম্ভ করেন। কিছুক্ষণ পরে নাসিকা-গর্জন শুনে সে দরজায় দু’বার টোকা মারল। কোনাে সাড়া নেই। নিশ্চিন্ত, রাস্তা পরিষ্কার। মা-ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
ক্যাটরিনার সংকেত পেয়ে রিচিয়ারডাে পাচিল ডিঙিয়ে বাগানে ঢুকলাে তারপর বাগান পেরিয়ে পাথরের খাজ বা গাছের ডাল ধরে অতি কষ্টে বারান্দায় উঠল। পড়ে যাবার বিপদ ছিল কিন্তু গায়ে শক্তি থাকায় সে নিরাপদেই উঠে পড়ল।
ক্যাটেরিনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল। ঐ দাঁড়ানােটাই ছিল সংকেত বিচিয়ারডাে বারান্দায় উঠেই প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে হাত রেখে চুম্বন করতে লাগল। স্তনে প্রথম পুরুষ হস্তের স্পর্শ, ওষ্ঠে প্রথম গভীর চুম্বন, ক্যাটরিনা শিহরিত ও বিগলিত। কখন যে তার বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়ে দেহের সমস্ত বস্ত্র উন্মােচন করে পারিপার্শ্বিক সব ভুলে রতিক্রিয়ায় মগ্ন হয়েছে তা বুঝি তারা বুঝতেও পারি নি। সেদিন কতবার যে তারা যুক্ত ও বিযুক্ত হল তাব্য সে হিসেব রাখেনি। তারপর দুই রতিক্লান্ত দেহ যে কখন গভীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে পড়েছে তাও তারা জানেনা।
দু’জনে আলিঙ্গনাবদ্ধ ও সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে। বিচিয়ারডাের এক হাত ক্যাটেরিনার একটি স্তন চেপে ধরে আছে আর ক্যাটরিনার এক হাত বিচিয়ারডাের কণ্ঠে আর অপর হাত পুরুষাঙ্গটি ধরে আছে। গভীর নিদ্রায় দু’জনে অচেতন। পুব আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। সূর্য উঠতে আর দেরি নেই। মেয়েরা তােমরা আমাকে মাপ করাে। দেখছি লজ্জায় তােমাদের গাল রক্তিম হয়েছে কিন্তু যা ঘটেছে তাই বললুম।
বাড়ির কর্তা লিজিওর ঘুম ভাঙল। মেয়েটা বারান্দায় ঘুমােচ্ছে। তাকে এবার তুলে দেওয়া দরকার। ইচ্ছে করলে ঘরে এসে আবার ঘুমােত পারে। তাছাড়া জিজ্ঞাসা করতে হবে নাইটিঙ্গেল তাকে কেমন ঘুম পাড়িয়েছে।
ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় পা দিয়ে মশারি ফেলা বিছানা দেখতে পেলেন। মশারির ভেতরে মনে হল যেন দু’জন শুয়ে রয়েছে। কি রকম হল ?
তিনি মশারিটা সম্পূর্ণ তুলে ফেললেন। যা দেখলেন তা দেখে তিনি স্তম্ভিত। যা দেখছেন তা কি সত্যিই দেখছেন? তাঁর বয়স হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনও চোখ খারাপ হয়নি। আর স্বপ্নও দেখছেন না। তিনি দেখলেন তার কন্যা ও রিচিয়ারডাে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে শুয়ে রেখেছে। দুজনেই সম্পূর্ণ নগ্ন, দেহে সুতােটি পর্যন্ত নেই, রিচিয়ারডাের একটি হাত ক্যাটেরিনার স্তন ধরে আছে আর ক্যাটরিনার এক হাত বিচিয়ারভাের নাইটিঙ্গেলটি ধরে আছে। কাটেরিনার সাধের নাইটিঙ্গেল, যে নাইটিঙ্গেলের গান শুনে ঘুমােবার জন্যে সে এত ব্যস্ত হয়েছিল।
লিজিও বুদ্ধিমান, চেঁচামেচি করলেন না। তিনি তখনি তাঁর পত্নীর শয়নকক্ষে গিয়ে পত্নীকে ডেকে তুললেন। বললেন আমার সঙ্গে শিগগীর এসো, না ভয়ের কিছু নয়, এসােই না। ম্যাডােনা গিওকোমিনা একটা লম্বা পােশাক পরে স্বামীর সঙ্গে বারান্দায় এলেন। লিজিও বললেন, ঐ দেখ আমাদের মেয়ে তার নাইটেলটিকে নিজের হাত নিয়ে কেমন ঘুমােচ্ছ।
ওরা দু’জনে যদি নগ্ন না হয়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকত তাহলে বােধহয় ম্যাডােনা এমন কঠিন আঘাত পেতেন না। ঘুম থেকে উঠেই এমন শালীনতা বিবর্জিত অতি অসভ্য এক দৃশ্য দেখে তিনি খুবই আঘাত পেলেন। তা মনে হল শীতের রাত্রে কেউ বুঝি তার গায়ে এক বালতি তুষারশীতল জল ঢেলে দিল।
তার মেয়ের ওপর তার বিশ্বাস ছিল এবং মেয়ে যে কারও প্রেমে পড়েছে এমন কোনাে লক্ষণও তিনি দেখেন নি, তাই সহসা এই অভব্য দৃশ্য তাকে অত্যন্ত ব্যথিত করলাে। তাছাড়া লজ্জায় যেন তিনি মরে যেতে চাইলেন। তার মেয়ে তার সঙ্গে এমন প্রবঞ্চনা করলাে?
তিনি তৎক্ষণাৎ মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে তুলে ভৎসনা করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু লিজিও তাকেও থামিয়ে দিয়ে বললেন, শােনাে প্রিয়তম, আমার জন্যে তােমার ভালবাসা এখনও যদি অটুট থাকে তাহলে ওদের কিছু বােলাে না। ভেবে দেখ রিচিয়ারডাে নামী বংশের ধনীর সন্তান, তাকে আমরাও ভালবাসি। আর আমাদের মেয়ে যেভাবে তার নাইটিঙ্গেলকে ধরেছে তাতে সে তাকে ছাড়বে না। তারপর ভেবে দেখ জামাতা হিসেবে বিচিয়ারডাে কাম্য। তাকে আমরা বলবাে তুমি যা করেছ তার জন্যে তােমার কঠোর শান্তি প্রাপ্য। তুমি আমাদের কন্যার কুমারীত্ব হরণ করেছ, ওকে আমরা অন্য যুবকের হাতে তুলে দিতে পারি না। তুমি যদি বিনা দণ্ডে এই বাড়ি থেকে যেতে চাও তাহলে তােমাকে ক্যাটেরিনাকে আগে বিয়ে করতে হবে। কি ম্যাডােনা তুমি প্রস্তাবে রাজি আছ?
ম্যাডােনা বুঝলেন তার স্বামী ঠিকই বলেছেন আর সত্যিই তাে রিচিয়ারডাে ছেলেটি ভালাে, ধনী এবং সম্রান্ত বংশের। তাই তিনি সম্মত হলেন।
তাদের কথাবার্তার শব্দে প্রথমে রিচিয়ারভাের ঘুম ভাঙল। দিনের আলাে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। তখনও সে ক্যাটেরিনার বাবা ও মাকে দেখতে পায়নি। সে ক্যাটেরিনাকে ডেকে বলল, এই ওঠো, সকাল হয়ে গেছে, হায় হায় এ আমরা কি করলুম? আমাদের ঘুম এতক্ষণ কেন ভাঙে নি? আমরা তাে এখুনি ধরা পড়ে যাব।
লিজিও এগিয়ে এসে বললেন, হ্যা তােমরা হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছ, এখন বলো তােমাকে আমি কি শাস্তি দেব।
সামনে লিজিও ও ম্যাডােনাকে দেখে রিচিয়ারডাে লজ্জা ও ভয়ে কুঁকড়ে গেল। কোনােরকমে দেহ আবৃত করতে করতে বলল, আমি আপনাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। যে অপরাধ করেছি তার ক্ষমা নেই কিন্তু ভগবানের দোহাই আমাকে ক্ষমা করুন, দয়া করে আমাকে প্রাণে মারবেন না।
লিজিও বললেন, রিচিয়ারডাে তােমার ওপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস ছিল। তােমাকে সৎ, শিক্ষিত ও চরিত্রবান যুবক বলে জানতুম কিন্তু তুমি যা করেছ তাতে তােমাকে ক্ষমা করলেও আমাদের মেয়ের কুমারীত্ব আর ফিরে আসবে না। আমি জানি এজন্যে তােমাদের যৌবনই দায়ী, কামতাড়িত হয়ে তােমরা এ কাজ করেছ কিন্তু যাতে তুমি প্রাণ রক্ষা করতে পারাে এবং আমাদের সম্মানও অক্ষুন্ন থাকে সেজন্যে তােমাকে আমাদের কন্যাকে বিবাহ করতে হবে। তুমি উপযুক্ত বধূ পাবে। যদি আমাদের প্রস্তাবে এখনি সম্মত হও তবেই তােমাকে আমি ক্ষমা করতে পারি নচেৎ তােমার জীবন বিপন্ন।
ক্যাটেরিনাওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে তার নাইটিঙ্গেলকে তার হাত মুক্ত করে আপাতত লজ্জা নিবারণের জন্য উপুড় হয়ে শুয়েছিল। তার মা তার দেহ আবৃত করে দিতে সেও উঠে কাঁদতে কাঁদতে তার বাবার কাছে ক্ষমা চাইল এবং রিচিয়ারডােকেও বলল তার বাবার প্রস্তাবে রাজি হতে। ক্যাটরিনা কিন্তু মনে মনে উল্লসিত। এমন রাত্রি বার বার ফিরে আসবে।
লিজিওকে আর বেশি কথা বলতে হল না। রিচিয়ারডাে তার সম্মতি জানাল। লিজিও তাঁর পত্নী কাছ থেকে আঁটি চেয়ে নিয়ে রিচেয়ারডােকে দিলেন। তারপর পিতামার সাক্ষ্যে তাদের বিবাহ হল পরে গির্জায় আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিবাহ হবে।
লিজিও ও তার পত্নীর কাঁধে হাত রেখে বললেন, চলাে আমরা যাই, ওরা এখন আর কিছুক্ষণ নিদ্রা যাক। এতে ওদের স্নায়ু নিস্তেজ হবে, মানসিক শান্তি পাবে।
বাবা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাটরিনা মশারি ফেলে দিয়ে সদ্যলব্ধ পতিকে জড়িতে ধরলো। রিচিয়ারড়াে তার নাইটিঙ্গেলকে আপাতত খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখল।
কয়েকদিন পরে সাড়ম্বরে ও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিবাহ হয়ে গেল। এখন সকলেই খুশি। বিচিয়ারডাে ও ক্যাটরিনার দাম্পত্যজীবন সুখের হয়েছিল। রিচয়ারডাের হাতে মেয়েকে দিয়ে লিজিও এবং ম্যাডােনাও অত্যন্ত সুখী হয়েছিলেন।
পঞ্চম গল্প
গিদোত্তো দ্য কৃমোনা মৃত্যুর পূর্বে একটি বালিকার সমস্ত ভার গিয়াকোমিনাে দ্য পাভিয়ার ওপর দিয়ে গেল। এই বালিকা যখন ফিনজা শহরে গেল তখন জিয়ানােল ডি সেভিরিনো এবং মিঙ্গিনো ডি মিঙ্গোলে নামে দু’জন যুবক তার মন জয় করবার চেষ্টা করলাে। দু’জনে মহামারিও হল কিন্তু জানা গেল ঐ বালিকা জিয়ানােলাের বােন। তখন মিজিলের সঙ্গে তার বিয়ে হল।
নাইটিঙ্গেলের গল্প শুনে মেয়ের দল খিল খিল করে হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। হাসি আর থামে না। এদিকে লজ্জায় ওদের মুখ রাঙা হয়ে গেছে। ওদিকে লিকোষ্ট্রাটো তখন মিষ্টি মিষ্টি হাসছে।
এক সময়ে মেয়েদের হাসি থামল, তখন কুইন বলল, ফিলােস্ট্রাটো তুমি আমাদের অনেকগুলি করুণ কাহিনী বলতে বাধ্য করেছিলে তুমি এখন ক্ষতিপূরণ করলে। মেয়েগুলিকে তুমি যেন কাতুকুতু দিয়ে হাসালে। যাই হােক আমরা এখন খুশি। কুইন তারপর নেফাইলের দিকে চেয়ে বলল, এবার গল্প বলার পালা তােমার।
নেফাইল তখন বলল, ফিলােস্ট্রাটোর গল্পের পটভূমি ছিল রােমান। আমার গল্পের পটভূমি ঐ শহরের কাছাকাছি। তাহলে এবার আরম্ভ করি :
ফেনাে শহরে একদা দু’জন লম্বার্ডবাসী বাস করতাে। প্রথমজনের নাম ছিল গিদোতো দ্য কৃমােননা আর দ্বিতীয়জনের নাম ছিল গিএকোমিনা দ্য পাভিয়া। যৌবন কালটা তাদের কেটেছে লড়াই আর যুদ্ধ করে। দেশে তখন অশান্তি চলছিল। শক্তসমর্থ সকল পুরুষকেই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়তে হয়েছিল।
দু’জনেই ক্রমশ বৃদ্ধ হল তাদের মধ্যে গিদোতো কমজোরী। প্রায়ই অসুখে ভােগে। ভুগতে ভুগতে মৃত্যুশয্যায়। তার কোনাে সন্তান নেই কিন্তু তার একটি পালিত ছােটো মেয়ে ছিল। গিদেত্তো মৃত্যুর পূর্বে তার বন্ধু গিয়াকোমিনােকে ডেকে পাঠিয়ে ছােট মেয়েটির সমস্ত ভার বন্ধুকে দিল আর সেই সঙ্গে তার যত অর্থ ও সম্পদ ছিল সবই বন্ধুর জিম্মা করে দিল। মেয়েটি বড় হলে গিয়াকোমিননা যেন তাকে সৎপাত্রে দান করে এবং উপযুক্ত যৌতুক দেয়। সমস্ত বিলি-ব্যবস্থা করে গিদোতো পরলােকে গমন করলো।
ফিনজা নামে একটি শহর ছিল। শহরটি যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েছিল। কালক্রমে শহর পুনর্গঠিত হল ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল। গিয়াকোমিননা এই শহরে বাসিন্দা ছিল। শহরের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে মেয়েটিকে নিয়ে গিয়াকোমিনা ফিরে এলাে। মেয়েটিকে সে নিজের কন্যার মতােই ভালবাসত।
মেয়েটির নাম অ্যাগনেসা। বয়স বাড়ার সঙ্গে অ্যাগনেসার রূপ যেন ফেটে পড়তে লাগল। এমন রূপসী তরুণী সে তল্লাটে আর একটিও ছিল না। যৌবনে ভরপুর, বয়সের তুলনায় তার প্রতি অঙ্গ ভরাট। ফিনজার যুবকরা চঞ্চল। তাদের মধ্যে দুটি যুবক ছিল ফিনজার নামী বংশের সন্তান। বনেদী শের ছাপ তাদের চোখে মুখে, সুদর্শন, মার্জিত রুচি। একজনের নাম জিয়ানােল ডি সেভরিনাে আর একজনের নাম মিঙ্গিননা ডি মগোলে। অ্যাগনেসাকে
পাবার জন্যে এই দু’জনের মধ্যে রীতিমতাে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গেল কিন্তু তখনও পর্যন্ত এর মেয়েটিকে শুধু চোখে দেখেছে, আলাপ পরিচয় হয়নি। পাত্র হিসেবে দু’জনেই উপযুক্ত এবং তরুণীর বিবাহের বয়স হয়েছে কিন্তু কোনাে পক্ষ থেকেই এখনও পর্যন্ত বিবাহের প্রস্তাব আসে নি বা কেউ উদ্যোগী হয় নি।
গিয়াকোমিনাের বাড়িতে একজন বয়স্কা পরিচারিকা ছিল আর ক্রিভেলা নামে একজন পরিচালক ছিল। দু’জনেই নানা বিষয়ে পারদর্শী ছিল এবং গিয়াকোমিনাের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা ঠিক প্রভুভৃত্যের মতাে ছিল না। তারাও পরিবারভুক্ত হয়ে গিয়েছিল।
দুই প্রেমিকই এই দু’জনের সন্ধান পেয়ে গেল। দুজনেই স্থির করলাে এদের মারফত তরুণীর কাছে পৌছতে হবে। জিয়ানােল একটু বেশি তৎপর। সে প্রথমেই ক্রিভেলাের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে দেন এবং তাকে স্পষ্টই বলল বাড়ির সুন্দরী মেয়েটিকে সে ভালবেসে ফেলেছে, মেয়েটিকে তার চাই তরে আগে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ক্রিভেলােকে সে প্রচুর পুরস্কার দেবে এবং অগ্রিম কিছু দিল।
ক্রিভেলা বলল, বড় কঠিন কাজ। কর্তা তাে বাড়িতে সব সময়ে থাকে। মেয়েটি তার নয়নের মণি, সর্বদা আগলে রাখে। তবে গিয়াকোমিনাে শীঘ্রই একদিন রাত্রে নিমন্ত্রিত হবে। বাড়ি থাকবে না। সেই সুযােগে আমি তােমার সঙ্গে অ্যাগনেসার আলাপ করিয়ে দেবাে। এতে তােমার মত আছে তাে?
জিয়ানােল বলল, তার মত আছে তবে দেখাে কোনাে বিপদ না ঘটে।
অপর প্রতিদ্বন্দ্বী মিঙ্গিনো যখন দেখল, জিয়াননাল ক্রিভােলােকে হাত করে নিয়েছে তখন সে পরিচারিকার সঙ্গে ভাব জমাল। প্রথমে তার অনেক প্রশংসা করে হাতে কিছু গুজে দিয়ে মনের মা বলল, মেয়েটিকে আমার চাই তবে তার আগে তুমি যেভাবে পারাে আমার সঙ্গে ভাব করিয়ে দাও।
পরিচারিকা চোখ মটকে বলল, সেজন্যে চিন্তা করাে না। আমি পাকা ব্যবস্থা করে দেবে। পরিচারিকা সেই দিন থেকেই অ্যাগনেসার কাছে মিঙ্গিনাের গুণগান আরম্ভ করে দিল। মিঙ্গিননাকে বলল, ভেবাে না, সুযােগ পেলেই তােমাদের দুটিকে আমি একেবারে বিছানা শুইয়ে দেব। তুমি কিছু চিন্তা করাে না বাপু।
জিয়াননালের সঙ্গে ক্রিভেলাের এইসব কথাবার্তার পর ক্রিভেলাে একদিন কৌশল করে গিয়াকোমিননাকে তার এক বন্ধুর বাড়ি রাত্রে নিমন্ত্রণ খেতে পাঠাল। জিয়ানােলকে খবর পাঠাল সে যেন তাদের বাড়ির সামনে একটা জায়গায় অপেক্ষা করে। তার সংকেত পেলেই সে যেন এসে সােজা দব ঠেলে বাড়িতে ঢােকে। সে রাস্তা পরিষ্কার রাখবে।
ওদিকে পরিচারিকা বুড়ি খবর পেয়েছে যে, কর্তা আজ রাত্রে বন্ধুর বাড়ি খানাপিনা করতে যাবে তবে তাে রাস্তা পরিষ্কার। পরিচারিকা বুড়ি মিঙ্গিনাকে খবর দিয়ে বলল, সে যেন বাড়ির কাছেই কোথাও অপেক্ষা করে, ইশার পেলেই যেন দৌড়ে আসে, সে সব ব্যবস্থা করে রাখবে।
এই যে ব্যবস্থা হয়েছে তার খবর কিন্তু দুই প্রেমিক জানত না। একজন জানত না যে অপরজনকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। অন্ধকারের পর দুই প্রেমিক মারামারির আশংকায় সঙ্গে কয়েকজন মুক্ত বন্ধু নিয়ে প্রেমিকের বাড়ির কাছে অপেক্ষা করতে লাগল। দু’জনেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কর্ক তারা সংকেত পাবে।
গিয়াকোমিননা সেজগুজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর ক্রিভেলাে ভেবেছিল এবার ঝিমাৰ
বােধহয় নিজের ঘরে ঢুকে (ভা ভো করে ঘুমােবে। কিন্তু সেরকম কোনাে লক্ষণ দেখা গেল না। সে খালি ঘরবার করছে।
ক্রিভেলা তখন অধৈর্য হয়ে পরিচারিকাকে বলল, এই মাগী কর্তা তাে বেরিয়ে গেছে। তাের তাে এখন কোনাে কাজ নেই, যা না গিলেকুটে ঘুমােগে যা না।
পবিচারিকা ঝাঝিয়ে উঠল, আমি কি করি না করি তাতে তাের কি দরকার রে ডাকরা মিনসে? তােবও তাে কোনাে কাজ নেই, তুই নাক ঘুমগে যা না।।
এইরকম ঝগড়া চলল, কেউ কাউকে নড়াতে পারল না। ক্রিভেলা তখন মনে মনে বলল, দুত্তোর ছাই পাজী মাগী, তাের নিকুচি করেছে কিন্তু তার কপালে অনেক দুঃখ আছে। ও যদি কিছু ফাস করে তাে মরবে।
ক্রিভেলা আর অপেক্ষা করলাে না। সে বাড়ির দরজা খুলে রেখে জিয়াননালের উদ্দেশ্যে সংকেতধ্বনি করলাে। আর জিয়ানােল সঙ্গে সঙ্গে তার দু’জন স্যাঙাতকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল।
বাড়ির ভেতরে অ্যাগনেসাকে দেখতে পেয়ে জিয়ানােল তার সঙ্গী দু’জনের সাহায্যে তাকে ধরে আনবার চেষ্টা করলাে। অ্যাগনেসা তার শক্তিমতাে বাধা দিতে ও চিৎকার করতে লাগল, সেই সঙ্গে পরিচারিকাও যােগ দিল।
বাড়ির মধ্যে চিৎকার শুনে মিঙ্গিননা তার দুই বন্ধুকে নিয়ে ছুটে এসে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে এই দৃশ্য দেখে সকলে তলােয়ার বার করে ফেলল। দু’পক্ষে চিৎকার, গালাগালি ও মারপিট শুরু হয়ে গেল।
গােলমাল শুনে একদল প্রতিবেশীও আলাে ও অস্ত্র হাতে বাড়ির সামনে জমায়েত হয়ে আক্রমণকারীদের গাল দিতে লাগল। ইতিমধ্যে জিয়ানােল অ্যাগনেসাকে তার ঘরের বাইরে এনেছিল কিন্তু মিঙ্গিনে বীর বিক্রমে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে অ্যাগনেসাকে আবার তার ঘরে ফিরিয়ে দিতে পারলো।
কেউ হয়ত খবর দিয়ে থাকবে অথবা প্রচণ্ড গােলমাল শুনে আরক্ষা বাহিনীর কর্মচারীরা ছুটে এসে মিঙ্গিননা, জিয়াননাল ও ক্রিভেলা সমেত কয়েকজনকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে গিয়ে আর্টিকে রাখল।
গিয়াকোমিনাে যখন ফিরে এলাে তখন সব শান্ত। সব শুনে সে তাে ভীষণ ঘাবড়ে গেল কিন্তু যখন। শুনল তাদের মেয়ের কোনাে দোষ নেই তখন সে নিশ্চিন্ত হল। তারপর সাব্যস্ত করলাে এমন রটন আবার ঘটতে পারে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে।
পরদিন সকালে জিয়ানােল ও মিঙ্গিনাের বাড়ির কয়েকজন লােক এসে গিয়াকোমিনাের সঙ্গে দেখা করে যা ঘটেছে তাে বলল। এ খবর তাে গিয়াকোমিনাে আগেই শুনেছিল। ওরাও শুধু ঘটনা জানতে আসে নি। ওরা বলল যে ওদের দুই ছেলেকে আরক্ষাবাহিনী আটকে রেখেছে। গিয়াকোমিনাে যদি ওদের অভিযুক্ত করে, যা করার অধিকার তার আছে তাহলে তাে কঠোর শাস্তি পাবে। তাই ওর গিয়াকোমিনােকে অনুরােধ করতে এসেছে যে গিয়াকোমিনাে যেন এমন কিছু না করেন যাতে ছেলেতে ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায় এজন্যে তারা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি আছে।
গিয়াকোমিনাের জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে যুদ্ধক্ষেত্রে, তাই জীবনের বাকি অংশে সে আর কোনাে ঝামেলায় নিজেকে না জড়িয়ে শান্তিতে কাটাতে চায়। গিয়াকামিনাে বলল দেখ বাপু আমার অনেক বয়স হয়েছে, জীবনে অনেক ঘা খেয়েছি, ঝগড়া বিবাদে নিজেকে আর জড়াতে চাই না তােমাদের বা তােমাদের ছেলেদের কোনাে বিপদেও ফেলতেও চাই না। তারপর শােননা যে মেয়েটিকে কেন্দ্র করে গােলমাল সেই মেয়েটি কৃমােনা বা পাভিয়ার নয়, সম্ভবত সে ফিনজার মেয়ে। সে আমার মেয়ে নয়, যে ব্যক্তি মেয়েটির ভার আমার ওপর দিয়ে গেছেন তিনি নিজেও জানতেন ও কার মেয়ে। এখন তােমরা বললাে আমরা কি করবাে?
মেয়েটি ফিনজা শহরের কন্যা শুনে সকলে অবাক হল। যাই হােক গিয়াকোমিননা কোনাে ঝামেলা করতে চায় না। শুনে সকলে আশ্বস্ত হল। তারা জিজ্ঞাসা করলাে তাহলে অজ্ঞাতপরিচয় মেয়েটিকে আপনি কোথায় পেলেন?
গিয়াকোমিনাে বলল, গিদোত্তো দ্য কৃমােনা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সে যখন মৃত্যুশয্যায় তখন সে আমাকে বলেছিল যে, যখন এই শহর সম্রাট ফ্রেডরিক আক্রমণ করেছিলেন তখন শহরে দাঙ্গা ও লুটপাট চলছিল। সে সময়ে গিদোত্তো এবং আরও কয়েকজন লুটপাটের উদ্দেশ্যে একটা বাড়িতে ঢুকে দেখে যে তাদের আগে কেউ অনেক মাল লুট করে সেই বাড়িতে জমা করে রেখে গেছে। বাড়ি লােকজনও পালিয়ে গেছে শুধু এই মেয়েটি একটি খাটে পড়েছিল। তখন তার বয়স দু’বছর। আমার বন্ধু দয়াপরবশ হয়ে লুটের মালসমেত মেয়েটিকেও নিয়ে ফিনাে শহরে চলে যায়। আর এই ফেনে শহরেই গিদোত্তো এই মেয়েটির ভার ও বন্ধুর যত সম্পত্তি ও সম্পদ ছিল সেসব ঐ মেয়েকে দান কবে আমাকে অছি নিযুক্ত করে। শর্ত ছিল যে মেয়ে বড় হলে উপযুক্ত পাত্রে তার বিয়ে দিতে হবে ও ঐ সমস্ত সম্পত্তি ও সম্পদ তার বিবাহের যৌতুক হিসেবে তাকে প্রদান করতে হবে। এখন মেয়েটির বিয়ের বয়স হয়েছে, তবে তাকে আমি এখনও যােগ্য পাত্রে অর্পণ করতে পারি নি। তবে কাল বাতে ঘটনার পর আমি এবার যত শীঘ্র সম্ভব বিয়ে দেব।
গিয়াকোমিনাের বাড়িতে যারা জমায়েত হয়েছিল তাদের মধ্যে গুইগ্লিয়েলমিনাে দ্য মেডিচিনা নামে একটি লােক উপস্থিত ছিল। গিদেত্তো সখন সেই বাড়ি লুঠ করতে ঢুকেছিল তখন সে গিসােণ্ডের সঙ্গী ছিল। তারা যার বাড়ি লুট করেছিল সেই বাড়ির মালিকের নাম তার মনে আছে এবং সেই মালিক শুল ৰে মধ্যেও উপস্থিত রয়েছে। গুইগ্নিয়েলমিনাে সেই মালিকের কাছে গিয়ে তার নাম ধরে ভেকে বলল, বারনাবুচিও শুনলে গিয়াকোমিনাে কি বলল?
বারনাবুচিও বলল শুনলুম। গিয়াকোমিনাে যখন তার কাহিনী বলছিল তখন আমারও অনেক কথা নে পড়ছিল। সেই সময় আমি আমার যে ছােট্ট মেয়েটিকে হারিয়েছিলুম তার বয়স ছিল দু’বছর।
শুনে গুইগ্নিয়েলমিনাে বলল, তাহলে এই মেয়েই তােমার সেই হারানাে মেয়ে। পিদোস্তোর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তার মুখেও আমি শুনেছি যে সেই সময়ে তােমার বাড়ি লুঠ হয়েছিল। এখন তুমি মনে করে দেখাে তাে যে, তােমার শরীরে এমন কোনাে চিহ্ন আছে কিনা যা দেখে সনাক্ত করা যাবে।
কিছুক্ষণ চিন্তার পর বারনাবুচিওর মনে পড়ল মেয়ের বা কানের পাশে একটা কাটা চিহ্ন আছে। শিশুকালে সেখানে ফোড়া হয়েছিল। ফোরাটা কাটাতে হয়েছিল। ক্রুশ চিহ্নের মতাে একটা কাটা দাগ এখনও থাকতে পারে।
বারনাবুচিও তখন গিয়াকোমিনােকে অনুরােধ করলে তাকে মেয়েটির কাছে নিয়ে যেতে কারণ মেয়েটি তখন বাড়ির ভিতরে ছিল। গিয়কোমিনাে তখনি তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে অ্যাগনেসার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়েকে দেখে বারনাবুচিওর মধ্যে পিতৃস্নেহ জেগে উঠল এবং বলল, ঠিক ও মায়ের মতাে দেখতে হয়েছে। মাও এমনি সুন্দরী ছিল। শুধু চেহারা এক রকম হলেও হবে না, সনাক্তকরণ চিহ্নিটিও দেখা চাই ।
বারনাবুচিও গিয়াকোমিনােকে অনুরােধ করলাে মেয়ের বাঁ দিকের কানের ওপরের চুল সরিয়ে ভালাে করে দেখতে সেখানে ক্রুশের আকারে কোনাে কাটা দাগ আছে কিনা। গিয়াকোমিনাে বলল, আমি নে? তুমি নিজেই দেখ।
সেই অনুসারে বারনাবুচিও মেয়ের বাঁ কানের ওপর থেকে চুল সরিয়ে চিহ্নটি আবিস্কার করে ক্লাসে চিৎকার করে উঠল। তার চোখে জল এসে গেল, সে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলাে। তারপর পিয়াকোমিনােকে বলল, বন্ধু আমি এখন নিঃসন্দেহ, এ আমার সেই হারানাে মেয়ে। তােমাকে অশেষ ন্যবাদ তুমি আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতাে যত্ন করে প্রতিপালন করেছ। তােমার ঋণ অপরিশােধ্য । গিদোত্তো দলবল নিয়ে যখন আমার বাড়ি লুঠ করতে আসছিল তখন আমার যুবতী স্ত্রী ভয় পেয়ে নিজের সম্মান বাঁচাবার জন্যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। মেয়ে বাড়িতেই পড়েছিল।
লুটপাঠের পর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আমরা ধরে নিয়েছিলুম আমাদের মেয়েও সেই আগুনে পুড়ে মারা গেছে।
অ্যাগনেসা এতক্ষণ পর্যন্ত বারবুচিওকে তার পিতা বলে মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু সব শুনে তার মনের পরিবর্তন হল । নাড়ীর টান আছে। পিতার বাহুবন্ধনে এতক্ষণ আড়ষ্ট হয়েছিল। সমস্ত বিবরণ শােনার পর তার আড়ষ্টতা দূরীভূত হল।
বারনাবুচিও তখনি তার মা, ছেলেদের, ভাই, বােন ও অন্যান্য আত্মীয় ও বন্ধুদের ডেকে পাঠাল। মাও মেয়েকে দেখেই কেঁদে ফেলল। হারানাে মেয়েকে পেয়ে সকলে খুশি। গিয়াকোমিনােকে সকলে বার বা ন্যবাদ দিয়ে মেয়েকে তার বাবা মা বাড়ি নিয়ে গেল।
আর একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সেই আর এক প্রেমিক জিয়ানােল কারাগারে আটকে ছিল। হল বারনাবুচিওর ছেলে অতএব অ্যাগনেসার ভাই। বিচারক তাকে মুক্তি দিলেন। শুধু তাই নয়, বিচার মিঙ্গিনোর সঙ্গে জিয়াননালের মিটমাট করিয়ে তাদের বন্ধুত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করে দিলেন।
বিচারকের উদ্যোগেই মিঙ্গিনোর সঙ্গে অ্যাগনেসার বিবাহও হয়ে গেল। ক্লিভেলাে এবং আর সকলকে মুক্তি দেওয়া হল। শহরে আনন্দের জোয়ার বইল।