আল মাহমুদ এর কিছু কবিতা

›› কবিতা / কাব্য  ›› কবিতার / কাব্যের অংশ  

লোক লোকান্তর কাব্য গ্রন্থ

অরণ্যে ক্লান্তির দিন

…..ঝড়িতে সবজি নিয়ে হেঁটে আসে চাকমা কিশোরী,
বিচিত্র কাপড়ে বাঁধা ঘামে ভেজা উপচানো বুকে
বনের রহস্য কাঁপে যেন। ভুরুতে ক্লান্তির নুন
গ’লে পড়ে গালের দু’পাশে। আর আমি নির্বিকার
হতাশার মতো শুধু চেয়ে থাকি অরণ্যের দিকে।….

এমন তৃপ্তির

……স্পর্ধিত রোমশ ঢুকে একেকটি চুম্বনের দাগ কাঁপা ঠোঁটে একে দাও ৷ ভাবক সে ডাইনী, মায়াবী
স্তন ঠোঁট নখ হতে ঢেলে দাও নিজের পরাগ
বলো তারে, ওরে পশু,, বল্ আর কতটুকু পাবি,
সবি তো দিলাম তুলে যা ছিলো এ দেহের ভূভাগ
তার বিনিময়ে করি মাঠ ঘর সন্তানের দাবী ।…..

চারজনের প্রেম

….চারজনের বুকের কাছে প্রিয়তমার লাশ
কালো করণ-কাফন ঢাকা চোখে গভীর সুর্মা মাখা
স্তনের কাছে এলিয়ে থাকা কালো চুলের রাশ ।
শেষ হাসিটি লেপ্টে আছে মৃত নারীর ঠোঁটে
চার জনের দঃখ যেন গন্ধ হয়ে ওঠে।
চারজনের রক্ত বুঝি এক হতে চায় সোজাসমুজি
স্তব্ধ কে লকিয়ে রেখে প্রিয় মুখের ছবি
এই ভূগোলে আমরা প্রথম ভালোবাসার কবি।…..

শোকের লোৰান

…..অক্ষরে বিম্বিত হতে চাও যদি, খুলে ধরো সমস্ত গোপন ।
কথা বলো, দঃখের সুরভি যেন ঝরে যায়। যেন,
জলে যায় শবাধারে শোকের লোবান ।
নগ্ন হও, শিশু যেন দ্যাখোনি পোশাক।
ভালোবাসো, তামসিক কামকলা শিখে এলে
যেন এক অক্ষয় যবতী।

তখন কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল,
যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর নিম্ননাভিল।…..

কালের কলস কাব্য গ্রন্থ

হে আচ্ছন্ন নগরী

…..আমিও যখন এসেছি নগরে একি !
তোমার শরীরে আভরণ নেই কোনো
পশুর থাবায় বিধে আছে চেয়ে দেখি,
নাভিমুল আর কামনার অঙ্গনও।

সবুজ শাড়িটি জীর্ণ মালার মতো
পড়ে আছে পায়ে নিটোল ঊর কাছে,
জীবন যেন বা হয়েছে কণ্ঠাগত
পাতা-ঝরা এক তরুণ সেগুন গাছে !

সাহসে আঘাতে স্পর্শে

যে আমি প্রায়ান্ধকার প্রত্যুষের দিকে
ভেবেছি করবো যাত্রা, নারী এসে এক
বললো, দাঁড়াও যাত্রী, অই সব ফিকে
বিবর্ণ আদর্শে গিয়ে নিজের বিবেক

পড়িয়ে কি লাভ বলো ? যতক্ষণ টিকে
থাকা যায় থাক তুমি । নইলে আরেক
মরমী মদির চিত্র মৃৎপটে লিখে
নিয়ে যাও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বারেক।

আমার সৌন্দর্যে এসো। শরীর জঘন
অসহ আগনে নিত্য জলে যেতে চায়
নটির মদ্রার মত মন আর স্তন
অশ্লীল আরব্ধ বিষ তুলেছে ফণায় :

সাহসে আঘাতে স্পর্শে তোমার রমণ
শেষ করো। ঘামে কামে পরিতৃপ্ততায়।

শূন্যে হাওয়া

ধ্বনিরা সব ফরিয়ে যায়
নিত্য ব্যবহারে
শূন্য হাওয়া চতুর্দিকে
বলায় লাল জিভ ;
জোটেনা কোনো শব্দকণা
কবির ওঙ্কারে
তখন কার আহত মুখ
দাঁড়াল পার্থিব ?

উদোম তার বুকের ভার
উদার হাতে খুলে
মোহিনী এক জননী যেন
রমণী হতে চায় ;
ঘুমের ছল কামের জল
এখনো নাভিমলে
মোছেনি তব্বু আবার এলো
আগের শয্যায় ৷

কিছুই যেন কাঁপেনা তার
ভাঙেনা সৌষ্ঠব
শীত বিদায় গ্রীষ্ম যায়
জমেনা ম্বেদকণা ;
সর্বদাই নিজের কাছে
নিরীহ পরাভব
গোপন রাখে দ’চোখে আঁকে
রাতের আল্পনা।

নিয়মহীন বিষাদ দু’টি
ব্লকের ভারে নত,
গভীর এক ভঙ্গি ধরে
ঊর অধিকার ;
গন্ধহীন পুষ্প যেন
ফাগনে উদ্যত
মুদ্রাহীন সর্প খেলে
কামের টঙ্কার।

মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো

চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি
বহ, ঘর পার হয়ে এক উজ্জ্বল কামরায় আমাকে থামতে বলা হলে,
আমি চোখ তুলে দেখলাম, চারটি স্বর্ণময় সিংহ-আসনে
চারজন রাজকন্যা কথোপকথনে রত।
চারজনের চার বাহারের শাড়ি আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল ।
কেউ পরেছে জামদানী, কেউ কনকের কাজকরা মসলিন।
কারো হাল্কা আবুয়ানের স্বচ্ছতা পার হয়ে দেহলতা দেখা যাচ্ছে।
আবার কারো গাঢ় লাল নয়নসকে শাড়ির পাড়ে
শাদা আগনের মত রূপোর চমকি জলছে ।
কুমারীরা তাদের বুকের ওপর দিয়ে দীর্ঘ বেণী দুলিয়ে দিয়েছে।
যেন চার রকম অগ্নিশিখার ওপর
ঝাঁপিয়ে পড়েছে চারটি কালো সাপ।
আমি হতবাক হয়ে রাণীমার দিকে তাকালাম।
তিনি অভিভাবিকার মত আমার দিকে ফিরে বললেন,
এখান থেকে তোমার সঙ্গিনী বেছে নাও ।
আমার মনে হলো, তার নির্দেশ মেনে নেয়া উচিত। কিন্তু আমি
কাকে পছন্দ করবো ?
চারজনই আমার কাছে সমান রূপসী বলে বোধ হলো।
এদের মধ্যে কে অন্যতমা ?
আমার চোখ, আমাকে কোনো সাহায্যই করতে পারছে না।

রাণীমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন,
তোমার চোখ, কোনো কাজের নয়। আমি তাড়াতাড়ি বললাম,
মা, আমার অন্য ইন্দ্রিয়ও আছে। দেখুন আমার হাত,
আমি স্পর্শ করতে পারি। এই যে আমার নাক,
আমি আঘাণ নিতে পারি। আর
এ জিহবা দিয়ে আমি লেহন করি।
চারটি প্রাণলাবণ্যের স্বাদ নিয়ে আমাকে পছন্দ করতে দিন।
রাণী হেসে আমাকে মেয়েদের কাছে যেতে ইঙ্গিত করলেন।
আমি প্রথম কুমারীর চিবুক স্পর্শ করতেই পলকে শিহরিত হলাম
তার ওষ্ঠের পাশে ঘাসফলের মত একটি রক্তবর্ণ তিল দেখে
আমার ভালো লাগলো।
দ্বিতীয় কুমারীর মাথায় হাতরেখে তার মুখের দিকে তাকালাম,
সুন্দর নাসিকার ওপর মুক্তোর নাকফুল তিল,ষ্পের চেয়েও
অপরূপ মনে হলো। আমি অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম ।
আমি যখন তৃতীয়ার কাঁধ স্পর্শ করে দাঁড়ালাম, মেয়েটি হাসলো।
তার পানিফলের মত অপরূপ দাঁত আমার ঠোঁটে চুম্বনের ইচ্ছাশক্তির
প্ররোচনা দিল। কিন্তু আমাকে তো চতুর্থ জনকেও দেখতে হবে ?
আমি শেষ অর্থাৎ প্রান্ততমার হাত ধরে দাঁড়ালে, এই কিশোরী
লজ্জায় নতমুখী হয়ে রইলো। অন্যহাতে তার চিবুক তুলে ধরতেই
সে চোখ বুজলো।
এই মৃগনয়নার দু’টি গাঙচিল আমার বাসনার সমদ্রে
উড়াল দিয়ে থাকলো । আমি কাকে নেবো ? আমার স্পর্শ ইন্দ্রিয়ও
আমার সাথে নিঃসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । এবার আমি
এই আমার শেষ পরীক্ষা। আমার আরও ইন্দ্রিয় আছে
আমার ঘাণশক্তির কথা ভাবলাম ।

এই আমার শেষ পরীক্ষা। আমার আরও ইন্দ্রিয় আছে
কিন্তু আমি কতক্ষণ আর এক মহান রাজ্ঞীকে দাঁড় করিয়ে রাখতে
পারি ?
প্রতিটি নারীকে আঘাণ করার নিমিত্ত আমি প্রথমার কাছে ফিরে
এলাম।
আমি তার ব্লকের কাছে মুখ নামাতেই
সে তার প্রথম বোতাম খুলে দিল। বহদ্রাগত নেব,ফলের গন্ধে
আমার মস্তিষ্ক ভরে যাচ্ছে। হায়, ফলের গন্ধে
আমার কি কাজ ?
আমি দ্বিতীয়ার কাছে পৌঁছবার আগেই সে তার পোশাকের
দু’টি বোতাম খুললো। মৃগনাভির ঝাঁঝালো গন্ধে
আমার শরীর যদিও রোমাঞ্চিত হচ্ছে, তবুও
আমি কস্তুরী-সবাসের জন্যে উপত্যকা পার হয়ে আসিনি !
আমি তৃতীয়ার বুকে তিনটি বোতামই খোলা দেখলাম ৷
দু’টি বতুল শঙ্খের মাঝে নাক ডুবিয়ে আমি প্রাণপণ শুকতে
লাগলাম ।
ধূপের গন্ধে চিরকাল আমার দম বন্ধ হয়ে আসে,
যেন আমি কোনো পূজামণ্ডপের অসংখ্য ধূপদানীর ধোঁয়ার আঁধারে
দেবীর মুখে খুজে বেড়াচ্ছি।

তারপর উন্মত্তের মত আমি চতুর্থ, অর্থাৎ প্রান্তবর্তিনীর কাছে এসে
নতজানু হয়ে বসে পড়লাম। বললাম, বাঁচাও আমাকে, দয়া করো।
নতমুখী রাজকন্যা দু’হাতে তার বুক চেপে ধরলো। আমি
দ্রুত তার কম্পিত হাত সরিয়ে দিলে, সে লজ্জায়
গ্রীবা বাঁকিয়ে অন্যদিকে চোখ ফেরালো। এই প্রথম
আমি কোনা নারীর মধ্যে লজ্জা দেখলাম ।
আর তা আগুনের মত লাল, আর শোণিতের মত সঞ্চরণশীল।
তার দু’টি মাংসের গোলাপ থেকে নুনের হাল্কা গন্ধ আমার
কামনার ওপর দিয়ে বাতাসের মত বইতে লাগলো। যেন আমি
লবণ পর্বতের পাদদেশে ঘুমিয়ে পড়বো।

সহসা সম্রাজ্ঞীর দিকে ফিরে বললাম, মা
এই আমার মনোনীতা। আমার বাক্যস্ফারিত হওয়ামাত্র
ভোজবাজির মত রাণী তার অপরা কন্যাদের নিয়ে
দুঃখিতের মত চারটি দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেন।
আর আমি আমার মনোনীতার হাত ধরে বললাম,
আমরা কোথায় যাবো ? বধ, বললো, বাসরে।

মেহগনির বিশাল পালঙ্কে আমার বিছানা। আমি নদীর মত
বাঁকে বাঁকে ঘোরানো তার শাড়ির আঁচল
যখন মাটিতে লুটিয়ে দিচ্ছি, ঠিক তখুনি সেই
সর্বনাশা হাসি শুনতে পেলাম। ঠা ঠা শব্দে
রাজার সেই পাথর কাঁপানো হাসিতে আমার স্ত্রী
দৌড়ে পালিয়ে গেলো। আর অদৃশ্য চাক ছোবল মারল
আমার মস্তকে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। আর
অজ্ঞান মানেই হলো, অক্ত স্বপ্ন থেকে ফিরে আসা।

 

Please follow and like us: