দগ্ধজাতক – বিনোদ ঘোষাল

›› সম্পুর্ণ গল্প  

রুষার গোলাপি আভার কোমল স্তনবৃত্তের থেকে মুখ সরাতে ইচ্ছে করছিল না প্রণবেশের। কিন্তু উবের ড্রাইভার আচমকা তার গাড়ি থামিয়ে দিতে ঝাঁকুনি খেয়ে মুখ সরে গেল প্রণবেশের। তবে চোখ খুললেন না। টের পেলেন রুষা ওর মুখটা জোর করে সরিয়ে দিচ্ছে।

আমি কিন্তু আপনাদের নামিয়ে দিতে পারি। এখুনি নামিয়ে দিতে পারি। পুরুষ কন্ঠস্বরে আবেশ ভাঙল প্রণবেশের। চোখ মেলে দেখলেন উবের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে আর রুষা ব্যস্ত ওর কালো টিশার্টটা নামিয়ে পিছনে হাত দিয়ে ব্রায়ের হুক লাগাতে।

প্রণবেশ কিছু বলতে পারলেন না। ওর দুই ঠোঁটে এখনও রুষার অপূর্ব স্তনবৃত্তের স্বাদ লেগে রয়েছে। আরও অনেক খিদে রয়েছে তার। ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন ড্রাইভারের দিকে।

কেন এমন করছেন? একটু সংযত হয়ে বসুন। রাস্তায় পুলিশ যদি এইভাবে দেখে আমাকেও কেস ঠুকে দেবে। কথাগুলো বলতে বলতে রুষার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। বারবার রুষার দিকে তাকাচ্ছিল ড্রাইভারটা।

রুষা সামান্য একজন ড্রাইভারের এমন ভর্ৎসনা এবং কড়া চাহনির সামনে লজ্জায় ঘৃণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল। এই লোকটা রুষার জীবনটাকে একেবারে তছনছ করে দিচ্ছে ও জানে কিন্তু কেন জানা নেই কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারছে না রুষা জানে, কিন্তু বুঝতে পারে না কেন ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। প্রণবেশ নিজেও কোন উত্তর না দিতে পেরে মাথা নিচু করে বসে রইলেন।

ছিঃ! শব্দটি ব্যবহার করে ড্রাইভার আবার মুখ সামনের দিকে ফিরিয়ে গাড়ি স্টার্ট নিল। ভবানীপুর থেকে সল্টলেক বেশ অনেকটা রাস্তা পথ। আজ বিকেলে ঢাকুরিয়ায় প্রণবেশের বাড়িতে এসেছিল রুষা। প্রণবেশই ডেকেছিলেন ওকে। ফোন করে নয়, মেসেজে। একটিই বাক্য—পারছি না। প্লিজ এসো লক্ষ্মীটি। এই ডাককে প্রতিবার উপেক্ষা করার চেষ্টা করে রুষা। কিন্তু কী যে দুর্নিবার এক আকর্ষণ ও শেষ পর্যন্ত পারে না নিজেকে আটকে রাখতে। মেসেজের রিপ্লাই না দিয়েও ঠিক সময় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল প্রণবেশের বাড়িতে। তারপর সেখান থেকে দুজনে গিয়েছিল ক্লিনিকে। এখন গন্তব্য সল্টলেক।

প্রফেসর প্রণবেশ গুপ্ত। ইংরেজির অধ্যাপক প্রণবেশ গুপ্তকে ইউনিভার্সিটির ছেলে মেয়েরা পিজি বলে ডাকে। তবে পি ফর প্রণবেশ নয়, পি ফর পাগলা জি ফর গুপ্ত। পাগলা গুপ্ত। তবে এটাও ঠিক পিজির ক্লাস করার জন্য ক্লাসের স্টুডেন্টরা মুখিয়ে থাকে। কী অসাধারণ যে পড়ান উনি, কী যে এক অমোঘ আকর্ষণ রয়েছে তাঁর কথায়, তাঁর প্রতিটি শব্দচয়নে, এবং ওনার উপস্থিতিতে। সকলের মতো রুষাও মুগ্ধ ছিল পিজির প্রতি। এমন অসাধারণ আবেগ দিয়ে তিনি বোঝাতেন কিটস, শেলি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর কবিতাগুলো, যে নতুন ভাবনায় ধরা পড়ত তাদের লেখা কবিতার আখরগুলি। ক্লাসে রুষাকে বন্ধুরা ডাকত মিস বার্বি নামে। এখনও পুরনো বন্ধুরা ওই নামেই ডাকে। এই ডাক অযৌক্তিক নয়। মাত্র পাঁচফুট হাইটের রুষা অবিকল একটি মেম পুতুল যেন। চোখ ধাঁধানো ফর্সা, ভরাট তুলতুলে গড়ন, একমাথা কোঁকড়া বাদামি আভার চুল ঘাড় পর্যন্ত ছুঁটে ছুঁয়ে থাকে। শরীর তার এমনই কোমল যে ঢালু কাঁধে ব্রায়ের স্ট্র্যাপ পর্যন্ত যেন কামড়ে বসে দাঁতের দাগ ফেলে দেয়। রুষার এখনও মনে পড়ে পিজি প্রথমবার যখন রুষার ব্র্যায়ের স্ট্র্যাপে হাত দিয়েছিলেন, ওই দগদগে লাল হয়ে ওঠা লম্বা লাইন বরাবর কী পরম যত্নে বার বার হাত বুলিয়েছিলেন, নিজের ঠোঁট রেখেছিলেন করুণ আদরে। ফর্সা ফোলা গাল, পুরু টুকটুকে লাল দুটি ঠোঁট আর দীর্ঘায়ত একজোড়া চোখের প্রতি স্বাভাবিক- ভাবে আকৃষ্ট ছিল ইউনিভার্সিটির অধিকাংশ পুরুষ। স্কুল জীবন থেকেই অসংখ্য নিত্যনতুন প্রণয় প্রস্তাবে প্রতিদিন ভরে উঠত রুষার দুই হাত। একটা সময়ে এইসব প্রস্তাব আর তাকিয়েও দেখত না ও, ভাল করে শুনতেও ইচ্ছে করত না। মনে হত এই পৃথিবীর পুরুষেরা বুঝি প্রেমের প্রস্তাব দিতেও ভুলে গেছে, তাদের প্রতিটি প্রেম- প্রস্তাবে তীব্র চাহিদা রয়েছে, ভালবাসা নেই। ফলে পুরুষের প্রতি যে স্বাভাবিক আকর্ষণবোধ তা রুষা হারিয়ে ফেলছিল, এবং এই হারিয়ে ফেলায় ও ভয় পাচ্ছিল। কাউকে আর আলাদা মনে হত না, সকলেই একইরকম। তবে তাই বলে নিজের প্রতি কখনও অসচেতন হয়নি রুষা। বরাবরের সৌন্দর্যসচেতন রুষা নিজেকে নিজের মনের মতই সাজিয়েছে দুইবেলা। বাবা সরকারি ব্যাঙ্কে উচ্চপদে কাজ করে অধিষ্ঠিত, মাও বেসরকারি ব্যাঙ্কে কর্মরতা ফলে বরাবরই একটি স্বচ্ছল পরিবার পেয়েছে রুষা পারিবারিক সচ্ছলতার অভাব কোনওদিনই ছিল না রুষার। আদরের মেয়েকে না চাইতেই তার জন্য নানারকম উপহারে ভরিয়ে দিয়েছে বাবা। ফলত একটি নিরুপদ্রব শৌখিন জীবন বরাবর কাটিয়ে এসেছে ও জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল ও। সবরকমের পোশাকেই রুষাকে চমৎকার দেখতে লাগে তাই নিজের পছন্দের আর বাবা মার নিয়ে আসা অজস্র দেশি বিদেশি পোশাকে ভরা ওর আলমারি। কলেজের ছেলেদের পুরুষদের মুগ্ধ অসহায় দৃষ্টিগুলোকে উপেক্ষা করতে করতে দিনগুলো বছরগুলো পার হয়ে গেল, চলে যাচ্ছিল কিন্তু কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটিতে আসার পর যেদিন প্রথম পিজির ক্লাস করল রুষা সেদিনই প্রথম টের পেল একজোড়া অন্যমনস্ক চোখ, যে যেন ওকে দেখেও দেখছে না। অবাক হয়েছিল। স্কুল কলেজের স্যারদের চোখেও যে এক পুরুষালি লুব্ধ পুরুষ-মুগ্ধতা দেখে অভ্যস্ত হয়েছিল। রুষা সেই প্রথমবার তার ব্যত্যয় দেখে বিস্মিত হয়েছিল। এ কী সম্ভব! প্রথম কয়েকটি ক্লাস করার পর রুষা ভেবেছিল স্যর বুঝি ওকে খেয়াল করেননি। কিন্তু তারপর ইচ্ছে করেই একদিন সামনের বেঞ্চে বসে দেখল স্যার পড়াচ্ছেন অথচ ওর প্রতি আলাদা অভিনিবেশ নেই তার দৃষ্টিতে সত্যিই কোনও আলাদা অ্যাটেনশন নেই! পড়াতে পড়াতে একেবারেই নিরাসক্ত নৈমিত্তিক চাউনি। লোকটা যেন নিজের কথাতেই বিভোর।

মানুষের স্বভাব হ’ল যে যতক্ষণ আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে ততক্ষণ সে উপেক্ষা করবে কিন্তু যখন সে দেখে তাকে কেউ উপেক্ষা করছে তখন সে গুরুত্ব পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। মানুষ স্বভাবত নিজের গুরুত্ব সম্বন্ধে সদা সচেতন। তার সামান্য অভাবও রুষ্ট করে তাকে। আর, এতটুকু উপেক্ষা নজরে এলে তার বিরোধে সক্রিয় হয়ে ওঠে অন্তরাত্মা। রুষার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। ফলে ইউনিভার্সিটির গণ্ডি পার করার পর রুষা যেদিন স্থির করল এবার ও পিএইচডি করবে, তখন গাইড হিসেবে সবার আগে ওর মনে এসেছিল পিজির কথা। রুষা চিরকাল স্বল্পভাষী। এবং কণ্ঠস্বরও খুব কোমল এবং মৃদু। তা ছাড়া ও বরাবর ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার ফলে রুষার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও খুব কম। অপরিচিত কারও সঙ্গে নিজে থেকে কথা বলতে ওর মধ্যে একটা স্বভাবসংকোচ কাজ করে। সেইজন্য ইউনিভার্সিটিতে পিজির কাছে গিয়ে স্যার আপনার কাছে পিএইচডি করব। কথাটুকু বলতেই ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল ও। আর সেদিনও পিজি মৃদু ঘাড় নেড়ে নিচু গলায় বলেছিলেন, বেশ তো বেশ তো।

লোকটা কি আদৌ ইহজগতে থাকে? নাকি অতিরিক্ত উন্নাসিক? চিরকাল সর্বজন প্রশংসিত নিজের রূপকে এইভাবে অবহেলিত দেখে বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল রুষা রূপের অবহেলা ক্ষোভ জাগিয়েছিল রুষার মনে। কেমন যেন একটা জেদ চেপেছিল প্রণবেশের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কাজের সূত্রে মাঝেমাঝেই স্যারের বাড়িতে যাওয়া শুরু। প্রণবেশ নিঃসন্তান। এবং স্ত্রী সামান্য অপ্রকৃতিস্থ। বাড়ির কাজের মহিলাই যাবতীয় দিক সামলান। নিজের কাজের জগতে ডুবে থাকা প্রণবেশ কলেজ, পড়াশোনা আর তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই তার মুক্তি খুঁজে নিতেন। কখনও তাকে মনমরা, বিরক্ত হতে দেখেনি কেউ। কিন্তু একদিন ঘটে গেল অন্যরকম।

সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। দুপুরে স্যারের বাড়িতে পৌঁছেছিল রুষা। ছাতাও সেদিন বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে পারেনি রুমাকে। বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন কাজের মহিলা। রুষাকে দেখে বলেছিলেন ইসস! একেবারে ভিজে গেছ তো? ঠান্ডা লাগবে।

এই এখুনি চলে যাব। আজ বেশিক্ষণের কাজ নেই। স্যার কোথায়?
কোথায় আবার পড়ার ঘরে। যাও।

রুষা ঢুকেছিল স্যারের স্টাডিরুমে। কড়া তামাক আর কফির গন্ধ আচ্ছন্ন করে রাখে এই ঘরের আবহ। স্যার সেদিন পড়ছিলেন না। ঘরের জানলা খুলে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিলেন। রুষা যে ঘরে এসেছে তা খেয়ালও করেননি উনি।

রুষা এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল স্যারের। বৃষ্টির ছাঁট এসে ঢুকছিল ঘরে। প্রণবেশের চোখ মুখে সেই জলকণারাশি স্বেদ আর অশ্রুর মতো দেখাচ্ছিল। প্রণবেশ বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলেন বাইরে। সেই তাকিয়ে থাকার মধ্যে বৃষ্টি দেখার আনন্দ ছিল না বরং এক বিষাদ ছিল।

তারপর প্রণবেশ ফিরে কয়েক মুহূর্ত অপলক তাকিয়েছিলেন রুষার দিকে এবং কোনও কথা না বলে খুব সহজে ভণিতাহীনভাবেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন রুষাকে। ওর কপালে, ঠোঁটে অজস্র চুমু খেয়ে তারপর নিজে হাতে ভিজে পোশাক ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মুগ্ধ, অপলক বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলেন কালো ব্রায়ে ঢাকা রুষার অপরূপ বুকদুটির দিকে। দুইহাতে স্পর্শ করেছিলেন, তারপর…আদরে চুম্বনে ভরিয়ে দিয়েছিলেন রুষার বুকদুটিকে।

হতচকিত রুষা সেদিন প্রণবেশের ওই আকস্মিক আচরণে হতবাক হয়েছিল, স্যারের প্রতি ঘৃণায় ভরে উঠেছিল মন কিন্তু একইসঙ্গে ও টের পেয়েছিল এক অদ্ভুত শরীরী সুখ যা ওর জীবনে সম্পূর্ণভাবেই প্রথম। প্রণবেশের এই সহজ আদর রুষাকে যেমন তীব্র শরীরী সুখ এনে দিয়েছিল তার সঙ্গে দিয়েছিল প্রণবেশকে জয় করার আনন্দ যা একজন নারী এক পুরুষকে জিতে যাওয়ার পর পায়।

সেই শুরু। তারপর হিসাব যেন বদলে গেল হু হু করে। আপাত শান্ত আত্মমগ্ন প্রণবেশ রুষাকে পেয়ে পুরো ভিন্ন মানুষ হয়ে উঠলেন। রুষাকে তার প্রতিদিন চাই, প্রতি মুহূর্তে। একদিন না এলেই ঘন ঘন ফোন, মেসেজ। প্লিজ এসো আমি পারছি না। আমাকে বাঁচাও লক্ষ্মীটি। রুষা ততদিনে নিজের সঙ্গে লড়াই শুরু করে দিয়েছে। সে একবার ভাবে বয়সে দ্বিগুণেরও অধিক এই বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে শারীরীক ও মানসিক সম্পর্কে জড়ানো সবদিক থেকেই বিপজ্জনক শুধু নয়, ক্ষতিকারকও। এই খবর জানাজানি হলে রুষার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনও যে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হবে তা বারবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করত রূষা। নিজেকে ওই ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে প্রাণপণে বিরত থাকার চেষ্টা করত, কিন্তু শেষপর্যন্ত পারত না, শিশুকে স্তন্যপান করানোর জন্য মা যেমন আগ্রহী হয়ে ওঠে, স্তন্যপানের দৃশ্যটি ভেবে কোনও সদ্য মাতৃত্বপ্রাপ্ত নারী পুলকিত হয়ে ওঠে ঠিক তেমনই একটা অনুভূতি হত রুষার। প্রৌঢ় ব্যক্তিটি বাছুরের মতো বার বার ঘাই মেরে স্তনবৃত্ত থেকে এক অদৃশ্য সুধাপান করে চলেছে অপূর্ব তৃপ্তিতে ভরে উঠছে তার মুখ, এই দৃশ্য রুষার মধ্যে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগাত। যৌনসুখকেও ছাপিয়ে যেত প্রণবেশের ওই মুহূর্তের নিষ্পাপ পবিত্র মুখখানি। রুষা অপলক তাকিয়ে দেখত ওই মধ্য পঞ্চদশবর্ষীয় শিশুটিকে।

প্রায় সাত-আট মাস কেটে গিয়েছিল এইভাবে। প্রণবেশ কখনও রুষাকে মিলনে আহ্বান করেনি, কখনও তাকে সঙ্গমের জন্য প্রলুব্ধ করেনি তার সকল আকর্ষণ শুধুমাত্র রুষার ওই নিটোল সুন্দর বুকদুটির প্রতি। ওই বর্তলাকার নারীসম্পদদুটিকে নিয়ে প্রণবেশ কী যে খেলায় মেতে উঠত যে তার স্থান কাল জ্ঞান থাকত না। এক এক সময় এই কারণে নানাবিধভাবে অপদস্থও হতে হয়েছে রুমাকে। কখনও সিনেমা-থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহে তো কখনও ট্যাক্সিতে, কখনও ময়দানে পুলিশ এসে ভর্ৎসনা করেছে। রুষার প্রথমদিকে এমন পরিস্থিতির সামনে মরে যেতে ইচ্ছে করত, প্রতিজ্ঞা করত আর প্রণবেশের ছায়াও মাড়াবে না কোনওদিন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই’ লক্ষ্মীটি দোহাই একবার এসো প্লিজ’ এর কাছে হার মানত।

রুষার বুকদুটিকে এমনভাবে স্পর্শ করতেন যেন স্বর্গের দুটি পবিত্র পারিজাতকে ছুঁচ্ছেন। ওই স্পর্শে এতটুকু পাপবোধ আসত না রুষার। রুষাও কখনও নিজের মুখ রাখত প্রণবেশের চওড়া রোমশ বুকে। কী অদ্ভুত এক শান্ত গন্ধ সেই বুকের ওমে রোমে। কী অপূর্ব এক আশ্রয়!

ঠোঁট রাখত রুষা। গাল ঘসত।
আমার বুক আসলে শূন্য রুষা। কিছু পাবার নেই। এর মধ্যে কী খোঁজ তুমি?
একটা গাছ…
গাছ ?

হ্যাঁ এই বুকের মধ্যে কেমন মস্ত বুনো গাছের গন্ধ পাই আমি। বহু বছরের পুরনো একটা জ্যান্ত গাছ।
রুষার কাছে এমন কথা শুনে প্রণবেশ বলতেন, আজ থেকে আমি নিজের বুককেও ভালবাসব দেখো।

রুষা খেয়াল করল উবের ড্রাইভার তার সামনের আয়না থেকে বারবার ওদের দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। খুব অস্বস্তিকর। রুষা বুঝল ড্রাইভার আসলে নজর রাখছে ওদের দুইজনের ওপর।

প্রণবেশ সিটে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন। সামান্য হাঁফাচ্ছেন। হাঁফানোর মধ্যে কাতরতা মিশে। ইদানীং এক এক সময় প্রণবেশকে নিজের সন্তান বলে ভ্রম হয় রুষার। প্রণবেশের বুকে আলতো হাত রাখতেই আহ করে অস্ফুটে শব্দ করে উঠলেন উনি। সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিল রুষা। নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল খুব কষ্ট হচ্ছে?

না। ঠিক আছি আমি।
আবার নৈঃশব্দ।

মাস দেড়েক আগের সেই সন্ধেটার কথা মনে পড়ল রুষার। ও তখন প্রণবেশের ঘরে। ওকে কফি দিয়ে গেছে কাজের মাসি যাকে মামনিদি নামে ডাকে রুষা। মামনি অবশ্য রুষাকে পছন্দ করে না মোটে। আর প্রণবেশের স্ত্রী তো রুষাকে দেখলেই বিরক্ত হয়ে ওঠেন, সরাসরি না বললেও ইঙ্গিতে তার অপছন্দ গজগজ করে বলতে থাকেন। মেয়েদের সহজাত অনুভূতি এবং আন্দাজ করার ক্ষমতা অনেক প্রখর। হয়তো উনি কিছু আন্দাজ করতেন। একদিন অঘটন ঘটেই গেল।

সেদিন সন্ধেবেলায় স্যারের স্টাডিরুমে ছিল রুষা। দরজা প্রতিদিনের মতো ভেজানোই ছিল। প্রণবেশের স্ত্রী কখনওই এই ঘরে আসে না। কিন্তু সেদিন যখন সহসাই প্রণবেশের আধো অন্ধকার ঘরে তিনি এলেন তখন রুষা প্রণবেশের কোলে বসে আর প্রণবেশ তার মুখ ডুবিয়ে রখেছে রুষার দুই বুকে। জেগে ওঠা দুই স্তনবৃত্তে ঠোট দিয়ে আপ্রাণ শুষে চলেছে অদৃশ্য অলভ্য সুধারস। রুমা বসেছিল দরজার দিকে মুখ করে আর প্রণবেশ পিছন ফিরে তাঁর চেয়ারে বসেছিলেন। প্রণবেশের স্ত্রীকে আচমকাই দরজা ঠেলে ঢুকতে দেখে মুহূর্তে কাঠ হয়ে গিয়েছিল রুষা। প্রণবেশের চুল ধরে থাকা রুষার মুঠি আলগা হয়ে খসে পড়েছিল। প্রণবেশ পিছন ফিরে থাকার ফলে কিছুই টের পাননি, আর ওর হুঁশও ছিল না। রুষার বুক কাছে পেলে প্রণবেশের মাথার ঠিক থাকে না কোনও কালেই। ও বারবার নিজের মুখ ডোবাতে চাইছিলেন রুষার কোমল দুই স্তনে।

ঘরের মধ্যে শুধু স্যারের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছিল। ওই আলো আঁধারি ঘরে দুটো অসমবয়েসি শরীর যে খেলায় মেতে উঠেছিল তাতে সহসা ছেদ পড়েছিল। প্রণবেশের স্ত্রী কয়েকমুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়েছিলেন, তারপর শুধু ছিঃ বলে ঘর থেকে সরে গিয়েছিলেন।

রুষার কাছে ফোনটা এসেছিল পরদিনই দুপুরের দিকে। হ্যাঁ স্যারের স্ত্রীই ফোন করেছিলেন। শোনো মেয়ে, আমি তোমার পরিবারের কালচার কেমন জানি না, তুমি কেমন তাও জানার ইচ্ছে বা রুচি আমার নেই। শুধু একটা কথা স্পষ্ট শুনে রাখো। আজ থেকে প্রণবেশের সঙ্গে যদি কোনওরকম যোগাযোগ রাখো তুমি, তাহলে কিন্তু আমি আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।

কথাগুলো রুষাকে অন্তর থেকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এইসব কথা যদি বাবা-মা জানতে পারে…যদি বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা জানতে পারে…কেউই কি হাসিমুখে মেনে নেবে? কেউ মানবে মানতে পারবে একজন পঁচিশ বছরের তরুণী সম্পর্কে জড়িয়েছে এক পঞ্চান্ন বছর বয়েসি প্রৌঢ়ের সঙ্গে। ভয়ে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রুষা।

এবং দাঁতে দাঁত চেপে সত্যিই সেই চেষ্টা করেছিল। প্রণবেশের মুহুর্মুহু ফোন, মেসেজ হোয়াটসঅ্যাপ থেকে রেহাই পেতে শেষে নাম্বারটাই ব্লক করে দিয়েছিল রুষা। তাতে প্রণবেশ যেন আরও পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলেন। প্রায় আরও তিন চারটে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন করেছিলেন উনি। প্রতিবারই ওই কন্ঠস্বর শুনেই সেই নাম্বারও ব্লক করেছিল রুষা। ভয় পেতে শুরু করেছিল ও। স্যারের এই শিশুসুলভ পাগলামো আগে ওর ভাল লাগত কিন্তু তখন এই আচরণটাই অসহ্য মনে হচ্ছিল। প্রতি মুহূর্তে ভয় এই বুঝি সবকিছু জানাজানি হয়ে গেল! ঠিক সাতদিনের মাথায় ফোন এসেছিল ঋতুপর্ণর। ঋতুও পিএইচডি করেছে, প্রণবেশ গাইড। জানিস নিশ্চয়ই স্যারের কী হয়েছে? কী? বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল ওর।

ঋতু বেশ কেটে কেটে বেঁকাভাবে বলেছিল সে কী, তোর জন্য এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল আর তুই বলছিস তুইই জানিস না !
আমার জন্য…কী হয়েছে ঋতু?
পিজি পরশুদিন গায়ে আগুন দিয়েছেন। শুশ্রষা নার্সিংহোমে ….
বাকি কথাগুলো আর কানের ভেতরে ঢুকছিল না রুষার। গোটা পৃথিবীটা যেন চৌচির হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবী… একদিন প্রণবেশকে রুষা জিজ্ঞাসা করেছিল আমার বুকের মধ্যে এইভাবে কী খোঁজেন?
পৃথিবী…এই দুটি আমার দুই পৃথিবী।

দিশাহারা রুষা আর নিজেকে আটকাতে পারেনি। ছুটে গেছিল সেই নার্সিং হোমে। বুকে ব্যান্ডেজ বেঁধে বেডে শুয়ে থাকা অসহায় প্রণবেশকে দেখে বুকের ভেতরটা ছিঁড়েখুড়ে গিয়েছিল রুষার। প্রণবেশের স্ত্রী তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তবে স্যারের একজন ছাত্র ছিল, সে রুষারও পরিচিত। তার কাছেই রুষা শুনেছিল ঘটনাটা। দুইদিন আগে স্যর জ্বলন্ত মোমবাতি দিয়ে নিজের গোটা বুক পুড়িয়ে ফেলেছেন। বুক !

হ্যাঁ, নিজে হাতে এইভাবে জ্বলন্ত মোমবাতিটা ধরে গোটা বুকে ছ্যাঁকা দিয়ে দিয়ে…. কেনওওও…! আর্তনাদের মতো প্রশ্নটা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রুষার মুখ থেকে। ছেলেটা মুখে কোনও উত্তর না দিলেও এমনভাবে তাকিয়েছিল রুষার দিকে, যে ওই তাকানোর মধ্যেই স্পষ্ট উত্তরটা ছিল। তোমার জন্য। কেন-র উত্তর তুমিই জানো। টানা বারোদিন ভর্তি ছিলেন প্রণবেশ। প্রথম দুই দিন বাদ দিয়ে তারপর প্রতিদিন স্যারকে দেখতে গিয়েছিল রুষা। ও বুঝতে পারছিল ওর দিকে ধেয়ে আসা প্রতিটি দোষারোপের আঙুল, প্রতিটি ছি ছি, প্রতিটি ধিক্কারের কিছুই ওকে আর স্পর্শ করছে না। অদ্ভুত একটা নিরাসক্তি ওকে স্রেফ ঢেকে ফেলেছে।

হসপিটাল থেকে যে দিন প্রণবেশ ছাড়া পেলেন, সেদিন ওর স্ত্রী এসেছিলেন নিতে। বেশ কয়েকজন স্টুডেন্টও ছিল। রুষা কাছে যেতে পারেনি। দূরে দাঁড়িয়েছিল। একবার চোখাচোখি হয়েছিল শুধু। সেই চোখে কী যে করুণ প্রার্থনা…নিজের মান-সম্মানবোধ কবে যেন ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল ওর। তাই স্যারের স্ত্রীর কাছে বা স্টুডেন্টদের কাছ গলা ধাক্কা খেতে পারে জেনেও পরদিনই রুষা গিয়েছিল প্রণবেশের বাড়িতে। না, স্যারের স্ত্রী কিছুই বলেননি একটা ঠান্ডা চাহনি ছাড়া। মামনিও কোনও কথা বলেনি।

স্যারের কাছে গিয়ে প্রথম প্রশ্ন করেছিল রুষা, কেন করলেন? খুব দরকার ছিল এইভাবে আমাকে পোড়ানোর। পোড়ানোর? জানেন না আপনি…অসমাপ্ত কথা আর ব্যান্ডেজবাঁধা বুকের দিকে তাকিয়ে থাকাটুকু দেখে ষাট ছুঁতে চাওয়া মানুষটার দুই পুরুষ চোখ দিয়ে যে জলধারা গড়িয়ে নেমেছিল তার উষ্ণতা মাপার মতো এই সৌরজগতে কোনও থার্মোমিটার ছিল না।

প্রথম দিকে একজন নার্স এসে নিয়মিত ড্রেসিং করে দিয়ে যেতেন। তারপর ক্ষত কিছুটা শুকোনোর পর স্যার নিজেই ক্লিনিকে ড্রেসিং করাতে যাবেন বললেন। আজ নিয়ে দ্বিতীয়দিন ছিল ড্রেসিং এর। আগের দিনও রুষা নিয়ে গিয়েছিল, আজও। ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে উবের বুক করে প্রণবেশ বলেছিলেন আজ আমরা এখন বাড়ি ফিরছি না। তাহলে?

আমি একটা রুম বুক করেছি। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ একা কাটাতে চাই।

ইচ্ছেটা বুঝতে সময় নেয়নি রুষা। সেইজন্যই আজ রুষাকে বলেছিলেন আজ আসার সময় তোমার আধারকার্ডটা সঙ্গে এনো, দরকার রয়েছে। আর কটা দিন যাক না, আপনি অসুস্থ।

আমার জীবনই আমার অসুখ রুষা। আর একমাত্র তোমার স্পর্শই আমার ওষধি। আজ তুমি একটু আমার বুকে হাত রাখবে রুষা? একটু হাত বুলিয়ে দেবে? আমার সব যন্ত্রণা তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।

ওই অকৃত্রিম শিশুসুলভ সারল্যের অনুরোধকে পেরিয়ে যাওয়ার সাধ্য পঁচিশ বছর বয়েসি রুষার ছিল না। সল্টলেকে যে ওয়ো কাপলফ্রেন্ডলি রুমটা বুক করেছিলেন প্রণবেশ, তার সামনে এসে উবেরটা থামল। ড্রাইভার একবার তাকাল বিল্ডিংটার দিকে। হয়তো ও চেনে, এখানে কাপল নিয়ে আগেও এসেছে। পেমেন্ট করে প্রণবেশ গাড়ি থেকে নামলেন। ড্রাইভারটা আচমকাই নিজের সিট ছেড়ে বেরিয়ে এসে প্রণবেশের হাত ধরল। রুষা একটু অবাক হল। আরও অবাক হল প্রণবেশ কিছুই বললেন না ছেলেটিকে। মেন গেট খুলে বিল্ডিঙ-এর ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে এল ছেলেটি। চারতলার ফ্ল্যাট। গ্রাউন্ড ফ্লোরে রিসেপশন। রুষা বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। জীবনে প্রথম এই ওয়ো রুমে আসা। অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। অজানা কোনও সংস্কার ওকে আচমকাই বাধা দিচ্ছিল এমন একটি হোটেল রুমে এক পুরুষের সঙ্গে প্রবেশে। ছেলেটি গাড়ি স্টার্ট নিল। আচমকাই ডাকল, ম্যাডাম শুনুন?

রুষা ইতস্থত করে এগিয়ে এসে সাবধানে বলল, বলুন? স্যারের কী হয়েছে?
রুষা কোনও উত্তর দিল না।

বুকে কিছু হয়েছে মনে হল। আসলে স্যার আমাকে চিনতে পারেননি, আমি দু’হাজার এগারোর ব্যাচ ছিলাম। অবশ্য না চিনে ভালই হয়েছে। কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, তখন এমন বললাম বলে। আসলে পুলিশ দেখতে পেলে আপনাদেরই হ্যারাস করত। পিজি খুব ভালো মানুষ তো…ওকে অন্য কেউ কিছু বললে …

হ্যাঁ, ধন্যবাদ। শব্দদুটো বলার সময়ে রুষা টের পেল ওর অস্বস্তিটা আচমকা পুরনো মৃত বাকলের মতো শরীর থেকে খসে গিয়ে ওই ভাল মানুষটার বুকের লাল লাল শুকিয়ে আসা ক্ষতগুলোতে নিজের আঙুল রাখার জন্য তীব্র বাসনা রচনা করছে। ওর বুকে প্রণবেশ ঠোঁট স্পর্শ করলে যেমনভাবে জেগে ওঠে শিহরিত বৃত্তদ্বয় অবিকল তেমনই কাঙাল আর হরষিত হয়ে উঠছে ওর প্রতিটি আঙুল !