তিন মহাকাব্যের তিন মহামানবী
তিন কন্যার আবির্ভাব
………এহেন শম্ভই বনাঞ্চলে পরিভ্রমণকালে আলটপকা দেখতে পেলেন বেদাবতীকে। রূপ ও যৌবনের অনবদ্য পশরা সামগ্রিক পারিপার্শ্বকে উজ্জ্বলতর করেছে। পুষ্পভূষণে সজ্জিতা দুর্লভ রূপবতী দৈত্যের শরীরে ও মনে তীব্র কামভাব সঞ্চালিত করে। যৌন মিলনই দৈত্যের নিকট প্রাধান্য পায় ও তিনি যুবতীকে অনুসরণপূর্বক কুশধ্বজের কুটিরে উপস্থিত হলেন।……
………কন্যা তখন দহনে সংযমে অধিকতর ভাবমূৰ্ছায় বিষ্ণুপ্রেমের অতলান্তে পৌঁছেছেন। তাঁর বারােমাস্যা ভিন্নতর। একাকী যুবতী বনের ফলমূল আহার করেন। সূর্যতপা হয়ে নদীতে অবগাহন হয় তাঁর। অকাট্য নিয়মে তাঁর যৌবন আরও বিকশিত। বর্ণনাতীত রূপ মাধুর্য। কৃষ্ণবর্ণ হরিণচর্মে তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গ আচ্ছাদিত। প্রশস্ত জংঘা, ক্ষীণ কটিদেশ সুপক্ক আম্রের ন্যায় স্তনযুগল, বিশাল তৃষ্ণার্ত মেঘসমান কেশসম্ভার, দুই আয়ত লােচনে নারীর চিরন্তন প্রণয়তৃষ্ণা, তাঁর স্পর্শলাভের জন্য কী উদগ্রীব অরণ্যভূমি!……
…….ভূবনবিজয়ী লঙ্কার রাজা রাবণ একদিন আবিষ্কার করলেন বেদাবতীকে। রােমাঞ্চিত হলেন বহু নারীসঙ্গে অভিজ্ঞ রাক্ষসরাজ। শম্ভুর মতন তাঁরও প্রতিটি রােমকূপ তপ্ততা পায় যৌনজ কামনায়। নারীর রূপ ও সৌন্দর্য যখন অগ্নিরূপ নেয়, তখন ন্যায়-নীতির প্রাকার চূর্ণ হতে থাকে। | রাবণ সরাসরি গিয়ে বেদাবতীকে প্রস্তাব দিলেন। যথারীতি বেদাবতী ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন রাবণের প্রস্তাবকে।
দিশেহারা কামক্ষিপ্ত রাবণ বেদাবতীকে আঁকড়ে ধরতে চাইলেন। বেদাবতী আত্মরক্ষা করতে অসমর্থ হলেন।……….
………তিনিই দ্রৌপদী।
তাঁর আবির্ভাবই পূর্ণযৌবনারূপে জন্মমুহুর্তে কেবল সাবলীল নয়, যেন আকাশছোঁয়া সংশয়হীন আনন্দঘন আত্মবিশ্বাস। দীঘল শরীরের গঠন দ্রস্টার অন্তরে তীব্র শিহরণ তুলবেই। কোন রক্ষাকবরচ নিয়ে এসেছেন এই রূপসী ? কোন কুলে ভিড়বে এ তরী ? সমকালে এমন কোনও সুন্দরী ভূভারতে ছিলেন না, যিনি দ্রৌপদী অপেক্ষা অধিকতর আকর্ষনীয়ারূপে নিজেকে দাবি করতে পারেন। দ্রৌপদী গৌরবর্ণা নন। কিন্তু তাঁর মসৃণ কৃষ্ণত্বক নির্বাসিতের জীবনেও সুখস্বপ্নের সঞ্চার করতে পারে। যজ্ঞাধার থেকে দ্রৌপদী একাই বেরিয়ে এলেন না, তাঁর সঙ্গে এলেন আরও দু’জন—একজন ধৃষ্টদুম্ন্য, অপরজন লিঙ্গচ্যুত শিখণ্ডী। অর্থাৎ দ্রৌপদী সুনিশ্চিতভাবেই কৌরবদের ধ্বংস সূচিত করলেন।……..
…….লীডা বড় সুন্দরী। আবার ময়াল সাপের মতন তাঁর প্রেমবন্ধন। তাঁর যৌবন, যৌন মদকতা, সুমিস্ট প্রগলভতা মুগ্ধ করে স্পার্টার সম্রাট তিন্দারাসকে। সম্রাটের সংসারে কত্রীর আশু পালনীয় কর্তব্যনিচয় সম্পন্ন করত রাণী লীডা সিন্দুকের চাবিকাঠিটিও হস্তগত করেছিলেন।
এহেন সম্রাজ্ঞী যখন দেবতাদের দেবতা জিউসের প্রেমে বাঁধভাঙ্গা হয়ে পড়েন পাঠকের হৃদয় ভিন্ন উষ্ণতায় মথিত হবেই। অর্থাৎ পরবর্তীকালে হেলেন যে পরকীয়া প্রেমে উদ্বেল হয়ে ওঠেন, তার বীজ তিনি পেয়েছিলেন তাঁর মার কাছ থেকেই।……
………যৌনতার দুই প্রতীক—যােনি ও লিঙ্গ। লিঙ্গপূজার বড় সড় প্রচলন ভারতবর্ষে যার গতিমুখ আজও সমান শক্তিশালী। শিবলিঙ্গের আরাধনা এক বিরাট পরম্পরা। প্রাচীন গ্রীসেও লিঙ্গপূজার প্রসার ছিল। কোথাও ব্যাপ্ত, কোথাও সংক্ষিপ্ত। | গ্রীসে ফেলিপোেরিয়া নামক এক উদ্দীপনাময় উৎসব ছিল—যার আঁকজমকে নরনারীরা বুঝি ঝলসে যেত। এটাও ছিল লিঙ্গপূজা। উৎসবপ্রাঙ্গণে লিঙ্গদেবতার গড়ন ও উচ্চতাকে মাপতেন পুরােহিতরা। প্রাচীন মিশরেও লিঙ্গ পূজিত হত। পরে সেই দেবতা যেন নির্বাসনে চলে যান।
অতীতের ব্যাবিলনে পাষাণনির্মিত লিঙ্গকে জড়িয়ে ধরে সম্রান্ত বংশীয়া নারীরা আকুল হয়ে নিজেদের নিবেদন করতে চাইতেন। যুদ্ধে সম্ভাব্য বিপর্যয়ে | বীর স্বামী যেন হতাশায় চুরচুর না হয়ে যান, তার জন্য রােমক নারীরা লিঙ্গ পূজা করতেন।
ক্রমে দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তন আসে। তখন লিঙ্গদেবতাকে নিছক যৌনতার প্রতীক বলে মনে করা হল না। কাচের পৃথিবীতে মনুষ্য জীবন অতীব ভঙ্গুর ও কণ্টকাকীর্ণ। লিঙ্গদেবতা তুষ্ট হলে তৃিনি তাঁর অনুগত ও পােয্য নর-নারীদের দুঃখ ও বিপদ থেকে রক্ষা করবার ব্যবস্থা করবেন। | সেমিটিকরা পুরুষাঙ্গ ও যযানি উভয়ের উপাসক ছিলেন। সর্পকে প্রাচীনকালে থেকে যৌনতার জোরালাে প্রতীকরূপে গণ্য করা হচ্ছে। সর্পদর্শন মানে অচিরে যৌন মিলনের বার্তা বয়ে আনতে পারে কোন ইষ্টিকুটুম পাখির মিষ্টি মধুর ডাক।
ফ্রয়েডও বলেন, সর্প হল পুরুষ যৌনাঙ্গের প্রতীক—যা সৃষ্টির প্রয়ােজনেই উখিত হয় ও কিছুক্ষণের জন্য যেন সূর্যের তাপ লাভ করে।
প্রায় সকল ধর্মই বলে, নৈঃশব্দের দৃষ্টিকারী ফলন্ত বৃক্ষ যৌনমিলনের পরিণতিকে ইঙ্গিত করে। কোলাহলের বাইরে নিভৃতে ঘূর্ণায়মান জগত থেকে যেন একটু দূরে সরে গিয়ে নর-নারীর হৃদয়গত প্রেম শরীরী প্রেমের পুষ্করিনীতে তরঙ্গ তুলবে, অনুরাগে রঞ্জিত সেই মিলনে সৃষ্টিধারা অক্ষুন্ন থাকবে এবং এই নিয়ে ক্রোধ ও আক্ষেপ অনুচিত। এইরূপ নিভৃত প্রেমের ফসল হেলেন।…….
তিন দেবীর প্রতি অপরাধে অপরাধী যারা
……..পরাশর তদনুযায়ী নদীঘাটে অপেক্ষমান তরীতে গিয়ে উঠলেন। কিন্তু পারানীকে দেখে তিনি এককথায় স্তম্ভিত। কিছুক্ষণ একেবারে বাক্যহারা।
ইনি যে উদ্ধত যৌবননিষ্পষিতা এক অপরূপা। নারীর রূপ ও যৌবন যে কতখানী উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে যে কোনও বয়সের একজন পুরুষের অভ্যন্তরে, এই যুবতী বুঝি তারই প্রমাণ দেবার জন্য বসে আছেন। এর যৌন আবেদনের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় নীতিবােধ, কাণ্ডজ্ঞান ও শিক্ষা।………..দু’চারটে অবান্তর কথা বলবার পরই তিনি প্রায় নজিরহীন আকুলতায় সত্যবতীর কাঞ্চনবর্ণ দেহাংশ স্পর্শ করে বলতে শুরু করেন, ‘আমি এতবছর ধরে এই বিশ্বের বহুস্থানে পরিভ্রমণ করেছি। কিন্তু তােমার মতন রূপবতী যৌবনবতী নারী এ যাবৎ দেখিনি। আমি তােমাকে চাইছি। তােমার ভিতরে প্রবিষ্ট হতে না পারলে আমি উন্মাদ হয়ে যাব। তুমি সম্মত হও, সুন্দরী।
শিহরিত সত্যবতী সলজ্জে বললেন, ‘ঋষি, আপনি বশিষ্ট বংশােদ্ভব। অন্যদিকে আমি শূদ্রবংশীয়া। আমাদের মিলন শাস্ত্রসমমত নাও হতে পারে। সুতরাং আপনি আপনার বাসনাকে দমন করুন। আমি আপনাকে নিরাপদে যমুনা পাড় করিয়ে দিচ্ছি।…….
…..সত্যবতীও ততক্ষণে দীপ্ত পুরুষ পরাশরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। কৃষ্ণবর্ণ এই ঋষির পৌরুষ যে অসামান্য আনন্দদায়ক হবে, সেটাই তিনি বুঝতে পারলেন। তথাপি বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করত তিনি আঙুল তুলে দেখালেন, “ওই দেখুন, নদীতটে কত যাত্রী অপেক্ষমান। ওঁরা সকলে এখনই এসে পড়বেন আমার নৌকার সওয়ারি হতে। পরাশর মনে মনে হাসলেন। সত্যবতী যে রাজি হয়েছেন, এই কথাতেই তা প্রমাণিত।
উল্লসীত পরাশর তখন তার তপঃপ্রভাবে এমন এক কুয়াশাজাল সৃষ্টি করলেন যে নদীতটে উপস্থিত কোনও ব্যক্তিই সত্যবতীর তরীটিকে দেখতে পেলেন না।
মিলিত হবার পূর্বক্ষণে পরাশর সত্যবতীকে প্রশ্ন করলেন, ‘সুন্দরী, বলল, তুমি আমার কাছ থেকে কী চাও ? সত্যবতী বললেন, ‘জন্মাবধি আমি মৎস্যগন্ধা। অনেক দূর থেকে আমার শরীরের ওই গন্ধ সকলে পায়। এটা আমার খুব খারাপ লাগে। তুমি কী পারবে, আমার দেহকে সুগন্ধময় করে তুলতে ?
প্রসন্ন পরাশর বললেন, এই মুহূর্ত থেকে তুমি এক আশ্চর্য সুগন্ধের অধিকারিনী হলে। বহুদূর থেকে লােকে তােমার সুগন্ধে মােহিত হবে। মুনির এই কথা শেষ হওয়া মাত্র সত্যবতীর দেহ থেকে নির্গত হতে থাকে আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ। এক যােজন দূরত্বেও সেই গন্ধ লভ্য হওয়ায় পরবর্তীকালে সত্যবতীর আর এক নাম হয় যােজন গন্ধ।
পরাশর ও সত্যবতীর সেই মিলন হল দীর্ঘস্থায়ী ও অত্যন্ত সুখদায়ক। পরাশরের তপ্ত বীর্য ধারণ করাতে সত্যবতী গর্ভবতী হলেন। তিনি তখন চলে গেলেন লােকচক্ষুর আড়ালে। আশ্রয় নিলেন সরস্বতী নদীর মধ্যস্থলে একটি দ্বীপে।….
……কৌতুহলােদ্দীপক বিষয় হল, শতবর্ষাধিক বৎসর বয়স্ক দ্বৈপায়ন যখন বিবাহ করলেন, তখনও তার যৌবন পূর্ণাঙ্গরূপে বিদ্যমান।
তবে দ্বৈপায়নের স্ত্রী যে পদ্ধতিতে গর্ভবতী হলেন, সেটা এক অস্বাভাবিকের নিদর্শন। স্ত্রীর মুখগহ্বরে হঠাৎ একটি ছােট্ট শুক পক্ষী প্রবেশ করে এবং তিনি গর্ভবতী হলেন।
কালানুসারে ষােল বছর পর্যন্ত মাতৃজঠরে অবস্থান করেছিলেন শুকদেব। শুকদেবও তাঁর পিতৃদেবেরই মতনই জন্মমুহূর্তে গৃহত্যাগ করলেন। দেহে যৌবনের জোয়ার। কিন্তু মনে আশ্চর্য নিরাশক্তি।……
…….জীবনের সকল সাধই অধরা। অথচ কোনও কিছুর প্রতি আগ্রহ নেই। কোনটি উচিত, কোনটি অনুচিত—এই সমস্ত নিয়ে ভ্রান্ত বা অভ্রান্ত ধারনা তাঁর মাথায় তখন নেই। তিনি জানেনও না, কোথায় চলেছেন ? এমনকী, তিনি চলেছেন সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন এক অপূর্ব জলাশয়ের তীরে। ওই সময় কোনও পুরুষের পক্ষে স্থানটি ছিল নীতিগতভাবে বর্জনীয়। কারণ, তখন সেখানে জলকেলি চলছে স্নানরতা পরমা সুন্দরী অপ্সরাদের। তারা সকলে নগ্ন ও মনােজ্ঞ শুকদেবকে দেখলেন। কিন্তু তাঁদের একজনও কামভাবে মােহিত হলেন না। পরিবর্তে তাঁদের অন্তরে জাগ্রত হল মাতৃভাব। শুকদেবের জীবনবৃত্তান্ত তাঁদের অজানা। তবুও তাঁদের মনে হল, ইনি তাঁদের পুত্রের সমকক্ষ। নারীচরিত্রের বহুতর ভাবনার শ্রেষ্ঠটি অধিকার করে নেয় তাঁদের। কিন্তু এর কিছুক্ষণ বাদেই পুত্রের সন্ধানে দ্বৈপায়ন সেখানে উপস্থিত হলে দেখা গেল একেবারে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। সুন্দরীরা লজ্জা পেলেন, শিহরিত হলেন, লজ্জা ও কামকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জলে ডুব দিলেন।
পরে অপ্সরীরা উপলব্ধি করেন, তরুণ হয়েও শুকদেব নির্বিকার অপাপবিদ্ধ। কামভাব তাঁকে পীড়িত করছে না। যৌনসঙ্গমের কোনও অভিজ্ঞতা বা আকুলতা তার নেই। কিন্তু ঋষি দ্বৈপায়নের কথা একেবারেই আলাদা। তিনি কেবল বৃদ্ধ ও প্রাজ্ঞ নন, অভিজ্ঞও। নারীসঙ্গমে এখনও দিব্যি সমর্থ এবং তাঁর এই শক্তি আরও বহুকাল অটুট থাকবে। সুতরাং একজন নগ্নিকা যুবতী যদি তাঁকে দেখে লজ্জিত হয় বা কামভাবে আক্রান্ত হয়, সেটা হবে তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।……..
……….স্বামীর ঘর করতে যাবার আগে হেলেন যে একাধিকবার একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনের স্বাদ নিয়েছেন, তার উল্লেখ প্রায় সকল প্রাচীন কবির লেখাতেই পাই। সেই মিলনের তেজ ও উদ্যম প্রশ্নাতীত। তাতে প্রেম, বেগ ও নিষ্ঠুরতা সকলই বর্তমান। কিন্তু গ্রীক ট্রাজেডির কোরাসের ধুয়া সেখানে নেই। যেন এইগুলিতে মানবমঙ্গলের শক্তি অন্তর্নিহিত রয়েছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যবর্তী যে দূরত্ব, তাঁকে অতিক্রম করবার জন্যই হেলেনের সৃষ্টি। তাই যুবতী হেলেন যেখন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে শরীর চর্চা করেন, কবি সেখানে স্রষ্টার অনবদ্য সৃষ্টিকেই দেখতে পান, নৈতিকতার প্রশ্নই ওঠে না। ভারতে কোনও মহাকাব্যিক নারী চরিত্রে অতখানি উদ্দামতা লক্ষ্য না করা গেলেও তাঁদের কার্যকলাপ ও সেই কার্যের ওপর যুক্তির প্রলেপগুলি একবিংশ শতাব্দীতেও হজম করা কষ্টকর।…..
……….সীতা কিংবা দ্রৌপদীর কার্যকলাপে প্রবল উগ্রতার স্থান না মিললেও সত্যবতী একাই অনেকখানি শূন্যতা পূরণ করেছেন। সত্যবতী তাঁর বিয়ের। আগে ভাসমান নৌকার মধ্যে পরাশর মুনিকে দেহদান করেছিলেন। সত্যবতী কিন্তু সেদিন পরাশরের দ্বারা ধর্ষিতা হননি। পরাশরের সতৃষ্ণ অনুরােধউপরােধ কিছুটা দৃষ্টিকটু হলেও আধুনিকা তরুণী সত্যবতীর মনেও কামের সঞ্চার ঘটে ও তাঁর সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। তাই তিনি কৃপা করে পরাশর মুনির অবদমিত পৌরুষকে ব্যাপক মুক্তি দেননি, মিলনকালে তাঁর মধ্যে ছিল না কোনও প্রেমহীনতার উপলব্ধিও। বিবাহপূর্ব জীবনের সেই ঘটনাকে সত্যবতী নিছক কুলকুচো করে ফেলে দিতে পারেননি, যেহেতু ওই মিলনের ফলই দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের জন্ম।…..শতাধিক বৎসর অতিক্রান্ত হবার পর সেই বয়স্কা সত্যবতী তাঁর প্রথম সন্তান দ্বৈপায়নকে দিয়ে এমন কয়েকটি কাজ করালেন, শুধুমাত্র ঘটনা হিসেবেও যা আমাদের স্তম্ভিত করে।……
……সত্যবতী তবুও ভীষ্মকে তাঁর দুই বিধবা ভ্রাতৃবধুকে বিয়ে করে গর্ভবতী করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ভীষ্ম যে প্রস্তাব রাখলেন, তা আরও বৈপ্লবিক। একবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের নানান খণ্ডিত নীতিবােধের মধ্যেও যাকে স্থান দেওয়া কার্যত অসম্ভব।
ভীষ্ম বললেন, ‘অম্বিকা ও অম্বালিকা যদি বন্ধ্যা নারী না হয়, তবে তাদের গর্ভবতী করবার জন্য আর একটি সঙ্গত উপায় বর্তমান। আমরা একজন সক্ষম পুরুষের সন্ধান করতে পারি। তিনি ব্রাহ্মণ হলেই বেশি ভালাে নয়। তিনি বিদ্বান ও তেজসম্পন্ন পুরুষ হবেন। তার এই কাজের জন্য আমরা তাঁকে উপযুক্ত মূল্য দেব। | ভীষ্মের এই প্রস্তাবে সত্যবতী সমাধানের আলাে দেখতে পেলেন। তিনি স্মরণ করলেন তাঁর কুমারী অবস্থায় প্রাপ্ত পুত্র দ্বৈপায়নকে।….
……..দ্বৈপায়নের নিগেটিভ পয়েন্ট ছিল দুটো প্রথমত, তাঁর বয়স তখন অনেক। অম্বিকা ও অম্বালিকার কাছে তিনি তাে এক বৃদ্ধব্যক্তি, যদিও তাঁর যৌনক্ষমতা তখনও ঈর্ষনীয়। দ্বিতীয়ত, তার রূপ যে কোনও তরুণীকে স্বেচ্ছাসঙ্গমে নিষ্ক্রিয় করতে পারে। সে যাই হােক, মাতৃ আজ্ঞা পালন করতে দ্বৈপায়ন দুই স্বামীহারা ভ্রাতৃবধুর। সঙ্গেই সঙ্গম করেন এবং অনিবার্যভাবেই দুই যুবতী গর্ভবতী হন। কেবল তাই নয়। রাজবাড়ির এক যুবতী পরিচারিকাকেও তিনি গ্রহণ করেন, যার পরিণতিস্বরূপ বিদুরের জন্ম।……..
……পরপুরুষের ছোঁওয়া লাগলেই নারী অপরাধিনী হয়ে গেলেন—এইরকম একটা উদ্ভট গোঁড়ামির কথা মহাভারতীয় যুগের ভারতবর্ষ বা হেলেনের গ্রীসে কেউ ভাবতেও পারত না। হেলেন যে তাঁর বিবাহপূর্ব জীবনে একাধিক পুরুষের কাছ থেকে যৌনসুখ আদায় করে নিয়েছিলেন, তা উপলব্ধি করতে মুহুর্তগুলিকে আর কল্পনায় গড়ে নেবারও দরকার পড়ে না। অনুরূপভাবে সত্যবতী, কুন্তি প্রমুখ ‘সতীরা তাঁদের বিবাহপূর্ব জীবনে চুটিয়ে প্রেম করেছেন, সংসর্গে রত হয়েছেন, এমনকী পুত্রবতীও হয়েছেন। আর ‘পরমা সতীর শিরােপাপ্রাপ্ত দ্রৌপদীর তাে আবার পঞ্চস্বামী। পঞ্চস্বামীকে সমান প্রেম ও সােহাগ দেওয়া কী সম্ভব ? চতুর কৃষ্ণ ঠিক বুঝতেন দ্রৌপদীর মানসিকতা। পঞ্চস্বামীর মধ্যে অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর টান ছিল বেশি। আর পঞ্চস্বামীর মধ্যে ভীমই যেন ছিলেন দ্রৌপদীর প্রেমে সর্বাধিক প্রভাবিত ও দায়বদ্ধ। দ্রৌপদীর অপমানে ভীম যতটা ক্রুদ্ধ ও বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, অন্য চার পাণ্ডবদের মধ্যে সেরকম তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। যুধিষ্ঠিরের তাে নয়ই। তিনি তাে দ্রৌপদীকে নিছক এক পণ্যের পর্যায়ে টেনে নামান। আবার দ্রৌপদী যে পঞ্চস্বামীতেই তৃপ্ত, এরকমটি ভাবার অবকাশ কম। কারণ, পরবর্তীকালে দ্রৌপদী যখন শুনলেন যে কৰ্শ আদতে জন্মসূত্রে আর পাণ্ডব, তিনি মনে মনে কর্ণকেও কামনা করেছিলেন।………
…….অন্যদিকে হেলেনও প্যারিসের সুঠামদেহ ও উজ্জ্বল দুই চক্ষুর প্রভাবে বিচলিত। তাঁর বিবাহিত জীবনে স্বামীর প্রতি যে একনিষ্ঠ অনুরাগ ছিল, তা টাল খায়। তিনি নারী হিসেবে তাঁর যে জন্মগত নিজস্ব অধিবিদ্যা, তাকে কাজে লাগালেন। তাঁদের মধ্যে বাক্যবিনিময় হল। নিভৃতে ও নির্জনে। হেলেনের দেহ থেকে নির্গত নির্যাস প্যারিসকে এতই উত্তেজিত করে তােলে যে তিনি একসময় প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়েও হেলেনকে আলিঙ্গন করেন। তৎপরে ধর্ষণও করেন। অর্থাৎ হেলেন অতদূর যেতে অস্বীকৃত ছিলেন। প্যারিসকে বাধাও দিয়েছিলেন। এটা অবশ্য ঐতিহাসিক হেরােডেটাসের অভিমত। কবি সাইপ্রা [Cypria] কিন্তু বলেন, ঘটনাটা আদৌ ধর্ষনের অভিধা পেতে পারে না। কারণ প্যারিস ও হেলেন দুজনই এমন কামাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন তখন যে উভয়ই অত্যন্ত সক্রিয়তার সঙ্গে পরস্পর পরস্পরের দেহ থেকে চরম সুখ টেনে নেবার কাজে ব্রতী হন।…………