সুতনুকা একটি দেবদাসীর নাম – নারায়ণ সান্যাল

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  ›› ১৮+  

………‘দেবদাসী’ প্রথার মূলে প্রবেশ করতে হলে আমাদের জানা দরকার পতিতাবৃত্তি র আদিকথা। কারণ দেবদাসী বাস্তবিকপক্ষে পতিতারই এক শর্করামণ্ডিত সংস্করণ। এবং প্রসঙ্গত: দাসপ্রথা ; যেহেতু ‘দেবদাসী’ ঐ দাসপ্রথারও এক বিচিত্র রূপান্তর।

দাসপ্রথা এসেছে ইতিহাসের উষামুহুর্তে। মানুষ যেদিন শিকার ও ফলমূল আহরণ ছেড়ে জমি চাষ করতে শিখল, যাযাবরবৃত্তি ত্যাগ করে গড়ে তুলল জনপদ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাজপুরােহিত-তন্ত্র, তখন থেকেই দাসপ্রথার শুরু। বিজয়ী জনপদলপতি বিজিত রাজ্যের মানুষকে নিয়ােগ করলেন দাসরূপে-পুরুষকে বিনা পারিশ্রমিকে শ্ৰমদানে এবং নারীকে বিনা-প্রতিবাদে দেহদানে বাধ্য করা হল।…….

……..রাজার প্রাসাদে সর্বদা দেহদানে প্রস্তুত উপপত্নী, দাসী বা গণিকা অপ্রত্যাশিত নয়; কিন্তু মন্দিরে তারা এল কেমন করে? কেন? একটি সভ্যতায় নয়; প্রাচীনকালের প্রায় প্রত্যেকটি সভ্যতায়। আর চুড়ান্ত বিস্ময়–তারা পতিতা নয়!!

কারণ ‘পতিতা’ শব্দটার আভিধানিক অর্থ : অর্থের বিনিময়ে যে দেহদান ব্যবসায়ে লিপ্ত। এরা পতিতা নয় তিনটি যুক্তিতে। প্রথমত : এরা অর্থের বিনিময়ে মন্দিরে গিয়ে দেহদান করত না ; দ্বিতীয়ত : এরা সামাজিক বিধান মেনেই মন্দিরে সমবেত হত এবং সর্বোপরি, মন্দির থেকে দেহদান করে বেরিয়ে এসে এরা নির্বিবাদে সমাজে মিশে যেত কারও স্ত্রী, কারও বা মা হয়ে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করত। সর্বস্তরের স্ত্রীলােকই।

এই প্রাচীনতম প্রথার তিনটি প্রকারভেদ লক্ষ্য করা গেছে। প্রথম প্রথায়, যৌবনােদগমের পর কুমারী অবস্থায় তাদের মন্দিরে যেতে হত আদিরসের প্রথম পাঠ নিতে মাত্র এক রাতের জন্য। দ্বিতীয় প্রথায়, তাদের মন্দির চত্বরে বেশ কিছুদিন যৌনজীবনের আদি পাঠ নিয়ে অভ্যস্ত হতে হত কোথাও কয়েক সপ্তাহ, কোথাও বা কয়েক মাস। দুটি ক্ষেত্রেই মন্দির থেকে ফিরে এসে তারা বিবাহ করত, সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘরকরণা করত। কেউ আপত্তি করত না। …..আমাদের সমাজে, স্ত্রীকে কোনও গাইকলজিস্ট দিয়ে পরীক্ষা করানাে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ পরপুরুষে দেখেছে বলে কোন স্বামীই ক্ষুব্ধ হয় না, স্ত্রীও লজ্জায় মুখ লুকায় না। তৃতীয় প্রথায়, কুমারী মন্দিরে যায়, আর ফিরে আসে না। সারাজীবনের জন্য দেবদাসী হয়ে যায়।

প্রথম প্রথাটির প্রাচীনতম নিদর্শন হেরােডােটাস-এর বর্ণনায়। ব্যাবিলনের মিতিঙ্গামন্দির প্রসঙ্গে ইতিহাসকার লিপিবদ্ধ করেছেন— “ব্যাবিলােনীয়দের মধ্যে একটা লজ্জাকর প্রথা আছে। ব্যাবিলনের প্রতিটি রমণীকে জীবনে একবার অন্তত (রতি) মন্দিরে উপস্থিত হতে হবে এবং মন্দিরের অলিন্দে সার দিয়ে বসতে হবে। অজানা অচেনা পুরুষদল ঐ অলিন্দ দিয়ে পদচারণা করবার অবকাশে রমণীদের ভিতর এক একজনকে পছন্দ করে তার কোলে একটি রৌপ্যমুদ্রা ফেলে দেবে। কে দিল, তা ফিরে দেখবার অধিকার মেয়েটির নেই। যে তাকে পছন্দ করল তার হাত ধরে মেয়েটিকে চলে যেতে হবে মন্দির চত্বরের বাহিরে নিভৃত-নিকুঞ্জে। সেখানে সেই অপরিচিতকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমেই মেয়েটি রতিদেবীর প্রাপ্য অর্ঘ্য মিটিয়ে দেবে। তারপর সে ফিরে যাবে নিজের সংসারে—সংসারধর্ম করতে। ঐ প্রথম রাতের পর আর কোনভাবেই মেয়েটিকে সতীত্ব থেকে টলানাে যাবে না।

ঐতিহাসিক হেরােডােটা খােলাখুলি বলেননি ব্যাবিলনের রমণী কি কুমারী অবস্থায় রতি-মন্দিরে আসত, অথবা জীবনের যে কোন পর্যায়ে। কিন্তু ফিনিশীয় সভ্যতার হেলিওপােলিস-এর মন্দিরে সমবেত হত শুধুমাত্র অক্ষতযােনী কুমারীর দল : তারা তাদের কৌমার্যদান করে বিবাহিত জীৱন যাপনের অনুমতি লাভ করত। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব-উপকূলে সিরিয়ার রতি-মন্দিরে এই প্রথা দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগের প্রারম্ভে কনতাস্তাইন সেই রতি-মন্দিরটি ভূমিসাৎকরে সেখানে একটি গীর্জা নির্মাণ করিয়ে এ প্রথা আইনত রদ করিয়েছিলেন।

লিডিয়ার রতি-মন্দিরেও কুমারীবলির প্রথা বিদ্যমান ছিল— কিন্তু সেখানেও সেটা ছিল এক রজনীর দুঃস্বপ্ন।

কিন্তু আর্মেনিয়া অথবা পারস্যে একরাতে মজুরি মেটানাে যেতনা। হতভাগিনীদের প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল সেখানে দেবদাসীর ভূমিকায় বন্দিনী হয়ে থাকতে হত। একাধিক পুরুষ কর্তৃক দীর্ঘকাল ধর্ষিতা না হলে তার মুক্তি নেই! “সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি এবং রাজা-রাজড়ার দলও নিজ নিজ কন্যাকে ঐরতি-মন্দিরে প্রেরণ করতে বাধ্য ছিলেন। সেখানে একাধিক অপরিচিত পুরুষকে দেহদানে ধন্য করে স্ত্রীলােকেরা পুরােহিতের অনুমতিপত্র হাতে নিজ নিজ পরিবারে ফিরে আসতেন। বলা বাহুল্য, তাদের বিবাহ হত এবং ঐ দৈহিক দেবপূজার জন্যে কেউ তাদের ঘৃণার চোখে দেখতো না। 

সিরিয়ার তাজ-মন্দিরে ছিল এই প্রথার এক অদ্ভুত রকমফের। সেখানে এক লৌকিক দেবতার উপকথা আশ্রিত মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম ঘিরে একটা বাৎসরিক অনুষ্ঠান হত বসন্তকালে। উপকথার সারাংশটি এই রকম : পাতা ঝরার দিনে পৃথিবীর মৃত্যু হয় ;-‘Autum, a Drge’—দেব তাম্বুজ ভূতলশায়ী হন, তার বার্ষিক মৃত্যু হয়। কিন্তু তখনই ঘটে বসন্তের শুভাগমন। বিরলপত্র বৃক্ষে দেখা দেয় কিশলয়-ফলের বাহার অন্তরাল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। প্রেমের স্পর্শে মৃতদেহে হয় নবজীবনের সঞ্চার। মদনােৎসবের ঐ চিহ্নিত দিনে নাগরিকার দল সমবেত হয় মন্দির চত্বরে। তারা বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকে। তারপর কে যেন হেঁকে ওঠে : আম্মুজ জীবিত! ঐ তে তিনি। তাঁকে বুকে টেনে নাও–

রােদনক্লাস্তা রমণীর দল কান্না ভুলে ছুটে আসে ধরা দেয় অপেক্ষমান পুরুষদের কবাটবক্ষে। বাস্তবে সামাজিক শাসনকে বছরে একদিন শিথিল করা হয় মাত্র। এই উৎসবের একটি রকমফের মধ্যযুগের ভারতবর্ষের মদনােৎসবের মধ্যে বিধৃত হয়েছিল বলে শরদিন্দু বর্ণনা করেছেন ……….

………আফ্রিকার উত্তর উপকুলে ফিনিশীয় এবং কার্থে সভ্যতাতেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল। সেখানেও সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষ তাদের কন্যাদের (রতি) দেবীর মন্দিরে প্রেরণ করত। স্বামীর অঙ্কশায়িনী হবার পূর্বে তাদের হতে হত অজানা অযুত পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী।

আশা করা স্বাভাবিক যে, এই প্রথার কোন একটি উৎস ছিল এবং তা ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন  সভ্যতায় সংক্রামিত হয়েছে বণিক, পর্যটক, রাজপ্রতিনিধি বা দিগ্বিজয়ীদের কল্যাণে। কিন্তু এটাই যে ধ্রুব সত্য তা না-ও হতে পারে। কয়েকজন পণ্ডিত তর্ক দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, একই জাতের প্রথা বিভিন্ন সমাজে উন্নত হয়েছে পরস্পরের সাহায্য ছাড়াই—হয়তাে একই অলনি প্রেরণার উৎসমুখ থেকে। সে যুগের প্রতিটি সভ্যতাতেই আছেন এক-একজন প্রেমের দেবতা ও দেবী। শুধু প্রেমের নয়, রতিরঙ্গরসের! মদন ও রতি। ব্যাবিলনে তাম্ভূজ-ইশতার, গ্রীসে ডায়ােনিশা আফ্রোদিতে, রােমক সভ্যতায় ব্যাক্কাস-ভেনাস ।ঐ যৌন-তথা-মদিরা উৎসবের হেতু নির্ণয়ে, অর্থাৎ পরােক্ষভাবে দেবদাসীপ্রথার মূল কারণ নির্ণয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতবর্গের যুক্তিতর্ক ঘেঁটে আমি ছয়টি মৌল হেতুর সন্ধান পেয়েছি। তাদের আবার দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় :

১। ধর্মীয় প্রেরণা :

     ক. উর্বরতাচার
     খ. বলিদান প্রথা-ভিত্তিক
     গ. কুমারী-তত্ত্ব

২। সমাজনৈতিক প্রেরণা :

      ক. যৌথ যৌনাচারের উত্তরাধিকার
খ. আতিথেয়তার ফলশ্রুতি
      গ. পুরােহিত-তন্ত্রের ব্যভিচার

একে একে তোল করে দেখা যাক :

১। ধর্মীয় প্রেরণা :

ক. উর্বরতাচার : উর্বরতার বিষয়ে নানান লােকাচার সভ্যতার একেবারে আদিযুগ থেকে লক্ষ্য করা গেছে। লিঙ্গপূজা ও মাতৃতন্ত্র মানুষের আদিম ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। লিঙ্গ ও যােনি-প্রতীকী পােড়ামাটির নানান লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকেই পাওয়া গেছে কুল্লি, যােয়াব অথবা হড়প্পা সভ্যতায়।

প্রজননতন্ত্রের আদিম প্রেরণাটিকে মানুষ সঙ্গোপন করেছে। সেই গােপনীয়তার সঙ্গে অনিবার্যভাবে মিশ্রিত হয়েছে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা কৌতুহল। প্ৰকৃত্রি যা কিছু চমকপ্রদ তাতেই সে তখন দেবত্ব আরােপ করছে সূর্য-চন্দ্ৰ-পান-অগ্নি সবই দেবত্বমণ্ডিত। জীবজগতের সঙ্গে মনুষ্যসভ্যতার মোল পার্থক্য এই প্রজন-তবে যৌনক্রিয়াকে সঙ্গোপনে রাখার নির্দেশ। ফলে তাতেও আরােপ করা হল দেবত্ব। যেহেতু এ তত্ত্বের দ্বৈতস্বরূপ আবশ্যিক, তাই শুধু দেব নয় এলেন দেবীও। হড়প্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত প্রােটোশিব-এর বিবর্তনে এলেন গৌরীপটুবিধৃত শিবলিঙ্গ, অন্যান্য সভ্যতায় তাম্বুজ-ইশতার, ডায়ােনিশাস-আফ্রোদিতে, ব্যাক্কাস-ভেনাস। একজাতের পণ্ডিতের বক্তব্য—এই দেবদেবীর পূজার নৈবেদ্য হচ্ছে কুমারী নারীর আত্মদান। এ থেকেই এ প্রথার জন্ম। ……

খ. বলিদান প্রথা : …… স্ত্রীলােকে খাদ্যের বিনিময়ে যে দেহদান করত একথা আগেই বলা হয়েছে। এমনকি পুরুষ তার অধিকারভূক্ত নারীদেহ—স্ত্রী ও কন্যার দেহ খাদ্য সংগ্রহের প্রয়ােজনে বিনিময় পণ্য হিসাবে দেখত—অর্থাৎ যেযুগে স্ত্রী ও কন্যার সংজ্ঞা চিহ্নিত হয়েছে। হয়তাে সেই আদিম বিনিময়ের প্রেরণা থেকেই সভ্যতার উষাযুগে সুমেরীয়, মিশরীয়, আসিরীয় বা ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় মানুষ স্থির করেছিল, বংশরক্ষার প্রয়ােজনে দেবতার কাছে সন্তান প্রার্থনা করার পূর্বে বিনিময় প্রথায় দেবতাকে দিতে হবে স্ত্রী ও কন্যার দেহ।

গ. কুমারী-তত্ত : কোন কোন পণ্ডিতের মতে এই অদ্ভুত প্রথার প্রচলন গােষ্টিসচেতনতা থেকে। এক গােষ্ঠীভক্ত মানুষ যাতে পরস্পরের মধ্যে মারামারি না করতে পারে সে বিষয়ে গােষ্ঠীপত্তি তীক্ষ্ম দৃষ্টি! অন্তর্কলহের পরিণতি হিসাবে কেউ যদি স্বগােষ্ঠীর কারও রক্তপাত ঘটায় তবে তার কঠিন শাস্তি হত। এ কানুন অতি আদিম যুগ থেকে বহাল—যখন মানুষ প্রথম গােষ্ঠীভুক্ত হতে শিখছে, প্রতিদ্বন্দ্বী গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার পথ খুঁজছে।

সালমন রাইনাচ বলছে , নরনারীর প্রথম যৌনমিলনে নারীঅঙ্গের কিছুটা রক্তপাত অনিবার্য ; তাই মানুষ সেই আদিম যুগেই স্থির করল: স্বগােত্রের নরনারীর বিবাহ অবিধেয়। যদিচ এ রক্তপাত কলহ-দ্বন্দ্বের পরিণতি নয়, কোমলাঙ্গীর কাম্য, তবু বাহ্যত এ কাজ সহস্রাব্দীর ঐতিহ্যের পরিপন্থী। এ থেকেই স্বগােত্র বিবাহ হল নিষিদ্ধ।” স্বগােত্র ও স্বগােষ্ঠীর এই ধারণাটা ভিন্ন দেশকালে বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। 

কেউ কেউ হয়তাে বললেন, “বাপু হে, স্বজাতির মধ্যে বিবাহে তমাদের আপত্তি ঐ প্রথম রাত্রির রক্তপাতের জন্য তাে? বেশ তাে শুধু সেই টুকু দায়িত্ব ভিন্ন গােষ্ঠীভুক্তের কাউকে দিলেই হয়।” একদল পণ্ডিতের মতে এইটিই বিভিন্ন সভ্যতায় রতিমন্দিরে কুমারীকন্যাদের প্রেরণের প্রেরণা। অর্থাৎপ্রথম রক্তক্ষরণের অপরাধ ভিন্ন গােষ্ঠীভুক্তের ঋন্ধে চাপানাে। মার্কো পােলাে তার ভ্রমণবৃত্তান্তে একস্থলে মধ্য-এশিয়ার একটি বিচিত্র সম্প্রদায়ের কর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে পথপার্শের পান্থশালায় আশ্রয় পাওয়া বিদেশী পান্থকে সনির্বন্ধ অনুরােধ করা হত কিছু আঞ্চলিক সমস্যা মিটিয়ে দেবার জন্য। বিনিময়ে পথিককে দেওয়া হত বিনামূল্যে আহার, আশ্রয়, এমনকি পারিশ্রমিক। সমস্যাটা কী? স্থানীয় কিছু প্রাপ্তবয়স্কা কুমারীকে বিবাহের উপযুক্ত করে তােলা। হয়তাে সেই কুমারী মেয়েটি স্থানীয় কোন যুবকের প্রেমে পড়েছে, অথবা পাত্রপক্ষ কন্যাপক্ষ উভয়েই সম্মত হয়েছে কিন্তু যতদিন না কোনও ভিনদেশী পান্থ মিলনের প্রাথমিক অন্তরায়টা অপনােদিত করে দিচ্ছে ততদিন বিয়ের ফুল ফুটবে কী করে? গ্রাম বৃদ্ধদের সনির্বন্ধ অনুরােধ বেচারি পান্থ এড়াতে পারে না। একের পর এক কনে বাড়িতে যায় আর উদ্ভিন্নযৌবনা কুমারী কন্যাদের বিবাহের উপযুক্ত করে, রক্তপাতের অভিশাপ নিজ মাথায় ধারণ করে ফের পথে নামে। মার্কোপােলাে সখেদে বলেছেন: কখনও কখনও এজন্য পথিকের বিলম্ব হয়ে যেত, কারণ একই রাত্রে অতগুলি কুমারীকন্যাকে বিবাহের উপযুক্ত করে তােলার দৈহিক ক্ষমতা হয়তাে যাত্রীর নেই!

এই কুলাচারটি এক এক দেশে এক এক রূপ নিয়েছে। কোথাও নিয়মটা হয়েছে এই রকম রক্তপাতের সম্ভাবনা এবং মিলনপথের প্রথম বাধাটি অপসারণ করবে বর ভিন্ন বরযাত্রীদলের যে কোন যুবক। পশ্চিম আফ্রিকার এক আদিম আরণ্যক সম্প্রদায়ে যে বীভৎস প্রথাটি এযুগেও প্রচলিত তার বর্ননা দিচ্ছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী পর্যটক , বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ হলে কনে বরের ঘরে শুতে যেতে পারবে না। বরযাত্রীরা সকলে ধরাধরি করে নববধূকে চিত করে শুইয়ে দেবে এবং বর স্বয়ং তার দুই হাঁটু দিয়ে চেপে ধরবে কনের মাথাটা। বসবে তার শিয়রের দিকে হাঁটু গেড়ে, কনের দুই হাত মাটিতে চেপে ধরে। বরযাত্রী দলের প্রত্যেকটি পুরুষ অতঃপর উদ্দাম নৃত্যগীতের আসর জমাবে এবং একে একে ঐ নিরুপায় নববধূতে উপগত হবে। সব অনুষ্ঠান শেষে বর স্বয়ং অচৈতন্য উলঙ্গ নারীদেহটা উঠিয়ে নিয়ে যাবে।” 

এই টাবু’ বা কুসংস্কারের সুযােগ নিয়ে প্রচলিত হয়েছিল একটি ব্যাপক বীভৎস প্রথা: প্রথম রাত্রির অধিকার। সুযােগ নিয়েছিল, বলা বাহুল্য গােষ্ঠীপতি, পুরােহিত এবং ভূম্যধিকারীর দল। এ প্রথা মধ্যযুগেও বিভিন্ন তথাকথিত সভ্যসমাজে প্রচলিত ছিল— ফ্রান্সে, জার্মানিতে এবং ইংলন্ডে। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা অ্যাংগেন্স বলছে, ‘উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ কয়া যেতে পারে—আরাগানে এই কুলাচার সাম্প্রতিককালেও প্রচলিত ছিল। ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দে ফার্ডিনান্ড দ্য ক্যাথলিক আইন করে এই প্রথা রদ করেন। ……….

…… এই পূণ্যভূমি ভারতবর্ষের কোনও কোনও অঞ্চলে গ্রাম্য বিবাহ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলে নববধুকে নিয়ে বর উপস্থিত হত কর্তামশায়ের বাগান বাড়িতে—দেউড়ি পার করে দিয়ে নিশ্চূপ বসে থাকত খিড়কির দরজায়, প্রভাতের প্রতীক্ষায়। ভাের রাতে পাইকের পিছন পিছন খিড়কি দিয়ে মেয়েটি বেরিয়ে আসত ; কিম্বা সদর দরজাতেই কখনও বা কর্তামশাই স্বয়ং মেয়েটির হাত ধরে বেরিয়ে আসতেন। মদমত্ত কন্ঠে বলতেন, বেশ সুন্দর বউ হয়েছে রে তাের। ঘরে নিয়ে যা এবার। গুরুপ্রসাদী করে দিয়েছি।

২। সমাজনৈতিক প্রেরণা

ক. যৌথ যৌনাচারের উত্তরাধিকার : ……..প্রথম কল্পের শুরু পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর পূর্বে, মানুষ যখন নিয়েনডার্থাল পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হল; শেষ হয়েছিল–তীর-ধনুক আবিষ্কারের ক্রান্তিকালে। বর্বর যুগের প্রারম্ভ পােড়ামাটির তৈজস ব্যবহার থেকে, সমাপ্তি-লৌহ আবিষ্কারে। ঐ দুটি প্রথম-দ্বিতীয় কল্পে ‘বিবাহ’ বলে কোনও ধারণা ছিল না। সে সমাজে না ছিল কেউ বহু-পতিক, না কেউ বহু-পত্নিক। ……

………..আংগেলস এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “সমাজ সৃষ্টির উষাযুগে শ্রীলােক ছিল পুরুষের দাসী—এই ভ্রান্ত ধারণাটি অষ্টাদশ শতাব্দীর আলােক প্রাপ্তির কাল থেকে আমাদের মনে বদ্ধমূল হয়েছে। বাস্তুবে জংলী এবং বর্বরকলে স্ত্রীলােকেরা ছিল মুক্ত, স্বাধীন, এবং সম্মানীয়া।…বিবাহ প্রথা পুরুষের আমদানি নয়। পুরুষ কোনদিনই এটা চায়নি, চাইতে পারে না এমন কি আজকের দিনেও নয়। যৌথ অথবা গােষ্ঠীগত বিবাহে তার দৈহিক চাহিদা মিটত অথচ দায়িত্ব ছিল না কিছু। সমাজে বিবাহ অর্থাৎ জোড় বাঁধা দ্বৈত পরিবারের পরিকল্পনাটি স্ত্রী জাতীয়দের আবিষ্কার এবং তাদের পীড়াপীড়িতেই।”…….

খ. আতিথেয়তার ফলশ্রুতি : কোন কোন পণ্ডিতের মতে রতিমন্দিরে কুমারী বলির প্রচলন হয়েছে আতিথেয়তার ধারণার সম্প্রসারণে। তাঁরা বলেন, বিদেশী অতিথি বণিক ব্যবসায়ী, রাজপ্রতিনিধিদের আশ্রয় দেওয়া হত মন্দির সংলগ্ন পান্থশালায়। তাদের আহার, পানীয় এবং স্বাচ্ছন্দ্যের দাবী মেটানাের দায় নগরবাসীর। কিন্তু বিদেশী পান্থ কি শুধু আহার্য আশ্রয়েই ছেড়ে-আসা গৃহের সুখসুবিধা পেতে পারে? তার প্রােষিতভর্তৃকা স্ত্রীর বিকল্প হিসাবে প্রয়ােজন একটি সাময়িক শয্যাসঙ্গিনীর।

আমার মনে হয়েছে, এ থিয়ােরিটা গ্রাহ্য হতে পারে না। ……..অর্থমূল্যে পতিতালয় থেকে উপাদান সংগ্রহকালে অথবা অন্তঃপুরে সঞ্চিত উপপত্নীদের কাউকে অতিথি সৎকারমানসে পাঠাতেন।

গ. পুরােহিত-তন্ত্রের ব্যভিচার : অপর একদল পণ্ডিতের মতে প্রথম রজনীর অধিকার করায়ত্ত করার পর পুরােহিতরা  নিজেরাই এই ব্যবস্থাটি কায়েম করেছিল নিজেদের রিরংসা অব্যাহত রাখতে এই মতামতটা মেনে নেওয়া চলেনা একই হেতুতে অর্থাৎ সেক্ষেত্রে নগর-নৃপতি এবং প্রধান পুরােহিত নিজ নিজ কুমারীকন্যার সতীচ্ছদ ছিন্ন করবার এই বর্বর ব্যবস্থায় নিশ্চয় সায় দিলে না।  …….

……….মন্দির পরিভাষায় দেখছি দেবদাসীদের ছয়টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে:

বিক্রিতা— অর্থের বিনিময়ে মন্দির কর্তৃপক্ষ যখন কোন কুমারীকে ক্রয় করেন তখন সে বিক্রীতা দেবদাসীরূপে গণ্য হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা অত্যন্ত গরীব সম্প্রদায়ের সুন্দরী বালিকা। একাধিকন্যার পিতা সব কয়টি আত্মাকে পাত্রস্থ করতে পারবে না আশঙ্কা করে দু-একটিকে তুলে দিত পুরােহিতদের হাতে। দেবদাসীর গর্ভজাতা কন্যাও এই দলভূক্ত ; মা যেহেতু দাসী, তাই তার কন্যাও তাই। বালিকাবয়স থেকে তাকে নানান বিদ্যা ও কলায় পারঙ্গম করে তােলা হত, নৃত্য, গীত, অক্ষর-পরিচয়, কাব্য, পুস্পচর্চা, আলিম্পন বিদ্যা ইত্যাদি। মন্দিরের প্রধান দেবদাসীর তত্ত্বাবধানে তারা ধীরে ধীরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়–…… রজোদর্শনের পর প্রধান পুরােহিতের নির্দেশ অনুসারে কিশাের মেয়েটির অভিষেক হয়। অর্থাৎ কোন এক পুণ্য লগ্নে তার বিবাহ হয় বর কখনাে দেববিগ্রহ স্বয়ং, কখনাে বা তার কোন প্রতীক–ত্রিশল, চক্র বা তরবারি। সেই রাত্রেই মেয়েটির ফুলশেষ রচিত হয়। মন্দির পুরােহিত স্বয়ং অথবা তার নির্দেশে কোন অধীনস্থ কর্মচারী নবাগতার কৌমার্য হরণ করে তাকে পরিপূর্ণ দেবদাসীতে রূপান্তরিত করে। সেই রাত্রি থেকে মেয়েটি হয়ে যায় আজীবনের জন্য দেবদাসী।

ভৃত্যা—এরা মূলত পরিচারিকা। মন্দিরের যাবতীয় মেয়েলি কাজ-ঝাড়া মােছা, মন্দির-প্রকা, তৈজসপত্র পরিষ্কার রাখা, নৈবেদ্য ও ভােগ প্রস্তুত করা, চন্দনবাটা, পস্পচয়ন ইত্যাদি কাজের জন্য এদের প্রয়ােজন। শ্রেণীগতভাবে এরা অপর দলের চেয়ে নিচে। অবশ্য যৌবন থাকলে তাদের দেহদানকার্যও কর্তব্যভুক্ত। নৃত্যগীতের আসরে এরা উপস্থিত থাকলেও প্রায়শ অংশ গ্রহণ করত না।

ভক্তা-স্বেচ্ছায় যখন কোন রমণী কুমারী অথবা স্বামীত্যক্তা, মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে দেবদাসী হতে চায় তখন সে ভক্তা’। এক্ষেত্রে মূল প্রেরণা ভক্তি। এঁরা অনেকে অতি উচ্চ শ্রেণী থেকে আসতেন আর্থিক ও সামাজিক বিচারে। মধ্যযুগে ইউরােপের রােমান ক্যাথলিক চার্চের নান’ বা সন্নাসিনীদের সঙ্গে এদের তুলনা করা যায়। এরা পর-পুরুষকে দেহদানে বাধ্য থাকতেন না। এদের প্রসঙ্গেই আনি বেসান্ট লিখেছিলেন, “প্রাচীন হিন্দুমন্দিরে এক শ্রেণীর পূত চিরকুমারী সেবারতা থাকলে তাদের বলা হয় দেবদাসী। তাঁরা সন্ন্যাসিনী, জিতেন্দ্রিয় এবং ঈশ্বরেই কায়মনঅন্তরাত্মা সমর্পণ করতে।” চিতাের-মহিষী মীরাবাঈ ভক্ত শ্রেণীর এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। যদিও তিনি কোনও সাধারণ মন্দিরে বসবাস করেননি, তবু তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন—দেবদাসী।

দত্তা: ‘ভক্তা’ শ্রেণীর সঙ্গে দাত্তা’র পার্থক্য দু-জাতের। প্রথম কথা, ভক্তা শ্রেণীর মৌল প্রেরণা ভক্তি ; অপরপক্ষে ‘দত্তা’র প্রেরণা দু-জাতের হতে পাবে। অন্ধ বিশাস অথবা আত্মরক্ষা। দ্বিতীয় কথা, ভক্তা-শ্রেণীর সন্ন্যাসিনী ঐহিক অর্থে দৈহিক মিলনে বাধ্য নয়; অপরপক্ষে দত্ত শ্রেণীর দেবদাসীকে মন্দির পুরােহিত অথবা পৃষ্টপােষক অতিথিদের দৈহিকঅর্থে সন্তুষ্ট করতে হত। আর একটু বিস্তার করে বলা যেতে পারে : কোনও পুণ্যলােভী গৃহ মনস্কামনা চরিতার্থ করতে, মানত রাখতে, স্বেচ্ছায় কন্যাকে মন্দিরে দান করতে পারে। এটা অন্ধ বিশ্বাস। অভিভাবক অনেক ক্ষেত্রে পিতামাতাও। ………

হ্রূতা—এদের সম্বন্ধে মন্দির-সাহিত্য স্বতই স্বল্পভাব—হেতুটা সহজবােধ্য।নামকরণ থেকেই বােঝা যায় আইন ফাঁকে এদের অপহরণ করে আনাহত। নিরুদ্দিষ্টা মেয়েটির সন্ধান পেত না সে অঞ্চলের নগর কোটাল। বহু দূর দেশে মন্দিরের অন্ধকূপে বন্দিনীরূপে সে জীবন অতিবাহিত করত।

অলঙ্কারা: নামেই তাদের পরিচয়। এক মন্দিরে একজন। মন্দিরের মুকুটমণি। নৃত্য গীতাদি চৌষট্টিকলায় এরা পারদর্শিনী—অপূর্ব রূপবতী। অন্যান্য শ্রেণীর নামকরণের মধ্যে তাদের সংগ্রহকারে ইঙ্গিত আছে, অলঙ্কারা-শ্রেণীর দেবদাসীর তা নেই। বস্তুত যেকোনও শ্রেণীর দেবদাসীই এই শীর্ষ পদে উন্নীত হতে পারে–রূপ ও গুণের মাপকাঠিতে মন্দিরের দেবদাসীদের সে হচ্ছে রানী। সকলে তার আদেশ মেনে চলতে বাধ্য। শিবমন্দিরে তার নাম ‘গণিকা, সম্বােধনে রূদ্রাণি ; বৈষ্ণব মন্দিরে তার নাম গােপিকা’। দেবদাসীর আমলাতন্ত্রের সােপানে যদিচ ‘অলঙ্কারা’র স্থান সবার উপরে……..

……………..বুদ্ধদেবের সমকালে পাচ্ছি আর একজন রাজনটীকে, আম্রপালীকে। বৈশালী নগরীর জনপদকল্যাণীকে। আম্রপালীর জন্ম নিয়ে নানান কিংবদন্তী। বিনয় পিটক অনুসারে আম্রপালী স্বয়ম্ভু। বৈশালী নগরী তখন লিচ্ছবীদের রাজধানী। লিচ্ছবীরাজ মহানামের একটি সুবৃহৎ আম্রকাননে আম্রপালী পূর্ণযৌবনারূপে জন্মগ্রহণ করেন। জ্যোতিষাচার্যের নির্দেশে মহারাজ মহানাম সেই অযোনিসম্ভবার সন্ধানে নির্গত হন এবং আম্রকাননে তার সন্ধান পান। সকল কলাপারঙ্গম এই সুতানুকাকে দেখে সকলেই মােহিত। কৌঞ্চ, শাক, মগধী ও লিচ্ছবীবংশীয় সকল রাজা এবং রাজপুত্রেরা এই অবিশ্বাস্য আবিষ্কারে মুগ্ধ সকলেই তাকে বিবাহ করতে উৎসুক। মহানাম প্রমাদ গণলেন। অযুত পাণিপ্রার্থীর ভিন্ন মাত্র একজনকেই সন্তুষ্ট করা সম্ভব বাকি সকলেই হয়ে যাবে তাঁর শত্রু। অগতা মহারাজ ‘গণ’-এর শরণ নিলেন। গণ হচ্ছে সিটি কাউন্সেল’ – নগর প্রধানদের পঞ্চায়েত। গণ বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে এলেন এই অনিৰ্ভব’ সুতনুকা ব্যক্তি বিশেষের অঙ্কশায়িনী হতে পারেনা—সে হবে বৈশালীর জনপদকল্যাণী ; সর্বজনভােগ্যা প্ৰধানা নটী।

গণ-এর সিদ্ধান্ত অতঃপর জ্ঞাপন করা হল আম্রপালীকে। সে সহাস্যে বলল, আপনাদের এই বিচার আমি শিরােধার্য করতে স্বীকৃত ;কিন্তু বিনিময়ে আপনাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। শর্তসাপেক্ষে আমি স্বাভাবিক পুরস্ত্রীর জীবন বিসর্জন দিতে স্বীকৃত।

—কী শর্ত?

-প্রথম শর্ত: নগরীর কেন্দ্রস্থলে নির্মিত হবে আমার প্রাসাদ, রাজপ্রাসাদের সমতুল্য।

গণ এ শর্ত এককথায় মেনে নিলেন। জনপদকল্যাণী মহারাজার সমমর্যাদাসম্পন্না, ফার্স্টলেডি। দ্বিতীয় শর্তটিও ওঁরা মেনে নিলেন প্রতিটি অতিধি আমাকে প্রতি রাত্রের জন্য পাঁচশত কার্ষাপণ সম্মানমূল্য দিতে বাধ্য থাকবে এবং একজন অতিথি বিদায় নিলে দ্বিতীয় জনকে আমার প্রাসাদে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে।

কিন্তু তৃতীয় শর্তটি কী?

—প্রাসাদে আমার স্বনিযুক্ত প্রহরী ও সহচরী থাকবে। প্রাসাদ অভ্যন্তরে আমার আইনই প্রযােজ্যগণ-এর কোনও এক্তিয়ার থাকবে না।

—তা কেমন করে সম্ভব? তােমার প্রাসাদে যদি কোনও অতিথি নিহত হয়? আমরা তদন্ত করে দেখতে পারব না?

পারবেন। কিন্তু আমাকে পূর্বেই জানাবেন। আমার সম্মতিসাপেক্ষে তদন্ত হবে। অভিযােগ দাখিলের পর অন্তত সপ্ত দিবস অতিক্রান্ত হলে।

কঠিন শর্ত। কিন্তু গণ এটি মেনে নিতে বাধ্য হলেন। কারণ আম্রপালী জানিয়েছিলেন সে যেমন স্বয়ম্ভু, তেমনি স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারিণী। দেব-অংশে তার আবির্ভাব শাপভ্রষ্টা সে, গণ এ শর্ত মেনে না নিলে সে আত্মবিলুপ্তিতে বাধ্য হবে। গণ-এর ইচ্ছা ছিল না এ শর্ত স্বীকার করতে কিন্তু কামনাজর্জর লিচ্ছবী নাগরিকদের পীড়াপীড়িতে এ শর্তটিও স্বীকৃত হল।।

আম্রপালী হল বৈশালীর শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ বস্তুত সমগ্র আর্যাবর্তের শ্রেষ্ঠ নারীরত্ব! প্রতি রজনীতে পাঁচশত কার্ষাপণ দক্ষিণা নিয়ে অচিরে সেই ধনি হয়ে উঠল বৈশালীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী।………

……….পুণ্ডরীক স্বনামধন্য মাগধী বণিক। কার্যোপলক্ষে সে প্রায়ই যায় বৈশালীতে। একাধিক রজনী সে যাপন করেছে আম্রপালীর প্রাসাদে। পুণ্ডরীক মহারাজের বয়সস্থানীয়। তাই সেবার ফিরে এসে সে অকুণ্ঠভাবে বলেছিল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে মগধ সম্রাট করেননি, করেছে সামান্য মাগধী বণিক। সম্রাট সকৌতুকে বলেছিলেন, এ কথা হঠাৎ মনে হল কেন পুণ্ডরীক?
—নিজ অভিরতা নেই মহারাজ, শুনেছি সিংহাসনের গদি খুব আরামদায়ক। কিন্তু আম্রপালীর উপাধানের চেয়ে নয় বােধ করি।
—আম্রপালীর শয্যার উপাধান এই কামদার?

—আজ্ঞে না। তার পীবর-বক্ষের যুগল উপাধানের কথা বলছি, মহারাজ। ……..

……….

অলঙ্কারা একজনই, তিনি রুদ্রাণী। দীর্ঘ বিংশবির্ষ পূর্বে লাজহরণ নৃত্যে অভিষেক-অন্তে তিনি ঐ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অভিষেক রাত্রে সর্বালঙ্কারে ভূষিতা যােড়শী উপস্থিত হয় নাটমন্দিরে, একবস্ত্রে। তার কণ্ঠে একটি অনতিদীর্ঘ শ্বেতমালিকা লাজমালিকা’ শুধু খই দিয়ে গাঁথা। এবং অলঙ্কারের যতই বাহুল্য থাক, সেই বিশেষ রাত্রে সে একবস্ত্রা। দর্শকসমাকীর্ণ নাটমন্দিরে ঐ একবস্ত্রে নর্তকীকে মৃদঙ্গের তালে তালে নাচতে হবে ; তার দেহসুষমা বিকশিত হবে, কিন্তু প্রকাশিত হয়ে পড়বে না। সে বড় কঠিন নৃত্য! তেহাই-এর তালে তালে দ্রুত বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাকে নাচতে হবে; আস্বচ্ছ রক্তচিনাংশুকের ভিতর দিয়ে তার প্রতিটি প্রত্যঙ্গের হিন্দোল শুধু আভাসে-ইঙ্গিতে অনুভূত হবে। তার যৌবন শুধু বিকশিত হবে, প্রকটিত হবে না। তারপর শেষ-সমের মাথায় যখন মৃদঙ্গ ধা’ বলবে, তখন সে লুটিয়ে পড়বে সাষ্টাঙ্গে। প্রণতি জানাবে দেবাদিদেবকে, প্রধান পুরােহিতকে, দর্শকদের। স্বেদাত নর্তকী অতঃপর ধীর পদে উঠে যাবে গর্ভগৃহে নিজ কণ্ঠের লাজমালিকা পরিয়ে দেবে শিবলিঙ্গে। তারপর রুদ্ধ করে দেবে দ্বারগর্ভগৃহ এবং অন্তরালের মধ্যবর্তী কবাট। বেরিয়ে আসবে একটি কাকন পরা হাত—তাতে তার শেষ লজ্জা!

প্রধান পুরােহিতের নির্দেশে সেই রক্তচীনাশুকের অঞ্চলটি কর্তন করে তা দিয়ে একটি নিশান নির্মিত হবে। মন্দিরের বেতনভুক একঅন্ধ সেই নিশানটি নিয়ে উঠে যাবে বিমানশীর্ষে। বাঢ়-গণ্ডী-মস্তক পার হয়ে, পাপুরি-আমলক ঘণ্টা উত্তরণে উপনীত হবে মন্দির-শীর্ষে। নিশানটিকে অনুবিদ্ধ করবে ধ্বজাদণ্ডে।

চীনাংশুকের খণ্ডবিখণ্ড দর্শকেরা সংগ্রহ করবে পুণ্যস্মৃতি হিসাবে। মাদুলি বন্ধনের উপযুক্ত সেই বস্ত্রখণ্ড। যাত্রী ও দর্শকুল বিদায় হলে প্রধান পুরােহিত একাকী ফিরে আসনে মন্দিরে। সমগ্র মন্দির-চত্বর তখন নিস্তব্ধ। অন্তরালের এ প্রান্তে দাড়িয়ে প্রধান পুরােহিত আহ্বান করবেন: তােমার নৃত্যপূজায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি রুদ্ৰাণি ধার খােল।

দ্বার খুলে যাবে। ঘৃত প্রদীপের স্তিমিত আলােকে নিরাবরণা দেবদাসী তার কৌমার্যের পশরাটুকু সম্বল করে নির্গত হয়ে আসবে অভিষিক্ত হতে।

যতদিন ধ্বজাদণ্ডে ঐ নিশানটি অক্ষত থাকবে, ততদিন রুদ্রাণীই থাকবে মন্দিরের অলঙ্কার। তারপর বছরে বছরে যেন সেই প্রধান দেবদাসীর যৌবন তিল তিল করে ক্ষয়িত হবে, তেমনি বছরে বছরে জীর্ণ হতে থাকবে কলসদণ্ডের সেই ধ্বজানিশান।

এরপর একদিন! কালবৈশাখীর প্রচণ্ড ঝঞ্জারাতে মহাকাল স্পষ্ট নির্দেশ দেবেন রুদ্রাণীর অবসর গ্রহণের কাল সমাগত।ঝড়ঝঞ্জার অবসানে সকলে অবাকহয়ে দেখবে নিশানটি অপহৃত। রুদ্রাণীর কাল শেষ। শেষনৃত্যে একবার প্রণতি জানিয়ে সে বিদায় নেবে। এগিয়ে আসবে নতুন কালের নতুন রুদ্রাণী। সালঙ্কারা। একবস্ত্রা। কণ্ঠে দুগ্ধশুভ্র লাজমালিকা। লাজহরণ নৃত্যের নতুন নর্তকী…………..

 

………….শ্রেষ্ঠভাস্কর রৌদারকথা বলি। ওঁর চেয়ে আটত্রিশ বছরের ছোট বিশবন্দিত মার্কিন নৃত্যশিল্পী তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন রোদ্যার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের একটি ঘটনা। একটি গ্রীক নৃত্য দর্শনাস্তে কাবাস পরিহিত ইসাভােরা ডানকান (১৮৭৮-১৯২৭) রােদ্যাঁকে ঐ ক্লাসিকাল নৃত্যের অনিহিত ব্যনাট বুঝিয়ে দিচ্ছেন “হঠাৎ আমার মনে হল রোদ্যা আমার কথা শুনছে না। তার অধরের নিম্নাংশ ঝুলে পড়েছে তার চোখে আগুনের হাল্কা। তিনি যেন অন্যজগতের মানুষ। আমার কাছে তিনি এগিয়ে এলেন। নিঃশব্দে আমার আস্বচ্ছ বেশবাসের উপর দিয়েই সর্বাঙ্গে হাত বুলাতে থাকে কাধে, স্তনে, হাতে, নিতম্বে, জানুদ্বয়ে এবং পায়ে। হঠাৎ আমাকে দুইহাতে পিষ্ট করতে চাইলেন—যেন আমি একটা কাদার তাল! তাঁর সর্বাঙ্গ থেকে তখন উত্তাপ নির্গত হচ্ছে। আমার ইচ্ছা হল—সেই উত্তাপে মােমের মত গলে যেতে। কিন্তু আজন্মের সংস্কার আমাকে ইচ্ছাপূরণে বাধা দিল। আমি হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলাম। দ্রুতহস্তে জামা কাপড়গুলাে টেনে নিয়ে বললাম, আপনি চলে যান।………..

……….আমাকে মার্জনা করবেন। আমার বিশ্বাস, ঐ দেবদাসী নামক কুপ্রথাটি যদি ভারতবর্ষে চালু না থাকত তাহলে এই ভারত ভূখণ্ডের অযুত-নিযুত মন্দিরে ঐ অনিন্দ্যকান্তি রমণীমূর্তিগুলিকেও আমরা পেতাম না। ঐ নাগরদোলায় দোলায়িত ঘৃণ্য নরকের কীটগুলিই ছিল যুগে যুগে ভারতীয় ভাস্করদলের স্টার অব বেহেম।……..

…………একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই পীনােদ্ধত যুবতীবৃন্দের অপরূপ দেহসৌষ্ঠব অথবা বেশভূষাই শুধু নয়, ভাবব্যঞ্জনাতেও প্রতিটি মূর্তি আর সকলের থেকে পৃথক। ধরা যাক প্রথম পােতালের পূর্বমুখী নায়িকাটিকে। ফুঁ দিতে গিয়ে ওর গালটা একটু ফুলেছে। অল্পবয়স, মনে হয় পঞ্চদশী। এখনও যেন কিশােরী। ও-যেন দুনিয়াদারীর অনেক কিছুই বােঝে না তাই এখানে সুলুকার হাসিটি অমলিন।

এবার ঠিক উপরের ধাপে, অর্থাৎ দ্বিতীয় পােতালের পূর্বমুখী মেয়েটিকে দেখুন। সে মৃদঙ্গ বাজাচ্ছে পােলের দীনতম প্রান্তে। এখানে সজনা পঞ্চদশী নয়—সে পূর্ণযৌবনা। ভাদ্রের ভরা গাঙের মতাে তার যৌবন টলমল টলমল। কিন্তু কি জানি কেন মনে হল ও বিষাদখিন্ন- সহস্রাক্ষের আদেশ অনুসারে কর্তব্যকর্ম করে যাচ্ছে বটে, কিন্তু মনে মনে সে কিছু একটা ভাবছে।……….

Leave a Reply