অনুবাদঃ জীমত কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়
উৎসঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আদি-রসের গল্প
সম্পাদনাঃ সুকান্ত সেনগুপ্ত
বাড়িতে বসে লক্ষ্য করলাম আমার প্রিয় কোতিস মাংস কুচোছে তার মনিব ও মনিব পত্নীর খাবারের ঝােল বানাবার জন্য। খাবারের আলমারিতে সাজানাে রয়েছে নানা রকমের মদ। আমার নাকে যেন গন্ধ পেলম মাংসের তৈরি উপাদেয় খাবারের।
কোতিসের শরীরের মাঝবরাবর ছিল একটাসাদা পরিস্কার অ্যাপ্রণ বা পরিধেয় আবরণী। তার স্তনদেশের নিচ থেকে গােটা শরীরটাকে বেষ্টন করে ছিল একখণ্ড লাল রেশমের পট্টি। সে তার শুভ্র সুন্দর দুহাতে রান্নার পাত্র ও তার ভেতরকার মাংস এভাবে নাড়াচাড়া করছিল যে আমার দেখতে ভারি ভাল লাগছিল।
এসব জিনিস যখন আমার চোখে পড়ল আমি কেমন যেন বিস্ময়াভিভূত হলাম। আর দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই ভাবতে লাগলাম। ক্রমে ক্রমে মনে আমার সাহস ফিরে এল। যা আগে ছিল না। আমি কোতিসের সঙ্গে সাধারণ ভাবেই কথাবার্তা বলতে লাগলাম। বললাম, ওগাে কোতিস। কি সুন্দর গােছানো ভাবেই না তুমি রান্নার পাত্রটা নাড়াচাড়া করছে। আর তােমার ঝােল তৈরির কায়দাটাই বা কত সুন্দর। ও ধন্য সেই ব্যক্তি। যে শুধু সুখী নয় ডবল সুখী, যাকে তুমি কেবলমাত্র ছয়ে দেখবার অনুমতি দাও। প্রশ্রয় দাও। | কোতিসও কম যায় না। সেও সমান সেয়ানা। কাজেই জবাব দিল- যা ভাগ আমার সামনে থেকে হতভাগা, আমার আগুনের আচ থেকে বাঁচতে চাস তাে। কারণ যত কম তেজই তার থাকনা কেন তাের মতন লােককে পুড়িয়ে ছাই করবার ক্ষমতা তার কাছে। আর সে আগুন আমি ছাড়া আর কেউ নেবাতেও পারে না।
এইসব কথাগুলাে বলবার সময় সে তার দুচোখের দৃষ্টি আমার ওপর মেলে ধরেছিল আর হাসছিল। কিন্তু আমি সেখান থেকে নড়লাম না যতক্ষণ না তার পুর্ণাবয়ব আমার সম্পূর্ণ নয়নগােচর হয়েছে। কিন্তু অন্যে পরে কা কথা, অপরের কথা কি বলব, বিদেশে থাকাকালীন আমি রপ্ত হয়েছি প্রতিটি তরুণকন্যার মুখে ও কেশরাজি লক্ষ্য করে দেখতে ও পরে নিজগৃহের নিভৃতে মনে মনে তা নিয়ে নিজে মনোরঞ্জন করতে। সেই ভাবে তাদের আকার প্রকারে স্মৃতির অবশিষ্টাংশটুকু নিজের মনে মনে যাচাই করে করে দেখতাম। কারণ মুখেই হচ্ছে মানুষের শরীরের সেই প্রধানতম অংশ যা আমাদের চোখের সামনে সর্বপ্রথম প্রকটিত। জমকালাে চটকদারী পােষাকের যা ভুমিকা নারীর শরীরের সৌন্দর্য বিধানের, মুখেরও অবিকল তাই। যা নারীকে স্বাভাবিক এক কমনীয় মধুর সৌন্দর্য দান করে। এমন কেউ কেউ আছে যারা তাদের অবয়বের লালিত্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে দেহের নানা অলংকারপকণ্ঠাভরণ, বহুমূল্য বেশবাস শিরােভষণাদি অনায়াসে পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত তাদের নিজ নিজ নিরাবরণ দেহের সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। বস্তুত তারা নগ্ন গাত্র চর্মের শুভ্রতা জ্বাহির করতে যত আনন্দ পায় সােনা ও জোড়ায় অলঙ্কারে সজ্জিত হতে ততটা না। কিন্তু যেহেতু আমার বক্তব্যকে সুপরিস্ফুট করতে কোন বাস্তব উদাহরণ না দেওয়া আমার পক্ষে পাপতুল্য, তাই বলছি, যদি আপনি মেয়েছেলের মাথার চুল কেটে বা নষ্ট করে ফেলেন বা তার মুখের চামড়ার স্বাভাবিক রঙ নষ্ট করে দেন তবে সেই নারী কখনো অত্যধিক সুন্দরী বলে বিবেচিত হয়ে থাকুক আর না থাকুক, সে সাক্ষাৎ স্বর্গভ্রস্টা অপ্সরীই হােক, সমুদ্রকন্যাই হােক বা স্বয়ং প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী ভেনাস বা রতিদেবীই হােক, যাবতীয় সলিতা সখীবৃন্দদ্বারা পরিবেষ্টিতই হোক আর মদনদেবের সভাসদ বন্দিতাই হােক, তার মনােরম প্রেমউত্তরীয় দ্বারা আবেষ্টিতই হোক অথবা সুগন্ধি ও মৃগনাভি চার্চীতাই হােক তথাপি যদি সে কেশহীন মণ্ডিত মস্তকে আবিভূতা হয় হবে অন্যে পরে কা কথা তার নিজের একান্ত নাগরকেও সন্তুষ্ট করতে পারবে না।
ওই চকচকে চুলের সঙ্গে ফর্সা রঙ ও উজল মুখে কি চমৎকারই না মানায়। লক্ষ্য করে দেখুন, এ চুল সুর্য কিরণের মােকাবেলা করে চোখকে দারুণ তৃপ্ত করে। কখনাে কখনাে ফুলের সৌন্দর্য সােনা ও মধুর রঙের সঙ্গে বেমালুম মিল খেয়ে যায়। কখনাে বা তার দুপাখীর গলার নীল ঝু’টি ও চওড়া পালকের রঙের সাদৃশ পায়। বিশেষ করে যখন তাকে হয় আরবী আরকে চাচত করা হয় নয়তো সুক্ষ চিরুণীর দাঁতের সাহায্যে ছিমছাম ছাদে চুড়োকরে বাঁধা হয়। সেই অবস্থায় যখন ঘাড়ের পেছনে বাধা হয় তখন প্রেমিকের চোখে, যে প্রেমিক দুচোখ ভরে দেখবে তার প্রিয়ার এ হেন কেশ সৌন্দর্য মনে হবে কোন কাঁচের মত যা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে এক অনাবিল মনােরম লালিত্য সুষমা যা, মেয়েটির দুকদের ওপর চুল ছড়িয়ে থাকলে কিম্বা যা পিঠ বেয়ে চুল নামলে দেখা যেত কিনা সন্দেহ। সর্বোপরি, চুলের এমন একটি গরিমা আছে যে কেশধারিণীর পরিচয় যাই হােক, কেশধারিণী যত স্বর্ণালঙ্কার, রেশম, মণিমুক্তো ও অন্য মুল্যবান ও জাকজমকপণ ভষণ অলঙ্কারেই ভূষিতা হোক না কেন, তার কেশ সজ্জা যদি না হয় মনােহারী তবে তাকে আদপেই সুন্দর দেখাবে না।
কিন্তু আমার কোতিসের ব্যাপারই আলাদা। বসন উন্মােচিত ও বন্ধনমুক্ত অবস্থায় ওর সৌন্দর্য বাড়ল বই কমল না। ওর মাথার চুল কাধ ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে ওর কণ্ঠাভরণ অঙ্গাবরণের ওপর তার মনােরম গ্রীবার প্রতিটি অংশে—যদিও চুলের বেশির ভাগ অংশই তার ঘাড়ের পেছনে ফিতের সাহায্যে ঝুটি করে বাধা আছে। অতঃপর আমি যে ঝলসনাে গরমের মধ্যে ছিলাম, তা আর সহ্য করতে না পেরে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার ওপর এবং যেখানটাতে সে তার চুলের ঝুটি পবেক্তি ভাবে ন্যস্ত করেছিল, সেখানটাতে চুমু খেলাম। এতে সে মুখ ফেরাল, তার ঘরস্ত চোখদুটো আমার ওপর ন্যস্ত করে বলল, ওহে পণ্ডিতবর, আপনি এখন তাে মধু ও গরল উভয়েরই আবাদ নিলেন ; খেয়াল রাখবেন আপনার আনন্দ যেন অনুশােচনায় পরিণত না হয়।
ধ্যস, (আমি বললাম) প্রিয়ামাের, আমি আরাে তৃপ্ত হই যদি এরকম আরেকটা চুম্বন এই আগুনে ঝলসে নিতে পাই। বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে আরাে বেশিকরে বার বার চুম্বন দিতে লাগলাম, আর সেও আমাকে অনুরুপভাবে আলিঙ্গন ও চুম্বন দান করতে লাগল। তার নিঃশ্বাসের গন্ধ দারচিনির মত লাগল। আর তার জিহবার তরলে যেন সুমিষ্ট অমৃতের স্বাদ। এতে আমার মন যারপর নাই অহদিত। আমি বললাম, দেখ কোতিস আমি তোমারই। যদি আমায় কৃপা না কর এক্ষণি মারা যাব। এই কথা বলার সাথে সাথে সে আমায় চুমু খেল। আমার মনে সাহস আনতে বলল। আর বলল, আমি তােমার সব বাসনাই মেটাব।……
খালি ধৈর্য্য ধরে রাত্তির অবধি অপেক্ষা কর। কাজেই এখন যাও তৈরি হয়ে থেকো।
এইভাবে আমরা পরপর প্রেমালাপ ও শলাপরামর্শ সেরে তখনকার মত বিদায় নিলাম।
এর পর আমি উঠে গিয়ে আমার কামরার গেলাম। দেখি সব কিছু সুন্দর ভাবে তৈরি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। টেবিলময় ছড়িয়ে আছে নৈশভােজের অবশিষ্ট মাংসাদি। বাটিগুলিতে আধাআধি করে জল রাখা হয়েছে দরকার মত মদে মিশিয়ে তার দক্ কমাবার জন্য। মদ্যপাত্রও প্রস্তুত। মদের জগটাও রাখা আছে। আমি যখন শয্যায় প্রবেশ করতে যাব, ওমা, দেখি আমার কোতিস এসে হাজির। সে আমার হাতে গোলাপ ও অন্যান্য ফল তুলে দিল তার আংরাখা থেকে নিয়ে কতক সে বিছানায় ছড়িয়ে দিল। আমায় মিষ্টি করে চুমু খেল একটা। আমার মাথায় একটা মালা জড়িয়ে বেধে দিল। বাকি ফুল সে সারা ঘরময় ছড়িয়ে দিল। এরপর সে এক পেয়ালা মদ নিয়ে গরম জল মিশিয়ে তার দক, ঠিক করল, ও আমার হাতে তা তুলে দিল পান করবার জন্য। আমি সেটা নিঃশেষ করার আগেই সে আমার মুখ থেকে পেয়ালাটি নামিয়ে নিয়ে আবার সেটা পরিপুর্ণ করে আমার হাতে তুলে দিল। এই ভাবে আমরা দুজনে মিলে গােটা মদপাত্রটা মােট বার দুই কি তিনকে খালি করে ফেললাম।… এই ভাবে মদে মদে যখন চুর চুর হয়ে পড়েছি, তখন সে এল আমার শয্যায় ••••.মধুর ভাবে আমায় আলিঙ্গন করল। কাজেই সারা রাতটা আমাদের কাটল আনন্দে, বিনােদন। আর শুধু সেই রাতটাই কেন, তারপরে পর পর আরাে কত যে রাত আমারা আনন্দফুতিতে কাটিয়ে দিলাম তার কি কোন ইয়ত্তা আছে।