সহস্র এক আরব্য রজনী – ২ (দ্বিতীয় ও তৃতীয় মিঞার কিসসা)

›› আরব্য রজনী  ›› ১৮+  

দ্বিতীয় মিঞার কিসসা

এবারে শিকারী কুকুর দুটোর মালিক দ্বিতীয় মিঞা আফ্রিদি দৈত্যকে কুর্ণিশ জানাল। সে বলল—‘দৈত্যরাজ আমার কাহিনী শুনলে তুমি এতই অবাক হয়ে যাবে যে, মুখ দিয়ে রা পর্যন্ত বেরােবে না। যে কিস্সা এইমাত্র শুনলে তার চেয়ে এটা অনেক, অনেক বেশী চটকদার। আমার কিসসা যদি বাস্তবিকই তােমার দিলকে একটু আধটুও নাড়া দেয় তবে সওদাগরের গুনাহর অল্প হলেও মাফ করে দিও তুমি।

আফ্রিদি দৈত্য মুচকি হেসে বল্ল—“তাই হবে যুবক। তােমার কিসসা শুরু কর।

যুবক এবার কুকুর দুটোর দিকে অঙুলি-নির্দেশ করে বল—এ শিকারী কুকুর দুটো কিন্তু মেটেই সাধারণ কুকুর নয়। আমার দু ২ ভাইয়া, সহােদর ভাইয়া। উভয়েই আমার বড়। আমাদের আব্বাজান মৃত্যুসজ্জায় তিন হাজার মােহর তিন বেটার নামে ভাগ করে দিয়ে যান। আমার অংশ দিয়ে আমি একটা দোকান খুলে বসলাম। আমার ভাইজনরাও আলাদা আলাদা দোকান খুল।

কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার ভাইজানদের একজন দোকান গুটিয়ে এক সওদাগরের সঙ্গে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে ভিন্ দেশে পাড়ি জমাল।

এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার সে ভাইজান নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরল। আমি তাকে বল্লাম—“তােমাকে তাে হাজারবার নিষেধ করেছিলাম সওদাগরের কাজে ভিনদেশে গিয়ে কাজ নেই। কিছুতেই সে-কথা কানে নিলে না। হয়ত বা খােদাতাল্লার এটাই মর্জি ছিল। তাই তাে তােমার নসীব এরকম হ’ল।

বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে এবার এনে আমার দোকানে বসালাম। নদীর পানিতে গােসল করে এলাে সে। আমার ভাল পােশাক আশাক পরালাম। তারপর দু’ ভাইয়া খানাপিনা খেলাম। একথাসেকথার মাঝে তাকে বললাম—’ভাইজান, এক বছরে দোকানে লাভ ভালই হয়েছে। আসল তাে রয়েই গেছে। তার ওপর হাজার দিনার নগদ মুনাফা। তুমি তার অর্ধেক নিয়ে নাও। আবার দোকান সাজিয়ে বস। দেখবে তাতেই ভাল চলে যাবে। বেশী মুনাফার দরকার কি! অল্পেতে সন্তুষ্ট থাকলে জীবনে সুখের হদিস পাওয়া যায়। কথায় আছে, অতিলােভে তাঁতী নষ্ট।

আমার বাৎলানাে বুদ্ধি সে নিল। আবার পসরা সাজিয়ে বসল। কিছু দিন এভাবে কাটার পর এক সকালে আমার দু’ ভাইয়া আমার বাড়ি হাজির হ’ল। বলল–একদল সওদাগর বাণিজ্যের উদ্দেশে ভিনদশে যাচ্ছে। তারাও সাব্যস্ত করেছে তাদের সঙ্গে সঙ্গ দেবে।

আমি সবিস্ময়ে তাকালাম।

তারা বলল—দোকানদারীতে কোনরকমে পেটের ভাত হতে পারে বটে কিন্তু আমীর হওয়া সম্ভব নয়। তারা আমীর হওয়ার জন্য অত্যুগ্রহী। আমাকেও তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি শুরু করে দিল।

আমি আপত্তি জানাতে গিয়ে বললাম—সে কী, বাণিজ্যে যাবে কি হে? একবার গেলে তাতেই তাে শখ মেটার কথা। আবারও যাওয়ার জন্য নাচাকুদা শুরু করে দিয়েছে! শরম হওয়া উচিত!

আমার কাছ থেকে ধাতানি খেয়ে তারা তখনকার মত নরম হল বটে কিন্তু মাঝে মাঝেই একথা-সেকথা পেড়ে লালসার জালে আমাকে আটকাতে কসুর করল না। বাণিজ্য করে কত ফকির আমীর বাদশা হয়ে গেল এমন সব কথাও কৌশলে আমার কানে তুলতে কসুর করল না। কিন্তু আমি কিছুতেই নরম হলাম না।

মুখ ব্যাজার করে তারা সেদিনও ফিরে গেল বটে কিন্তু বাণিজ্যের ভূত তাদের মাথা থেকে নামল না। নানা কৌশলে আমাকে রাজী করাতে চেষ্টা করতে লাগল। আমিও যুক্তিতর্ক দিয়ে তাদের প্রতিবারই ফিরিয়ে দিলাম।

পর পর দু’বছর ধরে তারা প্রয়াস চালাবার পর এক সময় আমি আর গররাজি হতে পারলাম না। তাদের কথায় মত দিতে গিয়ে বললাম “ঠিক আছে, দু’বছরে তােমরা কে কি কামিয়েছ আমার সামনে রাখ। কারবারের হাল আগে দেখি।

আমার কথা মত তারা দু’ হাজার দিনার এনে আমার সামনে রাখল। আলােচনার মাধ্যমে তিন ভাই একমত হলাম, তিন হাজার দিনার নিয়ে আমরা বাণিজ্যে যাব। আর বাকী তিন হাজার মাটিতে পুঁতে রেখে দেব। বলা তাে যায় না, আর-উপার্জন করতে গিয়ে যদি লােকসান হয় তবে আর কেঁদে কুল পাওয়া যাবে না। এতে দেশে ফিরে আর অথৈ পানিতে পড়তে হবে না।

আমার পরামর্শে সম্মত হল। মাথা পিছু এক হাজার করে দিনার নিয়ে মণিহারী মালপত্র কিনে নৌকো বােঝাই করলাম। খােদাতাল্লার নাম নিয়ে আমরা তিনজন নৌকো জলে ভাসালাম।

প্রায় একমাস নৌকো চালিয়ে বেশ আঁকজমকপূর্ণ এক বন্দরে আমাদের নৌকো ভেড়ালাম, একদিন থেকে দশ দিনার লাভে একটা জিনিস বেচে আবার নােঙর তুললাম। এবার আমাদের লক্ষ্য আরও বড় কোন বন্দর, কোন বড় শহর। কয়েকদিন পর এক বন্দরে আবার নৌকো নােঙর করলাম।

কেনা-বেচা চালাতে চালাতে এক রূপসী-যুবতীর সঙ্গে আমাদের চিন পরিচয় হ’ল। খুবই গরীব। ঘেঁড়া-ফঁাটা কাপড় পােশাক ছাড়া এমন পােশাক তার নেই যা দিয়ে ভালভবে লজ্জা নিবারণ করতে পারে। সে আমাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। আর এ-ও বল, আমাদের সাহায্যের বিনিময়ে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সওদা করা পর্যন্ত সব কাজই করতে রাজী। নগরে থাকার আস্তানা। তিনকুলে আপনজন বলতে কেউ-ই তার নেই।

যুবতীটির কথা শুনে মনে হ’ল সে উঁচু বংশােদ্ভুতই বটে। আমি তাকে আমার নৌকায় তুলে নিলাম। কামকাজ মন চাইলে করবে, না চাইলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, কই বাৎনেহি।

রূপসী-যুবতী এবার একটু সাহস পেয়ে বলল—“তা-ই যদি হয় তবে আমাকে শাদী করে নিজের কাছে রাখতে আপত্তি কোথায়?

যুবতীর কথাগুলাে আমার খুব মনে ধরে গেল। উপরী পাওনা তার অঢেল রূপ আর দেহের অনন্য যৌবনের জোয়ারটুকু। ভাবলাম বিদেশ বিভূঁইয়ে যদি এমন এক রূপসী-যুবতীর সঙ্গ লাভ করা যায় মন্দ কি? অমত করতে মন চাইল না। নৌকোয় তুলে নিলাম

অপরূপাকে। সাগরের পানিতে ভাল করে গােসল করিয়ে আমার বাঞ্চিতা রূপসীকে সাফসুতরা করে নিলাম। পরিয়ে দিলাম দামী পােশাক। আঁখির কোলে সুরমা আর গায়ে ছিটিয়ে দিলাম দামী আতর। ভাল খানাপিনা দিয়ে তার মন ভরিয়ে তুললাম। নৌকোর গলুইয়ে বসে ফুরফুরে বাতাসে উভয়ে কতই না গল্প করলাম। ভবিষ্যতের রঙীন খােয়বে মন প্রাণ ভরে তুল্লাম।

আমারা খুব সহজেই পরস্পরকে কাছে টেনে নিলাম। মাথার ওপর কুমড়ােফালি চাঁদ। তারই ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে সাগরের বুকে। আমি তার হাতে একটা হাত রাখলাম। বিস্ময় মাখনাে দৃষ্টিতে তার রূপ-সৌন্দর্য পান করতে লাগলাম।তার নরম হাতের ছোঁয়ায় আমার বুকের মধ্যে কলিজাটা যেন চনমনিয়ে উঠতে লাগল। আমরা ক্রমেই ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে লাগলাম। ঝিরঝিরে বাতাসে মনে রােমাঞ্চ জাগিয়ে তুলতে লাগল। তার তুলতুলে বুকে আমার মুখটাকে গুজে দেবার জন্য চিত্তচাঞ্চল্য বােধ করতে লাগলাম।

নৌকার গলুইয়ে আর বসে থাকা সম্ভব হ’লনা। কামােন্মাদনা আমাকে উত্যক্ত করতে লাগল। অনন্যোপায় হয়ে উঠে পড়লাম। তার নিটোল সরু কটিদেশ কখন আমার চঞ্চল হাত দুটো বেষ্টন করে ফেলেছে বুঝতেই পারি নি। সে আবেশে জড়ানাে আঁখি দুটো মেলে, নীরব চাহনিতে অপলক দৃষ্টিতে আমার যৌবনাক্ৰান্ত দেহটাকে যেন জরীপ করতে লেগে গেল। সে যেন বাস্তবিকই এক অনাস্বাদিত আনন্দ। তার উত্তপ্ত বক্ষটিকে আমার বক্ষের সঙ্গে সাপ্টে নিয়ে কোনরকমে শােবার ঘরে ফিরে এলাম।

শুইয়ে দিলাম কচি ঘাসের মত নরম বিছানায়। আমার কামতপ্ত প্রশল্প বক্ষের চাপে সে যেন কোন এক অন্ধকার অতল গহরে তিলে তিলে হারিয়ে যেতে লাগল। কারাে মুখে কোন ভাষা নেই, আঁখিতে আঁখি রেখে কথা। উভয়ের মধ্যেই কেবল আবেগ উচ্ছাস আর পরস্পরের আত্মদানের মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি লাভের সুতীব্র বাসনা বার বার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল।

দিন যায়, সপ্তাহ কাটে। আমাদের মহব্বত ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হয়ে বাড়তে লাগল। আমাদের সুখটুকু আমার ভাইয়া দু’জনের মধ্যে আনন্দ সঞ্চার করতে পারল না, ঈর্ষায় জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যেতে লাগল তারা।

আমি বয়সে কনিষ্ঠ। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তাদের বয়স অপেক্ষাকৃত বেশী। আমার মত যৌবনের উন্মাদনা তাে আর তাদের দেহ-মনকে এমন করে উত্যক্ত করে না। কোন রূপসী তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না তাে সে দোষ কেন আমার। আমাদের ওপর, আমাদের ঘরে তাদের ঈর্ষাজর্জরিত কৌতুহলী চোখগুলাে ঘুরপাক খেতে লাগল। আর আমাদের নিয়ে সর্বদা ফুসুর ফাসুর করতে লাগল নিজেদের মধ্যে। এক সময় দরজার ছিদ্র দিয়ে তাকিয়ে, দেওয়ালের  ফঁাকে চোখ রেখে তারা দেখতে লাগল আমি কিভাবে আদরে সােহাগে বিবির মধ্যে কামােন্মদনা জাগিয়ে তুলি। সে কিভাবে নিজের দেহের স্পর্শে আমাকে হিংস্র জন্তুতে পরিণত করে সম্ভোগের প্রেরণা জোগায়—তারা সে সবের ওপর গােপনে নজর রাখতে ভাল। এমনকি আমাদের এসমস্ত গােপন কার্যকলাপও তারা চুপিসার দেখে নিতে লাগল। আর এরই মাধ্যমে তারা তাদের বিকৃত বাঞ্ছা পূরণে লিপ্ত থাকত। আমার বুঝতে বাকী রইল না শয়তান তাদের কাঁধে চেপেছে। সহজে নামার নয়।

আমার দুই বড় ভাইয়া কেবলমাত্র আমাদের গােপন দৃশ্যাবলী দেখে তৃপ্ত হতে পারল না! আরও জঘন্যতম পরিকল্পনায় লিপ্ত হল।

এক রাত্রে আমরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে গভীর নিদ্রায় ডুবেছিলাম। তারা অতি সন্তর্পনে ঘরে ঢুকে আমাদের দুজনকে তুলে নৌকার ছইয়ের বাইরে নিয়ে গেল। নির্মমভাবে উত্তাল উদ্দাম সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তখনই এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

অথৈ জলে হাবুডুবু খেতে খেতে আমি দেখতে পেলাম, আমার বিবি অতিকায় এক জিনির আকৃতি ধারণ করে আমাকে পুতুলের মত কাধে তুলে নিল। এবার দিব্যি লম্বা লম্বা পা ফেলে নির্বিবাদে জলের ওপর দিয়ে হেঁটে তীরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। এক অজানা-অচেনা দ্বীপে নিয়ে গেল আমাকে। নির্জন-নিরালা দ্বীপের জমাটবাঁধা অন্ধকারে নামিয়ে দিয়ে চোখের পলকে সে অন্তর্ধান হ’ল। ভােরের আলাে ফুটে উঠলে সে আবার আমার কাছে এল। দুষ্টুমিভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি-মধুর সুরেলা কন্ঠে বলল- “আমায় চিনতে পারছ? কে আমি, বলতে পার?’ তার সুবিশাল বপুটির দিকে আমি নীরব চাহনি মেলে সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম।

ফিক করে হেসে বলল- “এই দেখ, তুমি দেখছি সত্যি আমায় চিনতে পারছনা আমি তােমার বিবি। অবধারিত মৃত্যুর কবল থেকে আমি তােমাকে ফিরিয়ে এনেছি। খােদাতাল্লার ওপর আমার বড়ই আস্থা। তার বাসনা হয়ত এরকমই ছিল। আর তার দোয়া থাকলে অসম্ভব বলে কিছু থাকে না। তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়ে যে মহত্বের পরিচয় দিয়েছিলে–আমি তা বিস্মৃত হই নি। আজ তােমাকে প্রাণে বাঁচাতে পেরে কী নে আনন্দ পাচ্ছি তা ভাষায় বুঝানাে যাবে  না! আমি আজই তােমার শয়তান ভাই দুটোকে খুন করে প্রতিশােধ নিব।

আমার ভাইদের হত্যা করবে শুনে মনটা হঠাৎ বিষিয়ে উঠল।  আমি আৎকে উঠে বললাম—“তুমি আর যাই কর, আমার ভাইদের খুন কোরাে না। কথায় আছে, মূখের অশেষ দোষ। উপকারীর উপকারের প্রতিদান কিভাবে দিতে হয় তা তাদের অজানা। উপকারীর সর্বনাশ করতেও দ্বিধা করে না। শয়তানরা চেষ্টা করেও ভাল হতে পারে না। আর সেটাই তাদের সবচেয়ে বড় শাস্তি মনে করা যেতে পারে।

জিনি চেঁচিয়ে ওঠে–‘অসম্ভব! শয়তান দুটোকে কিছুতেই ছেড়ে দেব না। আমি কোতল করব। মৃত্যুই তাদের একমাত্র প্রাপ্য।

কথা বলতে বলতে সে আমাকে কাঁধে তুলে নিল। আকাশপথে উড়তে আরম্ভ করল। আমার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল। এবার সােজা গাছতলায় গিয়ে পুঁতে রাখা দিনারগুলাে তুলে ফেললাম। দোকানে গেলাম। দরজা খুলে দেখি সবই ঠিকঠাক আছে। বন্ধ করে বাড়ি ফিরলাম। দেখি, দুটো শিকারী কুকুর আমার দরজায় বাঁধা। আমাকে দেখেই তারা কেঁদে আকুল হতে লাগল। কাছে গেলাম। তারাও এগিয়ে এল। আমার জোব্বার কিনারা কামড়ে ধরে টানতে লাগল। ব্যাপার কি মাথায় এল না। ঠিক তখনই আমার বিবি জিনির আবির্ভাব ঘটল। মুচকি হেসে বলল—এ-শিকারী কুকুর দুটো তােমার দু’ভাই। আমার ছােট বহিন যাদুবিদ্যায় পারদর্শিনী, সে বলেছে এরা দশ বছর কুকুর হয়েই থাকবে। কেউ এদের মানুষের চেহারা ফিরিয়ে দিতে পারবে না।

এবার দশ বছর পুর্ণ হ’ল। আমি কুকুররূপী আমার ভাইজানদের নিয়ে পথে নেমেছি। জিনি-র সে বহিনের খোঁজ করে বেড়াচ্ছি। তার দেখা মিললে অনুরােধ করব যাতে সে আমার ভাইজানদের আগের চেহারা ফিরিয়ে দেয়। তার খোঁজে পয়দল চলতে চলতে এখানে গাছটার তলায় এদের দেখা পেলাম। এরাই সওদাগরের দুঃখের কিস্সা বলল। অপেক্ষায় আছি দেখি, এর শেষ কোথায়।

 

তৃতীয় মিঞার কিসসা

দ্বিতীয় যুবকের কিসসা শেষ হলে খচ্চরের মালিক তৃতীয় মিল আফ্রিদি দৈত্যকে কুর্নিশ করে বলল—মেহেরবান, আমার কি শুনলে তাক লেগে যাবে।

—’তােমার কিস্সা? তােমারও আবার কি আছে নাকি হে? বল, শুনি কেমন তােমার কিস্সা আফ্রিদি দৈত্য মুচকি হেসে বলল।

এবার খচ্চরের মালিক তৃতীয় যুবক বলল—“দৈতীশ্রেষ্ঠ, এই খচ্চরটা কিন্তু সত্যিকারের খচ্চর নয়। আমার বিবি। যাদু বলে তাকে খচ্চরের রূপ দেওয়া হয়েছে। একবার আমি ভিনদেশে গিয়েছিলাম।

বছরখানেক পরে বাড়ি ফিরেই বিবির সঙ্গে দেখা করার জন্য অন্দরমহলে গেলাম। আমার মাথাটা অকস্মাৎ চক্কর মেরে উঠল। দেখি আমার বিবি এক নিগ্রো নােকরের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে মৌজ করে প্রেমালাপ করছে। মুখে আদিরসের জোয়ার, আর হাত দুটো তার শৃঙ্গারে লিপ্ত। কোনদিকে হুসমাত্র নেই।

উভয়ে যেন ভিন্নলোকে বিচরণ করছে। ক্রমে তাদের মধ্যে উত্তেজনা জাগছে। নোকরের এক হাত আমার বিবির স্তনগুলোকে ক্রমাগত দলাই মলাই করছে আর একহাত দিয়ে বিবির যোনিতে ঘসছে। কখনও স্তনে চুমা খাচ্ছে কখনও মুখে চুমু খাচ্ছে। আর আমার বিবি নোকরের বিশাল কালো বাড়াটে হাত দিয়ে চটকাচ্ছে তো মুখ নামিয়ে চুষে দিচ্ছে। আমি দরজার ফুটোয় চোখ রেখে তাদের প্রেম-পীরিতি দেখতে লাগলাম। অকস্মাৎ আমার বিবি আমাকে দেখে ফেলল। তড়াক করে চৌকি থেকে নেমে দেয়ালের তাক থেকে জলের বাটি মুখের কাছে তুলে নিয়ে ফিসফিস করে কি সব মন্ত্র আওড়াল। তারপর তা গন্ডুষ ভরে তুলে নিয়ে আমার গায়ে ছিটিয়ে দিল। ব্যাপারটা আমি আগে লক্ষ্য করিনি। ব্যস, মুহুর্তে আমি কুকুরের রূপ পেয়ে গেলাম। তারপর আমাকে দূর দূর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল।

মনের দুঃখে আমি নগরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। একদিন পেটের জ্বালায় এক মাংসের দোকানে গেলাম। ফেলে দেওয়া হাড়গােড় মুখে নিয়ে চিবােতে লাগলাম। আমাকে দেখে কষাইয়ের বড়ই দয়া হ’ল। সঙ্গে করে সে তার বাড়ি নিয়ে গেল।

কষাইয়ের যুবতী লেড়কি আমাকে দেখেই ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে তার আব্বাজানকে বকাবকি করতে লাগল—“তুমি একজন। পরপুরুষকে কেন একেবারে অন্দর মহলে নিয়ে এলে? এটা তাে সাধারণ কুকুর নয়, পুরুষ মানুষ। এক শয়তানী একে তুক করে কুকুরে পরিণত করে দিয়েছে। তােমার ইচ্ছা থাকলে আমি এর মানুষের রূপ ফিরিয়ে দিতে পারি।

—বেচারার কী কষ্ট, চোখে দেখা যায় না। তুমি একে মানুষে পরিণত করে দাও। এর কষ্টে আমার কলিজাটা উথাল পাথাল করছে।

কষাইয়ের লেড়কি এক বাটি জল নিয়ে বিড়বিড় করে কি সব মন্ত্র আওড়াল তারপর সে-জল আমার গায়ে বার বার ছিটিয়ে দিল। আমি আবার আগের সে-মানুষের রূপ ফিরে পেলাম।

আমি বললাম—সুন্দরী, তােমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। আমার শয়তানী বিবিকে আমি খচ্চরে পরিণত করে দিতে চাই। তােমার দ্বারা কি সম্ভব?

কষাইয়ের লেড়কি আবার সে বাটিটা ভরে জল নিল। আগের মতই বিড়বিড় করে কি যেন বলল। এবার বাটিটা আমার হাতে দিয়ে বলল—“তােমার বিবি যখন নিদ যাবে তখন এ-জল তার গায়ে দিয়ে মনে মনে যা ভাববে সে সে-রূপই পাবে।’

এবার আফ্রিদি দৈত্যের দিকে ফিরে সে বল—“দৈত্যশ্রেষ্ঠ এ খচ্চরটাই আমার সে বিবি। যাদুকরী বিবি!

আফ্রিদি দৈত্যের মুখে প্রসন্নতার ছাপ ফুটে উঠল। এবার সে বলল—সওদাগর আমি তােমার সব গুনাহ মাফ করে দিলাম। তুমি মুক্ত। যেখানে খুশি যেতে পার।

ইতিমধ্যে পূর্ব-আকাশে ভােরের আলাে উঁকি মারতে শুরু করেছে। শাহরাজাদ কিসসা শেষ করতেই দুনিয়াজাদ তার গলা জড়িয়ে বলল—“কী সুন্দর। কী সুন্দর কিস্সা-ই না তুমি জান দিদি!

–এ আর এমন কি সুন্দর কিস্সা বহিন। প্রাণে বাঁচলে দেখবি কাল আরও কত সুন্দর কিসসা শােনাব।

বাদশাহ শারিয়ার ভাবলেন, একে কোতল করে এমন সুন্দর কিস্সা শােনা থেকে কিছুতেই বঞ্চিত হওয়া যায় না। বিবি শাহরাজাদ-এর কোলে মাথা রেখে তিনি নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়লেন।

সারাদিন বারে নানা কাজে লিপ্ত থাকার পর বাদশাহ শারিয়ার সন্ধ্যার কিছু পরে অন্দরমহলে এলেন। রাত্রে তাড়াতাড়ি পানাহার সেরে ঢুকলেন শােবার ঘরে।। দুনিয়াজাদ তার দিদির গলা জড়িয়ে ধরে আব্দারের স্বরে বলল, “কিসসা শুরু কর।

Leave a Reply