রাকা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

…..সেবন্তীর আজ এ কী অদ্ভুত রূপ! সমস্ত জানলা খােলা, রােদুরে ঝলমল করছে ঘর। একটা ফিকে গােলাপি সিল্কের শাড়ি পরে ড্রেসিং টেবলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সেবন্তী। মাথায় বেঁধেছেন একটা মস্ত খোঁপা, সারা মুখে পাউডার, ঠোঁটে টকটকে রক্তের মতন লিপস্টিক, একটা আইলাইনার নিয়ে ভুরু আঁকছেন সেবন্তী। তাঁর শাড়ির আঁচলটা লুটোচ্ছে মাটিতে, লাে-কাট ব্লাউজে দেখা যাচ্ছে তাঁর বুকের আভা।….

…….কেন ওরা এরকমভাবে তাকায় ? খারাপ চোখ করে ওরা কী আনন্দ পায় ? তাপসীকে যে ছেলেটি দাই-এর কাজ জুটিয়ে দিয়েছে, সে কেন তাপসীর বুক নােখ দিয়ে চিরে দিল ?…..তাপসীর কথা ভাবতেই রাকার চোখে ভাসে তাপসীর বুকে সেই নােখের চেরা দাগ। ঐ ব্যাপারটাই রাকাকে বেশি কাঁপিয়ে দিয়েছে। কী অবলীলাক্রমে তাপসী বললাে কথাটা, সে একটা বদ ছেলের সঙ্গে স্বেচ্ছায় বেড়াতে গিয়েছিল। একজনের সঙ্গে না গেলে অন্যরা তার ওপর আরও বেশি নিষ্ঠুরতা দেখাতাে।……

…..এ পর্যন্ত রাকা তার শরীরকে নিষ্কলুষ রেখেছে। যারা জড়িয়ে-টড়িয়ে ধরে, তারাও রাকার স্পষ্ট প্রতিবাদের ইঙ্গিত পেয়ে বেশিদূর এগােয় না। তেরাে-চোদ্দ বছর থেকেই রাকা বড়দের উপন্যাস পড়ে, কোনাে কোনাে লেখায় নারী-পুরুষের শারীরিক মিলনের বর্ণনা পড়লে তার কর্ণমূল রাঙা হয়ে ওঠে, শরীরে তাপ বাড়ে, কিন্তু নিজের ওরকম কোনাে ইচ্ছে জাগে না। সে যে লিটল প্রিন্সেস, যার-তার কাছে সে ধরা দেবে কেন, এক সময় তার জীবনে আসবে প্রিন্স চারমিং, সে এসে তার শরীরের ঘুম ভাঙাবে। তার জন্য রাকা প্রস্তুত রেখেছে তার অমৃতমাখা অধরােষ্ঠ ।…..

…..এক সময় রাকা অনেকক্ষণ বাথরুমের দরজা বন্ধ করে রইলাে। দরজার পেছনে একটা প্রমাণ আকারের আয়না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় কাটাবার নারী-সুলভ রােগ এখনাে ধরেনি তাকে, এখনাে সে ততটা নারী হয়নি, নিজের পােশাক-খােলা শরীরের দিকে তাকাতে তার লজ্জা করে। রজস্বলা হবার পর বাথরুমের মতন বিচ্ছিন্ন নিভৃত জায়গাতেও রাকা সম্পূর্ণ বিবসনা হয়।

সেদিন রাকা শুধু বুকের জামা খুলে দাঁড়িয়েছিল আয়নার কাছে। নিজের বুক সম্পর্কে তার এমন একটা আশঙ্কা আছে, যা এ পর্যন্ত বলা হয়নি কারুকে। | রাকার দু দিকের বক্ষ জেগেছে। সমবয়েসী মেয়েদের তুলনায় রাকার শরীর যৌবনতী হচ্ছে একটু তাড়াতাড়ি, বুড়িমা বলেন বাড়বাড়ন্ত। গত বছর থেকে হঠাৎ সে লম্বা হতে শুরু করেছে অনেকখানি, চুলের গােছ ঘন হয়েছে, হাত দু’খানিতে এসেছে সুগােল মসৃণতা, বুকের দু পাশে সুমেরু পর্বতের চূড়া। আগে রাকা এমনকী ডিকশনারিতেও স্তন শব্দটি দেখতে লজ্জা পেত, এখন কাব্য, সাহিত্যে বার বার পায় এর বর্ণনা, রাকা মাঝে মাঝে নিজের দুটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে।

রাকার ধারণা, তার দুটি স্তন সমান নয়, ঈষৎ ছােট বড়, বাঁ দিকেরটা একটুখানি চাপা। যতবার দেখে, তার সেই ধারণা দৃঢ় হয়। মাখনের মতাে রং, মাঝখানটায় লালচে আভা, কিন্তু ডান দিকের চেয়ে বাঁ দিকের বৃন্তটি সামান্য ছােট নয় ? আজই প্রথম রাকার চোখে জল আসে সবাই যে তাকে সুন্দর বলে, সে কিসের সুন্দর, তার যে শরীরে খুঁত আছে, কেউ জানে না। মিথ্যেমিথ্যি সে লােকের প্রশংসা পাচ্ছে, এটা তার প্রাপ্য নয়, দু’তিন প্রস্থ পােশাকে ঢাকা থাকে বুক, কিন্তু শরীরের এই খুঁতের কথা কি কারুকে জানিয়ে দেওয়া যায় ?…..

…..তাপসীর কথা ভাবলেই রাকার চোখে ভাসে তার বুকের সেই নােখের চেরা দাগ। মনে পড়তেই রাকার কর্ণমূল রাঙা হয়ে যায়। কী অবলীলাক্রমে তাপসী ব্লাউজ টেনে নামিয়ে দেখালাে তার শ্যামবর্ণ স্তন। পৃথিবীর কারুকে কোনােদিন রাকা তার বুক দেখাবে না প্রতিজ্ঞা করেছে।…..

….যেমনভাবে সিনেমার প্রেমিক-প্রেমিকারা দাঁড়ায়, বাংলা সিনেমার চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ, সুকান্ত আর সুরেখা। বিদ্যুতের তরঙ্গ বুঝি একেই বলে, রাকা সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠেছিল, ততটা অন্ধকার নয় যে বােঝা যাবে না, রাকা দেখলাে তার দিদির বুকের জামা খােলা, সেখানে সুকান্তর মুখ, সে পাগলের মতন ছটফট করছে। | দারুণ লজ্জা পেয়ে রাকা সঙ্গে সঙ্গে নেমে এসেছিল, তারপরেও অনেকক্ষণ তার শরীরের কাঁপুনি থামেনি, তার সমস্ত অন্তরাত্মা ছি ছি করছিল, তিন বছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে সুরেখার, তবু সে অন্য পুরুষের কাছে নিজেকে খুলে দেয়? এরকমও যে সম্ভব, রাকার ধারণাই ছিল না, বাথরুমে গিয়ে বারবার চোখে জল দিয়ে রাকা দৃশ্যটা মুছে দিতে চাইলাে। সুরেখার তুলনায় সুকান্তকেই মনে হল তার বেশি পাপী, সে সুরেখাকে ভালােবেসেও তার বিয়ে হতে দিয়েছিল, তারপরেও সে দাবি ছাড়েনি, সুকান্ত যেন তাপসীর সেই গণাদার মতনই একজন। সুরেখার বুকেও কি নােখের দাগ থাকবে ?…..

…..বাড়িতে যেদিন পাটি থাকতাে, আমাকে আর ভাইকে আগে থেকে খাইয়ে দাইয়ে একটা ভেতরের ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখা হতাে, আমি একদিন দেখেছিলাম, তখন আমার ন দশ বছর, আমার বাবা একজন বন্ধুর বউয়ের বুকে মুখ ঠেকিয়ে নাচছে, হঠাৎ আলাে নিভিয়ে দেওয়া হলাে……

…….জিপটা দাঁড় করালাে ইন্দ্রজিৎ এক পাশের তেরপলের পদা ফেললাে কোনােক্রমে, দুদিকে ফাঁকা মাঠ, রাস্তা জনমানব শূন্য। অবলীলাক্রমে রাকার বুকে একটা হাত রেখে ইন্দ্রজিৎ বললাে, সত্যি, তুমি ভারী সুন্দর, রাকা । আমার মনে তােমার জন্য একটা বিশেষ জায়গা আছে…….

…..রাকা পেছন ফিরে সবেমাত্র বুকের জামা ও বন্ধনী খুলে শায়ার দড়িতে হাত দিয়েছে, একটা আর্ত শব্দ করে দু হাতে বুক চাপা দিয়ে ছুটে গেল দেওয়ালের কাছে। সুপ্রকাশ একঝলক শুধু দেখল তার নগ্ন পিঠ।
সে বললাে, কিছু দোষ করে ফেললুম ? মাথা ঠিক রাখতে পারিনি, তােমাকে দেখতে ইচ্ছে হলাে, মনে হলাে অনেকক্ষণ না দেখে রয়েছি। তুমি লজ্জা পেয়েছে, না রাগ করেছে আমার ওপর। রাকা বললাে, টর্চটা নিভিয়ে দাও, প্লিজ।
তারপর সে কাছে এগিয়ে এসে প্রথমে সুপ্রকাশের বুকে একটা হাত ছোঁয়ালাে। কিছুটা লােমশ এই পুরুষের বুক। বেশ কঠিন। কিন্তু রাকার আঙুলের ছোঁয়ায় সেখানে শিহরন জাগছে ।
সুপ্রকাশের দু কাঁধে হাত রেখে রাকা বললাে, এই প্রথম আমি তােমার কাঁধ চুলাম।
সুপ্রকাশ রাকার কোমর দু হাতে জড়িয়ে বললাে, আমিও এই প্রথম তােমার কোমর দুলাম। খুব ইচ্ছে করছিল !
এরপর দীর্ঘস্থায়ী চুম্বনটির জন্য কোনাে ভূমিকার প্রয়ােজন হলাে না। প্রায় দমবন্ধ হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে ওরা পরস্পরকে ছাড়িয়ে নিলাে। সুপ্রকাশ রাকার একটা হাত তার পা-জামার দড়িতে এনে বললাে, তুমি এটা খুলে দাও ! অন্ধকারে এগুলাে পরে থাকার দরকার নেই।
সে নিজেও রাকার সায়ার দড়ি খুলতে গিয়ে পারলাে না। শক্ত গিট। তবু সে খুলবেই। একটানে সে সায়াটাকে নীচে নামিয়ে দিলাে।
ঘরের মধ্যে রীতিমতন অন্ধকার। একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার টর্চ জ্বাললাে সুপ্রকাশ। রাকা বললাে, না, না, ওটা জ্বেলাে না !
ঐটুকু আলােয় সব অন্ধকার ঘােচে না। সুপ্রকাশ যে নারী মূর্তিটিকে দেখলাে, তার অনেকটাই যেন রহস্যময়, অলীক। অন্ধকার যেন ফুল-লতাপাতার মতন জড়িয়ে আছে তার গায়ে, যেন সমুদ্র থেকে এইমাত্র উঠে আসা এক নারী। উর্বশী কিংবা মেদিচির ভিনাস।
সুপ্রকাশ বললাে, কবিদের কাছ থেকে কোনাে উপমা ধার না নিয়েই বলছি, তােমার বুক যেন রেড সী, বাংলায় কী বলে, লােহিত সাগর, সেই লােহিত সাগরের ঢেউ।
রাকা বললাে, আমিও ধার না নিয়ে বলছি, তােমার বুক যেন শিলালিপি, বুকের বাইরের দিকেও কিছু লেখা আছে।
সুপ্রকাশ বললাে, তােমার কোমর, তােমার কোমর যেন ডমরু, ওখানে হাত দিয়ে নিজেকে শিব মনে হয়েছিল— রাকা বললাে, আমাকে টর্চটা দাও
সুপ্রকাশ আবার কাছে এসে রাকার চোখে, নাকে, থুতনিতে, গলায়, স্তনবৃন্তে একটা আঙুল বােলাতে লাগলাে। আবেশে রাকা বলে উঠলাে, আঃ আঃ
হঠাৎ ঝুপ করে বসে পড়ে সুপ্রকাশ রাকার দুই উরুর সন্ধিদেশে চেপে ধরল তার মুখ।
তারপর কীভাবে রাতটা কেটে গেল রাকা জানে না। বিছানাটা যেন একটা নদী। সেখানে সাঁতার কাটলাে দুজনে। একজন ডুবে গেলে আর একজন তাকে ভাসিয়ে তােলে। আবার দুজনে একসঙ্গে ডােবে, একসঙ্গে শূন্যে উঠে যায়।
একেবারে ভােরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাে সুপ্রকাশ। রাকার তবু চোখে একছিটে ঘুম নেই। শরীরটা বিষম হালকা হয়ে গেছে।……

Leave a Reply