যোনিতন্ত্রম – জ্যোতিলাল দাস

›› দুস্প্রাপ্য বই  ›› পৌরাণিক কাহিনী  

যোনিতন্ত্র প্রথমঃ পটলঃ

সদা প্রস্ফুরিতাননা অর্থাৎ ঈষদ্ মৃদু-মৃদু হাস্তবদনা দুর্গা কৈলাসশিখরাসীন দেবাদিদেব জগদগুরু পরমেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিলেন – হে প্রভো ! হে করুণানিধে! আপনি চতুঃষষ্টি তন্ত্র প্রণয়ন করিয়াছেন; তন্মধ্যে প্রধান তন্ত্রসমূহ আপনি আমাকে বিবৃত করুন।

মহাদেব কহিলেন—হে চাৰ্ব্বঙ্গি, পার্ব্বতি। শ্রবণ কর। এই গুহ্যতম বিদ্যা কোটিবার বারণ করা সত্ত্বেও তুমি কেবলমাত্র নারীস্বভাবসুলভ চাপল্যপ্রযুক্ত ইহা শ্রবণ করিতে চাহিতেছ এবং তজ্জন্তই তুমি ইহা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছ। হে পাৰ্ব্বতি ! হে চাৰ্ব্বঙ্গি। মন্ত্রপীঠ, যন্ত্রপীঠ এবং যোনিপাঁঠ ( শক্তিপীঠ ) সৰ্ব্বদা সর্ব্বপ্রযত্নে গোপন করিবে । এই ত্রিবিধ পীঠমধ্যে যোনি- পীঠই সৰ্ব্বপ্রধান। কেবলমাত্র তোমার প্রতি স্নেহবশতঃ আমি তাহা প্রকাশ করিতেছি ।
হে নগনন্দিনি! শ্রবণ কর। সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়কর্তা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং রুদ্র প্রভৃতি সমস্ত দেবগণই এই যোনি অর্থাৎ আদ্যাশক্তি হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছেন । শক্তিমন্ত্ৰ উপাসক যদি যোনিপীঠের পূজা না করে, তাহা হইলে তাহার দীক্ষা, মন্ত্র এবং পূজা প্রভৃতি সমস্তই নরক গমনের কারণ হয় ।
হে দেবি । তোমার যোনি অর্থাৎ শক্তি প্রভাবেই আমি মৃত্যুঞ্জয়ী এবং তজ্জন্য তোমার যোনিকে অর্থাৎ শক্তিরূপিণী তোমাকে আমি অহর্নিশি চিন্তা করি এবং আমার হৃৎপদ্মে সর্ব্বদা আমি তাহার পূজা করি। ওগো দুর্গে। যাঁহার চিত্তে দিব্যভাব এবং বীরভাব বিরাজ করে, মুক্তি তাহার অনায়াসেই করতলগত হয় ।
শক্তিমন্ত্র আশ্রয় করিয়া যে ব্যক্তি যোনিপীঠের অর্থাৎ শক্তিপীঠের উপাসক হয় সেই ব্যক্তিই ধন্য। সেই ব্যক্তি কবি, ধীমান এবং সুরাসুরগণেরও বন্দ্যনীয় হইয়া থাকে । ব্রহ্মা যদি চতুৰ্ম্মুখে শতকোটী কল্পকালও এই যোনিপীঠের অর্থাৎ শক্তিপীঠের মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করেন, তাহা হইলেও তিনি তাহা বলিয়া শেষ করিতে পারিবেন না। এ বিষয়ে অধিক আর আমি কি বলিব ? যদি ভাগ্যবশে পুষ্পিতা কুলম্ববর্তী প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা হইলে -যোনিপীঠে মহতী পূজা দ্বারা মোক্ষ লাভ হয় । স্বকাস্তাই হউক বা পরকাস্তাই হউক, সুবেশা, ঘৃণা-লজ্জা-বিবর্জিতা নয়নাভিরাম কুলযুবতী আনয়ন করতঃ প্রথমে তাহাকে মণ্ডলমধ্যে স্থাপন করিবে। তৎপর সর্ব্বপ্রথমে তাঁহাকে বিজয়া ( সিদ্ধি, ভাঙ, ) প্রদান করিয়া ভক্তিভাবে পূজা করিবে ।
তৎপর সাধক ঐ কুলযুবতীকে স্বীয় বাম উরুর উপরিভাগে স্থাপন করিয়া কুলাচার প্রথানুযায়ী তাঁহার পূজা করিবে। অর্থাৎ তৎপর সাধক ঐ কুলযুবতীকে স্বীয় ৰাম উরুর উপরিভাগে স্থাপন করিয়া সকুন্তলা সেই কুলযুবতীর যোনি (শক্তিপীঠে) পূজা করিবে। শক্তিপীঠে চন্দন এবং মনোহর পুষ্প প্রদান করিবে । এস্থলে ইষ্টদেবীর আবাহন, জীবন্যাস বা মন্ত্রাসের কোন প্রয়োজন নাই । সাধক ঐ কুলযুবতীকে কারণ প্রদান করিয়া সিন্দুরের দ্বারা ললাটে অর্দ্ধচন্দ্র অঙ্কিত করিবে। তৎপর কুলযুবতীর ললাটে চন্দন প্রদান করতঃ সাধক স্বীয় হস্তদ্বয় ঐ যুবতীর কুচোপরি স্থাপন করিবে। তদনন্তর কুচদ্বয় মধ্যে অর্থাৎ হৃদয়ে একশত আটবার মূলমন্ত্র জপ করিবে।
তৎপর কুচদ্বয়মদ্দনপূর্ব্বক সাধক কুলযুবতীর গণ্ডচুম্বন করিয়৷ যোনিমণ্ডলে অষ্টোত্তর শত বা অষ্টোত্তর সহস্র মূলমন্ত্র জপ করিবে। জপ শেষ হইলে ভক্তি- ভাবে স্তোত্র পাঠ করিবে । পূজাকালে যদি গুরু সেই স্থানে উপস্থিত না থাকে, তাহা হইলে সাধক স্বয়ং সেস্থলে কুলপূজা সম্পন্ন করিবে। কিন্তু গুরু উপস্থিত থাকিলে গুরুই কুলপূজা করিবেন। গুরু উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সাধক পৃথক- ভাবে কুলপীঠে পূজা করিলে তাহা সম্পূর্ণরূপে ফলহীন হইয়া থাকে । ইহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। সুতরাং গুরু উপস্থিত থাকিলে সর্ব্বপ্রযত্নে সমস্ত কার্য্যভার গুরুর উপর অর্পণ করিবে এবং গুরু কর্তৃক পূজার অবসানে সাধক পূজাস্থানে আগমন করিয়া যোনিপীঠকে প্রণাম করিবে।
অতঃপর যোনিপীঠে তিনবার পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করতঃ তদনন্তর সাধক স্বীয় গুরুকে প্রণাম করিবে। তৎপর সাধক কৃতাঞ্জলিপুটে সবিনয়ে গুরুকে নিম্নোক্ত বাক্যোচ্চারণপূর্ব্বক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিবে । যথা— আপনি আমাকে যোনিপূজা বিধি প্রদর্শন করায় আমি সর্ব্বপ্রকারে কৃতার্থ হইয়াছি । ইহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। অদ্য আমার জন্ম সফল হইল এবং জীবনও ধন্য হইল। অদ্য মহাযোনির পূজা করিয়া আপনি আমাকে নরকার্ণব হইতে উদ্ধার করিলেন।

যোনিতন্ত্রে প্রথম পটলের অনুবাদ সমাপ্ত ।

দ্বিতীয়ঃ পটলঃ

দেবী কহিলেন—হে দেবদেব, জগন্নাথ! আপনি সৃষ্টি স্থিতি এবং প্রলয়কর্তা। আপনি ভিন্ন সৃষ্টির পিতা অপর কেহ নাই এবং আমি ভিন্ন সৃষ্টির জননী আর কেহ নাই। আপনি সংক্ষেপে অত্যুত্তম যোনিপূজার বিধি কহিয়াছেন । কিন্তু কাহার যোনিপীঠে পূজা করা বিধেয় এবং কীদৃশ যোনি শুভদায়িকা, তাহা বিবৃত করুন।
মহাদেব কহিলেন—নটী, কাপালিকা, বেশ্যা, রঞ্জকী, নাপিভাঙ্গনা, ব্রাহ্মণী,শূদ্রকলা, গোপযুবতী, মালাকার কন্যা,—এই নব,( নর ) জাতীয়া যুবতী শুভযোনি এবং যোনিপীঠে পূজার জন্য প্রশস্তা। অথবা সৰ্ব্বজাতীয়া বিদগ্ধা এবং লোললোচনা (পুনঃ পুনঃ পরিভ্রামিত বা ঘুর্ণিত-চঞ্চলনয়না ) কুলযুবতী এতদুদ্দেশ্যে প্রশস্তা কেবলমাত্র মাতৃযোনি পরিত্যাগ করিয়া অন্য সমস্ত কুলযুবতীর যোনিতেই তাড়না প্রশস্ত। দ্বাদশবর্ষের অধিক কুলযুবতীর যোনিপীঠে সাধক স্বকীয় ষষ্টি বৎসর বয়স পর্যন্ত প্রত্যহ পঞ্চতত্ত্ব দ্বারা যথাবিধানে পূজা করিবে । যোনিপীঠ দর্শনমাত্রই কোটিতীর্থ দর্শনের ফল লাভ হয় ৷
যোনিতত্ত্বের দ্বারা তিলক প্রদান করিবে; কুলাচার প্রথানুয়াষী বস্ত্র এবং আসন গ্রহণ করিয়া কুলোচিত বিধানে ইষ্টদেবীর পূজা করিবে। প্রথমে কুলযুবতীর কুচমর্দ্দনপূর্ব্বক তাঁহার কুন্তলাদি আকর্ষণ করিবে। তৎপরে সাধকশ্রেষ্ঠ তাহার হস্তে স্বীয় লিঙ্গ অর্পণ করিবে। প্রথমে যোনিপীঠে পূজা করিয়া তৎপরে লিঙ্গপীঠে পূজাই সর্ব্বোত্তম পূজা। হে বরাননে ! লিঙ্গোপরি চন্দন ও কুঙ্কুম প্রদান করিবে।
যোনিতে লিঙ্গ নিক্ষেপ করিয়া সর্ব্বপ্রযত্নে তাড়না করিবে। তদবস্থায় কুলযুবতীজাত উত্তম তত্ত্ব গ্রহণ করিয়া তাহা দ্বারা যোনিরূপা [ অর্থাৎ আতাশক্তিস্বরূপা জগন্মাতার পুজা করিবে। মঙ্গলবারে অমাবস্থা ভিখিতে চতুষ্পথে, শ্মশানে অথবা প্রান্তরে গমন করিয়া পূজান্তে দগ্ধ মীন ( মৎস্য ) এবং পায়সান্ন বলি প্রদান করিলে, সাধক কুবেরতুল্য হইয়া থাকে ।
মঙ্গলবারে চিতায় অবস্থান করিয়া যে সাধক পূজান্তে শক্তিপীঠে প্রথমতঃ জপ, তাহার পর করচ পাঠ করতঃ তদনন্তর কালিকার সহস্রনাম পাঠ করে, সেই সাধক স্বয়ং কালিকার পুত্রতুল্য হইয়া থাকে এবং সেই সাধক তদীয় কোটিকুলসহ মুক্তিলাভ করিয়া থাকে।
শুন্যগৃহে অথবা নিজগৃহে আমিষ সংযুক্ত বলি প্রদান করিয়া মন্ত্রজপ এবং কবচ ও সহস্রনাম পাঠ করিলে সাধক শিবভুল্য হইয়া থাকে ।
রজঃস্বলা কুলযুবতীর (শক্তির ) যোনিপীঠ দর্শন ও স্পর্শনান্তে যে সাধক অষ্টোত্তর শতবার ইষ্টমন্ত্র জপ করে, সে ব্যক্তি ধরাতলে ইন্দ্রতুল্য হইয়া থাকে ।
যে ব্যক্তি স্বীয় শুক্র এবং স্বয়ম্ভূকুসুম দ্বারা বলি প্রদান করিয়া রাত্রিকালে মন্ত্র জপ করে, অথবা যে ব্যক্তি নিশামুখে দগ্ধ মৎস্য, কুক্কুটাণ্ড, মেষ, মহিষ, নর, মধু, মাংস ও পিষ্টকান্ন দ্বারা যে কোন মহাশ্মশানে বলি প্রদান করিয়া স্বয়ং দিগম্বর, মুক্তকেশ এবং নৃত্যপরায়ণ হয়, সে ব্যক্তি সমস্ত সম্পদের অধীশ্বর হইয়া থাকে।
সর্ব্বকালে এবং সর্ব্বস্থানেই পরকীয়া কুলযুবতীর যোনিতে (শক্তিপীঠে অর্থাৎ দেবাঙ্গে ) জপ করিবে । যোনিপীঠকে আদ্যাশক্তিরূপিণী [ পাঠান্তরের বচনের তাৎপর্য্যানুসারে—কুলযুবতীকে আদাশক্তিরূপিণী] অর্থাৎ ইষ্টদেবী জ্ঞানে পূজা করিবে । এইরূপে আরাধনা করিলে ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এই চতুৰ্ব্বৰ্গ ফল লাভ হয়। সাধক নিশাভাগে মধ্য ও মাংস দ্বারা বলি প্রদান করিবে। বলি প্রদানাপ্তে সযত্নে কুচমৰ্দ্দনপূর্ব্বক যোনিকে তাড়না করিবে । শক্তিরূপা সেই দেবী যদি বিপরীতরতিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে কোটিকুলসহ সাধকের জীবন ধন্য হয়। যোনি এবং লিঙ্গ প্রক্ষালিত সলিল দ্বারা মহাশক্তিকে পূজা করিয়া যথাবিধানে অর্থ প্রদান করিবে। ঐ সলিলকে ত্রিধা-বিভক্ত করিয়া এক ভাগ শক্তিরূপিণী কুলযুবতীকে নিবেদন করিবে। অন্ত দুই ভাগ কারণের সহিত মিশ্রিত করিয়া সাধকশ্রেষ্ঠ স্বয়ং তাহা পান করিবে ।
তৎপর বস্ত্রালঙ্কার এবং গন্ধাদি প্রদানে সেই শক্তিরূপা কুলযুবতীর সন্তোষ- বিধান করিবে। নিলাশেষে কুলযুবতীর যোনিপীঠে বিহিত বিধানানুসারে পরমাপ্রকৃতি আদ্যাশক্তির পূজা করিবে। পূজাকালে ভগলিঙ্গ দ্বারা- ভগপ্রক্ষালিত সলিল এবং ভগলিঙ্গামৃত দ্বারা সাধকশ্রেষ্ঠ নৈবেদ্য প্রদান করিবে ।

যোনিভন্ত্রের দ্বিতীয় পটলের অনুবাদ সমাপ্ত ।

তৃতীয়ঃ পটলঃ

মহাদেব কহিলেন হে শিবানি। অনন্তর আমি সর্ব্বপ্রযত্নে গোপনীয় বিষয় বলিতেছি। অবহিতচিত্তে তুমি তাহা শ্রবণ কর। এই সমস্ত বিষয় কদাচ প্রকাশ করিবে না ।
প্রকাশ করিলে সিদ্ধিহানি এবং মন্ত্রহানি হয়। প্রকাশ করিলে মৃত্যু ধ্রুব ( পাঠভেদ অনুযায়ী—বধ বা বন্ধন ) অর্থাৎ মৃত্যু সুনিশ্চিত এবং সমস্ত কল্যাণ নাশ হয়।
যোনিতত্ব সমৃভূত তন্ত্রই তন্ত্রমধ্যে প্রধান। এই তন্ত্র সর্ব্বপ্রযত্নে গোপনীয় হইলেও কেবল তোমার প্রতি স্নেহবশত: আমি ইহা প্রকাশ করিলাম ।
মৈথুনে যাহার ঘৃণা, রক্ত ও রেত পানে যাহার ভ্রান্তি এবং সাধনে যাহার ভেদবুদ্ধি অর্থাৎ যে স্থলে ইষ্টদেবী এবং সাধকের একাত্ম ও অভিন্নত্ববোধ নাই, সে ব্যক্তি মহাপাপিষ্ঠ। সেই দুরাত্মা শক্তিমন্ত্ৰ উপাসক মহামায়াকে ( মহাযোনিকে ) ছাগ, মেষ, ( পাঠভেদের বচন অনুযায়ী — মহিষ, নয় ), রুরু ( কৃষ্ণসার স্বগ বিশেষ), নকুল, উষ্ট্র, গো, অশ্ব, গজ, শিবা, সিংহ, কচ্ছপ, গদভ প্রভৃতি বলি দ্বারা ভক্তিভাবে পূজা করিলেও, সে কোথায় গমন করিবে ? অর্থাৎ সে পাপিষ্ঠ নিশ্চয়ই নরকে গমন করে।
যোনিপীঠ দর্শনমাত্রই সাধকের কোটি-কুল উদ্ধারপ্রাপ্ত হয়। চন্দ্র ও সূর্য্য গ্রহণকালে যে ব্যক্তি যোনিপীঠে পূজা করে এবং যোনিতত্ত্বের দ্বারা তর্পণ করে, সে ব্যক্তি মৃত্যুর পরে পুনরায় আর পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে না। সে ব্যক্তি মৃত্যুর পর ক্রমশঃ উর্দ্ধ, হইতে উর্দ্ধতর লোক প্রাপ্ত হইয়া অবশেষে যে স্থলে মহাশক্তির সহিত যুক্ত হইয়া মহেশ্বর সর্ব্বদা অবস্থান করেন, সেই …দেবীলোকে উপনীত হন এবং সে স্থলেই অবস্থান করেন। সাধক শ্রেষ্ঠ মহাশঙ্খের মালায় জপাদি সমস্ত কাৰ্য [ পাঠান্তরের শব্দার্থ অনুসারে— সমস্ত কাম্য জপ ] সম্পন্ন করিবে।
মহাশক্তির আরাধনায় যে ব্যক্তি পঞ্চতত্ত্ব ব্যতীত সামান্য কার্য্যও করে তাহার সেই সমস্ত সাধনাই নিষ্ফল হয় এবং সে দেহান্তে নরক গমন করে। যে ব্যক্তি এই সাধনায় স্বকীয়া বা পরকীয়া যোনিতে ( দেব্যঙ্গে) প্রভেদাত্মক জ্ঞানসম্পন্ন হয়, সেই ব্যক্তি প্রলয়কাল পর্যন্ত কুম্ভীপাক নামক নরকে পচ্যমান হয় ।
সাধক যোনিমুখে স্বীয় মুখ সংলগ্ন করিয়া যদি দশসহস্র মন্ত্র জপ করে তাহা হইলে তাঁহার অযুত জন্মার্জিত পাপও তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হয় ।
রেভযুক্ত পুষ্প বা স্বয়ভূকুসুম মিশ্রিত পুষ্প কারণের সহিত অভিমন্ত্রিত করিয়া যে ব্যক্তি সযত্নে যোনিপীঠে প্রদান করে, সে কালিকা পুত্ররূপে খ্যাতি লাভ করে। যোনির্মূলে গৌরী, যোনিদেশে পার্ব্বতী, যোনিচক্রে কালী ও তারা, যোনিকুন্তলে ছিন্নমস্তা, যোনিসমীপে বগলামুখী ও মাতঙ্গী, যোনিগৰ্ত্তে মহালক্ষ্মী, ষোড়শী ও ভুবনেশ্বরী অবস্থান করেন। যোনিপীঠে পূজা [ পাঠান্তর বচনের অর্থ—যোনিপূজা ] অনুষ্ঠানমাত্রই তাহা আদ্যাশক্তির পূজা করা হয়। ইহা নিশ্চিত সত্য।
পক্ষীর অথবা বলির জন্য নিদ্দিষ্ট পূৰ্ব্বো ল্লিখিত ( পূর্ব্বোক্ত পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শ্লোক দ্রষ্টব্য।) পশু প্রভৃতির রক্ত দ্বারা যোনিপীঠে পূজা করিবেG অপকালে যে ব্যক্তি ‘যোনি, যোনি’ শব্দ উচ্চারণ করে, আদ্যাশক্তি তাহার বাড়িয়া যাইবে।

যোনিভন্ত্রের তৃতীয় পটলের অনুবাদ সমাপ্ত ।

চতুর্থ: পটলঃ

মহাদেব কহিলেন—মহাচীনাচার বা মহাচীনতন্ত্রোক্ত বিধানানুসারে পূর্ব্বোক্ত সমস্ত পূজা ও জপ সমস্ত কার্য সম্পন্ন করিবে। চীনাচার – কথিত মতই মংকথিত যোনিপূজা পদ্ধতি বলিয়া জানিৰে । এই সাধন পদ্ধতি অত্যন্ত গোপনীয় হইলেও কেবলমাত্র তোমার প্রতি স্নেহবশতঃই আমি তাহা প্রকাশ করিলাম। কোচ নামক দেশে গঙ্গার পশ্চিমভাগে যোনিগর্ত-সমীপে মাধবী নামক বিখ্যাত যোনিপীঠ বর্তমান । যোনিদর্শন আকাঙ্ক্ষায় এবং যোনিপূজাভিলাষে আমি অহর্নিশি তথায় গমন করি ।
ভিক্ষাচার ব্যপদেশে আমি সর্ব্বদা সে স্থানে গমন করি। মাধবীসদৃশ যোনিপীঠ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নাই। সে স্থানে দেবীর কুচদ্বয় কঠিন এবং যোনি অত্যন্তস্থল [ পাঠান্তরের বচনার্থ— কঠিন ] ।
হে পাৰ্ব্বতি ! ঐ যোনিপীঠে দেবীর পূজা করিয়া আমি শিবত্ব লাভ করিয়াছি। রাধা যোনিপূজা করিয়া শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন। সীতা- যোনিপূজন-প্রভাবে জানকীনাথ শ্রীরাম রাবণকে সর্বংশে নিধন করিয়া পুনরায় রম্য অযোধ্যা নগরীতে প্রত্যাবর্তন করিয়া বাস করিয়াছিলেন। সমুদ্রযোনি আশ্রয় করিয়া মহাবিষ্ণু (জগন্নাথ) বেলাভূমিতে বটমূল অবলম্বনে অবস্থান করিয়াছিলেন।
ভগিনীযোনি ( শক্তি ) আশ্রয় করিয়া বলদেব ভৈরবত্ব লাভ করিয়াছিলেন এবং লক্ষ্মী অকুতোভয়ে সুদর্শন মধ্যে অবস্থান করিয়াছিলেন।
আমি [রুদ্র ], বিষ্ণু, ব্রহ্মা, মহামনা মুনিগণ এবং ব্রহ্ম হইতে স্তম্ভ পর্যন্ত সমস্তই যোনি হইতে জাত হইয়াছে। যোনির তত্ত্ব এবং মাহাত্ম্য এই ভুবনত্রয় মধ্যে কে জানিতে সক্ষম? হে দেবি । মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন— এই পঞ্চতত্ত্ব ব্যতীত সমস্ত সাধনাই নিষ্ফল। শাস্ত্রমধ্যে বেদই শ্রেষ্ঠ। বেদ হইতেও বৈষ্ণব, বৈষ্ণব হইতে শৈব, শৈব হইতে দক্ষিণাচারী, দক্ষিণাচারী হইতে বামাচারী, বামাচারী হইতে সিদ্ধান্তাচারী এবং সিদ্ধান্তাচার হইতে -কৌলগণই শ্রেষ্ঠতর। কৌল অপেক্ষাও যোনিসাধক শ্রেষ্ঠতর। খদেদাতের তুলনায় সূর্য্য যেরূপ এবং সর্বপের তুলনায় মেরুপৰ্ব্বত যেরূপ, কৌলগণ-মধ্যে যোনিপীঠে উপাসকগণ তদ্রূপ অতুলনীয়।
কুলীনসাধক সর্ব্ববিদ্যার [ পাঠান্তরের বচনার্থ—তন্ত্রের বা তত্ত্বের ] অধিকারী। যদি ভাগ্যবশে কখনও কোন কুলীনের অর্থাৎ কৌল সাধকের সহিত সাক্ষাৎ হয়, তাহা হইলে সর্বপ্রযত্নে ভক্ষ্য ও ভোজ্য প্রদানে তাহার সন্তোষ উৎপাদন করিয়া তাঁহার নিকট কুলজ্ঞান প্রার্থনা করিয়া বলিবে — হে সাধকশ্রেষ্ঠ। আপনি যোনিপূজন-তৎপর (নিষ্ঠ)। আপনি আমার গৃহে আগমন করুন। আপনার দর্শনমাত্রই আমি কৃতার্থ হইয়াছি। ইহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যোনিদর্শন-তৎপর [ পাঠান্তরের বচনানুযায়ী — কুলাচারী ] যদি পশু সাধকের সহিত আলাপ করে বা পশু সাধকের সংস্পর্শে আসে, তাহা হইলে যোনিতত্ত্বের দ্বারা তিলক প্রদান করিয়া নিজের বিশুদ্ধি সম্পাদন করিবে ।
কুমারীপূজন [ পাঠান্তরধৃত বাচ্যার্থ— কুমারীভোজন ] এবং কুলীন ভোজন, এই দুইটিই যোনিপাঠ সাধনপদ্ধতি লিখিত গ্রন্থসমূহের প্রধান ও সুনিশ্চিত পন্থা। কৌলসাধক মনে শাক্তভাবসম্পন্ন, বাহ্যিক আচরণে শৈব এবং সভাস্থলে বৈষ্ণবমতাবলম্বীরূপে নিজকে প্রকাশ করিবেন। কৌলসাধক নানাপ্রকার বেশ ধারণ করিয়া পৃথিবীতে বিচরণ করেন।
সহস্র জন্মান্তরেও যাহার বংশে কোন কৌলসাধক জন্মগ্রহণ করে, সেই কুলকেই কুলীন এবং পবিত্র জ্ঞান করিবে। হে পাতি। যদি কৌলসাধক কাহারও গৃহে পাদ প্রক্ষালন করেন, তাহা হইলে সেই ব্যক্তির গৃহ এবং দেহ পবিত্র হয়। যে দেশে যোনিপীঠ-সাধক কৌল বিদ্যমান, সেই দেশ ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব প্রভৃতি দেবগণেরও পূজ্য হইয়া থাকে ।
কৌলসাধককে যাহা কিছু দান করা যায়, তাহাই অনন্তফল প্রসবিনী হইয়া থাকে। পশু সাধককে যাহা কিছু দান করা যায়, তাহাই নিষ্ফল হইয়া থাকে। কুলীনকে অর্থাৎ কৌলসাধককে দানের ফল আমি বলিয়া শেষ করিতে পারি না । কুলীনকে সন্তুষ্ট করিলে সে ব্যক্তি স্বীয় কোটিকুল সং মুক্তি লাভ করে। কেবলমাত্র কুলসাধক দিগকে আমি অনুগ্রহ প্রদর্শন করিয়া থাকি। ইহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। চতুর্ব্বিধ আশ্রম মধ্যে যাহারা অবধূত আশ্রম অবলম্বন করে তাহারাই মহান।
ঐ কারণে আমি কুল-যোগ অবলম্বনে শিবত্ব লাভ করিয়াছি। তথাপিও আমি সৰ্ব্বদা যোনিপূজন-তৎপর ( সদা সচেষ্ট ও যত্নবান্ ) । হে মহাদেবি ! তোমার যোনি অর্থাৎ শক্তি প্রসাদে পুরাকালে আমি ত্রিপুরাসুরকে বধ করিয়াছিলাম। দ্রৌপদীর যোনিশক্তি আশ্রয় করিয়া পাণ্ডবগণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে জয়ী হইয়াছিলেন ।
অন্য যোনিপীঠের অভাব হইলে কন্যা, বধু, ভগিনী বা শিক্ষাণী যোনি আশ্রয় করিবে। প্রত্যহই যোনিপীঠে অর্চ্চনা করিবে, অন্যথা যন্ত্র ( দেবতাদির অধিষ্ঠান চক্র) মধ্যে অর্চ্চনা করিবে। যোনি পুজা ভিন্ন অন্য বৃথা পূজা করিবে না। অথবা কেবলমাত্র জপ করিতে করিতে ক্ষিতিমণ্ডলে বিচরণ করিবে।

যোনিতন্ত্রের চতুর্থ পটলের অনুবাদ সমাপ্ত ।

পঞ্চমঃ পটলঃ

মহাদেব কহিলেন—মহাবিস্তার উপাসকগণ যদি যোনিপীঠে পূজা না করে তাহা হইলে শত পুরশ্চরণ সত্ত্বেও মন্ত্র সিদ্ধ হয় না ।
হে মহেশ্বরি। যোনিগৰ্ত্তে ( যোনিপ্রদেশে অর্থাৎ শক্তিপীঠে) তিনবার পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করিলে সহস্র-জন্মান্তরের পূজাফল লাভ হয় ৷
গুরু স্বয়ং শিবতুল্য এবং তাহার পত্নীও শিবস্বরূপিণী। গুরুপত্নীর সহিত আসঙ্গাসক্ত হইলে কৌল তৎক্ষণাৎ নরকগামী হয় ।
কেলিসাধকের পক্ষে অন্য সমস্ত সাধারণ যোনিই মদনীয়। যাহার ললাটে যোনিতত্ত্বের তিলক দৃষ্ট হয়, সে স্থলে দেব, অসুর ও যক্ষগণ এবং চতুৰ্দ্দশ- ভুবন অবস্থান করে। হে পাৰ্ব্বতি । যদি শ্রাদ্ধে কুলীনগণ অর্থাৎ কৌলসাধকগণ এবং ব্রাহ্মণগণ নিমন্ত্রিত হন, তাহা হইলে সেই শ্রাদ্ধই সফল। সে ব্যক্তির স্বর্গবাসী পিতৃগণ তাহার কার্য্যের জন্ম আনন্দে নৃত্য করেন এবং স্বীয় বংশে কুলজ্ঞানী জন্ম গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া, পিতৃপুরুষগণ হৃষ্টচিত্তে তাহার কীর্তি গান (কীর্তন ) করিতে থাকেন। সাধকশ্রেষ্ঠ যে যোনিতে একাগ্রচিত্তে পূজা করিবে, সেই যোনিতে স্বীয় ইষ্টদেবী আদ্যাশক্তিরূপে বিদ্যমান ( বিরাজমানা ) — ইহা সৰ্ব্বদা চিন্তা করিবে। হে শঙ্করি! সাধক সকল সময়ে স্বীয় গাজে যোনিতত্ত্ব মর্দন করিবে।
তাহা হইলে তাহার দেহ ধন্য হয় এবং কোটিকুল সহ সে ব্যক্তি যুক্তি লাভ করে। যদি সাধক ভগগর্ভে স্বীয় লিঙ্গ প্রবেশ করান, তাহা হইলে যোনিলিঙ্গ সমাগমে মহতী পূজা সম্পন্ন করা হয়। শুক্রোৎসারণকালেও সাধক জপ ও পূজাপরায়ণ হইবে। ঐ শুক্র এবং যোনিতত্ত্ব যথাবিধানে মিশ্রিত করিয়া সাধক স্বীয় ধৃতি (দুঃখাদি হেতু অবসন্নচিত্তের স্থিরীকরণ) [ পাঠান্তরের বাচ্যার্থ— বিভূতি ] বৃদ্ধি কামনায় যোনিগর্ভে প্রদান করিবে। হে পার্বতি। তৎপর দেবীর শ্রীচরণে প্রণিপাত করিবে। হে দেবি। পূজাকালে অন্য সকল প্রকার আলাপ বর্জ্জন করিবে।
কামভোগাভিলাষী হইলে সাধক সেই যোনিকে তোষণ করিবে । যদি মাতৃযোনিকে সম্মুখে রাখিয়া পূজা করা হয়, তাহা হইলে যথাবিধানে পূজা সম্পন্ন করিয়া মৈথুন হইতে সর্ব্বদা বিরত থাকিবে। কেবলমাত্র মাতৃযোনিকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য সমস্ত ভুক্ত যোনিকেই তাড়না করিবে। যদি ভাগ্যবশে ব্রাহ্মণী-কুলশক্তি লাভ হয়, তাহা হইলে প্রথমে তাহার যোনিতত্ত্ব গ্রহণ করিয়া, তৎপর অন্য যোনির পূজা করিবে ।
হে পাৰ্ব্বতি । পঞ্চতত্ত্ব ভিন্ন অন্য দীক্ষা পণ্ডদীক্ষা এবং তাহার সাধনা নিষ্ফল। [ শূদ্র যদি ওঁঙ্কার উচ্চারণ করে, হোম করে, শালগ্রাম শিলায় অর্চনা করে বা ব্রাহ্মণীগমন করে, তাহা হইলে সেই শূদ্রের চণ্ডালত্ব প্রাপ্তি হয়। * ] সৰ্ব্ব প্রযত্নে শক্তিমন্ত্রের উপাসক কুলগুরুর শরণ গ্রহণ করিবে। পশুদীক্ষা-পরায়ণ ব্যক্তি যদি কুলাচারে পূজায় প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে তাহার সুতরাং সর্ব্বদা সর্ব্বপ্রযত্নে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রাধিকার দীক্ষা ও মন্ত্র নরক-গমনের কারণ হইয়া থাকে [ পাঠান্তর বাচ্যার্থ—তাহার দীক্ষা ও মন্ত্র অভিচারার্থ কল্পিত হইয়া থাকে ] । কুলীন [ অর্থাৎ কৌল ] গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করিবে। যোনি অর্থাৎ শক্তি যেরূপ প্রসন্না হইয়াছিলেন বা রামচন্দ্রের প্রতি সীতাযোনি অর্থাৎ তাহার শক্তি যেরূপ প্রসন্না হইয়াছিলেন অথবা তোমার যোনি অর্থাৎ শক্তি আমার প্রতি যেরূপ প্রসন্না, কুলীন অর্থাৎ কৌলগুরু গ্রহণ করিয়া যদি সাধক কুলাচারে পূজায় প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে তাঁহার যোনি অর্থাৎ আদ্যাশক্তি তাহার প্রতি তদ্রূপ প্রসন্না হইয়া থাকেন ।
সাধক যদি যোনিকুন্তল গ্রহণ করিয়া রাজগৃহে গমন করে তাহা হইলে রাজদ্বারে তাহার সমস্ত কাৰ্য্য সিদ্ধ হয় । ইহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই ৷
যোনিতত্ত্ব এবং স্বয়ম্ভকুসুম একত্র যোগ করিয়া যদি কেহ তিলক ধারণ করে [ পাঠাস্তরের বাচ্যার্থানুসারে যদি কেহ যোনিতত্ত্বের দ্বারা তিলক প্রদান করে এবং স্বর্ণকবচে যোনিতত্ত্ব পূর্ণ করিয়া তাহা ধারণ করে ] তাহা হইলে সেই সাধক যমকে ভৎসনা করিতে করিতে দুর্গালোকে গমন করে।
পাৰ্ব্বতী কহিলেন, হে করুণানিধে। কোন বিধি অনুসারে যোনিরূপা জগন্মাতা আদ্যাশক্তির অর্চ্চনা করিতে হইবে এবং কিরূপ কার্য্য করিলে আদ্যাশক্তি প্রসন্না হন, তাহা আমার নিকট বিবৃত করুন। উপাসক স্বয়ং যোনির পূজা করিবে অথবা অন্য সাধক দ্বারা যোনির পূজা করাইবে— তৎসমুদয় জানিবার জন্য আমার অত্যন্ত কৌতূহল হইয়াছে।
মহাদেব কহিলেন— সাধক স্বয়ং যোনিরূপা আদ্যাশক্তি জগন্মাতার পূজা করিবে, কূলশক্তি দ্বারা লিঙ্গ উদ্ধৃত করাইয়া লিঙ্গরূপী সদাশিব এবং শক্তিরূপিণী ভগরূপা মহামায়ার পূজা করিবে। শিব এবং আদ্যাশক্তির পূজা করামাত্রই সাধক জীবন্মুক্ত হইয়া থাকে। ইহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই ।
হে দুর্গে । যদি পুষ্পাদি, বলি এবং পূজার অন্যান্য উপকরণ কিছুই প্রাপ্ত না হওয়া যায়, তাহা হইলে কেবলমাত্র কারণ অর্থাৎ মদ্য দ্বারা আদ্যাশক্তির অর্জন। করিবে।
অথবা উপকরণ অভাবে কেবলমাত্র মন্ত্র দ্বারাই যোনিপূজা সম্পন্ন করিবে। যোনিগৰ্ত্তে ( অর্থাৎ সমগ্র শক্ত্যাধারে, কেন্দ্রস্থানে) প্রাণায়ামাস্তে মায়াবীজ (হ্রীং ) দ্বারা ষড়ঙ্গন্যাস করিবে। তৎপর যোনিমূলে ( মূলাধার পদ্মে স্থিত
শিবশক্তি মূলে ) শতসংখ্যক মন্ত্র জপ করিয়া তদনন্তর লিঙ্গ ( শিব ) এবং যোনি ( শক্তি বা শক্তিস্থান ) মাজ ́না (শোধন) করিবে। সকলের সাধনার নিমিত্ত আমি এই সহজ সাধনপদ্ধতি বিবৃত করিলাম ৷
হে দেবেশি ! এই তন্ত্র কখনও প্রকাশ করিবে না। অথবা অভক্ত অর্থাৎ শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তিকে কখনও এই সাধন
অপরের শিয়কে প্রদান করিবে না ।
এই যোনিতত্ত্ব ( শক্তিতত্ত্ব) অত্যন্ত গোপনীয় হইলেও কেবলমাত্র তোমার প্রতি স্নেহবশতঃ আমি এই তন্ত্র প্রকাশ করিলাম ।

যোনিতন্ত্রে পঞ্চম পটলের অনুবাদ সমাপ্ত।

ষষ্ঠঃ পটল:

মহাদেব কহিলেন-হে দেবেশি। সাধক যদি স্নানকালে যোনিপীঠ নিরীক্ষণ (বিশেষভাবে দর্শন) করে, তাহা হইলে সেই সাধকের জন্ম সফল, ইহা নিশ্চিত সত্য।
স্বকীয়া, পরকীয়া বা বধূযোনি অথবা তদভাবে করাযোনি বা শিয়াণী- যোনি নিরীক্ষণ করিবে।
হে পার্বতি। যাহার গৃহে এই তন্ত্র বিরাজ করে, তাহার কখনও চৌরভয় হয় না এবং দেহাবসানে সে ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করে ।
যদি পূজার্থে কুলযোনির অভাব হয়, তাহা হইলে পশুযোনিও পূজার্থে গ্রহণ করিবে। যোনি পুজনমাত্রই সাধক স্বয়ং নিঃসন্দেহে বিষ্ণুতুল্য হয়। ইহাতে কিছু সন্দেহ নাই ।
স্বর্গলোকে বা পাতালে সুর বা অসুরগণের পূজ্য বীরসাধন প্রভৃতি কা কেবলমাত্র দুঃখের হেতুভূত হইয়া থাকে ।
কিন্তু হে দুর্গে। এই সুগম সাধনপদ্ধতি কেবলমাত্র আমি তোমার প্রতি স্নেহবশতঃ প্রকাশ করিলাম। যদি কুলসাধক যোনিতত্ত্ব গ্রহণ করিয়া [ পাঠান্তরের বাচ্যার্থানুসারে আঘ্রাণ করিয়া ] সংগ্রামে প্রবেশ করে, তাহা হইলে সে সমস্ত শত্রুকে পরাজিত করিয়া সংগ্রামে জয়লাভ করে। তাঁহার গঙ্গাস্নানেই বা কি ফল আর তীর্থসেবা দ্বারাই বা কি ফল লাভ হয় ? [ পাঠাস্তরের বাচ্যার্থানুসারে — অন্যান্য সাধন দ্বারাই বা কি ফল এবং তীর্থসেবাদি দ্বারাই বা কি ফল? ] যোনিপীঠে ভক্তির ন্যায় ( অর্থাৎ ভক্তিমার্গাশ্রিত সাধনার তুল্য আর ) সাধনা নাই। অন্য সমস্ত সাধনাই ইহার তুলনায় নিরর্থক। হে দেবেশি । পঞ্চমুখে যোনিপীঠ-মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিলেও আমি তাহা বলিয়া শেষ করিতে পারিব না । [ কেবলমাত্র তোমার যোনি (শক্তি) প্রভাবেই আমি শিবত্ব লাভ করিয়াছি। ]
যে কুলসাধক নবীনকুগুল। যোনি মর্দন করে, সে এই ঘোর সংসার- সাগরের মহাদুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করে।
হে পাৰ্ব্বতি ! হে চাঙ্গি! এই সম্বন্ধে আর অধিক কি বলিব ? এই যোনিতত্ত্ব সম্পূর্ণ বর্ণনা কে করিতে সক্ষম? শিব এবং বিষ্ণু ভিন্ন অন্য আর কে এই তত্ত্ব বর্ণনা করিতে পারে? হে মাতঃ! হে দুর্গে। চপলতাবশতঃ যোনিতত্ত্ব সম্বন্ধে তোমার নিকট যৎকিঞ্চিৎ ( যাহা ) বলিয়াছি তজ্জন্য আমার দুর্ব্বলতা [ পাঠাত্তরের বাচ্যার্থ অনুসারে দুর্বাক্য ] চপলতা ক্ষমা কর।
পাৰ্ব্বতী কহিলেন– হে দেবদেব, জগন্নাথ। আপনি জগতের সৃষ্টি স্থিতি এবং প্রলয়কারী। বীরসাধন প্রভৃতি বহুবিধ সাধন এবং অন্যান্য বহুবিধ সহজসাধ্য সাধনও আমি আপনার মুখ হইতে শ্রবণ করিয়াছি। হে দেব ! আপনি যাহা কিছু বলিয়াছেন, কলিকালে তৎসমুদয় কিরূপে সিদ্ধ বা ফলদায়ক হইবে, তদ্বিষয়ে সর্ব্বদাই আমার সন্দেহ হইতেছে।
মহাদেব কহিলেন—হে চাৰ্ব্বঙ্গি, পাৰ্ব্বতি ! হে নগনন্দিনি। আমি যাহা বলিতেছি অবহিতচিত্তে পরমশ্রদ্ধা সহকারে তাহা শ্রবণ কর। এই বিদ্যা প্রাণান্তেও যাকে-তাকে অর্থাৎ কোন সাধারণ লোককে প্রদান করিবে না ।
হে প্রিয়ে। স্বযোনিবৎ গোপনীয়া এই বিদ্যা। আমি তোমাকে ইহার নিগূঢ় এবং সুনিশ্চিত সত্য কহিতেছি। তৎসমুদয় যথাবিহিত বিধানে অনুষ্ঠিত হইলে সাধক ভসমূদ্রে নিমজ্জিত হয় না ।
মহামায়া পরমাপ্রকৃতি আদ্যাশক্তি যোনিরূপা এবং সদাশিব লিঙ্গরূপী। রেড, মদ্য ও মাংস দ্বার। মহামায়ার তর্পণ করিবে। যোনিতে লিঙ্গ নিক্ষেপ করিয়া যোনি হইতে তত্ত্ব সংগ্রহ করিয়া, তাহার কিঞ্চিদংশ যোনিমধ্যে নিক্ষেপ করিয়া, অবশিষ্ট সমস্তই আদ্যাশক্তিকে সমর্পণ [পাঠান্তরের বাচ্যার্থ অনুযায়ী — নিক্ষেপ] করিবে। পঞ্চতত্ত্ব এবং যোনিতত্ত্ব দ্বারা ভগরূপা জগন্ময়ী আদাশক্তির সন্তোষ বিধান করিবে। ইহার বিপরীত কার্য্য করিলে অর্থাৎ উক্ত তত্ত্বসমূহ দ্বারা মহামায়ার সন্তোষ বিধান না করিলে সাধক ব্রহ্মহত্যার পাতকে লিপ্ত হয় ।
হে দুর্গে। বহুপুণ্যের ফলে এই সাধন পদ্ধতিতে ধ্রুব (সুনিশ্চিত, সুদৃঢ় ) বিশ্বাস জন্মে এবং বিশ্বাস হইতেই সিদ্ধি এবং সিদ্ধি লাভ হইলে মোক্ষপ্রাপ্তি হয় ৷ এই সাধন পদ্ধতিতে অবিশ্বাসী হইলে সাধক নিশ্চয়ই নরকে গমন করে। সমস্ত প্রকার সাধনপদ্ধতি মধ্যে যোনিপীঠে সাধনাই সর্ব্বোত্তম সাধনা । হে দেবেশি! ভোজন এবং পান সম্পন্ন করিয়া যদি সাধক তৎপর যোনিপীঠে পূজা করে তাহা হইলে কোটি জন্মার্জিত পাপও তৎক্ষণাৎ নষ্ট ( ক্ষয়প্রাপ্ত )
হয় ।
এই সাধনপদ্ধতিতে ভোগের দ্বারাই সুখ এবং ভোগের দ্বারাই মোক্ষলাভ হয়। সুতরাং এই সাধনায় সাধক সর্ব্বপ্রযত্নে সর্ব্বদা ভোগতৎপর হইবে। মতিমান সাধক যোনি নিন্দা, ঘৃণা ও লজ্জ। সর্ব্বদা পরিহার করিবে। যদি কুলাচার পদ্ধতিতে যোনিপূজা না করা হয়, তাহা হইলে সেই সাধক অন্য লক্ষ প্রকার সাধনা করিলেও তাহা নিষ্ফল হইয়া থাকে। সাধক যদি সূক্ষ্মা মূলা যোনিগর্ভ ( শক্তিকেন্দ্র) মার্জনা ( সংস্কার শোধন) করে, তাহা হইলে তাহার দেহ এবং গৃহগত পাপ নিশ্চয়ই বিনষ্ট হয়। গঙ্গাস্নান বা তীর্থসেবাদিতে আর কি ফল লাভ হয় ?
. হে প্রিয়ে। যোনিরূপা মহামায়ার সর্ব্বদা পূজা করাই সাধকের একমাত্র কর্তব্য। এ সম্বন্ধে অধিক বলিলে কি ফল হইবে ? হে প্রাণবল্লভে। শ্রবণ কর। কৌলসাধকদিগকে পূজা করা অতিসাধারণ কাৰ্য্য । হে দেবি! পঞ্চতত্ত্ব ব্যতীত চতুর্থ বৃথা হইবে। পঞ্চমতত্ত্ব ব্যতীত [ অর্থাৎ মৈথুন অপেক্ষা ] শাক্ত সাধকদিগের পক্ষে অধিকতর সুখ বা মোক্ষদায়ক অন্য কোন শ্রেষ্ঠতর পন্থা নাই । কুলশক্তি ভিন্ন যাহা কিছু পান করা যায়, সেই সমস্ত নিষ্ফল। শক্তির উচ্ছিষ্ট [ কারণ ] পান করিবে এবং বীরোচ্ছিষ্ট চর্ব্বণ করিবে [ পাঠাত্তরের শব্দার্থের তাৎপর্য্য— বীরগণ খাদ্যবস্তু চর্ব্বণ করিবে ]। উক্ত পদ্ধতিতে আদ্যাশক্তিকে যোনিপীঠে দিবানিশি পূজা করিবে।
হে মহেশানি। তৎপর পানভোজন করত ক্ষিতিমণ্ডলে যদৃচ্ছা বিচরণ করিবে। যখন পশুসাধক সংস্পর্শে আসিবে তখন তুলসী মালা ধারণ করিয়া হরিমন্দিরে বাস করিবে, কথোপকথনেও শ্রীহরির গুণকীর্তন করিবে— এবং হরিভাবপরায়ণ হইয়া পশুসাধকসমীপে বিচরণ করিবে।
এই বিদ্যা অর্থাৎ সাধনপদ্ধতি অত্যন্ত গোপনীয়, অপ্রকাশ। এই বিদ্যা প্রকাশ করিলে সাধনায় সাধকের সিদ্ধিহানি হয়। (হে পাতি। বরং পশুর অগ্রে পূজা করিবে না।) সাধক যদি কেবলমাত্র পুষ্পাঞ্জলিত্রয় প্রদান করিয়াও যোনিপীঠের অর্চনা করে, তাহা হইলেও ত্রিভুবনে তাহার পক্ষে দুষ্প্রাপ্য আর কিছুই থাকে না। (পাঠান্তর মতে— ত্রিভুবনে তাহার সমন্ত অশুভ কর্ম নষ্ট হয় ) ।

যোনিতন্ত্রের ষষ্ঠ পটলের অনুবাদ সমাপ্ত ।

সপ্তমঃ পটলঃ

মহাদেব কহিলেন—হে পাৰ্ব্বতি। অনন্তর আমি উত্তম বীরসাধন পদ্ধতি বিষয়ে বলিতেছি । এই সাধনার জ্ঞান লাভ হওয়ামাত্রই সাধক জীবন্মুক্ত হইয়া থাকে ৷
দিব্যসাধকগণ প্রায় দেবতুল্য। বীরসাধকগণ উগ্রতপা এবং উদ্ধতমনা । যে-দেশে বীরসাধক বর্তমান, দেবগণও সেই দেশের পূজা করেন ।
বীরসাধকের দর্শনমাত্রই কোটিতীর্থ দর্শনের ফল লাভ হয়। বীরসাধককে জলদান করিলেও দাতা কোটিকুলসহ মুক্তি লাভ করে ।
হে দেবেশি। বীরসাধকের সন্তোষ বিধান করিলে ত্রিভুবনে কিছুই অলভ্য থাকে না। বীরগণের জপের নিমিত্ত সমস্তকালই প্রশন্ত কাল।
উত্তম বীরসাধক বিশ্বমূলে, শ্মশানে, প্রান্তরে, গৃহে, একলিঙ্গ মন্দিরে বা মহাযো নিপীঠে সবদা জপ করিয়া থাকে । বীরমন্ত্রের আশ্রয়ে বীরসাধক আহার্য্য গ্রহণে উদরপূর্তি করিবে। মদ্য এবং মাংসাহার ভিন্ন বীরসাধক কখনও প্রাণ ধারণ করিবে না ।
বীরাচার অনুসারে পান ও ভোজন করিয়া বীরসাধক ক্ষিতিমণ্ডলে বিচরণ -করিয়া থাকে। সে সকলের অন্নই নির্ব্বিকারচিত্তে ভোজন করে। হে মহেশানি। বীরসাধকের নিকট মৈথুনার্থে (অস্তমৈথুন ) সমস্ত যোনিই প্রশস্ত । কখনও চন্দন, কখনও বা সুরা দ্বারা, কখনও পঙ্ক, আবার কখনও ধূলি দ্বারা -বীরসাধক স্বীয় দেহ অনুলেপন করিবে। হে দুর্গে। বীরসাধক সর্ব্বদা সদানন্দময়রূপে বিরাজ করে ।
আমি সবার্থসাধক বীরসাধন বিষয়ে বলিতেছি। এই সাধনায় স্নানাদি সমস্ত শৌচই মানসিক এবং প্রবর ( শ্রেষ্ঠ ) জপও মানসিক। ইহাতে মানসিক পূজাই দিব্যপূজা এবং তর্পণাদিও মানসিক । এই সাধনায় কালাকাল বিচার নাই—সমস্ত কালই সকল কার্য্যের জন্য শুভ ( প্রশস্ত ), এই সাধনায় কোন কালই কোন কার্য্যের জন্য অশুভ নহে।
এই সাধনায় দিবা, রাত্রি, সন্ধ্যা বা মহানিশার মধ্যে কোন প্রকার ভেদাভেদ বা বিশেষ অবিশেষ নাই। ইহাতে বস্ত্র, আসন, স্নান, [ পাঠ- ভেদের বাচ্যার্থ অর্থানুসারে স্থান ], গৃহ, দেহস্পর্শ ইত্যাদি গুচি অথবা অশুচি প্রভৃতি কোন কিছুরই বিচার করিবে না ।
ইহাতে নির্ব্বিকার এবং নির্ব্বিকল্প চিত্তে সাধনায় প্রবৃত্ত হইবে। ইহাতে দিক, কাল প্রভৃতির কোন বিধি নিষেধ মানিতে হয় না, বা সাধকের অবস্থানাধি ইত্যাদি বিষয়েও কোন নিয়মের অধীন হইতে হয় না ।
অর্চ্চনা, বলি, জপ প্রভৃতি কোন কাৰ্য্যেই কোন কালবিচার বা নিয়ম প্রতিপালন করা অনাবশ্যক। কখনও স্ত্রী-দ্বেষ (ঈর্যা, বিরাগ বা বৈরভাব পোষণ) প্রকাশ করিবে না। নারীদিগকে বিশেষভাবে পুজা করিবে। যে কোন স্থানে কুলস্ত্রী গমন, দর্শন, স্পর্শন ও তাহাদিগকে আহার্য্য প্রদান করত, এবং স্বয়ং যথারুচি আহার্য্য গ্রহণ করিয়া তদনন্তর মন্ত্র জপ করিবে। বীরাচার সাধনে সকল কার্য্যেই সাধক নিজের ইচ্ছানুযায়ী আচার অবলম্বন করিবে। স্বেচ্ছাচারই বীরসাধনার পদ্ধতি — ইহাতে অন্য কোন নিয়ম নাই। কিন্তু এই সাধনায় নারীই (শক্তিই ) আরাধ্যাদেবী, নারীই প্রাণ এবং নারীই সাধকের ভূষণ — ইহা সর্ব্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে ।
সৰ্ব্বদা কুলস্ত্রীসঙ্গিনীদিগকে অন্যথা নিজের স্ত্রীকেই সর্ব্বদা আদ্যাশক্তিরূপে চিন্তা করিবে। ইহা কেবলমাত্র ভাবসায়ে কথিত হইয়াছে। [ পাঠভেদের বাচ্যার্থ অনুসারে—তোমার জিজ্ঞাস্য সমস্ত বিষয় কহিলাম । ] এই বিষয় অন্যান্য সমস্ত তন্ত্রেই গুপ্ত অর্থাৎ অপ্রকাশিত রহিয়াছে ।
বীরসাধন পদ্ধতি কেবলমাত্র তোমার প্রতি স্নেহবশতঃ প্রকাশ করিলাম । যে কোন দ্রব্য ভক্ষণকালে সৰ্ব্বপ্রথমে তাহা শক্তিকে নিবেদন করিবে অথবা ভক্ষ্যদ্রব্যের প্রথমভাগ জলমধ্যে নিক্ষেপ করিবে। তৎপর সাধক শক্তিযুক্ত হইয়া প্রান্তরে অথবা শ্মশানে গমন করিয়া দ্রব্য ভক্ষণ করিয়া মন্ত্র জপ করিবে। জপ শেষ হইলে তৎপর মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। হে পাৰ্ব্বতি, চাৰ্ব্বঙ্গি ! শুক্রোৎসারণকালে যোনিতত্ত্ব গ্রহণ করিয়া, যদি তদ্বারা সাধক তিলক প্রদান করে, তাহা হইলে, শতজন্মার্জিত পাপও তৎক্ষণাৎ ( সঙ্গে সঙ্গে ) বিনষ্ট ( ক্ষয়প্রাপ্ত) হয় ।
শ্রবণ কর। শ্মশান তদভাবে শৃগৃহে গমন করিয়া কার্য্য করিবে। তদভাবে নিঃচ্ছিদ্র গৃহ মধ্যে অবস্থান করিয়া কার্য্য করিবে।
হে পাৰ্ব্বতি প্রাণাত্তেও এই বীরসাধন পদ্ধতি পশুসাধক সমীপে ব্যক্ত করিবে না। বীরসাধনায় অকারণ মদ্যপান, বীর-নিন্দা, বৃথা মৈথুন এবং বৃথা ভোজন সর্ব্বদা পরিহার করিবে। হে দুর্গে। মদ্য, মাংস, মৎস্ত, মুদ্রা এবং মৈথুন—এই পঞ্চতত্ত্ব বর্জ্জন করিয়া পৃথিবীতে কেহই বীরসাধক হইতে পারে না। সুতরাং এই পঞ্চতত্ত্ব ভোগ বা পান করিয়া বীরসাধক মহামন্ত্র জপ করিতে প্রবৃত্ত হইবে।
হে দেবি ! বীরগণের সাধনপদ্ধতি অতিশয় গোপনীয়। লক্ষ প্রকার দিব্যসাধনেই বা কি ফল এবং বীর সাধনায়ই বা কি ফল ?
শতকোটি জপ বা পুরস্করণেই বা ফল কি ? লক্ষ তীর্থসেবা বা তন্ত্রাদি সেবারই কি ফল? শতলক্ষ পূজা, দান বা তপস্যাদিতেই বা কি ফল ? হে মহেশানি ! যোনিরূপা আদ্যাশক্তির পূজা ভিন্ন এই সমস্ত কাৰ্যই নিষ্ফল। কেবলমাত্র যোনিপূজা দ্বারাই উক্ত কার্য্যসকল যথাযথ ফলদায়ক হইয়া থাকে। স্বর্গবাসী পিতৃগণকেও যোনিতত্ত্বের দ্বারা তর্পণ করিবে।
কুন্তলাকর্ষণ প্রভৃতি কার্য্যের দ্বারা সর্ব্বদা যোনিকে (শক্তি) লালন করিবে। মহাযোনিকে ক্রোড়ে গ্রহণ করিয়া যদি সাধক তাণ্ডব নৃত্যে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে অদ্ভুত জন্মার্জিত পাপ হইতে সে তাহার কোটিকুল সহিত মুক্তিলাভ করে। বিশেষভাবে শিয়াণী, কন্যা এবং বধূযোনিতে কেবলমাত্র গন্ধ পুষ্প দ্বারা ভক্তিভাবে পূজা করিবে। তাহা হইলে সাধক ইহলোকে সুখভোগ করিয়া মৃত্যুর পরে দেবীলোকে গমন করে।
এই সকল স্থলে পূজায় গন্ধপুষ্পাদির অভাব হইলে কেবলমাত্র কারণ (সুরা) দ্বারা পূজা সম্পন্ন করিবে। হে পাৰ্ব্বতি। যদি পূজাকালে পূজাস্থানে কেহ আগমন করে, তাহা হইলে তাহাকে বৈষ্ণবী পূজা, [ পাঠান্তরের তাৎপর্য্যানুসারে — বৈষ্ণবী মুদ্রা ] বিষ্ণুন্যাস এবং বিষ্ণুস্তব প্রদর্শন করিবে ।

যোনিতন্ত্রে সপ্তম পটলের অনুবাদ সমাপ্ত ।

অষ্টমঃ পটলঃ

মহাদেব কহিলেন—ত্রিভুবনে উর্ধ্বশী প্রভৃতি যত নারীগণ বিদ্যমান আছেন বীরসাধনকালে কৌলিক ( কুল বা বংশপরম্পরাগত কুলাচার বা কুলধৰ্ম্ম অনুষ্ঠানকারী ) তাহাদের সকলের নাথ হইয়া থাকেন ।
মৈথুন ভিন্ন মুক্তি লাভ হয় না—ইহাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত। হে প্রাণবল্লভে ! শ্রবণ কর। পশুসাধকদিগের বুদ্ধিনাশের জন্য আমি শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণ প্রভৃতি বিবিধশাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছি। পরমানন্দরূপিণীরূপে সকুগুলা যোনিকে ( শক্তিকে ) ভজনা করিবে। বিশেষজ্ঞ: কলিযুগে যোনিরূপা জগন্ময়ী আদ্যাশক্তিকে যে ব্যক্তি পরমভক্তি সহকারে ভজনা করে (স্বতন্ত্র পাঠ-এর লিখিত শব্দ (version)-এর তাৎপর্য্যার্থানুসারে — জপ করে) মুক্তি তাহার করতলগত জানিৰে ।
সহস্র সাধকমধ্যে ভাগ্যবলে একজন বা কোটিসংখ্যক তপস্বিগণের মধ্যে একজন কদাচিৎ ভাগ্যবশে কালীসাধন তৎপর ( পরায়ণ ) হইয়া থাকে ।
কালী জগতের মাতা । ইহা সকল শাস্ত্রের সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত। কালীকে স্মরণ করিবামাত্র সাধক সৰ্ব্ব পাপ [ ভববন্ধন হইতে ] বিনিযুক্ত ( মুক্ত ) হয়। ইহা ধ্রুবসত্য, পুন: সত্য এবং সুনিশ্চিত সত্য। কালীমন্ত্র জপ করিয়া সাধক কালিকাপুত্রতুল্য হইয়া থাকে। ইহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই ।
যিনি কালী, তিনিই ত্রিপুরা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, তারা, মহালক্ষ্মী [ মহামায়া ], মাতঙ্গী, কমলা, সুন্দরী, ভৈরবী প্রভৃতি বিভিন্ন বিদ্যারূপে প্রকাশিতা। চীনাচার ক্রমোক্ত পদ্ধতি ভিন্ন দক্ষিণাকালিকা ও তারা সিদ্ধিদায়িনী হয়েন না ।
যে মন্ত্রের যেরূপ আচার বিহিত হইয়াছে তাহাই সে মন্ত্রসাধনার শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি জানিবে। যে ব্যক্তি এ বিষয়ে অবিশ্বাসী তাহার মন্ত্রসিদ্ধি লাভ হয় না। সুতরাং সিদ্ধি-অভিলাষী সাধক সর্ব্বপ্রযত্নে ভাবপরায়ণ [ স্বতন্ত্র পাঠ (version)-এর মর্মানুসারে ভক্তিপরায়ণ ] হইবে ।
হে দেবি । এই যোনিতন্ত্রে যাহা লিখিত হইল, সিদ্ধি-অভিলাষী সাধক ভাবপরায়ণ হইয়া তৎসমুদয় অবশ্য সম্পাদন করিবে।
সাধক স্বীয় জিহ্বা, মুখ [ স্বতন্ত্র পাঠ ( version )-এর তাৎপর্য্যানু- যায়ী—মন ], চক্ষু এবং কর্ণ প্রভৃতি সকল ইন্দ্রিয়েই যোনিচক্র চিন্তা করিবে। হে পাৰ্ব্বতি । যোনিপূজা ভিন্ন অন্য সমস্ত পূজাই নিষ্ফল। আমি সত্য- সত্য বলিতেছি যে, যোনিপূজা ভিন্ন মন্ত্রও সিদ্ধ হয় না। সুতরাং অন্য সমস্ত পূজা পরিত্যাগ করিয়া যোনিপূজা (শক্তিপূজা) সম্পন্ন করিবে। হে পাৰ্ব্বতি। এই সাধনায় গুরূপদেশ ভিন্ন আমার ভক্তও সিদ্ধিলাভ করিতে পারে না।

ওঁ যোনিপীঠায় নমঃ ।

যোনিতন্ত্রে অষ্টম পটলের অনুবাদ সমাপ্ত ।

॥ সমাপ্ত গ্ৰন্থ ॥