মহাভারতে যৌনতা – শামিম আহমেদ

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  ›› ১৮+  

(সংক্ষেপিত)

ভূমিকা

………‘যৌনতা’ ও ‘কাম’ শব্দ দুটির অর্থ এক নয়। যৌন’ হল যোনিসম্বন্ধী, কন্যাদানাদি, বৈবাহিক। কাম’ হল ইচ্ছা। অর্থাৎ ‘যৌনতা’ কামের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু শব্দটিকে কয়েকটি শর্ত পালন করতে হয়। ……….

যৌনতা ও স্বৈরাচার

………. কাম’ আসলে সহবাসার্থ অভিলাষ বা সঙ্গমেচ্ছা; অন্তত ভাষার পরিবর্তনে কাম’ শব্দার্থের এটিই গ্রহণীয়। এইদিক থেকে দেখলে কাম’ ও ‘যৌনতা’-র মধ্যে বিশেষ পার্থক্য আর থাকে না। যৌনতা এসেছে ‘যৌন’ শব্দ থেকে। যৌনতা’ হল কামপ্রবৃত্তি বা সংগমের ইচ্ছা। ‘যৌন’ শব্দটি যােনিসম্বন্ধী। যােনি—স্ত্রীচিহ্ন, ভগ। ভগ’-এর আবার ১৯টি অর্থ, যার মধ্যে অন্যতম হল কাম ও যােনি। ……. রতিমঞ্জরীতে বিস্তীর্ণ ও গভীর এই দু’প্রকার ভগের উল্লেখ দেখে মনে হয়, ভগ’ আসলে যােনিই।

……….রতিমঞ্জরীতে পাঁচ প্রকার ভগকে উত্তম বলা হয়েছে— কুৰ্ম্মপৃষ্ঠ, গজস্কন্দ, পদ্মগন্ধ অথচ সুকোমল, অকোমল ও সুবিস্তীর্ণ। আবার ভগ শীতল, নিম্ন, অত্যুষ্ণ ও গােজিহ্বসদৃশ হলে তা নিন্দিত।……….

………মঙ্গল ও অমঙ্গলভেদে যোনি দু প্রকার। যে যােনি দৃঢ়, অবয়বে বিস্তৃত, পরিমাণে বৃহৎ ও উন্নত এবং উপরিভাগ মূষিকগাত্রবৎ বিরললোমযুক্ত, এবং যার মধ্যভাগ অপ্রকাশিত, দুই পার্শ্ব মিলিতপ্রায়, গঠনে ও বর্ণে কমলদলের ন্যায়, ক্রমশ অবধাদিকে সূক্ষ্ম ও সুন্দর এবং আকৃতিতে অশ্বখপত্রের ন্যায় ত্রিকোণ— এমন যােনিই সুপ্রশস্ত ও মঙ্গলাবহ। যে যােনি হরিণের ক্ষুরের ন্যায় অল্পায়ত, উনুনের অভ্যন্তর ভাগের মতাে গহ্বরবিশিষ্ট, লোমপূর্ণ এবং যার মধ্যভাগ প্রকাশিত ও অনাবৃত, সেই যােনি নিন্দিত ও অমঙ্গলপ্রদ। কচ্ছপের পিঠের মতাে বিস্তৃত এবং হাতির স্কন্ধের মতাে উন্নত যােনি মঙ্গলদায়ক। যােনির বাম ভাগ উন্নত হলে কন্যা এবং ডান দিক উন্নত হলে পুত্র হয়ে থাকে।………

………মহাভারতে দেখতে পাই, অতি প্রাচীনকালে ‘বিবাহ’ নামক প্রথা ছিল না। পুরুষ এবং নারী যথেচ্ছ কামাচারে লিপ্ত হত। বহু পুরুষে নারী আবদ্ধ হলে বা অনেক নারীতে পুরুষ উপগত হলে তা নিন্দার ছিল না! স্বৈরাচারই ছিল সেই যুগের ধর্ম। পশুপাখিরাও এমন স্বৈরাচারে অভ্যস্ত। তারা সেই প্রাচীন পদ্ধতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করেনি। এমনকী মহাভারতের সময় উত্তরকুরুতে এই স্বৈরাচার বিদ্যমান ছিল। ……….

…….শূদ্র যদি বলপূর্বক ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের স্ত্রীতে উপগত হয় এবং তার সঙ্গমে যদি পুত্রসন্তান না জন্মায়, তাহলে ওই স্ত্রী প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা শুদ্ধ হতে পারেন। অন্যদের এই শুদ্ধির ব্যবস্থা নেই। তবে এ সবই শ্বেতকেতুকর্তৃক বিবাহমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পরবর্তী অনুশাসন।……..

………উপনিষদের শ্বেতকেতু অজ্ঞতা থেকে আত্মজ্ঞান ও সত্যের পথে যাত্রা করেছিলেন। মহাভারতে সেই উদ্দালকপুত্র, আরুণির পৌত্র একদিন পিতামাতার কাছে বসেছিলেন। হঠাৎ এক ব্রাহ্মণ শ্বেতকেতুর মায়ের হাত ধরে তাকে বলপূর্বক নিয়ে যান। এই ঘটনায় শ্বেতকেতু খুব ক্ষুগ্ধ হন। পিতা উদ্দালক তাকে ক্রোধ-সংবরণ করতে বলেন এবং উপদেশ দেন, শােনাে বৎস! সকল স্ত্রীই গাভীর মতাে স্বাধীন অনাবৃত, স্বৈরাচারিণী। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধর্ম হয় না— এটাই সনাতনী ধর্ম। শ্বেতকেতুর রাগ আরও বেড়ে গেল। পুত্রের সামনে মাকে অন্য পুরুষ এসে সংগমের জন্য নিয়ে যাবে, আর জ্ঞানী পুত্র তা মেনে নেবে, এ কেমন করে সম্ভব! ………

…….অঙ্গিরার সঙ্গে কর্দম-কন্যা শ্রদ্ধার বিবাহ হয়। শ্রদ্ধা অঙ্গিবার সম্পর্কে ভাইঝি, অঙ্গিরা-শ্রদ্ধার দুই পুত্র উতথ্য ও বৃহস্পতি। উতথ্যের পত্নী মমতা। একদিন দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি বৌদি মমতার কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করেন। মমতা তখন গর্ভবতী। তিনি দেবরের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, “আপনার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার দ্বারা আমি গর্ভিনী হয়েছি। আপনার বীর্য অমােঘ, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।” বৃহস্পতি মমতার কথা না শুনে বলপ্রয়ােগে উদ্যত হলেন। মমতার গর্ভস্থ শিশু বৃহস্পতিকে রেতঃপাত করতে নিষেধ করল। কারণ, একই গর্ভমধ্যে দু’জনের স্থিতি সম্ভব নয়, তাছাড়া গর্ভগৃহ দু’জনের বাস করার মতাে প্রশস্তও নয়। বৃহস্পতি গর্ভস্থ শিশুর কথায় কান না দিয়ে মমতার অভ্যন্তরে রেতঃপাত করেন। তখন শিশুটি তার পা দিয়ে পিতৃব্যের চেষ্টা ব্যর্থ করল। বৃহস্পতি শিশুকে অভিশাপ দিলেন, তুমি অন্ধ হবে। উতথ্যের পুত্র অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন, তার নাম হল দীর্ঘতমা। ধার্মিক ও বেদজ্ঞ পুত্রকে রােহিনী-সন্তান কামধেনুর কাছে পাঠানাে হল। কামধেনু দীর্ঘতমাকে গােধর্মের শিক্ষা দিলেন | অর্থাৎ তিনি পশুদের মতাে যত্রতত্র সঙ্গম করে বেড়াবেন। দীর্ঘতমার গােধর্মের জন্য অন্য মুনিঋষিরা তাকে পরিত্যাগ করলেন। তিনি প্রদ্বেষী’ নামের এক সুন্দরী ব্রাহ্মণকুমারীর পাণিগ্রহণ করেন। কিন্তু তার স্ত্রী অন্ধ দুর্বিনীত পতিকে অমান্য করতে লাগলেন। পতিকে বললেন তিনি আর স্বামীর ভরণপােষণ করতে পারবেন না, অন্ধ ঋষি স্ত্রীর উপরিভর করে চলতেন। পত্নীর কঠোর বাক্যে ক্রুদ্ধ এবং আহত দীর্ঘত “আজ থেকে আমি এই নিয়ম করে দিলাম, কোনও নারী কখনও একাধিক পতি গ্রহণ করতে পারবে না। স্বামীর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরে যে নারী অন্য পুরুষকে গ্রহণ করবেন তিনি লােকসমাজে নিন্দিতা হবেন। পতিহীনা নারী কোনও সমৃদ্ধি ভােগ করতে পারবেন না। অবশেষে দীর্ঘতমার পুত্ররা মায়ের আদেশে পিতাকে ভেলায় চড়িয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেন। বলি রাজা তাকে দেখতে পেয়ে সন্তান-উৎপাদনের জন্য নিজের প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। বলির মহিষী সুদেষ্ণা দীর্ঘতমার কাছে গেলেন না, পরিবর্তে এক দাসীকে পাঠালেন। সেই শুদ্রকনার গর্ভে ঔরসে কাক্ষীবান প্রভৃতি এগারাে জন ঋষি উৎপন্ন হন। অবশেষে রাজার বিশেষ অনুরােধে সুদেষ্ণা-দীর্ঘতমার মিলন হয়। সুদেষ্ণার পাঁচটি পুত্র জন্মায়। তারা হলেন- অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, সুহ্ম। তাদের দেশ ও একই নামে খ্যাত হয়।………

………..ব্যাসদেবের জন্মবৃত্তান্তের পূর্বে মহাভারতের শুরুতেই এক অনা রকমের যৌনতার কথা বলে নেওয়া দরকার। চেদি দেশে উপরিচর বসু নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি পুরুবংশজাত। চেদি দেশ নর্মদা গােদাবরীর মধ্যস্থ একটি স্থান। ‘উপরিচর’ আসলে উর্ধ্বচর বা আকাশচর, অনেকটা বিহঙ্গের মতাে। ……..উপরিচরের র কাছেই ছিল শুক্তিমতী নদী। এই অনন্ত শুক্তিমতী নদী কোলাহল পূর্বতকে আহ্বান করে। তারা মিলিত হয়। নদীর গর্ভে জন্ম নেয় এক পুত্র ও কন্যা। উপরিচর পুত্রটিকে সেনাপতির কাজে লাগিয়ে দেন আর কন্যাটিকে কর্জমহিষীর আসনে বসান। এই কন্যার নাম ‘গিরিকা। রাজা গিরিকার সঙ্গে নিয়মিত সহবাস করতেন। কিন্তু ঋতুস্নাতা গিরিকার কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করলে তিনি রাজি হতেন না। রাজা তখন মৃগয়ায় বেরিয়ে পড়তেন। এ রকমই একবার রাজা উপরিচর গিয়েছেন মৃগয়ায়। গিরিকার ভাবনা মাথা থেকে যাচ্ছে না কিছুতেই। কামুক রাজা অগত্যা হস্তমৈথুনের দ্বারা বীর্য স্খলিত করেন। তাঁর সেই স্মৃলিত-শুক্র এক শ্যেনপক্ষী পত্রপুটে নিয়ে উড়ে যায়। পথে অন্য একটি শ্যেনপক্ষীর আক্রমণে সেই শুক্র যমুনার জলে পতিত হয়। …… যাই হােক, যমুনার জলে ছিল এক মত্সী। সে ঠিক মাছ নয়, ব্রহ্মশাপগ্রস্থ ‘অদ্রিকা’ নামের এক অপ্সরা। ওই স্খলিত শুক্র থেকে অপ্সরা অদ্রিকা গর্ভবতী হয়। 

অপ্সরারা এমনিতেই জলে বিচরণ করে। অপ্সরাদের স্বর্গবেশ্যাও বলা হয়ে থাকে। মৎসীরূপী অদ্রিকার গর্ভে দশম মাসে শিশু পরিণত হলে এক ধীবর বা ধারণকর্তার জালে সে ধরা পড়ে। অদ্রিকা এক পুত্র ও কন্যার জন্ম দেয়। তার শাপমুক্তি ঘটে। পুত্রকন্যাকে ফেলে দিয়ে সে আকাশপথে চলে যায় মুক্তির আনন্দে। এই সন্তান দুটির মধ্যে উপরিচর পুত্রটিকে গ্রহণ করেন, ধীবরের কাছে রয়ে যায় কন্যাটি। পুত্রটির নাম মৎস্য। কনাটি মৎস্যগন্ধা। ……..

মৎস্যগন্ধার পেশা ছিল নৌকো চালনা। সে ওই যমুনা নদীতেই খেয়া পারাপার করত। যে নদীতে তার জন্ম, সেখানেই শুরু হয় কর্মজীবন। একদিন মৎস্যগন্ধা যমুনায় নৌকো চালাচ্ছিল, এমন সময় পরাশর মুনি তীর্থপর্যটন করতে করতে সেখানে এলেন। পরাশর মুনি শক্তি ও অদৃশ্যত্নীর পুত্র। শক্তি বশিষ্ঠের ছেলে। পরাশর মুনির কোনও স্ত্রী ছিল না। আর তার ভিতরে ছিল অদ্ভুত এক অদৃশ্য শক্তি যা তিনি পেয়েছিলেন পিতা-মাতার কাছ থেকে। ….. নিজের জীবিকার স্বার্থে তিনি হাত মেলালেন মৎস্যগন্ধার সঙ্গে। অতীব রূপবতী চারুহাসিনী মৎস্যগন্ধাকে দেখে মােহিত হয়ে যান মুনি। তিনি বললেন, “হে সুন্দরী, এই নৌকার মালিক কোথায়?” জবাবে মৎস্যগন্ধা জানালাে, “আমিই এই নৌকোর দেখভাল করি। ধীবরের কোনও পুত্র না থাকায় আমিই সকলকে পার করি।” পরাশর মৎস্যগন্ধার নৌকোয় উঠলেন। উঠেই বললেন, “আমি তােমার জন্মবৃত্তান্ত জানি। আমি তােমার সঙ্গে যৌনমিলনে আগ্রহী। আমাদের বংশধর রেখেও যেতে চাই। যে আমার প্রজ্ঞার অধিকারী হবে, আর তােমার কাছ থেকে পাবে কর্মের উত্তরাধিকার। তুমি আমার কামনা পূর্ণ করো। এসাে, আমরা মিলিত হই— পুত্রসন্তান উৎপাদন করি।” | সেই উন্মুক্ত নৌকোয়, যমুনায় উপরে দিনের আলােয় মৎস্যগন্ধা এই রূপ মিলনে সম্মত হল না। সে বলল, “যমুনার দুই তীরে অসংখ্য মানুষ রয়েছে, তারা আমাদের যৌনমিলন দেখতে পাবেন। আমি চাই না, এই ভাবে লােকচক্ষুর সম্মুখে আমরা সঙ্গমে লিপ্ত হই।” পরাশর মুনি মৎস্যগন্ধার কথা বুঝতে পেরে প্রজ্ঞাবলে এমন এক কুয়াশার সৃষ্টি করলেন, যার ফলে চারদিক তমসাচ্ছন্ন হল। পরাশর তারপর বললেন, “এবার এসাে সুন্দরী, কেউ দেখতে পাবে না।” মৎস্যগন্ধা তবুও সম্মত হল না। সে বলল, “ঋষি, আমি কুমারী। আমার এই কৌমার্য কোনও ভাবেই আমি নষ্ট হতে দিতে চাই না। তা ছাড়া আমার জনক ধীবরই আমার প্রকৃত অভিভাবক। কুমারীত্ব হারালে তিনি আমাকে তাড়িয়ে দেবেন। কোন লজ্জায় কুমারীত্ব হারিয়ে গর্ভবতী হয়ে তার কাছে ফিরব আমি। আমার এই কন্যাভাব দূষিত করবেন না মুনিবর।” প্রজ্ঞাবান পরাশর জবাব দিলেন, “তুমি আমার সঙ্গে যৌনমিলনেও কুমারীই থাকবে। তােমার গর্ভজাত সন্তানও সঙ্গে সঙ্গেই ভূমিষ্ঠ হবে। গর্ভধারণের বােঝা তােমাকে বইতে হবে না। আর সেই পুত্র আমার কাছেই থাকবে।” সেই খােলা আকাশের নীচে, কুয়াশাচ্ছন্ন যমুনা নদীর উপরে উন্মুক্ত নৌকায় পরাশর-মৎস্যগন্ধার যৌনমিলন হল। মৎস্যগন্ধার দেহ হয়ে উঠল সুগন্ধময়। তিনি ‘গন্ধবতী’ নামে খ্যাত হলেন। এক যােজন দূর থেকে তাঁর সুগন্ধ পাওয়া যেত বলে লােকে তার নাম দিল ‘যােজনগন্ধা। দ্রুত নৌকা চালিয়ে যােজনগন্ধা সত্যবতী যমুনার দ্বীপে পৌছে গেলেন। সেই দ্বীপে তিনি একটি পুত্র প্রসব করেন। পরাশর-সত্যবতীর পুত্রের নাম হল কৃষ্ণদ্বৈপায়ন’। তার কোনও শৈশব ছিল না। জন্মেই তিনি কিশােরত্ব লাভ করেন। সত্যবতী পিতার ঘরে ফিরে গেলেন। দ্বৈপায়ন ব্যাস চললেন পরাশর মুনির সঙ্গে, অনন্ত প্রজ্ঞক পাঠক্রম নিতে।

পরাশর ও সত্যবতীর এই ‘যৌনমিলনকে কোন বিবাহ আখ্যা দেওয়া যাবে, তা পরিষ্কার নয়। বস্তুত প্রথম দিকে কালী অর্থাৎ মৎস্যগন্ধার কোনও রূপ ইচ্ছাই ছিল না। বরং সে ভয় পেয়ে যায়। সমাজে সে নিন্দিত, তার গায়ে মাছের গন্ধ। পরাশর তাকে সমাজে নন্দিত করবেন এবং তার গায়ের দুর্গন্ধ দূর করে সুগন্ধময় করে তুলবেন, এমন প্রলােভনে মৎস্যগন্ধা রাজি হয়। এমনকী সে তার কুমারীত্ব বিসর্জন দিতে চায় না। পরাশর তাকে নানা লােভ দেখিয়ে যৌনমিলনে সম্মত করান। এই ঘটনাটি দেবী ভাগবত পুরাণেও দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে মাঝ-যমুনায় পরাশর মৎস্যগন্ধার দক্ষিণহস্ত চেপে ধরে তার কাম চরিতার্থ করতে বলেন। মৎস্যগন্ধা কিছুটা ধমকের সুরেই বলে, তার মতাে ঋষির পক্ষে এমন কুপ্রস্তাব মােটেও মানানসই নয়। ঋষির অভিশাপে যমুনায় তার সলিল-সমাধি হতে পারে, এমন কথাও সে ভেবেছিল। সে রাজি হতে প্রায় বাধ্য হয় এবং কস্তুরীগন্ধী’ হিসাবে রূপান্তরিত হয়।……..

……..বারাে রকমের পুত্রের কথা রয়েছে। বিবাহিতা স্ত্রীতে স্বয়ং যে পুত্র উৎপাদন করা হয় তা হল ‘স্বয়ংজাত। বিবাহিত পত্নীতে অন্য উত্তম পুরুষ-দ্বারা যে পুত্র উৎপাদন করা হয় তার নাম ‘প্রণীত। অন্য পুরুষকে ধনসম্পদ দিয়ে প্রলােভিত করে নিজের বিবাহিতা পত্নীতে নিয়ােগের ফলে যে পুত্র লাভ করা হয় তাকে ‘পরিক্রীত বলে। অন্যের বিবাহিতা পত্নীকে পরে যদি অপরপুরুষ দ্বিতীয় বার স্ত্রী-রূপে গ্রহণ করে, তবে দ্বিতীয় পতির ঔরসে সেই স্ত্রীর গর্ভে যে পুত্রের উৎপত্তি হয় তার নাম ‘পৌনৰ্ভব’ । বিয়ের আগে কুমারীর গর্ভে যে পুত্রের উৎপত্তি হয় তাকে ‘কানীন’ বলে। বিবাহিতা স্বৈরিণী মহিলার গর্ভে পতি ছাড়া অন্য কোনও সমানজাতীয় বা উত্তমজাতীয় পুরুষ যে পুত্র উৎপাদন করেন, সেই পুত্রকে বলা হয় স্বৈরিণীজ’। এই ছয় প্রকার পুত্রই বন্ধুদায়াদ এবং তারা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। বাবা-মা যে পুত্রকে অন্য অপুত্রক ব্যক্তির পুত্ররূপে দান করেন, তার নাম ‘দত্ত। মূল্যের বিনিময়ে যদি কেউ পুত্র ক্রয় করে আনেন, সেই পুত্রকে বলা হয় ক্রীত। যদি কোনও বালক স্বয়ং উপস্থিত হয়ে কাউকে পিতা সম্বােধন করে, তাহলে সেই পুত্রকে কৃত্রিম’ আখ্যা দেয়া হয়। যদি বিয়ের সময় পাত্রী গর্ভবতী থাকেন, তবে সেই গর্ভজাত সন্ত্রাসকে ‘সহােঢ়’ বলা হয়। সহােদর ছাড়া অন্য জ্ঞাতির পুত্রকে বলে ‘জ্ঞান্তিরতা’। নিজ অপেক্ষা অধম জাতীয় স্ত্রীতে উৎপাদিত পুত্রকে বলা হয় হীনবানিত। শেষ ছয় প্রকার পুত্র অবক্ষুদায়াদ, এরা পিতার সম্পত্তির অধিকহঁবে না। মহাভারতের অন্যত্র পাঁচ রকমের পুত্রের কথা উল্লিখিত আছে, বিশ প্রকারের পুত্রের কথাও পাওয়া যায় ভীষ্মযুধিষ্ঠির-সংবাদে।……..

…..পুরু বংশের খ্যাতিমান রাজা দুষ্মন্ত ঠিক করলেন, তিনি মৃগয়ায় যাবেন। মালিনী নদীর তীরে কমুনির যেখানে আশ্রম, সেখানেই পরিশ্রান্ত হয়ে দুষ্মন্ত প্রবেশ করলেন।……

…….দুষ্মন্ত আশ্রমের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন এক অপরূপা কুটির আলাে করে বসে আছেন। দুষ্মন্ত মুগ্ধ চোখে তাকে অবলােকন করতে লাগলেন। চার পাশে হিংস্র পশুরা শান্ত হয়ে বসে আছে। দুষ্মন্তের হিংস্র হতে ইচ্ছে করল। বাসনাকে দমন করে তিনি সেই কন্যার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। শকুন্তলা পিতার নামও বললেন, কল্প মুনি। কিন্তু দুষ্মন্ত জানেন কল্প মুনির কন্যা নেই, তিনি উৰ্দ্ধরেতা পুরুষ। শকুন্তলা তাঁর জন্মবৃত্তান্ত বললেন।

বিশ্বামিত্র একদা কঠিন সাধনায় বসেছেন। এমন ধ্যান, যার প্রভাবে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও ভীত হয়ে পড়লেন। যদি বিশ্বামিত্র এই ধ্যান নিরন্তর ভাবে চালিয়ে যান তা হলে তার দেবরাজের আসনও বিশ্বামিত্রের দখলে চলে যাবে। অতএব ধ্যানে বাধা সৃষ্টি করতে হবে। স্বর্গের অপ্সরা মেনকা অসামান্য রূপসী। তাকে ডেকে ইন্দ্র বললেন, “যাও যেনতেন প্রকারে বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গ কর।” মেনকা নেমে এলেন স্বর্গ থেকে। সূক্ষ্ম আবরনে বিশ্বামিত্রের সামনে তিনি নৃত্যাদি পরিবেশন করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে শরীরাবরণ উন্মুক্ত হল তার। বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গ হল। স্বৰ্গবেশ্যার অতুলনীয় যৌন আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না তিনি। শরীরে-শরীরে তীব্র প্রমালাপ হল। মেনকা গর্ভবতী হলেন। কিন্তু তিনি স্বর্গের বাসিন্দা। দীর্ঘ গর্ভধারণের বদলে তিনি মুহূর্তে প্রসব করতে পারেন গর্ভস্থ শিশুকে। এই শিশুই শকুন্তলা। মালিনী নদীর তীরে তাকে পরিত্যাগ করে স্বর্গধামে ফিরে গেলেন মেনকা সুন্দরী। নির্জন নদীতীরে শকুন্তলা অর্থাৎ পক্ষীসকল শিশুকন্যাটিকে পাহারা দিতে লাগল। ঋষি কল্প সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনিই শিশুকন্যাটিকে এনে আশ্রমে রাখেন। সেই শিশুকন্যাই এই যুবতী শকুন্তলা। দুষ্মন্ত কালক্ষেপ না করে শকুন্তলাকে বলে ফেললেন, ‘কন্যা, তােমার রূপে আমি বিমােহিত। আমি কিছুতেই নিজের শরীরকে বাগে আনতে পারছি না। আমরা কি মিলিত হতে পারি না?”

শকুন্তলা এই প্রত্যক্ষ কাম-প্রস্তাবে সম্মত হলেন না। তিনি বললেন, “রাজা, আমি কল্প মুনির দুহিত। পিতার সম্মতি গ্রহণ না করে আমি এই অধর্ম করতে পারি না।” দুষ্মন্ত জানালেন, “এটা অধর্ম নয় শকুন্তলে। তুমি যুবতী, পরিণত। পালকপিতার সম্মতি গ্রহণ করার কোনও প্রয়ােজন দেখি না। আর তুমি শারীরিক মিলনকে অধর্ম বলছ কেন? শাস্ত্রে যে আট প্রকার বিবাহের কথা বলা হয়েছে তার একটি হল গান্ধর্ব মতে বিবাহ। আমরা শারীরিক মিলনের মধ্য দিয়ে সেই বিবাহে আবদ্ধ হব। এসাে।” শকুন্তলা পুনরায় অসম্মতি জানালেন। যদিও তার হৃদয়রূপ ঘনকৃষ্ণবর্ণ মেঘে জলের প্রতীক্ষা। তার সারা শরীর দুষ্মন্তের ক্ষত্রিয় দেহসৌষ্ঠবের জন্য আকুল। তবুও সংযত হলেন তিনি। বললেন, “হে রাজা, আমিও তােমার প্রণয়লাভে ইচ্ছুক। আমার পিতামাতা দুজনেই আমাকে পরিত্যাগ করেছেন। কল্প মুনি অবশ্য পিতৃস্নেহের অভাব রাখেননি। আজ যদি আমি গর্ভবতী হই তাহলে সেই সন্তানও কি কল্প মুনির গৃহে আশ্রমবালক হয়েই দিনাতিপাত করবে? একটি শর্তেই আমি দৈহিক মিলনে রাজি আছি যদি তুমি প্রতিজ্ঞা কর, আমার গর্ভজাত পুত্রই হবে তােমার রাজত্বের উত্তরাধিকারী। যদি হ্যা বলাে, তা হলে আমি যৌনমিলনে প্রস্তুত।”

দুষ্মন্তের চোখমুখ আরক্ত। সারা শরীর বেয়ে দুরন্ত অগ্নির প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তিনি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই যৌনাকাঙ্ক্ষারবশে বলে ফেললেন, “শকুন্তলা, তােমার জন্য আমি যে কোনও অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি। তুমি এসাে, আমার নিকটে এসাে। অপেক্ষা করতে পারছি না আর।” রাজার সঙ্গীরা তখন আশ্রম থেকে বহু দূরে। শকুন্তলা ধীরে ধীরে তার আভরণ খুলে রাখলেন। দুষ্মন্তের কঠিন বাহুতে ভীত সন্ত্রস্ত হরিতা নিজেকে সঁপে দিলেন। অনাঘ্রাতা শকুন্তলা তার উন্মুক্ত বক্ষে দুষ্মন্তকে পেষণ করে বললেন, “আমাকে ভুলে যেও না রাজা। আমি গর্ভবতী হবই। ঋতুচক্রের অমােঘ নিয়মে আমাদের এই সঙ্গম ব্যর্থ হবে না।” দুষ্মন্ত শকুন্তলার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করলেন। তাঁর দক্ষিণ হস্তের অনামিকা থেকে আংটি খুলে পরিয়ে দিলেন শকুন্তলার মধ্যমায়।…….

…….প্রতীপ ছিলেন রাজর্ষি। রাজকার্য চালানাের পাশাপাশি তিনি নিয়মিত জপও করতেন। একদিন গঙ্গাতীরে বসে ধ্যান করছিলেন তিনি। এমন সময়, মনােহর রূপ ধারণ করে গঙ্গা জল থেকে উঠে প্রতীপের দক্ষিণ উরুতে বসলেন। রাজা বললেন, “কল্যাণী, কী অভিলাষ তােমার ?” গঙ্গা উত্তর দিলেন, “কুরুশ্রেষ্ঠ নৃপতি, আমি তােমাকেই চাই”। রাজা জানালেন, পরস্ত্রী আর অসবর্ণা আমার অগম্য। গঙ্গা বললেন, “আমি দেবকন্যা, অগম্যা নই”। কামজয়ী প্রতীপ এবার উত্তরে বললেন, “তুমি আমার বাম উরুতে না বসে দক্ষিণ উরুতে বসেছ। যেখানে পুত্র-কন্যা আর পুত্রবধূর স্থান। তুমি আমার পুত্রবধূ হয়ে।”পরবর্তী কালে শান্তনুর সঙ্গে গঙ্গার বিবাহ হয়।

গঙ্গা শান্তনুর কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর ৩৬ বছর শান্তনু স্ত্রীসঙ্গ ছাড়াই রাজধর্ম পালন করে যাচ্ছেন। এদিকে গঙ্গাপুত্র দেবব্রতেরও বিবাহের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। দেবব্রতের অস্ত্রচর্চা দেখে তিনি ভাবলেন, পুত্র বােধহয় বিবাহে আগ্রহী নয়, বরং তাঁরই দ্বিতীয়বার বিবাহে মনােযােগী হওয়া উচিত। দাসরাজের কন্যাকে তার মনে ধরেছে। যুবতী, অসামান্য রূপবতী সেই কন্যা যমুনা নদীতে নৌকো বায়। যদিও শান্তনু জানেন, এই কন্যার সঙ্গে পরাশর মুনির কুয়াশাচ্ছন্ন সম্পর্কের কথা, কন্যার কানীন-পুত্র ব্যাসদেব সম্পর্কেও তিনি অবহিত। কিন্তু যৌন-মিলনের জন্য এতটাই উতলা হয়ে আছেন যে ওসব কথা ভাবতে পারছেন। যােজনগন্ধা সত্যবতীর গায়ের সৌরভ রাজভায় বসেও তিনি পাচ্ছেন। একি মতিভ্রম হল তার। কৈশােরের প্রেমেরতাে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত এক অস্বস্তি— ……. কিন্তু তুমি। অস্ত্রচর্চা নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকে যে আমি দুশ্চিন্তার সমুদ্রে হাবুডুবু খাই। তাছাড়া বহুদিন আমিও নারীসঙ্গ মানে যৌনমিলন থেকে বঞ্চিত। এই সব কারণেই আমাকে অসুস্থ বলে মনে হতে পারে।” ………

………দেবব্রত আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করার প্রতিজ্ঞ গ্রহণ করেন। কালক্রমে শান্তনু-সত্যবতীর দুটি সন্তান হয় চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য । শান্তনুপুত্র চিত্রাঙ্গদ অতিযৌবনেই মারা যান। কনিষ্ঠ বিচিত্রবীর্য তখন শিশু, শান্তনুও পরলােকে। দেবব্রত ভীষ্মই রাজকাজ সামলান। বিচিত্রবীর্য যুবক হলে তার সঙ্গে অম্বিকা ও অম্বালিকার বিবাহ হয়। এঁরা দুজনেই কাশীরাজের কন্যা। অম্বার কথা পরে বলা হবে। দুই সুন্দরী পত্নীকে পেয়ে বিচিত্রবীর্য ভয়ঙ্কর কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। সাত বছর তিনি অস্বাভাবিক ও অতিরিক্ত রতিক্রিয়ার মেতে থাকলেন। তার পর আক্রান্ত হলেন যক্ষ্মা রােগে। সূর্য যেমন অস্তাচলে ঢলে পড়ে, তেমনই বিচিত্রবীর্য মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

এবার শুরু হল সমস্যা। কুরু বংশের একমাত্র প্রদীপ ব্রহ্মচারী ভীষ্মদেব। তাহলে বংশরক্ষা হবে কী করে? বংশরক্ষার উপায় যৌনমিলন অর্থাৎ বিবাহ। ব্রহ্মচারী ভীষ্ম অটল, কোনও ভাবেই বিবাহ বন্ধবন না, এমনকী বিবাহ-বহির্ভূত যে কোনও শাস্ত্রসম্মত যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হঁবেন না। সত্যবতী ভীষ্মকে অনুরােধ করেও টলাতে পারলেন না। ভীষ্ম জানালেন, পুরাকালে জামদগ্ন্য পরশুরাম কর্তৃক পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হয়। ক্ষত্রিয় নারীরা বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সহবাসে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। বেদেও বলা আছে, ক্ষেত্রজ পুত্র বিবাহকারীরই পুত্র হয়। অতএব দুই বিধবা অম্বিকা ও অম্বালির গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, এমন কাউকে দরকার। মুশকিল আসান হলেন স্বয়ং ব্যাসদেব, সত্যবতীর আমন্ত্রণে তিনি হস্তিনাপুরে এলেন। সত্যবতী তাকে আলিঙ্গন করলেন। স্তনদুগ্ধে সিক্ত করে অশ্রুমােচন করতে লাগলেন রাজমাতা সত্যবতী। কৃষ্ণ বর্ণ, দীপ্ত নয়ন ও পিঙ্গল জটা-শশ্রযুক্ত ব্যাসদেব সব শুনলেন। বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদন করতে হবে তাকে। ইতিপূর্বে তার কোনও রূপ যৌন-অভিজ্ঞতা হয়নি। তিনিও মনে-মনে কিঞ্চিৎ উতলা। ব্যাসদেব সত্যবতীকে বললেন, “যদি অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভধারণ আপনার অভিপ্রেত হয়, তবে তারা আমার দেহের রূপ গন্ধ প্রভৃতি বিরূপতা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত হন এতে তাদের ব্রত পালন করা হবে এবং তাঁরা উৎকৃষ্ট পুত্র লাভ করবেন। পবিত্র বস্ত্র পরিধান করে, নানা প্রকার অলঙ্কার ও প্রসাধনে ভূষিত হয়ে দুই বিধবা সুন্দরী যেন শয্যায় আমার জন্য অপেক্ষা করেন।”

অম্বিকা ও অম্বালিকা সম্মত হলেন না। সত্যবতী প্রায় তাদের জোর করে, মতান্তরে কাকুতি-মিনতি করে রাজি করালেন। বললেন, “ভয় পেয়াে না, তােমাদের দেবর আসবে।” অম্বিকা শয্যায় সুপুরুষ ভীষ্ম প্রভৃতি কুরুশ্রেষ্ঠদের স্মরণ করছিলেন। মহর্ষি বেদব্যাস শয্যাগৃহে প্রবেশ করলে তিনি অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন। তার চেহারা দেখে ভয়ে অম্বিকার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাসদেব ভীত, মুদ্রিতনেত্র অম্বিকার সঙ্গে সঙ্গম করলেন।

পরদিন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন অম্বালিকার শয়মন্দিরে প্রবেশ করলে অম্বালিকাও ভয় পেয়ে যান। তিনি মুনিকে দেখামাত্র ভীতই হলেন না, পাণ্ডুবর্ণা হয়ে গেলেন। সেই বিধবা রানির সঙ্গে যৌনমিলন সম্পন্ন করলেন বেদব্যাস। 

তৃতীয় দিন অম্বিকাকে আবারও অনুরােধ জানানাে হল যাতে তিনি বেদব্যাসের সঙ্গে পুনরায় সহবাস করেন। কিন্তু ব্যাসদেবের চেহারা স্মরণ করে তিনি এক দাসীকে সাজিয়ে তার শােওয়ার ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। দাসীটির সঙ্গে সঙ্গমে ব্যাসদেব অত্যন্ত প্রীত হলেন। যথাকালে অম্বিকার গর্ভে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, অম্বালিকা থেকে পাণ্ডু ও দাসীর গর্ভে ধর্মজ্ঞ বিদুর উৎপন্ন হলেন। এঁদের তিনজনকেই বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ পুত্ৰহিসাবে গ্রহণ করা হল, যদিও বিদুরকে কোন সংজ্ঞাবলে ‘ক্ষেত্রজ পুত্র’ বিবেচনা কইল, তা পরিষ্কার নয়। | ব্যাসদেবের সঙ্গে দুই গররাজি বিরানির যৌনমিলনকে কোনও মতেই স্বাভাবিক বলা যায় না। অসম্মত, নারীর সঙ্গে পুরুষের সঙ্গমকে কী নামে অভিহিত করা যায়, তা বলা অপেক্ষা রাখে না। ব্যাসদেবই মহাভারতের রচয়িতা। তার ঔরসজাত পুত্র এবং তাদের বংশধরের দ্বন্দ্ব মহাভারতের মূল উপজীব্য।

বহুপত্নী ও বহুপতি

এক পুরুষের বহু পত্নী বা এক নারীর অনেক পতির পরিচয় মহাভারতে পাওয়া যায়। …….

……….ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর কথা বলা হল এই কারণে যে, ব্যাস ও বিচিত্রবীর্য এই দু’জনকেই আমরা তাদের পিতা বলে ধরে নেব। ব্যাসের ঔরসজাত কিন্তু বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে উৎপন্ন। এই বিচিত্রবীর্যেরও একাধিক পত্নী— অম্বিকা ও অম্বালিকা। ……….অম্বিকা ও অম্বালিকার শরীরের কান্তি ছিল বৃহতীপুরে ন্যায়। কেশকলাপ কুঞ্চিত ও নীলবর্ণ; নখসমূহ কিঞ্চিৎ উন্নত ও রক্তবর্ণ এবং নিতম্বযুগল ও স্তনযুগল স্থুল। এমন দুই স্ত্রীকে পেয়ে তিনি সম্ভোগে ব্যস্ত রইলেন। যার ফলে হল যক্ষ্মা ও মৃত্যু।…….শক্তির পিতা বশিষ্ঠ মুনি একাধিক নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করেছেন। অরুন্ধতী বশিষ্ঠ মুনির স্ত্রী। সৌদাস রাজা পুত্র উৎপাদনের জন্য স্ত্রীকে আদেশ করলে, তাঁর পত্নী মদয়ন্তী মহর্ষি বশিষ্ঠের সঙ্গে যৌনসংসর্গ করেছিলেন। তাদের পুত্র অশ্যক। ……..অশ্বক আসলে বশিষ্ঠের ঔরসজাত পুত্র। স্বয়ং ব্যাসদেবও তিনটি নারীর সঙ্গে সহবাস করেন। এখানেও বহুগামিতার বিষয়টি পরিষ্কার ওই তিন নারীর মধ্যে একজন আবার দাসী। ব্যাস / বিচিত্রবীর্যের দুই পুত্র রাষ্ট্র ও পাণ্ড বহুগামী ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী ছাড়াও দাসীর গর্ভে তিনি যুযুৎসু’ নামের এক পুত্র উৎপাদন করেন। …….

ধৃতরাষ্ট্রের ভ্রাতা পাণ্ডর দুই স্ত্রী কুন্তী এবং মাদ্রী। হঠাৎ পাণ্ড একদিন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে অরণ্যে চলে গেলেন। ……..একদিন মৃগয়া করতে বেরিয়ে তিনি এক মৃগ দম্পতিকে মিথুনাবদ্ধ অবস্থায় বাণবিদ্ধ করলেন। পুং মৃগটি ছিলেন মহর্ষি কিমিম ৷ তিনি পুত্রার্থেই স্ত্রীর সঙ্গে যৌনসংসর্গ করছিলেন। তবে তারা হরিণের রূপ ধরেছিলেন কেন তা জানা যায় না। যেমন জানা যায় না কেন শিব ও পার্বতী হস্তীর রূপ ধরে মৈথুনে রত হয়েছিলেন। তবে কামশাস্ত্র বা পরবর্তী কালের কামসূত্র বিশ্লেষণ করলে এইরূপ মৈথুনের অন্য ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। যাই হােক, বাণবিদ্ধ মৃগদম্পতি পাণ্ডুর উপর ক্রোধান্বিত হলেন। মৃত্যুর পূর্বে কিমিন্দম মুনি অভিশাপ দিলেন, তার যেমন শােচনীয় ভাবে মৃত্যু ঘটল, পাণ্ডুরও অনুরূপ মৃত্যু ঘটবে। পাণ্ডু নিজের দুষ্কর্মের জন্য অনুতাপের আগুনে পুড়তে লাগলেন। তিনি ঠিক করলেন, তপস্যা দ্বারা এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। সেই উদ্দেশ্যে দুই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে শতশৃঙ্গ পর্বতে চলে গেলেন। সেই পর্বতে বহু মুনিঋষি তপস্যা করছিলেন। পাণ্ডুর সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব হল। কিছু দিন পর তাঁর চিত্তে পুত্রমুখদর্শনের বাসনা জেগে উঠল। মুনির শাপে তিনি স্ত্রীসঙ্গমে অসমর্থ। অগত্যা ক্ষেত্রজ পুত্রলাভের জন্য কুন্তীকে অনুরােধ করতে লাগলেন।

কুমারী অবস্থায় মহর্ষি দুর্বাসার সেবা করায় কুন্তী ঋষির কাছে একটি মন্ত্র শিখেছিলেন। ……… —হে দেবি, এই মন্ত্রের দ্বারা তুমি যে দেবতাকে আহ্বান করবে, সেই সেই দেবতার অনুগ্রহে পুত্র লাভ হবে। কুন্তী তখন যুবতী। তিনি নিতান্ত কৌতূহলবশত ওই মন্ত্র দ্বারা সূর্যদেবকে আহ্বান করলেন। সূর্যদেব কুন্তী কাছে এলে কুন্তীভােজকন্যা সূর্যকে নিরস্ত করতে পারলেন না। তার কুমারীত্ব ও লােকলজ্জার কথা বলেও সূর্যকে আটকানাে গেল না। সূর্যদেবের সঙ্গে পৃথা অর্থাৎ কুন্তীর যৌনসঙ্গম হল। গর্ভবতীও হলেন তিনি। লােকলজ্জার ভয়ে গােপনে ধাত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সদ্যোজাত পুত্রকে তিনি একটি পেটিকায় ঢুকিয়ে অশ্ব নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। যৌবনে কুন্তী অতিশয় সুন্দরী ছিলেন। দীর্ঘনয়না, রূপযৌবনশালিনী, স্ত্রীসুলভ-গুণবতী। …… এই কুন্তীকেই পাণ্ডু শতশৃঙ্গ পর্বতে বললেন, “তুমি তাে জানােই আমি সঙ্গমে অসমর্থ। এখন তােমায় প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব বলব, শােনাে। চারুহাসিনী! প্রাচীনকালে সব নারীই ‘অরুন্ধতী’ ছিল, অর্থাৎ তাদের রুদ্ধ করা যেত না। তারা নিজের বাসনা অনুযায়ী যত্রতত্র বিহার করে বেড়াত ও স্বাধীন ছিল। সুন্দরী তারা বিয়ের পরেও স্বামীকে ছেড়ে নিজের ইচ্ছেমতাে পরপুরুষের সঙ্গে বিচরণ করত, তাতে অধর্ম হত না। কারণ, সব প্রাণীরই এটাই চিরন্তন স্বভাব। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা এখনও আসক্তি ও বিদ্বেষশূন্য হয়ে সেই পুরনাে ধর্মের অনুসরণ করে থাকে। উত্তরকুরুতে বর্তমানে এই নিয়মই প্রচলিত আছে। পদ্মনয়নে! উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতু এক-পতিপ্রথা চালু করেছেন কারণ তিনি অসহিষ্ণু। রাজা সৌদাসও তাঁর স্ত্রীকে বশিষ্ঠের কাছে পাঠান, সন্তান-উৎপাদনের জন্য। বেদব্যাস থেকে আমাদের জন্মবৃত্তান্তও তােমার অজানা নয়। অতএব তুমি ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্য প্রস্তুত হও।”

কুন্তী তার কুমারী অবস্থায় পাওয়া বরের কথা পাণ্ডুর কাছে ব্যক্ত করলেন। কিন্তু মন্ত্রের শক্তি যে তার পরীক্ষিত, সেই কথা প্রকাশ করলেন না। দেববিশেষকে আহ্বান করতে তিনি পাণ্ডুর আদেশ চাইলে ধর্মকে ডেকে পুত্র-উৎপাদনের জন্য পত্নীকে অনুমতি দিলেন কুন্তীর পতি।

সুন্দরীনিতম্বা কুন্তীদেবী শরীরধারী ধর্মদেবের সঙ্গে সঙ্গম করলেন।……কুন্তী জৈষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠিকে প্রসব করলেন। কুন্তী পাণ্ডুর অনুমতি নিয়ে এক বছর পর বায়ুকে ডাকলেন। অত্যন্ত বলবান বায়ুদেব মৃগে আরােহণ করে এসে কুম্ভীকে বললেন, “বলাে হে দেবী, কী অভিলাষ তােমার ?”

কুন্তী বললেন, “আপনার মতাে বলশালী পুত্র।” বায়ু-সঙ্গমে কুন্তী ভীমসেনকে লাভ করেন। পুনরায় আর এক পুত্রের জন্য পাণ্ডুর চিত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠল। কুন্তীও স্বামীর অনুরােধে বুদ্ধিমান তপস্বী অমিতবিক্রম একটি পুত্র ইন্দ্রের সঙ্গম থেকে পাবার জন্য সম্মত হলেন। এক বছর পর ইন্দ্রের ঔরসে কুন্তী সর্বগুণবান অর্জুনকে পুত্ররূপে লাভ করলেন।

তিনটি ক্ষেত্রজ পুত্রের মুখদর্শন করেও পাণ্ডু ক্ষান্ত হলেন না। তিনি পুনরায় কুন্তীকে অন্য দেবতা-শরীরের সঙ্গে সংসর্গ করতে অনুরােধ করলেন। কিন্তু কুন্তী উত্তরে জানালেন, চতুর্থ পরপুরুষ-সংসর্গ করলে সেই স্ত্রী স্বৈরিণী (স্বেচ্ছাচারিণী) এবং পঞ্চম পরপুরুষের সঙ্গে যৌনসঙ্গম করলে বন্ধকী বলে গণ্য হয়। ধর্মজ্ঞ হয়ে পাণ্ডুর এমন অনুরােধ করা উচিত নয়।

পাণ্ডু জানতেন না, কুমারী অবস্থায় কুন্তী সুর্যের ঔরসে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। সেই হিসেবে তিনি সুর্য, পাণ্ড, ধর্ম, পবনদেব ও ইন্দ্র- এই পাঁচ পুরুষের অঙ্কশায়িনী হলেন।

কুন্তী তিন পুত্রের জননী, ধৃতরাষ্ট্র-পত্নী শত পুত্রের মা হয়েছেন; মাদ্রীরও মাতৃত্বের তীব্র বাসনা তাকে ব্যাকুল করে তুলল। একদিন তিনি স্বামীকে একা পেয়ে বললেন, “মহারাজ তােমার অসামর্থ্যও আমাকে দুঃখ দেয়নি। কুন্তী তােমার প্রথম পক্ষের স্ত্রী, এতেও কষ্ট নেই। গান্ধারী শত পুত্রের জননী, এই সংবাদেও আমি বিচলিত নই। কিন্তু মহারাজ,…..আমি ও কুন্তী, দুজনেই তােমার স্ত্রী; কুন্তী পুত্রবতী হলেন, আমি নিঃসন্তান রইলাম— এটাই আমার পরম দুঃখ। কুন্তী যদি আমাকে মন্ত্রটি শিখিয়ে দেন, তবে কৃতার্থ হই। সপত্নীকে মনােবাসনার কথা বলতে পারছি না, তাই তুমি যদি তাকে অনুরােধ করাে!” ……… পাণ্ডুর অনুরােধে কুন্তী মাদ্রীকে মন্ত্রটি শিখিয়ে দিলেন। মাদ্রী সেই মন্ত্রে অশ্বিনীকুমার-নামক দু’জন দেবতাকে এক সঙ্গে আহ্বান করে তাদের সঙ্গে যৌন-সংসর্গ করলেন। মাদ্রীর যমজ পুত্র জন্মায়– নকুল ও সহদেব। পাঁচ পুত্রের মুখদর্শন করেও পাণ্ডুর পুত্ৰস্পৃহা দূর হয়নি। মাদ্রী মন্ত্র ভুলে গিয়েছেন, কুন্তীকে পুনরায় সেই মন্ত্র শিখিয়ে দেওয়ার অনুরােধ করলে কুন্তী পতির অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করলেন। একই সঙ্গে দুই দেবতাকে আহ্বান করে মাদ্রী দুটি পুত্র একই সময়ে লাভ করায় কুন্তী ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। কুন্তী বললেন, “মাদ্রী ধূর্ত স্ত্রীলােক, দুই দেবতাকে একত্রে স্মরণ করেছে সে। আমি প্রতারিত হয়েছি।

মাদ্ৰীও তিন পুরুষের অায়িনী হলেন– তাঁরা হলেন পাণ্ডু ও দুই অশ্বিনীকুমার। | ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু যে ব্যাসদেবের পুত্র, সেই অর্থে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব পাণ্ডুর পুত্র নন। অন্য দিকে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ যেহেতু ঔরসজাত, তাই তাঁরাই ব্যাসদেবের রক্তের উত্তরাধিকারী।

পাণ্ডু পাঁচ পুত্র নিয়ে আপন বাহুবলকে আশ্রয় করে পার্বত্য মহাবনে মহাসুখে বাস করতে লাগলেন। কিন্তু একটিই সমস্যা, তিনি স্ত্রীদ্বয়ের সঙ্গে সহবাস করতে পারছেন না। কিমিন্দম মুনির অভিশাপ সর্বদাই তাঁর মস্তিষ্কের ভিতরে, তাই দেহমন চঞ্চল হলেও অতি কষ্টে নিজেকে সংযত রাখছেন।

……. কোকিল ও ভ্রমর রব করে বেড়াচ্ছে। এ হেন বনে পাণ্ডুর দেহ মনে কামের আবির্ভাব হল। মাদ্রী অতি সূক্ষ্মবস্ত্র পরিধান করে পাণ্ডকে অনুসরণ করছেন। যুবতী মাদ্রীকে দেখে, তার সূক্ষ্ম বস্ত্রের ভেতর দেহসৌষ্ঠব দেখে পাণ্ডুর কামানল দাবানলের মতাে বৃদ্ধি পেতে লাগল। নির্জনে একাকিনী পদ্মনয়না মাদ্রীকে দেখে পাণ্ডু কামাবেগ রুদ্ধ করতে পারলেন না বরং তিনিই কামবলে অভিভূত হলেন। রূপবতী মাদ্রী শক্তি অনুযায়ী অঙ্গসঞ্চালন করে রাজাকে বাধা দিতে লাগলেন। কিন্তু পাণ্ডু শুনবেন কেন? তিনি বলপূর্বক মাদ্রীকে বশীভূত করে ফেললেন। যে রাজার চিত্ত কামে আকুল, তাকে শাপের বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া মাদ্রীর কর্তব্য ছিল। মাদ্ৰীও হয়তাে ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে সেই অভিশাপ ভুলে গিয়েছিলেন। পাণ্ডুরও স্মরণে ছিল না সেই শাপবাণী। তিনি বলপূর্বকই মাদ্রীর সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হলেন। সঙ্গম চলাকালীনই পাণ্ডু পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হলেন। মুনির শাপ সত্যে পরিণত হল।………

……….বিভিন্ন পুরাণে কাম সম্বন্ধে নানা কথা পাওয়া যায়। ব্রহ্মার হৃদয় থেকে কামের জন্ম- মৎস্যপুরাণে এমন উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রহ্মা নিজে কামশরে দগ্ধ হয়ে নিজকন্যা শতরূপাকে গ্রহণ করেন। সৃষ্টির শুরুতেই এই অজাচার (Incest) সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। ………

………উতথ্য ঋষির স্ত্রী মমতার গর্ভবতী অবস্থায় দেবর দেবগুরু বৃহস্পতি সঙ্গম প্রার্থনা করলে মমতা নিষেধ করেন। তখন বৃহস্পতি মমতাকে ধর্ষণ করেন। গর্ভস্থ শিশু পা দিয়ে বৃহস্পতির বীর্যপাত আটকায়। বৃহস্পতির বীর্য ভূমিতে পতিত হয়ে আর একটি পুত্র উৎপন্ন হয়। মমতা সেই পুত্রকে ত্যাগ করতে চান, কারণ তিনি ব্যভিচারিণী জানলে স্বামী তাকে ত্যাগ করবেন। বৃহস্পতি ও মমতা উভয়েই পুত্রটিকে ত্যাগ করে চলে যান। তখন মরুগণ এই শিশুকে পালন করেন। সেই পুত্রের নাম ভরদ্বাজ। মহর্ষি ভরদ্বাজ গঙ্গার নির্জন স্থানে বাস করতেন। একদিন হােমের জন্য তিনি গঙ্গা নদীতে গমন করেন। সেখানে রূপযৌবনসম্পন্ন, যৌবনগর্বিতা এবং যৌবনমদে মন্দগমন ঘৃতাচী নামের অপ্সরাকে স্নানের শেষে বস্ত্র পরিত্যাগ করতে দেখলেন। নদী তীরের বায়ু ঘৃতাচীর বস্ত্র আকর্ষণ করে নিলে তার সমস্ত অঙ্গই ভরদ্বাজের কাছে প্রকাশিত হয়। এই রূপ অবলােকন করে ভরদ্বাজের কামােদ্রেক এবং শুক্রক্ষরণ হয়। তিনি একটি দ্রোণে সেই শুক্র রাখেন। সেই ধীমান মহর্ষির কুস দ্রোণের জন্ম হল।………..

…….ঋষি বা ব্রাহ্মণরা যে ক্ষত্রিয় নারীতে উপগত হতেন তার দুই পক্ষই বহুপত্নী ও বহুপতিবাদের শিকার। কারণ, আধুনিক সমাজদর্শন বলে, পরিবার হল এমন এক সামাজিক গােষ্ঠী; যেখানে সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে একটি সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী যৌন সম্পর্কের দ্বারা নর ও নারী আবদ্ধ হয়। সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধের মাধ্যমে নর ও নারী যৌন সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে সহবাসের সম্মতি লাভ করে, নইলে অজাচার (Incest) প্রশ্রয় পায়। মানুষের সঙ্গে ইতরপ্রাণীর এখানেই পার্থক্য। তাদের যৌনক্রিয়ার মধ্যে কোনও বাধানিষেধ নেই। যে কোনও পুরুষ প্রাণী যে কোনও স্ত্রী প্রাণীর সঙ্গে মিলিত হতে পারে। মানুষের যৌনক্রিয়া অবাধ নয়, বিধি অনুযায়ী তা সংগঠিত হয়। কিন্তু মহাভারতের মতাে মহাকাব্যে অবাধ যৌনক্রিয়ার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ভরত পুত্রের জন্ম দিতে সমর্থ, এমনকী তাঁর নয়জন ঔরসজাত পুত্র থাকা সত্ত্বেও তিনি ভরদ্বাজ মুনিকে তার স্ত্রীর গর্ভসঞ্চার করতে বলেন।

পঞ্চপাণ্ডবের বহুপত্নীর কথা সুবিদিত। দ্রৌপদী ছিলেন তাঁদের সকলের ভার্যা। দ্রৌপদীর বহুপতিত্বের পাশাপাশি যুধিষ্ঠিরও দুইজন নারীর স্বামী ছিলেন। যুধিষ্ঠিরের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম দেবিকা। একই নামের অন্য আর এক জন নারী বিদুরের স্ত্রী ছিলেন। ……..দ্রৌপদী ছাড়া ভীমসেনের তিনজন স্ত্রী ছিলেন– হিড়িম্বা, বলন্ধরা ও কালী।…….

………হিড়িম্বা তার মােহিনীমায়ায় ভীমকে কামাতুর করে তুলল। তারপর তার দুই বৃহৎ তালফলবৎ স্তন দ্বারা ভীমের বক্ষ মর্দন করতে করতে বলল, “জানাে, আমি তােমাকে প্রথমে যক্ষ ভেবেছিলাম। তুমি যে মানুষ, সে কথা জানলে ভক্ষণই করে ফেলতাম।”

দ্বিতীয় পাণ্ডব বললেন, “কেন, এখন তাে আমাকে ভক্ষণই করছো।” তারপর ভীম হিড়িম্বার ওষ্ঠ পীড়ন করতে লাগলেন। তার নিষ্ঠুর কামনায় হিড়িম্বার স্তনবৃন্ত বুঝি বা ছিড়ে গেল। একে একে দেহাবরণ খুলে যেতে লাগল। উর্ধ্বাঙ্গের পীড়নে নিম্নাঙ্গে জ্বলে উঠল কামাগ্নি। তরঙ্গের পর তরঙ্গ আসতে লাগল। তরল এক বহ্নি হিড়িম্বার জঠরে প্রবেশ করে। আপ্লুত হয়ে ওঠে সে।…..

…….কুন্তীর আশঙ্কা ছিল, দুর্যোধন পাণ্ডবদের হত্যা করেনি তাে! গভীর রাতে তিনি ভীমের গলা পেলেন, “মা ভিক্ষা এনেছি”! কুন্তী ঘরের ভেতর থেকেই জবাব দিলেন, “সকলে মিলে ভােগ করাে”। দরজা খুলেই তিনি পুত্রদের সঙ্গে এক যুবতীকে দেখলেন। সেই নারী অনুপম রূপবতী। নীলাভ বর্ণের সেই রমণীর চোখ দুটি পদ্মের পাপড়ির মতাে। তার দেহের সুগন্ধে চারদিক ম ম করছে। এক ঢাল কোঁকড়ানাে দীর্ঘ চুল, তাঁর শ্রোণিদেশ অতি মনােহর। সেই গভীর রাতেই হিড়িম্বা পাণ্ডবদের ত্যাগ করে চলে যান বলে দৃঢ় অনুমান করা যেতে পারে।……..

………কল্যাণী দ্রৌপদী আমাদের সকলের ভার্যা হবেন। পাণ্ডবগণ শােওয়ার আয়ােজন করলেন। কুশময় শয্যা রচনা করলেন সহদেব। তার উপর আপন আপন মৃগচর্মে পঞ্চপাণ্ডব শয়ন করলেন। তাঁদের মাথা দক্ষিণ দিকে থাকল। কুন্তী তাদের মাথার উপরে এবং দ্রৌপদী চরণের নিম্নে শয়ন করলেন। দ্রৌপদীকে পাণ্ডবরা যেন পা-বালিশ করলেন | এতে দ্রৌপদীর কোনও দুঃখ হল না। | কিছুদিন পর দ্রুপদ পাণ্ডবদের কাছে হাজির হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “বাবা ধর্মপুত্র, বেদে এক পুরুষের অনেক স্ত্রী বিহিত আছে বটে, কিন্তু একটি স্ত্রীর অনেক পতি কোথাও শােনা যায় না। আপনার এমন বুদ্ধি হল কেন?”………

…….সহদেব বললেন, “একজন পুরুষের যদি বহু পত্নী থাকতে পারে, তাহলে একজন নারীর পঞ্চ স্বামীত্বে আপত্তি কোথায়?” ধৃষ্টদ্যুম্ন জানালেন, “একজন পুরুষ একটি নারীতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তাকে একাধিক বিবাহের অনুমতি দিলে সমাজে ব্যভিচার বাড়বে। তাছাড়া পুরুষের বহুবিবাহ তার অধিকার ও স্বাধীনতার ব্যাপার। শুধু সনাতন ধর্ম কেন, জগতের অন্য ধর্ম ও পুরুষের বহুবিবাহ স্বীকার করে, কিন্তু নারীর বহুপতিত্ব অস্বীকৃত। বহুপত্নী পুরুষকে সহিষ্ণুতা প্রদান করে, পতিতালয়ে যেতে বাধা দেয়।

সহদেব উত্তরে বললেন, হিমালয়ের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে শাক্যরা অনেকে মিলে একটি নারীকে বিবাহ করে। নেপাল ও দক্ষিণ ভারতের বহু স্থানে ভ্রাতৃগণ একপত্নীতে উপগত হয়। একে বলে সৌভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিবাদ। হিরণ্যাক্ষের ভগ্নী প্রচেতা দশ ভাইয়ের পত্নী হয়। চেরালাম ও কেদারখণ্ডের বহুস্থানে এই নিয়ম চালু আছে। শুধু পুরুষ বহুবিবাহ করতে পারবে, নারী পারবে না সে কথা ভ্রান্ত। নীলগিরির কুরু, মালাবারেরতোলকোলান, ইশাবানরা অনেকে মিলে একটি নারীকে সম্ভোগ করে।

যুধিষ্ঠির জানালেন, পুরাণে শুষ পাই, জটিল নামে গৌতমবংশীয়া এক রমণী ধার্মিকশ্রেষ্ঠা ছিলেন। তিনি সাত জন মুনিকে পতিরূপে আশ্রয় করেছিলেন। বাক্ষী নামের এক যুনিকন্যা প্রচেতা-নামধারী দশ ভাইয়ের সঙ্গে পত্নীরূপে মিলিত হয়েছিলেন। তাছাড়া, মাতা কুন্তী বলেছেন, যা এনেছে, সকলে মিলে ভােগ করাে। মায়ের কথা তাে অমান্য করতে পারি না।

কুন্তী বললেন, যুধিষ্ঠির যা বলেন তাই সত্য। অতএব দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের ভার্যা হােন।……..

……..ধৃষ্টদ্যুম্ন তবুও বহুপতিত্ব মানতে পারলেন না। তিনি প্রাচীন কাল থেকে যে বহুপত্নিকতা প্রচলিত আছে তার উল্লেখ করে বললেন, ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ-প্রজাপতি মারীচ-কাশ্যপকে তেরােটি এবং ধর্মকে দশটি কন্যা দান করেন। এই ভাবে তিনি চন্দ্রকে সাতাশটি কন্যা দান করেছিলেন। বিষ্ণুর নবম অবতার শ্রীকৃষ্ণের আট জন স্ত্রী ছিলেন। নরকাসুরের কবল থেকে মুক্ত করে ১৬, ১০০ গােপিনীকেও তিনি বিবাহ করেন।…..

………দ্রৌপদীর গর্ভে অর্জুনের একটি পুত্র জন্মায়, তার নাম শ্রুতকীর্তি। যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদী ও ভীম-যাজ্ঞসেনীর পুত্রদ্বয় হল যথাক্রমে প্রতিবিন্ধ্য ও সূতসােম এরা সকলেই অশ্বত্থামার হাতে নিহত হয়।

দেবর্ষি নারদের উপদেশ মতাে পান্ডবরা নিয়ম করেছিলেন, দ্রৌপদী যখন যাঁর সঙ্গে থাকবেন, তখন তিনি ছাড়া কোনও ভাই দ্রুপদ-কন্যার শােওয়ার ঘরে ঢুকতে পারবেন না। যদি কেউ এই নিয়ম লঙ্ঘন করেন, তাহলে তাকে বারাে বছর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে বনে কাটাতে হবে। একদিন এক ব্রাহ্মণের গরু চোরেরা নিয়ে পালাচ্ছিল। ব্রাহ্মণ কাঁদতে কাঁদতে পাণ্ডবদের দ্বারস্থ হলে অর্জুন তাকে অভয় দিলেন এবং অস্ত্রাগারে প্রবেশ করে ধনুর্বাণ নিয়ে ব্রাহ্মণের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন। সেই ঘরে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর সঙ্গে কামক্রীড়ায় মত্ত ছিলেন। অর্জুন তা দেখে ফেলেন। ব্রাহ্মণের গরু উদ্ধার করার পর তিনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তিনি বারাে বছরের জন্য বনে যাবেন। ………তিনি বনে যাত্রা করলেন। অনেক ভ্রমণ করে একদিন হরিদ্বারে উপস্থিত হলেন। গঙ্গাস্নান করে তীরে উঠবেন, সেই সময় কৌরব্যনাগের কন্যা উলুপী তাকে জলের মধ্যে আকর্ষণ  করে পাতালপুরীতে নিয়ে গেলেন। অসামান্য রূপবতী উলুপীর গায়ের রং কাঁচা সােনার মতাে। কৌরব্যনাগ ঐরাবত তার এই অপরূপা কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বামী সুপর্ণ কর্তৃক অপহৃত হন। উলুপী তাই বাপের বাড়িতে থাকতেন। পাতালপুরীতে গিয়ে অগ্নিকে প্রণাম করে অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁকে কেন নাগালােকে আনা হয়েছে? উলুপী জবাবে বলেন, “হে মহাবাহাে। তােমার স্নানকালে আমি তােমাকে দেখে কামাতুর হয়েছি। তােমাকে পতিরূপে পেতে বাসনা করি।” অর্জুন তাঁর প্রতিজ্ঞা ও ব্রহ্মচর্যের কথা জানালেন। উলুপী তাতেও দমলেন না। বললেন, “তােমার ব্রত আসলে দ্রৌপদী সম্বন্ধে ব্রহ্মচর্য পালন, আমার বাসনা পূরণ করলে অধর্ম হবে না। আমি শরণাগতা, আমার জীবনযৌবন রক্ষা করাই তােমার ধর্ম।”

স্বামী অপহৃত হওয়ার পর থেকে উলুপীর সমস্ত যৌনাকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। উলুপীর কাতর প্রার্থনায় অর্জুন সেই রাতে উলুপীকে সম্ভোগ করেন। কামে পীড়িতা নাগকন্যার সঙ্গে তৃতীয় পান্ডব সর্বপ্রকার রমণ করলেন। উলুপীর গর্ভে অর্জুনের ইরাবান’ নামে এক ঔরসজাত পুত্র জন্মগ্রহণ করে। ……

………উলুপীর সঙ্গে রমণের পর বহু দশ ঘুরে অর্জুন পৌছলেন দক্ষিণপশ্চিম ভারতে, মণিপুরে। সেই রাষ্ট্রের অধিপতি চিত্রবাহনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে তাঁর রূপে মুগ্ধ হলেন অর্জুন। চিত্ৰবাহনের কাছে তিনি চিত্রাঙ্গদাকে প্রার্থনা করলেন। চিত্ৰবাহন বললেন, “চিত্রাঙ্গদা আমার একমাত্র সন্তান। কন্যার সন্তান যদি আমার কাছে থাকে, তবেই কন্যাদান করব।” অর্জুন রাজি হলেন। কামের দহনে তিনি তখন টগবগ করে ফুটছেন। বিবাহ সম্পন্ন হতে না হতেই চিত্রাঙ্গদার উপর ঝাপিয়ে পড়লেন অর্জুন। টানা তিন বছর তিনি শ্বশুর বাড়িতে ঘর-জামাই থেকে চিত্রাঙ্গদাকে সম্ভোগ করলেন। চিত্রাঙ্গদার একটি পুত্র জন্মায়, তার নাম ‘বভ্রূবাহন’।

তিন বছর পর বহু তীর্থ ঘুরে ব্রহ্মশাপগ্রস্ত পাঁচ নারীকে উদ্ধার করে পুনরায় রমণের টানে চিত্রাঙ্গদার কাছে ফিরে গেলেন। পরে আবার সাক্ষাৎ হবে, এই আশ্বাস দিয়ে অর্জুন পুনরায় তীর্থভ্রমণে বের হলেন। প্রভাসতীর্থ, রৈবতক পর্বতে কিছুকাল কাটানাের পর অর্জুন দ্বারকায় গিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে বাস করতে লাগলেন। একদিন উৎসব উপলক্ষে সখী-পরিবৃতা কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকে দেখে তিনি তাকে পাওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠলেন। কৃষ্ণের পরামর্শমতাে তিনি সুভদ্রাকে বলপূর্বক রথে তুলে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে যাত্রা করেন। দ্বারকাতে সেই খবর পৌছতেই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। কৃষ্ণ নীরব, বলরাম ক্ষিপ্ত। শেষ পর্যন্ত পিসতুতাে ভাইয়ের হয়ে কৃষ্ণ নানা প্রবােধে বলরামকে শান্ত করলেন। অর্জুনের মাতুলকন্যা অর্থাৎ ভগিনী এবার তাঁর ভার্যা হলেন। লাল শাড়ি পরে গােপবালিকার বেশে সুভদ্রাকে নিয়ে এলেন অর্জুন। দ্রৌপদীর ভয়ে অর্জুন সুভদ্রাকে বহুমূল্য পরিচ্ছদাদি দেননি। অর্জুন-সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যু।।

এই প্রসঙ্গে দ্রৌপদী ও সুভদ্রার বেশভূষা ও রূপচর্চা নিয়ে সামান্য দু’ চার কথা বলা আবশ্যক। তারা কীভাবে পতিদের মনােরঞ্জন করতেন, তা এই সাজপােশাক থেকে কিছুটা বােঝা যাবে।

পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে সালঙ্কারা দ্রৌপদীর যখন বিবাহ হয় তখন তিনি ক্ষৌমবস্ত্র পরিধান করেছিলেন। একে অতসীবসন বা পট্টবস্ত্র বলা যেতে পারে। কৃষ্ণাঙ্গী দ্রৌপদী কোন রঙের বস্ত্র ব্যবহার করতেন তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। সুভদ্রা দ্রৌপদীর চেয়ে অনেক বেশি শৌখিন ছিলেন। বিয়ের দিন তিনি রক্তবর্ণের কৌশেয় বস্ত্র পরেছিলেন। দ্রৌপদী সুবর্ণমালাকুণ্ডল, নিষ্ক, কস্তু, কেয়ুর প্রভৃতি অলঙ্কার ব্যবহার করতেন। ভ্রূর মাঝখানে একটা কৃত্রিম চিহ্ন আঁকতেন যাজ্ঞসেনী রক্ততিলকাকৃত এই কৃত্রিম চিহ্নটিলো হয় পিপ্ল বা জটুল, যাকে ইংরেজিতে ‘পিম্পল’ বলা হয়। মহাভারত এটিকেও অলঙ্কার বলেছেন।…….. উভয়েই ত্বকের যত্ন নিতেন। মুখে তেল ছাড়া খড়ির ব্যবহার ছিল। ঘুমােতে যাওয়ার আগে ভেড়ার গায়ের ঘাম মাখার বর্ণনা পাওয়া যায়। রাজহাঁসের চর্বি, গােলাপজল, শামুকের নরম অংশটি পুড়িয়ে ফেসপ্যাক ইত্যাদি ব্যবহার করত পাণ্ডব ভার্যাদ্বয়। শরীরের নানা জায়গায় অবাঞ্ছিত লােম দূর করতে একটি পাথর ব্যবহার করতেন তারা, বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে সরীসৃপ-সীসা। তাছাড়া, রােম উৎপাটক হিসাবে বিশেষ এক গাছের আঠা লাগানাে হত, এমন কথাও পাওয়া যায়।

অর্জুনের বহুবিবাহে প্রবেশ করা যাক। উলুপীর কামনা পূর্ণ করায় অর্জুনের হয়তাে ব্রহ্মচর্য স্খলিত হয়নি। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রাকে তিনি কামাতুর হয়ে বিয়ে করেছেন। ধর্মানুসারে এতে অর্জুনের ব্রতভঙ্গ হয়েছে। অরণ্যবাস তাে করেনইনি, বরং দুই শ্বশুরবাড়িতে তিন-তিন ছ’বছরেরও বেশি ঘর-জামাইয়ের আদরে থেকেছেন। এইগুলাে অর্জুন-চরিত্রের দুর্বলতা, না কি, তার যৌনতার সবলতা তা পরিষ্কার নয়।

মহাভারতের তামিল সংস্করণে দেখা যায়, অর্জুন মােট সাতজন নারীর স্বামী। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন যােদ্ধা, তার নাম ‘অলি’। ইনি অর্জনের বিবাহ-প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অর্জুন তখন কৃষ্ণের শরণাপন্ন হন। কৃষ্ণ অর্জুনকে সর্পে পরিণত করে অলির বিছানায় রাতে শুয়ে থাকতে বলেন এবং অলিকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার ভয় দেখাতে বলেন। সর্পরূপী অর্জুন তাই করেন। অলিও সাপে পরিণত হয়ে অর্জুনের সঙ্গে কামক্রীড়া করেন।…………..

……….ইন্দ্ৰ গৌতম মুনির স্ত্রী অহল্যাকে ধর্ষণ করেন। মনে করা হয়, ইন্দ্ৰই জগতে প্রথম ধর্ষণ-প্রথা চালু করেন। গৌতম তাঁর স্ত্রী ধর্ষিতা হয়েছেন জেনে ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন। কেউ কেউ বলেন, ইন্দ্রকে অহল্যা চিনতে পেরেও সঙ্গমে সম্মত হন। সঙ্গমের পর তাকে তড়িঘড়ি পালাতে বলেন। স্নান সেরে গৌতম মুনি ফিরলে তিনি ইন্দ্রকে বৃষণ অর্থাৎ অণ্ডকোষহীন হওয়ার অভিশাপ দেন। গৌতম অহল্যাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “মার্জার চলে গিয়েছে। এই মার্জার’ শব্দটির আর একটি অর্থ নিষিদ্ধ প্রেমিক। অহল্যা গৌতমের শাপে পাথর হয়ে যান। ইন্দ্রের স্ত্রী হলেন ইন্দ্রাণী ও/বা শচী। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে কথিত আছে, ইন্দ্র যৌন-আবেদনে আকৃষ্ট হয়ে ইন্দ্রাণীকে বিবাহ করেন। অন্যান্য গ্রন্থে এমন কথা পাওয়া যায় যে তিনি ইন্দ্রাণীর সতীত্ব নষ্ট করেন এবং অভিশাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইন্দ্রাণীর পিতা পুলােমহত্যা করেন। আরুণির গর্ভে ইন্দ্র বালীর জন্ম দেন। শচীদেবী ও ইন্দ্ৰকৈ অভিন্ন বলে কেউ কেউ মনে করেন। শচীদেবী জয়ন্ত, ঋষভ ও মিস নামে তিনটি পুত্রের জন্ম দেন। অপ্সরাশ্রেষ্ঠ উর্বশী ইন্দ্রের যৌনসঙ্গিনী ছিলেন। উর্বশী শাপগ্রস্থ হয়ে মর্তে রাজা পুরুরবার স্ত্রী হন। দিনে তিনবার উর্বশীকে সম্ভোগ করতেন রাজা। পরে তাঁদের বাৎসরিক কামক্রীড়ার বন্দোবস্ত হয়। উর্বশী প্রতি বছরই পুরুরবাকে একটি করে সন্তান দান করতেন। অর্জুন যখন দেবলােকে যান তখন নৃত্যরতা উর্বশীর দিকে বার বার তাকালে পিতা ইন্দ্র তার যৌনসঙ্গিনীকে পুত্র অর্জুনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কামাতুরা উর্বশীকে অর্জুন মাতা-জ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করলেন। উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়ার জন্য উর্বশী ক্রোধে অর্জুনকে অভিশাপ দিলেন– 

তােমার পিতার নির্দেশে আমি স্বয়ং তােমার গৃহে এসেছি। যেহেতু কামার্তা আমাকে তুমি গ্রহণ করলে না, সেই হেতু হে পার্থ, মানবর্জিত এবং অপুরুষরূপে খ্যাত হয়ে তুমি নর্তকরূপে স্ত্রীলােকের মধ্যে নপুংসকের ন্যায় বিচরণ করবে।

দেবলােক থেকে ফিরে এক বছর অজ্ঞাতবাস করার জন্য বিরাট রাজার পুরীতে সকলে এলেন। ….. বিরাট রাজা মহিলাদের দিয়ে অর্জুনের ক্লীবত্ব পরীক্ষা করে তবেই তাকে অন্তঃপুরের কুমারীদের সঙ্গীত-শিক্ষার ভার দিলেন।

নকুল ও অর্জুন দু’জনেই ইন্দ্রের পুত্র। আচার্য যাস্ককে স্বীকার করলে তাই বলতে হয় | অর্জুনের যেমন চারজন পত্নী, ইন্দ্রের অগণিত যৌনসঙ্গিনী; তেমনই নকুলের স্ত্রীসংখ্যা দুই। সংখ্যায় কম হলেও তিনি বহুপত্নীবাদ স্বীকার করতেন। ……..

…….পঞ্চম পাণ্ডব মাদ্ৰীতনয় সহদেবের পিতা রেবন্ত, যাঁকে আচার্য যাস্ক বলেছেন সূর্য। অর্থাৎ কর্ণের এবং সহদেবের পিতা অভিন্ন। কর্ণের মা কুন্তী কিন্তু মাদ্রী হলেন সহদেবের জননী। কুমন্ত্রী সপত্নী। সহদেবের তিন স্ত্রী দ্রৌপদী, বিজয়া ও জরাসন্ধসূতা। বিজয়া হলেন মদ্ররাজ শলের কন্যা। তিনি সহদেবের মামাতাে বোেন। স্বয়ংবর-সভায় বিজয়া সহদেরে কন্ঠে বরমাল্য অর্পণ করেন। তার পুত্র সুহােত্র কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে নিহত হন। সহদেবের তৃতীয় ভার্যার নাম জানা যায় না। ………

………দ্বাপরযুগে স্ত্রী-পুরুষের যৌনসংযােগ প্রথম শুরু হয়। তখন থেকেই বহুপত্নী ও বহুপতিবাদের উৎপত্তি। ………মহাভারতে রক্ষিতা পােষণের কথাও পাওয়া যায়। গান্ধারী যখন প্রৌঢ়া, তখন এক বৈশ্যা ধৃতরাষ্ট্রের পরিচর্যা করতেন। তার গর্ভে যুযুৎসুর জন্ম। সেই মহিলা যে দাসী ছিলেন, এমন কথা মহাভারতে লেখা নেই। এটিকে তাই রক্ষিতা-পােষণের উদাহরণ বলা যেতে পারে। তবে দাসীরা প্রভুদের স্ত্রীরূপেই বিবেচিত হতেন। নইলে কীভাবে বিদুরকে বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ পুত্র’ বলা হবে। | বহুপতিবাদের আরেকটি উদাহরণ হল, অতিথির মনােরঞ্জনে নিজের স্ত্রীকে পাঠানো। এখানে মনােরঞ্জন’ বলতে দেহদানকেই বুঝতে হবে। মহাভারতের অনুশাসনপর্বে ভীষ্মদেব পাণ্ডবদের ওঘবকি কাহিনি বলছেন। এই নারী ওঘাবানের কন্যা, ইক্ষাকুবংশীয় রাজকুসুদর্শনাপুত্র সুদর্শনের স্ত্রী। সুদর্শন ওঘবতীকে নিয়ে কুরুক্ষেত্রে বাস করুত থাকেন। তিনি স্ত্রীকে বলেন, তিনি যেন অতিথি সৎকারে যত্ন নেয় অতিথি যা চাইবে, তাই যেন দিতে প্রস্তুত থাকেন। এমনকী স্বামী গৃহে না থাকলেও অতিথির সেবায় যত্ন নেবেন। একদিন সুদর্শনের অনুপস্থিতিতে এক অতিথি এসে ওঘবতীর সেবা পেতে চান। ওঘবতী সেই অতিথির প্রয়ােজন সম্বন্ধে জানতে চাইলে, তিনি সুদর্শনপত্নীকেই প্রার্থনা করে বসেন। ওঘবতী বললেন, “তাই হােক”| সহাস্যে সেই নারী অন্য গৃহে প্রবেশ করলেন। এমন সময় সুদর্শন বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বার বার ডাকতে লাগলেন। অতিথির সঙ্গে সঙ্গমে ব্যস্ত ওঘবতী নিরুত্তর রইলেন। সুদর্শনের ডাকে অতিথি ঘরের ভিতর থেকে বললেন, “আমি অতিথি, তােমার স্ত্রী আমাকে দেহদান করছেন। এবার তােমার যা ভাল মনে হয়, করাে।” সুদর্শন যৌন-ঈর্ষা ও ক্রোধ সংবরণ করে বললেন, “হে অতিথি, আপনার কামনা পূরণ হােক। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।” যৌন-সহবাস শেষ হলে তারা দু’জনেই বাইরে বেরিয়ে এলেন। ভীষ্ম জানালেন, “এই অতিথি আর কেউ নন, স্বয়ং ধর্ম- ন্যায় আচরণের দেবতা।” 

এই গল্পটি আধুনিক নীতিবিদ্যা ও নৈতিকতার ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এ যেন সেই আদিম সমাজ যেখানে যৌন-সেবাকে প্রথা হিসাবে মেনে নেওয়া হচ্ছে। নীতিবিদ্যা যেখানে সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত, তেমনই নৈতিকতা (morality} অনেকটাই ব্যক্তিগত। তাই এটিকে মহাভারতের নীতিবিদ্যার আলােকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা গেলেও নৈতিকতার মানদণ্ডে এই কাহিনিকে রুচিশীল বলা যায় না। ………

……..নারীত্বের আর এক চুড়ান্ত অপমানের দৃষ্টান্ত হলেন মাধবী। তিনিও মহাভারতের চরিত্র। তাকে বহু পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম করতে বাধ্য করানাে হয়। তিনি রাজা যযাতির কন্যা বিশ্বামিত্রের শিষ্য গলব তাঁর গুরুকে দক্ষিণা দিতে চাইলে বিশ্বামিত্র কিছুটা রেগে গিয়ে তাকুে বলেন, চন্দ্রের ন্যায় শুভ্র, একটি কর্ণ শ্যামবর্ণ, এমন আট শত অশ্ব তিনি গুরুক্ষিণা হিসাবে চান। গালব পড়ে গেলেন মহা ফাঁপরে। তিনি বিষ্ণুর শরণাপর্ন হলেন। বিষ্ণুর বাহন ও সখা গরুড় গালবকে নিয়ে নানা দেশে ঘুরতে অবশেষে চন্দ্রবংশীয় রাজা নহুষের পুত্র যযাতির কাছে এলেন। যযাতির দুইটি স্ত্রী দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা। ক্ষত্রিয় যযাতির প্রথম স্ত্রী ব্রাহ্মণকন্যা, দ্বিতীয়টি অসুরপুত্রী। মনে রাখতে হবে, কৌরবদের গায়ে অসুর-রক্তও আছে। যযাতি গালবের প্রার্থনা শুনলেন এবং নিজের সামর্থ্যহীনতার কথা জানালেন। যযাতি বললেন, “তুমি আমার কন্যা মাধবীকে নিয়ে যাও। রাজাদের কাছে একে ভাড়া খাটাবে, আর শুল্ক হিসাবে তুমি আটশত অশ্ব পেয়ে যাবে।” মাধবীকে নিয়ে গালব যাত্রা শুরু করলেন। প্রথমে এলেন অযােধ্যা। সেখানে রাজা হর্যশ্ব মাধবীকে দেখে খুব খুশি। তিনি মাধবীর সঙ্গে সহবাস করলেন এবং বসুমনা’ নামে একটি পুত্র উৎপন্ন করলেন। মাধবীর শুল্ক হিসাবে গালবকে তিনি দুই শত অশ্ব প্রদান করেন। এরপর গালব গেলেন কাশী। রাজা দিবােদাসও সঙ্গম করলেন মাধবীর সঙ্গে, উৎপন্ন করলেন ‘প্রতর্দন’ নামক পুত্র। শুল্ক সেই দুই শত অশ্ব। মােট চারশত অশ্ব ও মাধবীকে নিয়ে গালব এবার গেলেন ভােজরাজ উশীনরের কাছে। উশীনর রূপবতী মাধবীর গর্ভে শিবিকে উৎপাদন করেন এবং ভাড়া হিসাবে দুই শত অশ্ব দেন গালবকে। ছয় শত অশ্ব নিয়ে গালব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তখন গরুড় তাকে বলেন, “শােনাে বাছা, মহর্ষি ঋচিক গাধি রাজাকে এইরূপ এক হাজার অশ্ব দিয়েছিলেন। গাধি সেই অশ্ব ব্রাহ্মণদের দান করলে তারা সেগুলিকে বিক্রয় করে দেয়। হ্যশ্ব, দিবােদাস ও উশীনর প্রত্যেকে দুই শত করে অশ্ব ক্রয় করেন। চার শত অশ্ব পথে অপহৃত হয়। সুতরাং বাকি অশ্বের আশা ছেড়ে দিয়ে তুমি এই ছয় শত অশ্ব এবং অবশিষ্ট দুই শত অশ্বের পরিবর্তে বিশ্বামিত্রকে মাধবী-দান করাে।”

বিশ্বামিত্র ক্ষুন্ন হয়ে বললেন, “প্রথমেই মাধবীকে আমার হাতে দিলে পারতে। আমি এর গর্ভে পুত্র পেতাম।” যথাকালে দুই শত অশ্বের পরিবর্তে প্রাপ্ত মাধবীর গর্ভে গুরুদেব বিশ্বামিত্র ‘অষ্টক’ নামের এক পুত্র উৎপাদন করেন। তারপর মাধবীকে গালবের হাতে প্রদান করে তিনি বনে চলে গেলেন। গালব মাধবীকে নিয়ে কী করবেন! ইতিপূর্বে তিনি চার জনের অঙ্কশায়িনী হয়েছেন। গালব মাধবীকে যযাতির হাতে সমর্পণ করলেন। যযাতি মাধবীর স্বয়ংবর সভার আয়ােজন করলে সকল পাণিপ্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করেন মাধবী।

উদযােগ-পর্বের এই কাহিনি প্রসঙ্গে নিকোলসাটনের অভিমত হল, নারীর প্রতি এই অস্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বিস্ময়কর। অবশেষে মাধবীর প্রতিবাদ হল, পাণিপ্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান ও অরন্যজীবন বেছে নেওয়া যেখানে তিনি ঘাসের উপর বসে থাকতেন, জল ছিল তার খাদ্য। বিবাহের তুলনায় তিনি ব্রহ্মচর্যকে অধিক শ্রেয় মনে করছিলেন। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, মাধবীকে যৌন-হয়রানির পিছনে যযাতি ও গালব দায়ী। অবশ্য তিন জন রাজা ও বিশ্বামিত্রকেও বাদ দেওয়া উচিত হবে না। গালব যেন এখানে ‘ফ্লেশ-ট্রেডার। অথচ এই অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকেই খ্যাতিমান। রাজা যযাতি দানশীল, গুরুভক্তির মূর্ত প্রতিমূর্তি গালব মুনি, রাজা বিশ্বামিত্র প্রজ্ঞাবান। তিন রাজাও যথেষ্ট ধার্মিক। মাধবীর মােক্ষ যেন তার নীরবতার মধ্যেই, তার প্রতিবাদও।……..

…….প্রাথমিকভাবে দ্রৌপদী বহুপতিত্বে গররাজি ছিলেন কারণ তাঁর মনে সুন্দ-উপসুন্দর লড়াইয়ের কথা উদয় হয়েছিল। তিলােত্তমা ওই দুই ভাইয়ের কাছে উপস্থিত হলে দুজনের মধ্যেই ঘােরতর যুদ্ধ হয় এবং দু’জনেই উভয়ের হাতে নিহত হয়। ব্যাসদেবের দৈব বিধান শ্রবণের পর দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীত্বে আপত্তি রইল না। তিনি বিশ্বাস করলেন, পঞ্চপাণ্ডব আসলে পঞ্চ ইন্দ্র। অবশ্য যুধিষ্ঠির, ভীম, সহদেবকে কতটা ইন্দ্র’ বলে মেনে নেওয়া যায়, তা একটা বিরাট চিন্তার বিষয়।

ইন্দ্রের স্ত্রী শচীর প্রসঙ্গে আসা যাক। যযাতি-পুত্র নহুষ ইন্দ্রত্ব লাভ করে কামপরায়ণ ও বিলাসী হয়ে ওঠেন। তিনি শচীকে স্ত্রীরূপে পাওয়ার আশায় দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে গেলেন। এই সেই বৃহস্পতি যিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উতথ্যের স্ত্রী মমতাকে বলাৎকার করেন। দেবতারা নহুষকে পরস্ত্রী সংসর্গের পাপ থেকে নিবৃত্ত হতে বললেন। বৃহস্পতি হলেন শচীর রক্ষাকর্তা। এখানেই কূটাভাস উৎপন্ন হয়। যে দেবগুরু নিজেই পরস্ত্রী-সংসর্গে বলপ্রয়ােগ করেন, সেই তিনিই নহুষকে পরস্ত্রী-সংসর্গ থেকে রক্ষা করছেন, কারণ শচীকে নহুষ-স্পর্শ থেকে বাঁচাতে হবে।………..

আঠারাে রকমের যৌনমিলন

……..সন্তান-উৎপাদন করে বংশধারাকে রক্ষা করা বিবাহের প্রধান উদ্দেশ্য, এমনটাই বলা হয় প্রাচীন শাস্ত্রে। তবে মহাভারতে নারী-পুরুষের মিলনাক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পুত্র থাকা সত্ত্বেও শান্তনুর পুনরায় বিবাহ, বিচিত্রবীর্যের একাধিক স্ত্রী, পাণ্ডুর দুই স্ত্রী এবং ব্রহ্মচারী অর্জুনের উলুপী ও চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে যৌন মিলন থেকে এই উপসংহারে আসতে পারি। ……. মহাভারতে এমন আদর্শও আছে যে, ঋতুস্নাতা যে-কোনও স্ত্রীলােক কোনও পুরুষকে কামনা করলে তাকে উপেক্ষা করা পাপ- ………। সুতরাং প্রজাসৃষ্টির বিষয়টি মহাকাব্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বিধবা নারীর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন উত্তম-কল্প, তবু বিধবাদের গর্ভে প্রজা-উৎপাদনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। স্ত্রী ছাড়া দাসীদের গর্ভে সন্তান-উৎপাদনও মহাভারতে স্বীকৃত। এই নৈতিক শিথিলতাকে প্রজা-উৎপাদনের জন্য মানা হয়।

প্রজা-সৃষ্টির নানা উপায়গুলি শ্রেণিবিভাগ করলে মােট আঠারােটি যৌনমিলনের কথা পাওয়া যায়। ………

১. মানুষ পিতামাতার যৌনমিলন থেকে পাখি ও সাপের জন্ম……………….
২. ইতরপ্রাণীর মানবসন্তানের আকাঙ্ক্ষায় যৌনসঙ্গম …………….
৩. সাপ ও মানুষের সঙ্গম…………
৪. মৎসী ও মানুষের সংযােগ ………..
৫. জড় পদাৰ্থৰ্বয়ের মিলনে মানবসন্তান……..
৬. জড় (দেবী) পদার্থের সঙ্গে মানুষের মিলন……….
৭. অপ্সরা ও মানুষের মিলনে সন্তান……..

……..বিশ্বাচী, ঘৃতাচী, রম্ভা, তিলােত্তমা, মেনকা, উর্বশী প্রমুখ অপ্সরা স্বর্গলােকে ইন্দ্রের সভায় নাচগান করেন, এমন বর্ণনা মহাভারতের বহু স্থানে পাওয়া যায়।

মহাভারত মতে যে ছয়টি অপ্সরা শ্রেষ্ঠা বলে বর্ণিত হয়েছে, ঘৃতাচী তাদের একজন। স্বয়ম্প্রভা, মিশ্রকেশী, দণ্ডগৌরী তার কাছে ম্লান। বহু ঋষি ও মানুষের সঙ্গে এর প্রণয় কাহিনির বর্ণনা পাওয়া যায়। চ্যবন ঋষির পুত্র মতির সঙ্গে এর যৌনমিলন ঘটে। মহাভারতের আদিপর্বে দেখা যায়, চ্যবন-সুকন্যার পুত্র প্রতি ঘৃতাচীর গর্ভে রুরু-র জন্ম দেন। ………রাজা কুশনাভ ঘৃতাচীর রুপে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গম করেন। ঘৃতাচী অপ্সরার গর্ভে একশত পরমা সুন্দরী মানবকনা জন্মলাভ করেন। এই কন্যাদের যৌবনে মজে বায়ুদেবতা তাদের পাণিপ্রার্থনা করেন। ……..

…….ঘৃতাচীর যৌবন দেখে ব্যাসদেব ও ভরদ্বাজ মুনির রেতঃপাত হয়েছিল।

মহাভারতের আদিপর্বে অপ্সরা মেনকা ও বিশ্বামিত্র ঋষির কামক্রীড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। পূর্বকালে বিশ্বামিত্র ঘাের তপস্যা করছেন দেখে দেবরাজ ইন্দ্র ভয় পেয়ে যান। এবং তপস্যা ভঙ্গ করতে অপ্সরা মেনকাকে প্রেরণ করেন। মেনকা বিশ্বামিত্রের কাছে এসে তাকে অভিবাদন করেন। সেই সময় পবনদেব তার সূক্ষ্ম শুভ্র বসন হরণ করেন। সর্বাঙ্গসুন্দরী বিবস্ত্রা মেনকাকে দেখে বিশ্বামিত্র নিজেকে সংযত রাখতে পারেন না। মুগ্ধ ঋষি অপ্সরার সঙ্গে মিলিত হলেন। ইন্দ্র ও মেনকার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। মেনকা গর্ভবতী হলেন এবং একটি কন্যা প্রসব করেই তাকে মালিনী নদীর তীরে ফেলে ইন্দ্রসভায় চলে গেলেন। বিশ্বামিত্রও সেই কন্যার দায়িত্ব নিলেন না, তিনি তপস্যা করতে চলে গেলেন। ……..অপ্সরা মেনকা পুষ্করতীর্থে স্নান করতে গেলে, বস্ত্রহীনা সুন্দরীকে দেখে কামমােহিত বিশ্বামিত্র তার সঙ্গে দীর্ঘ দশ বছর সহবাস করেন। পরে চৈতন্যের উদয় হলে তিনি মেনকার সঙ্গত্যাগ করে হিমালয়ের কৌশিকী নদীর তীরে কঠোর তপস্যায় নিযুক্ত হন। দেবতারা পুনরায় ভীত হয়ে অপ্সরা রম্ভাকে প্রেরণ করেন। রম্ভা নানা ছলাকলায় ঋষিকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন। বিশ্বামিত্র তখন ক্রুদ্ধ হয়ে রম্ভাকে অভিশাপ দেন, তিনি পাষাণে পরিণত হন। | অপ্সরারা যখন মানুষের সঙ্গে মিলনের জন্য আসেন, তখন তার পিছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। প্রায় সর্বত্রই তার সমর্থন মেলে। বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করতে মেনকা ও রম্ভা আসেন। অভিশপ্ত উর্বশী মর্ত্যে এসে পুরুরবার স্ত্রী হতে চাইলেন নিজের স্বার্থে অথচ পুরুরবাকে শর্ত দিলেন, দিনে তিন বারের বেশি তিনি সঙ্গম করবেন না। উর্বশীর ইচ্ছার পুরুরবা সহবাস করতে পারবেন । এবং কখনও যেন স্বামীকে তিনি নগ্ন না দেখেন। পরে পুরুরবাকে দেবতাদের ষড়যন্ত্রে তিনি বিবস্ত্র দেখলেন ও পালিয়ে গেলেন। পুরুরবার আকুল ক্রন্দনে উর্বশী বললেন, বছরের শেষ রাত্রে একবার তার সঙ্গে শয্যাগ্রহণ করবেন। এই উর্বশীই তার যৌনসঙ্গী ইন্দ্রের সঙ্গে সহবাস তাে করতেনই, ইন্দ্রপুত্র অর্জুনের শয্যাসঙ্গী হতে চান। এবং তা ইন্দ্রেরই অনুজ্ঞায়। ……..

………..মহাভারতে তিলােত্তমাকেও অপ্সরা বলা হয়েছে। তিনি এসে দুই ভাই সুন্দ ও উপসুন্দের মধ্যে খুনোখুনি বাধিয়ে দেন। দু’জনেই মারা যান। ব্রহ্ম অবশ্য অত্যাচারী দুই ভাইকে নিকেশ করার জন্য রূপবতী এই অপ্সরাকে প্রেরণ করেন। তার সঙ্গে কে সহবাস করবে, তাই নিয়ে দুই ভাইয়ের যুদ্ধ। 

৮. অপ্সরার সঙ্গে গন্ধর্ব পুরুষ ও যক্ষের মিলন………

…….অপ্সরা মেনকার সঙ্গে গন্ধর্ব বিশ্বাবসুর মিলনে প্রমদবরার জন্ম। অপ্সরা-গন্ধর্বের কন্যার সঙ্গে আবার অপ্সরা-মানবের পুত্রের বিবাহ হয়। এই পুত্র হলেন রুরুতিনি ঘৃতাচী ও প্ৰমতির সন্তান।

‘গন্ধর্ব’ শব্দের অর্থ- গান ধর্ম যার। …….. এঁরা অবাধ মেলামেশা পছন্দ করতেন। তাই স্ত্রীলােকের প্রতি এঁদের খুব আসক্তি। তাঁদের নাম থেকে গান্ধর্ব বিবাহ’। ……….

৯. রাক্ষসী ও মানুষের মিলন………..
১০. শুক্রের আলােড়নে, অরণি-মন্থনে সন্তান উৎপাদন………
১১. অযোনিজ সন্তান……….
১২. মৃত স্বামীর সঙ্গে জীবিত স্ত্রীর মিলনে পুত্র উৎপাদন…….

পুরুবংশীয় রাজা ব্যুষিতা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন। কাক্ষীবানের রূপবতী কন্যা ভদ্রাকে ইনি বিবাহ করেন। স্ত্রীর রূপে বশীভূত হয়ে তিনি অপরিমিত কামক্রীড়ায় মত্ত হয়ে পড়েন। রাজকার্যও পরিত্যাগ করেন। অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়াসক্তিবশত ও সঙ্গমের পরিশ্রমে তিনি যক্ষ্মারােগে প্রাণত্যাগ করেন। অপুত্রক রানি ভদ্রা মৃত স্বামীর দেহ আলিঙ্গন করে হাহাকার করতে লাগলেন। ব্যুষিতাশ্ব দৈববাণী করেন, ভদ্রা যদি মৃত পতির সঙ্গে সহবাস করেন তাহলে রানির গর্ভে সন্তান জন্মাবে। সেই আকাশবাণী শুনে শব-সংসর্গে ভদ্রার গর্ভে তিনজন শাম্ব ও চারজন মদ্রের জন্ম হয় (আদিপর্ব, মহাভারত)।

১৩. আগুন ও মন্ত্রের মিলন থেকে মানুষের উৎপত্তি………
১৪. আম ও দুই রানির মিলনে সন্তান……..
১৫. মন্ত্রপূত জল ও পুরুষের সন্তান উৎপাদন…….
১৬. পুরুষের স্ত্রীরূপ ধারণ করে সন্তান প্রসব………
১৭. এক পুত্রকে যজ্ঞে আহুতি দিয়ে শতপুত্র উৎপাদন……….
১৮. পুরুষের মুষল প্রসব………..

ইতরকাম

………মহাভারতে উৰ্দ্ধরেতা ঋষি মন্দপাল পরজন্মে শাক্ষর্ক পাখির মূর্তি ধরে জরিতা নামে এক শাক্ষির্কের সঙ্গে সঙ্গম করেন।……..

……মপালের পাখিরূপ ধরে মৈথুনকে ইতরকাম’ বলা যাবে কি না, তা আলােচনার বিষয়। তবে পাখিদের মিথুন লক্ষ করে তারা ওইভাবে রমণে প্রবৃত্ত হতে পারেন অর্থাৎ ওই বিশেষ পক্ষীদ্বয়ের যৌনচারে তাদের প্রতি উৎপন্ন হয়েছিল। কিন্তু কিমিন্দম মুনির মিথুনকে ঠিক কী বলা যেতে পারে, তা নিয়ে তিনটি মত পাওয়া যেতে পারে। তারা সত্যিই হরিণদম্পতির উন্মত্ত কামক্রীড়া দেখে ওই ভাবে যৌনমিলন সম্পন্ন করছিলেন। বাৎস্যায়নের কামসুত্র’-এ মৃগভঙ্গিতে সঙ্গমের বিবরণ আছে। দ্বিতীয়ত, তারা সত্যিই দৈব বলে হরিণ-হরিণীর রূপ ধরে পুত্রার্থে কামাচার করছিলেন। ………

………..যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ-যজ্ঞে দীক্ষিত হলেন। ব্রাহ্মণরা যজ্ঞের কার্য করতে লাগলেন। ঘূপবদ্ধ অশ্বটিকে শাস্ত্রমতে বধ করলেন। | মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে তিনশাে পশু যুপে বন্ধন করা হয়। দিগবিজয়ী উত্তম অশ্বটিকে প্রধানভাবে রাখা হয়। | গন্ধর্বরা গান গাইতে লাগলেন, নাচতে শুরু করলেন অপ্সরারা। কিন্নররা যজ্ঞের শােভা বর্ধন করতে লাগলেন। উপস্থিত হলেন নারদ, মহাতেজা, তুরু, বিশ্বাবসু, চিত্রসেন প্রমুখ সঙ্গীতবিশারদেরা।।

ব্রাহ্মণরা অন্যান্য পশুদের প্রথমে ছেদন করলেন, তারপর শাস্ত্রানুসারে অশ্বটিকে বধ করলেন। মনস্বিনী দ্রৌপদীকে সেখানে যথাবিধানে উপবেশন করানাে হল। অশ্বটির শরীরের ভিতরের ধাতুবিষে (যা বক্ষস্থলে থাকে) বসা’ অগ্নিতে পাক করলে সর্বপাপনাশক সেই ধূমঞ্জআঘ্রান করলেন মহারাজ যুধিষ্ঠির ও তার চার ভ্রাতা- ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব।………

……….দ্রৌপদীকে যথাবিধানে’ অশ্বের নিকট উপবেশন করানাে হল— এটুকুই বলে মহাভারত মহিষীর ক্রিয়া নিয়ে আর কিছু বলেনি। এমনকী যৌনাচার বা যৌনাচারের অভিনয় বিষয়েও একটি কথাও বলা হয়নি ওই মহাকাব্যে। কিন্তু যথাবিধান’ কী– সে সম্পর্কেও কিছুই বলা নেই। যেহেতু বৈদিক ক্রিয়াকলাপের নানা বিধান শতপথ ব্রাহ্মণে উক্ত হয়েছে, তাই ওই বিধান সম্পর্কে শুক্ল যজুর্বেদের সঙ্গে যুক্ত শতপথ ব্রাহ্মণের দ্বারস্থ হওয়া যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ। বি. আর অম্বেডকর অশ্বমেধ-যজ্ঞের এই মৈথুনের কথা উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।

পরবর্তী কালে মন্দিরগাত্রে মানব-ঘােটকী বা ঘােটক-মানবীর সঙ্গমদৃশ্য তাই আশ্চর্যজনক নয়। আর এই মিলন সম্পূর্ণভাবে ইতরকাম। ………..

শবদেহের সঙ্গে যৌনাচার

……….এ দিকে অঙ্গদেশে বৃষ্টি না হওয়ার দরুন রাজা লােমােদ এক মুনির কাছে জানলেন, ঋশ্যশৃঙ্গ অঙ্গরাজ্যে পদার্পণ করলেই বৃষ্টিপাত হবে। রাজা তখন রাজ্যের প্রধান প্রধান বেশ্যাদের ডাকলেন। বললেন, ঋশ্যশৃঙ্গকে প্রলােভিত করে রাজ্যে নিয়ে আসতে হবে। বেশ্যারা ভীত হলেন। একজন বৃদ্ধা বেশ্যা রাজি হয়ে একটি রমণীয় নৌকো আর কয়েকজন রূপবতী তরুণী বারাঙ্গনা নিয়ে বিভাণ্ডকের আশ্রমের কাছে নৌকো বাঁধলেন। | বিভাশুক মুনি আশ্রমে নেই, একথা জেনে নিয়ে সেই বৃদ্ধা তার বুদ্ধিমতী সুন্দরী এক কন্যাকে পাঠালেন ঋশাশূঙ্গের কাছে। কন্যাকে দেখে ঋশাশৃঙ্গ অবাক, এমন মানুষ তিনি চোখেই দেখেননি। এই ‘জ্যোতিঃপুঞ্জ’ দেখে তিনি যথাবিধ সৎকারে প্রয়াসী হলেন। বেশ্যাকন্যা ঋশ্যশৃঙ্গকে আলিঙ্গন করলেন- পানীয়, খাদ্য, মালা উপহার দিলেন। মুনিপুত্র শুধু বিমােহিত হলেন না, বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। বিভাণ্ডক মুনি আশ্রমে ফিরে এসে পুত্রের এই মদনাবিষ্ট অচেতন অবস্থা দেখে প্রমাদ গুনলেন। কেউ এসেছিল কি না, পিতার এই প্রশ্নের জবাবে ঋশ্যশৃঙ্গ বললেন, একজন জটাধারী ব্রহ্মচারীর কথা। আয়ত চোখ, জটা সুদীর্ঘ নির্মল কৃষ্ণবর্ণ, সুগন্ধিযুক্ত এবং সােনার সুতােয় বাঁধা। তিনি লম্বাও নন, বেঁটেও নন। গায়ের রঙ পাকা সােনার মতাে। তার গলায় বিদ্যুতের মতাে অলঙ্কার। তার নীচে দুটো রােমহীন অতি মনােহর মাংসপিণ্ড। তার কটিদেশ পিপড়ের মধ্যভাগের মতাে ক্ষীণ। পরিধেয় বসনের ভেতরে সুবর্ণ মেখলা দেখা যায়। তাঁর সুন্দর মুখ, কোকিলের মতাে কণ্ঠস্বর। তাঁর বাক্য হর্ষবর্ধক। ঋশ্যশৃঙ্গ আরও বললেন, তার প্রতি আমার অনুরাগ হয়েছে। আমার মুখে মুখ ঠেকিয়ে তিনি শব্দ করেছেন, আমি খুশি হয়েছি। তার বিরহে আমি অসুখী, আমার গা পুড়ে। যাচ্ছে— আমি তার কাছে যাব, তার সঙ্গেই তপস্যা করব।” বিভাণ্ডক মুনি পুত্রকে অনেক বােঝালেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। একদিন মুনির উপস্থিতিতে বেশ্যাকন্যা ঋশ্যশৃঙ্গকে সঙ্গে নিয়ে অঙ্গদেশে যা করলেন, সেখানে বৃষ্টি নামল। | রাজা লােমপাদ বন্ধু দশরথের ঔরসূত্রুই কন্যা ও তার পালিতা শান্তার সঙ্গে ঋশ্যশৃঙ্গের বিবাহ দেন। দশরথমজন পুত্রকামনায় অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন, তখন বশিষ্ঠ ও সুমন্ত্রের পরামর্শের প্রধান পুরােহিত হিসাবে ঋশ্যশৃঙ্গকে বরণ করেন।

ঋশ্যশৃঙ্গ কর্তৃক অশ্বমেধযজ্ঞে শাস্ত্রানুসারে অশ্বটিকে ছেদন করা হলে তার শাশুড়ি, দশরথের প্রধান মহিষী কৌশল্যাকে সেখানে যথাবিধানে উপবেশন করালেন। মহাভারত অপেক্ষা রামায়ণে অনেক বিস্তৃতভাবে এই ঘটনা ব্যাখ্যা আছে। রানি কৌশল্যা যজ্ঞের নিয়ম মেনে মৃত ঘােড়াটির সঙ্গে এক রাত্রি বাস করেন। তিনি অশ্বটিকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্র পাঠ করেন, যে মন্ত্রের ব্যাখ্যা এখানে করা হবে না। রানির মৃত ঘােড়ার সঙ্গে সহবাস’ শবদেহের সঙ্গে যৌনাচার বলে পরিগণিত হতে পারে।

শবদেহের প্রতি যৌনাসক্তি কিংবা মৃতদেহের সঙ্গে যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে সন্তুষ্টিলাভ (Necromania or Necrophilia) এক ধরনের যৌনবিকৃতি। ………..

……….মহাভারতের আদিপর্বে কুন্তীর কথা থেকে ব্যুষিতাশ্ব-উপাখ্যান জানা যায়। রাজা ব্যুষিতাশের স্ত্রীর নাম ভদ্রা ! পুরুত্বংশের এই রাজা ও কাক্ষীবানের রূপবতী কন্যা ভদ্রার কোনও সন্তান ছিল না। স্ত্রীর রূপে বশীভূত হয়ে ব্যুষিতা রাজকার্য ছেড়ে অপরিমিত কামক্রীড়ায় মত্ত হন এবং যক্ষ্মারােগে প্রাণত্যাগ করেন! রানি ভদ্রা স্বামীর মৃতদেহ আগলাতে লাগলেন। তাঁর শােক কিছুতেই প্রশমিত হচ্ছে না।……… ভদ্রার সঙ্গে অতিরিক্ত সহবাসের ফলেই রাজার যক্ষ্মা ও মৃত্যু। …… এমন সময় তার মনে পড়ে রানি লীলার কথা। লীলাদেবী সরস্বতীকে বলেছিলেন, তার স্বামী মারা গেলেও যেন তার কাছেই থাকেন। লীলার স্বামীর মৃত্যু হলে রানি পতির শবদেহ ফুল দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন, যাতে সেই শরীর নষ্ট না হয়। লীলার স্বামী মারা যাওয়ার পরেও তিনি স্বামীর সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত হননি। রানি ভদ্রার আকুল ক্রন্দনে বৃষিতাশ্ব দৈববাণী করলেন চতুর্দশী বা অষ্টমীতে ঋতুস্নান করে মৃত স্বামীর সঙ্গে ভদ্রা নিজ শয্যায় সহবাস করলে ব্যুষিতাশ্ব রানির গর্ভে সন্তান উৎপাদন করবেন।

ভদ্রার নিকট আসা এই দৈববাণী দাসীদের মঞ্চ থেকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। বৈদ্যরা বললেন, এমন ব্যাপার আদৌ সম্ভয়। কারণ মৃতদেহের লিঙ্গোত্থান হয় না, ফলে সঙ্গম সম্ভব নয়। একজন পুরােহিত বললেন, বহু মৃত ব্যক্তির লিঙ্গ উথ্থিতই থাকে। ফাসিতে যারা মারাজান তাদের লিঙ্গের উত্থান সর্বজন বিদিত। অন্যান্য মৃতদেহের লিঙ্গ উথ্থিতকে হওয়াকে ‘দেবদূতের লিঙ্গা’ বলা হয়। রানিকে তিনি মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গম করতে বললেন। শয্যা প্রস্তুত হল, শবদেহকে নিয়ে যাওয়া হল বিছানায় সকলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রানি জানেন, আজ অষ্টমী, তাই তিনি শবের সঙ্গে শুয়ে থাকলেন। যে জীবন্ত রাজা তাঁকে শয্যায় পেলে ঝাপিয়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতেন, তিনি আজ সাড়াশব্দহীন। রানি তার পােশাক ছাড়লেন। ব্যুষিতাশ্বের শব থেকে বস্ত্র সরিয়ে দিলেন। সত্যিই রাজার লিঙ্গ উত্থিত হয়ে আছে। তিনি রাজাকে নিজের শরীরের উপর তুলে নিলেন। দীর্ঘ সেই সহবাসশেষে ক্লান্ত রানি জঠরে এক উষ্ণ অনুভূতি টের পেলেন। তিনি রাজার শবদেহকে শরীর থেকে নামিয়ে দিয়ে ফুল দিয়ে ঢেকে দিলেন, তারপর নিজে বস্ত্র পরিধান করলেন। এমন সময় দৈববাণী ভেসে এল, “এই মিলনের ফলে রানি ভদ্রা তিনজন শাম্ব ও চারজন মদ্রের জন্ম দেবেন।”………………

সঙ্গমে কার বেশি আনন্দ, স্ত্রী না পুরুষের ?

…………

ঋতুকালে স্ত্রীগণ পুরুষকে কামনা করেন। ঋতুকাল ব্যতীত অন্যসময় স্ত্রীসম্ভোগ সঠিক ধর্মপালন নয়। স্বাচ্ছন্দবিহার অতিশয় নিন্দিত। ঋতুকালে স্ত্রীকে উপেক্ষ করা পাপ– …….। ঋতুমতী স্ত্রীকে তিন রাত বর্জন করতে বলা হয়েছে। চতুর্থ থেকে যােড়শ রাত্রি পর্যন্ত সঙ্গম করা যাবে। অতিশয় নির্জন স্থানে গােপনে মিলিত হতে হবে। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, চতুর্দশী, অষ্টমী এবং রবিসংক্রান্তিতে স্ত্রীসম্ভোগ নিষেধ। দিনের বেলায় কামাচারকে উপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। যে নারী গর্ভবতী, সেই নারীকে সম্ভোগ করা অন্যায়। মিলনের পর স্নান করে পবিত্র হওয়াই নিয়ম। যে পুরুষ স্ত্রী সহবাসকেই পরম কাম্য মনে করেন এবং স্ত্রীতে সর্বদা কামাসক্ত হয়ে থাকেন, তিনি কাপুরুষ।……….

………নারী-পুরুষের এই মিলনে কে বেশি আনন্দ পান? স্ত্রী, না পুরুষ? …….এ বিষয়ে তিনটি মত আছে- ১) স্ত্রীর সুখ বেশি হয়, ২} পুরুষের আনন্দ অধিক হয় ৩) দুই জনই সমান সুখ পান। কেউ কেউ বলেন, সঙ্গমকালে পুরুষের বীর্যস্থলন দু’সেকেন্ডের ব্যাপার, অন্য দিকে মহিলার চরম মুহূর্ত ১০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। আনন্দে নারীর পেশিও যেন কথা বলে। আবার অনেকের অভিমত, পুরুষ যৌনমিলনে অধিক সুখ পায়। অধিকাংশই নারী না কি সহবাসে পুরােপুরি মনসংযােগ করেন না। কিন্তু পুরুষের লিঙ্গ ছাড়া শরীরের অন্যান্য স্থান যেহেতু কামস্থান নয়, তাই পুরুষ লিঙ্গ থেকে সর্বাধিক সুখ পান। মহিলাদের শরীরের নানা অংশ আছে যেগুলাের উন্দীপন শ্রমসাধ্য এবং পুরুষের ধৈর্যহীনতার জন্য সেই সব জায়গা উদ্দীপ্ত হয় না বলে নারীরা সম্ভোগে কম আনন্দ পান। তবে তৃতীয় মতটিও উপেক্ষনীয় নয়। পুংলিঙ্গের সংবেদনশীল অংশ ও যােনির সংবেদন এলাকা প্রায় সমান। তাই একটি সঠিক সঙ্গমে উভয়েই সমান আনন্দ পান। সপ্তদশ শতাব্দীতে একদল চিকিৎসক এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালান তাদের বিবেচনার বিষয় ছিল পুরুষ ও নারীর যৌন ইচ্ছার তুলনামূলক আলােচনা ও প্রাপ্ত আনন্দের বিচার। হিপােক্রেটস প্রমুখ চিকিৎসকরা নারীর কামলিপ্সা ও সঙ্গমানন্দের কথা বেশি বলে মত দিয়েছেন। প্লাজোনাস মনে করেন, সঙ্গমে মহিলাদের অধিক আনন্দের উৎস রয়েছে। ফেরান্দের মতে, নারী পুরুষ অপেক্ষা বেশি আবেগপ্রবণ। জাকচিয়া, সিনিাদুস, হরিনয়াস প্রমুখ একই মত পােষণ করেন।………

………কে বেশি যৌনতা চায় বা সম্ভোগের আকাঙ্গা কার বেশি, এ বিষয়ে ইসলাম ধর্মের উত্তর: নারী। পুরুষের উচিত নারীকে আনন্দ দেওয়া। এমনকী ওল্ড টেস্টামেন্টে নারীর যৌনইচ্ছার শক্তিকে স্বীকার করা হয়েছে। ওই গ্রন্থে বলা হচ্ছে, তিনটি জিনিসকে বিকৃত করা যায় না- নরক, যােনিদ্বার এবং পৃথিবী।…….

লিঙ্গপুরাণ ও মহাভারত

………. দু’রকমের লিঙ্গ আছে। বাহ্য ও অভ্যন্তর। বাহ্য হল স্থুললিঙ্গ এবং অভ্যন্তর সূক্ষ্মলিঙ্গ। শিবলিঙ্গ সাধারণত যােনি ও শিশ্ন (লিঙ্গ)-এর একত্রীকরণ। যােনি ও শিশ্ন হল যথাক্রমে বিন্দু ও নাদ। তাই দুর্গার অপর নাম বিন্দুবাসিনী। নাদ হল গর্জন যা অব্যক্ত এবং দীপ্তিবান।……..

কামদেব ও রতিদেবী

……….রতি কামদেবের স্ত্রী। তিনি যৌন আকাঙ্ক্ষার দেবী।…….রতি’-র অর্থ আসক্তি, প্রীতি, অনুরাগ, চিত্তপরিতােষ, ক্রীড়া, রমণ, প্রেম, গুহ্য, ইত্যাদি। শয়নমন্দিরকে তাই রতিগৃহ বা রতিমন্দির বলে। স্ত্রীসম্ভোগ হল রতিদান। রতিসৃষ্ট বা সুরতচতুরকে রতিটীট বলে। রতিশাস্ত্র হলেন রতি বা রতিজ্ঞ। রমণে স্ত্রীপুরুষের ষােড়শবিধ অবয়বসংস্থানভেদ আছে। ব্রহ্মা ও সন্ধ্যা চতুঃষষ্ঠি কলা উৎপন্ন করেন। কিন্তু রমণের আছে যােলাে কলা …….

…….তবে অন্যত্র চৌষট্টিটি রতিবন্ধের উল্লেখ আছে। এদের মধ্যে বহুল প্রচলিত রতিবন্ধটি হল ধর্মীয় যৌনাবস্থান, যেখানে নারী নীচে থাকে এবং পুরুষটি উপরে; দু’জনের মুখও একত্রে থাকে। সারমেয় শৈলী’ও একটি রতিবন্ধ- যেখানে নারীটি হাত পেতে উপুড় হয় কিন্তু শুয়ে পড়ে না এবং পুরুষটি দাঁড়িয়ে তার পিঠের দিক থেকে সঙ্গম করে। একটি জনপ্রিয় বন্ধ হল চামচ-অবস্থান’- যেখানে পাশ ফিরে মহিলাটি শুয়ে থাকেন এবং পুরুষটিও পাশ ফিরেই রতিক্রীড়া করেন। এছাড়া স্ত্রী উপরে, স্বামী নীচে এমন রতিবন্ধ বহুল প্রচলিত। আর একটি রয়েছে, ‘গগাবালিকা বন্ধ’– পুরুষটি চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে মহিলাটি তার উপর বসে রমণ করে। উপবিষ্ট রতিবন্ধ বা দণ্ডায়মন রতিবন্ধের নানা বর্ণনা মেলে। শান্তিবন্ধ’, ‘প্রজাপতিবন্ধ’, ‘ভেকবন্ধ কর্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে শশকীয় লিঙ্গ, বৃষকীয় লিঙ্গ, অশ্বকীয় লিঙ্গ ভেদে রতিবন্ধের পরিবর্তন হয়। আবার হরিণীযােনি, ঘােটকীযােনি বা হস্তিনী যোনি সব যৌন অবস্থানের পক্ষে উপযুক্ত নয়। শশকলিঙ্গ হরিণীযোনির সঙ্গে, বৃষলিঙ্গ হস্তিনী যােনির সঙ্গে রতিক্রিয়া করলে সম্পূর্ণ আনন্দ পায়। শশক যদি ঘােটকীর সঙ্গে, ঘােটক যদি হস্তিনীর সঙ্গে অসমান রতিক্রিয়ায় আবদ্ধ হয় তাহলে রতিআনন্দ সম্পূর্ণ হয় না।

রতিদেবী হলেন মৃণালায়ত বাহুযুক্তা এবং চক্র ও পদ্মধারিণী। বারাে রকমের অলঙ্কারে তিনি ভূষিতা। রতি হলেন সেই প্রেমের দেবী, যে প্রেম নারীকে গর্ভধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। | তন্ত্র দেবী মহাবিদ্যা ছিন্নমস্তা কামদেব ও রতি দম্পতির উপর তার মস্তক উৎসর্গ করেন। মহিলা যদি পুরুষের উপরে উঠে রতিক্রিয়া করে, তাহলে সেই রতিবন্ধ পুরুষের উপর মহিলার কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করে। ………

…………রতি দুই রকম বাহ্য ও অভ্যন্তর। অভ্যন্তরীণ রতি হল ভিতরস্থ প্রেম। তাঁরা সাতাশ রকমের অভ্যন্তর রতির কথা বলেছেন। লিঙ্গ ও যােনি একত্রিত হলেই এই রতি উৎপন্ন হয়। মানুষই একমাত্র প্রাণী যাঁরা মুখােমুখি সঙ্গমও করে থাকেন। সাতাশ রকমের অভ্যন্তর রতিকে তিনটি প্রকারবিশিষ্ট বলা হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রকারে নয়টি বিভাগ আছে। লিঙ্গ ও যােনির আকারভেদেই এই শ্রেণিকরণ। সঙ্গমকালের হিসাব অনুযায়ী এই রতি তিন ভাগে বিভক্ত। দ্রুত সঙ্গমকে বলে লঘু-দ্রব’। যাঁরা বহু সময় ধরে রতিক্রিয়া করেন সেই ক্রিয়ার নাম ‘চির-দ্রব’। মধ্যবর্তী সময়কে বলা হয় মধ্য-দ্রব। প্রথম দিকে পুংলিঙ্গ যােনির মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে ও ধীর লয়ে ক্রিয়া করে। কিন্তু এই ক্রিয়া আস্তে আস্তে দ্রুত ও হিংস্র ওঠে। সাধারণত মনে করা হয়, দীর্ঘ পুংলিঙ্গ যােনিকে বেশি তৃপ্তি দেয়। কিন্তু এই ধারণা ভ্রান্ত। কারণ নারীর সুখানুভূতি নিহিত থাকে ভগাঙ্কুর ও যোনিদ্বারের দুই প্রান্তে যাকে ভগওষ্ঠ’ বলা হয়। তবে রতিক্রিয়ায় চরম সুখ নারী ও পুরুষের বিভিন্ন রকম হতে পারে। যখন পুরুষ ও নারী একই সঙ্গে চরমাবস্থায় পৌঁছয় তখন তাকে সম-রতিক্রিয়া বলে। পুরুষের চরমতায় উঠতে যদি মাঝারি সময় লাগে ও তার সঙ্গিনী যদি অল্প কালেই চরম সুখ পান, তাহলে সেই রতির নাম ‘নীচ’। নারীর মাঝারি সময় ও পুরুষের কম সময় লাগলে তা নীচ রতিক্রিয়া হয়। পুরুষ ও নারীর কম সময় লাগলে তা উচ্চ রতিক্রিয়া।

রতিক্রিয়ার বল বা শক্তি অনুযায়ী একে তিনভাগে ভাগ করা হয়— মন্দ, মধ্য ও চণ্ড। রতিশক্তিকে বলে ভাব বা বেগ। কোকোকাচার্যের মতে, সব ক্ষেত্রেই মধ্য পস্থা শ্রেষ্ঠ। উচ্চ, নীচ কিংবা মন্দ ও মধ্যকে মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু চণ্ড’ বা অতি উচ্চ রতিক্রিয়া পরিত্যাজ্য। আচার্য কোকোক তার রতি-রহস্য’ গ্রন্থে নানা রকমের রতিক্রিয়া নিয়ে আলােচনা করেছেন। তার মতে নারী নীচ বা মন্দ রতিক্রিয়ায় তৃপ্তি পায় না। কারণ লিঙ্গ ও ভগের যত বেশি ঘর্ষণ হবে, নারী তত সুখ পাবে। তবে অতি-উচ্চ বা চণ্ড রতিক্রিয়ায় ভগের যন্ত্রণা ও অস্বস্তি হয় এবং নারী তৃপ্তি পায় না। কামনীতি হল রতিক্রিয়ায় পারস্পরিক সুখের আদানপ্রদান।

কোকোক বলছেন, রতিক্রিয়ার জন্য সুসজ্জিত শয্যাগৃহ দরকার, যেখানে থাকবে উজ্জ্বল বাতি, ফুললতা, সুগন্ধ। পুরুষটি নারীর বাম পাশে উপবিষ্ট হবে। তাকে নানা সুন্দর ও মনোহর বাক্য বলবে। তারপর নারীর স্তন স্পর্শ করবে। নারী কাঞ্চিপুর রেশমের মতাে সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করে থাকবে। অতঃপর, পুরুষটি কামােদ্দীপক গল্প ও প্রেমগীতি বলবে। চুম্বন শুরু হবে প্রথমে থুতনি, গাল ও কপালে। নাভীতে নখ দিয়ে আঘাত করার পর স্তনমর্দন, উরুমন ও কোমরে আদর করবে। পেটের কাছে বস্ত্র আলগা করে দেবে। যদি নারী অনিচ্ছুক হয়, তাহলে পুরুষ তার গালে চুম্বন করবে, লিঙ্গটি নিয়ে যােনিদেশে ঘর্ষণ করবে। নারীটির মুখ চাপা দিয়ে তাকে অন্য হাতে চেপে ধরবে পুরুষ এবং যােনিতে হস্ত-রতিক্রিয়া করবে।

রতিরত্নপ্রদীপিকায় বিভিন্ন রতিভঙ্গির কথা বলা আছে, সেগুলাের উল্লেখ করা হল:

১, গ্রাম্য ২. নাগরিক ৩. উৎফুল্ল ৪. জুঞ্জীত ৫. ইন্দ্রানীক ৬. সম্পূট ৭. পার্শ্ব-সম্পট ৮. পীড়িত ৯. বেষ্টিত , সামুদ্রিক ১১. উদভূগনক ১২. অর্ধ-অঙ্গ-পীড়িত ১৩. জ্বম্ভ ১৪ প্রসারিত ১৫. বেণু বিদায়িত ১৬, সুলঙ্কা ১৭. কর্কটী ১৮. ঝুলন ১৯. পার্সন ২০. অর্ধ-পদ্মাসন ২১. ফণীপাশ ২২. পরাবৃত্ত ২৩. সমায়ম ২৫ ফর্ম ২৫. সমুগক ২৬. পরিবর্তিত ২৭. যুগপদ ২৮. বিমর্দিত ২৯, মর্কট ৩০. আশ্রিত ৩১. সম্মুখ ৩২. ত্রৈবিক্ৰমিক ৩৩. দ্বিতলক ৩৪. জানুকূৰ্পর ৩৫, অবলম্বিত ৩৬. ধেনুকা ৩৭. ঐভিকা ৩৮. সংহত ৩৯, গােয়ুঠ ৪০. বারিকেলিত ৪১. পৌরুষ ৪২. ভ্রমর ৪৩, প্রেণখােলিতক ৪৪. মর্দন ৪৫, কোহল ৪৬. আমদন ৪৭. যােনিপীড়ন ৪৮. নির্ঘণ্ট ৪৯. বরাহঘট ৫০. বৃষঘট ৫১. চাতক-উল্লসিত ৫২. শ্রান্ত সম্পূট।

এই ৫২টি রতিবন্ধনকে পাঁচটি প্রকারে ফেলা হয়েছে— ১. অলস ২. তির্যক বা পার্শ্বিক ৩. উপবিষ্ট ৪. স্থিত বা দণ্ডায়মান ও ৫. আনত বা নমন।

রাজা দেবরাজ প্রণীত ‘রতি-রত্ন-প্রদীপিকা’-য় পাঁচটি রতিবন্ধের বর্ণনা আছে। গ্রাম্য রতিবন্ধে মেয়েটি শুয়ে তার দুই ঊরু একত্রিত করে বুকের উপর তােলে। পুরুষটি তখন রমণ করে। নারীর উরুদ্বয় যদি পুরুষের উরুর মধ্যে থাকে, তাহলে সেই বন্ধ হল নাগরিক। নারীটি যদি নিজের হস্তদ্বয় পদদ্বয় ঠেস দিয়ে থাকে যাতে তার যােনিদ্বার পুংলিঙ্গের অন্তর্গত হয় এবং পুরুষটি স্তনমর্দন করতে করতে রমণ করে তাহলে সেই রতিবন্ধ হবে উৎফুল্লক। নারী চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পদযুগল দু’পাশে বিস্তৃত করবে যাতে যােনিদ্বার উন্মুক্ত হয়, পুরুষ তাকে রমণ করবে- এই বন্ধুটি হল জুম্ভিত। নারী শয্যায় তার নরম উরু উত্তোলন করে পাশ থেকে প্রেমিককে ধরবে। এই ভঙ্গি হল ইন্দ্রানীক।

ঘােটকীর সঙ্গে পুরুষ ইতরকামে লিপ্ত হয়েছে, রতিরত্ন-প্রদীপিকার টীকাতে এমন চিত্রও পাওয়া যায়, এই রতি বন্ধের নাম হল ‘অশ্বসংযােগ। পুরুষটি দণ্ডায়মান হয়ে ঘােটকীর যােনিতে তার লিঙ্গ প্রবেশ করাবে এবং পুরুষের সঙ্গিনী নারী তাকে সাহায্য করবে। তবে বেণুবিদারিত বা ধেনুকা রতিবন্ধ বেশ যে কষ্টকর তার চিত্র এই পুস্তকে রয়েছে। ওই প্রাচীন গ্রন্থটিতে প্রতিটি ভঙ্গি সহজ ও সরল ভঙ্গিমায় প্রকাশিত হয়েছে।

ধর্ম, অর্থ, কাম ও মােক্ষ এই চারটিকে বলে চতুর্বর্গ। চার পুরুষার্থনামেও অভিহিত করা হয়। যক্ষের এক প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছেন, যাঁর স্ত্রী ধর্মাচরণের অনুকুল; সেই গৃহস্থ ধর্ম, অর্থ ও কাম এক সঙ্গে ভােগ করতে পারেন। ধর্ম থেকে অর্থলাভ হয়, অর্থ কামনা পূরণ করে। ধর্ম, অর্থ ও কামের মধ্যে কোনও বিরােধ নেই।……………………………….

মিলনে উপেক্ষিতা নারী

কাব্যে উপেক্ষিতা নন, কিন্তু মিলনে উপেক্ষিত নারীচরিত্র মহাভারতে কম নেই। ……….প্রথমেই যার কথা আসে, তিনি মৎস্যগন্ধা বা যােজনগন্ধা, পরবর্তী কঙা হস্তিনাপুরের প্রধান মহিষী সত্যবতী।

বিবাহের পূর্বে মাত্র একবার তার সঙ্গে মহর্ষি পরাশরের মিলন হয়েছিল। মহাপুরুষ ব্যাসদেবের জন্ম নিয়ে সেই পুরুষটির সঙ্গে আর কোনও দিন দেখা হয়নি।………পরাশর তার জীবনের প্রথম পুরুষ যার সঙ্গে মিলনে তিনি সুগন্ধবতী হন। সেই সৌরভ আঘ্রাণ করে হস্তিনাপতি শান্তনু তার প্রেমে পড়েন। …………. চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের জন্ম দিয়ে শান্তনু মারা গেলেন। সত্যবতী তখনও পূর্ণ যুবতী।…….. চিত্রাঙ্গদ গন্ধর্বের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারালেন, বিচিত্রবীর্য অসংযত কামক্রীড়ার ফলে।……..

অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী মিলনে উপেক্ষিতা। তার জীবনের প্রথম প্রেম ব্যর্থ হয়। …….দেবযানী ও তার সখীরা বনের মধ্যে একটি সরােবরে স্নান করছিলেন। ইন্দ্র তা উপভােগ করতে করতে ওই যুবতীদের বস্ত্রগুলি ওলােটপালােট করে দিলেন। স্নানশেষে অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা ভুল করে দেবযানীর পােশাক পরে ফেললেন। দেবযানী ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “তুই অসুরকন্যা হয়ে ইন্দ্রের নাতনি, গুরুপুত্রীর বস্ত্র পরলি কোন সাহসে? তাের ঘােরতর অমঙ্গল হােক।”শর্মিষ্ঠাও ছাড়বার পাত্রী নন। তিনি কচের প্রেমে ব্যর্থ দেবযানীকে বললেন, “তাের পিতা আমার পিতার অধীন। আমার বাবা বসেন সিংহাসনে, তাের বাবার আসন সিংহাসনের নীচে। তাের পিতা আমার পিতার স্তুতি করেন | তােরা যাচক, আমরা দাতা। আমাকরুণা করি, তাই তােরা অন্ন পাস। কচের বিরহে তাের মাথা খারাপ হয়েছে।” দেবযানীর মুখে কথা নেই। এবার হাতাহাতি শুরু হল। দেবযানী শর্মিয় পােশাক টানাটানি করতে লাগলেন। শক্তিমতী শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে তুলে একটি কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করলেন।

সেই কুপ থেকে তাকে উদ্ধৃত করেন রাজা যযাতি। শুক্রাচার্য, বৃষপর্ব সব শুনলেন। দেবযানী-শুক্র অসুররাজ্য ছেড়ে দেবেন জেনে বৃষপর্ব দেবযানীর কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন, “আপনি যা চাইবেন তাই হবে।” দেবযানী বললেন, “সহস্র দাসীর সঙ্গে শর্মিষ্ঠা আমার দাসী হােক।”

রাজা যযাতি কয়েক বছর পর পুনরায় সেই বনে এলেন। রাজার চোখ পড়ল শর্মিষ্ঠার দিকে। কী অপরূপ সৌন্দর্য! শর্মিষ্ঠাও অপলক চেয়ে আছেন যযাতির দিকে। এঁর কাছেই তিনি ঋতুরক্ষার দায়িত্ব সঁপে দিতে চান। একমাত্র এই সেই পুরুষ যাঁকে তিনি শয্যায় বরণ করে নিতে প্রস্তুত, তার সন্তান ধারণ করতে পারেন। শােনাতে পারেন যাবতীয় গােপন-গহীন উচ্চারণ! নইলে তার জীবন-যৌবন বৃথা।

দেব্যানী ব্রাহ্মণী হয়েও ক্ষত্রিয় রাজা যযাতিকে বিবাহ করার জেদ ধরলেন। যযাতি ইতস্তত করছিলেন, কারণ এই বিবাহ প্রতিলােম। শুক্রাচার্য প্রবেশ করলেন এই কাহিনিতে। তিনি বললেন, “আমার কন্যা বড়ই দুঃখী। আমি জানি, তুমি শর্মিষ্ঠাতে আসক্ত, সে রাজকুমারী, তুমি রাজা। কিন্তু সে যে দেবযানীর দাসী। যদি তুমি দেব্যানীকে বিবাহ করাে তাহলে শর্মিষ্ঠাকে দাসী হিসাবে পাবে। দাসীকে ভােগ করার কথা তাে সর্বজন বিদিত। প্রতিলােম বিবাহের কোনও পাপ তােমার হবে না। তবে চেষ্টা করে দেখে যাতে শর্মিষ্ঠা তােমার শয্যায় না ওঠে।” বিবাহের পর দেবযাণী গেলেন প্রাসাদে, শর্মিষ্ঠা অশােক বনে। দেবযানীর মনে সর্বদাই সন্দেহ, যযাতি কি শর্মিষ্ঠার কাছে যাচ্ছেন? রাজকন্যা শর্মিষ্ঠার বনে বাস করতে খুব কষ্ট হতে লাগল। ইতিমধ্যে দেবযানী পুত্রবতী হয়েছেন। অশােকবনের পর্ণকুটিরে পা রাখলেন যযাতি। শর্মিষ্ঠা বললেন, “শােনাে রাজা, দেবযানী যদি চন্দ্র হয়, আমি তাহলে সূর্য আমাকে উপেক্ষা কোরাে না। সন্তানবতী করাে।” কামের উদগ্র ইচ্ছায় রাজা শুক্রাচার্যের কথা ভুলে গেলেন। শর্মিষ্ঠা পুনরায় বললেন, “রাজা, মিথ্যায় পরিহাস পুষ্ট হয়। মনােরঞ্জনে, বিবাহে, প্রাণসংশয়ে মিথ্যা বলাও যায়। তুমি আমার সখীর পতি, আমারও পতি। দাসীকে তুমি তৃপ্ত করাে। এসাে আমরা মিলিত হই।” 

যযাতি শর্মিষ্ঠার শয্যায় উঠলেন। একে একে শর্মিষ্ঠা খুলে ফেললেন তার কুমারীত্বের যত আবরণ। যযাতি-শর্মিষ্ঠা মিশে গেলেন অনাবিল রতিবন্ধ। শর্মিষ্ঠা পুত্রবতী হলেন। দেবযানী ধরে ফেললেন সৰু বিললেন, “দাসী হয়ে তুই আমার পতিকে শয্যায় ডেকেছিস কোন দুঃসাহসি?” শর্মিষ্ঠা উত্তর দেন, “আমার কাম চরিতার্থ করার দায় রাজা যযাতি তিনিই আমার ভর্তা। আমি যৌবনবতী, সেই যৌবনের রক্ষণাবেক্ষণেরয় যদি ভুর্ত গ্রহণ না করেন তাহলে যে অধম হয় দেবযানী!” দেবযানী এবার সব কথা খুলে বললেন পিতাকে। শুক্রাচার্য যযাতিকে অভিশাপ দিলেন, “আপনি যতদিন বাঁচবেন যৌবনবিহীন ভাবেই বাঁচবেন। আপনি জরাগ্রস্থ হােন।”

দেবযানী-শর্মিষ্ঠা পুনরায় মিলন থেকে দূরে সরে গেলেন। ……………..

 

 

Leave a Reply