সারানুবাদঃ রাজশেখর বসু
……..আদিপর্ব…….
৩। উতঙ্ক, পৌষ্য ও তক্ষক
…….. উতঙ্ক গুরুগৃহে থেকে সকল কর্তব্য পালন করতে লাগলেন, একদিন আশ্রমের নারীরা তাঁকে বললে, তােমার উপাধ্যায়নী ঋতুমতী হয়েছেন কিন্তু উপাধ্যায় এখানে নেই; ঋতু যাতে নিস্ফল না হয় তুমি তা কর। উতঙ্ক উত্তর দিলেন, আমি স্ত্রীলােকের কথায় এমন অকার্য করতে পারি না, উপাধ্যায় আমাকে অকার্য করবার আদেশ দেন নি। কিছুকাল পরে উপাধ্যায় ফিরে এলেন এবং সকল বৃত্তান্ত শুনে প্রীত হয়ে বললেন, বৎস উপাধ্যায়, আমি তােমার কি প্রিয়সাধন করব বল।…….
………আদিবংশাবতরণপর্বাধ্যায়……..
১০। উপরিচয় বসু – পরাশর-সত্যবতী -কৃষ্ণদ্বৈপায়ন
……….উপরিচরের রাজধানীর নিকট শক্তিমতী নদী ছিল। কোলাহল নামক পর্বত এই নদীর গর্ভে এক পুত্র এবং এক কন্যা উৎপাদন করে। রাজা সেই পুত্রকে সেনাপতি এবং কন্যাকে মহিষী করলেন। একদিন মৃগয়া করতে গিয়ে রাজা তার ঋতুস্নাতা রুপবতী মহিষী গিরিকাকে স্মরণ করে কামাবিষ্ট হলেন এবং স্খলিত শুক্র এক শ্যেনপক্ষকে দিয়ে বললেন, তুমি শীঘ্র গিরিকাকে দিয়ে এস। পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমণের ফলে শুক্র যমুনার জলে পড়ে গেল। অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা হশাপে মৎসী হয়ে ছিল, সে শুক্র গ্রহণ করে গর্ভিণী হল এবং দশম মাসে ধীবরের জালে ধত হল। ধীবর সেই মৎসীর উদরে একটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রী সন্তান পেয়ে রাজার কাছে নিয়ে এল। অপ্সরা তখনই শাপমুক্ত হয়ে আকাশপথে চলে গেল। উপরিচর ধীবরকে বললেন, এই কন্যা তােমারই হক। পুরষ সন্তানটি পরে মৎস্য নামে এক ধার্মিক রাজা হয়েছিলেন।
সেই রুপগণবতী কন্যার নাম সত্যবতী, কিন্তু সে মৎস্যজীবীদের কাছে থাকত সেজন্য তার অন্য নাম মৎস্যগন্ধা। একদিন সে যমুনায় নৌকা চালাচ্ছিল এমন সময় পরাশর মুনি তীর্থপর্যটন করতে করতে সেখানে এলেন। অতীব রূপবতী চারুহাসিনী মৎস্যগন্ধাকে দেখে মােহিত হয়ে পরাশর বললেন, সুন্দরী, এই নৌকার কর্ণধার কোথায়? সে বললে, যে ধীবরের এই নৌকা তাঁর পুত্র না থাকায় আমিই সকলকে পার করি। পরাশর নৌকায় উঠে যেতে যেতে বললেন, আমি তােমার জন্মবত্তান্ত জানি কল্যাণী, তােমার কাছে বংশধর পুত্ৰ চাচ্ছি, তুমি আমার কামনা পুর্ণ কর। সত্যবতী বললে, ভগবান, পরপারের ঋষিরা আমাদের দেখতে পাবেন। পরাশর তখন কুজ্ ঝটিকা সৃস্টি করলেন, সবদিক তমসাচ্ছন্ন হল। সত্যবতী লজ্জিত হয়ে বললে, আমি কুমারী, পিতার বশে চলি, আমার কন্যাভাব দূষিত হলে কি করে গৃহে ফিরে যাব? পরাশর বললেন, আমার প্রিয়কার্য করে তুমি কুমারীই থাকবে। পরাশরের বরে মৎস্যগন্ধার দেহ সুগন্ধময় হল, সে গন্ধবতী নামে খ্যাত হল। এক যােজন দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যেত সেজন্য লোকে তাকে যােজনগান্ধাও বলে।
সত্যবর্তী সদ্য গর্ভধারণ করে পুত্র প্রসব করলেন। যমুনার দ্বীপে জাত এই পরাশরপুত্রের নাম দ্বৈপায়ন ……….
………
১২। দেবযানী , শর্মিষ্ঠা ও যযাতি
কচ ফিরে এলে দেবতারা আনন্দিত হয়ে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখলেন, তার পর ইন্দ্র অসুরগণের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন। এক রমণীয় বনে কতকগলি কন্যা জলকেলি করছে দেখে ইন্দ্র বায়ুর রুপ ধরে তাদের বস্ত্রগুলি মিশিয়ে দিলেন। সেই কন্যাদের মধ্যে অসুরপতি বৃষপর্বর কন্যা শর্মিষ্ঠা ছিলেন, তিনি ভুলক্রমে দেবযানীর বস্ত্র পরলেন।
দেবযানী বললেন, অসুরী, আমার শিষ্যা হয়ে তুই আমার কাপড় নিলি কেন? তুই সদাচারহীনা, তাের ভাল হবে না। শর্মিষ্ঠা বললেন, তাের পিতা বিনীত হয়ে নীচে বসে স্তুতিপাঠকের ন্যায় আমার পৃিতাঁর স্তব করেন। তুই যাচকের কন্যা, আমি দাতার কন্যা। ……….
দেবযানী নিজের বস্ত্র নেবার জন্য টানতে লাগলেন, তখন শর্মিষ্ঠা ক্রোধে অধীর হয়ে তাঁকে এক কুপের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিলেন এবং মরে গেছে মনে করে নিজের ভবনে চলে গেলেন। সেই সময়ে মৃগয়ায় শ্রান্ত ও পিপাসিত হয়ে রাজা যযাতি অশ্বআরােহণে সেই কুপের কাছে এলেন। তিনি দেখলেন, কুপের মধ্যে অগ্নিশিখার ন্যায় এক কন্যা রয়েছে। রাজা তাঁকে আশ্বস্ত করলে দেবযানী নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনাকে সকুলােদভব শান্ত বীর্যবান দেখছি, আমার দক্ষিণ হাত ধ’রে আপনি আমাকে তুলুন। যযাতি দেবযানীকে উদ্ধার করে রাজধানীতে চলে গেলেন।……..
……..দীর্ঘকাল পরে একদিন বরবৰ্ণিনী দেবযানী শর্মিষ্ঠা ও সহস্র দাসীর সঙ্গে বনে বিচরণ করছিলেন এমন সময় রাজা যযাতি মৃগের অন্বেষণে পিপাসিত ও শ্রান্ত হয়ে আবার সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখলেন, রত্নভূষিত দিব্য আসনে সুহাসিনী দেবযানী বসে আছেন, রপে অতুলনীয়া স্বর্ণালংকারভূষিতা আর একটি কন্যা কিঞ্চিৎ নিম্ন আসনে বসে দেবযানীর পদসেবা করছেন। যযাতির প্রশ্নের উত্তরে দেবযানী নিজেদের পরিচয় দিলেন। যযাতি বললেন, অসুররাজকন্যা কি করে আপনার দাসী হলেন জানতে আমার কৌতহল হচ্ছে, এমন সর্বাঙ্গসুন্দরী আমি পূর্বে কখনও দেখি নি। আপনার রুপ এর রপের তুল্য নয়। দেবযানী উত্তর দিলেন, সবই দৈবের বিধানে ঘটে, এর দাসীত্বও সেই কারণে হয়েছে। আকার বেশ ও কথাবার্তায় আপনাকে রাজা বােধ হচ্ছে, আপনি কে? যযাতি বললেন, আমি রাজা যযাতি, মৃগয়া করতে এসেছিলাম, এখন অনুমতি দিন ফিরে যাব।
দেবযানী বললেন, শর্মিষ্ঠা আর এই সমস্ত দাসীর সঙ্গে আমি আপনার তাধীন হচ্ছি, আপনি আমার ভর্তা ও সখা হন। যযাতি বললেন, সুন্দুরী, আমি আপনার যােগ্য নই, আপনার পিতা ক্ষত্রিয় রাজাকে কন্যাদান করবেন না। দেবযানী বললেন, ব্রাম্নণ আর ক্ষত্রিয় পরস্পরের সংসষ্ট, আপনি পুর্বেই আমার পাণিগ্রহণ করেছেন, আমিও আপনাকে বরণ করেছি। দেবযানী তখন তাঁর পিতাকে ডাকিয়ে এনে বললেন, পিতা, এই রাজা যযাতি আমার পাণি গ্রহণ করে কুপ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আপনাকে প্রণাম করছি, এর হস্তে আমাকে সম্প্রদান করুন, আমি অন্য পতি বরণ করব না।
শুক্র বললেন, প্রণয় ধর্মের অপেক্ষা রাখে না তাই তুমি যযাতিকে বরণ করেছ। কচের শাপে তােমার স্বর্ণে বিবাহও হতে পারে না। যযাতি, তােমাকে এই কন্যা দিলাম, একে তােমার মহিষী কর। আমার বরে তোমার বর্ণসংকরজনিত পাপ হবে না। বৃষপর্বার কন্যা এই কুমারী শর্মিষ্ঠাকে তুমি সসম্মানে রেখাে, কিন্তু একে শয্যায় ডেকো না।
দেবযানী শর্মিষ্ঠা আর দাসীদের নিয়ে যযাতি তাঁর রাজধানীতে গেলেন। দেবযানীর অনুমতি নিয়ে তিনি অশোক বনের নিকট শর্মিষ্ঠার জন্য পৃথক গৃহ নির্মাণ করিয়ে দিলেন এবং তাঁর অন্নবস্ত্রাদির উপযুক্ত ব্যবস্থা করলেন। সহস্র দাসীও শর্মিষ্ঠার কাছে রইল।
কিছুকাল পরে দেবযানীর একটি পত্র হল। শর্মিষ্ঠা ভাবলেন, আমার পতি নেই, বৃথা যৌবনবতী হয়েছি; আমিও দেবযানীর ন্যায় নিজেই পতি বরণ করব। একদা যযাতি বেড়াতে বেড়াতে অশােক বনে এসে পড়লেন। শর্মিষ্ঠা তাঁকে সংবর্ধনা করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহারাজ, আমার রুপ কুল শীল আপনি জানেন, আমি প্রার্থনা করছি আমার ঋতুরক্ষা করুন। যযাতি বললেন, তুমি সর্ব বিষয়ে অনিন্দিতা তা আমি জানি, কিন্তু তােমাকে শয্যায় আহবান করতে শুক্রাচার্যের নিষেধ আছে। শর্মিষ্ঠা বললেন,……
—মহারাজ, পরিহাসে, স্ত্রীলােকের মনােরঞ্জনে, বিবাহকালে, প্রাণসংশয়ে এবং সর্বস্ব নাশের সম্ভাবনায়, এই পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না।
যযাতি বললেন, আমি রাজা হয়ে যদি মিথ্যাচরণ করি তার প্রজারাও আমার অনুসরণ করে মিথ্যাকথনের পাপে বিনষ্ট হবে। শর্মিষ্ঠা বললেন, যিনি সখীর পতি তিনি নিজের পতির তুল্য, দেবযানীকে বিবাহ করে আপনি আমারও পতি হয়েছেন। পুত্রহীনার পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করুন, আপনার প্রসাদে পুত্রবতী হয়ে আমি ধর্মাচরণ করতে চাই। তখন যযাতি শর্মিষ্ঠার প্রার্থনা পূরণ করলেন।
১৩। যযাতির জরা।
শর্মিষ্ঠার দেবকুমারতুল্য একটি পুত্র হল। দেবযানী তাঁকে বললেন, তুমি কামের বশে এ কি পাপ করলে ? শর্মিষ্ঠা বললেন, একজন ধর্মাত্মা বেদজ্ঞ ঋষি আমার কাছে এসেছিলেন, তাঁরই বরে আমার পুত্র হয়েছে, আমি অন্যায় কিছু, করি নি। দেবযানী প্রশ্ন করলেন, সেই ব্রাম্নণের নাম গােত্র বংশ কি? শর্মিষ্ঠা বললেন, তিনি তপস্যার তেজে সুর্যের ন্যায় দীপ্তিমান, তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করবার শক্তি আমার ছিল না। দেবযানী বললেন, তুমি যদি বর্ণজ্যেষ্ঠ ব্রাম্নণের থেকেই অপত্যলাভ করে থাক তবে আর আমার ক্রোধ নেই।
কালক্রমে যদু ও তুর্বসু নামে দেবযানীর দুই পুত্র এবং দ্রুহ্য অনু ও পুরু নামে শর্মিষ্ঠার তিন পুত্র হল। একদিন দেবযানী যযাতির সঙ্গে উপবনে বেড়াতে বেড়াতে দেখলেন, দেবকুমারতুল্য কয়েকটি বালক নির্ভয়ে খেলা করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, বত্সগণ, তােমাদের নাম কি, বংশ কি, পিতা কে? বালকরা যযাতি আর শর্মিষ্ঠার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললে, এই আমাদের পিতা মাতা। এই বলে তারা রাজার কাছে এল, কিন্তু দেবযানী সঙ্গে থাকায় রাজা তাদের আদর করলেন না, তারা কাঁদতে কাঁদতে শর্মিষ্ঠার কাছে এল। দেবযানী শর্মিষ্ঠাকে বললেন, তুমি আমার অধীন হয়ে অসুর স্বভাবের বশে আমারই অপ্রিয় কার্য করেছ, আমাকে তােমার ভয় নেই। শর্মিষ্ঠা উত্তর দিলেন, আমি ন্যায় আর ধর্ম অনুসারে চলেছি, তােমাকে ভয় করি না। এই রাজর্ষিকে তুমি যখন পতিরুপে বরণ করেছিলে তখন আমিও করেছিলাম। যিনি আমার সখীর পতি, ধর্মানুসারে আমারও পতি।
তখন দেবযানী বললেন, রাজা, তুমি আমার অপ্রিয় কার্যকরেছ, আর আমি এখানে থাকব না। এই বলে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে সালােচনে শুক্রাচার্যের কাছে চললেন, রাজাও পিছু পিছু গেলেন। দেবযানী বললেন, অধর্মের কাছে ধর্ম পরাজিত হয়েছে, যে নীচ সে উপরে উঠেছে, শর্মিষ্ঠা আমাকে অতিক্রম করেছে। পিতা, রাজা যযাতি শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিন পত্রে উৎপাদন করেছেন আর দুর্ভাগা আমাকে দুই পত্র দিয়েছেন। ইনি ধর্মজ্ঞ বলে খ্যাত, কিন্তু আমার মর্যাদা লঙ্ঘনন করেছেন।
শুক্র ক্রদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিলেন, মহারাজ, তুমি ধর্মজ্ঞ হয়ে, অধর্ম করেছ, আমার উপদেশ গ্রাহ্য কর নি, অতএব দুর্জয় জরা তােমাকে আক্রমণ করবে। সাপ প্রত্যাহারের জন্য যযাতি বহু অনুনয় করলে শত্রু বললেন, আমি মিথ্যা বলি না, তবে তুমি ইচ্ছা করলে তােমার জরা অন্যকে দিতে পারবে। যযাতি বললেন, আপনি অনুমতি দিন, যে পুত্র আমাকে তার যৌবন দেবে সেই রাজ্য পাবে এবং পণ্যবান কীর্তিমান হবে। শুক্র বললেন, তাই হবে।
যযাতি রাজধানীতে এসে জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুকে বললেন, বৎস, আমি শুক্রের শাপে জরাগ্রস্ত হয়েছি কিন্তু যৌবনভােগে এখনও তৃপ্ত হই নি। আমার জরা নিয়ে তােমার যৌবন আমাকে দাও, সহস্র বৎসর পরে আবার তােমাকে যৌবন দিয়ে নিজের জরা ফিরিয়ে নেব। যদু উত্তর দিলেন, জরায় অনেক কষ্ট, আমি নিরানন্দ শ্বেত, লালচর্ম দুর্বলদেহ, অকর্মণ্য হয়ে যাব, যুবক সহচররা আমাকে অবজ্ঞা করবে। আমার চেয়ে প্রিয়তর পুত্র আপনার আরও তাে আছে, তাদের বলুন। যযাতি বললেন, আত্মজ হয়েও যখন আমার অনুরােধ রাখলে না তখন তােমার সন্তান রাজ্যের অধিকারী হবে না।
তার পর যযাতি একে একে তুর্বসু, দ্রুহ্যুন এবং অনুকে অনুরােধ করলেন কিন্তু কেউ জরা নিয়ে যৌবন দিতে সম্মত হলেন না। যযাতি তাঁদের এইরুপ শাপ দিলেন ………
…….যযাতির কনিষ্ঠ পুত্র পুরু পিতার অনুরােধ শুনে তখনই বললেন, মহারাজ আপনার আজ্ঞা পালন করব, আমার যৌবন নিয়ে অভীষ্ট সুখ ভােগ করুন, আপনার জরা আমি নেব। যযাতি প্রীত হয়ে বললেন, বৎস, তােমার রাজ্যে সকল প্রজা সব বিষয়ে সমৃদ্ধি লাভ করবে।
পুরুর যৌবন পেয়ে যযাতি অভীষ্ট বিষয় ভোগ, প্রজাপালন এবং বহুবিধ ধর্মকর্মের অনুষ্ঠান করতে লাগলেন। সহস্র বৎসর অতীত হলে তিনি পুরুকে বললেন, পুত্র তােমার যৌবন লাভ করে আমি ইচ্ছানুসারে বিষয় ভােগ করেছি।
—কাম্য বস্তুর উপভোগে কখনও কামনার শান্তি হয় না, ঘতসংযােগে অগ্নির ন্যায়। আরও বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীতে যত ধানা যব হিরণ্য পশু ও স্ত্রী আছে তা একজনের পক্ষে পর্যাতনয়, অতএব বিষয়তৃষ্ণা ত্যাগ করা উচিত।………..
১৪। দুষ্মন্ত-শকুল
পুরুর বংশে দুস্মন্ত নামে এক বীর্যবান রাজা জন্মগ্রহণ করেন, তিনি পৃথিবীর সর্ব প্রদেশ শাসন করতেন। তাঁর দুই পুত্র হয়, লক্ষণার গর্ভে জনমেজয় এবং শকুন্তলার গর্ভে ভরত। ভরতবংশের যশােরাশি বহুবিস্তৃত। একা দুস্মন্ত প্রভূত সৈন্য ও বাহন নিয়ে গহন বনে মৃগয়া করতে গেলেন। বহু পশু বধ করে তিনি একাকী অপর এক বনে ক্ষুৎপিপাসার্ত ও শ্রান্ত হয়ে উপস্থিত হলেন। এই বন অতি রমণীয়, নানাবিধ কুসুমিত বৃক্ষে সমাকীর্ণ এক ঝিল্লী ভ্রমর ও কোকিলের রবে মুখরিত। রাজা মালিনী নদীর তীরে কন্ব মুনির মনােহর আশ্রম দেখতে পেলেন, সেখানে হিংস্র জন্তুরাও শান্তভাবে বিচরণ করছে।
অনুচরদের অপেক্ষা করতে বলে দুস্মন্ত আশ্রমে প্রবেশ করে দেখলেন, ব্রাহমুণরা বেদপাঠ এবং বহুবিধ শাস্ত্রের আলােচনা করছেন। মহর্ষি কন্ব মুনির দেখা না পেয়ে তাঁর কুটীরের নিকটে এসে দুস্মন্ত উচ্চকণ্ঠে বললেন, এখানে কে জানে? রাজার বাক্য শুনে লক্ষীর ন্যায় রুপবতী তাপসবেশধারিণী একটি কন্যা এলেন এবং দুষ্মন্তকে স্বাগত জানিয়ে আসন পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে সংবর্ধনা করলেন। তারপর মধুর স্বরে কুশলপ্রশ্ন করে বললেন, কি প্রয়ােজন বলুন, আমার পিতা ফল আহরণ করতে গেছেন, একটু অপেক্ষা করুন, তিনি শীঘ্রই আসবেন।
এই সুনিতম্বনী চারুহাসিনী রূপযৌবনবতী কন্যাকে দুষ্মন্ত বললেন, আপনি কে, কার কন্যা, এখানে কোথা থেকে এলেন? কন্যা উত্তর দিলেন, মহারাজ, আমি ভগবান কন্বের দুহিতা। রাজা বললেন, তিনি তো ঊরেতা তপশী, আপনি তাঁর কন্যা কিরুপে হলেন? কন্যা বললেন, ভগবান কম্ব এক ঋষিকে আমার জন্মবৃত্তান্ত বলেছিলেন, আমি তা শুনেছিলাম। সেই বিবরণ আপনাকে বলছি শুনুন–
পূর্বকালে বিশ্বামিত্র ঘাের তপস্যা করছেন দেখে ইন্দ্র ভীত হয়ে মেনকাকে পাঠিয়ে দেন। মেনকা বিশ্বামিত্রের কাছে এসে তাঁকে অভিবাদন করে নৃত্য করতে লাগলেন, সেই সময়ে তাঁর সুক্ষ শুভ্র বসন বায়ু হরণ করলেন। সর্বশসুন্দরী বিবস্ত্রা মেনকাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। মেনকার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল, তিনি গর্ভবতী হলেন এবং একটি কন্যা প্রসব করেই তাকে মালিনী নদীর তীরে ফেলে ইন্দুসভায় চলে গেলেন। সিংহবাসমাকুল জনহীন বনে সেই শিশুকে পক্ষীরা রক্ষা করতে লাগল। মহর্মি কম্ব স্নান করতে গিয়ে শিশুকে দেখতে পেলেন এবং গৃহে এনে তাকে দুহিতার ন্যায় পালন করলেন। শকুন্তলা অর্থাৎ পক্ষী কর্তৃক রক্ষিত সেজন্য তার নাম শকুন্তলা হল। আমিই সেই শকুন্তলা। শরীরদাতা প্রাণদাতা ও অন্নদাতাকে ধর্মশাস্ত্রে পিতা বলা হয়। মহারাজ, আমাকে মহর্ষি কবের দুহিতা বলে জানবেন।
দুষ্মন্ত বললেন, কল্যাণী, তােমার কথায় জানলাম তুমি রাজপুত্রী, তুমি আমার ভার্যা হও। এই সুবর্ণমালা, বিবিধ বস্তু, কুণ্ডল, নানাদেশজাত মণিরত্ন, কক্ষের অলংকার এবং মৃগচর্ম তুমি নাও, আমার সমস্ত রাজ্য তােমারই, তুমি আমার ভার্যা হও, তুমি গান্ধর্বরীতিতে আমাকে বিবাহ কর, এইরুপ বিবাহই শ্রেষ্ঠ।
শকুন্তলা বললো, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমার পিতা ফিরে এলেই আপনার হাতে আমাকে সম্প্রদান করবেন। তিনিই আমার প্রভু ও পরম দেবতা, তাঁকে অমান্য করে অধর্মানুসারে পতিবরণ করতে পারি না। দুষ্মন্তু বললেন, বরবর্ণিনী, অর্ধমানুসারে তুমি নিজেই নিজেকে দান করতে পার। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব বা রাক্ষস বিবাহ অথবা এই দুইএর মিশ্রিত রীতিতে বিবাহ ধর্মসংগত, অতএব তুমি গান্ধব বিধানে আমার ভার্যা হও। শকুন্তলা বললেন, তাই যদি ধর্মসংগত হয় তবে আগে এই অঙ্গীকার করুন যে আমার পুত্র যুবরাজ হবে এবং আপনার পরেই পুত্ৰই রাজা হবে।
কিছুমাত্র বিচার না করে দুষ্মন্ত উত্তর দিলেন, তুমি যা বললে তাই হবে। মনস্কাম সিদ্ধ হলে তিনি শকুন্তলাকে বার বার বললেন, সুহাসিনী, আমি চতুর্মাণী সেনা পাঠাব, তারা তােমাকে আমার রাজধানীতে নিয়ে যাবে। এইরুপ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং কন্দ শুনে কি বলবেন তা ভাবতে ভাবতে দুস্মন্ত নিজের পুরীতে ফিরে গেলেন।…………
১৫। মহাভিষ – অষ্টবসু – প্রতীপ – শালগঙ্গ
………মহাভিষ নামে ইক্ষাকুবংশীয় এক রাজা ছিলেন, তিনি বহু, যজ্ঞ করে স্বর্গে যান। একদিন তিনি দেবগণের সঙ্গে ব্রহ্মার কাছে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সহসা বায়ুর প্রভাবে গঙ্গার সূক্ষ বসন অপসৃত হল। দেবগণ অধােমুখ হয়ে রইলেন, কিন্তু মহাভিষ গঙ্গাকে অসংকোচে দেখতে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁকে শাপ দিলেন, তুমি মর্ত্যলােকে জন্মগ্রহণ কর, পরে আবার স্বর্গে আসতে পারবে। মহাভিষ স্থির করলেন তিনি মহাতৈজস্বী প্রতীপ রাজার পুত্র হবেন।
গঙ্গা মহাভিষকে ভাবতে ভাবতে মর্তে ফিরে আসছিলেন, পৃথিমধ্যে দেখলেন বসু নামক দেবগণ মুর্ছিত হয়ে পড়ে আছেন। গঙ্গার প্রশ্নে উত্তরে তাঁরা বললেন, বশিষ্ঠ আমাদের শাপ দিয়েছেন—তােমরা নরযোনিতে জন্মগ্রহণ কর। আমরা মানুষীর গর্ভে যেতে চাই না, আপনিই আমাদের পুত্ররুপে প্রসব করুন, প্রতীপের পুত্র শান্তন, আমাদের পিতা হবেন। জন্মের পরেই আপনি আমাদের জলে ফেলে দেবেন, যাতে আমরা শীঘ্র নিষ্কৃতি পাই। গঙ্গা বললেন, তাই করব, কিন্তু যেন একটি পুত্র জীবিত থাকে, নতুবা শান্তুনুর সঙ্গে আমার সংগম ব্যর্থ হবে। বসুগণ বললেন, আমরা প্রত্যেকে নিজ বীর্যের অষ্টমাংশ দেব, তার ফলে একটি পুত্র জীবিত থাকবে। এই পুত্র বলবান হবে কিন্তু তার সন্তান হবে না।
রাজা প্রতীপ গঙ্গাতীরে বসে জপ করছিলেন এমন সময় মনােহর নারী ধারণ করে গঙ্গা জল থেকে উঠে প্রতীপের দক্ষিণ উরুতে বসলেন। রাজা বললেন, কল্যাণী, কি চাও? গঙ্গা বললেন, কুরুশ্রেষ্ঠ, আমি তােমাকে চাই। রাজা বললেন, পরশ্রী আর অসবর্ণা আমার অগম্য। গঙ্গা বললেন, আমি দেবকন্যা, অগম্য নই। রাজা বললেন, তুমি আমার বাম ঊরুতে না বসে দক্ষিণ উরুতে বসেছ, যেখানে পুত্র কন্যা আর পুত্রবধুর স্থান। তুমি আমার পুত্রবধু হবে। গঙ্গা বললেন, তাই হব, কিন্তু আমার কোনও কার্যে আপনার পুত্র আপত্তি করতে পারবেন না। প্রতীপ সম্মত হলেন।
গঙ্গা অন্তর্হিত হলে প্রতীপ ও তাঁর পত্নী পুত্রলাভের জন্য তপস্যা করতে লাগলেন। রাজা মহাভিষ তাঁদের পুত্ররুপে জন্মগ্রহণ করলেন, তাঁর নাম হল শান্তনু। শান্তনু যৌবন লাভ করলে প্রতীপ তাঁকে বললেন, তােমার নিমিত্ত এক রুপবতী কন্যা পুর্বে আমার কাছে এসেছিল। সে যুদি পুতকামনায় তােমার কাছে উপস্থিত হয়, তবে তার ইচ্ছা পূর্ণ করাে, কিন্তু তার পরিচয় জানতে চেয়ো না, তার কার্যেও বাধা দিও না। তার পর প্রতীপ তাঁর পুত্র শান্তনু রাজ্যে অভিষিক্ত করে বনে প্রস্থান করলেন।
একদিন শান্তনু গঙ্গার তীরে এক দিব্যাভরণভূষিতা পরমা সুন্দরী নারীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, তুমি দেবী দানব অপ্সরা না মানুষী? তুমি আমার ভার্যা হও। গঙ্গা উত্তর দিলেন, রাজা, আমি তােমার মহিষী ই, কিন্তু আমি শুভ বা অশুভ যাই করি তুমি যদি বারণ বা ভৎসনা কর তবে তােমাকে নিশ্চয় ত্যাগ করব। শান্তনু তাতেই সম্মত হলেন।…….
১৭। চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য – কাশীরাজের তিন কন্যা
সত্যবতীর গর্ভে শান্তনুর এই পুত্ৰ হল, চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। কনিষ্ঠ পুত্র যৌবনলাভ করবার পূর্বেই শান্তনু গত হলেন, সত্যবতীর মত নিয়ে ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। চিত্রাঙ্গদ অতিশয় বলশালী ছিলেন এবং মানুষ দেবতা অসর গন্ধব সকলকেই নিকৃষ্ট মনে করতেন। একদিন গন্ধরাজ চিত্রাঙ্গদ তাঁকে বললেন, তােমার আর আমার নাম একই, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর নতুবা অন্য নাম নাও। কুরুক্ষেত্রে হিরমতী নদীর তীরে দুজনের ঘাের যুদ্ধ হ’ল, তাতে … চিত্রাঙ্গদ নিহত হলেন। ভীম, অপ্রাপ্তষৌন বিচিত্রবীর্যকে রাজপদে বসালেন।
বিচিত্রবীর্য যৌবনলাভ করলে ভীষ্ম তাঁর বিবাহ দেওয়া স্থির করলেন। কাশীরাজের তিন পরমা সুন্দরী কন্যার একসঙ্গে স্বয়ংবর হবে শুনে ভীষ্ম বিমাতার অনুমতি নিয়ে রথারােহণে একাকী বারাণসীতে গেলেন। তিনি দেখলেন, নানা দেশ থেকে রাজারা স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হয়েছেন। যখন পরিচয় দেবার জন্য রাজাদের নামকীর্তন করা হল তখন কন্যারা ভীষ্মকে বৃদ্ধ ও একাকী দেখে তার কাছ থেকে সরে গেলেন। সভায় যে সকল হীনমতি রাজা ছিলেন তাঁরা হেসে বললেন, এই পরম ধর্মাত্মা পলিতকেশ নির্লজ্জ বৃদ্ধ এখানে কেন এসেছে। যে প্রতিজ্ঞাপালন করে না তাকে লােকে কি বলবে? ভীষ্ম বৃথাই ব্রহ্মচারী খ্যাতি পেয়েছেন।
উপহাস শুনে ভীম ক্রদ্ধ হয়ে তিনটি কনাকে নিজের রথে তুলে নিলেন এবং জলদগম্ভীরস্বরে বললেন, রাজগণ, বহুপ্রকার বিবাহ প্রচলিত আছে, কিন্তু ধর্মবাদিগণ বলেন, যে স্বয়ংবরসভায় বিপক্ষদের পরাভূত করে কন্যা হরণ করাই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। আমি এই কন্যাদের নিয়ে যাচ্ছি, তােমাদের শক্তি থাকে তাে যুদ্ধ কর। রাজারা ক্রোধে ওষ্ঠ দংশন করে সভা থেকে উঠলেন এবং অলংকার খুলে ফেলে বর্ম ধারণ করে নিজ নিজ রথে উঠে ভীষ্মকে আক্রমণ করলেন। সর্বশবিশারদ ভীস্মের সঙ্গে যুদ্ধে রাজারা পরাজিত হলেন, কিন্তু মহারথ শাম্বরাজ তাঁর পশ্চাতে যেতে যেতে বললেন, থাম, থাম। ভীষ্মের শরাঘাতে শাম্বের সারথি ও অশ্ব নিহত হল, শাম্ভ ও অন্যান্য রাজারা যুদ্ধে বিরত হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে চলে গেলেন। বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম তিন কন্যাকে পুত্রবধু, কনিষ্ঠা ভগিনী বা দহিতার ন্যায় যত্নসহকারে হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন।
ভীষ্ম বিবাহের উদযােগ করছেন জেনে কাশীরাজের জোষ্ঠা কন্যা অম্বা হাস্য করে তাঁকে বললেন, আমি স্বয়ংবরে শাম্বরাজকেই বরণ করতাম, তিনিও আমাকে চান, আমার পিতারও তাতে সম্মতি আছে। ধর্মজ্ঞ, আপনি ধর্ম পালন করুন। ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে অম্বাকে শারাজের কাছে পাঠালেন এবং অন্য দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলেন।
বিচিত্রবীর্য সেই দুই সন্দরী পত্নীকে পেয়ে কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। সাত বৎসর পরে তিনি যক্ষারােগে আক্রান্ত হলেন। সহৎ ও চিকিৎসকগণ প্রতিকারের বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু আদিত্য যেমন অস্তাচলে যান বিচিত্রবীর্যও সেইরপ যমসদনে গেলেন।
১৮। দীর্ঘতমা – ধৃতরাষ্ট, পান্ডূ ও বিধুরের জন্ম – অণিমান্ডব্য
পুত্রশােকার্তা সত্যবতী তাঁর দুই বধুকে সান্তনা দিয়ে ভীষ্মকে বললেন, রাজা শান্তনুর পিণ্ড কীতি ও বংশ রক্ষার ভার এখন তােমার উপর। তুমি ধর্মের তত্ত্ব ও কুলাচার সবই জান, এখন আমার আদেশে বংশরক্ষার জন্য দুই ভ্রাতৃবধুর গর্ভে সন্তান উৎপাদন কর, অথবা স্বয়ং রাজ্যে অভিষিক্ত হও এবং বিবাহ কর, পিতৃপুরুষগণকে নরকে নিমগ্ন করাে না।
ভীষ্ম বললেন, মা, আমি ত্রিলােকের সমস্তই ত্যাগ করতে পারি কিন্তু যে সত্যপ্রতিজ্ঞা করেছি তা ভঙ্গ করতে পারি না। শান্তনুর বংশ যাতে রক্ষা হয় তার ধর্মসম্মত উপায় বলছি শুনুন। পুরাকালে জামদগ্ন্য পরশুরাম কর্তৃক পথিবী নিঃক্ষত্রিয় হলে ক্ষত্রিয়নারীগণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সহবাসে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন, কারণ বেদে বলা আছে যে, ক্ষেত্রজ পুত্র বিবাহকারীরই পুত্র হয়। উতথ্য ঋষির পত্নী মমতা যখন গভির্নী ছিলেন তখন তাঁর দেবর বৃহস্পতি সংগম প্রার্থনা করেন। মমতার নিষেধ না শুনে বৃহস্পতি বলপ্রয়ােগে উদ্যত হলেন, তখন গর্ভ শিশু তার পা দিয়ে পিতৃব্যের চেষ্টা ব্যর্থ করলে বৃহস্পতি শিশুকে শাপ দিলেন, তুমি অন্ধ হবে। উতথ্যের পুত্র অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন, তাঁর নাম হল দীর্ঘতমা। তিনি ধার্মিক ও বেদজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু গােধর্ম অবলম্বন করায় প্রতিবেশী মনিগণ ক্রদ্ধ হয়ে তাঁকে ত্যাগ করলেন। দীর্ঘতমার পুত্ররা মাতার আদেশে পিতাকে ভেলায় চড়িয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেন। ধর্মাত্মা বলি রাজা তাঁকে দেখতে পেয়ে সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়ে গেলেন এবং মহিষী সুদেষ্ণাকে তার কাছে যেতে বললেন। অন্ধ বৃদ্ধ দীর্ঘতমার কাছে সুদেষ্ণা নিজে গেলেন না, তার ধাত্রীকন্যাকে পাঠালেন। সেই শুদ্রকন্যার গর্ভে কাক্ষীৰান প্রভৃতি এগারজন ঋষি উৎপন্ন হন। তারপর রাজার নিবন্ধে সদেষ্ণা স্বয়ং গেলেম, দীর্ঘতমা তার অঙ্গ স্পর্শ করে বললেন, তােমার পাঁচটি তেজস্বী পুত্র হবে …….বলি রাজার বংশ এইপে মহর্ষি দীঘতমা থেকে উৎপন্ন হয়েছিল।
তারপর ভীষ্ম বললেন, মাতা, বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য আপনি কোনও গুনবান ব্রাহ্মণকে অর্থ দিয়ে নিয়ােগ করুন। সত্যবতী হস্তি করে লঞ্জিতভাবে নিজের পুর্ব ইতিহাস জানালেন এবং পরিশেষে বললেন, কন্যাবস্থায় আমার যে পুত্র হয়েছিল তাঁর নাম দ্বৈপায়ন, তিনি মহাযােগী মহর্ষি, চতুর্বেদ বিভক্ত করে ব্যাস উপাধি পেয়েছেন। তিনি কৃষ্ণবর্ণ সেজন্য তাঁর অন্য নাম কৃষ্ণ। আমার এই পুত্র জন্মগ্রহণ করেই পিতা পরুশরের সঙ্গে চলে যান এবং যাবার সময় আমাকে বলেছিলেন যে, প্রয়ােজন হলে আমি ডাকলেই তিনি আসবেন। ভীষ্ম, তুমি আর আমি অনুরােধ করলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তাঁর প্রাতৃবধুদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন।
ভীস্ম এই প্রস্তাব সমর্থন করলে সত্যবতী স্বাসকে স্মরণ করলেন। ক্ষণকামধ্যে ব্যাস আবির্ভূত হলেন, সত্যবতী তাঁকে আলিঙ্গন এবং স্তনদুগ্ধে সিক্ত করে অশ্রু মােচন করতে লাগলেন। মাতাকে অভিবাদন করে ব্যাস বললেন, আপনার অভিলাষ পূরণ করতে এসেছি, কি করতে হবে আদেশ করুন। সত্যবতী তাঁর প্রার্থনা জানালে ব্যাস বললেন, কেবল ধর্মপালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার অভীষ্ট কার্য করব। আমার নির্দেশ অনুসারে দুই রাজ্ঞী এক বৎসর ব্রতপালন করে শুদ্ধ হন, তবে তারা আমার কাছে আসতে পারবেন। সত্যবতী বললেন, অরাজক রাজ্যে বৃষ্টি হয় না, দেবতা প্রসন্ন হন না, অতএব যাতে রানীরা যাতে সদ্য গর্ভবতী হন তার ব্যবস্থা কর, সন্তান হলে ভীস্ম তাদের পালন করবেন। ব্যাস বললেন, যদি এখনই পুত্র উৎপাদন করতে হয় তবে রানীরা যেন আমার কুৎসিত রুপ গন্ধ আর বেশ সহ্য করেন।
সত্যবতী অনেক প্রবােধ দিয়ে তাঁর পুত্রবধু অম্বিকাকে কোনও প্রকারে সম্মত করে শয়নগহে পাঠালেন। অম্বিকা উত্তম শয্যায় শুয়ে ভীস্ম এবং অন্যান্য কুরুবংশীয় বীরগণকে চিন্তা করতে লাগলেন। অনন্তর সেই দীপালােকিত গৃহে ব্যাস প্রবেশ করলেন। তাঁর কৃষ্ণ বর্ণ, দীপ্ত নয়ন ও পিঙ্গল জটা-শ্মশ্রু দেখে অম্বিকা ভয়ে চক্ষু নিমীলিত করে রইলেন। ব্যাস বাইরে এলে সত্যবতী প্রশ্ন করলেন, এ গর্ভে গুণবান রাজপুত্র হবে তো? ব্যাস উত্তর দিলেন, এই পুত্র শতহস্তিতুলা বলবান, বিধান, বুদ্ধিমান এবং শতপুত্রের পিতা হবে কিন্তু মাতার দোষে অন্ধ হবে। সত্যবতী বললেন, অন্ধ ব্যক্তি কুকুলের রাজা হবার যােগ্য নয়, তুমি আর একটি পুত্র দাও। সত্যবতীর অনুরোধে তাঁর দ্বিতীয় পুত্রবধু অম্বালিকা শয়নগ্হের এলেন কিন্তু ব্যাসের মূর্তি দেখে তিনি ভয়ে পাণ্ডু বর্ণ হয়ে গেলেন। সত্যবতীকে ব্যাস বললেন, এই পুত্র বিক্রমশালী খ্যাতিমান এবং পঞ্চপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে পাণ্ডুবর্ণ হবে।
যথাকালে অম্বিকা একটি অধ পত্র এবং অম্বালিকা পান্ডূ পুত্র প্রসব করলেন, তাঁদের নাম ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। অম্বিকা পুনবার ঋতুমতী হলে সত্যবতী তাঁকে আর একবার ব্যাসের কাছে যেতে বললেন, কিন্তু মহর্ষির রুপ আর গন্ধ মনে করে অম্বিকা নিজে গেলেন না, অপ্সরার ন্যায় রুপবতী এক দাসীকে পাঠালেন। দাসীর অভ্যর্থনা ও পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে ব্যাস বললেন, কল্যাণী, তুমি আর দাসী হয়ে থাকবে না, তােমার গভস্ত পুত্র ধর্মাত্মা ও পরম বুদ্ধিমান হবে। এই দাসীর গর্ভে বিধুর জন্মগ্রহণ করেন। ……..
১৯। গান্ধারী, কুন্তী ও মাদ্রী – কর্ণ – দুর্যোধনাদির জন্ম
…….একদা ঋষি দুর্বাসা অতিথি রুপে গৃহে এলে কুন্তী তাঁর পরিচর্যা করলেন, তাতে দুর্বাসা তুষ্ট হয়ে একটি মন্ত্র শিখিয়ে বললেন, এই মন্ত্র দ্বারা তুমি যে যে দেবতাকে আহবান করবে তাদের প্রসাদে তােমার পুত্রলাভ হবে। কৌতুহলবশে কুন্তী সুৰ্যকে ডাকলেন। সুর্য আবির্ভূত হয়ে বললেন, অসিতনয়না, তুমি কি চাও? দুর্বাসার বরের কথা জানিয়ে কুন্তী নতমস্তকে ক্ষমা চাইলেন। সুর্য বললেন, তােমার আহ্বান ব্যর্থ হবে না, আমার সঙ্গে মিলনের ফলে তুমি পুত্র লাভ করবে এবং কুমারীই থাকবে। কুন্তীর একটি দেবকুমার তুল্য পুত্র হল। এই পর স্বাভাবিক কবচ (বর্ম) ও কুণ্ডল ধারণ করে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, ইনিই পরে কর্ণ নামে খ্যাত হন। কলঙ্কের ভয়ে কুন্তী তাঁর পুত্রকে একটি পাত্রে রেখে জলে ভাসিয়ে দিলেন।……….
রাজা কুন্তিভােজ তাঁর পালিতা কন্যার বিবাহের জন্য সয়ংবরসভা আহবান করলে কুন্তী নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুর গলায় বরমাল্য দিলেন। পাণ্ডুর আর একটি বিবাহ দেবার ইচ্ছায় ভীষ্ম মধুদেশের রাজা বাহীকীয় গল্যের কাছে গিয়ে তাঁর ভগিনীকে প্রার্থনা করলেন। ………. শল্য প্রীত হয়ে তার ভগিনী মাদ্রীকে দান করলেন, ভীষ্ম সেই কনাকে হস্তিনাপরে এনে পার সঙ্গে বিবাহ দিলেন। …………
কিছুকাল পরে মহারাজ পাণ্ডু সসৈন্যে নির্গত হয় নানা দেশ জয় করে বহ, ধন নিয়ে বরাজ্যে ফিরে এলেন এবং ধতরাষ্ট্রের অনুমতিক্রমে সেই সমস্ত ধন ভীষ্ম, দুই মাতা ও বিধুরকে উপহার দিলেন। তারপর তিনি দুই পত্নীর সঙ্গে বনে গিয়ে মৃগয়া করতে লাগলেন।………..
২০। যুধিষ্ঠিরাদির জন্ম –গা ও মাধী অঙ্গ
একদিন পাণ্ডু অরণ্যে বিচরণ করতে করতে একটি হরিণমিথুনকে শরবিদ্ধ করলেন। আহত হরিণ ভূপতিত হয়ে বললে, কামক্রোধের বশবতী মঢ় ও পাপাসক লােকেও এমন নশংস কর্ম করে না। কোন জ্ঞানবান পুরুষে মৈথুনে রত মৃগদম্পতিকে বধ করে? মহারাজ, আমি কিমিক্ষম মনি, পুত্রকামনায় মৃগরুপ ধারণ করে পত্নীর সহিত সংগত হয়েছিলাম। তুমি জানতে না যে আমি ব্ৰাহ্মণ, সেজন্য তােমার হত্যার পাপ হবে না, কিন্তু আমার শাপে তােমারও সংগমকালে মৃত্যু হবে।
শাপগ্রস্ত পাণ্ডু বহু বিলাপ করে বললেন, আমি সংসার ত্যাগ করে…কঠোর তপস্যা ও কৃচ্ছসাধন করব। শাপের ফলে আমার সন্তান উৎপাদন অসম্ভব, অতএব গহধাশ্রমে আর থাকব না। কুন্তী ও মাদ্রী তাঁকে বললেন, আমরা তােমার ধর্মপত্নী, আমাদের সঙ্গে থেকেই তাে তপস্যা করতে পার, আমরাও ইন্দ্রিয়দমন করে তপস্যা করব। তার পর পাণ্ড নিজের এবং দুই পত্নীর সমস্ত অলংকার ব্ৰাহ্মণদের দান করে হস্তিনাপরে সংবাদ পাঠালেন যে তিনি প্রবজ্জা গ্রহণ করে অরণ্যবাসী হয়েছেন।
পাণ্ড তাঁর দুই পত্নীর সঙ্গে নাগশত, চৈত্ররথ, কালকট, হিমালয়ের উত্তর গন্ধমাদন পর্বত, ইন্দ্র সরােবর এবং হংসকট অতিক্রম করে শতশগ পর্বতে এসে তপস্যা করতে লাগলেন। বহু ঋষির সঙ্গে তাঁর সখ্য হল। ………পাণ্ডু বলেন, আমি নিঃসন্তান, স্বর্গের দ্বার আমার পক্ষে রুদ্ধ সেজন্য আপনাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম। আমি যজ্ঞ, বেদাধ্যয়ন-তপস্যা আর অনিষ্ঠরতার দ্বারা দেব, ঋষি ও মনুষ্যের ঋণ থেকে মত হয়েছি, কিন্তু পত্রোৎপাদন ও শ্রাদ্ধদ্বারা পিতৃ-ঋণ থেকে মুক্ত হতে পারি নি। আমি যে ভাবে জন্মেছি সেই ভাবে আমার পত্নীর গভে ষাতে সন্তান হতে পারে তার উপায় আপনারা বলুন। ঋষিরা বললেন, রাজা, আমরা দিব্য চক্ষুতে দেখছি তোমার দেবতুল্য পত্র হবে।
পাণ্ড নির্জনে কুন্তীকে বললেন, তুমি সন্তান লাভের জন্য চেষ্টা কর, আপৎকালে স্ত্রীলােক উত্তম বর্ণের পুরুষ অথবা দেবর থেকে পুত্রলাভ করতে পারে। কুন্তী বললেন, আমি শুনেছি রাজা ববিতার যক্ষা রােগে প্রাণত্যাগ করলে তাঁর মহিষী ভদ্রা মৃতপতির সহিত সংগমে পুত্রবতী হয়েছিলেন। তুমিও তপস্যার প্রভাবে আমার গর্ভে মানস পত্র উৎপাদন করতে পার। পাণ্ডু বললেন, ব্যষিতাশ দেবতুল্য শক্তিমান ছিলেন, আমার তেমন শক্তি নেই। আমি প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব বলছি শােন। পরকালে নারীরা স্বাধীন ছিল, তারা স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিচরণ করত, তাতে দোষ হত না কারণ প্রাচীন ধর্মই এইপ্রকার। উত্তরকুদেশবাসী এখনও সেই ধর্মানুসারে চলে। এদেশেও সেই প্রাচীন প্রথা অধিককাল রহিত হয় নি। উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন, তাঁর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু । একদিন শ্বেতকেতু দেখলেন, তাঁর পিতার সমক্ষেই এক ব্ৰাহ্মণ তাঁর মাতার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। উদ্দালক শ্বেতকেতুকে বললেন, তুমি ক্রদ্ধ হয়াে না, সনাতন ধর্মই এই, পৃথিবীতে সকল স্ত্রীলোকই গরুর তুল্য স্বাধীন। শ্বেতকেতু অত্যন্ত কুদ্ধ হয়ে বললেন, আজ থেকে যে নারী পরপুরুষগামিনী হবে, যে পুরুষ পতিতা পত্নীকে ত্যাগ করে অন্য নারীর সংসর্গ করবে, এবং যে নারী পতির আজ্ঞা পেয়েও ক্ষেত্রজ পত্র উৎপাদনে আপত্তি করবে, তাদের সকলেরই ভ্রণহত্যার পাপ হবে। কুন্তী, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন থেকে আমাদের জন্ম হয়েছে তা তুমি জান। আমি পুত্রপ্রার্থী, মন্তুকে অঞ্জলি রেখে অনুনয় করছি, তুমি কোনও তপস্বী ব্রাহ্মণের কাছে গণবান পুত্র লাভ কর।
কুন্তী তখন দুর্বাসার বরের বত্তান্ত পাণ্ডকে জানিয়ে বললেন, মহারাজ, তুমি অনুমতি দিলে আমি কোনও দেবতা বা ব্ৰাহ্মণকে মন্ত্রবলে আহবান করতে পারি। দেবতার কাছে সদ্য পুত্রলাভ হবে, ব্রাহ্মণের কাছে বিলম্ব হবে। পাণ্ডু বললেন, আমি ধন্য হয়েছি,’ অনুগৃহীত হয়েছি, তুমিই আমাদের বংশের রক্ষী ।-দেবগণের মধ্যে ধর্মই সর্বাপেক্ষা পণ্যবান, আজই তুমি তাঁকে আহবান কর।
গান্ধারী যখন এক বত্সর গর্ভধারণ করেছিলেন সেই সময়ে কুন্তী মন্ত্রবলে ধর্মকে আহবান করলেন। শতশগ পর্বতের উপর ধর্মের সহিত সংগমের ফলে কুন্তী পুত্রবতী হলেন। প্রসবকালে দৈববাণী হ’ল—এই বালক ধার্মিকগণের শ্রেষ্ঠ, বিক্ৰান্ত, সত্যবাদী ও পৃথিবীপতি হবে, এবং যুধিষ্ঠির নামে খ্যাত হবে।
তার পর পাণ্ডুর ইচ্ছাক্রমে বায়ু ও ইন্দ্রকে আহ্বান করে কুন্তী ভীম ও অর্জন নামে আরও দুই পুত্র লাভ করলেন। একদিন মাদ্রী পাণ্ডুকে বললেন, মহারাজ, কুন্তী আমার সপত্নী, তাঁকে আমি কিছু বলতে সাহস করি না, কিন্তু তুমি বললে তিনি আমাকেও পুত্রবতী করতে পারেন। পাণ্ডু অনুরােধ করলে কুন্তী সম্মত হলেন এবং তাঁর উপদেশে মাদ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে স্মরণ করে নকুল ও সহদেব নামে যমজ পুত্র লাভ করলেন। মাদ্রীর আরও পুত্রের জন্য পাণ্ডু অনুরােধ করলে কুন্তী বললেন, আমি মাদ্রীকে বলেছিলাম—কোনও এক দেবতাকে স্মরণ কর, কিন্তু সে যুগল দেবতাকে আহবান করে আমাকে প্রতারিত করেছে। মহারাজ, আমাকে আর অনুরােধ করাে না।।
দেবতার প্রসাদে লন্ধ পাণ্ডুর এই পঞ্চ পুত্র কালক্রমে চন্দ্রের ন্যায় প্রিয়দর্শন, সিংহের ন্যায় বলশালী এবং দেবতার ন্যায় তৈজস্বী হল। একদিন রমণীয় বসন্তকালে পাণ্ডু নির্জনে মাদ্রীকে দেখে সংযম হারালেন এবং পত্নীর নিষেধ অগ্রাহ্য করে ‘তাঁকে সবলে গ্রহণ করলেন। শাপের ফলে সংগমকালেই পাণ্ডুর প্রাণবিয়ােগ হল। মাদ্রীর আর্তনাদ শুনে কুন্তী সেখানে এলেন এবং বিলাপ করে বললেন, আমি রাজীকে সর্বদা সাবধানে রক্ষা করতাম, তুমি এই বিজন স্থানে কেন তাঁকে লােভিত করলে? ……….
ইন্দ্রলােকাভিগমনপবধ্যিায়।
৯১। ইন্দ্রলোকে অর্জন – উর্বশীর অভিসার
……..অর্জুন অমরাবতীতে এলে দেব গন্ধর্ব সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ হৃষ্ট হয়ে তাঁর সংবর্ধনা করলেন। তিনি নতমস্তকে প্রণাম করলে ইন্দ্র তাঁকে কোলে নিয়ে নিজের সিংহাসনে বসালেন। তুম্বুরু প্রভৃতি গন্ধর্বগণ গাইতে লাগলেন, ঘৃতাচী মেনকা রম্ভা উর্বশী প্রভৃতি হাবভাবময়ী মনােহারিণী অপ্সরারা নাচতে লাগলেন। তার পর দেবগণ পাদ্য অর্ঘ্য ও আচমনীয় দিয়ে অর্জনকে ইন্দ্রের ভবনে নিয়ে গেলেন।
ইন্দ্রের নিকট নানাবিধ অস্ত্র শিক্ষা করে অর্জন অমরাবতীতে পাঁচ বৎসর সুখে বাস করলেন। তিনি ইন্দ্রের আদেশে গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে নৃত্য-গীতবাদ্যও শিখলেন। একদিন চিত্রসেন উর্বশীর কাছে গিয়ে বললেন, কল্যাণী, দেবরাজের আদেশে তােমাকে জানাচ্ছি যে অর্জুন তােমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন, তিনি আজ তােমার চরণে আশ্রয় নেবেন। উর্বশী নিজেকে সম্মানিত জ্ঞান করে স্মিতমুখে বললেন, আমিও তাঁর প্রতি অনুরক্ত। সখা, তুমি যাও, আমি অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হব।
উর্বশী স্নান করে মনােহর অলংকার ও গধমাল্য ধারণ করলেন এবং সন্ধ্যাকালে চন্দ্রোদয় হ’লে অর্জনের ভবনে যাত্রা করলেন। তাঁর কোমল কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশপাশ পুষ্পমালায় ভূষিত, মুখচন্দ্র যেন গগনের চন্দ্রকে আহ্বান করছে, চন্দনচর্চিত হারশােভিত স্তনদ্বয় তাঁর পদক্ষেপে লম্ফিত হচ্ছে। অল্প মদ্যপান, কামাবেশ ও বিলাসবিভ্রমের জন্য তিনি অতিশয় দর্শনীয় হলেন। বারপালের মুখে উর্বশীর আগমনসংবাদ পেয়ে অর্জুন শঙ্কিতমনে এগিয়ে এলেন এবং লজ্জায় চক্ষু আবৃত করে সসম্মানে বললেন, দেবী, নতমস্তকে অভিবাদন করছি, বলুন কি করতে হবে, আমি আপনার ভৃত্য। অর্জুনের কথা শুনে উর্বশীর যেন চৈতন্যলােপ হল। তিনি বললেন, নরশ্রেষ্ঠ, চিত্রসেন আমাকে যা বলেছেন শােন। তােমার আগমনের জন্য ইন্দ্র যে নন্দোৎসবের অনুষ্ঠান করেছিলেন তাতে দেবতা মহর্ষি রাজর্ষি প্রভৃতির সমক্ষে গন্ধবগণ বীণা বাজিয়েছিলেন, শ্রেষ্ঠ অপ্সরারা নৃত্য করেছিলেন। পার্থ, সেই সময়ে তুমি নাকি অনিমেষনয়নে শুধু আমাকেই দেখেছিলে। সভা ভঙ্গের পর তােমার পিতা ইন্দ্র চিত্ররথকে দিয়ে আমাকে আদেশ জানালেন, আমি যেন তােমার সঙ্গে মিলিত হই। এই কারণেই আমি তােমার সেবা করতে এসেছি। তুমি আমার চিরাভিলষিত, তােমার গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে আমি অনঙ্গের বশবর্তিনী হয়েছি।
লজ্জায় কান ঢেকে অর্জুন বললেন, ভাগ্যবতী, আপনার কথা আমার শ্রবণযােগ্য নয়, কুন্তী ও শচীর ন্যায় আপনি আমার গুরুপত্নীতুল্য। আপনি পরবংশের জননী , গুরুর অপেক্ষাও গুরুতর, সেজন্যই উৎকল্পনয়নে আপনাকে দেখেছিলাম। উর্বশী বললেন, দেবরাজপুত্র, আমাকে গুরুস্থানীয় মনে করা অনুচিত, অপ্সরারা নিয়মাধীন নয়। পুরুবংশের পুত্র বা পৌত্র যেকেউ স্বর্গে এলে আমাদের সঙ্গে সহবাস করেন। তুমি আমার বাঞ্ছা পূর্ণ কর। অর্জন বললেন, বরবৰ্ণিনী, আমি আপনার চরণে মস্তক রাখছি, আপনি আমার মাতৃবৎ পুজনীয়া, আমি আপনার পুত্রবং রক্ষণীয়। উর্বশী ক্রোধে অভিভূত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভ্রূকুটি করে বললেন, পার্থ, আমি তােমার পিতার অনুজ্ঞায় স্বয়ং তােমার গৃহে কামার্তা হয়ে এসেছি তথাপি তুমি আমাকে আদর করলে না; তুমি সম্মানহীন নপুংসক নর্তক হবে স্ত্রীদের মধ্যে বিচরণ করবে। এই বলে ঊর্বশী বলে চলে গেলেন।………
অনুশাসনপর্ব
২। সুদর্শন-ওঘবতীর অতিথিসৎকার
……….সুদর্শন পত্নীর সঙ্গে কুরুক্ষেত্রে বাস করতে লাগলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে গৃহস্বাশ্রমে থেকেই মত্যুকে জয় করবেন। তিনি ওঘবতীকে বললেন, তুমি অতিধিকে সর্বপ্রকারে তুষ্ট রাখবে, এমন কি প্রয়োজন হ’লে নির্বিচারে নিজেকেও দান করবে। আমি গৃহে থাকি বা না থাকি তুমি কখনও অতিথিসেবায় অবহেলা করবে না। কল্যাণী, অতিথি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কেউ নেই। ওঘবতী তাঁর মস্তকে অঞ্জলি রেখে বললেন, তােমার আদেশ অবশ্যই পালন করব।
একদিন সুদর্শন কাঠ সংগ্রহ করতে গেলে স্বয়ং ধর্ম ব্রাহ্মণের বেশে ওঘবতীর কাছে এসে বললেন, আমি তােমার অতিথি, যদি গার্হস্থ্যধর্মে তােমার আশা থাকে তবে আমার সৎকার কর। ওঘবতী আসন ও পাদ্য দিয়ে বললেন, বিপ্র, আপনার কি প্রয়ােজন? ব্রাহ্মণরুপী ধর্ম বললেন, তােমাকেই আমার প্রয়োজন। ওঘবতী অন্যান্য অভীষ্ট বস্তুর প্রলােভন দেখালেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ তাতে সম্মত হলেন না। তখন তিনি পতির আজ্ঞা স্মরণ করে সলজ্জভাবে বললেন, তাই হোক, এবং ব্রাহ্মণের সঙ্গে সহবাসে অন্য গৃহে গেলেন।
সুদর্শন ফিরে এসে পত্নীকে দেখতে না পেয়ে বার বার ডাকতে লাগলেন। ওঘবতী তখন ব্ৰাহুণের বাহুপাশে বদ্ধ ছিলেন এবং নিজেকে উচ্ছিষ্ট মনে করে পতির আহ্বানের উত্তর দিলেন না। সুদৰ্শন আবার বললেন, আমার সাধনী পতিব্রতা সযরলা পত্নী কোথায় গেল, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার কিছুই নেই। তখন কুটীরের ভিতর থেকে ব্রাহ্মণ বললেন, অগ্নিপুত্র সুদর্শন, আমি অতিথি ব্রাহ্মণ তােমার গৃহে এসেছি, তােমার ভার্যা আমার প্রার্থনা পূরণ করছেন; তােমার যা উচিত মনে হয় কর।
সুদর্শনের পশ্চাতে লৌহমুদগধারী মত্যু অদৃশ্যভাবে অপেক্ষা করছিলেন; তিনি স্থির করেছিলেন, সুদর্শন যদি অতিথিসৎকারব্রত পালন না করেন তবে তাকে বধ করবেন। অতিথির কথা শুনে সুদৰ্শন বিস্মিত হলেন, এবং ঈর্ষা ও ক্রোধ ত্যাগ করে বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আপনার সুরত সম্পন্ন হক, আমার প্রাণ পত্নী এবং আর যা কিছু আছে সবই আমি অতিথিকে দান করতে পারি। ……..তখন সেই অতিধি ব্রাহ্মণ কুটীর থেকে বেরিয়ে এসে ত্রিলােক অনাদিত করে বললেন, আমি ধর্ম, তােমাকে পরীক্ষা করবার জন্য এসেছি। …………