পবনদেব ও অঞ্জনা – (রামায়নী প্রেমকথা) – সুধাংশরঞ্জন ঘোষ

›› পৌরাণিক কাহিনী  ›› সম্পুর্ণ গল্প  

সুমেরু পর্বতের সুরম্য ক্রীড়াপ্রাসাদ হতে প্রতিদিন অপরাহ্রে বেরিয়ে সরােবরে স্নান করতে যান যখন অঞ্জনা, তখন তার ক্ষিপ্রচরণের দোলনে মন্দার ফুল খসে পড়ে তার সুচারু কবরীস্তবক হতে। তখন কোথা হতে উতল বাতাস এসে তার কলহংসচিত্রিত সুগন্ধ বসনাঞ্চলখানিকে দুলিয়ে দেয়। কাঁচুলিপিষ্ট অথচ উদ্ধত ও দোলায়িত পীবরস্তনের উপর শশাভিত মুক্তাজালটি আলােড়িত হতে থাকে প্রবলভাবে।

সুমেরু পর্বতের নিতম্বদেশে সেই দীঘল সরােবরের সােপানগুলি সবুজ মরকত শিলা দিয়ে বাঁধানাে। সােনার পদ্ম ফুটে থাকে তার কাজল কালাে জলে। আর সেই পদ্মের মৃণালগুলি সুনীল বৈদূর্যমণির দ্বারা নির্মিত।

জলে নেমে প্রথমে অঙ্গরাগ ধৌত করেন অঞ্জনা। তারপর নীলমণিময় মৃণালের উপর বিকশিত স্বর্ণপদ্ম নিয়ে আপনার মনে খেলা করেন কিছুক্ষণ। তারপর স্নানশেষে শূন্য স্বর্ণকলসখানি পূর্ণ করে নিয়ে সিক্ত বসনে তার উচ্ছলিত যৌবনসৌন্দর্যকে প্রস্ফুটিত করে মদমন্থরগতিতে প্রাসাদ অভিমুখে এগিয়ে যান যখন অঞ্জনা, তখন কেমন যেন সহসা চঞ্চল ও উন্মত্ত হয়ে ওঠে চারিদিকের উদাস বাতাস। আর সেই বাতাসের স্পর্শে এক শিরশিরে কাপন জাগে অঞ্জনার সারা দেহে।

এদিকে তার ফিরে আসার মুহূর্তটির জন্য পরম আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকেন রাজা কেশরী। তার এই নাস্তিক দেহসৌন্দর্যকে উপভােগ করবার জন্য অধীর হয়ে ওঠেন তিনি। অঞ্জনার এই ক্ষণকালের অনুপস্থিতিটুকুও তার পক্ষে অসহ্য।

অঞ্জনা কিছুক্ষণ না থাকলে এক অপূরণীয় শূন্যতায় কেমন যেন হাহাকার করতে থাকে অজস্র মণিমুক্তাখচিত প্রাসাদের কুট্টিমগুলি। সমস্ত ঐশ্বর্য হয়ে ওঠে অর্থহীন। মাঝে মাঝে তাই অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে অনুযােগ করেন রাজা কেশরী, একদিনও কি না গেলে চলে না? হাসিমুখে উত্তর দেন অঞ্জনা, না, একদিনও না।

সত্যিই। একদিনও না গিয়ে থাকতে পারেন না অঞ্জনা। অপরাহের ক্লান্ত সূর্যরশ্মিগুলি স্নিগ্ধরঙীন হয়ে ওঠে যখন একে একে, ধীরে ধীরে ক্রীড়াপ্রাসাদের দীর্ঘ ছায়া ঘন হয়ে ওঠে চারিদিকের পর্বতের উপলখণ্ডের উপর, ঠিক তখনি মনটা কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠে অঞ্জনার। কিছুতেই আর মনকে নিবদ্ধ রাখতে পারেন না সেই মণিমুক্তাখচিত প্রাসাদের মধ্যে ধাতব পিঞ্জরের।

রাজা কেশরী এক একদিন বলেন, তােমার এতদূরে যাবার প্রয়ােজন কি অঞ্জনা! আমি প্রাসাদের সীমানার মধ্যে এর থেকে আরও ভালাে একটি সরােবর নির্মাণ করব তােমার জন্য।

অঞ্জনা আপত্তি করে বলেন, না মহারাজ, দিনরাত এই প্রাসাদের মধ্যে থাকতে ভালাে লাগে না। প্রস্তরনির্মিত ও অজস্র মণিমুক্তাখচিত এই প্রাসাদের কৃত্রিম ঐশ্বর্যের মধ্যে আমার দেহমনের স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে ফেলি হারিয়ে। মাঝে মাঝে কেমন যেন ক্ষুদ্র ও ম্লান বলে মনে হয় নিজেকে।

কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন কেশরী। কিন্তু তাকে তা বলবার সুযােগ দিলেন না অঞ্জনা।

অঞ্জনা বলে চললেন, তাই মাঝে মাঝে এই জনবহুল প্রাসাদ হতে দূরে গিয়ে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে নিজের দেহমনকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছা হয় মহারাজ। সেখানে গিয়ে মনে হয়, সমুদ্রমেখলা, অরণ্যকুন্তলা ও পর্বতস্তনিত বিরাট পৃথিবীর আমি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমিও বড়। আমি তখন বাতাসের সঙ্গে কথা বলি, জলের সঙ্গে খেলা করি, আলাের সঙ্গে হাসাহাসি করি। পাহাড়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলি।

কেশরী তখন বললেন, একান্তই যাবে যদি তাহলে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাও। আমিও তােমার সঙ্গে সঙ্গে অদ্য বিহার করব সরােবরের জলে।

তাতেও কিন্তু ঘাের আপত্তি অঞ্জনার। তিনি বললেন, আপনি তাে আমার সঙ্গে সর্বক্ষণই বিহার করছেন মহারাজ। আপনার অবিরাম সাহচর্যে আমি ধন্য। আমাদের দুজনের এই অবাধমধুর মিলন আমাদের প্রেমকে দিনে দিনে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তবু মাঝে মাঝে এই ক্ষণকালীন বিরহটুকুরও প্রয়ােজন আছে মহারাজ। আশ্চর্য হয়ে একবার অঞ্জনার মুখপানে চাইলেন রাজা কেশরী।

অঞ্জনা তার অর্থ বুঝতে পেরে বললেন, ক্ষণকালীন হলেও এই বিরহের মধ্যে পরস্পরের অভাবকে অনুভব করব আমরা। আর সেই অভাবের মধ্য দিয়ে জীবনে আমরা উপলব্ধি করতে পারব পরস্পরের এক প্রণয়মধুর গুরুত্ব। কেশরী বললেন, যুক্তিতে তােমার সঙ্গে আমি পেরে উঠব না কুঞ্জরতনয়া। তবু আমার ভয় হয়। তাই বলি তােমার কোনাে বিশ্বস্ত সহচরীকে সঙ্গে নিয়ে যাও।

অঞ্জনা বললেন, ভুলে যাবেন না মহারাজ, মহাবীর বানররাজ কুঞ্জর আমার পিতা। আপনি আমার স্বামী। বিপদ হতে কেমন করে আত্মরক্ষা করতে হয় বীর নারীদের তা জানা উচিত। তাছাড়া এখানে বিপদের সম্ভাবনাই বা কোথায়! কার সাধ্য মহারাজ কেশরীর এই সুরক্ষিত রাজ্যে প্রবেশ করে তার স্ত্রীর কেশাগ্র স্পর্শ করে? এ ভয় আপনার অমূলক মহারাজ।

হয়তাে তাই। মহারাজ কেশরীও তাই ভাবলেন। তাই চুপ করে গেলেন।

এমনি করে দিনে পর দিন তর্কে হেরে গিয়েছেন কেশরী। এমনি করে প্রতিদিন রক্তিম অপরাহে তার খুশি নীল মনের ব্যাকুল একটি বাসনাকে চরিতার্থ করবার জন্য বনচ্ছায়াবিম্বিত কৃষ্ণসলিল এক সরােবরে ছুটে গিয়েছেন অপ্রতিরােধ্যা অঞ্জনা। সহসা একদিন বিপদ দেখা দিল অঞ্জনার। ঠিক বিপদ নয়। শুধু কিছুটা বিপন্ন বােধ করলেন অঞ্জনা।

সেদিন স্নান সেরে ঘাটে উঠতে যাবেন এমন সময় অঞ্জনা দেখলেন দীর্ঘদেহী এক সুন্দর পুরুষ অদূরে দাঁড়িয়ে হাসছেন। বলিষ্ঠ উন্নত দেহ। কর্ণে মকর কুন্তল, কষ্ঠে বনমালা। দীর্ঘ বিন্যস্ত কেশপাশ। হাসিমুখে এতক্ষণ হয়তাে একদৃষ্টে অবলােকন করছিলেন স্নানরতা অঞ্জনাকে।

নীল মরকত শিলাময় সােপানের উপর রক্তপদ্মতুল্য পদযুগল স্থাপন করে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন অঞ্জনা। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন সাহস সঞ্চয় করে। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে কিছুই দেখতে পেলেন না অঞ্জনা।

এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসের মধ্যে কোথায় যেন বিলীন হয়ে গেল অশরীরী সেই পুরুষ। ঠিক মনে হলাে, কোনাে মানুষ নয়। কোনাে এক চঞ্চল চতুর মানুষের ছলচপল একটি ছায়া যেন অঞ্জনার চোখের সঙ্গে একবার প্রতারণা খেলে মিলিয়ে গেল মুহূর্তে। | কথাটা কিন্তু কেশরীকে বললেন না অঞ্জনা। তবু এক গােপন শঙ্কার অভিঘাতে বিকম্পিত হতে লাগল তার প্রতিটি বক্ষঃপিঞ্জর।

পরদিন আবার যথাসময়ে অঙ্গরাগ করে স্নানে বার হলেন অঞ্জনা। ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগলেন চারিদিকে। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেলেন না।

জলে নেমে অঙ্গরাগ ধৌত করলেন অঞ্জনা। তারপর যত শীঘ্র সম্ভব স্নানটা সেরে নিলেন। আজ আর স্বর্ণপদ্ম নিয়ে খেলা করলেন না একটি বারের জন্যও। সুন্দর সুবর্তুল মৃণালবাহু দ্বারা জলরাশিকে আঘাত করে ঢেউ জাগালেন না সরােবরের বুকে।

স্নানান্তে সেই মরকত শিলানির্মিত সােপানে আরােহণ করে সিক্ত বসনখানি গায়ে জড়িয়ে নিজের উদ্ধত উচ্ছলিত যৌবনকে আবদ্ধ করবার চেষ্টা করতে লাগলেন অঞ্জনা। তারপর শঙ্কিত বনহরিণীর মতাে চকিত নয়নে চারিদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখতে লাগলেন।

সহসা এক উচ্চ অট্টহাসিতে চমকে উঠলেন অঞ্জনা। মুহূর্তে তার স্বর্ণকলসখানি পড়ে গেল তার শিথিল কটিতট হতে। কিন্তু আজ আর কোনাে ছায়া নয়। ভীতিবিহুল অঞ্জনা।

আজ স্পষ্ট দেখলেন, তার সামনে অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেই দীর্ঘদেহী পুরুষ। যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সুন্দর সুঠাম তার দেহভঙ্গিগমা। গতকাল যেমনটি দেখেছিলেন ঠিক তেমনটি। শক্তির সঙ্গে সৌন্দর্যের এমন অপূর্ব সমন্বয় আর কোনাে মানবদেহের মধ্যে কখনাে দেখেননি অঞ্জনা। প্রদীপ্ত জ্যোতির সঙ্গে মধুর হাসির এমন মিশ্রণ আর কখনাে দেখেননি কারাে মুখমণ্ডলের উপর।

শত সুন্দর হলেও সে মূর্তি বড় ভীষণ।

দৃঢ়কাম কোনাে কিরাতের অব্যর্থ শরসম্মুখে কম্প্ৰবক্ষ কোনাে মৃগললনার মতাে এক অব্যক্ত অপরিসীম ভয়ে রােমাঞ্চিত হয়ে উঠল অঞ্জনার সারা শরীর।

তবু জোর করে বুকে সাহস এনে সােজা হয়ে দাঁড়িয়ে অঞ্জনা জিজ্ঞাসা করলেন, কে আপনি? কেন আপনি হীন কামাচারী লম্পটের মতাে পরনারীর প্রতি এমনভাবে লালসাসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে?

মূর্তিটি কাছে এগিয়ে এসে হাসিমুখে উত্তর করল, আমি পবনদেব। তারপর অঞ্জনাকে আর কোনাে কিছু বলবার অবকাশ না দিয়েই পবনদেব নিবিড় নিষ্ঠুর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন অলসগাত্রী অঞ্জনাকে।

অঞ্জনা প্রাণপণ শক্তিতে কোনােরকমে নিজেকে মুক্ত করে পরিক্লান্ত হয়ে উঠলেন। ঘৃণা ও ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে বললেন, ছিঃ আপনি এত নীচ! পরস্ত্রীকে একা পেয়ে এমন অবৈধভাবে আলিঙ্গন করতে এতটুকু কুণ্ঠা বা লজ্জাবােধ করছেন না? নিজেকে আবার স্বর্গের দেবতা রূপে পরিচয় দিচ্ছেন আপনি!

তেমনি হাসিমুখে পবনদেব বললেন, যে-কোনাে কটুভাষায় ভূষিত করতে পার আমায় সুন্দরি। কিন্তু বিশ্বাস করাে, তােমার প্রতি এক দুর্দমনীয় প্রীতি সঞ্জাত হয়েছে আমার অন্তরে। অবৈধ হলেও এ প্রীতি আমার জৈব অস্তিত্বের গভীরতম প্রদেশ হতে উথিত, হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ অনুরাগে অনুরঞ্জিত।

আর শােনবার ধৈর্য হয় না অঞ্জনার। ভয়ঙ্কর ক্রোধে কাপতে কাপতে জিজ্ঞাসা করেন, কি চান আপনি?

শান্তকণ্ঠে উত্তর করলেন পবনদেব, আমি তােমার অনুমতি না নিয়েই মনে মনে তোেমাতে সঙ্গত হয়ে মনমৈথুন করেছি তােমার সঙ্গে দিনের পর দিন। তােমার এই অপরূপ দেহসৌন্দর্য দেখে আমার কামপ্রবৃত্তি এমনি প্রবল হয়ে উঠেছিল যে অধর্ম জেনেও আমি তা প্রতিনিবৃত্ত করতে পারিনি। আজ তাই দেহ দিয়ে তােমার দেহকে ভােগ করে সে বাসনাকে সার্থক করতে চাই আমি।

ক্রোধের আতিশয্যে কণ্ঠ রােধ হয়ে আসছিল অঞ্জনার। তবু কোনােরকমে বললেন, আপনার রুচিকে ধিক। দেবতা হলেও মানুষ হতে আপনি অনেক ইতর। আপনার কি কোনাে ধর্মপত্নী নেই? আপনার এই হীন কামপ্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করবার জন্য আপনি কি স্বর্গে কোনাে অপ্সরা বা মর্ত্যে কোনাে বারবনিতাকে খুঁজে পাননি?

পবনদেব হাসলেন। ঈষদ্বিকশিত হাসিটা এবার ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখমণ্ডলে। আপনি এসেছেন আমার মতাে পতিগতপ্রাণ একজন সতীনারীর কাছে এই হীন বাসনা নিয়ে? মনে রাখবেন আমি সুমেরু দেশের রাজা কেশরীর স্ত্রী। আমি স্বামীর প্রতি অনুরক্ত। আমি প্রাণ গেলেও দেহ দান করতে পারব না অন্য পুরুষকে, মানব, দানব, দেবতা বা গন্ধর্ব যেই হােক না কেন সে পুরুষ। রাগতভাবে চলে যাচ্ছিলেন অঞ্জনা। কিন্তু পবনদেব ডাকলেন।

ডেকে বললেন, আমি পবন সর্বত্রসঞ্চারী। অবাধ আমার গতি। অগ্নি ও জলকে সকলে আবদ্ধ করতে পারে বা তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু আমাকে কেউ তা পারে না। স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ত্রিভুবনের সকল জীবকে আমি ইচ্ছামত স্পর্শ করতে পারি। কিন্তু আসল কথাটা শােনবার জন্য অধৈর্য হয়ে উঠলেন অঞ্জনা।

পবনদেব বললেন, আমার গতিপথে আমি বহু মানবী দানবী, সুরকন্যা ও গন্ধর্বকন্যা দেখেছি ; কিন্তু তােমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেমন কামবিমােহিত হয়ে উঠেছি এমনটি আর কখনাে কাউকে দেখে হইনি। চন্দ্রবিনিন্দিত তােমার সস্মিত বদন। জ্যোৎস্নার কুন্দধবল আলােও ম্লান হয়ে যায় তােমার হাসির কাছে। তােমার মধুর বচনবিন্যাস মন্দিরক্ষিত শুকের ভাষাকেও লজ্জা দেয়! তােমার নিশ্বাসগন্ধে কমলগন্ধসুরভিত বাতাসও অবজ্ঞাত হয়।

কোনাে উত্তর না দিয়েই চলে গেলেন অঞ্জনা!

এ বিষয়ে আজও কোনাে কথাই বললেন না মহারাজ কেশরীর কাছে। কিন্তু চিন্তিত হয়ে পড়লেন মনে মনে এবং সেই চিন্তার স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠলাে তার চোখে মুখে। তার এই আকস্মিক ভাবান্তরে কেশরীও বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু অঞ্জনা নিজে থেকে কিছু বলায় তিনি আর জোর করলেন না এ নিয়ে। | প্রাসাদবক্ষের মধ্যে সবচেয়ে সুরম্য যে ঘরটি, সেইটিই রতিমন্দির রূপে ব্যবহৃত হয়। সেই রতিমন্দিরে মধ্যে রত্নখচিত শয়নপর্যঙ্কের উপর চন্দ্রকান্তমণির ঝালর দেওয়া চন্দ্রাতপ খাটানাে আছে।

কিন্তু সারারাতের মধ্যে একবারও ঘুম এলাে না অঞ্জনার। সেই স্বর্ণপালঙ্কের উপর শুয়ে ছটফট করতে লাগলেন অঞ্জনা। কেবলি সেই পবনদেবের চেহারাটা ভাসতে লাগল চোখের সামনে। স্বামীর বাহুবন্ধনে বার বার আবদ্ধ হয়েও মনকে আবদ্ধ করতে পারলেন না অঞ্জনা। | শুধু বিস্মিত নয়, বেশ কিছুটা রুষ্ট হলেন রাজা কেশরী। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন আস্তে আস্তে। | ঘটনাটাকে এতক্ষণে একটা বিপদ বলে মনে হলাে অঞ্জনার—যে বিপদ দেহটাকে কোনােভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করেও ভেঙে চুরে একেবারে বিপর্যস্ত করে দিয়ে যায় মনের স্বাভাবিক ভিত্তিটাকে। যে বিপদের কথাকে বাইরে কারাে কাছে প্রকাশ করে বলা যায় না। যার জ্বলন্ত বেদনাকে মনের মধ্যে নিজের হাতে চেপে রেখে জ্বলে পুড়ে মরতে হয় নিজে নিজে।

পরদিন সকাল হতেই অঞ্জনা ভাবলেন, আজ আর বিকালে স্নান করতে যাবেন না সেই সরােবরে। শুধু আজ নয় আর কোনােদিনই যাবেন না।

প্রতিদিন কোথাও যেতে যেতে সহসা যদি যাওয়া বন্ধ করতে হয় তাহলে তার কারণটাও খুলে বলতে হবে রাজা কেশরীর কাছে। কিন্তু তার জন্য লজ্জার যে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা, পরাজয়ের যে তিক্ত গ্লানি আর অপমানের যে তীব্র বেদনা সহ্য করতে হবে তার কথা ভেবে শিউরে উঠলেন অঞ্জনা।

তাছাড়া পবনদেবকে যতখানি ভয় করছে ততখানি ভয়ের কিছু নেই। এই ভেবেও কিছুটা আশ্বস্ত হলেন অঞ্জনা। তিনি নিজে ঠিক থাকলেই হলাে। তিনি যদি সম্মত না হন, তাহলে তাহলে তার উপর নিশ্চয়ই বলপ্রয়োগ করবেন না পবনদেব। মুখে যাই বলুন পরস্ত্রীকে জোর করে ধর্ষণ করতে পারেন না কিছুতেই। এতখানি কখনাে নীচ হতে পারেন না তিনি দেবতা হয়ে।

এমনি করে দিনকতক একটু শক্ত হয়ে থাকলেই পবনদেব আর কোনদিন জ্বালাতন করতে আসবেন না তাকে। তার কাছ থেকে কোনাে উৎসাহ না পেয়ে ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসবে তার অত্যুগ্র কামনার বহ্নিশিখা। সমস্ত ঘটনাটাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারবেন তিনি। এ নিয়ে আর কোনাে চিন্তাই বিঘ্নিত করতে থাকবে না তার মনের সহজ শান্তিকে।

অন্যদিনকার মতাে অপরাহু হতেই আজও স্বর্ণকলস নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন চঞ্চলবিলােচনা অঞ্জনা। ঠিক এই সময়টায় মনটা তার এমনি মদচঞ্চল হয়ে ওঠে যে, না গিয়ে ঘরে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে তার পক্ষে। সরােবরে স্নান করতে যাওয়া এক অভ্যাসজাত কর্মরূপে তার জৈবিকতার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে এখন যে, সে কাজের জন্য কোননা সিদ্ধান্তের প্রয়ােজন হয় না, এখন সে কাজ তিনি না করে থাকতে পারেন না। | বিকাল হতেই প্রাসাদপ্রকোষ্ঠের স্বর্ণমণিজালগুলি দেখে সরােবরের জলের কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয় স্নিগ্ধ সরােবরের বিপুলকৃষ্ণ জলরাশি ম্লান চোখে তার পানে চেয়ে রয়েছে। পথের দু’পাশের ফুল তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে! | প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পথে নামতেই রক্তবসনের স্বর্ণাঞ্চলটি বাতাসে একবার আন্দোলিত হয়ে উঠল অঞ্জনার। সঙ্গে সঙ্গে অমনি পবনদেবের কথা মনে পড়ল। মনে হলাে বাতাসের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে কোথায় যেন লুকিয়ে আছে সর্বত্রসঞ্চারী পবনদেব। এই বাতাসের মধ্য দিয়েই কামমত্ত চিত্তের লালসাসিক্ত দৃষ্টিতে অশরীরী স্পর্শে সকলের অলক্ষ্যে অগােচরে নির্লজ্জভাবে তিনি হয়ত উপভােগ করছেন তার এই রূপযৌবনকে।

সমস্ত দেহটা কেমন যেন অলিচুম্বিত পুষ্পলতার মতাে শিহরিত হয়ে উঠল অঞ্জনার। মন্দ মধুর বাতাসটাকে মনে হলাে বিষাক্ত। তবু সাহসে ভর করে এগিয়ে যেতে লাগলেন অঞ্জনা। কিন্তু আজ আর জলে নামতে হলাে না। সরােবরের শিলা সােপানে পা দিতেই চমকে উঠলেন অঞ্জনা। তার সামনে পথরােধ করে দাঁড়িয়ে আছেন পবনদেব। তার নীরব নিষ্করুণ চোখে মুখে এক অবৈধ উন্মত্ত আহ্বান।

অধৈর্য হয়ে অঞ্জনা বললেন, আজ আবার আপনি এসেছেন? মধুর হাসি হেসে উত্তর করলেন পবনদেব, তুমি জান না সুন্দরী, তােমাকে একবার দেখে তােমাকে ছেড়ে থাকাটা কতখানি কষ্টকর।

ক্রোধে বাকরুদ্ধ হলাে অঞ্জনার।

তেমনি হেসে পবনদেব বলল, সুন্দরি, তুমি সেই সব সুলক্ষণা ললনাদের অন্যতমা যারা অকালে ফুল ফোটাবার জন্য অশােকে বাম-পাদের আঘাত ও বকুলে মুখখাচ্ছিষ্ট মদিরা সিঞ্চন করে থাকে। এইভাবে যদি শুষ্ক তরুর নীরস হৃদয়কে রসময় করে তুলতে পার, কেন তবে আমার উষ্ণব্যাকুল হৃদয়ের অনুরাগরসপরিপূর্ণ কামনার কুসুমগুলিকে ফুটিয়ে তুলবে না?

এবারও কোনাে কথা বলার প্রবৃত্তি হলাে না অঞ্জনার।

পবনদেব বললেন, সুন্দরি তুমি দেখতে পাচ্ছ না, চন্দ্রের আকর্ষণে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে যেমন সমুদ্রের জল, বসন্ত আগমনে দিকে দিকে প্রস্ফুটিত হয় যেমন কুসুমদল, তেমনি তােমার যৌবনলাবণ্য দর্শনে আমার জীবন কোরকের মধ্যে ফুটে ওঠবার জন্য এক অত্যুষ্ণ প্রবলতায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে কতকগুলি দুরন্ত কামনার ফুল। | এই বলে অঞ্জনার দেহটাকে আলিঙ্গনের জন্য পবনদেব উদ্যত হতেই দূরে সরে গেলেন অঞ্জনা। তারপর চীৎকার করে বললেন, আমায় যতটা অসহায় ভাবছেন ততখানি অসহায় আমি নই। আমি এখান থেকে বিপদসূচক চীৎকার করলে প্রাসাদ থেকে শুনতে পাবেন রাজা কেশরী। তিনি আমায় এমনি ভালবাসেন যে আমি এই সরােবরে স্নান করতে এলে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত অস্থিরভাবে পদচারণা করতে থাকেন প্রাসাদশীর্ষে। তিনি আমার এই অবস্থা দেখতে পেলে মুহুর্তে অসংখ্য সৈন্য পাঠিয়ে দেবেন আমার রক্ষার জন্য।

অট্টহাসি হাসলেন পবনদেব। সে হাসির আঘাতে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত কেঁপে উঠল অঞ্জনার। স্বলিত হয়ে যেতে লাগল তার প্রতিটি বক্ষঃপিঞ্জর।

পবনদেব বললেন, মনে রেখাে সুন্দরি, বাতাস আমারি আদেশে প্রবাহিত হয়। আমি নিষেধ করে দিলে বাতাস তােমার কোনাে শব্দকে বহন করে নিয়ে যাবে না এ স্থান হতে প্রাসাদশীর্ষে। আমার আদেশে স্বচ্ছ বায়ুস্তর নিমেষে ঘন হয়ে অদৃশ্য করে তুলবে তােমায় রাজা কেশরীর সজাগ সতর্ক দৃষ্টি হতে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার সুন্দরি।

কিন্তু তাতেও কিছুমাত্র দমলেন না অঞ্জনা। বরং শক্ত হয়ে উঠলেন আরও। দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমি প্রাণ থাকতে আমার দেহ স্পর্শ করতে দেব না আপনাকে। আপনি বলপ্রয়ােগ করতে গেলে আমি আত্মহত্যা করব আপনার সামনে।

পবনদেব বললেন, অকারণে উত্তেজিত হচ্ছ তুমি সুন্দরি।

অঞ্জনাকে শান্ত করবার চেষ্টা করলেন পবনদেব। বললেন, আম্মা হচ্ছে অমূল্য। দেহ হতে যে আত্মা সব সময়ের জন্য বড়, সে আত্মা তােমার আমি চাইনি। আমি শুধু চেয়েছি তােমার দেহকে ক্ষণিকের জন্য একবার ভােগ করতে। অকারণে অমূল্য আত্মাকে ত্যাগ করতে পারবে, আর একটি কামনাকে তৃপ্ত করবার জন্য একবার দান করতে পারবে না তােমার ওই তুচ্ছ দেহটাকে? এমনি নিষ্ঠুরা তুমি! তাছাড়া ভুলে যেও না সুন্দরি, এজন্মটাই সব নয়। এজন্মের পূর্বে ও পরে জীবন আছে। রাজা কেশরীকে তুমি পেয়েছ শুধু এজন্মে। কিন্তু আমার সঙ্গে তােমার পরিচয় জন্ম-জন্মান্তরের। পূর্বজন্মে তুমি ছিলে স্বর্গের অপ্সরা পুঞ্জীকস্থলা। তুমি মর্ত্যজীবনের স্বাভাবিক মায়াপ্রভাবে বিস্মৃত হয়ে গিয়েছ সে কথা। | দপ্তকণ্ঠে অঞ্জনা বললেন, সেকথা আজ আমি মনে আনতে চাই না। আজ বর্তমানই আমার কাছে মহাসত্য। এ সত্য ত্যাগ করে অতীতের মাঝে ফিরে যেতে আমি পারব না পবনদেব।

আপনি চলে যান। আমি আমার স্বামীকে ভালবাসি।

 স্বামীপ্রেম হতে সন্তানকেই সকল যুগের সকল নারী বড় বলে মনে করে সুন্দরি। অঞ্জনার কথা শেষ হতে না হতেই বলে উঠলেন পবনদেব।

চমকে উঠলেন অঞ্জনা। সন্তান! আপনি জানেন না বিবাহিতা হলেও আমি নিঃসন্তানা।

পবনদেব আবার হাসলেন। হেসে বললেন, আমি তা জানি। আমার সব কথা না শুনেই অধৈর্য হয়ে উঠেছ তুমি।

পবনদেব একটু থেমে বললেন, তুমি হয়ত জান না, যে সঙ্গম আমি কামনা করছি আমাদের সেই সঙ্গমের ফলে এক মহাবলশালী পুত্র জন্মলাভ করবে তােমার গর্ভে।

কেশরীর ক্ষেত্রজ হলেও আমারি নামে বিশ্বজগতে পরিচিত হবে সে সন্তান। ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলেন অঞ্জনা।

পবনদেব আবার বললেন, সে পূত্র একদিকে যেমন হবে ধর্মপ্রাণ এবং বিবিধ গুণের আকর তেমনি দেহের দিক থেকে হবে অমিত বিক্রমশালী ও বীর্যবান।

পাথরের মতাে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অঞ্জনা। তিনি সহসা অনুভব করলেন পবনদেবের সঙ্গে বিরােধিতা করবার সমস্ত শক্তি একে একে স্তিমিত হয়ে আসছে তার।

পবনদেব বললেন, তুমি যদি মনে করাে,নরনারীর সঙ্গমের একমাত্র উদ্দেশ্য হলাে, দৈহিক সুখ বা জৈবিক তৃপ্তি তাহলে ভুল করবে সুন্দরি। দৈহিক সুখ ছাড়াও সকল সঙ্গমেরই বৃহত্তর একটা উদ্দেশ্য আছে। সে উদ্দেশ্য হলাে মহৎ কিছু সৃষ্টি। এই মহৎ সৃষ্টির জন্য আজ আমি মিলিত হতে চাই তােমার সঙ্গে।

এই বলে অঞ্জনার একখানি হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিলেন পবনদেব। প্রতিবাদের শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন অঞ্জনা।

পবনদেব বললেন, জীবনের প্রধানতম উদ্দেশ্যই হচ্ছে সৃষ্টি। সৃষ্টির মধ্যেই নির্ভর করছে জীবনের চরমতম সার্থকতা। জীবদেহের সমস্ত সুষমা তার সত্তার সমস্ত মহিমা নূতনতর রূপ পরিগ্রহ করে তার সৃষ্টির মধ্যে। ওই দেখ, বসন্তের আগমনে নবােদ্ভিন্ন যে সবকচি কিশলয়গুলি এক মসৃণ পুষ্টতা লাভ করে নধর কান্তিতে নৃত্য করছে, দুদিন পর ওরা শুকিয়ে ঝরে যাবে এবং ওদের বৃন্ত হতে নূতন পত্রোগম হবে। ওই দেখ, গাছে গাছে যে সব নয়নাভিরাম কুসুমগুচ্ছ শােভা পাচ্ছে, দুদিন পরে তারা ফলে পরিণত হবে। সার্থকতামণ্ডিত হয়ে উঠবে তাদের বর্ণগন্ধের নশ্বর ঐশ্বর্য।

তােমার এই অনবদ্য দেহসৌন্দর্য ফুলের সঙ্গে যদি স্বচ্ছন্দে উপমিত হয় তাহলে তােমার সন্তান হবে তার স্বাভাবিক ফল। মানব দেহ যদি নশ্বর ও ক্ষণস্থায়ী হয় তাহলে তার যৌবন ও সৌন্দর্য হচ্ছে আরও ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু তােমার এই ক্ষণভঙ্গুর দেহসৌন্দর্য এক অপরূপ পরিণতি ও সার্থকতা লাভ করবে তােমার সন্তানের মধ্যে। মনে রেখাে সুন্দরি, সৃষ্টির ক্ষেত্রে বৈধতা অবৈধতার কোনাে প্রশ্ন নেই। বৈধতা অবৈধতার কথাটা একান্তভাবে লৌকিক ও সামাজিক। মানুষ তার সুবিধার জন্য সৃষ্টি করেছে অসংখ্য বিধি নিষেধ। বিধাতা শুধু সৃষ্টি করেছে নিয়মের। যে নিয়মের দ্বারা সমগ্র বিশ্বসংসার নিয়ন্ত্রিত হয়, যে-কোনাে সৃষ্টিকার্য সেই নিয়মেরই অন্তর্গত।

সুন্দর ও মহৎ কোনাে কিছু সৃষ্টির উদ্দেশে যে-কোনাে মিলন বা সঙ্গমই নিয়ম সঙ্গত। মহত্তর সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বিবর্তিত হয়ে চলেছে এই মহাবিশ্ব। ক্রমপরিণতির ধাপে ধাপে চলেছে অবিরাম উধ্বগতি। যে নিয়ম এই সৃষ্টিকার্যে প্রতিকূলতার সৃষ্টি করে সে নিয়মের মধ্যে কোনাে মঙ্গল নেই। উপযুক্ত আনুকুল্যের দ্বারা এই সৃষ্টিকে সার্থক করে তােলাই হলাে সকল নিয়মের কর্তব্য।

তােমার সঙ্গে রাজা কেশরীর সম্পর্কটা বৈধ, কারণ তােমরা পরস্পরে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ। কিন্তু এই বৈধ সম্পর্ক তােমায় কী দিয়েছে? আর কতদিন তােমার দেহের মধ্যে এই অনিন্দ্যসুন্দর রূপ যৌবনকে ধরে রাখতে পারবে সুন্দরি তা ভেবে দেখেছ কি? তােমরা এতদিন মিলিত হচ্ছ পরস্পরে; কিন্তু কেন সে মিলন কোনাে মহৎ সৃষ্টির দ্বারা সমৃদ্ধ ও সার্থক করে তুলতে পারল না তােমার রূপযৌবনকে ?

অথচ দেখবে তােমার আমার মধ্যে এই ক্ষণিকের মিলন অবৈধ হলেও এক চিরন্তন সার্থকতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, এক অবিস্মরণীয় অমরতা দান করবে তােমায়।

যে বৈধতা চিরদিন বন্ধ্যা ও বিশুদ্ধ করে রাখে জীবনকে সে বৈধতায় মঙ্গল নেই। তাকে জীবনে বাধ্য হয়ে মেনে চললেও শ্রদ্ধা করা উচিত নয় কখননা।

অঞ্জনাকে ধীরে ধীরে বুকের কাছে টেনে নিলেন পবনদেব। তারপর তাকে পরিপূর্ণ ভাবে আলিঙ্গন করলেন।

সহসা দেহের প্রতিটি জীবকোষে সৃষ্টির এক উন্মাদনা অনুভব করলেন অঞ্জনা। এই সৃষ্টির জন্য এখন তিনি শুধুঠার এই তুচ্ছ নশ্বর দেহনয়, তিনি তার প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারেন। সপ্তকীমেখলা কটিতটের নীবিবন্ধের সঙ্গে সঙ্গে দেহমনের সমস্ত সতর্ক গ্রন্থিগুলাে শিথিল হয়ে আসতে লাগল অঞ্জনার।

তখনাে সন্ধ্যা হয়নি। কিন্তু শেষ অপরাহের রক্তিম আলােক রেখাগুলিকে নিঃশেষে মুছে দিয়ে কোথা হতে এক বিপুলঘন অন্ধকার নেমে এলাে সহসা। বায়ুস্তর অস্বচ্ছ ও ভারী হয়ে উঠতে লাগল ক্রমশঃ। ভীত হয়ে পবনদেবকে জড়িয়ে ধরলেন অঞ্জনা।

পবনদেব বললেন, ভয় নেই, বহিঃপ্রকৃতি সহানুভূতি প্রদর্শন করছে আমাদের প্রতি। অঞ্জনার রক্তপ্রবালােপম অধরােষ্ঠের উপর মৃদু চুম্বনের একটি রসসিক্ত রেখা অঙ্কিত করে দিয়ে পবনদেব বললেন, যেদিন বিশ্বজগতের সৃষ্টির জন্য পরমা প্রকৃতির সঙ্গে প্রথম মিলিত হন পরমপুরুষ, সেদিনও হয়ত ছিল এমনি এক মহা অন্ধকার। স্বর্গ মর্ত্য, দ্যুলােক ও ভূলােক ব্যাপ্ত করে জীবহীন জড়হীন যে বিরাট শূন্যতা বিরাজ করছিল সেদিন, তার মধ্যে বাতাস আর অন্ধকার ছাড়া আর কোনাে কিছুই ছিল না। সেদিনকার সেই শূন্যতার উপর চাপ দিয়ে মহামিলনের উপযুক্ত এক মহাসঙ্গীত রচনা করেছিল বাতাস। চারিদিকের স্তব্ধ অন্ধকার রচনা করেছিল শান্ত সমাহিত এক পরিবেশ। অঞ্জনা চারিদিকে একবার চেয়ে দেখলেন, নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। সে অন্ধকারকে বড় মধুর বলে মনে হলাে তার।

কান পেতে কী একবার শুনলেন অঞ্জনা। শুনলেন, অশ্রুত ধ্বনিতে গান করে চলছে যেন বাতাস। সে সঙ্গীত বড় মধুর ও মনােরম মনে হলাে তার।

কেবলি মনে হচ্ছিল অঞ্জনার, শান্তশীতল এক আবরণ দিয়ে তাদের এই মধুর মিলনকে চিরদিন বাইরের সমস্ত দৃশ্যমানতা হতে এমনি করে আচ্ছন্ন করে রাখুক অন্ধকার।

উদাত্ত অশ্রুত ধ্বনিতে বাতাস এমনি করে গান করে চলুক অনন্ত কাল ধরে।

গভীর আশ্লেষে পবনদেবকে আলিঙ্গন করলেন অঞ্জনা।

পবনদেব বললেন, সষ্টিকার্যে প্রধান সহায় হচ্ছে এই অন্ধকার। অন্ধকারই হচ্ছে আমাদের আদিজননী। অন্ধকারের মহাগর্ভ হতে বার হয়েই আলােকের পথে ছুটে চলে সকল সৃষ্টি। মাতৃগর্ভ তাই অন্ধকার। সৃষ্টির পূর্বে এ বিশ্বের অবস্থা ছিল নিবিড় অন্ধকারে সতত সমাচ্ছন্ন। অন্ধকার মহানিশা হচ্ছে সৃষ্টিধর্মী মিলনের প্রশস্ত সময়।

পবনদেবের বাহুবন্ধন হতে মুক্ত হয়ে সরােবরের শীকরসিক্ত সেই শীতল অন্ধকারের আবরণ থেকে আলােকোজ্জ্বল রাজপ্রাসাদে গিয়ে উপস্থিত হলেন যখন অঞ্জনা, তখন রাত্রি প্রথম প্রহর উত্তীর্ণপ্রায়। তার প্রত্যাবর্তনে এতখানি বিলম্ব কোনােদিন হয়নি। ‘

তাই আজ চঞ্চল হয়ে উঠেছে সমস্ত রাজপ্রাসাদ। সশস্ত্র সান্ত্রীরা প্রস্তুত হয়ে উঠেছে তার সন্ধানে বার হবার জন্য। বরনারীরা নৃত্যগীত ত্যাগ করেছে। অন্তঃপুরবাসিনীরা চিন্তায় আকুল হয়ে উঠেছে তার বিপদাশঙ্কায়।

একমাত্র রাজা কেশরীর মধ্যেই কোনাে চাঞ্চল্য বিকার দেখল না অঞ্জনা। অন্যদিনকার মতােই প্রাসাদশীর্ষে নির্বিকার চিত্তে পদচারণা করছিলেন রাজা কেশরী।

অঞ্জনা বুঝতে পারলেন, সুচতুর মায়াবিশারদ পবনদেব সময়ের দীর্ঘতাকে অনুভব করতে দেননি কেশরীকে। অঞ্জনার ফিরতে এতখানি বিলম্ব হয়েছে একথা কিছুতেই বুঝতে পারেননি কেশরী। | মৃদুখুশিসিক্ত ঈষদোজ্জ্বল মুখমণ্ডলে স্মিত হাসি ফুটিয়ে অঞ্জনাকে সাদরে অভ্যর্থনা করে নিলেন রাজা কেশরী।

অঞ্জনা একবার ভাবলেন, রাজা কেশরী যখন কিছুই জানেন না তখন তাকে এখন কোনাে কথা বলার প্রয়ােজন নেই। আবার পরক্ষণে ভাবলেন, স্ত্রী হিসাবে তার স্বামীর কাছে কোনাে কিছু গােপন করা উচিত নয়। তাদের পবিত্র প্রেম সম্পর্কের মধ্যে মিথ্যা বা প্রতারণার কোনাে সামান্যতম অবকাশ থাকবে না। তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন রাজা কেশরী। পত্নীপ্রাণ কেশরীকে এ কথা গােপন করে প্রতারণা করলে মহাপাপে নিমজ্জিত হবেন অঞ্জনা। তাছাড়া অঞ্জনা বুঝতে পারলেন না, তিনি দোষের এমন কি করেছেন। | কোনাে এক দেবতার ঔরসজাত মহাবলশালী ধর্মপ্রাণ ও গুণবান এক সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছেন তিনি। সে সন্তান একদিন আপন শৌর্যে ও বীর্যের গৌরবে উজ্জ্বল করে তুলবে তাদের এই বংশকে, এ তাে সৌভাগ্যের কথা, সুখের কথা।

এ সুসংবাদ তিনি আনন্দের সঙ্গে পরিবেশন করবেন রাজা কেশরীকে। শুনে নিশ্চয়ই খুশি হবেন কেশরী। উপযুক্ত পুরস্কারে ভূষিত করবেন তাকে। | রাত্রি গভীর হতে প্রাসাদশীর্ষ হতে অঞ্জনার হাত ধরে রতিমন্দিরে গিয়ে প্রবেশ করলেন রাজা কেশরী। তারপর সেই চন্দ্রকান্তমণির ঝালর দেওয়া চন্দ্রাতপের তলে স্বর্ণ পালঙ্কের উপর নিজের পাশে বসালেন অঞ্জনাকে।

অঞ্জনা কিন্তু বসলেন না। মুহূর্তে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বিস্মিত হলেন রাজা কেশরী।

শাস্তকণ্ঠে অঞ্জনা বললেন, আমি আমার গর্ভস্থ সন্তানের মঙ্গলের জন্য কিছুদিন সাত্ত্বিক আহার ও সরল জীবন যাপন করতে চাই মহারাজ।

সন্তান! বিস্ময়ের আতিশয্যে পালঙ্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রাজা কেশরী! ব্যস্ত অথচ শান্তকণ্ঠে অঞ্জনা বললেন, সেই কথাই এখন আপনাকে বলতে চাই মহারাজ। গম্ভীর মুখে অঞ্জনার পানে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে উৎকর্ণ হয়ে রইলেন রাজা কেশরী।

অঞ্জনা বললেন, আজ আমি সরােবরে গেলে পবনদেব আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আলিঙ্গন করেন। আমি রুষ্ট হয়ে প্রতিবাদ করলে তিনি ধীরে ধীরে যুক্তির দ্বারা আমায় তুষ্ট করে আমার গর্ভে এক পুত্র উৎপাদন করেন। তিনি বলেছেন এ পুত্র হবে মহাবলশালী এবং ধর্মপ্রাণ।

ক্রোধে গর্জন করে উঠলেন রাজা কেশরী, আমার বিনা অনুমতিতে কোন্ অধিকারে তুমি ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপন্ন করলে তােমার গর্ভে ?

ভীত ও স্তম্ভিত হয়ে উঠলেন অঞ্জনা। কেশরী বললেন, একমাত্র স্বামীর অনুমতি নিয়েই বিশেষ কোনাে সতী নারী পরপুরুষের দ্বারা ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপন্ন করতে পারে। কিন্তু আমার বিনা অনুমতিতে তুমি এ কাজ করেছ বলে তােমার সন্তান অবৈধ। তুমি সতীত্বধর্ম হতে বিচ্যুত হয়েছ। তুমি দ্বিচারিণী।

কিছু বলতে যাচ্ছিলেন অঞ্জনা। কিন্তু বাক্যস্ফুরণ হলাে না। অবেগে কণ্ঠ রােধ হয়ে এলাে তার।

কেশরী বললেন, অসতী নারীর স্বামীর সাহচর্য বা ধনসম্পদে কোনাে অধিকার নেই। তুমি সামান্য দাসীর মতাে কোনােরকমে এখানে রাত্রি যাপন করে প্রত্যুষে এ প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাবে। এই আমার আদেশ। এ আদেশ লঙ্ঘন করলে প্রাণদণ্ড ভােগ করতে হবে। | কষ্ঠের মধ্যে অশ্রুকে আর রুদ্ধ করে রাখতে পারলেন না অঞ্জনা। এবার কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আপনি আমার প্রতি অবিচার করছেন মহারাজ। আমি এখন অসতী হলেও স্বেচ্ছায় সতীত্ব ত্যাগ করিনি। আমি পবনদেবকে বারবার প্রতিনিবৃত্ত করবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি দেবতা অপ্রতিরােধ্য, আমি সামান্যা নারী।

তাছাড়া আপনি বিশ্বাস করুন ক্ষণিকের জন্য তাকে দেহ দান করলেও মন আমার আপনার প্রতিই অবিচলিত নিষ্ঠায় নিবদ্ধ আছে।

কেশরী কিন্তু অনমনীয়। তিনি বললেন, না না, আমি কোনাে কথা শুনতে চাই না। সেখানে আর না দাড়িয়ে গৃহান্তরে চলে গেলেন রাজা কেশরী। সেইখানে বসে বসে ভাবতে লাগলেন অঞ্জনা। ভেবে পেলেন না কি অপরাধ তিনি করেছেন। ভুল যদি তিনি করেই থাকেন, তবে ক্ষণিকের ভুলের জন্য এতদিনের প্রেমসম্পর্ক কেন এমন করে ভেঙে যাবে।

ভূমিতলে শয়ন করলেও সারারাতের মধ্যে ঘুমােতে পারলেন না অঞ্জনা। অশ্রুসিক্ত তার ফাকে ফাকে কেবলি একটা ছবি ভেসে উঠতে লাগল অস্পষ্টভাবে, স্বর্ণকমল-প্রস্ফুটিত সেই স্বচ্ছ সরােবর, শীকরসিক্ত শীতল বাতাস, তাম্রাভ পর্বতগাত্রের উপর নেমে আসা গােধূলির ধূসর নিবিড় ছায়া। অবশেষে দীর্ঘদেহী এক বলিষ্ঠ সুন্দর পুরুষ।

রাত্রিশেষে উঠে ঘর হতে বেরিয়ে অলিন্দে এসে একবার দাঁড়ালেন অঞ্জনা। দেখলেন এক ঘন নৈশকুহেলি জমাট বেঁধে রয়েছে সমস্ত পর্বতদেশে। কোথায় যাবেন কিছুই ঠিক করে উঠতে পারলেন না অঞ্জনা।

ভাের হতেই সমস্ত অলঙ্কার খুলে রেখে নিরাভরণা অঞ্জনা নীরবে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন প্রাসাদ হতে। যে প্রাসাদের প্রতিটি ধূলিকণায় একদিন তার অনাবিল হাসির আলােকরেণু ঝরে পড়ত নিয়ত, আজ তার উপর ঝরে পড়ল অজস্র অশ্রুবিন্দু। আজ তিনি অনুভব করলেন, হিমশীতল এক পাহাড়ের মতাে এক বিরাট ব্যথার চেপে বসে রয়েছে তার বুকের মধ্যে। বিগলিত বেদনার শতনদীরূপে শত দিকে প্রবাহিত হলেও নিঃশেষিত হবে সে ব্যথার পাহাড়। তার কান্না কখনাে শেষ হবে না।

ঘুরতে ঘুরতে পর্বতের সানুদেশে এক বিরাট অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করলেন অঞ্জনা। তিনি স্থির করলেন এইখানেই অরণ্য জীবন যাপন করবেন।

শাপদসঙ্কুল সেই ভয়াল অরণ্যের কুটিল অন্ধকারে প্রথমে ভীত হয়ে উঠলেন অঞ্জনা। তারপর ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলেন। নতজানু হয়ে প্রণাম করে অঞ্জনা বললেন, হে অরণ্যমাতা, আজ তুমি আমায় আশ্রয় দাও। তুমিই হচ্ছ পৃথিবীর আদিম রূপ। তােমাকে অপসারিত করে মানুষ যে নগর ও সমাজ গড়ে তুলেছে সেখান হতে আজ আমি নির্বাসিত। আজ তুমিই আমার একমাত্র আশ্রয়। হে বাতাস, তুমি আমার এই গর্ভস্থ পবনপুত্রকে রক্ষা করাে। কিছুকাল পর সেই অরণ্যের মধ্যে এক পুত্রসন্তান প্রসব করলেন অঞ্জনা।

অঞ্জনা একবার ভাবলেন, তিনি ধ্যানস্থ হয়ে পবনদেবকে স্মরণ করলেই তিনি তাকে ও তার শিশুপুত্রকে আশ্রয় দান করবেন। কিন্তু পরক্ষণেই তার ভুল ভাঙল, স্বর্গের দেবতার সঙ্গে মর্ত্যের কোনাে মানবীর চিরমিলন কখনাে সম্ভব নয়। তিনি বিপদাপন্ন হলে নিজে থেকে তাকে সাহায্য করবেন পবনদেব। 

পবনদেবের কাছ থেকে এর বেশি কিছু চাওয়া উচিত নয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন অঞ্জনা, কোনােদিন আর কিছুই চাইবেন না তার কাছে। কোনাে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে ক্ষুন্ন করবেন না তার সন্তানের মর্যাদা।

নবজাত শিশুসন্তানটিকে কোলে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অঞ্জনা।

Leave a Reply