জয়দ্রথ ও দ্রৌপদী
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
অতঃপর জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে জোর করে রথে তুলে নিয়ে
বনপথে দ্রুত ধাবমান
ক্রোধ ও বিস্ময় ভরে হীরকাক্ষী দ্রুপদতনয়া
দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, হে নৃপকুমার,
উচ্চবংশে জন্ম তবু এ কী নীচ আচরণ তব?
আমার স্বামীরা কেউ আশ্রমে এখন নেই, তবুও তোমাকে
আতিথ্য দিয়েছি আমি, প্রাতরাশ প্রস্তুত করেছি
মৃগ ও শরভ, শশ, বরাহ, মহিষ মাংস দিয়ে
কিছুই ছুঁলে না, তুমি আমাকে ছুঁয়েছ পাপ মনে
জানো না কি শাস্তি এর? চেনো না আমার স্বামীদের?
কুকুর বোঝে না বুঝি সিংহের বিক্রম!
বৃষ্টিভেজা কদম্বের মতন আপ্লুত স্বরে বলল সিন্ধুরাজ
তোমার স্বামীরা আজ রাজ্যচ্যুত, দীন ও শ্রীহীন
কী হবে তাদের কথা মনে রেখে, আমাকে ভজনা করো তুমি
তোমাকে, হে বরারোহা, দর্শন মাত্রই আমি তড়িৎ আহত!
এতকাল সুন্দরের যত বিভা গোচর করেছি
তোমার রূপের কাছে সব যেন তুচ্ছ হয়ে গেল
লাবণ্য যৌবনবতী নারীদেরও কম তো দেখিনি
তোমার তুলনা দিলে তাদের বানরী মনে হয়!
তোমার গোড়ালি উচ্চ নয়, ঊরুদ্বয় পরস্পর
স্পর্শ করে আছে
স্তন দুটি নিতম্বের প্রতিবিম্ব, নাসিকা উন্নত
নিম্ননাভি স্বভাবেরই মতন গভীর
পদতল রক্তবর্ণ, যেমন ওষ্ঠ ও করতল
কাশ্মীরী তুরগীসম সুদর্শনা, হে সুকেশী, শ্যামা
অধরে অমৃতমাখা, পীন পয়োধর যেন অয়স্কান্ত মনি
দু’চক্ষু ভরেও দেখা শেষ হয় না এ শরীরী রূপ
শরীর শরীর চায়, বক্ষে বক্ষ টানে
এ রমণীরত্ন দেখে উন্মত্ত হওয়া কি অপরাধ?
পাপ নেই, পুণ্য নেই, আজ আমি সকলই ভুলেছি
কাম জীবনেরই ধর্ম, কামানল প্রকৃতি জানায়
কামার্ত পুরুষ আর নারীর মিলন, সেও প্রকৃতির খেলা
সকল সুখের শ্রেষ্ঠ রমণ-সম্ভোগ, কেন সময় হরণ?
হে অগ্নিশিখারূপিনী, আমার অগ্নিকে দীপ্ত করো!
এই কথা শুনে কৃষ্ণা ঘৃণা ভরে দূরে সরে গিয়ে
বললেন, ওরে মূঢ়, তোর ওই স্তুতিবাক্যগুলি
শুধুই কদর্য নয়, যেন কোনও রোগীর বিকার
সবলে নারীকে যারা পেতে চায়, তারা কি পুরুষ, নাকি পশু?
কাম শরীরের নয়, মনোবাঞ্ছা, এবং সে মন দু’জনের
দুটি মন যদি মেলে, তখনই শরীর জেগে ওঠে
নারীর বাসনা, সাধ যে জানে না, জানাই যে মিলনের সার কথা
তাও যে জানে না
সারাটা জীবন তার মরুভূমি, ব্যর্থ বাঁচা, সে পুরুষ নয়
পেশি শক্তি দিয়ে যারা নারীর শরীর চায়, তারা সম্ভোগের সুখ
জীবনে জানবে না
ওরে দুরাচার, শোন, অমৃত পাবি না তুই,
দগ্ধ হবি নিজের আগুনে!
পয়োধর
-আনন্দ মোহন বিশ্বাস
পয়োধর সব সময় বিনুন্নত নাহি রয়
কখনো কখনো নত হয়।
একে সর্বদা উন্নত রাখতে যেয়ে
প্রয়োজন প্রয়োজনীয়তার গণ্ডি হারায়।
পয়োধর যখন পণ্য, উন্নত তখন ধন্য
নত তখন পরিণতির রুপ অনন্য।
পণ্য যারা বানিয়েছে তারা পতিত
ঘর তাদের জন্য আলয়।
পয়োধর তখন বিকিকিনির মাধ্যম রুপে পরিগণিতের পথ পাই।
নত এবং উন্নতের মাঝে নতই সেরা।
যে পয়োঃ ধারি ধর রুপে পয়োঃকে বক্ষবন্ধনীর মাঝে
আবদ্ধ রেখে প্রদর্শনের বস্তুতে রুপান্তর করেছে ,
সে কিন্তু জননী নয় …!
সে হল ভামিনী,বহুগামিনি,কিম্বা কামিনী
জন্ম দেয়া জননীর কাজ, তাই সে জন্মদাত্রী।
জন্ম দিয়েই শেষ নয়, সে পালনকর্ত্রী।
জানু পেতে নত হয়ে যখন স্তন্য দানে রত
সে এক অপূর্ব মাতৃরুপ, জগতের জগদ্ধাত্রী।
নত হয়ে, নম্র হয়ে বিনম্র চিত্তে পীযূষ ধারা, ফল্গুধারা পর্যবসিত
পয়োঃ সন্তানের জন্য পয় ,নারীকে করে পয়মন্ত
পয়মন্ত নারী রত্নগর্ভা রুপে জগত মাঝে সম্মান পায়।
কিন্তু-
দোষ সব কবি কালিদাসের
তিনি পয়োধরকে কুচযুগ শোভিত মুক্তা হারে বলে প্রশংসা করেছেন।
পয়োঃ যখন ধর, ধরকে ধারায় রুপান্তর পয়োধরের কাজ
ধারা অমৃত ধারা ,পীযূষধারা ফল্গু ধারা
ধারায় জগতের সৃষ্টির মূল।
ধারা স্রষ্টার ল্লা-দিনী শক্তি
ধারা উল্টালে রাধা হয়, রাধাই গুরু, প্রেমের কল্পতরু।
পয়োধর যারা ধারণ করে, তারাই মা
এই মা-কথাটি পঞ্চম “ম” সমষ্টি
মতি, মগ্ন, মনন, মহৎ, ও মহিমান্বিত
এই পাঁচ “ম”কে এক করে একটি “আ” কার দিলেই তবে “মা”।
পিতা-মাতার শ্রেষ্ঠত্তের বিচারে মা হল তিন বার সেরা।
এই জগতে ধন্য আমার মা ,
তার সাথে নেই কোন তুলনা।
এই পয়োধর রুপে পয়োধরকে বিতংশ করেছে যারা
তারাই পঞ্চম “ম” কে পদদলিত করেছে।
তাদের জন্য রসূলের বানী প্রযোজ্য
“হে প্রভু ওদের জ্ঞান দাও”।