কথা অমৃতসমান -১ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

›› পৌরাণিক কাহিনী  ›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

তিন

………ব্রহ্মচারী উতঙ্কও, এইভাবেই ছিলেন গুরুর বাড়িতে। যজ্ঞের নিমন্ত্রণ পেয়ে গুরু বেদ শিষ্যকে বললেন, বাড়িতে তুমি রইলে। যদি কোনও অসুবিধে হয় একটু দেখাে। যদি কোনও ঝামেলাও হয় সামাল দিও। বেদ চলে গেলেন। বাড়িতে থাকলেন তার যুবতী স্ত্রী এবং ব্রহ্মচারী উতঙ্ক। ইতিমধ্যে বেদের পত্নী ঋতুমতী হলেন। সেকালে স্ত্রীলােকের ঋতুরক্ষার একটা ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল। অর্থাৎ স্ত্রী ঋতুমতী হলে ঋতুস্নানের পর যে কোনও উপায়েই তার সঙ্গমের ব্যবস্থা করতেই হবে। হয়তাে সমাজে এই নিয়ম যখন চালু হয়েছিল, তখন স্ত্রীলােকের সংখ্যা ছিল অল্প এবং সন্তানের চাহিদা ছিল বেশি। তাছাড়া কামশাস্ত্রের মতে এই সময়টাতে নাকি স্ত্রীলােকের আসঙ্গলিপ্সা প্রবল হয় এবং সন্তান ধারণের পক্ষেও নাকি সময়টা যথেষ্ট উপযােগী এবং উর্বর। ফলে যেনতেন প্রকারেণ ঋতুস্নাতা স্ত্রীলােকের সঙ্গমেচ্ছা পূরণ করাটা তখন ধর্মের তাৎপর্যে গ্রহণ করা হত।

মহর্ষি বেদের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীর বান্ধবীরা এসে উতঙ্ককে জানাল, তােমার অধ্যাপকের স্ত্রী ঋতুমতী হয়েছেন। এদিকে তােমার অধ্যাপক বিদেশে। তুমি এমন ব্যবস্থা কর যাতে এঁর ঋতুকাল নিল না হয়। তাছাড়া এই কারণে তােমার অধ্যাপক-পত্নীও যথেষ্ট বিষয় হয়ে আছেন এষা বিষীদতি ইতি। একেবারে শেষ বাক্যে অধ্যাপকের স্ত্রীর যে পুরুষান্তর-সংসর্গে আপত্তি নেই সেটাও জানিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু উতঙ্ক সংসর্গকামিনী এই রমণীর ইচ্ছা একেবারে নস্যাৎ করে দিলেন।………..

…….হয়তাে দীর্ঘদিন স্বামীর অনুপস্থিতিতে বেদ-পত্নীর মন এই যুবক পুরুষটির প্রতি সরস হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই সরসতার সুযােগ উতঙ্ক নেননি। এখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে, সেকালের সমাজে যারা একটা সময়ে শুরু হয়ে বসতেন, তাদের জীবনের বহুলাংশ কেটে | যেত বিদ্যালাভে। ফলে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করতে তাদের দেরি হয়ে যেত। বিয়ে করার পক্ষে বয়স বেশি হয়ে গেলেও বিদ্যা এবং ব্রাহ্মণ্যের কারণে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে পেতেও তাদের অসুবিধে হত না। তাছাড়া বয়স বেশি হলেও ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠ ঋষি-মুনিদের সরসতা কম ছিল না। বড় ঘরের মেয়ে, রাজার ঘরের সুন্দরী মেয়েদের তারা মন দিতে ভালবাসতেন।…….

…….দেবতা বলে পরিচিত ইন্দ্ৰ গৌতম পত্নী অহল্যার রূপ-মুগ্ধ হয়ে গুরু গৌতমের সাজ নিয়েই অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন। আর রামায়ণের কবি সেখানে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, অহল্যা তার স্বামীর শিষ্যটিকে শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু তবু যে তিনি ইন্দ্রের বাহুবন্ধনে শয্যাশায়িনী হয়েছিলেন, তার কারণ নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের রমণ কেমনতর, তাই দেখবার জন্য দেবরাজ-কুতুহলাৎ। …….

পাঁচ

……..ভৃগুর সুন্দরী স্ত্রীটিকে দেখে রাক্ষসের মন বড় পুলক হল, বেশ কামাবেশও হল। লক্ষণীয় ব্যাপার হল—এই রাক্ষসের নামও পুলােমা।……যাই হােক, ভৃগুমুনি স্নান করতে গেছেন, আর এই অবসরে রাক্ষস পুলােমা ঢুকে পড়লেন তার আশ্রমে। তার বেশ-বাস বা চেহারার মধ্যে কোনও রাক্ষুসেপনা ছিল না। কেননা সুন্দরী পুলােমা তাকে দেখে ভয়ও পাননি, লজ্জাও পাননি। বরং সেকালের আতিথ্যের আদর্শে থালায় করে বেশ কিছু ফল-মূল খেতে দিয়ে ঘরে নেমন্তন্ন করলেন রাক্ষসকে……..

দশ

……ভারি আশ্চর্য, লােকের ধারণা— কালাে মেয়ে নাকি (সৌন্দর্যের) কোনও কনসেপ্টের’ মধ্যে আসে না, কিন্তু মহাভারতের কবি যেহেতু পরেও বিশেষত দ্রৌপদীর মধ্যে কালাে মেয়ের। শ্ৰেষ্ঠতা নিরূপণ করবেন, অতএব এই মােহিনী মূর্তির মধ্যেও আমরা সেই কালাে রূপের মর্যাদা দেখতে পাব। মহাভারতের কবি যেহেতু অতি সংক্ষেপে এই বর্ণনা সেরেছেন, অতএব এখানে না পেলেও আমরা ভাগবত পুরাণে খবর পেয়েছি যে, বিষ্ণুর সেই মােহিনী মায়া মূর্তি ছিল নিকষ কালাে—প্রেক্ষনীয়ােৎপলশ্যামাং সবাবয়ব-সুন্দর। নবীন বয়সী রমণীর কাঞ্চী দামে উদ্বেলিত হাঁটা চলায় তথা স্তনভারকৃশােদরী’ মােহিনীর উদ্দাম কটাক্ষে বশীভূত দৈত্য দানবদের মনে জেগে উঠল কামনার আগুন– দৈত্য-যুথপ চেতঃসু কাম উদ্দীপয়ন্ মুহুঃ। যারা এতক্ষণ, অমৃত পানের জন্য ‘অহং পূর্বং অহং পূর্বং’- আমি আগে আমি আগে করছিলেন, তাঁরা স্তব্ধ হয়ে বসে শুধু রমণীর কটাক্ষ ভিক্ষা করছিলেন।…….

সতেরাে

……চন্দ্রের তখন বিশাল ঐশ্বর্য, অগাধ প্রতিপত্তি। ত্রিভুবন তার কাছে খুবই ছােট কথা, সপ্ত | লােকের আধিপত্য তার করতলগতসপ্তলােকৈকনাথত্ব অবাপ তপসা সদা। এই রকমই এক স্বাধিকার আর সুখের সময়ে চন্দ্র তার ভবন-সংলগ্ন উদ্যানের মধ্যে পাচারে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎই সেখানে দেখতে পেলেন এক সুন্দরী রমণী। উদ্যানের ফুলের আভরণ তার গায়ে। স্তন-জঘনের সৌন্দর্যে পরম আকর্ষণীয়া। কোমল শরীর, যেন ফুল ছিড়তে গেলেও তার আঙুলে ব্যথা লাগবে—পুষ্পস্য ভঙ্গে’ প্যতিদুর্বলাঙ্গীম্।

চন্দ্রে বিলাস-উদ্যানে যে রমণীটিকে এইমাত্র দেখা গেল ইনি দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী-তারা। নিসর্গ-সৌন্দর্যের মধ্যে সৌন্দর্যের আধারভূতা এই রমণীটিকে দেখে চন্দ্র মনের আবেগ রুদ্ধ করতে পারলেন না। নির্জন উদ্যানভূমির সমতলে দাঁড়িয়ে তিনি তারাকে আলিঙ্গন করলেন। তারার গ্রন্থিবদ্ধ কেশরাশি আলুলায়িত কেশে জগ্রাহ বিবিক্তভূমৌ। বােঝ গেল, স্বয়ং দেবগুরুর পরিণীতা স্ত্রী হওয়া সত্তেতাঁরা চন্দ্রের রূপে এবং প্রতিপত্তিতে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন—ত-রূপকাত্যা হৃতমানসেনশুযে, এই বলাৎকারী রসিককে বাধা দেওয়া তাে দূরের কথা, তিনি শরীরে ও মনে খুশিলেন। অনেক দিন সেই উদ্যান-ভূমির মধ্যেই কেটে গেল রসে-রমণে। চন্দ্রের সঙ্গে তারার সাহচর্য ঘনীভূত হল।

বৃহস্পতির পত্নী বাড়ি ফেরার নামও করলেন না। উদ্যান-বিলাসের দিন শেষ হলে চন্দ্র তারাকে একেবারে নিজের বাড়িতে নিয়ে তুললেন। সুন্দরী তারার সাহচর্য-সুখ এমনই যে চন্দ্রের তৃপ্তি কখনও শান্তির পর্যায়ে আসে না-বিধুগৃহীত্ব স্বগৃহং ততাে’পি/ন তৃপ্তিরাসীচ্চ গৃহেপি তস্য।

ইন্দ্র দূতের মুখে এইটুকু জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। সুধাকর চন্দ্রের তৃপ্তির জন্য তিনি আরও | কিছু ভাবনা-চিন্তাও করেছেন। দূতমুখে ইন্দ্র জানালেন—বেশ তাে, তােমার নক্ষত্র-সুন্দরীদের যদি একান্তই ভাল না লাগে, তবে মনােহর এই স্বর্গভূমিতে সম্ভোগ-তৃপ্তির ব্যবস্থা কি কিছু কম আছে? অপ্সরা সুন্দরী মেনকা আছেন, রম্ভা আছেন, উর্বশী আছেন। তুমি ভােগ করাে। কে না করেছে? গুরুপত্নী তারাকে তুমি ছেড়ে দাও বাপু……….

আঠারাে

………স্বর্গের মতাে একটা রাজ্যে, দেবতাদের মতাে ভােগী সমাজে গুরু হয়ে বসার ফলে মেয়েদের ব্যাপারে বৃহস্পতির অভিজ্ঞতা কিছু কম ছিল না। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি তার নীতিশাস্ত্রে বিধান দিয়েছিলেন যে, কোনও রমণী যদি স্বেচ্ছায় পুরুষের সম্ভোগবাসনায় সম্মতি দেয়, তবে তাকে ভােগ করায় পুরুষের তত দোষ লাগে না। চন্দ্র বললেন—আমি তাে তাই। করছি। গুরুর পত্নী স্বয়ং আমার আসঙ্গ-লিপ্সা করছেন, আমি তার বাসনা পূরণ করছি তারই সম্মতিক্রমে।……..

……বললেন—অনুরাগিণী স্ত্রীর সঙ্গেই লােকে ঘর বাঁধে, নতুন জীবন শুরু করে। কিন্তু স্ত্রী যদি একজনকে ভালই না বাসতে পারেন, তার সঙ্গে তবে থাকবেন কী করে? তারা বৃহস্পতির ঘরে। এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু যেদিন তিনি দেখলেন যে তার স্বামী তাকে ছেড়ে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর সঙ্গে শৃঙ্গার-রমণে মত্ত হচ্ছেন, সেদিন থেকেই সুন্দরী তারা আর বৃহস্পতিকে ভালবাসেন ।……….

উনিশ

…….একটি গল্প আছে। কথিত আছে-এক সময় সনুকসন প্রমুখ ব্ৰহ্মবাদী ঋষিগণ মহাদেবের দর্শন লালসায় এই অসাধারণ বনভূমিতে প্রবেশ করেন। সেই সময় দেবদেব শঙ্কর পার্বতীর সঙ্গে ক্রীড়াসক্ত ছিলেন এবং শৈলদুহিতারকন-ভূষণও কঞ্চিৎ অসস্তৃত ছিল। এই অবস্থায় ব্ৰহ্মবাদী ঋষিদের দেখে পার্বতী বড় লজ্জা পেলেন এবং কোনও মতে বস্ত্র সম্বরণ করে দাড়িয়ে রাগে কাপতে থাকলেন—লজ্জাবি স্থিতা তত্র বেপমানাতিমানিনী।। | ব্ৰহ্মবাদী ঋষিরা ব্রহ্মানন্দে মগ্ন। তাদের মনে স্ত্রী-পুরুষের ভেদাভেদ, রমণ-মৈথুন বড় একটা ক্রিয়া করে না। দেবদেব শঙ্করের উদাসীন ক্রীড়াকৌতুক এবং পার্বতীর বিপর্যস্ত অবস্থা | দেখামাত্রই ব্রহ্মর্ষিরা স্থান ত্যাগ করে নর-নারায়ণ আশ্রমের দিকে রওনা দিয়েছেন।

আকস্মিকভাবে ইল এক সুন্দরী নারীতে পরিণত হলেন, এমনকি তার ঘােড়াটিও ঘােটকীতে পরিণত হল। স্ত্রী স্বরূপে ইল’র নাম হল ইলা।

স্ত্রীত্ব প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত শরীরে স্তন-জঘনাদির স্ত্রী লক্ষণগুলিও প্রকাশিত হল। তার গলার স্বর থেকে আরম্ভ করে গতি-স্মিত-কটাক্ষেও এল রমণীয় পরিবর্তন।………

আটত্রিশ

শর্মিষ্ঠা পুষ্পবতী হয়েছেন। সেকালের দিনে পুষ্পবতী রমণী যথার্থ সময়ে পুত্রলাভের জন্য যে কোনও পুরুষের সঙ্গে সঙ্গত হতে পারত। এই নিয়ম ছিল প্রায় ধর্মীয়। বৈদিক যুগ থেকে আরম্ভ করে মহাভারত পুরাণের যুগ পর্যন্ত ভারতীয় রমণীর কাছে বহু পুত্রের জননী হওয়াটা ছিল প্রায় আদর্শের মতাে হয়তাে স্থানান্তর থেকে আর্য পুরুষদের সঙ্গে আসা স্ত্রীলােকের সংখ্যা নগণ্য ছিল এবং হয়তাে যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে যেকোনও উপায়ে বীর পুত্র লাভ করাটা তাদের কাছে পরম ইঙ্গিত ছিল। বেদের মধ্যে আর্য-রমণীদের পুত্র-লাভের আকাঙ্ক্ষা বারবার শােনা | গেছে। রমণীর কাছে বীরসূ, বীরমাতা বীরপ্রজা হওয়াটা যেমন গর্বের ছিল, তেমনই পুত্রজন্মের অর্থই ছিল পরম কল্যাণ- য বৈ পুরুষস্য বিত্তং তদ্ ভদ্রং, গৃহা ভদ্রং প্রজা ভদ্র।

হয়তাে এই কল্যাণের মাহাত্ম থেকেই স্ত্রীলােকের দিক থেকে ঋতুকালমাত্রেই যে কোনও পুরুষের কাছে পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করাটা অস্বাভাবিক ছিল না। মহাভারত এবং পুরাণে এমন বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেখানে রমণী ঋতুর পর্যায় সফল করার জন্য পুরুষের সঙ্গ কামনা করছে। ঋতুরক্ষার তাগিদটা যেহেতু প্রায় ধর্মীয় সংস্কারের মতাে হয়ে গিয়েছিল, তাই একজন বুদ্ধিমতী রমণীর পক্ষে এই সময়টাই ছিল অভীষ্টতম পুরুষের সঙ্গে সঙ্গত হওয়ার | প্রকৃষ্টতম উপায়। উপায় না বলে তাই এটাকে কৌশল বলাই ভাল, যদিও শর্মিষ্ঠার আমরণ | দাসীত্বের নিরিখে শর্মিষ্ঠার দিক থেকে এটাকে আমরা সুযােগ নেওয়া বলব, কৌশল বলব না। | নির্জন স্থানে আপন অশােক-কুঞ্জে রাজাকে পেয়ে শর্মিষ্ঠা বললেন আমার রূপ নিয়ে আপনার কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়, রাজা! আমার আভিজাত্য এবং চরিত্রও আপনার অজানা নয়— রূপাভিজন-শীলৈ হি ত্বং রাজন বেশ্ব মাং সদা। আমার এখন ধর্মসঙ্কট উপস্থিত। আপনার কাছে আমার সানুনয় প্রার্থনা— আমি পুষ্পবতী, আপনি আমার ঋতুরক্ষা করুন।………

উনচল্লিশ

…….শর্মিষ্ঠার কথা মহারাজ যযাতির কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হল। যযাতি শর্মিষ্ঠার সঙ্গে মিলিত হলেন। মনে মনে এই মিলন তার কাম্য ছিল। হয়তাে যেদিন তিনি: শর্মিষ্ঠাকে দেখেছিলেন, সেদিন থেকেই এই মিলন তার কাম্য ছিল। দেবযানী এবং শুক্রাচার্যের সাবধানবাণীতে এতদিন যে মিলন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ছিল, আজ শর্মিষ্ঠার যুক্তিতে এবং যযাতির মনের অনুকূলতায় সেই মিলন বাঁধভাঙা নদীর মতাে আছড়ে পড়ল অশােক-বনের উপান্ত-শয্যায়। মিলন সম্পূর্ণ হলে দুজনেই পরস্পরকে সানন্দে কৃতজ্ঞতা জানালেন……..

তেতাল্লিশ

………আশ্রমবাসিনী শকুন্তলার পরনে ছিল চীরবাস, যা তার অপার যৌবনরাশির তুলনায় ছিল। নিতান্তই অপ্রতুল। তার মধ্যে আশ্রমসুলভ শম-দমের সাধনে শকুন্তলার শরীরে ছিল সেই অদ্ভুত দীপ্তি যা নাগরিকার মধ্যে মেলে না—বিভ্ৰাজমানাং বপুষা তপসা চ দমেন চ। নাগরিক রাজা মুগ্ধ হলেন আশ্রমবাসিনীকে দেখে। অথচ হাতে সময় নেই, মহর্ষি কম্ব এসে পড়বেন কখন? রাজা সােজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি কে রমণী? কার মেয়ে? এই বনে এসেছ কী করতে, এমন সুন্দর যার চেহারা, সে কোথা থেকে এসে এই বনের মধ্যে জুটলএবংরূপগুণােপেতা কুতত্ত্বমসি শােভনে? তােমাকে দেখামাত্রই আমি মুগ্ধ হয়েছি কন্য। তুমি তােমার সমস্ত কথা আমায় খুলে বল।……

………উতলা হাওয়া, বনস্থলীর পুষ্প-পরিমল এবং হঠাৎ ঝড়ে উড়ে যাওয়া বসনের বিপন্নতার | মধ্যে তপস্যা-ক্লান্ত বিশ্বামিত্র মেনকাকে দেখতে পেলেন সম্পূর্ণ অনাবৃতা| অনির্দেশ্যবহােরূপাম্ অপশ্য বিবৃতাং তদা। মেনকার অলােকসামান্য রূপ দেখে শুষ্ক-রুক্ষ্ম মুনির কঠিন হৃদয় একেবারেই গলে গেল। মহাকাব্যের কবি লিখেছেন-মেনকার রূপ-গুণ দেখে—তস্যা রূপগুণান্ দৃষ্টা, এখানে গুণ কিছু দেখেননি ঋষি। আসলে এই সমাসের ব্যাসবাক্য রূপ’ এবং গুণ’ নয়, হবে রূপের গুণ’! সেই অমর্ত্য রূপের মােহে মুগ্ধ হয়ে | বিশ্বামিত্র মিলনের আহ্বান জানালেন মেনকাকে, যে মিলন দেবরাজ ইন্দ্রের চক্রান্তে একান্ত কাঙ্ক্ষিত ছিল মেনকারও-ন্যমন্ত্ৰয়ত চাপেনাং সা চাপ্যৈচ্ছদনিন্দিতা।…….

পঞ্চান্ন

………কালাে যমুনার জলের ওপর নৌকার প্রান্তদেশে নিষগ্না কৃষ্ণবর্ণা এই রমণী চিত্রার্পিতের মতাে দিগন্তের শােভা বর্ধন করছিলেন। তার কেশরাশি মাথার ওপর চূড়া করে বাঁধা। আতা ওষ্ঠাধারের মধ্যে মুক্তাঝরানাে হাসি। রমণীর উত্তমাঙ্গের বস্ত্র পৃষ্ঠলম্বী গ্রন্থিতে দৃঢ়নিবদ্ধ। আর অধমাঙ্গের বস্ত্র কিছু খাটো। নৌকার ত্রিকোণ প্রান্তের ওপর বসে রমণী পা-দুটি নিবদ্ধ অবস্থায় | নৌকার কাষ্ঠ-স্তরের ওপর ছড়িয়ে দেবার ফলে কদলীস্তম্ভ-সদৃশ তার পা-দুটি উরু পর্যন্ত প্রায় অনাবৃত।…..

……..বাসবী’! এই শব্দের অর্থ এই রমণী বােঝে। তবে মুনি তাকে কেন বাসবী’ বলে ডাকলেন, | তার কারণ জানার জন্য মনে মনে এই রমণীর আগ্রহ জেগে রইল। তবে আপাতত মুনির মন টলিয়ে কালী তার নৌকায় শেষ যাত্রীকে তুলে নিলেন। নৌকা বাইতে আরম্ভ করলে হালের টানের সঙ্গে তার রমুণী-শরীরের বিভঙ্গও একাকী সেই যাত্রীর চোখে পড়ল। মুনি তার দিকে | নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন। কালাে মেয়ে সব বুঝে ফেলল এক লহমায়।……

……পরাশর কোনও অসভ্য ভণিতার মধ্যে যাননি। একবারও মৎস্যগন্ধার অপার রূপরাশি | বর্ণনা করে তার স্তন-জঘনের প্রত্যঙ্গশােভায় মন দেননি। তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন| বাসবী। আমি তােমার কাছে একটি পুত্র চাই, তাই তােমার সঙ্গে আমি মিলন প্রার্থনা করি।……

…..সত্যবতী মিলিত হলেন মহর্ষি পূব্রাশরের সঙ্গে এবং অলৌকিকভাবে সদ্যই গর্ভবতী হলেন। পুত্রও প্রসব করলেন সঙ্গে সঙ্গেই। জন্মালেন মহাভারতের কবি বেদব্যাস।……

বাষট্টি

……..এই সম্ভোগের ফল খুব একটা ভাল হল না। বাড়িতে যদি আশি-নব্বই বছরের বৃদ্ধ সক্ষম অবস্থায় থাকেন, তবে তাদের জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে—এই অতিরিক্ত স্ত্রীসম্ভোগের ফল কী? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও বিবাহিত দম্পতির একতর পুরুষ মানুষটির যদি ‘টিবি হত, তাহলে বয়স্ক জনেরা মনে মনে সন্দেহ করতেন যে, ওই রােগ অতিরিক্ত স্ত্রী-সম্ভোগের ফল।…….

চৌষট্টি

…….প্রশংসায় মানুষ খানিকটা দ্রবীভূত হয় এবং এই দ্রবীভবনের মধ্যে সত্যবতী নিজের ব্যক্তিত্ব আরােপ করলে কাজ হবে, এই কথা ভেবেই সত্যবতী বললেন—ভীষ্ম! আমি তােমার ওপর ভরসা করে—তস্মাৎ সুভূশমাখস্য ত্বয়ি—একটা কাজ করতে বলেছি তােমাকে। তুমি মন দিয়ে শােনাে। সত্যবতী বললেন—আমার পুত্র ছিল তােমার ভাই। তাকে তুমি যথেষ্ট ভালওবাসতে।

তা সে তাে অল্প বয়সেই মারা গেল। একটা ছেলেপিলেও রইল না যে বংশে বাতি দেবে—বাল | এব গতঃ স্বর্গম্ অপুত্রঃ পুরুষভঃ । আমি বলি কী—আমার ছেলের বউ দুটি তাে রয়েছে— ইমে মহিষ্যৌ ভ্রাতুস্তে কাশীরাজসুতে শুভে। | সত্যবতী নিজের বক্তব্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পুত্রবধূদের রমণীয়তা এবং তাদের উপাদেয়তাও বর্ণনা করেছেন। ভীষ্ম নিজে পছন্দ করে কাশীরাজের মেয়ে দুটিকে ভাইয়ের বিয়ের জন্য হরণ করে নিয়ে এসেছিলেন বলেই সর্তবতীর কথা বলবার যুক্তি হল-ওরা তাে দেখতে শুনতে খারাপ নয়। যথেষ্ট রূপবতীএবং যৌবনবতী। তাছাড়া বেচারাদের দুঃখ দেখ-স্বামীটি মারা গেল, যাক। বেচারা কাল-আলাে করা ছেলে পেল না একটিও রূপযৌবনসম্পন্নে পুত্ৰকামে চ ভারত…….

………আপনারা জানেন—সেকালে এই নিয়ম প্রচলিত ছিল। যে রমণী অপুত্রক অবস্থায় বিধবা হলেন অথবা যার স্বামী পুত্র উৎপাদনে অক্ষম, সেই রমণীকে পুত্রহীনতার অভিশাপ নিয়েই সারা জীবন কাটাতে হত না। বিধবা রমণী হলে একই বংশজ দেবরের দ্বারা পুত্রোৎপত্তি সামাজিকরা মেনে নিতেন। দেবর কিংবা স্বামীর বংশজ কেউ না থাকলে ধার্মিক ব্রাহ্মণকেও পুত্র উৎপাদন করার জন্য অনুরােধ করা হত। কিন্তু অপুত্রক রমণী নিজের ইচ্ছামতাে যাকে পছন্দ তাকে দিয়েই নিজের গর্ভাধান করাতে পারতেন না। এক্ষেত্রে বাড়ির বয়োেজ্যষ্ঠ বা হিতৈষী বৃদ্ধদের অনুমতি প্রয়ােজন হত। তার বংশরক্ষার প্রয়ােজনে উপযুক্ত ব্যক্তিকে পুত্রোৎপাদনে নিয়ােগ করতেন বলেই—এই প্রথার নাম নিয়ােগ-প্রথা। সত্যবতীর মুখেও ভীষ্মের প্রতি এই নিয়ােগের উচ্চারণ শুনতে পাই—তােমাকে আমি এই কাজে নিযুক্ত করছি -কার্যে ত্বাং বিনিযােক্ষ্যামি তদ্ভুত্ব কর্তুমহসি। অথবা সত্যবতী বলছেন—আমার আদেশে তুমি এই ধর্মকার্য সম্পন্ন করাে—মন্নিয়ােগাহাবাহাে ধর্মং কমিহাহসি।………

……..ভীষ্ম সত্যবতীর কাছে সাধারণভাবে প্রথমে জানালেন যে, কীভাবে উচ্ছিন্ন ক্ষত্রিয় বংশ ব্রাহ্মণদের দ্বারা পুনঃস্থাপিত হয়েছিল। দ্বিতীয় উদাহরণে তিনি সেই অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। দীর্ঘতমার কথা আমরা পূর্বে বলেছি। বলেছি—উতথ্য এবং বৃহস্পতির প্রসঙ্গে। বৃহস্পতি তার অগ্রজ উতথ্যের পত্নী মমতার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে গর্ভবতী অবস্থায় ধর্ষণ করেন। মমতার গর্ভস্থ সন্তান বৃহস্পতির শাপ লাভ করে অন্ধ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। | অথবা গর্ভবতী অবস্থায় ধর্ষিতা হবার কারণেই হয়তাে তিনি অন্ধ দীর্ঘতমার জননী হন। | দীর্ঘতমার নিজের জন্ম-কাহিনী যাই হােক, মহাভারত এবং অন্যান্য পুরাণগুলিতে যেমন | খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখছি তার মধ্যেও কিছু কিছু যৌন বিকার তৈরি হয়েছিল। তিনি | নিজে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ছিলেন। খােদ ঋগবেদে তার নামে কতগুলি সূক্ত আছে। কিন্তু বিদ্যাবত্তা এবং শাস্ত্রজ্ঞাম যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও তিনি এতটাই ইন্দ্রিয়পরায়ণ হয়ে পড়েছিলেন যে, তার | স্ত্রী-পুত্র তাকে ভেলায় করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেন। ভেলায় ভাসতে ভাসতেই দীর্ঘতমা এসে | পৌছন আনব বা অনুবংশীয় রাজার দেশে। এখনকার দেশস্থিতিতে এই দেশ হল মুঙ্গের-ভাগলপুর অঞ্চল। এই দেশের রাজা বলির কোনও পুত্র ছিল না। রানী সুদেষ্ণা অপুত্রক অবস্থায় দিন কাটান। রাজবংশের ধারা বজায় রাখতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন এবং এই ব্যর্থতা | বােধহয় অনেকটাই তাঁর স্বামীর কারণেই। যাই হােক বলিরাজ দীর্ঘতমার কাছে প্রার্থনা | জানালেন তার স্ত্রীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার জন্য—সন্তানার্থং মহাভাগ ভার্যাসু মম মানদ।

দীর্ঘতমা বলিরাজের অনুরােধে স্বীকৃত হলেন বটে, কিন্তু রানী সুদেষ্ণা দীর্ঘতমাকে অন্ধ এবং বৃদ্ধ দেখে রাজার অজ্ঞাতসারে তার দাসীটিকে পাঠিয়ে দিলেন মুনির কাছে। মুনি সবই বুঝলেন এবং পরে অবশ্য বলিরাজের অনুরােধে এবং তিরস্কারে সুদেষ্ণাও দীর্ঘতমার সঙ্গে মিলিত হন। দীর্ঘতমার ঔরসে সুদেষ্ণার গর্ভে যে পুত্ররা জন্মাল, তাদের নাম জড়িয়ে আছে | আমাদেরই পূর্ব ভারতের দেশগুলির সঙ্গে। এই পুত্রগুলির নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র এবং | সুহ্ম। বলিরাজের পুত্রদের নাম থেকেই না হয় আমরা আমাদের পরিচিত দেশগুলির নাম পেলাম, কিন্তু এই সম্পূর্ণ ঘটনা এবং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের যেটা লক্ষ্য করতে হবে, সেটা হল পরক্ষেত্রে উৎপাদিত দীর্ঘতমার এই প্রত্রেরা কেউ দীর্ঘতমার পিতৃত্ব নিয়ে বিখ্যাত হলেন না। বলিরাজের নামেই তারা সবাই কালেয় ক্ষত্রিয় বলেই পরিচিত হলেন।……..

পঁয়ষট্টি

……সত্যবতী আর ভণিতা করছেন না। কারণ, তখনকার দিনের সামাজিক রীতিনীতি এবং বিপন্নতায় সত্যবতী এখন কী প্রস্তাব করবেন, সে আন্দাজ ব্যাসের হয়ে গেছে বলেই সত্যবতী  এবার ঝটিতি তার বক্তব্য জানালেন। বললেন—তােমার ছােট ভাইয়ের দুটি স্ত্রীই দেবরমণীদের মতাে সুন্দরী। তাদের রূপ-যৌবন যথেষ্ট এবং তারা ধর্মানুসারে পুত্রকামনা করে—রূপযৌবন | সম্পন্নে পুত্ৰকামে চ ধর্মতঃ। ব্যাসের সামনে পুত্রবধূদের রূপযৌবনের কথা উচ্চারণ করে সত্যবতী বােঝাতে চাইলেন—বিচিত্রবীর্য মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে এই দুই যুবতী বধুর সমস্ত কিছু ব্যর্থ হয়ে গেছে, এমনকি কোল-আলাে করা দুটি সন্তানও নেই, যাদের দিকে তাকিয়ে এরা জীবন কাটাবে।

অতএব সত্যবতীর প্রস্তাব—আমার এই দুই পুত্রবধুর গর্ভে তুমি পুত্র উৎপাদন করাে।…….

……..অম্বিকা শাশুড়ির মুখে বংশের প্রয়ােজন এবং তার ধর্ম-সম্মত ব্যাখ্যা শুনে কোনওমতে তার প্রস্তাবে নিমরাজি হতেই রাজবাড়িতে উৎসবলেগে গেল। সত্যবতী ব্রাহ্মণদের ডেকে, মহর্ষি-দেবর্ষিদের ডেকে খুব করে ভােজ দিলেন। ক্রমে দিন শেষে রাত্রি হল। সত্যবতী | ঋতুস্নাতা পুত্রবধু অম্বিকাকে শয়ন-গৃহে নিয়ে গেলেন ধীরে, সযত্নে। তার গলার স্বর মৃদু হল,

সত্যবতী বললেন—অম্বিকা! তােমার ভাশুর আছেন, তিনি আজ তােমার সঙ্গে মিলিত | হতে আসবেন। তুমি সাবধানে তার জন্য অপেক্ষা করাে। রাত্রির অর্ধকাল অতীত হলে তিনি আসবেন। তার লক্ষ্য কিন্তু তুমিই অপ্রমত্তা প্রতীক্ষৈনং নিশীথে হ্যাগমিষ্যতি। সত্যবতী | অম্বিকার মানসিক প্রস্তুতি খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে শয়ন-গৃহ ছেড়ে চলে গেলেন।……

…….একা মহার্ঘ শয্যায় শুয়ে রইলেন অম্বিকা। কাশীরাজনন্দিনী, বিচিত্রবীর্যের প্রথমা প্রেয়সী। ঘরের মধ্যে প্রদীপ জ্বলছিল অনেক—দীপ্যমানেষু দীপেষু। অম্বিকা রাজবাড়ির এক বিন্ধা রমণী। ভরত বংশের ধারা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে কোনওদিন তাকে এমন অস্বস্তিতে পড়তে হবে, এমন কথা তিনি ভাবেননি। সত্যবতী তাকে বলে গেলেন তােমার ভাশুর আসবেন . নিশীথিনীর অন্ধকারে। কিন্তু কে এই ভাশুর ? ভীষ্ম কি? অন্য কেউ যিনি ভাশুর-স্থানীয় ? | অম্বিকা এক এক করে ভাবতে লাগলেন। তাদের চেহারা, হাব-ভাব বয়স, মিলিত হবার সময় তাদের একেকজনের বিকার—এই সব—সাচিন্তয়ত্তদা ভীষ্মমন্যাংশ্চ কুরুপুঙ্গবা। বহুতর দীপালােকিত শয়নকক্ষে কত শত কথা তার মনে আসছে—ভীষ্ম তাদের তিন বােনকে হরণ করে নিয়ে এলেন, মহারাজ বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে তার বিবাহ, তার প্রাণাধিক ভালবাসা, তার মৃত্যু | এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ এই রম্য অভিযান—এত সব ভাবতে ভাবতেই রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর উপস্থিত হল।

মহর্ষি বেদব্যাস উপস্থিত হলেন অম্বিকার শয়ন কক্ষে-শয়নং প্রবিবেশ হ। মহাভারতের কথক-ঠাকুর তার কথাগুরু বেদব্যাসের চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলেছেনতাঁর মাথায় ছিল পিঙ্গল জটাভার, এক গাল দাড়ি, কালাে গায়ের রঙ, আর চোখ দুটো যেন জ্বলছিল—তস্য কৃষ্ণস্য কপিলাং জটাং দীপ্তে চ লােচনে। দ্বৈপায়ন তার মাকে বলেছিলেন-আজই যদি তােমার | বধুর সঙ্গে মিলন চাও, তবে আমার বিকৃত রূপ, বিকৃত বেশ আর গায়ের দুর্গন্ধ সহ্য করতে হবে তােমার বধুকে। আমাদের ধারণা—তিনি আর নতুন কী বিকার ঘনিয়ে আনবেন নিজের চেহারায়। তার চেহারাটাই তাে ওইরকম। আমরা ছােটবেলায় বৈষ্ণব-সজ্জনদের মুখে মহামতি ব্যাসের একটা ধ্যানমন্ত্র শুনতাম। সেই শ্লোক মন্ত্রে ব্যাসের প্রথম উপাধি হল—বেদ-শাস্ত্রের অধ্যয়ন-অধ্যাপনে যার বুদ্ধি পরিশীলিত হয়েছে এই তার আন্তর রূপ। দ্বিতীয় রূপ হল | বাহ্যরূপ—চামড়ার কাপড় পরিধানে, কালাে গায়ের রঙ, মাথায় কপিল-তুঙ্গ জটাভারকৃষ্ণত্বিষং কনকতুঙ্গ-জটালাপম্। আর মধ্যে আছে দুটি আগুনের আঁটার মতাে চোখ রাজবাড়ির সার্বত্রিক পরিচ্ছন্নতার মধ্যে যে রাজবধু জীবন কাটিয়েছেন, যিনি ভীষ্ম কিংবা  রাজপরিবারের ভাশুর স্থানীয় অন্য কারও কথা ভেবে নিজের মনকে তবু একটু প্রস্তুত করছিলেন, সেই রাজবধু রাজবালা মহর্ষি বেদব্যাসের এই অকল্পনীয় রূপ দেখে ভয়ে চোখ বুজলেন- দৃষ্টা দেবী নামীলয়| ঘরে দীপ জ্বালা রয়েছে ব্যাস উপস্থিত হয়ে রমণীর হৃদয়হারী। কোনও চাটুবাক্য বললেন না, কোনও শৃঙ্গার-নর্মে মন দিলেন না। শুধু মায়ের ইচ্ছাপূরণ করে | ইতিকর্তব্য পালন করলেন। ওদিকে অদ্ভুত আশঙ্কায়, ভয় রাজবধু অম্বিকা চক্ষু মুদে আপন।

রুচি-বিরােধী এক পুরুষ-সংসর্গ সহ্য করে গেলো একবারের জন্যও তিনি চোখ খুলে | ব্যাসের দিকে আর তাকালেন না— ভয়াৎ কাশতা তন্তু নাশক্লোদভিবীতুম।

রানীর শয়নকক্ষ থেকে ব্যাস বেরিয়ে চলে যাবার পথেই তাকে ধরলেন সত্যবতী।  জিজ্ঞাসা করলেন—খুব ভাল ছেলে হতাে, বাবা। রাজার ছেলে রাজপুত্রের মতােই হবে ততা সে অপ্যস্যাং গুণবান্ পুত্র রাজপুত্রো ভবিষ্যতি? …..

……..অন্ধ পুত্রের মুখ দেখে ভূয়ােদর্শিনী সত্যবতী আবারও আহ্বান জানালেন ব্যাসকে। এবারে এবার বিচিত্রবীর্যের দ্বিতীয়া মহিষী অম্বালিকার পালা। সত্যবতী তাকেও ধীরে-মধুরে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শয়নকক্ষে পাঠালেন-পুনরেব তু সা দেবী পরিভাষ্য সুষাং ততঃ।

অম্বালিকা অপেক্ষা করতে লাগলেন নিযুক্ত পুরুষ ব্যাসের আগমনের জন্য। ব্যাস একইভাবে জটা-দাড়ি আর দীপ্ত চক্ষুর বিকর্ষণ নিয়ে উপস্থিত হলেন অম্বালিকার শয়ন-প্রকোষ্ঠে—ততস্তেনৈব বিধিনা মহর্ষিস্তামপদ্যত। অগ্রজা অম্বিকার অভিজ্ঞতায় অম্বালিকা মনের জোর করেই চোখ বন্ধ করলেন না বটে, কিন্তু ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন একেবারে। সেই | ভয়েই তিনি বুঝি একেবারে বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন- বিবর্ণা পাভুসঙ্কাশা সমপদ্যত | ভারত। মিলন সম্পূর্ণ হল এইভাবেই– ভয়ে, বিবর্ণতায়।

আগের বারে যার সঙ্গে তার মিলন হয়েছিল, সেই ভীতা নিমীলিতচক্ষু অম্বিকার সঙ্গে কথা | বলার কোনও সুযোেগই পাননি ব্যাস। এক অন্তহীন বিকর্ষণের মধ্যেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এবারে শত শত প্রজ্বলিত দীপামালার মধ্যে তাঁরই দিকে তাকিয়ে থাকা এক বিবর্ণ মলিন সন্ত্রস্ত মুখ ব্যাস দেখতে পেলেন। সে মুখের মধ্যে তৃপ্তির আভাস ফুটে না উঠলেও, তার মধ্যে অভিনন্দন বা সম্পূর্ণ নির্বিকার ভাব ছিল না ভয়ে সিটিয়ে থাকা রমণীর মুখপানে তাকিয়ে ব্যাস দুটো কথা বলার সুযােগ পেলেন বললেন—আমার এই বিরূপ বিষম আকৃতি | দেখে তুমি যখন এমন বিবর্ণ পাণ্ডুর হয়ে গেলে তাই তােমার পুত্রটির চেহারাও হবে এইরকম | নিষ্প্রভ বিবর্ণ গােছের। আমি বলি-তারকর্ম রেখাে পাণ্ডু-তস্মাদেষ সুতন্তে বৈ পারেব | ভবিষ্যতি। মাথা নত করলেন অম্বালিকা | শয়নকক্ষ থেকে নির্গত হতেইদ্বৈপায়নকে ধরলেন সত্যবতী। বললেন—এবারে একটি সুলক্ষণ পুত্রের জন্ম হবে তাে? ব্যাস বললেন—এই পুত্রটি যথাকালে প্রবল পরাক্রান্ত এবং জগদ্বিখ্যাত হবে। কিন্তু মা! অম্বালিকার পূর্ব আচরণ আচরণনুযায়ী এই ছেলেটির গায়ের রঙ হবে বিবর্ণ পান্ডু।

গায়ের রঙ দিয়ে আর কী হবে! সত্যবতী খুব একটা হতাশ হলেন না। কিন্তু তবুও আবার কী মনে করে দ্বৈপায়ন পুত্রকে তিনি তৃতীয়বার অনুরােধ করে বসলেন। হয়ত এই অনুরােধও পাণ্ড জন্মাবার পরেই তিনি করেছিলেন। হয়ত বা পাণ্ডুর বিবর্ণতা দেখে তার বড় কোনও আশঙ্কা হয়নি। কিন্তু একবারের তরেও হয়ত বড় রানী অম্বিকার দশা দেখে তার মায়া হয়েছিল। হয়তাে ভেবেছিলেন—স্বামী বেঁচে নেই এবং একটি জন্মান্ধ পুত্রের মুখ দেখে সারাজীবন | কাটাতে হবে তাকে। মনে মনে হয়ত সে দুষবে তার শাশুড়িকে। সত্যবতীর জন্যই তাে তার এই দুর্দশা। সত্যবতী মাতৃসুলভ বায়না করে ব্যাসকে তৃতীয়বার অনুরােধ জানালেন—আরও একবার অম্বিকার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য।………

…….আজ কিন্তু সেরম ঘটল না। আজ তিনি দেখলেন এক সুন্দরী রমণী সর্বাভরণ ভূষিতা হয়ে তার আগমনের প্রতীক্ষা করছে। শয়নকক্ষে ৰয় রাজগৃহের দ্বারে। তিনি আসতেই সে রমণী তাকে সাদরে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল শয়নকক্ষ পর্যন্ত—সা তমৃ িঅনুপ্রাপ্তং প্রত্যুৰ্গম্যাভিবাদ্য চ। ঋষির অনুমতি নিয়েই সে তাকে আসন দিল বসতে, আহার দিল | ফল-মূল। ভারি খুশি হলেন বেদব্যার শুষ্ক-রুক্ষ মুনি-জীবনে কোনও সুন্দরী রমণী এমন মধুর ব্যবহার করেনি তার সঙ্গে। ব্যাসবড় খুশি হয়ে তার সঙ্গে বসে বসে বেশ খানিকক্ষণ গল্প করলেন। গল্পে-সঙ্গে, কথারঙ্গে কখনও তার হাত দুটি ধরলেন মুনি, কখনও হাত রাখলেন কাঁধে, পিঠে; কানে কানে কহিবার ছলে’ দাসীর লজ্জারুণ কুসুম-কপােল চুম্বন করলেন হয়ত-বাগভাবােপপ্রদানেন গাত্র-সংস্পর্শনেন চ। লগ্ন অনুকূল হল, আলিঙ্গন ঘনতর হল। ব্যাস দাসীর সঙ্গসুখে পরম তৃপ্তি লাভ করলেন-কামােপভােগেন রহস্তস্যাং তুষ্টিমগাদৃষিঃ।।

হয়ত এই তৃপ্তির কারণও ছিল। এখানে নিয়ােগ প্রথার নিয়ম মেনে কামনার গন্ধহীন | কোনও যান্ত্রিকতা নেই। মহর্ষির দিক থেকেও নেই, শূদ্রা দাসীর দিক থেকেও নেই। অন্যদিকে | সত্যবতী পূর্বে ব্যাসকে ডেকে এনে বলেছিলেন—তুমি তােমার ভ্রাতৃজায়াদের গর্ভে বিচিত্রবীর্যের এবং তােমার নিজেরও পুত্র উৎপাদন করাে—অনুরূপং কুলস্যাস্য সত্যাঃ প্রসবস্য চ। আমাদের ধারণা বিচিত্রবীর্যের দুই রানীর গর্ভে দুটি পুত্র উৎপাদন করার পর এই | যে তৃতীয় দাসী—এই দাসীগর্ভজাত পুত্রটিকেই তার একান্ত আপন পুত্র মনে করেই ব্যাস পরম | আনন্দ লাভ করলেন। মহর্ষির বিবাহ হয়নি। সমাজের বিধান অনুযায়ী না হলেও এই শূদ্রা দাসীর অভিবাদন অভিনন্দনে তিনি প্রথম বিবাহের আনন্দ পেলেন যেন।

সহবাসের অন্তে পরম প্রীত ব্যাস—মহর্ষিঃ প্রিয়মানয়া-দাসীর কপালে হস্তস্পর্শ করে বললেন—আমার অনুগ্রহে আজ থেকে আর তুমি দাসী থাকবে না—অভুজিষ্যা ভবিষ্যতি। | ব্যাস আরও বললেন—আমি মনে করি কোনও মহাপুরুষ আসছেন তােমার গর্ভে—অয়ঞ্চ তে | শুভে গর্ভঃ শ্রেয়ানুদরমাগতঃ। যিনি তােমার পুত্র হয়ে জন্মাবেন তিনি হবেন পরম ধার্মিক এবং | বুদ্ধিমান মানুষের মধ্যে তিনি হবেন শ্রেষ্ঠ। দাসীকে আশীর্বাদ করে দ্বৈপায়ন ব্যাস বাইরে এলেন। জননীর কাছে বিদায় নেবার সময় বড় রানী অম্বিকার ছলিক আচরণের কথাও যেমন জানালেন, তেমনি জানালেন, শূদ্রা দাসীর সঙ্গে তার আনন্দ-মিলনের কথা—প্রলম্ভ আত্মনশ্চৈব শূদ্রায়াং পুত্রজন্ম চ।…….

Leave a Reply