কড়ি ও কোমল (কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

›› কবিতা / কাব্য  

গীতোচ্ছাস

ব বাঁশরী খানি বেজেছে আবার !
প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার
বসন্ত কানন মাঝে বসন্ত সমীরে!
তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত!
তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্লবীর তীরে
পুরাতন হাসি গুলি ফুটে শত শত!
তাই বুঝি হৃদয়ের বিস্তৃত বাসনা
জাগিছে নবীন হ’য়ে পল্লবের মত!
জগত কমল বনে কমল-আসনা
কত দিন পরে বুঝি তাই এল ফিরে !
সে এলন এল তার মধুর মিলন,
বসন্তের গান হ’য়ে এল তার স্বর,
দৃষ্টি তার ফিরে এল—কোথা সে নয়ন ?
চুম্বন এসেছে তার—কোথা সে অধর ?

 

স্তন  (১)

নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল,
বিকশিত যৌবনের বসন্ত সমীরে
কুসুমিত হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে,
সৌরভ সুধায় করে পরাণ পাগল।
মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল
উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে !
কি যেন বাঁশীর ডাকে জগতের প্রেমে
বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয়,
সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে
সরমে মরিতে চায় অঞ্চল আড়ালে !
প্রেমের সঙ্গীত যেন বিকশিয়া রয়,
উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে ?
হেরগে কমলাসন জননী লক্ষ্মীর—
হের নারী-হৃদয়ের পবিত্র মন্দির ।

 

স্তন  (২)

পবিত্র সুমেরু বটে এই সে হেথায়,
দেবতা-বিহার-ভুমি কনক-অচল ।
উন্নত সতীর স্তন স্বরগ-প্রভায়
মানবের মর্ত্যভূমি করেছে উজ্জ্বল !
শিশু-রবি হোথা হতে ওঠে সুপ্রভাতে,
শ্রান্ত-রবি সন্ধ্যাবেলা হোথা অস্ত যায়।
দেবতার আখিতারা জেগে থাকে রাতে
বিমল পবিত্ৰ দুটা বিজন শিখরে।
চিরস্নেহ-উৎস-ধারে অমৃত্ত নির্ঝরে
সিক্ত করি তুলিতেছে বিশ্বের অধর।
জাগে সদা স্বখ মুণ্ড ধরণীর পরে,
অসহায় জগতের অসীম নির্ভর।
ধরুণীর মাঝে থাকি স্বৰ্গ আছে চুমি
দেব শিশু মানবের ঐ মাতৃভূমি।

 

চুম্বন

অধরের কাণে যেন অধরের ভাষা ।
দোহার হৃদয় যেন দোহে পান করে।
গৃহ ছেড়ে নিরুদেশ দুটী ভালবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর-সঙ্গমে !
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রমের নিয়মে
ভাঙ্গিয়া মিলিয়া যায় দুইটা অধরে।
ব্যাকুল বাসনা দুটী চাহে পরস্পরে
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা !
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে
অধরতে থরে থরে চুম্বনের লেখা।
দুখানি অধর হতে কুসুম চয়ন,
মালিক গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে ?
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসর শয়ন।

 

বিবসনা

ফেল গো বসন ফেল—ঘুচাও অঞ্চল।
পর শুধু সৌন্দর্ঘ্যের নগ্ন আবরণ
সুর বালিকার বেশ কিরণ বসন।
পরিপূর্ণ তমুখানি—বিকচ কমল,
জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা !
বিচিত্র বিশ্বের মাঝে দাড়াও একেলা !
সৰ্ব্বাঙ্গে পড়ুক তব চাদের কিরণ
সৰ্ব্বাঙ্গে মলয় বায়ু করুক সে খেলা ।
অসীম নীলিমা মাঝে হও নিমগন
তারাময়ী বিবসনা প্রকৃতির মত।
অতন্তু ঢাকুক মুখ বসনের কোণে
তমুর বিকাশ হেরি লাজে শির নত।
আমুকু বিমল উৰা মানব ভবনে,
লাস্তুহীনা পবিত্রতা-শুভ্ৰ বিবসনে।

 

বাহু

কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহু লতা।
কাহারে কাদিয়া বলে যেওনা যেওনা।
কেমনে প্রকাশ করে ব্যাকুল বাসনা,
কে শুনেছে বাহুর নীরব আকুলতা!
কোথা হতে নিয়ে আসে হৃদয়ের কথা
গায়ে লিখে দিয়ে যায় পুলক অক্ষরে!
পরশে বহিয়া আনে মরম বারতা
মোহ মেথে রেখে যায় প্রাণের ভিতরে !
কণ্ঠ হতে উতারিয়া যৌবনের মালা
দুইটি আঙ্গুলে ধরি তুলি দেয় গলে।
দুটি বাহু বহি আনে হৃদয়ের ডাল।
রেখে দিয়ে যায় যেন চরণের তলে ।
লতায়ে থাকুক বুকে চির আলিঙ্গন,
ছিড়োনা ছিঁড়োনা দুটি বাহুর বন্ধন।

Leave a Reply