মর্ত্যের শুচিশুভ্র কুকলি অথবা স্বর্গের নন্দন কাননের পারিজাত—সকল কুসুমের মধ্যেই কীট আছে। কিরণােজ্জ্বল পূর্ণচন্দ্রের মধ্যে আছে কলঙ্ক। অনিন্দ্যসুন্দর নরনারীর রূপেরও বিরূপতা আছে। যে-কোনাে মহৎ চরিত্রের মধ্যে আছে কালিমা কিন্তু আমি এমন এক নারী সৃষ্টি করেছি। যার মধ্যে কোনাে দিক থেকে কোনাে হল’ বা বিরুপতা নেই। সে হচ্ছে আমার অহল্যা।
স্বর্গের দেবতাদের সভায় একথা একদিন গর্বের সঙ্গে ঘােষণা করলেন পিতামহ ব্রহ্মা। একজন দেবতা জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু তাকে দেবী না করে মানবী করলেন কেন পিতামহ ? ব্রহ্মা বললেন, নারীজাতির মধ্যে আদর্শ স্থাপন করবার জন্যই আমি তাকে মানবী রূপে সৃষ্টি করেছি। কারণ মতের মানবীরা স্বর্গের দেবীকে শ্রদ্ধা করতে পারে; কিন্তু আদর্শ রপে কখনাে তাকে গণ্য করবে না। মানুষ মানুষের মধ্যেই একজনকে আদর্শ রূপে দেখতে চায়।
অহল্যাকে চোখে না দেখেই তাকে ভালবেসে ফেললেন ইন্দ্র। ইন্দ্রের মনােভাব বুঝতে পেরে ব্রহ্মা তাকে বললেন, স্বর্গের দেবরাজ হয়ে মর্ত্যের কোনাে নারীরূপের মােহে এমন ভাবে বিচলিত হওয়া তােমার উচিত নয় বৎস।
ইন্দ্র বললেন, এ মােহ নয় পিতামহ। এ হচ্ছে আমার প্রেম। সমগ্র দেহ মন হতে উৎসারিত স্বচ্ছ সুন্দর একটি কামনা। তার কথা আপনার কাছে কানে শুনেই তার প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়েছি আমি। এ শুধু পূর্বরাগ নয়, এ আমার প্রগাঢ় প্রেম। অহল্যাকে আমায় আপনি দান করুন। তাকে পেয়ে আমি সুখী হব। | ব্ৰহ্ম বললেন, নারীসঙ্গ কামনায় চিত্ত তােমার চঞ্চল। তুমি কামাবিষ্ট। রুপলাবণ্য দ্বারা যে চিত্ত বিমােহিত, কামনার দ্বারা যে চিত্ত সংক্ষুব্ধ, সে চিত্তে কখনাে কোনাে মহৎ প্রেম জন্মগ্রহণ করতে পারে না। আর যে প্রেমে মহত্ত্ব নেই, সে প্রেমে মঙ্গল নেই। যে মিলনে প্রকৃত প্রেম নেই, সে মিলনে সুখ নেই। সুতরাং আমার মানসপ্রতিমা অহল্যাকে তােমার হাতে সম্প্রদান করতে পারি না দেবরাজ।
এক কুটিল ভুভঙ্গরেখায় কুঞ্চিত হয়ে উঠল দেবরাজের অক্ষিযুগল। পিতামহ ব্রহ্মর কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল তার মন। এক তীব্র অসন্তোষ ফুটে উঠলাে তার আয়ত মুখমণ্ডলে। কিন্তু কণ্ঠে কোনােরূপ অসন্তোষ প্রকাশ না করে তিনি বললেন, জানতে পারি কি পিতামহ, কে সেই ভাগ্যবান পুরুষ যার হাতে আপনি অহল্যাকে সমর্পণ করে সুখী হবেন?
ব্রহ্মা বললেন, মহর্ষি গৌতম কোশল রাজ্যে গঙ্গার তীরে এক মনােরম পােবন তপস্যা করছেন। তিনি মহর্ষি ; কিন্তু দেবর্ষি ও পরে ব্রহ্মর্ষি হবার জন্য দুস্তর ও সুকঠোর তপস্যায় মগ্ন। তিনি জিতেন্দ্রিয় এবং সমস্ত প্রকারের রিপুপারবশ্য হতে মুক্ত। আমি তাই স্থির করেছি, সেই মহাত্মা গৌতমের হাতেই অহল্যাকে সম্প্রদান করব।
ব্রহ্মার কথার উপর আর কোন প্রতিবাদ করলেন না দেবরাজ ইন্দ্র। কিন্তু এক তীব্র অপমানের জ্বালায় মনে মনে জ্বলতে লাগলেন। তিনি স্থির করলেন, পিতামহ ব্রহ্ম যাই বলুন, তিনি নিজে গিয়ে একবার অহল্যার সঙ্গে দেখা করবেন।
সত্যিই অপূর্ব। অহল্যাকে দেখে বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে বহুক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইলেন দেবরাজ ইন্দ্র। কিছুতেই চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলেন না। কোনাে কিছু বলতেও পারলেন না।
শ্বেতমর্মরের মতাে শুভ্র মসৃণ দেহ নিটোল স্বাস্থ্যে উজ্জ্বল। উন্নত পীনস্তন। আজানুলম্বিত ঘনকৃষ্ণ আলুলায়িত কুন্তল। আকর্ণ বিস্তৃত লীলায়িত বিন্যাসে সমৃদ্ধ আয়ত উজ্জ্বল অক্ষিযুগল। মন্দগতি মেঘের মতােই গাম্ভীর্যপূর্ণ তার গতিভঙ্গী। পূর্ণচন্দ্রে প্রদীপ্ত মাধুর্য তার মুখমণ্ডলে। সুগন্ধি মুকুলভারে অবনত আম্রশাখার মতাে তার স্নিগ্ধমেদুর কুমারীমনের সুবাসিত কমনীয়তা। ইন্দ্রকে স্তম্ভিত ও হতবাক দেখে আশ্চর্য অহল্যা। অহল্যাকে অনুঢ়া দেখে আশ্বস্ত হলেন ইন্দ্র।
অতিথি ভেবে ইন্দ্রকে পাদ্যার্ঘ দান করে শান্ত কণ্ঠে অহল্যা প্রশ্ন করলেন তাকে, আপনি কে এবং কি হেতু আপনার এখানে আগমন তা জানতে পারি কি আর্য?
ইন্দ্র বললেন, আমি দেবরাজ ইন্দ্র। সুদুর স্বর্গ হতে তােমার কাছে অন্তরের এক আকুল কামনা নিয়ে এসেছি ঋষিকন্যা! যদি তুমি প্রসন্ন হয়ে অভয় দাও, তবেই সে কামনার কথাকে প্রকাশ করব অসঙ্কোচে।
প্রথমটায় বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন অহল্যা। তারপর আস্তে আস্তে অবিশ্বাসের সুরে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে উপহাস করছেন কেন দেবরাজ? মত্যের এক সামান্য মানবী কিনা কামনা পূরণ করবে স্বর্গের দেবরাজের? আমার ধৃষ্টতা মাপ করবেন, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনা। স্বৰ্গই হচ্ছে সমস্ত নরনারীর চরম এবং পরম লক্ষ্যস্থল। বিরামহীন বাসনার দ্বারা চিরচঞ্চল ও বিক্ষুব্ধ এই মতলােক। এখানে মরণশীল প্রতিটি মানুষের অন্তরে কামনার কখনাে অন্ত নেই, তৃষ্ণার তৃপ্তি নেই। বুভুক্ষার নিবৃত্তি নেই। তাই তারা স্বর্গ চায়। স্বর্গ হচ্ছে তাদের কাছে এমন এক স্থান যেখানে গেলে তাদের সমস্ত কামনা বাসনা এক পরমাশ্চর্য পরিতৃপ্তি লাভ করে ধন্য হয় ; চিরশান্ত এক অতিমানস চেতনায় লীন হয়ে যায় চিত্তের সমস্ত চঞ্চলতা ; মরণশীল প্রতিটি ক্ষুদ্র প্রাণ অমরত্বের এক সুমহান ঐশ্বর্যে মণ্ডিত হয়ে ওঠে। সেই স্বর্গরাজ্যের অধিপতি হয়ে হীন কামনার ক্রীতদাসরূপে কেন আপনি এই মর্ত্যলােকে নেমে এলেন প্রভু?
নতজানু হয়ে হাতজোড় করে ইন্দ্রের মুখপানে সকরুণ নয়নে চেয়ে রইলেন অহল্যা।
ইন্দ্র বললেন, আমি দেবতা হলেও আমার দেহমন আছে এবং কোনাে প্রাণীর মধ্যে দেহমন সংযুক্ত হলেই তার মধ্যে কামনা জাগবে। দেহের ধর্ম হচ্ছে অন্য একটি পরিপূর্ণ দেহের সঙ্গ চাওয়া। মনের ধর্ম হচ্ছে অন্য একটি দরদী মনের সাহচর্য কামনা করা। পিতামহ ব্রহ্মার কাছে তােমার দেহের অফুরন্ত রুপের ঐশ্বর্য ও গুণের মহত্ত্ব শুনে আমার সমগ্র দেহমন। তােমার জন্য এক অদম্য কামনায় উদগ্রীব হয়ে উঠেছে অহল্যা। তােমাকে না পেলে আমার সে কামনার শাস্তি হবে না কোনােদিন।
এক অপরিসীম লজ্জার শিহরণে মুহূর্তে সঙ্কুচিত হয়ে উঠল অহল্যার সারা অঙ্গ। নম্রনত মুখখানা যথাসম্ভব নীচু করে অহল্যা বললেন, আপনি হয়ত জানেন না দেবরাজ, পিতামহ ব্রহ্মা আমায় মহর্ষি গৌতমের হাতে সম্প্রদান করবেন বলে স্থির করেছেন।
ইন্দ্র বললেন, তা আমি জানি।
অহল্যা বললেন স্রষ্টার দ্বারা যা পূর্বনির্দিষ্ট বা পূর্বপরিকল্পিত, সৃষ্টির কাছে তাই হচ্ছে ভাগ্য। এই ভাগ্যের সীমারেখাকে লঙ্ঘন করবার কোন অধিকার বা ক্ষমতাই সৃষ্টির নেই। আপনি তা জেনে আমার সঙ্গে কেন ছলনা করতে এসেছেন দেবরাজ?
ছলনা নয় অহল্যা । আমি আমার অন্তরের অনুভূত সত্যকে ব্যক্ত করতে এসেছি তােমার কাছে। এ সত্য হচ্ছে আমার প্রেম। আমার সমগ্র দেহমন হতে উদ্ভূত এক নিবিড় আসক্তি। নির্মম অবহেলায় এ সত্য তুমি পায়ে ঠেলে দিও না।
অহল্যা একটুখানি হাসলেন। বিদ্যুদ্দামস্ফুরিত চকিত আলােকরেখার মতাে সে হাসি তার গম্ভীর মুখখানার উপর ফুটে উঠতেই মিলিয়ে গেল মুহূর্তে।
গম্ভীরমুখে অহল্যা বললেন, কিন্তু দেবরাজ আপনি যাকে অন্তরের সত্য বলছেন তা আপনার দেহগত এক জৈবিক ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি যাকে প্রেম বলছেন তা আমার দেহের প্রতি আপনার এক উচ্ছসিত কামাবেগ। আপনার প্রেমকে স্বীকার করছি। কিন্তু তাকে শ্রদ্ধা করতে পারছি না। এ প্রেমের হয়ত বেগ আছে ; গভীরতাও আছে; কিন্তু মহত্ত্ব নেই।
অবাক বিস্ময়ে অহল্যার পানে চাইলেন ইন্দ্র। চেয়ে বললে, তােমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না অহল্যা।
শমীশাখার ফাক দিয়ে হঠাৎ এক ঝলক সূর্যরশ্মি এসে রাঙিয়ে দিল অহল্যার লজ্জার মুখখানাকে। মৃদু হাওয়ায় ঈষৎ দুলে উঠল তার আলুলায়িত কেশপাশের দুটি চুর্ণ কুন্তল।
অহল্যা বললেন, আমার কথার অর্থ অতি সরল এবং স্পষ্ট দেবরাজ। পিতামহের কাছে আমার রূপের কথা শুনেই আমার রুপের প্রতি অদম্য লালসা জন্মে আপনার মনে। এই হীন রূপলালসা হতেই আপনার প্রেমের উৎপত্তি। আমার প্রতি আপনার যে আসঙ্গলিপ্সা তা হচ্ছে রুপগত আকর্ষণ। তার সঙ্গে গুণগত পরিচয়ের কোনাে সম্বন্ধ নেই। কিন্তু রুপলালসাজনিত ক্ষণিকের চিত্তবিভ্রম হতে যে প্রেমের জন্ম তা একান্তভাবে ক্ষণকালীন দেবরাজ। তা কখনই চিত্তের স্থায়ীভাবে পরিণত হতে পারে না। তাকে প্রেম না বলে কামজ মােহ বলাই শ্রেয়। তা রতি নয়, রাগ। দীর্ঘকাল ধরে কারাে বিভিন্ন সদগুণের নিবিড় পরিচয় থেকে তার প্রতি যে আসক্তি জন্মে, সেই আসক্তিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ রতি। এই রতি নিষ্কাম ভক্তির সমান, যে ভক্তি দিয়ে আমরা দেবতার পূজা করি।
মনে মনে ক্ষুন্ন ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন দেবরাজ ইন্দ্র। সামান্য একজন মানবীর কাছ থেকে এমনভাবে অপমানিত হতে হবে তাকে তা তিনি ভাবতেই পারেননি। কিন্তু বাইরে কোনাে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন না তিনি। ভাবলেন, হয়ত তার রুপের গর্ব করছে অহল্যা। মৃগনাভির গন্ধে ব্যাকুল বনহরিণীর মতাে আপন সৌন্দর্যচেতনার সুরভিতে মগ্ন ও মাতােয়ারা হয়ে উঠেছে অহল্যা। রুপের মদগর্ব এমনি প্রবল হয়ে উঠেছে তার মধ্যে যে নিজেকে ছাড়া সে আর কোনদিন কাউকে ভালবাসতে পারবে না, অপরের প্রেমের কোনাে গুরুত্বকে উপলব্ধি করতে পারবে না। আত্মরতি ছাড়া যে অন্য কোনাে রতির কথাই জানে না, সত্যিকারের প্রেম কি জিনিস তা অন্তরে যে অনুভব করেনি কোনােদিন, সে অপরের প্রেমের সত্যাসত্য বিচার করতে যায় কোন সাহসে।
অনেকক্ষণ পর অহল্যা বললেন, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, সামান্য একজন মানবী হয়েও আপনার মতাে দেবতার প্রেম নিবেদনে সন্তুষ্ট হতে পারলাম না কেন।
শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ইন্দ্র, না বুঝতে পারলাম না, কেন তুমি পরীক্ষা না করেই আমার প্রেমকে অপ্রকৃত ও প্রকারান্তরে অসত্য বলে প্রতিপন্ন করতে চাইছ। যথাযথ পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা, বিশ্লেষণ ও বিচারের মধ্য দিয়েই কোনাে বস্তুর সত্যাসত্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে থাকি আমরা। কিন্তু জ্ঞানলাভের এই সাধারণ রীতিটিকে তুমি লঙঘন করছ অহল্যা।
অহল্যা বললেন, প্রেম হচ্ছে অপার্থিব বস্তু দেবরাজ। বাইরের কোনাে জাগতিক বস্তু বা ঘটনার মধ্য দিয়ে তার সত্যাসত্য প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবু যদি আপনি ইচ্ছা করেন, আপনার প্রেমের সত্যতা সম্পর্কে যথাযোেগ্য প্রমাণ উপস্থাপিত করতে পারেন।
প্রথমে একটু ইতস্ততঃ করলেন ইন্দ্র। তারপর বললেন, আমি মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করছি অহল্যা, আমি আমার এই প্রেমের খাতিরে প্রয়ােজন হলে ইন্দ্ৰত্ব ও দেবত্ব ত্যাগ করতে পারি। তােমার অন্তরের সিংহাসনে স্থান পেলে আমি স্বর্গের রাজসিংহাসনকে ত্যাগ করে এই মর্তের মাটিতে এসে ঘর বাঁধতে পারি।
সহসা এক বেদনার্ত বিস্ময়ে চমকে উঠলেন অহল্যা। ইন্দ্রের প্রেম এতখানি খাঁটি হবে ভাবতেই পারেননি তিনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনার প্রেমের সত্যতাকে প্রমাণ করে কোনাে ফল হবে না দেবরাজ। কারণ আপনি জানেন, আমাদের মিলন সম্ভব নয়। আপনার প্রেম যত খাটিই হােক আমি পিতামহ ব্রহ্মার অবাধ্য হতে পারি না।
ইন্দ্র বললেন, স্রষ্টার কাছে সৃষ্টি চিরঋণী একথা স্বীকার করি। কিন্তু তাই বলে তার সারাজীবনের সুখ এবং ইচ্ছার স্বাধীনতা স্রষ্টার কাছে চিরবিক্রীত একথা কিছুতেই স্বীকার করব না আমি। | অহল্যার পানে একবার চাইলেন ইন্দ্র। অহল্যাকে নীরব দেখে আবার বলতে শুরু করলেন, প্রকৃতি জগতে একবার চেয়ে দেখ অহল্যা, ধূলিকণা হতে নীহারিকা পর্যন্ত প্রতিটি বস্তুর একটি করে নিজস্ব গতি আছে, আছে এক একটি বিশিষ্ট লক্ষ্য। প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর প্রতিটি কর্মপ্রয়াসে মূর্ত হয়ে ওঠে এক স্বাধীন ইচ্ছা।
আশ্চর্য হয়ে শুনতে লাগলেন অহল্যা। বেলা তখন দ্বিপ্রহর। ছায়াঘেরা নির্জন বনভূমির শান্ত অবকাশে মাথার উপর শমীগাছের শাখায় দুটি কপােত কূজন করছে মনের নিবিড় আনন্দে। স্বপ্নবিষ্টের মতাে স্থির হয়ে ইন্দ্রের দিকে দাঁড়িয়ে রইলেন অহল্যা।
ইন্দ্র বললেন, স্রষ্টা কখনাে বলে দেয় না কোন্ কপােতী কোন্ কপােতকে সাথী করে বাসা বাঁধবে, কোন্ লতা কোন্ গাছকে জীবনে একমাত্র অবলম্বন করে জড়িয়ে ধরবে, কোন্ ফুলের গর্ভকেশর কোন ফুলের পরাগরেণুকে ধারণ করবে। | তাছাড়া আমাদের প্রতিটি কর্মপ্রয়াসের পিছনে যদি ইচ্ছার স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে ন্যায় বা অন্যায় কোনাে কর্মের জন্যই আমাদের দায়ী করা চলবে না। ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে বলেই বিশ্ব সংসারে আছে পাপ ও পুণ্যের অস্তিত্ব, আছে ন্যায় ও নীতির বিধান।
ইন্দ্রকে থামিয়ে দিয়ে সহসা করুণকণ্ঠে চীৎকার করে উঠলেন অহল্যা, এমন করে জটিল যুক্তিজাল বিস্তার করে আমার চিত্তকে দুর্বল করে দেবেন না দেবরাজ। আমার পিতামাতাকে আমি কোনদিন দেখিনি। জন্মের পর হতে পিতামহ ব্রহ্মার তত্ত্বাবধানেই এই নির্জন পােবনে মানুষ হয়েছি। পিতামহ আমায় মহর্ষি গৌতমের হাতে সম্প্রদান করবেন এ কথা জানার পর হতে আমি মনে মনে তাকেই পতিত্বে বরণ করেছি দেবরাজ। এরপর দ্বিচারিণী হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। | তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে ছাড়লেন না ইন্দ্র। বললেন, আর একবার ভেবে দেখ অহল্যা। মহর্ষি গৌতমের পত্নী হয়ে তুমি সৌভাগ্য ও সম্মান লাভ করবে একথা ঠিক; কিন্তু সুখ পাবে না জীবনে। গৌতম একজন মহাতপস্বী ; জিতেন্দ্রিয়, মিতবাক ও নিয়ত ধ্যানগম্ভীর। সত্য ও অমৃতের উপাসক গৌতমের কাছে পারিবারিক সুখ হচ্ছে তুচ্ছ চিন্তাবিলাস, প্রেম হচ্ছে দুর্বলতা। অনলপ্ৰভ ব্যক্তিত্বের জ্যোতি তার মুখমণ্ডলে। সূর্যসন্নিভ তাঁর তেজ। ভূমি হতে ভূমার প্রতি দৃষ্টি তার ঊধ্বায়িত। অধ্যাত্মসাধনার অনির্বাণ আগুনে তার অন্তরের যে ধূসর আকাশখানা নিয়ত জ্বলছে, সকাম অনুরাগের কোনাে বর্ণচ্ছটা জাগতে পাবে সেখানে কোনােদিন। তিনি হবেন তােমার ভর্তা, স্বামী, তুমি হবে তার ভার্যা, সেবাদাসী। অণুমাত্র প্রণয়ের কোনাে মাধুরিমা থাকবে না তােমাদের দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে।
কোনাে উত্তর দিলেন না অহল্যা। দু’হাত দিয়ে মুখখানাকে কে মৃদু কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে দেখলেন, তার সামনে থেকে কখন অন্তর্হিত হয়েছেন দেবরাজ
অহল্যার মনে হলাে, সমগ্র পৃথিবীটাই যেন কাঁদছে। এক নির্জন কান্নার সকরুণ সমারােহ চলেছে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে। এক বিগলিত অন্তর্বেদনার অব্যক্ত মূৰ্ছনা অনুরণিত হয়ে উঠেছে চারিদিকের অশান্ত বনমর্মরে, কামার্ত পাখির কুজনে আর অশান্ত নদীর কলতানে।
তবু গৌতমকে পেয়ে ইন্দ্রকে একেবারে ভুলে যাবার চেষ্টা করতে লাগলেন অহল্যা। নিজেকে বােঝাতে লাগলেন, বিধির বিধানের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের বাসনাকে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলাই হলাে মানব জীবনের প্রকৃত ধর্ম। জীবনে যে সত্য অনাগত, যে বস্তু অনায়ত্ত তা শত আকাক্ষিত হলেও তার প্রতি হতাশ্বাস ফেলে লাভ নেই। তার চেয়ে অবাঞ্ছিত হলেও যে সত্য সহজভাবে জীবনে এসে ধরা দিয়েছে তাকেই সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে গ্রহণ করে নেবেন অহল্যা। এই সত্যের নীরস আবর্তের মধ্যেই তৃপ্তির ফুল ফোটাবেন তিনি।
জাহ্নবী তীরে মিথিলার একটি উপবনে মহর্ষি গৌতমের তপােবনটি বড় চমৎকার। দিনরাত জপ তপ আর যাগ যজ্ঞ নিয়ে থাকেন মহর্ষি গৌতম। আর অহল্যা থাকেন সংসারের কাজকর্ম নিয়ে। | তবু মাঝে মাঝে কোনাে উতল বসন্তপ্রভাবে কোনাে অবগুণ্ঠিত ফুলের মুখে মধুগন্ধী হাসি ফোটাবার জন্য গুঞ্জন করতে থাকে যখন কোনাে মদোম্মত্ত অলি, অথবা কোনাে অলস দ্বিপ্রহরে এক শান্ত শমীশাখায় কৃজন করতে থাকে কোনাে কামার্ত কপােতদম্পতী অথবা কোনাে বর্ণগন্ধমদির অপরাহে যখন দক্ষিণের মলয় বাতাসে মৃদুশিহরিত জাহ্নবীর বুকে জলকেলি করতে করতে কোনাে চক্রবাক তার সাথীকে চুম্বন করতে থাকে, তখন দেবরাজ ইন্দ্রের কথা মনে পড়ে অহল্যার। সঙ্গে সঙ্গে তার শান্ত বুকের অতলে এক গােপন দ্বন্দ্বের শিহর জাগে।
এতদিনে বুঝতে পারলেন অহল্যা, দেবরাজ ইন্দ্রের কথাই ঠিক। তার অতুলনীয় দেহসৌন্দর্যের কোনদিন কোনাে মূল্য দেবেন না মহাতপস্বী মহর্ষী গৌতম। তার একনিষ্ঠ অবিচল প্রেমের দেবেন না কোনাে মর্যাদা।
কতদিন কত মদির বসন্ত অপরাহ্তোর তিমিরকল্প কেশকলাপকে বিন্যস্ত করে মৃগ নাভির দ্বারা কপােলফলককে রঞ্জিত করে ও কাঞ্চীদাম দ্বারা পীনস্তনকে শােভিত করে মহর্ষি গৌতমের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন অহল্যা। কিন্তু কোনাে মদচঞ্চল কটাক্ষবিক্ষেপ দ্বারা তার সেই প্রসাধিত দেহসৌন্দর্যকে কোনাে স্বীকৃতি দেননি গৌতম।
আসলে সকল ঋষিই অত্যন্ত স্বার্থপর। ব্রহ্মের ধ্যানে যাদের প্রাণমন নিঃশেষে সমর্পিত,
মােক্ষলাভের জন্য যারা নিয়ত যােগনিত, অপরের দেহমনের প্রতি তাকাবার অবকাশ কোথায় তাদের?
কিন্তু আশ্চর্য! গৌতমের এই নীরস ঔদাসীন্য রুক্ষ কঠিন এক প্রেমানুভূতি জাগিয়ে তুলল অহল্যার অন্তরে। এক নির্মম প্রতিকূলতায় প্রতিহত না হয়ে দিনে দিনে তীব্র হয়ে বেড়ে উঠতে লাগল সে প্রেমানুভূতি।
অহল্যা ভাবলেন, এই প্রেমানুভূতির উত্তাপ দিয়ে ধীরে ধীরে বিগলিত করে তুলবেন গৌতমের হিমশীতল ঔদাসীন্যটাকে। গৌতম তাকে ভালােবাসলেও বিপরীতরতি সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি ভালবেসে যাবেন গৌতমকে।
এমনি করে বহুদিন যাবার পর সহসা একদিন ফুল ফুটল মহর্ষি গৌতমের বুদ্র তপােবনে। ক্রমে সেই ফুল থেকে ফললাে ফল। গর্ভলক্ষণ দেখা দিল অহল্যার মধ্যে। মহর্ষি গৌতম কিন্তু নির্বিকার। সুখে দুঃখে নির্বিকার চিত্ত থেকে সংসারের সকল বস্তু ও ঘটনার মধ্যে এক অদ্বিতীয় সত্যকে দেখাই তার ধর্ম। এদিকে অহল্যার কিন্তু উল্লাস চঞ্চলতার আর সীমা রইল ।
যথাসময়ে এক পুত্রসন্তান প্রসব করলেন অহল্যা। গৌতম তার নাম রাখলেন শানন্দ। এক বৎসর অতিক্রান্ত হতেই আবার সন্তান সম্ভবা হলেন অহল্যা। কিছুটা বিরক্তিবােধ করলেন গৌতম। দ্বিগুণ আনন্দ অনুভব করলেন অহল্যা। দেখতে দেখতে অহল্যা হয়ে উঠলেন যেন সম্পূর্ণ এক অন্য মানুষ। অন্য মন। চিত্তের সমস্ত চঞ্চলতা যৌবনের সমস্ত প্রগলভতা স্নিগ্ধগম্ভীর এক মাতৃত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল নিঃশেষে।
কিন্তু সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে মলয়বাতাস বইতে থাকে যখন মৃদুমন্দ, প্রিয়সখা কন্দর্প সহ ঋতুরাজ বসন্ত এগিয়ে আসতে থাকেন যখন মদালস গতিতে, যেন শুধু অহল্যার নয়, সংযতচিত্ত যােগনিমগ্ন গৌতমের মনটাও কেমন যেন বিচলিত হয়ে ওঠে ক্ষণিকের জন্য। শান্তস্নিগ্ধ তপােবনের হৃদয়ে দেখা দেয় এক মধুর উন্মাদনা। বৈরাগ্যের মাঝে আসে ক্ষণবিলাসের আবেগ। বিবর্ণ রুক্ষতার মাঝে আসে সকাম বাসনার বর্ণচ্ছটা।
অহল্যা তখন নানারকমের গন্ধদ্রব্য দিয়ে অঙ্গরাগ করেন। অবতংসরূপী নবপল্লব দ্বারা শোভিত করেন তার কর্ণযুগলকে; চন্দ্রহারতুল্য বকুলমালা পরেন পীনস্তনােত গলদেশে এবং সুবিন্যস্ত কেশকলাপে সংযুক্ত করেন স্বর্ণোজ্জ্বল কর্ণিকার কুসুম।
ঋষিকুমারদ্বয় ব্রহ্মচর্যাশ্রমে চলে গেলেন শিক্ষালাভের জন্য। মাঝে মাঝে মনের মধ্যে একটা শূন্যতা অনুভব করেন অহল্যা। প্রয়ােজন না হলে কোনাে কথা বলেন না। মিতবাক গৌতম।
সেদিন কিন্তু প্রভাতকাল হতেই লঘুপক্ষ বলাকার মতাে এক সুমধুর লীলাচপলতায় চঞ্চল হয়ে উঠল গৌতমের মন। যােগাসনে বসলেন না সেদিন, কারণ বুঝলেন আজ তপস্যায় নিবদ্ধ করা যাবে না এ মনকে। পরিহাসচ্ছলে দুই একটি মধুর কথা বলে অহল্যাকে প্রীত করতে লাগলেন গৌতম। অহল্যাও বেশ উপভােগ করতে লাগলেন প্রণয়কলাপতুল্য সেই সব কথাগুলিকে।
একসময় মহর্ষি গৌতম বললেন, ইন্দ্রিয়দ্বার একটু মুক্ত হলেই সে পথে মন নিয়ত বহির্মুখী হয়ে ছুটে চলে। বস্তুজগতের অজস্র উদ্দীপন অনিবারণীয় বেগে আকর্ষণ করে মনকে। তাই সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বারকে রুদ্ধ করে উল্টো সাধনের দ্বারা সংহত করতে হয় আমাদের মনকে।
মহর্ষি একটুখানি মৃদু হাসলেন। হেসে বললেন, অন্য বস্তুর কথা ছেড়ে দিলেও তােমার অতুলনীয় দেহসৌন্দর্যের মােহবন্ধন থেকে মনকে মুক্ত করা খুবই কঠিন অহল্যা। তুমি হচ্ছ অয়স্কান্তমণি ; তােমার আকর্ষণকে প্রতিহত করা লৌহের মতাে কঠিনতম পদার্থেরও ক্ষমতা নেই।
কৃত্রিম অথচ নিবিড় এক অভিমানে ফুলে উঠলেন অহল্যা। বললেন, আমাকে আপনি দেখে শুনেই ধর্মপত্নীরূপে গ্রহণ করেছেন মহর্ষি। তা সত্ত্বেও আপনি যদি মনে করেন আমি আপনার ধর্মসাধনার পথে বিঘস্বরূপ তাহলে আপনি আমায় স্বচ্ছন্দে পরিত্যাগ করতে পারেন। আপনার মঙ্গলের জন্য পরম আনন্দে আমি মেনে নেব আপনার সে বিধানকে।
আবার একটু হাসলেন মহর্ষি। তার তেজোদীপ্ত শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডলে ফুটে উঠল এক মধুর বর্ণরাগরেখা। হাসিমুখেই বললেন, কামিনীকাঞ্চন উচ্চতর অধ্যাত্ম সাধনার ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিবন্ধক একথা জেনেও আমি তােমার মতাে রূপরম্যা ভাস্বরদেহিনী এক কামিনীকে গ্রহণ করেছি; তার কারণ এই যে চিত্তবিকারের প্রভূত উপাদান কাছে থাকা সত্ত্বেও যার চিত্ত বিকৃত হয় বা যিনি ধর্মপথ হতে বিচ্যুত না হন, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত সাধক।
তবু এ কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না অহল্যা। কারণ একথা বিশুদ্ধ প্রণয়ের কথা নয়। মহর্ষি গৌতমের কাছে অহল্যার রুপগুণের কোনাে স্বকীয় মূল্য নেই। পুত্রসৃষ্টি ও আত্মশক্তির পরীক্ষা এই দুই আপন প্রয়ােজন সিদ্ধির জন্য তাকে শুধু এক হীন ব্যবহারিক মূল্য দান করে থাকেন মহর্ষি গৌতম। অহল্যার রূপযৌবন হচ্ছে তার কাছে এক নির্ভুল কষ্টিপাথর যার মাধ্যমে তার চিত্তের শক্তি ও শুচিতাকে কষিত করে নিচ্ছেন তিনি অহরহ। কিন্তু মহর্ষির কথায় কোনাে প্রতিবাদ করলেন না অহল্যা।
কথায় কথায় এমনিতেই বেলা দ্বিপ্রহর হয়ে যায়। আম্রমুকুলের গন্ধভরা বসন্তের মধ্যাহ্ন কেমন যেন অলস ও মন্থর হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। জাহ্নবীর জলে স্নান সেরে সমিধ আহরণ করে আনবার জন্য বেরিয়ে যান মহর্ষি। ভৃঙ্গারক হাতে নিয়ে আশ্রম প্রাঙ্গণে রক্তাশােকমূলে জলসিঞ্চন করতে থাকেন অহল্যা।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে পােবন প্রাঙ্গণে মহর্ষি গৌতমের কণ্ঠস্বর শুনে বিস্মিত হয়ে চাইলেন অহল্যা। এত শীঘ্র স্নান সেরে ফেরা কখনােই সম্ভব নয় মহর্ষির পক্ষে।
আশিঞ্জিতপুর গজগামিনী অহল্যা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন প্রাঙ্গণের দিকে। সহসা থমকে স্থাণুর মতাে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভালাে করে নিরীক্ষণ করে দেখলেন, গৌতম নন, মহর্ষির ছদ্মবেশে দেবরাজ ইন্দ্র।
এক অজানা আশঙ্কায় মুহূর্তে পার হয়ে উঠল অহল্যার মুখখানা। সভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি পরস্ত্রী, সন্তানের জননী, একথা জেনেও কেন ছলনার আশ্রয় নিয়ে আবার আমার সকাশে এসেছেন দেবরাজ?
ইন্দ্র বললেন, চিনতে যদি পেরেছ তাে আমার মনের সবকথা শােনাে অহল্যা। তুমি সেবার আমায় প্রত্যাখ্যান করার পর হতে এক তীব্র মর্মজ্বালায় জ্বলছি আমি। অবশ্য যদিও আমাদের এই দেহগত বিরহ তােমার প্রতি আমার প্রেমের প্রগাঢ়তাকে ক্ষুন্ন করতে পারেনি কিছুমাত্র, যদিও শত যােজন দূরে থেকেও অচ্ছেদ্যভাবে বিজড়িত হয়ে আছ তুমি আমার অন্তরাত্মার সঙ্গে, যদিও মনে মনে আমাদের চিরমিলন দূরত্বের সমস্ত ব্যবধানকে বিলুপ্ত করে দিয়ে অক্ষয় হয়ে বিরাজ করছে আজও, তথাপি শুধু একটিবারের জন্য তােমার দেহের সুধাকে পান করবার জন্য চিত্ত আমার চন্দ্রিকাবিহুল চকোরের মতােই উম্মত্ত হয়ে উঠেছে অহল্যা।
জলসম্ভত একখানি মেঘের মতাে গম্ভীর হয়ে উঠলেন অহল্যা। বৃঢ়ভাবে বললেন, ছিঃ দেবরাজ! একজন পরস্ত্রী সতীনারীর সঙ্গে আপনার এই হীন রমণেচ্ছাকে আপনি অকৃত্রিম প্রেমের পরকাষ্ঠা বলে অভিহিত করছেন! | কুটিল ও নির্লজ্জ এক হাসি ফুটে উঠল ইন্দ্রের মুখে। হেসে বললেন, সুন্দরী তুমি বড় নিষ্ঠুরা। তুমি বুঝতে পারছ না, আত্মিক বা দৈহিক যাই হােক, যে আসক্তির বশবর্তী হয়ে দেবতার অহঙ্কার ত্যাগ করে সুদূর স্বর্গ হতে মর্ত্যলােকে ছুটে এসেছি, সে আসক্তিহীন হতে পারে না কখনাে।
অহল্যাকে নীরব থাকতে দেখে ইন্দ্র বললেন, আয়তনয়না, তুমি দেখতে পাচ্ছ না, এখন বসন্তকাল। প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলনের এই প্রশস্ত সময়। প্রিয়ামিলনের আনন্দে উন্মত্তপ্রায় চেতন অচেতন প্রতিটি বস্তু। ওই দেখ, একটি পুষ্পদ্রমের উপর কোনাে একটি ভ্রমরী মধুপান করার পর তার পরিভুক্ত পীতাবশিষ্ট মধুটুকুকে পান করছে তার প্রিয় ভ্রমর।
ওই দেখ, একটি ইঙ্গুদী গাছের তলে প্রেমালস একটি কৃষ্ণসার তার শৃঙ্গাগ্রভাগ দিয়ে নয়ন কণ্ডুয়ন করে দিচ্ছে তার প্রিয়তমার আর মদালসা মৃগীটি নিমীলিতনেত্রে তার প্রিয়তমের চিরবাঞ্ছিত স্পর্শসুখ অনুভব করছে। আরও দেখ, আরক্ত নবপল্লবগুচ্ছমণ্ডিত তরুদল তাদের শাখাবাহু দ্বারা ললিততরুণ নবপুষ্পিত লতাদের আলিঙ্গন করতে গিয়ে নিজেরাই আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে লতাজালে।
অভিমানিনী, তুমি হয়ত বলবে এ মিলন একান্তভাবে দৈহিক, এর সঙ্গে আত্মার কোনাে সম্বন্ধ নেই। কিন্তু আমি বলব, এই দেহমিলনই আত্মিক মিলনকে সম্পূর্ণতা দান করে। তুমি হয়ত বলবে এ মিলন অবৈধ। কিন্তু আমি বলব অবৈধ হলেও এ মিলন বিশুদ্ধ। এর মধ্যে নেই কোনাে উদ্দেশ্যের আবিলতা। আনন্দের আকাঙ্ক্ষাতে এর জন্ম, আনন্দলাভের মধ্যেই এর লয়।
তােমাদের দাম্পত্য জীবনে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে যে মিলন, সে মিলন বৈধ হলেও বিশুদ্ধ নয় কখনই। কারণ তার মধ্যে আছে পরস্পরের কর্তব্যবােধ, নীতির শাসন, পুত্র সৃষ্টির উদ্দেশ্য। এ মিলনে তাই কেউ চরম ও পরম আনন্দ লাভ করতে পারে না। কিন্তু মনে রেখাে, এই আনন্দ দানের জন্যই বিশ্বসংসারে সকল বস্তুর সৃষ্টি। আনন্দই হচ্ছে পরমার্থ ব্ৰহ্ম। আনন্দ দানের মধ্যেই নির্ভর করছে সকল বস্তুর চরম সার্থকতা। যে বস্তু যত আনন্দ দান করতে পারে সে বস্তু তত সার্থক। তাই একমাত্র নিবিড় আনন্দ উপভােগের মধ্য দিয়েই কোনাে বস্তুকে চরম মূল্য দান করতে পারি আমরা। একটি ফুলের জীবন একমাত্র তখনি হয়ে উঠবে সার্থক এবং স্বকীয় ও স্বতন্ত্রমূল্যে উজ্জ্বল যখন আমরা আমাদের দর্শনেন্দ্রিয় দ্বারা তার সৌন্দর্যের সুষমাকে উপভােগ করব, আমাদের স্পর্শেন্দ্রিয় দ্বারা তার কোমলতাকে স্পর্শ করব, ঘ্রাণেন্দ্রিয় দ্বারা আস্বাদনে করব তার সৌগন্ধকে।
পদ্মমুখি, তুমি বিরূপা হয়াে না। অনেক আশা নিয়ে এসেছি আমি। আজ আমি আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দ্বারা উপভােগ করতে চাই তােমার দেহসৌন্দর্যকে। এই উপভােগের মধ্য দিয়ে যে বিশুদ্ধ আনন্দ আমি লাভ করব তা এক অপূর্ব সার্থকতা দান করবে আমাদের দুজনের জীবনকে।
কারণ আমি বিশ্বাস করি আজকের এই দেহসঙ্গমের ফলে তােমার দেহের সমস্ত নির্যাস এক সুরভিত স্মৃতি হয়ে চিরদিন মিশে থাকবে আমার আত্মার সঙ্গে। | আর আমি কোনােদিন সশরীরে আসব না তােমার কাছে, যদিও মনে মনে আমাদের দেখা হবে প্রায়ই। তােমার কর্মহীন জাগরণের শান্তমধুর অবকাশে, নিভৃত স্বপ্নের বিলাসকুঞ্জে, তােমার স্নিগ্ধগভীর হৃদয়ের তন্দ্রালস প্রদেশে দেখা হবে আমাদের মাঝে মাঝে। আর আমি কোনােদিন তােমার কাছে এ ভিক্ষা চাইব না।
সারাদিনের গৃহকর্মের পর প্রতিদিন অপরাহে কেশবিন্যাস করেন অহল্যা। কিন্তু গতকাল কেশপাশ মুক্ত থাকায় আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে। আলুলায়িতকেশ অহল্যা এতক্ষণ পুষ্পস্তবকভারে অবনত কোনাে পল্লবদলের মতাে ব্রীড়াবনত মুখে মাটির দিকে চেয়ে ইন্দ্রের কথা শুনছিলেন।
এবার ইন্দ্রের মুখপানে সকরুণ দৃষ্টিতে চাইলেন অহল্যা।
মনে মনে উৎসাহিত বােধ করলেন ইন্দ্র। বললেন, সুকেশিনি, তােমার ভ্রমরকৃষ্ণ কুন্তলরাশির মধ্যে রয়েছে রহস্যময় এক আরণ্যক কুটিলতা, ছলাে ছলাে এক তরল দুর্বলতা তােমার দৃষ্টিতে, এক উদ্ধত নিষ্ঠুরতা তােমার উত্তুঙ্গ ও কৃষ্ণবৃন্ত কুচাগ্রভাগে।
দেবরাজ ইন্দ্র যেন মায়াবিশারদ। কে জানত তার কথায় এমন যাদু আছে। কে জানত তাঁর প্রতিটি কথার নির্মম আঘাতে অহল্যার সুকোমল প্রতিটি অঙ্গের গ্রন্থি শিথিলিত হয়ে উঠবে এমন ভাবে।
অহল্যা অনুভব করলেন, ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে তার সারা দেহ। আত্মসংযমের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলছেন তিনি একে একে। | ইন্দ্র বললেন, সুন্দরী তুমি পাষাণপ্রতিমা। তােমার অঙ্গে এত রূপ, কিন্তু অন্তরে প্রাণ কোথায় ? তােমার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড আছে কিন্তু হৃদয় নেই। তা থাকলে এই সকরুণ অনুনয়ে নিশ্চয়ই তা বিগলিত হতাে।
মনে রেখাে তৃষ্ণার্ত ভিক্ষুককে জল দান করে তৃষ্ণা নিবারণ করা প্রতিটি গৃহিণীর কর্তব্য। | দেবরাজ ইন্দ্র নই আমি। তােমার রুপের তৃষ্ণায় আর্ত ও আকুল এক ভিক্ষুক আমি। আমার তৃষ্ণাকে শান্ত ও নিবৃত্ত করা তােমার ধর্ম দয়াবতী।
সতীত্বের অহঙ্কারে এই ধর্মে জলাঞ্জলি দিও না। মনে রেখাে মহীয়সী, সতীত্ব মানবহৃদয়ের একটি সামান্য গুণ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু যে ধর্ম নির্গুণ অরূপ ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত করে দেয় মানুষকে, সে ধর্ম সমস্ত রূপগুণের থেকে বড়।
ইন্দ্রকে নিয়ে ধীরে ধীরে শয়নগৃহের দিকে এগিয়ে গেলেন অহল্যা।
দেখতে দেখতে পুরাে একটি দণ্ড কেটে গেল। অহল্যা ব্যস্ত হয়ে বললেন, মহর্ষির প্রত্যাগমনের সময় উপস্থিত। আমি আপনার সাহচর্যে কৃতার্থ হয়েছি দেবরাজ। এবার আপনি যান। এবার মহর্ষির কোপবহুি থেকে আমাকে ও নিজেকে বাঁচান।
কিন্তু ঘর হতে বেরিয়ে বেশিদূরে যেতে পারলেন না দেবরাজ ইন্দ্র। সহসা মহর্ষি গৌতমকে সামনে উপস্থিত দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন ভয়ে।
এদিকে গৌতমের কণ্ঠস্বর শুনে ব্যস্ত ও শশব্যস্ত হয়ে শয়নগৃহ হতে বেরিয়ে এলেন অহল্যা। একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অহল্যার পানে চেয়েই তার সারা অঙ্গে শৃঙ্গারলক্ষণ দেখতে পেলেন মহর্ষি।
অহল্যার অঙ্গের বসন তখন বিস্ত। কণ্ঠের বকুলমালা ছিন্ন ভিন্ন। নির্মম নখচিহ্ন তার কুচযুগের উপর। কপােলফলকের উপর নিবিড়তম চুম্বনের এক নির্ভুল অভিজ্ঞান।
আগুনের মতাে জ্বলতে লাগলেন মহর্ষি গৌতম। ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেলেন ইন্দ্র ও অহল্যা দুজনেই।
রােষকষায়িত দৃষ্টিতে ইন্দ্রের দিকে চেয়ে অভিশাপ দিলেন মহর্ষি। যে পুরুষত্বের দ্বারা অপরের ধর্মপত্নীকে ধর্ষণ করেছ তুমি, এখনি অঙ্গচ্যুত হবে তােমার সে পুরুষত্ব।
কাতরকণ্ঠে ইন্দ্র বললেন, যত ইচ্ছা আমায় অভিশাপ দিন মহর্ষি। কিন্তু অহল্যার কোনাে দোষ নেই। কারণ আমিই তাকে এ কর্মে প্ররােচিত করেছি।
বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে মহর্ষি বললেন, যে-কোনাে কারণেই হােক, যে নারী এই সব পাপকর্মে জড়িয়ে থাকে অর্ধপাপ তার মধ্যে সঞ্চারিত হবেই।
তারপর অহল্যার পানে চেয়ে অভিশাপ দিলেন। সুরাসুরের দুর্নিরীক্ষ্য ও বায়ুভুক হয়ে সহস্র বৎসর তপস্যা করতে হবে তােমায় এই শূন্য তপােবনে। তারপর বিষ্ণুর অবতার রামের স্পর্শে পাপমুক্ত হয়ে আবার মিলিত হবে আমার সঙ্গে।
এই বলে কালবিলম্ব না করে দূর হিমালয়ে নূতন করে তপস্যা শুরু করতে চলে গেলেন মহর্ষি গৌতম।
দেখতে দেখতে বেদনাবিহুল ও হতবাক দেবরাজের দৃষ্টির সীমা হতে মুহূর্তে ধূমপরিবৃত এক দীপ্তশিখার মধ্যে নিঃশেষে বিলীন হয়ে গেল অতুলনীয়া অহল্যার অনঙ্গবিমােহন রুপাবয়ব।