অবচেতন – সমরেশ বসু

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

…….মেয়েটি হেসে উঠেছিল আবার। বলেছিল, ‘এতে জানাজানির আর কী আছে। এ এমন কী আর হাতী ঘােড়া ব্যাপার।’ বলে মেয়েটি ঘরের উজ্জ্বল আলােয় নিজেকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘এই তাে দেখুন না, এই সব দাগ, এরকম রং, শরীরের এসব জায়গায় কখনাে অবিবাহিত মেয়েদের দেখতে পাবেন না। ছেলেপিলে না হলে এ রকম চামড়ায় ফাটা ফাটা দাগ দেখা যায় না। বুকের চেহারা আর রঙও এরকম হয় না। আজকাল তাে শুনতে পাই, বইয়েতেও এসব অনেক লেখা থাকে। পড়ে দেখেননি?…….

…..মেয়েটি তার শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশ অবলীলাক্রমে আমাকে খুলে দেখিয়েছিল। এবং সে মিথ্যে বলেনি, নিশ্চয়ই সে জানত, ওসব বিষয় আজকাল নানান ভাবে লেখা হয়, সেসব বই প্রচুর বিক্রীও হয়। কিন্তু আমি কখনাে তা খুলে দেখিনি। সেকস সম্পর্কে নাকি সকলেরই সাধারণ কৌতুহল থাকে। সত্যি বলতে কি, আমি তা কখনাে অনুভব করিনি। তার কারণ সম্ভবতঃ এই, যৌন বিষয়ে সকলের মনের মধ্যে যে একটা নিবিড় আকুলতা আছে, ভয় আছে, এবং নারীর দেহ-যৌবন বা প্রেম ও বিবাহিত জীবন সম্পর্কে পরম কৌতুহল আছে, আমার তা নেই।….

……হেসে মেয়েটি বলেছিল, ‘আপনি একেবারে হাতে কলমেই সব জানতে চান, এই তো ? বলতে বলতে মেয়েটি আরাে রঙ্গিনী হয়ে উঠেছিল। এর থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হতে পারে মেয়েটি কামনায় উদ্বেল হয়ে উঠেছে। আমার অভিজ্ঞতা অবিশ্যি তা বলে না। বরং হয়তাে একেবারেই বিপরীত। তাড়াতাড়ি ছুটি চাইছিল বলে হয়তাে, আমাকে উত্তপ্ত করার নিতান্ত যান্ত্রিক ভঙ্গিগুলাে সে প্রয়ােগ করছিল। এবং সন্দেহ নেই, আমার নিশির ডাকের যে ঘাের, তা ক্রমেই আমার মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করছিল, তার কেন্দ্র থেকে। সে আমার স্নায়ু ও ইন্দ্রিয়সমূহে, একমাত্র উদ্দেশ্যসাধনের জন্যে, আগুনের প্রবাহ বইয়ে দিচ্ছিল ।

তাছাড়া, এই মেয়েটির প্রতি আমি যেন অনেকটা কৃতজ্ঞতাও বােধ করছিলাম। না, শরীর খেলাটা এখানে কোনাে নতুন ব্যাপার নয়। না খেলাটাই নতুন, বৈচিত্র্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু এ মেয়েটি যেভাবে, আমার মত একজন প্রৌঢ় বয়স্ক লােককে, তার অনভিজ্ঞ চোখের কাছে, বিশেষ ভাবে মেলে ধরেছিল, এমনটা সচরাচর ঘটে না। ও যেন একটি অনভিজ্ঞ শিশুকে জ্ঞান দেবার জন্যে, বইয়ের পাতা খুলে দেখাবার মত, নিজেকে দেখিয়ে দিয়েছিল।……

……মেয়েটি তার কালাে বড় বড় চোখের তারা মেলে আমার দিকে তাকিয়েছিল, অথচ স্বাভাবিক ভাবে যা হয়ে থাকে, দু একবার ছেলেদের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই, চোখ ফিরিয়ে নেয়, মেয়েটি সে ভাবে চোখ ফিরিয়ে নেয়নি। নেয়নি তাে বটেই, বরং আমার মনে হয়েছিল, সে যেন আমাকে কিছু বলবে। এই ধারণা হওয়াতেই আমার কৌতূহল একটু বেড়েছিল। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিলাম, তার গায়ে একটি জামা রয়েছে, অনেকটা হিন্দুস্থানী কঁচুলি ধরনের, যা তাব কোমর ও পেটের একটা অংশ মুক্ত রেখেছিল। কিন্তু সে ঘুরিয়ে, কুঁচিয়ে শাড়ি পরেনি, নিতান্ত বাংলা ধরনেরই সাদাসিধে ভাবে কাপড়টা পরা ছিল। বুকের একটা অংশ থেকে তার শাড়ি সরানাে ছিল, এবং এখন স্বীকার করতে কোনাে বাধা নেই, তার উদ্ধত যৌবন যেন গাঢ় বর্ণের কঁচুলির ওপর দিয়ে একটা দুর্বিনীত ভাব প্রকাশ করছিল। দুর্বিনীত বলতে আমি ঠিক কথাটা বােঝাতে পারলাম কি না জানি না। বােধহয়, এই বলতে চাইছি, তার যৌবন যেন কাচুলিতে অধবা হয়ে উঠতে চাইছিল, একটা বেআব্রু ধরনের প্রকট বলে বােধ হচ্ছিল। শুধু বুক নয়, তার সর্বাঙ্গের প্রতিটি বিভাগেই যেন তা ফুটে উঠছিল।……..

……আমি বুঝতে পারিনি। মেয়েটি হেসে, তার বুকের কাঁচুলির ওপরে শাড়ি তুলে দিয়েছিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার তা সরে গিয়েছিল, এবং আমার যেন স্পষ্টই তখন মনে হয়েছিল, মেয়েটি ঘাড় নেড়ে আমাকে যেন কিছু একটা ইশারা করল। আমার একবারও মনে হয়নি, এরকম একটা ঘটনা অস্বাভাবিক। আমি যেন কেমন এক রকম সম্মােহিত হয়ে পড়ছিলাম, আমার বুকের ভিতরে অদ্ভুত একটা দাপাদাপি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মুহুর্ত আমি কিছুই স্থির করতে পারিনি। মেয়েটি একটু নড়ে উঠেছিল সহসা, যেন চলে যাবে এমনি একটা ভঙ্গি করেই, একটা পা ওপরের সিড়িতে রেখেছিল। কিন্তু সে যায়নি। তার দাড়াবার ভঙ্গিটা একটা অন্য রূপ নিয়েছিল। স্বভাবতই তার কোমর একটু বেঁকে উঠেছিল, প্রশস্ত নিতম্বে শাড়ি টান টান হয়ে উঠেছিল, যে কারণে, তার অবয়বের মধ্যে যে একটি প্রায় নির্লজ্জ যৌবনের উচ্চাস ফেটে পড়ছিল, তা আরাে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।…….

…….আমি কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। আমার রক্তের শিরায় একটা প্রবাহ। গলা শুকিয়ে উঠছিল। চলে যাওয়াই উচিত ছিল, তবু আমি জিজ্ঞেস কবেছিলাম, আপনাদের বাড়ি কোথায় ?

সে একদিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল, যা থেকে কিছুই ঠিক বােঝা যায়নি। যেন কোনাে রহস্যেব ইঙ্গিতে আঙুল দেখাতে গিয়ে, তার শরীবের ভঙ্গি আর এক রূপে বিচিত্র হয়ে উঠেছিল। তখন দেখেছিলাম, তার কাঁচুলির হাতা কাধেই শেষ, এবং সেখান থেকে তার পুষ্ট ডানা দুটি নিটোল নেমে এসেছে, আমি অস্পষ্টভাবে হলেও তার স্বল্প রােমশ কুক্ষিতল (বগল) দেখতে পেয়েছিলাম।……

…..পাত্রে সরবত ছিল ঠিকই, কিন্তু সিদ্ধির সরবত। তখন আমার সেসব কথা মনে হয়নি, যদিচ সিদ্ধির স্বাদ আমার জানা ছিল, তার আগেও আমি সিদ্ধি খেয়েছি। সে যখন আমার সামনে দাড়িয়ে আমার ঠোটে তার আঙুল স্পর্শ করে প্যাড়া খাওয়াচ্ছিল, তখন তার উদ্ধত বক্ষদেশ নিশ্বাসের তালে, আমার খুব কাছেই ওঠানামা করছিল। আমি তার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলাম না। সে যেন তা বুঝতে পেরেই, তার নিজের মুগ্ধতাও প্রকাশ করার জন্যে, কখনাে এদিকে, কখনাে ওদিকে ঘাড় কাত করে, চোখের কোণ দিয়ে আমাকে নিবিড় ভাবে দেখছিল। সে এমন করে দেখছিল, এবং শুধু দেখার ভিতর দিয়েই যে মানুষের রক্তে একটা প্লাবন সৃষ্টি হতে পারে, আগে তা জানা ছিল না।……

…….মত্ত পুরুষের মধ্যে তখন যা-কিছু ঘটে, সবই আমার মধ্যে ঘটছিল। সে দাড়িয়ে পড়াতে আমি খাট থেকে নেমে এসেছিলাম, তার সামনে গিয়ে দাড়িয়েছিলাম। সে তার একটা হাত আমার বুকে তুলে দিয়েছিল। আমি তাকে দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করেছিলাম। করতেই সে এমন নিবিড় ভাবে আমাকেও জড়িয়ে বলেছিল, আমার সর্বদেহে এক বিচিত্র তরঙ্গ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। মানুষকে জীবধর্মের কিছুই শেখাতে হয় না, যা চির অকল্পিত ছিল, আমি তাকে চুম্বন করেছিলাম। সে যেন আমার মত্ততায় অত্যন্ত আমোদ বােধ করে হেসে উঠেছিল, আমার হাত ধরে খাটের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তারপরে ঈষং আলােয়, তাকে আমি সম্পূর্ণ নগ্ন দেখেছিলাম, যা আগুনের চেয়েও উজ্জ্বল ও তীব্র, যে আগুনে আমি নিজেকে, পতঙ্গের মত থর থর করে কাঁপতে দেখেছিলাম। তথাপি আমি থমকে রইলাম। আমার ভিতরে যেন হাজার কড়ানাকাড়া বাজতে লাগল । আহার মৈথুনাদি সকলই জীবধম বটে। মানুষের বেলায় তার প্রকাশটা, জীবজগতের সঙ্গে পুরােপুরি বােধহয় মেলে না। আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অথচ যা করনীয়, সেটা যেন আমার ভিতরে রূপ পাচ্ছিল। সে আমাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে, তার শরীরের ওপর টেনে নিয়েছিল। আমি তাকে বারে বারে চুম্বন করেছিলাম। সে আমাকে তার প্রতিদান দিয়েছিল।…….

………আমি মেজ-বউদিকে চুম্বন করেছিলাম। | মেজ-বউদির ঠোটে চুম্বন করেই ভেবেছিলাম, একটা ভয়ংকর ধিক্কার এবং প্রতিবাদ উঠবে। কিন্তু কিছুই ওঠেনি। মেজ-বউদি যেন আমার শরীরের মধ্যে আরাে নিবিড় হয়ে এসেছিল। আমি আশ্লেষ চুম্বনে, তাকে আরাে গভীরভাবে আলিঙ্গন করেছিলাম। কিছু হয়ত বলেও ছিলাম। কী বলেছিলাম, কিছুই মনে করতে পারি না।

মুহূর্তের মধ্যেই, কী ঘটে গিয়েছিল জানি না। কান্নাকাটি মানঅভিমানের মধ্যে, আমরা দুজনেই অন্য এক অনুভূতির জগতে চলে গিয়েছিলাম। আমরা পরস্পরকে সমানভাবে আলিঙ্গন করেছিলাম। মেজ-বউদি যেন সমস্ত ব্যাপারটাকে নিবিড় এবং সহজ করে তুলেছিল। বিস্ময় প্রতিবাদ কিছুই ছিল না। যেন সমস্ত ঘটনার একটা স্বাভাবিক পরিণতি ঘটেছিল, এবং নিয়তির অমােঘ সংকেতেই, আমরা ঘরের মধ্যে, খাটের বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

দেখাে সাহিত্যিক, এ ঘটনাকে যেন কোনাে প্রেমের ঘটনা মনে করাে না। ভালবাসা প্রেম কাকে বলে, আমি জানি না, বিশেষতঃ স্ত্রী-পুরুষের প্রেম ভালবাসা। আমি শুধু দেহ-ই জানি, দেহেরই পুজারী, এবং তা বিবাহিতা নারী অথবা বেশ্যার। মন নিয়ে তােমার কারবার। অতএব বুঝতেই পারছ, মেজ-বউদি যেহেতু বারােবধু নয়, সেইহেতু, আমার কাছে তার দাবীও বেশী ছিল। সেই দাবীর খােয়ারি কাটাতে আমার বহুকাল লেগেছিল। কারণ মেজ-বউদির কাছে সেটা ছিল প্রেম। আমার কাছে দেহের গ্রাসের ক্ষুধা মেটানাে।……..

Leave a Reply