অন্ধকারে আলাের রেখা – সমরেশ বসু

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  ›› ১৮+  

……..এই কারণে, পঞ্চ ‘ম’ কারের যেটি শেষ ও প্রধান ক্রিয়া মৈথুন, যাকে তারা বলে থাকেন, “শিব স্বরূপ সাধকের সঙ্গে শিবস্বরূপিনী সাধিকার সংযােগ” শুধু তারই সাক্ষী ছিলাম না। সেই উজ্জ্বল প্রভাময়ী কুমারী সাধিকা যিনি দীক্ষান্তে, নিজেকে পূর্ণ অভিষেকের জন্য কঠিন সাধনার দ্বারা প্রস্তুত করেছিলেন, এক উজ্জ্বলকান্তি যুবাপুরুষ সাধকের সঙ্গে, সেই চক্রে তাদের মিলন প্রত্যক্ষ করেছিলাম। অবিশ্যি সেই চক্রে, সেই সাধক তান্ত্রিক পুরুষ এবং তাঁর সাধন সঙ্গিনীর অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, তিনি যেন চক্রটিকে পরিচালনা করছিলেন, এবং তার নবীন শিষ্যশিষ্যর পরীক্ষা নিচ্ছিলেন।……

………আমাদের পূজা যে তন্ত্রমতে হয়, তার আর একটি হলাে, পঞ্চতত্ব দ্বারা এই পূজা হয়। পঞ্চতত্ব হলো, মদ, মাংস, মাছ, মুদ্রা, মৈথুন। এখন তুমি যদি ভাবাে, পূজায় বাস্তবে সবই ব্যবহার করা হচ্ছে, তা হলে ভুল হবে। মদ অবিশ্যিই রয়েছে, কিন্তু বলির আগে মাংসের অনুকল্প হলো লবণ আদা জাফরান তিল গম মাষকলাই আর রসুন। সিদ্ধি আর ছােলা বেটে মাছের আকারের বড়া হলো মৎস্য, মুদ্রা হলো। ঘিয়ে ভাজা অন্ন । এর পরে মৈথুন। রক্তকরবী ফুল হলো লিঙ্গ পুষ্প, নীল অপরাজিতা যােনিপুষ্প ! দুইয়ের মিলনে মৈথুন, আর এক্ষেত্রে চন্দনকে বীর্য আর কুঙ্কুমকে রজঃ রূপে মেলাতে হবে। এইভাবে মৈথুন ভাবনা করে দেবীকে পূজা দেওয়া হবে। এই হলাে তন্ত্রমতে পূজা। কিছু বুঝলে?”………

……….সঁওতাল রমণী পুরুষরা ক্রমেই সুরাপানে মত্ত হয়ে উঠছিল, আর গ্রামের পথে পথে, পূজাবাড়িগুলাের মণ্ডপ প্রাঙ্গণে, এমন কি ভিতর বাড়ির উঠোনেও মাদল বাজিয়ে নেচে গান গাইতে আরম্ভ করেছিল। আমি তাদের গানের ভাষা বুঝতে পারছিলাম না। তারা যে আদিম উল্লাসে মত্ত, এবং নাচের ছন্দ ভেঙে মেয়ে পুরুষ। জড়াজড়ি করছিল, তা দেখতে পাচ্ছিলাম।……..

………বেলা পড়ে আসতেই, সমস্ত কালী প্রতিমাগুলাে বিসর্জনের জন্য, নদীর ধারে মৌলীক্ষা দেবীর মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এবং ঢাকের বাজনার তালে তালে প্রতিমা নিয়ে সারা মাঠে ঘুরে ঘুরে নাচ চলছিল। তার মধ্যেই মাঠ জুড়ে সহস্রাধিক সঁওতাল রমণী পুরুষের নাচ গান চলছিল। তারপরেই একটা অভাবিত দৃশ্য আমার চোখে পড়েছিল। দেখেছিলাম সঁওতাল রমণী পুরুষ জোড়ায় জোড়ায় ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে মৈথুন ক্রিয়ায় রত। অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমার চোখের সামনে আমি এক গণ-মৈথুনের জীবন্ত চিত্র দেখছিলাম। অন্ধকার নামার সঙ্গে এ ঘটনা যেন তাদের মধ্যে সংক্রামিত হয়ে যাচ্ছিল।

আমি জানি না, মহাশক্তির জো, বলি, রক্ত, তন্ত্র আর সেই গণমৈথুনের সঙ্গে আদিম কালের উর্বরাশক্তি বিশ্বাসের কোনাে যােগাযােগ ছিল কী না। সেই ভাবে স্বাধীন বাছাই করা জুটির সঙ্গে পরস্পরের মিলনের পরিণতি সম্পর্কে আমার বন্ধু জানিয়েছিল, সাঁওতালদের গাঁও বুড়া বা নেতৃস্থানীয় লােকেরা নাকি সকলের প্রতিই নজর রেখেছিল এবং অবিবাহিত জুটিদের মধ্যে ভবিষ্যতে বিয়ে হবে। কিন্তু বিবাহিত নরনারীদের কী গতি ? তারা তাে স্বামী স্ত্রী বেছে একত্রে কিছু করেনি। সেই উদ্দাম উন্মত্ত পরিবেশে তা সম্ভবও ছিল না।

তার কোনাে জবাব আমি পাইনি। কামাখ্যার প্রাণতােষবাবাকে আমি উক্ত ঘটনা বলেছিলাম। জবাবে উনি বলেছিলেন, “মৈথুনকে আমরা বলি পঞ্চমতত্ত্ব, তার সঙ্গে যােগ সাধনা আছে। বীরভমের সেই অঞ্চলের সাঁওতালরা হয় তাে তাদের বিশেষ কোন অনুষ্ঠানের দিন হিসাবে, কালীজার বিসর্জনের দিনটিকে বেছে নিয়েছে।……….

…..লিঙ্গমূল পর্যন্ত একটি সরলরেখা টেনেছিলেন, এবং সেই সরলরেখাটিকে মাঝখানে রেখে, একটি ত্রিকোণ রেখা একে বলেছিলেন, “এই এই যােনিরূপ ত্রিকোণের বাঁয়ে ইড়া, ডাইনে পিঙ্গলা, মাঝখানে সুষুম্না।…….

……..বাবা হেসে বলেছিলেন, “সাধনার অনুভূতি নয়। তবু এ ভাবটি তাের ধারণা করতে সাহায্য করবে। এখন এই যে যােনিরূপ ত্রিকোণ মধ্যে, সুষুম্নর গভীরে কুণ্ডলিনী আছেন, এখানে আছে কামবীজ, আর এই কামবীজের ওপরেই রয়েছেন স্বয়ম্ভুলিঙ্গ। এই স্বয়ম্ভুলিঙ্গের মুখে, কুণ্ডলিনী নিজের মুখ দিয়ে চুম্বন করে, তাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। উভয়েই সুপ্ত। সাধকের কাজ হচ্ছে, এই কুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে তোলা।…….

……..প্রাণতোষবাবা বলেছিলেন, ‘পবিত্র মায়ের সেই অধিকার আছে। এমনকি তিনি এখন স্ত্রীগুরুও হতে পারেন। এটা খুবই বিরল ব্যাপার, তবু আমাদের মধ্যে স্ত্রী গুরুর কাছ থেকেও দীক্ষালাভ করা যায়। যাই হােক আমাদের বীরাচারী তন্ত্র মতে পঞ্চ ‘ম’ কার আবশ্যিক । মদ্য পান, মাংস মৎস্য মুদ্রা, খাওয়া আর শেষে মৈথুন। তন্ত্র মতে প্রকৃতি মিলন হলাে যৌন মিলন, অথাৎ পঞ্চম ‘ম’ কার। কিন্তু এ মিলন বংশ রক্ষার্থে না। একে বলা যায় যৌন-যােগ মিলন। এর মধ্যে আলিঙ্গন, চুম্বন স্তন-মর্দন, দর্শন, স্পৰ্শন, যােনিবিকাশ, লিঙ্গ ঘর্ষণ, প্রবেশ, আর স্থাপন, এগুলােকে আমরা বলি পুষ্প। অর্থাৎ পূজারই নয়টি ফুল। এর সঙ্গেই আছে, রেচক, পূরক, কুম্ভক, জপ আর মন্ত্র। সেই জন্যই যৌনযােগ মিলন, আর এই মিলনের মধ্য দিয়েই, কুণ্ডলিনীকে সহস্ৰারে তুলে পরম শিবের সঙ্গে মিলন ঘটানাে হয়। সহস্ৰারে এই যে শিব শক্তির মিলন, সেই সময়ে সাধক সাধিকার অনুভূতির কথা ভাষা দিয়ে বােঝানাে যায় না। এখন তাের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, আমাদের এই মিলনে কি বীর্যপাত ঘটে না?”

আমি বলেছিলাম, “আজ্ঞে হ্যা, ঠিক তাই।”

প্রাণতােষবাবা বলেছিলেন, “ঘটে, কিন্তু সেটা আমাদের যােগ ক্ষমতা ও ইচ্ছাধীন। সহস্রারে যে শিব শক্তির মিলন ঘটছে, সেই অনুভূতিতে আমরা চিদানন্দস্বরূপ থাকি, তারপরে একটি বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণ করে, শুক্র ত্যাগ করি। তা বলে, তুই যদি মনে করিস, এই ঋলন মানেই, সবই অশক্ত আর শিথিল হয়ে পড়লাে, তা হলে ভুল হবে। কুণ্ডলিনীকে যেভাবে চক্রভেদ করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই ভাবেই ধাপে ধাপে তাকে তার জায়গায় নামিয়ে আনতে হবে।”………..

……..তার আগে বলে রাখি, আসলে এ সাধনা ভােগ মােক্ষ। আমরা যখন মিলনের মধ্যে সুষুম্নার পথে কুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে তুলি তখন বলি, ‘আমাদের ইন্দ্রিয়বৃত্তি সকলকে আহুতি দিচ্ছি। এখন তাের কথার জবাবে বলছি, ঋতুযুক্তলতামধ্যে সাধয়ােদ্বিধিবদা। অর্থাৎ ঋতুমতী শক্তির সঙ্গে মিলন। এ অবস্থায় সন্তানের জন্ম সম্ভব নয়, এটা সবাই জানে। অবিশ্যি ঋতুযুক্তলতা বলতে, যে কয়দিন নারী রজঃস্বলা থাকবে, সেই কদিনই বােঝানো হচ্ছে না। ঋতুস্রাবের মধ্যে, এবং আগে ও পরের কয়েকটি দিনও বােঝায়। এই মিলনকে আমরা বলি ‘ভাণ্ডের সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের’ মিলন। এত কথা শুনে কোনো ধারণা করতে পারলি কি ?”

আমি তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিলাম। তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তাের জননেন্দ্ৰিয়র সঙ্গে প্রথম কবে নারীর জননেন্দ্ৰিয়র স্পর্শ ঘটেছিল ?”

আমি লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম, “আজ্ঞে, আমার জীবনে অল্প বয়সেই নারী সংযােগ ঘটেছিল।”

তিনি হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তবু শুনি, সেই বয়সটা কত ?” বলেছিলাম, “আজ্ঞে কৈশােরেই অবৈধভাবে এক আত্মীয়ার—

“ইডিয়ট !” তিনি ধমক দিয়ে বলে উঠেছিলেন, “তাের ওসব কৈশোের বৈধ অবৈধ সংযােগের কথা শুনতে চাইনি। ভেবে দ্যাখ, জন্ম লগ্নেই মাতৃযােনির সঙ্গে তাের অঙ্গের স্পর্শ হয়েছিল। তাই নয় কি?”…….

…….পটের বিষয়, দিগম্বরী কালী, দিগম্বর শিবের বস্তিদেশের দু পাশে দু পা ছড়িয়ে বসে আছেন। সেই কালী চতুভূজা নন, দ্বিভূজা, কিন্তু জিভ কেটেছেন।…….

…….প্রাণতােষবাবা বলেছিলেন, “মায়ের ঘরের পটের কথা মায়ের সামনে বলতে লজ্জা কী? কালীর ওই মূর্তির নাম ‘বিপরীতরতাতুরা। রতিক্রীড়ায় পুরুষের ওপরে নারী যখন ক্রিয়াশীলা, তাকে বলে বিরপীত রতিবিহার। আমরা বলি, শবরূপী শিবের ওপর শক্তিরূপিণী কালী আসীনা। শিবকে জাগিয়ে তুলছেন। অথবা, যেহেতু শিৰ শক্তি এক আর অভিন্ন, এক্ষেত্রে কালী স্বেচ্ছায় সানন্দে সৃষ্টিকর্মে ব্যাপৃত। দেবীর এটি সক্রিয় ভূমিকা। আরাে স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, মহাদেবী পুরুষকে অধেদেশে রেখে রমণ করছেন। কিছু বােঝা গেল ?”………

………..অমাবস্যার সেই দিনটি এসেছিল। এখানে কয়েকটি প্রয়ােজনীয় কথা বলে নেওয়া দরকার : প্রাণতােষবাবা আমাকে বলেছিলেন, কথার প্রকৃত নাম কামপীঠ। দেবীর মহামুদ্রা বা যােনি এখানে পতিত হয়েছিল। এর আর এক নাম কামগিরি। আশ্রমে চালা ঘরে একটি আলাদা মন্দির ছিল। সেখানে মাটির মাতঙ্গী মূর্তি ছিল। মূর্তিটি দ্বিভুজা, পীনপয়ােধরা শ্যামা, নাভিস্থলে ত্রিবলী, নিম্নাঙ্গ রত্নালংকারে আবৃত। হাতে ও গলায় নানা অলংকার, কিন্তু নরমুণ্ডের মালা ছিল না, জিভও বাইরে ছিল না। শিবরূপী শবের ওপর আসীন। ইনি যােড়শী, এবং এর পীঠস্থানও কামাখ্যায় অবস্থিত।……

……….অতঃপর প্রাণতোষবাবা এবং যােগেশ্নর পবিত্ৰীমা ও জগতের পায়ের কাছে নতজানু হয়ে, তাঁদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন। আমাদের সামাজিক ক্ষেত্রে যা অসম্ভব। কিন্তু পবিত্রীমা বা জগতের কোনাে বিকার ঘটেনি, তারা দুজনেই ঠোট নেড়ে যেন কিছু বলেছিলেন। হয়তো বা মন্ত্রোচ্চারণ করেছিলেন। তারপরেই হতবাক বিস্ময়ে দেখেছিলাম, তারা দুজনেই বিবস্ত্র হয়েছিলেন। প্রাণতােষবাবা এবং যােগেস্বরও না হয়েছিলেন, এবং ফুল ও মালার পাত্র, সিদ্রের পাত্র, রক্ত চন্দনের পাত্র সামনে টেনে নিয়েছিলেন।

আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, দৃশ্যটি আমি দেখছি। ঘরের আলাে যতই ক্ষীণ হোক, দুই জোড়া রমণী পুরুষের উজ্জ্বল দৃঢ় শরীর আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রাণতােষবাবা ও যােগেশ্বর দুটি ক্ষুদ্র সরু কাটিতে সিন্দুর লাগিয়ে, পবিত্রীমা ও জগতের কপালে ত্রিকোণ রেখা এঁকেছিলেন। রক্তচন্দন নিয়ে উভয়ের পীনস্তনে লেপন করেছিলেন। উভয়ের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন ফুলের মালা। তারপরে দুই সাধক দুই সাধিকার নাভি থেকে, বস্তিদেশে, যােনিতে, এবং প্রথমে ডান পা ও পরে বাঁ পর্যন্ত, হাতের বিভিন্ন মুদ্রার দ্বারা স্পর্শ করেছিলেন। সেই রকম ভাবেই, আবার স্তনদ্বয় থেকে নাভি, এবং মাথা থেকে স্তনদ্বয় পর্যন্ত আঙুলের বিভিন্ন মুদ্রা দ্বারা স্পর্শ করেছিলেন। আবার ডান পা থেকে মাথার ডান দিক পর্যন্ত, এবং বাঁ পা থেকে মাথার বাঁ দিক পর্যন্ত, শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করে যেন কিছু জপ করেছিলেন। জপ বলছি কারণ এই কাজটিতে অনেকটা সময় কেটেছিল । তারপরে কেবল যােনিদেশে, ডাইনে বাঁয়ে, মধ্যখানে, দুই হাতের স্পর্শে খানিকটা সময় নিয়ে জপ করেছিলেন । জপের কথা কিছুই শােনা যাচ্ছিল না, কেবল মাঝে মাঝে মন্ত্রের | দু একটি দুর্বোধ্য শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

ইতিমধ্যেই সাধকদয়ের পুরুষাঙ্গ উস্থিত হয়েছিল। তারা জল ও চন্দন দিয়ে দুজনে নিজেদের সেই বিশেষ অঙ্গের পুজা করেছিলেন, এবং স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিলাম, তার উচ্চারণ করেছিলেন, “ওঁ নমঃ শিবায়ঃ”। তারপরে আবার দুই “শক্তি”র মাথায় কপালে স্তনে যােনিতে ও পায়ে ফল ও চন্দন স্পর্শ করে পূজা করেছিলেন। প্রদীপ এবং সুগন্ধ ধূপ দিয়ে তাদের আরতি করেছিলেন।

ইতিমধ্যে আবার বাইরে শৃগাল ডেকে উঠেছিল। আবছা পীত আলােয় পাঁচটি নরকরােটিকে জীবন্ত আর সহাস্য দেখাচ্ছিল। আমি কম্বল গায়ে না দিয়েও ঘামছিলাম। অথচ সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার আকস্মিকতায় আমি যেন জড়বৎ হয়ে গিয়েছিলাম। জানি না, আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে আদৌ তারা সচেতন ছিলেন কী না, অথবা আমাকে মনুষ্যপদবাচ্য জ্ঞান করছিলেন কী না। | প্রাণতােষবাবা সেই পিতলের পানের কৌটোর ঢাকনা খুলে, পানের খিলি পবিত্রীমায়ের মুখে পুরে দিয়েছিলেন। পবিত্ৰীমাও প্রাণতােষবাবার মুখে পানের খিলি পুরে দিয়েছিলেন। যােগেশ্বর ও জগতও একইভাবে পরস্পরকে পানের খিলি মুখে দিয়েছিলেন। তারপর দুই পুরুষ দুই প্রকৃতির দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, “মা, তমার মােক্ষলাভ হােক, তুমি অনুমতি দাও।”

দুই “শক্তি” দুই ‘শিব” কে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেছিলেন। দুই সাধক, দুই সাধিকাকে গভীর আলিঙ্গনে পিষ্ট করেছিলেন, এবং কোলে নিয়ে আসনে বসেছিলেন। শুরু হয়েছিল কামকলার নানা শৃঙ্গার চুম্বন, আলিঙ্গন, বিভিন্ন অঙ্গে পরস্পরের মর্দন, চোষণ, ঘর্ষণ। সেই মুহূর্তে আমার একবার প্রাণতােষবাবার একটি কথা মনে পড়েছিল, “ঋতুযুক্তলতা মধ্যে…”। কিন্তু আমার পক্ষে বােঝা সম্ভব ছিল না, সাধিকারা ঋতুমতী ছিলেন কী না। সেই সময়ে সাধকদ্বয়, সাধিকাদের “দেবী, দেবেশী, শিবানী” ইত্যাদি নামে সম্বােধন করেছিলেন। | কিছুকাল সেইভাবে নানা শৃঙ্গারের পরে সাধকদ্বয় মন্ত্রোচ্চারণ করে সাধিকাদের সঙ্গে মৈথুনে রত হয়েছিলেন। তখন নানা রকমের শীৎকার, হুংকার গভীর ও দীর্ঘ নিশ্বাস টানার শব্দ হচ্ছিল। সে নিশ্বাস সাধারণ নিশ্বাস গ্রহণের ন্যায় ছিল না, বিশেষ শব্দ করে যে ভাবে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন, তা পূরক বলেই আমার মনে হয়েছিল তারপরে কিছুক্ষণ স্তব্ধতা, যাকে কুম্ভক বলা যায় তারপরেই রেচক। রেচকের পরেই মৈথুনের তীব্রতা বাড়ছিল, এবং মাঝে মাঝেই পূরক কুম্ভক রেচক করা চলছিল। মাঝে মাঝে সাধক সাধিকার মুখের দিকে তাপলক চোখে দেখছিলেন, তখন কুম্ভকের মতো নিশ্বাস বন্ধ থাকছিল, এবং তারপরেই উভয়ে হেসে উঠে আবার অঙ্গ চালনা করছিলেন।

আমি সেই সময় বিবাহিত ছিলাম, কিন্তু সঙ্গমক্রিয়ার ঐরকম ভাবের কোনাে ধারণা ছিল না। সাধক পুরুষরা যেন বীর বিক্রমে পূরক কুম্ভক রেচক সহযােগে, মৈথুনক্রিয়ার ভিতর দিয়ে একটা কঠোর সংগ্রাম করছিলেন। সাধারণ রমণী বা পুরুষের সেই প্রাথমিক ক্রিয়াকালের মধ্যেই পর্যুদস্ত হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু পবিত্রীমা বা জগৎ পর্যদস্ত হওয়া দূরের কথা, মনে হয়েছিল, তারাও যেন সাধক পুরুষদের মতাে সাধন সংগ্রামের অংশভাগিনী হয়ে পড়েছিলেন। শীৎকার ও নানা প্রকারের শব্দ তাদের গলায়ও শােনা যাচ্ছিল। প্রাণতােষবাবার কুণ্ডলিনী জাগরণ ও তাকে উধ্বগামিনী করার কথা আমার মনে পড়েছিল। তারা কি কুণ্ডলিনীকে উধ্বগামিনী করছিলেন। যােগ মৈথুনের দ্বারাই তা সম্ভব। প্রাণতোষবাবা ও যােগেশ্বর যেন মাঝে মাঝে মন্ত্রোচ্চারণ ও করছিলেন। কতক্ষণ সেইভাবে কেটেছিল জানি না, আমার হাতে ঘড়ি ছিল না। যদি থাকতাে, দেখবার মতাে মনের অবস্থা ছিল না।

এক সময়ে দুই সাধকই অঙ্গ চালনায় বিরত হয়ে, মৈথুনরত অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় সােজা হয়ে বসেছিলেন। সাধিকাদ্বয় দু পা দিয়ে সাধকদের কোমর বেষ্টন করেছিলেন। আর সাধক দুজন যেন নিশ্বাস বন্ধ করে, দুই হাতের বিশেষ মুদ্রায় সাধিকা দুজনের যােনিদেশে স্পর্শ করে কিছু জপ করছিলেন। অথবা কেবল নিশ্বাস বন্ধ না করে পুরক কুম্ভক ও রেচক করছিলেন। সাধিকা দুজন যে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তা মনে হয়নি তাদের মৃদু শীৎকার শব্দের মধ্যে, শরীরের পেশী আকুঞ্চিত হচ্ছিল, এবং তারাও যেন পুরক কুম্ভক রেচক করছিলেন। ব্যাপারটা কী ঘটছিল আমি বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, তাদের ক্রিয়ানুষ্ঠান বােধহয় শেষ হয়ে এলাে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে পুনরায় আরও তীব্র বেগে মৈথুনক্রিয়ার অঙ্গচালনা শুরু হয়েছিল। তার সঙ্গে শীৎকার হুংকার অদ্ভুত সব শব্দ করছিলেন।

রাত্রি কত হয়েছিল, কিছুই অনুমান করতে পারছিলাম না। এত দীর্ঘ সময় ধরে মিলন, প্রাণায়াম, জপ ও মন্ত্রোচ্চারণ, আমার কল্পনার বাইরে ছিল। প্রাণতোষবাবার মুখে শুনেছিলাম, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। ব্যাপারটা আমার কাছে এমনই অমানুষিক কঠিন বলে বােধ হয়েছিল, নরনারীর মিলন সঞ্চাত ক্রিয়া দর্শনের স্বাভাবিক কোনাে প্রতিক্রিয়াই আমার মধ্যে ঘটবার অবকাশ পায়নি। সাধারণ কোনাে দম্পতীর দৈহিক মিলন দেখলে, নিশ্চয়ই আমার শরীরে ও মনে প্রতিক্রিয়া ঘটতো। অথচ আমার সামনে সাধক সাধিকাদের পঞ্চম তত্ত্ব সাধনাটি অতি কামকলার ওপর নির্ভরশীল তাতে কোনাে সন্দেহ ছিল না। সাধকদ্বয় আবার অবিচ্ছিন্ন অবস্থায়, সােজা হয়ে বসেছিলেন এবং সাধিকা দুজন যথারীতি তাঁদের জংঘা ও দু পা দিয়ে, সাধকদের কোমর বেষ্টন করেছিলেন। সাধক দুজন তখন প্রাণায়ম সূচক নিশ্বাস প্রশ্বাসের মধ্যে, সাধিকা দুজনের বস্তিদেশে দু হাতের মুদ্রা করে স্পর্শ করেছিলেন, এবং জপ করেছিলেন। প্রাণতােষবাবার ষটচক্রভেদের কথা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। যে-চক্রগুলােকে তারা কল্পনা করে থাকেন, শিরদাড়ার ভিতর দিয়ে, লিঙ্গমূল থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত অবস্থিত। চক্রের স্থানগুলো তিনি আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন। অতএব আমি অনুমান করেছিলাম, সুষুম্নার ভিতর থেকে কুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে তুলে, তারা উধ্বগামিনী করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

আমি কিছু ভুল ধারণা করিনি। দুই সাধক, সাধিকাদের বস্তিদেশ অর্থাৎ স্বাধিষ্ঠান চক্রে জপ করে, আবার হুহুংকার শব্দে মৈথুন শুরু করেছিলেন, এবং এক সময়ে আবার স্থির হয়ে, মণিপুরে অর্থাৎ সাধিকাদের নাভিমূলে জপ করেছিলেন। সেই ভাবে ক্রমাগত হৃদয়ে, কণ্ঠে, জমধ্যে চক্রগুলােকে দুই সাধক ভেদ করেছিলেন। আমি জানি না, শেষ প্রহরের শৃগাল ডেকে উঠেছিল কী না। কিংবা চক্র সাধন সময়কে আমার অতি বিলম্বিত ধারণা হয়েছিল।

ভ্রমধ্যকে সাধকরা আজ্ঞাচক্র’ বলেন। তারপরেই“সহস্রার” অর্থাৎ মস্তিষ্কে, যেখানে কুণ্ডলিনী অর্থাৎ মহাশক্তির সঙ্গে স্বয়ম্ভুলিঙ্গ পরম শিবের মিলন হয়। প্রাণতােষবাবা বলেছিলেন, সেই অবস্থায় সাধক তাঁর ইচ্ছাও সাধ্যমতাে সময় পরমানন্দে অতিবাহিত করেন। তারপর মন্ত্রোচ্চারণ করে শুক্ৰত্যাগ করেন। আমি দেখেছিলাম, জগত থরথর কঁপছিলেন। কাদছিলেন বা হাসছিলেন, সঠিক বুঝতে পারিনি। তার পদযুগল ও দুই হাত তখন যােগেশ্বরের কণ্ঠ বেষ্টন করেছিল। তাকে অনেকটা বৃত্তের মতো দেখাচ্ছিল। যােগেশ্বর তাঁকে দু হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। প্রাণতােষবাবা ও পবিত্রীমা দুটি সাপের মতাে জোড়া লাগা অবস্থায় অদ্ভুতভাবে গড়াগড়ি দিচ্ছিলেন। কখন একজন নীচে আর একজন ওপরে থাকছিলেন। সেইভাবে কিছুক্ষণ চলার পরে আস্তে আস্তে দুই জোড়া দেহই যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে তাদের গলা দিয়ে অদ্ভুত অস্ফুট শব্দ নির্গত হচ্ছিল।

আমি ভাবছিলাম, সেই কি তাদের ইচ্ছা ও সাধ্যমতাে সময় পরমানন্দে অতিবাহিত করা? জানি না। মাঝে মাঝে দু একটি অস্ফুট শব্দ ছাড়া, এমন কি তাদের নিশ্বাসের শব্দও যেন পাচ্ছিলাম না। প্রাণতােষবাবা পরে আমাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেই অবস্থায় সাধকদের দেহ প্রায় মৃতবৎ ঠাণ্ডা হয়ে যায়, কিন্তু মস্তিষ্ক অত্যন্ত উষ্ণ থাকে। তার পরবর্তী অধ্যায়, বিশেষ একটি মন্ত্রোচ্চারণ করে, শুক্রক্ষরণ। এবং তারও পরবতী অধ্যায়, কুণ্ডলিনীকে ধাপে ধাপে মূলাধারে নামিয়ে নিয়ে আসা।……….

………আমি একজন শক্তির উপাসক। শক্তির উপাসককে ‘লজ্জা’ ‘ঘৃণা ‘ভয়’ এই তিনটি প্রবৃত্তি সমূলে বর্জন করতে হবে। আমরা অন্তরে একরকম, লােকচক্ষে আর একরকম। এ সবই গােপনীয়তার জন্য । কেন না, তােমাকে বলেছি, আমাদের পঞ্চমকারের সাধনা দেখলে, অজ্ঞদের চোখে তা একরকমের যৌনাচার ছাড়া কিছুই মনে হবে না।”

সে বিষয়ে আমার কিছুটা অভিজ্ঞতা ছিল, যদিও আমি তাকে তা প্রকাশ করিনি। গোঁসাই ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, “আমাদের স্ত্রী পুরুষের সঙ্গম, শিব শক্তির সামরস্ত, কিন্তু যােগের দ্বারা সুষুম্নায় সেই মিলন ঘটে। মহাদেব দেবীকে বলেছেন, দেবী, আমি শুক্র, তুমি শশাণিত, আমাদের দুইয়ের থেকে নিখিল জগতের উদ্ভব হয়েছে।”……….

…………এই সব ব্যবস্থাদির পরেই, ঘরে প্রবেশ করেছিল এক অতুলনীয় কৃষ্ণাঙ্গী কন্যা, যার বয়স উপস্থিত সকল যুবতীর তুলনায় অনেক কম। আমার ধারণায় সে ছিল অষ্টাদশী। অতুলনীয়া বললাম এই কারণে, তার উদ্ধত বক্ষ, ছিপছিপে শরীরের সুষমায় যেন এক আশ্চর্য অলৌকিকতা ঘিরে ছিল। অনেকটা প্রতিমার মতােই তার দুই চোখ আকৰ্ণ বিস্তৃত, উন্নত নাসায় পাথরের নাকছাবি। পাখির খােলা ডানার মতাে দুই ভুরুর মাঝখানে বড় একটি সিন্দুরের ফোটা, কিন্তু সিথেয় সিদুর না থাকায় বুঝেছিলাম, সে অবিবাহিতা। সামান্য একটি চওড়া লালপাড় শাড়ি ছাড়া আর কোনো বস্ত্র ছিল না তার গায়ে। এমন কি কোনো অলংকার বা রুদ্রাক্ষের মালাও তার গলায় ছিল না। কেবল দু পায়ে চওড়া করে আল্তা পরা ছিল। কুঞ্চিত কেশদাম পিঠে ও ঘাড়ে ছড়িয়ে ছিল। কোমরের কাছ থেকে তার পিঠের শিরদাড়া যেন অনেকটা ধনুকের মতাে বাঁকা, আর সেই কারণেই তার বুক যেন পায়রার বুকের মতাে সামনে উদ্ধত দেখাচ্ছিল, এবং ভারি নিতম্বও ছিল বুকের মতােই চওড়া ও সুঠাম। আমার অভিজ্ঞতায় সচরাচর সেই রকম দেহ সৌষ্ঠব উচ্চ বর্ণের নারীর থেকে, নিম্নবর্ণের নারীদেরই বেশি দেখা যায়। পরে জেনেছিলাম, সে চণ্ডাল কন্যা।…….

………..একজন সাধক উঠে দুটো হারিকেন নিভিয়ে দিয়েছিল। পাঁচটি প্রদীপ জ্বলছিল। তার আলো কিছু কম না। কামাখ্যায় প্রাণতােষবাবার ঘর যেমন একটা আবছা আলো আঁধারের ভাব ছিল, তার থেকে এ ঘরে সবই স্পষ্ট দেখাচ্ছিল। গুরুদেব ডাকলেন, “তারা মা, আয় তােকে দীক্ষা দিই।

সেই কৃষ্ণাঙ্গী যুবতী গুরুদেবের কাছে আরও এগিয়ে গিয়েছিল । যারা মা মা ডাকছিলেন, বা গান করছিলেন, সকলেই নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। গুরুদেব সেই কৃষ্ণাঙ্গী যুবতীর কানের কাছে মুখ নিয়ে, কিছু বলেছিলেন, যার এক বর্ণও আমি শুনতে পাইনি। গোসাই ঠাকুরের কথা আমার মনে পড়েছিল। অদীক্ষিতা শক্তিকেও শোধন করে নিতে হয়। গুরুদেব কি তারাকে শােধন করছিলেন। প্রায় মিনিট পাঁচেক নিঃশব্দে কেটেছিল। তারা নামে ( অবিশ্যি সেই চণ্ডাল কন্যাটির নাম তারা নয়।) অষ্টাদশীর মুখে একটি ভাবান্তর হয়েছিল। তার চোখ বুজে গিয়েছিল, নাসারন্ধ্র স্ফীত হয়েছিল। বুকের লালপাড় শাড়ির আঁচল খসে পড়েছিল, আর পৃথিবীর যে কোনাে শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সৃষ্ট পাথরের মূর্তির মতােই তার সুগঠিত কুচযুগ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল। গুরুদেব মাথা নত করে তাকে প্রণাম করেছিলেন। তারা নির্বিকার ছিল। এটা বিস্ময়ের বিষয়, একজন অশীতিপর ব্রাহ্মণ বৃদ্ধ একটি চণ্ডাল তরুণীকে প্রণাম করছেন। তন্ত্রধর্মেই বােধহয় এমন সম্ভব। তারপরেই গুরুদেব বলেছিলেন, ‘বাবারা তােমরা এবার মাতৃঅঙ্গে ন্যাস কর।

কথাটা আমার কানে নতুন শােনালেও, দেখেছিলাম, মাতৃঅঙ্গ ন্যাস আসলে, ‘শক্তি রমণীদের শরীরকে নানা ভাবে পুজা করা, যা দেখেছিলাম কামাখ্যায় প্রাণতােষবাবার সাধনার সময়ে। বর্ণনা দিতে গেলে, অনেকটাই পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা। সেখানেও সাধক সাধিকারা সকলেই নগ্ন হয়ে দাড়িয়েছিলেন। সাধকরা সাধিকাদের কপালে সিন্দুরের ত্রিকোণ যন্ত্র একে দিয়েছিলেন। তারপরে পা থেকে নাভিস্থল পর্যন্ত, নাভি থেকে স্তন পর্যন্ত, স্তন থেকে মাথা পর্যন্ত, ফুল চন্দন ইত্যাদি দ্বারা পূজা করেছিলেন। সকলের ঠোট নড়া দেখে বােঝা যাচ্ছিল, তাঁরা কোনাে মন্ত্রোচ্চারণ করছিলেন।

লক্ষণীয় যেটা দেখেছিলাম, সেই অশীতিপর বৃদ্ধ গুরুদেব নগ্ন, তারাকে একইভাবে পূজা করেছিলেন । আমি যথেষ্ট সংযত ও স্থির থাকা সত্বেও, স্বীকার না করে পারছি না, আমার দৃষ্টি বারেবারেই তারার দিকে পড়ছিল । একমাত্র তারাই সাধিকাদের মধ্যে চোখ বুজেছিল, বাকি সাধিকারা স্থির থাকলেও, চোখ খোলাই ছিল। আরও যেটা লক্ষণীয় ছিল, গোসাইঠাকুর একেবারে ধ্যানস্থ হয়ে নিশ্চল বসেছিলেন। বুঝতে পারছিলাম না, তিনি কি তবে এই ঢক্র সাধনা থেকে বিরত থাকছেন ? আমার প্রশ্ন করার কোনাে উপায় ছিল না। বরং বৃদ্ধ গুরুদেবকে তরুণের ন্যায় দেখে অবাক হচ্ছিলাম। অর্থাৎ তাঁর অঙ্গটি তরুণের ন্যায় উচ্ছিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু প্রাণতোষবাবার সাধন প্রকরণে, এই অনুষ্ঠানটি যতোক্ষণ সময় নিয়েছিল, এখানে তার থেকে অনেক কম সময় ব্যয় হয়েছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, এটি ভৈরবীচক্র। পরস্পরকে পানের খিলি মুখে পুরে দেওয়ার মধ্যে মিল ছিল। পান চিবােতে চিবােতেই সাধিকারা সাধকদের পায়ের কাছে বসে প্রণাম করেছিলেন। তারপরেই শুরু হয়েছিল, শৃঙ্গার। আলিঙ্গন, চুম্বন, স্তন মর্দন ও পরস্পরের যৌনাঙ্গে চোষণ শেষণ। তার সঙ্গে নানা শব্দ, যা হাসি ও উল্লাস ছাড়া কিছু মনে হয়নি। এমন কি, সাধক সাধিকারা প্রেম গদগদ স্বরে, পরস্পরকে নানা ভাষায় প্রশংসা করছিলেন। শুনতে অবাক লাগলেও, সেই সব ভাষার কয়েকটি অশ্রাব্য বলেই আমার মনে হয়েছিল।

গুরুদেব মাঝে মাঝে কিছু বলে উঠছিলেন। বাকিরা অট্টহাস্য করছিলেন, এবং অদ্ভুত কোনো শব্দ উচ্চারণ করছিলেন, যা আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। তিনি তারার সর্বাঙ্গ লেহন করছিলেন, বিশেষ ভাবে, তার নিজ ভাষায়, ‘এই কামপঠ দেবদুর্লভ’ বলে বারে বারে জিহবার দ্বারা স্পর্শ করছিলেন। আমার মাতৃভাষায় সব ক্রিয়া গুলাের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা দিতে আমি অক্ষম।

শৃঙ্গারাদির পরেই, মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা মৈথুন ক্রিয়া শুরু হয়েছি। গুরুদেবও বিরত থাকেন নি। অথচ গোসাইঠাকুর তেমনই চোখ বুজে স্থির ধ্যানস্থ হয়ে বসেছিলেন। তারাকে অনেকটা নির্বিকার দেখাচ্ছিল। সাধিকারা কেউই তেমন উৎসাস প্রকাশ করছিলেন না। গুরুদেব তারার সঙ্গে মৈথুনে রত হয়ে, অচঞ্চল স্থির হয়ে, বারে বারেই কিছু মন্ত্রোচ্চারণ করছিলেন, তার ধীরে অঙ্গ সঞ্চালন করছিলেন। অন্যান্য সাধকরাও প্রমত্ত মৈথুনে লিপ্ত হলেও, মাঝে মাঝেই নিশ্চল হয়ে, নিশ্বাস টেনে নিয়ে স্থির হয়ে যাচ্ছিলেন। এক জোড়া সাধক সাধিকা বিপরীত বিহার করছিলেন, এবং সাধিকাটি সামনে কলসী থেকে নারকেলের খােলে মদ তুলে, নিজে পান করছিলেন, সাধকের মুখেও ঢেলে দিচ্ছিলেন। দৃশ্যটি আমার কাছে অভাবিত মনে হয়েছিল। পরে শুনেছিলাম, ভৈরবীচক্রে ঐ রকম অবস্থায় পান নিষিদ্ধ না।

গুরুদেবের গলা থেকে নানাবিধ শব্দ ক্রমেই বেশি শােনা যাচ্ছিল। অথচ তাকে শান্তই দেখাচ্ছিল। মাঝে মাঝে তারা তারা ! ডেকে তারার দুই চোখের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তারাও তাঁর চোখের দিকে তাকাচ্ছিল । অনধিক এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই, গুরুদেব কিছু উচ্চারণ করলেন, এবং তারাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলেন। তারার শরীর যেন কেঁপে উঠলাে, মাত্র ক্ষণিকের জন্য। তারপরেই গুরুদেব তারার কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে, তাকে দু হাতে তুলে বসালেন। ডাকলেন, ‘সৌরীন্দ্র।

গোঁসাইঠাকুরের নাম যে সৌরীন্দ্র, সেই আমি প্রথম শুনেছিলাম। তিনি চোখ খুলে বললেন, ‘আদেশ করুন গুরুদেব।’
‘তুমি এই মহাশক্তি অঙ্গে ন্যাস কর। তারাকে দেখিয়ে বললেন, এবং তারাকে বললেন, ‘উঠে দাড়া মা।’

তারা উঠে দাড়ালাে। সৌরীন্দ্র গোঁসাইও উঠে দাড়ালেন। নিজকে বিবস্ত্র করলেন, এবং সকলের মতো তারাকে মাথা পর্যন্ত যথাবিহিত চন্দন ফুল ইত্যাদি দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণও পূজা করলেন। গুরুদের উঠে দাড়ালেন, সৌরীন্দ্র গোসাইকে কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের নিম্নাঙ্গের সঙ্গে জাপটে ধরে বললেন, “ওঁ শিবায় নমঃ। গোসাইও উচ্চারণ করলেন, ওঁ শিবায় নমঃ। তারপরেই তিনি তারার মুখে পানের খিলি পুরে দিলেন। তারাও দিল। এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে দুজনের মধ্যে চুম্বন মর্দন দংশন চোষণ শোষণ ইত্যাদি শুরু হলাে।

ঘটনাটা আমার কাছে অভাবিত ছিল। গুরুদেবও গোঁসাইয়ের কোমর জড়ানাে আলিঙ্গনের বৈশিষ্ট্য কি, বা একই সাধিকার সঙ্গে দুই সাধকের চক্রে যােগদান ঘটতে পারে বলে আমার জানা ছিল না। পরে শুনেছিলাম, চক্রে ঐ রকম ঘটনা নিষিদ্ধ না। গুরু যদি বৃদ্ধ হন, অথচ চক্রে বসে সাধনা করেন, তা সার্থক হলেও সীমিত হতে বাধ্য। তখন তিনি তাঁর শিবতঃ শিষ্যকে দান করে সেই সাধিকার সঙ্গে সাধনায় লিপ্ত হতে অনুমতি দেন। অবশ্যই সাধিকার অনুমতি থাকা চাই। দেখেছিলাম, তারার অনুমতি ছিল।

আগেই বলেছি, গোঁসাইঠাকুর বয়স্ক হলেও, তার ছিল উজ্জ্বল স্বাস্থ্য। নিশ্চয়ই তাঁর বয়স ষাটের উপর ছিল। তার শরীরের পেশিসমূহ, চওড়া রক্তাভ বুক, সবই ছিল, শক্ত ও দৃঢ়। আর সকলের তুলনায় তাঁকে দেখাচ্ছিল, যেন গভীর একাগ্রতায় এক কঠিন কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। তিনি তার দুই পা দু দিকে এত দূরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, মনে হচ্ছিল, কোনাে মানুষের পক্ষে তা সম্ভব না। সাধারণ মানুষের পক্ষে দুই জঙ্খর সংগমস্থল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার কথা ! যেন তার হাড় নেই, অতএব ভাঙবারও কিছু নেই। এরকমটি আমি পৃথিবী বিখ্যাত এক ব্যালেরিনাকেই করতে দেখেছিলাম। সেই অবস্থায় গোঁসাই তার হাঁটু মুড়েছিলেন, এবং তারাকে পুতুলের মতো দু হাতে নিয়ে, কোলের মাঝখানে বসিয়েছিলেন। অস্পষ্ট উচ্চারণে কোনাে মন্ত্রোচ্চারণ করেছিলেন। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, পঞ্চ ‘ম কারের ক্রিয়া শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ মৈথুন, এবং শুরুতেই তাঁর আসন ভিন্ন, অনেকটা প্রাণতােষবাবার মতো বসা অবস্থায়।

অঙ্গ সঞ্চালনের সময় মনে হচ্ছিল, তিনি যেন নাচছেন, এবং তাঁর সঙ্গে তারাও নাচছে। কিন্তু একটানা কিছুই চলছিল না। কিছুক্ষণ পরে পরেই একেবারে স্থির হয়ে, তারার শরীরের নানা অংশে দু হাত রেখে জপ করছিলেন। অঙ্গসঞ্চালন ও জপ, দুই-ই চলছিল। আমার সামনে চার জোড়া সাধক সাধিকা চক্র সাধক করছিলেন। আমার দৃষ্টি বারেবারেই গোসাই ও তারার দিকে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছিল। গুরুদেবের সঙ্গে সাধনার সময় তারাকে যতােটা নির্বিকার দেখেছিলাম, গোঁসাইয়ের সাধন সময়ে তাকে ততােটা নির্বিকার দেখাচ্ছিল না। অথবা সেটা আমারই দৃষ্টিবিভ্রম হতে পারে। গোঁসাই মাঝে মাঝে এমন হুংকার দিয়ে উঠছিলেন, যেন তিনি কারাে সঙ্গে লড়াই করছিলেন, এবং প্রতিপক্ষকে গর্জন করে ধমক দিচ্ছিলেন।

রাত্রি কত হয়েছিল জানি না। একে একে তিন জোড়া সাধক সাধিকা একেবারেই মৃতবৎ হয়ে গিয়েছিলেন। গোঁসাইঠাকুর এবং তারার সাধনা কতো সময় ধরে চলেছিল, আমার কোনাে হিসাব ছিল না। দুজনের মৈথুন ক্রিয়ার আসনও একরকম ছিল না। গোসাই ঠাকুর একবার দাড়িয়ে পড়েছিলেন। তারা তার গলা জড়িয়ে দু পা দিয়ে তার কোমর বেষ্টন করছিল। বিচ্ছিন্ন হবার কোনাে প্রশ্নই ছিল না।

রাত্রি বােধ হয় শেষ হয়ে এসেছিল। আমি ঘরের ভিতর থেকে কাক ও দু একটি অন্য পাখির ডাক শুনতে পেয়েছিলাম। আমি অবসন্ন বােধ করলেও ঘুমােইনি। গোঁসাইকে শিবত্ব দান করার পরে, গুরুদেব জোড়াসনে চোখ বুজে বসেছিলেন। যেন জপ করছিলেন। গোসাইঠাকুর একবার মা মা বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন, তারপরে তারার সঙ্গে শয্যায় আসন করে, গাঢ় সংস্পৃষ্ট আলিঙ্গিত অবস্থায় স্থির হয়ে গিয়েছিলেন। গুরুদেব চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি কিছু চাও ?”

আমি কী চাইতে পারি? আমি যা দেখতে চেয়েছিলাম, তা দেখা | হয়েছিল। বলেছিলাম, না, আমি কিছু চাই না।”
“তা হলে তুমি দরজা খুলে বাইরে যাও।” তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।……..

………পরে জেনেছিলাম সাধক সাধিকার যে শষ্যায় চক্রানুষ্ঠান করেন, সেই শয্যার কাপড়কে ‘সিদ্ধবস্ত্র’ বলে, এবং তা সংগ্রহ করার জন্য সবাই ব্যাকুল হয়। গুরুদেব বােধহয় সেই জন্য জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কিছু চাই কী না। ঐ বস্ত্র নাকি লােকের অনেক কামনা সিদ্ধ করে।……..

……..সকলের সঙ্গে স্নান করলাম। মেয়ে পুরুষ, কে নগ্ন আর কে নগ্ন নয়, সে বিচার এখানে অচল। প্রচণ্ড ভিড়, তার জলের স্রোতের টান তীব্র। কে কার গায়ে মেশামিশি করে আছে, কেউ দেখছে না। আমাকে মাধব হাত ধরে রেখেছে। আর এক পাশে উদ্ভিন্ন যৌবনা পূর্ণিমা।…….

…….শরীরের বর্ণনায় তারা আটটি চন্দ্রের কথা বলে। মুখ দুই স্তন, দুই হাত, একটি (পুরুষের) বুক, নাভি, উপস্থ-অর্থাৎ জননেন্দ্রিয় ।……….

…………..চতুর্থ দিনে গানে কেবল, ‘উজানে চলো, ‘উল্টা কলে চলে ‘আর মানুষকে অনুভব কর। কী করে অনুভব করা সম্ভব ? নিরন্তর মুহাসুখের মধ্যে। একটি গানের ব্যাখ্যা : সাধক পায়ের গােড়ালি দিয়ে, যােনিস্থান সবলে চেপে ধরবে, রমণ চলতে থাকবে, আর গুজ্বদ্বার বারে বারে আকুঞ্চন করে, বীর্যকে উধ্বগামী করবে, এর নাম মূলবন্ধ। কিন্তু বিন্দু অর্থাৎ শুক্র কোনােরকমেই বিচলিত হবে না, টলবে না, স্থলিত হবে না। তাকে কেবল উধ্বগামী করে রাখতে হবে। এই সময়ে বিপরীত বিহার চলতে পারে, আর চোখে চোখে তাকিয়ে শৃঙ্গার। যে যত বড় সাধক, সে মৈথুন-মিলনের নিরন্তর নিবিড় আনন্দময় অবস্থায় সব থেকে বেশি সময় থাকতে পারে। চবিবশ ঘণ্টারও বেশি হতে পারে। কারণ সে তাে ঈশ্বর’ চায় না। চায় নিরন্ত প্রেমলীলা-বিলাসময় মানুষ। কিন্তু বীজ থাকবে অটল।……

……….তন্ত্রসাধনায় এমন অসম্ভব কিছু নেই। প্রকৃত পক্ষে ছিয়ানব্বই ঘণ্টারও ওপর সাধনা চলছিল। শেষের দিন পূর্ণ চব্বিশ ঘণ্টা তাে অবিচ্ছিন্ন মিথুনানন্দ ।…….

……..বাউলদের দেহতত্ত্ব যে তন্ত্র সাধনারই এক রূপ, আমার জানা ছিল না। কয়েকটি তফাত চোখে পড়লো। তার মধ্যে বিশেষ করে বীর্যপাত । হিন্দুতন্ত্র সাধনায় বীর্যপাত আছে, বাউলদের মিলনে তা নেই । পরে বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের কথা বইয়ে পড়তে গিয়ে, মনে হয়েছে, তাদের সঙ্গে বাউল সাধনার মিল আছে। বাউলরা তন্ত্রের পঞ্চমকারের মাত্র একটি ‘ম’—অর্থাৎ প্রকৃতি গ্রহণ করে। সেটা অনিবার্য। কিন্তু মদ মাংস মাছ ইত্যাদি গ্রহণ করে না। বাউলদের বৈশিষ্ট্য “চারচন্দ্র এবং বীর্যপাতহীন নিরন্তর মিথুনানন্দ। ব্যাখ্যা, এই ব্রহ্মাণ্ডে নিরন্তর যা ঘটছে, এই দেহে, তারই ক্রিয়া চলছে। বাউল ঈশ্বর বিশ্বাসী না।………..

…………কিন্তু খাজুরাহাের মন্দিরের রমণীর নিশ্বাস যেন কুসুমের গন্ধে স্পর্শ করেছে আমার শরীর। শালপ্রাংশু বৃষস্কন্ধ পুরুষের বলবীর্যের উত্তাপ লেগেছে আমার গায়ে। অল্প অথবা সুরসুন্দরী, (nymphs) ওঁদের যাই বলাে ঈষৎ গোলাপী বা পীত আভাযুক্ত এই সব অপরূপ রমণীরা, যারা ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্বিনী, বিম্বফল সদৃশ সুস্তনী, যাদের এক একজনের চোখে মুখে, ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি, ভিন্ন ভিন্ন ক্রীড়ার কারণে, তারা সকলেই যেন আমার চেনা-অচেনার মাঝখানে দাড়িয়ে নাচিয়ে দিচ্ছে রক্তধারা।……..

………এ কি কেবলই পাথরের মায়া ? “তুমি কি কেবলই ছবি?” কাথা পেকে তুলে নিয়ে এলে হাতের শতদল পদ্ম ? তােমার নাচের ভঙ্গিতেও কি মুকুর একটি সরঞ্জাম ? অথবা তাও তুমি নিবেদন কর তোমার দেবতাকে ? কে পরালে তােমার নগ্ন বক্ষে এমন চন্দ্রহার । আশ্চর্য, তােমার হাত ছাড়া আর কার হাতেই বা মানায় এমন কঙ্কণ ।……

……..দেখছি, উদ্ধতৰক্ষ নারী, কোমরের কাছে একটি পা তুলে পরে নিচ্ছে পায়ের অলঙ্কার। স্পষ্টতই, খুলে পড়েছিল কোনাে এক মুহূর্তে। কিন্তু অন্য এক রমণী নতমুখে ঘাড় বাঁকিয়ে দুই জঘর মধ্যস্থলে, পা তুলে, কী খুটে তুলছে পায়ের তলা থেকে ? চোখে তার কুটি, একটু বা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ। বলে দেবার দরকার হয় না, বিধে যায়। কাটা তুলছে, পায়ের তলা থেকে। বড় চেনা ছবি। কোথায় যেন দেখেছলাম ? কোথায় যেতে যেতে না কি কোনাে গৃহাঙ্গনেই ? ইচ্ছা কি করে না, ব্যস্ত হয়ে হাত বাড়িয়ে দিই, তুলে নিই ওই সুকোমল চরণ ? মুক্ত করি কাটা ?……

……..কিন্তু এই যে রমণী, একে একে খুলে ফেলছে তার প্রতিটি অলঙ্কার আর একজন হাই তুলেছে, অন্যে ভেজা কাপড় শরীর থেকে খুলে জল নিংড়াচ্ছে, অপর একজন সামনের দিক পিছন ফিরে নত হয়ে কিছু তুলে নিচ্ছে, কেউ বা অন্যমনস্ক আবেগে নিজের নগ্ন বক্ষে হাত রেগেছে, দেখে মনে হয়, সে স্বাধীনভাবে আপন গৃহেই রয়েছে, এমন আত্মমগ্ন চরিত্র সকল কালের সৃষ্টিকে যেন মান করে দিয়েছে। ………..

………এই যুদ্ধ চিত্রের মধ্যেই সহসা কোথাও কোথাও নারীর প্রবেশ যারা একাধিক পুরুষের বাহুবন্দী। কল্পনা করতে ইচ্ছা করে, এ হয়তাে বিজয়ী সেনাদের স্বাভাবিক প্রাপ্তির উল্লাস। তবু এক জায়গায় এসে থমকে দাড়াতে হয়, যখন দেখি, এক সৈনিক অশ্বিনী মৈথুনে উদ্যত। আমি নিজে এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি।…….

………খাজুরাহাের মন্দিরগাত্রের এই যুদ্ধ ও জীবনযাত্রার নানা চিত্রের মধ্যে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা মহিমময় সৃষ্টি রমণী পুরুষদের আদি ও অকৃত্রিম আকাক্ষার, অনায়াস ও নগ্ন প্রকাশ, নাম যার যৌবন। যে সব ক্রীড়ারত মূর্তিগুলােকে বলা হয়েছে মিথুন মূর্তি। অথবা যুগলবন্দী। একি সৃষ্টির উল্লাস, না কি জীবনেরই আকাঙ্ক্ষার এক বিপুল আনন্দ। আমি জানি না, কেন কেউ কেউ মিথুন মূর্তিগুলাের অভিব্যক্তিকে স্বর্গীয় আখ্যা দিয়েছেন। আমি দেখেছি, কামনায় উদ্বেল, যৌনাসনে উভয়ে প্রগাঢ়ভাবে আপনাতে আপনি মগ্ন, আশ্লেষ চুম্বনে যেন পিপাসিত প্রাণ তৃপ্ত—অথচ অতৃপ্ত, যা একান্ত মানবিক।………

…….অবাক হয়েছি সেই রমণী মূর্তির দিকে তাকিয়ে, যে যুগলবন্দী ক্রীড়ারত রমণী পুরুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সহসা মনে হয়, রমণী লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অন্য পাশের রমণীর আপন অঙ্গে হস্তাবলেপ অথবা বক্ষমর্দন এবং মুখের বাসনা ব্যাকুলতা অন্য ভাবনা এনে দেয়। বুঝতে পারি, চারি পাশের নানান জীবনলীলার মাঝখানে অন্য এক পরিবেশে রমণী পুরুষের। চুম্বনে আলিঙ্গনে রতিবিহারে মগ্ন। প্রতিটি প্রস্তরখণ্ডেই যেন জীবননাট্যের নানা দৃশ্য উপস্থিত। অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার মধ্যেও এক একটি পরিবেশ বিচ্ছিন্ন, চরিত্রবৃন্দ ভিন্ন। অন্যান্য সব মূর্তির মতই মিথুন মূর্তিগুলােও এমনই প্রাণবন্ত, এমন আশ্চর্য তাদের দেহসৌষ্ঠব, এমনই অনায়াসে তারা, ক্ষেত্রবিশেষে দুরূহ আসনে ক্রীড়ারত, আমাদের সীমায়িত শক্তির তুলনায় তা যেন অনেকটাই অসাধারণ।……

…….ভুলি কেমন করে ? এই যে দেখি, নর্তকী হাঁটু মুড়ে, দু পায়ের অপরূপ ভঙ্গিতে নিতম্বে বাঁক নিয়ে বসে, চন্দন বাটে ও বক্ষে লেপন করে, শুনি জয়দেবের রাপার স্বগতােক্তি গান, তখন আমার ব্যাকুল চোখ বারে বারে ছুটে যায় জ্যোৎস্নালােকের মায়াময় মন্দির গাত্রে।

এ রূপান্তরের হাট ভিন্ন, যদিও মনে করি তার আত্মাৎসর্গও মৌল প্রেরণাজাত। কিন্তু এখানে স্তনে চন্দন লেপন, শৃঙ্গারে বিবিধ ভঙ্গি নেই।………..

Leave a Reply