…………… চতুর্থ রাত্রির শেষবামে দেবী ইয়েলা তাকেস্বপ্নাদেশ দিলেন—একটি সুলক্ষনা অক্ষতযােনী কুমারী কন্যাকে যদি সে দেবীমন্দিরে দেবদাসীরূপে উৎসর্গ করতে পারে, তবে তার মনােবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।………
……….জানে সুতনুকা। মাদারকে সেকথা সে মুখ ফুটে বলেনি কোনদিন। সে কথা কি বলা যায়? মামলা জয়ের পর প্রতিশ্রুতি মতাে সহস্রাত উকিলবাবুকে আমন্ত্রন জানিয়েছিল ছুটির সাতটা দিন মন্দিরের অতিথি হতে। গণেশন ইয়েলাম্মা-মন্দিরের অতিথিশালায় সাতটা দিন কাটিয়ে আসে। এবং সাতটা রাত। তার সেই সাতটা রাতে পর্যায়ক্রমে তার শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিল ইয়েলক্ষ্ম-মন্দিরের সাত-সাতজন দেবদাসী। চম্পা, মেনকা, রাধা, রুক্মিণীবাঈ, সত্যভামা, বাসবী—আর হ্যা, উৎসবের শেষরাত্রে একাদশবর্ষীয়া একফোটা ঐ মেয়েটা-পুস্পা।
পরে একদিন অশ্রুসিক্ত পুস্পা সুতনুকার বুকের উপত্যকায় মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে ফুলিয়ে ব্যক্ত করেছিল তার লজ্জার কথা, যান্ত্রনার কথা। মানসিক শুধু নয়, দৈহিক। হাসপাতালে গিয়ে স্টিচনিতে হয়েছিল তাকে। ভিজা গামছা যেভাবে নিড়ানাে হয়, ঠিক সেভাবেই ঐ একফোটা মেয়েটার দেহ নিঙড়ে শেষ মধুবিন্দুটি পর্যন্ত নিষ্কাশন করেছিল দানবটা।………..
……….মনে পড়ছে বছর তিন-চার আগেকার সেই মর্মান্তিক দিনটার কথা। উৎসর্গ অভিষেক উৎসব। কী নৃশংস, বীভৎস, ন্যক্কারজনক। সেটি ছিল ‘রন্ডে হুম্মিমে’ অর্থাৎ বারবণিতাদের পূর্ণিমা তিথি। এককালে যার নাম ছিল ‘দেবী হুন্মিমে’। দেবীরা কালে হয়েছে দাসী, ইদানীং রন্ডে অর্থাৎ বেশ্যা। ছয়টি মেয়েকে এ বছর উৎসর্গ করা হবে। তাদের মধ্যে চারজনের বয়স চৌদ্দ থেকে ষােলাে, একমাত্র পূষ্পই নেহাৎ নাবালিকা একাদশবর্ষীয়া। হ্যা, এ ব্যবস্থা হয়েছে সারদা আইন পাশ হবার কয়েক দশক পর। কার ঘাড়ে দুটো মাথা যে, পুরােহিত ও রাজতন্ত্রের সমর্থনে আয়ােজিত এ উৎসবে প্রতিবাদ করবে? সুতনুকাই ওদের মধ্যে বয়ঃজ্যেষ্ঠা অষ্টাদশী। ……..
……….কাল যে তাের ‘বে’ রে পাগলি। দ্যাবতার সঙ্গে বে হবে যে। সুতনুকা যেটা জানে, চম্পা কিংবা মেনকা সেটা আন্দাজ করেছে। ঐ বালিকা সেটা এখনও কিছুই জানে না, কিছুই বােঝে না। তা হােক, তবু এগারাে বছর বয়সে মেয়েরা ‘বিবাহ’ শব্দটা বােঝে। …
…….. সরস্বতী বুড়ি বুঝিয়ে দেয়, সেই কাকডাকা ভােরে উঠে কাল তােদের স্নান করতে যেতে হবে। ঐ ‘জোগতি-বাভীর’ কুয়োর জলে। ভুল্কো-তারা ডােবার আগেই অতিথিরা এসে বসে থাকবে চাদোয়ার তলায়। এখান থেকেই তােরা সবাই যাবি। একে একে। একের পর এক। ছােট থেকে বড়। পেরথমে পুষ্প, সব শেষে কী নাম যেন তাের, হ্যা, সুতনুকা। নিজে হাতে কুয়াে থেকে জল তুলবি। দড়ি-বালতি কুয়ােপাড়েই রাখা আছে। হাস্তায় জল ভরতি করবি। তিন বালতি জল তুললেই হবে নে। তারপর হস করে মাথায় ঢালবি। তার আগেই তােদের কপালে, হাতে, বুকে তেল-হলুদ নাগিয়ে দেব আমি। স্নান সেরে ভিজে গায়ে একছুটে পাইলে আসবি এখানে। গা মােছর কানুন নেই। ভিজে গায়ে এ-ঘরে এলে আমি নতুন কাপড় দেব—ঐ হলুদরঙের শাড়ি। তাই পরে তােরা সার বেঁধে মন্দিরে যাবি। আমি শাঁখ বাজাব।
সুতনুকা বলে, গা-মােছার কানুন নেই বললেই হল। অতটুকু মেয়ে পুষ্প, ভিজে কাপড়ে শীত করবে না ওর?
ম্নান হাসল সরস্বতী-আম্মা। শনের দড়ির মতাে চুলে ভর্তি মাথাটা নেড়ে বললে, ‘ভিজে কাপড়ে’ বলি নাই রে পাগলি। বলেছি, ভিজে গায়ে। কাপড় পরারও কানুন নেই যে।
বজ্রাহত হয়ে গেল ওরা। তার মানে? মানেটা বুঝিয়ে দিতে পােড়খাওয়া প্রাক্তন দেবদাসী ঐ বৃদ্ধাও লজ্জা পেল। কিন্তু এই ওর চাকরি। বছরে বছরে একথা জানাতে হয় তাকে নতুন যুগের নতুন দেবদাসীদের। কালে যারা হবে জোগতি-শেখাতে আসবে একই কথা আগামী যুগের দেবদাসীদের।
দেবদাসীরূপে যাকে মন্দিরে উৎসর্গ করা হচ্ছে তার শরীরে যে শ্বেতি নেই, গুপ্তক্ষত নেই এটা মন্দির কর্তৃপক্ষকে সম্জে নিতে হবেনা? তাই এই প্রত্যুষ-স্নানের আয়ােজন। আর তাই উচ্চ মূল্য দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে সমবেত হয়েছেন দর্শকুল। অক্ষতযােনী কুমারী নারীর নগ্নস্নানদৃশ্য দেখতে। শুরু হবে একাদশবর্ষীয়া পম্পাকে দিয়ে, সারা হবে অষ্টাদশী সুতনুকার স্নানদৃশ্যে। ….
বাকহারা মেয়েগুলির দিকে তাকিয়ে সরস্বতী-আম্মা বলে, এক্কেরে ন্যাংটো হতে নেই। তাতে ভৈরবের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। আমি তাই তােদের মাজায় বেঁধে দুব একটা করে সুতাে,আর নাভিমূলের কাছে নটকে দুব এক-একটা নিমের ডাল। এবার বুঝলি? ……
তারপর? তারপর বাসীরঙের শাড়ি পরা মেয়েটির দক্ষিণ বাহুমূলে প্রধান পুরােহিত সহস্রাক্ষ পরিয়ে দেবেন তালী’। গলায় দুলিয়ে দেবেন শংখ ও পুঁতি দিয়ে গাঁথা মঙ্গলসূত্ৰ। কপালে দেবেন চন্দনের তিলক’ সব কয়টি মেয়ে সমবেত হবে মন্দিরে। জোগতিরা তখন তাদের মাথায় অক্ষত তন্ডূল ও দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করবে। নতুন উৎসর্গীকৃত মেয়েরা বসবে দেবদাসীদের ঘিরে। শুরু হবে মঙ্গলগীতি এবং তারপরে দেবদাসী নৃত্য। সমস্ত দিন চলতে থাকবে নানান আচার অনুষ্ঠান। তারপর সন্ধ্যারতির পর পট্টবস্ত্র পরিধান করে, ফুলসাজে সেজে অভিষিক্ত হবার জন্য প্রস্তুত হবে উৎসর্গীকৃত কুমারী কন্যারা। কোনও দেবদাসী বা জোগতি মেয়েটিকে হাত ধরে নিয়ে যাবে তার বাসরঘরে, যেখানে পট্টবস্ত্র পরে, চন্দনচর্চিত হয়ে অপেক্ষা করছেন তার ভৈরব।
পূস্পার কৌতুহল তখনও নিবৃত্ত হয়নি। বলে, তারপর? ভৈরব তখন কী করবে?
কেউ এ কথার জবাব দিলনা। না সরস্বতী-আম্মা, না ওর বয়ঃজ্যেষ্ঠা হতভাগিনীদলের কেউ। ওরা জানে, ওরা বুঝেছে-বৎসরান্তে একদিন ভৈরব সাজতে পারার সুযােগে এরা সহস্র রজতখন্ড পর্যন্ত দান করে মন্দির তহবিলে। অনাঘ্রাতা পুষ্পমধুর স্বাদ যে বড় মধুর! উচ্ছিষ্ট বারবণিতার শয্যায় রাত্রিবাসের সঙ্গে এ ‘তুরীয় আনন্দের কোন তুলনা হয়?
না। সেই প্রভাতী স্নানের কথাটা সুতনুকার আজ আর স্মরণ হয় না। সে যেন তখন কেমন সম্মােহিত হয়ে গিয়েছিল। পুরুষের দৃষ্টির সম্মুখে নিরাবরণ যে একদিন হতে হবে এটা সে জানত। কিন্তু ওর কল্পনায় পরিবেশটা ছিল বেড়সুইচ জুলাআধাে-অন্ধকার কক্ষ, ওর ধারণায় শয্যাটা হবে কুসুমাকীর্ণ, আর ওর স্বপ্নে দর্শক ছিল চন্দনচর্চিত এক মুগ্ধ দৃষ্টির যুবাপুরুষ। তাই বিশ-ত্রিশ জোড়া কামুক দর্শনার্থীর সম্মুখে একমুঠি নিদার্কের কাছে তার লজ্জাকে গচ্ছিত রেখে সে যখন দ্বার খুলে বার হল তখন সে বাহ্যজ্ঞান হারিয়েছে। সরস্বতীবাঈ বুদ্ধি করে ওর আজানুলম্বিত কেশরাজি দুভাগে ভাগ করে ওর দু-কাঁধের উপর টেনে এনে বুকের যুগ্ম উচ্ছ্বাসটাকে ঢাকা দিতে চেয়েছিল। সুতনুকা তাও টের পায়নি। তার তখন শুধু মনে পড়ছিল ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশানের বলি মারী আততানিয়েতের কাহিনী। সাদা চুলেভরা মাথাটা নিয়ে যখন তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন গিলােতিনের দিকে।
তার চেয়ে সহস্রগুণ বড় আঘাত পেয়েছিল সেদিন সন্ধ্যার পরে।……..
…….তবু তবু, পালঙ্কের উপর পদ্মাসনে-ক ভৈরবকে দেখে সে আর্তনাদ করে উঠেছিল। ………লােকটার মাথায় এখন উইগ নেই, টাক ; গায়ে গাউন নেই, উত্তরীয় ; পরনে পাটুকুনয়, গরদের ধুতি।কপালে রক্তচন্দনের ত্রিপুক, গলায় রুদ্রাক্ষেরমালা, মুখে তৃপ্তির হাসি।
চিৎকার করে উঠেছিল সুতনুকা : য়ু! য়ু সােয়াইন, মি লর্ড! কট্টর হিন্দুকুলতিলক মহা ধার্মিক-জাস্টিস্ বিনায়ক প্যাটেল।……….