প্রথমবার নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে দেখে একটু চমকে গেলাম। কলকাতার মেট্রো স্টেশন এর চেয়ে অনেক থকথকে আর পরিষ্কার। গ্র্যান্ড সেন্ট্রালে টিকিট কাটব, মেশিনের কাছে দেখি একটা ট্রেনের কার্ড রাখা। আমি সেটা একটু ওপরে তুলে ধরে এদিক-ওদিক তাকালাম, কেউ সাড়া দিল না। শেষে এক বুড়ো ভবঘুরে এসে বলল, ওটা এর কার্ড। আমি দিয়ে দিলাম। ক্রেডিট কার্ড ছোঁয়াচ্ছি, কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। আমার আজ হাডসন নদীতে নৌ-ভ্রমণ করে নিউইয়র্ক দেখার কথা, হাতে সময় খুব একটা নেই। বিন্দু বিন্দু ঘাম হচ্ছে কপালে, বুঝতে পারছি। আজ সকালেই সান দিয়াগো থেকে নিউ ইয়র্কে নেমেছি।
সেই বুড়ো ভবঘুরে আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, “তোমার কার্ডে তো কাজ হচ্ছে না। আমি তোমায় সাহায্য করছি, । সাহায্য করো। আমি তোমায় র ঢুকিয়ে দিচ্ছি আমার কার্ড দিয়ে, তুমি আমায় ভেতরে, আমাকে দু’ডলার দাও।”
আমি রাজি হলাম না। তবে দু’ডলারে ঢুকিয়ে দেবে, মানে কার্ডটা অবশ্যই ওর নয়, কারণ, ভাড়া দু’ডলারের বেশি।
আমি অরাজি দেখে বলল, “তা হলে এমনি দু’ডলার দাও, কিছু খাইনি কাল থেকে। তোমার কাছে দু’ডলার কিছুই নয়। ”
এদিকে টিকিট হচ্ছে না, আর বুড়ো ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করছে। দু’ডলার দিয়ে দিলাম। ও একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল নতুন কাউকে পাকড়াতে । ক্রেডিট কার্ডে কাজ না হওয়ায় ডেবিট কার্ড ছোঁয়াতে দেখলাম, কাজ হল। এমন সময় পিছন থেকে একটি নারীকণ্ঠ শুনলাম, “এক্সকিউজ মি স্যার।”
টিকিটটা নিয়ে পিছন ফিরে দেখলাম, এক শ্বেতাঙ্গিনী তরুণী। মেয়েটি বলল, “এখানে কি একটা টিকিট পেয়েছেন? আমি । ভুল করে ফেলে গেছি মনে হচ্ছে।”
আমি বুঝে ফেললাম কয়েক মিনিট আগের ঘটনাটা। বুড়োকে ডাকলাম। বুড়ো আসতে সরাসরি বললাম, “এঁর টিকিটটা ফেরত দাও।” বুড়ো যেন আকাশ থেকে পড়ল, “কিসের টিকিট?”
আমি বললাম, “যেটা এইমাত্র তোমার বলে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলে — না দিলে এক্ষুনি পুলিশ ডাকব। দু’ডলার চেয়েছিলে, দিয়েছি। এবার এঁর টিকিটটা ফেরত দাও।”
বুড়ো আর কথা বাড়াল না। বিড়বিড় করতে করতে দিয়ে দিল টিকিটটা। মেয়েটি বেশ কয়েকবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। ইংরেজি শুনে বুঝলাম আমেরিকান নয়। দু’জনে স্টেশনের ভিতরে ঢুকলাম। দেখলাম, ট্রেন আসতে তখনও বেশ কয়েক মিনিট বাকি।
মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “নিউ ইয়র্কে প্রথম বার!”
মেয়েটি বলল, “হ্যাঁ, পারি থেকে গতকালই এসেছি। গ্রীষ্মে বেড়াতে। আপনি?”
বললাম, “ইন্ডিয়া থেকে, তবে আমেরিকায় আছি তিন বছর হয়ে গেল, আর নিউ ইয়র্কে এসেছি আজ সকালে। সান দিয়াগো থেকে।” মেয়েটি হাত বাড়িয়ে বলল, “লিজা।” আমিও হাত মিলিয়ে বললাম, “দেব।” মেয়েটি একটু অবাক হয়ে বলল, “দেভ? মানে দেভিদ? আপনাদের নাম তো এরকম হয় না। ”
আমি হেসে বললাম, “ডেভিড নয়,দেবমিত।”
লিজা বলল, “সান দিয়াগো! দাবমিত? মানে দাবমিত মাঁদাল?”
“হ্যাঁ, দেবমিত মণ্ডল।”
“এ বছর ইমিউনিটিতে পেপার?
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়াগো?
দেভিদ কোলব্যাঁর্তের ল্যাব?”
আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম, “হ্যাঁ, কোলবার্টের ডেভিড ল্যাব। কিন্তু আপনি এত সব জানলেন কী করে?”
লিজা ফরাসিতে কিছু একটা বিস্ময়বোধক শব্দবন্ধ বলল। যার মানে, ও একই বিষয়ে পিএইচডি করছে, পাস্তুর ইনস্টিটিউট থেকে। খুব শিগগির থিসিস জমা দেবে। ডেভিডের কাছে পোস্টডক্টরালের জন্য চেষ্টা করেছে। ডেভিড ওকে আমার সাম্প্রতিক পেপারটা পাঠিয়ে সেটা থেকে ভবিষ্যৎ কাজের পরিকল্পনা লিখে পাঠাতে বলেছে। পরিকল্পনা পছন্দ হলে ইন্টারভিউ হবে। “আমিও বিস্মিত হলাম, “সত্যি? দারুণ যোগাযোগ তো?”
লিজা বলল, “আমি তোমার প্রোফাইলও দেখেছি তোমাদের ল্যাবের সাইটে। তাই প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন দেখেছি!”
“লিজা বলল, “তোমার কি পরের ট্রেনটা ধরলে অসুবিধে হবে খুব?”
আমি বললাম, “আসলে আমার আজ বারোটা থেকে নৌ-ভ্রমণের টিকিট কাটা আছে, নৌকো ছেড়ে গেলে আমার তিরিশ ডলার জলে যাবে। আর বাকি দিনের প্ল্যানটাও ঘেঁটে যাবে।” লিজা একটু বিমর্ষ হয়ে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। কাল তোমার কোথায় যাওয়া আছে?”
আমি বললাম, “কাল তো লিবার্টি আইল্যান্ড আর এলিস আইল্যান্ডের প্ল্যান।”
লিজা বলল, “গ্রেট, আমারও তাই প্ল্যান। তা হলে কাল কি আমরা একসঙ্গে বেড়াতে পারি? তখন রিসার্চ নিয়েও কিছু কথা বলা যাবে।”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, কেন নয়?”
দূরে আমার ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছিল।
লিজা দ্রুত আমার নম্বর নিয়ে বলল, “থ্যাঙ্কস! আমি তা হলে পরে যোগাযোগ করছি।”
ট্রেন থেকে নেমে দৌড়ে দৌড়ে ফেরিঘাট পৌঁছলাম। তিন মিনিট বাকি ছিল। ডেকের ওপর বসে নিউ ইয়র্কের সব বিখ্যাত বহুতল বাড়ি, ব্রিজ, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে দেখতে চললাম। আকাশ মেঘলা, তাই ক্যামেরায় ছবি ভাল আসছিল না। একটু শীত শীতও করছে হাডসন নদীর হাওয়ায়। আমি লক্ষ্য করলাম, ডেকে আমিই একা। বাকিরা হয় দু’জন, নয়তো বড় গ্রুপে। সবাই গ্রুপে ছবি তুলছে কিংবা দু’জনে একসঙ্গে সেলফি তুলছে, আমিই একা একা সেলফি তুলতে লাগলাম। কেমন যেন বোকা বোকা লাগছিল নিজেকে মেসেজ ঢুকল টুং করে, ‘নৌকো পেয়েছ আশা করি । মজা করো। কাল সকাল ন’টা নাগাদ দেখা হবে লিবার্টি আইল্যান্ডের ফেরিঘাটে,লিজা।
মনে হল, লিজা আজ সঙ্গে থাকলে বেশ ভাল হত। ট্রেন-নৌকো সব মিলিয়ে তাড়াহুড়োয় লিজাকে কেমন দেখতে, মন দিয়ে খেয়াল করিনি। এখন মনে হল, বাতিচেল্লির ভিনাসের মতো। আর এত সুন্দরী একটা মেয়ে, তাও আবার ফরাসি, তার সঙ্গে কাল সারা দিন ঘোরা যাবে ভেবে মনটা বেশ পুলকিত হয়ে উঠল।
দুই
পরদিন সকালে ন’টার আগেই ব্যাটারি পার্ক পৌঁছে গেলাম। দেখি, মস্ত লাইন পড়েছে। একজন একটা টুলের ওপর স্ট্যাচু অফ লিবার্টি সেজে সকলের সঙ্গে ছবি তুলছে এক-দুই ডলারের বিনিময়ে। কিন্তু লিজা কোথায়! এদিক- ওদিক তাকাতেই মেসেজ ঢুকল, ‘তোমায় দেখতে পাচ্ছি। টিকিট কালেক্ট করে লাইনের পেছন দিকে এসো। আমি লাইনে আছি, লাইন ছাড়তে পারছি না।’
লাইনে যেতেই দেখা হয়ে গেল। একসঙ্গে এগোতে এগোতে লিজার প্রচুর প্রশ্ন। আমি কী করে ডেভিডের ল্যাবে সুযোগ পেলাম?
বস হিসেবে ডেভিড কেমন? ল্যাবের পরিবেশ কেমন ?
আমি বললাম, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, সারা দিন আছে তো, আস্তে আস্তে আলোচনা করা যাবে। তুমি দেশে ফিরছ কবে?”
লিজা বলল, “দেশে ফিরতে একটু দেরি আছে, এখান থেকে মন্ট্রিয়েল যাব, কানাডা।” আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “মন্ট্রিয়েলে ইন্টারন্যাশনাল ইমিউনো কনফারেন্সে যাচ্ছ নাকি?”
লিজাও উত্তেজিত, “হ্যাঁ তো, তুমিও যাচ্ছ নাকি?”
বললাম, “ইয়েস।”
লিজা খুব খুশি হয়ে বলল, “দারুণ ব্যাপার। অদ্ভুত যোগাযোগ। অবশ্য এখানে দেখা না হলেও কনফারেন্সে দেখা হতই, আর সেখানেও তোমাকে ল্যাবের কথা জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করতাম। থাকছ কোথায়? এবার বোলো না, সেন্ট পলস হস্টেলে থাকছ?” “হ্যাঁ, সেখানেই তো। একটাই তো সস্তায় থাকার জায়গা পেলাম। তুমিও ওখানে জুটলে?”
“হ্যাঁ, একই কারণ। চলো, খুব মজা করা যাবে আর তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখাও যাবে।”
বললাম, “এখন আগে লেডি লিবার্টির দর্শন তো করা যাক।”
লিজার মুখে প্রচ্ছন্ন ফরাসি জাত্যভিমান ফুটে উঠল, “জানো তো, এই স্ট্যাচু অফ লিবার্টি কিন্তু ফ্রান্স উপহার দিয়েছিল।”
জানতাম। তাও লিজাকে খুশি করার জন্য বললাম, “তাই নাকি?”
লিবার্টি দ্বীপে নেমে লেডি লিবার্টিকে প্রথম দেখে উত্তেজনায় লিজা মাতৃভাষায় চিৎকার করে উঠল। লিবার্টির ভাস্কর্য ভাস্কর্য দেখে আর হ্যান্ডসেটে তার ব্যঞ্জনা শুনে মন ভরে গেল। দু’জনে লিবার্টি দ্বীপের বিখ্যাত লেমনেড খেলাম। সেখান থেকে এলিস দ্বীপে গেলাম। আগে যেখানে জাহাজ ভিড়লে, শরীর-স্বাস্থ্য, টাকাকড়ি, জাতপাত সব বিচার করে আমেরিকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হত। দু’জনে আবার ফেরি করে মূল ভূখণ্ডে ফিরলাম। চললাম এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং দেখতে। মানে ছিয়াশি তলায় চড়ে নিউ ইয়র্ক দেখতে। লিফট খুব দ্রুত ছিয়াশি তলায় পৌঁছে দিল। এখন সূর্যাস্ত হবে। পশ্চিম রেলিং জুড়ে মারাত্মক ভিড়। সবাই বেশ লিবাহ বেশ আগে থেকেই এদিক-ওদিক অপেক্ষা করছে। জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। -ওদিক করে একচিলতে জায়গা বের
করলাম। কিন্তু সেটা একজনের জন্যও যথেষ্ট নয়। নিউ ইয়র্কের আকাশছোঁয়া বাড়ির ওপর সূর্যের পড়ন্ত আলো পড়ছে। লিজা আমার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধে ভর করে রেলিং দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগল। লিজার ফরাসি সুবাস আমার নাকে ঢুকছে। লিজার স্তন আমার বাহু ছুঁয়ে আছে। আমার একটু অস্বস্তি লাগছে, আবার ভালও লাগছে। লিজা কি বুঝতে পারছে?
নাকি বুঝতে পেরেও কিছু করার নেই বলে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যাস্ত হল। ধীরে ধীরে শেষ রেশটুকুও চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঝকমক করে উঠল নিউ ইয়র্ক। এবার একটু ঠিক করে দাঁড়ানোর জায়গা হল। লিজা অবশ্য কিছুক্ষণ একই ভাবে আমার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বললাম, “তা হলে চলো, এবার টাইম স্কোয়ারের মোচ্ছবটা দেখে আসা যাক।”
তিন
পরদিন আমার পরিকল্পনা ছিল ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে আধবেলা কাটিয়ে তারপর মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট বা মেট-এ
যাব। দুটোই কাছাকাছি। লিজা শুনে বলল, “তুমি কি পাগল! মেট ঠিকঠাক দেখতে তিন দিন সময় লাগে, তুমি তিন ঘণ্টায় শেষ করবে? মেট বিশ্বে দ্বিতীয়, ল্যুভ্র্-এর পরেই। আমাদের পারিতেও বিরাট ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম আছে, সেটা আমার দেখা। আমি তাই মেট-এই যাব।” আমি জানতাম। লিজা প্যারিসের কথা টানবেই। বেশির ভাগ ফরাসির মতো লিজারও বোধ হয় এখনও বিশ্বাস হয় না যে, প্যারিসের
সেই গত শতকের এখন অনেকটাই গরিমা এখন অস্তমিত। তাই কালকেও এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং থেকে ফেরার সময় আইফেল টাওয়ারের ওপর থেকে প্যারিস দেখার কথা, টাইম স্কোয়ারে গিয়ে শঁজে লিজের কথা বলছিল। আমাদের নস্টালজিক কলকাতার বাঙালিদের সঙ্গে লিজার বেশ মিল আছে। এদিকে লিজা বলেই চলেছে, “তুমি জানো মেট-এ কাদের ছবি আছে?” দু’-তিনটে নাম জানি সাকুল্যে, আন্দাজে চোখ বুজে বলে দিলাম, “হ্যাঁ, পিকাসো, ভ্যান গখ, গগ্যাঁ।”
“মাতিস, রনোয়া— কে নেই? তা ছাড়া কত দেশের প্যাভিলিয়ন— গ্রিক, রোমান, বাইজান্টাইন, ইজিপশিয়ান, আফ্রিকান, এশিয়ান। ইন্ডিয়ানও আছে।” শেষেরটা আমায় । আমি বললাম, “এখানে ইন্ডিয়ার প্যাভিলিয়ন দেখে আমি কী করব? ও আমি জানি। কয়েকটা গণেশ, বিষ্ণু, নটরাজ আর সূর্যমূর্তি থাকবে। ‘আগ্রহী।
আর প্রচুর বুদ্ধমূর্তি থাকবে। ওসব আমাদের জাদুঘরে আমি ছোটবেলায় অনেক দেখেছি।”
লিজা আমার ধৃষ্টতা দেখে ইংরেজিতে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। শেষে বলল, “অল রাইট, আর্ট বোঝা সবার কম্ম নয়। যে-রকম তোমার ইচ্ছে।”
আমি বললাম, “আমি তো আর ফরাসি নই, তাই অত আর্ট-টার্ট বুঝি না।” লিজা একটু খুশি হয়েও ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলল, “শুরু হল সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া স্টিরিওটাইপিং। আর কী কী ধারণা আছে শুনি ফরাসিদের সম্পর্কে?” আমি বললাম, “তোমরা শিল্প-কাব্য এসবে খুব পারদর্শী। রন্ধনপটীয়সী।”
“এগুলোর কোনওটাই সম্পূর্ণ সত্য নয়। কাব্য-শিল্প-রান্না এসব করা কি মুখের কথা নাকি? ইন্ডিয়ান কুইজিনও তো খুব বিখ্যাত, তাই বলে ইন্ডিয়ায় সবাই কি শেফ নাকি?”
“তা বটে। তারপর ধরো, ফরাসিরা জন্ম রোম্যান্টিক। এত রোম্যান্টিক যে, চুমু পর্যন্ত ফরাসি! সবার জন্য অবারিত দ্বার।” “গোদা রক্ষণশীল ফরাসিরও কোনও অভাব নেই ফ্রান্সে, মঁসিয়ে। আর-একটু হলেই তাদের
ভোটে ল্যু পেন জিতে যেত। আর ফরাসি চুম্বন তো ব্রিটিশ আর আমেরিকানদের দেওয়া নাম। সেও ওই স্টিরিওটাইপিং থেকেই।”
“আর প্যারিসে তোমরা বিদেশিদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করো। বিশেষত, আমেরিকানদের সঙ্গে। আমার এক আমেরিকান বন্ধুর প্যারিসে
গিয়ে খুব খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে।”
“মোটেই তা নয়। সেটা কোনও একজনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হতে পারে। আর?” “তোমাদের শব্দে ল্যাজা মুড়ো বাদ দিয়ে উচ্চারণ করতে হয়। তাই বিদেশিদের জন্য খুব কঠিন, ফরাসি উচ্চারণ করা। ইংরেজি তুলনায় সহজ।”
লিজা বলল, “সেনেগাল, আইভরি কোস্টের লোকেরা কিন্তু ভাল ফরাসি বলে! ওদের কাছে ফরাসি সহজ।” কথাটার প্যাঁচটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। লিজা মনে করিয়ে দিল, আমরা ইংরেজদের শাসনে ছিলাম, সেই কারণে ইংরেজি সহজ লাগে। সেনেগাল, আইভরি কোস্ট ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল, তাই ফরাসি ওদের সহজ লাগে। এমন মোক্ষম আক্রমণে আমি একটু দিশাহারা হয়ে গেলাম। কিন্তু এই অপমানের জবাব না দিতে পেরে মনটা খচখচ করতে লাগল।
বললাম, -একটা আছে। তবে সেটা বলা বোধ হয় পলিটিকালি কারেক্ট হবে না।”
“আরে, বলোই না!” “লোকে বলে, তোমরা চান করো, যখন নৌকোডুবি হয়। আর তোমাদের গায়ের গন্ধ ঢাকার জন্য তোমাদের সুগন্ধী বানাতে হয়।” “তোমায় নিশ্চয়ই কোনও ব্রিটিশ এটা বলেছে? ওরা নিজেরা চান করে না, আর অন্যদের বদনাম করে। আমার গায়ে দুর্গন্ধ পাচ্ছ?
“সে তো তুমি তোমাদের জগদ্বিখ্যাত পারফিউম মেখে আছ, তাই দুর্গন্ধ ঢাকা পড়ে গেছে।”
“মোটেই না। আমরা যথেষ্টই চান-টান করি। ব্রিটিশদের মতো নই। ওরা ঢের বেশি নোংরা।
ওরা..
আমি দেখলাম, ব্যাপারটা ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ পুরনো দ্বন্দ্বে চলে যাচ্ছে। বললাম,“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি এখন ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে যাই, দুপুরে মেট-এ আসছি, তখন আবার কথা হবে!” দুপুরে যখন মেট-এ এলাম, হু হু করে সময় বেরিয়ে গেল। একটা প্যাভিলিয়নও ভাল করে দেখা হল না। বুঝলাম, সত্যি এটা কয়েক ঘণ্টার নয়, দু’-তিনদিনের ব্যাপার। কাল আবার ডলার গুনে টিকিট কাটতে হবে। লিজারও কাল আসার ইচ্ছে। লিজাকে বলতে বলল, “কাল আবার আসবে কেন? তোমার তো ফরাসিদের মতো আর্টে আগ্রহ নেই!” পরদিন মেট প্রায় অনেকটাই দেখা হল। তাও বাকি রয়ে গেল। তার পরদিন সকালে লিজার কোলা ফ্লাইট, আমার দুপুরে।
মেট থেকে বেরিয়ে লিজা হাত বাড়িয়ে বলল, “খুব ভাল লাগল তোমার সঙ্গে তিনদিন কাটিয়ে। ভেবেছিলাম একা একাই নিউ ইয়র্ক ঘুরতে হবে। কিন্তু তোমার মতো একজন বন্ধু পেয়ে গেলাম অপ্রত্যাশিতভাবে। মন্ট্রিয়েলেও বেশ মজা করা যাবে একসঙ্গে। তা হলে কাল আবার দেখা হচ্ছে নতুন দেশে, নতুন শহরে।” বিদায়বেলায় আমি পাশ্চাত্য প্রথামতো জড়িয়ে ধরতে যেতে, লিজা খুব আলতো করে জড়িয়ে বলল, তোমায় আমি জড়িয়ে ধরতাম না। তোমরা ভারতীয়রা তো এরকম করো না বলেই জানি।”
আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম। বললাম, “কাল সন্ধেয় দেখা হচ্ছে। শুভযাত্রা।”
চার
মন্ট্রিয়েলে আমাদের কনফারেন্স ভালই হয়েছে।
আমার মঞ্চে বলার ব্যাপার ছিল আর লিজার কাজটা ছিল পোস্টারের মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের প্রশংসা পেয়েছে আমার কাজ।
লিজাও ওর পোস্টারের জন্য পুরস্কার পেয়েছে। কাছাকাছি কাজের বিষয়ের সুবাদে লিজা আর আমার সঙ্গে বাংলাদেশের এক যুগল— তারা স্বামী-স্ত্রী, একটি হাঙ্গেরিয়ান ছেলে আর এক আমেরিকান-পাকিস্তানি মেয়ের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। কনফারেন্সের পর বিকেলে আমরা দলবেঁধে পায়ে হেঁটে মন্ট্রিয়েলে ঘুরতাম।
একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, ঘোরা, অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা, পরের দিন ভোরে উঠে আবার দৌড়ে কনফারেন্সে যাওয়া ঝড়ের মতো কেটে গেল চারটে দিন। এর মধ্যে লিজার সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও বেড়ে উঠেছে। লিজাকে আমাদের ল্যাবে আসার জন্য সবরকম তথ্য দিয়ে দিয়েছি। আমরা দু’জনেই আশাবাদী, ডেভিড লিজাকে নিতে বাধ্য। ব্যাঙ্কোয়েট ডিনারের মাধ্যমে আমাদের কনফারেন্স শেষ হল। পরদিন বাকি বন্ধুরা বিদায় নিল। আমার হাতে আরও তিন দিন ছিল মন্ট্রিয়েল ঘুরে বেড়ানোর। লিজাও আর কিছুদিন থাকবে। ওর এখানে নাকি অনেক আত্মীয়স্বজন আছে। তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
কানাডার মধ্যে হলেও মন্ট্রিয়েলের ভাষা- সংস্কৃতি সবই ফরাসি। গ্রীষ্মকাল। ফরাসি- কানাডিয়ান সুন্দরীরা বেশ খোলামেলা পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ প্রেমিকের চুম্বনরত। পাশ থেকে সঙ্গে পাশ থেকে জনস্রোত আর সময় দুই-ই বয়ে যায়, তবু তাদের ভালবাসার তীব্রতা আর আশ্লেষে ভাটা পড়ে না। আমেরিকার রাস্তাঘাটে এত খোলামেলা পোশাকের ফ্যাশন আর ভালবাসার উষ্ণতা খুব-একটা চোখে পড়েনি আমার। লিজাকে বললাম, “ক্যালিফোর্নিয়ার মেয়েদের চেয়ে তো মন্ট্রিয়েলের মেয়েদেরই বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছে।” লিজা বলল, “হ্যাঁ, খোলামেলা পোশাকে ঘুরছে বলে বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছে। কাল আমিও খোলামেলা পোশাক পরব, আমাকেও তোমার সুন্দরী মনে হবে?”
আমি বললাম, “তোমাকে তো এমনিতেই সুন্দরী মনে হয়, খোলামেলা পোশাকে রূপ আরও খুলবে, তাতে সন্দেহ নেই। আমি আগ্রহী দেখতে!”
লিজার মোমের মতো সাদা গালে একটু যেন রক্ত ছলকাল। বলল, “বাঃ, বাঃ, ক’দিনেই ফরাসি মেয়ের পাল্লায় পড়ে বেশ ফ্লার্ট করতে শিখেছ দেখছি! গুড।” আমি আর লিজা হাঁটা লাগালাম নোত্র দাম ব্যাসিলিকার উদ্দেশে। এখানকার প্রথম আর সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল। লিজা প্রত্যাশিতভাবেই মনে করিয়ে দিল এই গথিক ডিজাইনের নোত্র দাম-এর সঙ্গে প্যারিসের নোত্র দাম-এর প্রচুর মিল। সেখান থেকে ওল্ড পোর্টে এসে সেন্ট লরেন্স নদীতে নৌকোয় করে শহর দেখলাম। এসব করতে করতে বেশ বিকেল হয়ে গেল। যদিও গ্রীষ্মে আলো থাকে অনেকক্ষণ। আমরা ডিনার করতে ঢুকলাম এক বিকেল হয়ে গেলা ফরাসি রেস্তরাঁয়। আমার ফরাসি খানা নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই লিজাকেই অর্ডার করতে বললাম। লিজা রুটির ভেতর ডিম, চিংড়ি,নানারকম চাল। লতাপাতা দেওয়া দু’রকমের দুটো ডিশ নাম ক্রেপ।
বেশ ভালই লাগল। অবশ্য যত না ভাল লাগল, তার চেয়ে ফরাসি খাবার বলে লিজাকে খুশি করতে বিগলিত প্রশংসা করলাম।
লিজা খুশি হয়ে বলল, “পারিতে এসো। এর চেয়েও ভাল ক্রেপ খাওয়াব।”
আমি বিল মেটানোর জন্য ক্রেডিট কার্ডটা দিতে, লিজাও নিজের কার্ড বের করল। আমি বললাম, “আমি দিচ্ছি তো!”
লিজা না না করা সত্ত্বেও আমি জোর করে দিতে গেলাম। লিজা তখন হেসে বলল, “তুমি তো আমার বয়ফ্রেন্ড নও, বরও নও। তা হলে তুমি কেন দেবে?”
কথাটা হেসে বললেও আমার কানে খুব রূঢ় লাগল। দু’জনের মধ্যে বিল ভাগ হয়ে গেল। আমার নিজেকে খুব অপমানিত লাগছিল। আমি রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে জ্যান্স কার্টিয়ার চত্বরে এসে চুপচাপ | একটা বেঞ্চে বসলাম। লিজা ও পাশে বসল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে, আদিখ্যেতা করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি দুঃখ পেলে আমার কথায়?”
আমি ওর দিকে না তাকিয়ে বললাম, “না, তুমি ঠিকই করেছ। আমারই ভুল ছিল।”
লিজা বলল, “আমি দুঃখিত। ভেবে দ্যাখো, আমার থাকা-খাওয়া আজকে পর্যন্ত ইনস্টিটিউট থেকে পাব। তোমাকেও নিশ্চয়ই খালি তোমারটা দেওয়া হবে। আমারটা শুধুশুধু তোমায় দিতে হত।”
বললাম, “সেটা তখন বললেই হত।”
“কিন্তু কথাটা কি ভুল? তবে বয়ফ্রেন্ড না হলেও তুমি ফ্রেন্ড অবশ্যই, খুব ভাল বন্ধু। বন্ধু হিসেবে আমার খুব ভাল লাগে তোমায়,” বলে আমার মুখটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে গালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল। বলল, “এমনিই আমাদের নিয়ে স্টিরিওটাইপের শেষ নেই। ফরাসি । মেয়েরা নাকি সবসময় রাজকন্যার মতো ব্যবহার আশা করে। রূপের ডালি খুলে ছেলেদের মুণ্ডু ঘুরিয়ে সর্বস্বান্ত করে। ছেলেদের সঙ্গে বেরোলে কোথাও বিল পে করে না।
আমি চাই না, এরপর কোনও এক ভারতীয় কোনও এক ব্লগে কখনও লিখুক, আমার সঙ্গে এক ফরাসি মেয়ের আলাপ হয়েছিল। সে তার মন্ট্রিয়েলে থাকা-খাওয়ার খরচ আমার ওপর দিয়েই চালিয়ে দিয়েছিল।”
এবার আমি হেসে ফেললাম। বললাম, “আমার সঙ্গে এক সুন্দরী ফরাসি মেয়ের আলাপ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে বিল দিতে দেয়নি, সেটা নিশ্চয়ই লিখব।”
পাঁচ
পরদিন লিজার পাল্লায় পড়ে মাউন্ট রয়্যালে পায়ে হেঁটে উঠতে হল। মাউন্ট রয়্যাল শহরের মধ্যেই সবুজ জঙ্গলঘেরা অদ্ভুত সুন্দর একটা পাহাড়। তার ওপর থেকে সূর্যাস্তের সময় সবাই মন্ট্রিয়েলের স্কাইলাইন দেখে। এত চড়াই ভেঙে দু’জনেই বেদম হয়ে গেলাম। বহুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম দু’জনে। সন্ধে পর্যন্ত থাকার ইচ্ছে থাকলেও থাকা গেল না। কারণ, কাছেই সেন্ট জোসেফ ওরেটারি কানাডার সবচেয়ে বিশালাকার চার্চ। সেটাও দেখার ছিল। চার্চটি বহুতল। যিশুর জীবনের বহু ঘটনার ভাস্কর্য পাহাড়ের ওপরেই। প্রতিটি তলাই আমরা মন দিয়ে ঘুরলাম। সন্ধে নামছে বলে লোকজন কম। আমরা ব্যালকনিতে এলাম। এতবড় ব্যালকনিতে আমরা মাত্র দু’-চারজন। দু’জনে পাশাপাশি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
লিজা মৃদুকণ্ঠে বলল, “কী অদ্ভুত, না! আমরা দু’জন দুটো আলাদা মহাদেশের লোক। ক’দিন আগে পরস্পরকে চিনতামও না। সেখানে গত সপ্তাহে একটা তৃতীয় মহাদেশের শহর থেকে একসঙ্গে সুর্যাস্ত দেখলাম, আজ আবার অন্য দেশের একটি শহর থেকে দেখছি।”
সূর্যাস্ত আসন্ন। সূর্য রাঙা হয়ে গেছে। রাঙা আলো মেঘের ফাঁক দিয়ে লিজার মুখে পড়ছে। মুখটাও নরম আলোয় রাঙা হয়ে গেছে। আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমি লিজার সরু কোমর জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকালাম। লিজা বাধা দিল না, সাড়াও দিল না। লিজা সাড়া দিল না বলে, আমারও ঘোর কেটে গেল। আমি খুব লজ্জিতভাবে বললাম, “আমি দুঃখিত, হঠাৎ করে হয়ে গেছে। আমি সত্যিই দুঃখিত।”
লিজা বিশেষ কিছু বলল না। “ইটস ওকে,” বলে এ নিয়ে আর কোনও আলোচনাতেই গেল না। আমিও মরমে মরে যেতে লাগলাম।
ফেরার সময় আমি চুপ করে ছিলাম। ‘মি টু’ আন্দোলনের কথাও মনে এল। তবে লিজা ল্যাবের কথা-টথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করল। আমিও স্বস্তি পেলাম।
ডিনারের পর লিজা একটু তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ল। বসা হল জ্যাক্স কাটিয়ারের খোলা রাস্তার ওপরে পানশালায়। সুন্দরী লাস্যময়ী তরুণীরা হাসি আর করুণা ছড়াতে ছড়াতে হেঁটে যাচ্ছে পাশের রাস্তা দিয়ে। লিজা দু’গেলাস ওয়াইন খেল, • আমি মকটেলেই সুখী রইলাম।
পানশালা থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে কাছেই সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে গিয়ে বসলাম, একটা বিরাট উঁচু বাড়ির দেওয়ালে মন্ট্রিয়েলের কয়েকশো বছরের ইতিহাস সিনেমার মতো দেখাচ্ছে। সারা গ্রীষ্মকাল জুড়েই প্রতিদিন এটা দেখানো হয়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেশ কয়েকজন লোক ঘাসে শুয়ে-বসে তা দেখছে। আমরাও বসলাম দেখতে। টুকটাক কথা বলছি,
লিজা গায়ে গা ঠেকিয়ে বসেছে। ওর ঘন শ্বাসের শব্দও আমি শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ লিজা আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। আমার কাছে ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত মনে হল না, আমিও ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলাম। পরিপূর্ণ চুম্বন, দু’জনেই দু’জনকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে। লিজার জিভ আমার জিভ স্পর্শ করতে লাগল। এক অপূর্ব আচ্ছন্নতায় আমার হাত লিজার শরীরে ঘুরতে লাগল। লিজা কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “আরও চাও? তা হলে রাতে আমার ঘরে এসো।”
মন্ট্রিয়েলের ইতিহাস শেষ হল। আলো জ্বলে উঠল। আমরাও হস্টেলে ফিরলাম। পথে লি আমার হাত ছাড়েনি। বুধবারের মন্ট্রিয়েলের আকাশজুড়ে তখন রঙিন আতসবাজির রোশনাই। গ্রীষ্মের বুধবারে নাকি এরকম জ্বালানো হয়।
রাতে শুয়ে ঘুম আসছিল না কিছুতেই, লিজা ওর ঘরে আহ্বান করেছিল, কিন্তু আমি উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। আমার ঠিক নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না, মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়েই বিছানায় যাওয়া যেতে পারে। লিজা আমার প্রেমিকা নয়, এমনকী বান্ধবীও বোধ হয় বলা যায় না। রাতের মোহিনী মায়ায় আর কিছুটা নেশার ঘোরে না হয়। হঠাৎ করে চুমু খেয়ে ফেলেছে, আর তাৎক্ষণিক সোহাগের উত্তেজনায় বলে ফেলেছে, যেমন বিকেলে আমি করে ফেলেছিলাম। মেসেজ করলাম, ‘জেগে?’
কোনও সাড়া পেলাম না। বুঝলাম, ঘুমিয়ে পড়েছে।
পরদিন সকালে দেখা হল যখন, কালকের কথা কিছু মনে আছে বলে মনে হল না। আমিও নিজের বিবেচনার জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিলাম। আমার মন্ট্রিয়েলের বোটানিক্যাল গার্ডেন আর অলিম্পিক স্টেডিয়াম দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু লিজার কিছু লেখালেখির কাজ ছিল। তাই একাই গেলাম। ১৯৭৬ সালে মন্ট্রিয়েলে আমি অলিম্পিক হয়েছিল। এখন খুব একটা দর্শনীয় সেখানে কিছু নেই। মশালের জায়গাটা দেখলাম। সব দেশের পতাকার সঙ্গে ভারতের পতাকাও উড়ছে পতপত করে।
পাশেই বোটানিকাল গার্ডেন। বিরাট জায়গা জুড়ে হাজার হাজার প্রজাতির গাছ। এর মধ্যে আবার চিনা উদ্যান, জাপানি উদ্যানও আছে। চিনা উদ্যানে গিয়ে দেখলাম, বিরাট একটা ড্রাগন তৈরি করা আছে। সেই ড্রাগনের গায়ে প্লাস্টিকের গোল আঁশে সবাই কিছু না-কিছু লিখে রেখেছে। এই ড্রাগন নাকি শুভ, মনের ইচ্ছা পূরণ হয় ড্রাগনকে বললে। আমার কী মনে হল, একটা আঁশ নিয়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের মতো লিখলাম, ‘দেব+লিজা’, তারপর সেঁটে দিলাম ড্রাগনের গায়ে। সন্ধেবেলায় রেস্তরাঁয় খেতে বসেছি। কনফারেন্সের পর একদিনের রাহাখরচ দেওয়া হয়। গতকাল থেকে নিজেদের পকেট থেকেই খরচা হচ্ছে। এই চত্বরে এই রেস্তরাটাই একটু সস্তা অন্যগুলোর তুলনায়। খাবার পর র বিলের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ আমার আমার মোবাইলে জমেল ঢকল। দেখলাম, সিএসআইআর একটা থেকে এসেছে। একটা ভাল খবরের প্রত্যাশায় হৃৎপিণ্ডটা লাফাতে লাগল। মেলটা [ খুললাম। যা ভেবেছি, একটা সিএসআইআর সংস্থায় বৈজ্ঞানিক চ হিসেবে। | চাকরি পেয়েছি। লিজা জিজ্ঞেস করল, “ভাল খবর মনে হচ্ছে? নতুন পেপার হল?”
আমি বললাম, “না, তার চেয়েও ভাল খবর।
আমি দেশে চাকরি পেয়েছি। নিজের শহরে। এবার নিজের ল্যাব। স্বাধীন বিজ্ঞানী। দু’মাসের লিজাও উৎফুল্ল হয়ে মধ্যে যোগ দিতে হবে।”
হয়ে বলল, “দারুণ খবর, তা হলে তো আজ ডিনার তুমিই খাওয়াচ্ছ?” আমার কেন যেন মনে হয়েছিল লিজা একটু বিমর্ষ হবে, দুঃখ পাবে। কিন্তু লিজার মধ্যে সে সব কিছু না দেখতে পেয়ে এত ভাল চাকরির
খবর, দেশে ফেরার আনন্দ, সব যেন কেমন একটু ফিকে হয়ে গেল। লিজা বলল, “কী ভাবছ?” বললাম, “ভাবছি, সব ছেড়ে এখনই চলে যাওয়া ঠিক হবে কি না! ডেভিডের কাছে থাকলে আরও ভাল একটা পেপার হবে, আমি জানি।” লিজা বলল, “খুব ঠিক হবে, তোমার সঙ্গে এই ক’দিন মিশে বুঝেছি, তুমি তোমার দেশ শহর তোমার মা তোমার পরিবার, এদের খুব মিস করো। তুমি তো ফিরতেও চাও। তা হলে আর দেরি কেন, সুযোগ যখন পেয়েছ?” আমি একটু ম্লান গলায় বললাম, “ঠিকই বলছ হয়তো।”
তারপর হঠাৎ মনে হল, ডেভিড লিজাকে নিলে তো আমার কাজের পরের অংশের জন্যই নেবে। কারণ, ওর দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা আমার কাজের অংশেই। আমার চলে যাওয়া লিজার জন্য বড় সুযোগ। এক, ডেভিড সেক্ষেত্রে ওকেই নেবে। আর দুই, আমার অনেকটা এগিয়ে রাখা কাজ শুর হয়ে যাবে। সেটাই তাহলে এত খুশি আর আমাকে ল্যাব ছাড়তে এত উৎসাহ দেওয়ার কারণ। আমার মনটা লিজার প্রতি একটু বিমুখ হয়ে গেল। যদিও সেটা অযৌক্তিক। কারণ, এখানে কেউ কিছু হারাচ্ছে না,
কেউ কারও পথে বাধা হচ্ছে না, অথচ দু’জনেই লাভবান হচ্ছে। তবুও আমার খালি মনে হতে লাগল, আমি যেন কিছু হারাতে চলেছি।
হস্টেলে ফেরার পথে লিজা একটা দীর্ঘশ্বাস প্রশ্বাস ফেলে বলল, “ভেবেছিলাম একসঙ্গে কিছুদিন কাজ করা যাবে। সেটা আর হল না! অবশ্য ডেভিড না নিলে। এমনিও হবে না।” আমি একটু নিরাসক্ত গলায় বললাম, “ডেভিড নিয়ে নেবে। আমার জায়গাতেই নেবে। চিন্তা কোরো না।”
লিজা বলল, “দেখা যাক,প্রোপোজালটা পাঠাই। তুমি প্লিজ ওকে বোলো না যে, প্রোপোজালটার অনেকটাই তোমার আইডিয়া!”
বললাম, “বলব না! অল দ্য বেস্ট!”
লিফা বলল, “কাল আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন?
কাল একসঙ্গে আমরা ব্রেকফাস্ট করতে পারি। আমার ফ্লাইট তো বারোটায়।”
লিজা বলল, “না, কাল খুব ভোরে আমার ট্রেন আছে। কুবেক সিটির। আমার কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাব।”
“কত ভোরে? ”
“ভোর ছ’টায়।”
“তা হলে তো সত্যিই আর দেখা হওয়া রেখো।”
মুশকিল। তোমার সঙ্গে গত দু’সপ্তাহ খুব ভাল কাটল। ভাল করে কাজ করো। যোগাযোগ “তুমিও যোগাযোগ রেখো। যদি মেল করি, অপরিচিতের মতো ব্যবহার কোরো না। নতুন চাকরি, নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভেচ্ছা।” বলে নিজেই আমায় জড়িয়ে ধরল, আমিও জড়িয়ে ধরলাম দৃঢ়ভাবে। আমি বোধ হয় একটু বেশি জোরে জড়িয়ে ধরেছিলাম, লিজা ছাড়িয়ে নিল আস্তে আস্তে।”
ছয়
মন্ট্রিয়েলের কনফারেন্সের পর প্রায় তিনমাস কেটে গেছে। সকালে মেল চেক করছিলাম। লিজার একটা মেল ঢুকল। লিজার সঙ্গে এর মধ্যে খুব একটা যোগাযোগ হয়নি। খালি ঠিকঠাক পৌঁছেছি কি না, এরকম সামান্য কিছু কথা। আর ডেভিডের প্রোপোজালটা পাঠিয়েছিল দেখে দেওয়ার জন্য। আমি কিছুটা হেঁটে-কেটে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ভাবলাম, লিজা নিশ্চয়ই ডেভিডের কাছ থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়ে ধন্যবাদ জানাতে
মেল করেছে।
লিজা লিখেছে:
‘প্রিয় দেব, ডেভিড আমাকে ওর ল্যাবে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। এর অনেকটাই তোমার কৃতিত্ব। সেজন্য তোমায় ধন্যবাদ। আমার সঙ্গে ডেভিডের যেটুকু কথা হয়েছে, খুব সম্ভবত তোমার প্রোজেক্টেই আমি যোগ দেব। ল্যাবে তোমাকে পাশে পেলে ভাল হত। নতুন দেশ নতুন সংস্কৃতি নতুন ল্যাবে তোমার মতো ভাল বন্ধু পেলে মানিয়ে নিতে সুবিধে হত। সে আর হল না।
যাই হোক, ইন্ডিয়ায় ফিরে তোমার কেমন গছে? নিজের ল্যাব সেট-আপ কতদূর এগোল?
লাগছে? তোমায় একটা কথা আমি আগে বলিনি। কারণ, বলার সঠিক সময় পাইনি। যখন বলব ভেবেছিলাম, সব একমূহূর্তে বদলে গেল। তোমার ব্যক্তিত্ব আর মেধায় আমি প্রথম থেকেই তোমার প্রতি খুব আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আকৃষ্ট হতে হতে শেষে কখন যেন আমি তোমায় ভালবেসেও ফেলেছিলাম। ফরাসি নিয়মে তোমার কাছে আমি তা প্রকাশও করেছিলাম। তুমি ফরাসি হলে বুঝতে পারতে। আমাদের প্রথম তীব্র চুম্বনই ভালবাসার অঙ্গীকার। আমি সেভাবেই তোমায় তা জানিয়েছিলাম।
তুমি তা না জেনেও আমার চুম্বন গ্রহণ করেছিলে। মনে হয় ভূমিও বোধ হয় আমায় ভালবেসে ফেলেছিলে। তোমার আবেগ-মথিত চুম্বন যেন তাই বলছিল। কিন্তু বলতে পারোনি বা নিজে বুঝতেও পারোনি। সে রাতে
ভাবতেও শুরু করেছিলাম, দু’জনে একসঙ্গে কাজ করব— থাকব, আদর করব, ভালবাসব। কিন্তু পরদিনই তোমার দেশে ফেরার ডাক আসায় হঠাৎ সব বদলে গেল। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, তাই বিদায়বেলাতেও
আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইনি।
আর তখন তোমায় আমার মনের কথা বলে, তোমায় নতুন দ্বিধায় ফেলতে চাইনি। কারণ, তুমি ফেরা নিয়ে একটু দ্বিধান্বিত ছিলে প্রথমে। নিজের দেশ নিজের পরিবার নিজের লোকজনের গুরুত্ব আমি বুঝি। নিজেকে যখন দেশ ছাড়তে হবে, তখন যেন আরও বেশি করে বুঝতে পারছি।”
আরও অনেক কিছু লিখেছে লিজা। লম্বা চিঠি। দু’সপ্তাহের অনেক ছোট ছোট মুহূর্তের অনেক সুখ-স্মৃতির কথা বলেছে লিজা।
আমি একটু ভেবে মেল করতে বসলাম। অত বড় চিঠি নয়। ছোট্ট চিঠি।
‘প্রিয় লিজা,
স্বীকার করি, ফরাসি চুম্বনে ভালবাসার অঙ্গীকারের নিয়মটা তখন আমি জানতাম না।
পরে জেনেছি যদিও। কষ্ট পাচ্ছ বলেই যে তুমি বিদায়বেলায় দেখা করতে চাওনি, সেটাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ, মন্ট্রিয়েল থেকে ক্যুবেক সিটির ন’টার আগে কোনও ট্রেন ছিল।
আর সেজন্যই যাত্রায় আমার আর দেশে ফেরা হল না। সান দিয়াগোয় স্বাগতম। আমার এখনকার রুমমেট চলে যাচ্ছে ক’দিন পরে। আমি এখন নতুন রুমমেট খুঁজছি। তুমি কি থাকবে আমার সঙ্গে?
তোমার দেব।’