দেবলোকের যৌনজীবন – অতুল সুর

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  ›› ১৮+  

(সংক্ষেপিত)

দেবলোকের যৌনজীবন

…মনুষ্যসমাজে পুরুষ অপরের স্ত্রীর প্রতি লালসা প্রকাশ করে বা অপরের স্ত্রীকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে বা নারী-পুরুষ অজাচার ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। গ্রীক দেবদেবীদের মধ্যেও তাই হতো।…

— জ্যুস তার অনূঢ়া ভগিনী ডিমিত্রাসে উপগত হয়ে কৃষিদেবী পারসিফোনের জন্ম দিয়েছিল।
— নিজ দুহিতা মিরহাতে উপগত হয়ে তার পিতা অ্যাডোনিস-এর জন্ম দিয়েছিল। এই অজাচারের জন্য মিরহাকে বৃক্ষে পরিণত হতে হয়েছিল।
— অ্যাক্টিয়ন নামে এক পৌরানিক শিকারী আর্টেমিসকে নগ্ন অবস্থায় স্নান করতে দেখেছিল বলে সে মৃগীতে পরিণত হয়েছিল।
— অ্যালকিন্তু তার নিজ ভগিণী এরিট্রকে বিয়ে করেছিল।
— সবচেয়ে বীভৎস হচ্ছে ইডিপাসের নিজ মাতাকে বিয়ে করে তার গর্ভে চারটি সন্তান উৎপাদন করা।
— প্রণয়ের দেবী অ্যাফ্রোড়িটিকে আমরা ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখি এবং ওই ব্যভিচারের ফলে তার অনেকগুলি সন্তান হয়েছিল।
— অ্যাপোলোকে আমরা দেখি ড্রাইওপি নামক পরীকে অপহরণ করতে।
— টিটিয়াসকে আমরা দেখি লিটোকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হতে।
— আটলাণ্টা কুমারী অবস্থায় মেলিয়াগারকে প্রসব করেছিল।

….এই বইয়ে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে মাত্র হিন্দুদের দেবলোকের যৌনাচার। সেজন্য এই বইয়ে আমরা হিন্দুদের দেবলোকের যৌনাচার নিয়েই আলোচনা করব।

॥ দুই ॥

মানুষ গোড়া থেকেই তার দেবতাকে নিজের স্বরূপে কল্পনা করে নিয়েছিল। সেজন্য মানুষের যে সব দোষ-গুণ আছে, তার দেবতাদেরও তাই ছিল। এটা বিশেষ করে লক্ষিত হয় দেবতাদের যৌনজীবনে। যৌনজীবনে মানুষের যে সব গৰ্হিত আচরণ আছে, দেবতাদেরও তাই ছিল। যৌনজীবনে সবচেয়ে গৰ্হিত আচরণ হচ্ছে ইনসেষ্ট’ বা অজাচার। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে যে যৌনসংসর্গ ঘটে, তাকেই অজাচার বলা হয়। তবে যে সমাজের মধ্যে এরূপ সংসর্গ ঘটে, সেই সমাজের নীতি-বিধানের ওপরই নির্ভর করে কোনটা অজাচার, আর কোনটা অজাচার নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের কোন কোন উপজাতির মধ্যে বিধবা বিমাতা ও বিধবা শাশুড়ীকে বিবাহ করার প্রথা আছে। অন্যত্র এটা অজাচার। উত্তর ভারতে বিবাহ সপিণ্ড-বিধান ও গোত্র-প্রবর-বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে অজাচার ঘটবার উপায় নেই। আবার দক্ষিণাত্যে মামা-ভাগ্নী ও পিসতুতো-মামাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ সামাজিক নিয়ম-কানুন দ্বারা স্বীকৃত। সেখানে এরূপ যৌনসংসর্গ অজাচার নয়। আবার প্রাচীনকালে ভ্রাতা ও ভাতৃবধুর মধ্যে যৌন-সংসর্গ অজাচার বলে গণ্য হত না। ভ্রাতা অস্বীকৃত হলে, অপরকে ডেকেও বিধবা বধূদের গর্ভসঞ্চার করানো হত। এরূপ গর্ভসঞ্চারের ফলেই মহাভারতের দুই প্রধান কুলপতি ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্ম হয়েছিল। অথর্ববেদে (৮৬৭ ) পিতা-পুত্রী ও ভ্রাতা-ভগিনীর মধ্যে যৌনমিলনের উল্লেখ আছে। নহুষ তার ‘পিতৃকন্যা’ বিরজাকে বিবাহ করেছিল ও তার গর্ভে ছয়টি সন্তান উৎপাদন করেছিল।

॥ তিন ॥

মানুষের এরূপ যৌনাচারের প্রতিফলন আমরা দেবতাদের জীবনেও লক্ষ্য করি। … বস্তুতঃ দেবতাদের আমরা ইন্দ্রিয়পরায়ণ, কামাসক্ত, অজাচারী, বহুপত্নীক ও ব্যভিচারীরূপে দেখি। … দেবসভায় আমরা যখন অপ্সরাদের নাচতে দেখি, … বস্তুত দেবসভা মুখরিত হয়ে থাকত অপ্সরাদের নাচগানে। নামজাদা অপ্সরাদের মধ্যে ছিল উর্বশী, মেনকা, রস্তা, তিলোত্তম, ঘৃতাচী, মুকেশী, মঞ্চঘোষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু, মুপ্রিয়া, সরসা, পঞ্জিকাস্থল ও বিশ্বাচী। নৃত্যকলায় এরা সকলেই ছিল পারদর্শিনী। তাদের সৌন্দর্য ও যৌন আবেদনের কথা সব সময়ই বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে। তারা ছিল স্বর্গের স্বাধীন নারী। তার মানে মর্ত্যলোকের বারযোযিতদের সঙ্গে তাদের কোন প্রভেদ ছিল না।

…ঋগ্বেদে দেখি যমী তার যমজ ভ্রাতা যমের কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করছে ; দস্ত নিজ ভগিনী মায়াকে, লোভ নিজ ভগিনী নিবৃত্তিকে, ক্রোধ নিজ ভগিনী হিংসাকে ও কলি নিজ ভগিনী নিরুক্তিকে বিবাহ করছে। আবার উষা সূর্যের জনয়িত্রী। কিন্তু সূর্য প্রণয়ীর ন্যায় তার অনুগমন করছে ও তাকে স্ত্রীরূপে বরণ করছে। ( পরে দেখুন)। মৎস্যপুরাণ অনুযায়ী শতরূপ ব্ৰহ্মার কন্যা। কিন্তু ব্ৰহ্মা কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হন। এই কন্যার গর্ভে ব্ৰহ্মা হতে স্বায়ম্ভুব মনুর জন্ম হয়। কিন্তু অন্য মতে ইনি স্বায়ম্ভুব মনুর স্ত্রী ও স্বায়ম্ভুব মনু হতে শতরূপার গর্ভে প্রিয়ত্রত ও উত্তানপাদ নামে দুই পুত্র ও কাকুতি ও প্রস্থতি নামে দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করে। আবার এদের পুত্রকন্যা হতে মনুষ্য জাতির উদ্ভব হয়। তার মানে জন্ম থেকেই মনুষ্যজাতির রক্তের মধ্যে অজাচারের বীজ উপ্ত হয়েছিল।

যৌনজীবনে দেবতাদের কোনরূপ সংযম ছিল না। আদিত্যযজ্ঞে মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে দেখে কামলালসায় অভিভূত হয়ে যজ্ঞকুম্ভের মধ্যে শুক্রপাত করে। অগ্নি একবার সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের দেখে কামোন্মত্ত হয়েছিল। ঋক্ষরজাকে দেখে ইন্দ্র ও সূর্য দুজনেই এমন উত্তেজিত হয়েছিল যে ইন্দ্র তার চিকুরে ও সূর্য তার গ্রীবায় রেতঃপাত করে ফেলে। রামায়ণ অনুযায়ী সূর্যের বীর্য তার গ্রীবায় ও ইন্দ্রের বীর্য তার বালে ( কেশে ) পড়েছিল।

॥ চার ॥

সূর্য অজাচারী দেবতা। চন্দ্র ব্যভিচারী দেবতা। চন্দ্র দক্ষের সাতাশটি মেয়েকে বিবাহ করেছিল। কিন্তু তাতেও তার কাম-লালসা পরিতৃপ্ত হয়নি। কামাসক্ত হয়ে সে দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে। দেবগুরু বৃহস্পতি নিজেও সাধু চরিত্রের দেবতা ছিলেন না। তিনি কামলালসায় অভিভূত হয়ে নিজ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী মমতার অন্তস্বত্বা অবস্থায় বলপূর্বক তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিলেন। আবার ঋগ্বেদে দেখি রুদ্রদেব তার নিজ কন্যা উষার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হয়েছিলেন। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। কিন্তু তিনিও পরস্ত্রী বৃন্দা ও তুলসীর সতীত্ব নাশ করেছিলেন।

এই তো গেল দেবলোকের যৌনজীবনের নমুনা। আগেই সূর্যের স্ত্রী উষার কথা বলেছি। উষাকে পাবার জন্য অগ্নি, সূর্য, ইন্দ্র ও অশ্বিনীদ্বয় দেবগণের মধ্যে ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। এই পাঁচজন শক্তিমান দেবতা উষার পাণিপ্রার্থী হওয়ায় প্রজাপতিগণ ঘোষণা করেন যে অনন্ত আকাশপথ অনুধাবনে যিনি কৃতকার্য হবেন ও সেই সঙ্গে যত বেশী স্বরচিত বেদমুক্ত উচ্চারণ করতে পারবেন তারই হাতে উষাকে সমর্পণ করা হবে। এই পথের কথা শুনে অগ্নি, ইন্দ্র ও সূর্য আজীবন অগ্রসর হন, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা বিফল হয়। তখন অশ্বিনীদ্বয় ইন্দ্রের কাছ থেকে বেদমুক্ত লাভ করে সফল হন ও উষাকে লাভ করেন। কিন্তু এরা সূর্যের অনুচর বলে উষাকে প্রতিগ্রহ করেন নি। তখন সূর্য উষাকে স্ত্রীরূপে বরণ করেন।

॥ পাঁচ ॥

…..ইন্দ্রের স্ত্রী ইন্দ্রাণী বা শচী। তৈত্তিরীয়ব্রাহ্মণ অনুযায়ী ইন্দ্র তার যৌন আবেদনে আকৃষ্ট হয়ে অত্যান্ত সুন্দরীদের প্রত্যাখ্যান করে ইন্দ্রাণীকে বিবাহ করেছিল। অন্য মতে ইন্দ্র ইন্দ্রাণীর সতীত্ব নষ্ট করে, এবং শাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্য ইন্দ্রাণীর পিতা পুলমাকে হত্যা করে ইন্দ্রাণীকে বিয়ে করেছিল।

ইন্দ্র যে মাত্র ইন্দ্রাণীর সতীত্ব নষ্ট করেছিল, তা নয়। মহাভারত অনুযায়ী ইন্দ্র গৌতম মুনির অনুপস্থিতিতে গৌতমের রূপ ধারণ করে তাঁর স্ত্রী অহল্যার সতীত্ব নাশ করেছিল। ইন্দ্র এইভাবে মর্ত্যলোকে এসে মানবীদের সঙ্গে মিলিত হত। এইভাবে বালী ও অর্জুনের জন্ম হয়েছিল। ধর্মও মর্ত্যে এসে মানবীদের সঙ্গে মিলিত হতেন। ধর্মের ঔরসেই কুন্তীর গর্ভে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। অনুরূপভাবে অগ্নির ঔরসে মাহিষ্মতী নগরীর ইক্ষাকুবংশীয় রাজকন্যা সুদর্শনার গর্ভ হয়। পবনদেবও হনুমানের পিতা কেশরীরাজের স্ত্রী অঞ্জনার গর্ভে এক পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। সেই পুত্রই হনুমান।……

॥ ছয় ॥

এতক্ষণ দেবলোকের পুরুষদের যৌন চরিত্রের কথা বলা হয়েছে। এখন দেবলোকের দেব-স্ত্রীদের কথা কিছু বলি স্বাহা দক্ষের কন্যা। ইনি অগ্নিকে কামনা করতেন। একবার সপ্তর্ষিদের যজ্ঞে অগ্নি সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের দেখে কামার্ত হয়ে ওঠেন। স্বাহা এটা লক্ষ্য করেন। স্বাহা তখন এক এক ঋষিপত্নীর রূপ ধরে ছয়বার অগ্নির সঙ্গে মিলিত হন। এবং ছয়বারই অগ্নির বীর্য কাঞ্চনকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন। এই ঘটনার পর সপ্তর্ষির তাদের স্ত্রীদের সন্দেহ করে পরিত্যাগ করে। সপ্তর্ষিদের অন্যতম বশিষ্ঠের স্ত্রী অরুন্ধতীর তপঃপ্রবাহে স্বাহা আর তার নিজের রূপ ধারণ করতে পারেন নি। বিশ্বামিত্র প্রকৃত ব্যাপার জানতেন বলে তিনি ঋষি-পত্নীদের নির্দোষী বলেন। কিন্তু ঋষিরা তা বিশ্বাস করেন না। পরে স্বাহ৷ অগ্নির স্ত্রী হন। কিন্তু স্বর্গে গিয়েও স্বাহার স্বভাব পরিবর্তিত হয় না। তিনি নিজ স্বামীকে ছেড়ে, কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পাবার জন্য তপস্যা করতে লাগলেন। বিষ্ণুর বরে স্বাহা দ্বাপরে নগ্নজিৎ রাজার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন ও কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পান।

॥ সাত ॥

দেবতাদের মধ্যে শিবই হচ্ছেন সবচেয়ে সংযমী দেবতা। ……….শিব কামগামী দেবতা নন, যদিও অর্বাচীন কালের সাহিত্যে শিবকে কোচপাড়ায় গিয়ে কুচনীদের সঙ্গে প্রেম করার কাহিনী রচিত হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্রে শিব ব্যভিচারী দেবতা নন।

॥ আট ॥

মনুষ্যলোকে যেমন আমরা মানুষের কৌতুহল দেখি অপরের রমণক্রিয়া দেখবার, দেবতাদেরও সেরূপ কৌতুহলজনক প্রবৃত্তি ছিল। কালিদাসের কুমারসম্ভবে আমরা দেখি যে উমার সহিত মহাদেবের রমণকালে অগ্নিদেব পারাবতাকারে সেই রমণক্রিয়া দেখেছিলেন। উমাদেবী অগ্নিদেবকে দেখে লজ্জাবশতঃ রমণক্রিয় হতে নিবৃত্ত হন ও মহাদেব ক্রোধবশতঃ তার বীর্য অগ্নিদেবের প্রতি নিক্ষেপ করেন। অগ্নিদেব সে বীর্ষের তেজ সহ্য করতে না পেরে তা গঙ্গায় বিসর্জন দেন।

॥ দশ ॥

…..দেবসভায় নৃত্যকালে পুরুরবার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকালে উর্বশীর তালভঙ্গ হয়। ফলে ইন্দ্রের শাপে উৰ্বশীকে মর্ত্যে এসে বাস করতে হয়। মর্ত্যে এসে পুরুরবা ও উর্বশী পরস্পর প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ে। উর্বশী কয়েকটি শর্তে পুরুরবার স্ত্রীরূপে থাকতে সম্মত হয়। মহাভারতের বনপর্ব অনুযায়ী পাণ্ডুপুত্র অর্জনও দিব্যাস্ত্র সংগ্রহের জন্য স্বর্গে গিয়েছিলেন এবং সেখানে পাঁচ বৎসর বাস করেছিলেন। সে সময় উর্বশী তার কাছে তার প্রেম নিবেদন করেছিল। কিন্তু অর্জুন তা প্রত্যাখান করেছিলেন। …..

 

অপ্সরাদের যৌন আবেদন

স্বর্গের বারযোষিতদের বলা হত অপ্সরা । অপ্সরা অপূর্ব লাবন্যময়ী হত । নৃত্যকলায় তারা হত পটীয়সী । তারা সবসময়েই তাদের নৃত্যদ্বারা ইন্দ্রের দেবসভা মাতিয়ে রাখত। ইন্দ্র অত্যন্ত ইন্দ্রিয়পরায়ণ দেবতা ছিলেন । দেবলোক বা নরলোকে আর কেউ কঠোর তপস্যায় রত থেকে ইন্দ্ৰত্ব পাবার চেষ্টা করছে দেখলে, ইন্দ্ৰ প্রায়ই অপ্সরাদের নিযুক্ত করতেন তাদের তপোভঙ্গের জন্য ।

অপ্সরাদের মধ্যে সর্বোত্তম অপ্সরা ছিল উর্বশী। ঋগ্বেদ থেকে আরম্ভ করে কথাসরিৎসাগর পর্যন্ত, নানা প্ৰাচীন গ্রন্থে আমরা উর্বশীর কথা পাই । এসব গ্রন্থে উর্বশীর উদ্ভব সম্বন্ধে নানারকম কাহিনী লিখিত আছে। পদ্মপুরাণে বিবৃত হয়েছে যে একসময় বিষ্ণু ধৰ্মপুত্ৰ হয়ে ঘোরতর তপস্যায় রত হন। ইন্দ্ৰ ভয় পেয়ে তাঁর তপোভঙ্গ করবার জন্য কামদেব ও অপ্সরাদের পাঠান। কিন্তু অপ্সরাগণ বিষ্ণুর তপোভঙ্গ করতে অসমর্থ হয়। তখন ইন্দ্ৰ নিজ উরু থেকে উর্বশীকে সৃষ্টি করেন। আবার শ্ৰীমদভাগবত অনুযায়ী বিষ্ণু তপস্যায় রত হলে ইন্দ্ৰ কামদেব ও অপ্সরাগণকে তাঁর তপোভঙ্গের জন্য পাঠান । তারা বিষ্ণুর তপোভঙ্গ করতে না পারলে, নরনারায়ণ দেবতাগণকে বহু লাবন্যময়ী রমণী দেখিয়ে তাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করতে বলেন । দেবতারা উর্বশীকে নির্বাচন করে । তাতেই উর্বশী শ্রেষ্ঠ অপ্সরা বলে গণ্য হয়। আবার অন্য কাহিনী অনুযায়ী উর্বশী ইন্দ্রের উরু থেকে উদ্ভূত হয়নি, অথন্সরাদের উরু থেকে। এরূপ কাহিনীও আছে যে উর্বশী নারায়ণের উরু ভেদ করে আত্মপ্ৰকাশ করে । আবার অন্যান্য পুরাণের মতে উর্বশী সমুদ্রমন্থনের সময় উদ্ভূত হয়েছিল । সাতজন মনু উৰ্বশীকে সৃষ্টি করেছিল, এ কথাও কোনও কোনও পুরাণে আছে ।

উর্বশী সম্বন্ধে একাধিক কাহিনী প্রাচীন গ্ৰন্থসমূহে আছে । তার মধ্যে সবচেয়ে প্ৰসিদ্ধ কাহিনী হচ্ছে পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর মিলন । পুরুরবা হচ্ছে বুধের পুত্ৰ চন্দ্রের পৌত্র। বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে চন্দ্র একবার হরণ করেছিল । তারার গর্ভে চন্দ্রের এক পুত্র হয়। এই পুত্রের নাম বুধ । বুধ বৈবস্বত মনুর মেয়ে ইলাকে বিবাহ করে । ইলার গর্ভে বুধের যে পুত্ৰ হয় তারই নাম পুরুরবা ।

৷৷ দুই ।।

পুরুরবা ও উর্বশীর মিলনের সবচেয়ে প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের সংবাদসুক্তে ( ১০।১৫ ) । সেখানে যে আখ্যান আছে, সে আখ্যান অনুযায়ী উর্বশী চার বছর পুরুরবার সঙ্গে ছিলেন, এবং গর্ভবতী হবার পর তিনি অন্তর্হিতা হন। …

…শতপথব্ৰাহ্মণের কাহিনী অনুযায়ী উর্বশী কয়েকটি শর্তে পুরুরবার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীরূপে বাস করতে রাজী হন । এই শর্তগুলি হচ্ছে—(১) উর্বশী যেন কোনদিন পুরুরবাকে বিবস্ত্র না দেখেন, (২) উর্বশীর শয্যার পাশে পুত্রবৎ প্রিয় দুটি মেষ বাধা থাকবে এবং এরা কখনও অপহৃত হবে না, (৩) উর্বশী একসন্ধ্যা ঘৃতমাত্র আহার করবেন । অন্য কাহিনী অনুযায়ী আরও একটা শর্ত ছিল । সেটা হচ্ছে-উৰ্বশী কামাতুরা না হলে, মৈথুনকৰ্ম সংগত হবে না। শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী পুরুরবা শর্তগুলি পালন করতে সন্মত হন। অতঃপর পুরুরবা ও উর্বশী পরম সুখে বহু বৎসর একত্রে বাস করেন । কিন্তু দেবলোকে উর্বশীর অনুপস্থিতে গন্ধৰ্বরা ব্যথিত হয়ে ওঠে । গন্ধর্বরা তখন উৰ্বশীকে দেবলোকে নিয়ে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে । পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর বসবাসের শর্তগুলি তারা জানত। সুতরাং কৌশল করে তার শর্তগুলি ভাঙাবার উপায় উদ্ভাবন করে। একদিন রাত্রিকালে গন্ধৰ্ব বিশ্বাবসু, উর্বশীর মেষদুটিকে হরণ করে। উর্বশী চিৎকার করে ওঠে ও কাঁদিতে কাঁদিতে পুরুরবাকে মেষ দুটি উদ্ধার করবার জন্য অনুরোধ করে । পুরুরবা নগ্ন অবস্থাতেই শয্যা হতে উঠে ক্ষিপ্ৰগতিতে বিশ্বাবসুর পশ্চাদ্ধাবন করে । এই সময় দেবতারা বজপাতের সূচনা করে বিদ্যুতের সৃষ্টি করে। বিদ্যুতের আলোকে উর্বশী পুরুরবাকে নগ্ন দেখে তৎক্ষণাৎ তাকে ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যায়।

পুরুরবা তখন উর্বশীর সন্ধানে দেশবিদেশে ভ্ৰমণ করতে থাকে। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে এক সরোবরে পুরুরবা চারজন অপ্সরার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখে । পুরুরবা তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। উর্বশী বলে-’আমি তোমার সহবাসে গর্ভবতী হয়েছি। তুমি এক বছর পর আমার সঙ্গে দেখা করলে, আমি তোমাকে আমার প্রথম সন্তান উপহার দিব এবং মাত্র একরাত্রি তোমার সঙ্গে বাস করব ।’ এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর কাল এক রাত্রির জন্য উর্বশী ও পুরুরবার মিলন ঘটে। তার ফলে আয়ু, বিশ্বায়ু, শতাষ্ণু প্ৰভৃতি নামে তাদের ছয়টি পুত্র জন্ম গ্ৰহণ করে । তারপর উর্বশী পুরুরবাকে জানান যে গন্ধর্বরা পুরুরবাকে যে কোন প্রার্থিত বর দিতে প্ৰস্তুত আছে । পুরুরবা তখন বলেন যে উর্বশীর সঙ্গে তিনি চিরজীবন বাস করতে চান এবং এটাই তার একমাত্র প্রার্থনা । তখন গন্ধৰ্বরা অগ্নিপূর্ণ একপাত্র পুরুরবার সামনে রাখে এবং বলে যে – ‘এই অগ্নিপাত্ৰ গ্ৰহণ করে বেদের নির্দেশানুযায়ী এই অগ্নিকে তিনভাগে ভাগ কর । তারপর উর্বশীতে মনসংযোগ করে আহুতি দাও । তবেই তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে ।’ পুরুরবা সেই অনুযায়ী কার্য করলে গন্ধৰ্বলোকে স্থান পান এবং উর্বশীর চিরসঙ্গী ও চিরপ্রেমিক হয়ে সেখানে বাস করতে থাকেন ( শতপথব্ৰাহ্মণ ৩।৪৷১।১১)। উর্বশীর গর্ভে মোট ছয় সন্তান হয়- আয়ু, বিশ্বায়ু, অমাবসু, বলায়ু দৃঢ়ায়ু ও শতায়ু ।

।। তিন ॥

পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর মিলন সম্বন্ধে বেদে আরও এক কাহিনী আছে । একবার আদিত্যযজ্ঞে মিত্র ও বরুণ নিমন্ত্রিত হয়েছিল । সেখানে অপ্সরা উর্বশীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ায় তাদের রেতঃপাত হয় । রেতের যে ভাগ কুম্ভে পড়ে, তা থেকে বশিষ্ঠ ও অগস্ত্য জন্ম গ্ৰহণ করে । তাতে এই দুই দেবতা ক্রদ্ধ হয়ে উর্বশীকে অভিশাপ দেয় যে তাকে মর্ত্যে নিৰ্বাসিত হতে হবে । সেই কারণেই মর্ত্যে এসে উর্বশী পুরুরবার স্ত্রী হয় ।

উৰ্বশী সম্বন্ধে আরও আখ্যান প্ৰাচীন গ্রন্থে আছে। মহাভারতের বনপর্ব অনুযায়ী মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে অর্জুন যখন দিব্যাস্ত্ৰ সংগ্রহের জন্য দেবলোকে গিয়ে পাঁচ বৎসর বাস করেছিলেন, তখন তিনি ইন্দ্রের আদেশে গন্ধৰ্ব চিত্ৰসেনের কাছে নৃত্য-গীত-বাদ্য শিখছিলেন । একদিন চিত্ৰসেন উর্বশীর কাছে গিয়ে বলল–‘কল্যাণী দেবরাজের আদেশে তোমাকে জানাচ্ছি যে অর্জুন তোমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন । তিনি আজ তোমার কাছে আসবেন।’ – উর্বশী নিজেকে সম্মানিত জ্ঞান করে বলল, ‘আমিও তার প্রতি অনুরক্ত । সখা তুমি যাও, আমি অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হব।’ তারপর রাত্রিকালে উর্বশী অর্জুনের গৃহে যান । তার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে উর্বশী বলে—‘তুমি যখন দেবালোকে আস, তখন তোমার আগমনের জন্য ইন্দ্ৰ যে আনন্দোৎসবের অনুষ্ঠান করেছিলেন, সে সময় তুমি নাকি অনিমেষনয়নে শুধু আমাকেই দেখেছিলে ।’ তাই দেখে ইন্দ্ৰ চিত্ৰসেনকে আদেশ দিয়েছিলেন আমি যেন তোমার সঙ্গে মিলিত হই । আমিও তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনঙ্গের বশবর্তী হয়ে তোমার কাছে এসেছি ।’ সে কথা শুনে অর্জুন কান ঢেকে উর্বশীকে বলে—‘ভাগ্যবতী, আপনার কথা আমার শ্রবণযোগ্য নয়, কেননা কুন্তী ও শচীর ন্যায় আপনি আমার গুরুপত্নী তুল্য। আপনি পুরুবংশের জননী ( পুরুরবার ঔরসে উর্বশীর গর্ভে আয়ু জন্মগ্রহণ করে, তারই প্রপৌত্র পুরু ), গুরুর অপেক্ষাও গুরুতম, সেজন্যই উৎফুল্লনয়নে আপনাকে দেখেছিলাম ।’ তখন উর্বশী বলল, ‘আমাকে গুরুস্থানীয়া মনে করা অনুচিৎ, কেননা অপ্সরারা নিয়মাধীন নয়। পুরুবংশের পুত্র বা পৌত্র যে কেউ স্বর্গে এলে আমার সঙ্গে মিলিত হয়। তুমিও আমার বাঞ্ছা পূর্ণ কর।’ অৰ্জুন কর্তৃক প্ৰত্যাখাতা হয়ে উর্বশী ক্ৰোধে অভিভূত হয়ে অর্জুনকে অভিশাপ দেয় —’আমি ইন্দ্রের অনুজ্ঞায় স্বয়ং তোমার গৃহে কামার্ত হয়ে এসেছি, তথাপি তুমি আমাকে গ্ৰহণ করলে না, তুমি সম্মানহীন নপুংসক নর্তকী হয়ে স্ত্রীদের মধ্যে বিচরণ করবে।’ এই বলে উর্বশী নিজ গৃহে চলে যায়। এই অভিশাপের জন্যই অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজার গৃহে অৰ্জুনকে বৃহন্নলা নামে নর্তকীর ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকতে হয়েছিল ।……..

।। চার ।।

উৰ্বশী ছাড়া আরও অপ্সরা ছিল। আগেই বলেছি যে দেবলোকের বারযোষিতদের সংখ্যা ৬০ কোটি বলে উল্লিখিত হয়েছে । তাদের মধ্যে উল্লেখনীয় হচ্ছে মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, মঞ্জুঘোষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্না, সুপ্রিয়া, সরসা, পঞ্জিকাস্থলা, বিশ্বাচী প্রভৃতি।… রম্ভা, মেনকা প্ৰভৃতি অপ্সরা ক্ষীরোদসাগর মন্থনের সময়ে উদ্ভূত হয়। একবার রম্ভা কুবেরের পুত্র নলকুবেরের নিকট অভিসার গমনকালে, রাবণ তাকে দেখে কামমুগ্ধ হয় ও বলপূর্বক তাকে ধর্ষণ করে । ধর্ষণের প্রাক্কালে রাবণের উক্তি থেকে আমরা রম্ভার রূপলাবণ্যের পরিচয় পাই । রাবণ বলেছিল—…( রামায়ণ উত্তরকাণ্ড ৩১।২৩-২৪ ) । ‘তোমার সুন্দর কুচযুগল স্বর্ণকুম্ভসদৃশ পীন, নিরন্তর ( কুচদ্বয় মধ্যে কোন ব্যবধান নেই ) ; তোমার কুচযুগল কোন পুরুষের বক্ষ স্পর্শ করবে ? তোমার জঘনদ্বয় সুবর্ণচক্ৰ প্ৰতিম, স্বর্ণহারশোভিত স্থূল ; তোমার এই স্বৰ্গরূপী শ্ৰোণিতটে কোন পুরুষ অদ্য আরোহন করবে।’ ‘আমি ধৰ্মানুসারে আপনার পুত্রবধু’, এই কথা বলে রম্ভা রাবণকে প্ৰতিহত করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাবণ রম্ভাকে শিলাতলে ফেলে উপভোগ করল। রম্ভা রতিশ্রমে কাতরা ও ব্যাকুলা, বেপমানা ও ভীতিগ্ৰস্তা হয়ে নলকুবেরকে একথা জানালে নলকুবের রাবণকে অভিশাপ দেন যে রাবণ যদি কোন স্ত্রীলোকের অনিচ্ছায় তার প্রতি বলপ্ৰয়োগ করে, তাহলে রাবণের মস্তক সপ্তখণ্ডে ভগ্ন হবে । এই জন্যই সীতা রাবণ কর্তৃক, অপহৃত হয়েও নিজের সতীত্ব রক্ষা করেন । … স্কন্দপুরাণে রম্ভা সম্বন্ধে দু’টা কাহিনী আছে। একটা কাহিনী অনুযায়ী একবার ইন্দ্ৰসভায় নৃত্যুকালে রম্ভার তালভঙ্গ হয়। তখন ক্রুদ্ধ ইন্দ্রের শাপে স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ হয়ে রম্ভা ভূতলে পতিত হয়। পরে নারদের পরামর্শে রম্ভা শিবের পূজা করে পুনরায় স্বৰ্গে ফিরে যেতে পারে। অপর কাহিনী অনুযায়ী ইন্দ্রের আদেশে রম্ভা জাবালি মুনির তপোভঙ্গ করে । মুনির ঔরসে রম্ভার এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। জাবালি ওই কন্যাকে প্রতিপালন করেন । ওই কন্যার নাম ফলবতী ।

পূর্বকালে ঋষি বিশ্বামিত্রকে ঘোর তপস্যারত দেখে ইন্দ্র ভীত হয়ে তার তপস্যাভঙ্গের জন্য অপ্সরা মেনকাকে প্রেরণ করেন। সর্বাঙ্গসুন্দরী বিবস্ত্রা মেনকার রূপে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্ৰ মেনকার সহিত মিলিত হয় । এই মিলনের ফলে বিশ্বামিত্রের ঔরসে ও অপ্সরা মেনকার গর্ভে কন্যা শকুন্তলার জন্ম হয়। শকুন্তলার জন্মের পর বিশ্বামিত্র অপ্সরা মেনকাকে বিদায় দিয়ে আবার তপস্যায় রত হন । তখন মেনকা সদ্যজাতা কন্যাকে বনমধ্যে মালিনী নদীর তীরে পরিত্যাগ করে ইন্দ্ৰসভায় প্ৰস্থান করেন। এই পরিত্যক্ত কন্যা শকুন্ত অর্থাৎ পক্ষী কর্তৃক রক্ষিত হয় ও মহৰ্ষি কন্বের দৃষ্টিপথে পতিত হয় । মহর্ষি কন্ব নিজের আশ্রমে এনে একে নিজ কন্যার ন্যায় পালন করতে থাকেন। শকুন্ত কর্তৃক রক্ষিত বলে কন্যাটির নাম হয় শকুন্তলা । গন্ধৰ্বরাজ বিশ্বাবসুর ঔরসেও অপ্সরা মেনকার গর্ভে প্ৰমদ্বারা নামে এক কন্যা হয় । জন্মের পর মেনকা প্ৰমদ্বারাকে পরিত্যাগ করলে মহৰ্ষি স্থূলকেশ্‌ তাকে নিজ আশ্রমে এনে পালন করেন। রুরু মুনির সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

ইন্দ্ৰ সব সময়েই সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন, পাছে কেউ কঠোর তপস্যা করে তাঁর ইন্দ্ৰত্ব কেড়ে নেয় । সেজন্য ইন্দ্ৰ স্বর্গের বারযোষিতদের নিযুক্ত করতেন তাদের তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য। একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এখানে তোলা যেতে পারে । স্বর্গের এসব বারযোষিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সুন্দরী ছিল কে ? মনে হয় তিলোত্তমাই সবচেয়ে বেশী সুন্দরী ছিল । সেটা তিলোত্তমার উৎপত্তি থেকে আমরা জানতে পারি । এ সম্বন্ধে উপাখ্যানটি এখানে বিবৃত করা যেতে পারে । একবার দৈত্যরাজ নিষ্কুম্ভের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দ ব্ৰহ্মার কঠোর তপস্যা করে ত্ৰিলোক বিজয়ের জন্য অমরত্ব প্রার্থনা করে । কিন্তু ব্ৰহ্মা তাদের অমরত্বের বর না দিয়ে বলেন যে ত্রিলোকের কোন প্রাণীর হাতে তাদের মৃত্যু হবে না। যদি কখনও তাদের মৃত্যু হয় তবে পরস্পরের হাতে হবে । এই বর পাবার পর তারা আবার দেবতাদের পীড়ন করতে থাকে, তখন দেবতারা ব্ৰহ্মার কাছে যায়। ব্ৰহ্মা বিশ্বকর্মাকে এক পরমাসুন্দরী নারী সৃষ্টি করতে বলেন । ত্ৰিভুবনের সমস্ত উত্তম জিনিস তিল তিল করে সংগ্ৰহ করে বিশ্বকর্মা এক অতুলনীয় সুন্দরী নারী সৃষ্টি করে। এই কারণেই তার নাম হয় তিলোত্তমা । সৃষ্টির পর তিলোত্তমা দেবতাদের প্রদক্ষিণ করে । তাকে দেখবার জন্য ব্ৰহ্মার চারদিকে চারটি মুখ সৃষ্টি হয় ও ইন্দ্রের সহস্ৰ চক্ষু হয় । তাকে সুন্দ ও উপসুন্দকে প্ৰলুব্ধ করবার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় । তিলোত্তমা তাদের সামনে গিয়ে নৃত্য করতে থাকে । সুন্দ ও উপসুন্দ তিলোত্তমার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে পাবার জন্য পরস্পর যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হয়, এবং সেই যুদ্ধেই তারা পরস্পরের হাতে নিহত হয়। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুযায়ী তিলোত্তমা একবার দুর্বাশা মুনির ধ্যান ভঙ্গ করতে গেলে দুর্বাশার শাপে বাণের কন্যা ঊষারূপে জন্মগ্রহণ করে ।

অপ্সরা ঘৃতাচী, দু’দুজন ঋষিকে কাৎ করেছিলেন । তার মধ্যে একজন হচ্ছেন ভরদ্বাজ ঋষি। মহাভারতের আদিপর্ব অনুযায়ী ওই ঋষি গঙ্গোত্তরী প্রদেশে বাস করতেন। একদিন স্নানরতা অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে তার রেতস্খলন হয়। ওই বীৰ্য তিনি কলসের মধ্যে রাখেন এবং তা থেকে কৌরবদের শিক্ষাগুরু দ্রোণের জন্ম হয়। ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী বশিষ্ঠের ঔরসে অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে কপিঞ্জলের জন্ম হয় । চ্যবন ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির ঔরসেও ঘৃতাচীর গর্ভে রুরু নামে এক পুত্র হয় । ( আগে মেনকা দেখুন )। রামায়ণের আদিকাণ্ড অনুযায়ী রাজৰ্ষি কুশানাভ ও ঘৃতাচীর গর্ভে একশত পরম রূপবতী কন্যা উৎপাদন করেছিলেন। বর্গাও একজন অপ্সরা । একদিন চার সহচরীর সঙ্গে তিনি ইন্দ্রসভা থেকে ফিরছিলেন। পথে এক তপস্যারত ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাদের দেখা হয় । তারা এই ব্ৰাহ্মণের তপোভঙ্গ করবার জন্য তাকে প্রলুব্ধ করতে থাকে। ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যেন শতবর্ষ তারা কুম্ভীর হয়ে জলে বাস করে। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর ব্ৰাহ্মণ প্রশমিত হয়ে বলেন, যদি কোন পুরুষ তাদের জলমধ্য থেকে তোলেন, তবেই তারা তাদের পূর্ব রূপ ফিরে পাবে। অর্জুন একসময় তীর্থভ্ৰমণ করতে এসে শোনেন যে ওই তীর্থে পাঁচটি কুম্ভীর বাস করে এবং তারা মানুষকে জলের মধ্যে টেনে নেয় । জলের মধ্যে অৰ্জুনের পা আঁকড়ে ধরলে, অৰ্জুন সবলে তাকে তুলে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে সে সুন্দরী নারীরূপ পায় । সেই অপ্সরা বর্গা ওইভাবে অৰ্জুন তার সহচরীদেরও উদ্ধার করে । এ কাহিনীটা মহাভারতের আদিপর্বে আছে।

আর একজন অপ্সরা পঞ্জিকাস্থলা । পঞ্জিকাস্থলা পঞ্চচূড়াবিশিষ্ট অপ্সরাদের অন্যতম । ইন্দ্র একবার মার্কণ্ডেয় মুনির তপোভঙ্গের জন্য পঞ্জিকাস্থলাকে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু পঞ্জিকাস্থলাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল । একবার পঞ্জিকাস্থলা যখন ব্ৰহ্মার কাছে যাচ্ছিল, তখন রাবণ তাকে বিবসনা করেছিল । ব্ৰহ্মা একথা শুনে রাবণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে কোন স্ত্রীলোকের প্রতি বলপ্রয়োগ করলে তার মস্তক শতধা চুৰ্ণ হবে। এই অপ্সরাই বানররাজ কেশরীর স্ত্রী অঞ্জনা রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । পবনদেব এর গর্ভে হনুমানকে উৎপাদন করেছিলেন ।

স্বর্গের আর একজন অগ্রসর হচ্ছে পূর্বাচিত্তী । একবার জম্বুদ্বীপের রাজা প্রিয়ব্রতের জ্যেষ্ঠপুত্র অগ্নিধ্রের কোন পুত্র না হওয়ায়, তিনি পুত্ৰকামনায় মন্দার পর্বতে ব্ৰহ্মার তপস্যায় রত হন। ব্ৰহ্মা তার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে পূর্বাচিত্তী নামে অপ্সরাকে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। পূর্বচিত্তীর রূপে মুগ্ধ হয়ে অগ্নিধ্র তাকে গান্ধৰ্বমতে বিবাহ করে । এই বিবাহের ফলে অগ্নিধ্রের ঔরসে ও পূর্বাচিত্তীর গর্ভে নয়টি পুত্রসন্তান হয় ।

আরও একজন অপ্সরা হচ্ছে প্রম্লোচ্চা । কণ্ডু মুনির তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য ইন্দ্র প্রম্লোচ্চাকে কণ্ডুমুনির কাছে পাঠিয়ে দেন। কণ্ডু প্ৰণয়াসক্ত হয়ে প্রম্লোচ্চার সঙ্গে দীর্ঘকাল বাস করেন। তাঁর ঔরসে প্রম্লোচ্চার এক কন্যা সন্তান হয়, তার নাম মারিষা । বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী মারিষার গর্ভে প্ৰজাপতি দক্ষ জন্মগ্রহণ করেন । বরুণ পুত্র পুষ্করের ঔরসে ও প্রম্লোচ্চার গর্ভে মনোরমা নামে এক কন্যা হয় । প্রম্লোচ্চার অনুরোধে প্ৰজাপতি রুচি এঁকে স্ত্রী রূপে গ্ৰহণ করেন। রুচির ঔরসে এঁর গর্ভে রৌচ্যমনুর জন্ম হয় । হেমা নামে আর একজন অপ্সরা ময়দানবকে বিবাহ করে। তাঁর গর্ভে মায়াবী ও দুন্দুভী নামে দুই পুত্ৰ ও মন্দোদরী নামে এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে, মন্দোদরী রাবণের স্ত্রী ও মেঘনাদের মাতা ।

…অদ্রিকা নামে আর একজন অপ্সরার নাম আমরা মহাভারতে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম বৃত্তান্তের কাহিনীর মধ্যে পাই । কুরুরাজ চেদিবংশীয় উপরিচর বসু একবার মৃগয়া করতে গিয়ে তঁর রূপবতী স্ত্রী গিরিকাকে স্মরণ করে কামাতুর হয়ে পড়েন। তাতে তাঁর রেতঃস্বলন হয় । স্খলিত শুক্র তিনি এক শ্যেনপক্ষীর সাহায্যে তঁর স্ত্রীর নিকট প্রেরণ করেন । পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমনে উক্ত শুক্র যমুনার জলে পড়ে। সে সময় অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা ব্ৰহ্মশাপে মৎস্যরূপ ধারণ করে যমুনার জলে বাস করছিল । সেই অপ্সরা ওই শুক্র গ্ৰহণ করে গর্ভবতী হয়। তার ফলে তার এক পুত্র ও কন্যা হয়। কন্যা এক ধীবর কর্তৃক পালিত হয় । তার গায়ে মৎস্যের গন্ধ থাকার দরুন তার নাম মৎস্যগন্ধা হয় । তাঁর অপর নাম সত্যবতী। কুমারী অবস্থায় পরাশর মুনির ঔরসে তাঁর গর্ভে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম হয় ।

৷৷ পাঁচ ॥

অপ্সরাদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক ছিল গন্ধৰ্বদের । বৈদিকযুগে গন্ধৰ্বরা ছিল এক শ্রেণীর উপদেবতা ।… সঙ্গীতবিদ্যায় তারা বিশেষ পারদর্শী ছিল। …অপ্সরাদের সঙ্গে তারা অবাধে মেলামেশা করত। নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে যে বিবাহ হয়, তাকেই গান্ধৰ্ব বিবাহ বলা হত। …

দেবদেবীদের ব্যভিচার

……..পুরাণে সরস্বতীকে ব্ৰহ্মার স্ত্রী বলা হয়েছে। শতরূপ ব্ৰহ্মার কন্যা । কিন্তু ব্ৰহ্মা নিজ কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হন । এই অজাচারের ফলে শতরূপার গর্ভে স্বায়ভুব মনুর জন্ম হয়। অন্য কাহিনী অনুযায়ী শতরূপ ব্ৰহ্মার স্ত্রী, মনুর মাতা নন ।…….


।।তিন ।।

ইন্দ্র দেবলোকের রাজা । ইন্দ্ৰ ইন্দ্ৰিয়াদোষে দুষ্ট । রামায়ণ অনুযায়ী ইন্দ্ৰ গৌতম ঋষির স্ত্রী অহল্যার সতীত্ব নাশ করেছিলেন । অহল্যা ছিলেন ব্ৰহ্মার মানসী কন্যা ও শতানন্দের জননী ৷ …তিনি বহুদিন অহল্যাকে সংযমচিত্ত গৌতম ঋষির কাছে রেখেছিলেন । গৌতম যখন তাকে পবিত্র ও নিষ্কলঙ্ক অবস্থায় ব্ৰহ্মার কাছে ফিরিয়ে দেন তখন ব্ৰহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে গৌতমের সঙ্গে অহল্যার বিবাহ দেন । এতে ইন্দ্র ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন, কেননা ইন্দ্র ভেবেছিলেন, এই অপূর্ব সুন্দরী নারী তারই প্ৰাপ্য। একদিন গৌতম স্নান করবার জন্য আশ্রমের বাহিরে গেলে ইন্দ্ৰ গৌতমের রূপ ধরে অহল্যার কাছে আসেন ও তার সঙ্গম প্রার্থনা করেন । অহল্যা ইন্দ্ৰকে চিনতে পেরেও সেই সময় কামার্তা ছিলেন বলে দুর্মতি বশত তাঁর সঙ্গে সঙ্গমে রত হয়। ইতিমধ্যে গৌতম এসে উপস্থিত হন এবং ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন যে ইন্দ্র নপুংসক হবেন । সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রের অণ্ড খসে পড়ে । কিন্তু ইন্দ্র দেবতাদের কাছে নিজের দুৰ্দশার কথা বললে, দেবতারা মেষাণ্ড উৎপাটিত করে ইন্দ্রের দেহে সংযুক্ত করেন। …

ইন্দ্র একবার বৃষণশ্চ রাজার কন্যা মেনা অভিমুখী হয়েছিলেন । পরে মেনাকে প্ৰাপ্তযৌবন দেখে ইন্দ্ৰ স্বয়ং তার সাথে সহবাস অভিলাষ করেছিলেন ।…

।। চার ।।

…বিষ্ণুও ব্যভিচার দোষ থেকে মুক্ত নন।… জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা সম্বন্ধে আর একটা শঙ্খচূড়ের স্ত্রী তুলসী সম্বন্ধে। প্রথমেই বলছি তুলসীর কথা । তুলসী রাধিকার সহচরী। একদিন গোলোকে কৃষ্ণের সঙ্গে তাকে ক্রীড়ারত দেখে, রাধিকা তুলসীকে অভিশাপ দেন যে সে মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করবে । কিন্তু কৃষ্ণ তুলসীকে সান্তনা দিয়ে বলেন, তুমি দুঃখিত হয়ে না, কেননা তপস্যা দ্বারা তুমি আমার এক অংশ পাবে। তুলসী ধৰ্মধ্বজ রাজার স্ত্রী মাধবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে ব্ৰহ্মার তপস্যায় রত হন । ব্ৰহ্মা তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে, তাকে বর চাইতে বলেন । তুলসী বলে, তিনি নারায়ণকে স্বামীরূপে পেতে চান । ব্ৰহ্মা বলেন, কৃষ্ণের অঙ্গসম্ভুত সুদাম দানবগৃহে শঙ্খচূড় নামে জন্মগ্রহণ করেছে। তুমি তার স্ত্রী হবে, এবং পরে নারায়ণের পাশে বৃক্ষরূপে জন্মগ্রহণ করবে। তোমাকে না হলে নারায়ণের পূজাই হবে না। যথা সময় শঙ্খচূড়ের সঙ্গে তুলসীর বিবাহ হয়। শঙ্খচূড়ের বর ছিল যে তার স্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট না হলে, তার মৃত্যু হবে না। শঙ্খচূড়ের অত্যাচার ও উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা ব্ৰহ্মা ও শিবের সঙ্গে নারায়ণের কাছে যায়। নারায়ণ বলেন, শিব শঙ্খচূড়ের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলে, তিনি তুলসীর সতীত্ব নষ্ট করবেন। যুদ্ধের সময় নারায়ণ শঙ্খচূড়ের রূপধারণ করে, তুলসীর সতীত্ব নষ্ট করে। তখন শিবের হাতে শঙ্খচূড় নিহত হয় । … এটা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের কাহিনী। ……….

দেবলোকের খুব চাঞ্চল্যকর ব্যভিচার হচ্ছে দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার সঙ্গে চন্দ্রের ব্যভিচার । তারার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে চন্দ্র একবার তারাকে হরণ করে। …

…. অশ্বিনীকুমারদ্বয় শর্যাতি রাজার মেয়ে যৌবনদীপ্ত সুকন্যাকে স্নানের পর নগ্নাবস্থায় দেখে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ স্বামী চ্যবনকে ত্যাগ করে তাদের গ্ৰহণ করতে প্ৰলুব্ধ করেছিল। আৰ্যদেবতামণ্ডলীর যৌন-জীবনে পরস্ত্রীকে এভাবে ফুসলে নিয়ে যাওয়া-আদৰ্শ নীতির পরিচায়ক নয়।

আবার রামায়ণের আদিকাণ্ডে আমরা পড়ি যে একবার পবনদেব রাজৰ্ষি কুশনাভের একশত পরম রূপবতী কন্যাদের ধর্ষণ করতে অভিলাষ করেছিলেন । মেয়েগুলি অস্বীকৃত হলে, পবনদেব তাদের শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে, তাদের শরীর ভগ্ন করে দেন | পবনদেব কেশরীরাজ অঞ্জনার গর্ভে হনুমানকে উৎপাদন করেছিলেন ।

দেবতারা অনেক সময় অস্বাভাবিক মৈথুনেও রত হতেন । সংজ্ঞা বিশ্বকর্মার কন্যা ও সূর্যের স্ত্রী । সংজ্ঞা সূর্যের অসহ্য তেজ সহ্য করতে না পেরে, নিজের অনুরূপ ছায়া নামে এক নারীকে সূর্যের কাছে রেখে, উত্তরকুরুবর্ষে ঘোটকীর রূপ ধরে বিচরণ করতে থাকে। পরে সূর্য যখন এটা জানতে পারে, তখন তিনি বিশ্বকৰ্মার কাছে গিয়ে নিজের তেজ কর্তন করে অশ্বরূপ ধারণ করে ঘোটকীরূপিনী সংজ্ঞার কাছে এসে তার সঙ্গে সঙ্গমে রত হয় । এই মিলনের ফলে প্ৰথমে যুগলদেবতা অশ্বিনীকুমার ও পরে রেবন্তের জন্ম হয় । এরপর সূর্য নিজের তেজ কর্তন করায় সংজ্ঞা নিজের রূপ ধারণ করে স্বামীগৃহে ফিরে আসে।

…প্ৰজাপতির কন্যা ঊষা যখন মৃগীরূপ ধারণ করেছিল, প্ৰজাপতি তখন মৃগরূপ ধারণ করে কন্যায় উপগত হয়েছিলেন । শতপথ ব্ৰাহ্মণে বলা হয়েছে যে এই অপকর্মের জন্য রুদ্র প্রজাপতিকে এক তীক্ষ বানদ্বারা আঘাত করেছিলেন । কিন্তু ঋগ্বেদ (১০।৬১।৫-৭ ) অনুযায়ী রুদ্র নিজেও এই অপকৰ্ম করেছিলেন ।

।। পাঁচ ।।

দেবলোকে যে মাত্র পুরুষরাই ব্যভিচার করত, তা নয়। দেবালোকের মেয়েরাও ব্যভিচারে লিপ্ত থাকত। আগেই বলেছি যে দক্ষকন্যা স্বাহা অগ্নিকে কামনা করতেন । সপ্তর্ষিদের যজ্ঞে অগ্নি ( এ থেকে প্ৰকাশ পাচ্ছে যে অগ্নিও একজন কামুক দেবতা ) যখন সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের দেখে কামার্ত হয়ে ওঠে স্বাহা তখন এক এক ঋষিপত্নীর রূপ ধরে ছয়বার অগ্নির সঙ্গে সঙ্গম করে । ছয়বারই অগ্নির বীর্য কাঞ্চনকুম্ভে নিক্ষিপ্ত হয় । এই ঘটনার পর সপ্তর্ষিরা তাদের স্ত্রীদের সন্দেহ করে পরিত্যাগ করে । সপ্তর্ষিদের অন্যতম বশিষ্ঠের স্ত্রী অরুন্ধতীর তপোপ্রভাবে স্বাহা আর তার রূপ ধারণ করতে পারেনি। বিশ্বামিত্র প্ৰকৃত ব্যাপার জানতেন বলে তিনি ঋষি-স্ত্রীদের নির্দোষী বলেন । কিন্তু ঋষিরা তা বিশ্বাস করে না। পরে স্বাহা অগ্নির স্ত্রী হন। কিন্তু স্বৰ্গে গিয়েও স্বাহার স্বভাব পরিবর্তিত হয় না । তিনি নিজ স্বামীকে ছেড়ে, কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পাবার জন্য তপস্যা করতে থাকেন । বিষ্ণুর বরে দ্বাপরে স্বাহা নগ্নজিৎ রাজার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পায় ।

….
….
….

দেবদেবীর অজাচার
…..

।। দুই ।।

এবার শুনে চমকে উঠবেন না ষে সহোদরাকে বিবাহ করা যদিও আজকের হিন্দুর কাছে অজাচার বলে গণ্য হয় তা হলেও এরূপ বিবাহ এক সময়ে ভারতীয় সমাজে স্বীকৃত হত। বাঙালী সমাজেও হত । এর প্রমাণ আমরা পাই সিংহল দেশের ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ’ নামে দুই প্ৰাচীন গ্ৰন্থ থেকে । সেখানে বিবৃত হয়েছে যে গৌতম বুদ্ধের অবিভাবের পূর্বে বঙ্গদেশের বঙ্গনগরে এক রাজা ছিলেন। তিনি কলিঙ্গদেশের রাজকন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। তাদের এক অতি সুন্দরী কন্যা হয় ; কিন্তু সে অত্যন্ত দুষ্টা ছিল । সে একবার পালিয়ে গিয়ে মগধ-যাত্রী এক বণিকের দলে ঢুকে যায়। তারা যখন বাঙলার সীমানায় উপস্থিত হয়, তখন এক সিংহ তাদের আক্রমণ করে। বণিকেরা ভয়ে পালিয়ে যায় । কিন্তু রাজকন্যা সিংহকে তুষ্ট করে তাকে বিবাহ করে । মনে হয় এখানে আক্ষরিক অর্থে ‘সিংহ’ না ধরে, সিংভূম জেলার ‘সিংহ’ উপাধিধারী কোন উপজাতীয়কে ধরে নিলে, এর অর্থ খুব সরল হয়ে যাবে। ওই সিংহের ঔরসে মেয়েটির গর্ভে সিংহবাহু নামে এক পুত্র এবং এক কন্যা জন্মে। সিংহবাহু বড় হয়ে সিংহকে হত্যা করে ও নিজ ভগ্নীকে বিবাহ করে । পরে রাঢ়দেশে সে এক রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করে । সহোদরার গর্ভে ও তার ঔরসে সিংহবাহুর অনেকগুলি পুত্ৰ সন্তান হয়। …….

।। তিন ।।

নিজ সহোদরা বা সমগোত্ৰীয়াকে বিবাহ করা প্ৰাচীনকালে প্ৰাচ্য ভারতে প্ৰচলিত ছিল। বৌদ্ধ জাতকগ্ৰন্থ সমূহে আমরা এর ভুরিভুরি প্ৰমাণ পাই । বৌদ্ধ সাহিত্যের এক জায়গায় আমরা পড়ি যে, রাজা ওঙ্ককের ( ইক্ষাকুর ) প্ৰধানা মহিষীর গর্ভে পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ওই প্ৰধান মহিষীর মৃত্যুর পর রাজা এক যুবতীকে বিবাহ করেন । এই রাণীর যখন এক পুত্র হয়, তখন তিনি রাজাকে বলেন যে তাঁর ছেলেকেই রাজা করতে হবে । রাজা তার প্রথম মহিষীর পাঁচ পুত্র ও চার মেয়েকে হিমালয়ের পাদদেশে নির্বাসিত করেন। সেখানে কপিলমুনির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। কপিলমুনি তাদের সেখানে একটি নগর স্থাপন করে বসবাস করতে বলেন । এই নগরের নামই কপিলাবস্তু হয় । ভ্রাতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অকৃতদার রইলেন। আর বাকী চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে । ‘মহাবস্তু’ নামে বৌদ্ধগ্রন্থে এই কাহিনীটা আছে ।

বৌদ্ধ সাহিত্যের আর এক কাহিনীতে (অশ্বতথ সুত্ত ১৷১৬ ; কুনাল জাতিক ৫৩৬) শাক্যরা ছিল পাঁচ বোন ও চার ভাই। এই কাহিনী অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ ভগিনীকে তারা মাতৃরূপে বরণ করে, আর চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে ।
…..

আমি আমার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ গ্রন্থে দেখিয়েছি যে ( দশরথজাতকে বিবৃত ) মাত্র রামই নিজ ভগিনীকে বিবাহ করেন নি, রামের পিতা দশরথও তাই করেছিলেন । দশরথের সঙ্গে কৌশল্যার বিবাহই তার দৃষ্টান্ত । দশরথ কৌশল বংশের নৃপতি ছিলেন । কৌশল্যাও যে সেই বংশেরই মেয়ে ছিলেন, তা তার নাম থেকেই প্ৰকাশ পাচ্ছে । ( তুলনা করুন গান্ধারী, মাদ্রী, কৈকেয়ী, বৈদেহী, কুন্তী, দ্ৰৌপদী ইত্যাদি ) । সুতরাং নিজ বংশেই যে রাজা দশরথ বিবাহ করেছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । আজকালিকার দৃষ্টিভঙ্গীতে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ, অজাচার বলে গণ্য হবে । কিন্তু উত্তর ভারতের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ যে এক সময় প্ৰচলিত প্ৰথা ছিল এবং তার সামাজিক স্বীকৃতিও ছিল, তা উপরের কাহিনীসমূহ থেকে প্ৰকাশ পায় ।

………

।। ছয় ।।

পিতা-পুত্রীর বা মাতা-পুত্রের মধ্যে যৌনমিলনের কথা দেশবিদেশের পুরাণেও বিবৃত আছে। আমাদের পুরাণ অনুযায়ী ব্রহ্মা নিজ কন্যা শতরূপাকেই বিবাহ করেছিলেন । এদের সঙ্গমের ফলে মনুর জন্ম হয়। মনু থেকে পৃথিবীতে মানবজাতির সৃষ্টি হয় । …….
মাতা-পুত্রের মধ্যে যৌনমিলনের ক্লাসিক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্ৰীক পুরাণে-জোকাষ্টা ও ইডিপাসের কাহিনীতে । এই কাহিনী অনুযায়ী থিবসের রাজা ইডিপাস। তাঁর নিজ গৰ্ভধারিনী মাতাকেই বিবাহ করেছিল, এদের দুজনের মধ্যে সঙ্গমের ফলে দুই পুত্র পলিওনিসেন ও ইটিওক্লিস ও তুই কন্যা অ্যানটিগনি ও ইসমিন জন্মগ্রহণ করে ।

এরূপ সঙ্গম যে দেবসমাজে অনিন্দনীয় ছিল, তা অর্জুনের প্রতি উর্বশীর উক্তি থেকে প্রকাশ পায় ।
…….

।। আট ।।

…….

নিয়োগ প্ৰথা সুবিদিত। তবে নিয়োগ প্ৰথা সম্বন্ধে এখানে দুএকটা কথা বলা প্ৰয়োজন । নিয়োগ প্ৰথায় যে যৌন অধিকার থাকত তা সাধারণ রমণের অধিকার নয় । মাত্র সন্তান উৎপাদনের অধিকার । সন্তান উৎপন্ন হবার পর এ অধিকার আর থাকত না | শাস্ত্র অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ভ্ৰাতা বা কোন নিকট আত্মীয়, বিশেষ করে সপিণ্ড বা সগোত্রকেই এই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করা হত। নিয়োগ প্ৰথা অনুযায়ী মাত্র এক বা দুটি সন্তান উৎপন্ন করা হোত, তার অধিক নয়। শাস্ত্ৰে বলা হয়েছে যে সন্তান প্রজননের সময় উভয়ে নিজ নিজ চিত্তবৃত্তিকে এমনভাবে উন্নীত করবে যে পরস্পর পরস্পরকে শ্বশুর ও পুত্রবধু বিবেচনা করবে। ( উপমাটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়) । সমাজের দৃষ্টিতে কোনটা অজাচার, আর কোনটা অজাচার নয়। সে সম্পর্কে এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে এই উদ্দেশ্যে কেবলমাত্র কোন আত্মীয়কেই আহবান করা যেত, অপরকে নয়। স্মৃতিযুগের শেষের দিকে কিন্তু নিয়োগ প্রথা পরিত্যক্ত হয়েছিল। বৃহস্পতি বলেছেন কলিযুগে ‘নিয়োগ’ প্ৰথা যুক্তিযুক্ত নয়। মনু যদিও তার ধর্মশাস্ত্রের এক অংশে এর অনুমোদন করেছেন, অপর অংশে তিনি এই প্ৰথাকে সম্পূর্ণভাবে গৰ্হিত ঘোষণা করেছেন ।

।। নয় ।।

পরবর্তীকালের সমাজে পতিব্ৰতা স্ত্রীর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, সে সংজ্ঞা অনুযায়ী আগেকার যুগের সমাজের যৌনপ্ৰথাগুলি যে অজাচার বা ব্যভিচার ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্ৰাচীনকালের সমাজে এগুলি অজাচার বা ব্যভিচার বলে গণ্য হত না । সেজন্যই অতিথির সঙ্গে সঙ্গমে রত হওয়া, সে যুগে ব্যভিচার বলে গণ্য হত না। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বর্ণিত সুদৰ্শন ও ওঘাবতী কাহিনী এ সম্বন্ধে বিশেষ আলোকপাত করে। এই কাহিনী অনুযায়ী সুদৰ্শন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি গৃহস্থাশ্রম পালন করেই মৃত্যুকে জয় করবেন। সংকল্প করেছিলেন । স্ত্রী ওঘাবতীকে অতিথি সৎকার কাজে নিয়োজিত করে তিনি তাকে আদেশ দেন যে প্ৰয়োজন হলে ওঘাবতী যেন নির্বিচারে নিজেকেও অতিথির কাছে সমৰ্পণ করে । কেননা, অতিথি অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ ব্যক্তি আর কেউ নেই। একদিন তার আদেশের সততা পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর অনুপস্থিতকালে যমরাজ স্বয়ং ব্ৰাহ্মণবেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে ওঘাবতীর সঙ্গে সঙ্গম প্রার্থনা করেন। ওঘাবতী তার সঙ্গে যৌন মিলনে প্ৰবৃত্ত হয়। এই সময় সুদৰ্শন ঘরে ফিরে এসে। স্ত্রীকে সামনে দেখতে না পেয়ে তাকে বারবার ডাকতে থাকেন । কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না । কেননা ওঘাবতী তখন ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে যৌনমিলনে নিযুক্ত থাকায় নিজেকে অশুচি জ্ঞান করে স্বামীর আহবানে সাড়া দেন নি । এমন সময় অতিথি ব্ৰাহ্মণ ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে সুদৰ্শনকে বলেন যে ওঘাবতী তার কামনা পূর্ণ করেছে। ওঘাবতীর অতিথিপরায়ণতা দেখে সুদৰ্শন অত্যন্ত প্ৰীত হন । ধর্ম তখন আত্মপ্ৰকাশ করে বলে –‘সুদৰ্শন তুমি তোমার সততার জন্য এখন থেকে মৃত্যুকে জয় করলে ।’

মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত উদ্দালক-শ্বেতকেতু কাহিনী থেকেও আমরা প্ৰাচীন ভারতে অতিথির সঙ্গে যৌন মিলনের নিদর্শন পাই। ওই কাহিনীর মধ্যে উদ্দালক বলেছিলেন–‘স্ত্রীলোক গাভীদের মত স্বাধীন। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না–এটাই সনাতন ধর্ম ।’

।। দশ ।।

স্ত্রীকে অপরের হাতে সমর্পণ করা যে প্রাচীনকালে হিন্দু সমাজেই প্ৰচলিত ছিল, তা নয় । বর্তমানকালে আদিবাসী সমাজেও কোথাও কোথাও এ প্ৰথা প্ৰচলিত আছে । যেমন মধ্যপ্রদেশের সাথিয়া উপজাতির মধ্যে কোনও চুক্তির শর্ত হিসাবে বা ঋণের জামিন স্বরূপ উত্তমর্ণের কাছে নিজের স্ত্রী, কন্যা বা অপর কোন আত্মীয়াকে বন্ধক, রাখা যায়। ঋণ পরিশোধ বা চুক্তির শর্ত প্ৰতিপালন না হওয়া পর্যন্ত ওই স্ত্রী বা কন্যা পাওনাদারের গৃহে থাকে । বন্ধকী অস্থাবর সম্পত্তি ভোগদখল করবার যেমন উত্তমর্ণের অধিকার থাকে, এক্ষেত্রে ওই বন্ধকী স্ত্রী বা কন্যাকে উপভোগ করবার সম্পূর্ণ অধিকারও পাওনাদারের থাকে । এই অবস্থায় ওই পাওনাদারের স্ত্রী বা কন্যাকে উপভোগ করবার সম্পূর্ণ অধিকারও পাওনাদারদের থাকে । এই অবস্থায় ওই পাওনাদারের গৃহে স্ত্রী বা কন্যা যদি সন্তানবতী হয়, তা হলে সে নিজগৃহে পুনরায় ফিরে আসবার সময় ওই সন্তানকে পাওনাদারের গৃহে রেখে আসে। (তুলনা করুন তারা বৃহস্পতির গৃহে ফিরে অন্যাসবার আগে চন্দ্রের ঔরসে জাত সন্তানকে চন্দ্রের গৃহে রেখে এসেছিল ) । সাথিয়ারা স্ত্রী বা কন্যাকে বন্ধক রাখা মোটেই লজ্জাজনক বা নীতিবিগহিত ব্যাপার বলে মনে করে না।

।। এগার ।।

হিন্দুসমাজে ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গস্বরূপ পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন মিলনের অনুমোদন আছে। তান্ত্রিক সাধনার মূলকথা হচ্ছে প্ৰকৃতি ও পুরুষের মিলন । এই প্ৰকৃতি ও পুরুষের মিলনকে তন্ত্রশাস্ত্রে গুহ্যরূপ দেওয়া হয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্ৰে পঞ্চ ‘ম’-কার সহকারে চক্ৰপূজার ব্যবস্থা আছে। পঞ্চ ‘ম’-কার হচ্ছে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন। তন্ত্রপূজার এগুলি হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। তন্ত্রে শক্তিসাধনা বা কুলপূজার ওপর বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে। কোন স্ত্রীলোককে শক্তির প্রতীক ধরে নিয়ে তার সঙ্গে যৌন মিলনে রত থাকাই তান্ত্রিক সাধনার মূলতত্ত্ব। গুপ্তসংহিতায় বলা হয়েছে যে সে ব্যক্তি পামর যে ব্যক্তি শক্তিসাধনার সময় কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে মৈথুন ক্রিয়ায় নিজেকে না নিযুক্ত রাখে । নিরুক্ততন্ত্র এবং অন্যান্য অনেক তন্ত্রে বলা হয়েছে যে শক্তিসাধক কুলপূজা হতে কোনরূপ পুণ্যফল পায় না, যদি না সে কোন বিবাহিত নারীর সহিত যৌনমিলনে প্ৰবৃত্ত হয় । এ কথাও বলা হয়েছে যে, কুলপূজার জন্য কোন নারী যদি সাময়িকভাবে স্বামীকে পরিহার করে তবে তার কোন পাপ হয় না । সমাজের দৃষ্টিতে যাকে অজাচার বলা হয়, অনেক সময় এটা সে রূপও ধারণ করত। কেননা কুলচুড়মণিতন্ত্রে বলা হয়েছে যে, অন্য রমনী যদি না আসে তা হলো নিজের কন্যা বা কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ ভগিনী, মাতুলানী মাতা বা বিমাতাকে নিয়েও কুলপূজা করবে। ( “অন্যা যদি ন গচ্ছেতু নিজকন্যা নিজানুজা । অগ্রজা মাতুলানী বা মাতা বা তসপত্নীকা। পূর্বাভাবে পরা পূজ্যা মদংশা যোষিতো মতাঃ।। একা চেৎ কুলশাস্ত্ৰজ্ঞ পুজোর্হা তত্র ভৈরব ।।” ) .

অনেক সময় ধর্মের রূপ দিয়ে কামাচারী ব্ৰাহ্মণ পুরোহিতরা বিবাহিতা নারীকে প্ৰলুব্ধ করত, তাদের সতীত্ত্ব বিসর্জন দিত । এরূপভাবে প্ৰলুব্ধ হয়ে সতীত্ব বিসর্জন দেবার এক কাহিনী অষ্টাদশ শতাব্দীর পর্যটক আবে দুবোয়া তার গ্রন্থে বিবৃত করে গেছেন । তিনি বলেছেন যে দক্ষিণ ভারতে এমন কতকগুলি মন্দির আছে যেখানকার পুরোহিতগণ প্রচার করে যে আরাধ্য দেবতার অত্যাশ্চর্য শক্তি আছে স্ত্রীলোকের বন্ধ্যতা দূর করবার। এরূপ মন্দিরের মধ্যে কর্নাটক দেশের তিরুপতির মন্দির বিশেষভাবে প্ৰসিদ্ধ । এখানকার দেবতা ভেন কাটেশ্বরের কাছে অসংখ্য স্ত্রীলোক আসে সন্তান কামনায় । পুরোহিতগণ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তারা মন্দিরে রাত্রি যাপন করে। পুরোহিতগণ তাদের বলে যে তাদের ভক্তিদ্বারা গ্ৰীত হয়ে ভেনকাটেশ্বর রাত্রিকালে তাদের কাছে আসবে এবং তাদের গর্ভবতী করে দিয়ে যাবে। তারপর যা ঘটতে, তা না বলাই ভাল। পাঠক তা সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন । পরদিন প্ৰভাতে এই সকল জঘন্য চরিত্রের ভণ্ড তপস্বীরা কিছুই জানে না। এরূপ ভান করে ওই সকল স্ত্রীলোকের কাছে এসে দেবতার করুণা লাভ করেছে বলে তাদের পুন্যবতী আখ্যা দিয়ে তাদের কাছ থেকে দান গ্ৰহণ করত । দেবতার সঙ্গে তাদের যৌন মিলন ঘটেছে, এই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এই সকল হতভাগিনী নারীরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যেত ।

ধর্মানুষ্ঠানের নামে বিবাহিতা মেয়ের সতীত্ব সর্বপ্রথম নাশ করবার অধিকার কুলগুরুদের বাঙলা দেশেও ছিল । একে ‘গুরুপ্রসাদী’ বলা হত। এ প্রথা ইংলণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডেও ছিল । এ প্রথাকে বলা হত – ‘Jus prima noctis,’ উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলাদেশে এই প্রথার কি ভাবে অবলুপ্তি ঘটেছিল, তার একটা সজীব চিত্র হুতোম তাঁর নকশায় দিয়েছেন । তিনি লিখছেন — চক্রবর্তীদের জামাই হরহরি বাবু সেই যে বিয়ের সময় স্ত্রীকে দেখেছিলেন আর দেখেন নি। পাঁচ বৎসর পর তিনি শ্বশুরবাড়ী এসেছেন । এবার হুতোমের ভাষায় বর্ণনাটা শুনুন । এদিকে চক্রবর্তী বাড়ীর গিন্নীরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল যে, ‘তাই তো গা ! জামাই এসেছেন, মেয়েও ষেটের কোলে বছর পনেরো হল, এখন প্ৰভুকে খবর দেওয়া আবশ্যক’। সুতরাং চক্রবর্তী পাঁজি দেখে উত্তম দিন স্থির করে প্রভুর বাড়ি খবর দিলে, প্ৰভু তুরী, খন্তি ও খোল নিয়ে উপস্থিত হলেন। গুরুপ্ৰসাদীর আয়োজন হতে লাগল।…চক্রবর্তীর বাড়ীর ভিতর বড় ধুম । গোস্বামী বরের সজ্জা করে জামাইবাবুর শোবার ঘরে শুলেন । হরহরিবাবুর স্ত্রী নানালঙ্কার পরে ঘরে ঢুকলেন । মেয়েরা ঘরের কপাট ঠেলে দিয়ে ফাঁক থেকে আড়ি পেতে উঁকি মারতে লাগল।…হরহরিবাবু একগাছি রুল নিয়ে গোস্বামীর ঘরে শোবার পূর্বেই খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন ; এক্ষণে দেখলেন যে স্ত্রী ঘরে ঢুকে গোস্বামীকে একটা প্ৰণাম করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। প্ৰভু খাট থেকে উঠে স্ত্রীর হাত ধরে অনেক বুঝিয়ে শেষে বিছানায় নিয়ে গেলেন । কন্যাটি কি করে । বংশপরম্পরানুগত ধর্মের অন্যথা করলে মহাপাপ–এটি চিত্তগত আছে, সুতরাং আর কোন আপত্তি করল না–সুড়সুড়ি করে প্রভুর বিছানায় গিয়ে শুলে। প্ৰভু কন্যার গায়ে হাত দিয়ে বল্লেন, ‘ব’ল, আমি রাধা তুমি শ্যাম’ । কন্যাটিও অনুমতি মত ‘আমি রাধা, তুমি শ্যাম’, তিনবার বলেছে এমন সময় হরহরিবাবু আর থাকতে পারলেন না, খাটের নীচে থেকে বেরিয়ে এসে এই ‘কাঁধে বাড়ি বলরাম’ বলে গোস্বামীকে রুলসই করতে লাগলেন । এই ঘটনায় প্রভুরা ভীত হলে সমাজে গুরুপ্রসাদী উঠে গেল। খরতাল বাজাবে ; গোস্বামীর রুল সইয়ের চিৎকারে তার হরিধ্বনি ভেবে দেদার খোল বাজাতে লাগল, মেয়ের উলু দিতে লাগল, কাঁসির ঘণ্টা শাকের শব্দে হুলস্থল পড়ে গেল। হরহরিবাবু হঠাৎ দরজা খুলে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে, একেবারে থানার দারোগার কাছে গিয়ে সমস্ত কথা ভেঙ্গে বলল। এদিকে সকলে ঘরে গিয়ে দ্যাখে যে গোস্বামীর দাঁতে কপাটি লেগে গ্যাছে, অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন, বিছানায় রক্তের নদী বইছে। সেই অবধি গুরুপ্ৰসাদী উঠে গ্যালো, লোকেরও চৈতন্য হলো ; প্রভুরাও ভয় পেলেন।

শিব সংযমী দেবতা

ইন্দ্র থেকে ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু পর্যন্ত সকলেই ব্যভিচারী দেবতা । একমাত্র শিবই ব্যভিচারী বা কামুক দেবতা নন । বরং তার কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি কামদেবকে ভস্ম করেছিলেন । শিব মহাযোগী। কিন্তু মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শিব ঘোর সংসারী ।

…..কিভাবে শিবশক্তি পূজার উদ্ভব হল, তার ইতিহাস এখানে সংক্ষেপে বলে নিই।

আদিম মানুষ যখন খাদ্য-আহরণের জন্য পশুশিকারে বেরুত, তখন অনেক সময় তাদের ফিরতে দেরি হত । মেয়েরা তখন ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল এবং ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্য খেয়ে প্ৰাণ ধারণ করত । তারপর তাদের ভাবনা চিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা । সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্য অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেই হেতু ভূমিকে তারা মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে। পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমি ( আমাদের সমস্ত ধৰ্মশাস্ত্ৰেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র’ বা ভূমি বলে বর্ণনা করা হয়েছে ) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন ? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমিকৰ্ষণ করতে থাকে। প্রৎমুলুসকি তাঁর ‘আর্য ভাষায় অনার্য শব্দ’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল” ও ‘লাঙ্গল’, এই তিনটা শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন । মেয়েরা এইভাবে ভূমিকৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল । যখন ফসলে মাঠ ভরে গেল, তখন পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। চিন্তা করল লিঙ্গরূপী যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী পৃথিবী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active. Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার । ফসল তোলার পর যে প্ৰথম নবান্ন উৎসব হল সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গ ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা । এই আদিম ধারনা হতেই উদ্ভূত হয়েছিল শিব ও শক্তির কল্পনা । শিব ও শক্তির আরাধনা মোটেই বৈদিক উপাসনা পদ্ধতির অন্তভূক্ত ছিল না। আর্যরা এদেশে আসবার পরে শিব ও শিবানীর অনুপ্ৰবেশ ঘটেছিল আৰ্যদেবতামণ্ডলীতে। …..

।। দুই ।।

রুদ্র-শিব গোড়াতে বৈদিক দেবতামণ্ডলীতে ছিলেন না বলেই, তিনি অন্যান্য বৈদিক দেবতাদের মত কামাসক্ত নন। শিব মহাযোগী। তার মনে কামের ভাব জাগাবার জন্য কামদেবকে পাঠাতে হয়েছিল, কিন্তু মহাদেব কর্তৃক কামদেব ভস্মীভূত হয়েছিল ( মৎস্যপুরাণ অনুযায়ী কামদেব ব্ৰহ্মার হৃদয় হতে উৎপন্ন । কিন্তু ব্ৰহ্মা নিজে তার শরে জর্জরিত হয়ে নিজ কন্যা শতরূপাতে উপগত হওয়ার দরুণ, ব্ৰহ্মা কামদেবের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে, তিনি মহাদেব কর্তৃক ভস্মীভূত হবেন। এখানে আরও উল্লেখনীয় যে বিষ্ণু আৰ্য দেবতা । সেই কারণে আমরা ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণু উভয়কেই ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখি । শিবকে নয় । কোন নারীরই ক্ষমতা ছিল না শিবের রেতঃ ধারণ করবার । এটা আমরা স্কন্দের ( কার্তিকের ) জন্ম বিবরণ থেকে জানতে পারি। শিব লিঙ্গরূপে পূজিত হলেও (শিবের লিঙ্গচ্ছেদের বিবরণ ‘ব্ৰহ্মাণ্ডপুরাণ’-এ আছে) এটাই হচ্ছে শিবের বৈশিষ্ট্য। সেজন্যই যারা শিবের গাজন উৎসবের ব্ৰত পালন করে, তারা সারা চৈত্র মাস সন্ন্যাস গ্ৰহণ করে ও ব্ৰহ্মচৰ্য পালন করে ।

।। তিন ।।

শিবের মত জনপ্রিয় দেবতা বাঙলায় আর দ্বিতীয় নেই। সে জন্যই বাঙালী ধান ভানতেও শিবের গীত গায়। বাঙলায় শিবমন্দিরের যত ছড়াছড়ি এ রকম ভারতের আর কোথাও নেই । আর শিবজায়া শিবানীর উৎসবই হচ্ছে বাঙলার শ্রেষ্ঠ উৎসব।

পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে পর্যন্ত ছোট ছোট বাঙালী মেয়েরা যখন বোশেখ মাসে শিবপূজা করত তখন ওই পূজার ছড়া-মন্ত্রে স্বগতোক্তি করত-‘গৌরী কি ব্ৰত করে ?’ ব্ৰতের শেষে প্রার্থনা করত–’যেন শিবের মত বর পাই ।’ তখন বাঙলার প্রতি মেয়েই কল্পিত হত গৌরী হিসাবে । আর শিব ছিল বাঙালীর কাছে জামাই বিশেষ ।

দক্ষযজ্ঞের পর শিবজায়া সতী হিমালয়-পত্নী মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এবং মহাদেবকে পতিরূপে পাবার জন্য কঠোর তপস্যা করেন । তখন মহাদেবও কঠোর তসস্যায় রত ছিলেন। এদিকে তারকাসুরের অত্যাচারে উৎপীড়িত দেবতারা জানতে পারেন যে, মহাদেবের ঔরসে যে পুত্র জন্মাবে সেই পুত্রই তারকাসুরকে বধ করবে। সেজন্য পাৰ্বতী ও মহাদেবের মিলন করাতে এসে কামদেব বা মদন মহাদেবের কোপে ভস্মীভূত হয়। তারপর পাৰ্বতী ও মহাদেবের মিলন হলে মদন পুনর্জীবন লাভ করে। এই মিলনের ফলে কার্তিকের জন্ম হয় । কার্তিককে দেবসেনাপতি করা হয়। কার্তিক তারকাসুরকে বধ করেন । মহাভারতে আছে যে ব্রহ্মা থেকে আরম্ভ করে পিশাচ পর্যন্ত সকলেই মহাদেবকে পূজা করেন। একবার ব্ৰহ্মা মহাদেবকে অসম্মানসূচক কথা বলেছিলেন বলে মহাদেব ব্ৰহ্মার একটি মস্তক কর্তন করেন । সেই থেকে, ব্ৰহ্মা চতুর্মুখ। আগে ব্ৰহ্মার পাঁচ মুখ ছিল। শিবই একটা মুখ কেটে দিয়েছেন।

শিবের নিবাস কৈলাসে। তাঁর তিন স্ত্রী সতী, পাৰ্বতী ও গঙ্গা । দুইপুত্র কার্তিক ও গণেশ। দুই কন্যা লক্ষ্মী ও সরস্বতী। বিষ্ণু শিবের জামাতা । শিবের অনুচরদের মধ্যে আছে নন্দী ও ভৃঙ্গী ।

……….

রাজমহীষীদের অশ্বসঙ্গম

….

অশ্বমেধ ছিল বৈদিক যুগের সবচেয়ে বড় যজ্ঞ । বৈদিক গ্ৰন্থসমূহে অশ্বমেধের মহিমা উচ্ছসিত ভাষায় কীর্তিত হয়েছে। ঐতিহাসিক যুগে পুষ্যমিত্ৰ শুঙ্গ দুবার অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্তও অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন । রামচন্দ্র ও যুধিষ্ঠিরও অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন । শত অশ্বমেধকারী রাজা ইন্দ্ৰত্ব লাভ করতেন । সেজন্যই ইন্দ্রের এক নাম শতক্ৰতু। এটা চৈত্রমাসে অনুষ্ঠিত হত । কিন্তু কাত্যায়ন তাঁর শ্রৌতসুত্ৰে (২০।১।২১) বলেছেন যে এটা যে-কোন সময়েও হতে পারত । যজ্ঞের আসল অংশটা তিনদিন স্থায়ী হত, কিন্তু এর প্রস্তুতিপর্ব শেষ করতে এক থেকে দুবছর সময় লগত । এতে অংশ গ্ৰহণ করতেন রাজা ও তার চার মহিষী, ৪০০ জন পারিষদ ও ৪ জন পুরোহিত । কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র (২।১।২১-৩৫) অনুযায়ী প্রাথমিক আচার অনুষ্ঠানের পর এক বৎসরের ( এই এক বৎসর তাকে যৌনমিলন থেকে বিরত রাখা হত) জন্য তাকে দেশের মধ্যে বিচরণ করবার জন্য ছেড়ে দেওয়া হত । তার সঙ্গে থাকত ৪০০ জন সশস্ত্র প্রহরী ও ১০০ জন রাজারাজড়া বা তাদের ছেলে পুলে । অপর রাজ্যের ভিতর দিয়ে যাবার সময় যদি কেউ অশ্বটি অপহরণ করত বা তার গতি প্ৰতিহত করত, তা হলে সংঘর্ষ ও যুদ্ধ হত ও অশ্বটিকে উদ্ধার করা হত । অশ্বটি নির্বিঘ্নে স্বরাজ্যে ফিরে এলে আসল যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত ।

প্ৰথম দিনে এক অগ্নিষ্টোম যজ্ঞ করা হত । দ্বিতীয় দিনে যজ্ঞকারী রাজার রাণীরা অশ্বটিকে এক নিকটস্থ জলাশয়ে নিয়ে গিয়ে তার বিলোপন ও প্ৰসাধনাদি ক্রিয়া সম্পাদন করত। তারপর অশ্বটিকে যজ্ঞস্থানে ফিরিয়ে এনে, একটি ছাগ ও অন্যান্য বধ্য প্রাণীর সঙ্গে যুপকাষ্ঠে বাঁধা হত। তখন ঘোড়াটাকে সংজ্ঞাপন বা শ্বাসরোধ করে মারা হত ।

তারপর প্রধান রাজমহিষী ঘোড়াটার পাশে শুয়ে পড়ত ৷ তাদের ওপর একখানা কাপড় চাপা দেওয়া হত । কাপড়ের আচ্ছাদনের ভিতরে প্রধান মহিষী ঘোড়াটার সঙ্গে মৈথুন কর্মে নিযুক্ত হত, এবং তাকে যৌনকর্মে উত্তেজিত করবার জন্য বাহিরে দণ্ডায়মান পুরোহিত ও উপস্থিত মেয়েরা নানারকম অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করত। ( আপস্তম্ভ শ্রৌতিসূত্র ২০|১৮|৩-৪ ; কাত্যায়ন শ্রেণীতসূত্র ২০|৬|১৫-১৭ ) । তারপর ঘোড়াটাকে কাটা হত, রান্না করা হত ও বিতরণ করা হত । ( নীচে দেখুন ) । যজ্ঞের তৃতীয় দিনকে “অতিরাত্ৰ’ বলা হত । ওই দিন ‘অবভূত” অনুষ্ঠানের পর যজ্ঞের সমাপ্তি ঘটত। অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য চারজন পুরোহিতের প্রত্যেককে দক্ষিণাস্বরূপ ৪৮,০০০ গাভী দান করা হত। ( অশ্বমেধ সম্বন্ধে বিশদ বিবরণের জন্য পি. ই. ডুমোণ্টের L’ Asvamedha, Paris 1927 দেখুন )। বাজসনেয়ী সংহিতায় (২২-২৩) অশ্বমেধের যে বিবরণ আছে, তা থেকে মনে হয় যে অশ্বের পরিবর্তে প্ৰধান পুরোহিতের সাহিতই প্ৰধান রাজমহিষী সর্বসমক্ষে মৈথুন ক্রিয়ায় রত হতেন ।

………..

নারীসঙ্গম ও তন্ত্রধর্ম

হিন্দু ধর্মের এক বিশেষ “ইডিয়াম” হচ্ছে তান্ত্রিক সাধনা, তান্ত্রিক সাধকদের মধ্যে যাঁরা বামাচারী তাদের নারী সঙ্গমই হচ্ছে সাধনার প্রধান অঙ্গ । ….
……..

।। ছয় ।।

……….

তান্ত্রিক সাধনায় তিনটি অধিকারভেদ আছে। উত্তম, মধ্যম ও অধম অধিকারভেদে দিব্যাচার, বীরাচার ও পশ্বাচার। ভোগ না হলে, ত্যাগ আসে না, সেজন্যই তান্ত্রিক সাধনার প্রথম ধাপ পশ্বাচার। এই ধাপে সাধক কামকে সম্পূর্ণভাবে জয় করেন। পশ্বাচারের পর সাধক বীরাচারে প্রবৃত্ত হয় । ……..

বস্তুতঃ তন্ত্রগ্রন্থসমূহে বলা হয়েছে যে ‘মৈথুন’ ছাড়া কুলপূজা হয় না । যেমন গুপ্তসংহিতায় বলা হয়েছে-“কুলশক্তিম বিনা দেবী যো জপেত স তু পামর ।” আবার বলা হয়েছে যে, সে নারী নিজের স্ত্রী হলে চলবে না । এ সম্বন্ধে নিরুত্তরতন্ত্রে বলা হয়েছে ‘বিবাহিতা পতিত্যাগে দুষণমন কুলার্চনে।’ তার মানে কুলপূজার জন্য সধবা স্ত্রীলোক যদি তার পতিত্যাগ করে, তবে তার কোন দোষ হয় না । মাত্ৰ সধবা হলেই চলবে না । সে ষোড়শী, সুন্দরী, কামবর্জিতা ও বিপরীতরমণদক্ষ হওয়া চাই । ( ‘বিপরীতরতা সা তু ভাবিত হৃদয়োপরি’ ) । এরূপ কুলপূজায়রত নারীকে কুলনায়িকা বলা হয়। কুমারীতন্ত্রে বলা হয়েছে যে নটী, কাপালিকা, বেশ্য, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, মালাকার কন্যা, নাপিত স্ত্রী, রাজকী ও গোপালকন্যা, এই নববিধ কন্যাই এই কার্যে প্ৰশস্ত । বিকলাঙ্গী, বিকৃতাঙ্গা, সন্দিগ্ধচিত্তা, বৃদ্ধা, পাপযুক্ত, হুঙ্কারকারিণী, অর্থলুব্ধ, অভক্তিচিত্তা এবং কাতরা রমণীকে এই কার্যে ত্যাগ করবে। কুলচুড়ামণিতন্ত্রে বলা হয়েছে বিশেষভাবে লীলাচাতুর্য থাকলে যাবতীয় কুলাঞ্জনাই শক্তিরূপে গৃহীত হতে পারে। ( বিশেষবৈদদ্ধ যুতঃ সৰ্ব্ব এব কুলাঙ্গনা ) । কুলচূড়ামণিতন্ত্রে আরও বলা হয়েছে যে, অন্য রমণী যদি না আসে তা হলে নিজের কন্যা, নিজের কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠা ভগিনী, মাতুলানী, মাতা বা বিমাতাকে নিয়ে কুলপূজা করবে । ( অন্যা যদি ন গচ্ছেত্তু, নিজকন্যা নিজানুজা । অগ্ৰজা মাতুলানী বা মাত৷ বা তৎ সপত্নিকা ৷ পূৰ্বাভাবে পরা পূজ্যা মদংশা যোযিতো মতাঃ। এক চেৎ কুলশাস্ত্রজ্ঞ পূজার্হা তত্ৰ ভৈরব ।।’

………

রাত্রিকালে সাধক ‘আমি শিব’ ( ধ্যাত্বা শিবোহমতি’ ) এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে নগ্ন অবস্থায় নগ্ন রমণী রমণ করত ( “ততে নগ্নাং স্ক্রিয়ং নগ্নং রমণ ক্লেদযুতোহপি বা” ) রাত্রির তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত নিজ সাধন কার্যে লিপ্ত থাকবে । কুলাৰ্ণবতন্ত্র অনুযায়ী এই সাধন-প্রক্রিয়া কি, তা আমি আর বাংলায় অনুবাদ করব না । মূল সংস্কৃত শ্লোকই এখানে উদ্ধৃত করছি—

“আলিঙ্গনং চুম্বনঞ্চ স্তনয়োর্মদনস্তথা ।
দর্শনং স্পৰ্শণং যোনেৰ্বিকাশে লিঙ্গঘর্ষনম্‌ ।।
প্ৰবেশ স্থাপনং শক্তের্ণব পুষ্পানিপূজনে” ।

সাধারণ পাঠককে তন্ত্রের গুহ্য রহস্যময় জগতে আর নিয়ে যেতে চাই না । সেজন্য এ সম্বন্ধে এখানেই থেমে যাচ্ছি ।

।| সাত ।।

বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবতামণ্ডলীর ন্যায়, হিন্দু তান্ত্রিক দেবতামণ্ডলীতেও অসংখ্য দেবদেবী আছেন । তবে তাঁদের মধ্যে দশমহাবিদ্যাই হচ্ছেন প্ৰধান । এই দশমহাবিদ্যা হচ্ছেন- “কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী । ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা । বগল সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা । এতা দশমহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্ৰকীৰ্ত্তিতাঃ।” এই সকল দেবতার ধ্যানমন্ত্র থেকে আমরা তাদের আকৃতির পরিচয় পাই। কালী উলঙ্গিনী, সহস্যবদনা, চতুর্ভূজা, কৃষ্ণবর্ণা, দিব্যরূপিণী, গলদেশে নরমুণ্ডমালা, বামভাগের নীচের হাতে অভয়মুদ্রা ও ওপর হাতে বরমুদ্রা । তিনি শিবরূপ শবের ওপর দণ্ডয়ামান । তারা ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা খর্ব, লম্বোদরী, ভয়ঙ্করাকৃতি, গলদেশে নরমুণ্ডরচিত মালা, চতুর্ভূজা ও নবযুবতীরূপা । শবহৃদয়ে তাঁর বাম পদ বিন্যস্ত। ষোড়শী ‘বালাকমণ্ডলাভাসাং চতুর্বাহুংত্ৰিলোচনাম্‌। পাশাংকুশ শরাংশ্চাপান্‌ ধারয়ন্তীং শিবং ভজে”। ভুবনেশ্বরীর উদিত সূর্যের ন্যায় দেহকান্তি, কপালে অর্ধচন্দ্র, মস্তকে মুকুট, পীনোন্নত পয়োধরা, ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সহাস্যবদন । ভৈরবীর উদয়কালীন সূর্যের ন্যায়৷ দেহকান্তি, কপালে অর্ধচন্দ্র, রক্তবর্ণা, ক্ষৌমবস্ত্ৰপরিহিতা, গলায় মুণ্ডমালা, রক্ত অনুলিপ্তস্তনা, মাথায় মুকুট ও চতুর্ভূজা। তাঁর হাতে যথাক্রমে জপমালা, পুস্তক, অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা আছে। ছিন্নমস্তার সদা ষোড়শবর্ষীয়া যুবতীর ন্যায় আকৃতি, স্তনদ্বয় স্থূল ও উন্নত, আলুলায়িত কেশ, বিবসনা ও ভয়ঙ্করী। তিনি বাম করে আপনি ছিন্নমস্তক ধারণ করেন ও নিজকণ্ঠোত্থিত রক্ত পানে রত। ধূমাবতী ‘বিবর্ণা চঞ্চলা রুষ্টা দীর্ঘা চ মলিনাম্বরা । বিবর্ণকুন্তলা রক্ষা বিধবা বিরলাদ্বিজা ৷’’ ইনি কাকধ্বজ রথে আরোহণ করে থাকেন । বগলা সুধাসাগর মধ্যে মণিময়মণ্ডপো রত্ননির্মিত বেদীর ওপর সিংহাসনে উপবিষ্টা, পীতবর্ণা, মাল্য বিভূষিতা দ্বিভূজা ও পীতবর্ণ বস্ত্ৰ পরিহিতা । মাতঙ্গী শ্যামবর্ণা, অর্ধচন্দ্ৰদ্ধারিণী ও ত্রিনয়না। ইনিও রত্ননির্মিত সিংহাসনে উপবিষ্টা । কমলার দেহকান্তি কাঞ্চনের ন্যায়। তিনি চতুর্ভূজা, তাঁর মস্তক রত্নমুকুটে বিভূষিতা । তাঁর করে পঞ্চবস্তু ও তিনি পদ্মের ওপর উপবিষ্টা ।………….

বিদ্যাধর ও বিদ্যাধরীদের আচরণ

এদেশের লোক অতি প্ৰাচীন কাল হতেই বিদ্যাধরীতে বিশ্বাস করে এসেছে। বিদ্যাধরী কারা ? অভিধান খুলে দেখি, বিদ্যাধরীরা দেবযোনি বিশেষ। তবে অন্য সূত্র থেকে জানতে পারা যায়, এরা পৃথিবী ও আকাশের মধ্যস্থলে বাস করে। সাধারণতঃ এরা মঙ্গলকামী অনুচর হলেও এদের নিজেদের রাজা ছিল । এরা মনুষ্য জাতির সঙ্গে বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপন করত । এদের কামরূপী বলা হত, কারণ এরা ইচ্ছা মত নিজের চেহারা পরিবর্তন করতে সক্ষম হত । ভারতীয় ভাস্কর্যে উড়ন্ত বিদ্যাধর ও বিদ্যাধরীদের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।

যাঁরা বঙ্কিমের ‘ইন্দিরা’ পড়েছেন, তঁরা জানেন যে ইন্দিরা উপেন্দ্রের কাছে আত্মপ্ৰকাশ না করে বলেছিল– ‘আমি মায়াবিনী । কামরূপে আমার অধিষ্ঠান । আমি আদ্যাশক্তির মহামন্দিরে তাহার পার্শ্বে থাকি । লোকে আমাদিগকে ডাকিনী বলে কিন্তু আমরা বিদ্যাধরী। আমি মহামায়ার নিকট কোন অপরাধ করেছিলাম, সেই জন্য অভিশাপগ্ৰস্ত হইয়া এই মানবীরূপ ধারণ করিয়াছি। পাচিকাবৃত্তি ও কুলটা বৃত্তি ভগবতীর শাপের ভিতর । তাই এই সকল অদৃষ্ট ঘটিয়াছে।’ যদি তৎকালীন পাঠকসমাজ বিদ্যাধরীদের আজগুবী বা ঐ জাতীয় কিছু বলে মনে করত তা হলে বিদ্যাধরীর অনুপ্ৰবেশ ঘটিয়ে বঙ্কিম কখনই তার উপন্যাসখানিকে অবাস্তবতার রূপ দিতেন না ।
….

মহাদেবের অনুচর

…….ভৃঙ্গী ও মহাকাল দুজনেই শিবের অনুচর। শিব যখন একবার পাৰ্বতীর সঙ্গে বিহার করছিলেন, ভূঙ্গী ও মহাকাল দ্বাররক্ষক রূপে নিযুক্ত ছিল। গোপনে তারা শিব ও শিবানীর বিহার দেখে। এতে শিবানী ক্রদ্ধ হয়ে এদের মনুষ্যযোনিতে জন্ম হবে বলে অভিশাপ দেন । তখন ভৃঙ্গী ও মহাকাল শিবানীর কাছে প্রার্থনা করে যে শিব ও শিবানীও যেন মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করেন, কেননা তারা শিবানীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করতে চায় ।….

দেবদেবীর কুলজী

……

ইন্দ্রের স্ত্রী শচী বা ইন্দ্ৰানী । তৈত্তিরীয়ব্ৰাহ্মণ অনুযায়ী ইন্দ্ৰ ইন্দ্ৰাণীর যৌনআবেদনে আকৃষ্ট হয়ে অন্যান্য সুন্দরীদের প্রত্যাখান করে ইন্দ্ৰাণীকে বিয়ে করেছিলেন । অন্যান্য গ্রন্থে আছে যে তিনি ইন্দ্ৰাণীর সতীত্ব নষ্ট করে তাকে বিবাহ করেছিলেন । পুলোবা তার শ্বশুর। ইন্দ্রের পুত্রের নাম জয়ন্ত ।

মহাভারতে আছে গৌতম মুনির অনুপস্থিতিতে ইন্দ্ৰ তাঁর রূপ ধরে তাঁর স্ত্রী অহল্যার সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন। মহাভারতে আরও আছে যে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ইন্দ্রের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে । ইন্দ্রের রেতঃ থেকে বালীরও জন্ম হয়েছিল ।

…..

মুনি-ঋষিদের যৌনজীবন

……..

মুনিঋষিরা যে মাত্র নিজ পূৰ্বপুরুষদের মঙ্গলের জন্যই বিবাহ করতেন, তা নয়। রাজারাজড়ারাও তাদের ডাকতেন। তঁদের দিয়ে নিজ নিজ স্ত্রীদের গর্ভে পুত্র উৎপাদনের জন্য ।

সাধারণ মানুষের মত মুনিঋষিদেরও যৌনবাসনা থাকত। আমরা অনেক ঊর্ধ্বরেতা মুনিঋষিদের দেখি, সুন্দরী অন্সরাদের দেখে রেতঃপাত করছেন। ( ঊর্ধ্বরেতা মানে যার বীর্য উৰ্ব্বরেতা হয়েছে, এবং যার কখনও রেতঃস্থলন হয় না ) । মাত্র পাণ্ডবরাই বহুপতিক ছিলেন না । মুনিঋষিরাও ছিলেন । গৌতমবংশীয়া জটিলা সাতটি ঋষিকে একসঙ্গে বিবাহ করেছিলেন । আবার বার্ক্ষী নামে অপর এক ঋষিকন্যা একসঙ্গে দশ ভাইকে বিবাহ করেছিলেন ।

।। দুই ।।

অগস্ত্য ও জরতকারু কাহিনী নিয়েই শুরু করা যাক । অগস্ত্য বেদের একজন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি । বশিষ্টও একজন বড় ঋষি । ইনি সূর্যবংশের কুলগুরু ও কুল-পুরোহিত। আদিত্য যজ্ঞে মিত্র ও বরুণ উৰ্বশীকে দেখে যজ্ঞ কুম্ভের মধ্যে শুক্রপাত করেন। সেই কুণ্ডে পতিত শুক্র হতে অগস্ত্য ও বশিষ্টের জন্ম হয় । অগস্ত্য প্ৰতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি চিরকাল অকৃতদার থাকবেন । কিন্তু একদিন ভ্ৰমণ করতে করতে দেখতে পেলেন যে তাঁর পিতৃপুরুষরা এক গুহার মধ্যে পা উপরে ও মাথা নীচের দিকে করে ঝুলছেন। তাদের জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারলেন যে বংশরক্ষা না করলে তঁদের সদগতি নেই। তখন অগস্ত্য বিবাহ করা স্থির করলেন । নিজ তপোবলে পৃথিবীর সমস্ত প্ৰাণীর সুন্দর ও শ্ৰেষ্ঠ অংশ নিয়ে তিনি এক পরমাসুন্দরী নারী সৃষ্টি করলেন। সমস্ত জীবের সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ অংশ এই নারী লোপ করে নিয়েছিল বলে, এই নারীর নাম হল লোপামুদ্রা। লোপামুদ্রাকে পালন করবার ভার তিনি বিদর্ভরাজের ওপর দিলেন । মেয়েটি বড় হলে, অগস্ত্য তাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলেন। তখন তিনি লোপমূদ্রাকে সম্বোধন করে বললেন—“প্রিয়ে ! তোমার অভিলাষ বল, তুমি আমার দ্বারা কতগুলি সন্তানের জননী হতে চাও, একটি, না একশত, না এক সহস্ৰ ?” এরপর অগস্ত্য দৃঢ়স্যু নামে এক পুত্র উৎপাদন করলেন ।……..

।। তিন ।।

….একদিন মৎস্যগন্ধা নামে এক ধীবর কন্যা যমুনায় নৌকা পারাপারে নিযুক্ত ছিল। পরাশর তখন সেই নৌকায় যাচ্ছিলেন। মৎস্যগন্ধাকে দেখে পরাশর কামাতুর হয়ে মৎস্যগন্ধার কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করেন । সেই সঙ্গমের ফলেই বেদের বিভাগকর্তা ও পুরাণসমূহের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসের জন্ম হয়।

…..তিনি বশিষ্টকে তার স্ত্রীর গর্ভে এক সন্তান উৎপাদন করতে বলেন । বশিষ্টের সঙ্গে এই সঙ্গমের ফলে রাজমহিষী গর্ভবতী হন । কিন্তু ১২ বছর কেটে গেলেও সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় না। তখন রাজমহিষী এক পাষাণখণ্ড দিয়ে নিজের উদর বিদীর্ণ করে এক পুত্র প্রসব করেন । এই পুত্রের নাম অশ্মক ।

।। চার ।।

বিশ্বামিত্র বৈদিক যুগের একজন ব্রহ্মর্ষি এবং ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলের সমস্ত সূক্তের মন্ত্রগুলির অভিবক্তা। ক্ষত্ৰিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেও কঠোর তপস্যাবলে তিনি ব্ৰাহ্মণত্ব লাত করেন। তিনি ঊর্ধ্বরেতা ঋষি । এক সময় পুষ্করতীর্থে তিনি উগ্ৰ তপস্যায় রত ছিলেন। সেই সময় ইন্দ্রের প্রেরণায় অপ্সরা মেনকা পুষ্করতীর্থে স্নান করতে গেলে, বিশ্বামিত্র তার রূপে মুগ্ধ হন এবং তাঁর সহবাসে দীর্ঘ দশবছর অতিবাহিত করেন । এই সহবাসের ফলে মেনকার গর্ভে শকুন্তলা নামে এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। মেনকা কন্যাকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। পরিত্যক্ত কন্যাকে কন্ধমুনি পালন করেন ।

গালব বিশ্বামিত্রের প্রিয় শিষ্য । শিক্ষান্তে বিশ্বামিত্র তাকে গৃহে প্ৰত্যাবর্তনের অনুমতি দেন। গা্লব গুরু দক্ষিণা দিতে চান । বিশ্বামিত্র বলেন তিনি এমন ৮০০ অশ্ব গুরুদক্ষিণ চান, যাদের কান্তি চন্দ্রের মত শুভ্র এবং একটি কর্ণ শ্যামবর্ণ। গালিব রাজা যযাতির কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানায়। যযাতি এতগুলো অশ্ব দান করতে অসমর্থ হয়ে, গালবের হাতে নিজ কন্যা মাধবীকে দিয়ে বলেন যে, এই কন্যাকে নিয়ে তুমি রাজাদের হাতে সমর্পণ করলে কন্যার শুল্কস্বরূপ তারা ৮০০ অশ্ব দান করবেন ও তিনি দৌহিত্র পাবেন । গালব প্রথমে অযোধ্যার রাজা হর্যশ্বের কাছে যায় । রাজা হর্যশ্ব বলেন যে তাঁর মাত্র ২০০ অশ্ব আছে এবং তিনি এই কন্যার গর্ভে মাত্র একটি পুত্র উৎপাদন করতে চান। তখন মাধবী গালিবকে বলে– ‘এক মুনির বরে প্রত্যেকবার প্রসবের পর আমি কুমারী থাকব । অতএব আপনি ২০০ অশ্ব নিয়ে আমাকে এঁর হাতে দান করুন । পরে আরও তিনজন রাজার কাছে আমাকে দান করলে আপনার ৮০০ অশ্ব পূর্ণ হবে, এবং আমার চারপুত্ৰ লাভ হবে।’ এরপর গালব এইভাবে আরও ৪০০ অশ্ব সংগ্ৰহ করে, এবং বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে বলে, আপনি ৬০০ অশ্ব গ্ৰহণ করুন, আর বাকী ২০০ অশ্বের পরিবর্তে মাধবীকে গ্ৰহণ করুন । বিশ্বামিত্র মাধবীকে গ্ৰহণ করেন, এবং তার গর্ভে এক সন্তান উৎপাদন করেন ।

চ্যবন মহর্ষি ভৃগু ও পুলোমার পুত্র। দীর্ঘকাল তপস্যা করে চ্যবন । জরাগ্রস্ত হন ও বাল্মীকি স্তুপে পরিণত হন। একদিন রাজা শৰ্যাতি তাঁর ৪০০০ স্ত্রী ও সুন্দরী কন্যাকে নিয়ে সেখানে বিহার করতে আসেন । বাল্মীক স্তুপ মধ্যে চ্যাবনের খদ্যোৎবৎ দীপ্যমান দুই চক্ষু দেখে সুকন্যা কৌতুহলবশতঃ, কাঁটা দিয়ে তা বিদ্ধ করে। চ্যাবনের অভিসম্পাতে রাজার সৈন্যদের মলমূত্র ত্যাগ বন্ধ হয়ে যায়। শর্যাতি এর কারণ জানতে পেরে চ্যাবনের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করেন। চ্যবন বলেন, এই কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ দিলে তিনি তাঁকে ক্ষমা করতে পারেন । একদিন স্নানান্তে নগ্ন সুকন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাকে প্ৰাৰ্থনা করেন । সুকন্যা তার স্বামীর প্রতি অনুরক্ত বলে জানান । প্রীত হয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয় তখন চ্যবনকে তার পুর্নযৌবন দান করেন। সুকন্যার গর্ভে চ্যাবনের প্রমতি নামে এক পুত্র হয়।

।। পাঁচ ।।

ঋষি উতথ্যের ঔরসে ও মমতার গর্ভে ঋষি দীর্ঘতমার জন্ম হয় । মমতা যখন গর্ভবতী ছিল, তখন তার দেবর দেবগুরু বৃহস্পতি তার সঙ্গম প্রার্থনা করে। মমতা বলে– ‘তোমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হতেই আমার গর্ভ হয়েছে, তোমার বীর্য অমোঘ্য, সুতরাং এরূপ সঙ্গম থেকে বিরত হও ।’ গর্ভস্থ শিশু বৃহস্পতিকে রেতঃপাত করতে নিষেধ করে। কিন্তু বৃহস্পতি শিশু ও তার মার কথা না শুনে, মমতার অসম্মতিতে রেতঃপাত করেন । শিশু নিজের পা দিয়ে শুক্র প্রবেশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। এতে বৃহস্পতি ক্রুদ্ধ হয়ে গর্ভস্থ শিশুকে অভিসম্পাত করে–‘তুমি দীর্ঘতামসে প্রবিষ্ট হবে অর্থাৎ অন্ধ হবে ৷ উতথ্যের এই পুত্র অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করে ও এর নাম হয় দীর্ঘতমা । যত্রতত্র সঙ্গম করার জন্য অন্য মুনিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। দীর্ঘতমার স্ত্রী প্ৰদ্বেষীও স্বামীর আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে স্বামীকে ত্যাগ করে, ও তাকে ভেলায় করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় । অসুররাজ বলি স্নানের জন্য গঙ্গায় এসে ভাসমান দীর্ঘতমাকে তেজস্বী দেখে নিজ স্ত্রী সুদেষ্ণায় গর্ভে পুত্র উৎপাদনের জন্য তাকে নিজ গৃহে নিয়ে আসেন । সুদেষ্ণার গর্ভে দীর্ঘতমা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, ও সুহ্ম নামে পাঁচপুত্র উৎপাদন করেন ।

।। ছয় ।।

কশ্যপ একজন বিখ্যাত ঋষি । শ্ৰীমদভাগবত মতে মরীচি এর পিতা ও কলা এর মাতা । ইনি দক্ষ প্রজাপতির তেরোটি মেয়েকে বিবাহ করেন । এই কন্যারাই ত্ৰিজগতের সমস্ত লোকের জননী । কশ্যপের ছেলে বিভাণ্ডক মুনি । বিভাণ্ডক মুনি দীর্ঘকাল তপস্যায় শ্ৰান্ত হয়ে কোন হ্রদে স্নানরত ছিলেন । সেই সময় স্বর্গের অন্সর উর্বশীকে দেখে কামার্ত হয়ে জল মধ্যে রেতঃপাত করেন । এক তৃষিত হরিণী সেই রেতমিশ্রিত জল পান করাতে গৰ্ভিনী হয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে প্রসব করে। ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে রাজা দশরথের কন্যা শান্তার বিবাহ হয়।

।। সাত ।।

উদ্যালকও একজন বিখ্যাত ঋষি । এর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু । একদিন শ্বেতকেতু তাঁর পিতার নিকট বসেছিলেন । এমন সময় একজন ব্ৰাহ্মণ এসে তাঁদের সামনেই তাঁর মাতাকে যৌন আবেদন জানায় ও বলপূর্বক তার হাত ধরে নিয়ে যায় ও তার সঙ্গে রমণে প্ৰবৃত্ত হয়। এতে শ্বেতকেতু ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠায়, উদ্ধালক পুত্রকে বলেন- “হে পুত্র! ক্রুদ্ধ হয়ে না, এটাই সনাতন ধর্ম। গাভীদের ন্যায় স্ত্রীরাও অরক্ষিতা ।” শ্বেতকেতু এই বাক্য অস্বীকার করে, এবং স্ত্রী-পুরুষের দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে এই নিয়ম প্রবর্তন করেন যে, যে নারী নিজ পতি ভিন্ন অপর পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ করবে এবং যে পুরুষ পতিব্ৰতা স্ত্রীকে ত্যাগ করে অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হবে, তারা উভয়েই ভ্ৰাণহত্যার পাপে নিমগ্ন হবে ।

।। আট ।।

মহর্ষি চুলি একজন ঊর্ধ্বরেতা শুভাচারী ও দ্যুতিমান ঋষি ছিলেন । রামায়ণের আদিকাণ্ডে আমরা পড়ি যে মহর্ষি চুলি ভীষণ তপস্যায় রত ছিলেন । সোমদা নামে এক গন্ধৰ্ব কন্যা তার সেবা করত । সোমদার প্রার্থনা মত সেই মহাষি তার গর্ভে ব্ৰহ্মদত্ত নামে একজন বিখ্যাত ব্ৰহ্মতপঃ সমন্বিত পুত্র উৎপাদন করে। রাজা কুশীনাভ তার হাতে তাঁর শত কন্যাকে সম্প্রদান করেন । পবনদেব একবার কুশীনাভের এই একশত কন্যাকে ধর্ষণ করবার চেষ্টা করেছিলেন । মেয়েগুলি পবনদেবের এই অভিলাষ প্ৰত্যাখ্যান করলে, পবনদেব তাদের কুব্জা করে দেন । কিন্তু বিবাহের পর ব্ৰহ্মদত্ত ওই কন্যাদের স্পর্শ করা মাত্র, তারা বিকুব্জা, ও পরামশোভান্বিত হয়।

রামায়ণের আর এক কাহিনী অনুযায়ী মাণ্ডকনি ঋষি মাত্র বায়ু আহার করে দশ হাজার বছর ঘোর তপস্যা করে । তাতে অগ্নি প্ৰভৃতি দেবতারা ভীত হয়ে তার তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য পাঁচজন অপ্সরাকে পাঠিয়ে দেন। মাণ্ডকনি তাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে, তাদের স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ করে এক সরোবরের মধ্যে গুপ্ত গৃহ নিৰ্মাণ করে সুখে বাস করতে থাকে। রাম বনবাসকালে এই সরোবরের নিকট এসে জলশূন্য সরোবর থেকে সঙ্গীত ধ্বনি উঠছে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন ।

।। নয় ।।

কানা-খোড়া ঋষিরাও মেয়েছেলের প্রতি লালায়িত হতেন । চক্ষুহীন ও পদহীন পরাবৃদ্ধ ঋষি কতকগুলি মেয়েকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন, মেয়েগুলি ঋষিকে দেখেই পালিয়ে যায় । কন্যাগণকে পালাতে দেখে পরাবৃদ্ধ ঋষি সকলের প্রত্যক্ষে উঠে দাঁড়ালেন এবং পঙ্গুতা সত্বেও মেয়েগুলিকে ধরবার জন্য তাদের পিছনে ছুটলেন । ( ঋগ্বেদ ২।১৫।০ )।

।। দশ ।।

ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৭৯ সূক্তে অগস্ত্য ও তাঁর স্ত্রী লোপামুদ্রা সম্বন্ধে এক বিচিত্ৰ কাহিনী আছে। অগস্ত্য বহুকাল লোপামুদ্রার সঙ্গে যৌনসঙ্গম করে শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন । তিনি জরাগ্রস্ত । নিরত জপতপে নিযুক্ত থাকেন । কিন্তু সেই অবস্থায় তাঁর হঠাৎ স্ত্রীসম্ভোগ করবার ইচ্ছা হয়েছে। তিনি প্রার্থনা করছেন – ‘যদিও আমি জপ ও সংযমে নিযুক্ত, তথাপি ভোগপ্রাপ্তিসাধনের কারণেই হোক বা অন্য কারণেই হোক আমার প্রণয়ের উদ্রেক হয়েছে। লোপামুদ্রা সমর্থ পতিতে সঙ্গত হউন, অধীরা যোষিৎ, বীর ও মহাপ্ৰাণ পুরুষকে উপভোগ করুক ৷’ ( ঋগ্বেদ ১।১৭৯।৪ ) ।

।। এগার ।।

উপরে মুনি ঋষিদের যৌনজীবনের যে সব কাহিনী দেওয়া হয়েছে, তা থেকে যে সব সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতে পারে, সেগুলি এখানে সংক্ষেপে বলছি। বিবৃত কাহিনীসমূহ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, ব্ৰহ্মচর্য পালন পূৰ্বপুরুষদের মঙ্গল সাধন করে নি। একমাত্র বিবাহ দ্বারাই সে মঙ্গল সাধিত হয়। অনেক সময় মুনি-ঋষির ব্ৰহ্মচর্য পালন ও তপস্যার দ্বারা ঊর্ধ্বরেত হতেন । কিন্তু একাধিক কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি যে সুন্দরী রমণী দর্শনে তাদের রেতের আবার অধোগতি হত। বিবাহ যে মাত্র পুরুষদের পক্ষেই বাধ্যতামূলক ছিল, তা নয় ; মেয়েদের পক্ষেও । মহাভারতের এক কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি যে মহাতপা মুনির মেয়ে শুভ্ৰা, বহু বর্ষ তপস্যার পর যখন স্বর্গে যেতে চাইল, তখন নারদ তার সামনে এসে বলল যে, “অনুঢ়া কন্যা কখনও স্বর্গে যেতে পারে না।” তাই শুনে শুভ্রা গালব মুনির ছেলে প্রাকশৃঙ্গকে বিবাহ করেছিল। মাধবীর কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি যে একই কন্যার একাধিকবার বিবাহ হতে পারত । সধবা মেয়েরও দ্বিতীয়বার বিবাহ সম্ভবপর ছিল। এরূপ কন্যাকে পুনর্ভু বলা হত। ঐরাবত দুহিতার স্বামী যখন গরুড় কর্তৃক নিহত হয়েছিল তখন অৰ্জুন তাকে বিবাহ করে তার গর্ভে ইরাবন নামে এক সন্তান উৎপাদন করেছিল। আবার গৌতম ঋষি যখন জনৈক নাগরিকের গৃহে ভিক্ষার্থে এসেছিল, তখন তাকে ভিক্ষাস্বরূপ এক বিধবা শূদ্ৰাণীকে দান করা হয়েছিল । গৌতম তাকে বিবাহ করে তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে । সধবার পক্ষেও দ্বিতীয়বার বিবাহ প্ৰয়াসের দৃষ্টান্ত, নলের কোন সংবাদ না পেয়ে দময়ন্তীর দ্বিতীয়বার স্বয়ংবরা হবার চেষ্টা থেকে পাওয়া যায়। মাধবীর পর পর চার বার সন্তান প্রসবের পরও কুমারী থাকার প্রতিধ্বনি আমরা কুন্তীর যৌনজীবনেও পাই। বৃহস্পতির মমতার সঙ্গে সঙ্গম আমাদের দেবরণ প্ৰথাকে স্মরণ করিয়ে দেয় । অনুরূপভাবে দীর্ঘতমা কর্তৃক সুদেষ্ণার গর্ভে সন্তান উৎপাদন, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় প্রাচীনকালে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নিয়োগ প্রথা ।

।। বারো ।।

ঋষিপত্নীরা যে সব সময়ই পতিব্ৰতা হতেন, তা নয়। অহল্যার দৃষ্টান্ত থেকেই আমরা বুঝতে পারি। অহল্যা ইন্দ্ৰকে চিনতে পেরেও সে সময় কামার্তা ছিল বলে দুর্মতিবশতঃ ইন্দ্রের দ্বারা নিজের কামলালসা পরিতৃপ্ত করেছিল। অহল্যার অসতীপনা সম্বন্ধে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না । কেননা, বাল্মীকি লিখে গেছেন যে ইন্দ্ৰ অহল্যাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন “ঋতুকালং প্রতিক্ষ্যন্তে নাথিন সুসমাহিতে । সঙ্গমং ত্বহমিচ্ছামি ত্বয়া সহ সুমধ্যমে।” অহল্যা ইন্দ্ৰকে চিনতে পেরেও দুর্বুদ্ধিবশত ও রমণার্থে কৌতুহলী হয়ে যে ইন্দ্রের অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন, তা বুঝতে পারা যায় এই থেকে যে অহল্যা কৃতাৰ্থ ও পূৰ্ণমনোরথ হয়ে ইন্দ্রকে বলেছিল–“কৃতাৰ্থস্মি সুরশ্ৰেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্ৰমিতঃ প্রভো । আত্মানাঞ্চ মাঞ্চ দেবেশ সৰ্বথা রক্ষ গৌরাবৎ।।” সুতরাং অহল্যা যে সজ্ঞানে এবং সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় কামলালসা পরিতৃপ্ত করবার জন্য রমণাভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন এবং নিজে ‘কৃতার্থা ও পূর্ণমনোরথা হয়েছিলেন’ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। …………

মৈথুনের মল্লবীর

…পূর্বকালে বেদবিদগণের শ্ৰেষ্ঠ কণ্ডু নামে এক মুনি গোমতীতীরে পরম তপস্যায় রত ছিলেন। ইন্দ্ৰ কণ্ডুর চিত্তবিকার উৎপাদনের জন্য প্রম্লোচ্চা নামী এক সুন্দরী অপ্সরাকে পাঠিয়ে দেন। প্রম্লোচ্চা কণ্ডুর চিত্তবিকার ঘটায় ৷ কণ্ডু তার সঙ্গে মন্দার পর্বতের এক দ্রোণীতে ( দুটি শৈলের সন্ধিস্থলে ) বাস করে একশত বৎসর তার সঙ্গে সঙ্গমে রত হন । একশত বর্ষ উত্তীর্ণ হলে প্রম্লোচ্চা কণ্ডুকে বলে– ‘হে ব্ৰাহ্মনী! আমি স্বগে যাইতে ইচ্ছা করি। প্ৰসন্ন হইয়া অনুজ্ঞা দাও।’ কিন্তু কণ্ডু। তৎপ্ৰতি আসক্ত হয়ে বলেন- ‘ভদ্রে । আরও কিছু দিন থাক।’ কৃশাঙ্গী প্রম্লোচ্চা আবার তার সঙ্গে এক শত বৎসর সহবাস করল । একশত বৎসর পরে প্রম্লোচ্চা আবার কণ্ডুকে বলল– ‘হে ভগবান ! অনুজ্ঞা দাও, আমি স্বর্গে যাই।’ পুনশ্চ একশত বৎসর গত হইলে শুভাননা ওই অপ্সরা প্রণয়ের মৃদুহাস্যসহ মধুর বাক্যে বলল– ‘ব্রহ্মণ ! আমি স্বর্গে যাই।’ কিন্তু কণ্ডু তাকে আলিঙ্গন করে বলল– ‘সুভ্রু ! ক্ষণকাল থাক, চিরকালের নিমিত্ত যাইবে ।’ তখন তাঁর শাপের ভয়ে ভীত হয়ে অন্সরী আরও দুশো বছর ওই ঋষির কাছে রইল । তারপর বার বার স্বৰ্গে ফিরে যেতে চাহিলে মুনি কেবল তাকে ‘থাক’ ‘থাক’ বলতে লাগলেন। প্রম্লোচ্চা শাপভায়ে মুনিকে পরিত্যাগ করল না । “তয়া চ রমতস্তস্য মহর্ষেস্তদহর্নিশম । নবং নবমভূৎ প্ৰেম মন্মথাবিষ্টচিতসঃ।।” তার মানে মন্মথাবিষ্টচিত্ত মহর্ষি তার সঙ্গে অহৰ্নিশি ( দিবা রাত্ৰি ) রমন করতে থাকলে, নব নব প্রেমের উদ্রেক হতে লাগল। এইভাবে মুনি প্রম্লোচ্চার সঙ্গে ৯৮৭ বৎসর ছয়মাস তিন দিন আনন্দ উপভোগ করল । এজন্যই কণ্ডুকে মৈথুন দক্ষ বলা হয়। এই সংসর্গের ফলে কণ্ডুর ঔরসে ও প্রশ্নোচ্চার গর্ভে মারিষা নামে এক কন্যা হয়। বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী মারিষার গর্ভে প্রজাপতি দক্ষ জন্ম গ্রহণ করে ।

।। দুই ।।

যদিও পুরাণে একমাত্র কণ্ডুকেই ‘মৈথুন দক্ষ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল তা হলেও প্ৰাচীনকালে আরও অনেকেই এই অভীধার দাবী রাখতেন। আমরা আগেই দেখেছি যে অগস্ত্য মুনি যখন লোপামুদ্রাকে স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ করেছিলেন, তখন তিনি লোপামুদ্রাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন “প্রিয়ে! তোমার অভিলাষ আমাকে বল, তুমি আমার দ্বারা কতগুলি সন্তানের জননী হতে চাও, একটি, না একশত, না এক সহস্ৰ ?” আমরা আবার দেখছি পুরু যখন পিতা যযাতির জরা গ্ৰহণ করে পিতাকে যৌবন দিয়েছিল তখন যযাতি এক হাজার বৎসর ইন্দ্ৰীয় সম্ভোগের পর পুনরায় পুত্র পুরুকে তার যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছিল।

শ্ৰীকৃষ্ণের ষোল হাজার স্ত্রীর কথাও তো শুনেছেন ? তবে যা শুনেছেন, তার মধ্যে একটু ভুল আছে। সংখ্যাটা ষোল হাজার নয়। পুরাণ অনুযায়ী ষোল হাজার একশত। এ সম্মন্ধে লোকের আরও একটা ভুল বিশ্বাস আছে। লোকের ধারণা এরা সব গোপবালা ছিল। তা নয় । সকলেই নানাদেশ থেকে অপহৃত (abducted ) মেয়ে ছিল। (‘তাঃ কন্যা নরকেণাসন সর্বতে যা সমাহৃতাঃ”, বিষ্ণুপুরাণ ৫।৩১৷১৪ ) । পুরাণে লিখিত আছে যে একই সময়ে পৃথক পৃথক ভাবে গোবিন্দ সেই সকল কন্যার ধর্মানুসারে বিধি অনুযায়ী পাণিগ্রহণ করেছিলেন, যাতে সেই সকল কন্যাগণ প্ৰত্যেকে মনে করেছিল যে শ্ৰীকৃষ্ণ মাত্র তাকেই বিবাহ করলেন । তা ছাড়া, প্ৰতিরাত্রেই তিনি তাঁদের প্রত্যেকের ঘরে গমনপূর্বক বাস করতেন । ( “নিশাসু চ জগৎস্রষ্টা তাসাং গেহেষু কেশবঃ” )

।। তিন ।।

প্ৰাচীনকালের এ সকল ব্যক্তির কথা পড়লে মনে হবে যে তারা সব যৌন শক্তিধর বা Sexual athlete ছিলেন। মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল । কেননা মনু ও শতরূপা যখন ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল–“পিতঃ কোন কর্মের দ্বারা আমরা আপনার যথোচিত সেবা করব ?” ব্ৰহ্মা বলেছিলেন—“তোমরা মৈথুন কর্মদ্বারা প্ৰজা উৎপাদন কর। তাতেই আমার তুষ্টি।” পরবর্তীকালে এটাই “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা”–এই বচনে প্ৰকাশ পেয়েছিল। এটাই বায়োলজির পরম সত্য ।

হিন্দুদের কামশাস্ত্ৰ

যৌনমিলন নিয়ে অনুশীলন ভারতে অতি প্ৰাচীনকাল থেকে অনুসৃত হয়েছে। এরূপ অনুশীলনমূলক গ্রন্থগুলিকে কামশাস্ত্র বলা হত । রতিসম্ভোগের প্রয়োজনীয়তার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৭৯ সুক্তে ! তবে কামশাস্ত্ৰ সম্বন্ধে অনুশীলনেরও উল্লেখ পাওয়া যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৬।২৷১২-১৩ ; ৬।৪।২-২৮ )। সেখানে খোলাখুলিভাবে বলা হয়েছে যে রমণের সময় যদি নারীর কামোদ্রেক করাতে চাও, তা হলে যোনির ওষ্ঠপৃষ্ঠ জিহবা দ্বারা লেহন করবে । (৬।৪।৯) । পরবর্তীকালে বাৎসায়নের কামসূত্রই প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু বাৎসায়নের উক্তি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে বাৎসায়নের পূর্বে বহু আচাৰ্যই এ সম্বন্ধে অনুশীলন করেছিলেন। …

বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ই অবশ্য যৌনসম্ভোগ সম্পর্কিত শেষ গ্রন্থ নয়। তবে বাৎসায়নের কামসূত্রেই আছে শেষ কথা । কেননা, বাৎসায়নের পরে যাঁরা কামশাস্ত্ৰ সম্বন্ধে বই লিখেছিলেন, তাঁরা সবাই বাৎসায়নের ‘কামসূত্রে’র ওপরই নিজেদের রচনাসমূহ ভিত্তি করেছিলেন । যদিও বাৎসায়নের পরবর্তী লেখকগণ বাৎসায়নের উপরই নির্ভর করেছেন, তা হলেও তাঁরা মৈথুন-ভঙ্গীর (coital postures ) অনেক কাল্পনিক বিবরণ দিয়েছেন । গণনা করে দেখা গিয়েছে যে এ সকল ভঙ্গীর মোট সংখ্যা হচ্ছে ৭২৯ ।

কামশাস্ত্ৰ সম্বন্ধে পরবর্তীকালে যে অগণিত গ্ৰন্থ লেখা হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখের দাবী রাখে (১) খ্ৰীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষে বা নবম শতাব্দীর গোড়াতে কাশ্মীররাজ জয়াপীড়ের মন্ত্রী দামোদর গুপ্তের ‘কুট্টনীমত‘, (২) খ্ৰীষ্টীয় দশম বা একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধভিক্ষু পদ্মশ্ৰীজ্ঞান রচিত ‘নাগরসর্বস্ব‘, ( ৩) একাদশ শতাব্দীতে রচিত মহাকবি ক্ষেমেন্দ্রের বাৎসায়ন কামসূত্রের পদ্য অনুবাদ ও ‘সময়মাতৃকা’ নামে বেশ্যাদের সম্পর্কে একখানা বই, (৪) দ্বাদশ শতাব্দীতে কোক্কোক রচিত ‘রতিরহস্য’, এর অন্যূন চারখানা টীকা আছে, তার মধ্যে কাঞ্চীনাথের টীকাই প্ৰসিদ্ধ, (৫) চতুৰ্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মিথিলার জ্যোতিরীশ্বর কবিশেখর রচিত ‘পঞ্চ সায়ক’, (৬) পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে বা ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জৌনপুরের কল্যাণমল্লর ‘অনঙ্গরঙ্গ’, এখানা ফার্সী, উর্দু, ইংরাজী, ফরাসী ও জার্মান ভাষায় অনুদিত হয়েছে ; (৭) ষোড়শ শতাব্দীতে বিজয়নগরের রাজা ইম্মাদি প্ৰৌঢ়দেবরায়ের ‘রতিরত্নদীপিকা’, (৮) সপ্তদশ শতাব্দীতে বিকানীরের রাজা অনুপসিংহের সভাকবি ব্যাসজনার্দনের ‘কামাগ্রাবোধ’ । এ ছাড়া, এ সময় আরও রচিত হয়েছিল অনন্তের ‘কামসমূহ’, রুদ্রের ‘স্মরদীপিকা’ হরিহরের ‘শৃঙ্গারদীপিকা’ ও জনৈক জয়দেবের ‘রতিমঞ্জরী’ । অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাপণ্ডিত ভারতচন্দ্ৰ ‘রাসমঞ্জুরী’ নামে একখানা কামশাস্ত্ৰ বিষয়ক গ্ৰন্থ বাংলা পদ্যে রচনা করেন ।

বাৎসায়নের ‘কামসূত্ৰ’ নাগরিক সমাজের জন্য লিখিত হয়েছিল । নাগরিক সমাজের লোকেরা কিভাবে তাদের যৌনজীবনকে সুখময় করে তুলত তারই পরিচয় বইখানাতে পাওয়া যায়। যত রকম পদ্ধতিতে (coital postures ) মানুষ রতিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হতে পারে তার পরিচয় বাৎসায়নের বইয়ে আছে । বাৎসায়ন একটা বিশেষ রকম পদ্ধতিতে রমণের নাম দিয়েছেন ‘ইন্দ্ৰানিক রতি’ । সেখানে বলা হয়েছে যে ইন্দ্ৰানী শচী এই বিশেষ পদ্ধতিতে রতিক্রিয়া করতে ভালবাসতেন । সেজন্যই এর নাম ‘ইন্দ্রানিক রতি’ ।

হিন্দুমন্দিরে মিথুনমূর্তি

ভারতের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরগাত্রে কামকলার অনেক নিদর্শন আছে । বহু স্থানে ( যেমন ভুবনেশ্বরের রাজারাণী মন্দিরে) এমন অনেক দুঃসাহসিক ধরণের রমণমূর্তি আছে, যেগুলো দেখলে মনে হবে যে প্ৰাচীনকালের হিন্দুরা মৈথুনক্রিয়ার কৌশলে বিশেষ রকমের acrobats ছিলেন । মৈথুনক্রিয়ার এসকল পদ্ধতি বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’-এও বর্ণিত হয়েছে । সুতরাং এগুলো কামকলার যে অসম্ভব বা অবাস্তব পদ্ধতি তা নয় ।

মন্দিরগাত্রে এরূপ খোদিত কামকলার প্রদর্শনে রত নরনারীর মূর্তির কথা উঠলেই আমরা কোনারক, পুরী, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহো প্রভৃতি স্থানের মন্দিরের উল্লেখ করে থাকি । কিন্তু এই শ্রেণীর ভাস্কর্যের সংস্থান এত সঙ্কীর্ণ ভৌগলিক গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । এরকম মূর্তি মহারাষ্ট্রের ইলোরার শৈলমন্দিরে, মহীশূরের হলেবিদে অবস্থিত হরশৈলেশ্বরের মন্দিরে, পশ্চিম, মধ্য ও প্রাচ্য ভারতের বহু স্থানের মন্দিরে লক্ষ্য করা যায় । ১৯২৬ খ্ৰীষ্টাব্দে বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটের ওপর অবস্থিত এক নেপালী মন্দিরেও আমি এরূপ ভাস্কৰ্য লক্ষ্য করেছিলাম। বাঙলার মন্দিরের পোড়ামাটির অলংকরণেও এর নিদর্শনের প্রতুলতা কম নয়। এক হাওড়া জেলারই দশটা মন্দিরে মৈথুন অলংকরণ আছে। চব্বিশ পরগণারও অনেকগুলি মন্দিরে আছে। বস্তুতঃ বাঙলার মন্দিরে মিথন দৃশ্যের অলংকরণ অতি প্রাচীন । পাহাড়পুরে অবস্থিত পালযুগের মন্দিরসমূহের মিথবুনমূতিগুলি দেখলেই এটা বুঝতে পারা যায় ।

।। দুই ।।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে দেবতার মন্দিরে মিথন দৃশ্যের বিদ্যমানতার কারণ কি ? এটা বিংশশতাব্দীর শেষপাদের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আমরা বুঝতে পারব না। আপাতদৃষ্টিতে মূর্তি বা দৃশ্যগুলির মধ্যে আমরা অশ্লীলতারই গন্ধ পাব ; কিন্তু ঋগ্বেদ থেকে আরম্ভ করে। পরবর্তীকালের সাহিত্য পড়লে আমরা বুঝতে পারব যে হিন্দুর কাছে সৃষ্টিই ছিল সবচেয়ে বড় ধর্ম । যে কর্মের মাধ্যমে যে ধর্ম পালিত হত, মিথন মূর্তিগুলি তারই সজীব প্রতীক মাত্র। প্রজাপতি ব্ৰহ্মাই প্ৰথম প্রজা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অন্তরের মধ্যেই ছিল সৃজন শক্তির উৎস। সেজন্যই তিনি দ্বিধাগ্ৰস্থ হয়ে গিয়েছিলেন সেই সুপ্ত শক্তিকে সঙ্গিনী হিসাবে পাবার জন্য। এক কথায় পুরুষ প্ৰকৃতির সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিলেন। ইহজগতে নারী ও পুরুষের মিলন, সেই বৃহত্তম মিলনেরই প্রতীক। এই মিলনের মধ্যেই আছে সৃষ্টি, কামনার নিবৃত্তি ও সুখ দুঃখের বন্ধন থেকে মুক্তি । ( বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১।৪।৪-৮) ।

।। তিন ।।

যৌন মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকে সংরক্ষিত করবার জন্য আমরা ঋগ্বেদের ঋষিদের পরম ব্যাকুলতা লক্ষ্য করি। এই মিলনে যারা ব্যাঘাত ঘটায় তাদের বিনাশ সম্বন্ধে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৬২ সূক্তে বলা হয়েছে—“যে তোমার যোনি আক্রমণ করে, অগ্নি তাকে বিনাশ করুন। পুরুষের শুক্র সঞ্চারকালেই হোক অথবা গৰ্ভমধ্যে আন্দোলিত হবার কালেই হোক অথবা ভূমিষ্ঠ হবার সময় হোক, তোমার গর্ভকে যে নষ্ট করে বা নষ্ট করতে ইচ্ছা করে, তাকে আমরা এখান হতে দূরীভূত করলাম। গর্ভ নষ্ট করবার জন্য যে তোমার দুই উরু বিশ্লেষিত করে দেয়, অথবা যে ওই উদ্দেশ্যে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যস্থলে শয়ন করে অথবা যে যোনির মধ্যে বিপতিক পুরুষ শুক্ৰকে লেহন করে, তাকে এখান হতে দূরীভূত করলাম।” ( ঋগ্বেদ ১।১৬২৷১-৬ )।

।। চার ।।

খুব যুক্তিযুক্ত কারণে অনেকে অনুমান করেছেন যে মন্দির গাত্রের এই সকল মিথন মূর্তির সঙ্গে তান্ত্রিক ধর্মের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা প্রভাব ছিল। সকলেরই জানা আছে যে নারী সঙ্গমই তান্ত্রিক সাধনার ভিত্তি । বস্তুতঃ তন্ত্রগ্রন্থসমূহে বলা হয়েছে যে মৈথন ছাড়া কুলপূজা হয় না । তান্ত্রিক সাধনায় মৈথুন কামমাৰ্গ নয়, জ্ঞানমার্গ । তন্ত্ৰমতে নারীর দুই স্বরূপ কামিনী ও জননী–একই। গোড়াতে প্ৰকৃতি কামিনী, সৃষ্টিতে সম্ভোগার্থে তার সার্থকতা । তারপর যখন সৃষ্টি হয়ে গেল, সেই সৃষ্ট জীবের অসহায় ও দুর্বল অবস্থায় তার লালন পালন ও বৃদ্ধির জন্যই তো জননী ভাব ! তান্ত্রিক সাধনায় রাত্রিকালে সাধক ‘আমি শিব’” ( ‘ধ্যাত্বা শিবোহমত্তি’ ) এইরূপে ভাবতে ভাবতে নগ্ন অবস্থায় নগ্ন রমণী রমন করত ( ‘ততো নগ্নাং স্ক্রিয়াং নগ্নং রমণ ক্লেদ যুতোহপিাবা” ) রাত্রির তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত নিজ সাধন কার্যে লিপ্ত থাকে। কুলানির্বতন্ত্র অনুযায়ী এই সাধন প্রক্রিয়া কি, তা এখানে উদ্ধত মূল শ্লোক থেকে বুঝা যাবে।

‘আলিঙ্গনং চুম্বনঞ্চ চ স্তনয়োমর্দন স্তথা।
দর্শনং স্পৰ্শনং যোনিৰ্বিকাশে লিঙ্গঘর্ষণম্।’

( লেখকের ‘হিন্দুসভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষা’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৭১-৮৩ দেখুন ) ৷

।। পাঁচ ।।

পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে আমরা তান্ত্রিক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করি। এই মন্দিরের তান্ত্রিক শক্তি হচ্ছেন বিমলা । বিমলা অধিষ্ঠিতা আছেন মাটির তলায় এক মন্দিরে । জগন্নাথ মন্দিরের চত্বর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেখানে যেতে হয় । জগন্নাথের উপাসনা বৈষ্ণব তন্ত্রমতে হয় । আরাধনার সময় পঞ্চ-’ম’কারের বিকল্প হিসাবে মৎস্যের পরিবর্তে হিঙ্গুমিশ্ৰিত সবজী, মাংসের পরিবর্তে ‘আদাপচেদি’, মদ্যের পরিবর্তে কাংস্য-পাত্রে নারিকেলের জল, মুদ্রার পরিবর্তে ‘কান্তি’ (গোধূমচূর্ণ ও শর্করা মিশ্রিত দ্রব্য) ও মৈথুনের পরিবর্তে দেবদাসীর নৃত্য ও অপরিজাতা ফুল উৎসর্গ করা হয়। আসল আমিষ দ্রব্য পুরীর মন্দিরে কখনও প্রবেশ করানো হয় না। কিন্তু বৎসরে একদিন এর ব্যতিক্রম করা হয়। সেদিনটা হচ্ছে মহাষ্টমীর দিন। মাত্র মহাষ্টমীর দিন পুরীর মন্দিরে বিমলার ভোগ রন্ধনের জন্য মৎস্য ব্যবহার করা হয়। যাঁরা মহাষ্টমীর দিন বিমলার ভোগ খেয়েছেন, তঁরা জানেন এটা মাছের পোলাও বিশেষ ।

আমি আগের এক অধ্যায়ে প্রাচীন ভারতে সহোদরা বিবাহের উল্লেখ করেছি। পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহত্রয়ের সমাবেশ তারই ইঙ্গিত করে। এই সম্পর্কে আগে উদ্ধৃত কুলচূড়ামণি তন্ত্রের উক্তি স্মরণীয়। সেখানে বলা হয়েছে যে সাধনার সময় যদি অপর নারী পাওয়া না যায়, তা’হলে নিজের কন্যা, নিজের কনিষ্ঠা বা জ্যেষ্ঠ ভগিনী, মাতুলানী, বা বিমাতাকে নিয়ে কুলপূজা করবে।

।। ছয় ।।

পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে যে সব দুঃসাহসিক নারী-পুরুষ মৈথুনের মূর্তি আছে (মন্দিরের ভিতর ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না বলে ) সে সব মূর্তির ছবি এখনও ছাপা হয় নি। সে গুলো দেখলেই বুঝতে পারা যাবে যে এক সময় শ্ৰীক্ষেত্র তান্ত্রিক সাধনারই এক পীঠস্থান ছিল । তবে পুরীর মন্দিরের মৈথুন মূর্তিগুলি সম্বন্ধে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে। সত্তর বছর আগে ওই মূর্তিগুলি আমি যখন প্ৰথম দেখি, তখন ওগুলো নানা রঙে রঞ্জিত ছিল । আজ আর ওগুলোর সে রূপ নেই। শালীনতা রক্ষার খাতিরে ওগুলোকে কলিচুন দিয়ে আবৃত করা হয়েছে ।

ভুবনেশ্বরে এক সময় ৭০০ মন্দির ছিল। সত্তর বছর আগেও আমি তিন-চারশ মন্দির দেখেছি। এখানেও মৈথুন মূর্তির ছড়াছড়ি । তবে রাজা রানী মন্দিরের মৈথুন মূতিগুলি হচ্ছে সবচেয়ে দুঃসাহসিক ধরণের ।

কোনারক পরিত্যক্ত মন্দির । এখানে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ নয়। সেজন্যই আমরা কোনারকের রমনমূর্তিগুলির সহিত বেশী পরিচিত। অনুরূপভাবে আমরা পরিচিত খাজুরাহোর মন্দিরের রমণ বিলাস মূর্তিগুলির সঙ্গে । এখানেও বহু দুঃসাহসিক ধরনের রমন মূৰ্তি আছে। খাজুরাহোতেও এক সময় অগণিত মন্দির ছিল। তাদের মধ্যে এখনও গোটা পঁচিশ বিদ্যমান । নাগর রীতিতে গঠিত মন্দিরের এখানেই চরম পরাকাষ্ঠা প্ৰদৰ্শিত হয়েছিল। মূল দেবতার মন্দিরকে অবলম্বন করে এখানে ৬৪ যোগিনীর মন্দিরও রচিত হয়েছিল । এ থেকেই এগুলির তান্ত্রিক উৎপত্তি প্ৰকাশ পায় ।……

পৌরানিক উপাখ্যান

পুরাণসমূহের পঞ্চলক্ষ্মণের মধ্যে এক লক্ষণ হচ্ছে সর্গ । সৰ্গ মানে সৃষ্টি । সব পুরাণেই সৃষ্টি প্রকরণ বর্ণিত হয়েছে। এই বর্ণনা অনুযায়ী ব্ৰহ্মা প্ৰথমে সনৎকুমার, সনন্দ, সনক, সনাতন ও বিভু, এই পাঁচ ঋষিগণকে সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁরা ঊর্ধ্বরেতা থাকায় প্ৰজাসৃষ্টি হল না। তখন ব্ৰহ্মা নিজেকে দুইভাগে বিভক্ত করেন। তাঁর এক অংশ পুরুষ ও অপর অংশ স্ত্রী হল। তিনি পুরুষের নাম দিলেন মনু, আর স্ত্রীর নাম দিলেন শতরূপা । তারা পরস্পর বিবাহিত হয়ে ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করল–‘পিতঃ কোন কর্মের দ্বারা আমরা আপনার যথোচিত সেবা করব ?’ ব্ৰহ্মা বললেন–‘তোমরা মৈথন কর্মদ্বারা প্ৰজা উৎপাদন কর । তাতেই আমার তুষ্টি।’ তখন থেকে মৈথন কর্মের প্রবর্তন হল ।
……….

।। তিন ।।

দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে আছে । বৈদিক সাহিত্যে আরও আছে পুরূরবা ও উর্বশীর কথা । শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী একবার চন্দ্ৰ বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করে নিয়ে যায়। তারার গর্ভে চন্দ্রের এক পুত্র হয়। এই পুত্রের নাম বুধ । বুধের সঙ্গে ইলার বিবাহ হয়। ইলার গর্ভে বুধের পুরূরবা নামে এক পুত্র হয়। একবার ইন্দ্ৰসভায় রাজা পুন্ধর বা আহুত হন। সেখানে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে উৰ্বশী নাচতে নাচতে তার দিকে তাকায় । এতে উর্বশীর তালভঙ্গ হয় । ফলে, ইন্দ্রের শাপে উৰ্বশীকে মর্ত্যে এসে বাস করতে হয় । মর্ত্যে কয়েকটি শর্তে উৰ্বশীর সঙ্গে পুরূরবার মিলন হয়। শর্তগুলি হচ্ছে(১) উর্বশীর সামনে পুরস্কারবা কোনদিন বিবস্ত্র হবেন না, (২) পুরূরবা দিনে তিনবার উর্বশীকে আলিঙ্গন করতে পারবেন। কিন্তু তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গম করতে পারবেন না, ও (৩) উৰ্বশী বিছানায় দুটি মেষ নিয়ে শয়ন করবে এবং কেউ ওই মেষ হরণ করতে পারবে না । এইভাবে উর্বশী ও পুরূরবা বহুবৎসর পরম সুখে বসবাস করে। এদিকে স্বগের গন্ধৰ্বোরা উর্বশীকে স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় । একদিন বিশ্ববসু নামে এক গন্ধৰ্ব উর্বশীর মেষ দুটি হরণ করে । উৰ্বশী কেঁদে উঠলে, পুরূরবা বিবস্ত্র অবস্থাতেই মেষ দুটি উদ্ধারের জন্য বিশ্ববসুর পিছনে ছুটে যান। সেই সময় আকস্মিক বজ্রপাতের বিদ্যুতালোকে উর্বশী পুরূরিবাকে বিবস্ত্র দেখে তাকে ত্যাগ করে চলে যান । পুরূরবা উর্বশীর সন্ধানে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ান। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে চারজন অপসারীর সঙ্গে উর্বশীকে স্নানরতা দেখে, তাকে ফিরে যাবার জন্য কান্নাকাটি করেন । অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর উর্বশী এক শর্তে রাজী হন । প্ৰতি বৎসর মাত্র একদিন এসে তিনি পুরূরবার সঙ্গে মিলিত হবেন, এবং তাতেই তঁদের পুত্রসন্তান হবে। এইভাবে মিলিত হয়ে তাঁদের পাঁচটি সন্তান হয়। তারপর উর্বশী পুরূরবাকে জানান যে স্বগের গন্ধৰ্বরা তাকে যে কোন বর দিতে প্ৰস্তুত । পুরূরবা উর্বশীর সঙ্গে চিরজীবন যাপন করতে চান । গন্ধর্বরা পুন্ধরবাকে গন্ধৰ্বলোকে স্থান দেয়। এইভাবে পুন্ধর বা উর্বশীর চিরসঙ্গী হয়ে থাকেন।

।। চার ৷।

এবার আর এক বৈদিক কাহিনী বলব । সত্যকাম ও জবালার কাহিনী। এই কাহিনী ছন্দোগ্য উপনিষদের চতুর্থ প্ৰপাঠকে আছে। একদিন সত্যকাম বিদ্যার্থী হয়ে গৌতম ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হয় । গৌতম তার পিতার নাম ও গোত্র জানতে চান । সত্যকাম বলে— ‘আমি জানি না, তবে মার কাছ থেকে জেনে আসি ।’ মা জবালা যৌবনে বহুচারিণী ছিলেন। সেই সময় তাঁর গভে সত্যকামের জন্ম হয় । সেজন্য তিনিও সত্যকামের পিতার নাম জানেন না । সত্যকাম মার কাছে এসে প্রশ্ন করলে, মা বলেন–‘তোমার পিতার নাম আমি জানি না । তুমি মহৰ্ষিকে বল, আমি জবালার পুত্র।’ সত্যকাম ফিরে এসে গৌতমকে সেই কথা বলে। তার সত্যবাদিতায় সন্তুষ্ট হয়ে গৌতম তাকে শিষ্যরূপে গ্ৰহণ করে। গৌতম বলেন– ‘ব্রাহ্মণ, তুমি সত্য হতে ভ্ৰষ্ট হও নি। ব্ৰাহ্মণ ভিন্ন কারুর পক্ষে এরূপ সত্যাচারণ কখনও সম্ভব নয় ।’

।। পাঁচ ।।

শ্বেতকেতুর কাহিনী আছে মহাভারতের আদিপর্বে । একদিন শ্বেতকেতু পিতা উদ্দালকের কাছে বসে থাকার সময় একজন ব্ৰাহ্মণ এসে তার মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে যৌনমিলনে প্ৰবৃত্ত হয় । এই দেখে শ্বেতকেতু ক্রুদ্ধ হয় । কিন্তু উদালক তাকে ক্ৰোধ নিবারণ করতে বলেন,–এই বলে ‘স্ত্রীলোকেরা গাভীদের মত স্বাধীন। সহস্ৰ পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না। ইহাই সনাতন ধর্ম।’ সেই থেকে শ্বেতকেতু মনুষ্য সমাজে বিবাহ প্রথার প্রচলন করে এবং বলে যে, স্ত্রী স্বামী ভিন্ন অপর পুরুষে উপগত হবে, সে মহাপাপে লিপ্ত হবে ।…..

……

।। নয় ।।

নহুষের ছেলে যযাতির দুই বিয়ে। এক স্ত্রী দেবযানী দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে, আর অপর স্ত্রী শৰ্মিষ্ঠা দৈত্যরাজ বৃষপর্বার মেয়ে । তার মানে ক্ষত্রিয় হয়ে, যযাতি বামুনের মেয়েকেও বিয়ে করেছিল, আবার দৈত্যের মেয়েকেও বিয়ে করেছিল। তবে শুক্রাচাৰ্য যখন দেবযানীর সঙ্গে যযাতির বিয়ে দিয়েছিল, তখন শর্ত করিয়ে নিয়েছিল যে যযাতি শৰ্মিষ্ঠার সঙ্গে সহবাস করতে পারবে না । কিন্তু ঋতুকাল উপস্থিত হলে, শৰ্মিষ্ঠার অনুনয়-বিনয়ে ও দেবযানীর অজ্ঞাতে যযাতি শৰ্মিষ্ঠার গর্ভে এক পুত্র উৎপাদন করেন । দেবযানী পিতা শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে স্বামী ও শমিষ্ঠার বিরুদ্ধে নালিশ করে। শুক্রাচার্য যযাতিকে দুৰ্জয় জরাগ্রস্ত হবার অভিশাপ দেন। তবে যযাতির অনুনয়ে বলেন যে যযাতি অন্যের দেহে নিজের জরা সংক্রামিত করতে পারবে । যযাতি পুত্রদের তার জরা গ্ৰহণ করতে বলেন। দেবযানীর গর্ভজাত দুইপুত্র ও শমিষ্ঠার গর্ভজাত প্ৰথম দুইপুত্র জরা গ্রহণে অস্বীকার করে। মাত্র শৰ্মিষ্ঠার কনিষ্ঠ পুত্র পুরু জরা গ্রহণ করে পিতাকে তার যৌবন দেয়। এক হাজার বৎসর ইন্দ্ৰিয় সম্ভোগের পর যযাতি পুরুকে আবার তার যৌবন ফিরিয়ে দেয় । তারপর কঠোর তপস্যা করে যযাতি স্বর্গ লাভ করে, কিন্তু নিজেকে অতি ধাৰ্মিক মনে করায়, ইন্দ্ৰ তাঁকে স্বর্গভ্ৰষ্ট করে অন্তরীক্ষে ফেলে দেন। যযাতির দৌহিত্ররা মাতামহের এই অবস্থা দেখে তঁদের পুণ্যবলে তাঁকে আবার স্বর্গে পাঠিয়ে দেয়।

যযাতির যে দৌহিত্রদের কথা বললাম, তারা হচ্ছে যযাতির মেয়ে মাধবীর পুত্ৰগণ । মাধবীর উপাখ্যান মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে আছে। একবার বিশ্বামিত্রের শিষ্য গালব বিশ্বামিত্ৰকে গুরুদক্ষিণা দিতে চাইলে বিশ্বামিত্র বলেন, তিনি চাঁদের মত শুভ্ৰ এক কন্যা ও আটশত অশ্ব গুরুদক্ষিণা চান । গালব বিপদে পড়ে, রাজা যযাতির কাছে যায় । যযাতি তাঁর মেয়ে মাধবীকে গালবের হাতে দিয়ে বলেন যে অন্যান্য রাজারা এই মেয়ের শুদ্ধস্বরূপ গালবকে আটশত অশ্বদান করবেন । গালব মাধবীকে নিয়ে প্ৰথমে অযোধ্যার রাজা হর্যশ্বের কাছে যান । হর্যশ্ব মাধবীর গর্ভে বংশুমনা নামে এক পুত্র উৎপাদন করে গালবকে দুইশত অশ্ব দেন । এক ব্ৰহ্মজ্ঞ মুনির বরে মাধবীর কুমারীত্ব বজায় থাকে । তারপর গালব যথাক্রমে মাধবীকে কাশীরাজ দিবোদাস ও ভোজরাজ উশীনরের কাছে নিয়ে যায়। তাঁরা মাধবীর গর্ভে যথাক্রমে প্ৰতিদান ও শিবি-কে উৎপাদন করেন ও গালবকে প্ৰত্যেকে দুইশত অশ্ব দেন। পরে আর অশ্ব পাওয়া না যাওয়ায় গালব বিশ্বামিত্ৰকে ছয়শত অশ্ব ও মাধবীকে দান করেন। বিশ্বামিত্রের ঔরসে মাধবীর অষ্টক নামে এক পুত্র হয়। বিশ্বামিত্র তাকেই ধর্ম, অর্থ ও অশ্বগুলি দান করে মাধবীকে গালবের হাতে দিয়ে বনে গমন করেন । গালব মাধবীকে যযাতির হাতে ফিরিয়ে দেন। পরে যযাতি মাধবীর বিবাহের জন্য এক স্বয়ংবরা সভার আয়োজন করেন । কিন্তু মাধবী সকল রাজকে প্রত্যাখ্যান করে বনে গিয়ে ধর্মপালনে রত হয় ।
………..

।। চোদ্দ ।।

শিবের বীর্যতেজের কথা রামায়ণের আদিকাণ্ডের ৩৫-৩৭ সর্গে বিবৃত হয়েছে। সেই কাহিনী অনুযায়ী হিমবান পত্নী মেনকার গর্ভে দুই কন্যা রত্ন লাভ করেন। — (১) গঙ্গ ও (২) উমা। দেবগণের অনুরোধে গঙ্গাকে তিনি দেবগণকে প্রদান করেন। তাঁরা গঙ্গাকে নিয়ে প্রস্থান করেন, তারপর হিমবান কনিষ্ঠা কন্যা তপস্বিনী উমাকে রুদ্রহস্তে সমর্পণ করেন। মহাদেব বিবাহান্তে উমার সহিত রতিক্রিয়া করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু রতিক্রিয়া করতে করতে দেবপরিমিত শতবর্ষ বিগত হলেও সেই দেবীতে কোন পুত্রোৎপাদন হল না (অর্থাৎ শুক্রক্ষরণ হল না)। তখন তখন পিতামহ দেবগণসহ ‘এই বীর্যে যে পুত্রোৎপাদন হবে, তা কে ধারণ করবে ?’ এরূপ বিচার করে মহাদেবের নিকট গমন করে প্রণিপাতপূর্বক বললেন, ‘দেবাদিদেব ! আপনি আমাদের প্ৰতি প্ৰসন্ন হউন ! এই সকল লোক আপনার তেজধারণে সমর্থ নয় ; আপনি ব্ৰাহ্মতপোযুক্ত হয়ে দেবীর সহিত তপস্যা করে ত্ৰৈলোক্যের মঙ্গলের জন্য তেজধারণ করুন এবং সমস্ত লোক রক্ষা করুন ।’ তখন মহাদেব বললেন, ‘সুরগণ ! আমি উমার সহিত স্বীয় তেজেই তেজধারণ করব, তোমরা ও পৃথিবী সকলেই শান্তিলাভ কর। কিন্তু আমার যে অনুত্তম তেজ স্বস্থান হতে বিচলিত হয়েছে তা কে ধারণ করবে, তা নির্দেশ কর ।’ তখণ দেবতারা বললেন, ‘আপনার যে তেজ ক্ষুব্ধ হয়েছে, পৃথিবী তা ধারণ করবে।’ তারপর মহাদেব বীৰ্যত্যাগ করলেন, এবং সেই বীর্যের তেজে পৃথিবী, কানন ও গিরি পরিব্যাপ্ত হল । তখন দেবগণের অনুরোধে অগ্নিদেব পবনদেবের সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই রুদ্র-তেজে প্ৰবেশ করলেন, এবং সেই তেজ অগ্নি কর্তৃক ব্যাপ্ত হয়ে পৰ্বত রূপে পরিণত হ’ল । সেই পর্বতে এক শরবন সৃষ্ট হল । সেই শরবনে কার্তিকের জন্ম হল ।

।। পনেরো ।।

মনে হয়, মহিষমৰ্দিনীর উপাখ্যানের সঙ্গে পাঠকরা পরিচিত । রম্ভ নামে এক দুর্দান্ত অসুর মহাদেবকে তপস্যায় প্রীত করে, মহাদেবের বরে এক ত্ৰিলোক বিজয়ী পুত্ৰ পায় । সেই পুত্ৰই মহিষাসুর। ব্ৰহ্মার বরে সে পুরুষের অবধ্য হয় । মহিষাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়। অবধ্য জেনে বিষ্ণু দেবতাদের নিজ নিজ স্ত্রীর সহিত মিলিত হয়ে, সম্মিলিত তেজ থেকে এক অপূর্ব লাবন্যময়ী নারীদেবতা সৃষ্টি করতে বলেন । তাঁরই হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু ঘটবে। মহিষাসুরের তিনবার আবির্ভাব ঘটেছিল এবং তিনবারই দেবী ত্ৰিবিধিরূপ ধারণ করে তাকে বধ করেন। প্ৰথমবার দেবী উপচণ্ডী, দ্বিতীয়বারে ভদ্রকালী ও তৃতীয়বারে দূর্গারূপ ধারণ করেন । এ সম্বন্ধে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন বিবরণ আছে।
…….

এই সকল পৌরানিক উপাখ্যানের নৃতাত্ত্বিক ভাষ্যের প্রয়োজন আছে । তবে তা গবেষণা সাপেক্ষ ।

Leave a Reply