পালটা-পালটি – এডমন্ড উইকহ্যাস-এর “জাস্ট এ ক্রিসক্রস” অবলম্বনে

›› অনুবাদ  ›› সম্পুর্ণ গল্প  

অনুবাদঃ সুধীন্দ্রনাথ রাহা

“আজও সেই বার্টির সঙ্গেই নাকি ?”—মায়ের মুখখানা খুবই ব্যাজার দেখাল প্রশ্ন করার সময়।
প্রশ্ন বড় একটা করেন না মিসেস ক্যাবট। দেশাচারও নয় সোমত্ত মেয়েদের ওরকম প্রশ্ন করা, তাছাড়া অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো ক্যাবটগিন্নীর স্বভাববিরদ্ধেও বটে। পেটের মেয়েকেও ‘অন্য’ বলে ভাবতে হয়, দেহে মনে জোয়ার আসে তার যখন।
এঞ্জেলা একগাল হেসে জবাব দিল—“না গো না, ভেবে দেখেছি কথাটা তুমি মন্দ বল নি। বার্টির নিজের যখন পয়সা নেই, আর চাকরিটাও তার আহা-মরি-গোছের নয় যখন, ওকে আস্কারা না দেওয়াই ভাল । বাপের দয়ার ভরসাতেই সে ঝুলে পড়তে চায় অবশ্য, কিন্তু বাপ ত অথর্ব নয় তার, কাল যদি সে নিজে একটা বিয়ে করে বসে আবার ?”
“ঠিক!”—মাথাটা দুলিয়ে মিসেস ক্যাবট বললেন– “ঠি-ই-ক! বার্টির বাবা মানুষ সে-রকম নয়, যতদূর জানি, কিন্তু কিছুই বলা যায় না মা, ব্যাটাছেলেদের মনে কী আছে, আগে কেউ কিছ আঁচ করতে পারে না। পচাত্তর বছরের বড়ো নিজের রাঁধনীকে বিয়ে করে বসল, চাক্ষুষ দেখেছি আমি। কিন্তু সেকথা থাকুক, আজকের ডেট তাহলে কার সঙ্গে? আমাদের জানা কেউ ? ”
“ব-ল-বো না-আ”—কোকিলকন্ঠে জবাবটি মায়ের কানে উপহার পাঠিয়ে দিয়ে অষ্টাদশী এঞ্জেলা ঘুরপাক খেলো একটা ঘরের মধ্যে, যেন এ্যাথেনিয়ামের মঞ্চে এক হাত নাচের কসরত দেখিয়ে দিল মার্লেন ডায়েট্রিচ। তারপর সে বেরিয়ে গেল, প্রায় নাচতে নাচতেই, মিসেস ক্যাবট মুগ্ধ- নয়নে তাকিয়ে রইলেন তার ‘সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতা’-র মত তন বল্লীর পানে। উনি ভালবাসেন খুবই মেয়েটিকে। খু-উ-ব !
না-বাসবার ত কথাও নয়। ঐ এঞ্জেলাই তাঁর একমাত্র সন্তান। ওর যখন কুল্যে দুই বছর বয়স, তখন মিস্টার ক্যাবট দেহরক্ষা করলেন, নবযৌবনা পত্নীর হাত-পা একখানা অত্যন্ত বেয়াড়া উইলের বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ রেখে। উইলের মর্মটা এই, এঞ্জেলার বিয়ের আগে যদি কর্নেলিয়া অর্থাৎ এঞ্জেলার মা দ্বিতীয় পতি গ্রহণ করেন, তাহলে প্রথম পতির বিত্তসম্পত্তি থেকে এক কপদকও তিনি পাবেন না। কাজেই—যাকে ছেড়ে যাবার উপায় নেই, তাকে— ভালবাসতে পারলে ভাল কথাই। না-ও যদি পারা
যায় কোন কারণে, ভালবাসার ভান অন্ততঃ করতে হবে সে-ক্ষেত্রে। তাতে শান্তি থাকে অন্তরে না-থাকুক, সংসারে অন্ততঃ থাকেই।
ও মশাই পাঠক, ও মহাশয়া পাঠিকা, আপনারা বুঝি এইটুকু পড়েই সিদ্ধান্ত করে বসলেন যে কর্নেলিয়া ক্যাবট সম্পর্কে আমরা একটা নিষ্ঠার ইঙ্গিত করতে চাইছি? প্রকারান্তরে বলতে চাইছি যে মেয়ে এঞ্জেলার উপরে স্নেহ- মমতা কমই আছে তার মা-জননীর? উহঃ উহঃ হলফ নিয়ে বলতে পারি যে সে-কথা বলা মোটেই উদ্দেশ্য নয় আমাদের। কেমন করে থাকবে উদ্দেশ্য? যে-কথা জানি না, তা নিয়ে কেন কথা কইতে যাব? স্প্রিয়াশ্চরিত্রং জানেন ত! দেবতারা জানেন না, তা মানুষ কোন ছার! কর্নেলিয়া মেয়েকে ভালবাসেন কিনা, বাসলেও কতখানি বাসেন, তা সাফ বলে দিচ্ছি, আমরা ত জানিই না, ভগবান ছাড়া জানে না অন্য কেউই ৷ গল্পটা শুনেন, দেখুন ঘটনা কী দাঁড়ায় ৷ শোনেন যদি, দেখেন যদি, শেষ পর্যন্ত নিজেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারবেন, এই তুচ্ছ লেখকের মুখে ঝাল খেতে হবে না আপনাকে। তাহলে শুনেন এইবার।
এঞ্জেলা ত নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল। কর্নেলিয়া খানিকক্ষণ উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলেন তার গমনপথের দিকে, তারপর—সময় কাটে না বলেই পড়তে বসলেন।
অন্য কিছু নয়। উপন্যাস নয়, মাসিক পত্রিকার সম্ভোগ বর্ণনা বিগলিত ছোট গল্প নয়, এমন-কি সিনেমা- প্রিন্সদের গোপন জীবনকথাও না, পড়তে বসলেন সেই অলপেয়ে অলক্ষণে স্বামীটার বহু, পুরাতন বহুবার পঠিত উইলখানাই। এটা অবশ্য আসল উইল নয়, সে-বস্তু রয়েছে এ্যাটর্নি-অফিসে। এখানি হল তারই নকল। বিধবা হওয়ার পর থেকেই সযত্নে এটি নিজের কাছে রক্ষা করেছেন কর্নেলিয়া, লোহার আলমারির এক গোপন খা পরিতে । মাঝে মাঝেই এটা বার করেন, আর মনোযোগ দিয়ে পড়েন। “এঞ্জেলার বিয়ের আগে যদি কর্নেলিয়া দ্বিতীয় পতি গ্রহণ করেন—”
না, তা করেন নি। ষোল বছর। কম সময় নয় । অসহ্য যৌবনজ্বালা ঠোঁট কামড়ে ধরে সহ্য করেছেন কর্নেলিয়া। চিন্তাই করতে দেন নি অন্তরাত্মাকে। ও-চিন্তা বড় সর্বনাশা চিন্তা। বিয়ের কথা মনের বল ধসে পড়ে ও-চিন্তাতে। নীচে জল চোয়াতে থাকলে বালির দেয়াল ধসে যায় যেমন। নিজেকে যদি সংযত রাখতে হয়, ও-চিন্তাকে একদম আমল দেওয়া নয়। দিয়েছ কি মরেছ। জ্ঞানদদ্ধি উবে যাবে, দ্বিতীয় পতির অধরসুধাকে মনে হবে প্রথম পতির ত্যক্ত ঐশ্বর্যের চেয়ে অনেক বেশী লোভনীয় এবং প্রয়োজনীয়, তার ফলে বরাতে ঘটবে সচ্ছল৷ জীবনের স্বর্গ থেকে বিদায়, কোন নধরকান্তি কেরানীর তেঠ্যাঙ্গা খাটিয়ার অর্ধাংশে আশ্রয়লাভ। মরণ!
নধরকান্তি কেরানী ! ঠিক ঐ বার্টি মেলরোজটি যেমন !
এঞ্জেলার পাণিপ্রার্থী ঐ ছোকরা বার্টি। বছর বাইশ তেইশ বয়স হবে লম্বা চওড়া পালোয়ানী চেহারা, বাটার ফ্লাই হলদেপানা গোঁফের নীচে লালচেপানা পুরুষ্ট ঠোঁট-
উঃ, এঞ্জেলা মেয়েটার মনটা খুব কঠিন, সন্দেহ নেই ৷ ঐ লালচে-পুরু ঠোঁটের নিবিড় চুম্বন দু-চার ডজন উপভোগ করার পরেও (অবিশ্যি করেছে) সে যখন বাটিকে বিসর্জন দিয়ে অন্য পুরুষকে ডেট দিতে পেরেছে, তখন ওর অসাধ্য কাজ নেই ।
না, এঞ্জেলার জন্যে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই তার মায়ের। সে-মা এখন নিজের চরকায় তেল দেবার চিন্তা অনায়াসে করতে পারে।
চরকা মানে ভবিষ্যৎ। বৈধব্যের দীর্ঘ ষোলটা বছর। উঃ, কী মর্মান্তিক বঞ্চনাই ঘটে গেল, অভাগিনী কর্নেলিয়ার ভাগ্যে! পাছে কোন বেপরোয়া ফন্দিবাজের ছলাকলায় বিভ্রান্ত হয়ে নিজের পায়ে কুড়োল মেরে বসেন নিজের হাতে, উইলকে বড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বরমালাই দিয়ে বসেন কোন চালচুলোহীন নধরকান্তি যুবাকে—এই ভয়ে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে একান্ত নিরামিষ জীবনই যাপন করেছেন কর্নেলিয়া । বার্টি-ফার্টি নধরকান্তিদের ত্রিসীমাও মাড়ান নি কখনও। সাবধানের মার নেই ৷ মনে রাখতে হবে—প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে । অসাবধানে তোমার পা যদি পড়ে গেল সে-ফাঁদে, কোথা রইল কুল মান অন্নের চিন্তা, সেই ফাঁদকেই বাসরশয়ন বলে পরমানন্দে গ্রহণ করলে তুমি। না, ওরকম বোকামী কর্নেলিয়া করেন নি।
ভরাট যৌবনের দংশনে ক্ষতবিক্ষত ষোলটা বছরে একদিনের তরেও না।
কিন্তু আজ ? এঞ্জেলা ধর দুই চার মাসের মধ্যেই ঝুলে পড়ছে নির্ঘাৎ। তাহলে? তার পরে ?
কর্নেলিয়ার বয়স এখন ছত্রিশ। এঞ্জেলা ছাড়া আর কোন সন্তান হয় নি, কাজেই দেহের বাঁধনী শক্ত, অটুট। প্রথম বয়সের সে-জালা ধরানো বিদদ্যুৎ আর চোখের কোণে চমকায় না এখন, কিন্তু তার আকর্ষণ এখনও আছে বই কি! পুরুষের মনকে টেনে আনার, বেধে রাখার মত মোহিনী শক্তি এখনও আছে বই কি এই পেলব কপোলে, স্ফারিত অধরে, পীনবক্ষের অনতি-প্রকট উদ্ধত ভঙ্গিমায়, ভুজবল্লীর সাবলীল আন্দোলনে !
একটা নধর মৃগশাবক, বয়স এই বছর ত্রিশের বেশী না হয়, নীচে পচিশ পর্যন্তও চলতে পারে, উচ্ছল, চঞ্চল, দূরন্ত, দুর্নিবার, লম্বা চওড়া পালোয়ানী ঢংয়ের যুবা পুরুষ, পয়সা কড়ি থাকলে ভাল, না থাকলেও কুছ পরোয়া নেই, এখন ত কর্নেলিয়ারই হাতে যথেষ্ট অর্থ এসে যাচ্ছে, মৃত স্বামীর উইলের দরুন-
হ্যাঁ, দ্বিতীয় পতিটি বার্টির মত কেরানীমাত্র হলেও দোষ নেই, যদি বার্টিরই ধাঁচের সে হয় আকারে প্রকারে আচারে আচরণে।
কী মশাই পাঠক? কী মহাশয়া পাঠিকা ? সন্দেহ জাগছে মনে? বাটিকে ঘেষ না-দেওয়া সম্পর্কে একটু আগেকার সেই পরামর্শ কন্যা এঞ্জেলাকে, সেটাকে নিছক নিঃস্বার্থ বলে আর বিবেচনা করতে পারছেন না ? সে আপনারা যা-ই করুন বিবেচনা, লেখকের তা নিয়ে কোন মন্তব্য করার নেই, সে শুধু বর্ণনা করে খালাস, ঘটনা দেখে যে যা বুঝবার, বুঝে নিন।
অনেক কিছু, ভেবে নিলেন মিসেস কর্নেলিয়া, কন্যা এঞ্জেলা নৃত্যভঙ্গিমায় অভিসারে বেরবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। আরও কতক্ষণ কী সব ভাবতেন, আন্দাজ করার কোন উপায় নেই। ভাবনাতেই ছেদ পড়ে গেল অকস্মাৎ, খটখটে আওয়াজ হল দরোজায়। দুটো দাসীর একটাও বাড়িতে নেই, একজনের আজ ছুটির দিন (হপ্তায় একবেলা ছুটি পায় দাসীরা), অন্যজন লন্ড্রিতে গিয়েছে কাপড় পৌঁছোতে। অগত্যা আগন্তুকের সঙ্গে কথা কইবার জন্য করণীকেই উঠতে হল। উঠলেন তিনি, বেশ বিরক্ত- ভাবেই উঠলেন। বিরক্তিটা, বলা বাহুল্য, চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটার দরুনই। যে-চিন্তায় আনন্দ পাচ্ছি, সে চিন্তায়
ব্যাঘাত যদি কেউ ঘটায়, আমি ত তাকে পরম শত্রু বলেই বিবেচনা করে থাকি মশাই! শ্যাম্পেনের গেলাসে সবে একটি চুমুক দিয়েছি কি না দিয়েছি, এমন সময় থেকে কেউ যদি হাত বাড়িয়ে গেলাসটা কেড়ে নেয় আচমকা, তাকে শত্রু, ছাড়া অন্য কী ভাবা যেতে পারে, বলুন না আপনারাই ? বিরক্তভাবেই উঠে গিয়ে দরোজাটা ঈষং ফাঁক করলেন কর্নেলিয়া ৷ তারপরই “ওঃ, তু-উ-মি!” একটা সুরেলা উক্তি বেরলো তাঁর মুখ থেকে, আর দরোজাখানা একটু একটু করে ফাঁক হতে হতে একদম হাট হয়ে গেল একেবারে। লীলায়িত ঢংয়ে একপাশে ঈষৎ সরে দাঁড়ালেন কর্নেলিয়া, যার অর্থই হল—“এসো হে এসো, চলে এসো দ্বিধা-কুন্ঠা বিসর্জন দিয়ে।” “আমি, মানে, এঞ্জেলার সঙ্গে কথা ছিল—”
“এঞ্জেলা ? তা সে ত বেরিয়েই গেল একটু আগে। অবশ্য ফিরেও আসতে পারে, বলা যায় না কিছু‍ই। তা
তুমি ত এসে তার জন্যে অপেক্ষা করতে পার খানিক ! যদি আসেই ফিরে ! ”
“বেরিয়েছে যখন, ফিরবে কি আর ?”–বেশ হতাশার সুরেই বলল বার্টি—“তবে বলছেন যখন, দশ মিনিট
বসলেও হয়—”
কর্নেলিয়া সরে দাঁড়িয়েছেন বার্টিকে পথ দেবার জন্য। কিন্তু পথ যা দিয়েছেন, তা খুবই সংকীর্ণ । ঢুকতে
গিয়ে কর্নেলিয়ার বুকে কনুইটা লেগে গেল বার্টির— “ওঃ, মাফ করবেন – ”
মাফ চাইতে গিয়েও ছোকরা হাসল নাকি ? হাসবার কারণ যে ঘটেছে একটু সে-সম্বন্ধে কনেলিয়া সচেতন। ওর বাহুতে যে-বস্তুর পরশ লেগে গিয়েছে দৈবাৎ, তা যেমন বতুল, তেমনি কোমল। যে-পরশ লেগেছে, তাতে ছোকরার তনুমনে উন্মাদনা ছড়িয়ে যাওয়ারই ত কথা! দেখা যাক!
বার্টি বসেছে! কর্নেলিয়াও বসেছেন মখোমুখি৷ তিনিই করলেন আলাপ শহর—“তোমার সঙ্গে কোন কথা, এঞ্জেলার সম্পর্কে, এক্ষণি কওয়ার সময় আমার এসেছে কিনা, তা আমি জানি না অবশ্য।”
“সময় এলে ত আমিই কইব কথা”–গোড়াতেই বাগড়া দিল ও ।
“তা ত বটেই। তবে সময় হোক বা না হোক, কিছু একটু কানে এসেছে যখন, আর তুমি দৈবাৎ আমার বাড়িতে এসে পড়েছই যখন, একট বেসরকারী মানে ঘরোয়া, মানে গুরুত্বহীন মতামত বিনিময়ে দোষ কী? কিছু মনে করো না। আমি এঞ্জেলার মা ত? তার যাতে ভাল হয়, তার যাতে ভাল হবে বলে আমার ধারণা, তা যদি আমি বন্ধু ভাবে বলিই তোমাকে, তোমার তা শুনতে, মানে সেই অনুসারে তোমায় চলতেই হবে, এমন কথা কেউ বলে না, ধৈর্য ধরে শুনতে তোমার দোষ কী?”
বার্টির সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ভূমিকাতেই যার এত বাগাড়ম্বর, না-জানি সে-বিষয়বস্তুটা কত গোলমেলে ? বন্ধু ভাবে কী বলতে চান এঞ্জেলার মা? আর, বাস্তবিকই ত, মা হোন আর মাসী হোন, উপরপড়া হয়ে কারও কিছু বলার সময় ত আসেই নি এখনো। মোটে দুটো ডেট গিয়েছে। আজ তৃতীয়টা ছিল , কিন্তু এঞ্জেলা পলাতকা । এ-পলায়নের অর্থ যদি হয় কাটান-ছাড়ান, তা হলে ত চুকেই গেল সব। খানিকটা দুঃখ অবশ্য পাবে বার্টি, তা বলে সে-দুঃখে ভগ্নহৃদয়ে মারা পড়বার আকাঙ্ক্ষা তার নেই। মিসেস ক্যাবট কি আর জানেন না এ-যুগের ছেলেদের (বা মেয়েদের) মনের গতি ?
হ্যাঁ, খুবুই গোলমেলে লাগছে মিসেস ক্যাবটের কথাবার্তা। আর তার চাইতেও যা বেশী গোলমেলে লাগছে, যার মানে বুঝতে কষ্ট রীতিমত, তা হল মিসেসের ভাব আর ভঙ্গী। কথা শব্দে যে তাঁর মুখই কইছে, তা ত নয় ! কথা কইছে তাঁর বিলোল চক্ষু, তাঁর আন্দোলিত বাহু তাঁর হিল্লোলিত স্বর্ণাভ কেশপাশ। কথা কইছে ঠিকই, কিন্তু কী এক দুর্বোধ্য ভাষায়। এ ভাষার পাঠোদ্ধারে এখনও অক্ষম বেচারী বার্টি। মোটে বছর বাইশ তেইশ তার বয়স, আর এঞ্জেলাই তার সর্বপ্রথম প্রণয়িনী।
মিসেস ডাগর আঁখির তণু থেকে একটা শাণিত গায়ক ছুড়ে মারলেন বার্টির পানে, সঙ্গে সঙ্গে করলেন—“মাইনে ত যা পাও, তা তোমার যোগ্য নয়, কী বল?”
“না, তা ত নয়ই! অন্য জায়গায় গেলে ওর ডবল পেতে পারি। কিন্তু বাবা যেতে দেবেন না। তিনি
বলেন, এই বার্থোলোমোরা বনেদী কারবারী। কাছে টিকে থাকলে আখের ভাল হবে।”
“তা ত হবে! কিন্তু বিয়ে জিনিসটা ত আখের পর্যন্ত মুলতুবি রাখা চলে না!”
উঃ, এবারকার তাঁর- খানা যেন রবিনহডের লং-বো থেকেই নিক্ষিপ্ত, একেবারে হৃদয় বিদ্ধ করে ফেলেছে বার্টির।
“এঞ্জেলা বলেছে—বিয়ের পরে হাজার দশেক পাউণ্ড সে পাবে পৈতৃক।’ বলে ফেলল বার্টি।
পাঠক-পাঠিকা বুঝেন, কতখানি বেসামাল হলে তবে মানুষে একথা কবুল করতে পারে যে বিয়ের চিন্তা মাথায় ঠাঁই দিতে সে সাহস পাচ্ছে ভাবী পত্নীর অর্থের ভরসাতেই।
কর্নেলিয়া মুক্তাপাঁতির মত দাঁত বার করে হেসে নিলেন একচোট—“হাজার দশেক নয়, হাজার বারো। আমি জানি, কারণ অর্থটা রেখে গিয়েছেন আমারই প্রথম স্বামী, যিনি স্বর্গলাভ করেন ষোল বছর আগে। বন্দোবস্তটা এই রকম যে এঞ্জেলার বিয়ের পরই সে-অর্থটা সমানভাবে ভাগ হবে তার আর আমার মধ্যে । কাজেই, বুঝতেই পারছ, আমি হিসাব রেখেছি, মাথাপিছু আমরা কত করে পাব। বারো হাজার পাউণ্ড। মাত্রই রারো হাজার এঞ্জেলার মত নবীনার হাতে সে বারো হাজার কতক্ষণ টিকবে, মনে কর? সংসার কী করে করতে হয়, তার অভিজ্ঞতা ত কিছুই নেই ওর! ছয় মাসে ফুকে দেবে বারো হাজার । তারপর তোমাদের সংসার চালাবার জন্য রইল তোমার মাইনেটুকু । সাহস পাও ঐ পয়সায় সংসার চালানোর ঝকি ঘাড়ে নিতে ?”
বার্টি হাঁইফাঁই করছে। কোন্ নবীন নাগর কবে এত এত হিসেব করে থাকে প্রেমে পড়বার আগে ?
কিন্তু উত্তর দেওয়ার দায় থেকে তাকে রেহাই দিচ্ছেন কর্নেলিয়া–“হ্যাঁ, পারি বটে আমরা। বারো হাজারে একটা স্বামীকে রাজার হালে রাখতে পারি। ঐ যে বললাম, অভিজ্ঞতা আছে। থাকুক না স্বামীর মাইনে তারই পকেটে। ব্যাটাছেলের কত কী খরচ আছে। পোশাক-আশাক কিনবে, বাজি ধরবে তাসের আড্ডায়, কত কী! কে চাইছে তার মাইনের টাকা সংসার খরচের জন্য ? আমার বারো হাজারের সব্দে আমি—ঐ যে বললাম—”
হঠাৎ মাঝপথে কথা থামিয়ে কর্নেলিয়া বললেন— “এই দেখ, কথায় কথায় তোমাকে একটু কফি খাওয়াবার কথাও ভুলে গেছি। অবিশ্যি, দাসীরা কেউ বাড়িতেও নেই, তা যাক গে, এঞ্জেলার বদলে তার মাকে নিয়েই কার্ল টনে চল। খরচ-খরচা আমার গো, আমার। তোমার মাইনের পয়সা তাসের আড্ডার জন্যে রেখে দাও।”
কালটনে—অপংবা কিং ভবিষ্যতি ? একটা খালি টেবিলে বসতে গিয়ে সামনে সাপ দেখলে মানুষ যেভাবে হটে আসে এক লাফে সেই ভাবেই হটে এলো বার্টি। কর্নেলিয়ার উপরে প্রজাপতি প্রসন্ন।
একখানা টেবিল বাদেই, পাশাপাশি ঘেষাঘেষি যারা ভোজনে এবং আলাপনে নিরত, তারা হল এঞ্জেলা, এবং –বার্টির পূজ্যপাদ পিতৃদেব ম্যাময়েল মেলরোজ। বয়স পঞ্চাশ হলে কী হবে, তাঁর সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ লক্ষ পাউণ্ডেরও বেশী।
বার্টি হয়ত একটা কেলেঙ্কারিই করে বসত চেচিয়ে মেচিয়ে, কিন্তু তাকে রক্ষা করলেন কর্নেলিয়া। তাকে জোর করেই টেনে নিয়ে গেলেন — “চুপ-চুপ-চুপ-চুপ” রুমাগত তার কানে মন্তর দিতে দিতে।
পরদিন প্রাতরাশের টেবিলে মেলরোজ বললেন- “বাবা বার্টি, একটা খবর তোমাকে দিতে চাই। এ-বয়সে
একটা যত্ন-তদ্বির করার লোক না থাকলে ত আমি বাঁচি না। তাই ঠিক করেছি—মানে একটা বিয়েই করব আবার, ঠিক করেছি—”
কী আশ্চর্য! বার্টি যতটা বেসামাল হয়ে পড়বে বলে তিনি ভেবেছিলেন, তা সে কিছুই হল না। উলটে হিংস্রভাবে বলে উঠল-“এঞ্জেলা ক্যাবটকে ত? অ করুন। আমিও বিয়ে করা ঠিক করে ফেলেছি, ঐ এঞ্জেলারই মাকে। যদি আপনার আপত্তি না হয়, দুটো বিয়ে একদিনেই হতে পারে।”

Please follow and like us: