উদ্ধারণপুরের ঘাট – অবধূত

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

…..এখনও মাঝে মাঝে দেখা দেয় একমাথা-কোঁকড়া চুল রামহরি ডোম আব আধ-বিঘত চওড়া রুপার বিছা কোমরে পরে রামহরির বউ। সঙ্গে নিয়ে আসত তাদেব পাঁচ বছরের উলঙ্গ মেয়ে সীতাকে। মেয়েটাকে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে রামহরি বলত—“তোমার সেবায় দিলুম গোসাঁই । তোমার পেসাদী ফুল না হলে যে শালা একে ছোঁবে তাকে জ্যান্ত চিতেয় তুলে দোব।” নিজের সুপুষ্ট নিতম্বের ওপর হাতখানা ঘষে মুছে আঁচল থেকে একখিলি পান খুলে দিয়ে রামহরির বউ বলত—“নাও জামাই, মুখে দাও”…..
……আসে সবাই । টাট্ট চেপে দারোগা আসেন মদ ধরতে। রামহরির ঘরে রাতটা কাটিয়ে যান ৷ রামহরি সে রাতটা মেয়ে নিয়ে আমার কাছে এসে থাকে আর সারারাত ঢক ঢক করে মদ গেলে। পরদিন সকালে রামহরি বউ গঙ্গাস্নান করে এসে আমার সামনে কাঁচা গোবর খায়। গোৰ-গঙ্গায় সব শোধন হয়ে যায়।….
…..তা জিভ দিয়ে লাল গড়াবার মত সম্পদ ছিল বৈকি নিতাই বোষ্টমীর ৷ কাঁচা হলুদের সঙ্গে অল্প একটু চুন মেশালে যে রঙ দাড়ায় সেই রঙে রঙিন ছিল নিতাই। তার ওপর তার সেই ছোট্ট শরীরখানির বাঁধুনি ছিল অটুট, সব খাঁজ-খোঁজগুলি তীক্ষ্ণ সুস্পষ্ট ৷ পেছন ফিরে চলে গেলে ষাট বছরের তত্ত্বদর্শী মশাই থেকে তের বছরের ফচকে ছোড়া নাপিতদের মুলো পর্যন্ত সবাই একবার বোষ্টমীর কোমরের নিচে চোখ বুলিয়ে না নিয়ে স্থির থাকতে পারত না। ‘জয় রাধে, দুটি ভিক্ষে পাই মা’ বলে যখন গেরস্তের দরজায় গিয়ে দাঁড়াত নিতাই, তখন বউ-ঝিরা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত বাড়ীর ভেতর । পিড়ি পেতে বসিয়ে মুড়ি নাড়ু খাইয়ে পানের খিলি হাতে দিয়ে জেনে নেবার চেষ্টা করত, কি উপায়ে বুকের সম্পদ বোষ্টমীর মত চিরকাল বজায় রাখা যায় । মাথার চুল অত কালো হয় কি করে ?……
…..চেয়ে থাকি ওর মুখের দিকে । চাঁদের আলোয় তব মুখখানি বড়ই করুণ দেখাচ্ছে। ওর অনুপম কালো ভুরু দুটি আরও বেঁকে গেছে। ছোট্ট দু’পাশে নুয়ে পড়েছে ৷ নিজের ছড়ানো-পায়ের এই দেহখানির মধ্যে যেন কপালখানা একটু কুঁচকেছে । অনারত সুডৌল কাঁধ দুটি নিরাভরণ হাত দু’খানি পড়ে আছে কোলের ওপর । আঙুলের ডগায় নজর রেখে চুপ করে বসে আছে। ডুব দিয়ে তলিয়ে গেছে নিতাই ।…..
.সশব্দে একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ল এ পাশে। মুখ ফিরিয়ে দেখি বোষ্টমী তার রাশীকৃত চুলে চূড়ো বাঁধছে দু’হাত মাথার ওপর তুলে। সারাদিন তার পরনে থাকে একখানি সাদা থান আর তার তলায় গলাবদ্ধ কাঁধ কাটা শেমিজ ৷ মাত্র হাত দুখানি ছাড়া সম্পূর্ণ শরীরটাই থাকে ঢাকা। বোধ হয় গরমের জন্যেই রাত্রে শেমিজটা খুলে ফেলেছে। দু’হাত মাথার ওপর তোলার দরুন দু‍ই বাহুমূলের পাশ দিয়ে বুকের অনেকটা অংশ দেখা চাচ্ছে। জ্যোৎস্নার রূপালী আলোয় ভয়ানক রকম জীবস্ত পাতলা চামড়া-ঢাকা দুইটি রক্ত-মাংসের ডেলা ।….
….চূড়ো বাঁধা শেষ করে নিতাই বললে, “জল নেই গোসাঁই, কোথাও এক ফোঁটা তেষ্টার জল নেই । কাঁটার জ্বালায় মন বিষিয়ে উঠেছিল ঘরে, তেষ্টায় বুকের ছাতি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। মনে করেছিলাম পথের ধূলায় আছে মুক্তি । আকাশের জল মাথায় পড়লে মনের জ্বালা আর বুকের তেষ্টা দুই-ই জুড়িয়ে যাবে । কে জানত যে সবচেয়ে বড় শত্রু যে আমার, সেও সঙ্গে সঙ্গে পথে নামবে। পথও বিষিয়ে উঠল। কেউই আমায় চায় না । আমার খোঁজে কেউ আসে না আমার কাছে। সবাই আসে আমার এই শত্রুর কাছে। বাপ-মায়ের হাড় মাংস থেকে পাওয়া এই হাড় মাংসের বোঝাটার লোভে সবাই ছোক ছোক করে ঘোরে আমার পেছনে। কানের কাছে ফিসফিস করে- সোনা-দানায় গা-গতর মুড়ে দেবে, বাড়ীঘর দাসী চাকর কোনও কিছুবই অভাব রাখবে না। খেংরা মারি সোনা-দানা বাড়ী-ঘরের মুখে—হ্যাংলা কুকুরের পাল । ”
হেসে ফেলি। বলি— “খামকা গালমন্দ দিচ্ছ কেন সই দুনিয়াশুদ্ধ সবাইকে ? সে বেচারাদের দোষ কি । লোভের জিনিস নাকের ডগায় ঘুরঘুর করে ঘুবলে কে কতক্ষণ মাথার ঠিক রাখতে পারে । আমারই মাঝে মাঝে লোভ হয় । মনে হয় যা থাকে কপালে, দুর্গা বলে ঝুলে পড়ি তোমার সঙ্গে ৷ তারপর যেখানে হাত ধরে নিয়ে যাবে সেখানেই চলে যাই দু’চোখ বুজে ৷ যা হুকুম করবে তাই করব, সারা জীবন ঘুরতে থাকব তোমার পিছু পিছু।”…..
……পাঁচ বছরের উদলা মেঘে সীতাকে নিয়ে এসে দাঁড়ায় সে। পরনে শুধু কস্তাপেড়ে পাতলা একখানি শাড়া । তার আঁচলখানা বা কাঁধের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে শক্ত করে বাঁধা থাকে কোমরে। মাজায় জড়ানো থাকে আধ বিঘত চওড়া রূপের বিছা | সামনে উবু হয়ে বসে সে টাকা গুণে দেয়। যাকে দেয় সে চেয়ে থাকে । চেয়েই থাকে শুধু ওর দিকে। পাতলা শাড়ীখানা কিছুই ঢাকতে পারেনি। মাংস শুধু মাংস — টাটকা তাজা জ্যান্ত মাংস অনেকটা বয়ে বেড়াচ্ছে পঙ্কেশ্বরের দিদি।……

Please follow and like us: