আমি পুণ্যশ্লোক রাজা যযাতির মেয়ে মাধবী। মাতৃপরিচয়? কী হবে জেনে? মাতো শুধুই গর্ভধারণের আধার, তার পরিচয় কোন কাজে লাগে? আমি জন্মেছি অমিতবীর্য রাজা যযাতির ঔরসে, এই আমার একমাত্র পরিচয়। ‘কুমারী’ মেয়ের এ ছাড়া আর কোনও পরিচয় থাকতে নেই যে।
পরিচয় কেন, আমার কোনও স্বতন্ত্র অস্তিত্বও আছে কি?
মনে পড়ে এক বসন্তের সকালে, আমি তখন সদ্য যুবতী, রাজপুরীর বাগানে প্রিয় সখীদের সঙ্গে ফুল কুড়োচ্ছি, রাজসভায় ডাক পড়ল আমার। গিয়ে দেখি ভারী গম্ভীর মুখে সিংহাসনে বসে আছেন বাবা, কিছুটা বুঝি বা চিন্তিতও। সামনে ঋষির বেশে এক দিব্যকান্তি যুবক, পাশে তার এক মহাবলশালী পুরুষ। দ্বিতীয় পুরুষটিকে আমি চিনি। ইনি আমার পিতৃসখা গরুড়। নত হয়ে প্রণাম করলাম তাঁকে। ঋষিকেও।
আমার আগমনে সভায় ঈষৎ চাঞ্চল্য দেখা দিল। রাজার ভুরুর কুঞ্চন যেন শিথিল সামান্য। মন্ত্র স্বরে বললেন, শোনো মাধবী, সখা গরুড় ঋষি গালবকে আমার কাছে নিয়ে এসেছেন। ঋষি গালব আমার কাছ থেকে এমন কিছু চান যা এঁরা দেশে দেশে ঘুরেও পাননি ।
আমি বিস্মিত হলাম। এজন্য আমাকে ডেকে আনার কী দরকার ?
বাবা আর আমার দিকে তাকালেনও না। অকম্পিত স্বরে ঋষিকে বললেন,—মুনিবর, এই মুহূর্তে আপনার প্রার্থনা পূরণ করার সঙ্গতি আমার নেই। কিন্তু বিষ্ণুসখা কিংবা আপনার মতো ব্রহ্মর্ষিকে নিরাশ করা আমার অন্যায় হবে। আপনি এক কাজ করুন, আপনার প্রার্থিত আটশো অশ্বের বদলে আমার কন্যা মাধবীকে নিয়ে যান। আমার কন্যাটি অতি সুশীলা, রূপবতী। আশা করি একে পেলে আপনার অভীষ্ট পূর্ণ হবে।
ঘোড়ার বদলে আমি? বাবার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। প্রশ্ন করাও যাবে না কিছু, সে অধিকারও আমার নেই। বিহ্বল চোখ জন্মদাতার মুখ থেকে ঋষি গালবের দিকে পড়ল। আজ থেকে আমি এঁরই অধীনা? ভাবতে অবশ্য মন্দ লাগছে না। ক্ষত্রিয় বীর নয় নাই হল, এমন বিদ্বান সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। আমার মতো মেয়েরা তো মনে মনে এমন একজনকেই স্বপ্ন দেখে থাকে।
অন্দরমহলে খানিক কান্নাকাটি হল। দাসিরা কাঁদল, সখীরা কাঁদল, মা কাঁদলেন, বিমাতা কাঁদলেন। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এক বস্ত্ৰে ঋষি গালবের সঙ্গে রাজপ্রাসাদ ছাড়লাম আমি।
পিতৃসখা গরুড় অন্য পথে চলে গেলেন। নীরবে হাঁটছেন গালব, পিছনে দুরু দুরু বুকে আমি। মনে মনে প্রস্তুত করছি নিজেকে। বিলাস বৈভব সব ভুলে এবার থেকে তপোবনে কাটাতে হবে বাকি জীবন, নিজেকে ওই মানুষটার যোগ্য করে তুলতে হবে। পারব তো? নিশ্চয়ই পারব। আমি গালবের প্রেমে পড়েছি, মেয়েরা কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে পেলে তার জন্য সব করতে পারে।
হাঁটছি তো হাঁটছি। রাজধানী পার হয়ে লোকালয় এল। তারপর ছোট্ট অগভীর বন। বনের শেষে কুলকুল নদী। পথশ্রমে ক্লান্ত ঋষি নদীর কিনারে এক শিংশপা গাছের নীচে বসেছেন। একটু দূরত্ব রেখে সসঙ্কোচে আমিও।
পথের নীরবতা বৃক্ষছায়ায় অসহ্য লাগছিল। অথচ নিজে থেকে কথা বলার সাহসও হচ্ছে না। এক সময়ে মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম, – ঋষিবর, আমি কি আপনার সেবা করব?
গালব হাসলেন সামান্য। মাথা নেড়ে বললেন, –না। দরকার নেই।
একটু পরেই উঠব আমরা।
কী মধুর কণ্ঠস্বর! আমি বিগলিত গলায় বললাম,—আমার কি নদীর ওপারে যাব?
—আপনার আশ্রম কি এখান থেকে বহু দূর ?
কথা বলছেন গালব, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি আমার দিকে নেই, বহতা নদীতে
ঈষৎ লাস্য আনলাম গলায়,—আপনি এত গম্ভীর কেন ঋষি? আমাকে কি আপনার পছন্দ নয়?
গালব যেন একটু বিরক্ত হলেন। ক্ষণেক আমাকে দেখেই আবার তাঁর চোখ নদীতে। রুক্ষ স্বরে বললেন, – শোনো যযাতির মেয়ে, এটা রঙ্গ রসিকতার সময় নয়। তুমি কি জানো, কী কারণে তোমায় নিয়ে এসেছি? আরেকটু চপল হলাম, জানি। আটশো ঘোড়ার বদলে আপনি আমায় গ্রহণ করেছেন।
—ভুল। আটশো ঘোড়ার বদলে নয়, আটশো ঘোড়ার জন্য তোমাকে আনা হয়েছে।
—ও, তার মানে রাজা যযাতি তোমায় সব খুলে বলেননি !
পলকের জন্য গালব অন্যমনস্ক। উঠে পড়লেন, পায়ে পায়ে গেলেন নদীর ধারে, আঁজলা ভরে মুখে চোখে জল ছেটালেন। ফিরে এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে, স্পষ্ট কথা স্পষ্টভাবে শুনে নাও যযাতির মেয়ে। আমি তোমাকে গ্রহণ করার জন্য আনিনি। অন্তত এই মুহূর্তে। আমার জন্য তোমায় একটা কাজ করতে হবে। কঠিন কাজ।
আমার বুক থর থর। অস্ফুটে বললাম, – আজ্ঞা করুন।
গুরু বিশ্বামিত্র আমার কাছে আটশোটি দুর্লভ ঘোড়া গুরুদক্ষিণা চেয়েছেন। এমন ঘোড়া যাদের গায়ের রঙ ধবধবে সাদা, কিন্তু একটি কান শ্যামবর্ণ। অযোধ্যার রাজা হর্ষশ্বের কাছে এমন ঘোড়া আছে শুনেছি। তবে খবর পেয়েছি তিনি তা এমনি এমনি দেবেন না। বিনিময়ে হর্ষশ্ব এমন এক নারী চান যে তাঁকে রাজচক্রবর্তী পুত্র উপহার দিতে পারে।…আমি এখন তাঁর কাছেই যাব। যদি তিনি তোমাকে পছন্দ করেন, তবে তাঁর হাতে তোমাকে তুলে দিয়ে আমার ঘোড়া সংগ্রহ করব।
আমি স্তম্ভিত। বাকরুদ্ধ। এ কী বলছেন গালব? মেয়ে হতে পারি কিন্তু মানুষ তো বটে। ইনি আমাকে ভাড়া খাটাতে চান? ছি ছি।
সম্বিত ফিরতেই সোজাসুজি তাকালাম, আমার বাবা এসব জানেন? —অবশ্যই। তিনিই তো আমাকে পরামর্শটা দিলেন।
রাগে দুঃখে অভিমানে চোখে জল এসে গেল। আমার জন্মদাতাই
কোনওক্রমে বললাম, তার মানে এখন আমায় অযোধ্যায় জীবন কাটাতে হবে?
—হুঁ। অন্তত যতদিন না তুমি পুত্র প্রসব করো ততদিন।
গালবের ঠোটে বিচিত্র হাসি ফুটল। কোমল স্বরে বললেন, – তারপর আমি তোমাকে ফেরত নিয়ে আসতে পারি।
—আনতেই হবে। তোমার দায়িত্ব যখন আমার…
আশ্চর্য নারীর মন! কথাটা শুনেই কোথথেকে যেন আশার দীপ্তি জ্বলে উঠল বুকে। কে এক কুহকিনী কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে বিপদে সাহায্য করা নারীর ধর্ম। ঘেন্নাপিত্তি ভুলে, চোখ-কান বুজে ক’টা দিন কাটিয়ে দে, তারপর তো গালব তোরই।
ধন্য আশা কুহকিনী। ধন্য পুরুষের প্রতি নারীর আকর্ষণ!
আবার শুরু হল আমাদের যাত্রা। নদী পাহাড় অরণ্য জনপথ পার হয়ে পৌঁছলাম অযোধ্যায়।
রাজা হর্ষশ্বের সভায় আমাকে নিয়ে গেলেন গালব। প্রস্তাবটি রাখলেন রাজার কাছে।
হর্ষশ্ব আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। যেমন ভাবে কোনও বিক্রয়যোগ্য পশুকে দেখে কোনও বণিক, অনেকটা তেমনই ভাবে। মুখে হাসি ফুটল,—নাঃ, বলতেই হয় এ মেয়ে ভারী সুলক্ষণা। মনে হচ্ছে আমি যা চাই, এ তা আমায় দিতে পারবে।… কিন্তু আপনার শুল্ক তো আমি পুরোপুরি মেটাতে পারব না মুনিবর। ও রকম ঘোড়া আমার আছে বটে, তবে মাত্র দুশো। এতে কি আপনার চলবে?
এ যে রীতিমত দরাদরি! আমার গা ঘিনঘিন করে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে তবু দাঁড়িয়ে আছি। শুধু গালবের মুখ চেয়ে
গালবের মুখ পাংশু হয়ে গেছে। আমার কথা ভেবে নয়, অন্য চিন্তায়। একান্তে ডাকলেন আমাকে। অস্থির স্বরে বলে উঠলেন,—এখন আমার কী হবে যযাতির মেয়ে? গুরুদক্ষিণা মেটাতে না পারলে আমি যে পাতকী হব !
নাঃ তোমাকে দিয়ে আমার কোনও কাজই হল না। আমার সারা জীবনের শ্রম তপস্যা সব নিষ্ফল হয়ে গেল।
কথাক’টি তিরের মতো আমার মর্মমূল ভেদ করল। ক্ষণিকের জন্য পাথর হয়ে যাওয়া হৃদয়ে বিন্দু বিন্দু মায়া জমছিল। ওই মানুষটির জন্য। হাতের কাছে রমনীরত্ব থাকা সত্ত্বেও কী অসহায়! ইহলোক আর পরলোকের ভাবনায় কী কাতর!
মনোকষ্ট চেপে রেখে বলেই ফেললাম, –এর তো সহজ সমাধান আছে ঋষি। আপনি দুশো ঘোড়ার বদলেই এঁর কাছে আমাকে রেখে যান। ছেলে হতে তো বছর খানেক সময় লাগবেই, এর মধ্যে আপনি খোঁজখবর করুন আর কোন্ কোন্ রাজার কাছে এমন ঘোড়া পাওয়া যায়। ভাড়া খাটাই যখন আমার মতো মেয়েমানুষের নিয়তি, তখন নয় আর কটা রাজার সঙ্গেও শোব। আপনারও প্রাপ্য ঘোড়া মিলে যাবে।
প্রস্তাবটায় শ্লেষ ছিল আমার। ভেবেছিলাম বিদ্রূপের অভিঘাতে আহত হবেন ঋষি, হাঁ-হাঁ করে উঠবেন। শুনেছিলাম সাত-পা একসঙ্গে হাঁটলে সঙ্গী নাকি বন্ধু হয়। সে যদি জঙ্গলের পশু হয়, তবুও। ঋষি গালবের সঙ্গে এই ক’দিনে লক্ষ পা হেঁটেছি আমি, এককণা দুর্বলতাও কি আমার জন্য জমেনি তাঁর মনে? বন্ধুর মনোবেদনা বুঝতে পারবেন না, ঋষি কি এতই প্রজ্ঞাহীন? নাঃ, গালবের মুখে যন্ত্রণার চিহ্নমাত্র নেই। বরং উদ্ভাসিত হয়েছেন।
পরক্ষণেই ম্লান আবার। কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, – উপায়টা মন্দ বলো নি। তবে এতেও সমস্যা আছে।
—নেই? গালবের বিস্ময় যেন বাঁধ মানলনা, — তুমি তো রাজবংশের মেয়ে, জানো না, রাজারা কুমারী মেয়ে পছন্দ করেন? এক রাজার সঙ্গে বছরভর কাটানোর পর অন্য কোনো রাজা তোমায় নেবেন?
ধন্য পুরুষ। ভাড়া খাটার মেয়েছেলেও চাই, টাটকা কুমারীও চাই!
সামান্য ছলনার আশ্রয় নিলাম এবার। হেসে বললাম,—এই কথা? এ তো কোনও সমস্যাই নয়। অতি শৈশবে এক ব্রহ্মবাদী ঋষিকে আমি সেবায় তুষ্ট করেছিলাম। তিনি আমাকে একটা অদ্ভুত বর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রতিবার সন্তান প্রসবের পর তুমি আবার কুমারী হয়ে যাবে।
—হয়। আপনাদের মতো পুরুষরা বর দিলে সবই হয়। সবই তো আপনাদেরই ইচ্ছানির্ভর। চাওয়া নির্ভর।
মনে মনে বললাম, শত শাস্ত্র অধ্যয়ন করেও আপনি কী অজ্ঞ ঋষি!
এত জানেন আর এটুকু বোঝেন না, শরীর তো দূরের কথা, হৃদয়ে একজনের জন্য প্রণয় জাগলেই নারী আর কুমারী থাকে না ! ঋষি গালব আনন্দের আতিশয্যে আমার হাত জড়িয়ে ধরেছেন, – তুমি আমায় বাঁচালে যযাতির মেয়ে। কী বলে যে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানাব ! –থাক। শুধু কথা দিন আপনার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়ে গেলে আমাকে
—সে আর বলতে। আমি কি বুঝি না এমনভাবে জীবন কাটাতে মেয়েদের কত কষ্ট হয় !
গালব চলে গেলেন। আমার ঠাঁই হল রাজা হর্ষশ্বের অন্তঃপুরে। শুরু হল আমার নদীর জীবন। বয়ে চলেছি, বয়েই চলেছি। দিন যায়। কী ভাবে যে যায় সে শুধু আমিই জানি। একে একে তিন রাজার শয্যাসঙ্গিনী হলাম আমি। হর্ষশ্বের পরে কাশীরাজ দিবোদাস, তারপর ভোজরাজ উশীনর। এঁরা প্রত্যেকেই মহৎ, কিন্তু পৃথক ধরনের মানুষ।
হর্ষশ্বের দানধ্যানের সুনাম আছে, দিবোদাস বীর, ঊশীনর সত্যের পূজারী। শুধু একটা বিষয়েই তিনজনের ভীষণ মিল। মাত্র দুশোটি ঘোড়ার বিনিময়ে একটি নারীকে ভোগ করতে কারও মনে এতটুকু দ্বিধা নেই। কে জানে, হয়তো এর মধ্যেও ধর্মের কোনও গূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে। সে যাই হোক, এঁদের কার্যসিদ্ধি হয়েছে। প্রকৃতির নিয়মে এঁদের প্রত্যেকের গৃহেই আমি গর্ভবতী হয়েছি, তিনজনকেই উপহার দিয়েছি একটি করে পুত্র। হর্ষশ্বের ঘরে বসুমনা, দিবোদাসের প্রাসাদে প্রতর্দন, ঊশীনরের রাজপুরীতে শিবি। প্রতিটি জন্মের সংবাদই যথাসময়ে পৌঁছেছে আমার বাবার কানে। আশ্চর্য, তিনিও দৌহিত্র লাভ করে নাকি মোহিত! তিন সন্তানকেই দুধ-মা’র কাছে ছেড়ে রেখে এসেছি আমি। প্রথম বার যখন অযোধ্যা থেকে গালব আমায় নিতে এলেন, বসুমনার জন্য আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। অতটুকু দুধের শিশু ফেলে কোন প্রাণে যাই! হর্ষশ্বকে বললাম, ছেলে এখন আমার কাছে থাক। একটু বড় হয়ে ফিরিয়ে দিয়ে যাব। তিনি সম্মত হলেন না। তাঁর ছেলে অন্যের ঘরে প্রতিপালিত হবে? অসম্ভব। পশুপাখির জগতে শিশু মায়ের, মানুষের জগতে নয়।
আমার বুকের দুধ যন্ত্রণার পুঁজ হয়ে জমে গেল। শুকিয়ে মরে গেল।
ঊশীনরের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গালবকে বললাম, –এখনও তো আপনার দুশো ঘোড়া সংগ্রহ বাকি। এবার কোথায় ? গালবকে সেদিন একটু যেন বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। হতাশ স্বরে বললেন,
আমার চেষ্টা বোধহয় সফল হবে না। সমস্ত শ্রম আমার ব্যর্থ হয়ে গেল।
—মহা সমস্যায় পড়ে গেছি। কালই গরুড় আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি এক নতুন সংবাদ দিয়ে গেলেন।…এই যে সব দুর্লভ অশ্ব, এ সবই নাকি আগে মহর্ষি ঋচিকের ছিল। তিনি এদের পেয়েছিলেন বরুণালয়ে। তাঁর কন্যা সত্যবতীর বিয়ের সময়ে মহর্ষি ঋচিক কান্যকুব্জরাজ গাধিকে এরকম এক হাজারটি ঘোড়া যৌতুক দিয়েছিলেন। মহারাজ গাধি ঘোড়াগুলোকে নিজের কাছে রাখেননি, সবই তিনি ব্রাহ্মণদের দান করে দেন। সেই ব্রাহ্মণরা যখন ঘোড়া নিয়ে ফিরছিলেন তখন হর্ষশ্ব দিবোদাস আর উশীনর তাঁদের কাছ থেকে দুশোটি করে ঘোড়া কিনে নিয়েছিলেন। বাকি চারশো পথে চুরি হয়ে যায়। অর্থাৎ এরকম ঘোড়া আর আমার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। গরুড় অবশ্য বলছিলেন তুমি এই ছ’শো ঘোড়াই গুরুদেব বিশ্বামিত্রকে দক্ষিণা দিয়ে দাও। তোমার অসুবিধের কথা খুলে বললে তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন।
পলকের জন্য অন্তরে যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম। উজ্জ্বল মুখে বললাম, —বিষ্ণুসখা গরুড় যা বলছেন তাই করুন তবে। —তা কি হয় যযাতির মেয়ে? গুরুদক্ষিণা পুরো না দিলে আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় কী করে? বলতে বলতে গালব অপাঙ্গে আমার দিকে তাকালেন, —একটা বুদ্ধি অবশ্য মাথায় এসেছে, জানি না তাতে লাভ হবে কিনা —যদি অবশিষ্ট ঘোড়ার বদলে গুরুদেব তোমায় রাখেন…না না, এ বোধহয় হয় না। গুরুদেব হয়তো এতে আহত হতে পারেন। তিনি তো ঘোড়াই চেয়েছেন, স্ত্রীলোকে কি তিনি সন্তুষ্ট হবেন ? তিন তিনজন রাজর্ষির শয্যা আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। মনে মনে বললাম, খুব হবেন। ঋষি হলেও তিনি পুরুষ তো বটে। গালব আমার হাত ধরলেন, – আরেকবার আমার জন্য কষ্ট করবে যযাতির মেয়ে? এই শেষবার ?
চোখে জল এসে গেল। সামলে নিয়ে বললাম, – চলুন। নির্দয় পুরুষ অপরের করুণা চায়! সে করুণার প্রকৃতিই বা কীরকম?
না ঘোড়ার বদলে সুন্দরী ভোগ করে অপর জনটি তৃপ্ত হবেন কি হবেন না ! আমার ধারণাই মিলে গেল। এক ঝলক আমাকে দেখামাত্রই ঋষি বিশ্বামিত্রের কামজ্বর এসে গেল। গদগদ গলায় বললেন, – তুই কী আহাম্মক রে গালব! এমন একটা মেয়েছেলে তোর হাতে আছে, অথচ তাকে আগে আমার কাছে আনিসনি! থাকি তো বনে বাদাড়ে, ঘোড়া আমার কী কম্মে লাগবে? নেহাত গুরুদক্ষিণা দেব, গুরুদক্ষিণা দেব বলে বায়না জুড়েছিলি, তাই তোকে পরীক্ষা করার জন্যে…। এহেহেহে, এই কটা বছর মেয়েটাকে ব্যস্। এবার আর রাজপ্রাসাদ নয়, মুনির তপোবন। এবারও সেই একই পরিণতি। তিন রাজার মতো আমায় ছিঁড়েখুঁড়ে একশা করলেন ঋষিবর। ফলত আরেকটি ছেলে। অষ্টক। ছেলে জন্মাতেই ঋষির কামজ্বর উধাও। বুঝি বা পরমব্রহ্মের কথা মনে পড়ে গেল। তুচ্ছ মানবীতে কতদিন আর আটকে থাকতে পারেন সাধুসন্ন্যাসীরা!
আবার গালবের কাছে প্রত্যাবর্তন। এতদিনে সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গালবকে দেখে হৃদয়ে এখন আর এতটুকু চাঞ্চল্য জাগে না। প্রণয়ের ক্ষুধা মরে গেছে, প্রথম প্রেম এখন দূরের স্মৃতি। তবু মনে একটা ক্ষীণ স্বস্তি, যাক আর ভেসে বেড়াতে হবে না। রাজকন্যা হই আর যাই হই, মেয়েদের যে কোনও আলাদা সত্তা থাকতে নেই এ আমি হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি। আমাদের আবার ইচ্ছে-অনিচ্ছে কী? এখন বাকি জীবনটা গালবের সঙ্গে চোখ-কান বুজে কাটিয়ে দিতে পারলে বাঁচি । গালবের পিছু পিছু হাঁটছি আবার। নদী গিরি প্রান্তর অরণ্য লোকালয় পার হয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি। এক দুপুরে এক স্রোতস্বিনী পার হলাম আমরা। তিলেক বিশ্রামের জন্য বসেছি এক শিংশপা গাছের নীচে। জায়গাটা ভারী চেনা চেনা। এখানেই প্রথম দিন আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম না? হ্যাঁ তো। গালবও বুঝি চিনেছেন জায়গাটাকে। ঘুরে ঘুরে দেখছেন চার দিক । নদীকেও। চৈত্রমাসের ঘূর্ণি উঠছে ছোট ছোট। কোত্থেকে একটা কোকিল নির্বাক মানুষটা হঠাৎ সবাক হলেন, কী ভাবো যযাতির মেয়ে? গাম্ভীর্য সরে মৃদু হাসি উঁকি দিল, —কটা বছর তোমার ওপর দিয়ে খুবঅর্থহীন কথা। উত্তর দিলাম না।
–তোমার এই আত্মত্যাগ বিফল যাবে না, দেখো। তোমার চার সন্তানেরই নাম ত্রিভুবনে ছড়িয়ে পড়বে। বসুমনা হবে দাতা, প্রতর্দন হবে বীর, শিবি ধার্মিক হবে, আর আমার গুরুর সন্তান অষ্টক হবে যজ্ঞকারী। কী, খুশি ? পলকের জন্য চারটে কচি কচি মুখ বুকে ভেসে উঠেছে। কেমন আছে ছেলেগুলো? কী করছে? মাকে কি খোঁজে তারা? মার জন্য কাঁদে? নাকি ভুলেই গেছে এই অভাগিনী মাকে? বুকফাটা কষ্টের মধ্যেও হাসি পেল সহসা। গালব আশীর্বাদ করছেন আমার ছেলেদের, আমাকে নয়! মেয়েদের এতটুকু গৌরব দিতেও এত কার্পণ্য? হায় রে পুরুষ !
নীরস স্বরে বললাম,—আমার খুশিতে আপনার কী দরকার? আপনার কার্যসিদ্ধি হয়েছে, সেটাই যথেষ্ট।
কোকিলের ডাক আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে। গালব কাছে সরে এলেন, একদম পাশটিতে। কাঁধে হাত রেখেছেন, পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে। এক সময়ে ওই স্পর্শের জন্য উন্মুখ ছিল হৃদয়, কিন্তু সেই মুহূর্তে কোনও রোমাঞ্চ অনুভব করলাম না। অথচ এই দৃষ্টি আমার চেনা। ওই স্পর্শের ভাষাও। শুকনো গলায় বললাম, – সংযত হোন ঋষি।
– কেন ?
—এখানে নয়। এভাবে নয়।
–কেন, এই জায়গাটা কী দোষ করল? গালব সবলে আলিঙ্গনে বেঁধে ফেললেন আমাকে। কানেকানে ফিসফিস করে বললেন, –এ তো অতি মনোরম স্থান। নদী গাছ প্রকৃতি…তুমি আর আমি… মনে নেই এখানেই একদিন তুমি আমার সেবা করতে চেয়েছিলে? আজ তোমার জীবনে সেই সৌভাগ্য এসেছে। শুভলগ্ন বয়ে যেতে দিও না ।
হঠাৎ কেমন গা গুলিয়ে উঠল। এত বিবমিষা আগে কখনও জাগেনি তিন রাজার সঙ্গে শুয়েও নয়, বিশ্বামিত্রের অঙ্কশায়িনী হয়েও নয়।
রূঢ়ভাবে বললাম,—এত তাড়াহুড়োর কী আছে? আর তো কারও কাছে আমাকে পাঠানোর নেই! চলুন, আপনার আশ্রমে যাই, সেখানে নয় সারা জীবন ধরে আমাকে যত খুশি….
—সারা জীবন ধরে? আমার আশ্রমে? তোমাকে নিয়ে? গালব ছিটকে সরে গেলেন,—তুমি কি জানো না, তোমাকে আশ্রমে আর নিয়ে যাওয়া যায় না? আশ্রম অতি পবিত্র স্থান, অন্যপূর্বা নারীকে নিয়ে সেখানে বাস করাট অধর্ম। আমি কোনও ভাবেই তোমাকে আমার সহধর্মিনী করতে পারি না। পলকের জন্য স্তম্ভিত আমি, পলকেই স্থিত আবার।
বাঃ বাঃ, এই তো যোগ্য উত্তর। এরকমটাই তো আশা করা উচিত ছিল। তবু কেমন জেদ চেপে গেল। বললাম, – আমি অন্যপূর্বা নই। সন্তান প্রসব করা হয়ে গেছে, এখন আমি আবার কুমারী ।
—তুমি কুমারী! গালব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, ওসব গালগল্প তুমি আমাকেও বিশ্বাস করতে বল?
রাগে হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেল। চিৎকার করে উঠলাম, – যদি জানেনই গালগল্প, একের পর এক পুরুষের কাছে আমায় কুমারী সাজিয়ে পাঠালেন কী বলে? এতে অধর্ম হয়নি?
—তুমি নেহাতই বোকা যযাতির মেয়ে। এও বোঝে না, মহৎ কারণে ছোটখাটো ছলনার আশ্রয় নিলে কোনও পাপ হয় না। গালব আবার আমায় আলিঙ্গন করলেন, বাজে তর্ক কোরোনা। এসো আমরা মিলিত হই। চিন্তা নেই, তোমার বাবার কাছে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব ।
–কক্ষনও না। আপনি ছোঁবেন না আমাকে। সরে যান।
না, এরপর গালব আর আমাকে ছোঁননি। বোধহয় তাঁর মানে লেগেছিল। বাবার হাতে নামহীন যযাতির মেয়েকে তুলে চিরতরে বিদায় নিলেন ঋষি গালব।
এখানেই আমার কাহিনি শেষ হয়ে যেতে পারত। বাদবাকি জীবন রাজা যযাতির অন্তঃপুরেই, সুখে না হোক, শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারতাম রাজকন্যাদের তো আর পেটের ভাতের অভাব হয় না ।
কিন্তু বিধি বাম। মহাপুণ্যবান রাজা যযাতি দু’বেলা কানের কাছে এসে হুশহাশ নিশ্বাস ফেলেন, ঘরে অবিবাহিতা মেয়ে রয়েছে বলে তাঁর নাকি রাতে ঘুম হয় না! আরও দুঃখ, মেয়েটা পতিহীন থাকলে মরার পরে স্বর্গে তার নাকি ঠাঁই হবে না! অতএব মেয়েকে পাত্রস্থ করতেই হবে। ওদিকে মনে আবার সঙ্কোচও আছে, চারটে বাচ্চা হওয়া মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলে অন্য রাজারা হাসাহাসি না করে !
অনেক ভেবেচিন্তে পাঁচ ছেলের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন রাজা। শেষ পর্যন্ত নিজেরা নিজেরা একটা উপায়ও বার করে ফেললেন। আমাকে ডেকে হুকুম জারি করা হল, প্রস্তুত হও। তোমার স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করা হয়েছে।
আঁতকে উঠে আপত্তি জানাতে গেলাম, কেউ কর্ণপাত করল না। গঙ্গা যমুনার সঙ্গমস্থলে, প্রয়াগতীর্থে নাকি সভা ডাকা হয়ে গেছে, আমাকে যেতেই হবে। তা রাজপ্রাসাদ থাকতে ওখানে কেন? না প্রয়াগতীর্থ অতি পুণ্যস্থান, ওখানে স্বয়ম্বরা হলে আমার সব দোষ কেটে যাবে। বাবা যেটা মুখে বললেন না সেটা হল, দোজবর হোক, তেজবর হোক, একটা বোকাসোকা ভালমানুষ রাজা কপালে জুটে গেলে এবারকার জীবনটা তো আমার তরে গেল।
আজ সেই শুভদিন। প্রয়াগতীর্থের এক আশ্রমে আনা হয়েছে আমাকে । এখানেই বসেছে স্বয়ম্বর সভা। বাবা নিজে আসেননি, রাজকাজে ব্যস্ত। হতেও পারে, নাও হতে পারে, সত্যি-মিথ্যে আমি জানিনা। আয়োজনে অবশ্য কোনও ত্রুটি নেই। আমার দুই দাদা যদু আর পুরু নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে আশ্রম সাজিয়েছে, রাজকীয় মঞ্চ বানিয়েছে, ফুলের গন্ধে আমোদিত হয়ে আছে দশ দিক। লোকলস্কর সেপাই শাস্ত্রী ছুটে বেড়াচ্ছে অবিরাম, আগত রাজাদের আপ্যায়নে যেন কোনও ফাঁক না থাকে।
অবাক কাণ্ড! চার ছেলের মাকে বিয়ে করতে রাজাও কিছু এসেছেন বটে! এমনকি নাগ যক্ষ গন্ধর্বরাও উপস্থিত। এত লোক আমাকে পেতে আগ্রহী? কেন? রাজার মেয়ে বলে ? নাকি পুত্রদায়িনী সুলক্ষণা মেয়েমানুষ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছি তাই?
একটু আগে সখীরা আমায় বধূসাজে সাজিয়ে দিল। ঋষিকন্যারা বরমালা গেঁথে ধরিয়ে দিয়েছে হাতে, এবার সভায় গিয়ে পছন্দসই কাউকে পরাতে হবে সে মালা ।
কাকে পরাব এই মালা? কোন হর্ষশ্ব দিবোদাস ঊশীনর অথবা বিশ্বামিত্রকে? অথবা কোন গালবকে ? এদের একজনকেও না বাছার স্বাধীনতা আজ আমার আছে, কিন্তু তারপর? বাবার কাছে থাকা, সেও তো এক পুরুষের আশ্রয়েই থাকা। বাবা মারা গেলে ভাইদের আশ্রয়, তারাও তো পুরুষ। অপেক্ষা করব ছেলেরা কবে বড় হয়ে মাকে নিয়ে যাবে? হায়, ততদিনে তারাও তো এক একটা আস্ত পুরুষমানুষ হয়ে যাবে !
কোনও পথ নেই? কোনও পথ নেই?
জঙ্গলে চলে যাব? বাঘ ভাল্লুক শিয়াল কুকুরদের জগত কি মানুষের
সমাজের চেয়ে হীন কিছু হবে?
ভাবছি আমি। ভাবছি, ভাবছি…
মালা আমার হাতেই শুকিয়ে গেল।