উর্বশীর প্রেম – অনিতা বসু

›› পৌরাণিক কাহিনী  

‘হায়ে জায়ে মনসা তিষ্ঠ ঘোরে’- হায় । ওগো নিঠুরা জায়া, দাড়াও
মহারাজ পুরুরবার এই আর্ত হাহাকার অপ্সরী উর্বশীর প্রতি কতকাল আগে ধ্বনিত হয়েছিল, আজ তার হদিশ পাওয়া যাবে না। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৯৫ নম্বর সূক্তটি উর্বশী-পুরুরবা সূক্ত নামে সুপরিচিত। উদ্ধৃতিটি তারই প্রথম পংক্তির অংশ।
মর্ত্যমানবের সঙ্গে দিবালোক দুহিতার এই ভগ্ন প্রেমের আখ্যানটিই না কি বিশ্বের প্রাচীনতম প্রেমকাব্য। শুধু প্রাচীনতম নয়, অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তাই বোধহয় সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যে ঘুরে-ফিরে এসেছে উর্বশী-পুরুরবার কাহিনী। যজুর্বেদের অগ্নিমথন মন্ত্রে, শতপথ ব্রাহ্মণে, বৌধায়ন শ্রৌতসূত্রে, সর্বানুক্রমনী, বৃহদ্দেবতা ইত্যাদি বেদান্ত সাহিত্যেই শুধু নয়, এই কাহিনী রয়েছে রামায়ণে, মহাভারতে, হরিবংশে, বিষ্ণুভাগবত-বায়ু-মৎস্য-পদ্ম প্রভৃতি পুরাণেও। পুরাণোত্তর সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাসের ‘বিক্রমোর্ব- শীয়ম’ নাটকটি এই কাহিনীর সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যরূপ। গুণাত্যের বৃহৎকথা, সোমদেবের কথাসরিৎ সাগরেও রয়েছে এই কাহিনী। উল্লেখ আছে অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিতে, কিংবা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। তারপর আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও উর্বশী-পুরুরবা কাহিনীর ছড়াছড়ি। মধুসূদনের কাব্যই বলুন, আর রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রা’ (উর্বশী) কিংবা বিষ্ণু দে-র ‘উর্বশী ও আর্টোমিস ই বলুন—এই কাহিনীটি কবিচিত্ত তোলপাড় করেছে সুদীর্ঘ সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে। প্রধানত ঋগ্বেদ এবং শতপথ ব্রাহ্মণের অনুসরণে আমরা আজ উপস্থিত করছি কবি চিত্ত তোলপাড় করা সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরাতন উর্বশী পুরুরবা উপাখ্যান।
উর্বশীর জন্ম নিয়েই নানা মুনির নানা মত। কারো মতে উর্বশী নারায়ণের উরু ভেদ করে বহির্গত হয়েছিলেন। তাই তাঁর নাম উর্বশী। সমুদ্র মন্থনের সময় তিনি উত্থথিত হয়েছিলেন বলেও কথিত আছে। আবার এমনও প্রচলিত আছে যে, তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন সাতজন মনু।
তাঁর শাপগ্রস্তা হওয়া নিয়েও নানান মত। শতপথ ব্রাহ্মণ অনুসারে উর্বশী নৃতা করছিলেন ইন্দ্রের সভায়। সেই সভায় আমন্ত্রিত পুরুরবার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে উর্বশী তাকিয়েছিলেন তাঁর দিকে। ফলে নৃত্যের তাল ভঙ্গ হয়। ইন্দ্রের শাপে উর্বশীকে বাস করতে হল মর্ত্যমানবী রূপে।
উর্বশীর শাপগ্রস্তা হওয়ার আর একটি কাহিনী এরকম: মিত্রাবরুণ আদিত্য যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে অপ্সরা উর্বশীর অনিন্দ্য- কান্তি যৌবন দেখে তাঁদের রেতঃপাত হয়। এতে দুই দেবতা ক্রুদ্ধ হয়ে উর্বশীকে অভিশাপ দেন যে তাঁকে পৃথিবীতে নির্বাসিতা হতে হবে। পদ্ম পুরাণে এ ঘটনাই একটু ভিন্ন রূপে আছে।
কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশীয়ম’ নাটকে উল্লিখিত হয়েছে, কেশী দৈত্য উর্বশীকে হরণ করেছিল। মহারাজ পুরুরবা দৈত্যের কবল থেকে উর্বশীকে উদ্ধার করেন। তখন উভয়ে উভয়ের প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েন। স্বর্গে অভিনয়কালে উর্বশী ভুলক্রমে পুরুরবার নাম বলে ফেলেন। তাতেই তিনি শাপগ্রস্তা হন। উর্বশী তো শাপগ্রস্তা হয়ে মর্ত্যের বাসিন্দা হলেন। স্বাভাবিক- ভাবেই তিনি পুরুষশ্রেষ্ঠ পুরুরবাকে স্বামী-রূপে পেতে চাইলেন। অসম্মতি ছিল না উর্বশী-রুপমুগ্ধ পুরুরবার। কিন্তু উর্বশী শর্ত দিলেন, “দিনে তিনবার তুমি আমাকে রমণ করতে পারবে। কিন্তু কামরহিত হয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারবে না। তোমাকে যেন কখনও নগ্ন অবস্থায় না দেখি।’
পুরুরবা তখন উর্বশীকে পাবার জন্য পাগল। তিনি ওই প্রতিশ্রুতি দিলেন। ‘সর্বানুক্রমনী’ অনুসারে উর্বশীর শর্ত ছিল : ‘শয্যার বাইরে তোমাকে নগ্ন দেখলে যেখান থেকে এসেছি, সেখানে ফিরে চলে যাবো, পুত্র মেষ দুটিকে সর্বদা আমার কাছে রক্ষা করতে হবে।’ রাজা এই শর্ত মেনে উর্বশীকে আনলেন রাজধানী প্রতিষ্ঠানপুরে। বহু বছর ধরে তাঁরা মৈথুনক্রিয়া করেছিলেন।
উর্বশীর সঙ্গে পুরুরবার সাক্ষাৎকার নিয়ে বৌধায়ন সূত্রে এক চমকপ্রদ কাহিনী বিধৃত রয়েছে। এই কাহিনী অনুসারে পুরুরবা ছিলেন এক মহান রাজা। তাঁকে উর্বশী অপ্সরা ভালোবেসেছিলেন। এক বছর ধরে রাজাকে অনুসরণ করেছিলেন তিনি। রথে যাবার সময় রাজা কাউকে যেন সামনে দেখতে পেলেন। তাঁকে দেখে রাজা থামলেন। কিন্তু কাউকে আর দেখতে পেলেন না। পুনরায় চলতে শুরু করলেন। আবার সেই বিভ্রম—কেউ যেন সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাজা সারথিকে প্রশ্ন করলেন-‘সারথি কি দেখছ ?”
-ভগবান আপনাকে, রথ, অশ্ব, আর পথ—এছাড়া তো আর কিছুই দেখছি না।’
রাজা তখন ‘অদৃশ্য’ কেই প্রশ্ন করলেন-“আপনি কে ?”
আমি উর্বশী, অপ্সরা, যে আপনাকে এক বছর ধরে অনুসরণ করছে।’
তাঁকে আমার জায়া করা হোক।
দেবতারা দুরূপচার হন। আপনার উপচর্যা কি? আমার জন্য একশ উপসদ (যজ্ঞ বিশেষ) দরকার। আমার জন্য শত শত কলসী ঘৃত প্রয়োজন। আমি বারে বারে প্রতিদিন এসে তা থেকে আহার করব। আপনাকে যেন নগ্ন দেখতে না হয়।’
‘হে ভগবতি। এ সবই সহজ হবে, কিন্তু আপনি স্ত্রী হয়ে স্বামীকে নগ্ন দেখবেন না তা কি করে হবে ? অন্তর্বাস পরে অনগ্ন হবেন। এইভাবেই উর্বশীর সঙ্গে পুরুরবার মিলন হল। রাজা তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমে মিলিত হতেন অন্তর্বাস পরিধান করে। তাঁদের পুত্রসন্তানও জন্মেছিল। কিন্তু জন্মানো মাত্রই উর্বশী পুত্রদের হত্যা করতেন। পুরুরবা আপত্তি করাতে উর্বশী বললেন, —এই পুত্ররা এমনিতেই অল্পায়ু হত, আপনার চিন্তা নেই, আমি আপনার বহু প্রিয় কাজ করব।’
অবশেষে পুরুরবার ঔরসে উর্বশীর গর্ভে জন্ম নিল আয়ু এবং অমাবসু। এঁরাই পুরুরবার রাজ্য আরও বাড়িয়েছিলেন। আয়ু গিয়ে- ছিলেন পূর্বদিকে। তাই কুরু, পাঞ্চাল, কাশী, বিদেহ—এই সব রাজ্য আয়ুর হয়েছিল। অমাবসু গিয়েছিলেন পশ্চিমে, তাই গান্ধার, স্পর্শ, অরাট্ট প্রভৃতি রাজ্য এসেছিল তাঁর অধিকারে।
উর্বশী পুরুরবার প্রেমকাহিনী ক্লাইম্যাকসে পৌঁছয় ঠিক এই সময়ে। উর্বশীর শর্ত অনুযায়ী পুরুরবা অন্তর্বাস পরে তাঁর সঙ্গে রমণ করতেন, উর্বশীর খাটের কাছে বাঁধা থাকত দুটি মেষ এবং তিনি ঘৃত ভোজন করতেন। এদিকে উর্বশীর ছিল এক বোন। তিনিও অপ্সরা। তাঁর নাম পূর্বচিত্তি। তিনি দেখলেন, তাঁর বোন (উর্বশী) বহুদিন মানুষের সঙ্গে রতিক্রিয়া করছে। পূর্বচিত্তি ঠিক করলেন, প্রেমিক যুগলকে বিচ্ছিন্ন করবেন। পূর্বচিত্তি তাই নেকড়ের রূপ ধারণ করে পুরুরবার শয়নকক্ষের কাছে এসে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। মেষদুটি ভয় পেয়ে ঘরের বাইরে যেতেই নেকড়ে তাদের নিয়ে পালাল। উর্বশী তখন কেঁদে উঠলেন, রাজাকে বললেন, “আপনি বীরপুত্র নন, আপনি মেষদুটিকে রক্ষা করতে পারেননি।’
উর্বশীর মুখে একথা শুনে খাট থেকে লাফিয়ে পুরুরবা নামলেন। তখন পূর্বচিত্তি নকুলী (বেজি) হয়ে রাজার অন্তর্বাস হরণ করে পালালেন। অন্ধকারে সম্পূর্ণ নগ্ন রাজা মেষ দুটির অনুসন্ধানে বের হলেন। উর্বশীকে বললেন, ‘এখনই মেষ জয় করে এনে দিচ্ছি।’
ঠিক সেই সময় পূর্বচিত্তি (মতান্তরে গন্ধর্বরা) বিদ্যুৎ চমকালেন। বিদ্যুতের আলোয় উর্বশী দেখলেন মহারাজ পুরুরবা শর্ত ভঙ্গ করেছেন। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন দ্বারপ্রান্তে। ‘আপনাকে নগ্ন দেখতে পেলাম’- বলেই উর্বশী অন্তর্হিতা হলেন। তার পরের কাহিনী আগেই উল্লেখ করেছি। উর্বশী বিরহে পাগলের মতো দেশে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন পুরুরবা। কেঁদে কেঁদে সারা কুরুক্ষেত্র খুঁজে বেড়ালেন তিনি। সেখানে ছিল এক পদ্ম সরোবর। নাম তার অন্যতঃপ্রক্ষ! সেই সরোবরের তীরে নগ্নপদে, ছিন্ন পোশাকে আতুরের মতো পুরুরবা বিলাপ করতে করতে চলেছেন। সরোবরে অপ্সরারা হাঁস হয়ে চরছিলেন। উর্বশীও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। তিনি প্রেমিক পুরুরবাকে চিনতে পেরে সখীদের বললেন,-
এই সেই মানুষ, যার সঙ্গে আমি বাস করেছিলাম।’ সখীরা বললেন, এতে আমরা তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘তাই হোক।’ সঙ্গীদের নিয়ে উর্বশী আবির্ভূতা হলেন রাজার সামনে।
পুরবরা তার কাছে কাতর অনুনয় কলহন, হায়ে জায়ে মনসা তিষ্ঠ ওগো নিঠুরা জায়া, দাড়াও অনেক কথা বলার আছে
-তোমার সঙ্গে কথা বলে তবে বাতাসের মতো দুষ্পাপ্যা পুরুরবা, ঘরে ফিরে যাও। পুরুরব-আমি তোমাকে রমণ করতে ইচ্ছু করি। প্রিয়তমা, এই তুমিই রাত্রিদিন আমার সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত থাকতে।
উর্বশী-পুরুরবা, প্রত্যহ তিন-চারবার আমরা রতিক্রিয়ায় মগ্ন একই সপত্নী বিদ্বেষ আমার ছিল আমি ছাড়া তোমার আরও মহিলা ছিল। কিন্তু তুমি সেরে আমাকেই তুষ্ট করতে। করে তোমাকে পেয়ে ও তৃপ্ত ছিলাম। আমার অন্য কর সামার ঘরে আসত না।
উর্বশী-আমার যৌবনবতী শরীরে তোমার অমোঘ বীর্যের পতনে আমি আজ অন্তসত্ত্বা। জন্ম নেবে তোমার বীরপুত্র। ধরিত্রীকে সে রক্ষা করবে। আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, আর তোমার কাছে আমার থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু তুমি কিছুতেই শুনলে না। এখন নিষ্ফল অনুরোধ কোরো না। যাও, রাজকার্যে মনোনিবেশ কর।
পুরুরবা কবে তোমার পুত্র পিতাকে ভালবাসবে? আমার কাছে থাকলে সে কি কাঁদবে না? আমাদের এই প্রেমের কি কোনও মূল্য নেই? প্রিয়ে, কেন এই বিচ্ছেদ? এ বিরহ যাতনা সহ্য করার শক্তি যে আমার নেই।
উর্বশী-গর্ভস্থ সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। তোমার কাছে থাকলে সে অশ্রুপাত করবে না। ফিরে যাও পুরুরবা, আর আমাকে কামনা কোরো না। পুরুরবা-তোমার প্রণয়ী আজ ভূলুণ্ঠিত হোক,
তাহলে নেকড়ে, কাক, শেয়াল তাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাক।
উর্বশী-ছিঃ, পুরুরবা। মৃত্যু- কামনা কোরো না। নারীর মন নিতা চঞ্চল, কখনই একজনের উপর স্থির থাকে না। স্ত্রীলোকের প্রণয় স্থায়ী হয় না, তাদের হৃদয় নেকড়ের মতো। চার বছর তোমার দেহে দেহ লগ্ন করে কাটিয়েছি।
পুরুরবা আকাশচারিণী প্রেয়সী, তোমাকে আমার প্রশস্ত বুকে একদিন আলিঙ্গন করেছি। তোমার আসঙ্গ পুনরায় কামনা করি। হে উর্বশী, ফিরে এসো, আমার হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে। হৃদয়ং তপ্যতে মে। না, উর্বশী ফেরেননি। বুভুক্ষু অতৃপ্ত হৃদয় নিয়েই ফিরতে হয়েছিল মহারাজা পুরুরবাকে। তাঁর সেই আর্ত হাহাকার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যে- হৃদয়ং তপাতে মে–আমার হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে। ফিরে এসো, উর্বশী, প্রিয়া আমার। আর একবার তোমাকে আলিঙ্গন পাশে বাঁধতে চাই। ফিরে এসো।