মহাভারতের অষ্টাদশী – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

›› পৌরাণিক কাহিনী  ›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

আরম্ভে
মহাভারতের অষ্টাদশী। অষ্টাদশী কথাটা একটা সংজ্ঞা। আমি বিয়াল্লিশ বছরের ঈষৎ-মেদিনী দেখেছি কত, তাঁদের মনের ভিতর এখনও কেমন অষ্টাদশী খেলা করে। কত ষাট-বাষট্টির মহিলা দেখেছি—সতত রোমন্থনী—সংস্কৃতের কবিতমা শিলা ভট্টারিকা কি এঁদেরই কথা স্মরণ করেছিলেন সহস্রবার উচ্চারিত এই শ্লোকে—সেই আমার যৌবন সন্ধিতে আমার কুমারীত্ব হরণ-করা এই বর, সে তো সেই আছে, সেই চৈত্রের রাতগুলি তাও একই রকম আছে, এখনও উন্মীলিত মালতীর বুক স্পর্শ করে ঘুরে আসে প্রৌঢ়পুষ্প কদমফুলের হাওয়া, এমনকী আমিও তো সেই আমিই আছি, বদলাইনি একটুও, কিন্তু তবুও…তবুও বারবার মনে পড়ে সেই রেবা নদীর তীর, সেই বেতসীলতার যেখানে বারবার চুরি করে গিয়ে মিলিত হয়েছি তাঁর সঙ্গে—সা চৈবাস্মি রোধসি বেতসীতরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে। এই হল বিয়াল্লিশ-বাষট্টির দেহপুটে বললাম। প্রাচীনা এক রমণীই দুঃখ মন। আর পুরুষ মানুষের কথা নাই বা বলেছিলেন—এটা ঠিকও নয় এবং এটা মানায়ও না যে, পুরুষগুলোর শরীরে জরা ধরে যাবে, তবু তাদের লাম্পট্যের বিকার যায় না—যদিহ জরাস্বপি মান্মথাঃ বিকারাঃ। কথাটা সম্পূর্ণ মেনে নিয়েছিলেন বিদগ্ধ ভোজরাজ। তিনি এই কথার উত্তরে বলেছিলেন—তা হলে কি মেয়েরা ঠিক এইরকম নাকি যে, যৌবনবতীর মৃদু-কঠিন স্তন দুটি বয়সের ভারে একটু নমিত হতেই তাঁদের জীবনটাও শেষ হয়ে যায়, নাকি শেষ হয়ে যায় রতি-বিলাস-কলা—স্তনপতনাবধি যৌবনং বা রতং বা? ভোজরাজের প্রত্যুত্তরটা হয়তো একটু তীক্ষ্ম হয়ে গেছে বিদগ্ধা রমণীর মুখের ওপর জবাব দিতে গিয়ে এবং আমরা এটা বেশ জানি যে, শাস্ত্র এবং কাব্যে অশেষ রমণীকুলকে যতই কলঙ্কিনী করা হোক, যতই না তাঁদের অখিল পুরুষের ধৈর্য-ধ্বংসী যন্ত্রে পরিণত করা হোক, আমরা বেশ জানি—তার জন্য দায়ী পুরুষেরাই এবং দায়ী তাঁদের বিধিসৃষ্ট শরীরগ্রন্থিগুলি, আর হৃদয়গ্রন্থিও বটে।
মহাভারতের রমণী-মানস নিয়ে যদি গভীরভাবে চিন্তা করা যায়, তা হলে দেখা যাবে সেখানে একটা বড় দুশ্চিন্তা আছে মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে। এটা অবশ্যই সেই চরিত্র যার অবশেষ পরিণতি হল সেই সব নিন্দামুখর প্রবাদ- নারী নরকের দ্বার, কিংবা বিশ্বাসো নৈব কর্তব্যঃ স্ত্রীষু রাজকুলেষু চ। মেয়েদের সম্বন্ধে এইসব প্রচার যে, মেয়েরাই দুর্দম কামনায় পুরুষকে প্রলুব্ধ করে, তারাই সবচেয়ে বেশি কামুক এবং সুযোগ পেলে কোনও পুরুষকেই তারা ছাড়ে না—পুমান্ ইত্যেব ভুঞ্জতে—এই সব প্রচার কিন্তু ভারতীয় নীতি-উপদেশের জায়গা নয় শুধু, কিংবা নয় শাস্ত্রীয় সতর্কবাণী, এমনকী এটা একটা সামাজিক সিদ্ধান্তও শুধু নয়, এটা একটা সামগ্রিক বিশ্বাস যে, মেয়েরাই যত সর্বনাশ তৈরি করে।
একটি মেয়েই এখানে ত্রস্ত-ভীত নীতিবাগীশ বৃদ্ধের মতো বলে ওঠে—যৌনতার সমস্ত দোষের মূলে আছে মেয়েরা এবং তা সবাই জানে—স্ত্ৰিয়ো হি মূলং দোষাণাং তথা ত্বমপি বেত্থ চ। আমরা অবশ্য মনে রাখব যে, এই কথাগুলি যে বলছে সে একজন অপ্সরা, যার মধ্যে পৌরুষের গণ্যতা থাকে না, গম্যতাও নয় এবং ভাবনায় এটাও বুঝতে দেরি হয় না যে, পুরুষমাত্রেই যেভাবে সার্বিক কামনায় মথিত হয়, সেই মানসিক তথা যৌন মন্থনই এটা ঠিক যে, নারী-শরীরের গঠন, তার প্রতিফলিত-ভাবে নারীর মধ্যে দেখে পুরুষ। স্তন-জঘন-নিতম্বের ব্যঞ্জন স্বভাবতই অথবা সে আকর্ষণ দুর্দমনীয় বলেই কামুকতায় আলি’ পুরুষকে আকর্ষণ করে এবং ওপর যেন তারা আকর্ষণ করছে পুরুষ সমস্ত দোষটাই চাপিয়ে দেয় মেয়েদের পুরুষ আকৃষ্ট হচ্ছে, তা নইলে তারা শমদমের সাধনে এতটাই সিদ্ধ যে অশেষ রমণীকুল যদি চলাফেরা করে আকর্ষণ না করত তা হলে পুরুষেরা সব সময় উদাসীন চক্ষুতে ঊর্ধ্বরেতা হয়ে বসে থাকত।
কিন্তু স্ত্রীলোকের দিক থেকে ঔপপত্য কিংবা পুরুষের দিক থেকে পরকীয়ার কোনও সুস্থির পরিণতি নেই, তা নেহাৎই এক চরম আস্বাদন মাত্র। ব্যবহারিক জীবনে পরকীয়া কিংবা ঔপপত্যের ব্যাপারে কোনও শাস্ত্রীয় অনুমোদন থাকতে পারে না। ফলে মহাভারত সেখানে প্রায় নিশ্চুপ আর ধর্মশাস্ত্রের ভাবনাতেও প্রথাসিদ্ধ বৈবাহিক প্রেমের বাইরে নারী- পুরুষকে উৎসাহিত করাটা কোনও মহাকাব্যিক উদ্দেশ্য হতে পারে না। কিন্তু মহাভারতের সমসাময়িক সমাজ এবং তার পূর্বকল্পে জীবনচিত্রটাই এমন ছিল, যেখানে কন্যা অবস্থায় যাচিত এবং অযাচিত পুরুষ-সঙ্গমে স্ত্রীলোককে নিগ্রহের জায়গায় নিয়ে যায়নি। এমনকী বৈবাহিক জীবনেও ধর্ষণ এবং অতিক্রমের ঘটনায় স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা বা ভয়ংকর শাস্তি দেওয়া শাস্ত্রীয় অনুমোদনেই নিষিদ্ধ হয়েছে মহাভারতে। মহাভারতে সত্যবতী, কুন্তী এবং দ্রৌপদীর জীবনে বারবার যে প্রশ্ন উঠেছে—প্রথম সঙ্গমের পরেও তাঁদের কন্যাভাব সুস্থির থাকছে কিনা—এই কুটিল প্রশ্নে দেবতার বরদান বস্তুটাকে একটা অতিপ্রাকৃতিক স্যাংশন হিসেবে না মানলেও চলে। মাসান্তিক অথবা সন্তান জন্মের পর রজঃচক্রের আবর্তনেই স্ত্রী-শুদ্ধির ঘটনাটা এত উদার এবং মহান ভাবে বুঝেছে মহাভারত যে সেটাকে দেবতার বরদানের মতোই গ্রহণ করা যায়। এমনকী তাতে কঠিন-হৃদয় ধর্মশাস্ত্রকার অথবা স্মার্তেরও বিধান-নিদান বটে।

উর্বশী
ভরত মুনি এতকাল তাঁর নাটক চালিয়ে এসেছেন পুরুষ অভিনেতাদের দিয়েই। কিন্তু শৃঙ্গার-রসের নৃত্যনাটকে সুন্দরী স্ত্রীলোক ছাড়া যে কৈশিকী বৃত্তির প্রয়োগ সম্ভব নয়— এ তিনি ভালই জানতেন। ফলে ব্রহ্মার কথা শুনে তিনি একটু রেগেই গেলেন। তাঁর বক্তব্য আপনি তো বলেই খালাস— কৈশিকাঁটাও লাগাও। তা কৈশিকীর অভিনয়ের লোকজন দিন আমাকে। শুধু পুরুষমানুষ দিয়ে অভিনয়ের মধ্যে এই রসভাবসম্পন্ন শৃঙ্গার আমদানি করা সম্ভবই নয়, এর জন্য রমণী চাই, রমণী— অশক্যা ষঃ সা তু প্রযোক্তুং স্ত্রীজনাদৃতে। ব্রহ্মা আর দেরি করেননি। ভরত মুনির সিদ্ধ করার জন্য ব্রহ্মা তাঁর মন থেকে সৃষ্টি করলেন অপ্সরাদের। শৃঙ্গার রসের ভাব-ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তুলে অপ্সরারা ভরত মুনির কৈশিকী বৃত্তির প্রয়োগ ঘটালেন নৃে —নাটকে।
লক্ষণীয়, অপ্সরারা সৌন্দর্য্য এবং দিক থেকে প্রজাপতি ব্রহ্মার মানসসম্ভবা হলেও চারিত্রিক দিক দিয়ে তাঁদের ব্যবহার তৎকালীন সামাজিকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস যদি বেশ্যাদের অভিনয়ে প্রথম সমৃদ্ধ হয়ে থাকে, তবে সংস্কৃতের নাট্যশালাও পুষ্ট হয়েছিল স্বর্গবেশ্যা অপ্সরাদের অভিনয়ে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে গুপ্তযুগের তথা ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ কোষকার অমর সিংহের লেখা ‘অমরকোষ’ খুলুন। দেখবেন অপ্সরাদের পরিচয় দিয়ে তিনি বলেছেন, মেয়েদের মধ্যে উর্বশী, মেনকা, রম্ভার মতো অপ্সরারা হলেন স্বর্গবেশ্যা— স্বর্বেশ্যা উর্বশীমুখাঃ।
আমরা শুধু বলতে চাই— বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় যে নবরত্নের সমাহার ঘটেছিল, তার অন্যতম রত্ন, কোষকার অমর সিংহ যদি মুখ বলে থাকেন, স্বর্বেশ্যা উর্বশীমুখাঃ— তবে অন্যতর কালিদাস উর্বশীকে বিখ্যাত করে দিয়েছেন পুরু-ভরতবংশের হিসেবেই। সবচেয়ে বড় কথা, সুরসুন্দরী মহাভারত-পুরাণে বিখ্যাত হয়ে আছে, যেখানে অপ্সরাদের সতত অস্থির যে শীকে স্বর্গবেশ্যাদের প্রধান পরিচিত উর্বশীর মধ্যে আমরা সম্পূর্ণা এক প্রেমিকার হৃদয় দেখেছি সুপ্রাচীন ঋগ্‌বেদের মধ্যেই, দেখেছি সুরসুন্দরীর জননী হয়ে ওঠার পরিণতি। স্বয়ং কালিদাসও এই বৈদিক মন্ত্রণা ভুলতে পারেননি বলেই উর্বশীকে নামিয়ে এনেছেন একান্ত মানবিক সত্তার মধ্যে যেখানে পূর্বরাগ, প্রেম, শৃঙ্গার, বিরহ শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব-কৌরব-বংশের আদি-প্রসূতিকে জননীর স্নেহ- পরিণতির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে।
আমাদের ইতিহাস-পুরাণে অপ্সরাদের সম্বন্ধে যা বলা আছে, তাতে প্রথম যেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অপ্সরাদের মতো এমন সুন্দরী আর পৃথিবীতে নেই। আর এমন ভীষণ রকমের সুন্দরী হলে এমনিতেই আপন সৌন্দর্য-সচেতনতা এবং অনন্ত পুরুষের লোভদৃষ্টিতে নিজেকে প্রথাগত নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠা করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এমনিতে একটা কথাই আছে যে, রাজার ঘরে অতিরিক্ত বেশি সময় থাকলে বামুনের চরিত্র নষ্ট হয়, আর অতিরিক্ত রূপ থাকলে নষ্ট হয় স্ত্রী— স্ত্রী বিনশ্যতি রূপেণ ব্রাহ্মণো রাজসেবয়া। কিন্তু এই লোকমুখরতা যদি নাও মানি, তবুও বলতে হবে যে, স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের পৌরাণিক উদ্ভবের মধ্যেই নষ্ট হওয়ার মন্ত্র লুকানো আছে, কিন্তু তার মধ্যে নিজে নষ্ট হওয়ার চেয়েও অন্য পুরুষকে নষ্ট করার মন্ত্রণা আরও বেশি। অবশেষে এর চেয়েও কুটিল যুক্তিতে আমার মনে হয়— পুরুষ মানুষ স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে নিজে নষ্ট হওয়ার জন্যই এমন একটা পৌরাণিকী ব্যবস্থা সামাজিকভাবে রেখে দিয়েছে যাতে শেষ জায়গায় এসে বলা যাবে— আমি শান্ত, দান্ত মুনি-ঋষি মানুষ। সমস্ত সংযম করপুটে রাখা আমলকীর মতো আমার হাতের মুঠোয়, কিন্তু কী করব— ওই অপ্সরা মেনকা, রম্ভা, ঘৃতাচী-পুঞ্জিকস্থলা— ওদেরই ছলা-কলায় আমার এই দশা হল।
আসলে শুধুই সৌন্দর্য্য নয়, তার সঙ্গে বৈদগ্ধ্যও আছে। ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে একথা প্রমাণিতই হয়ে যাবে যে, সৌন্দর্য্যের সঙ্গে শাস্ত্রীয় কলা এবং বিদ্যা-বৈদগ্ধ্যের প্রধান আধার ছিলেন গণিকারাই। আর এ-প্রসঙ্গে আমরা বিস্তারিত তথ্য এই প্রবন্ধে জানাব না। তবে এটা অবশ্যই বলব যে, অতিশয়ী সৌন্দর্য্যের সঙ্গে যদি বিদগ্ধতার অতিশয় যুক্ত হয় তবে সেই রমণী চিরকালই বেশির ভাগ পুরুষের অনায়ত্তা ছিলেন বলেই গণিকার সম্বোধন লাভ করতেন। এক নিপুণ কবি বলেছিলেন, ওরে মেনকা-রম্ভাদের সঙ্গে কীভাবে সম্ভোগ উপভোগ করতে হয়, সে জানেন সুরপতি ইন্দ্র। তোদের মতো দাসী-চাকরানিদের পিছনে ঘোরা লোকেরা রম্ভা-মেনকাকে বুঝবে কী হয়তো এই শ্লোকের মধ্যে যৌনতার নয়, সেটা জানিয়ে রাখাই ভাল। তবে পার্থক্য এইখানেই যে, যৌনতা এখানে, করে অন্য কিন্তু অপ্সরা মানেই যে যৌনতা অনেক বেশি সার্বত্রিক এবং ররের জানাতি রম্ভাসংযোগবিভ্রমম্। না, এখানে ‘ফ্লন্ট’ করার একটা গার্হস্থ্য রমণীকুলের সঙ্গে অপ্সরাদের -বিলীন কোনও নিশ্চেষ্ট বৃত্তি হিসেবে থাকে
আছে। আজকের দিনে অবশ্য ‘ফ্লন্ট’ করার ঘটনা কারণ হিসেবে সুব্যবস্থিত তর্কযুক্তিও হাজির করেন যুক্তিবাদীরা। সিডনির ‘মর্নিং হেরাল্ড’ কাগজে পল শিহান বলে একজন লিখলেন যে, অল্পবয়সি মেয়ে এবং অবশ্যই তরুণীরাও মাঝে মাঝে বড় অশালীন হয়ে ওঠে; যে-সব জামা-কাপড় তারা পরে, তাতে পুরুষকে ‘প্রোভোক’ করার সমস্ত উপকরণই মজুদ থাকে, এরা অনেক সময়েই বিপজ্জনক যৌন মিলনকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলে এবং কোনও না কোনও সময়ে অন্তঃসত্ত্বাও হয়ে পড়ে। শিহান মন্তব্য করেছেন, এমনটি যারা করেছে বা করে তারাই স্বাভাবিক, আমরাই অস্বাভাবিক। জামা-কাপড়ের বিভিন্ন যত নমুনা আছে— যাতে শরীর স্ফুটাস্ফুট ব্যঞ্জনায় যৌন মহিমায় প্রকট হয়ে ওঠে, সে-সবই নাকি সতেরো থেকে তেইশের মধ্যে অতিস্বাভাবিক, কেননা এই সময়ে তারা রমণীজনোচিত উর্বরতার তুঙ্গে থাকে। ফলত এই অবস্থায় যে-মেয়েরা নিজেদের বিজ্ঞাপিত করে অথবা ‘ফ্লন্ট’ করে, সেখানে তাদের অন্তর্গত যৌন তীব্রতাই কাজ করে এবং সেটা জুডো-খ্রিস্টান নৈতিকতা মেনে কাজ করে না, এবং সেটাই স্বাভাবিক ।

পল শিহান কিন্তু এতাদৃশী রমণীদের কথা বলেননি। তিনি সতেরো থেকে তেইশের সাধারণ মেয়েদের কথা বলেছেন অথবা বলেছেন অধিকয়সা তরুণীদের কথা, শারীরিক উর্বরতা যাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং সেই কারণে তারা শরীরের চটুলতা না করে পারে না। আর অপ্সরারা কী রকম? না, তাঁরা দেবকার্য-সাধনের জন্য নিজেদের ‘এক্সপোজ়’ করেন ‘ফ্লন্ট’ করেন। কিন্তু তাতে অপ্সরাদের কী হয়? ধ্যানভঙ্গ করে দেবতারা না হয় নিজের সিদ্ধি গুছিয়ে নিলেন। কিন্তু তাতে অপ্সরারা কী পাচ্ছেন? আপন সৌন্দর্য্যে অন্যান্য ঋষিদেরও ধ্যানভঙ্গ করতে পারছেন শুধু এই সাফল্যের গর্ব! আমরা বলব—বরং এটাই মেনে নেওয়া ভাল যে, রূপ-গুণের গৌরবে যে-সব সুন্দরী রমণীরা খানিক উর্বরতার আকর্ষকী তাড়না অনুভব সামাজিক সতীত্বে যাঁরা তেমন
‘ফ্লন্ট’ কিংবা ‘এক্সপোজ়’ করার ব্যাপারে করতেন না, তাঁরাই আমাদের স্বর্গসুন্দরী অপ্সরা।
প্রসঙ্গত পুরুষদের কথাটাও বলে নেওয়া ভাল। সামাজিক সৌজন্যে এবং পারিবারিক মহিমা প্রকটিত করার জন্য যত লক্ষ্মীমতী এবং মহা-মহিম মর্যাদাময়ী রমণীই পুরুষ-মানুষরা পছন্দ করুন না কেন, উপভোগ-শয্যাতে সেই লক্ষ্মীমতীর কাছেই কিন্তু পুরুষেরা বেশ্যার ব্যবহার আশা করেন। তা নইলে এমন সংস্কৃত নীতিশ্লোক তৈরি হত না যে, এমন বউটি সত্যিই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে খাওয়া-দাওয়া করাবে মায়ের মতো, বাড়ির কাজ করবে দাসীর মতো, আর রেতের বেলায় বিছানায় হয়ে উঠবে বেশ্যার মতো— কার্যে দাসী রতৌ বেশ্যা ভোজনে জননীসমা।
নর-নারায়ণ যুগল-ঋষির তপস্যার স্থানটি পর্বত। সেখানে ভালবাসার দেবতা শুরু হল বকুল গাছে বকভাবেই ছিল অতি মনোরম গন্ধমাদন মুনি-যুগলের ধ্যান ভাঙাতে। অকালে -রস্তার মতো কাম-সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হলেন ফুল ফুটল সেখানে, কোকিল কুলের আলাপ বৃক্ষাগ্রেষু মনোহরাঃ। রম্ভা- তিলোত্তমা মনোহরণ শরীর-বিভঙ্গে নাচতে আরম্ভ করলেন দুই মুনির সামনে, সঙ্গে চলল তন্ত্রী-লয়- সমন্বিত গান। অপ্সরাদের মধুর নৃত্য-গীত শুনে মুনিদের ধ্যান ভাঙল এবং সাময়িক বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করলেন— কী হয়েছে বলো তো? আজ কি হঠাৎ কালধর্মের বিপর্যয় ঘটে গেল— কালধর্ম-বিপর্য্যাসঃ কথমদ্য দুরাসদঃ। এমন তো হবার কথা ছিল না। সমস্ত প্রাণীদের কেমন কামাতুর বলে মনে হচ্ছে। বসন্তলক্ষ্মীর এই আগমন ও তো স্বাভাবিক নয়। সুরসুন্দরীরা এত সুন্দর সব গান করছে। আমার তো মনে হচ্ছে— এর মধ্যে দেবরাজ ইন্দ্রের কোনও চক্রান্ত আছে, তিনি আমাদের ধ্যানভঙ্গ করার জন্যই এত সব আয়োজন করেছেন। এরই মধ্যে নৃত্যপরা অপ্সরা-সুন্দরীদের ওপর নজর পড়ল দুই ঋষির। দেখলেন— এক-দু’জন নয়, রম্ভা-তিলোত্তমা, মেনকা-ঘৃতাচী থেকে আরম্ভ করে কাঞ্চনমালিনী-বিদ্যুন্মালারাও আছেন। রম্ভা-তিলোত্তমাদের যত মনোমোহিনী শক্তিই থাক, তাঁরা কিন্তু মুনি-যুগলকে দেখে ভয়ও পাচ্ছেন একটু-একটু। কিন্তু দেবকার্য-সিদ্ধির জন্য তাঁরা পুনরায় নৃত্য আরম্ভ করলেন মুনিদের সামনে। অপ্সরারা মুনিদের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে যথোচিত সম্মান পুরঃসর নৃত্য আরম্ভ করলেও তাঁদের নৃত্যের বিষয় ছিল কামোদ্দীপক।
মুনিরা নিজেদের পরিশীলন অনুসারেই বুঝে গেলেন সব কিছু। বুঝে গেলেন— এখানে অপ্সরাদের দোষ নেই কিছু। তাঁদের মনোহরণ ভঙ্গি দেখে এতটুকুও অভিভূত না হয়ে নারায়ণ ঋষি তাঁদের বললেন, হ্যাঁগো ! তোমরা তো সব এখানে স্বর্গ থেকে আমার অতিথি হয়ে এসেছ। তো বসো সব এখানে। আমি যথাসাধ্য আতিথ্য করব তোমাদের। অপ্সরাদের সঙ্গে এত ভাল করে কথা বললেও যুগল ঋষির অন্যতম নারায়ণের মনে একটু রাগ- অভিমানও হল এবং সেটা হয়তো দেবরাজ ইন্দ্রের ওপরেই। তিনি মনে মনে ভাবলেন— বেশ তো তিলোত্তমা-রম্ভাদের পাঠিয়েছেন দেবরাজ। কিন্তু এ আর এমন কী! সৌন্দৰ্য বস্তুটার কি অন্ত আছে কোনও! আমি এদের চেয়েও শতগুণ সুন্দরী অপ্সরা সৃষ্টি করতে পারি নতুন করে— বরাক্যঃ কা ইমাঃ সর্বাঃ সৃজাম্যদ্য নবাঃ কিল। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঋষি নারায়ণ নিজের ঊরুতে চপেটাঘাত করলেন একবার। অমনই তাঁর ঊরু থেকে সৃষ্টি হল এক সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণীর। নারায়ণের ঊরু থেকে জন্মালেন বলেই তাঁর নাম হল— উর্বশী— নারায়ণোরুসম্ভূতা হু্যর্বশীতি ততঃ শুভা। উর্বশীর রূপ দেখে স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের মনে চমৎকার তৈরি হল। তাঁরা লজ্জায় নারায়ণ ঋষির কাছে মাথা নত করলেন। নারায়ণ ঋষি বললেন— তোমাদের ওপর আমার কোনও ক্ষোভ নেই। আমি আমার এই ঊরু- সম্ভবা উর্বশীকে দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তোষের জন্য উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছি। এই পরমাসুন্দরী তোমাদের সঙ্গেই যাক দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে— উপায়নমিয়ং বালা গচ্ছত্বদ্য মনোহরা।
রম্ভা-তিলোত্তমারা এবার উর্বশীকে নিয়ে উর্বশীকে নিবেদন করলেন ইন্দ্রের কাছে। ইন্দ্ৰ বাক হলেন যুগল ঋষির তপস্যার শক্তি দেখে, যে শক্তিতে উর্বশীর মতো এমন স্বতপসা তাদৃরূপাঃ প্রকল্পিতাঃ। করেছিলেন অসামান্যা উর্বশীর—সৃষ্টি হতে পেরেছে যেনোবশ্যাঃ নারায়ণ ঋষি তাঁর তপোবল ক্ষয় করে সৃষ্টি নারীং সর্বাঙ্গসুন্দরীম— আর স্বর্গ ঋষিকে, তাঁদের পরিচর্যার জন্য তিনি আরও অনেক সমতুল্য অপ্সরাদের সৃষ্টি করেন। তারপর যখন উর্বশীকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হল, তখন এঁরাও উর্বশীর অনুগামিনী হয়ে স্বর্গরাজ্যে চলে গেলেন। এই সম্পূর্ণ কাহিনি থেকে উপাখ্যানের আবরণটুকু ছেড়ে দিলে এইটুকু আমাদের মনে আসে যে, উর্বশী সমস্ত মনুষ্য- কুলের তপস্যার ফল এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে স্বর্গের অলৌকিকতার চেয়েও নর এবং নারায়ণের মানুষী ভাবনাটাই বড় হয়ে ওঠে।
উর্বশী কিন্তু নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিতে পারলেন না। বললেন— রাজা, তোমাকে দেখা অবধি আমার মন জ্বলছে রিরংসায়। কিন্তু তবু আমার একটা শর্ত আছে, রাজন।
সুরলোকের শ্রেষ্ঠতমা রূপসির রিরংসার কথা জেনেও পৃথিবীতে এমন কোনও পুরুষমানুষ আছে যে তাঁর শর্তে রাজি না হবে? পুরূরবা বললেন, বলো তোমার শর্ত। উর্বশী দুটি মেষ শাবকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, মহারাজ, এই দুটিকে আমি পুত্রস্নেহে লালন করেছি। এই দুটি আমার শয্যার দুই পাশে বাঁধা থাকবে, এদের সরানো চলবে না। উর্বশী এবার বললেন, আমি তোমাকে মৈথুনের সময় ছাড়া অন্য কোনও সময় নগ্ন দেখতে চাই না, রাজা। এবং আমাকে অন্য কিছু খাবার জন্য অনুরোধ করবে না তুমি, আমি শুধুই ঘি খেয়ে থাকব— ঘৃতং মে বীর ভক্ষ্যং স্যান্নেক্ষে তান্যত্র মৈথুনাৎ।
পুরূরবা রাজি হলেন উর্বশীর শর্তে। তারপর উর্বশীর রমণ-সুখে তাঁর দিনরাত কোথা দিয়ে যেতে লাগল তা টেরও পেলেন না রাজা। উর্বশীকে নিয়ে কখনও তিনি চৈত্ররথের বনে, কামনার মোক্ষধাম অলকাপুরীতে বেড়াচ্ছেন, কখনও-বা মানসসরোবরে কমল-কলির মধ্যে জলক্রীড়া করছেন, কখনও বা স্বর্গসুন্দরীর সঙ্গে বিজন রহস্যালাপ চলছে বহুক্ষণ ধরে।
এতসব দেখে গন্ধর্ব বিভাবসু আরও সব গন্ধর্বদের নিয়ে উর্বশীকে রাজার হৃদয় থেকে সরিয়ে আনার চক্রান্ত করলেন। একদিন গভীর রাতে, অন্ধকার যখন প্রায় গ্রাস করে ফেলছে প্রতিষ্ঠানপুরের রাজপ্রাসাদ, সেইসময় গন্ধর্ব অন্য গন্ধর্বদের সঙ্গে এসে
সবার অলক্ষিতে রাজার অন্তঃপুরে ঢুকলেন।
রাজা তখন বিবস্ত্র অবস্থায় উর্বশীর সঙ্গে শুয়ে আছেন। গন্ধর্বরা উর্বশীর শয্যার পাশ থেকে একটি মেষশাবক তুলে নিয়ে চলে গেল। মেষের ডাক শুনে মাঝরাতেই উর্বশীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বলে উঠলেন- নিশ্চয়ই অনাথ, নইলে আমার ছেলের মতো মেষশাবকটিকে হরণ করবে কে? হায় হায় কী করি, কার কাছেই বা যাই !
পুরূরবা সব শুনলেন, কিন্তু উর্বশী তাঁকে নগ্ন অবস্থায় দেখে ফেলবেন— এই ভয়ে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন না— নগ্নং মাং দেবী প্রক্ষ্যতীতি ন যযৌ। রাজাকে নির্বিকার দেখে গন্ধর্বরা এবার দ্বিতীয় মেষটিকেও হরণ করল। উর্বশী আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন— এক রত্তি ক্ষমতা নেই, অথচ দেখায় যেন ওঁর কত ক্ষমতা। আসলে একটা নপুংসক স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার— কুনাথেন নপুংসসা বীরমানিনা। নইলে আমার ছেলে নিয়ে যাচ্ছে চোরে, আর উনি! পুরুষমানুষ বাইরে গেলে মেয়েছেলে যেমন দরজা বন্ধ করে দিনের বেলা ঘুমোয়, সেইরকম ঘুমোচ্ছেন- যঃ শেতে নিশি সন্ত্রস্তো যথা নারী দিবা পুমান্ ।
পুরূরবা আর থাকতে পারলেন না। সেই বিবস্ত্র অবস্থাতেই বিছানা ছেড়ে উঠে খড়্গা হাতে নিয়ে বেরোলেন উর্বশীর মেষশাবক ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু যেই না তিনি বেরোতে যাবেন, এই সময় গন্ধর্বরা বিদ্যুতের স্ফুরণ ঘটাল আকাশে। চকিত ক্ষণপ্রভায় উর্বশী দেখলেন— রাজা উলঙ্গ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজবাড়ি থেকে চলে গেলেন অন্যত্র—— তৎপ্রভয়া চোৰ্বশী রাজানম্ অপগতাম্বরং দৃষ্ট্বা অপবৃত্তসময়া তৎক্ষণাদেব অপক্রান্তা। রাজা তো এই মারি কি সেই মারি করে বেরিয়েছিলেন, এদিকে গন্ধর্বরা কাজ হয়ে গিয়েছে দেখে মেষশাবক ফেলে রেখে পালাল। রাজা পরম পুলকে মেষদটি কোলে করে বাড়ি ফিরে দেখলেন— উর্বশী নেই। উর্বশীর প্রেমে আকুল পুরূরবা সেই নগ্ন অবস্থাতেই উন্মত্তের মতো বেরিয়ে পড়লেন উর্বশীকে খুঁজতে— তাঞ্চ অপশ্যন্ অপগতাম্বর এর উন্মত্তরূপো বভ্রাম। এখানে-সেখানে পরিচিত-অপরিচিত নানা জায়গায় খুঁজে পুরূরবা উপস্থিত হলেন কুরুক্ষেত্রে। দেখলেন এক কমল-সরোবরে অন্যান্য অনেক অপ্সরাদের সঙ্গে জলক্রীড়ায় মত্ত উর্বশী।
পুরাণকারের হৃদয় অবশ্য বড়ই দয়াপ্রবণ। তাঁরা পুরূরবাকে একেবারে নিরাশ করেননি। রাজা যখন পদ্ম সরোবরের তীরে দাঁড়িয়ে উর্বশীকে বারবার ফিরে আসার অনুরোধ জানাচ্ছেন, তখন উর্বশী বললেন— কেন এমন অবিবেচক পাগলের মতো করছ! আমার গর্ভে তোমারই ছেলে আছে। তুমি ঠিক এক বছর পরে আবার এইখানে ফিরে এসো। তখন তোমার ছেলেকে তোমারই কোলে দেব, আর সম্পূর্ণ এক রাত্রি ধরে তোমার সঙ্গে মিলন- সঙ্গম উপভোগ করব আমি— সংবৎসরান্তে হি ভবানেকরাত্রং ময়েশ্বরঃ রংস্যতি। পুরূরবা বড় খুশি হয়ে রাজধানীতে ফিরলেন— তবু তো এক রাত্রির জন্য তিনি পাবেন উর্বশীকে। পুরূরবা ফিরে চলে গেলে কমলসরোবরের যত স্নান-সহচরী অপ্সরারা ঘিরে ধরল উর্বশীকে। উর্বশী বললেন, ইনিই আমার সেই পুরুষ-রত্ন পুরূরবা, যাঁর ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে এতকাল তাঁরই সহবাসে দিন কেটেছে আমার। অপ্সরারা বলল— কী সুন্দর! কী সুন্দর! ইচ্ছা হয় ভাই, আমরাও এমন পুরুষের সঙ্গে রসে-রমণে সারা জীবন কাটিয়ে দিই— অনেন সহাস্মকমপি সর্বকালমভিরন্তুং স্পৃহা ভবেদিতি।
পুরূরবা কিন্তু এমনটি চান না। উর্বশী ছাড়া দ্বিতীয় কোনও সত্তা তাঁর হৃদয় অধিকার করে না। এক বছর পরে তিনি আবার এসেছেন উর্বশীর সংকেতিত স্থানে। একটি দুর্লভ রাত্রি উর্বশীর সহবাসে ক্ষণিকের মধ্যে কেটে গেল। অবশ্য রাজা তাঁর প্রথম পুত্র ‘আয়ু’-কে লাভ করলেন এরমধ্যে এবং দ্বিতীয় পুত্রের গর্ভাধান করে এলেন। উর্বশীর সঙ্গে মাত্র পাঁচ রাত্রির আঙ্গিক মিলনের অধিকারে পুরূরবা আরও পাঁচটি পুত্রের জনক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, পাঁচ বছরে পাঁচটি রাত্রি মাত্র ভিক্ষা পেয়ে ও পুরূরবা উর্বশীকে স্মরণ করেছেন আরও গভীরভাবে। এই স্মরণের অনন্যতার মধ্যেই উর্বশী বুঝেছেন পুরূরবা তাঁকে ছাড়া জানেন না। পুরূরবাকে তিনি বলেছেন— আমাকে তুমি এত ভালবাস, তাই আমার সগন্ধতায় গন্ধর্বরা তোমার উপর খুশি হয়েছেন। তুমি বর চাও তাঁদের কাছে। রাজা বর চাইলেন এবং তাঁদেরই করুণায় হোম করে তিনি একাত্ম হলেন উর্বশীর সঙ্গে উর্বশীলোকে।

কত কষ্টের তপস্যায় মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে অর্জুন স্বর্গে পৌঁছেছেন ইন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে। কচি-কাঁচা ছেলে স্বর্গে গিয়েছে তার জন্মদাতা বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সুন্দরী স্ত্রীলোকের ব্যাপারে এমনিতে অর্জুনের কিছু দুর্বলতা আছে; সে আমরা উলূপী, চিত্রাঙ্গদাকে দিয়েই বেশ বুঝেছি। কিন্তু পাড়ার মেয়ে এক কথা, আর স্বর্গের মতো বিদেশ-বিভুঁই, সে বড় ভয়ানক কথা। আমাদের বন্ধু-বান্ধব দু-একজনা— অরুণ-বরুণ এই শ্যাম বঙ্গদেশে শ্যামলা- কমলাদের সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়েছিল, তাদের কয়েকজনকে দেখলাম মেমসাহেবদের দেশে গিয়ে, একেবারে থম মেরে গেল। ছেলেমেয়ের নির্বিচার ‘ডেটিং-ফেটিং’ দেখে তারা কোথায় সুযোগ নেবে, না একেবারে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে গর্তে ঢুকে পড়ল। আমাদের অর্জুনেরও ওইরকম থম-মারা অবস্থা হল স্বর্গসুন্দরীদের দেখে। বাবা ইন্দ্র ছেলেকে দেখে অর্ধাসন ত্যাগ করে সানন্দে তাঁকে বসতে দিলেন বটে, কিন্তু বাবার বৈজয়ন্ত প্রাসাদের সভায় অর্জুন যা দেখলেন, তাতে তিনি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। অর্জুন দেখলেন উর্বশী- মেনকারা সব নাচ জুড়েছেন দেবসভায় এবং তাঁদের নাচের ঠমক-গমক দেখলে একেবারে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হবে। অর্জুনের মনোভাব বুঝে মহাভারতের কবি নাচনিদের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন— এঁরা হলেন সব বরাঙ্গনা। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করা মহাপুরুষরা পর্যন্ত এঁদের দেখলে পরে পাগল হয়ে যান। আর এখানে তাঁদের অঙ্গভঙ্গি কেমন? বিশাল নিতম্বে তরঙ্গ তুলে— মহাকটিতটশ্রোণ্যঃ কম্পমানৈঃ পয়োধরৈঃ- পয়োধরের ঈষৎ-চকিত কম্পনে মাতাল করে দিয়ে ইন্দ্রসভার অপ্সরারা হাবে-ভাবে, কটাক্ষে মানুষের বুদ্ধিটাই মোহিত করে দিচ্ছে সম্পূৰ্ণ।
চিত্রসেনের কথা শুনে উর্বশী বেশ হলেন। মুচকি হেসে তিনি বললেন— তাতে কোন মেয়ে তাকে না চাইবে অর্জুনের যত গুণের কথা তোমার কাছে বলো? একে তো দেবরাজ বলেছেন, তাতে আবার তুমি যেমন তাঁর গুণপনা বলছ— সেসব শুনেই তো অর্জুনের উপর আমার কামনার উদ্রেক হচ্ছে– তস্য চাহং গুণৌঘেন ফাল্গুনে জাতমন্মথা। উর্বশী চিত্রসেনকে কথা দিয়ে দিলেন— তুমি ভেব না। আমি ঠিক সময়মতো চলে যাব তাঁর কাছে।
গন্ধর্ব চিত্রসেনকে বিদায় দিয়ে উর্বশী ভাল করে স্নান করলেন। অর্জুনকে তিনি ইন্দ্রসভায় দেখেছেন। তাঁর কথা ভাবলেই এখন তাঁর মন কামনায় পীড়িত হচ্ছে— মন্মথেন প্রপীড়িতা। উর্বশী খুব সাজলেন। গলায় সাতনরি হার পরে, গায়ে সুগন্ধ মেখে মনে মনে তিনি এতটাই অর্জুনের কাছে চলে গেলেন যে, তাঁর মনে হল যেন অর্জুন উর্বশীর মহার্ঘ শয্যাতেই এসে পড়েছেন এবং তিনি যেন রমণে প্রবৃত্ত হয়েছেন অর্জুনের সঙ্গে— মনোরথেন সংপ্রাপ্তং রময়ত্যেব হি ফাল্গুনম্।
উর্বশী অর্জুনের ঘরের দিকে চললেন। আকাশে চাঁদের আলো এবং রজনির অন্ধকার— দুই-ই গাঢ় হল। বেণিতে টাটকা ফুলের মালা গুঁজে, স্তনের উপর কুঙ্কুম-চন্দনের অলকা- তিলকা এঁকে, সূক্ষ্মবস্ত্রের স্ফুটাস্ফুট ব্যঞ্জনায় জঘন দেশে ঢেউ তুলে উর্বশী চললেন— সূক্ষ্মবস্ত্রধরং রেজে জঘনং নিরবদ্যবৎ। যাওয়ার সময় কামোদ্রেকের জন্য একটু মদ্যও পান করে নিলেন উর্বশী— সীধুপানেন চাপ্লেন। জনহীন স্বর্গপথে চাঁদের জ্যোৎস্নাকে সাথি করে, মিহি সুরে গান করতে করতে উর্বশী যখন চলতে আরম্ভ করলেন, তখন তাঁর সূক্ষ্মবস্ত্রের অন্তরালেও পীন পয়োধরের উল্লম্ফনটুকু দৃশ্যত রোধ করা গেল না।— গচ্ছন্ত্যা হাররুচিরৌ স্তনৌ তস্যা ববল্পতুঃ।
উর্বশী এসে পড়েছেন অর্জুনের বাড়িতে। দারোয়ান খবর দিল স্বর্গসুন্দরী উর্বশী আপনার সেবায় উপস্থিত। অর্জুন কিন্তু এতটা ভাবেননি। এগিয়ে এসে স্বাগতভাষণ করে ঘরে নিয়ে যাবেন কী, তার আগে উর্বশীর সাজগোজ দেখে অর্জুন চক্ষু মুদে রইলেন। তারপর তাঁর উচ্ছ্বাসে জল ঢেলে দিয়ে বললেন— মা! আপনি অপ্সরাদের মধ্যে প্রধান, আপনাকে প্রণাম। বলুন, কী আদেশ? স্বর্গসুন্দরীর সমস্ত সম্মান ধুলোয় মিশে গেল যেন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল উর্বশীর।
বললেন— কী যা-তা বলছ? ওই যে ইন্দ্রসভায় নাচবার সময় আমার দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলে তুমি— অনিমিষং পার্থ মামেকাং তত্র দৃষ্টবান্— এমনকী তোমার বাবা ইন্দ্র পর্যন্ত সেই বেহায়া চাউনি দেখে গন্ধর্ব চিত্রসেনকে দিয়ে আমায় খবর পাঠালেন যে, তোমার কাছে যেতে হবে আমায়— সেসব কী তা হলে মিথ্যা?
একটা প্রশ্ন এখানে উঠবেই। আপনারা বলতেই পারেন— কোথায় সেই পুরূরবা, অর্জুনের কতকাল আগের পুরুষ, আর কোথায় অর্জুন? এ উর্বশী কি সেই উর্বশী? পুরাতনেরা বলবেন— স্বর্গের অপ্সরা বলে কথা। তাঁদের বয়স বাড়ে না, তাঁরা চিরযৌবনা
অতএব উর্বশী যখন সানুরাগে যাচিকার অনুনয়ে বললেন— না অর্জুন, তোমার পিতা কিংবা চিত্রসেনের কথাতেই শুধু নয়, আমিই তোমাকে চেয়েছি। তুমি আমারও আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ, আমি নিজেই তোমার কাছে এসেছি— মমাপ্যেষ মনোরথঃ— তখনও কিন্তু অর্জুন কানে আঙুল দিলেন। বললেন— আপনি যা বললেন, আমার সে কথা না শুনলেই ভাল হত— দুঃশ্রুতং মেহস্তু সুভগে। সম্মানের প্রশ্নে আপনি আমার কাছে জননী কুন্তীর মতো, অথবা ইন্দ্রপত্নী শচীর মতো। আমি যে আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তার কারণ আমার বিস্ময়। ভাবছিলাম, এই উর্বশী আমাদের পুরুবংশের জননী! উর্বশী এই মাতৃ সম্বোধনে মোটেই সুখী হলেন না। বললেন– দেখো, আমরা হলাম গিয়ে অপ্সরা। আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই যে, আমরা কুলবধূদের মতো একটি স্বামী নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেব— অনাবৃতাশ্চ সর্বা স্মঃ— আমরা সবার কাছেই মুক্ত। তোমার ওই পুরুবংশের কত পুরুষ, এমনকী তাঁদের পুত্র-প্রপৌত্ররা পর্যন্ত—- যাঁরাই আপন পুণ্যবলে এই স্বর্গলোকে এসেছেন, তাঁরাই আমাদের সঙ্গে রমণসুখ অনুভব করে গেছেন, কেউ বাদ যাননি— তপসা রময়ন্ত্যস্মান্ ন চ তেষাং ব্যতিক্রমঃ। আর এতসব তুমি যদি নাও বোঝো, তা হলে শেষ কথাটা বলি শোনো— তোমাকে দেখার পর থেকে কামনায় শরীর জ্বলছে আমার, আমি তোমাকে চাইছি, অতএব তুমিও আমাকে চাইবে, এটাই কথা— এমন করে চাইলে তুমি কিছুতেই ধর্মত আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না— তৎ প্রসীদ ন মামার্তাং ন বিসর্জয়িতুমর্হসি।
অর্জুন বললেন– এবার আমার অন্তরের সত্য কথাটাও শুনুন। আমি এই স্বর্গের দেব- দেবীদের শপথ নিয়ে আবারও বলছি— আমার কাছে আমার মা কুন্তী-মাদ্রী যেমন সম্মানিত, যেমন সম্মানিত ইন্দ্রপত্নী শচীদেবী, আপনিও আমার কাছে তেমনই মায়ের মতো, এমনকী তার চেয়েও বেশি, কেননা আপনি আমার এই বংশেরই আদি জননী —কামার্তা এবং স্বয়মাগতা রমণীর সকাম নিবেদনের মধ্যে এমন সম্পর্কশুদ্ধির গঙ্গাজল ঢেলে দিলে তার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। স্বর্গের অধুনাতনী সুন্দরীতমারও রাগ হল। উর্বশী বললেন— তোমার পিতা চেয়েছিলেন— আমি তোমার কাছে আসি, তাই তোমার ঘরে এসেছিলাম আমি; আর আমিও তোমাকে দেখে মুগ্ধা কামিনী হয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এমনটা দেখেও যেভাবে অনভিনন্দনে মুখ ফিরিয়ে নিলে— যস্মান্মাং নাভিনন্দেথাঃ স্বয়ঞ্চ গৃহমাগতাম্— তাই আমিও তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি— তুমি মেয়েদের মধ্যে বাস করবে নপুংসকের মতো, কেউ তোমাকে আর পুরুষ বলবে না— অপুমানিতি বিখ্যাতঃ যণ্ডবদ্ বিচরিষ্যসি।

শকুন্তলা
সবাইকে ছেড়ে আশ্রমে ঢুকে মহাভারতের দুষ্মন্ত কণ্বকে দেখতে পেলেন না। কিন্তু তাই বলে তিনি কালিদাসের দুষ্মন্তের মতো দুষ্টুমি করেননি। লতাজালে অন্তরিত হয়ে তিন যুবতী কন্যার বিশম্ভালাপ শুনতে শুনতে তাড়িয়ে তাড়িয়ে শকুন্তলার রূপ উপভোগ করা— কালিদাসের দেওয়া এই সুযোগ ব্যাসের দুষ্মন্তের হয়নি। ব্যাপারটা এখানে অনেক সরল এবং সহজ। কন্বমুনির আশ্রমে ঢুকে কাউকে না দেখে দুষ্মন্ত একেবারে বন মাতিয়ে তুললেন। হেঁকে বললেন, কে কোথায় আছ গো, সাড়া দাও। তার গলা শুনে শান্ত আশ্রমপদ যেন সচকিত হয়ে উঠল— উবাচ ক ইহেত্যুচ্চৈর্বনং সন্নাদয়ন্নিব।
কণ্বমুনির অনুপস্থিতি পূরণ করতে পর্ণকুটির থেকে বেরিয়ে এল লক্ষ্মীর মতো সুন্দরী এক মেয়ে— কন্যা শ্রীরিব রূপিণী। তাপসীর বেশ তাঁর পরিধানে। শক্তিধর রাজার চেহারা এবং ঐশ্বর্যের যে ছায়া পড়েছিল সেটি তার মনে দ্রুত এক প্রতিক্রিয়া তৈরি করল। কিন্তু ব্যাসের শকুন্তলা তো আর কালিদাসের শকুন্তলার মতো সারা প্রথম অঙ্ক জুড়ে কথা-না-কওয়া শৃঙ্গার-লজ্জায়-নাটানো সব্রীড়া যুবতীটি নন। উত্তম নাট্যকারের বদান্যতায় পাওয়া দেওয়া দুষ্মন্তের শূন্য শব্দ শুনেই ব্যাসের
দুটি সপ্রতিভ সখীও তাঁর নেই। আকাশে শকুন্তলা সহজভাবে বেরিয়ে এসে দুষ্মন্তকে বসার আসন দিলেন, পা ধোয়ার জল দিলেন, প্রশ্ন— হে বন্ধু আছ তো ভাল– প্রপচ্ছানাময়ং রাজন কুশলঞ্চ নরাধিপম্। সহজ বেশে, হেসে — ঠিক হেসে নয়, যেন হাসছেন এমনিভাবে— স্ময়মানের— শকুন্তলা প্রশ্ন করলেন, তা রাজার কাজটা কী, বলুন কী আমাদের করতে হবে? কালিদাসের দুষ্মন্ত আগেই জানেন যে, শকুন্তলার পিতা কণ্ব আশ্রমে নেই। আগেই তপস্বীদের কাছে খবর পেয়ে গিয়েছেন যে, শকুন্তলার প্রতিকূল ভাগ্য প্রশমনের জন্য মহর্ষি কণ্ব সোমতীর্থে গিয়েছেন। কালিদাস তাঁর নায়ক নায়িকাকে শূন্য আশ্রমপদে মিলিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন অনেকক্ষণ। পিতা কণ্বকে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন অনেক দূরে সোমতীর্থে। কিন্তু যুবতী নায়িকার প্রতি ব্যাসের এই প্রশ্রয় নেই। তাঁর কণ্বমুনিও আশ্রম ছেড়ে বড় বেশি নড়াচড়া করেন না। সেই অনুপস্থিতির মুহূর্তে শুধু তিনি ফল কুড়োতে গিয়েছিলেন— ফলান্যাহতুম্ আশ্রমাৎ। ব্যাসের শকুন্তলাকে তাই অবস্থা বুঝে অনেক বেশি স্মার্ট হতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, এই তিনি এলেন বলে— মুহূর্তং সম্প্রতিক্ষস্ব দ্রষ্টাস্যেনমুপাগতম্।
তারপর জড়তাহীন গলায় স্বাগত শে ব্যাসের শকুন্তলার কোনও সখী নেই, পিতা কণ্ব দূরে যান না। অতএব চমৎকার অরণ্য পরিবেশে ক্ষ্যাপা হাওয়ার মধ্যে বরারোহা আগুনপানা সুন্দরীর কাছে রাজাকে প্ৰণয় নিবেদন করতে হয়েছে তাড়াতাড়ি। অবশ্য তার আরও কারণ ছিল এবং প্রথম কারণ বোধহয় তাপসী শকুন্তলার সপ্রতিভতা। যে মুহূর্তে রাজা শকুন্তলাকে কণ্ব মুনির কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সেই মুহূর্তে শকুন্তলার দুটি গুণ তাঁকে স্পর্শ করেছে রীতিমতো। কী মধুর কথা বলে এই মেয়ে–কন্যাং মধুর ভাষিণীম্। আর কথা যেমন বলে, দেখতেও তেমনি একেবারে নিখুঁত— ‘অনবদ্যাঙ্গী’। শকুন্তলার রূপ একেবারে ফেটে পড়ছিল, নিরন্তর ব্রহ্মচর্যে কঠোর দমনে সে রূপে মৃদুতা আনার চেষ্টা করা সত্ত্বেও কোনও লাভ হয়নি। আসলে সংযমের স্বভাবই বোধ হয় এই। আজকের দিনেও রমণী রূপের আদর্শ বলে চিহ্নিত হন যাঁরা, যাঁদের শরীরে যৌনতার অভিজ্ঞান খোদিতবৎ বলে মনে হয়— নিশ্চিত জানবেন— তাঁদের তপস্যা এবং সংযমের অন্ত নেই। খাদ্যের কৃচ্ছ্রতা থেকে দৈহিক কৃচ্ছ্রতা এতটাই তাঁদের পালন করতে হয় যে, সেই শম-দমের অভিব্যক্তি স্ফুট হয়ে ওঠে স্তন- জঘণে, কটি-নিতম্বে। আশ্রমবাসিনী শকুন্তলা হয়তো লোকচক্ষুতে দর্শনীয় হয়ে ওঠার জন্য সচেতনভাবে কোনও কৃচ্ছ্রসাধনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাননি। কিন্তু আশ্রমবাসিনীর জীবনে ব্রত-উপবাস, পরিশ্রম এবং কৃচ্ছ্রসাধন এতটাই স্বাভাবিক যে, সেই স্বাভাবিক কৃচ্ছ্রতাতেই শকুন্তলার রূপ এবং যৌবন রাজার কাছে মোহময় হয়ে উঠেছিল — বিভ্রাজমানা বপুসা তপসা চ দমেন চ। কালিদাস যে শকুন্তলার বল্কলোদ্ভেদী যৌবন নিয়ে প্রিয়সখী প্রিয়ংবদার মুখে চটুলতার প্রকাশ করেছেন তার মূল উপাদান বোধহয় এখানেই। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে যৌবন দমিত হলেও শকুন্তলার অপার রূপরাশি দেখে যথেষ্ট আলোড়িত হয়েছেন দুষ্মন্ত। কিন্তু রাজাকে একবার লৌকিকতার খাতিরে জানতে
বা এই নির্জন বনে তাঁর বাস? অবশ্য এ প্রশ্নের সঙ্গে রাজা প্রাসঙ্গিক কথাটি স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দিয়েছেন—— তোমাকে দেখেই আগেই বলেছি ব্যাসের শকুন্তলাকে। কার মেয়ে? কেনই কাছে— দর্শনাদেব হি শুভে ত্বয়া লজ্জা না করে সোজাসুজি
কলা বৃত্তান্ত রাজাকে সবিস্তারে জানিয়েছেন।
আমি, আমার মন বাঁধা পড়েছে তোমার বলেই বেশি ‘স্মার্ট’ অতএব একটুও বিশ্বামিত্র-মেনকার বিলাস রহস্য, কেলি-এলোমেলো চুলে, উতলা আঁচলে মেনকা কেমন করে ভুলিয়েছিলেন বিশ্বামিত্রকে সে কথা বলতে ব্যাসের নায়িকার একটুও বাধে না। শকুন্তলা বললেন, শুনুন তা হলে আমি কেমন করে মহর্ষি কণ্ঠের মেয়ে হয়ে গেলাম।
শকুন্তলা বলে চললেন, তপস্যায় বসে ছিলেন বিশ্বামিত্র। তাঁর তীব্র তপস্যায় ভয় পেলেন ইন্দ্র। এই বুঝি তাঁর ইন্দ্রত্ব চলে যায়, গোটাতে হয় স্বর্গের রাজপাট। ইন্দ্র ভয় পেয়ে ধরলেন স্বৰ্গবেশ্যা মেনকাকে। বললেন, অপ্সরাদের মধ্যে তোমার সমান আর কে আছে! তা তুমি বাপু তোমার রূপ যৌবন দিয়ে, মধুর ব্যবহার, স্মিত হাসি আর কথা দিয়ে বিশ্বামিত্রকে ভোলাও। মেনকা বললেন সে কি সোজা কথা! ওই কোপন স্বভাব মুনি, যাকে কি না তুমি পর্যন্ত ভয় পাচ্ছ, তার মুখোমুখি হব আমি! না বাপু, সে হবে না। ওই মুনির কাছে যাওয়া, আর আগুনে হাত দেওয়া একই ব্যাপার। তুমি আমাকে রক্ষা করার ভার নাও, আমি যাচ্ছি। হ্যাঁ, এক যদি এলোমেলো হাওয়া আর ভালবাসার দেবতা পুরুষমানুষের মন-মথন-করা মন্মথ আমার সহায় হয়, তবেই তাঁকে একবার ভোলানোর চেষ্টা করতে পারি। বলা বাহুল্য, দেবরাজ রাজি হলেন এবং সদাগতি সমীরণকে পাঠিয়ে দিলেন মেনকার সঙ্গে আর রইলেন কামদেব, বিশ্বামিত্রের মনে বাসনা তৈরি করবেন তিনি। কালিদাসের কুমারসম্ভবে অকাল বসন্তের সূত্র কি এইখানে ?
ব্যাসের শকুন্তলা এখানেও থামেননি। তিনি বলতে থাকলেন, কেমন করে মেনকা বিশ্বামিত্রের সামনে খেলা করতে লাগলেন, নাচতে লাগলেন। এমন সময় বন থেকে উদোম হাওয়া এল আর মেনকার পরিধেয় বসনখানি উড়ে গেল। চাঁদনি রঙের বসনখানি আঁকড়ে ধরতে গিয়েই যেন মেনকা প্রায় শুয়ে পড়লেন মাটিতে। কিন্তু সেই অবস্থাতেও মেনকার মুখের হাসিটি গেল না। লোক দেখানো লজ্জার আভাসটুকুও সজীব রাখলেন মুখে- বিশ্বামিত্র তাঁকে দেখলেন একেবারে অনাবৃতা— দদর্শ বিবৃতাং তদা। মেনকার রূপে গুণে বিশ্বামিত্রের মন চঞ্চল হয়ে উঠল, তার ফল এই ,মুনিও তাঁকে সরস আমন্ত্রণ জানালেন, মেনকাও সানন্দে রাজি হলেন। জন্মালেন কলার সংবাদ দিতে এতটাই নিঃসঙ্কোচ রঙ্গ রসে কাটানোর পরেও মহর্ষির মেপা। ব্যাসের শকুন্তলা পিতামাতার কেলি-জানালেন, মেনকার সঙ্গে অনেক কাল যেন এক দিন কাটল।
আসলে এসব গল্প শকুন্তলা পালকপিতা কম্বের কাছে শুনেছেন। কণ্বই তাঁকে বলেছেন কেমন করে মালিনীর তীরে পাখিরা শকুন্তলাকে ঘিরে ছিল— শকুন্তৈঃ পরিবারিতাম্, কেমন করে পথে যেতে যেতে নির্জন বনের মাঝখানে নিষ্পাপ শিশুটিকে তিনি দেখতে পান। ব্যাসের শকুন্তলা মহর্ষি কণ্বের বদান্যতার কথা সগৌরবে ঘোষণা করে বললেন, তিনিই আমার নাম দিয়েছেন শকুন্তলা, আমি তাঁকেই পিতা বলে জানি— কণ্বং হি পিতরং মন্যে।
কিন্তু শকুন্তলা কম্বকে পিতা মনে করলে কী হবে, রাজা দুষ্মন্ত যে বিশ্বামিত্রকেই শকুন্তলার পিতা হিসেবে চান। এতক্ষণ তিনি একটি মেয়ের মুখে স্বর্গবেশ্যা মেনকা এবং মহর্ষি বিশ্বামিত্রের কেলি-কলার উত্তেজক গল্প শুনছিলেন, কিন্তু তাঁর মন পড়ে ছিল শকুন্তলার কাছে। দৃষ্টি তো বটেই। দেখামাত্রই অজ্ঞাতকুলশীলা এক রমণীর রূপে মোহিত হয়েও যিনি তাঁকে প্রশ্ন করছেন— নিতম্বিনী কন্যে! তুমি কার মেয়ে— সেখানে তাঁর এই প্রশ্নের মধ্যে শুধু সরল পরিচয়-জিজ্ঞাসা-মাত্র আকারিত হয় না, বোঝা যায়, এতক্ষণ তিনি শুধু তাঁর জাত বিচার করে যাচ্ছিলেন। অর্থাৎ এঁকে বিয়ে করা যাবে কি যাবে না শুধু এই চিন্তা ছিল রাজার। বিশেষত দুষ্মন্ত তাঁর পূর্বপুরুষ যযাতি রাজার ব্রাহ্মণী বিবাহের ফল মাথায় রেখে থাকবেন। তাই রাজা সন্দেহ মুক্ত হলেন যে, শকুন্তলা মূলত ক্ষত্রিয় রাজার মেয়ে। বিশ্বামিত্র তপস্যা করে যতই ঋষি হন না কেন, তাঁর জন্মসূত্রই রাজার কাছে বড় হয়ে উঠল। যেই না রাজা জাতবিচারে নিজের দিকে সায় পেলেন, অমনি তিনি বায়না ধরলেন, তুমি আমার বউ হও— সর্বং রাজ্যং ভবাদ্যান্ত ভার্যা মে ভব শোভনে।
কালিদাসের শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্মন্তের কথা কখনওই এত খোলাখুলি পর্যায়ে পৌঁছায়নি। সারা প্রথম অঙ্ক জুড়ে সেখানে শকুন্তলার কথাটি নেই। লজ্জায় আনন্দে তাঁর বাক্য সরে না । দুষ্মন্তের যা কথা সবই সখীদের সঙ্গে। আর তৃতীয় অঙ্কের মিলন পর্বে যাও বা শকুন্তলার মুখ ফুটল, তাও লজ্জায়, আশঙ্কায় প্রকাশের পথ পায় না। কিন্তু ব্যাসের শকুন্তলা ভালরকম কথা বলা না জানলেও, সে ভীরু নয়। রাজার খোলাখুলি প্রস্তাব শুনে তিনি ভাবলেন, পাগল রাজা বলে কী? গান্ধর্ব বিবাহ আবার কী? দুষ্মন্ত তখন আর্ট কিসিমের বিয়ের নিয়মকানুন শুনিয়ে বললেন, গান্ধর্ব বিবাহ বুঝলে না? এই যেমন, আমি তোমায় মন দিলুম, তুমিও আমায় মন দিলে। আমি তোমায় চাই, তুমিও আমায় চাও— সা ত্বং মম সকামস্য সকামা বরবর্ণিনী— এই হল গান্ধর্ব বিবাহ। তাই করব। শকুন্তলা দেখলেন মহা বিপদ। এই পাগল এবং একাধারে পাগল করা রাজাকে আটকানো তো একেবারেই দায়। ভবিষ্যতের কিছুই না বুঝে যখন রাজাকে এখনই মন দিতে হবে, তখন ভবিষ্যতের একটা ব্যাপার অন্তত গুছিয়ে রাখা ভাল। রাজার অত্যাগ্রহ বুঝে শকুন্তলা বললেন, আপনি যখন এত করে বলছেন, তা হলে গান্ধর্ব বিবাহই বুঝি বা ধর্ম হবে। সে হোক, আপনি যদি একান্তই আমাতে আসক্ত হন, তবে একটা শর্ত আছে, সেটা আগে শুনুন— শৃণু মে সময়ং প্রভো। আমার শর্ত হল আমার গর্ভে আপনার যে ছেলে হবে তাকে যুবরাজ করতে হবে। ভবিষ্যতে সেই হবে রাজা। এতে যদি আপনি রাজি থাকেন— যদ্যেতদেবং দুষ্মন্ত অস্ত্র মে সঙ্গম স্তয়া— তবেই আমি মিলিত হতে পারি আপনার সঙ্গে।
সোজাসুজি কথা। ফেলো কড়ি মাখো তেল। দুষ্মন্ত নির্বিচারে রাজি হলেন শকুন্তলার শর্তে। মিলিত হলেন দু’জনে— দুষ্মন্ত শকুন্তলা। দু’দিন বাদেই চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে শকুন্তলাকে রাজধানীতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজা চলে গেলেন। কালিদাসের বৈদগ্ধ্যে লজ্জাবতী শকুন্তলার তরফ থেকে এ সব শর্ত আরোপের কথা আগে মনে আসেনি। সে ভীরু আশ্রম বালিকা, রাজাকে সে নিজের অজ্ঞাতেই মন দিয়েছে, অকারণের আনন্দে। এখানে মিলন নিঃশর্ত, আবেগে মধুর। রাজা যাওয়ার সময় শুধু তাঁকে নিজের নাম লেখা একটি আংটি দিয়ে গিয়েছেন। কালিদাসের শকুন্তলা প্রতিদিন সেটি দেখেন আর একটি করে পুজোর পুষ্পে রাজার দিন গোনেন। কালিদাসের শকুন্তলার যত ভাবনা সখীদের। প্রিয় সখীর বিয়ে হয়েছে, এখন তাঁর বিবাহ বৃত্তান্ত শুনে পিতা কণ্ব কী বলেন, খুশি হন, না অখুশি হন। এইসব ভাবনাই তিনকন্যার নিস্তরঙ্গ আশ্রম জীবনে ঢেউ তোলে।
মহাভারতে কিন্তু চিত্রটা অন্যরকম। সেখানে ক্ষণিকের মিলন ছেড়ে দুষ্মন্ত পালিয়ে যান নগরে এবং পালিয়ে যান এই ভেবে যে, মুনি তপঃপ্রভাবে সব জেনে দুষ্মন্তকে কী করবেন কে জানে— ভগবাং স্তপসা যুক্তঃ শ্রুত্বা কিং নু করিষ্যতি? আমি দুষ্মন্তের এই ভাব দেখে বলতে চাই— কালিদাসের দুষ্মন্ত দুষ্টু, কিন্তু মৃগয়াবিহারী দুষ্মন্ত তপস্বিনী বালিকাকে মৃগয়া শেষ নয়। এখানে শকুন্তলাকে স্মরণচিহ্ন ফিরে শতেক রমণীবিলাসে শকুন্তলার পরতের দুষ্মন্ত একেবারে দুষ্ট, দুষ্ট চরিত্র।
ইচ্ছে করেই ভুলে গিয়েছেন। বাড়ি পালিয়েছেন। তাঁর দুষ্টুমির এই আংটি-ফাংটি কিছুই দেননি। রাজধানীতে স্রেফ ভুলে গিয়েছেন তিনি….

সত্যবতী
নৌকোর হালের পিছনে, নৌকোর উপরি-প্রান্তভাগে এক উদ্ভিন্নযৌবনা রমণীকে আমরা বসে থাকতে দেখছি। যমুনার মতোই ঘননীল তার দৃষ্টিটুকু সুদূর অরণ্যবাহী পথের দিকে প্রসারিত। সে অপেক্ষা করছে বোঝা যায়, কারও জন্য সে নির্জন জলপ্রান্তে অপেক্ষা করছে, কিন্তু এ অপেক্ষা যে কোনও প্রাণপ্রিয় প্রণয়ীর মিলনাপেক্ষা নয়, সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যায়। এ অপেক্ষা নিছকই এক অপেক্ষা, নিতান্তই প্রয়োজনে।
রমণী অতিশয় সুন্দরী। কিন্তু যে অর্থে সেই সেকালে এবং একালে রমণীর সৌন্দর্য্য বিচার করা হয়, সেই অর্থে কেউ তাঁকে সুন্দরী বলবেন না। কারণ এই রমণীর শরীরে গৌরবর্ণের আভাসমাত্রও নেই। রমণী ঘন কৃষ্ণবর্ণা, এবং লোকে তাকে আদর করে কালী বলে ডাকে। কিন্তু মানুষের সাধারণ সৌন্দর্য্য-ভাবনার মধ্যে থেকে যদি গৌরীয় দুর্বলতাটুকু ছেঁটে ফেলা যায়, তবে এই কৃষ্ণবর্ণা রমণীর দিকে একবার চক্ষুমাত্র নিবেশ করলে মানুষের সমস্ত ইন্দ্রিয়বৃত্তি এমনই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে যে, সে স্বীকার করে বসবে— সৌন্দর্য্য-ভাবনায় গৌরবর্ণের পূর্বাবেশ একেবারেই মূল্যহীন।
এখনও সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসেনি। সবেমাত্র গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়েছে নীল যমুনা জলের ওপর, সবুজ বনভূমির ওপর, বনমধ্যবর্তী সর্পিল পথের ওপর এবং অবশ্যই পূর্বোক্ত রমণীর চিক্কণ-কৃষ্ণ শরীরের ওপর। আসন্ন সন্ধ্যারাগে উদ্ভাসিত দিগন্তের মধ্যে নৌকার প্রান্তদেশে নিষণ্ণা কৃষ্ণবর্ণা এই রমণী চিত্রার্পিত মূর্তির মতো একা বসেছিল। তার ঘন কৃষ্ণ কেশরাশি মাথার ওপরে চূড়া করে বাঁধা। আতাম্র ওষ্ঠাধারে মুক্তাঝরানো হাসি। রমণীর উত্তমাঙ্গের বস্ত্র পৃষ্ঠলম্বী সূত্রগ্রন্থিতে দৃঢ়নিবদ্ধ এবং অধমাঙ্গের বস্ত্র কিছু খাটো। নৌকার ত্রিকোণ প্রান্তদেশে বসে রমণী তার পা দুটি নিবদ্ধ অবস্থায় নিম্নস্থিত কাষ্ঠস্তরের ওপর ছড়িয়ে রাখার ফলে তার কদলীস্তম্ভ-সদৃশ্য চরণ-দুটি ঊরু পর্যন্ত প্রায় অনাবৃত। এই অনাবরণ প্রকট লাবণ্য পৌরুষেয় দৃষ্টিতে পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার যান্ত্রিকতা বলে মনে হলেও এই রমণীর কাছে এটি স্বভাবসিদ্ধ এবং অতি সহজ।
কিন্তু ওই রমণীর পক্ষে এই অনাবরণ ব্যবহার যতই সহজ, সরল আর স্বাভাবিক হোক, সাধারণ মানুষ তা সহ্য করতে পারবে কেন! এমনকী কোনও জিতেন্দ্রিয় সিদ্ধ মহাপুরুষ হলেও নীলোর্মিচঞ্চল যমুনার জলে একটি নৌকোর ওপর অমন স্বভাবসুন্দর প্রত্যঙ্গমোহিনী রমণীমূর্তি দেখতে পেলে, তিনি স্থির থাকতে পারবেন না। অন্তত একবারের জন্যও তাঁর মনে হবে— সমস্ত জীবনের ত্যাগ বৈরাগ্যের সাধন, অথবা সেই চিরাভ্যস্ত ইন্দ্রিয়নিরোধ তাঁর উচিত হয়েছে তো? অন্তত একবারের তরেও মনে হবে— এই রমণীর অধিকার পেলে বেশ হত— অতীবরূপসম্পন্নাং সিদ্ধানামপি কাঙ্ক্ষিতাম্।
রমণী যে আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তার অবসান ঘটল আকস্মিকভাবে। জটাজুটধারী এক মুনিকে নদীতীরবর্তী সর্পিল পথ বেয়ে নৌকোর দিকেই আসতে দেখা গেল। সন্ধ্যা হয়ে আসবে এখনই, তাঁকে পরপারে পৌঁছোতে হবে।
মহর্ষি অন্য সময়েও নদী পার হবার জন্য তাঁর পরিচিত এই খেয়াঘাটে এসেছেন, কিন্তু সবসময়ে একটি পুরুষকেই দেখেছেন নৌকো পার করে দিতে। কিন্তু আজকের দিনে সব কিছুই কেমন অন্যরকম ঘটছে। খেয়াঘাটে আসতেও তাঁর দেরি হয়ে গেছে, আর এদিকে সূর্যের শেষ অস্তরাগ যমুনার জলে লুটোপুটি খেয়ে সেই নৌকার প্রান্তদেশে বসা নিকষ-কৃষ্ণ রমণী- শরীরের মধ্যে নতুন মায়া তৈরি করেছে। মুগ্ধ হলেন মুনিবর। উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে আরও এক চিক্কণ প্রকৃতি-শরীর তাঁর নিরুদ্ধ প্রকৃতিকে বিক্ষুব্ধ করে তুলল। তিনি মনে মনে এই উদ্ভিন্নযৌবনা রমণীর আসঙ্গলিপ্সা করলেন— দৃষটুৈব চ তাং ধীমাংশ্চকমে চারুহাসিনীম্।
. প্রথম সম্বোধনেই তিনি এই সন্ধ্যার রক্তিমা মাখানো কৃষ্ণা রমণীর হাতে উপহার দিয়েছেন কবির হৃদয়, বলেছেন— আমি তোমার দিনশেষের খেয়ার শেষ যাত্রী হব, বাসবী! নিয়ে চল আমাকে— অহং শেষো ভবিষ্যামি নীয়তামচিরেণ বৈ। বাসবী !
কবির হৃদয়ের সঙ্গে মিশিয়ে এমন করেই বলতে হয়! রমণী তার দিনশেষের যাত্রীকে তুলে নিল নৌকোয়। নৌকো বাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা রমণীর শারীরিক বিভঙ্গ দিনশেষের যাত্রী মহামুনি পরাশরের চোখ এড়িয়ে গেল না। চিত্তদুয়ার মুক্ত করে নির্নিমেষে তিনি তাকিয়ে রইলেন সোনার আঁচলখসা সন্ধ্যাসমা রমণীর দিকে।
কৃষ্ণা রমণী মহামুনি পরাশরের এই আকর্ষণ নারীজনোচিত সচেতনতায় বুঝে নিল এক লহমায়। মুনি তাকে বাসবী বলে সম্বোধন করেছেন। এই সম্বোধনের অর্থ সে জানে। কিন্তু মুনি কেন তাকে এই নামে ডাকলেন, সে-সম্বন্ধে তার মনে অদ্ভুত এক অনুসন্ধিৎসা রয়েই গেল। নিজেকে খানিকটা সপ্রতিভ দেখানোর জন্য ‘বাসবী’ নামের রহস্যটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে রমণী বলল— লোকে আমাকে মৎস্যগন্ধা বলে ডাকে, আমি অত্রস্থ ধীবরদের প্রধান দাশ রাজার কন্যা। বাস্তবে আমার পিতামাতার সংবাদ সর্বাংশে আমি জানি না এবং তার জন্য দুঃখও আমার কম নেই।
সত্যি কথা বলতে কি, ‘বাসবী’ নামটি শোনা মাত্রেই রমণীর মনে যে রহস্য তৈরি হয়েছিল, তার বাচনভঙ্গির মধ্যেও কিন্তু তার নাম-রহস্য সম্বন্ধে একটা জিজ্ঞাসা জেগেই রইল। পরাশর উত্তর দিলেন সঙ্গে সঙ্গে এবং বোঝাতে চাইলেন যে, রমণীর বাসবী নামের রহস্যটি তিনি জানেন। অবশ্য নৌকার ওপর সন্ধ্যার এই অনুকূল লগ্নে রমণীকে তিনি তার নাম-রহস্য শোনাননি, কারণ তা শোনালে রমণীর লজ্জা বোধ হত।
পরাশর যা আভাসে বলেছেন এবং মহাভারতে যে রমণীকে ধীবর-রাজা দাশের ঔরসজাত কন্যা বলে হয়েছেন মাত্র। মহাভারতের উপাখ্যান সবিস্তারে ধরা আছে, তাতে এই হয় না। তিনি দাশরাজার ঘরে পালিত দেশের রাজা চৈদ্য উপরিচর বসু তাঁর করছিলেন। অন্যদিকে গিরিকাও ঋতুস্নান প্রিয় মিলনের আকাঙ্ক্ষায়। ঠিক এই অবস্থায়, চেদিরাজকে মৃগবধের উদ্দেশে মৃগয়া করতে চলে স্ত্রী গিরিকার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশায় শেষ করে অপেক্ষা করছিলেন ওই পিতৃপুরুষের আদেশে পিতৃযজ্ঞের যেতে হয় আকস্মিকভাবে। পৌরাণিক নিয়মে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে বন্য পশুপাখির মাংসে পিতৃপুরুষের তর্পণ সেকালে প্রথাগত ছিল। অতএব পিতৃপুরুষের ওই আদেশ অমান্য করতে না পেরেই উপরিচর বসু মৃগয়ায় গেলেন।
মৃগয়ায় রাজার মন বসল না মোটেই। অপেক্ষমাণা সুন্দরী গিরিকার কথা তাঁর বারবার মনে পড়ল। যান্ত্রিকভাবে রাজা মৃগয়া করছিলেন বটে, কিন্তু অযান্ত্রিক মনে নিরন্তর জেগে রইল সেই মধুর মুখখানি— চকার মৃগয়াং কামী গিরিকামেব সংস্মরন। রতিলিপ্সু রাজার মন সংযমের বাধ মানল না। তাঁর তেজোবিন্দু উৎসারিত হল এবং রাজা তা ধারণ করলেন পত্রপুটে। তার পরের ঘটনা প্রায় সবারই জানা। অপেক্ষমাণা ঋতুস্নাতা স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়া হল না, ঈপ্সিত পুত্রলাভও বিঘ্নিত হয়ে গেল তার ফলে। কিন্তু পুত্রজন্ম বিফল হোক— এটা যেহেতু রাজা চাইছিলেন না, অতএব পত্রপুটে ধরা সেই তেজোবিন্দু রাজা গিরিকার কাছে পাঠিয়ে দিলেন একটি বাজপাখির পায়ে বেঁধে। রাজার কপাল, গিরিকার কাছে সেই তেজোবিন্দু পৌঁছোল না, পথের মধ্যে আরেকটি বাজপাখির আক্রমণে সেই বিন্দু পতিত হল যমুনায়।
যমুনা নদীতে তখন শাপগ্রস্তা অপ্সরা অদ্রিকা মসী হয়ে বিচরণ করছিলেন।
উপরিচর বসুর তেজ সেই মৎসী ভক্ষণ করে গর্ভবতী হল। এদিকে এক সময়ে ধীবরেরা জাল ফেলতে এল যমুনা নদীতে এবং দৈবের দোষে সেই গর্ভবতী মৎসী ধরা পড়ল ধীবরদের জালে। ধীবরেরা সেই মৎসীকে কাটতে গেলেই তার গর্ভ থেকে বেরিয়ে এল একটি স্ত্রী এবং একটি পুংশিশু। এই আশ্চর্য ঘটনা ধীবরেরা নিবেদন করল দেশের রাজা উপরিচর বসুর কাছে। সব দেখে শুনে উপরিচর বসু পুরুষ শিশুটিকে গ্রহণ করেন। মহাভারতের মতে চৈদ্য উপরিচরের এই শিশুপুত্রই ভবিষ্যতে ‘মৎস্য’ নামে এক ধার্মিক রাজা বলে পরিচিত হয়েছিলেন— স মৎস্যো নাম রাজাসীদ্ ধার্মিকঃ সত্যসঙ্গরঃ। শিশুকন্যাটিকে রাজা ধীবরদের হাতেই দিয়ে দেন এবং তা কন্যাসন্তান বলেই হয়তো। রাজা ধীবরদের বলে দেন যেন শিশুকন্যাটিকে তারাই মানুষ করে। মৎস্যঘাতীদের আশ্রয়ে থাকার ফলে এই মেয়েটি মৎস্যগন্ধা নামে পরিচিত হয়— সা কন্যা দুহিতা তস্যা মৎস্যা মৎস্যসগন্ধিনী। মৎস্যগন্ধার অপর নাম সত্যবর্তী এবং তাঁর গায়ের রং কালো বলে তাঁর ডাক নাম হয়ে গেল কালী।
পরাশর কোনও অসভ্যতা করেননি যৌবনবতী সত্যবতীর সঙ্গে, কোনও অসভ্য ভণিতার মধ্যেও যাননি, পৌরাণিক পুরুষেরা স্ত্রীলোক দেখলেই যেমনটি করতেন। মৎস্যগন্ধার অপার রূপরাশি বর্ণনা অথবা স্তন-জঘনের সকাম বর্ণনা করে অন্যান্য পুরাণ-পুরুষের মতো সত্যবতীকে তিনি বিব্রতও করেননি। কোনও ভণিতা না করে পরাশর বলেছেন— বাসবী ! আমি একটি পুত্র চাই তোমার কাছে এবং সেইজন্যই তোমার সঙ্গে মিলন প্রার্থনা করি।
সেকালের দিনের নিরিখে পরাশরের এই প্রার্থনার একটা তাৎপর্য আছে। কামনা কীভাবে ধর্মে পরিণতি লাভ করে— এটা তারই উদাহরণ। সেকালের দিনে পিতৃঋণ শোধ করার জন্য পুত্র-কামনা করতেন প্রাচীনেরা। রমণীর সঙ্গে শারীরিক মিলনের মধ্যে যে বাধ-ভাঙা কামনার অভিসন্ধি আছে প্রাচীনেরা সেই কামনাকে শৃঙ্খলিত করবার চেষ্টা করতেন পুত্রার্থে মিলনের সকারণতায়। অর্থাৎ শারীরিক মিলন যেন বল্গাহীন অসংখ্যাত ইন্দ্রিয়-চর্বণে পরিণত না হয়, পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষায় মিলন ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তির ক্ষেত্র থেকে মানুষকে সরিয়ে আনে ধর্মের বৃহত্তর ক্ষেত্রে। পরাশর ঠিক তাই করেছেন। যিনি ভবিষ্যতে বিশালবুদ্ধি ব্যাসের পিতা হবেন, তিনি ইন্দ্রিয়-পরবশ হয়ে কাজ করছেন না, তিনি পুত্রের প্রয়োজনে সেকালের ধর্মের আনুগত্যে একবার মিলন সম্পন্ন করতে চান যান্ত্রিকভাবে।
মুনিবর পরাশরের ইচ্ছা এবং আশয় ধরে ফেলতে সত্যবতীর অসুবিধে হয়নি, এমনকী তাঁর ওই পুত্রলাভের যান্ত্রিকতার কথাটাও সত্যবতী মেনে নিতে খুব অসুবিধে বোধ করছেন না। কিন্তু নারীসুলভ সাধারণ লজ্জা তাঁকে কুণ্ঠিত করে তুলেছে। তিনি বললেন, দেখুন মুনিবর! পরপারে কিছু ঋষি-মুনিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে— পশ্য ভগবন্ পরপারে স্থিতান্ ঋষীণ।। হয়তো এই ঋষি-মুনিরা আগেই খেয়া পার হয়ে যমুনার ওপারে গেছেন। হয়তো বা পরাশরের জন্যই তাঁরা অপেক্ষা করছেন এবং তাকিয়েও আছেন ওই খেয়া- নৌকার দিকে। সত্যবতী ভারী লজ্জাবোধ করলেন। বললেন মুনিরা সব তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। এই অবস্থায় কীভাবে আমাদের মিলন সম্ভব— আবয়োদৃষ্টয়োরেভিঃ কথং নু স্যাৎ সমাগমঃ ।
পরাশর তপস্বী, যোগী। তিনি বিভূতিমান মহাসত্ত্ব পুরুষ। নারী-পুরুষের শারীরিক মিলনের মধ্যে বাহ্যত যে আবরণ দরকার সেই আবরণ তিনি সৃষ্টি করলেন যোগবলে। চারিদিক ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হল। আমাদের ধারণা, শেষ লগ্নে অন্ধকারের যে ছায়া নামছিল প্ৰেমনত নয়নের দীর্ঘচ্ছায়াময় পল্লবের মতো সেই ছায়াই মুনিসৃষ্ট অলৌকিক ‘নীহারিকা’র রূপকে বর্ণিত হয়েছে। সন্ধ্যার প্রায়াচ্ছন্ন অন্ধকারের মধ্যে এবার সত্যবতী অনুভব করলেন যে, মুনি যা বলছেন, মৌখিকতা মাত্র নয়। মুনি শারীরিক মিলনে আগ্রহী এবং সে মিলন আসন্নপ্রায়। বাস্তব সত্যবতীকে হঠাৎই পরিণত করে তুলল এক মুহূর্তে। আরও বড় কথা— তিনি জানেন যে, সমাজের অসম্মত অবিধির মিলনে যে পুত্রের জন্ম হবে, তার দায়িত্ব যদিও বা পরাশরই গ্রহণ করেন— কারণ পরাশর পুত্রলাভের জন্যই মিলন কামনা করেছেন— কিন্তু সেই মিলনের মধ্যে যে সামাজিক অসম্মতি আছে তার জন্য সমাজ তাঁকে কী মর্যাদা দেবে?
সত্যবতী ভয় পেলেন। নিজের জন্মের কারণেই যিনি কষ্ট পান, তিনি তো এই প্রস্তাবে ভয় পাবেনই। তাঁর বাস্তবতার বোধও তাই অন্যের চেয়ে প্রখর। সত্যবতী বললেন, মুনিবর! আমি যে কুমারী। আপনার প্রস্তাবিত মিলন ঘটলে আমার পিতা কী বলবেন? আমার কুমারীত্ব দূষিত হলে আমি ঘরেই বা ফিরব কী করে, ঘরে থাকবই বা কী করে— গৃহং গন্তুষে চাহং ধীমন্ ন স্থাতুমুসহে।
তখনকার সমাজের যে রীতি ছিল, তাতে পরাশর জানতেন যে, তিনি যদি মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর কুমারীত্ব হরণ করেন এবং তাঁর গর্ভজাত পুত্রের পিতৃত্ব অস্বীকার না করেন তা হলে সত্যবতীর কোনও অসুবিধে হবে না এবং সমাজেও তা খুব দূষণীয় বলে গণ্য হবে না। তবু তিনি সত্যবতীর ভয়টা বোঝেন, ‘জন্মশোকাভিতপ্তা’ এক রমণীর ভবিষ্যতের দায়ও তিনি বোঝেন, পরাশর অতএব সামান্য আশীর্বাদের ভঙ্গি মিশিয়েই বললেন, তুমি আমার প্রিয় কার্য সম্পাদন করো। তুমি আবারও তোমার অভীষ্ট কুমারীত্ব ফিরে পাবে। আমার সন্তোষ ঘটেছে অতএব যে বর চাও তাই পাবে। মৎস্যগন্ধা বললেন, আমার গায়ের মৎস্যগন্ধ দূর হোক, সুন্দর সৌগন্ধে প্রসন্ন হোক আমার শরীর।
সত্যবতীর সঙ্গে পরাশরের অভীষ্ট মিলন সম্পূর্ণ হল এবং অলৌকিকভাবে তিনি সদ্যই গর্ভবতী হলেন এবং সদ্যোগর্ভ মোচন করলেন অলৌকিকভাবেই। মহভারতের কবি বেদব্যাস জন্মালেন। সদ্যোগর্ভ এবং সদ্যপ্রসবের কথাটা যে লৌকিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, তা আমরা মনে করি না, কিন্তু মহাভারতের কবি যে অলৌকিক প্রতিভার অধিকারী তাতে তাঁর জন্মের এই অলৌকিকতাটুকু আমরা জিইয়ে রাখতে চাই। বলতে চাই— জয় হোক মহামতি ব্যাসের— জয়তি পরাশরসূনুঃ সত্যবতীহৃদয়নন্দনো ব্যাসঃ ।
এই ঘটনার পর অনেক কাল কেটে গেছে। সত্যবতী আরও রূপবতী আরও যৌবনবতী হয়েছেন। এই সময়ে আরও এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল তাঁর জীবনে। হস্তিনাপুরের রাজা, প্রসিদ্ধ ভরত-কুরুবংশের জাতক মহারাজ শান্তনু মৃগয়ায় এসেছেন। যমুনার তীরবাহী পথ ধরে শান্তনু অনেক দূর চলে এসেছেন। মৃগয়াযোগ্য পশুপাখী সব সময়েই মৃগয়াকারী পুরুষের সামনে এসে উপস্থিত হয় না। এখানে ওখানে তাকে খুঁজতে হয়। ‘মৃগ্’ ধাতুর মানেই তো অন্বেষণ করা। শান্তনুও সেই অন্বেষণেই ছিলেন। কিন্তু অন্বেষণ করতে করতে যে মৃগমদের সৌরভ তাঁর নাসাপুট পূর্ণ করল, তা কোনও পশুপাখির নয়, সে সৌরভ বসন্তের হাওয়ায় ভেসে আসা যৌবনের সৌরভ। আসলে সুগন্ধ এবং সৌরভ এখানে রূপকমাত্র। এ রূপক প্রলোভনের; এ রূপক আকর্ষণের প্রতীক। গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে স্বর্গসুন্দরীর মতো এক রমণীকে দেখতে পেলেন মহারাজ শান্তনু। তিনি সত্যবতী। তিনি আবারও সেই যমুনার ওপর ডিঙি-নৌকোয় বসেছিলেন সবিভঙ্গে। এমন অসাধারণ রূপের আবেদন নাসিকার কাছে অবশ্যই নয়, সে আবেদন দৃষ্টির কাছে। বেশ বুঝি, সত্যবতীর নাম শুধু গন্ধবতী অথবা যোজনগন্ধা বলেই এখানে এবং গন্ধের অবতারণা। এমন একটি সুন্দরী রমণীকে এমন মিতিতে বসে থাকতে দেখে শান্তনু একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। মে জিজ্ঞাসাও করলেন তাঁকে— কে তুমি? কার মেয়ে? এই জনশূন্য স্থানে কীই বা বা । করতে চাইছ— কস্য ত্বমসি কা বাহুসি কিঞ্চ ভীরু চিকীর্ষসি? সত্যবতী নিজের পালক পিতার ঋণ অস্বীকার করলেন না। জানালেন— আমি দাশ রাজার কন্যা। তিনি না থাকলে আমাকে এই নৌকো পারাপার করতে হয়।
যমুনার কালো জলে কৃষ্ণবর্ণা সত্যবতীর কথা শুনে এবং অবশ্যই তাঁর সর্বাঙ্গে সৌন্দর্য্য- লাবণ্য দেখে আবারও মুগ্ধ হলেন শান্তনু। গঙ্গাকে শান্তনু গৃহবধূ করে আনতে পারেননি, হয়তো সে উপায়ও তাঁর ছিল না। তা ছাড়া গঙ্গার সঙ্গে সম্ভোগ-মিলনের মধ্যে যে কঠিন শর্ত ছিল, তাতে দেবব্রতর মতো একটি পুত্র লাভ করেই তাঁকে শান্ত থাকতে হয়েছে মাত্র, গঙ্গাকে রাজধানীতে নিয়ে যাবার মতো স্বাধিকার তিনি নিজেও বোধ করেননি, উপরন্তু গঙ্গার মধ্যে সুগৃহিণী সুলভ সত্তাও হয়তো ছিল না। কিন্তু সুচিরকাল স্ত্রী-সঙ্গহীন এক রাজা হিসেবে শান্তনুর দিন কেটেছে শুধু রাজকার্য নিয়ে আর অনাবিল পুত্রস্নেহে। বসন্তের উদাসী হাওয়ায় অথবা শরতের শেফালি-প্রভাতে অথবা বর্ষার ঘন-দেয়া বরিষণের মধ্যে রাজা শান্তনুর যে কত কিছু সংগোপনে বলার থাকে, অথচ বলা হয় না, কত কিছুই যে শোনার থাকে, অথচ শোনা হয় না। এই অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা এড়াতেই যমুনা-পুলিনে এসেছিলেন শান্তনু। আর সেই মুহূর্তে কী অদ্ভুত যোগাযোগ— বিধাতার আদিসৃষ্টির মতো শান্তনু দাশেয়ী গন্ধবতীকে দেখতে পেলেন যমুনার তরঙ্গচঞ্চল জলের মধ্যে।
দেখামাত্রই তাঁর প্রেমে পড়লেন শান্তনু। একে ঠিক প্রেম বলা উচিত কিনা সে বিষয়ে আমাদের আধুনিক সচেতনতা কাজ করে, কিন্তু গন্ধবতী দাশেয়ীর শরীরের মধ্যে আগুন ছিল, সেদিকে তাকালে দৃষ্টিরমণ আপনিই হয়ে যায়। অতএব তাঁকে দেখা মাত্রই কামনায় মোহিত হলেন শান্তনু। দেবরূপিণী কন্যার দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, তুমি শুধু আমারই থাকবে, কন্যা! এরকম আহ্বান হয়তো জীবনে বহুবার শুনেছেন সত্যবতী। অতএব নিজের মর্যাদা সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রেখে তিনি বললেন, আমার সেই অধিকার নেই, যাতে আমি নিজেই নিজেকে তুলে দিতে পারি তোমার হাতে। তুমি আমার পিতার সঙ্গে কথা বলো।
সত্যবতী এবার আসল কথাটা পেড়ে বললেন, দেখ, আমার ছেলে বিচিত্রবীর্য, সে তো তোমারই ভাই বটে; তা সে তো, বাবা অকালে চলে গেল। এখন তাঁর যে দুই মহিষী, তাদের রূপ-যৌবন সব আছে, কিন্তু স্বামীটি তাদের চলে গেল। তাদের কোলে একটি ছেলেও হল না। তাই আমি বলছিলাম বাছা, তুমি এই দুই কুলবধূর গর্ভে পুত্রের জন্ম দিয়ে এই বিখ্যাত বংশধারা রক্ষা কর— তয়োরুৎপাদয়াপত্যং সন্তানায় কুলস্য নঃ। এই নিয়োগকর্মে যে অনুমতি প্রয়োজন হয়, সে অনুমতি আমি দিচ্ছি তোমাকে এ বাড়ির গুরুজন হিসেবে।
প্রস্তাবে এসে বললেন, তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের দুটি স্ত্রী আছে, দু’জনেই যথেষ্ট রূপবতী এবং যৌবনবতী, কিন্তু তাদের কোলে কোনও পুত্র নেই। তারা দু’জনেই ধর্মানুসারে পুত্র কামনা করে। তাই বলছিলাম— বাছা! তুমি যদি তোমার এই দুই ভ্রাতৃবধূর গর্ভে পুত্র উৎপাদন কর তা হলে এই বংশের এবং এই রাজ্যের সমূহ মঙ্গল— তয়োরুৎপাদয়াপত্যং সমর্থো হাসি পুত্রক।
ব্যাস সত্যবতীর কথা ধৈর্য ধরে শুনলেন এবং তাঁর ভূয়োদর্শিতার প্রশংসা করে বললেন, মা! তুমি তো ধর্মের সমস্ত তত্ত্বই জানো। ইহজন্মের পক্ষে যা মঙ্গল এবং পরজন্মের পক্ষেও যা মঙ্গল, তা সবই তুমি জান। কাজেই তোমার আদেশে ধর্মোদ্দেশে যেটুকু এই রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য করা দরকার, তা অবশ্যই করব আমি— তস্মাদহং তুন্নিয়োগাদ্ধর্মং উদ্দিশ্য কারণম্। আমি বিচিত্রবীর্যের বংশধারা রক্ষা করার জন্য দুই রানির গর্ভে নিশ্চয়ই পুত্র উৎপাদন করব। কিন্তু তার জন্য আমারও একটা কথা মানতে হবে। তোমার দুই মহারানি পুত্রবধূ এক বৎসর ধরে যথানিয়মে ব্রত পালন করে শুদ্ধ হোন, তবেই আমার সঙ্গে মিলন সম্ভব হবে। নইলে ব্রতাচরণহীন ত্যাগ-বৈরাগ্যহীন কোনও রমণীর সঙ্গে আমার দৈহিক সংশ্লেষ সম্ভব হতে পারে না— ন হি মামব্রতোপেতা উপেয়াৎ কাচিদঙ্গনা।
ব্যাস মায়ের কথায় রাজি হলেন বটে, কিন্তু পুরো রাজি হলেন না। বললেন, এমন অকালে ব্রতহীন অবস্থায় যদি আমাকে এখনই তোমাদের রানিদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে হয়, তবে আমার বিকৃত রূপ সহ্য করতে হবে রানিদের। বহুকাল তপশ্চরণ করে আমার শরীরে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে, সেই দুর্গন্ধ সহ্য করতে হবে তোমার রানিদের। আমার এই বিকৃত রূপ, এই বিকৃত বেশও তাঁদের সহ্য করতে হবে। আমি মনে করি, অন্তত এইটাই তাঁদের ব্রত হোক— বিরূপতাং মে সহতাং তয়োরেতৎ পরং ব্রতম্। আসলে ব্যাস এই শর্তগুলি কেন দিচ্ছেন, আমরা তা জানি। নিয়োগ প্রথায় একটি স্ত্রী পুরুষের মিলনে কোনও পক্ষেরই যাতে শারীরিক, মানসিক কোনও আসক্তি না জন্মায়, যেন সন্তান লাভের মতো প্রয়োজনীয় কর্মটি একটি যান্ত্রিকতার মধ্য দিয়েই শেষ হয়— এই উদ্দেশ্যেই ব্যাসের ওই শর্ত, যুক্তি, ভাবনা।
ব্যাস রাজি হবার পর সত্যবতীর দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। বিচিত্রবীর্যের দুই বধূ পুত্রলাভের ব্যাপারে যথেষ্টই উন্মুখ ছিলেন, হস্তিনাপুরের রাজপরিবারের পক্ষ থেকে একটি নিয়োগের ঘটনাও যে ঘটবে— এটাও বুঝি তাঁরা জানতেন। অর্থাৎ তাঁদের মানসিক প্রস্তুতি একটা ছিল। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এত তাড়াতাড়ি এটা ঘটবে এবং সেই নিয়োগের নায়ক হবেন একজন ঋষি, তাও কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মতো এক ঋষি, এটা বুঝি তাঁদের ধারণার বাইরে ছিল।
তিনি ব্রাহ্মণ-ভোজন, দান-ধ্যান সত্যবতী ঋতুস্নাতা পুত্রবধূ অম্বিকার সে তোমার সঙ্গে মিলনের উদ্দেশে সত্যবতী প্রখর বুদ্ধিমতী। প্রথমেই তিনি বললেন না— কে বধূদের সাময়িক নায়ক হবেন। শুধু নিয়োগ-মিলনের জন্য বধূদের সম্মতি শুরু করে দিলেন। গুরু-ব্রাহ্মণ-অতিথিসেবা শেষ ঘরে গিয়ে বললেন, তোমার একটি দেবর আছে। রজনীর দ্বিপ্রহরে তোমার ঘরে আসবে। তার জন্য প্রতীক্ষা করে থেকো — অপ্রমত্তা প্রতীক্ষ্যৈনং নিশীথে হ্যাগমিষ্যতি। | পুত্রলাভেচ্ছু বধূর কাছে একবারও বিকৃত-রূপ, বিকৃত-বেশ ঋষি ব্যাসের কথা বললেন না। সত্যবতীর এই অনুচ্চারণ আরও বোঝা যায় বধূ অম্বিকার ব্যবহার থেকে। তিনি যখন গভীর নিশীথে শাশুড়ি সত্যবতীর কথা শুনে দেবরের আগমন-প্রতীক্ষা করছেন, তখন তিনি যাঁদের কথা প্রত্যাশিতভাবে ভাবনা করছিলেন, তাঁরা কিন্তু ভীষ্ম ইত্যাদি কুরুমুখ্যরা, যাঁরা তাঁর দেবর বলে চিহ্নিত— সাংচিন্তয়ত্তদা ভীষ্মমন্যাংশ্চ কুরুপুত্রঙ্গবান্ ।
ক্ষত্রিয় রাজকুলবধূর স্বপ্নেও ব্যাসের মতো ঋষির কোনও পদসঞ্চার ছিল না। বিশেষত তাঁর বিকৃত রূপ, বিকৃত বেশ রাজরানির মনে এমনই এক ‘রিপালশন’ তৈরি করেছিল যে ব্যাসের মিলন-মুহূর্তে তিনি ভয়ে, ঘৃণায় চক্ষু মুদে ফেলেছিলেন। এই নৈশমিলনের পর সত্যবতীর সোৎকণ্ঠ প্রশ্ন শুনে ব্যাস তাঁকে আশ্বস্ত করতে পারেননি। এক অঙ্গে বিকল এক অন্ধ পুত্রের জন্ম-সম্ভাবনার ভবিষ্যদ্বাণী করে ব্যাস সত্যবতীকে আরও ব্যগ্ৰ করে তুলেছিলেন। কিন্তু এই বিপন্ন মুহূর্তেও সত্যবতী কত বিচক্ষণা, তাঁর রাজনৈতিক বুদ্ধিও কত প্রখর। অবশ্য যিনি যৌবনলগ্নে ভীষ্মের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বের উত্তরাধিকার- সম্ভাবনা স্তব্ধ করে দিয়ে শান্তনুর রাজমহিষী হয়েছিলেন এবং যিনি দুই পুত্রের মৃত্যুর পরেও হস্তিনাপুরের কল্যাণকামিতায় ভীষ্মের সঙ্গে যুগ্মভাবে রাজ্যশাসনের হাল ধরে বসেছিলেন, তাঁর এই বিচক্ষণতা স্বাভাবিক। প্রখ্যাত ভরতবংশের ধারায় একটি অন্ধপুত্র জন্মালে সে যে সমকালীন আইনপ্রণেতাদের অনুশাসনে রাজা হবার অধিকার পাবে না, মনুপ্রণীত এই রাজনৈতিক আইনের খবর সত্যবতী জানতেন। ফলে ব্যাসের কথা শোনামাত্রই তিনি আকুলভাবে বললেন, হে তপোধন পুত্র আমার! একজন অন্ধ কখনও কুরুবংশের রাজা হতে পারে না— নান্ধঃ কুরূণাং নৃপতিরনুরূপস্তপোধন। আমি চাই— যে নাকি এই ভরত- কুরুবংশের রক্ষা বিধান করবে, যে বাড়াতে পারে পিতৃবংশের উত্তরাধিকার, তুমি সেইরকম একটি পুত্র দাও আমার দ্বিতীয়া পুত্রবধূর গর্ভে। ব্যাস মাতৃবাক্যে স্বীকৃত হলেন।
দ্বিতীয়া বধূ অম্বালিকা ব্যাসকে দেখে চক্ষু মুদলেন না বটে, কিন্তু তাঁরও শরীরে কিঞ্চিৎ বিকার হল, যার ফলে পাণ্ডুবর্ণ পাণ্ডুর জন্মের সম্ভাবনা ঘটল। সত্যবতী তবুও যেন শান্তি পাচ্ছিলেন না। নিজের গর্ভস্থ দুই সন্তানের অপমৃত্যু-হেতু সত্যবতী এতটাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন যে, তিনি ব্যাসের কাছে তৃতীয় একটি পুত্রের জন্য আবারও আবদার করলেন। ব্যাস জননীর কথা ফেলেননি। তিনি রাজি হয়েছেন জননীর সেবাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হয়ে। কিন্তু জ্যেষ্ঠ কুলবধূ অম্বিকা ব্যাসের প্রতি ঘৃণায় নিজে উপগত না হয়ে দাসীকে পাঠিয়ে দিলেন ব্যাসের কাছে। ব্যাস তাঁর জননীর কাছে বড় রানির এই ছলনা না জানিয়ে পারেননি— প্রলম্ভমাত্মনশ্চৈব শূদ্রায়াং পুত্রজন্ম চ। সত্যবতীও এই ছলনার নিরিখে ব্যাসের কাছে আর কোনও উপরোধ করেননি, অন্যদিকে বড় রানি অম্বিকার মানসিকতাও তিনি অস্বীকার করেননি। তিনি তাঁকে কোনও তিরস্কার করেননি, কেননা তিনি বুঝেছেন— রাজকুলবধূ অম্বিকার পক্ষে ব্যাসকে সহ্য করা সত্যিই কঠিন ছিল।

কুন্তী
আমাদের এই মহিলাটি অবশ্য রামায়ণ-বিখ্যাতা অহল্যা, তারা এবং মন্দোদরীকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর আক্রমণ এবং আক্রোশ প্রধানত দু’জনকে লক্ষ করে— – কুন্তী এবং দ্রৌপদী। কাজেই অন্যতরা যখন সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করল— কী এমন হল যে কপালের দোষ দিচ্ছ— তখন তিনি জিহ্বার বাঁধন খুলে মহাভারতের প্রবীণা এবে নবীনা— দুই নায়িকার মুখে ঝামা ঘষে দিলেন। বললেন— কপাল না তো কী? পাঁচ-পাঁচটা পুরুষ মানুষ ওই কুন্তীর সঙ্গে আশনাই করেছে, কামনা করে সঙ্গ দিয়েছে; আর তার ব্যাটার বউ দ্রৌপদী— তাকেও কামনা করেছে পাঁচ-পাঁচটা পুরুষ—পঞ্চভিঃ কামিতা কুন্তী তদ্বধূরথ পঞ্চভিঃ। তবু এঁরা হলেন গিয়ে সতী। তা, একে কপাল বলব না তো কী? পোড়া কপাল আমার! লোকেও এদের সতী বলে। তাই বলছিলাম—কপাল থাকলে কীই বা না হয়— সতীং বদতি লোকোঽয়ং যশঃ পুণ্যৈরবাপ্যতে।
বিদ্যাসাগর ‘কবিরত্নপ্রকরণে’ লিখেছিলেন— “কোনও সম্পন্ন ব্যক্তির বাটীতে মহাভারতের কথা হইয়াছিল। কথা সমাপ্ত হইবার কিঞ্চিৎ কাল পরেই বাটীর কর্তা জানিতে পারিলেন, তাঁহার গৃহিণী এবং পুত্রবধূ ব্যভিচারদোষে দূষিতা হইয়াছেন। তিনি, সাতিশয় কুপিত হইয়া তিরস্কার করিতে আরম্ভ করিলে, গৃহিণী উত্তর দিলেন, আমি কুন্তী ঠাকুরাণীর, পুত্রবধূ উত্তর দিলেন, আমি দ্রৌপদী ঠাকুরাণীর দৃষ্টান্ত দেখিয়া চলিয়াছি। …তাঁহারা প্রত্যেকে পঞ্চপুরুষে উপগতা হইয়াছিলেন; আমরা তদতিরিক্ত করি নাই।”
ভুলে গেলে চলবে না—কুন্তী অসাধারণ রূপ সম্বন্ধে সাবধানও করেছেন, আবার হয়তো নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসার জন্য সেই রূপ ব্যবহারও করেছেন— ইচ্ছে করেই। কিন্তু একভাবে দিনের পর দিন দান-আদানের মাঝখানে দুর্বাসার শুষ্ক রুক্ষ ঋষি-হৃদয় যদি কখনও কুন্তীর প্রতি সরস হয়ে থাকে, যদি অকারণের আনন্দে কখনও চপলতা কিছু ঘটে গিয়ে থাকে তাঁর দিক থেকে—তবে আপন শুদ্ধতা আর সংযমের তেজে কুন্তী হয়তো মুনির সেই সরসতা এবং চাপল্য সযত্নে পরিহার করেছেন, নিজেকে স্থাপন করেছেন প্রিয়শিষ্যা, পুত্র অথবা ভগিনীর ব্যবহার-ভূমিতে। হয়তো ঋষির দিক থেকে এটাও একরকমের পরীক্ষা ছিল, অথবা নিরীক্ষা। অবশেষে দুর্বাসা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হয়েছেন। সন্তুষ্ট হয়েছেন কুন্তীর চরিত্রবলে কাছাকাছি থাকতে থাকতে, সে বিতী ছিলেন। স্বয়ং কুন্তিভোজ তাঁকে তাঁর যাই হোক কুন্তীর নিষ্কাম ব্যবহারে দুর্বাসা বোধহয় আরও খুশি হলেন। বললেন—ঠিক আছে। বর না হয় নাই নিলে। আমি তোমাকে একটা মন্ত্র দিচ্ছি, যে মন্ত্রে যে কোনও দেবতাকে আহ্বান করতে পারবে তুমি। শুধু আহ্বানই নয় এই মন্ত্রের মাধ্যমে যে দেবতাকেই তুমি ডাকবে, সেই দেবতাই তোমার বশীভূত হবেন। কামনা ছাড়াই হোক অথবা সকামভাবেই হোক এই মন্ত্রবলে যে কোনও দেবতা বাঁধা পড়বেন তোমার বাঁধনে, তিনি ব্যবহার করবেন তোমার ভৃত্যের মতো—বিবুধো মন্ত্রসংশান্তো ভবেদ্ ভৃত্য ইবানতঃ।
দুর্বাসার বর, বড় অদ্ভুত বর। পৃথিবীতে যৌবনবতী কুমারীর প্রাপ্য ছিল আরও কত কিছু, কিন্তু সব ছেড়ে কেন যে দুর্বাসা এই দেব-সঙ্গমের বর দিলেন কুন্তীকে—তা ভেবে পাই না। একটা কথা অবশ্য মনে হয়, যা একেবারেই ব্যক্তিগত। মনে হয়—কুন্তীর রূপ ছিল অলোকসামান্য। তার ওপরে তিনি এখন সদ্য যৌবনবতী। দিনের পর দিন একান্তে এই রূপের সংস্পর্শ ঋষি দুর্বাসাকে হয়তো বা যুগপৎ বিপন্ন এবং বিস্মিত করে তুলত, হয়তো বা তাঁর মনে জাগিয়ে তুলত কোনও অকারণ বিহ্বলতা, যাতে করে কুন্তীকে তিনি স্পর্শও করতে পারতেন না, আবার ফেলেও দিতে পারতেন না—এরে পরতে গেলে লাগে, এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে।
সংবৎসরের শেষ কল্পে দুর্বাসা যখন বিদায় সেই বিস্ময়-ব্যাকুল বিপন্নতা তাঁকে কিন্তু এক মানসিক আসঙ্গের প্রত্যুত্তরে কথা ভাবছেন, তখনও কুম্ভীর সম্বন্ধে উদাসীন রাখতে পারেনি। অশব্দ অস্পর্শ চেয়েছেন–হয়তো প্রতিহিংসায় নয়, হয়তো চেয়েছেন—কুন্তী যেন কোনও মর্ত্য মানুষেরই সম্পূর্ণ প্রাপণীয় না হন। পরে দেখব, তা তিনি হনওনি। এমন একটা ভাব যদি থেকে থাকে যে—আমি পেলাম না, অতএব অন্য কেউ যেন তাঁকে না পায়, তবেই কুন্তীর প্রতি দুর্বাসার এই বর আমার কাছে সযৌক্তিক হয়ে ওঠে। আরও সযৌক্তিক হয়ে ওঠে মহাভারতের কবির ব্যঞ্জনা। এমন ব্যঞ্জনা যে, শুষ্ক হৃদয় ঋষির বর দেওয়ার সময়েও মনে রাখতে হচ্ছে যে,–এমন একজনকে তিনি বর দিচ্ছেন যিনি রূপে অতুলনীয়া—ততস্তাম্ অনবদ্যাঙ্গীং গ্রাহয়ামাস স দ্বিজঃ। দেবলোকের বিভূতি দিয়ে দুর্বাসা কুন্তীকে দেবভোগ্যা করে রাখলেন। কুন্তীর রূপ-মাধুর্য সম্বন্ধে একেবারে নিজস্ব কোনও সচেতনতা না থাকলে এক নবযুবতীর প্রতি দেব-সঙ্গমের এই প্রসঙ্গ উত্থাপন এবং বরদান একজন বিরাগী ঋষির দিক থেকে কতখানি যুক্তিযুক্ত?
অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায় নিবানবীন যৌবনমতী কুন্তীর কানে দেব-সঙ্গমের রহস্য-মন্ত্র উচ্চারণ করে দুর্বাসা যেই চলে গেলেন, আর অমনই কুন্তীর কুমারী-হৃদয়ে শুরু হল নতুন এক অনুভূতি। তাঁর হৃদ্যন্ত্র কথা কইতে শুরু করল পুরুষ-গ্রহণের স্বাধীনতায়। সামান্যতম সংশয় শুধু মন্ত্রের বলাবল নিয়ে—পাব তো, যাঁকে চাই, তাঁকেই কি পাব? এ কেমন মন্ত্র যাতে ইচ্ছামাত্র বশীভূত করা যায় যেকোনও অভীপ্সিত পুরুষকে! আমি পরীক্ষা করব মন্ত্রের শক্তি, দেখব—যাকে চাই সে আমার ডাক শুনতে পায় কি না? কুমারী হৃদয়ে এই নবসঙ্গমের ভাবনায় তাঁর ঋতুভাব ত্বরান্বিত হল। ঋতুর এই অস্বাভাবিকতা বৈদ্যশাস্ত্রে মোটেই অস্বাভাবিক নয়, কারণ কুন্তী মন্ত্র পরীক্ষার জন্য সবসময় পুরুষের আসঙ্গ ভাবনায় আকুল ছিলেন–এবং সঞ্চিন্তয়ন্তী সা দদৰ্শৰ্ত্তুং যদৃচ্ছয়া।
তারপর একদিন। সেদিন অন্তঃপুরের শুয়েছিলেন পুষ্পবর্তী কুন্তী। ভোরের সূর্য তাঁর যেন লাল করে দিল। কী ভাল যে লাগছিল। আসছে রক্তিম সূর্য—তাঁর সুমধুর একলা ঘরে পুষ্পের বিছানায় -করের স্পর্শে নবযুবতীর গালখানিও ব! পূর্ব দিগন্তে আকাশের বুক চিরে বেরিয়ে পরাক্রমে মুগ্ধা কুন্তীর, মন এবং দৃষ্টি—দুইই স্কিলগ্নের এই দেবতাটিকে এক দৃষ্টিতে দেখতে পুরুষের সন্ধান পেলেন। দেখতে পেলেন তাঁর কানে সোনার কুণ্ডল, বুক-পিঠ জুড়ে সোনার বর্ম—আমুক্তকবচং দেবং কুণ্ডলাভ্যাং বিভূষিতম্।
দেখতে কুন্তী তাঁর মধ্যে দিব্যদর্শন নিবদ্ধ হল সূর্যের দিকে। যা কায় দেব-তত্ত্বের মূল-স্বরূপ ওই সূর্যকেই কুন্তী তাঁর মন্ত্র-পরীক্ষার প্রথম আধার বলে বেছে নিলেন। হৃদয়ে হাত ঠেকিয়ে আচমন-পুরশ্চরণ করে দুর্বাসা মন্ত্রে কুন্তী আহ্বান জানালেন সূর্যকে। সূর্য নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করলেন। আকাশ থেকে নিজের তাপ-বিতরণের কাজ যেমন চলার তেমনই চলল, কিন্তু অলৌকিকতার সূত্রে তিনি শরীর পরিগ্রহ করে কুন্তীর সামনে এসে দাঁড়ালেন—মুখে হাসি, মাথায় বদ্ধমুকুট, তেজে চারদিক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কুন্তীর জীবনের প্রথম অভীপ্সিত পুরুষ, তিনি তাঁকে ডেকেছিলেন সানুরাগে—তস্য দেবস্য ভাবিনী।
অতএব এই অনুরাগের প্রত্যুত্তরের মতো সুন্দর ভাষায় সূর্য বললেন—ভদ্রে। প্রথম আলাপে স্ত্রী-লোককে ‘ভদ্রা’ সম্বোধনটি অনেকটা ফরাসিদের মাদামের মতো। এই সম্বোধনের মধ্যে প্রথম আলাপের দূরত্বটুকু বজায় রেখেই সূর্য বলেন—ভদ্রে! আমি এসেছি তোমার মন্ত্রের শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে। এখন আমি সম্পূর্ণ তোমার বশীভূত—বলো আমি কী করব—কিং করোমি বশো রাজ্ঞি? অনুরাগবতী কুন্তীর বুঝি এইবার আপন কুমারীত্বের কথা স্মরণ হল। কুন্তী বললেন—আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই ফিরে যান। আমি কৌতুকবশে অর্থাৎ এমনি মজা দেখার জন্য আপনাকে ডেকেছি, অতএব আপনি এখন ফিরে যান—কৌতূহলাৎ সমাহৃতঃ প্রসীদ ভগবন্নিতি। সংস্কৃতে আছে—প্রসীদ—প্রসন্ন হোন, ফিরে যান; ইংরেজিতে এই ‘প্রসীদ’ হল—প্লিজ।
যৌবনবতী কুন্তী সানুরাগে দেব-পুরুষকে ডেকেছেন মজা দেখার জন্য—কৌতূহলাৎ সমাহৃতঃ,—তিনি জানেন না একক পুরুষকে সানুরাগে ঘরে ডাকলে সে আর প্রসন্ন হয়ে ফিরে যায় না; প্রথম ভদ্র সম্বোধনের পরেই তার নজর পড়ে অনুরাগবতীর শরীরে। উচ্চাবচ প্রেক্ষণের পর যথাসম্ভব ভদ্র সম্বোধনে সে বলে—কৃশকটি সুন্দরী আমার! যাব, নিশ্চয় যাব, কিন্তু আমাকে সাদরে ডেকে এনে নিজের ইচ্ছে করে এমন করে পাঠিয়ে দেবে আমাকে—ন তু দেবং সমাহূয় ন্যায্য তোমার ইচ্ছেটুকু জানি। তুমি চাও—সোনার পুত্র হোক তোমার গর্ভে। কিন্তু তার জন্য নিজেকে আমার কাছে ছেড়ে দাও-
সূর্য পরিষ্কার বললেন—আমি -পরা সোনার কুণ্ডল-পরা আমার একটি তোমার শরীরের মূল্যটুকু দিতেই হবে। তুমি ত্বমাত্মপ্রদানং বৈ কুরুম্ব গজগামিনি। তুমি যেমন ভেবেছ তেমন পুত্রই হবে তোমার এবং আমিও যাব তোমার সঙ্গে মিলন সম্পূর্ণ করে অথ গচ্ছাম্যহং ভদ্রে ত্বয়া সঙ্গম্য সুস্মিতে।
সূর্যের প্রণয়-সম্বোধনের মধ্যে এখন রমণীর অলসগামিতা অথবা মধুর হাসিটিও উল্লিখিত হচ্ছে। অবশ্য এই সপ্রণয় ভাষণের মধ্যে পুরুষের ভয় দেখানোও ছিল। কথা না শুনলে অভিশাপ দিয়ে তোমার বাবা আর সেই ব্রাহ্মণ ঋষিটিকে ধ্বংস করব—এর থেকেও বড় দায় চাপানো হয়েছিল কুন্তীর নিজের চরিত্রের ওপরই। সূর্য বলেছিলেন—তুমি যে আমার মতো একজন দেবপুরুষকে ঘরে ডেকে এনেছ—এই অন্যায় কাজ তোমার বাবা জানেন না। কিন্তু তোমার অপরাধে আমি ধ্বংস করব তাঁকে এবং তাঁর পরিজনকে। এবারে সূর্য কুন্তীর স্বভাব নিয়েই বড় গালাগালি দিয়ে ফেললেন। সূর্য বলতে চাইলেন— বোকা হলেন সেই মুনি যিনি তোমাকে এই মন্ত্র দিয়েছেন। পুরুষের সম্বন্ধে যে রমণীর সংযমটুকু নেই, সেই রমণীকে এই মন্ত্র দেওয়াটাই একটা বাতুলতা। তা সেই ব্রাহ্মণকে গুরুতর দণ্ড দেব আমি, যিনি তোমার স্বভাব-চরিত্র না জেনেই এই পুরুষ-আহ্বানের মন্ত্র তোমায় শিখিয়েছেন— শীলবৃত্তমবিজ্ঞায়… যোঽসৌ মন্ত্রমদাত্তব।
সূর্য যে প্রত্যাখ্যাত হয়েই কুন্তীর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে গালাগালি দিচ্ছেন, সে-কথা আমরা বেশ বুঝতে পারি। কুন্তীর মন্ত্র-পরীক্ষার মধ্যে কৌতুক ছাড়া অন্য কোনও প্রবৃত্তি ছিল বলে আমার মনে করি না। একান্ত মানবোচিতভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখুন—অসাধারণ কোনও লাভের অভিসন্ধি মেশানো এমন কোনও মন্ত্র যদি আমরা পেতাম, তবে আমরাও তা পরীক্ষা করেই দেখতাম। মন্ত্রের শক্তি যে আছে, সে সম্বন্ধে মানুষ ইতিবাচক ধারণা পূর্বাহ্নে পোষণ করে না বলেই মণি-মন্ত্র-মহৌষধি—মানুষ তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করতে চায়। তার মধ্যে এই মন্ত্র হল বশীকরণের মন্ত্র; আধুনিক যুবক-যুবতীর হাতে যদি পুরুষ বা রমণী বশ করার এমন সিদ্ধমন্ত্র থাকত, তবে তা অবশ্যই পরীক্ষিত হত কুন্তীর মতোই কৌতুকে—এ- কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
তবে দেবপুরুষ কুন্তীকে যে গালাগালি দিচ্ছিলেন, সে কুন্তীর স্বভাব-চরিত্রের জন্য যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি নিজের সম্মানের জন্য। সুন্দরী রমণীর কাছে সাদর আমন্ত্রণ লাভ করে কোন পুরুষেরই বা প্রত্যাখ্যাত হতে ভাল লাগে, নিজের বন্ধু-বান্ধব বা সমাজের কাছেই বা তার মুখ থাকে কতটুকু? সূর্যের আসল কথাটা এবার বেরিয়ে এল। তিনি বললেন—তুমি যে আমাকে অনুরাগ দেখিয়ে এখন বঞ্চিত করছ—এসব আকাশ থেকে আমার বন্ধু দেবতারা দেখছেন আর হাসছেন—পুরন্দরমুখা দিবি। ভুয়া প্ৰলব্ধং পশ্যন্তি স্ময়ন্ত ইব ভাবিনি। তোমার তো দিব্যদৃষ্টি আছে, একবার তাকিয়ে দেখো আকাশপানে। কুন্তী সুর্যের কথা শুনে আকাশের দিকে চাইলেন। দেখলেন অন্য দেবতাদের। কুন্তী নিজের বোকামিতে সত্যিই লজ্জা পেলেন। বড় হয়ে গেলেন। বললেন—তবু আপনি চলে যান এই শরীর দিয়েছেন, মেয়েদের কাছে এই আমার পিতা-মাতা আমাকে শরীরটাই আমাকে রক্ষা করতে হবে তুক-লিপ্স কুমারী এক মুহূর্তে যেন দ্বিতীয় একটি কুমারীর শরীর তো আমি র-রক্ষার মূল্যই যে সবচেয়ে বেশি, কারণ করতে পারব না, অতএব আমার এই কুমারী- বীণাং বৃত্তং পূজ্যতে দেহরক্ষা। কুন্তী এবার অনুনয়ের সুরে বললেন—বিশ্বাস করুন, আমি আমার অল্প বয়সের চঞ্চলতায় শুধু কৌতুকের বশে মন্ত্রশক্তি জানার জন্য আপনাকে ডেকেছি। এটা ছেলেমানুষি ভেবেই আপনি ক্ষমা করে দিন।
সূর্য বললেন—বয়স তোমার অল্প বলে আমিও তোমাকে এত সেধে সেধে বলছি। অন্য কেউ কি আমার এত অনুনয় পাওয়ার যোগ্য? তুমি নিজেকে ছেড়ে দাও আমার কাছে, তাতেই তোমার শান্তি হবে—আত্মপ্রদানং কুরু কুন্তি কন্যে শাস্তিস্তবৈবং হি ভবেচ্চ ভীরু। সূর্য শুধু একটা কথাই ভাবছেন। ভাবছেন-যে রমণী প্রথম যৌবনের চঞ্চলতায় সাদরে দেবপুরুষকে কাছে ডেকেছে, উপভোগের দ্বারাই তার শান্তি হবে। হয়তো এটাই ঠিক কুন্তীর প্রথম আহ্বানটুকু মিথ্যে ছিল না, কিন্তু ডাকার পর পুরুষের একান্ত দুরবগ্রহ একমুখী প্রয়াস দেখে এখন তিনি চিন্তিত, ব্যথিত। যে কোনওভাবেই হোক, সূর্য কুন্তীর শরীর- সম্ভোগ ব্যতিরেকে ফিরে যেতে চান না। স্বর্গের দেবতা হওয়া সত্ত্বেও মনুষ্য-রমণীর আহ্বানে তিনি মানুষের শরীরে নেমে এসেছেন ভুঁয়ে। এখন এই সামান্যা মানবী তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবে, এ তিনি সহ্য করতে পারছেন না। কুন্তীর কাছে বারংবার দেবসমাজে তাঁর ভাবী অপমানের কথা তিনি বলেওছেন, কারণ সেটাই তাঁর প্রধান লজ্জা — গমিষ্যাম্যনবদ্যাঙ্গি লোকে সমবহাস্যতাম্।
কুন্তী অনেক চিন্তা করলেন। সূর্য সতেজে তাঁর হাত ধরেই রয়েছেন। তবু মুখখানি নিচু করে তিনি কত কিছুই ভেবে নিলেন। বুঝলেন—তাঁর প্রত্যাখ্যানে নিরপরাধ কুন্তিভোজ এবং স্বয়ং দুর্বাসার বিপদ নেমে আসতে পারে। অন্যদিকে স্বর্গের দেবতা উপযাচক হয়ে তাঁর কাছে প্রসাদ ভিক্ষা করছেন, তাঁর হাতখানিও ধরে আছেন নিজের হাতে—এই বিচিত্র অনুভূতি তাঁর মোহও জন্মাচ্ছে বারে বারে। একদিকে তিনি ‘শাপ-পরিত্রস্তা’ অন্যদিকে ‘মোহেনাভিপরীতাঙ্গী’–এই ভয় এবং মোহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কুন্তী এবার তাঁর ভয় এবং মোহ দুই-ই প্রকাশ করলেন সূর্যের কাছে
ভয়াবিষ্টা কুন্তী বললেন—আমার বাবা, মা, ভাই, আত্মীয়-স্বজন কী বলবে আমাকে ? তাঁরা এখন বেঁচে আছেন, আর আমি সমাজের নিয়ম ভেঙে নিজেকে হারিয়ে ফেলব? যদি সব নিয়ম ভেঙে এমনি করে হারিয়ে ফেলি নিজেকে—ত্বয়া তু সঙ্গমো দেব যদি স্যাদ্ বিধিবর্জিতঃ—তা হলে আমার বংশের মান-মর্যাদা সব যাবে।
মোহাবিষ্টা কুন্তী বললেন—আর এত কথা শুনেও যদি মনে হয়, আপনি যা বলছেন তাই ধর্ম, তবে আমি আত্মীয়-স্বজনের দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে আপনার ইচ্ছে পূরণ করব—ঋতে প্রদানাদ্ বন্ধুভ্য স্তব কামং করোম্যহম্। কিন্তু আমার একটাই কথা—আমার এই শরীর দিয়েও আমি সতী থাকতে চাই। কুন্তী এই মুহূর্তে সূর্যকে সম্বোধন করলেন ‘দুর্ধর্ষ’ বলে— আত্মপ্রদানং দুর্ধর্ষ তব কৃত্বা সতী ত্বহম্। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। মনস্তত্ত্ববিদেরা বলেন—অধিকাংশ ধর্ষণের ক্ষত্রে—যেখানে পরস্পরের পরিচিতি আছে—সেখানে রমণীর দিক থেকে বাধাদানের ব্যাপার থাকলেও পরবর্তী সময়ে কিছু আত্মসমর্পণের ইচ্ছাও থেকে যায়। কিন্তু কি রমণী, কি পুরুষ, সার কথাটা কুন্তীর মুখ দিয়েই তিন ভুবনের -শরীর দিয়েও আমি সতী থাকতে চাই। প্ৰথম রমণীর পক্ষে বিধিবহির্ভূত মিলনের এই হাহাকারটুকু যৌবনের হাজারও চঞ্চলতার বড়ই স্বাভাবিক—আমি আপনাকে শরীর দিয়েও সভী থাকতে চাই—আত্মপ্ৰদানং দুর্ধর্ষ তব কৃত্বা সতী ত্বহম্।
সূর্য সব বোঝেন। কুন্তীকে সামান্য উন্মুখ দেখা মাত্রই তিনি কথা আরম্ভ করলেন একেবারে কামুক পুরুষের স্বার্থপরতায়। বললেন—বরারোহে। বরারোহা মানে জানেন কি? A good mount for a distinguished personality. সূর্য বললেন—বরারোহে! তোমার বাবা-মা বা অন্য কোনও গুরুজন—কেউ তোমার প্রভু নন অর্থাৎ জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তে তাঁদের ইচ্ছামতো চলার কথা নয় তোমার। যাতে তোমার ভাল হবে, সেই কথাই বরং আমার কাছে শোনো। সূর্য এবার পণ্ডিত-জনের পাণ্ডিত্য দেখিয়ে বললেন –‘কম্’ ধাতুর অর্থ কামনা করা। কন্যা শব্দটাই এসেছে এই ধাতু থেকে, অতএব কন্যাজন মাত্রই সব পুরুষকেই কামনা করতে পারে, সে স্বতন্ত্রা—সর্বান্ কাময়তে যস্মাৎ কমেধাতোশ্চ ভাবিনি। তস্মাৎ কন্যে সুশ্রোণি স্বতন্ত্রা বরবর্ণিনি।
সূর্য কন্যা-শব্দের মধ্যেই কামনার উৎস প্রমাণ করে দিয়ে কুন্তীর মনের আশঙ্কা দূর করতে চাইলেন। বোঝাতে চাইলেন সূর্যের প্রতি তাঁর অনুরাগবতী হওয়াটাই যথার্থ হয়েছে। কামনার চূড়ান্ত পর্যায়ে কুন্তীর কাছে সূর্যের যুক্তি হল—-স্ত্রী এবং পুরুষ পরস্পরকে কামনা করবে, এইটাই স্বাভাবিক, এবং অন্যটাই বিকার—স্বভাব এষ লোকানাং বিকারোহন্য ইত্য স্মৃতঃ। সূর্য জানেন—এত যুক্তি, এত স্বভাব বোধনের পরেও কুমারী কুন্তীর মনে সামাজিকের সেই ভ্রূকুটি-কুটিল জিজ্ঞাসাটুকু থেকেই যাবে। অতএব প্রথম যৌবনবতী রমণীর রিরংসা এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কুন্তীকে আশ্বাস দিয়ে সূর্য বললেন—আমাদের মিলনের পর তুমি আবারও তোমার কুমারীত্ব ফিরে পাবে—সা ময়া সহ সঙ্গম্য পুনঃ কন্যা ভবিষ্যসি—আর তোমার ছেলেও হবে অনন্ত খ্যাতির আধার এক মহাবীর। সূর্যের এই আশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে কুন্তী তাঁকে সম্বোধন করেছেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচার ভঙ্গীতে—হে আমার আঁধার-দূর-করা আলো—সর্বতমোনুদ। এই মুহূর্তে কুন্তী জানেন—যে ছেলে জন্ম নেবে সূর্যের ঔরসে, সেই ছেলের সঙ্গে তাঁর থাকা হবে না, তাকে লালন- পালন করার সামাজিক সাহস তাঁর নেই। থাকলে কুমারীত্বের জন্য লালায়িত হতেন না তিনি। কিন্তু ‘দুর্ধর্ষ’ এই তেজোনায়ক ফিরে যাবেন না অসঙ্গমের অসন্তোষ নিয়ে। অতএব সেই ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্মলগ্নেই তাঁর স্বয়ম্ভরতার নিরাপত্তা চান তিনি। কুন্তী বললেন— আপনার ঔরসে আমার যে পুত্র হবে সে যেন আপনার অক্ষয় কবচ এবং কুণ্ডল নিয়েই জন্মায়। সূর্য বললেন—তাই হবে ভদ্রে! এই কবচ এবং কুণ্ডল অমৃতময়। তোমার সেই পুত্র অমৃতময় বর্ম এবং কুণ্ডল নিয়েই জন্মাবে।
কুন্তী বললেন-যদি তাই হয়, যদি আমার পুত্রের কুণ্ডল এবং বর্ম দুটিই অমৃতময় হয় অর্থাৎ জীবনে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা যদি তার সঙ্গম, যেমনটি আপনি বলেছেন আমি তো ওই থাকে, তবে হোক আপনার ঈপ্সিত রাজি—অস্ত্র মে সঙ্গমো দেব যথোক্তং মতো শক্তি, রূপ, অধ্যবসায়, তেজ এবং ভগবংস্ত্বয়া। মনে করি—আমার পুত্র ধর্মের দীপ্তি নিয়ে জন্মাবে। কুন্তী দেখেছেন—সূর্যের হাত থেকে যখন নিস্তার নেই-ই, সেক্ষেত্রে তাঁর কন্যাসত্তা এবং ভাবী পুত্রের নিরাপত্তা—দুটিই তাঁর একান্ত প্রয়োজন—একটি বাস্তব কারণে, অন্যটি মানবিক। প্রথম যৌবনের কৌতূহলে তিনি বোকার মতো ভুল করে ফেলেছিলেন, তাকে তিনি শুধরে নিয়েছেন মনস্বিনীর মতো অতি দ্রুত, সুর্যের দ্বারা প্রায় আলিঙ্গিত অবস্থায়। ভবিষ্যৎ জীবনের পরিণত মাতৃত্বের ব্যাপ্তি প্রথম যৌবনের মাদকতার মধ্যে আশা করা যায় না বলেই, অন্তত পুত্রের নিরাপত্তার ভাবনাই যে তাঁকে এই মুহূর্তে স্বতন্ত্র নারীর মহিমা দিয়েছে, তাতে সন্দেহ কী? ভবিষ্যতে কর্ণের শত অভিমানের উত্তরে সূর্যের দুরাগ্রহ এবং তাঁর অসহায়তার জবাবদিহি সম্ভব ছিল না বলেই অন্তত এই নিরাপত্তার চিন্তাও আমার কাছে কুন্তীর বাস্তববোধের পরিচয়।
কুমারীত্ব এবং কুমারীপুত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতেই কুন্তী তাঁর প্রথম মিলনের কৌতুক যেন আবারও ফিরে পেয়েছেন, অন্তত দেখাচ্ছেন সেইরকম। সূর্যের কথায় সায় দিয়ে তিনি বলেছেন—হোক সেই পরমেন্সিত মিলন–সঙ্গমিয্যে ত্বয়া সহ—যেমনটি তুমি চাও। আর প্রার্থিতা রমণীর সোচ্চার আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য একাধিক প্রিয় সম্বোধনে ভরিয়ে তুলেছেন কুন্তীকে—আমার রানি, যৌবন শোভার আধার, বামোরু। সূর্য আলিঙ্গন করলেন কুন্তীকে, হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন কুন্তীর নাভিদেশ। দেবভাব থাকা সত্ত্বেও মানুষের শরীরে সূর্যের করস্পর্শের এই ইঙ্গিত পণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ফুটিয়ে তুলতে দ্বিধা করেননি। বলেছেন—বসনমোচনায় ইত্যাশয়ঃ ।
নবীন যৌবনবতী কুন্তী যেদিন সূর্যকে দেখে সকৌতুকে পুরুষ বশীকরণের মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, সেদিন তিনি ভেবেছিলেন—দেখি তো পুরুষকে কাছে ডাকলে কেমন হয় ! দেখি তো পুরুষ ভোলালে কেমন হয়! এই কৌতুক আর কৌতুক রইল না, কঠিন বাস্তব আর সূর্যের ‘দুর্ধর্ষতা’য় সে কৌতুক এক মুহূর্তে কুন্তীকে প্রৌঢ়া করে তুলল। আর এখন সেই অভীপ্সিত সঙ্গম-কৌতুকের মুহূর্তে পুরুষের ধর্ষণ-মুখরতায় কুন্তী অচেতন হয়ে গেলেন। মহাভারতের কবি দেবতা পুরুষকে বাঁচানোর জন্য লিখেছেন —–কুন্তী সূর্যের তেজে বিহ্বল হলেন, বিছানায় পড়ে গেলেন অচেতনের মতো—পপাত চাথ সা দেবী শয়নে মূঢ়চেতনা— মোহাবিষ্টা, ছিন্ন লতার মতো— ভজ্যমানা লতেব। আমরা জানি—ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গমে প্রবৃত্ত হয়ে কুন্তী সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন আর ‘দুর্ধর্ষ’ সূর্য তাঁর সঙ্গম সম্পন্ন করেছেন কুন্তীর অচেতন অবস্থাতেই, কারণ আমরা দেখেছি, ব্যাসদেবকে অধ্যায় শেষ করতে হয়েছে— একাকী সূর্যের সঙ্গম-সন্তোষের পর কুন্তীর চেতনা ফিরিয়ে দিয়ে—সংজ্ঞাং লেভে ভুয় এবাথ বালা। ব্যাসের শব্দ প্রয়োগও খেয়াল করবেন—‘বালিকা আবারও চেতনা ফিরিয়া পাইল’ । এই বালা বা বালিকা শব্দের মধ্যেই কুন্তীর অজ্ঞতা, চঞ্চলতা, কৌতুকপ্রিয়তা ইত্যাদি নির্দোষ গুণগুলি নিহিত করে মহাভারতের কবি তাঁকে সমস্ত দোষ থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
কুন্তী আর সূর্যের প্রথম মিলন কাহিনীটি আমি সবিস্তারে শোনালাম। এর কারণ এই নয় যে কুমারী অবস্থায় সূর্যের সঙ্গে কুম্ভীর সঙ্গম-রসের রগরগে বর্ণনা দিয়ে অল্পস্বল্প পাঠকের চিত্ত- বিনোদন করায় আমার বড় মোহ আছে। এই বিস্তারটুকু আমার কাছে এইজন্য প্রয়োজনীয় যে, অনেকেই কুন্তীকে খুব দোষারোপ করে থাকেন। পরবর্তী সময়ে ভাগ্যহত কর্ণের যন্ত্রণা যত বাড়তে থাকে এই দোষারোপও ততই বাড়তে থাকে। এই বর্ণনার মাধ্যমে আমি কুন্তীর নাচার অবস্থাটা বোঝাতে চেয়েছি।
আমরা একবারের জন্য পেছন ফিরে তাকাব হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির সেই ঘরটির মধ্যে যেখানে ‘অশেষ-যোগ-সংসিদ্ধ’ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস মায়ের আদেশ মেনে নিয়ে বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর ক্ষেত্রে পুত্র উৎপাদন করছিলেন। আপনারা জানেন—রাজবধূর বিদগ্ধ রুচিতে অম্বিকা এবং অম্বালিকা—কেউই ব্যাসের সঙ্গে মিলনের ঘটনাটা পছন্দ করেননি। কিন্তু তাঁরা হলেন নিরুপায়, কারণ সে যুগে এই নিয়োগ প্রথা ছিল সমাজ-সচল। তার মধ্যে রাজমাতা সত্যবতী নিজেই হস্তিনাপুরের অরাজক সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর জন্য দুই বধূকে ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হতে উপরোধ করেছিলেন।
সত্যবতীর ইচ্ছায় এই দুই রাজবধূর কোনও সম্মতি লোপ হয়ে যাবে—শুধু এই কারণে তাঁদের না। কিন্তু তাঁদের জন্য কুরুবংশের মতে রাজি করাতে পেরেছিলেন সত্যবতী। সত্যবতী বলেছিলেন—কিছুই নয়, তোমাদের ভাশুর আসবেন নিশীথ রাতে, তোমরা দুয়োর খুলে অপেক্ষা কোরো। পরাণ সখার সঙ্গে অভিসারে পর্যব মতো।
রাজবধূর বিদগ্ধ-রুচিতে এই নিশীথ-মিলন এ মিলন বস্তুত তাঁদের কাছে ছিল ধর্ষণের স্বয়ং ব্যাসও এটা জানতেন। সত্যবতীকেও তিনি বারবার সাবধান করেছেন। বলেছেন- আমার বিকৃত রূপ তাঁদের সহ্য করতে হবে—সে-কথা মনে রেখো—বিরূপতাং মে সহতাং তয়োরেতৎ পরং ব্রতম্। কিন্তু বলে-কয়েও কোনও শরীর মিলনে কি রুচি নির্মাণ করা যায়? শত-শত প্রজ্জ্বলিত দীপের আলোয় ব্যাসকে দেখেই অম্বিকা তিক্ত ঔষধ সেবনের মানসিকতায় সেই যে চোখ বুজেছিলেন, আর চোখ খোলেননি। তাঁর পুত্র শত হস্তীর শক্তি সত্ত্বেও অন্ধ হবে—ব্যাসই সে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এই দুর্ঘটনার ফলে দ্বিতীয়া রানি অম্বালিকার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল, কারণ অন্ধ ব্যক্তি কুরুবংশের রাজা হতে পারে না, অতএব তাঁর চক্ষু মুদে থাকা চলবে না।
চক্ষু মুদে যে অনীপ্সিত সঙ্গমে বড় রানি কোনওরকমে পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন, অম্বালিকাকে সেই সঙ্গম চোখ খুলে দেখতেই হল বলেই তাঁর কাছে এই সঙ্গম সম্পূর্ণ ধর্ষণের বিকারে ধরা দিল। মহর্ষির লালচে কটা দাড়ি, মাথাভর্তি জটা, তপোদীপ্ত চক্ষু এবং গায়ের উৎকট গন্ধ—সব কিছু টান টান চোখে দেখে দ্বিতীয়া রানির শরীর ভয়ে ফ্যাকাসে- হলুদ হয়ে গেল। সত্যবতী পুনরায় জিজ্ঞাসা করলে ব্যাস বললেন—এই রানির ছেলে পাণ্ডুবর্ণ হবে।
বনে আসা, আবার বনে এসেও মৃগয়ায় ডুবে থাকা—এই সবকিছুর মধ্যেই পাণ্ডুর দুর্বার হৃদয়-যন্ত্রণা ছিল, কিছু আত্ম-বঞ্চনা ছিল, যার চরম মুহূর্তে মহাভারতের কবি কিন্দম মুনির অভিশাপ বর্ণনা করেছেন। পাণ্ডু নাকি মৈথুনরত দুটি হরিণ-হরিণীকে মেরে ফেলবার পরেই দেখতে পেলেন হরিণটি ছিল এক ঋষিকুমার। মনুষ্যবসতির মধ্যে মৈথুন চরিতার্থ করার মধ্যে যে লজ্জা আছে, সেই লজ্জা থেকে বাঁচবার জন্যই ঋষিকুমার হরিণের আচ্ছাদন গ্রহণ করেছিলেন। ঋষি পাণ্ডুকে বলেছিলেন—স্ত্রীসম্ভোগের সুখ আপনি জানেন, অথচ সেই অবস্থায় আমাকে মেরে আপনি কী নারকীয় কাজটাই না করলেন! ঋষিকুমার বলেছিলেন—আমি পুত্রের জন্য মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম, আপনি সেই আশা বিফল করে দিলেন—পুরুষার্থফলং কর্তুং তৎ ত্বয়া বিফলীকৃতম্।
প্রাথমিকভাবে পাণ্ডু নিয়োগপ্রথারও পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি স্বয়ং বিচিত্রবীর্যের পুত্র নন, তাঁর স্ত্রীর গর্ভে তিনি ব্যাসের ঔরসে জন্মেছিলেন। নিজের জন্ম-প্রক্রিয়ার এই অকৌলীন্যে হয়তো প্রাথমিকভাবে তিনি নিয়োগের বিরোধী ছিলেন। কারণটা পরিষ্কার। বাবা বিচিত্রবীর্য বেঁচে ছিলেন না, তাঁর অনধিকৃত ক্ষেত্রে কেউ সন্তান দান করলেন—সে এক কথা। আর পাণ্ডু বেঁচে আছেন, অথচ তাঁর চোখের সামনে বা আড়ালে অন্য কেউ তাঁরই প্রিয়া পত্নীতে উপগত হবে—এমন একটা অনধিকারচর্চা তাঁকে হয়তো ঈর্ষাকাতর করে তুলেছিল।
প্রিয়তমা দুই পত্নীর মুখের দিকে চেয়ে কাতর দীর্ঘশ্বাসে তিনি বলেছিলেন—সন্ন্যাসী হয়ে যাব আমি। আমার সন্তান উৎপাদন করার শক্তি নেই, কী দরকার আমার ঘর-গেরস্তির— নাহং… স্বধর্মাৎ সততাপেতে চরেয়ং বীর্যবর্জিতঃ। এই অবস্থায় অবশ্যই প্রশ্ন আসে এবং বলা যায়-পাণ্ডু তুমি কোনও ব্রাহ্মণের সাহায্য নিয়ে নিয়োগ-প্রথায় পুত্রলাভ করো। এইরকম আশঙ্কার আগেই পাণ্ডু তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন—কুন্তী-মাদ্রী দু’জনের কাছেই। পাণ্ডু বলেছিলেন—আমি কি কুত্তা নাকি যে, অন্যের কাছে ছেলে দাও, ছেলে দাও করে কাতর চোখে ভিক্ষে করব; যে ব্যাটা এমন করে, সে কুত্তা—উপৈতি বৃত্তিং কামাত্মা স শুনাং বর্ততে পথি।
পাণ্ডু একটা গল্প বললেন কুন্তীকে। বললেন—কেমন করে এক বীর রমণী স্বামীর আদেশ মতো এক যোগসিদ্ধ ব্রাহ্মণকে আশ্রয় করে পুত্রলাভ করেছিলেন। গল্প বলার শেষে পাণ্ডুর অনুরোধ—কুন্তী! আমি মত দিচ্ছি। তুমি কোনও বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের ঔরসে পুত্র-লাভের চেষ্টা করো।
পাণ্ডু গল্প বলেছিলেন। তার উত্তরে কুন্তীও এবার গল্প বললেন পাণ্ডুকে। বললেন, পাণ্ডুরই ঊর্ধ্বতন এক বিরাট পুরুষ ব্যুষিতাশ্বের গল্প। ব্যুষিতাশ্ব বহুতর যজ্ঞ এবং ধর্মকার্য করে দেবতাদের তুষ্ট করেছিলেন বটে, তবে নিজের স্ত্রী ভদ্রার প্রতি তাঁর অতিরিক্ত আসক্তি এবং সম্ভোগের ফলে তাঁর শরীর হল ক্ষীণ এবং তিনি অপুত্রক অবস্থাতেই মারা গেলেন। মারা যাবার পর মৃত স্বামীকে জড়িয়ে ধরে অশেষে-বিশেষে বিলাপ করলেন ভদ্রা। সেই বিলাপের সুর—কুন্তী যেমন শুনিয়েছেন—সে সুর প্রায় পূর্বকল্প বলা যেতে পারে। যাই হোক ব্যুষিতাশ্বের প্রেতাত্মা অন্তরীক্ষ- লোক থেকেই জবাব দিল—তুমি ওঠো, সরে ও, চতুর্দশী আর অষ্টমী তিথিতে তোমার শয্যায় ফিরে আসব আমি। আমারই সন্তান তোমার গর্ভে—জনয়িষ্যাম্যপত্যানি ত্বয্যহং
MA অলিদাসের রতি-বিলাপ সংগীতের চারুহাসিনি।
কুন্তীর জীবনে স্বামীর ভালবাসার এই বুঝি চরম মুহূর্ত। পাণ্ডুর আবেগ-মধুর অনুনয়ে কুন্তী বিগলিত হলেন। আস্তে আস্তে শোনাতে আরম্ভ করলেন কুন্তিভোজের বাড়িতে সেই অতিথি-পরিচর্যার কাহিনী। বললেন তাঁর পরম তুষ্টির কথা এবং অবশ্যই বশীকরণ মন্ত্রের কথা। এই বিষণ্ণ গম্ভীর মুহূর্তে, যখন তিনি স্বামী থাকতেও স্বামীর ইচ্ছাতেই অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে চলেছেন, এই মুহূর্তে তাঁর পক্ষে সেই কৌতুক-সঙ্গমের কথা উল্লেখ করা সম্ভব হল না। স্বামী যা চাইছেন ঠিক সেইরকম অর্থাৎ তাঁর অতি-অভিলষিত একটি খবর দেওয়ার সময় তাঁর পক্ষে স্থূলভাবে বলা সম্ভব হল না—মহারাজ ! আমার একটি ছেলে আছে। কুন্তী এখানে নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছেন। তিনি দেবতা আহ্বানের মন্ত্র জানেন, সেটা তিনি করবেন। কিন্তু কোন দেবতাকে আহ্বান করবেন, কখন করবেন—এই সমস্ত ভার তিনি পাণ্ডুর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। স্বামীর সম্মতি, স্বামীর চাওয়া—এই পরম অধীনতার মধ্যেই তিনি যেন পাণ্ডুর পুত্র পেতে চাইছেন, দেবতার আহ্বান তাঁর কাছে যান্ত্রিকতামাত্র।
কুন্তী বললেন—তুমি অনুমতি দাও। দেবতা, ব্রাহ্মণ—যাঁকে তুমি বলবে—যং ত্বং বক্ষ্যসি ধর্মজ্ঞ দেবং ব্রাহ্মণেব চ—তাঁকে আমি ডাকতে পারি। তবে কোন দেবতাকে ডাকব, কখন ডাকব—এই সমস্ত ব্যাপারে আমি তোমার আদেশের অপেক্ষা করব, আমি কিছু জানি না। তোমার ঈন্সিত কর্মে তোমারই দেশ নেমে আসুক আমার ওপর—ত্বত্ত আজ্ঞাং প্রতীক্ষন্তীং বিদ্ধ্যস্মিন কর্মণীন্সিতে।
কুন্তী সংযত চিত্তে ধর্মের পূজা করে দুর্বাসার মন্ত্রে ধর্মকে আহ্বান জানালেন মিলনের জন্য। ধর্ম এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন—কী চাই তোমার কুন্তী। কুন্তী বললেন—পুত্র চাই। পুত্র দিন। তারপর শতশৃঙ্গ পর্বতের বনের ভিতর একান্তে ধর্মের সঙ্গে মিলন হল কুন্তীর— শয্যাং জগ্রাহ সুশ্রোণী সহ ধৰ্মেণ সুব্রতা।
জ্যৈষ্ঠ মাসের এক পূর্ণিমা তিথিতে কুন্তীর প্রথম ছেলের জন্ম হল। নাম হল যুধিষ্ঠির। প্রথম পাণ্ডব। ধর্মের দান প্রথম পুত্রটি লাভ করেই পাণ্ডুর এবার ক্ষত্রিয় জাতির শৌর্য- বীর্যের কথা স্মরণ হল। কুন্তীকে বললেন—লোকে বলে ক্ষত্রিয় জাতির শক্তি-বলই হল সব। তুমি মহাশক্তিধর একটি পুত্রের কথা চিন্তা করো। পাণ্ডুর ইচ্ছা জেনে কুন্তী নিজেই এবার বায়ুদেবতাকে স্মরণ করলেন। কার মধ্যে তিনি মহাশক্তিধর। বায়ু এলেন।
কুন্তীর দ্বিতীয় পুত্র লাভ হল—ভীমসেন।
একটি বীরপুত্রের জন্য তিনি নিজে তপস্যায় বসলেন আর ঋষি-মুনির পরামর্শে কুন্তীকে নিযুক্ত করলেন সাংবৎসরিক ব্রতে। স্বামী-স্ত্রীর যুগল-তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন দেবরাজ। স্বীকার করলেন—কুন্তীর গর্ভে অলোকসামান্য পুত্রের জন্য দেবেন তিনি। পাণ্ডুর ইচ্ছায় কুন্তী এবার দেবরাজকে স্মরণ করলেন সঙ্গম-শয্যায়। জন্মালেন মহাবীর অর্জুন।
তারই মধ্যে পাণ্ডু কুন্তীর কাছে আরও একটি পুত্রের জন্য বায়না ধরলেন। কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। প্রজননশক্তিহীন এক অসহায় স্বামীর পুত্রকামনা মেটানোর জন্য তিনি তাঁর ইচ্ছেতে অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছেন। তাও একবার নয়, তিনবার। এখন স্বামী আবারও বলছেন চতুর্থ এক পরপুরুষের সংসর্গে পুনরায় পুত্রবতী হওয়ার জন্য। কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। বললেন–মহারাজ! বংশকর পুত্র না থাকায় আমাদের আপৎকাল উপস্থিত হয়েছিল—এ কথা ঠিক। সেইরকম আপৎকালে স্বামীর সম্মতিতে দেব-পুরুষের সংসর্গে আমাদের পুত্রলাভ হয়েছে—তাতেও দোষ নেই। কিন্তু বিপৎকালেও তিন তিনবার পরপুরুষের সহবাসে পুত্রোৎপত্তির পর চতুর্থ পুত্রের জন্ম দেওয়া—সাধুদের আচার সম্মত নয়। কুন্তীর বক্তব্য—তোমার যতই অনুমতি থাকুক, এই বিপৎকালেও চতুর্থ পুরুষের সংসর্গে আমার উপাধি জুটবে স্বৈরিণীর, আবার যদি—যা মতিগতি দেখছি তোমার—পঞ্চম পুরুষের সহবাস জোটে আমার কপালে তা হলে লোকে আমায় বেশ্যা বলবে—অতঃ পরং স্বৈরিণী স্যাৎ পঞ্চমে বন্ধকী ভবেৎ।
মাদ্রী পাণ্ডুকে একদিন বলেই ফেললেন—মহারাজ! তোমার পুত্র জন্মাবার শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে—তাতেও আমার দুঃখ হয়নি। কিন্তু শক্তি আমারও ছিল। মাদ্রী বললেন—দেখো, আমার দুঃখ নেই। কিন্তু মহারাজ, আমি একশোটি ছেলে হয়েছে—তাতেও খাটো কীসে? তাঁর ছেলে হল অথচ কোথায়—ইদন্তু মে মহদ্ দুঃখং তুল্যতায়াম্ অপুত্রতা। মাদ্রী নিজের দুঃখ ও রাজার মেয়ে এবং পুত্র প্রসবের আমার ছেলে হল না—এ দুঃখ আমি এবার আসল প্রস্তাব পেশ করলেন পাণ্ডুর কাছে।
বললেন—কুন্তী আমার সতীন তাঁর কাছে আমি হ্যাংলার মতো ছেলে হওয়ার মন্ত্র শিখতে যাব না—সংরম্ভো মে সপত্নীত্বাৎ বক্তৃং কুন্তিসুতাং প্রতি। যদি তোমার ইচ্ছে হয়, যদি তোমার ভাল লাগে, তবে কুন্তীকে তুমি বলে রাজি করাও।
ছোট বউ বলে কথা। মাদ্রী যা বললেন, পাণ্ডু তা নিজেই ভেবেছিলেন। স্বামীর গাম্ভীর্য বজায় রেখেও কুন্তীর কাছে কিছু কাকুতি-মিনতি করতেই হল পাণ্ডুকে। কুন্তী রাজি হলেন। ভাবলেন–বেচারা! শেষে এইভাবে বলতে হল! স্বামীর আদরিণী ধনিকে করুণা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। বললেন—ঠিক আছে। এইটুকু দয়া আমি তাকে করব— তস্মাদনুগ্রহং তস্যাঃ করোমি কুরুনন্দন। কুন্তী মাদ্রীকে মন্ত্র দিলেন বটে, কিন্তু সাবধান করে বললেন—একবার, শুধু একবারের জন্য যে কোনও দেবতাকে ডাকতে পারো তুমি। মাদ্রী একবারে যমজ দেবতা অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আহ্বান করে কুন্তীর বুদ্ধির ওপর টেক্কা দিলেন। কুন্তীর মনে মনে রাগ হল বটে কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না ৷
মহাভারতের কবি পর্যন্ত তাঁর এই ভঙ্গি নাপছন্দ করে লিখেছেন—মাদ্রী তাঁর পিছন পিছন গেছেন একা—তং মাদ্রী অনুজগামৈকা। তাও যদি বা তিনি সাবগুণ্ঠনে জননীর প্রৌঢ়তায় অনুগমন করতেন স্বামীর। না, তিনি তা করেননি। একটি শাড়ি পরেছেন যেমন সুন্দর তেমনই সূক্ষ্ম। তাও পুরো পরেননি অর্ধেকটাই কোমরে জড়ানো। সূক্ষ্ম শাড়ির অনবগুণ্ঠনে গায়ের অনেক অংশই বড় চোখে পড়ছিল। মাদ্রীকে তরুণীর মতো দেখাচ্ছিল। পাণ্ডু দেখছিলেন, কেবলই দেখছিলেন—সমীক্ষমাণঃ স তু তাং বয়স্থাং তনুবাসসম্
পাণ্ডুর হৃদয়ে দাবানল ছড়িয়ে পড়ল। তিনি জড়িয়ে ধরলেন মাদ্রীকে। মাদ্রী শুধু স্বামীর মৃত্যু-ভয়ে তাঁকে খানিক বাধা দিলেন বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম বস্ত্রের পরিধানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে রক্ষা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। মৈথুন-লিপ্সায় পাণ্ডুর তখন এমন অবস্থা যে, অত বড় একটা অভিশাপের কথাও তাঁর মনে ছিল না। যদিবা মাদ্রীর কথায় তাঁর মনে হয়েও থাকে তবু-ধুর শাপশাপজং ভয়মুৎসৃজ্য—এইরকম একটা ভঙ্গিতে তিনি মৃত্যুর জন্যই যেন কামনার অধীন হলেন—জীবিতান্তায় কৌরব্যো মন্মথস্য বংশগতঃ। সঙ্গম-মুহূর্তেই পাণ্ডু মারা গেলেন। মাদ্রীর উচ্চকিত আর্তনাদ শোনা গেল। পাঁচটি কিশোর-বালককে সঙ্গে নিয়ে কুন্তী ছুটে এলেন পাণ্ডুর কাছে।
জীবনের এই চরম এবং অন্তিম মুহূর্তে মাদ্রী কুন্তীর কাছে কতগুলি অকপট স্বীকারোক্তি করে বসলেন। সেকালের পারলৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী মাদ্রী বলে চললেন—স্বামীর সঙ্গে আমিই সহমরণে যাব দিদি। এই সামান্য জীবনে সীমিত স্বামীসুখে এবং সীমিত শারীরিক কামোপভোগে আমার তৃপ্তি হয়নি—নহি তৃপ্তাস্মি কামানাম্। আর রাজার কথা ভাবো। আমার প্রতি শারীরিক লালসাতেই তাঁর মৃত্যু হল। এই অবস্থায় আমি মৃত্যুলোকে গিয়েও তাঁর সম্ভোগ-তৃষ্ণা মেটাব না কেন—তমুচ্ছিন্দ্যামস্য কামং কথং ন যমসাদনে?

মাদ্রী
মাদ্রী তো জানতেন যে মিলিত হবার উপক্রমেই সম্ভোগদৃঢ় পাণ্ডুর ওপর কিমিন্দম মুনির মৃত্যুর অভিশাপ নেমে আসবে। এই অভিশাপের মধ্যে অলৌকিকতাই থাকুক অথবা সঙ্গমেচ্ছু ব্যক্তির পক্ষে এ কোনও মরণ ব্যাধিই হোক, মাদ্রী তো জানতেন যে, পাণ্ডু সকাম হলেই তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। তবু তিনি তা মনে রাখেননি। হয়তো বেশ রূপবতী ছিলেন বলেই অথবা হৃদয়ের মধ্যে পুষ্পে কীটসম সেই সঙ্গমেচ্ছা লুকিয়ে ছিল বলেই আজ এই বসন্তের উত্তাল প্রকৃতির মধ্যে নিজেকেও তিনি মোহিনী করে তুলেছিলেন। তাঁর বয়স তো চলে যায়নি, মনুষ্য শরীরের স্ত্রীজনোচিত সন্ধিগুলি তো এখনও শিথিল হয়ে যায়নি তাঁর। অতএব আজ কী কথা তাঁর জাগল প্রাণে, তিনি এমন করেই সাজলেন, যাতে তাঁর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি একেবারে প্রকট হয়ে ওঠে। মহাকাব্যের কবি সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন মাদ্রীর মন-রাঙা পরিধেয় বসনখানির ওপর। সে বসন এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যা মাদ্রীর যুবতী- শরীরকে প্রকট করে তুলেছিল স্ফুটাস্ফুট ব্যঞ্জনায়— অন্তত পাণ্ডুর কাছে মাদ্রীর এই রূপই প্রকট হয়ে উঠেছে। একাকী অরণ্যমধ্যে মাদ্রীর মাদ্রীর যুবতী শরীরের দিকে বারবার দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন তিনি— সমীক্ষমাণঃ স তু তাং বয়স্থাং তনুবাসসম। পিছন পিছন যেতে যেতে সূক্ষ্মবস্ত্ৰভেদী পাণ্ডু পাগল হয়ে গেলেন। তাঁর শরীরে মনে আগুন জ্বলে উঠল। জেগে উঠল এতদিনের উপবাসী আকাঙ্ক্ষা— যেন গহন বনের গভীরে আগুন লেগেছে— তস্য কামঃ প্রবধে গহনেহগ্নিরিবোত্থিতঃ। স্ত্রীর সঙ্গে বিচরণ করতে করতে অরণ্যপথে বহু দূর চলে এসেছেন পাণ্ডু। এখানে জন-মানব নেই কোনও দিকে। নির্জন স্থান, বাসন্তী প্রকৃতি এবং সামনে সুসূক্ষ্মাম্বরধারিণী মদ্ররাজনন্দিনী এবং তিনি কিনা পাণ্ডুর বিবাহিতা স্ত্রী। পাণ্ডু নিজের শরীর- মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না— ন শশাক নিয়ন্তং তং কামং কামবলাদিতঃ। তিনি প্রায় জোর করে মাদ্রীকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন— বলাদ্ রাজা নিজগ্রাহ। ‘জোর করে’— এইজন্য যে, মাদ্রী মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেছেন বিপদ ঘনিয়ে আসছে তাঁর চোখের সামনে, তাঁর জ্ঞাতসারে। তিনি হাত দিয়ে, পা দিয়ে, সমস্ত শরীর দিয়ে যথাসম্ভব, যথাশক্তি বাধা দিতে লাগলেন স্বামীকে— বার্য্যমানস্তয়া দেব্যা বিস্ফুরন্ত্যা যথাবলম্— যাতে সেই মধুর আলিঙ্গন পর্যন্তই তাঁর স্বামীর মিলন-সুখ সিদ্ধ হয়, তার চাইতে বেশি নয়।
মাদ্রীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহু-ক্ষেপণ, নির্বল স্ত্রী-শরীরের বাধা এতটুকুও আমল দিলেন না পাণ্ডু। তাঁর মনে থাকল না কিমিন্দম মুনির অভিশাপ; তাঁকে আক্রান্ত করল না মৃত্যুভয়।
প্রায় বলাৎকারে তিনি মাদ্রীর সঙ্গে সঙ্গত হলেন মৃত্যুর সঙ্গে চিরসঙ্গত হবার জন্য— মাদ্রী মৈথুনধর্মেন সোহন্বগচ্ছন্ বলাদিব। মহাকাল গ্রাস করল পাণ্ডুর বুদ্ধি, মাদ্রীকে আলিঙ্গন-রত অবস্থাতেই পাণ্ডু ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে— স তয়া সহ সঙ্গম্য… যুযুজে কালধর্মণা। স্বামী পাণ্ডুর গতসত্ত্ব অবস্থা দেখে মাদ্রী বুঝলেন— এক মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেছে। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল সেই হাহাকার-চিৎকার, সদ্য বিধবার প্রথম বিস্ফোরক ক্রন্দন- ধ্বনি— মুমোচ দুঃখজং শব্দং পুনঃ পুনরতীব চ।

হিড়িম্বা
এবার দ্বিতীয় ভাবনাটা বলি। এটাই তো সার্বিকভাবে দৃষ্ট এবং শ্রুত যে, সুন্দরী মেয়ে দেখলে যুবক পুরুষেরা খানিক উত্তাল হয়ে ওঠে। পুরুষের কামার্ততার দৃষ্টান্তই হাজার হাজার। কিন্তু সামণীর স্তন-জঘন বিস্তারে এইরকম নয়। স্বীকৃতি এইরকমই যে, মেয়েরা এখনকার দিনে ভিক্টোরিয়ান যুগে Flirt’s Tragedy নিয়ে বই লেখা হচ্ছে, মানুষের ‘শরীর’ নিয়ে নতুন দার্শনিক ভাবনা আরম্ভ হয়েছে, তার মধ্যে স্ত্রীলোকের সম্ভোগেচ্ছা লুকিয়ে রাখারও খুব একটা দায় থাকছে না। এই অত্যাধুনিক ভাবনায় আপ্লুত হবার আগেই কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে যে, মহাভারতের কালে অথবা রামায়ণের কালে কিন্তু অনেক মহিলাই নিজের ভোগেচ্ছার কথা নিজেই বলতে পারতেন। তার জন্য কোনও ‘পোস্ট- মডার্নিজমে’রও দরকার হয়নি, অথবা প্রয়োজন হয়নি কোনও উত্তর-ঔপনিবেশিকতার আবেশ। সহজ কথাটা তখন সহজেই বলা যেত এবং এই সহজ ভাবের একটা অন্য মূল্য আছে। কথোপকথনে বক্রোক্তির চমৎকার এখানে থাকে না হয়তো, অথবা থাকে না ধ্বনি-ব্যঞ্জনার মধুর তাৎপর্য, কিন্তু প্রেম ভালবাসার ক্ষেত্রে শারীরিক ভাবনারাশি মূল্যহীন নয় যেহেতু, সেখানে কোনও শরীরী আবেদনই বা এত নিন্দিত হবে কেন।

দ্রৌপদী
তার নাম দ্রৌপদী। তবে গায়ের রং কালো হলে কী হবে, সেকালে দ্রৌপদীর মতো সুন্দরী সারা ভারতবর্ষ খুঁজলেও মিলত না। অবশ্য দ্রৌপদীর রূপ যে শুধুমাত্র শরীরকেন্দ্রিক ছিল না, তাঁর রূপ যে দেহের সীমা অতিক্রম করেছিল, সে-কথা বোঝা যাবে স্বয়ং ব্যাসের বর্ণনায়। মহাভারতকার দ্রৌপদীর শারীরিক রূপ বর্ণনায় বেশি শব্দ খরচ করেননি। ‘সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোণীপয়োধরা’— দ্রৌপদীর এই বর্ণনা মহাকাব্যের সুন্দরীদের তুলনায় অল্পমাত্র। লক্ষণীয় বিষয় হল- নায়িকার রূপ বর্ণনার ক্ষেত্রে মহাকাব্যকারেরা যেখানে অনুপম শব্দরাশির বন্যা বইয়ে দেন, সেখানে দ্রৌপদীর রূপবর্ণনায় মহাভারতকার যেন একেবারে আধুনিক মানসিকতায় গ্ল্যামারের দিকে মন দিয়েছেন। দ্রৌপদী যে মোটেই বেঁটে ছিলেন না, আবার ঢ্যাঙা লম্বাও ছিলেন না— নাতিহ্রস্বা ন মহতী — সেকেলে কবির কাছে এই বর্ণনা, এই বাস্তব দৃষ্টিটুকু অভাবনীয়। তাও একবার নয়, দু’বার এই কথা ব্যাসকে লিখতে হয়েছে, যদিও অন্যত্র হলে নারীদেহের প্রত্যঙ্গ বর্ণনার ঝড় উঠে যেত তাঁরই হাতে। ব্যাস জানতেন দ্রৌপদীর রূপ তাঁর কুঞ্চিত কেশরাশি কিংবা স্তন-জঘনে নয়, তাঁর রূপ সেই দৃপ্ত ভঙ্গিতে— বিভ্রাজমানা বপুষা— সেই বিদগ্ধতায়, যার সঙ্গে তুলনা চলে শুধু সমুজ্জ্বল বৈদুর্যমণির— বৈদুর্যমণিসন্নিভা।
প্রধানতমা রমণীটির ক্ষেত্রে মহাকাব্যের কবি যে তাঁর শৈশব-পৌগণ্ড ছাড়িয়ে একেবারে সোজাসুজি যৌবনে উপনীত হলেন, সেখানে একটা ব্যঞ্জনা আছে বলে অবশ্যই মনে হয়। অগ্নিবেদীর মধ্য থেকে যজ্ঞ-সিদ্ধির মতো যে কুমারী জন্মালেন, মহাভারতের কবি তাঁর রূপ-বর্ণনায় চাঁদ-তারার উপমা জোগাড় করে আনেননি, বরঞ্চ খুব গদ্যজাতীয় ভাষায় সোজাসুজি বলেছেন– তিনি বেশ সুশ্রী, তাঁর শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দর্শনীয় সুভগা দর্শনীয়াঙ্গী— আজকের দিনে এই শব্দটা ‘এক্সকুইজিট ফিগার’ বলে অনুবাদ করা যেতেই পারেন তাঁর চোখ দুটি কৃষ্ণবর্ণ এবং সুদীর্ঘ পাপড়ির মতো, তার ওপরে মনোহর ভ্রূ; গায়ের রংও কালো এবং কেশকলাপ কুঞ্চিত, নখগুলি তাম্রাভ এবং উন্নত, আর স্তনযুগল সুগঠিত পীন— দেখলে মনে হয়, কোনও স্বর্গসুন্দরী মানুষের রূপ ধরে নেমে এসেছেন ছুঁয়ে।
অতএব আমরা বলব— কৃষ্ণা পাঞ্চালী এই পরিস্থিতিটা ‘এন্‌জয়’ করছিলেন এবং আদিম ভাবেই ‘এন্‌জয়’ করছিলেন। পাঁচ-পাঁচটা বীর পুরুষ তাঁর দিকে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করছেন— এই অবস্থায় প্রতিক্রিয়া তাঁদেরও পরিষ্কার চোখে দেখে নেওয়াটা যেমন তাঁর সাহসের মধ্যে পড়ে, তেমনই তাঁর প্রতিকামিতার আমোদের মধ্যেও পড়ে। মহাকাব্য মহাভারতের প্রধানতমা নায়িকার এই সাহসও আছে এবং তেমনই প্রতিকামিতাও আছে। যদি এখানে একান্তভাবেই পশ্যমানা প্রেক্ষমাণা পাঞ্চালীর নিগূঢ় সম্মতি না থাকত, তা হলে সমস্ত পাণ্ডবরা তাঁকে একই সঙ্গে আপন আপন হৃদয়ে ধারণ করতে পারতেন না— কবি লিখেছেন— দ্রৌপদীকে দেখে তাঁরা একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করেছেন এবং সকলেই তাঁকে হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করেছেন— সম্প্রেক্ষ্যান্যোন্যমাসীনা হৃদয়ৈস্তাম্ অধারয়ন।
দ্রৌপদী কিন্তু পঞ্চ পাণ্ডব ভাইয়ের প্রকট কামদৃষ্টিকে প্রত্যাখ্যান করছেন না, ঘৃণার চোখেও দেখছেন না, বরঞ্চ উদার চোখে দাঁড়িয়ে দেখছেন— তাঁরা কী দেখছেন। ব্যাস সাফাই গেয়েছেন পরে, কিন্তু পাঁচ ভাইয়ের অবস্থা বর্ণনা করেছেন— ঈষৎ অনিবার্য কামনার ভাষায়। তিনি বলেছেন— কী আর করা যাবে বলো, পাঞ্চালী কৃষ্ণার চেহারাটাই এমন যে তাঁকে দেখলে কামনার উদ্রেক হবেই, সমস্ত পুরুষের কাছেই তিনি সহনীয়— কাম্যং হি রূপং পাঞ্চাল্যা বিধাত্রা বিহিতং স্বয়ম্ তিনি অন্যা রমণীদের মতো নন, সকলের চাইতে আলাদা এবং সকলেরই মনোহরণ, ফলে পাঁচ পাণ্ডব ভাই যখন দ্রৌপদীর দিকে ভাল করে তাকালেন এবং যখন বুঝলেন— এই মনোহরণ রমণী তাঁরও হতে পারে, তখন তাঁদের সমস্ত ইন্দ্রিয়-দমনের শক্তি যেন শিথিল হয়ে গেল, তাঁদের হৃদয়ে জেগে উঠল প্রবল কামনা- সম্প্রমথ্যেন্দ্রিয়গ্রামং প্রাদুরাসীন্মনোভবঃ।
আমি মহাভারতের কবির কাছে কৃতজ্ঞ এই কারণে যে, তিনি কোনও দ্বিচারিতা করেননি। তেমন তেমন জায়গায় রমণী-শরীরের বহিরঙ্গও যে ভদ্রলোক-ছোটলোক একাকার করে দেয়, মহাকবি সেটা লুকিয়ে রাখেননি। আমি জানি, ভদ্রা সুবুদ্ধিমতী বিষয়াভিজ্ঞা বিদুষীরা এই বৈয়াসিকী ভাষায় বিব্রত হবেন এবং আরও কবার বলবেন— এই হল সেই জায়গা, যেখানে পুরুষমানুষই তার পৌরুষেয় ভাষায় স্ত্রীলোককে ‘কমোডিটি’ বানিয়ে ফেলছে, সমস্ত মহাভারত জুড়ে দ্রৌপদীর এই মোডিটাইজেশন’ অথবা ‘কমোডিফিকেশন দোহাই চাইব, বলব — সমস্ত ব্যাপারটাকে এত এটাকে যদি অতিসাধারণ দেহতত্ত্ব, তথা রমণী-শরীর দর্শনে পুরুষের যৌন জাগরণের তাত্ত্বিকতা দিয়ে বিচার করেন, তবে মহাভারতের কাল তথা দ্রৌপদীকে বোঝা অনেক সহজ হবে। আর মনে রাখবেন, পাঁচ ভাই পাণ্ডবের এই প্রতিক্রিয়াটা তিনি কিন্তু দেখছেন এবং বাধা দিচ্ছেন না। আমি বলব— ‘এনজয়’ করছেন । এবং অবশেষে সব দেখেশুনে যুধিষ্ঠির যখন এই সিদ্ধান্ত দিলেন— আমাদের সকলেরই স্ত্রী হবেন দ্রৌপদী— সর্বেষাং দ্রৌপদী ভার্যা ভবিষ্যতি হি নঃ শুভা— তখনও দ্রৌপদী কিন্তু প্রতিবাদ করেননি। এবং আমি বলব— তিনি ‘এন্‌জয়’ করছিলেন।
জটিল করে তুলবেন না এখনই।

রুক্মিণী
এই ভীষ্মকের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম রুক্মী, তিনি জরাসন্ধ-শিশুপালের গুণমুগ্ধ, আর মেয়ে হলেন রুক্মিণী। যেমন তাঁর রূপ, তেমনই গুণ। রুক্মিণীর সমসাময়িক কালে কি না সন্দেহ— অনন্যা প্রমদা লোকে রূপেণ তার ম
মতো সুন্দরী আর দ্বিতীয় ছিল শ্রিয়া। যেমন ফরসা তাঁর গায়ের রঙ, তেমনই তাঁর দেহের সৌষ্ঠব। চেহারাটা লম্বা এবং ‘স্লিম’— বৃহতী চারুসর্বাঙ্গী তন্বী।
স্থূলতা যদি কোথাও থেকে থাকে তবে সে স্তনে, জঘনে, নিতম্বে — পীনোরুজঘনস্তনী।
চুল কালো এবং কোঁকড়ানো। নখ তীক্ষ্ণ, সাদা, সমান এবং ঝকঝকে দাঁতের স্মিত হাসিতে রুক্মিণীকে মনে হয় স্বর্গের মায়াময়তা নেমে এসেছে ভুঁয়ে— মায়াং ভূমিগতামিব। যেন চাঁদের কিরণ জমাট বেঁধেছে রুক্মিণীর নারী-শরীরের আনাচে কানাচে।
… রুক্মিণী মান করা জানেন না। বিকার একটা হল বটে, তবে সেটা মধ্যযুগীয় পতিব্রতা রমণীর গড্ডলিক-বিকার যা হয়ে থাকে, সেই বিকার হল মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে প্রথমে তিনি মাটি খুঁড়তে লাগলেন, কাজল-মাখা চক্ষুর জলে স্তনভূষা কুমকুম- রাগ ধুয়ে গেল, গলা দিয়ে আর স্বর বেরোল না— তস্থাবধোমুখ্যতিদুঃখরুদ্ধবাক্।

সুদেষ্ণা
আসলে সুদেষ্ণার সমস্ত নজর তখন দ্রৌপদীর শরীরের দিকে। একেতেই সাধারণ রমণীকুলের মধ্যে এই স্বভাব থাকেই। সুন্দরী রমণী দেখলে নিজের সঙ্গে তুলনা করে দেখার একটা প্রবণতা থাকেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুলনার পর অন্য সুন্দরীর প্রতি এক ধরনের ঈর্ষা-অসূয়া এমনকী অনীহাও কাজ করে। কিন্তু সুদেষ্ণা এদিকে খুব সরল। প্রথম দেখাতেই তিনি দ্রৌপদীর দাসীত্ব-বিলাস উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন— তোমার চেহারাটা তো অসম্ভব সুন্দর। রমণী-দেহের উচ্চাবচ সংস্থানের মধ্যে যে যে অঙ্গ গভীর-নিম্ন হওয়া দরকার, দ্রৌপদীর ঠিক তাই, আবার যে যে-স্থান উচ্চ-পীন হলে পরে রমণীর সৌন্দৰ্য বর্ধিত হয়, দ্রৌপদীর শরীর সংস্থানের উচ্চতা সেখানেই। সাধারণ সৌন্দর্য্য উচ্চারণে— ‘সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোণী-পয়োধরা’– দ্রৌপদীকে এইটুকু প্রশংসা করেই সুদেষ্ণা থামলেন না, দ্রৌপদীর শারীরিক সৌন্দর্য্য ছাড়াও তাঁর মধ্যে যে ‘একস্ট্রা অর্ডিনারি গ্ল্যামার’ এবং অসম্ভব একটা ‘এনার্জি’ কাজ করছে, এটা বোধহয় দেষ্ণা ছাড়া মহাভারতের আর কেউ এমনভাবে বলেননি। সুদেষ্ণা বলেছেন— তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কাশ্মীরি ঘোটকীর মতো টগবগ করছ যেন— তেন তেনৈব সম্পন্না কাশ্মিরীব তুরঙ্গমী। যেমন তেজ। এমন চেহারা কি দাসীদের জন্য তোমার রূপ, তেমনই তোমার সদা-প্ৰস্তুত তৈরি করেছেন ভগবান! তার চেয়ে তুমি না কিন্নরী, নাকি দেবকন্যা না দেবপত্নী- করে বল যে, তুমি দেবী না গন্ধবী, অপ্সরা ত্বং কতমা শুভে?

লোপামুদ্রা
এই প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে সঠিকভাবে ফুটে উঠেছে আদিকাব্য রামায়ণে। এখানে মহর্ষি গৌতমের স্ত্রী অহল্যা— যাঁর রূপের মধ্যে সামান্য দোষ বা ‘হল্য’ ছিল না বলেই তাঁর নাম অহল্যা। কিন্তু এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও ঋষিপত্নীর জীবনে যৌন সার্থকতা কম ছিল বলেই স্বর্গের দেবতা ইন্দ্র যেদিন গুরু গৌতমের রূপ ধারণ করে এসে গুরুপত্নীর সঙ্গম প্রার্থনা করলেন, সেদিন কিন্তু ইন্দ্রকে স্বরূপে চেনা সত্ত্বেও শুধু দেবেন্দ্রের রতি-পূরণ কেমন লাগে, সেটা বোঝার জন্যই তিনি সঙ্গত হলেন ইন্দ্রের সঙ্গে— মুনিবেশং সহস্রাক্ষং বিজ্ঞায় রঘুনন্দন… দেবরাজ কুতূহলাৎ। এক্কেবারে অনুরূপ ঘটনা হয়তো রামায়ণ মহাভারতে বেশি নেই, কিন্তু এই ধরনের যৌন অতিক্রম, ধর্ষণ— হয়তো অনেক সময়ে না জেনেই, না চিনেই, তবু যখন সেটা ঘটেছে— তখন রমণীর দিক থেকে এগুলি যে সর্ব সময়েই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, তা আমাদের মনে হয়নি। লোপামুদ্রা ঋষি-স্বামীর হৃদয়টুকু জানেন বলেই এতকালের শারীরিক অনভিনন্দন তাঁর সহ্য হল না। কিন্তু এখন সেই বৈরাগ্যবান স্বামীর মুখে মৈথুনের আহ্বান শুনে তিনি একেবারে উপবাসী বুভুক্ষুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন না। লোপামুদ্রা খানিক লজ্জা পেলেন— লজ্জমানের ভাবিনী— এবং সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান-বাক্য উচ্চারণ করলেন মহাকাব্যিক উদারতায়। লোপামুদ্রা বললেন— ঋষি ! তুমি আমাকে পুত্রলাভের জন্যই ভার্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলে, সে কথা আমি জানি— অসংশয়ং প্রজাহেতোর্ভার্য্যাং পতিরবিন্দত। লোপামুদ্রা সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে দিলেন যে, পুত্রলাভের ওই যান্ত্রিকতার চেয়েও আরও বেশি কিছু কাম্য আছে তাঁর এবং তিনি বলেও ফেললেন সে কথা। বললেন— তুমি শুধুই সন্তান চাইলেও এখানে আমারও কিছু ইচ্ছে-অনিচ্ছে অথবা ভাল লাগার প্রশ্ন আছে এবং সেটা তোমায় আগে মেটাতে হবে— যা তু ত্বয়ি মম প্রীতিস্তাষে কর্তুমর্হসি।
লোপামুদ্রা বোঝাতে চাইলেন যে, বিবাহ মানেই শুধু চিরাচরিত সঙ্গমের এক যান্ত্রিক অনুষঙ্গ নয়, পুত্রলাভের হেতুটা সেখানে স্মার্ত নিয়মে মুখ্য হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু তার মাধ্যম রতি, রমণ শৃঙ্গার কোনও গৌণ যান্ত্রিকতা নয়, বস্তুত তারও একটা প্রস্তুতি আছে। লোপামুদ্রা বললেন— আমার পিতার ভবনে অট্টালিকার ভিতর আমার মহার্ঘ শয্যা ছিল, আমি চাই সেইরকম এক শয্যায় তোমার সঙ্গে মিলন হোক আমার– তথাবিধে ত্বং শয়নে মামুপৈতুমিহার্হসি। স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গমে অন্যতর উপাদান হল শৃঙ্গারোচিত বেশ। আমি চাই তুমি অলংকার পরে মালা-চন্দনে বিভূষিত হয়ে বিভূষিতা হতে, মাল্য-চন্দনের গন্ধে আমোদিতা তোমাকে লাভ করতে চাই আমি— উপসর্তুং যথাকামং দিব্যাভরণ-ভূষিতা। এবারে লোপামুদ্রার কণ্ঠে ভেসে এল সেই বৈদিক হাহাকার, যেটাকে মহাভারতীয় ভাষায় করলে প্রত্যাখ্যানের ব্যঞ্জনাটুকু ঠিক ধরা পড়ে। লোপামুদ্রা বললেন— যদি কাছে আসো, তবেই সেই মিলন এ মার কাছে এসো। এবং আমিও চাই অলংকার-বিভূষণে উৎকৃষ্ট শয্যায় তুমি আমার আমাদের, তা নইলে এই গৈরিক কৌপীন ধারণ করে তোমার সঙ্গে আমি মিলিত হতে চাই না— অন্যথা নোপতিষ্ঠেয়ং চীর-কাষায়বাসিনী।

মাধবী
যযাতি এবার বললেন— দেখো, আমার ঘরে রূপ-গুণ-সম্পন্না এক অতি সুলক্ষণা কন্যা আছে। এমনই তার রূপ যে, দানব-মানব-দেবতা যেই তাকে দেখুক, দেখামাত্রই তাকে কামনা করে— সদা দেব-মনুষ্যানাম্ অসুরাণাঞ্চ গালব। আর শুধু রূপই নয়, যাঁরা বংশলাভের জন্য ধর্মত পুত্রকামনা করেন, তাঁরাও আমার এই দেবকন্যার মতো মেয়েটিকে পেলে বংশকর পুত্রলাভের ধর্মও লাভ করবেন— ইয়ং সুরসুতপ্রখ্যা সর্বধর্মোপচায়িনী। স্বর্গসুন্দরীর মতো রূপ আমার এই মেয়েটিকে পাবার জন্য এক একজন রাজা তাঁদের রাজ্য পর্যন্ত দিয়ে দেবেন— অস্যাঃ শুল্কং প্রদাস্যন্তি নৃপা রাজ্যমপি স্বয়ম্— সেখানে কালো কানওয়ালা আটশো ঘোড়ার কথা আর কী বলব? অতএব গালব! তুমি নিশ্চিন্ত মনে আমার এই মেয়েটিকে নিয়ে যাও। আমার মেয়ের নাম মাধবী। মাধবীকে দিয়ে তোমারও অভীষ্ট পূরণ হবে আবার আমিও হয়তো আমার মেয়ের ঘরে একটা-দুটো নাতি পাব— স ভবান্ প্রতিগৃহ্নাতু মমৈতাং মাধবীং সুতাম্।
বিশ্বামিত্রের শিষ্য গালব এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেননি একবারও। পিতা হিসেবে যযাতি তাঁর নিজের মেয়েকে অন্যের যৌন ব্যবহারে নিযুক্ত করছেন সামাজিক বিধি-নিয়মের বাইরে গিয়ে এবং তাঁর মেয়েরও কোনও অনুমতি গ্রহণ করছেন না— এইসব নৈতিক প্রশ্ন গালবের মনে উঠল না এবং তিনি নিজেও যে এই সামাজিক বিধি-ভঙ্গের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করছেন, সেটাও একেবারের তরেও ভেবে দেখলেন না। গুরুদক্ষিণা দানের জন্য অশ্বলাভের একটা উপায় বেরোনো মাত্রেই গালব যযাতিকে বলেছেন— আপনার সঙ্গে আবার আমার দেখা হবে। কথাটা বলেই মাধবীকে নিয়ে প্রস্থান করলেন এখানে প্রাথমিকভাবে তিনটি চরিত্র নে হিসেবে যযাতির পৌরুষেয় অধিন নেমে এল— যযাতি, মাধবী এবং গালব। পিতা এখানে খুব স্পষ্ট। ঔরসজাতা কন্যার ওপর পিতা যযাতির অধিকার-বোধ এতটাই প্রবল যে, একবারের তরেও তিনি মাধবীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেননি যে, এই কাজটা তিনি করতে যাচ্ছেন। অথবা এমন একটা যৌনতার প্রকল্প যেখানে মাধবী ব্যবহৃত এবং ব্যবহৃত হবেন বার বার, সেখানে একবারও মেয়েকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন না যে, এমন একটা অসামান্য যৌনতার মধ্যে সে যাবে কিনা ! চিন্তা করলেন না গালবও।
মাধবীকে হাতে পেয়ে গালব ইক্ষ্বাকু বংশের প্রসিদ্ধ রাজা হর্ষশ্বের কথা ভাবলেন। তিনি যেমন বীরপুরুষ তেমনই ঐশ্বর্যশালী রাজা। হয়তো তাঁর কাছে গেলে একবারেই কাজ হয়ে যাবে। গালব হর্যশ্ব রাজার কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন– আমার হাতে এই অসামান্যা সুন্দরী রমণীটি আছে। আপনি এই কন্যাটির মাধ্যমে আপনার বংশবৃদ্ধি করতে পারেন। কিন্তু এঁকে ভার্যা হিসেবে গ্রহণ করতে হলে আপনাকে শুল্ক দান করতে হবে – ইয়ং শুল্কেন ভার্যার্থং হর্যশ্ব প্রতিগৃহ্যতাম্। তবে হ্যাঁ, শুল্কের বিষয়টা আমি বলব এবং সেটা আগে শুনে তারপর আপনার কর্তব্য স্থির করুন।
মহাভারতের কবি বড় বুদ্ধি করে এবং বেশ লৌকিক-নির্মাণ-নিপুণতায় এই জায়গাটা সাজিয়েছেন। আমরা প্রথমে দেখছি— মহারাজ হর্যশ্ব— ইক্ষ্বাকু-কুলধুরন্ধর— এই সময়ে তার যথেষ্টই বয়স হয়ে যাবার কথা, অথচ এখনও তাঁর কোনও পুত্রসন্তান নেই- এইজন্য তাঁর যথেষ্ট হতাশা আছে এবং সেই হতাশায় এখনও তাঁর নিশ্বাস দীর্ঘতর হয়— দীর্ঘমুষ্ণঞ্চ নিশ্বস্য প্রজাহেতোনৃপোত্তম। অর্থাৎ একটি সুন্দরী রমণীর সঙ্গে মিলন-প্রার্থনার যুক্তি হিসেবে প্রথমত এক ধরনের শাস্ত্রীয় কল্পের ভাবনা আসছে হর্যশ্বের মনে এবং তাতে পুত্রলাভের যুক্তিটা ভীষণভাবে একটা শাস্ত্রীয় প্রয়োজন হয়ে ওঠে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মহাভারতের কবি বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, এটা এক ধরনের চক্ষু ধৌত করার যুক্তিমাত্র, আসল প্রয়োজনটা বিখ্যাত রাজার বুক ঠেলে মুখে বেরিয়ে আসছে। দিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন— এই কন্যার উন্নতেষুন্নতা ষ সূক্ষ্মা সূক্ষ্মেষু এই রমণী-শরীরের প্রত্যঙ্গ-সংস্থানে দৃষ্টি ছয়টি অঙ্গ উন্নত, পাঁচটি অঙ্গ সূক্ষ্ম— তিনটি স্থান গভীর আর পাঁচটি স্থান রক্তবর্ণ।
এই সাধারণ বাচনিকতায় যদি বোঝা না যায়, তাই মাধবীর সামনেই হর্যশ্ব বললেন— দুই নিতম্ব, দুই ঊরু, কপাল এবং নাসিকা— এই ছয়টি অঙ্গ উন্নত। এঁর অঙ্গুলীর পর্বগুলি, কেশ, লোম, নখ এবং চর্ম— এই পাঁচটি সূক্ষ্ম। কণ্ঠস্বর, স্বভাব এবং নাভি গভীর, আর পাণিতল, পদতল, বাম-দক্ষিণ নয়নের প্রান্ত এবং নখ— এই পাঁচটি রক্তবর্ণ।
মাধবী বহুপুরুষগামী হওয়া সত্ত্বেও তিনি গণিকা-বেশ্যার সমতা লাভ করছেন না কিন্তু পুরুষের রতিতৃপ্তির প্রসঙ্গটা এখানে অবশ্যই খুব জোরদার, কিন্তু অন্যের দ্বারা উপভুক্তা হওয়া সত্ত্বেও মাধবীর স্বাত্মারোপিত কন্যাভাবের জন্যই হোক অথবা বংশের ধারা বিধিসম্মতভাবে বজায় রাখার জন্যই হোক, মাধবীকে কিন্তু বিধিসম্মতভাবেই বিবাহ করতে হচ্ছে। এটাকে মাধবীর প্রতি সম্মান-প্রদর্শনের পরিসর বলেই ধরতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, কাশীশ্বর দিবোদাসের সঙ্গে মাধবীর বৈবাহিক প্রসঙ্গে পৌরাণিক যত বিখ্যাত স্বামী-স্ত্রীর উদাহরণ আছে, স্বামিত্ব এবং সতীত্বের ক্ষেত্রে পুরাণগুলি যাঁদের দৃষ্টান্ত বলে মনে করে, সেই সব উদাহরণ একের পর এক এখানে উচ্চারণ করে শেষে বলা হল- রাম যেমন সীতার সঙ্গে, কৃষ্ণ যেমন রুক্মিণীর সঙ্গে রমণ করেছেন, ঠিক সেইভাবেই রাজর্ষি দিবোদাস মাধবীর সঙ্গে রমণ করতে লাগলেন এবং সেই বিধিসম্মত রতির ফল হল মাধবীর গর্ভজাত পুত্র পুরাণ-বিখ্যাত প্রতর্দন— মাধবী জনয়ামাস পুত্রমেকং প্রতদনম্। দিবোদাস পুত্রলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে গালব ঋষি আবারও উপস্থিত হলেন তাঁর কাছে। দিবোদাস কাল বিলম্ব না করে মাধবীকে গালবের কাছে প্রত্যর্পণ করলেন।

 

Please follow and like us: