……সাধারণভাবে জীবন যাপনের বেলায় যে-কথা যৌনজীবনের বেলাতেও সেই কথাই । অর্থাৎ, এই দশায় যৌনসম্পর্কটাও দলগত সম্পর্কই। শুধু একজন বিশেষ পুরুষের সঙ্গে একজন নির্দিষ্ট নারীর সম্পর্ক নয়, দলের মধ্যে সমস্ত পুরুষের সঙ্গেই সমস্ত নারীর সম্পর্ক ৷ আধুনিক যুগের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হবে তখন প্রত্যেক পুরুষের বহু পত্নী আবার প্রত্যেক স্ত্রীলোকেরই বহু পতি। তাই এর নাম দেওয়া হয় দলগত বিয়ে। অবশ্যই, আজকের দিনের নীতিবাগীশ মহল অতীত যুগের এই দলগত যৌনসম্পর্কের কথাটা উড়িয়ে দিতে চায়। ভাবখানা যেন এই যে, মানবজাতির কপাল থেকে অতীত কলঙ্কের এই চিহ্ন মুছে ফেলা দরকার। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, অতীত যুগের যৌনসম্পর্কে যে-অবাধ মুক্তি তার স্বরূপ আমাদের পক্ষে আজকের দিনে বুঝতে পারাই কঠিন, কেননা সহস্র বছর ধরে আমাদের কাছে যৌনমুক্তির একমাত্র বিকাশ দেখা দিয়েছে ব্যভিচার আর গণিকালয়ের হুল্লোড়ে। এঙ্গেল্স্ ‘তাই বলছেন, গণিকালয় থেকে সংগ্রহ করা দৃষ্টিভঙ্গির হাত থেকে ‘আমবা যতক্ষণ না মুক্তি পাই ততক্ষণ আমাদের পক্ষে অতীত যুগের যৌনমুক্তিকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে বুঝতে পারাই সম্ভব নয়।
অবশ্যই, মানুষেরই এই বন্যদশা স্থির এ নিশ্চল অবস্থা নয়। এই দশার মধ্যেই নিম্ন স্তর থেকে উচ্চ স্তরের দিকে একটানা অগ্রগতি, আর শেষ পর্যন্ত বা অবস্থা ছেড়ে অসভা অবস্থায় উঠে আসবার চেষ্টা । বন্যদশায় যে যৌনসম্পর্ক মোটের উপর তা দলগত যৌনসম্পর্কই, যদিও উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই দলগত যৌনসম্পর্কে পরিবর্তন দেখা দিতে লাগলো। আদিম যুগের নির্বিচার যৌনসম্পর্কের সঙ্গে তার অনেকখানি তফাত । এই পরিবর্তনের মূল কথা হলো আদিম মানুষের অভিজ্ঞতায় অাচারের অবাঞ্ছনীয় ফলাফল ধরা পড়া ৷ যার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে তারই সঙ্গে যৌনমিলনের নাম হলো অজাচার, ইংরেজীতে বলা হয় incest অজাচার যে ঠিক কেন অবাঞ্ছনীয় আদিম মানুষের পক্ষে তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবার কথা নিশ্চয়ই নয় । তবু যত অস্পষ্টভাবেই হোক তাদের অভিজ্ঞতায় নিশ্চয়ই ধরা পড়েছিল যে, অজাচারের ফলে সন্তানের জন্ম হলে নতুন বংশের পক্ষে, অতএব পুরো দলের পক্ষেই, পঙ্গু হয়ে যাবার সম্ভাবনা। এঙ্গেলস্ বলেছেন, অজাচারের এই অবাঞ্ছনীয় ফলাফল আবিষ্কার আদিম মানুষের পক্ষে একটি মস্ত বড় আবিষ্কার ।
অজাচার আবিষ্কার করবার পর মানুষ নির্বিচার যৌনজীবনকে শুধরে নিতে লাগলো। শুধরে নেবার প্রধান দুটি স্তর। এক হলো, দলের মধ্যে পিতা-কন্যা আর মাতা-পুত্রের যৌনমিলন বন্ধ করা এবং দ্বিতীয় স্তর হলো ভাই-বোনদের মধ্যে যৌনসম্পর্ক বর্জন করা। এই দুই ধাপে শুধরে নেবার পর লগত যৌনসম্পর্কের যে-রূপ সেইটেই বন্যদশার যৌনজীবনের চরম সামাজিক রূপ : পুরো একদল নারীর সঙ্গে পুরো একদল পুরুষের বিবাহ-সম্পর্ক, অর্থাৎ প্রত্যেক পুরুষেরই বহু পত্নী এবং প্রত্যেক নারীরই বহু পতি, তবে দলের মধ্যে মা-বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের এবং ভাই-বোনদের মধ্যে যৌনসম্পর্ক বন্ধ ।
আদিম যুগের এই স্মৃতি আমাদের দেশের প্রাচীন পুঁথি আর ঐতিহ্যের মধ্যে টিকে আছে । এবং তার থেকেই প্রমাণ হয়, অন্যান্য দেশের মতো, আর্যজাতির বন্যদশার প্রথম অবস্থায় ছিল নির্বিচার যৌনসম্পর্কই। তখনো মানুষ অজাচার আবিষ্কার করেনি, মা-বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের বা ভাইবোনদের যৌনসম্পর্কের অবাঞ্ছনীয় ফলাফল মানুষের অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েনি । ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আছে, সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রজাপতি নিজের দুহিতাকে বিয়ে করলেন ! মৎস্য ও বিষ্ণু পুরাণেও ব্রহ্মা সম্বন্ধে ওই কথাই । হরিবংশেও ( আমাদের দেশের আর একটি প্রাচীন পুঁথি) এই জাতীয় নানান ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় । বিশিষ্ট প্রজাপতির কন্যা ছিলেন শতরূপা ; বয়ঃপ্রাপ্তির পর শতরূপা হলেন বিশিষ্ট প্রজাপতির পত্নী। মনু বিয়ে করলেন নিজের মেয়ে ইলাকে, জহ্নুর সঙ্গে বিয়ে হলো জহ্নুর কন্যা জাহ্নবী গঙ্গার। এর চেয়ে জটিলতর কাহিনী হরিবংশেই পাওয়া যায় : দশ-ভাই প্রচেতা ( প্রজাপতি বিশেষ) মিলে এক পুত্রের জন্ম দিলেন, নাম সোম ! মরীশা নামে সোমের একটি মেয়ে হলো ; মরীশার গর্ভে এবং দশ-ভাই প্রচেতা ও সোমের ঔরসে যে-পুত্র জন্মালো তার নাম দক্ষ-প্ৰজাপতি । পরে এই দক্ষ-প্রজাপতি সাতাশটি কন্যার জন্ম দিলেন এবং সন্তান উৎপাদনের জন্য সাতাশজনকেই উপহার দিলেন পিতা সোমের কাছে। আবার, মহাভারতে বলা হয়েছে, ব্রহ্মার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে জন্ম হলো দক্ষের আর বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে তাঁর ভগ্নির, দু’জনের মিলনে ষাটটি মেয়ে জন্মালো। দক্ষের দুই ভাই ছিলেন, মরীচি ও ধর্ম। যাটটি মেয়ের মধ্যে দশটিকে বিয়ে করলেন ধর্ম, মরীচির ছেলে কশ্যপ বিয়ে করলেন সতেরোটিকে, ইত্যাদি ইত্যাদি । প্রাচীন পুঁথিতে ভাইবোনদের মধ্যে যৌনসম্পর্কের স্মৃতিও বিরল নয়। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ থেকে একটা নমুনা দেওয়া যাক : প্রজাপতির এক কন্যার নাম সীতাসাবিত্রী আর এক কন্যার নাম শ্রদ্ধা এবং প্রজাপতির পুত্রের নাম ছিল সোম। সীতাসাবিত্রী সোমকে পেতে চাইলেন, চাইলেন সোমের ঔরসে নিজের গর্ভে একটি সন্তান। কিন্তু সোমের আকর্ষণ শ্রদ্ধার দিকে। তাই সীতাসাবিত্রী বাবার কাছে উপদেশ চাইলেন, কি করা যায় । ভাইকে বশ করবার জন্যে প্রজাপতি সীতাসাবিত্রীকে একটি মাদুলি দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই মাদুলির সাহায্যে সীতাসাবিত্রীর মনস্কামনা পূর্ণ হলো।
অজাচারের ফলাফল সম্বন্ধে মানুষের অভিজ্ঞতা যত স্পষ্ট হতে লাগলো দলগত যৌনসম্পর্কের মধ্য থেকে ততই বাদ পড়তে লাগলো অজাচার । প্রথম স্তরে মা-বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের যৌনসম্পর্ক বর্জন । তাই এই যুগের বর্ণনায় বলা হয়েছে, নিজের কন্যার সঙ্গে মিলিত হবার আশায় প্রজাপতি এক হরিণের ছদ্মবেশ ধারণ করলেন আর তাঁর কন্যা ধারণ করলেন রোহিত হরিণের ছদ্মবেশ । কিন্তু এমনতরো মিলনের বিরুদ্ধে দেবতারা তখন বড়ো বেশি সজাগ হয়েছেন, তাই ছদ্মবেশ সত্ত্বেও দেবতারা টের পেয়ে গেলেন এবং এঁদের সহবাস সম্পূর্ণ হবার আগেই দেবতাদের তীর এসে বিদ্ধ করলো প্রজাপতিকে । ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, এই ঘটনার পর প্রজাপতি ও তাঁর কন্যা আকাশে নক্ষত্র হয়ে স্থান পেলেন। ভাইবোনদের মধ্যে যৌনমিলন বন্ধ করা নিশ্চয়ই আরও কষ্টসাধ্য হয়েছিল। এ-কথা ঋগ্বেদের যম ও যমীর উপাখ্যানে প্রতিফলিত । যমের বোন যমী আপন গর্ভে যমের কাছ থেকে সন্তান চাইলেন ; কিন্তু যম তাতে সাহস পান না, কারণ বরুণের দৃষ্টি অত্যন্ত সজাগ এবং সেই দৃষ্টির কাছে ব্যাপারটা ধরা পড়লে দেবতারা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হবেন । যমী কিন্তু তর্ক তুলে বললেন : না, এতে বরং দেবতারা সন্তুষ্টই হবেন । শেষ পর্যন্ত যে কি হলো তা অবশ্য জানা যায়নি, কেননা এই উপাখ্যানের শেষ অংশ হারিয়ে গিয়েছে।
প্রাচীন পুঁথির এই সব উপাখ্যানকে আদিম যুগের নির্বিচার যৌনসম্পর্কের স্মৃতি ছাড়া আর কি বলা যায় ? ক্রমশ অবশ্য এই নির্বিচার যৌনসম্পর্ক থেকে অজাচার বাদ পড়েছে। সব কথা শুনলে শুধু যে আজকের দিনে আমরা অবাক বোধ করি তাই নয়, ব্যাস এবং বৈশম্পায়নের মুখে এই জাতীয় কথা শুনতে শুনতে রাজা জনমেজয়ও অত্যন্ত অবাক হয়েছিলেন । কিন্তু বৈশম্পায়ন আর ব্যাস অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলাতেই উত্তর দিয়েছিলেন, এসব কথা ‘পুরাতন ইতিহাস’ মাত্র বস্তুত, দলগত বিয়ে শেষ হবার অনেক পরে পর্যন্ত প্রাচীনদের স্মৃতি থেকে অতীতের এই যৌনসম্পর্কের কথা মুছে যায়নি । তাই এক-বিবাহ প্রচলিত হবার পরেও যখনই প্রয়োজনের খাতিরে এই এক-বিবাহের গণ্ডিকে শিথিল করা দরকার হয়েছে তখনই প্রাচীনেরা অতীতকালের নজির তুলেছেন। যেমন ধরুন, পাণ্ডু কুন্তি সংবাদ। পুত্রলাভের আশায় অসুস্থ পাণ্ডু তাঁর দুই পত্নী কুম্ভি ও মাদ্রীকে অনুরোধ করলেন ভিন্ন পুরুষ নিয়োগ করতে এই প্রস্তাবে কুন্তি আপত্তি তুললে পর পাণ্ডু অতীত যুগের নজির তুলে একটি দীর্ঘ উপদেশ দেন । আবার কুন্তির যখন কৈশোর তখন সূর্য এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে মিলিত হবার ইচ্ছে নিয়ে। মনের বাসনা সত্ত্বেও কুন্তির সাহস হচ্ছিলো না, কারণ যৌনসম্পর্ক প্রসঙ্গে সমাজে তখন অনেক রকম বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। তাই সূর্য অতীত দিনের কথা বলে, প্রাচীনদের নিদর্শন তুলে, কুন্তির সংকোচ ও ভয় দূর করলেন । ভীষ্মের মুখেও শুনতে পাওয়া যায় প্রাচীন যুগ নিয়ে এই ধরনের নজির। ভীষ্মের ভাই মারা যাবার পর তাঁর মা বিধবা পুত্রবধূকে অন্যের নিয়োগে পুত্রলাভ করতে নির্দেশ দিলেন এবং প্রাচীন যুগের নজির তুলেই জননীর কথা সমর্থন করলেন ভীষ্ম !…..
….আজকালকার দিনে এই দলগত যৌনসম্পর্কের ব্যাপারটা আমাদের কাছে নেহাতই কদর্য আর কুৎসিত মনে হতে পারে । তার আসল কারণ, বহু শতাব্দী ধরে যৌনমুক্তি বলতে মানুষ শুধুই ব্যভিচার আর গণিকা-সম্ভোগই বুঝতে শিখেছে। অথচ, অতীত যুগের যে-যৌনমুক্তি তার ভিত্তিতে দারিদ্র্য আর অভাব যতই প্রকট হোক না কেন, তার মধ্যে লুকোচুরি নেই, নোংরামি নেই, দ্বন্দ্ব’ব নেই, তাই অসুস্থতাও নেই । আসল কথা হলো, বহু দীর্ঘদিন ধরে শ্রেণীসমাজের মানুষ নারী বলতে যা বুঝেছে আদিম মানুষ মোটেই তা বোঝেনি শ্রেণীসমাজে নারী হলো আরো পাঁচ রকম উৎপাদনের উপায়ের মতে একরকম উৎপাদনের উপায় মাত্র, আর না হয় তো আর পাঁচ রকম উপভোগ্য পণ্যের মতো একরকম উপভোগ্য পণ্য মাত্র । এই দু’মুখো ধারণার সঙ্গে যৌনমুক্তির কথাটা একটুও খাপ খায় না। আদিম শ্রেণীহীন সমাজে যৌনমুক্তি সম্ভব ছিল কারণ তখন নারী বলতে মানুষের ধারণা একেবারে অন্যরকম।…..
…..বহুর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক ছেড়ে শুধু একের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হবার আগে অনেক জায়গাতেই নারীকে প্রথমে মন্দিরে গিয়ে বহু পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে । যেন সাময়িক সমর্পণ দিয়ে আজীবন ব্যাবিলোনিয়ায় বছরে একটা করে সমর্পণের মূল্য চোকানো।
প্রত্যেক মেয়েকেই মন্দিরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হতো । মধ্য প্রাচ্যের অনেক দেশে প্রথা ছিল বিয়ের আগে গিয়ে কিছুদিন ধরে প্রত্যেক মেয়েকে মন্দিরে মুক্ত যৌনজীবন যাপন করতে হবে। আবার অন্যান্য কোনো কোনো জাতির মধ্যে ধর্মের এই মুখোশটা নেই, বিয়ের আগে পর্যন্ত প্রত্যেক মেয়ে মুক্ত যৌনজীবন যাপন করতে বাধ্য । মালয় এবং ভারতবর্ষের জাতির মধ্যে অনেক ‘আদিম এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। আবার কোনো কোনো জাতির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় যে, বিয়ের রাতে বন্ধুর সঙ্গে প্রথম সহবাসের অধিকার স্বামীর নয়, বরযাত্রীদের। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকোতে পারবার পরই স্ত্রী স্বামীর কাছে যেতে পায় ৷
অন্যদের বেলায় এই ব্যবস্থা একটু-আধটু শুধরে নিতে দেখা গিয়েছে : বিয়ের রাতে বরপক্ষের প্রত্যেকেই বন্ধুর উপর অধিকার স্থাপন করে না, সকলের বদলে একজন—বরপক্ষের তরফ থেকে একজন প্রতিনিধি যেন ৷ অনেক দেশেই পুরোহিতরা এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে শিখলো, তাই এই সেদিন পর্যন্ত গ্লুয়োপের নানান জায়গায় পুরোহিতরা প্রথম রাতের অধিকার’ আদায় করেছে। আজো আমাদের দেশে ‘গুরুপ্রসাদী পথা কোথাও প্রচলিত আছে কি না জানি না, তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে প্রচলিত ছিল সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।
আমাদের দেশের প্রাচীন পুঁথিতে সুদর্শন-এখবতীর যে উপাখ্যান তার মধ্যে পরিচয় রয়েছে এই অবস্থায় নারী যখন বহুর উপভোগ্য হতে আপত্তি তুলেছে তখন স্বামীর মনে অস্বস্তির ভাব । ঋষি সুদর্শন আশ্রম ছেড়ে কিছুদিনের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন। এই সময়ে আশ্রমে এলেন এক ব্রাহ্মণ অতিথি । সুদর্শনের স্ত্রী ওঘবতী প্রথা অনুযায়ী শুধু যে অতিথির সেবা-যত্ন করলেন তাই নয়, অতিথির সঙ্গে রাত্রি বাসও করলেন। সুদর্শন আশ্রমে ফিরে আসবার পর এই ঘটনা শুনে অত্যন্ত প্রীত বোধ করলেন—প্রীত, কারণ সেই যুগে মেয়েদের মনে এইভাবে উপভোগ্য হবার বিরুদ্ধে যে পুঞ্জীভূত বিরোধ, ওঘবর্তী সে-বিরোধের পরিচয় দেননি।….
…..সভ্যতা শুরু হবার পর আমাদের দেশে মাতৃসত্তা সরে গিয়ে যখন পিতৃসত্তার জন্যে জায়গা করে দিলো, তখন সমাজে নারীজাতির স্থান ঠিক কি রকম হয়ে পড়লো তার নমুনা পাওয়া যায় গৌতম-গৌতমী, জমদগ্নি-রেণুকা, প্রভৃতির উপাখ্যান থেকে ।
গৌতমের অনুপস্থিতিতে ইন্দ্র এলেন গৌতমীর কাছে এবং উভয়ে সহবাস করলেন । এই কথা জানতে পারার পর গৌতম রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন এবং ছেলেকে বললেন মা-র মাথা কেটে ফেলতে! জমদগ্নির চোখে পড়লো তাঁর স্ত্রী চিত্ররথ গন্ধর্বের দিকে প্রণয়ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন; সঙ্গে সঙ্গে জমদগ্নি তাঁর পুত্র পরশুরামকে বললেন মা-র মাথা কেটে ফেলতে। কুঠারে কাটা পড়লো রেণুকার মাথা। এই জাতীয় উপাখ্যানের সঙ্গে সুদর্শন-ওখবতী উপাখ্যানের তুলনা করলেই বুঝতে যায় শ্রেণীসমাজে স্ত্রীর স্থান কিসে পরিণত হলো। শুধু স্ত্রী নয়, নারী মাত্রেরই, কন্যারও । মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে গলভ-এর যে উপাখ্যান তাতে দেখতে পাওয়া যায় শ্রেণীসমাজে মানুষ कौ ভাবে নিজের মেয়েকেও ভাড়া খাটাতে কসুর করেনি- মেয়ের আর মানুষ নয়, তারা হয় উৎপাদনের উপায়মাত্র, আর না হয় তো উৎপন্ন পণ্যমাত্রে পরিণত হয়েছে। গুরুগৃতে শিক্ষা সমা হবার পর গলভ সমস্যায় পড়লেন : কী গুরুদক্ষিণা দেওয়া যায় ? গলভ গিয়ে জয়ন্তীর সাহায্য চাইলেন এবং জয়টা নিজের কন্যা মাধবীকে দিলেন এই উদ্দেশ্যে। তারপর গলভ মাধবীকে পরপর তিনজন রাজার কাছে ভাড়া দিলেন—প্রত্যেক রাজাই মাধবীকে উপভোগ করে এবং তার গর্ভে একটি করে भान লাভ করে মাধবীকে ফিরিয়ে দিলেন। বিনিময়ে পেলেন দু’শ’ ঘোড়া । এই দু’ শ’ ঘোড়া এবং মাধবীকে গুরুর কাছে দক্ষিণা হিসেবে দান করলেন গলভ। গুরু বিশ্বামিত্র ভোগ করলেন মেয়েটিকে এবং শেষ পর্যন্ত তার গর্ভে একটি সন্তান পাবার পর মাধবীকে ফেরত দিলেন গলভ-এর কাছে। গলভ মাধবীকে ফেরত দিলেন জয়ন্তীর কাছে। জয়ন্তী তখন স্বয়ম্বর-সভা ডাক মাধবীর বিয়ের আয়োজন করতে গেলেন । কিন্তু এত দিনে মাধবীর মনে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা দেখা দিয়েছে : সকলকে প্রণাম জানিয়ে মাধবী স্বয়ম্বর-সভা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে চলে গেলেন, গেলেন সোজা বনের দিকে । বনে গিয়ে প্রার্থন! আর উপবাস—নারীর জীবনে যে-গ্লানি দেখা দিয়েছে তার হাত থেকে নারীকে মুক্ত করবার জন্যে প্রার্থনা ?…….