রক্ষিতা আখ্যান কঙ্কুবাইন – আশরাফ উল ময়েজ

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

ভূমিকা

কঙ্কুবাইন হল একটি প্রথা যেখানে বিবাহ ব্যতিরেকেই একজন পুরুষ ও নারী একত্রে বসবাস করেন। এই পুরুষটি যে অবিবাতি তা নয়—স্ত্রীর পাশাপাশি তিনি একাধিক তার কঙ্কুবাইনও রাখতে পারতেন। ধনী ও শাসকগোষ্ঠি সবকালেই কঙ্কুবাইন রাখতেন এবং একটি সময় ছিল এটি স্ট্যাটাসের বিষয়।

এই কঙ্কুবাইন প্রথা কবে থেকে শুরু হল সে এক বিশাল বিতর্ক, তবে প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তারের কারণেই কঙ্কুবাইন প্রথার প্রচলন শুরু করেন—সে বিষয়ে সকলেই একমত। পুরুষরা তাদের জৈবিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অধিক সংখ্যক সন্তানের জন্ম দেওয়া ছিল এর প্রধান কারণ। সাধারণত কঙ্কুবাইনরা ছিলেন প্রভুর যৌনসঙ্গী, তবে এর ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানদের বৈধতা কোন কোন সমাজে থাকলেও অনেক সমাজই এর বৈধতা দেয় নি। আর যারা বৈধতা দিয়েছিল তাদের সন্তারাও উত্তরাধিকারের বেলায় সবসময় সমান উত্তরাধিকারী হতেন না।

তৎকালীন সময়ে নারীদের খুব সামান্যই অধিকার ছিল। কি পরিবার কি সমাজ সর্বত্রই ছিল নারী অবহেলিত। আর দারিদ্রতার কারণে অনেক পিতাই নিজ কন্যাকে ধনী ব্যক্তির নিকট কঙ্কুবাইন হিসাবে বিক্রয় করে দিতেন। এর উদ্দেশ ছিল দুটি প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পরিবারের বাদবাকী সদস্যদের ভরণপোষণ করা এবং কঙ্কুবাইন মেয়েটির একটি স্বচ্ছল জীবনের নিশ্চয়তা পাওয়া । অনেক সময়ই প্রভাবশালী বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠী জোরপূর্বক নারীদেরকে কঙ্কুবাইন হিসাবে গ্রহণ করতেন ।

কঙ্কুবাইন প্রথা চীনের সংস্কৃতিরই একটি অংশ। স্ত্রীর কঙ্কুবাইন রাখা ছিল সেখানে আভিজাত্যের প্রতীক। আর কঙ্কুবাইন রাখা তো নিয়মের মধ্যেই ছিল। শত শতক সম্রাটরা হারিয়ে যেতেন। সেখানে এমনও শাসক কঙ্কুবাইন ছিল। এ প্রসঙ্গে মিং রাজাদের কথা না শাসনামলে নিষিদ্ধ শহরে ২০,০০০ এর বেলায় ভীড়ে কঙ্কুবাইনদের পাহারা দিয়ে রাখত হাজার শধিক যার হাজারেরও বেশি নয়, মিং রাজাদের কঙ্কুবাইন ছিল। এই খোজা প্রহরী। সম্রাট ব্যতীত অন্য কেউ যেন তাদের শয্যাসঙ্গিনী না হন সেটি নিশ্চিত করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ—রাজকীয় রক্তের পবিত্রতা বলতে একটি কথা আছে ।

বাইরে থেকে প্রাসাদের কঙ্কুবাইনদের জীবন বিলাসী মনে হলেও প্রকৃত সুখ ছিল অনেক দূরে। সম্রাটের সাথে রাত কাটানোর সুযোগ পাওয়াটাও ছিল বেশ কঠোর কারণ কঙ্কুবাইনকে সম্রাটের পছন্দের হওয়া এবং একই সাথে এত সংখ্যক কঙ্কুবাইনের মাঝে সুযোগ পাওয়া এ দুয়ের সমন্বয় সবসময়ই হত না ।

কঙ্কুবাইনরা একবার প্রাসাদে প্রবেশ করলে বাইরের জগতের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেত। ব্যক্তিগতভাবে দেখা সাক্ষাত কিংবা চিঠি আদান প্রদানও ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।

কোন কোন কঙ্কুবাইন কখনো প্রাসাদ ত্যাগ করতেন। অনেক সময় সম্রাটগণ বিদেশী শাসক কিংবা বণিকদের নিকট হতে পেতেন। এর ফলে সম্রাটকেও সে শাসককে আরেকজন কঙ্কুবাইন উপহার দিতেন, তখন সে নতুন প্রভুর নিকট চলে যেতে হত। এ যেন এক কোন কঙ্কুবাইনকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তাদের সুযোগ দেওয়া হত। তা বেশ কয়েক বৎসর পর। এটি কম হলেও ছিল পাঁচ বৎসর ফিরে গিয়ে বিয়ে শাদী করে সংসার করারও অনুমতি ছিল। অনেক কঙ্কুবাইন যারা প্রাসাদে থাকতেই বুড়ো হয়ে যেতেন তাদেরকে পরবর্তীতে প্রাসাদ ত্যাগ করে বন্দী বিনিময়। কোন পরিবারে ফিরে যাওয়ার ও প্রাসাদে সার্ভিস দেওয়ার সকল কঙ্কুবাইনদের পরিবারে প্রাসাদে চাকরের কাজ করতে হত অথবা নিজ থেকেই বেছে নিতে হত নানের জীবন।

কঙ্কুবাইন প্রথা আজও প্রচলিত আছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে, কোথাও কম কোথাও বেশি, কোথাও সমাজে স্বীকৃত কোথাও বা না। ধনী ব্যবসায়ীরা নারীদেরকে ব্যবহার করেন পণ্য হিসাবে। কঙ্কুবাইনরা আজ আর স্ত্রীর পাশাপাশি এক বাসায় অবস্থান করেন না। তারা পৃথক থাকেন। আর তার সকল খরচ যোগান দেয় ধনী ব্যবসায়ী কিংবা প্রভাবশালীরা। যদিও কঙ্কুবাইনদের পূর্বের ক্রীতদাসদের ন্যায় প্রভুর গৃহস্থালি কাজ হয় না; তারা বিলাসী জীবনযাপনও করেন, তবে এখনো প্রয়োজন তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় ৷

কঙ্কুবাইন

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় (Encyclopedia Britannica) কঙ্কুবাইনেজ (Concubinage)-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, একজন পুরুষও একজন নারীর একত্রে সহবাস, যদিও তারা আইনত বিবাহিত নয়। ম্যারিয়াম-ওয়েবস্টার (Merriam-Webster) অভিধানে কঙ্কুবাইনেজের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে যে, বিবাহিত নয় কিন্তু একত্রে বসবাস করা। কঙ্কুবাইন শব্দটি এসেছে প্রাচীন ল্যাটিন শব্দ কনকুমবেরি (Concumbere) থেকে, যার অর্থ শোয়া কিংবা কারো সাথে শোয়া। এ শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন উপসর্গ কম (Com) থেকে, যার অর্থ সাথে এবং কুবারা (Cubara) অর্থ শোয়া থেকে। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান উভয় জাতির মধ্যেই কঙ্কুবাইন প্রথা চালু ছিল। বাইবেলেও কঙ্কুবাইনের কথা বলা হয়েছে। ……

…..কোনো নারী স্বেচ্ছায় কিংবা তার পরিবারের সম্মতিতেই কঙ্কুবাইন হতেন এবং এ ক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়টিই ছিল মুখ্য। আর নিজের পরিবারের সদস্যদের কঙ্কুবাইন হতে দিয়ে পরিবারটিও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো।….

প্রাচীন চীন

চীনের কঙ্কুবাইন ইতিহাস চীনের সংস্কৃতিরই একটি অংশ। তখন শাসকগণ একাধিক কঙ্কুবাইন রাখতেন আর যেহেতু তখন একমাত্র পুত্রসন্তানই উত্তরাধিকারী হতেন তাই পুত্রসন্তানের জন্য তারা শত শত কঙ্কুবাইন হিসেবে গ্রহণ করতেন। খ্রিস্টপূর্ব ২২১-২০৬ অব্দের Dynasty)-এর শাসনামলে কঙ্কুবাইনদের ওপর ছিল। তেমনি একটি কনফুসিয়ান রীতি ছিল যে অবশ্যই তার মালিকের বিছানা ছেড়ে চলে যেতে হে বংশের (Qin রীতিনীতি প্রচলিত যৌন মিলনের পর আর কঙ্কুবাইনদের মালিকের হবে। তখন একই কঙ্কুবাইনের সাথে পরিবারের আপন আত্মীয় যেমন পিতা-পুত্র কিংবা পৌত্রদেরও যৌন সম্পর্ক সাথে সপ্তাহে অন্ততপাঁচ দিন যৌন মিলন করছে। ত ছিল ।…..

প্রাচীন গ্রিস

গ্রিক পাল্লাকিস (Pallakis)-এর অর্থ বাসাবাড়িতে অবস্থান করা মিস্ট্রেস বা উপপত্নী ।

তখনকার গ্রিক সমাজে স্ত্রীর পাশাপাশি গৃহকর্মী রেখে তার সাথে যৌন মিলন করা একটি লজ্জার বিষয় ছিল। তবে অনেক অবিবাহিত পুরুষের কঙ্কুবাইনসম সঙ্গী ‘হেতেরা’ (Hetaera) ছিল, তার অনেক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। সাধারণভাবে বলা যায়, হেতেরা ছিল রাজদরবার বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সেবিকা বা কোর্টিসান (Courtesan)। সাধারণত উচ্চশিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পারদর্শী নারীরাই হেতারা হিসেবে নিয়োগ পেতেন আর স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভুর সাথে তার শারীরিক সম্পর্ক থাকত । তবে হেতেরাইগণ সাধারণ পতিতাদের মতো ছিলেন না।….

প্রাচীন গ্রিসে পোরনাই (Pornai) নামে অর্থের বিনিময়ে পতিতালয়ের বাইরে যৌন কর্মীও ছিল, যাদের সাথে জন করা যেত। গ্রিক শব্দ থেকেই এসেছে ইংরেজি শব্দ Pornography। …..

প্রাচীন রোম

প্রাচীন রোমে কঙ্কুবাইন সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল। তখন কোনো পুরুষ ইচ্ছা করলে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বাইরে কোনো নারীর সাথে স্ত্রীর মতো সম্পর্ক রাখতে পারতেন, যা কঙ্কুবিনা (Concubina) নামে পরিচিত আর এর বহুবচন হলো কঙ্কুবাইনি (Concubinae)। সাধারণত কঙ্কুবাইনের সামাজিক অবস্থান ছিল অপেক্ষাকৃত নিচু শ্রেণির আর এই নিচু শ্রেণির হওয়াই তার বিবাহের বড় সমস্যা ছিল।

প্রাচীন রোমে ক্রীতদাসীরা তাদের প্রভুর সাথে যৌন সম্পর্ক করতেন এবং পরে অনেক প্রভুই এই ক্রীতদাসদের কঙ্কুবাইন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তবে প্রচলিত আইন অনুসারে কঙ্কুবাইনের সন্তানদের কোনো বৈধ স্বীকৃতি ছিল না ।

কঙ্কুবাইন সংস্কৃতি: প্রাচীন চীন

প্রাচীন চীনে সে সকল নারী, যারা বিবাহ ছাড়াই কোনো পুরুষের সাথে একত্রে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতেন তারাই কঙ্কুবাইন নামে পরিচিত ছিলেন। প্রাচীন চীনে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের কঙ্কুবাইন রাখা ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার। যেমন চীনের অনেক সম্রাট ছিলেন, যাদের হাজার হাজার কঙ্কুবাইন ছিল। এই কঙ্কুবাইনদের আবার অনেক স্তর ছিল যেমন, কেউ কেউ উপপত্নীর মর্যাদা ও সম্মান পেলেও অনেকেই কেবল যৌন আনন্দের জন্যই ব্যবহৃত হতেন একজন পতিতার ন্যায় তবে তার আভিজাত্য ছিল ।…..

Please follow and like us: