কালিদাসের মেঘদূত – বুদ্ধদেব বসু

›› কবিতা / কাব্য  ›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

ভূমিকা : সংস্কৃত কবিতা ও ‘মেঘদূত’

……আমি ভুলে যাচ্ছি না যে সব ভাষাতেই শব্দের উৎপত্তিস্থল বর্ণনা ; আমি বলতে চাচ্ছি, শব্দ যখন বর্ণনার স্মৃতি হারিয়ে ফ্যালে তখন তার বিকল্পের অভাবেই ভাষার পরিণতি সূচিত হয়। ‘স্তন’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ—যে শব্দ করে (অর্থাৎ জানিয়ে দেয় যৌবন আগত), এ-কথা আভিধানিক ছাড়া আর কেউ না-জানলে ক্ষতি নেই, একটি নারী-অঙ্গের নাম হিশেবেই তা আমাদের কাছে গ্রাহ্য। (রবীন্দ্রনাথের ‘সমুদ্রস্তনিত পৃথ্বী’তে ছাড়া আদি অর্থে এই শব্দের ব্যবহার বাংলায় আমি আর কোথাও পেয়েছি ব’লে মনে পড়ে না।) এবং এই নামের মধ্যে একটা ছবিও বিধৃত হ’য়ে আছে, উচ্চারণ করার সঙ্গে-সঙ্গেই যা আমাদের মনে ভেসে ওঠে। কিন্তু এই ছবিটা স্পষ্ট হবার জন্যই এটা দরকার যে প্রত্যেকটি নাম-শব্দ একটিমাত্র উল্লেখের মধ্যে সীমিত থাকবে ।….

…..‘পয়োধর’ মানে মেঘ বা নারীর স্তন হ’তে পারে ; এতে বোঝা যায় তা সম্পূর্ণ নাম-শব্দ হ’য়ে উঠতে পারেনি, বৈশেষণিক পরাধীনতায় কুণ্ঠিত হ’য়ে আছে। ‘রত্নাকর’-এর চলিত অর্থ সমুদ্র, কিন্তু লিঙ্গভেদহীন বাংলা ভাষায় পৃথিবীকেও রত্নাকর বলা সম্ভব, আর সেজন্যই আধুনিক কবি শব্দটিকেই বর্জন ক’রে চলেন। ‘বিম্বাধরা’, ‘নিতম্বিনী’, ‘ভামিনী’ ইত্যাদিতেও সেই আপত্তি : তারা কোনো বস্তুর নাম নয়, বর্ণনা মাত্র।…..

……ভারতের গরীয়ান ভাস্কর্যশালায় মিথুনমূর্তি অনেক আছে, কিন্তু বিশুদ্ধ নগ্নমূর্তি—জৈন তীর্থংকরের ঋজুকঠিন ধ্যানী বিগ্রহ ছাড়া—একটিও দেখা যায় না। নগ্ন ব’লে যাদের মনে হয় তাদের নিম্নাঙ্গে থাকে বসনের আভাস, আর থাকে স্ত্রী-পুরুষ- নির্বেশেষে বহু প্রথাসিদ্ধ, মর্যাদাবান অলংকার। বলা বাহুল্য, এর কারণ দেহ বিষয়ে কোনো কুণ্ঠা নয়— ভারতীয় চিত্ত বিষয়ে আর যে-কথাই বলা যাক, তাকে কেউ কখনো শুচিবায়ুগ্রস্ত বলবে না— এর পিছনেও এই ধারণা কাজ করছে যে ভূষণহীন সৌন্দর্য অসম্ভব। কিন্তু কোনারকের অপ্সরা বা অজন্তার মারকন্যার সঙ্গে তুলনীয় যে-সব মূর্তি বা ছবি য়োরোপীয় মহাদেশে রচিত হয়েছে, তারা সম্পূর্ণ নিরাভরণ ও নিরাবরণ । গ্রীক শিল্প চেয়েছে বিশুদ্ধ দেহকে সুন্দর ক’রে প্রকাশ করতে, কিন্তু পরবর্তীরা সুন্দরী নারীর প্রতিকৃতি আর আঁকেননি, সুন্দরকেই মূর্ত ক’রে তুলেছেন। বতিচেল্লির ভেনাসকে কোনো সুন্দরী নারী আর বলা যাবে না, কেননা ছবিটা নিজেই সুন্দর হ’য়ে উঠলো । এই শুদ্ধ নগ্নতার মধ্যে সৌন্দর্য তার স্বারাজ্য লাভ করলো, উচ্চারিত হ’লো শিল্পকলার স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীনতা ।…..


মানতেই হয়, ‘মেঘদূতে’র যক্ষ একজন লিবিডোভারাতুর জীব, তার প্রেমের ধারণা শৃঙ্গারবাসনায় সীমাবদ্ধ । তাকে প্রেমিকরূপে, বিরহীরূপে, উপস্থাপিত করার চেষ্টা আজকের দিনে কিছুতেই সার্থক হবে না, বরং তার কামাতুরতা স্বীকার ক’রে নিলেই কাব্যটিকে আমরা ঠিকমতো বুঝতে পারবো। এই স্বীকৃতি মনে রেখে, আমরা যখন গভীরভাবে বার-বার ‘মেঘদূত’ পড়ি, তখন কাব্যটির আর-একটি দিক আস্তে-আস্তে খুলে যেতে থাকে; আমরা দেখতে পাই, কালিদাস যক্ষের মুখে যা-কিছু কথা বসিয়েছেন তার প্রায় প্রত্যেকটি তার রুদ্ধ রতির ব্যঞ্জনা দিচ্ছে। আটমাসব্যাপী সম্ভোগের অভাবে, সে এখন যে-দশা প্রাপ্ত হয়েছে তার নাম দেয়া যায় নিখিলকামুকত্ব ; সব চিন্তা, সব স্মৃতি তার মনে যৌন চিত্রকল্প জাগিয়ে তুলছে ; তার কাম, যথাযথ পাত্র থেকে বঞ্চিত হ’য়ে, নিসর্গে ছড়িয়ে পড়লো। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের ‘মদনভস্মের পর’ কবিতারও এ-ই বিষয় ; তার শেষ স্তবকে ‘মেঘদূতে’র অবদান সুস্পষ্ট, এবং প্রথমে দুই পঙক্তি কুমার : ৪ : ২৭-এর পুনর্লিখন । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অনুভব ভিন্ন, মদন বিষয়ে তাঁর ধারণাও আলাদা। আধুনিক কবি যাকে বায়বীয় নির্যাসে পরিণত করেছেন, কালিদাসে আমরা পাই তার রক্তমাংসনির্ভর আকার ও আকৃতি। ‘মেঘদূতে’ যৌনতার উল্লেখ যে এত বেশি, তার কারণ দেখাতে হ’লে শুধু আদিরসের প্রতি সংস্কৃত কবিদের সাধারণ দুর্বলতার উল্লেখ করলে চলবে না, এ-কথাও মনে রাখা চাই যে যক্ষ তার রমণতৃষ্ণায় সর্বভূতে ঈন্সিতকে বিম্বিত ক’রে তুলছে। অর্থাৎ, ‘মেঘদূতে’ যৌনতা একটি বিষয়গত সার্থকতা পেয়েছে, কাব্যের কাহিনীর সঙ্গে তা সম্পৃক্ত ; মেঘ যে এখানে যক্ষেরই প্রতিভূ বা দ্বিতীয় সত্তা, তার পুরুষত্ব ও কামুকত্বের প্রতি পৌনঃপুনিক ও বিচিত্র উল্লেখে তার প্রমাণ পাই। পূর্বমেঘের ভূগোল ও উত্তরমেঘের অলকা—সবই যক্ষের কামনায় অনুরঞ্জিত, যে-সব দৃশ্য আমরা দেখছি তাদেরও মধ্যে তার অভিলাষ ব্যক্ত হয়েছে বা প্রচ্ছন্ন রয়েছে। পথে- পথে প্রতিটি পর্বতচূড়ায় মেঘের জন্য বিশ্রামের নির্দেশ আছে ; সেই পর্বতসমূহ যে নারীর স্তনের প্রতিরূপ, তা প্রথম সুযোগেই ব’লে দিতে কবি ভোলেননি :

প্রান্ত ছেয়ে আছে আম্রবনরাজি, ঝলক দেয় তাতে পক্‌ ফল, বর্ণে চিকুণ বেণীর মতো তুমি আরূঢ় হ’লে সেই শৃঙ্গে—
দৃশ্য হবে যেন ধরার স্তনতট, অমরমিথুনের ভোগ্য,
গর্ভসূচনায় মধ্যে কালো আর প্রান্তে পাণ্ডুর ছড়ানো। (পৃ ১৮ )

‘গর্ভিণীর স্তন’* ব’লে ব্যাপারটিকে আরো বিশদ করা হ’লো— এরও আগে বকপক্ষিণীর গর্ভাধানের উল্লেখ আছে (পৃ ৯), আছে শিলীন্ধ্রবতী পৃথিবীর উর্বরতার কথা (পৃ ১১), এবং ‘মেঘদূতে’ অন্য যে-সব পশুপক্ষী দেখা যায় তাদের প্রায় সকলেরই মৈথুনঋতু বর্ষা, কাকাদির নীড়নির্মাণ ও হস্তীর মদস্রাবেও যক্ষের কামনা প্রকাশ পাচ্ছে।

*মূলে শুধু বলা হয়েছে ‘পৃথিবীর স্তনের মতো’ (স্তন ইব ভুবঃ), কিন্তু ‘মধ্যে শ্যামঃ শেষবিস্তারপাণ্ডুঃ’— এই বর্ণনায় গর্ভিণীর স্তনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট ব’লে আমি অনুবাদে ‘গর্ভসূচনায়’ শব্দটি যোগ করে দিয়েছি। — চতুর্থ সংস্করণের পাদটীকা।

……যেমন পর্বতে বিশ্রাম, তেমনি মেঘ পথে-পথে নদীসমূহে অবতরণ করবে ; তার এই কর্মে খুবই স্পষ্টভাবে রতিক্রিয়ার ছবি আঁকা হ’লো একবার নয়, বার-বার মেঘ নায়করূপে এই ভিন্নপ্রকৃতি নদীনায়িকাদের তৃপ্তিসাধন ক’রে নিজেও পরিতৃপ্ত হচ্ছে। কোনো নদীর ঢেউ রূপসীর ভ্রূভঙ্গির মতো, কোনা নদী তার ঘূর্ণিরূপ নাভি দেখাচ্ছে, কেউ বিরহে কৃশ, কারো বায়ু মিলনোৎসুক প্রিয়ের মতো চাটুকার, কারো বায়ুতে যুবতীর জলকেলির সৌরভ ভেসে আসছে, আর কারো বা ‘লম্বমান’ কথাটি মূলেই

বসন ধ’রে আছে শিথিল হাতে যেন, তেমনি ঝুঁকে আছে বেতের শাখা, মুক্ত কোরো, সখা, তটনিতম্বেরে সরিয়ে দিয়ে নীল-সলিল-বাস ;
সহজে প্রস্থান হবে না সম্ভব, তুমি যে তার ‘পরে লম্বমান,
বিবৃতজঘনার বারেক পেলে স্বাদ কে আর পারে, বলো, ছাড়াতে! (পৃ ৪২)

আছে— এখানে কালিদাসের রচনা চিত্রকল্পের সীমা পেরিয়ে একেবারে বাস্তব আলেখ্য হ’য়ে উঠলো । যেখানে যেখানে প্রসঙ্গ ভিন্ন তেমন অনেক স্থলেও মল্লিনাথ আদিরসাত্মক ধ্বনি আবিষ্কার করেছেন, তাছাড়া আমরা শাদা চোখেও দেখতে পাই যে ‘মেঘদূত’ কাব্যটি যৌনধর্মের প্রভাবে একেবারে পূর্ণ ও পরিস্ফীত; কী পূর্বমেঘে, কী উত্তরমেঘে, নারী ও রতিপ্রসঙ্গের উল্লেখ বহুলপরিমাণে অত্যধিক ; বনবধূ, গ্রামবধূ, পুষ্পচায়িকা, পুরস্ত্রী, বারাঙ্গনা, নর্তকী, যক্ষনারী, দেবকন্যা, কাউকে কবি বাদ দেননি — কোথাও শিলাগৃহে বেশ্যাবিলাসীদের মত্ত যৌবন রাষ্ট্র হচ্ছে, কোথাও স্নানার্থিনী স্বৰ্গযুবতীরা মেঘকে বাহুবেষ্টনে ধরে রাখতে চায়, কোথাও গঙ্গা স্খলিত হচ্ছে অঙ্কশায়িনী প্রণয়িনীর বসনের মতো, আর কোথাও বা মেঘ অগোচরে প্রবেশ ক’রে অন্তঃপুরিকাদের ‘স্বজলকণিকা’য় দূষিত ক’রে পালিয়ে যাচ্ছে। আর যে-সব স্থলে অভিসার, প্রমোদ, রতিক্রিয়া ও উত্তরক্লান্তি প্রত্যক্ষভাবে চিত্রিত হয়েছে তাদের পুনরুল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। বস্তুত, সমগ্র ‘মেঘদূতে’ এমন শ্লোকের সংখ্যা অল্পই, যাদের বিষয় সম্পূর্ণরূপে অযৌন । এর ফলে কাব্যটি ক্লান্তিকর হ’তে পারতো— তা যে হয়নি তাতেই বোঝা যায় কালিদাসের রচনা কত পরাক্রান্ত। পূর্বে বলেছি যক্ষ কামুকমাত্র ; এখন যোগ করবো যে তার কাম এমন পরিশীলিত, বহুমুখী ও দ্যুতিময় যে তা-ই, শুধু তা-ই অবলম্বন ক’রে একটি মহৎ কাব্যের সৃষ্টি হ’তে পারলো। এই অতিশয় পরিমিত বিষয়টির মধ্যে কালিদাস যেমন বৈচিত্র্য ও সরসতার সঞ্চার করেছেন, যেমনভাবে বহুক্ষণ ধ’রে আমাদের মনোযোগ নিবিষ্ট রাখতে পেরেছেন, বিশ্বসাহিত্যে তার কোনো তুলনা আমার জানা নেই। কালিদাসের নিজেরই কাব্যের মধ্যে ‘ঋতুসংহার’, ‘কুমারসম্ভব’ অষ্টম সর্গ ও ‘রঘুবংশ’ শেষ সর্গ প্রধানত বা সম্পূর্ণত আদিরসাত্মক (তিনটিকেই তাঁর রচনা ব’লে ধ’রে নেয়া যাক), কিন্তু এর একটিও আমরা দ্বিতীয়বার পড়বার জন্য অত্যন্ত বেশি উৎসাহ বোধ করি না। অথচ ‘মেঘদূতে’র সঙ্গে আমরা যত, বেশি ঘনিষ্ঠ হ’তে পারি, তত বেশি আনন্দ পাই। তার একটি কারণ এই যে কাম এখানে রোমান্টিক বেদনায় রূপান্তরিত না-হ’লেও বিশ্বের পটভূমিকায় বিন্যস্ত হয়েছে, যক্ষের মানসরমণে অংশ নিচ্ছে রামগিরি থেকে অলকা পর্যন্ত সমস্ত জড় ও জীবজগৎ। কামের এই বিশ্বরূপ পৃথিবীর অন্য কোনো কাব্য আমাদের দেখাতে পারেনি ।

নারীদেহের বর্ণনায় সংস্কৃত কবিরা অক্লান্ত, তার কোনো-কোনো অংশের প্রশংসাতেও ভারতীয় সমালোচকেরা ক্লান্তিহীন । কিন্তু এই প্রসঙ্গেও— পূর্বেই বলেছি— উপমাদি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও পরিমিত; প্রতি অঙ্গের জন্য কয়েকটি বাঁধা-ধরা উপমান আছে, সেগুলোকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করতে কালিদাসও লজ্জাবোধ করেন না।

আবর্জিতা কিঞ্চিদিব স্তনাভ্যাং বাসো-বসানা তরুণাকরাগম্, পর্যাপ্ত পুষ্পস্তবকাবম্রা সঞ্চারিণী পল্লবিনীলতের ( কুমার : ৩ ঃ ৫৪ )

যাঁরা অল্পস্বল্প সংস্কৃত কবিতা পড়েছেন, তাঁরাও এই বিখ্যাত শ্লোকে দেখতে পাবেন— একটি পুনরাবৃত্তি মাত্র, যা পদলালিত্যের গুণে চমৎকারিত্ব পেয়েছে ; অল্প একটু চেষ্টা করলেই এই একই চিত্ররূপের বহু ভিন্ন-ভিন্ন প্রকরণ অন্যান্য কবির ও কালিদাসের নিজের রচনা থেকে উদ্ধার করা যায়। (মাত্র কয়েক শ্লোক আগে [ কুমার : ৩ : ৩৯ ] এই লতার প্রসঙ্গেই পর্যাপ্তপুষ্পস্তবকস্তনাভ্যঃ’ পাওয়া যায়, এবং ‘রঘুবংশ’ ১৩ : ৩২- এও অশোকলতাকে বলা হচ্ছে ‘তন্বীং স্তনাভিরাম স্তবকাভিনম্রাম্’।) কোনো উপমা হ এমন নয় যাতে আমরা ভাষার পিছনে ব্যক্তিকে দেখতে পাই, যাতে কালিদাসের স্বকীয় বা অনন্য কোনো দৃষ্টি ধরা পড়ে। সে-রকম দৃষ্টি থাকলে, নারীদেহের মতো ‘ব্যবহৃত, ব্যবহৃত, ব্যবহৃত’ প্রসঙ্গেও কল্পনার কত বড়ো ব্যাপ্তি ধরা দিতে পারে, তার কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি :

দুটি জানু, চাঁদের মতো, স্পষ্ট বেয়ে উঠলো উপরে,
ঊরুর সীমান্ত-মেঘে ডুব দিলো ;
জঙ্ঘার কৃশ ছায়াটি হঠলো পিছনে,
পা দুটি এলো এগিয়ে, উদ্ভাসিত,
আর দেহের সব ক-টি সন্ধি জীবন্ত হ’য়ে উঠলো
সুরাপায়ীদের কণ্ঠের মতো ।
* * **
তারপর এই শরীরের অস্পষ্ট উন্মেষের মধ্যে
ঢুকে পড়লো প্রথম গাঢ় নিশ্বাস, যেন প্রভাতী বায়ু ।
শিরাবৃক্ষের কোমলতম ডালে-ডালে জাগলো গুঞ্জন,
আর তারপর আরম্ভ হ’লো
গভীরতর স্থানগুলিতে শোণিতের মর্মর।
আর এই বাতাস, প্রবল হ’তে-হাতে, নিশ্বাসের সবটুকু ক্ষমতায়
তীব্র ঝাপটে ভ’রে তুললো সদ্যতন স্তন দুটিকে,
নিজেকে দিলো প্রবিষ্ট ক’রে তাদের মধ্যে, আর তারা
দিগন্তে-ভরে-ওঠা স্ফীত পালের মতো
হালকা মেয়েটিকে তীরে নিয়ে এলো ঠেলে। (‘ভেনাসের জন্ম’ : রাইনের মরিয়া রিলকে)….

….‘চাঁদের মতো মুখ’-এর চাইতে ‘চাঁদের মতো জানু’ অনেক বেশি সার্থক মনে হয় আমাদের কাছে, আর তার কারণ শুধু নূতনত্বের চমক ব’লেও মানতে পারি না। দেবী সমুদ্র থেকে উঠছেন (বতিচেল্লির চিত্র স্মরণীয়), জানুর অস্থি গোলাকৃতি, দিগন্তে যেমন চাঁদের উদয় পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাবও তেমনি ; কিন্তু এই চাক্ষুষ সাদৃশ্যই এখানে সব কথা নয় ; জানুর প্রতি এই মনোযোগের কারণ, ঐ অঙ্গ চালনা ক’রেই তিনি তীরে উঠবেন, সকাল ভ’রে ফুটিয়ে তুলবেন ‘ফুল আর ঘাস, উষ্ণ, উদ্‌ভ্রান্ত,/যেন আলিঙ্গন থেকে উঠে-আসা।’ এই গতির ভাবটিকেই ক্রমশ সোচ্চার ক’রে তোলা হচ্ছে : দেবীর জঙ্ঘা ‘সুরাপায়ীদের কণ্ঠের মতো জীবন্ত’, আর ‘দিগন্তে-ভ’রে-ওঠা ভরা পালের মতো’ তাঁর নূতন স্তন দুটি। একই রকম অযৌক্তিকের সাধনায় বোদলেয়ার এক তরুণীর জঙ্ঘাকে দুটি ডাকিনী ব’লে ভাবতে পেরেছিলেন, যাদের আন্দোলনে তীব্র কাম উদ্‌গীর্ণ হচ্ছে ; জীবনানন্দ দেখতে পেয়েছিলেন এমন চোখ, যা নীড়ের মতো স্নেহে ও আশ্রয়ে পরিপূর্ণ। বিদিশার রাত্রির মতো চুল, শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মতো মুখ, বা–আরো আশ্চর্য ‘উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা’— কালিদাসের কাব্যাদর্শ অনুসারে এ-সব উপমার কোনো অর্থই করা যাবে না, কিন্তু আমাদের কাছে এদের অর্থ সব-কিছু। শ্রাবস্তী ও বিদিশা বিষয়ে তবু বলা যায় যে এই দুই নগর যেমন লুপ্ত, সুদূর, স্মৃতিভারাক্রান্ত, তেমনি কবির জীবনে বনলতা সেন নাম্নী নারী, কিংবা তিনি মানবীও নয়, এক স্বপ্নচারিণী, যাকে কখনো পাওয়াও যাবে না, ভোলাও যাবে না। কিন্তু উটের গ্রীবার সঙ্গে নিস্তব্ধতার সম্বন্ধ কী ? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা যখন ভাষা খুঁজে পাই না, তখনও আমরা উপমাটিকে অত্যন্ত সংগত ব’লে অনুভব করি ; এই উপমা আমাদের চিত্তবৃত্তিকে জাগ্রত ও কর্মিষ্ঠ ক’রে তোলে, তার প্রেরণায় বিশ্বের দুই সুদূরপরাহত বস্তুর মধ্যে সেতুবন্ধন সহজ হ’য়ে যায় ।….

…..ইঙ্গিতময় উপমার একটি শর্ত হ’লো এই যে উপমেয় ও উপমানে কোনো যান্ত্রিক যোগ থাকবে না, একটি তির্যকভাবে অন্যটির প্রান্ত ছুঁয়ে চ’লে যাবে। অবশ্য কোনো উপমাতেই দুই অংশে কোষ-তরবারি সম্বন্ধ থাকতে পারে না। ‘চাঁদমুখ’ বললে চাঁদের মনোহারিত্ব শুধু মনে পড়ে আমাদের, তার শৈত্য, গোলত্ব বা মৃত অবস্থা নয় ; কিন্তু রোমান্টিক কবিতায় উল্লিখিত প্রসঙ্গেই কথা ফুরোয় না, তাকে আস্তে সরিয়ে দিয়ে উপমার অভিপ্রায় আরো দূরে উত্তীর্ণ হয় ।

কুঁকড়ে আছে তারা,
একটু নড়ে না,
নিশ্বাস নেয় লাল ঘুলঘুলিতে
স্তনের মতো উষ্ণ ।

রেবোর এই স্তবকে আমরা দেখতে পাই, উপমেয়ের স্থানচ্যুতির ফলে উপমা কত বেশি বলতে পারে। কবিতাটির নাম ‘উদ্ভ্রান্তেরা’, বিষয় পাঁচটি দরিদ্রসন্তান, যারা রুটিওলার দোকানের বাইরে বুভুক্ষুভাবে দাঁড়িয়ে আছে, শীতের রাত্রে, কনকনে হাওয়ায়। ভিতরে সারি-সারি রুটি সেঁকা হচ্ছে, চুল্লির লাল ঘুলঘুলির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তারা। সেই ঘুলঘুলিকে কবি বলছেন স্তনের মতো উষ্ণ। স্তনের মতো কেন ? আমাদের বুঝতে দেরি হয় না যে চুল্লির ফোকরটা এখানে একটা ধাপ মাত্র, সেই ফোকরে তৈরি- হ’তে-থাকা রুটিগুলোই উপমানের আসল লক্ষ্য। উষ্ণ, নরম, টাটকা রুটিকে অনেক বিষয়েই ‘স্তনের মতো’ বলা যায়– এবং উভয় বস্তুই খিদে মেটায়, পুষ্টি দেয়, যা এই ক্ষুধিত শিশুদের পক্ষে সবচেয়ে বড়ো কথা ।….

 

মেঘদূত

পূর্বমেঘ


জনেক যক্ষের কর্মে অবহেলা ঘটলো ব’লে শাপ দিলেন প্রভু,
মহিমা অবসান, বিরহ গুরুভার ভোগ্য হ’লো এক বর্ষকাল ;
বাঁধলো বাসা রামগিরিতে, তরুগণ স্নিগ্ধ ছায়া দেয় যেখানে,
এবং জলধারা জনকতনয়ার স্নানের স্মৃতি মেখে পুণ্য ।


যখন আট মাস কাটলো সে-পাহাড়ে কান্তাবিরহিত কামুকের,
সোনার কঙ্কণ স্খলিত হ’য়ে তার শূন্য হলো মণিবন্ধ ।
দেখলো মেঘোদয় ধূমল গিরিতটে একদা আষাঢ়ের প্রথম দিনে-
বপ্রকেলি করে শোভন গজরাজ আনত পর্বতগাত্রে ।


কামের উদ্রেক যে করে, সেই মেঘে সহসা দেখে তার সমুখে
যক্ষ কোনোমতে চোখের জল চেপে ভাবলে মনে-মনে বহুখন :
নবীন মেঘ দেখে মিলিত সুখীজন তারাও হ’য়ে যায় অন্যমনা,
কী আর কথা তবে, যদি সে দূরে থাকে যে চায় কণ্ঠের আলিঙ্গন ।

8
কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে
যদি-না জলধরে বাহন ক’রে আমি পাঠাই মঙ্গল-বার্তা ?
যক্ষ অতএব কুড়চি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য
স্বাগত-সম্ভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে ৷


বাতাস, জল, ধোঁয়া এবং আলোকের কোথায় মেঘরূপী সমবায়,
কোথায় ইন্দ্রিয়ে সুপটু, সজ্ঞান প্রাণীর প্রাপণীয় সমাচার!
এ-ভেদ ভুলে গিয়ে ব্যগ্র বিরহী সে জানালে মেঘে তার যাচনা,
চেতনে-অচেতনে দ্বৈত অবলোপ, তা-ই তো কামুকের স্বাভাবিক।


হে মেঘ, জানি আমি ভুবনবিশ্রুত তুমি যে পুষ্কর-আবর্তের
বংশে জাত, আর সেবক ইন্দ্রের, ইচ্ছেমতো নাও নানান রূপ ।
দৈব প্রতিকূল, বন্ধু বহু দূরে, তোমার কাছে আমি প্ৰাৰ্থী,
গুণীরে অনুনয় বিফল সেও ভালো, অধমে বর দিলে নিতে নেই।


প্রিয়ার বাহু থেকে কঠিন বিচ্ছেদ কুপিত ধনপতি ঘটালেন,
আমার সমাচার, পয়োদ, নিয়ে যাও, তুমি যে তাপিতের আশ্রয়!
যক্ষপুরে যাবে, অলকা নাম, তার আছেন উদ্যানে শম্ভু,
সৌধশ্রেণী তার চন্দ্রমৌলির ললাট-জ্যোৎস্নায় ধৌত


যখন আরোহণ করবে বায়ুপথে, পথিকবনিতারা অলক তুলে
গভীর প্রত্যয়ে দেখবে তোমাতেই প্রিয়ের আগমন-আশ্বাস ।
আমার মতো নয় যে-জন পরাধীন, বলো তো সে কি পারে দয়িতার
বিরহভারাতুর ব্যথা না-ক’রে দূর গগনে তুমি যবে উদিত ?


যেমন অনুকূল পবন ধীরে-ধীরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তোমাকে,
এবং বাম দিকে গরবী চাতকেরা ঐকতান তোলে মধুময়,
তেমনি নভতলে গর্ভাধানকালে মালার মতো বাঁধা বলাকা
সহজ অভ্যাসে, হে প্রিয়দরশন, করবে আপনাকে সেবায় সুখী।

১০
অবাধ গতি নাও, জলদ, চ’লে যাও, যেখানে একমনা ভ্রাতৃবধূ
দিবস-গণনায় এখনো বেঁচে আছে— বন্ধু, তুমি তাকে দেখবে!
ফুলের মতো মৃদু হৃদয় রমণীর অচিরে বিচ্ছেদে ভেঙে যায়,
কী আর আছো, বলো, আশার বাঁধ বিনা, যা তাকে রাখে তবু বাঁচিয়ে ।

১১
প্রভাবে হয় যার পৃথিবী উর্বর, এবং ভ’রে ওঠে শিলীন্ধ্রে,
শ্রবণ–রমণীয় তোমার সেই নাদ শুনবে চঞ্চল মরাল-দল,
মানস-উৎসুক, পাথেয়রূপে নেয় মৃণালকিশলয়খণ্ড-
আকাশ-পথে, সখা, আকৈলাস ওরা তোমার হবে সহযাত্রী।

১২
ভুবন-পূজনীয় রাঘব-পদরেখা রয়েছে আঁকা যার মেখলায়,
তোমার প্রিয় সখা তুঙ্গ এই গিরি, বিদায় বলো তাকে তাহ’লে ।
নিত্য কালে-কালে প্রাবৃট দেখা দিলে তোমার সঙ্গ সে ফিরে পায়,
নিহিত স্নেহ তার বিরহসঞ্চিত উষ্ণ আঁখিজলে ব্যক্ত ।

১৩
প্রথমে শোনো, মেঘ, বলছি আমি সব, যোগ্য পন্থার বিবরণ,
আমার সমাচার শুনবে তার পরে, করবে পান তুমি শ্রবণে ।
শান্ত হবে যেই, পা রেখো বিশ্রামে উদার পর্বতশৃঙ্গে,
শীর্ণ যদি হও, তখনই পান কোরো নদীর অতি লঘু কোমল জল ।

১৪
তোমার উৎসাহ দেখবে মুখ তুলে মুগ্ধ অপ্সর-অঙ্গনারা,
চমকে মনে-মনে ভাববে বায়ু বুঝি হরণ ক’রে নিলো অদ্রি!
আর্দ্র বেতসের আবাস এই স্থল ছাড়িয়ে,
উত্তর-আকাশে যাত্রা করো, পথে এড়িয়ে সংঘাত বিপুল দিাগহস্তের ।

১৫
উইয়ের ঢিবি থেকে বেরিয়ে এলো এই ইন্দ্রধনুকের টুকরো,
রত্ন বহুবিধ মেশায় আভা যবে, তেমনি অভিরাম নয়নে;
তোমার শ্যাম তনু কান্তি পাবে তাতে মোহন ভঙ্গিতে উজ্জ্বল,
ময়ূরপুচ্ছের দীপ্ত প্রসাধনে যেমন গোপবেশী বিষ্ণু ।

১৬
জানে না ভ্রূবিলাস, নয়ন স্নেহময়, সরল জনপদবধূরা
তোমাতে নির্ভর কৃষির, তা-ই জেনে করবে দৃষ্টিতে তোমাকে পান ।
লাঙল পেয়ে হোক সুরভি মালভূমি, তোমার বর্ষণে ধন্য,
এবার লঘু হ’য়ে খানিক পশ্চিমে, আবার দিক নাও উত্তর ।

১৭
তোমার ধারাজলে ভীষণ দাবদাহ নিবলো যার, সেই আম্রকূট
সাদরে নেবে টেনে তোমাকে বুকে তার, জুড়োবে ভ্রমণের পরিশ্রম ;
বন্ধু যদি চায় শরণ, তবে তার অতীত-উপকার-স্মরণে
ক্ষুদ্রজন সেও থাকে না উদাসীন, কী আর কথা তবে মহতে

১৮
প্রান্ত ছেয়ে আছে আম্রবনরাজি, ঝলক দেয় তাতে পক্ক ফল,
বর্ণে চিক্কণ বেণীর মতো তুমি আরূঢ় হ’লে সেই শৃঙ্গে—
দৃশ্য হবে যেন ধরার স্তনতট, অমরমিথুনের ভোগ্য,
গর্ভসূচনায় মধ্যে কালো আর প্রান্তে পাণ্ডুর ছড়ানো

১৯
কুঞ্জে ভ্রমে যার বন্য বধূগণ, ক্ষণেক থেকো সেই শৈলে,
মোচন ক’রে বারি ত্বরান্বিতগতি, নতুন পথে উত্তীর্ণ,
দেখবে নদী এক বিন্ধ্যশৈলের উপলবন্ধুর চরণে—
হাতির গায়ে আঁকা চিত্রলেখা যেন শীর্ণ রেবা সেই বিসর্পিতা

২০
যখন বর্ষণ ফুরোবে, পান কোরো তীব্রসৌরভ রেবার জল,
জামের বনে যার আঘাত লাগে, আর বন্য গজমদগন্ধে ভরা ।
বিফল হবে বায়ু তোমার পরাভবে, হে মেঘ, যদি হও সারবান,
কেবল পূর্ণতা দেয় যে গৌরব, লঘুতা রিক্তেরই লক্ষণ।

২১
নব কদম্বের সবুজ-পিঙ্গল অর্ধবিকশিত বৰ্ণ
দ্যাখে যে-মৃগদল, নেয় অরণ্যের মাটির আমোদিত আঘ্রাণ,
এবং মুকুলিত সদ্য ভুঁইচাঁপা জলার ধারে করে ভক্ষণ—
হে মেঘ, জলকণা-মোচনে উন্মুখ, তোমার হবে তারা দিশারী।

২২
বিন্দুবর্ষণ-গ্রহণে সুনিপুণ চাতকদলে করে দর্শন,
দেখায় গুনে-গুনে বকের পঙক্তির বদ্ধশৃঙ্খল বিন্যাস-
সে-সব কিন্নর তোমাকে সম্মান জানাবে, গর্জনসময়ে
বেপথুমতী প্রিয় সখীর শঙ্কিত আলিঙ্গন পেয়ে সহসা ।

২৩
যদিও জানি, তুমি আমার প্রিয় কাজে অচির যাত্রায় উৎসুক,
দেখছি তবু সব কুটজসৌরভে মোদিত পর্বতে কাটবে কাল ;
সজল চোখে ক’রে তোমার অর্চনা তুলবে কেকারব ময়ূরগণ,
বিদায়কালে দেবে এগিয়ে কিছু পথ— ত্বরার তবু কোরো চেষ্টা ।

২৪
তোমার আগমনে হবে দশার্ণেই যাত্রী হংসের বিশ্রাম,
কাননে বেড়াগুলি পাণ্ডু ক’রে দিয়ে ফুটবে থরে-থরে কেতকী,
গ্রামের পথে-পথে আকুল হবে তরু কাকের বাসা-বাঁধা ঝাপটে,
পক,পরিণত, প্রচুর জম্বুতে শ্যামল হবে বনপ্রান্ত।

২৫
বিদিশা নাম, সারা ভুবনে বিখ্যাত, যখন যাবে রাজধানীতে,
তখনই পাবে, মেঘ, সকল উপচারে কামুকবৃত্তির পূর্ণফল ।
তটের কলতানে রূপসী রমণীর ভুরুর ভঙ্গিমা যে দেয় এঁকে,
ঊর্মি-চঞ্চল বেত্রবতী সে-ই করবে পান তার মধুর বারি ।

২৬
নীচে নামে গিরি সেখানে আছে, তার শিখরে বিশ্রামে নামবে,
তোমার স্পর্শের পুলকে ফোটাবে যে নব কদম্বের গুচ্ছ,
বারাঙ্গনাদের অঙ্গপরিমলে লিপ্ত শিলাগৃহ যেখানে
রটনা করে দেয় পৌর পুরুষের মত্ত, উতরোল যৌবন ।

২৭
শ্রান্তি দূর ক’রে যাত্রা কোরো পুন, কিন্তু নদীতীরবর্তী
কাননে জলকণা ছিটিয়ে যেয়ো, মেঘ, তরুণ যূথিকার কোরকে ;
কপোলে স্বেদ মুছে ক্লান্ত হলো যারা, মলিন হ’লো কানে পদ্মকলি,
আননে ছায়া ফেলে ক্ষণেক দেখে নিয়ো পুষ্পচায়িকা সে মেয়েদের।

২৮
জেনেছো, উত্তরে তোমার অভিযান ; যদি বা পথ হয় বক্র,
ভুলো না দেখে নিতে উজ্জয়িনীপুরে সৌধসমূহের উপরিতল ;
সেখানে সুন্দরী আছেন যাঁরা, তুমি তাঁদের চঞ্চল চাহনির
স্ফুরিত বিদ্যুতে না যদি প্রীত হও, হবে যে বঞ্চিত নিদারুণ।

২৯
দেখবে যেতে-যেতে স্খলিত, মনোরম ভঙ্গি নেয় নির্বিন্ধ্যা,
ঢেউয়ের সংঘাতে মুখর বিহগেরা রচনা করে তার কাঞ্চীদাম,
ঘূর্ণি নাভি তার দেখায়, তুমি তাই সরস হবে তার সন্নিপাতে,
জানো তো হাবেভাবে আদ্য অনুরাগ জানায় দয়িতেরে প্রমদা।

৩০
বেণীর মতো ক্ষীণ জলের ধারা যার তোমারই ভাগ্যের ঘোষণা,
তটজ বৃক্ষের জীর্ণ পাতা ঝরে পাণ্ডু হ’লো যার বর্ণ,
তোমার কারণে যে বিরহলক্ষণ ধারণ ক’রে আছে অঙ্গে-
যাতে সে-তটিনীর কাশ হয় দূর, এবার করো সেই চেষ্টা ।

৩১
যাবে অবন্তীর পুরীতে, বৃদ্ধেরা যেখানে উদয়ন-কথাবিদ,
বলেছি পূর্বেই ঋদ্ধিশালী সেই নগর বিশালার গৌরব
স্বর্গবাসীদের পুণ্য হ’লে ক্ষয় যা থাকে সুকৃতির অবশেষ,
প্রভাবে তারই যেন এনেছে ধরাধামে স্বর্গকণা এক কান্তিমান।

৩২
ফুল্ল কমলের গন্ধে আমোদিত শিপ্রাবায়ু সেথা প্ৰভাতে
ছড়িয়ে দেয় দূরে হৃষ্ট সারসের মধুর, অস্ফুট কাকলি ;
প্রার্থী প্রণয়ীর মতোই চাটুকার, অঙ্গে অনুকূল সে-অনিল
সোহাগে ধীরে-ধীরে ভোলায় মেয়েদের রতির উত্তরক্লান্তি ।

৩৩
সেথায় বাতায়নে কেশের প্রসাধনে গন্ধধূপ উদ্‌গীৰ্ণ,
পুষ্ট তাতে, পাবে প্রীতির উপহার, পালিত ময়ূরের নৃত্য ;
শ্রান্তি হবে দূর, দ্যাখো এ-লক্ষ্মীরে পুষ্পসুরভিত ভবনে,
যেখানে আঁকা আছে ললিতা বনিতার অলক্তকরাগচিহ্ন।

৩৪
ত্রিলোকগুরু যিনি দেবাদিদেব, তাঁর পুণ্যধামে যেতে ভুলো না,
নিকটে নদী বয়, স্নিগ্ধ বায়ু তার আন্দোলিত করে উদ্যান,
সঙ্গে আনে বাস পদ্মপরাগের, যুবতী-জলকেলি-সৌরভ;-
প্রভুর কণ্ঠের বর্ণ ধরো, তাই দেখবে সমাদরে প্রমথগণ ।

৩৫
হে মেঘ, মহাকাল-দেউলে দৈবাৎ অন্য কালে যাও যদি বা,
তবুও থেকো তুমি, যাবৎ দৃষ্টির না হয় অগোচর সূর্য ;
সান্ধ্য আরতির লগ্নে তুমি যদি হও মৃদঙ্গের প্রতিভূ ;
মন্ত্র, গম্ভীর, শ্লাঘ্য নিনাদের পুণ্যফল পাবে অবিকল।

৩৬
তখন বেশ্যারা, নাচের তালে যারা তুলছে মেখলায় নিক্কণ,
সলীল ভঙ্গিতে রত্নছায়াময় চামর নেড়ে যারা ক্লান্ত,
তোমার দিকে তারা হানবে চাহনির দীর্ঘ মধুকর-পঙক্তি
কেননা নখক্ষতে পরশে আনে সুখ প্রথম বৃষ্টির বিন্দু।

৩৭
উত্তোলিত বাহু বন্য তরু যেন, নৃত্যে উদ্যত শম্ভু-
তখন হবে তুমি সন্ধ্যাকিরণের জবায় রক্তিম মণ্ডল ;
ব্যাপ্ত তুমি, তাই তৃপ্ত হবে তাঁর আর্দ্র অজিনের বাসনা,
তোমার ভক্তিরে শান্ত, অনিমেষ নয়নে দেখবেন ভবানী ।

৩৮
সেখানে প্রণয়ীর ভবনে রমণীরা চলেছে পুঞ্জিত আঁধার ঠেলে
বিজন রাজপথে, তামসী যামিনীতে, দৃষ্টিবিরহিত চরণে—
দেখিয়ে নিয়ো পথ স্নিগ্ধ বিদ্যুতে নিকষে কনকের তুল্য,
কিন্তু বরিষন অথবা গর্জন কোরো না, তারা অতি ভয়াতুর।

৩৯
পত্নী বিদ্যুৎ ক্লান্ত হ’লে পরে ঝলক তুলে তুলে অনেক বার,
বিরাম নিয়ো কোনো ভবন-বলভিতে, যেখানে কপোতেরা সুপ্ত ;
সূর্য দেখা দিলে আবার বাকি পথে যাত্রা শুরু হোক আপনার
বন্ধুবিনোদনে অঙ্গীকৃত জন পথে কি দেরি করে কখনো ।

৪০
তখন খণ্ডিতা নারীর আঁখিজল শান্ত ক’রে দেবে প্ৰণয়ী ;
সূর্য ফিরে এসে সিক্ত নলিনীর কমল-মুখ থেকে সরাবে
শিশির-অশ্রুর চিহ্ন-অতএব ত্বরিতে ছেড়ে দিয়ো সেই পথ ;
বন্ধু, পাবে তাঁর তীব্র বিদ্বেষ রুদ্ধ করো যদি রশ্মি।

৪১
বরং গম্ভীরা নদীর অন্তরে প্রবেশ কোরো তুমি, হে সুন্দর!
অমল হৃদয়ের মতো সে-জলধারা তোমার ছায়ারূপে ধন্য হোক ৷
চটুল পুঁটিমাছ লাফিয়ে চলে যেন, ধবল কুমুদের কান্তি-
তেমনি তার চোখে চাহনি, তুমি তায় কোরো না নিষ্ফল ধৈর্য ধ’রে ।

৪২
বসন ধ’রে আছে শিথিল হাতে যেন, তেমনি ঝুঁকে আছে বেতের শাখা,
মুক্ত কোরো, সখা, তটনিতম্বেরে সরিয়ে দিয়ে নীল-সলিল-বাস;
সহজে প্রস্থান হবে না সম্ভব, তুমি যে তার ‘পরে লম্বমান,
বিবৃতজঘনার বারেক পেলে স্বাদ কে আর পারে, বলো, ছাড়াতে ।

৪৩
যখন যাবে দেবগিরিতে, বাতাসের বীজন পাবে মৃদুমন্দ,
রমণীয় তোমারই বৃষ্টিতে সদ্যপুলকিত মাটির ঘ্রাণে,
নাসিকারন্ধ্রের মধুর বৃংহিতে গন্ধ নেয় তার হাতির পাল, স
হজ বনজাত ডুমুর পেকে ওঠে শীতল তার সৌজন্যে ।

৪৪
সেখানে নিত্যই আছেন কার্তিক, অধীন তাঁর সব ইন্দ্রসেনা ;
মূর্ত করেছেন, চন্দ্রমৌলির যে-তেজ হুতাশনে নিহিত,
পরাক্রমে তাঁর সূর্য হার মানে। পুষ্পমেঘরূপে আপনি
আকাশগঙ্গার আর্দ্র ফুলদলে, হে মেঘ তাঁকে স্নান করাবেন ।

৪৫
মন্দ্র গরজনে শৈল মেখলায় প্রতিধ্বনি তুলে অতঃপর
নাচাবে পাবকির ময়ূরটিকে, যার স্খলিত, উজ্জ্বল পুচ্ছ
গৌরী প’রে নেন পুত্রস্নেহবশে, কর্ণে, কুবলয়কলির পাশে—
এবং ধবলিত নয়ন-কোনা যার শিবের ললাটের জ্যোৎস্নায় ।

৪৬
নিলেন শরবনে জন্ম যে-দেবতা, সাঙ্গ হ’লে তাঁর ভজনা,
এড়াতে জলকণা, দেবেন ছেড়ে পথ সবীণ সিদ্ধেরা সকলে ;
যোগ্য সম্মান দিয়ো সে-কীর্তিরে, গেছেন রেখে সেথা রন্তিদেব ——
সুরভিসন্তান-নিধনে পরিণত নদীর স্রোতে ক’রে অবতরণ ।

৪৭
যখন হবে নত জলের ‘পরে, তুমি শাঙ্গী বিষ্ণুর বর্ণচোর,
গগনচারীগণ, অনেক দূরে ব’লে, দৃষ্টিনিক্ষেপে নিশ্চয়
দেখবে সে-বিপুল নদীরে ক্ষীণতনু ; যেন এ-পৃথিবীর কণ্ঠে
একক লহরের মুক্তামালা দোলে, মধ্যমণি তার ইন্দ্রনীল ।

৪৮
সে-নদী পার হ’লে তোমার কান্তিরে কৌতূহলে-ভরা চক্ষে
দেখবে দশপুরবধূরা, ভ্রূলতার বিলাসে যারা অভ্যস্ত,
যাদের পক্ষের চটুল উৎক্ষেপে ধবলে শোভা পায় কৃষ্ণ,
কুন্দকুসুমের আন্দোলনে যেন মুগ্ধ মধুকর ধাবমান।

৪৯
ব্রহ্মাবর্তের প্রথিত জনপদ, একদা যেথা কুরুক্ষেত্রে
কমলদলে তুমি যেমন ঢালো জল, তেমনি অবিরল শরজাল
শাণিত বিক্রমে শত রাজন্যের আননে হেনেছেন অর্জুন—
এবার ছায়ারূপে যাবে সে-যুদ্ধের অস্ত্রচিহ্নিত ভূমিতে ।

৫০
বন্ধুপ্রীতিবশে যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ছিলেন যিনি, সেই বলরাম
সরিয়ে মনোমতো মদিরা, যাতে আঁকা রেবতীনয়নের বিশ্ব,
নিতেন যার স্বাদ— সৌম্য, তুমি সেই সরস্বতী-বারি ভুলো না—
সেবন ক’রে হবে হৃদয়ে নির্মল, বর্ণে শুধু র’বে কৃষ্ণ ।

৫১
ঐ যে হিমাচল, নিকটে কনখল, গা বেয়ে নামে তার গঙ্গা,
জহ্নু-দুহিতা সে, সগরবংশের স্বর্গযাত্রায় যেন সোপান ;
গৌরী তাকে যত ভ্রূকুটি করেছেন, তত সে ফেনময় হাস্যে
ঢেউয়ের মুঠি তুলে ধরেছে শম্ভূর ইন্দু জ্বলা কেশগুচ্ছ ।

৫২
আকাশে পশ্চাৎ এলিয়ে দিয়ে তুমি, আকারে যেন এক ঐরাবত,
বক্র হ’য়ে পান করবে যদি ভাবো স্ফটিক-নির্মল সেই জল,
তাহ’লে তার স্রোতে তোমার ছায়ারূপ তখনই হবে বিস্তীর্ণ,
যেমন অস্থানে নয়ন-অভিরাম গঙ্গা-যমুনার সংগম ।

৫৩
আসীন মৃগদের নাভির সৌরভে মোদিত হয় যার শিলাতল,
তুষারে সমাহিত ধবল সেই গিরি গলিত গঙ্গার উৎস;
শ্রান্ত হে পথিক, শিখরে তুমি তার বিরাম নিলে পাবে সেই রূপ-
ধবল হরবৃষশৃঙ্গে উৎখাত যেমন শোভা পায় কদম ।

৫৪
চমরী-রোমরাজি দগ্ধ করে যার বাতাসে ধাবমান ফুলকি,
সরল বৃক্ষের স্কন্ধ-ঘর্ষণে অভ্যুদিত সেই দাবানল
দুঃখ দেয় যদি নগাধিরাজে, তুমি বিপুল বারিপাতে নিবিয়ো,
কেননা পীড়িতের আর্তিনিবারণে বিত্ত সার্থক মহতের।

৫৫
মুক্ত ক’রে দিলে তাদের গতিপথ, অথচ আক্রোশে বেগবান
লস্ক দিয়ে উঠে শরভদল যদি আক্রমণ করে তোমাকে,
তখনই উতরোল শিলার বর্ষণে অঙ্গ ক’রে দিয়ো চূর্ণ-
চেষ্টা পায় যেবা অসম্ভবে, তার ঘটবে পরাজয় নিশ্চয় ।

৫৬
সেখানে প্রস্তরে ব্যক্ত শিবপদ ভক্তিভরে কোরো প্রদক্ষিণ—-
সিদ্ধগণ যাকে নিত্য পূজা দেন, এবং পেয়ে যায় দৰ্শন
সকল পাপ থেকে মুক্ত হয় সে-ই, হৃদয়ে যার আছে শ্রদ্ধা,
মরণ-পরপারে পায় চিরন্তন পুণ্য প্রমথের পদবি ।

৫৭
বাতাসে ভরপুর বেণুর সুমধুর শব্দ ওঠে সেথা অবিরাম,
সকল কিন্নরী মিলিত সমসুরে ত্রিপুরজয় করে কীর্তন ;
বাজাও তুমি যদি পাষাণ-কন্দরে গভীর ধ্বনিময় পাখোয়াজ,
তবেই পশুপতি পাবেন উপচার পূর্ণ সংগীত-বাদ্য ।

৫৮
পেরিয়ে হিমালয়তটের বিস্ময়, হংসদ্বার পাবে সমুখে,
ক্রৌঞ্চরন্ধ্র সে পরশুরাম যাতে যশের পেয়েছেন পন্থা–
দীর্ঘ, তির্যক তুমিও সেই পথে আবার উত্তরে চলবে,
শোভন যেন শ্যাম চরণ বিষ্ণুর, সমুদ্যত বলিদমনে ।

৫৯
শিথিল সানু যার রাবণ-বিক্রমে, দ্যুলোকবনিতার দর্পণ—
তুঙ্গতর সেই ধবল কৈলাসে অতিথি হোয়ো তুমি ক্ষণকাল ;
মহান তার চূড়া ব্যাপ্ত করে নভে শুভ্র কুমুদের কান্তি,
নিত্য-জ’মে-ওঠা অট্টহাসি যেন রাষ্ট্র করেছেন ত্র্যম্বক ।

৬০
সদ্য-কেটে-আনা দ্বিরদ-দন্তের গৌর আভা যার তনুতে
সে-গিরিতটে যবে আগত হবে তুমি দলিত-অঞ্জন-বৰ্ণ,
দেখাবে মনোরম শ্যামল বাস যেন, যা তাঁর কাঁধে নেন বলরাম—
বন্ধু, আমি জানি তখন হবে তুমি নির্নিমেষে দ্রষ্টব্য ।

৬১
রম্য সে-গিরিতে গৌরী সেইক্ষণে করেন যদি পদচারণা,
কাটাতে ভয়, খুলে সাপের কঙ্কণ, ধরেন পাণি তাঁর শম্ভু—
এগিয়ে যেয়ো তুমি, কিন্তু অন্তরে রুদ্ধ রেখো সব বৃষ্টিবেগ,
ক্রমশ ধাপে-ধাপে এলিয়ে দিয়ে তনু, সোপান হ’য়ে যেয়ো মণিতটের।

৬২
সেখানে নিশ্চয়ই স্বর্গযুবতীরা বলয়কুলিশের আঘাতে
উদ্‌গিরিত জলে রচনা ক’রে নেবে তোমাতে স্নানধারাযন্ত্র ;
গ্রীষ্মে খরতাপে তোমাকে পেয়ে তারা না যদি দিতে চায় মুক্তি,
রূঢ় গরজনে দেখিয়ো ভয় সেই আমোদে মাতোয়ারা মেয়েদের ।

৬৩
সোনার অম্বুজ ফোটে যে-সরোবরে, সে-বারি পান কোরো কখনো,
ঐরাবতে দিয়ো ক্ষণিক সুখ, তার আননে টেনে দিয়ে গুণ্ঠন,
কাঁপিয়ো বায়ুবেগে কল্পপাদপের সূক্ষ্ম-অংশুক-পল্লব—
হে মেঘ, এইমতো বিবিধ বিনোদনে কোরো সে-পর্বতে উপভোগ।

৬৪
প্রণয়ী কৈলাস, এলিয়ে আছে কোলে বিমান-মনোরমা অলকা,
গঙ্গা নামে তার স্রস্ত অঞ্চল, প্রাসাদচূড়া তার বর্ষায়
ধারণ করে মেঘ মুক্তাজালে গাঁথা যেমন কামিনীর কেশদাম
স্বৈরী, তুমি সেই পুরীকে পুনরায় চিনতে পারবে না ভেবো না ।

 

উত্তরমেঘ

৬৫
রয়েছে বিদ্যুৎ ললিত বনিতায়, ইন্দ্রধনু গৃহচিত্রে,
গানের আয়োজনে প্রহত পাখোয়াজে স্নিগ্ধগম্ভীর নির্ঘোষ,
স্বচ্ছ ভূমিতল সজল মনে হয়, লেহন করে মেঘে তুঙ্গ চূড়া—
সৌধাবলি যেথা এ-সব লক্ষণে তোমারই অবিকল তুলনা।

৬৬
হস্তে ধৃত লীলাকমল, কুন্তলে কুন্দকলি বিন্যস্ত,
পাণ্ডুরতা পায় মুখের মধুরিমা লোধকুসুমের রেণুতে,
তরুণ কুরুবকে কবরী ধরে শোভা, শিরীষ দোলে চারু কর্ণে,
এবং তুমি যাকে ফোটাও, সেই নীপে সিঁথির প্রসাধন মেয়েদের।

৬৭
যেথায় তরুগণ নিয়তপুষ্পিত, মুখর উন্মাদ ভোমরায়,
নিত্য পদ্মের বিকাশ নলিনীতে, মরালশ্রেণী তার মেখলা,
ময়ূর নিত্যই কলাপে উজ্জ্বল, এবং কেকারবে উদ্‌গ্রীব,
নিত্য জ্যোৎস্নায় আঁধার কেটে যায়, তাই তো মনোরম সন্ধ্যা ।

৬৮
অন্য হেতু নেই—যেথায় আঁখিজল স্খলিত হয় শুধু পুলকে,
প্রণয়-অভিমান ব্যতীত অন্যত কখনো বিচ্ছেদ ঘটে না,
অন্য তাপ নেই— কেবল কামজ্বর, দয়িত কাছে এলে কেটে যায়,
যেথায় যৌবন ব্যাপ্ত আজীবন, অন্য বয়সের দেখা নেই ।

৬৯
তারার ছায়া দেয় ছড়িয়ে ফুলদল, ধবল মণিময় কুট্টিম,
যেথায় যক্ষেরা মিলিত, মনোমতো রূপসী বনিতার সঙ্গে,
সেবন করে ধীরে কল্পবৃক্ষের প্রসূত রতিফলমদ্য
মৃদু মৃদঙ্গের বাদনে ফোটে যবে তোমারই গম্ভীর মন্ত্র ।

৭০
যেথায় কন্যারা, অমরবাঞ্ছিতা, কনকসৈকতে ছুঁড়ে দেয়
হাতের মুঠো ভ’রে রত্নরাজি, পুন খেলাচ্ছলে করে সন্ধান,
এবং সেবা পায় শীতল অনিলের, মন্দাকিনী-বারি-স্পৃষ্ট,
বারণ করে তাপ ছায়ার বিস্তারে তটজ মন্দারবীথিকা ।

৭১
আকুল প্রণয়ীরা আবেগভরে যেথা উচ্ছ্বসিত হাতে সহসা
নীবির বন্ধন খসিয়ে, ক’রে দেয় ক্ষৌম অংশুক প্রস্ত,
বিম্বাধরাগণ, বিমূঢ় লজ্জায়, তখনই কুঙ্কুমচূর্ণ,
যদিও ছুঁড়ে দেয় দীপ্ত মণিদীপে, বিফল হয় সেই চেষ্টা।

৭২
উচ্চ বিমানের অন্তঃপুরে যেথা তোমারই অনুরূপ মেঘেরা
সংক্রমণে তারা দূষিত ক’রে দিয়ে চিত্রাবলি,
সততগতিশীল বায়ুর চালনায় অবাধে নীত হয় কখনো—
স্বজলকণিকার সংক্রমণে তারা দূষিত ক’রে দিয়ে চিত্রাবলি,
সদ্য শঙ্কায় পলায় বাতায়নে, ধোঁয়ার অনুকারে, শীর্ণ ।

৭৩
তোমার আবরণ কখনো স’রে গেলে, অমল ইন্দুর কিরণে,
বিতানে লম্বিত চন্দ্ৰমণিদাম ক্ষরণ ক’রে জলবিন্দু,
নিশীথে মুছে নেয় সে-সব নায়িকার লব্ধশৃঙ্গার ক্লান্তি,
শিথিল বাহুপাশে যাদের প্রণয়ীরা আলিঙ্গনে হ’লো ভ্ৰষ্ট ।

৭৪
যেথায় যক্ষেরা, যাদের ঘরে আছে ধনের অক্ষয় ভাণ্ডার,
বেড়ায়, বারমুখী বিবুধবনিতার সঙ্গে আলাপনে বদ্ধ,
উদার বৈভ্রাজ-কাননে প্রতিদিন ; এবং সমবেত কিন্নর
উচ্চ, রঞ্জিত কণ্ঠে তুলে তান যশের গাথা গায় ধনপতির ।

৭৫
গতির কম্পনে কবরীপাশ থেকে ভ্রষ্ট মন্দার পুষ্প,
কর্ণবিচ্যুত সোনার শতদল, স্তনের উচ্ছ্বাসে ছিন্ন হার,
মুক্তাজাল, আর খণ্ড পত্রিকা যেথায় সবিতার উদয়ে
সূচনা ক’রে দেয় বিবিধ লক্ষণে নৈশ অভিসার মেয়েদের ।

৭৬
কুবেরসখা শিব স্বয়ং অধিবাসী, এ-কথা জেনে কন্দৰ্প
নেন না ভয়ে ভয়ে প্রায়শ ধনু, যার ছিলায় মধুকর পঙক্তি
করেন তাঁর কাজ চতুর বনিতারা কামুকসন্ধানে নির্ভুল,
অমোঘ বিভ্রমে মিশিয়ে দৃষ্টিতে ভুরুর অপরূপ ভঙ্গি

৭৭
যেথায় ললনার সকল প্রসাধন প্রসব করে এক কল্পতরু
রঙিন বেশবাস, ভূষণ নানামতো, পুষ্পবিকশিত কিশলয়,
অলক্তকরাগ, চরণকমলের প্রান্তে লেপনের যোগ্য,
এমন মধু, যার আদেশে দেখা দেয় নয়নে আবেশের বিভ্রম।

৭৮
দেখবে আমাদের ভবন উত্তরে, যক্ষরাজপুরী ছাড়িয়ে,
চিনবে দূর থেকে ইন্দ্রধনুকের তুল্য মনোরম তোরণে,
প্রান্তে আছে তার আমারই কান্তার পালিত কৃত্রিমপুত্র-
তরুণ মন্দার, স্তবকভারে নত, বাড়ালে হাত তাকে ছোঁয়া যায় ।

৭৯
রয়েছে সরোবর, সোপানদাম তার কঠিন মরকতে রচিত,
কনক-শতদল প্রচুর প্রস্ফুট, মৃণালে জ্বলে বৈদূর্য,
যদিও দূরে নয় মানস, তবু সেই সলিলবাসী সব হংস
তোমার উদয়েও অনুৎকণ্ঠিত, হবে না যাত্রায় তৎপর

৮০
প্রমোদশৈলের ইন্দ্রনীলে গড়া শৃঙ্গ শোভা পায় তীরে তার,
কনককদলীর নিবিড় বেষ্টনে নয়ননন্দন দৃশ্য ;
তুমিও পরিবৃত স্ফুরিত বিদ্যুতে, বন্ধু, তা-ই দেখে দুঃখে—
ঘরনী তাকে ভালোবাসেন ব’লে, আমি স্মরণ করি সেই শৈলে ।

৮১
রেখেছে বেড়া দিয়ে ফুল্ল কুরুবক সেথায় মাধবীর বিতানে,
অদূরে কমনীয় বকুলতরু, আর কম্প্রকিশলয় রক্তাশোক ;
হে মেঘ, সে তোমার সখির বাম পদ আমারই মতো করে অভিলাষ,
অন্য জন তার দোহদ ছল ক’রে চায় যে বদনের মদিরা।

৮২
সে-দুটি বৃক্ষের মধ্যে শোভমান দেখবে কাঞ্চনযষ্টি,
ফলক স্ফটিকের, ভিত্তি মণিময়, তরুণ বেণু যেন বর্ণে,
দিনের অবসানে তোমার প্রিয় সখা ময়ূর এসে বসে সেখানে—
কণিত বলয়ের ললিত করতালে নাচায় তাকে যবে কান্তা ।

৮৩
অবিস্মরণীয় এ-সব লক্ষণ, তোমারই হৃদয়ে যা নিহিত,
এবং দ্বারপাশে শঙ্খপদ্মের চিত্র দেখে তুমি চিনবে –
অধুনা যে-ভবন আমার বিচ্ছেদে মলিন হ’য়ে আছে নিশ্চয়,
কমল কখনো কি আপন রূপ ধরে সূর্য রয় যদি আড়ালে।

৮৪
সহজ প্রবেশের উপায় বলি, শোনো : করভ-রূপ নিয়ে সদ্য
পূর্বকথিত যে-প্রমোদগিরি, তার রম্য সানুদেশে বসবে,
স্বল্পবিলসিত আভাসে নেভে, জ্বলে যেমন জোনাকির পুঞ্জ,
তেমনি বিজলির স্ফুরিত দৃষ্টিতে তাকাবে ভবনের মধ্যে ।

৮৫
তন্বী, শ্যামা, আর সূক্ষ্মদন্তিনী, নিম্ননাভি, ক্ষীণমধ্যা,
জঘন গুরু ব’লে মন্দ লয়ে চলে, চকিত হরিণীর দৃষ্টি,
অধরে রক্তিমা পক্ক বিম্বের, যুগল স্তনভারে ঈষৎ-নতা,
সেথায় আছে সে-ই, বিশ্বস্রষ্টার প্রথম যুবতীর প্রতিমা ।

৮৬
আমি-যে সহচর রয়েছি দূরে, তাই একেলা যেন এক চক্রবাকী,
তুহিনমন্থনে যেমন পদ্মিনী, অন্যরূপা তাকে মনে হয় —
ক্বচিৎ কথা বলে, দীর্ঘ দিনমান কাটায় ঘোর উৎকণ্ঠায়,
মেনেছি, সে আমার দ্বিতীয় প্রাণ ; তাকে, জলদ, তা-ই ব’লে জানবে ।

৮৭
ব্যাকুল, অবিরল রোদনে রঞ্জিত পরিস্ফীত তার চক্ষু,
অধর নয় আর স্বভাবরক্তিম, যেহেতু নিশ্বাস উষ্ণ ;
ন্যস্ত কর আর স্রস্ত কেশদামে স্বল্প-প্রকাশিত প্রিয়ার মুখে
অধুনা মুকুরিত তোমার তাড়নায় পীড়িত ইন্দুর দৈন্য ।

৮৮
বুঝি বা সেক্ষণে পূজায় মনোযোগী—দেখতে পাবে তাকে অচিরে,
অথবা অনুমানে আঁকছে প্রতিকৃতি বিরহে-ক্ষীণতনু আমারই,
শুধায় নতুবা সে—মঞ্জু বাণী যার, পিঞ্জরিতা সেই সারিকায়,
‘সোহাগী তুই তাঁর, স্বামীরে কখনো কি পড়ে না মনে, ওলো রসিকা ?’

৮৯
অঙ্কে নিয়ে বীণা, মলিন বেশবাসে হয়তো গান ধরে কখনো,
আমার নাম দিয়ে রচিত পদে এসে ব্যর্থ হয় সেই বাসনা ;
চোখের জলে ভেজা বীণার তার যদি পারে বা কোনোমতে চালাতে,
অনেক অভ্যাসে স্বকৃত মূর্ছনা তাও সে বার-বার ভুলে যায় ।

৯০
রেখেছে প্রতিদিন ভবন-দেহলিতে একটি ক’রে ফুল সাজিয়ে,
ভূমিতে রেখে তা-ই গণনা করে, আর ক-মাস বাকি আছে বিরহের
কিংবা সে আমার সঙ্গ করে ভোগ, কল্পনায় যার জন্ম—
প্রায়শ এইমতো বিনোদ খুঁজে নেয় রমণবিরহিণী মেয়েরা ।

৯১
ব্যাপৃত দিবাকালে তোমার সখী নয় বিরহভাৱে তত খিন্ন,
দেখবে সাধ্বীরে ভূতলশয্যায়, নিদ্ৰালেশ নেই চক্ষে ;
কিন্তু মানি ভয়, বিনোদব্যতিরেকে দুঃখে ভরা তার যামিনী ;
মহৎ সুখ দিয়ো, সৌধবাতায়নে আমার সমাচার জানিয়ে ।

৯২
বিরহশয্যায় শুয়েছে একপাশে, শীর্ণ তনু মনোকষ্টে,
পূর্বাকাশে যেন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের শেষ কলা উদিত,
আমাকে নিয়ে তার যে-নিশি কেটে গেছে স্বেচ্ছাশৃঙ্গারে ক্ষণিকে,
এখন বিচ্ছেদে দীর্ঘায়িত হ’য়ে অশ্রুজলে হয় অবসান ।

৯৩
এখনো জানালায় শীতল চন্দ্রমা ছড়ায় অমৃতের স্পর্শ,
পূর্বপ্রীতিবশে দৃষ্টি ছোটে তার, কিন্তু ফিরে আসে তখনই,
অশেষ বেদনায় নয়ন ঢেকে যায় অশ্রুভারাতুর পক্ষে
মেঘলা দিনে যেন মলিন কমলিনী, জেগেও নেই, নেই ঘুমিয়ে।

৯৪
শুদ্ধস্নান করে, অলক অতএব রুক্ষ হ’য়ে, বিস্রস্ত,
কপোলে নেমে আসে, তাপিত নিশ্বাসে ক্লিষ্ট অধরের কিশলয় ;
ঘুমেরে সাধে কত, যদি বা অন্তত স্বপ্নে বুকে পায় আমাকে,
অথচ অশ্রুর উৎপীড়নে তার কোথায় তন্দ্রার অবকাশ ।

৯৫
মাল্য ফেলে দিয়ে বেঁধেছে একবেণী বিরহদিবসের প্রথমে,
শাপের অবসানে বিগতশোক আমি ছাড়ায়ে দেবো তার গ্রন্থি,
পরশে কর্কশ কঠিন সেই বেণী গণ্ডদেশ থেকে বার-বার
যে-হাতে ঠেলে দেয়, হেলায় এতকাল কাটে না তার নখপঙক্তি।

৯৬
অসহ বেদনায় কখনো উঠে বসে, এমনি বার-বার শয্যাতলে
ভূষণবর্জিত পেলব তনু তার ন্যস্ত করে সেই অবলা,
নবীন জলময় অশ্রু নিশ্চয় মোচন করাবে সে তোমাকেও,
অন্তরাত্মায় আর্দ্র যারা, প্রায় করুণাশীল তারা সকলেই ।

৯৭
তোমার সখী তার স্নেহের সম্ভার, জেনেছি, আমাকেই দিতে চায়,
তাই তো অনুমান, প্রথম বিচ্ছেদে এমনি শোচনীয় দশা তার;
এ নয় বাচালতা— ‘ভাগ্যবান আমি’ তা ভেবে, অভিমানবশত,
আমার বিবরণ অচিরে অবিকল আপন চোখে, ভাই, দেখবে ।

৯৮
স্রস্ত কুন্তলে রুদ্ধ বিস্তার, স্নিগ্ধকজ্জলশূন্য,
সুরার পরিহারে ভুলেছে ভ্রূবিলাস, এমন বাম আঁখি মৃগাক্ষীর
তোমার আগমনে ঊর্ধ্বকম্পনে যে-শোভা করি তার অনুমান,
তুলনা সে-রূপের ক্ষুব্ধ মৎস্যের আঘাতে চঞ্চল কুবলয় ।

৯৯
গৌর বরনে যে তুলনা আনে মনে সরস কদলীর কাণ্ড,
দৈবে এক্ষণে আমার চিরচেনা মুক্তাজাল যার ত্যাজিত,
আমার নখে আর যে নয় চিহ্নিত, পায় না সম্ভোগ-অন্তে
আমারই হস্তের সংবাহন-সুখ হবে সে-বাম ঊরু স্পন্দমান ।

১০০
যদি বা সেক্ষণে নিদ্রাসুখ তার ভাগ্যে জুটে থাকে দৈবে,
জলদ, গরজনে বিরত, সাবধানে প্রহরকাল থেকো অপেক্ষায় ;
প্রেমিক আমি তার স্বপ্নে কোনোমতে লব্ধ হ’লে পরে, তখনই
কোরো না বিচ্যুত কণ্ঠ হ’তে সেই গাঢ় ভুজলতা-বন্ধন ।

১০১
তোমার জলভারে শীতল পরশন বাতাসে মানিনীরে জাগিয়ে
আনবে তার মুখে মালতীমুকুলের সদ্যবিকশিত আশ্বাস,
লুকোবে বিদ্যুৎ, যখন সে তোমায় দেখবে অনিমেষে জানালায়,
তোমার ধ্বনিরূপ বচনে ধীরে ধীরে বলবে এইমতো বার্তা :

১০২
‘জানবে, অবিধবা, অম্বুবাহ আমি, তোমার ভর্তার বন্ধু,
হৃদয়ে সমাচার বহন ক’রে তার তোমারই সম্মুখে আগত ;
স্নিগ্ধগম্ভীর স্বননে প্রবাসীর ত্বরান্বিত করি যাত্রা,
পথশ্রান্ত যে-পতিরা উৎসুক প্রিয়ার বেণীপাশমোচনে।’

১০৩
যেমন মৈথিলী পবননন্দনে, তেমনি উৎসুক হৃদয়ে
এ-কথা বলা হ’লৈ যোগ্য সম্মানে দেখবে সে তোমাকে, সৌম্য!
শুনবে একমনে যা বলা বাকি আছে, কেননা মিলনের তুলনায়
সুহৃৎ-উপহৃত প্রিয়ের সমাচার অল্প ন্যূন মানে বধূরা ।

১০৪
আমর অনুনয়ে, নিজেরও লাভহেতু, আয়ুষ্মান, তুমি বলবে :
‘তোমার সহচর, যদিও বিরহিত, জীবিত আছে রামগিরিতে।
অবলা, তোমাকে সে কুশল জিজ্ঞাসে ;– প্রথমকৃত্য এ-প্রশ্ন,
কেননা প্রাণীদের জীবন অস্থির, বিপদ ঘটে অতি সহজে।

১০৫
বৈরী বিধি আজ, রয়েছে দূরে তাই, গতির পথ অবরুদ্ধ ;
কেবল মনোরথে তোমার অঙ্গে সে সঞ্চারিত করে অঙ্গ ;–
মিলায় সন্তাপী, দীর্ঘনিশ্বাসী, অশ্রুপুত, ক্ষীণ তনু তার ।
তেমার অতিকৃশ, সাশ্রুনিশ্বাসী, বেদনাতাপময় তনুতে

১০৬
‘যে-কথা বলা যায় সহজে সোচ্চারে তোমার সখীদেরই সমুখে,
তাও যে-লোভাতুর বলতো কানে-কানে আননপরশের লালসায়,
সে আজ, দৃষ্টির বহির্ভূত, আর শ্রবণবিষয়ের অগোচর,
আমার মুখ দিয়ে তোমায় বলে বাণী, রচিত ঘোর উৎকণ্ঠায় ;

১০৭
“দেখি প্রিয়ঙ্গুতে তোমার তনুলতা, বদন বিম্বিত চন্দ্ৰ,
ময়ূরপুচ্ছের পুঞ্জে কেশভার, চকিত হরিণীতে ঈক্ষণ,
শীর্ণ তটিনীর ঢেউয়ের ভঙ্গিতে তোমার বঙ্কিম ভ্রূবিলাস—
কিন্তু, হায়, নেই তোমার উপমান কোথাও একযোগে, চণ্ডী!

১০৮
“অধুনা সে-পটে ধাতুরাগে শিলায় আঁকি আমি প্রণয়কোপবতী-তোমাকে,
আপনাকে লোটাতে চাই যদি তোমার চরণের প্রান্তে,
তখনই অশ্রুর প্লাবনে বার-বার লুপ্ত হ’য়ে যায় দৃষ্টি
নিয়তি নির্দয়, চিত্রফলকেও মিলন আমাদের সহে না ।

১০৯
“স্বপ্নে কোনোমতে তোমায় কাছে পেয়ে নিবিড় আশ্লেষে ব্যাগ্র
আমার প্রসারিত বাহুর বিক্ষেপ ব্যর্থ হয় যবে শূন্যে,
তা, দেখে মনে জানি, বনের দেবগণ মুহুর্মুহু তরুপত্রে
করেন বর্ষণ অশ্রুবিন্দু, যা আকারে মুক্তার অনুরূপ ৷

১১০
গুণবতী, শোনো, যে-বায়ু দক্ষিণে তুষারগিরি হ’তে বহমান
সদ্য দেওদারে দীর্ণ কিশলয়ে গন্ধনিস্রাব ঝরিয়ে
“হে তোমার সুকুমার অঙ্গ বুঝি বা সে পরশ করেছিলো পূর্বে
আমি সে-তনুহীন সুরভি বাতাসেরে আলিঙ্গনে বাঁধি অতএব ।

১১১
“কেমনে ক্ষণিকের তুল্য ক’রে আনি দীর্ঘযামা এই ত্রিযামায়,
এবং দিনমান সর্বকালে হবে স্বল্পতাপ কোন উপায়ে—
এ-সব দুর্লভ বাসনা যত ভাবি হৃদয় তত ছায় দুঃখে,
তোমার বিচ্ছেদব্যথায় নেই কোনো শরণ, হে চটুলনয়না !

১১২
“অনেক ভেবে আমি আপন চেষ্টায় ধারণ ক’রে আছি নিজেকে,
তুমিও, কল্যাণী, পরম হতাশায় হোয়ো না অসহায় মগ্ন ;
এমন কে বা আছে, নিত্য দুঃখ বা নিয়ত সুখ জোটে ভাগ্যে,
কখনো উত্থান, কখনো অবনতি, চক্রনেমি যেন মানবদশা।

১১৩
“রয়েছে চার মাস, যাপন করো তুমি ধৈর্যে, নিমীলিত নয়নে,
বিষ্ণু উঠবেন শয্যা ছেড়ে তাঁর, আমার হবে শাপমুক্তি ;
তখন পরিণত শরৎ-জ্যোৎস্নায় মিলনপুলকিত রাত্রে
পূর্ণ হবে সব, বিরহসঞ্চিত যা-কিছু আমাদের অভিলাষ।”

১১৪
‘আরেক কথা শোনো, যক্ষ জানিয়েছে : ‘একদা ছিলে যবে সুপ্ত
আমারই গলা ধ’রে যুগলশয্যায়, হঠাৎ কেঁদে উঠে জাগলে ;
আমার বহুবিধ প্রশ্ন শুনে পরে বললে মৃদু হেসে— ধূর্ত !
স্বপ্নে দেখি তুমি রমণে উপগত অন্য কোন এক নায়িকায় ।

১১৫
“দিলাম পরিচয়চিহ্ন, অতএব জানবে আমি আছি কুশলে,
তোমার কালো চোখে লোকের কথা শুনে না যেন দেখা দেয় অবিশ্বাস ;
বিরহে প্রণয়ের ধ্বংস হয় নাকি, কিন্তু অভাবের প্রভাবে
আমার মনে হয় স্নেহের উপচয় মহৎ প্রেমে পায় পরিণাম।”

১১৬
সখীরে দেবে তুমি এ-মতো আশ্বাস, প্রথম বিরহে সে আর্তা,
ত্বরায় ফিরে এসো সে-গিরি থেকে, যার শৃঙ্গ হরবৃষখনিত;
পাঠাবে প্রিয়া তার কুশল-সমাচার, এনো অভিজ্ঞান সঙ্গে
প্রভাতকুন্দের মতোই স্খলমান আমার জীবনেও রক্ষা করো।

১১৭
সৌম্য, হবে তুমি আমার বান্ধব ? আছো কি সম্মত কার্যে ?
নিরুত্তর যদি, তবুও সংশয় করি না আপনার সাধুতায় ;
যাচিত হ’লে পরে তুমি যে দাও জল চাতকদলে নিঃশব্দে—
কেননা প্রার্থীর বাঞ্ছাপূরণেই মহজন দেন উত্তর ।

১১৮
বিধুর আমি, তাই, অথবা করুণায়, কিংবা বন্ধুতাসূত্রে,
জলদ, করো তুমি আমার প্রিয় কাজ, মিটাও অনুচিত যাচনা ;
প্রাবৃটে দেশে-দেশে ঋদ্ধিশালী হ’য়ে বিহার কোরো তুমি তারপর
কখনো না ঘটুক তোমার বিদ্যুৎ-প্রিয়ার ক্ষণেকের বিচ্ছেদ।

 

চিত্র যক্ষী টর্সো সাঁচী খ্রি-পূ প্রথম শতক

এ-যাবৎ আবিষ্কৃত যেগুলি প্রথমতম নারী বা দেবীমূর্তি, সেগুলি উর্বরতা ও প্রজননশক্তিরই দৃশ্যরূপ মাত্র। প্রাগৈতিহাসিক য়োরোপে (আ থ্রি-পৃ ২০,০০০) যে-সব নারীমূর্তি রচিত হয় (AIA. ১ম খণ্ড, চিত্র A৯ এ, বি, সি), সন্তানধারণের পরাক্রান্ত যন্ত্র ছাড়া তাদের আর-কিছু ব’লে ভাবা যায় না ; তাদের উদর, শ্রোণী ও স্তনযুগ বিরাট, মুণ্ড ক্ষুদ্র অথবা বিকৃত, নাক চোখ বা মুখ নেই । এই শক্তিরূপিণী আদিমাতাকে মানবজাতি ভুলতে পারে না ; সম্প্রতি পিকাসো যদি তাকে ফিরিয়ে নাও আনতেন, তবু বহু ঐতিহাসিক যুগ ধ’রে নারীমূর্তির বিবর্তনে আমরা তার প্রতিপত্তি দেখতে পেতাম। আফ্রিকার শিল্পে তার রাজত্ব ; মোহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার (আ খ্রি-পূ ৩০০০-১৫০০) নিদর্শনসমূহে তার নিশেন উড়ছে। (দেহকে সম্পূর্ণ বর্জন ক’রে শুধু লিঙ্গ ও যোনি- গহ্বরের প্রতীকরচনা মোহেঞ্জোদারোরই কর্ম।) ভাবতে অবাক লাগে, নারীকে তার প্রজননধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে নিতে কত দেরি হয়েছে মানুষের, কী সুদীর্ঘ কাল কেটে গেছে ‘সৌন্দর্য’কে আবিষ্কার করতে। এই যক্ষীমূর্তি সভ্য মানুষের সৃষ্টি, তার আত্মা আছে ; তার ঊর্ধ্বাঙ্গ (হয়তো বাহু ও স্তনযুগ ভগ্ন হয়েছে ব’লেই) আমাদের মনে সুন্দর ব’লৈ প্ৰতিভাত হয়, তবু তার অতিপীন ঊরুদ্বয়ে আদিমাতার স্মৃতিরেখা এখনো সুস্পষ্ট ।

 

চিত্র মারকন্যা : অজন্তা ; আ ৬০০ খ্রি

এই চিত্র যত উৎকৃষ্ট ততোধিক ভাগ্যবান ; ওঅল্টর পেটার একটি অবিস্মরণীয় অনুচ্ছেদে একে মহিমান্বিত করেছেন, এবং রাইনের মারিয়া রিলকে-র ‘ভেনাসের জন্ম’ কবিতা প’ড়েও (দুয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট ব্যবধান সত্ত্বেও ) এই চিত্র দুর্বারভাবে আমাদের মনে পড়ে । এর প্রধান লক্ষণীয় বস্তু এর মুখশ্রী, যা সুন্দর ও বিষাদময়, এবং বিষাদময় ব’লেই সুন্দর। পাশ্চাত্ত্য দৃশ্যশিল্পে এই প্রথম আমরা মুখশ্রী-মায়ার সম্মুখীন হলাম ; গ্রীক শিল্পের মুখাবয়বে নিখুঁত প্রত্যঙ্গবিন্যাস আছে, তার বেশি আর-কিছু নেই। বত্তিচেল্লির ভেনাসের দৃষ্টি সুদূরে প্রসারিত, ‘অনাগত সুদীর্ঘ প্রেমের দিবসের দিকে’, কিন্তু তাঁর গ্রীক ও রোমক প্রতিযোগীদের চোখ উপস্থিত মুহূর্তের চেতনাটুকুতেই সীমাবদ্ধ !

 

চিত্র কুবের যক্ষ : ভাহুৎ স্তূপ; খ্রি-পূ প্রথম শতক


‘দি ন্যুড’ গ্রন্থে স্যর কেনেথ ক্লার্ক এই চিত্রের উপর গ্রীক প্রভাবের উল্লেখ করেছেন, শুধু চাক্ষুষ নয়, সাহিত্যিক প্রভাব। অজ্ঞাতনামা কবির (বা কবিদের) যে-সব রচনা হোমরীয় স্তোত্র নামে পরিচিত, তার একটিতে বর্ণনা আছে কেমন ক’রে আফ্রোদিতে সমুদ্র থেকে উঠলেন ; সেই কবিতার একটি ইতালীয় অনুকরণ এই চিত্রের উৎসস্থল ব’লে কথিত আছে। আমরা লক্ষ করি, দেবী এখানে সম্পূর্ণ নিরাভরণ ও নিরাবরণ, কিন্তু হেলেনিস্টিক প্রথা অনুসারে তার যোনিদেশ লুক্কায়িত— এবং এখানে বত্তিচেল্লির সঙ্গে রিলকের মস্ত বড়ো প্রভেদ ধরা পড়ে।

এখানে উল্লেখ্য, একটি হোমরীয় স্তোত্রেই দেবীকে সালংকারা ও রশ্মিবসনা ব’লে বর্ননা করা হয়েছে : তাতেও বোঝা যায় আদি গ্রীক শিল্প ভূষণবিমুখ ছিলো না। (‘Hymn to Aphrodite’, The Homeric Hymns এর ষষ্ঠ কবিতা, লোয়েব সংস্করণে ঈভলিন হোয়াইট-কৃত ইংরেজি অনুবাদ দ্র)।

‘এই শ্লোকে নারীসৌন্দর্যের যে-আদর্শ বিধৃত হয়েছে, অজন্তার মারকন্যার সঙ্গে তার সাদৃশ্য সুস্পষ্ট।’ (টী উ ৮৫) এই মন্তব্যের সঙ্গে এখানে কিছু যোগ করা প্রয়োজন। পীন, বর্তুল ও পরস্পর-সংশ্লিষ্ট স্তন, ক্ষীণ কটি, গভীর নাভি, বিশাল ঊরু ও জঘন প্রাচীন হিন্দুমানসে রমণীরূপের সর্বসম্মত লক্ষণ হ’লো এই । এর সবগুলি লক্ষণ মারকন্যায় দ্রষ্টব্য নয় ; বরং চিত্র ২-কে কল্পণায় পূর্ণ করে নিলে বেশি সাদৃশ্য পাওয়া যায়, এবং কালীর (খ্রি-প ২য় শতক) একটি দ্বারপাল মূর্তিতে (AIA, ২য় খণ্ড, চিত্র ৮১) এই লক্ষণসমূহের অবিকল আলেখ্য আছে। মারকন্যার দেহের গঠন কৃশতার দিকে, অথচ তার কটি ক্ষীণ নয় ; তার নাভি অদৃশ্য, এবং আবৃত নিম্নাঙ্গে ঊরু বা জঘনের বিন্দুমাত্র স্ফীতি নেই। চিত্র ২, ৬, ১৫ বা ১৬-র তুলনায় তার দেহ অনেকটা এক ছন্দে গঠিত (তার বক্ষোদেশ ও কটির প্রসর সমান ব’লে মনে হয়) ; কিন্তু তার ভঙ্গিতে এমন একটি আশ্চর্য ভঙ্গুর নমনীয়তা আছে যে মনে হয় মৃদুতম স্পর্শেও সে ভূমিতে লুণ্ঠিত হবে। সবচেয়ে আশ্চর্য ও মোহময় তার অর্ধনিমীলিত চোখের দৃষ্টি : সে যেন কিছুই দেখছে না, বিন্দুমাত্র আত্মচেতনা তার নেই, যেন স্বপ্নের ঘোরে তাকিয়ে আছে সে, আর আমরাও স্বপ্নের মধ্য দিয়ে তাকে দেখছি। যে-পেলব, স্বপ্নিল, অর্ধ- ঘুমন্ত আবহ তাকে ঘিরে আছে, তারই জন্য যক্ষপ্রিয়ার প্রতিরূপ ব’লে মনে হয় তাকে অন্তত আমরা এমনি ভাবেই যক্ষপ্রিয়াকে ভাবতে ভালোবাসি ৷ আবয়বিক সাদৃশ্য না-থাকলেও এই দুই সৃষ্টিতে ভাবের দিক থেকে মিল আছে।
মারকন্যার সব উন্মাদনা তার চোখে ও দেহের ভঙ্গিতে, তার মুখশ্রী সুন্দর নয়। চিত্র ৫-৬-এ যে-ক’টি মুখ দেখা যাচ্ছে তার একটিকেও রমণীয় বলা যায় না। এ- প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই যে আধুনিক যুগের জড়বাদী ব’লে যে-নিন্দা প্রচলিত আছে, সেটা কুসংস্কার ; আসলে আধুনিক কালই আধ্যাত্মিক, সুন্দর মুখ আধুনিক কালেরই আবিষ্কার। যেমন গ্রীসে, তেমনি প্রাচীন ভারতে, প্রধান ভাবনা ছিলো দেহ নিয়ে ; গ্রীস ছিলো ব্যায়ামবীরের উপাসক, এবং কালিদাসের সুপ্রচুর ও সমুচ্ছল দেহবর্ণনায় মুখের উল্লেখ নেই । নাক, চোখ, ঠোঁট ইত্যাদির বহু প্রথাসিদ্ধ বিশেষণ আছে; কিন্তু সমগ্রভাবে মুখশ্রীর যে-আবেদন, যার প্রভাবে ব্যক্তিত্ব নামক বস্তুটিকে আমরা চিনতে পারি, সে- বিষয়ে প্রাচীন সাহিত্য সর্বত্র সমভাবে নিশ্চেতন।
গ্রীক শিল্প আদ্যন্ত প্রকৃতিপন্থী ; অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুষম সমন্বয়কে সে সুন্দর ব’লে ভুল করেছিলো। একটি মূর্তির জন্য প্রাক্সিতেলেস বহু মডেল ব্যবহার করতেন ; কারো কপোল, কারো চিবুক, কারো কটি, কারো ঊরু ও কারো বা জঙ্ঘা নিয়ে রচনা করতেন তিলোত্তমাকে। ফলত, মূর্তিটি হ’তো আলিঙ্গনযোগ্য কামোদ্দীপক, বাস্তব অর্থে কাঙ্ক্ষণীয়— অর্থাৎ, জীবনের সঙ্গে যে-ব্যবধান সার্থক শিল্পের নিশ্চিত লক্ষণ ব’লে আমাদের মনে হয়, তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ক’রেই গ্রীক শিল্প সম্ভব হ’তে পেরেছে।…..

Please follow and like us: