সূর্য – ডি. এইচ. লরেন্স

›› অনুবাদ  ›› সম্পুর্ণ গল্প  

ডাক্তার বলল, তাকে সূর্যের আলোয় সরিয়ে নিয়ে যাও।
সূর্যের আলোয় তার খুব একটা বিশ্বাস ছিল না। তবু তাকে যখন সমুদ্রের ধারে তার শিশুসন্তান, ধাত্রী ও মাতাসহ সূর্যালোকিত এক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সে তখন বাধা দিল না।
জাহাজ ছাড়ল মধ্যরাত্রিতে। শিশুকে বিছানায় শোয়ানো হলে তার স্বামী দু’ঘন্টা তার কাছেই রইল। সেদিন রাত্রিটা ছিল ঘন অন্ধকার। একঝাঁক কম্পিত আলোর ছটা ফেলে এক বিশাল গ্রহপুঞ্জের মত অন্ধকার সমুদ্রের উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল হাডসন জাহাজটা।
রেলিং-এর উপর ঝুঁকে নিচে জলের দিকে তাকিয়ে ভাবল সে, এই সমুদ্র এত গভীর যে তা কল্পনা করা যায় না। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই সমুদ্রের সঙ্গে। এখন সমুদ্রের ঢেউগুলোকে অসংখ্য কালো কালো সাপের মত দেখাচ্ছিল। তার স্বামী তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, এই ধরনের বিচ্ছেদ কখনো ভাল হতে পারে না। আমি তা চাই না।
তার মনে পড়ল তারা দুজনেই বিচ্ছেদ চেয়েছিল একদিন। এই কথাটা মনে পড়তেই তার আবেগে কিছুটা টান পড়ল। কিন্তু তার লৌহকঠিন মনটা শক্ত হয়ে উঠল আবার।
তারা দুজনেই তাদের ঘুমন্ত শিশুর পানে তাকাল। পিতার চোখদুটো সিক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু তারা বুঝতে পারল তাদের দুজনের মধ্যে পরস্পর-বিরুদ্ধ দুটো শক্তি কাজ করে এসেছে এতদিন। যেন দুটি এঞ্জিন ভিন্ন দুটি দিকে গিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাদের দুটো অন্তরকে।
এমন সময় যাত্রীরা সবাই টীৎকার করে উঠল, উপকূল এসে গেছে। এবার নামতে হবে।
সে তখন মনে মনে বলল, তার যাত্রা এখানেই শেষ, কিন্তু আমাকে এখনো সমুদ্রেই ভেসে চলতে হবে।
আলো জ্বালা কতকগুলো ফেরী নৌকো এসে হাডসন জাহাজের কাছে লাগল । লাকাওয়ালা স্টেশান এসে গেছে।
জাহাজ আবার এগিয়ে চলল। সারারাত যাওয়ার পর সকাল হতে ইতালির এক উপকূলে এসে জাহাজ ভিডল। আবার সূর্যের মুখোমুখি হলো সে। নীল সমুদ্রের পারে বড় বাগানওয়ালা তাদের বাড়িতে এসে উঠল।
বাড়িটা দেখে তার ভাল লাগলেও তার অন্তরের অশান্তি আর বিক্ষোভকে দমন করতে পারছিল না সে। এই আনন্দময় পরিবেশ থেকে কোন আনন্দই অনুভব বা উপভোগ করতে পারছিল না সে। বিশেষ করে তার সন্তানের জন্য রাগ হচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল এই সন্তানই তার মনের শান্তিকে কুরে কুরে খাক করে দিচ্ছে। তার প্রতি দায়িত্বটা কত ভয়ঙ্কর। তার মনে হলো তার প্রতিটি নিঃশ্বাসের জন্য সে দায়ী। একদিন তাব মা বলত, তুমি জানো জুলিয়েত, ডাক্তার তোমাকে রোদে বিবস্ত্ৰ অবস্থায় শুয়ে থাকতে বলেছে। কিন্তু তুমি যাও না কেন?
আমি যখন পারব যাব। তুমি আমাকে মেরে ফেলতে চাও না নিশ্চয়
মা বলল, তোমাকে মেরে ফেলতে চাই না, তোমার ভাল করতে চাই।
এই বলে মা চলে গেল ।
তারপর দিনকতক বৃষ্টি বাদলে কেটে গেল। সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছিল না । তারপর আবার সূর্য উঠল আকাশে। নগ্ন নবীন সূর্যের আলো ঝলমল করতে লাগল সমুদ্রের বুকে। তাদের বাড়িটা ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। জুলিয়েত সেদিন সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়েই সূর্যোদয় দেখল। জীবনে যেন এই প্রথম সূর্য ওঠা দেখছে সে। সমুদ্র-রেখাঙ্কিত দিগন্তের উপর সূর্যকে এমন করে নগ্ন ঋজু হয়ে দাঁড়াতে দেখেনি কখনো।
এবার সমুদ্রের ধারে গিয়ে সূর্যের রোদে নগ্ন হয়ে গা ডুবিয়ে শুয়ে এক গোপন বাসনা জাগল তার মনে। আসলে সে চাইছিল চিরদিনের এই বাড়ি ছেড়ে মানব সমাজ থেকে দূরে যেতে। কিন্তু এখানে তা সম্ভব নয়, কারণ এখানে প্রতিটি অলিভ গাছেরও চোখ আছে।
অবশেষে একটা জায়গা খুঁজে পেল সে। জায়গাটা সমুদ্রের ধারে। তিন-দিকে পাথর আর ক্যাকটাসের ঝোপ দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে মোটা গুঁড়িওয়ালা একটা সাইপ্রেস গাছ। সমুদ্রের দিকটা একেবারে খোলা ।
সাইপ্রেস গাছের পাশে বসে একে একে তার পোশাকগুলো খুলে ফেলল জুলিয়েত। ক্যাকটাসকে লোকে কাঁটাওয়ালা ভালুক বললেও তার ঝোপটাকে ভাল লাগছিল তার।
সূর্য তখন নীল আকাশে কিরণ দিচ্ছিল। প্রথমে তার অনাবৃত বুকের উপর সমুদ্রের মৃদুমন্দ বাতাসের স্পর্শটা অনুভব করছিল সে। কিন্তু সূর্যের উত্তাপটা সে অনুভব করছিল না।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সে তার সারাদেহের মধ্যে সূর্যের উত্তাপটা অনুভব করল। সে উত্তাপ যে কোন প্রেম, তার স্তনদুগ্ধ ও শিশুসন্তানের হাতের উত্তাপের থেকে বেশী।
সব পোশাক খুলে নগ্নদেহে রোদে শুয়ে পড়ল জুলিয়েত। চিৎ হয়ে শুয়ে সূর্যের দিকে একবার তাকাল। দেখল সূর্যের ভিতরটা নীল আর গোলাকার। তার চারদিক হতে কিরণ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সূর্য নীল আগুনভরা দৃষ্টি দিয়ে তার, বুক, মুখ, তার গলা, তার জানু, জঙ্ঘা, পেট, পা সব বিদ্ধ করছে।
চোখদুটো বন্ধ করে শুয়ে ছিল সে। তার চোখের পাতার উপর একটা গোলাপী আভা ছড়িয়ে পড়েছিল। একটা গাছের পাতা কুড়িয়ে মুখের উপর চাপা দিল। তার মনে হলো সূর্যের আলোটা তার দেহগাত্র ভেদ করে অস্থি-মজ্জার গভীরে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। এমন কি তার চিন্তা ও আবেগানুভূতির গভীরেও প্রবেশ করেছে। তার আবেগানুভূতির বিভিন্ন কোণ থেকে সব অন্ধকার দূর হয়ে গেল একে একে। তার চিন্তার সব জটগুলো খুলে যেতে লাগল আপনা থেকে। তার হিমশীতল বরফের মত কঠিন অন্তরটা গলে যেতে লাগল। এইভাবে সূর্যের মধুর উত্তাপটা সৰ্বদেহে ও মনে অনুভব করল সে। সে নিজের দেহটাকে উল্টে পাল্টে সে উত্তাপটা গ্রহণ করতে লাগল নিবিড়ভাবে।
এবার সে উঠে পোশাক পরে উপরে তাকিয়ে দেখল সূর্য আকাশের উপরে অনেকটা উঠে গেছে। সাইপ্রেস গাছের পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে।
বাড়িতে গিয়ে তার মনে হলো চোখে যেন অন্ধকার দেখছে সব কিছু। তার অর্ধেকটা চেতনাও যেন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তার মনে হলো তার চোখের এই অন্ধকার, তার চেতনার অর্থ-বিলুপ্তিই এক পরম ঐশ্বর্য এবং সম্পদ তার কাছে। তাকে দেখেই তার শিশুপুত্র ‘মা’ ‘মা’ বলে ছুটে এল তার কাছে। ছেলেকে কোলের উপর তুলে নিল সে। তারপর ভাবল এও যদি আমার মত প্রাণভরে সূর্যস্নান করত তাহলে এমন একতাল মাংসের মত হত না। সে লাফাত।
ছেলেটা তার গলাটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু তার ভাল লাগছিল না। সে আস্তে আস্তে ছেলেটাকে নামিয়ে দিল কোল থেকে। বলল, যাও, রোদে ছুটে বেড়াওগে। রোদে খেলা করগে।
ছেলেটার মনে অভিমান জমে উঠেছিল। তার কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু জুলিয়েত তার সামনে একটা কমলালেবু গড়িয়ে দিয়ে খেলা করতে লাগল তার
সঙ্গে।
সূর্যের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হওয়ার ফলে এক বিরাট পরিবর্তন এল জুলিয়েতের জীবনে। ছেলের প্রতি যে দায়িত্ববোধ এক তীব্র উদ্বেগ হয়ে অনবরত পীড়িত করে তুলত তার মনটাকে সে বোধটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল সে। ছেলেটার প্রতি কোন আগ্রহ বা উদ্বেগ কিছুই রইল না যেন। সে শুধু ভাবত সূর্যের কথা। সূর্যের সকল উত্তাপ সকল ঐশ্বর্য সে তার দেহ মনের গভীরে চেতনার সমস্ত নিবিড়তা দিয়ে শোষণ করে নিতে চায় সে।
সকালে সূর্য ওঠার অনেক আগেই জেগে ওঠে সে। তখন আকাশের কোলে কিছু মেঘের চাপ থাকে। গলন্ত সোনার মত সূর্য যখন এক নিরাবরণ নগ্নতায় আকাশে প্রথম ওঠে তখন সে সূর্য বড় লাজুক, বড় কুণ্ঠিত তার পদক্ষেপ। ক্রমে এই সূর্যের দৃষ্টি কেমন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। তারপর সে যতই আকাশের উপর উঠে যেতে থাকে ততই সমগ্র আকাশ ও পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তার উত্তপ্ত প্রতাপের অসহনীয় তীব্রতা।
একমাত্র বৃষ্টির দিন ছাড়া প্রতিদিন সমুদ্রের ধারে সেই সাইপ্রেস গাছের কাছটায় চলে যায় সে। এখন সে আর বেশী পোশাক পরে যায় না। তার পরনে থাকে একটা স্কার্ট, গায়ে একটা ধূসর রঙের চাদর আর পায়ে একজোড়া চটি। ক্যাকটাস ঝোপে ঘেরা সেই নির্জন জায়গাটায় গিয়েই গা থেকে সবকিছু খুলে নগ্ন হয়ে পড়ে সে। নিজেকে সূর্যের অপ্রতিরোধ্য প্রতাপ আর পৌরুষের কাছে একবারে নগ্ন করে দিয়ে সকাল থেকে প্রায় দুপুর পর্যন্ত শুয়ে থাকে।
তার মনে হয় যে সূর্য তারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষকে কিরণ দেয় সেই সূর্য তার মত একটি নারীকেও কিরণদানে ধন্য করতে পারে। সে যেমন সূর্যের গতি- প্রকৃতি সব কিছু জানে, সূর্যও তেমনি তার সব কিছু জানে। তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তার মনের প্রতিটি দিক দিগন্ত এক দ্বিধাহীন নগ্নতায় অনাবৃত তার কাছে।
এই ভাবে সূর্যের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা নিবিড় হয়ে উঠতে থাকে ততই মানুষের সমাজ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে সে মনে মনে। কোন মানুষের সঙ্গ বা সাহচর্যই ভাল লাগে না তার।
একদিন সে তার ঝি মেরিয়ানাকে বলল, ডাক্তার সূর্যস্নান করতে বলছে। এটাই যথেষ্ট। আর কোন ওষুধ লাগবে না আমার ।
মেরিয়ানার বয়স ষাটের উপর। লম্বা খাঁড়া চেহারা। জীবনে তার অভিজ্ঞতা অনেক। সে বলল, কিন্তু বেশী রোদ লাগলে গায়ের রূপ যে নষ্ট হয়ে যাবে। শেষে যেন সূর্যকে দোষ দিও না ।
জুলিয়েত কিছু না বলে শুধু মনে মনে ভাবল, সে রূপসী কিনা তা জানে না, তার দেহে রূপসৌন্দর্য বলে যদি কিছু থাকে ত একমাত্র সূর্যের কাছেই তা পাবে উপযুক্ত সমাদর।
এক একদিন সূর্যস্নান শেষ করে পাহাড়ের ধারে লেবুগাছের ছায়াতলে একটা জলাশয়ের পাশে বেড়াত জুলিয়েত। একদিন সে তার ছেলেটাকেও নিয়ে গেল। তোকেও একবারে নগ্ন করে সূর্যস্নান করাল। তারপর ছেলেটা ছুটে ছুটে খেলা করে বেড়াতে লাগল। জুলিয়েত বলল, দেখো যেন কাঁটা না লাগে।
সেবার ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে দারুণ গরম পড়ল। সামান্য বাতাস লাগতেই বাদামের কুঁড়িগুলো গোলাপী তুষারকনার মত ঝরে পড়তে লাগল গাছ থেকে। জুলিয়েত কিন্তু যথারীতি ছেলেকে নিয়ে সূর্যস্নানে যেতে লাগল সমুদ্রের ধারে সেই সাইপ্রেস গাছটার তলায়। এক একদিন সমুদ্রেও স্নান করত সে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাটাত সে সেখানে। ছেলেটা সর্বক্ষণ ছোটাছুটি করে খেলে বেড়াত। লেবু ফুল তুলত।
একদিন ছেলেটা তার মাকে ডেকে বলল, দেখ মা, একটা সাপ। জুলিয়েত গিয়ে দেখল পাথরের ধারে সত্যিই একটা সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গায় বিরক্ত হয়ে সে পাথরের পাশ দিয়ে একটা গর্তের ভিতর চলে গেল।
আর একদিন জুলিয়েত একটা কালো সাপ দেখে। সে বাড়িতে গিয়ে মেরিয়ানাকে জিজ্ঞাসা করে, কালো সাপ কামড়ায়?
মেরিয়ানা বলল, কালো সাপের বিষ নেই। কিন্তু হলদে সাপে কামড়ালে মানুষ বাঁচে না।
মার্চ মাসে সূর্যের রোদ আরো প্রখর হয়ে উঠল। কিন্তু সেই প্রখর রোদেও বেশ কিছুক্ষণ সেইখানে শুয়ে থাকত জুলিয়েত। তারপর সে চলে যেত লেবু গাছের শীতল ছায়াভরা কুঞ্জবনে। ছেলেটা প্রাণোচ্ছল এক জন্তুর মত ছুটে বেড়াত কিছু দূরে।
একদিন জুলিয়েত একটা জলাশয়ে স্নান করার পর সমুদ্রের ধারে ঢালু কিনারাটায় বসেছিল। এমন সময় মেরিয়ানা একটা কালো কাপড় মাথায় বেঁধে ছুটতে ছুটতে এসে তাকে ডাকল, সিনোরা জুলিয়েত্তে !
জুলিয়েত উঠে ঘুরে দাঁড়াল। তার অনাবৃত দেহ দেখে মেরিয়ানা কিছুক্ষণের জন্য থামল। তার রোদেপোড়া সুন্দর সোনালী চুলের গোছাগুলো পিঠের উপর ছড়িয়েছিল। সত্যিই আগের থেকে জুলিয়েত যেন অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছে। সে যেন হয়ে উঠেছে এক নতুন মানুষ।
মেরিয়ানা তার কাছে সরে গিয়ে বলল, সত্যিই কত সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে। তোমার স্বামী এসে গেছে।
আমার স্বামী! বিস্ময়ে চমকে উঠে জুলিয়েত।
তোমার স্বামী নেই!
কোথায় সে?
মেরিয়ানা তার পিছনে কিছুদূরে হাত বাড়িয়ে দেখাল। এখানে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
মেরিয়ানার দিকে তাকিয়ে জুলিয়েত বলল, ঠিক আছে। তাকে আসতে বল। একটুখানি বিদ্রূপাত্মক হাসি হেসে মেরিয়ানা বলল, এখানে আসতে বলব? ঠিক আছে, তুমি যা চাও।
ছেলেটা তখন গাছ থেকে একরাশ লেবু ফুল পেড়ে তার বুকের উপর একটা হাত দিয়ে আটকে রেখে ছিল। মেরিয়ানা হাসিমুখে ছেলেটাকে বলল, দেখ দেখ, ছেলেটাকে কত সুন্দর দেখাচ্ছে। ওর বাবা দেখে খুব আনন্দ পাবে।
জুলিয়েত বলল, ওকে নিয়ে এস এখানে।
ওদিকে ধূসর রঙের একটা টুপি আর ধূসর রঙের পোশাক পরে আঙ্গুর ক্ষেতের কাছে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মরিস। সত্যিই পথ খুঁজে পাচ্ছিল না।
মেরিয়ানা তাকে ডাকল, এখানে চলে এস। এই নিচু জায়গাটায় ও আছে। ঘাসে ঢাকা একটা উঁচু জায়গায় উঠে মেরিয়ানা মরিসকে বলল, এবার নেমে ঐখানে যাও ।
সেখান থেকে চলে গেল মেরিয়ানা। তাকে ধন্যবাদ দিল মরিস ।
জুলিয়েত একটা বড় পাথরের আড়ালে নগ্ন দেহে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মরিস প্রথমে তাকে দেখতে পায়নি। সে জুলিয়েতের অনাবৃত দেহটা দেখেই লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর ভয়ে ভয়ে ডাকল, জুলি, জুলি ! চমৎকার!
মরিস জুলিয়েতের অনাবৃত দেহটার দিকে সলজ্জভাবে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে এল। তার মনে হলো জুলিয়েতের দেহটা অনাবৃত থাকলেও তার সোনালী গোলাপী চামড়ার আবরণ তার দেহটাকে ঢেকে রেখেছে।
জুলিয়েত বলল, হ্যালো মরিস, আমি তোমাকে এত তাড়াতাড়ি আশা করিনি। না, আমি কাজটা সেরে একটু তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে মরিস কাশতে লগল। বলল, চমৎকাব লাগছে তোমায় । ছেলেটা কোথায়?
জুলিয়েত লেবু গাছের গভীর ছায়াভরা কুঞ্জবনের দিকে একটি নগ্ন ছেলের পানে তাকিয়ে বলল, ঐ দেখ ওখানে।
মরিস বলল, খুব ভাল। চমৎকার হয়েছে ছেলেটা। হ্যালো জনি !
ছেলেটা লেবু ফুলগুলো আঁকড়ে ধরে তাকাল একবার। জুলিযেত বলল, চল, আমরা ওর কাছে যাই ।
মরিস তার স্ত্রীর সঙ্গে ছেলেটার কাছে গিয়ে বলল, হ্যালো জনি, তোমার বাবাকে চিনতে পারছ?
জনি এসে তার বাবার হাত ধরে বলল লেবু, দুটো লেমন।
তার বাবা বলল, অনেক অনেক লেবু।
জনি তার বাবার দুটো হাতে দুটো ফুল গুঁজে দিল। তারপর বলল, বাবা আবার চলে যাবে?
মরিস বলল, হ্যাঁ যাব, কিন্তু আজ নয়।
ছেলেকে কোলে তুলে নিল মরিস। জনি বলল, বাবা, তোমার কোটটা খুলে ফেল।
মরিস তার কোটটা খুলে নিচে নামিয়ে রাখল। তারপর ছেলেকে কোলে তুলে নিল। জামাপরা এক শহুরে ভদ্রলোক উলঙ্গ একটি শিশুকে কোলে তুলে নিল, নিজে নগ্নদেহে দাঁড়িয়ে তা দেখল জুলিয়েত। জনি তার বাবার টুপিটা খুলে ফেলল। জুলিয়েও দেখল মরিসের মাথার ধূসর-কালো চুলগুলো ঠিক বিন্যস্ত আছে।
জনি তার বাবাকে ভালবাসে বলে অনেকক্ষণ চেপে রইল তার কোলে। জুলিয়েত একসময় তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে এ-বিষয়ে কি ঠিক
করলে !
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মরিস বলল, কি বিষয়ে জুলি?
আমার যাওয়ার বিষয়ে। আমি কিন্তু তোমার কাছে গিয়ে থাকতে পারব না।
না না, আমিও তোমাকে এখন যেতে বলছি না।
শুধু এখন না, কখনই না।
ঠিক আছে, পরে ভেবে দেখা যাবে।
তুমি কি মনে করো আমার এখানে তুমি থাকতে পারবে ?
হ্যাঁ। মাসখানেক আমি এখানে থাকতে পারব। একটা মাস আমি কাজকর্ম সামলে নেব।
এই বলে কুণ্ঠা ও লজ্জার সঙ্গে তার স্ত্রীর মুখপানে তাকিয়ে তার কথার প্রতিক্রিয়াটা লক্ষ্য করার চেষ্টা করল।
জুলিয়েতও তার স্বামীর পানে নীরবে তাকাল। তার বুকের স্তনদুটো যেন উচ্চকিত ও উত্তুঙ্গ হয়ে উঠল সহসা। এক গোপন অসহিষ্ণুতা ও বিতৃষ্ণার দমকা হাওয়ায় কেঁপে উঠল যেন সে।
সে বলল, আমি ওখানে যেতে পারব না। তুমি যদি না আসতে পার এখানে- স্ত্রীর দেহসৌন্দর্যে ক্রমশই মুগ্ধ ও প্রলুব্ধ হয়ে উঠল মরিস। সে বলল, ঠিক আছে তোমাকে যেতে হবে না। এ জায়গাটা যদি তোমার ভাল লাগে তাহলে এখানেই থাকবে তুমি। তোমাকে আর যেতে হবে না।
অতীতের কথাগুলো একবার মনে করে দেখল মরিস। সে জানে সে যখন নিউ ইয়র্কের ফ্ল্যাটে তার স্ত্রীকে।নয়েছিল তখন কত অশান্তি ভোগ করতে হয়েছে তাকে। বিশেষ করে সন্তান হওয়ার পর থেকে আরো বেশী বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠে স্ত্রী তার প্রতি। মেয়েরা এই রকমই। তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই অনেক সময় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে তাদের মন। যার মনের চিন্তা ভাবনা আবেগ অনুভূতি তার সম্পূর্ণ বিপরিত এমন একটি নারীকে নিয়ে এক ঘরে বাস করা কত ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তার স্ত্রীর অকারণ শত্রুতার জাঁতাকলে দিনের পর দিন নিষ্পেষিত হয়েছে সে। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি সে আর চায় না। তাতে যা হয় হোক। তাতে যা তাকে করতে হয় সে করবে।
জুলিয়েত এবার তার স্বামীকে বলল, কিন্তু তুমি কি করবে?
আমি আমার ব্যবসাই করে যাব। তুমি যতদিন থাকবে এখানে ছুটি পেলেই চলে আসব। ছুটিগুলো এখানে কাটাব।
মরিসের দৃষ্টির মধ্যে অস্বস্তিকর এক প্রার্থনার সকরুণ আবেদন ছিল।
জুলিয়েত বলল, চিরদিন এইভাবে চলবে?
হ্যাঁ। তুমি যদি চাও চিরকালই এভাবে চলবে ।
আমি তাহলে যা খুশি তাই করব?
এই বলে সে স্বামীর দিকে সরাসরি তাকাল উদ্ধতভাবে। অনেক আলো হাওয়ার ঘা খাওয়া তার শক্ত সুন্দর দেহের অনাবৃত ঐশ্বর্য সম্ভারের সামনে নিজেকে অসহায়বোধ করছিল মরিস।
অবশেষে মরিস বলল, যতদিন তুমি তোমার নিজের বা ছেলেটার কোন ক্ষতি না করবে ততদিন এইভাবেই চলবে।
না, ক্ষতি আমি করব না।
না, আমিও তা মনে করি না।
এরপর দুজনেই চুপ করে গেল। গাঁয়ে — কোথায় মধ্যাহ্নকালীন ঘণ্টা বাজল তার মানেই লাঞ্চের ডাক।
নিজে পোশাক পরে এবং ছেলেটাকে জামা পরিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়ে পড়ল জুলিয়েত। মরিস তাদের সঙ্গে যেতে লাগল ৷
খাওয়ার টেবিলে জুলিয়েত তার স্বামীর বেশভূষা ও শহুরে কেতাদুরস্ত হাবভাব লক্ষ্য করতে লাগল বারবার। মরিসও তার স্ত্রীর দিকে বারবার তাকিয়ে কি যেন দেখতে লাগল। কিন্তু তার সে দৃষ্টির মধ্যে ছিল এমন এক গৃহপালিত জন্তুর ভীরুতা যে জন্তু আশৈশব বন্দীত্বের মধ্যেই লালিত পালিত হয়েছে।
খাওয়ার পর বারান্দায় কফি খেতে গেল তারা। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পা দিয়ে জুলিয়েত দেখতে পেল তাদের বাড়ি থেকে কিছুদূরে একটি বাদাম গাছের তলায় সবুজ গমের ক্ষেতের ধারে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে এক চাষী দম্পতি। মাটির উপর একটুকরো সাদা কাপড় পাতা। তাদের সামনে ছিল একটা বড় পাঁউরুটি আর দুটো গ্লাস ভরা কালো মদ।
ওদের দেখার জন্য কৌশলে জুলিয়েত বাইরের দিকে মুখ করে বসল, আর তার স্বামীকে বাইরের দিকে পিছন ফিরে তার দিকে মুখ করে বসাল।
সমুদ্রের ধারে সূর্যস্নান করতে গিয়ে এর আগে চাষীটিকে অনেকবার দেখেছে জুলিয়েত। কথাবার্তা না হলেও তাকে বেশ ভালভাবেই চিনত। চাষীটির বয়স ছিল প্রায় পঁয়ত্রিশ, চওড়বুক, বলিষ্ঠ চেহারা। তার স্ত্রীকে সুন্দরী বলা যায়। তবে গম্ভীর প্রকৃতির। তাদের কোন ছেলেপুলে ছিল না।
চাষীটা মাঠে প্রায়ই সাদা পায়জামা আর রঙীন জামা পরে কাজ করত। তার গায়ে যেমন শক্তি ছিল তেমনি সে ছিল কর্মঠ এবং প্রাণচঞ্চল। তার মাথায় থাকত একটা বেতের টুপি। তার মুখখানা ছিল গোল আর থ্যাবড়া। গোঁফের আর ভূর চুলগুলো বাদামী রঙের। একদিন জুলিয়েত তাকে দেখার আগে সে দেখতে থাকে জুলিয়েতকে। জুলিয়েত তার মাথার টুপি খুলে লজ্জায় মুখটা নামিয়ে নেয়। তারপর থেকে সমুদ্রে যাবার সময় রোজই কিছুটা দূর থেকে দেখতে পেত তাকে জুলিয়েত। তাকে দেখে তার মনে হত লোকটা স্বাধীনচেতা এবং তার স্ত্রী তাকে খুব ভালবাসে। আবার তার দেহমনের পূর্ণতায় তার স্ত্রী ঈর্ষাবোধও করে। কারণ সে জানে সে তার স্বামীর কাছ থেকে যা চায় তার থেকে অনেক বেশী কিছু দেবার ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য তার আছে।
একদিন জুলিয়েত দেখে একটা গাছের তলায় একদল চাষীর মাঝখানে সেই চাষীটি আনন্দে নাচছে আর তার স্ত্রী তার সেই নাচ দেখছে।
এইভাবে জুলিয়েত আর ঐ চাষীটি সচেতন হয়ে ওঠে পরস্পরের প্রতি। দূরে থেকেও অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে। সকালে কখন সে তার গাধা নিয়ে মাঠে আসবে তা
জানত জুলিয়েত। একদিন সে না এলে মনটা কেমন করত। আজ তাকে বারান্দায় দেখতে পেয়েই চাষীটি তাকে চিনতে পেরে মুখ তুলে তাকায় তার পানে।
একদিন সকালে জুলিয়েত যখন নগ্নদেহে হেঁটে বেড়াচ্ছিল তখন চাষীটি কাঠ জড়ো করে তার গাধার পিঠে চাপাচ্ছিল। সে জুলিয়েতকে দেখতে পেয়েই লজ্জা পায়। পিছন ফিরে চলে যায় জুলিয়েত। তবু তার চোখে চোখ পড়তেই সে বুঝতে পারে উত্তপ্ত কামনার যে অগ্নিশিখা তার আপাত সলজ্জ চোখদুটিতে ফুটে ওঠে সেই অগ্নিশিখাই তার শিরায় শিরায় সঞ্চারিত হয়ে গলিয়ে দিচ্ছে তার অস্থিমজ্জাগুলোকে।
লোকটা এত নীরবে কাজ করছিল যে জুলিয়েত তা বুঝতেই পারেনি আগে হয়ত।
এরপর তার নিজের সেই নির্জন জায়গাটায় চলে যায় জুলিয়েত। এরপর থেকে কেউ বাইরে প্রকাশ না করলেও এক দুর্বোধ্য জটিল চেতনার এক বেদনা অবদমিত হতে থাকে দুজনের দেহের মধ্যে। চাষীটির স্ত্রী হয়ত এর কিছুটা জানতে পারে।
তখন একদিন ভাবতে থাকে জুলিয়েত, কেন আমি ঘন্টাখানেকার জন্য লোকটির সঙ্গে মিলিত হয়ে তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করব না? কেন আমি শুধু একটি লোকের সঙ্গে সারা জীবনটাকে জড়িয়ে রাখব আমার? আমাদের দুজনের মধ্যেই যখন কামনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলছে তখন কেন শুধু একটি বারের জন্য সাধ মিটিয়ে সে কামনাকে চরিতার্থ করব না? কিন্তু কোনদিন তার এই মনের কথাটা ইশারাতেও জানায়নি লোকটাকে।
আজ সেই চাষীটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর তার স্ত্রী দেখছে তার স্বামীকে । তার স্ত্রীর প্রতি ঈর্ষা হলো জুলিয়েতের।
একথা ভাবতে খারাপ লাগছিল আজ জুলিয়েতের যে মরিসের চোখের পানে তাকিয়ে সে বেশ বুঝতে পেরেছ তার সন্তান আবার গর্ভে ধারণ করতে হবে তাকে। সে একবার মরিসকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমিও আমার সঙ্গে সূর্যস্নানে যাবে ?
নগ্নদেহে আমার সঙ্গে বেড়াবে সমুদ্রের ধারে ?
মরিস তখন বলেছিল, হ্যাঁ, যখন রয়েছি এখানে তখন নিশ্চয় যাব। জায়গাটা সত্যিই খুব নির্জন।
জুলিয়েত দেখল মরিস লোকটা ভীরু প্রকৃতির হলেও এক্ষেত্রে আর সব পুরুষের মত এক পৌরুষসুলভ কামনায় উত্তপ্ত ও উদ্দীপ্ত। তার নির্লজ্জ দৃষ্টি এরই মধ্যে নিবদ্ধ হয়েছে তার চাদর-ঢাকা উত্তঙ্গ স্তনযুগলের উপর। তা হোক, কিন্তু লোকটার গায়ে সভ্য জগতের ছাপ। সভ্য জগতের যত সব জটিল বন্ধনের গন্ধ তার গায়ে। আসলে সে চেয়েছিল সেই স্বাধীনচেতা গ্রাম্য চাষীটার কাছে গিয়ে তার সন্তান গর্ভে ধারণ করতে কিন্তু তা আর হলো না। অকালে শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়িগুলোর মত তার কামনার কুঁড়িগুলিও ফুটতে না ফুটতেই শুকিয়ে ঝরে গেল।
মরিসের সন্তানকেই আবার গর্ভে ধারণ করতে হবে তাকে।

Please follow and like us: