বাচনি – সাদত হাসান মান্টো

›› অনুবাদ  ›› সম্পুর্ণ গল্প  

ধাঙ্গড়দের সম্পর্কে কথা হচ্ছিল। বিশেষত বিভাগ পূর্বকালে যেসব ধাঙ্গড় অমৃতসরে বাস করতো তারাই ছিল আলোচ্য বিষয়। মজিদের বিশ্বাস অমৃত- সরের ধাঙ্গড়দের মত উদগ্র যৌবনা মেয়ে আর কোথাও পাওয়া যায় না । বিভাগ পরবর্তীকালে তারা কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে কে জানে ! রশীদ গুজরি ধাঙ্গড়দের প্রশংসা করছিল। মজিদকে সে বলল, অশ্বতসরের ধাঙ্গড়রা যৌবনকালে অত্যন্ত আকর্ষণীয় থাকে এটা অস্বীকার করছি না, কিন্তু তাদের এ যৌবন বেশীদিন থাকে না। যুবতী হওয়ার পর দেখতে না দেখতেই তাদের যৌবন চলে যায়, তাদের যৌবন কোন চোর চুরি করে নেয় কি জানে ! আমাদের ওখানে একটা ধাঙ্গড় কাজ করতো, তার যৌবনের চমক দেখে নিজের দুর্বল যৌবনকে তুচ্ছ মনে হতো, এ জন্যে তার সাথে কখনো কথাই বলতাম না ! নাম ছিল ফাতেমা। খৃস্টান মিশনারীরা তাকে নিজেদের ধর্মে দীক্ষিত করে নেয়। ফাতেমা নাম হলেও বাড়ীতে তাকে ফাতু বলে ডাকা হতো । কিন্তু খ,স্টান হয়ে যাওয়ার পর খৃস্টান মিশনারীর লোকেরা তার নাম রাখলো মিস ফাতু । সকালে সে ব্রেকফাস্ট করতো, দুপুরে লাঞ্চ এবং রাতে ডিনার ।

কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই দেখা গেল তার উদগ্র যৌবন যেন বিগলিত হয়ে পড়েছে । তার উন্নত বুক করুণভাবে ঢলে পড়ল । অথচ তার তুলনায় আমাদের ঘরে উপল নিয়ে আসা মেয়েটির যৌবন অটুট ছিল। ধার্মন্তরিত ধাঙ্গড় আয় উপল নিয়ে আসা ধাঙ্গড় উভয়ের বয়স ছিল একই রকম। তিন বছর সে আমাদের এখানে কাজ করেছে, অথচ এর মধ্যে তার যৌবনের যেন কোন পরিবর্তনই হয়নি । পরে তার বিয়ে হয়ে যায়। তার কোমরের, ঘাড়ের একটুখানি স্পন্দনও ছিল দেখার মতো । বিয়ের পর সে তিনটি সন্তা- নের মা হয়, অথচ সে যেন ঠিক আগের মতই রয়েছে । এজন্য বলছি গুজরি ধাঙ্গড়দের কোন তুলনা হয় না, আমাদের এ কথা তোমাকে মানতেই হবে ।

মজিদ জ্বলে যাচ্ছিল । ডিব্বা থেকে সে পানের খিলি বের করে মুখে দিল। দিয়াশলাইর কাঠি দিয়ে একটি কৌটো থেকে খানিক কিমাম বের করে মুখে পুরে বলল, রশীদ ঠিকই বলেছ, কিন্তু আমার মাথায় যে ধাঙ্গড়ের স্মৃতি জাগরুক রয়েছে আর যার কথা আমি আসলেই বলতে চাই, তার কাছে কোন গুজরি পৌছুতে পারবে না। সে ছিল একটা প্রলয়, রীতিমত একটা ফেতনা । তুমি আমার কাছ থেকে একটা কাহিনী শোন, তাহলে তার সম্পর্কে স্পষ্ট বুঝতে পারবে। যৌবন ঢলে পড়া সম্পর্কে তুমি যা বলছো সে আমি ভাল করেই জানি । গুজরিরা স্বভাবতই বেশ লম্বাটে, প্রাকৃতিক কারণেই তাদের তাড়াতাড়ি ঢলে পড়া উচিত, অথচ তা কিন্তু হয় না । কারণ তারা নগ্ন পায়ে থাকে এবং তোমার বর্ণনা অনুযায়ী পাহাড়ের মত উঁচু উপলের বোঝা মাথায় নিয়ে চলাফেরা করে । কিন্তু এখন গুজরিদের কথা রাখো, আমাকে বাচনির কথা বলতে হবে । বাচনি ছিল আমাদের পাড়ার এক উদগ্র যৌবনা ধাঙ্গড়। মাঝারী ধরনের দেহ। মুখ যেন খাপছাড়া তলোয়ার । বিবাহিত ছিল। প্রতিদিন স্বামীর সাথে ঝগড়া লড়াই করতো । আমাদের কম্পাউণ্ডে ওরা স্বামী-স্ত্রী প্রতিদিন ভোরে আসতো এবং একটি গাছের সাথে দোলনা ঝুলিয়ে শিশুকে শুইয়ে রাখতো । কিন্তু মুশকিল হলো দোলনা দোলানোর কেউ ছিল না । স্বামী-স্ত্রী উভয়ে ঝাড় দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে দোলনায় দোল দিত, বা কোলে নিয়ে পায়চারি করতো ।

রশীদ মজিদকে বলল, এই দোলনার কথা এলো কোত্থেকে ? তুমি তো একটা উদগ্র যৌবনা ধাঙ্গড়ের কথা বলছিলে, তোমার ভাষায় সে ছিল খুবই সুন্দরী ৷

মজিদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, দোস্ত, তুমি দোলনার সাথে জড়িয়ে গেলে কেন ? আমার কাহিনীটা তো পুরোপুরি শুনবে। এটাও আসলে বাচনিরই কাহিনী, যে বাচনিকে আমি সারাজীবন ভুলতে পারব না । সে ছিল একটা আপদ ৷ সকালে লম্বা ঝাড়, হাতে, মাথায় রকমারি জিনিসের বোঝা নিয়ে স্বামীর সাথে আমাদের পাড়ায় আসতো । দেখে মনে হত যে ঝাড় এক্ষুণি আপনার মাথায় মেরে বসবে। কিন্তু তা কখনো করেনি। তার স্বামী, কি যেন তার নাম মনে নেই— লম্বায় ছিল তার স্ত্রীর চেয়ে ছোট। সে কাজের সময় স্ত্রীকে গালাগাল করতো, যারা শুনতো তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ- আলোচনা করতো ।

রশীদ কাহিনী দীর্ঘায়িত হতে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি আসল কথায় আসো ! এদিক ওদিকের কথা রাখো । বাচনি খুব ভাল নাম, না হলে তোমার এ বক বক শুনতাম না ৷ এ তোমার সাজানো কাহিনী কি না কে জানে ! যাক গে, তোমাকে কয়েক মিনিট সময় দিচ্ছি, শোনাও ৷

মজিদ রুষ্টস্বরে বলল, আরে উল্লুক, তুমি শুধু বাচনির নামটাই শুনেছ, ওকে যদি দেখতে, তবে হৃদয় খুলে তার আঁচলে দিয়ে দিতে। আমি এ কাহিনী শোনাচ্ছি, এতে কিছু লবণ মরিচ লাগানোর অনুমতি থাকা উচিত, তুমি যদি বিরক্ত হয়ে পড়ে। তবে জাহান্নামে যাও ।

রশীদের অন্য কোন কাজ ছিল না, অতো টাকাও ছিল না যে সিনেমায় যাবে । এজন্যে মজিদের কাহিনী শোনাই সমীচীন মনে করলো। বলল, জাহান্নামে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তুমি একটু সংক্ষিপ্ত করো। আসলে তোমার বাচনিকে আমার ভালো লাগছে ।

মজিদ রেগে বলল, তোমার ভাল লাগার নিকুচি করি, তুমি কে এমন যে, ওকে তোমার ভালো লাগতে হবে। শুধু তুমি নও, তোমার মতো অনেকেরই তাকে ভালো লাগতো। কিন্তু সে কাউকে পাত্তা দিতো না । আমি তোমার চাইতে অনেক বেশী ছদর্শন, অথচ আমি সবসময় তার করুণার দৃষ্টি কামনা করেছি। বড় জাঁদরেল মেয়ে বাচনি। সত্যি বলছি রশীদ, অমন মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি. নাম বাচনি হলে কি হবে আসলে সে ছিল একটা ডাহা কুটনি ৷ আমি ওকে নিজের অধিকারে আনার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হতে পারিনি । সে কিছুতেই ধরা দিতো না ।

রশীদ বলল, তুমি দোস্ত, এসব ব্যাপারে বরাবরই আনাড়ি ছিলে ।

মজিদের চোট লাগলো । বলল, বাজে বকো না, একদিন আমি তাকে জাপটে ধরেছি, আমার ঘরের বাইরে সে ঝাড় দিচ্ছিল, আমি তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম ।

তারপর কি হলো ? রশীদ কৌতুক করে সিগারেট ধরালো এবং দিয়াশলাইর কাঠি কয়েক টুকরো করে ভেঙ্গে এসট্রেতে রাখলো ।

মজিদের মনে হলো রশীদ যেন তাকে ভেঙ্গে এসট্রেতে রাখছে । খুবই বিরক্ত হলো, কিন্তু লোক ভাল ছিল এজন্যে মিথ্যা বলতে পারল না । বলল, দোস্ত রশীদ, তুমি ঠাট্টা করছো, কিন্তু আসলে সেদিন যা হয়েছিল তা ঠাট্টা বিদ্রূপ করার মতোই । আমি যেই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, হারামজাদী সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখে ঝাড় মেরে বসল । লজ্জায় আমি ঘরের ভেতরে ছুটে গেলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরোলাম, দেখি। সে একই ভাবে ঝাড় দিচ্ছে। আবার তাকে জাপটে ধরলাম । কিন্তু এবার সে কোন প্রতিবাদ করল না। আমি ভাবলাম……

রশীদ বলল সব ঠিক-

মজিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ছাই ঠিক ! সে আমার নিকট থেকে নিজেকে মুক্ত করে সোজা আমার স্ত্রীর কাছে চলে গেল । কিন্তু তার কাছে কোন অভিযোগ করল না। আমি ভয়ে চুপসে গিয়েছিলাম । শুনলাম সে বলছে, বিবিজী, আজও পানি এলো না । যারা আপনাদের কাছ থেকে মাসে দশ টাকা বিল নেয় তাদের কি হয়েছে বলুনতো! তারা কেন ভেবে দেখে না যে, মশকীকে প্রতিদিন দশ মশক পানির জন্যে চার আনা করে দিলে আড়াই টাকা লেগে যায়। আমার বুকের ভার হালকা হলো, খোদার শুকরিয়া আদায় করলাম। আবার ভাবলাম, বাচনিই আমার সম্মান রেখেছে, কিন্তু এরকম চিন্তা করা কুফুরী।

রশীদ প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বলল, আরে কাফেরের বেটা, আসলে কথা হলো, বাচনিকে তুমি কাবু করতে পেরেছ কিনা তাই এবার বলো ৷ মজিদ রশীদের ডিব্বা থেকে আরো একটি পান মুখে পুরে বলল, দেখ রশীদ, তুমি বাচনিকে জানো না। সত্যি বলছি, যদি আমি গল্পকার হতাম তবে বাচনিকে একটা জীবন্ত চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে পারতাম । সে যে কি ছিল ভেবে পাই না । বয়স ছিল তার বড় জোর সতের আঠারো, লম্বায় সাড়ে চার ফুট হবে, বুক এমন দৃঢ়—দেখে মনে হয় যেন লোহার তৈরী, অথচ সে এক সন্তানের মা ।

রশীদ বলল, রাখো তোমার এক সন্তানের মা – তুমি কাহিনী শেষ করো ৷ আমাকে একটা জরুরী কাজে যেতে হবে। সাড়ে সাতটা বাজে, অথচ তোমার কাহিনী শেষই হচ্ছে না ।

মজিদ গম্ভীর স্বরে বলল, রশীদ লালে, ব্যাপার বড় গুরুতর।

রশীদ বলল, কার, তোমার না আমার ?

মজিদ বলল, জানি না, কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি তখন আমার ব্যাপারই গুরুতর ছিল। বুঝতে পারছিলাম না যে কি করব, কি না করব । তুমি ভেবে দেখ আমি হাজার হাজার টাকার মালিক ৷ তুমি তো জানোই বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সব সম্পত্তি আমি পেরেছি, যেখানে যতো টাকা ইচ্ছা খরচ করতে অসুবিধা ছিল না। বাচনিকে বুকে জড়িয়ে ধরার পর সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার স্ত্রীর কাছে নালিশ না করায় ভাবলাম কয়েকবার এরকম করার পর আমি সফল হবো। রশীদ জিজ্ঞেস করল, সফল হয়েছ ?

মজিদ বলল, ছাই হয়েছি! তুমি ওকে জানোই না । বড় জাঁদরেল মেয়ে। স্বামীকে পরোয়া করতো না । কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার, আমি যা কিছু করেছি এ সম্পর্কে সে কারো কাছে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। অথচ সে ইচ্ছে করলে আমাকে আমার স্ত্রীর সামনে বেইজ্জত করে ঘরের বার করতে পারতো ।

রশীদ হেসে বলল, তোমার বাচনিকে আমি জানি ৷

মজিদ বিস্ময়ভরে বলল, তুমি ওকে জানো কি ভাবে ? রশীদ বলল, তুমি যেভাবে জানো, সেভাবেই জানি। তুমি কি ঠিকা নিয়েছ যে, তোমার এলাকাতেই সে কাজ করবে অন্য কোথাও করতে পারবে না ? আমি তাকে ভাল করেই জানি।

মজিদের বিশ্বাস হলো না । বলল, বাজে বকো না, তার বয়সই বা কতো যে তুমি তাকে জানবে। দু’বছরের কিছু বেশী সময় ধরে সে আমাদের পাড়ায় আসছিল। আমাদের এখানে আসবার পর তার কোন সন্তান ছিল না, দু’তিন মাস পর তার কোলে ছেলে এলো ।

রশীদ হেসে বলল, তোমার ?

আমার ! মজিদ রসিকতার জবাব দিয়ে বলল, আমার হলে তো কোন কথাই ছিল না । কমপক্ষে এটা তো বলতে পারতাম যে নিজের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

রশীদ অদ্ভুত ভাবে হেসে বলল, তুমি কি তোমার বাচনির স্বামীর নাম জানো ?

– না।

—আমি বলছি তোমাকে – তার স্বামীর নাম রশীদ ?

মজিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, তার নাম রশীদ ।

রশীদ দৃঢ়তার সাথে বলল, হাঁ, তার স্বামীর নাম রশীদ। আসলে রশীদই তার প্রকৃত স্বামী ৷

মজীদ ধীরে ধীরে বলল, তাহলে আমার পাড়ায় যে ঝাড়ু দিত এবং শিশুকে দোলনায় দোলাতো, সে কে ?

রশীদ বলল, আড়ে উল্লক, সে নিজের সন্তানকে দোলনায় দোলাত না ।

—তবে কাকে দোলাতে। ? সে কি তবে সেই রশীদের সন্তান নয় ?

-না।

– তবে কার সন্তান ?

—একজন দরিদ্র লোকের, যে কিনা সুদর্শন নয়, তোমার চেয়ে অনেক অপ্রিয়দর্শন ।

– কে সে ?

– জিজ্ঞেস করে কি করবে ?

– কি আর করব । এমনিতেই জানতে চাচ্ছি ।

রশীদ একটা সিগারেট ধরিয়ে, পরিতৃপ্তির সাথে বলল, জানতে চাও যখন শোনো, সেই রশীদ হলাম আমি, তোমার বাচনির সাথে আমার ছোটবেলা থেকে সম্পর্ক ছিল। তার বয়স ছিল এগার। আমার বয়স ছিল তেরো। তখন থেকে তার এবং আমার সম্পর্ক চলে আসছিল । তার কোলে তুমি যে সন্তান দেখেছ, এবং থাকে তার ‘উল্লুকে পাঁঠা স্বামী দোলনায় দোল দিত সে এই হতভাগার সন্তান । খোদার শোকর যে, মেয়ে হয়নি, তাহলে তাকে মেরে ফেলতাম ।

এই বলে রশীদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে বিদায় নিয়ে চলে গেল । মজিদ ভাবতে লাগল যে, খোদার কোন বিশেষ অনুগ্রহের কারণে রশীদ তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে ?