সন্ধ্যার ঘন অন্ধকার নিবিড় হয়ে আসছে চারদিক থেকে। রাস্তার দু’ধারে গাছগুলির বাস্তবতা হারিয়ে যাচ্ছে এক রহস্যময় কুহেলিকায়। স্নান সেরে ধীর পায়ে বাসবদত্তা উঠে এল কল্লোলিত ঝরনার বুক থেকে। ভেজা কাপড় তার অঙ্গের সঙ্গে এমনই সেঁটে ছিল যে বিশ বছরের উদ্দাম যৌবনের সব চিহ্নগুলি আবরণ ভেদ করে ফুটে বেরোচ্ছিল। ঝরনার বুক থেকে কাজ গন্ধ বয়ে নিয়ে ফুরফুরে হাওয়া ছুটে এল তার পিছু পিছু। প্রেমপিপাসু নাগরের মত কানে কানে স্তুতি করে বার বার অস্ফুটস্বরে বলছিল যেন; বাসবদত্তা কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে। ঝরনার সঙ্গ জল, মৌনগম্ভীর পর্বতের শুভ্র তুষার, দিগন্তের নীলাভ ছায়ায় ঢাকা পর্বতমালা, সবুজ বনানী, আকাশের অফুরন্ত আলো এই সব দিয়ে বিধাতা তিল তিল করে তিলোত্তমার মত গড়েছে তোমার সেহশ্রী। তুমি ভীষণ সুন্দরী। মনের অভ্যন্তরে কথাগুলো তার বুকের ভেতর তীর খুশির কলধ্বনি হয়ে বাজতে লাগল। ঝরনার কলতান, বাতাসের ফিসফিসানি, দু’পাশে সারিবদ্ধ গাছের বিস্ময়, গাছের ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে দেখা চাদের লোভী দৃষ্টি তার ভেতর রূপসচেতন নগরনটীর ফুরিয়ে যাওয়া জীবনকে নবীকৃত করে। রোজই ঝরনার জলে স্নান করে সে নতুন হয়ে ওঠে। নতুন করে প্রাণ পায়।
দর্শনের সামনে বসে অনেকক্ষণ ধরে সাজল বাসবদত্তা। প্রস্ফুটিত ফুলের মত তরতাজা যৌবনকে বিপুল ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অপলক দুই চোখে মুগ্ধ তন্ময়তা নেমে আসে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিজেকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ইস্ বাসবদত্তা তোমার হাত-পা কী নিটোল, কী সন্দুর ননীর মত নরম, মোমের মত মসৃণ তোমার ত্বক। কচি শিশুর মত নরম তুলতুলে হাত দিয়ে তার সুডৌল বুকটা স্পর্শ করে বিচিত্র এক শিহরনে রোমাঞ্চিত হয় কলেবর। হঠাৎই মন পড়ে যায় মার কথা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে মা নাকি স্বপ্ন দেখেছিল সে রাণী হয়ে পৃথিবী শাসন করবে। বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক হয়ে দু’হাত দিয়ে দান করবে। মার সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়লে ভীষণ হাসি পায় তার। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
চোখের সামনে সুদূর অতীতের কত ছবি ভেসে ওঠে। অভাব অনটনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বাপ-মায়ের কথাবার্তা হয়ে গিয়েছিল রুক্ষ, কর্কশ। প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতার পাত্র শুকিয়ে গিয়েছিল। কোথাও করুণার আভাস ছিল না। জীবনটাই তাদের ফুরিয়ে গেছিল। তবু হাঁ করা অভাবের সংসারে ভাঙা নড়বড়ে ঘরের ঝাঝরা চালের নিচে মাটিতে তরে মায়েরা ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখে। দুঃখী মানুষের এ ধরনের স্বপ্ন বিলাস তার অফুরান কষ্টের মধ্যে একটুকরো সুখ হয়ে বেঁচে থাকার শক্তি দেয়। সেই ছোট্ট, তৃপ্তি শান্তিটুকু ছিনিয়ে নেয় রাজার লোকেরা। রাজস্ব আদায়ের নাম করে সর্বস্ব অপরহণ করে তাদের। ঘরে সুন্দরী মেয়ে, বৌ থাকলে বাজপাখির মত ছোঁ মেরে তাদের ছোট সুখকে ধারাল ঠোটে করে তুলে নিয়ে ভাগাড়ে গিয়ে তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত দুটো পা দিয়ে চেপে ধরে তাকে ছিন্নভিন্ন করে। অমনি এক জ্বালা ধরা ক্রোধে ঘৃণায় মনটা পুড়তে থাকে।
খুট্ খুট্ করে জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ হতে লাগল। আগন্তক দরজা না খোলা পর্যন্ত কড়া নাড়িয়েই যাচ্ছিল। বাসবদত্তা সাড়া না দিয়ে চুপি চুপি দরজা খুলে দিল।
ঝড়ের মত ঘরে ঢুকল বজ্রসেন। ব্যস্ত-ত্রস্ত হয়ে দ্রুত হাতে কপাট বন্ধ করে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। মনে হল অনেকখানি পথ দৌড়ে এসে হাঁপিয়ে পড়েছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। বাসবদত্তা তার এই অস্বাভাবিকতায় বেশ একটু অবাক হয়ে অপলক চেয়ে রইল। বজ্রসেনও অসহায়ের মত জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে কিছু বলার চেষ্টা করছিল।
বজ্রসেনকে হাত ধরে বাসবদত্তা তার পালঙ্কে বসাল। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল কী হয়েছে তোমার? এত হাপাচ্ছে কেন?
বজ্রসেন বাসবদত্তার কোমর জড়িয়ে ধরে তার বুকের কাছে মাথা রাখল। চন্দন অগক লেপিত সুবাসিত অঙ্গের মাপ নিল বুক ভরে। তারপর তাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে কোলের ওপর বসিয়ে বলল: আমার ভাগ্য খুলেছে। এই সুসংবাদটা দিতে দৌড়ে এলাম। পাছে ঘোড়ার পায়ের আওয়াজে লোক জানাজানি হয় তাই খালি পায়ে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছি। বাসবদত্তা, আজ থেকে তুমি শুধু আমার। বাসবদত্তা তার বাহুবন্ধনে বন্দী হয়ে চটুল হেসে বলল কিন্তু তুমি কি আমার হয়েছ?
উত্তেজিত গলায় দৃঢ়তার সঙ্গে বহুসেন তৎক্ষণাৎ বলল আলবাৎ।
চোখের তারায় বিদ্যুৎ কটাক্ষ হেসে বলল কেমন করে জানলে ?
বজ্রসেনের ভেতরটা হঠাই খুশিতে ভরপুর হয়ে গেল। বলল জান বাসবদত্তা বৈশালী নাটমন্দিরে আজ এক নতুন মেয়ের নাচ দেখে এলাম। উতরোল বাদ্যযন্ত্রের সুরের মূর্ছনায় নাটমঞ্চ যখন গমগম করছে মরালীর মত এক লাবণ্যময়ী তরুণী সুরের ভেলায় ভেসে এল যেন। কী দারুণ দেখতে। ফিনফিনে শুভ্র উত্তরীয়টি খুলে ফেলে দিল। স্বপ্নের মত নীলাভ পোশাকের আড়ালে রূপসী নর্তকীর ক্ষীণ তনু তুষারশুভ্র অবয়ব গোটা নৃত্যস্থলীতে নদীর মত তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে। সে যখন নাচছিল তার যৌবনপুষ্ট স্বল্পবাস তন্বীদেহের লীলায়িত বিন্যাসে বিচিত্র মুদ্রা রচনা করে নাচতে লাগল। তার নাচে কেমন একটা আদিমতা ছিল। নাচছিল পাগলের মত। চক্রাকারে পাক খেয়ে খেয়ে লম্বা বেণীর এক দুরন্ত ঘূর্ণি সৃষ্টি করে, দর্শকদের মাতিয়ে তুলেছিল। তার রঙিন বক্ষবাসের আড়ালে আন্দোলিত দুটি সুডৌল পয়োধর। নিতম্বের সর্পিল তরঙ্গময় ওঠানামা বৈশালী যুবরাজ চন্দ্রকান্তকে হঠাৎই প্রমত্ত আবেগে অসহিষ্ণু করে তুলল হঠাৎই নটী নাচের বেগে যুবরাজের পদতলে লুটিয়ে পড়ল। কেমন একটা অভিভূত আচ্ছন্নতায় যুবরাজ পদতল থেকে তাকে দু’হাতে তুলে ধরল তার মুখের সামনে। বলল । কী সুন্দর তোমার নাচ। লোকলোকান্ত পেরিয়ে আমাকে এক অজানা চিত্তরহস্যময় জগতে নিয়ে গেছ তুমি। কথা শেষ করে তার গলায় পরিয়ে দিল নিজের গলার হীরে-মোতির মালা।
বাসবদত্তার বুকের ভেতরটা শুঁড়িয়ে যেতে লাগল। নিজেকে সে শান্ত এবং সংযত রাখল। একটুও কাতরতা নেই তার মধ্যে। বজ্রসেনের কথাগুলো সে উপভোগ করছিল। চোখের তারায় বিদ্যুৎ খেলা করছিল। মাঝে মাঝে হাঁ-ই করে সায়ও দিয়ে যাচ্ছিল। হাসলও আবার। মোহন হাসি। বলল মনটা দর্পণের মত। নানা প্রতিবিম্ব পড়ে তার ওপর। দর্পণের মত সব কিছুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে যে না শেখে, সে নানাবিধ ঘটনার মধ্যে নিজেও বাঁচতে পারে না। যা সত্য তাকে সহজভাবে মেনে নিলে জীবনে কোন বিরোধ থাকে না। প্রত্যেকের ভেতর যে মাধুরীলতা আছে তার ফুল ফুটলে আপনা থেকে তার সৌরভ ছড়িয়ে যাবে।
বজ্রসেন খুশিতে ভরপুর হয়ে বাসবদত্তাকে বুকের মধ্যে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে তার মাথার উপর চিবুক রেখে আদর করে খুব করল। চোখের ওপর চোখ রেখে রেখে বাসবদত্তা বলল: বসেন তুমি তো আমার হয়ে গেছ, কিন্তু আমি তোমার হয়েছি কি না জানতে চাইলে না তো।
বাসবদত্তার গালের ওপর একটা ছোট্ট করে টোকা দিয়ে বলল: এই মুহূর্তে তোমার কৌতুক শুনতে ভাল লাগছে। আচ্ছা এই যে আগুনের মত উত্তাপ লাগছে আমার গায় এটাকে কী বলবে তুমি! এটাই তো ভালবাসা। আমার সর্বাঙ্গে তোমাকে অনুভব করছি তুমিও আমার নীরব স্পর্শ গায়ে মেখে চুপ করে বসে আছো কেন?
বজ্রসেন রঙিন কথার ফুলঝুরি জ্বেলে একটু একটু করে অব্যর্থ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিপুণ হাতে দ্রুত খুলে ফেলল তার কাঁচুলি, ঘাঘরা। বাসবদত্তা একটুও আপত্তি করল না, যে মুহূর্তে নিরাবরণ দেহলতাটি মত্ত উল্লাসে সম্ভোগে মেতে ওঠার জন্য তাকে বেষ্টন করল অমনি সে দুরে সরে গিয়ে বলল: বজ্রসেন! নগ্নিকা কালীমূর্তি দেখেও কি তোমার মনে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে! ছিঃ! ঝাড়বাতির আলোয় উজ্জ্বল তার নগ্নদেহের অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের দিকে ইঙ্গিত করে প্রশান্ত কন্ঠে বলল : বিধাতার দান এই নারীদেহের রূপলাবণ্য, শুধু ভোগ করার জন্য উন্মত্ত না হয়ে শ্রদ্ধা করতে শেখ বজ্রসেন।
বজ্রসেনের ভেতর উত্থান পতটা হঠাৎই পাথুরে মূর্তির মত স্থির হয়ে গেল। তার ভেতরে কামনার আগুন নিভে গেল। চোখে ফুটে উঠল বিস্ময়।
বাসবদত্তা অভিভূত গলায় বলল কি দেখছ বজ্রসেন! আমাকে না নিজেকে? আমি দেবদাসী। একদিন ঐ নাচনীর মত দেবতার মনোরঞ্জন করতে এসে চন্দ্রকান্তর বাঞ্ছিতা হয়ে যাই। তাকে ছাড়া আর কোনো পুরুষকে এদেহের ভাগ দিতে পারব না। তুমি তার বন্ধু, বন্ধুর বিশ্বাসভঙ্গ করে আমার কাছে কোনদিন এস না।
বজ্রসেন আর একটা মুহূর্ত থাকেনি বাসবদত্তার ঘরে। মাথা নিচু করে চলে গেল।
বজ্রসেনের সঙ্গে এরকম অদ্ভুত আচরণে সে একটু অবাকই হল। শুরু হল আত্মবিশ্লেষণ। জীবনে কত ধরনের মানুষ এসেছে গেছে, তাদের প্রত্যেককেই সে চরিতার্থ করেছে। অদ্যাবধি কাউকে প্রত্যাখ্যান করেনি। এক শয্যার রাতের পর রাত কাটিয়েছে তাদের পাশে শুয়ে, কখনও দ্বিধা করেনি কিছুতে। যে যখন আমন্ত্রণ করে একান্ত পেতে চেয়েছে। দেহের নৈবেদ্য উৎসর্গ করেছে তাকে। এ ব্যাপারে অদ্যাবধি ক্লান্তি আসিনি। নাগরকে তুষ্ট করাই তার ধর্ম। কারণ তারা তো মুখ-আনন্দ কিনতে আসে। দোকানীর মত সে তা বিক্রি করে। কিন্তু বজ্রসেনের সঙ্গে যে রূঢ় আচরণ আজ সে করল তা নিতান্তই আকস্মিক এক অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। জীবনে এরকম আচরণ তার একেবারে নতুন এবং বিস্ময়কর। বজ্রসেনের সারা শরীর যখন মিলনের আনন্দে শীথের সুরের মত বেজে যাচ্ছিল, খুশিহীন জীবনটা খুশিতে ভরপুর করে নিতে তার বুকে নদী হয়ে মিশে যেতে চাইল, ঠিক তৰুমি সুরত ক্লান্ত রমণীর মত বিরক্তিকে ছিটকে গেল তার কাছে থেকে। যা সন্তা ছিল সেই শরীরটাকেই দামী মনে করে দারুন তাচ্ছিল্য করল তাকে। বহুসেনের সঙ্গে এরকম অদ্ভুত আচরণে সে একটু অবাকই হল। বজ্রসেনও প্রত্যাখ্যাত হয়ে বর্বর হয়ে উঠল না। জোর করল না তার ওপর। হঠাৎ এমন উপেক্ষার জন্য রাগ করতে পারত। সবেগে জাপ্টে ধরে খামচা-খামচি করে তাকে কব্জা করতে তো পারত। কিন্তু সে কিছুই করল না। তার এই অদ্ভুত ঠাণ্ডা পুরুষ প্রকৃতিটা ভিতরে ভিতরে ভীষণ এক যন্ত্রণা দেয় তাকে প্রতিকারহীন যন্ত্রণা। শরীর ছাড়াও একজন পুরষকে যে একজন নারীর দেওয়ার মত অনেক কিছু আছে। বেশিরভাগ পুরুষ তা নিতে জানে না। পুরুষ শুধু জংলী উদ্দামতায় মেতে ওঠে তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে যায়। তাই বোধ হয় তীব্র অভিমানে তার ভেতর জমে ওঠা বিরূপতাই বহুসেনের ওপর উপরে দিয়েছিল। তার প্রশ্রয় ভরা তিরস্কারের মধ্যে একরকমের চাপা নিষ্ঠুর কৌতুক ছিল। আর সেই কৌতুকের সঙ্গে মিশে ছিল এক ধরনের অপ্রকাশ্য আতঙ্ক মেশা আনন্দও। কিন্তু সেখান থেকে আনন্দ নিয়ে ফেরার কথা ছিল সেখান থেকে নিরানন্দ হয়ে শুন্য হাতে ফিরতে হল তাকে। এসব আনন্দকর অনুভূতির নাম জানে না বাসবদত্তা। নটীর জীবনে এ অনুভূতিও একেবারে নতুন। নটীর মন বলে কিছু থাকতে নেই। কারণ নটী নিজের আনন্দের জন্য সুখের জন্য বাঁচে না। নাগরের আনন্দ, স্ফূর্তি, সুখ, আরামের জন্যই বাড়ে। তার নিজের জীবনটা নৈবেদোর ফুল-বেলপাতার তলায় চাপা পড়ে যায়। স্তূপাকৃতি সেই জঞ্জালের পাকে পদ্ম ফোটাতে চাইলেও ফোটে না। দৈবাৎ হৃৎকমলের চারাগাছ যদি চোখের আড়ালে অঙ্কুরিত হয় তাহলে কামনার এমন হঠাৎ মৃত্যু ঘটে কি সেখানে? নটীর সুরত ক্লান্ত হওয়া মানেই তো তার মৃত্যু। এমন হঠাৎ মৃত্যু সে এর আগে কখনও নিজের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেনি। এহল পরাজয়ের সূচনা। তবে কি ফুরিয়ে গেল সে। ভেতরে ভেতরে সে আতঙ্কিত হল। নিজেকেই প্রবোধ দিয়ে নিরুচ্চারে প্রবোধ দিল। না এ হতে পারে না। হয় না। হলেও বাঁচবে না সে।
দর্পণের সামনে এসে দাড়াল বাসবদত্তা। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্নভাবে দেখল। মুকুরে মুকুরে তার আশ্চর্য দেহকান্তির সতেজ অক্ষের অনাবৃত যে অংশের প্রতিবিশ্ব ফুটে বেরোচ্ছে তার কমনীয় লাবণ্যপ্রভা তাকে জানিয়ে দিয়ে দিচ্ছে এখনও বয়সের ছাপ পড়েনি কোথাও। নিটোল শরীরে কোথাও এতটুকু খাঁজ পড়েনি কিংবা টোল খায়নি। এখনও তার দেহ অনন্ত ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। এখনও তৃষ্ণা মেটানো ক্ষমতা আছে তার। নাগরের আনন্দিত হওয়ার অনেক কিছুই আছে তার শরীরে। কিছুই ফুরিয়ে যায়নি। বাসবদত্তার কিছু ভাল লাগছিল না। থেকে থেকে চন্দ্রকান্তর কথাই মনে হচ্ছিল। চন্দ্রকান্ত মথুরাপুরের রাজার বখে যাওয়া ছেলে। তাকে সুস্থ জীবনস্রোতে ফেরানোর জন্যই তার মত একজন সুন্দরী মেয়েকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। অনেকটা পুজোর জন্য
পাঁঠা উৎসর্গের মত। তব কথাটা মনে হলে লজ্জা হওয়ার বদলে গর্ব হয়। এত তো মেয়ে আছে পৃথিবীময়, তবু তাদের কাউকে নয়, চন্দ্রকান্তর জন্য শুধু তাকেই চাই। তার মধ্যে মথুরাপুরের রাজা প্রসেনজিৎ কী দেখলেন তিনিই জানেন। এটা কি
চন্দ্রকান্ত ইদানীং সুরা প্রায় ছোঁয় না। বাস্তবিক যাদের নেশা থাকে তারা না খেয়ে পারে না। কিন্তু চন্দ্রকান্ত একদম না খেয়েও থাকতে পারে দিনের পর দিন। হয়ত এটা ওর সত্যিকারের নেশা ছিল না। আসলে সে নিজের মত হতে চেয়েছিল। সেই হতে না পারার বিদ্রোহটা তাকে বিনাশের পথে নিয়ে গেছিল। বাসবদত্তা বুঝেছিল সে চায় একটা আলাদা সম্মান এবং স্বীকৃতি যা তার বাপের কাছ থেকে পাওয়া নয়। তার একেবারে নিজস্ব। বাসবদত্তা তাকে গান ও নাচ শেখায়। সময়টা তার সঙ্গে নাচ ও গানের মধ্যে কোথা দিয়ে কেটে যায় টেরও পায় না। তবু এই মানুষটার ওপরে তার কোন অধিকার নেই, দাবি নেই। তার শুধু দেবার আছে, নেবার কিছু নেই। নিজের অজান্তে তার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। মাথার মধ্যে অদ্ভুত একটা বোবা ভাব। সব ভাবনা চিন্তা থেমে গেছে। কথা খেলছে না। অস্থিরভাবে ঘরময় পায়চারি করছিল। রাগে, ঈর্ষায় তার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছিল। বজ্রসেনের কাছে নটীর কথাটা শোনা থেকেই কেবলই মনে হচ্ছিল বিশাল একটা ঢেউ বুঝি তাকে নিষ্পিষ্ট করে দেবে। ঘরদোর ভাসিয়ে দেবে। যে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎই মনে হলে সর্ষে দানার মত পায়ের তলা থেকে কুলকুল করে তা সরে যাচ্ছে। চলন্ত বালির ওপর সে কিছুতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এইরকম একটা মনের সংকটময় মুহূর্তে চন্দ্রকান্তকে চোখের দেখা দেখতে না
পাওয়ার শুন্যতা । কতখানি বাসবদত্তা তীব্রভাবে অনুভব করল। তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। সে আর অপেক্ষা করতে পারছিল না। অতি স্পর্শকাতর মনটাই তাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছিল। তার অন্তরের তার সব যন্ত্রণার গভীর থেকে উৎসারিত হল চন্দ্রকান্ত আমার চন্দ্রকান্ত! তুমি নিষ্ঠুর হয়ো না। বড় ভয়ে ভয়ে থাকি। সব সময় হারানোর ভয় না পাওয়ার ভয় আমার মনটাকে আর্দ্র করে রাখে।
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো বাসবদত্তা আবার ব্যাকুল কণ্ঠে বলল: চন্দ্রকান্ত -অ। তুমি কি সত্যিই হারিয়ে যাবে বাসবদত্তার জীবন থেকে। তুমি গেলে বাসবদত্তা আর বাঁচবে না। কী নিয়ে থাকবে, কার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাবে? রাত এখন নিঝুম। আকাশ ভরা নক্ষত্র। দেবতা লক্ষ লক্ষ চোখ হয়ে জ্বলছে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় বন পাহাড় সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দূরে কোথাও মাদল বাজছে। মাদলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বনের মানুষরা মেয়েদের কোমর জড়িয়ে গান গাইছে, নৃতা করছে। গাছের মগডালে বসে থাকা একটা কাময়ূর ভাগে রাঙানো বন পাহাড়, নীল আকাশকে চমকে দিয়ে কর্কশ গলায় কেঁয়াকেঁয়া করে ডেকে উঠল। মৌন রাতের স্নিগ্ধ শাস্তি ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গেল তার হর্ষে। কোথা থেকে ছাইরঙা মেঘ উড়ে এসে তাদের কাছে পরতে পরতে জমতে লাগল। বিষাদের ছায়া নামল গাছগাছালির মাথায় মাথায়। ঘরে মন বসল না বাসবদত্তার। মুক্তির জন্য ছটফটিয়ে উঠল তার ভেতরটা। চাদের আলোর ভেসে যাওয়া চরাচর, বন-পাহাড়, নাচের গান, ময়ূরের ডাক, চমকানো রাত ভয় পাওয়া গাছের ফিসফিসানি, বুনো ফুলের গন্ধ, মহুয়ার মাতাল বাতাসে আধো আলো আধো ছায়ায় রহস্যে ভরা রাত তাকে ঘর থেকে ডেকে নিল। এমন মায়াবী রাতেই তার আজকের অভিসার। বাসবদত্তার মন বলছিল, প্রমোদ কাননে চন্দ্রকান্ত তার অপেক্ষায় ঘর বার করছে। স্বামীর দীপ ধরার তর সইল না। ভেতটা তার মহুয়ার মাতাল বাতাসের মতই আকুল হয়ে উঠেছিল। যার হাট করে খুলে রেখে সে একা প্রমোদ কাননের দিকে নূপুরের ঝমক ঝমক শব্দে রাতকে চমকে দিয়ে বনভূমিকে সচকিত করে, চাদের আলো গায়ে মেখে, মৃদু মন্থর বাতাসের একাই মথুরাপুরীর বিলম্বিত ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মরালের মত উড়ে চলল মহৎ ও উদার অনুভূতির রাজ্যে আশ্চর্য একটা আত্মপ্রসাদে আবিষ্ট হয়ে গেছে তার মন। আর সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল তার স্বপ্নের রাজপুত্র চন্দ্রাত্তর উজ্জ্বল তাদের মত স্নিগ্ধ মুখশ্রী। আকাশ বাতাস দিদিগন্ত আলোড়িত করে মধুপগুঞ্জনের মত কানের মধ্যে বাজছিল তার শান্ত, স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর। বাসবদত্তা! আমি স্বর্গ চিনি না। এই পৃথিবীটাই মানুষের ভালবাসার স্বর্ণ হয়ে যায়। স্বর্গ শুধু সুখের জন্য। দুঃখও যে মানুষকে অসাধারণ সুন্দর করে, স্বর্গের দেবতারা তা জানে না। তাই একটু বিচ্যুতি ঘটলেই অভিশাপ দেন। অর্থাৎ অনন্ত দুঃখভোগের যন্ত্রণা এবং পরিতাপের আগুনে পুড়ে পুড়ে তাকে খাঁটি হতে হয়। দেবতাদের অভিশাপ হল শুধরে নেয়ার ধরনের শাস্তি। এই শাস্তিটুকুও যে কত সুন্দর, কত প্রয়োজন তা দুঃখের মধ্যে নিজেকে না নিয়ে এলে অনুভব করা যায় না। জীবনও বোধ বা পূর্ণ হয় না। আমার আগের জীবন আর এই এখনকার জীবনযাপনের মধ্যে দুটো মস্ত বড় ভাগ। তুমিই আমাকে সেটা অনুভব করতে শিখিয়েছ। তোমার কাছে আমার একলা কোনদিন ফুরোবে না।
চন্দ্রকান্তর মুখে নিজের স্তুতি শোনার পর বিশেষ আনন্দে বাসবদত্তার ভেতরটা ভরে যাচ্ছিল। নীল সাগরের মত তার গভীর দুই চোখের ওপর চোখ রেখে তার গালের ওপর নিজের গাল রেখে গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে বাসবদত্তা বলেছিল প্রত্যেক মানুষকে ভগবান আলাদা আলাদা ভাবার মত মন দিয়েছেন বলেই মানুষ সেটা নিজের কাজে লাগায়। কিন্তু যাকে কলুর বলদের মত চোখ ঢেকে খানি ঘুরিয়ে সারা জীবন পিষে তেল বের করতে হয় তার কাছে কিন্তু স্বর্গ অনেক দামি। পৃথিবীর অন্য কিছু নয়, স্বর্গের সুখই চায়।
তুমি কি স্বর্গসুখের অভিলাষী? চন্দ্রকান্ত একটু আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেছিল তাকে। সব মানুষই চায় সুখে থাকতে। আনন্দ, বিলাস, বৈভব কার না ভাল লাগে? সাধ করে দুঃখে থাকতে চায় কে? বিপুল ভোগ সুখে মশগুল থাকার নামই স্বর্গসুখ। এই সুখের জন্য স্বর্গে যেতে হয়। না। এই মর্তলোকেই সেই স্বর্গ তৈরি করে মানুষ শান্তি, আরাম, সুখ খুঁজেছিল। কিন্তু একদিন তাতে ক্লান্তি এল। তখন সে নিজেই বিদ্রোহ করল নিজের বিরুদ্ধে। সুখ, আরাম, বিলাসের মধ্যে প্রেম মরে যায়, ভালবাসা শুকিয়ে যায়, মমতার অমৃতটুকুও নিজের অজান্তে গলাধঃকরণ করেছে। আমার নিজের জীবন দিয়ে তা অনুভব করেছি। তোমার মত দুঃখী মর্ত মানবীর বুকে ভালবাসার সুধা আছে এই বোধ, অনুভূতি স্বর্গের মানুষের বুকে জন্মায় না। মর্তের দুঃখী মানুষের বুকে জন্মায় বলেই এখানে সব অনিতা চায়।
প্রতিমুহূর্ত হারানোর ভয় থাকে বলেই ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরে সার্থক হয়ে উঠতে মর্তের জীবন বড় একঘেয়ে। দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থাকতে থাকতে একধরনের ভয় আমাকে ব্যাকুল করে। অভিশপ্ত দুঃখের জীবন থেকে মুক্ত হয়ে কবে যে স্বর্গ সুখে ফিরব, কিংবা আদৌ এজীবনে তার স্বাদ পাব কি না – কে জানে? চন্দ্রকান্ত দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে বাসবদত্তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। বলল : আশ্চর্য! মর্তের সব অমৃতটুকু আমাকে দিয়ে তুমি নতুন জীবন দিয়েছ, আর তুমি তার গরলটুকু নীলকন্ঠের মত একা গলাধকরণ করে বিষের জ্বালায় ছটফট করছ। বাসবদত্তা আমার স্বর্গসুখের সঙ্গে তোমার মর্তের দুঃখ বিনিময় করে নেবে? তোমাকে না পেলে আমার জানা হত না মর্ত কত সুন্দর। প্রেম, ভালবাসা, মমতা, দয়া, করুণা শুধু মর্তেই আছে।
শস্যের মত মর্তের মাটিতে ভালবাসা জন্মায়।
কি জানি? তোমার জীবন তোমার, আমার জীবন আমার। যার যার জীবনের ভারে চাপা পড়ে আছি।
তোমার জীবনে অনেক পুরুষ এসেছে, তারা তোমাকে ভালবেসে নতুন হয়ে উঠেছে। তোমার মনও রঙিন হয়েছে। তবু তুমি এত রিক্ত কেন? তোমার মন বলে এসব কথায় সে একই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল যে পথের ওপর তার নজর ছিল না। আনমনে হাঁটছিল। মথুরাপুরের প্রমোদ কাননের প্রাচীরের ধার দিয়ে চলার সময় হঠাৎই হোঁচট খেল। রীতের নীরবতা ভঙ্গ করে সব নুপুরগুলো একসঙ্গে বেতাল সত্যি কিছু নেই? সত্যিই তুমি স্বর্গেরই যোগ্য।
বেজে উঠল। মুহূর্তে একটা বিরাট বিশৃঙ্খল ঘটে গেল গেল। বাসবদত্তা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যেতে যেতে কোনও মতে সামনে নিল। অন্যমনস্কতার জগৎ থেকে বাস্তবে প্রত্যাবর্তন করে সে অনুভব করল মাটিতে শায়িত কোনো ঘুমন্ত মানুষের গায়ে না দেখে পা দিয়ে ফেলেছে। সেই ধাক্কায় লোকটিও ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল। বেশ একটু বিব্রত এবং ব্যক্ত হয়ে উৎকণ্ঠিত গলায় ব্যাকুল হয়ে বলল: আহা। বড্ড লেগেছে তাই না! সত্যি আমি কি যেন। গোটা পথটা জুড়ে শুয়ে আছি। শুভ্র চাদের আলোয় বাসবদত্তা দেখল মুণ্ডিতমস্তক এক সন্ন্যাসী তার শান্ত, সৌম্য শ্রীময় মুখের ওপর চাদের আলো পড়ে অপূর্ব লাগছিল তাকে। মনে হল তার শুদ্রপায়ে আকাশ থেকে এক অপার্থিব আলো এসে পড়েছে। নিকপ্লাবী জ্যোৎস্নার আলোর প্রাঙ্গণের মাঝখানে যেন এক জ্যোতির্ময় পুরুষ এসে দাঁড়িয়েছে স্বর্গলোকের বার্তা নিয়ে। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে বাসবদত্তার সারা অঙ্গে এর আশ্চর্য পুলকিত শিহরন খেলে গেল। অপ্রস্তুত বাসবদত্তা তৎক্ষণাৎ তার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে বলল ক্ষমা কর ওগো তরুণ তাপস। আমি ইচ্ছাকৃত করে কিছু করিনি। তবু হয়ে গেছে আমার অপরাধ। আমার চোখ দুটো পথের দিকে ছিল না, নিজেকে দেখতেই বিভোর ছিলাম। তাই বোধহয় তথাগত অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানে ফেরানোর জন্য আমাকে এতবড় শাস্তি দিল। ওগো সন্ন্যাসী না জেনে অপরাধ করেছি, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। বাসবদত্তার আচমকা স্পর্শে পাথর হয়ে বসে রইল সন্ন্যাসী। আড়ষ্টভাবেটা কেটে গেলে স্মিতহাসির আভাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখমণ্ডল মধুর গলায় বলল কল্যাণী, কোনো দোষ করনি। তথাগত তোমার মঙ্গল করুন। কী বেদনার্থ গম্ভীর সে কন্ঠস্বর। বাসবদত্তা সোজা হয়ে বসল। সন্ন্যাসীর চোখের ওপর চোখ রাখল। সন্ন্যাসীর সামান্য স্পর্শেই মনে হয় চারপাশের পৃথিবীটা মুহূর্তে বদলে গেছে। একজন নগরবন্ধুর জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে তা ভাবেনি কোনদিন। সন্ন্যাসী শ্রীপাদপদ্মে তার হাতখানি তখনও লেগে আছে। তার স্পর্শটা ভীষণ ভাল লাগছিল। মনে মনে বলছিল, এ তার পাপ হচ্ছে, কিন্তু পাপবোধের কোনও অপরাধবোধ কিংবা অনুশোচনা ছিল না তার। বরং সমস্ত মনটা দীন হয়ে সন্ন্যাসীর মাথা নুয়ে এল সন্ন্যাসীর পদতলে। রূপগর্বিতা বাসবদত্তার মনে হল সে কত তুজ কত দীন, কী অসহায়! চোখের কোল ফলে ভরে গেল। এরকম একটা অনুভূতি চেপে রাখা তার পক্ষে মুশকিল হল। আবেগ, ভাললাগা গোপন করতে সে অভ্যক্ত না। তাই কি ভেতরে এর অধীরতা? না, অন্য কোনও প্রত্যাশা আছে। সন্নাসীর কাছে কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? সুদাস মালীর মতই তার অবস্থা। ‘মুখে আর বাক্য নাহি সরে।
হাতে যদি সুদাসের মত পদ্ম থাকত তা হলে বাসবদত্তা তখনি তা সন্ন্যাসীর চরণপত্রে নিবেদন করে ধন্য হত। দীন নম্র হৃদয়ে ভিখিরির মত বলল আমাকে ক্ষমা কর। সামান্য দেবদাসী আমি। কিন্তু আজ সে আর বলতে পারল না। উদ্‌গত কান্নায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।
সন্ন্যাসী ক্ষমাসুন্দর চোখে বাসবদত্তার দিকে অপলক চেয়ে বলল: তথাগতের কাছে সকলেই মানুষ। সবাই অমৃতের পুত্র। কেউ পাপী নয়। শয়তানরা একজন সুন্দর মানুষকে অসুন্দর করে। তোমার ভেতর সুন্দরের মৃত্যু হয়নি। পাপ তোমাকে স্পর্শ করেনি। তুমি শুচিশুদ্ধা। তথাগতর করুণায় তুমি ধন্য হবে। প্রত্যেক মানুষকে নিজের মত হতে পারার, থাকতে পারার জন্য অনেক দাম দিতে হয়। প্রত্যেক মানুষের দুঃস্থ সে মানুষকে একা একাই বইতে হয়, তার জীবনপথে সে সত্যিই একা যাত্রী। সন্ন্যাসীর কথাগুলো দূরাগত মন্ত্রধ্বনির মত বাসবদত্তার কানে ধ্বনিত হতে লাগল পুলকে, গৌরবে, আনন্দে শরীর কণ্টকিত হতে লাগল। দুটো বড় বড় চোখে নিষ্পলক দৃষ্টি। কিন্তু বিস্ময় নয়। কেমন শূন্য। পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সন্ন্যাসী। শরীর যেন প্রাণহীন, সংজ্ঞাহীন। বাসবদত্তার ভেতরটা কেমন যেন মমতায় ভরে যেতে লাগল। মমতা হল গড়ানে জমি। আত্মগ্লানির প্রায়শ্চিত্ত করব।
তবু মনটা এক জায়গায় এসে আটকে গেল। নানা সংস্কার ভিতরে ভিতরে কাজ করছিল। আর একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় তার বুকটা টনটন করছিল। কিছুক্ষণ বিবশ হয়ে চেয়ে রইল। আপন মনে একটু মাথা নাড়ল। তারপর সসঙ্কোচে মায়াবী গলায় বলল : প্রভু, আপনার এই নবীন কোমল তনু ধূলিধূসরিত কঙ্করময় এই মাটিতে কতই না ক্লেশ অনুভব করছে। দয়া করে আমার গৃহে চলুন। নিজের হাতে পরিচর্যা করে আমার সব হঠাৎ আতঙ্ক মেশানো একটা অদ্ভুত ভরে সন্ন্যাসী বিচলিত বোধ করল। কিন্তু সে মুহূর্ত মাত্র। নটীর মমতা-মাখানো সরল আচরণে কৌতুকারিষ্ট হয়ে বলল : ভূমিশয্যাই সন্ন্যাসীর আদর্শ শয্যা। তোমার অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ। গৃহীর গৃহে সন্ন্যাসীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। সেবা করাই সন্ন্যাসীর ধর্ম, সেবা নেওয়া সন্ন্যাসীর পাপ। জেনেশুনে আমাকে তথাগতের কাছে অপরাধী কোর না। বাসবদত্তা মাথা নোয়াল। উত্তর দিতে বেশ একটু জড়তা দেখা গেল। কুণ্ঠিত হয়ে বলল : আমি ব্যভিচারী, পাপী বলেই আমার সংসর্গে আপনার আস্থা কম। রমণী হওয়া যদি অপরাধ হয়, তা হলে বিধাতা রমণী সৃষ্টি করলেন কেন? রমণীর সঙ্গ এবং সেবা যদি নিষিদ্ধ হয় তা হলে তথাগত সুজাতার পরমার গ্রহণ করে কী করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন? রমণীর সেবা, যত্ন, পরিচর্যা না পেলে হয়ত এ জীবনে বোধিলাভ হত না তাঁর। তার কথা শুনে সন্ন্যাসী হাসল। বলল, অন্ধকারে তুমি জ্যোতির্ময়ী দেবীমূর্তির মতই বলল করছ। তোমাকে ভয় করব কেন? কিন্তু এত রাতে পথের বাধাবিপত্তি ভয় অগ্রাহ্য করে যেখানে যাচ্ছ, সেখানে যেতে বিলম্ব হয়ে যাবে। এমন সুন্দর অভিসারের দিন জীবনে খুব কম পাবে। এ অভিসার পরাণবধুর সঙ্গে তোমার। প্রভুর কী লীলা !
বাসবদত্তা সন্ন্যাসীর কথায় আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল মহাম্মন আপনার আমি চলেছি প্রভুর সন্ধানে। ফিক করে হাসল বাসবদত্তা। আপনিও তা হলে অভিসারে বেরিয়েছেন। এক অর্থে আমারও অভিসার। পথটাই শুধু আমাদের আলাদা। তথাগতের কাছে
প্রার্থনা করি, তোমার দৃষ্টি উন্মোচিত হোক, তোমার কামনার পরিসমাপ্তি হোক। কথাগুলো বলা শেষ করে সন্ন্যাসী পুনরায় ভূমিশয্যা গ্রহণ করলেন। বাসবদত্তার বুকে দয়ার সাগর উথলে উঠল। বলল। প্রভু আপনার ধূলিমলিন এই ভূমিশয্যা আমি
সহ্য করতে পারছি না।
সন্ন্যাসী নির্লিপ্তভাবে বলল: তোমার উৎকণ্ঠার কোনও কারণ নেই। তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলে এভাবেই আমার নিশাবসান হত। এভাবে এ জীবনে অভ্যস্ত আমি।
তোমার বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আমার ঘুম পাচ্ছে। নিশ্চিন্ত মনে তোমার অভিসারে যাও। মুহূর্তেই সন্ন্যাসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হল।
বাসবদত্তা তখনও তার খুব কাছে বসেছিল। অথচ সন্ন্যাসীর এতটুকু প্রক্ষেপ নেই।
কী নিরু, কী কিপ মানুষ। রমণীর মধুর সঙ্গসুখ এবং সান্নিধ্যও তাকে বিচলিত করে না, আকর্ষণ করে না। তাই এত নিশ্চিন্তে সন্ন্যাসী ঘুমুতে পারছিল। রূপগর্বিতা রমণীর অহঙ্কারে আঘাত লাগল। নিজের রূপ-লাবণ্য, প্রসাধনকে ধিক্কার দিল। যে প্রসাধন একজন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে না, তার চিত্তকে চঞ্চল করে না, রুক্ষ্মণীর সে সাজের মূল্য কী? রমণীর সাজসজ্জা, অলঙ্করণ সবই তো পুরুষের নজর কাড়ার জন্য। পুরুষের কাঙাল দৃষ্টির স্পর্শ যদি তার সর্বাঙ্গে লেগে না থাকল প্রবলভাবে এবং
সর্বক্ষণ তার সত্তা দিয়ে যদি তা অনুভব না করল, শিহরিত না হল, যদি তাকে গর্বিত না করল, এক অদ্ভুত বাসবদত্তার।
অনুভূতিতে প্রশ্নে প্রশ্নে চমৎকৃত না করল, তা হলে সে সাজ তো অর্থহীন। সন্ন্যাসীর নিরুত্তাপ দৃষ্টিপাতে সেই কথাটাই বারংবার মনে হতে লাগল রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের তারাগুলো ফিকে হয়ে এল। বাতাস ঠাণ্ডা হল। ঝিঁঝির ডাকও নীরব হয়ে গেল। জোনাক পোকার আলোও নিতে গেছিল। সন্ন্যাসী কিন্তু গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গিয়ে নিরুদ্বেগে নাসিকা গর্জন করছিল। বাসবদত্তার এ এক অবিশ্বাস্য নতুন অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন বয়সের পুরুষের সান্নিধ্যে এসেছে সে। কিন্তু এমন নিরুত্তাপ পুরুষের সংস্রবে আসেনি। নিজেকে উজাড় করে দিতে যে রমণী আকুল, তাকে কোনও পুরুষ বিমুখ করতে পারে, এমন দুর্লভ পুরুষরত্নের সাক্ষাৎ সে পায়নি। মুনি-ঋষিরাও রূপসী রমণীর রূপ-যৌবনের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে সাধনা ও সিদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। এই তরুণ সন্ন্যাসী তাদের মত নয় ভুলেই তার প্রতি এক দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করল বাসবদত্তা। মানুষের স্বভাবই হল যা দুর্লভ অনায়ত্ত, তাকেই সে জয় করতে চায়। বাসবদত্তারও খুব ইচ্ছে হল, সন্ন্যাসীর সংযমের লৌহকঠিন দৃঢ়তা, এবং রাত্রির মত নির্বিকার নির্লিপ্ততার বাঁধ ভেঙে তার আব্বাকে সে একবার দেখবে। অপমানহত মনের জ্বালা প্রশমিত করার জন্য বাসবদত্তার ভিতরটা নির্ঝর হয়ে উঠল।
সহসা রাতের নীরবতা ভঙ্গ করে পায়ের পুকুর জলতরঙ্গের মত বেজে উঠল। ঘুম ভেঙে গেল সন্ন্যাসীর। তন্দ্রাकডিমা গলায় বলল যেথায় চলেছ যাও তুমি ধনি, সময় যেদিন আসিবে, আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে। ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত ক্ষিপ্ত আক্রোশে বলল থাম তুমি। বড় আত্মত্যাগ, প্রভা, বিশ্বাস, সংযম, প্রেম, মমতা, সেবা করার মনোবৃত্তি ছাড়া সন্ন্যাসী হওয়া যায় না।
সন্ন্যাস মুখের কথায় হয় না। বিনীত বাক্যে তোমার অহস্তার, উচ্চতা, আত্মগর্ব গোপন নেই। নিজের ওপর তোমার আস্থা অতি সামান্য বলেই অন্যের বিশ্বস্ততার প্রতি তোমার সন্দেহ। যে মানুষ নিজেকে শ্রদ্ধা করতে শেখেনি, সে অন্যকে শ্রদ্ধা করবে
কোথা থেকে? পাছে নগরবন্ধুর গৃহে গেলে বুকে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে; তাই তাতে ঘুমায়, অবহেলার অবস্থায় পরিহার করছে। আসলে নিজের চরিত্রের ওপর ভরসা ও বিশ্বাস কম বলেই স্বেচ্ছাচারী হওয়ার ভয় পাও। কিন্তু নারী কী শুধুই কামিনী? এই কামিনীর মধ্যে তো জননীও রয়েছে। সব নারীকে শ্রদ্ধা করতে শেখ সন্ন্যাসী। শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের ভক্তির পাত্রে বহুভোগ্যা, ইন্দ্রের বাঞ্ছিতা, রূপসী ঊর্বশী অর্জুনের শ্রদ্ধা-ভক্তির শতদলে জননী উবর্ণীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠে যাবতীয় মানুষের সম্পর্ক। সেই অগ্নিপরীক্ষা করতে তথাগত তোমার আমার এই সাক্ষাৎ ঘটালেন। কিন্তু দুর্বলচিত্ত পুরুষের মত হেরে যাওয়ার ভয়ে জীবনের কঠিন কঠোর বাস্তব পরীক্ষা এড়িয়ে নিজেকে যথার্থ একজন দুর্বলতাকে।
সিদ্ধ সন্ন্যাসী বলে ভাবতে পার কি? ধিক তোমার কাপুরষতাকে, ধিক তোমার বাসবদত্তার আকস্মিক তীব্র ভর্ৎসনা এবং কত বাক্যে সন্ন্যাসীর আত্মসম্বরণ করতে কিছুটা সময় লাগল। তদ্ৰাজড়িত নিদ্রালু চোখ দুটো শেষ রাত্রির আকাশে অন্তমান
চাদের দিকে ভাসিয়ে দিয়ে গভীর চৈতন্যের ভেতর মগ্ন হয়ে বসে রইল। তন্দ্রাচ্ছন্নের মত ছাড়া ছাড়া গলায় বলল ভেতর থেকে সাড়া না পেলে আমি কিছু করতে পারি না। আমার তথাগতের সব নির্দেশ যে সেখান থেকেই আসে। মানুষের জাগ্রত বিবেক, চৈতন্য তো তিনিই। তথাগতের কঠিন পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হয়ে গেছি। শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সম্পর্কের একটা মাত্রা থাকে সুন্দরী। সেই মাত্রা অতিক্রম করলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সুন্দর, মধুর সম্পর্কও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। আমি সীমারেখাটুকু অতিক্রম
করিনি বলেই তুমি আমাকে শ্রদ্ধা করবে, বিশ্বাস করবে।
বাসবদত্তার সব কথা হারিয়ে যায়। লজ্জায়, অপমানে দুই করতলে লুকিয়ে ভাবতে লাগল । হায়রে এ কী মানুষ। এ কী বিশ্রম হল তার সন্ন্যাসীকে পরীক্ষা করতে গিয়ে এ কী পাপ করল। বাসবদত্তা বেশ একটু ভীত হয়ে পড়ল। বিপন্ন মানুষের মত অসহায় গলায় অস্ফুটস্বরে বলল প্রভু, তবে কি কোনও অপরাধ হল আমার ?
সন্ন্যাসী নির্লিপ্তভাবে বলল। তা তো জানি না। তবে আমার কাছে তুমি কোনও অপরাধ করনি। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, কারও কাছে আমার একটা অপরাধ হয়ে গেছে। তিনি কে? তথাগত জানেন। তোমার ঘুম ভাঙিয়ে অসন্তোষ উৎপাদনের যে চেষ্টা আমি করেছি। সেও তা হলে আমার ভিতর নিয়ে তোমার তথাগতই করেছেন।
জানি না । তা হলে তুমি আমাকে ‘না’ বলে ফিরিয়ে দিও না। আমার গৃহে চল। বাকি রাতটা—বাসবদত্তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সন্ন্যাসী পুনরায় বলল সময় যেদিন আসিবে, আপনি যাইব তোমার কৃষ্ণে। তুমি এখন যেখায় চলেছ, যেখানেও যাও। প্রেমাস্পদ তোমার প্রতীক্ষা করছে। সময় হলেই আমি তোমার কাছে যাব।
কিন্তু কবে সে সময় হবে?
ঠিক সময়ে ঠিক মুহূর্তেই তথাগত তোমার দুয়ারে যেতে নির্দেশ দেবেন। যতদিন সে নির্দেশ না আসছে, ততদিন তো তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে সুন্দরী। এবার খুশি বাসবদত্তা গৃহে ফিরল ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে। মনে হল, এক রাত্রিতে তার ওপর
তোমার ঘরে যাও দিয়ে বিশাল ঝড় বয়ে গেছে। তার কিছুই ভাল লাগল না। শুভ্র ফেনসিভ কোমল শয্যার ওপর দেহটা এলিয়ে দিয়ে সে দূরে বহুদুরে দিগন্তরেখায় আঁকা পাহাড়মালার দিকে চোখ দুটো ছড়িয়ে দিয়ে কেমন স্বপ্নাচ্ছন্নের মত ছাড়া ছাড়া গলায় বলল জানিস মনিকা, সন্ন্যাসী মিথ্যে বলেনি কিছু। আমার মন বলছে একদিন সে আসবে। আমার বন্ধ ঘরের দরজা সে খুলে দিয়েছে। চারদিক থেকে অফুরন্ত আলো-হাওয়ায় আমার ঘর ভরে গেছে। মুক্তির আনন্দে বুকখানা আমার খোলা আকাশের মতই বিরাট হয়ে গেছে। আমি নীল আকাশের অনন্ত মাধুরী পান করে আকাশগঙ্গায় ভাসছি।
মদনিকা হতভম্ব হয়ে বাসবদত্তার দিকে তাকিয়ে হাসল। মজা করার জন্য বলল করেছিলে, তাই না?
এখনও ঘোর কাটেনি। কাল রাতে খুব নেশা মহৎ, উপর, পবিত্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার সমস্ত চেতনা। আর তীব্র বাসবদত্তা ওর কথায় চমকে তাকাল। বলল হ্যারে নেশায় পেয়েছে। মুহূর্তে একটা একটা আবেগে তার বুকের ভেতরে কান্নার সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল। মদনিকার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে শিশুর মত ডুকরে কেঁদে উঠল। কান্না-বিজড়িত গলায় বলল মদনিকা এই ঘেন্নার জীবনটা আর বয়ে বেড়াতে পারছি না। অনেক পাপ করেছি।
এবার প্রায়শ্চিত করতে হবে বোন। বাঁচার লড়াইতে হেরে গেছি। সন্ন্যাসীও জানে না হেরে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড় জেতা।
বাসবদত্তা সত্যিই অন্যরকম হয়ে গেল। রকমটা ঠিক কী মদনিকা ব্যাখ্যা করতে পারে না। নিশিদিন বুদ্ধের মূর্তির সামনে নিশ্চল হয়ে বসে থাকে। তার কোনও বাহ্যজ্ঞান থাকে না। ডাকলে সাড়া মেলে না। খেতে দিলে যায়, না দিলে খায় না।
নিজের মনে কেবলই বিড়বিড় করে বলে, আমার মন বলছে সোনার বরন তরুণ সন্ন্যাসী আসছে। আমি তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
মদনিকা অসহিষ্ণু হয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল তোমার কী হয়েছে বল তো? মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। সারাদিন বিড়বিড় করে কী বল?
বাসবদত্তা ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে কথা এই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা না হলে কোথায় পেতাম আমার সুখের অনুভূতি? তাঁর ছোঁয়ায় আমার নবজন্ম হল। সন্ন্যাসী তো বলল ভেতরের মানুষটাকে চোখে মেলে দেখ একবার। সারাজীবন কি ছদ্মবেশ পরে কাটিয়ে দেওয়া যায়। তারপর থেকে শুধুই মনে হয়, আমি অন্য এক নারীচরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছি।
মদনিকা রাগ করে বলল । বুঝি না বাপু, তুমি কী করতে চাও? সব ছেড়ে-ছুঁড়ে যোগিনী হয়ে বসে থাকলে পেট শুনবে? খদ্দের না এলে খাবে কী? এমনিতে অযত্নে অবহেলায় কী করেছ শরীরটা, আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখ একবার? তোমার দিকে তাকলে
কান্না পায়।
বাসবদত্তার কণ্ঠ থেকে তৎক্ষণাৎ স্বতস্ফুর্তভাবে গান উৎসারিত হল। আয় আয় আমার কাছে/সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ। প্রতিদিন কাঁদিবি কেবল/একদিন নয় হাসিবি তোরা / একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে যদি মিলিয়া
গাহিব মোরা।
মদনিকার রাগ হয়। রাগে গজর গঞ্জর করে বলল আদিখ্যেতা ভাল লাগে না। বেশ্যার আবার সাধ হয়েছে সন্ন্যাসিনী হতে। কথাটা বাসবদত্তার বুক চিরে ফানা ফানা করে দিল। উদ্‌গত কষ্ট চট করে লুকিয়ে ফেলে বলল : বেশ্যা হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। এই নিয়া তাকে বেশ্যা করে। বেশ্যাবৃত্তি পাপ কিন্তু বেশ্যা পাপী নয়। আমি শুধু পাপ থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করছি।
বেশ কয়েকটা ঋতু ঘুরে বসন্ত এল। নানা তীর্থ পর্যটন করে সন্ন্যাসী সেই প্রমোদ কাননের চত্বরে এসে বসেছেন। বকুল ফুলের গন্ধে ভরে আছে জায়গাটা। বনফুলের গন্ধের সঙ্গে রাতের গন্ধ, মাটির গন্ধ মিশে গেছে। রাত বটে। কিন্তু ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না কোথাও কোনও অন্ধকার নেই। কেবল গাছগাছালির নিচেই যা একটু আঁধার।
পৃথিবীময় নরম চাদের আলো। কেবল চন্দ্রকান্তর প্রমোদগৃহই অন্ধকার। কেন? তবে কি বাসবদত্তা এসব ছেড়ে অন্য কোথাও গেছে? কিন্তু কেন?
প্রশ্নটা করে নিজেই চমকাল। বড় অপরাধী লাগল নিজেকে। বাসবদত্তার সেদিনের প্রশ্নটা আজও মনে আছে তার। প্রবৃত্তি যদি মারের মারণাস্ত হয়, মারের রূপ হয়, তা হলে এই শয়তানের স্রষ্টা কে? যিনি এই ভুবনের স্রষ্টা তিনিই সব শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রবৃত্তিগুলোকে সৃষ্টি করে থাকেন, তা হলে এই প্রবৃত্তিকে এত ভয় পাওয়ার কী আছে?
প্রবৃত্তিবেগ না থাকলে ঈশ্বরের ভুবন রসাতলে যেত। তা হলে এর প্রতি সন্ন্যাসীর এত অশ্রদ্ধা কেন? বাসবদত্তার এই প্রশ্নের জবাব আজও সন্ন্যাসী জানা নেই। অনিয়ন্ত্রিত প্রযুত্তিকা অসুস্থতার লক্ষণ। তাই বোধহয় বারবধূ বাসবদত্তাকে ভয় পেয়েছিল সেদিন।
অশান্ত মনকে শান্ত করতেই তীর্থে তীর্থে ঘুরল। সবই মায়া মনে হল।
চিন্তার বোঝাটা মস্তিষ্ক থেকে নামাতে পেরে সে একটু স্বস্তি বোধ করল। নিদ্রা যাওয়ার জন্য পাযাগ চত্তরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। কিরকিরে বাতাসে টুপটাপ করে কয়েকটা বকুল ঝরে পড়ল সন্ন্যাসীর গায়ে। খুব যত্ন করে কুড়িয়ে নিয়ে বুক ভরে যা নিল। মুঠিবদ্ধ বকুলের দিকে চেয়ে নিজের মনেই বলল ‘এই বকুল যদি মায়া হয়,তবে কার প্রতিচ্ছায়া? শুনোর কিন্তু শুনোর তো আকার নেই? প্রশ্নটা করে নিজেই তার জবাব দিল, আকাশও শূন্য, কোনও কিছুর প্রতিফলন নয়, তবু নীল বলে প্রতীয়মান হয়। এ মায়া হলেও বাহ্যত আকারহীন নয়। বকুল তো দৃশ্যমান বস্তু, তাই এর রূপ প্রতিফলিত হচ্ছে। তা হলে এর একটা সত্যবস্তু থাকবে কোথাও। তেমনি আমি ব্যক্তি মানুষটি যদি প্রতিবিম্ব মাত্র হই তা হলে কোথাও একটা সত্যকারের আমি আছে। সেই আমিটাকে বাসবদত্তা চিনিয়ে দিল আমার। ঋণ রয়ে গেল।
নটী হলেও তার কাছে কিছু এরকম একটা চিন্তার সন্ন্যাসী বা হঠাৎই দেখল আধো অন্ধকারে কয়েকজন লোক ধরাধরি করে কাকে রাস্তার ধারে শুইয়ে রেখে চলে গেল।
সন্ন্যাসীর চোখে তখন তন্দ্রা নেমেছিল। দু চোখের পাতা একটু একটু করে বুজে আসছিল। আর সে তন্দ্রার মধ্যে শুনতে পাচ্ছিল, একটা নারী যেন অন্ধকারে কাতরাচ্ছে। তার কণ্ঠ থেকে ক্ষীণ আওয়াজ দুরাগত সঙ্গীতের সুরের মত কানের পর্দায় আঘাত করছিল। কিন্তু ঘুম-জড়ানো দু’চোখের পাতা কিছুতেই খুলতে পারছিল না। হঠাৎই মরিয়া হয়ে নারী পাগলের মত চেঁচাতে লাগল – শেয়ালে খেয়ে ফেলল গো, বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও ভাগ, যা যা – হায় ভগবান শেষকালে শেয়ালে ছিঁড়ে খাবে?
তথাগত আমায় বাঁচাও, নিষ্ঠুর হয়ো না। সমস্ত শক্তি কণ্ঠে পুঞ্জীভূত করে ভাঙা গলায় কাদতে কাদতে বলল। সন্ন্যাসী তুমি ফিরে জায়গায়। সেই সময় আর কবে হবে?
আসবে বলেছিলে ঠিক সময়ে ঠিক শেয়ালগুলো আমাকে ঘিরে বসেছে। অসহায়ের মত মোটা গলায় কम লাগল।
সন্ত্রাসীর ঘুম ছুটে গেল। তৎক্ষণাৎ ভূমি থেকে গারোস্থান করে সে রমণীকে শেয়ালের মুখ থেকে রক্ষা করার জন্য হেই হেই করতে করতে দৌড়ে গেল। রমণী তখন সংজ্ঞাহীন। তাদের স্নিগ্ধ আলোয় তাকে দেখে সন্ন্যাসী চিনল। আশ্চর্য হল মাত্র কটা ঋতুর ভেতর তার সেই রূপের একী হাল হয়েছে? মায়ায়, দয়ার, করুণায়, মমতায় তার ভেতরটা গলে গলে পড়তে লাগল।
শিয়রের ধারে বসে সন্ন্যাসী মাথাটা কোলে তুলে নিল পরম যত্নে। বিশ্বস্ত কালো চুলে ঢেকে যাওয়া মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল আমি এসেছি বাসবদত্তা।
অমনি মনে হল রমণী খলখল করে হেসে উঠল তার সেই অট্টহাস্য লক্ষ কলরোল। হয়ে যেন আকাশে বাতাসে প্রবলভাবে বেজে উঠল। সংজ্ঞাহীন মুদ্রিত চোখে মুখে তার একটা প্রসন্ন পরিতৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল। মৃদু মৃদু হাসছে যেন বাসবদত্তা। খুব কষ্ট করেই বলল : সন্ন্যাসী, তোমার বিশ্বাসের কাছে হেরে গেলে তো দয়া, মায়া, করুণা, তিতিক্ষা এই সব হৃদয়বৃত্তি মায়া হলেও মার নয় – এগুলি পরিত্যাজ্য হয় না।
হাদয়বৃত্তি যদি পরিত্যাজ্য না হয়, তা হলে প্রেমের মত সুন্দর জিনিস, কামের মত স্বতস্ফূর্ত স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবেগ দেহ মনকে যা সুস্থ ও সবল রাখে, জীবের বংশবৃদ্ধি ঘটায়, প্রাণধারাকে চিরপ্রবহমান রাখে তা কেন পরিত্যাজ্য হবে। বাসবদত্তার সেই
কঠিন প্রশ্নের কোনও সদুত্তর সন্ন্যাসী সেদিন নিতে পারেনি। তার কাছ থেকে পালিয়ে আত্মগ্লানিতে সে শুধু দগ্ধ হয়েছে। মনে হল, আজ তার জবাব দেওয়ার দিন যাওয়ার এসেছে বসন্তের গুটিকা।

সংজ্ঞাহীন বাসবদত্তার সারা শরীর প্রচণ্ড তাপে পুড়ে যাচ্ছিল। সারা গায়ে তার সন্ন্যাসী নির্ভয়ে তার পাশে বসে পরম মমতার সারা অঙ্গে শীতল জলের প্রলেপ মাখিয়ে দিল। মুখে জনের ছিটে দিল। অনুশোচনায় তার বুক তোলপাড় করছিল। সপ্রেমে নিরুচ্চারে বলল বাসবদত্তা আমি হেরে গেছি। নবজীবনের অভিসারে তোমাকে আমি নতুন করে পেলাম। এ পাওয়া কোনওদিন ফুরোবে না আমার।