শাহরাজাদ বলতে শুরু করে:
এক সময় এক নামজাদ সওদাগর ছিলো-তার নাম আয়ুব। আয়ুবের দুটি সন্তান। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলেটির নাম ঘানিম। আর মেয়ের নাম ফিৎনা। দুজনেই দেখতে শুনতে বড় চমৎকার। যেমন তাদের ধবধবে ফর্সা গায়ের রং তেমনি তাদের চাঁদপনা গড়ন। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
এমন সময় রাত্রি ভোর হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
সাঁইত্রিশতম রজনীর দ্বিতীয় প্রহরে আবার সে বলতে শুরু করে :
ছেলে মেয়েদের জন্যে বিশাল বিষয় সম্পত্তি রেখে আয়ুব একদিন মারা গেলো। দুই ভাই বোন দেখলো, একশো গাঁট সিন্ধের কারুকার্যকরা মূল্যবান কাপড় আর একশো বয়াম গুলাবের নির্যাস। এগুলো সবই বাগদাদে পাঠাবার জন্যে বাধা-ছাঁদা হয়ে গিয়েছিলো। সেখানকার বাজারে বিক্রি করা হবে-এই ছিলো উদ্দেশ্য। কিন্তু আয়ুব তার এই অর্ধসমাপ্ত কাজটুকু আর শেষ করে যেতে পারলো না।
তরুণ ঘানিম ঠিক করলো, বাগদাদে যাবে। বাবার ব্যবসাই মন দিয়ে করবে। বাগদাদে বাবার বহুকালের ব্যবসা। ওখানে বাবার বহু চেনাজানা আছে। নিজের পরিচয় দিয়ে সামনে দাঁড়ালে সকলেই সাধ্য মতো সাহায্য করবে-এই ভরসায় মা ও বোনকে রেখে একদিন বাগদাদের পথে রওনা হয়ে গেলো সে।
বাগদাদে এসে সব আগে সে একখানাবাড়ি ভাড়া নিলো। শোবার ঘরখানা বেশ ঝকঝকে তকতকে। দামী আসবাবপত্রে সাজানো গোছানো। সঙ্গে লাগোয়া গুদোমঘরটা বেশ বড়সড়। উটের পিঠ থেকে নামিয়ে ঘরে ভরলো মালগুলো। তারপর তালাচাবি বন্ধ করে শহর পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়লো ঘানিম। শহরের যে যে অঞ্চলে বড় বড় দোকানপাট আছে, ঘুরে ঘুরে দেখলো। সবারই সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ পরিচয় করলো। তার বাবার পরিচয় দিতে অনেকেই বেশ খাতির যত্ন করলো। সবারই কাছে তার বাসার ঠিকানাপত্র রেখে এলো। উদ্দেশ্য, যার প্রয়োজন বাসাতে এসেও মালপত্র দেখেশুনে সওদা করে নিয়ে যেতে পারে।
পরদিন সকালে খানদশেক শৌখিন কাজ করা সিস্কের থান নিয়ে সে বাজারে এলো। বাহারী কাজ দেখে প্রথম দোকানদারই পছন্দ করে কিনে নিলো। ঘানিম দেখলো প্রতি থানে দু দিনার লাভ পেয়েছে সে। পরদিনও আবার কয়েকটা থান নিয়ে বাজারে গেলো। সেগুলোও চটপট বিক্রি হয়ে যায়।
এইভাবে একটা বছর কেটে গেলো। ঘানিমের কাপড়ও যেমন বাজারের সেরা, তেমনি তার গুলাবের নির্যােসও ষোলআনা খাঁটি। কোন মালই পড়ে থাকলো না। এক এক করে সব বিক্রি হতে লাগলো। এবং ভালো লাভ দিয়েই বিক্রি হলো।
একদিন বিকেলে বাজারে গিয়ে ঘানিম দেখলো, সব দোকানপাট বন্ধ। এমন কি বাজারে ঢোকার সদর ফটকটাও তালা দেওয়া। কি ব্যাপার, কিছুই বুঝতে পারে না সে। আজ তো কোন পরবের দিন না। তবে? তবে কেন সব বন্ধ! একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করতে বললো, বাজারের খুব নামজাদা এক দোকানের মালিক মারা গেছেন আজ। তাকে নিয়ে সবাই মিলে মিছিল করে গেছে গোরস্থানে। ঘানিম ভাবলো, তারও যাওয়া উচিত। কারণ ব্যবসাদারদের এই সব সৌজন্য খুব দরকার।
গোরস্থানের পথে দ্রুত হেঁটে চললো সে। কিছু দূর যেতেই দেখলো, বড় মসজিদের সামনে নামানো হয়েছে মৃতদেহটা। একটু পরে প্রার্থনা শেষ হলে আবার উঠানো হলো শব। ঘানিমকে পেয়ে দোকানদাররা খুব খুশি হলো। বিদেশী হয়েও সে তাদের কাজের সময় এসেছে।
কবর দেওয়া শেষ হতে অনেক রাত হয়ে গেলো! ঘানিমের। ভয় করতে লাগলো। বাসাতে তার দ্বিতীয় কোন লোক নাই। অথচ চোর ডাকতের উপদ্রব্য যথেষ্টই আছে। যদি তার ঘরের তালা ভেঙে চুরি করে নিয়ে যায় সব মালপত্র। ঘানিম দ্রুত পা চালিয়ে বাসার দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু কিছু দূরে গিয়ে আর এগোতে সাহস পায় না। সামনে একটা বান্দাবন পেরুতে হবে। শেয়াল, পেচা, হোদল প্রভৃতি নানারকম জন্তুজানোয়ারের ডাক শুনতে পেলো। ঘানিম দাঁড়িয়ে পড়ে; অচেনা অজানা জায়গা। রাতের বেলায় এদিকে সে কখনও আসেনি। না জানি কোন বাঘ ভালুকের আস্তানায় গিয়ে পড়বে সে। দারুণ ভয় করতে লাগলো তার। এখন সে কি করবে? কী করে পৌঁছবে তার বাসায়? আর তাছাড়া যাবেই বা কোথায়? কালো লম্বা মতো কি একটা বস্তু যেনো তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ঘানিম। ভয়ে একপা একপা করে পিছু হটতে থাকে। তারপর পিছন ফিরে চোঁ দৌড়। দৌড়ে যে কোথায় যাবে তার হদিস জানা নাই। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবেই দীেড়তে দৌড়তে এক সময় একটা ছোট্ট গোরস্থানে এসে ঢুকে পড়ে। একটু আগে সে তার মালপত্রের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছিলো। এখন কিন্তু সে-সব চিন্তাভাবনা উবে গেছে। আপন প্ৰাণ বাঁচানোর সমস্যাই এখন সবচেয়ে বড় তার কাছে।
কোন এক বড়লোক পরিবারের ব্যক্তিগত সমাধিক্ষেত্র। গুটি কয়েক মাত্র কবর। মাঝখানে বেশ বড় রকমের একটা গম্বুজ। পাশেই একটা নারকেল গাছ। আর এ পাশে শান বাঁধানো একটা চবুতরা। ঘানিম রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেবে বলে চবুতরার উপরে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম আসে না কিছুতেই। উঠে গিয়ে ফটকের দরজাটা বন্ধ করে এসে আবার শুয়ে পড়ে। তবু ঘুম আসে না। একটু পরে দেখতে পেলো, একটা লণ্ঠনের আলো শহরের প্রধান ফটক ছাড়িয়ে ক্রমশ ঘানিমের দিকেই আসছে। ভয়ে শিউরে উঠে সে। কি করবে। কোথায় লুকোবে ভেবে পেলো না। এখন যদি দরজা খুলে বাইরে পালাতে যায়, নিৰ্ঘাৎ ধরা পড়ে যাবে ওদের হাতে। উপায়ন্তর না দেখে নারকেল গাছ বেয়ে উপরে একেবারে মাথায় উঠে গেলো সে। আলো আরো নিকটবতীর্ণ হলে গাছের মাথায় বসে ঘানিম দেখলো, তিনটি নিগ্রো। একেবারে দৈত্যের মতো দেখতে। একটা বিরাট বড় বাক্স দুজনে মাথায় করে বয়ে আনছে। আর একজনের হাতে একটা লণ্ঠন আর একখানা কোদল। ফটকের সামনে এসে লণ্ঠনটা উঁচু করে তুলে ধরে একটা নিগ্রো আশ্চর্য হয়ে বললো, কী ব্যাপার, সবাব। সন্ধ্যাবেলা আমরা দেখে গেলাম দরজা খোলা। আর এর মধ্যে ভিতর থেকে বন্ধ করলে কে?
সবাব জবাব দিলো, তাই তো, আমার মনে হচ্ছে, কাফুর ভিতরে লোক আছে।
তৃতীয় নিগ্রোটার নাম বুখাইৎ। বললো, তোমাদের যেমন বুদ্ধি! মালিক দরজা খুলে রেখে দেবে তোমাদের? আর তোমরা এসে দিব্যি মর্যাটা তুলে ফলার করো আর কি?
অপর দু’জন বলে, দুর্থাৎ, আবোলতাবোল বকছিস খালি। মালিকের খেয়েদেয়ে কাজ নাই সে এই গোরস্থানের দরজা বন্ধ করতে আসবে।
বুখাইৎ বলে, বিশ্বাস না হয় ভিতরে ঢুকে দেখো, নিশ্চয়ই কেউ পাহারায় আছে! আর এও ঠিক আমাদের হাতের আলো দেখার পর সে নারকেল গাছের মাথায় উঠে লুকিয়ে পড়েছে।
ঘানিম ভাবলো আর কোন বাঁচার উপায় নাই। এখুনি ওরা ভিতরে ঢুকবে। নারকেল গাছে উঠে তাকেহিড়ী হিড় করে টেনে নামাবে। তারপর? তারপর আর ভাবতে পারে না সে। ঐ তিনটি সুদানী নিগ্রোর হাতে তার জানটা আজ যাবে। একমাত্র আল্লাই ভরসা। তিনি ছাড়া আর কেউই বাঁচাতে পারবে না।
দুই নিগ্রো সবাবকে বোঝাবার চেষ্টা করলো, সবাব তুই দেওয়ালটা টপকে ওপারে গিয়ে দরজা খুলে দে। তোকে সবচেয়ে চর্বিওলা মাংসগুলো দেবো।
সবাব বললো, আমাকে কি তোমরা এতোই হাঁদা পেয়েছো? তার চেয়ে এসো একসাথে মিলে বাক্সটাকে দেওয়ালের মাথায় তুলে ওপারে ফেলে দিই।
কিন্তু অন্যজন রাজি হলো না।–না না সে হয় না। বাক্সটাই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
সবাব মাথা নাড়ে, তা ভাঙ্গতেও পারে বটে। আবার ওদিকটাও ভাবো। আমরা হয়তো ভেতরে ঢুকে দেখলাম আর এক মস্তান তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে আমাদের জন্যেই বসে আছে। তখন তাদেরও ভাগ দিতে হবে।
—তুই একটা আস্ত গাধা। যত সব বিদঘুটে কল্পনা—
ওরা দুজনে দেওয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে ফটক খুলে দিলো। সবাব আলো দেখালো আর ওরা দু’জনে বাক্সটাকে টেনে ভিতরে ঢুকিয়ে আবার দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
একজন হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, কি শালা লম্বা পথ, ফুরাতে আর চায় না।
বোঝা গেলো অনেকটা পথ বাক্সটা বয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। তারপর কসরৎ করে দেওয়াল টপকে ভিতরে ঢুকেছে। তাই তাদের হাঁপ ধরে গেছে। একজন বললে, দাঁড়াও আগে একটু জিরিয়ে নিই। তারপর গর্ত খোঁড়া যাবে ‘খান! এখন সবে মাঝ রাত্তির। সকাল হতে ঢের বাকী।
আর একজন বললো, তা এই মাঝ রাতে শুয়ে শুয়ে তো আর জিরোনো ঠিক হবে না। শালা ঘুমিয়ে পড়লেই চিক্তির। এক্কেবারে সকাল হয়ে যাবে।
আর একজন বললে তার চেয়ে গল্প বলো, নিজের নিজের খোজা হবার কাহিনী এসে বলি আমরা তিনজন। তাতে আয়েসও হবে, গল্পও শোনা যাবে-অথচ ঘুমও আসবে না।
বাকী দুজনে সায় দিয়ে বললো, খুব ভালো বলেছো। আজ আমরা নিজের নিজের কাহিনী বলবো। কি করে আমরা খোজা হলাম। সেই কাহিনী।
এই সময় শাহরাজাদ দেখলো, রাত্রি প্রায় শেষ। গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে!
আটত্রিশতম রজনী।
শাহরাজাদ আবার কাহিনী শুরু করে। সেই তিনজন সুদানী নিগ্রো তাদের খোজা হওয়ার কাহিনী বলবে বলে ঠিক করলো। প্রথমে শুরু করে সবাব।
নিগ্রো সাবাবের খোজা হওয়ার কিস্সা
আমার তখন বয়স মাত্র পাঁচ। সেই সময় বাগদাদের বাজারে এনে বিক্রি করে দিয়ে যায় আমার মা-বাবা। সুলতানের প্রাসাদের দ্বাররক্ষী আমাকে কিনে নিয়েছিলো। তার নিজের একটি তিন বছরের মেয়ে ছিলো। আমি যেমন ঘরদোরের কাজ করতাম, তেমনি তার খেলার সাখীও ছিলাম আমিই। আমি তাকে গান শোনাতাম, নাচ করতাম, মজার মজার গল্প করতাম। মোট কথা সে ছিলো আমার নিত্য সহচরী।
এইভাবে আমার বয়স যখন বারো, তখন ওর দশ। একদিন আমি একটা বাগানে নির্জন নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে গুলতি দিয়ে পাখী তাক করছিলাম। এমন সময় মেয়েটি এসে পিছন থেকে আমার চোখ চেপে ধরলো। আমি তখুনি বুঝেছি। কিন্তু না বোঝার ভান করে ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম, কে?
কিন্তু মেয়েটা জবাব দেয় না। আমার পিঠের সঙ্গে ওর বুকটা আরও সেঁটে আরও শক্ত করে চেপে ধরে আমার চোখ দু’টো। আমি ওর সারা হাত দু’টো বাহু পর্যন্ত হাত বুলাতে থাকি। কি নরম আর মসৃন সুডৌল ওর বাহু। সদ্য উকি দেওয়া তার ছোট্ট স্তন দুটোর স্পর্শ আমি স্পস্ট অনুভব করতে লাগলাম। সে আরও জোরে আমার পিঠে চাপ দিল। বুঝলাম, তার স্তন দুটো আমার পিঠের চাপে পিস্ট হওয়াতে সে মনে মনে রোমাঞ্চ অনুভব করছে। আমার পিঠে ওর বুকের ছোট ছোট স্তন দুটি পিষ্ট হতে থাকলো। কেমন যেন শিহরণ খেলে গেলো আমার শরীরে। বোধহয় মেয়েটারও ঐ একই দশা হয়ে থাকবে। সেও আমাকে ছাড়ে না। আমিও তাকে ছাড়তে চাই না।
এইভাবে কয়েক মুহুর্ত কেটে গেছে। এবার আমি ওর বাহু ছাড়িয়ে গলায় হাত বুলাতে থাকি। তারপর হাতখানা ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যেতে থাকে। হাত বুলাতে বুলাতে ওর ছোট ছোট কচি বুকগুলোর উপর নিয়ে আসলাম। কি নরম আর গরম। মুঠির মধ্যে নিয়ে কিছুক্ষন টিপলাম। আহ কি সুখ। হাত আরো নামিয়ে তলপেটে রাখলাম। নাভির গর্তে সুরসুরি দিলাম। আরো নিচে নামিয়ে ওর দুপায়ের সন্ধিস্থলে রাগলাম। পুরো গরম হয়ে আছে জায়গাটা।
এমন সময় মেয়েটা খিলখিল করে হেসে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে দৌড় মারে। কিন্তু বেশী দূর যায় না। একটা বিরাট মোটা গাছের গুডি পড়েছিলো, তার ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়ে সে। আমিও ছুটতে ছুটতে গিয়ে তার ওপরে হুমডি খেয়ে পড়ি। তারপর শুরু হয় ধস্তাধস্তি। কামড়া কামডি, খামচাখামচি। ও আমার ডান হাত-এর বাহুতে এমন জোরে দাঁত বসিয়ে দিলো যে রক্ত বেরিয়ে গেলো। আমি ছেড়ে কথা কইবার ছেলে নই। দিলাম ওর ঠোঁটটা কামড়ে। ও আমাকে এলোপাথাড়ী কিল চড় ঘুষি মারতে লাগলো। আমার বেশ ভালোই লাগছিলো। ওর ছোট্ট নরম হাতের মার আমার বেশ আরামই লাগছিলো। এমন সময় একটা কাণ্ড ঘটলো। আমি আলতো করে ওর কোমরটা আমার দেহের কাছে টেনে নিতেই আবার ছুটে পালাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু আরও ক্ষিপ্রতায় ওর বুকে হাত ঢুকিয়ে চেপে ধরলাম সেমিজটা। আর সঙ্গে সঙ্গে দুফালা হয়ে ছিঁড়ে গেলো। সেই প্রথম দেখলাম ওর দেহে সবে যৌবনের জোয়ার আসতে শুরু করেছে। লজ্জায় ও দু’হাত দিয়ে বুকটা ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। আমি তখন হাসছি। ওর চোখে দেখলাম এক আদিম হিংস্রতা। এক মুহূর্ত। তারপরে ও ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ওপর। ওর এই আচমকা আক্রমণের জন্যে তৈরি ছিলাম না। টাল সামলাতে না পেরে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলাম। তারপর আমার ইজেরটা ধরে এমন জোরে একটা হ্যাঁচকাটান মারলে যে, পড়াৎ করে ছিঁড়ে ওর হাতের মধ্যে চলে গেলো একটা টুকরো। আর সেই মুহূর্তে নিশ্চল নিথর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে। অপলক চোখে দেখতে থাকলো আমার ছেড়া ইজেরটার দিকে। আমিও নির্বাক নিশ্চল। তারপর আকাশে ঝড় উঠলো। কালো মেঘে ঢেকে গেলো সারা দুনিয়া। ভয় হলো এখনই প্রবল বর্ষণ শুরু হবে। হলোও তাই। সেই প্রথম বর্ষণেই সব ভেসে গেলো।
বাড়ি ফিরে গেলো সে ভয়ে ভয়ে। জামা ছেড়া, রক্তের দাগ। ওর মার সন্দেহ হলো! ভালো করে পরীক্ষা করে বুঝলো মেয়ে সর্বনাশ করে এসেছে। মায়ের কাছে কিছুই গোপন করতে পারলো না সে। ওর মা আমাকে কিছু বললো না। কারণ বকাবিকি করতে গেলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে। তা ছাড়া মেয়েটার বাবা ছিলো ভীষণ কড়া লোক। হয়তো আমার সঙ্গে তার মেয়েকেও কেটে ফেলবে। ওর মা শাদীর পাত্র খুঁজতে লাগলো। একটা নাপিতের ছেলের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই কথাবার্তা হয়েছিলো। এবার পাকাপাকি। শাদীর তারিখ ঠিক হয়ে গেলো।
মেয়ে বায়না ধরলো, আমি সঙ্গে না গেলে সে শাদী করবে না। তখন ঠিক করা হলো আমাকে খোজা করে মেয়ের সঙ্গে পাঠানো হবে। একদিন নাপিত ডেকে আমাকে খোজা করা হলো। এর মাসখানেকের মধ্যেই শাদী হয়ে গেলো তার। ওর দেখাশুনা করার জন্যে আমিও গেলাম ওর শ্বশুর বাড়ি। সেইখানেই আমার জীবনের বেশী সময় কেটে গেছে। তারপর একে একে মেয়েটির মা বাবা এবং স্বামী মারা গেলো। আমি চাকরী পেলাম সুলতানের প্রাসাদে। সেই থেকে ওখানেই আছি। এই হলো আমার খোজা হওয়ার কাহিনী। এবার কাফুর, তুমি শোনাও তোমার কিসসা।
নিগ্রো কাফুর খোজা হওয়ার কিস্সা
কাফুর বলতে থাকে :
আমার বয়স তখন সবে আট। ঐ বয়সেই আমি মহা ধডিবাজ হয়ে উঠেছিলাম। আমার মতো অসৎ এবং মিথ্যেবাদী সে তল্লাটে ছিলো না কেউ। এমন কায়দা করে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে কথা বলতাম, শুনে লোকের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেতো। তবে একটা গুণ ছিলো আমার। আমি যখন তখন মিথ্যা কথা বলতাম না। বছরে মাত্র একটাই মিথ্যে বলতাম। এবং সেইটে বড় জব্বর। তার জন্যে আমার কতো মালিকের কতো যে ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে তার ইয়াণ্ডা নাই। এইভাবে একবার এক মালিকের সঙ্গে মিথ্যে রসিকতা করতে গিয়ে আমি আমার পুরুষ অঙ্গ হারিয়ে খোজা হয়েছিলাম। সেই কাহিনীই এখানে সংক্ষেপে শোনাচ্ছি। তোমাদের।
তখন আমি এক সওদাগরের হেপাজতে। ক্রীতদাস কেনাবেচাই তার ব্যবসা। আমার আগের মালিক তার কাছে বিক্রি করে গেছে। এবার সে আমাকে নীলামে তুললো। দাম উঠলো ছয়শে দিরহাম। আমার নতুন মালিক সওদাগরের হাতে গুণে গুণে ছয়শ্যে কুড়ি দিরহাম দিলো। কুড়ি দিরহাম দালালী। সওদাগর আগেই বলে দিয়েছিলেন, কাজে কর্মে আমি দারুণ চৌকস। শুধু একটাই দোষ আমার, বছরে মাত্র একবার মিথ্যে কথা বলা। এই দোষের কথা জেনেশুনেই আমার মালিক আমাকে কিনে নিয়ে এলো। নতুন জামাকাপড় দিলো। ভালো দেখে শোবার আস্তাবলী দিলো। মোট কথা খাওয়া পরার ব্যবস্থা বেশ ভালোই করেছিলো। মালিক আমাকে ভালোভাবে কাজ করার জন্যে অনেক বোঝালো। মিথ্যে কথা বলা মহাপাপ, দোজকে যেতে হয়। সুতরাং কোন কারণেই যেন আমি মিথ্যে কথা না বলি। কিন্তু ওদের ভালো কথা কি আর আমার ভালো লাগে। মুখে বললাম, না না, আর কখনো মিথ্যে বলবো না, কিন্তু মনে মনে শয়তানী পাঁচ খুঁজতে থাকলাম। এই ভাবে ছ’ মাস কেটে গেলো। মালিক ভাবলো তার উপদেশে কাজ হয়েছে। আমি সুবোধ বালক হয়ে গেছি।
একদিন সকালে মালিক বললো, কাফুর, চল আজ এক জায়গায় যাবো। অনেক লোক আসবে। খানাপিনা, নাচ, গান খুব হবে সেখানে।
মালিক আমাকে শহরের বাইরে, অনেক দূরে এক বাগানবাড়িতে নিয়ে গেলো! এক এক করে মালিকের বন্ধুবান্ধব আসতে শুরু করলো। মালিক আমাকে বললো, কাফুর, একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে রে। এখন কী করা যায়?
আমি বললাম, কী করতে হবে বলুন?
—তুই আমার খচ্চরটা নিয়েবাড়ি চলে যা। আলমারীর মাথায় দশ জোড়া তাস কিনে রেখেছি। ওগুলো জলদি নিয়ে আয়। তা না হলে, আসর জমবে না।
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, আপনি কিছু ভাববেন না। আমি ছুটে যাবো। আর ছুটিয়ে আসবো।
খচ্চরটা ছুটিয়েই বাড়ি চলে এলাম। হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। মালকিন, তার দুই মেয়ে, দুই ছেলে সবাই ছুটে এলো।
-কী ব্যাপার কাঁদছিস কেন?
আমি কোন জবাব দিই না। আরও জোরে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে থাকি।
ওরে বাবারে, কি হবে রে, কি করে আমি সে কথা বলবো রে।
এবার আমার মালকিন, চিৎকার করে উঠলো-কাফুর! কি হয়েছে বল।
–মালিক মারা গেছে।
–মালিক মারা গেছে—!
—হ্যাঁ মালকিন, মালিক মারা গেছে।
ছেলে মেয়ে বউ সবাই এক সঙ্গে কঁকিয়ে উঠলো, কি হয়েছিলো? কি করে মারা গেলো?
আমি তখন বানিয়ে বললাম।-বাগান বাড়ির পাঁচিলের ওপর উঠে একটা সরবতী লেবুর ডাল থেকে লেবু পাড়তে উঠেছিলো মালিক। হঠাৎ বেসামাল হয়ে নিচে পড়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ। এখন কি হবে, মালকিন?
কাদতে লাগলো সবাই। ঘরের দামী দামী বাসনপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভাঙ্গতে লাগলো। চেয়ার, টেবিল, আলমারী সব বাইরে বের করে পিটিয়ে পিটিয়ে ভাঙ্গা হলো। খাট পালঙ্ক লেপ তোষকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। দেওয়ালে। আলকাতরা লেপে দেওয়া হলো। মোট কথা, বাড়ির মালিক মারা গেলে যা যা করে শোকপ্রকাশ করতে হয় তার কিছুই বাদ রাখা হলো না।
এর পর চিরাচরিত প্রথা অনুসারে বোেরখা খুলে, মাথার চুল এলোমেলো করে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় ছুটতে থাকলো। দু’ পাশের বাড়ির লোকজন বেরিয়ে এসে সমবেদনা সান্ত্বনা জানাতে লাগলো।–কি করবে বাছা, সবই আল্লাহর খেলা। তার বিধান মেনে নিতেই হবে।
মালকিন বললো, ওরে কাফুর আমাকে সেই বাগানবাড়িতে নিয়ে চলরে বাবা। গোর দেবার আগে তাকে একবার শেষ দেখা দেখে আসি।
পাড়া পড়াশীরা বললো, অপঘাতে মারা গেছে। কোতোয়ালীতে খবর পাঠানো দরকার। কোতোয়াল সাহেব না যাওয়া পর্যন্ত কবর দেওয়া যাবে না।
মালকিনকে সঙ্গে নিয়ে তারা কোতোয়ালের উদ্দেশে রওনা হলো। আর সেই ফাঁকে আমি গোলাম বাগান বাড়িতে।
শাহরাজাদ দেখলো রজনী অতিক্রান্ত। গল্প থামিয়ে সে চুপ করে বসে রইলো।
উনচল্লিশতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
খোজা কাফুর তার কাহিনী বলছে :
মালকিন যখন কোতোয়ালের উদ্দেশে রওনা হলো আমি তখন চলে গেলাম বাগানে। সারা গায়ে কাদামাটি মেখে কিম্ভুতকিমাকারের মতো সাজলাম। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে হাজির হলাম মালিক-এর সামনে।
—ও মাগো, ও বাবাগো, আমার কি হলো গো? আমার মালকিন, আমার ছোট্ট দুই মালকিন, আমার ছোট দুই মালিক-ও বাবা গো, কি করে বলবো এসব কথা—
আমার মালিক কিছুই বুঝতে পারে না। ছোড়াটা কি বলে?-কীরে কি হয়েছে কেঁদেছিস কেন?
–সব শেষ হয়ে গেছে মালিক, সব খতম
—কী সব শেষ হয়ে গেছে রে? কী সব যাতা বলছিস? তোর কি মাথাটাথা সব খারাপ হয়ে গেলো নাকি?
–হয়নি। কিন্তু এবার হয়ে যাবে। ওরে বাবা, একসাথে অতোগুলো মানুষ-? না না, আমি বলতে পারবো না, আমি বলতে পারবো না—
আমি মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম।
মালিকের এবার ভয় হলো।–কাফুর! কি হয়েছে বাবা, তাড়াতাডি বল।
মালিক, আমি এখান থেকেবাড়ি ফিরে দেখি আমাদের বাড়ির সামনে হাজার হাজার লোক। এমন সব চেচামেচি—কিছুতেই বুঝতে পারছি না। কাউকে জিজ্ঞেস করলেও কেউ কিছু জবাব দেয় না।
মালিক অধৈৰ্য হয়ে ওঠেন, কাফুর? মোদ্দা কথাটা কি-তাই আগে বল, বাঁদর। তারপর শুনবো তোর ভ্যানতারা।
মালিক, লোকজন দেখে আমি ভ্যাবাচক খেয়ে গেছি তখন। লক্ষ্যই করিনি যে আমাদের গোটা বাড়িটাই ধসে পড়ে গেছে।
–বলিস কিরে? কারো লাগে টাগে নি তো?
—না তেমন কিছু না, তবে মরে গেছে।
—মরে গেছে? কে মরে গেছে? তোর মালকিন?
–জী হ্যাঁ।
–তো ছোট দুই মালকিন? তারা?
–জী, তারাও মারা গেছেন।
এবার বিকট এক চিৎকার দিয়ে ওঠে মালিক। –তোর ছোট দুই মালিক? তারা বেঁচে আছে তো?
—জী না। তারাও চাপা পড়ে মারা গেছে। বাড়ির একটা জনপ্রাণী বঁচেনি। গরু, ছাগল, মুরগী সব-সব দেওয়াল চাপা পড়ে শেষ হয়ে গেছে।
মালিক এবার দু’হাতে মুখ ঢেকে ধপাস করে মাটির উপর বসে পড়লো। ছোট ছেলের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। দাড়ি উপড়াতে থাকলো। জামাকাপড় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো।
—হায় আল্লাহ আমি কি পাপ করেছিলাম, এইভাবে আমাকে সাজা দিলে? আমার বিবি আমার আদরের মেয়ে আমার জানের কলিজা ছেলে–সব তুমি কেড়ে নিলে? এই কি তোমার বিচার মালিক?
উপস্থিত বন্ধুবান্ধব অভ্যাগতরা মালিককে সান্ত্বনা দিতে থাকে, কি করবে বলো, কপালের লিখন কেউ খণ্ডাতে পারে না। ওঠি, চলো, ঘরে যাই! তাদের ইস্তাকালের কাজ কাম সমাধা করতে হবে তো। বিপদের দিনে ভেঙে পড়লে তো চলবে না, ভাই। নিজেকে শক্ত করো। খোদা যা করে, তাকে মেনে নিতেই হবে।
মালিককে টেনে তোলে তারা। মদ খাওয়া মাতালের মতো টলতে থাকে সে। সবাই মিলে ধরাধরি করে তাকে বাড়ির দিকে নিয়ে আসতে থাকে। এমন সময় অদূরে শোনা গেলো কান্নার রোল। মনে হলো বিরাট একটা শোক মিছিল এগিয়ে আসছে বাগানবাড়ির দিকে। মিছিল আরো কাছে এলে দেখা গেলো তার পুরোভাগে রোরুদ্যমানা মালকিন। বোেরখা নাই। এলোমেলো অবিন্যস্ত চুল। ঠিক একটা পাগলীর মতোন।
মালিক অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকে। মালকিনের পিছনে তার দুই মেয়ে আর দুই ছেলে। সবাই হাহুতাশ করে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। সবারই সাজপোশাক ছিন্ন ভিন্ন। চুল উস্কো খুসকো। মালকিন এসে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।—ওগো, তুমি বেঁচে আছো?
মালিক কিছুই বুঝতে পারে না। বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।-কেন, লাগবে কেন? কি হয়েছে আমার?
মালকিন বলে, সে কি? তুমি নাকি পাচিলের উপর থেকে পড়ে মরে গেছ?
—মরে গেছি? আমি? আমি তো শুনলাম বাড়ি ধসে পড়ে তোমরা সবাই মারা পড়েছে?
—বাড়ি ধসে পড়ে? আমরা সবাই মারা গেছি? কে? কে? তোমাকে এসব ডাহা মিথ্যে খবর দিয়েছে, বলো তো?
—কেন? তোমার গুণধর চাকর কাফুর। সেই তো কাঁদতে কাঁদতে এসে বললো, তোমরা কেউই বেঁচে নাই।
মালকিন এবার বুঝতে পারলো, সব আমার শয়তানী।—ব্যাটা, শয়তান, ছুঁচো এত বড় বদমাইশ! এইরকম ডাহা মিথ্যে কথা কেমন নিখুঁত করে সাজিয়ে বলেছে। অবিশ্বাস করার উপায় ছিলো না।
মালিক এসে আমাকে এক ঘুষি মেরে নিচে ফেলে দিলো। পাশে একটা শাবল পড়েছিলো, সেটা তুলে নিয়ে তেড়ে এলো আমার দিকে, হারামী বাচ্চাটাকে আজ মেরেই ফেলবো।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনি আমাকে মারছেন কেন?
—মারবো না তো কি সোহাগ করবো, বাঁদর কোথাকার।
কিন্তু সওদাগরের কাছ থেকে যখন আমাকে কিনে আনেন তখন একটা শর্তের কাগজে আপনি সই করে এসেছেন, মালিক। সওদাগর আপনাকে সব খুলেই বলেছিলো। কাজে কামে আমার কোন গাফিলতি নাই। দোষের মধ্যে একটাই বছরে একটা শুধু মিথ্যে বলা। আপনি সব শুনেও আমাকে কিনে নিলেন। সওদাগরের সঙ্গে আপনার চুক্তি হয়েছে। কাজ কাম ঠিক মতো না করলে আপনি আমাকে সাজা দিতে পারেন। কিন্তু মিথ্যে কথা বললে বছরে প্রথমবার আমাকে কোনও সাজা দিতে পারবেন না। প্রত্যেক বছরে একবার মাত্র আমি মিথ্যা কথা বলবো এবং তার জন্যে আপনার যা-ই ক্ষয়ক্ষতি হোক, আপনাকে মেনে নিতে হবে। এই ছিলো আপনার শর্ত।
কাফুর-এর কথা শুনে মালিক শাবলটা নামিয়ে রাখে।—তা বলে এই রকম মিথ্যে রসিকতা? এতে তো মানুষের জীবন সংশয় ঘটতে পারে।
ঘটতে পারে ঘটবে। আপনাকে তো কিছু গোপন করা হয়নি। আর তাছাড়া আমার মিথ্যে কথাটা তো এখনও পুরো বলা হয়নি মালিক। সবে অর্ধেক হয়েছে। আরও অর্ধেক এখনও বাকী।
মালকিন চোখ বড় বড় করে বলে, ওরে বান্দর, এই তোর আধখানা রসিকতা। তা হলে পুরোটা কি, সোনার চাঁদ? দাঁড়াও তোমার বাকী রসিকতাটা আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
কোতোয়াল পাশেই দাঁড়িয়েছিলো। তার হুকুমে সিপাই আমাকে সপাং সপাং করে বেতের চাবুক চালাতে থাকলো। এর পর আমার আর জ্ঞান নাই। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখি আমার পুরুষাঙ্গটা কাটা। ওষুধ লাগিয়ে তুলো কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
মালকিন বললো, বাকী অর্ধেক রসিকতাটা এ-ই—বুঝলে বাঁদর। আমার শখের ঘরদোর, খাট, পালঙ্ক, আসবাবপত্র সব তুমি নষ্ট করে দিয়েছ। সেই কারণে আমিও তোমার জীবনের আসল জিনিসটাই ছেটে বাদ করে দিয়েছি।
এর পর মালিক আমাকে বাজারে নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে দিলো। সাধারণ নফর চাকরীদের চেয়ে খোজাদের বাজার দর অনেক বেশী। এইভাবে দু’ বছর চার বছর বাদ বাদ আমি নানা মালিকের হাত বদল হতে হতে একদিন খলিফার হারেমে এসে পড়লাম। তারপর থেকে এখানেই রয়ে গেছি!
কাফুর বললো, এই হলো আমার খোজা হওয়ার ইতিবৃত্তান্ত।
অন্য দুজনে কাফুরের পিঠে গাঁটা বসিয়ে দিয়ে বললো, -শালা মাইরি, এক্কেবারে হাড়ে হারামজাদা। এমন রসিকতা-জান কয়লা করে ছেড়ে দেবে!
নিগ্রো বুখাইতের খোজা হওয়ার কিস্সা
এবার বুখাইতের পালা।
বুখাইত বললো, শোনো ভাই, আমার দুঃখের কাহিনী বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। কিন্তু রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতে কাজ হাসিল করে এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। তাই আজ আর তোমাদের সে কাহিনী শোনাবার সময় নাই। ভালোয় ভালোয় কাজ কাম শেষ করে। নাও। তারপর ফিরে গিয়ে বলবো।
অল্প কথায় বলছি। আমি এক বাড়ি ক্রীতদাসরূপে থাকতাম। আমার মালকিনটির বয়স ছিল কম। ছিমছাম চেহারা। যাকে বলে একেবারে ডাসা পেয়াধার মত আমি কাজের ফাকে তার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে থাকতাম। চেষ্টা করতাম তার মনের খবর নিতে। সে তার শরীরের যৌবনচিহ্নগুলাে ঢেকেঢুকে রাখলেও মাঝে মধ্যে তার কাপড় চোপড় কেমন বেসামাল হয়ে পড়ত। তার নিটোল স্তনদুটোর এক বিরাট ভগ্নাংশই কামিজের ফাঁক দিয়ে উকি মারত। আসলে সে দুটো ছিল এতই বড় যে কামিজের তলায় বন্দী হয়ে থাকতে চাইত না। বিদ্রোহ করত। আমার সুযােগ সন্ধানী চোখ দুটো সে-সুযােগের প্রতীক্ষায় সর্বদা ছোঁক ছোঁক করত। আর থেকে থেকে আমার খুনে ধরে যেত মাথায়। নিজেকে আর সংযত রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ত।
একদিন আমার মালিক এক জরুরী কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। আমরা দুটোমাত্র প্রাণী বাড়িতে। আমার মাথার দুষ্ট পােকাগুলাে কিলবিলিয়ে উঠল। আমার কুড়ি বছরের যৌবনকে আর নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে রাখতে পারলাম না। অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়লাম মালকিনের ওপর। তার জামা একটানে ছিড়ে ফেললাম। তার বড় বড় স্তনদুটোকে চোখের সামনে দেখে পাগল হয়ে গেলাম। দুহাতে ইচ্ছামত দলাই মলাই করলাম, চুষলাম। তারপর কি হ’ল আশাকরি আর খুলে বলার দরকার নেই। সেদিনের সে সাময়িক আনন্দানুভূতিই আমার কপাল পােড়ার একমাত্র কারণ।
আমার মালিক বাড়ি এসে সবকিছু শুনলেন। আমাকে নিয়ে ছােট্ট এক কামরায় তালাবন্ধ করে রেখে দিলেন। পরদিন সকালে নাপিত এসে পুরুষের যা অমূল্য সম্পদ সেটি ছেদন করে আমাকে সারা জীবনের মত খােজা করে দিল।
যাক, ওসব কথ্য পরে শুনো, এখন এসো গর্ত খুঁড়ি।
কোদাল দিয়ে মাটি কেটে বাক্সটার মাপে একটা বেশ বড় সড় গর্ত খুঁড়লো ওরা। তারপর দু’জনে ধরে বাক্সটা নিচে নামিয়ে দিলো। আর একজন উচু করে আলো ধরে রাখলো। এর পর তিনজনে মিলে মাটি চাপা দিয়ে, গোরস্থান থেকে বেরিয়ে হন হন করে হেঁটে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
ঘানিম নারকেল গাছ থেকে নেমে এলো। হাত দিয়ে মাটি সরিয়ে সরিয়ে বাক্সটাকে টেনে উপরে তুললো। একটা পাথরের চাই দিয়েবাড়ি মেরে মেরে তালাটা ভেঙে ফেললো! ডালাটা তুলতেই মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেলো। ফুটফুটে ফর্সা ডানাকাটা পরীর মতো সুন্দরী এক যুবতী ঘুমিয়ে আছে। তার পরণে সূক্ষ্ম কারুকার্য করা দামী সিঙ্কের সাজপোশাক। গলায় সাতনরী জড়োয় হার। নাকে হীরের নাকছবি। মাথায় টায়রা। বাহুতে তাগা। বাজুতে বাজীবনধ। কোমরে বিছা। পায়ে মল। আগাগোড়া শরীরটা সোনা হীরা জহরতে মোড়া। ঘানিম ভাবে এতো কোনও সাধারণ ঘরের মেয়ে নয়। নিশ্চয়ই কোনও সুলতান বাদশাহর শাহজাদী! বুকে হাত রেখে অনুভব করলো, মরা নয় জীবন্ত। ঘুমিয়ে আছে। মানে নাকে ওষুধ ধরে ঘুম পাডিয়ে রাখা হয়েছে। একটা বিশ্ৰী ওষুধের আরাক এসে ঘানিমের নাকে লাগে, মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে। ঘুম ঘুম আমেজ আসে। কিন্তু নাকে কাঠি দিয়ে জোরে জোরে হেঁচে নিজেকে ঠিক করে নেয়। মেয়েটার গায়ে নাড়া দেয়। কিন্তু অঘোর ঘুমে সে কাতর। ঘানিম ভাবে, কি করে ওর ঘুম ভাঙ্গানো যায়—নাকের ফুটোর ভিতরে সুড়সুডি দিতে থাকে। মাথাটা এদিক ওদিক নাডিয়ে নাকটা সরিয়ে নিতে চায়। তারপর জোরে জোরে হাঁচতে থাকে। ঘানিম দেখলো, একটা বড় ডেলা নাক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো। অজ্ঞান করার ওষুধ। এইবার ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো মেয়েটি। ওষুধের বডিটা কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ঘানিম। ওরে বাস, একটা হাতীর নাকে গুজেও দিলেও তা বিশঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকবে।
চোখ মেলে তাকালো বটে, কিন্তু তখনও তন্ময়ভােব কাটলো না, স্বগতভাবে বিড়বিড় করে কি সব বলতে থাকে। সব কথা বোঝা যায় না। দু-একটার অর্থ উদ্ধার করতে পারে ঘানিম। ওঃ কি গরম, একটু ঠাণ্ডা হাওয়া করো, আমাকে একটু পানি দাও। কোথায় রে, কোথায় গেলি সব? কাছে আয় ও সীতারা, ও বাজিয়া, কাছে আয়, হাওয়া করা। কইরে, তোরা সব গেলি কোথায়? কথা বলিস না কেন?
কিন্তু কেউ জবাব দিলো না। জবাব দেবার মতো একমাত্র ঘানিম ছাড়া তো সেই গোরস্থানে দ্বিতীয় কোন মানুষ নাই। এবার বড় বড় চোখ মেলে তাকালো সে। এপোশ ওপোশ উপরে নিচে সব ভালো করে দেখে চিৎকার করে উঠলো।—এখানে, এই গোরস্থানে আমাকে কে নিয়ে এলো? আমার প্রাসাদের হারেম? আমার খাট পালঙ্ক, দাসী, খোজা তারা সব কোথায় গেলো? হায় আল্লাহ কে আমার এই সর্বনাশ করলো?
এতক্ষণ ঘানিম চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। ওকে। বললো, সুন্দরী, আমার নাম–ঘানিম ইবন আয়ুব। তোমার কোনও ভয় নাই। যদিও তুমি তোমার প্রাসাদের অন্দরমহল থেকে এই গোরস্থানে এসে পড়েছে, তবু ভরসা রাখো, তোমার কোন ক্ষতি আর কেউ করতে পারবে না। আমাকে বিশ্বাস করো, আমি তোমার ভালো-বই মন্দ করবো না। আল্লাহর অপার মহিমা, তা না হলে আজ রাতে আমিই বা এখানে আসবো কেন? তিনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তোমাকে বাঁচাতে-উদ্ধার করতে। আমি আল্লাহর বান্দা। তোমারও গোলাম। তুমি যা হুকুম করবে। আমি তাই তালিম করবো।
মেয়েটি দু’হাত দিয়ে চোখ রাগড়াতে লাগলো। ভাবলো, বুঝি বা খোয়ার। কিন্তু না, সে তো জেগেই আছে।
—আমি কি করে এখানে এলাম, বলো তো।
তখন ঘানিম আদ্যোপোন্ত সব খুলে বললো। মেয়েটি বললো, ঠিক আছে, আমি যেমন বাক্সের মধ্যে ছিলাম সেইভাবেই আমাকে শুইয়ে রেখে ডালা বন্ধ করে দাও। একটা খচ্চর ভাড়া করে। নিয়ে এসে তোমার ঘরে নিয়ে চলো। আমি তোমাকে আমার সব কাহিনী খুলে বলবো সেখানে।
তখন সবে সূর্য উঠছে। ঘানিম মেয়েটিকে বাক্সে ভরে গোরস্থান থেকে বেরিয়ে পড়ে। একটু পরে একটা খচ্চর ভাড়া করে নিয়ে আসে। চালকাঁটার সঙ্গে ধরাধরি করে বাক্সটা চাপিয়ে দেয়। খচ্চরের পিঠে।
সারাটা পথ ঘনিম ভাবতে ভাবতে আসে, নিশ্চয়ই কোনও সুলতান বাদশাহর পরিবারের মেয়ে সে। তার গায়ে খুব কম করে হলেও দশ হাজার দিনারের গহনা আছে। নানারকম কল্পনার জাল বুনতে বুনতে এক সময় তার বাসার দরজায় এসে হাজির হয়।
এইসময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে যায়।
চল্লিশতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয়।
তারপর শুনুন জাঁহাপনা, খচ্চরের পিঠ থেকে বাক্সটা নামিয়ে ঘানিম ঘরে নিয়ে যায়। ডালা তুলে মেয়েটিকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। ঘরের চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে সে। মেজেট দামী গালিচায় মোড়া। দরজা জানলায় সিস্কের কাজ করা পর্দা। পালঙ্কে মখমলের শয্যা। কুর্নিশ কেদারায় ঘরটা বেশ সাজানো গোছানো। পালঙ্কের একপাশে বসে বলে, শোনো ঘানিম, আমার বড় খিদে পেয়েছে। একটু কিছু খেতে দাও।
ঘানিম বাজারে গিয়ে দুম্বার চাপ, শাহী হালওয়া, পেস্তার বরফী, বাগদাদী লাড্ডু, কিছু আঙ্গুর আপেল কলা, আর এক ঝারি মদ নিয়ে এলো। আর নিয়ে এলো কিছু সুগন্ধী ফুল। খানাপিনার এই আয়োজন দেখে মেয়েটির চোখ খুশিতে নেচে ওঠে। রেকবী করে সাজিয়ে দিলো ঘানিম, নাও, খাও।
—বারে, আমি এক খাবো নাকি? তুমিও বসো।
ঘানিম বলে, বেশ বসছি।
অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে ঘানিম বসলো ওর পাশে। মেয়েটির কিন্তু মোটেই পছন্দ হলো না। একেবারে ঘানিমের গা ঘেসে এসে বসলো সে। —অত দূরে দূরে বসছো কেন? খিদে পেয়েছে বলে তোমাকে সুদ্ধ খেয়ে ফেলবো নাকি?
ঘানিম মাথা নিচু করে হাসে। জবাব দিতে পারে না-না, মানে—মানে–
—আর মানে মানে করতে হবে না। নাও, খাও! একটা মাংসের টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে ঘানিমের মুখে পুরে দেয়।
মেয়েটির চাপার কলির মতো আঙ্গুলগুলোর ছোঁয়া ওর ঠোঁটে লাগে। পলকে সারা শরীরে কি যেন এক শিহরণ খেলে যায়। নিজের মা বোন ছাড়া এই প্রথম সে এক অচেনা অন্য মেয়ের এত কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে।
মেয়েটি এবার ওর মুখটা তুলে ধরে। আহা লজ্জা কেন তোমার!
ঘানিম কোনও কথা বলে না। ওর চোখ দুটো হাসে।
—বারে, আমি তো আজ তোমার ঘরে মেহেমান। আমাকে আদর যত্ন করো।
–আলবৎ হয়েছে, খানাপিনা এনে সামনে ধরলেই সব হয়ে গেলো? খাইয়ে দেবে না-?
ঘানিম তাড়াতাডি রেকবী থেকে এক টুকরো মাংস তুলে ওর মুখে পুরে দিতে যায়। কিন্তু অনভ্যাসের ফলেই হোক, বা হাতটা কেঁপে ওঠার জন্যেই হোক, মেয়েটির কমিজের ওপর পড়ে যায়।
—দিলে তো? দিলে তো মাটি করে! এখন আমি কি করি? তোমার ঘরে আছে নাকি বাড়তি কামিজ?
–আমার ঘরে? আমার ঘরে মেয়েদের কামিজ আসবে কি করে?
–আচ্ছা, কি করে আসে তাও বুঝি জানো না?
–না তো–
শাদী করলেই আসে। খালি কামিজ কুর্তাই আসে না, ঝোলের সঙ্গে মাংসও এসে পড়ে।
ঘানিম-এর সারা মুখ লাল হয়ে ওঠে।—না, এখনও আমি শাদী করিনি! তুমি আমার জীবনে প্রথম নারী। এর আগে পর্যনারীর সামনে দাঁড়াইনি কখনও।
আহা-হা-হা, চুক চুক। তা হলে তো দারুণ গোস্তাকি করে ফেলেছি। তোমাকে আমি ছুঁয়ে দিয়েছি। না বাবা, তা হলে সরেই বসি।
মেয়েটি সরে যাবার ভান করে। ঘানিম এবার ওর একখানা হাত চেপে ধরে বলে, আমি কি তাই বলেছি নাকি?
মেয়েটি ঠোঁট টিপে হাসে।–তবে কি বলেছে, চাঁদ?
সে-কথার জবাব না দিয়ে একটা তোয়ালে ভিজিয়ে এনে কামিজটায় ঘসে ঘসে ঝোলের দাগ তুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু তেল-হলুদের দাগ শুধু জলে ওঠে না।
মেয়েটি বলে, ছাড়ো তো। থাক দাগ। একটু আধটু দাগফাগ থাকা ভালো, বুঝলে। তোমার মতো অতি সফেদ হলে আরও বিপদ।
এর পর ওরা দুজনে খানাপিনা সারে। মৌজ করে মদ খায়। মদের নেশায় মন্দির হয়ে আসে মেয়েটির চোখ। ঘানিমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। ছেলেটির সারা শরীরে এক অপূর্ব পুলক জাগে। এ অনুভূতি তার জীবনে এই প্রথম। অপলক চোখে মেয়েটিকে দেখে! কি তার রূপ! কি তার যৌবন!
মেয়েটি হাসে। অপূর্ব সে হাসি। বলে, কী? কি দেখছ?
—তোমাকে। কি সুন্দর তুমি। আকাশের চাঁদ তোমার মতো এত সুন্দর না।
–ও বাবা, এ যে কবিতা গো।
—তোমাকে দেখলে, কবিতা আপনা থেকেই আসে।
–তা শোনাও না একটা।
—পরে শোনাবো। এখন বাঁশী বাজাবো, শুনবে।
–শোনাও।
নেশায় মেয়েটির চোখ ঢুলু ঢুলু হয়ে আসে। আর নিবিড় করে ঘানিমের কোলের মধ্যে মাথাটা গুঁজে দেয়।
—একটু ছাড়ো। বাঁশীটা বের করে নিয়ে আসি। আমার বাক্সে আছে।
—না থাক, এখন ছাড়বো না তোমাকে। বাঁশী পরে শুনবো। তুমি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও। বড্ডো ঘুম পাচ্ছে।
ঘানিম ওর কপালে হাত রাখে। চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বিলি কাটতে থাকে। আর একভাবে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে তার নিটোল নিখুঁত রূপলাবণ্য। কি সুন্দর টানাটানা হরিণ কালো চোখ। আপেলের মতোটুকটুকে গাল, পাকা আঙুরের মতো ঠোঁট। ওর সারা মুখে হাত বুলিয়ে অনুভব করতে থাকে কোমল মসৃণতা। মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠে বসে।–এই বুঝি তোমার মাথায় হাত বুলানো হচ্ছে-সাহেব?
ঘানিম লজ্জা পায়। নিজের অজান্তে কখন হাতটা নেমে এসেছিলো ওর গালে ঠোঁটে। মেয়েটি বলে, আর একটু সরাব দাও, সব নেশা কেটে গেছে।
ঘানিম আবার দু পেয়ালা সরাব ঢালে। এক পেয়ালা তুলে দেয় মেয়েটির হাতে। নিজে নেয় এক পেয়ালা। এইভাবে সারাটা দিন মদ খেয়ে গান গেয়ে, খুশির বন্যায় দু’জনে গা ভাসিয়ে দেয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। আবার বিকেলও ফুরিয়ে রাত্রি নেমে আসে। মোমের আলোয় এক অপূর্ব মাদকতা আছে। ঘানিম আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। আরও কাছে! দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ওকে চুমু খেতে চায়। কিন্তু মেয়েটি খিলখিল করে হেসে দু-হাত পিছিয়ে সরে যায়।-এখনি নয়গো বন্ধু, এখনি নয়। আরও কিছু ধৈর্য ধরে। রজনী গভীর হোক। আজ সারা রাত তোমাকে আমি অমৃতসায়রে ভাসিয়ে রাখবো। এখনি নয়, আমাকে আরও একটু নেশা করতে দাও। তুমিও আরও উদাম হও। তোমার চোখে এখনও দেখতে পাচ্ছি না সিংহের বিক্রম। নাও, আরও একটু সরাব খাও।
নিজের পেয়ালাটা ঘানিমের মুখে তুলে ধরে। এক চুমুকে সবটুকু টেনে নিয়ে বলে, কেন, আমাকে কি পুরুষ বলে মনে হচ্ছে না।
–সারাদিন হয়নি। এখন একটু হচ্ছে। অতো শান্তশিষ্ট হয়ে লজ্জায় লাল হয়ে বসে থাকলে কি কোনও মেয়ের ভালো লাগে। পুরুষ পুরুষের মতো হবে। তোমার দাঁতের দংশনে আমার ঠোঁটে রক্ত ঝরবে, তোমার হাতের থাবায় আমার যৌবন জর্জরিত হবে, তবে না তুমি সার্থক পুরুষ! তুমি আমাকে জাগাবে, না, মেয়ে হয়ে আমি তোমাকে সারাদিন ধরে জাগালাম।
ঘানিম বলে, জীবনে এই প্রথম তুমি আমার যৌবনে রং ধারালে। প্রথম প্রথম একটু শরম হবে না?
-ও, তাই বুঝি! পরে তা হলে একেবারে বে-শরম বেহায়া হয়ে যাবে?
—কি যে বলো!
–বুঝেছি। বুঝেছি। দেখতে মনে হচ্ছে, ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানো না। আসলে তুমি একটা জাগুয়ার।
ধীরে ধীরে রাত্রি গভীরতর হয়। দুজনেই তখন মদের নেশায় বিভোর। ঘানিমকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে মেয়েটি। ঘানিমও তার ডাকে সাড়া দেয়। দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ। মেয়েটি এবার হিংস্র হয়ে ওঠে। কিন্তু ঘানিম শঙ্কিত হয়। না না, এই ভালো। এর বেশী আর কিছু চাই না আমি। আজকের রাতটা তোমাকে বুকে নিয়েই কাটাতে চাই।
—কিন্তু, সোনার চাঁদ, এত অল্পে তো আমি তুষ্ট হবে না।–আজি আমাকে ক্ষমা করো। আজ আর এর বেশী না। মেয়েটি আদর করে ঘানিমকে ঠোনা মারে, বোরখা পরে থেকে। ঘানিম ওর বুকের মধ্যে মুখ লুকায়।–দিন কি শেষ হয়ে যাচ্ছে নাকি? তুমি তো আমারই আছো। আমারই থাকবে।
–কি করে বুঝলে?
—কেন, তুমি চলে যাবে?
—ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হবে। ওরা আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।
ঘানিম উঠে বসে।—দুনিয়াতে এমন কোনও শক্তি নাই আমার কাছ থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিতে পারে।
—আহা, কি আমার বীর পুরুষ গো! একটা মেয়ের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারে না, তা আবার বড়াই।—চলো, অনেক রাত হলো। এবার খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়া যাক। শুয়ে শুয়ে আজ আমার সব কাহিনী বলবো। তখন জানবে। আমার পরিচয়।
খানাপিনা সেরে দু’জনে দুজনকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। ঘানিম বলে, কই, বলবে বলেছিলে? বল তোমার কাহিনী?
মেয়েটি বলতে থাকে- খলিফা হারুন-অল-রাসিদের আমি খুব পেয়ারের বাদী। তিনি আমাকে সোহাগ করে কুৎ-আল-কুলুব বলে ডাকেন। খুব ছোট থেকে খলিফার প্রাসাদে আমি মানুষ হয়েছি। খলিফার যত বাদী রক্ষিতা আছে আমি তাদের সকলের সেরা। আমাকে খুশি রাখার জন্যে খলিফার চেষ্টার অন্ত নাই। আমার জন্যে গোটা একটা মহল তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। সুন্দর সুন্দর বারোটা দাসী আমার পরিচর্যায় দিন রাত ব্যস্ত থাকে। হীরে জহরৎ আর দামী দামী সাজপোশাকে সাজিয়ে তিনি আমাকে পটের বিবি বানিয়ে রেখেছিলেন। প্রায় প্রতি রাতেই তিনি আমার ঘরে আসতেন। তাঁর খাস বেগম জুবেদার এটা সহ্য হতো না। হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতো। অনেক দিন থেকে আমাকে দুনিয়া থেকে সরাবার তাকে খুঁজছিলো সে। কাল রাতে সেই মউকা মিলেগেছে। খলিফা আজ দুদিন হলো বাইরে গেছেন। একটা কুবায়তার গেছেন বিদ্রোহিদের দমন করতে।
আমার বারোজন দাসীর মধ্যে দু-একজন জুবেদার প্রিয় পাত্রী ছিলো। মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে তাদের হাত করেছিলো। কাল রাতে শোবার আগে অভ্যাস মতো এক গেলাস সরবৎ খেয়েছিলাম। একটু পরেই আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো। দাসীটাকে বলেছিলাম, এমন কেন হলো?
সে আমাকে বোঝালো, ও কিছু নয়, ঘুমিয়ে পড়ো মালকিন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার মনে কেমন সন্দেহ ঘনিয়ে এলো। নিজেকে শক্ত করে বসে রইলাম! কিন্তু ওষুধের ক্রিয়া এড়াবো কি করে? মাথাটা ঢলে পড়তে থাকে। জোর করে নিজেকে সোজা রাখার চেষ্টা করি। একটু পরে ঐ দাসীটা এসে আমার মুখটা তুলে ধরে বললো, কই চলুন মালকিন, শোবেন চলুন।
আমি আর প্রতিবাদ করতে পারলাম না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পালঙ্কে শুয়ে পড়লাম। কেমন একটা বিশ্ৰী গন্ধে সারা শরীর গুলিয়ে যেতে লাগলো। তখনও আমার চৈতন্য লুপ্ত হয়নি। সবই শুনতে পাচ্ছি। সবই বুঝতে পারছি। অথচ হাত-পা নাড়তে পারছি না। কোনও কথা বলতে পারছি না। মনে হতে লাগলো, আমি মরে যাচ্ছি।
শুনতে পেলাম, জুবেদা আমার ঘরে এসে ঐ দাসীটাকে বলছে, সবাব, কাফুর আর বুখাইৎকে বলে রেখেছি। ওদের কাঠের বাক্সটা নিয়ে এখানে আসতে বল।
বুঝতে পারলাম, একটু পরে ঐ তিন খোজা আমাকে ধরাধরি করে একটা বাক্সের মধ্যে শুইয়ে দিলো। জুবেদা বললো, যা নিয়ে যা। আমাদের গোরস্থানে কবর দিয়ে রাত থাকতে থাকতে ফিরে আসবি।
আমি সবই শুনতে পেলাম, সবই বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমার আচ্ছন্নভাব কাটিয়ে কথা বলতে পারলাম না। পারিনি, একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। জুবেদা যদি বুঝতে পারতো ওষুধে কাজ হয়নি, হয়তো আমার বৃকে ছুরি বসিয়ে দিতে।
এর পরের ঘটনা তো তোমার সবই জানা। আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছিলেন। তা না হলে, তুমি এক বিদেশী, নিশি রাতে মানুষের অগম্য ওই গোরস্থানেই বা যাবে কেন? আর আমাকেই বা উদ্ধার করবে। কেন?
এখন আমি ভাবছি, খলিফা লড়াই থেকে ফিরে এসে যখন দেখবেন আমি নাই, তখন কি কেলেঙ্কারী কাণ্ড হবে!
কুৎ-আল-কুলুবের কাহিনী শুনে ঘানিম ঘামতে থাকে। সর্বনাশ! এ কাকে নিয়ে এসে সে ঘরে তুলেছে? ধর্মাবতার খলিফার রক্ষিতা! তাকে ছোঁয়াও তো মহাপাপ! ঘরের এক প্রান্তে গিয়ে একটা টুলের উপর বসে থাকে। কুৎ-আল-কুলুব বুঝতে পারে না। ডাকে, তুমি দূরে সরে গেলে কেন, সোনা?
–না না, সে হয় না। তুমি খলিফার বাঁদী। তোমার দিকে হাত বাড়ালে সে হাত আমার পঙ্গু হয়ে যাবে। খলিফা সাক্ষাৎ আল্লাহর পয়গম্বর।
কুৎ-আল-কুলুব উঠে এসে ঘানিমের হাত ধরে। দূর বোকা ছেলে, ভয় পাচ্ছে কেন? আমি তো আছি। চলো, শোবে চলো।
ঘানিম। কিন্তু সত্যিই শঙ্কিত হয়েছে। বাদশাহর রোষানলে দগ্ধ হতে পারে সে। সামান্য এক সওদাগর হয়ে সে চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছে। কুৎ-অল-কুলুবের ডাকে আর সাড়া দিতে পারে। না ঘানিম। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। নেশা কেটে যায়। খলিফার প্রিয় পাত্রীকে সে তার অঙ্কশায়িনী করতে চেয়েছিলো।
—না, না, তুমি পালঙ্কে শুয়ে পড়ে। আমি নিচে শোবো।
—তাই হয় নাকি চলো, এক সাথে শোবো।
কিন্তু ঘানিম রাজী হতে পারে না। সারারাত একরকম বসেই কেটে যায়।
ভোর না হতেই ঘানিম বাজারে বেরিয়ে গেলো। কুৎ-আল-কুলুব তখনও নিদ্রামগ্ন। বাজার গিয়ে নানারকম দামী দামী খাবারদাবার কিনলো। সুলতান বাদশাহরা যে সব দুষ্প্রাপ্য সরাব খায় তারই একটা কিনলো কুৎ-আল-কুলুবের জন্য। তার ঘরে আজ মহামান্য অতিথি-তার মনোরঞ্জনের জন্য দামী আন্তর, বাহারী ফুল, সুগন্ধী আগরবাতি প্রভৃতি নানা শৌখিন জিনিসপত্র কিনে যখন বাসায় ফিরলো, বেশ বেলা হয়ে গেছে। কুৎ-অল ঘরের মধ্যে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। ঘানিমকে দেখে ছুটে এলো, কখন তুমি কোথায় গেলে, আমি ভেবে আকুল, এতে দেরি হলো কেন?
–এই একটু বাজারে গিয়েছিলাম। কুলির মাথা থেকে সামানপত্র নামাতে নামাতে বলে, আমার ঘরে সুলতানের খাস বাদী-এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়? আদর যত্নের ত্রুটি হলে যে গর্দান যাবে।
কুৎ-অল রাগ করে।—তুমি আমাকে এত পর পর ভাবো?
ঘানিম টেবিলে নাস্ত সাজাতে থাকে। কুৎ-আল সামনে এসে রুখে দাঁড়ায়!-ওসব রাখো বলছি, আগে আমার কাছে এসো। না হলে সব ছুঁড়ে ফেলে দেব বলছি। আমি কি তোমার এখানে খানাপিনা করতে এসেছি? যে কটা দিন থাকবো, আমি আর তুমি এক হয়ে থাকবো। কোথাও যেতে পারবে না।
ঘানিমকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিতে চায়। কিন্তু ঘানিম উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি তোমার আজ্ঞাবহ দাসানুদাস। তুমি খলিফার ‘ভালোবাসা’। ওসব ভাবাও আমার পাপ।
—কি বললে? দাসানুদাস? আজ্ঞাবহ। তা হলে আমি আদেশই করছি—আমার বুকে এসো।
ঘানিম মাথা হোঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে।–দেখো, ঘানিম, আমি খলিফার খাস বাঁদী-আমার হুকুম, কাছে এসো। তা না হলে তোমার গর্দান যাবে।
—গর্দান তো বাড়িয়েই আছি। ইচ্ছে হয় নিতে পারো। কিন্তু ওকথা বলে না। আমি পারবো।
কুৎ-অল উঠে এসে, দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, ঘানিমের ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে দেয়। রক্ত ঝরে পড়ে। কুৎ-অল উম্মাদিনীর মত ঘানিমকে আকড়ে ধরে। নিজের বুকের ওপর তার সুপ্রশস্ত বড় বড় স্তনগুলো সজোরে চেপে ধরে। -ওগো সাধু মহাপুরুষ, এবার তোমার খোলসটা ছাড়ো। আমি যে আর সইতে পারছি না। সিংহের মতো একবার ঝাঁপিয়ে পড়ো, সোনা।
ঘানিম বলে, প্রভুভক্ত কুকুর কখনও সিংহ হতে পারে না, কুৎ-আল। আমাকে ক্ষমা করো।
আমার কথা না শুনলে তো তোমার ক্ষমা নাই, ঘানিম। আমাকে চটিও না, বলছি। তোমার ভালো হবে না।
ঘরের এক প্রান্তে গিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে পড়ে ঘানিম। কুৎ-অল এগিয়ে আসে। মাথায় হাত বুলায়।–রাগ করলো? ঠিক আছে, চলো, নাস্তা সেরে নিই।
ঘানিমের হাত ধরে দু’জনে টেবিলে এসে বসে। আর একটাও কথা হয় না। নীরবে আহার পর্ব শেষ হয়। ঘানিম কেমন মনমরা হয়ে যায়। বাঁশীতে করুণ সুর বাজাতে থাকে। কুৎ-অল অবাক হয়। এমন বেহাগের সুর অনেককাল সে শোনেনি। শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে। আস্তে আস্তে উঠে এসে ঘানিমের কাঁধে হাত রাখে।-কোথায় শিখেছ?
—আমার বাবা খুব গুণী লোক ছিলেন। দামাসকাস শহরে গাইয়ে বাজিয়ে মহলে তার বেশ নাম ছিলো। সেই সুবাদে অনেক নামজাদ ওস্তাদের আনাগোনা ছিলো আমাদের বাসায়। যা কিছু শিখেছি, তাদের কল্যাণেই।
গান বাজনার মধ্য দিয়ে সারা দিন কেটে যায়। রাতের আহার শেষ করে ঘানিম নিজের জন্য নিচে আলাদা বিছানা করে নেয়। এবার কুৎ-অল চিৎকার করে ওঠে, তোমার এই ফালতু গোড়ামী রাখো তো। যতক্ষণ তোমার ঘরে আছি, আমি তোমার! তুমিও আমার। এর মধ্যে খলিফার কথা মনে রেখে না। এসো, আমার কাছে এসো। এক সাথে শোবো আমরা। আজকের রাত হবে, আমাদের মধুযামিনী।
ঘানিম রাজী হয় না।–না, তা হতে পারে না, কুৎ-আল।
কুৎ-অল মিনতি করে, তোমার দু’টো পায়ে পড়ি, ঘানিম আমার কথা শোনো। তোমাকে না পেলে আমি এক ফেঁটা ঘুমুতে পারবো না।
ঘানিম রাজী হয় না, সে হয় না, কুৎ-অল।
কৃৎ-অল কেঁদে ফেলে, আমন করে না’ করো না, সোনা। আমার দেহ-মন তোমাকে চাইছে। এসো, কাছে এসো। শুধু একটা চুমু। আর কিছু চাই না।
কুৎ-অল অঝোর নয়নেকাঁদতে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
এইভাবে একটা মাস কেটে যায়। খায় দায় আর বিরহ বেদনার গান গায়। কুৎ-অল-এর আসল পরিচয় জানার পর থেকে ঘানিম নিজেকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখে।
এদিকে খলিফার খাস বেগম জুবেদা খবর পায়, লড়াই শেষ করে খলিফা বাগদাদে ফিরে আসছেন। প্রাসাদের সবচেয়ে পুরনো এক বুড়ি দাসী ছিলো জুবেদার প্রিয় পাত্রী। কুমন্ত্রণা দিতে তার জুডি নাই। জুবেদা তাকে জিজ্ঞেস করে, খলিফা তো ফিরে আসছেন। এখন কি হবে?
—কিছু ভেবো না মা, আমি তোমাকে ফিকির বাৎলে দিচ্ছি। ছুতোরকে দিয়ে একটা কাঠের পুতুল বানিয়ে নাও। আমাদের প্রাসাদে একজন ভালো কারিগর আছে। খুব সুন্দর সুন্দর পুতুল বানাতে পারে। তাকে ডেকে তুমি বলে দাও, সে ঠিক কৃৎ-আলোর মতো দেখতে একটা পুতুল বানিয়ে দেবে। প্রাসাদের চত্বরে একটা কবর খুঁড়ে পুতুলটাকে গোর দিয়ে রাখো। হ্যাঁ, একটা কথা, কুৎ-আল যে সব দামী দামী হীরে জহরৎ পরে থাকতো সেইভাবে সাজাতে হবে তাকে। খলিফার যদি সন্দেহ হয়, যদি বলেন, কবর খোলো, আমি তাকে দেখবো। সেই জন্যে পুতুলটাকে দামী দামী রত্নালঙ্কারে সাজাতে হবে। খলিফা। যদি কবর খুলে দেখেনও, ঐ সব মূল্যবান অলঙ্কারাদি দেখে তার আর কোন সন্দেহ থাকবে না।
জুবেদা বলে, আর যদি খলিফা বলেন, আমি ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখবো, তখন?
—তখন তুমি বলবে, কুৎ-আল-এর মৃতদেহ বিবস্ত্র করে কবর দেওয়া হয়েছে। শাস্ত্ৰে আছে, নিজের বিবি হলেও ন্যাংটো করা মেয়েছেলের মৃতদেহ কোনও পুরুষ স্পর্শ করতে পারে না।
–সাব্বাস! তোমার কি বুদ্ধি!
জুবেদা সেই বুড়ি দাসীকে দামী দামী সাজপোশাক এবং স্বর্ণমুদ্রায় পুরস্কৃত করলো। বুড়ির কথা মতো কাঠের তৈরি নকল কুৎ-আল-কুলুবকে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হলো।
এর দুদিন পরে খলিফা ফিরে এলেন। প্রাসাদে ঢুকতে গিয়েই দেখলেন, প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে এক বিরাট সমাধি। প্রাসাদের কর্মচারী নফর। চাকর খোজা দাসদাসী সকলের পরনেই কালো পোশাক। অন্দরমহলে গেলেন। খাস বেগম জুবেদাও শোকের পোশাকে সজ্জিতা। সারা প্রাসাদে থমথমে ভাব। কারো মুখে কথা নাই। কুৎ-আল-কুলুবের মহলে গেলেন। দাসী পরিচারিকারা অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইলো। কুৎ-অল নাই। সারা মহল ধূপ আর আতরের গন্ধে ভরপুর। চারপাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো মোমের বাতি গলছে। জুবেদা কাঁদতেকাঁদতে বলে, কুৎ-অল আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
খলিফাকে সঙ্গে করে সমাধির পাশে নিয়ে গেলো জুবেদা–আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কবর খুঁডিয়ে বাদশাহী মর্যাদায় তাকে গোর দিয়েছি।
খলিফা কোনও কথা বলতে পারলেন না। কুৎ-অল-এর এই আকস্মিক মৃত্যু তাকে মুহ্যমান করে ফেলেছে। পথশ্রমে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ। তার উপর এই গভীর শোকসংবাদ। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শয্যা নিলেন।
সারা দিন সারা রাত মড়ার মতো পড়ে রইলেন। কারো সঙ্গে দেখা করলেন না। খানাপিনা কিছুই খেলেন না। শুধু ভাবতে লাগলেন, আমন সুন্দর সুস্থ কুৎ-অল হঠাৎ মারা গেলো কি করে। যতই ভাবেন, সন্দেহ ঘনীভূত হয়। সকালে উঠে জাফরকে ডেকে বললেন, কবর খোলার ব্যবস্থা করো, আমি একবার কুৎ-অলকে শেষবারের মতো দেখতে চাই।
জুবেদার বুক কেঁপে উঠলো। বুড়ি দাসী তাকে অভয় দেয়, কিছু ভেবো না, মা। নিজেকে শক্ত করো। খলিফার পাশে গিয়ে দাড়াও; যা বলেছি, মনে থাকে যেন।
খলিফার নির্দেশে কবর উন্মুক্ত করা হলো। মাথা ঝুঁকিয়ে তিনি দেখলেন, প্রায় স্বচ্ছ দামী কফিনে মোড়া কুৎ-আল-কুলুবের মৃতদেহ। দেখলেন তার সারা অঙ্গে সেই সব হীরে জহরতের অলঙ্কার। পলকে সকল দ্বন্দ্ব ঘুচে গেলো। বললেন, ঠিক আছে, কবর ঠিক করে রাখো।
জাফরকে নির্দেশ দিলেন, সাত দিন সাত রাতব্যাপী কবরের সামনে কোরান পাঠ হবে। ব্যবস্থা করে।
এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।
একচেল্লিশতম রজনী।
আবার কাহিনী শুরু হয়। শাহরাজাদ বলতে থাকে :
খলিফার ইচ্ছানুসারে কুৎ-আল-কুলুবের নকল সমাধির পাশে সাত দিন সাত রাতব্যাপী কোরান পাঠ হতে থাকলো। সব কাজকাম মুলতুবি রেখে খলিফা দরবার কক্ষের একখানা সাধারণ চৌকির ওপর মাদুর বিছিয়ে শুয়ে রইলেন। জাফরকে বলে রাখলেন, কেউ যেনো তাকে বিরক্ত না করে।
খলিফার মাথা ও পায়ের কাছে বসে দুই পরিচারিকা পরিচর্যা করতে থাকে। পানাহার পরিত্যাগ করে তন্দ্ৰাচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে থাকেন। খলিফা। কোরানের পবিত্র বাণী শুনতে শুনতে পার্থিব সুখ দুঃখের অনেক উপরে অন্য এক জগতে বিচরণ করতে থাকেন।
হঠাৎ তার কানে আসে, দুই পরিচারিকার একজন বলছে,
ছিঃ ছিঃ কি কেলেঙ্কারী কাণ্ড ভাই শুভিয়া।
শুভিয়া অবাক হয়, কেন, কেলেঙ্কারী কিসের ভাই নুজা?
—আমাদের খলিফা একটা মিথ্যে কবরের সামনে কোরান পাঠের আসর বসিয়েছেন। আসলে ওটা কুৎ-অল-এর কবর না ছাই।
—তবে? কুৎ-আল গেলো কোথায়?
—তাকে তো বেগম সাহেবা জুবেদাহ ঔষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে মারার ফন্দী করেছিলেন। সবাব, কাফুর আর বুখাইৎ এই তিনটি খোজা জুবেদা বেগমের খুব পেয়ারের। কুৎ-অলকে অজ্ঞান করে, একটা কাঠের বাক্সে পুরে ঐ তিন খোজাকে দিয়ে সুলতানের খাস কবরখানায় পুতে রেখে এসেছিলো। শুভিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, তাহলে প্রাসাদের চত্বরে এই কবরখানা কার?
—নকল কুৎ-আল-এর। একটা কাঠের পুতুলকে সাজিয়ে-গুজিয়ে শুইয়ে রেখেছে। জুবেদা বেগম।
—তা হলে কুৎ-অলকে জ্যান্ত কবর দিয়ে মেরে ফেলেছে?
–আল্লাহ যাকে রাখেন, তাকে কেউ মারতে পারে? শুনেছি, কুৎ-আল বেঁচেই আছে।
–কোথায়?
–এই বাগদাদ শহরেই এক নওজোয়ান সওদাগরের ঘরে। তার নাম নাকি ঘানিমা ইবন আয়ুব।
—তোমাকে এসব কথা কে বললো ভাই, নুজা?
ওই যে বুড়ি দাসীটা। জুবেদা বেগমের পেয়ারের দাসী গো। ওই বুড়িটাই বলছিলো আমাকে। তা ভাই অনেক দিব্যি করিয়ে নিয়েছে। তুমি যেন আমার বলো না কাউকে। বড় ঘরের বড় বড় ব্যাপার। ওসব নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কি দরকার?
খলিফা লাফিয়ে উঠে বসলেন। দরবার কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন, জাফর?
কোরবানীর খাসির মতো জাফর এসে দাঁড়ালো।— ফৌজদারকে বোলাও। এক্ষুণি যত লোক-লস্কর দরকার নিয়ে বেরিয়ে পড়। কে এক ঘানিম ইবন আয়ুব আছে এই শহরে, তাকে ধরে নিয়ে এসো। যেমন করে পারো।
সঙ্গে সঙ্গে জাফর সব কোতোয়ালদের ডেকে পাঠালো। বললো, তোমাদের নিজের নিজের এলাকায় সন্ধান করে দেখো, ঘানিম ইবন আয়ুব নামে এক ছোকরা সওদাগর এই শহরেই কোথাও বাসা ভাড়া করে আছে। গোপনে তার বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে এক্ষুণি আমাকে জানাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঘানিমের ঠিকানা সংগ্রহ হলো। আর তিল মাত্র দেরি না করে জাফর-অল-বারমাকী চল্লিশজনের এক ফৌজী বাহিনী নিয়ে ঘানিমের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে।
তখন টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে ঘানিম। আর কুৎ-আল সবে আহারে বসেছে। হঠাৎ চারদিক জনরবে মুখর হয়ে উঠলো। কুৎ-আল কান খাড়া করে শুনলো অশ্বক্ষুরধ্বনি। খট খট খটাখট!—ঘানিম! সর্বনাশ হয়েছে। খলিফার সৈন্যবাড়ি ঘিরে ফেলেছে। তুমি পালাও! পালাও।
—কিন্তু তুমি?
–আমার জন্যে কোনও চিন্তা করো না, ঘানিম। যেমন করো পারো, পালাও! তোমাকে ধরতে পারলে আর অস্ত রাখবে না।
ঘানিম কি করবে কিছুই ভাবতে পারে না। বোকার মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
–কিন্তু পালাবো কি করে? ফৌজ তোবাড়ি ঘেরাও করে ফেলছে।
ক্ষিপ্র হাতে কুৎ-অল টেবিল-মোছা ন্যাকড়াটা ফালা ফালা করেছিড়ে ঘানিমের মাথায় ফেটি বেঁধে দেয়। রসুইখানা থেকে এটোকাটার বালতী আর নর্দমা পরিষ্কার করার একটা ঝাড়ু নিয়ে আসে। বলে, শিগ্গির জামা পাতলুন খুলে ফেলো। শুধু ইজেরটা থােক। এই নাও এটোকাটার বালতি-মাথায় তোেল। আর হাতে ধরে এই ঝাড়খানা। যাও গভীর-সে বেরিয়ে হন হন করে কেটে উধাও হয়ে পালাও। ওরা কেউ সন্দেহ করবে না। ভাববে, মেথর। নোংরা পরিষ্কার করতে এসেছিলো। আমার কথা বিলকুল তুমি ভেবো না। আমার কোনও অনিষ্ট করতে পারবে না। ওরা। খলিফার সামনে হাজির হতে পারলে আমার কোনও ভয় নাই। তাকে বশ করার যাদু আমার জানা আছে।
জাফর ঘরে ঢুকে দেখে, কুৎ-অল পালঙ্কে বসে আছে একা। তার সারা দেহ হীরে জহরতের অলঙ্কারে মোড়া। আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানালো জাফর।
কুৎ-অল বলে, নিয়তিই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এখন আপনি আমাকে যেখানে নিয়ে যেতে চান, আমি প্রস্তুত।
জাফর বলে, আমার ওপরে হুকুম হয়েছে, ঘানিব-ইবন আয়ুব নামের এক ছোকরা সওদাগরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে হবে। আপনি কি বলতে পারেন, মালকিন, সে কোথায়?
কুৎ-অল বলে, সে তো দিন কয়েক আগে তার দেশেরবাড়ি দামাসকাসে চলে গেছে! এর বেশী কিছু আর আমি বলতে পারবো না।
জাফর বিনীতভাবে বলে, আপনি যদি মেহেরবানী করে আমার সঙ্গে প্রাসাদে ফিরে চলেন—
নিশ্চয়ই যাবো। যাওয়ার জন্যেই তো আমি তৈরি হয়ে বসে আছি। চলুন।
প্রাসাদে ফিরে এসে জাফর জানায়, ঘানিম কয়েকদিন আগে বাগদাদ ছেড়ে দামাসকাসে ফিরে গেছে। সেখানেই তার দেশ। নিজের বলতে তার মা আর এক বোন আছে।
খলিফা গম্ভীর হলেন। হুম, পালিয়েছে। তা পালিয়ে কোথায় সে যাবে। ধরা তাকে দিতেই হবে।
কুৎ-অল-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘানিমের বয়স কত?
কুৎ-অল বলে, তা মনে হয় চব্বিশ পাঁচশ হবে।
–তা হলে তো ভালোই জন্মেছিলো, কি বলো?
কুৎ-অল বলে, সে কোনও খারাপ কাজ করেনি।
— চোপ রহ, বেশরম—একটা জোয়ান ছেলের সাথে এক সঙ্গে এতদিন কাটালে, আর কিছু খারাপ কাজ করোনি? এও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।–আগুনে ঘি পড়লে জুলবে না? মসরুর; অন্ধকার ঘরে কয়েদ করে রাখে।
—জো হুকুম, জাঁহাপনা!
খলিফা এবার ঘানিমের অনুসন্ধানে মেতে উঠলেন। এক দল অশ্বারোহী ফৌজ পাঠিয়ে দিলেন দামাসকাস শহরে। নিজে হাতে একখানা খৎ লিখে দিলেন।
দামাসকাসের ভারপ্রাপ্ত সুলতান ইবন সুলেমান অল-জেনির প্রতি আব্বাসের পঞ্চম বংশধর। খলিফা হারুন-অল-রসিদ-এর হুকুমনামা।
।।এলাহী ভরসা।।
আশা করি তোমাদের সর্বাঙ্গীন কুশল। মেহেরবান আল্লাহর দোয়ায় সুখে থাকো।
অতঃপর লিখি :
প্রিয় বৎস, তোমার শহরে ঘানিম ইবন আয়ুব নামে এক তরুণ সওদাগর বাস করে। সম্প্রতি সে বাগদাদে এসেছিলো। আমার এক বাদীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠত হয়। এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল যা হওয়া সম্ভব তাই ঘটেছে। কয়েকদিন আগে সে এখান থেকে পালিয়ে আবার দামাসকাসে ফিরে গেছে। আমার বিশ্বাস এখন সে তার মা ও বোনের কাছেই আছে। আমার এই পত্ব পাওয়ামাত্র তাকে গ্রেপ্তার করে পাঁচশো ঘা বেত লাগাবে। উটের পিঠে চাপিয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করাবে। এবং ঘোষণা করে দেবে, খলিফার ব্যক্তিগত সম্পত্তি আত্মসাৎ করার অপরাধে এই সাজা তাকে দেওয়া হচ্ছে। এর পর বদমাইশটাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। তারপর আমি ওর উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করবো।
ওর বাড়ি-ঘরদের ভেঙে চুরে ধূলিসাৎ করে দেবে। ওর মা আর বোনকে উলঙ্গ করে, চৌমাথার মোড়ে তিন দিন তিন রাত্রি দাঁড় করিয়ে রাখবে। তারপর তোমার শহর থেকে বহিষ্কার করে দেবে।
আমার এই হুকুম যথাযথ পালন করবে। খোদা হাফেজ।
তীর বেগে ছুটে চললো অশ্ববাহিনী। বিশদিনের পথ মাত্র আট দিনে পৌঁছে গেলো। সুলতান মহম্মদ খলিফার চিঠিখানা হাতে নিয়ে সাতবার কপালে ছুঁইয়ে শ্রদ্ধা জানায়। তারপর খুলে পড়ে।
ক্ষণমাত্র দেরি না করে লোক লস্কর সঙ্গে নিয়ে ঘানিমেরবাড়ি চড়াও হলো সুলতান। দরজায় কড়া নাড়তেই ফিৎনা দরজা খুলে দেয়। তখন তার মা প্রার্থনায় বসেছিলো। ঘানিম আজ এক বছরের ওপরবাড়ি থেকে চলে গেছে। কিছুদিন আগে বাগদাদ থেকে এক দল সওদাগর ফিরে এসে খবর দিয়েছে ঘানিম নাকি মারা গেছে। সেই থেকে ঘানিমের মা শোকে দুঃখে মুহ্যমান। উঠনের ঠিক মাঝখানে পুত্রের স্মৃতির উদ্দেশে একটা তাজিয়া বানিয়েছে। সারা দিন রাত সেই তাজিয়ার সামনে বসে ছেলের শোকে সে আকুল হয়ে কীদে, আল্লাহর কাছে দোয়া মাঙে।
-ঘানিম কোথায়?
ফিৎনা বলে, সে আজ এক সালের উপর হলো বাগদাদে গেছে। তারপর আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। লোকে বলছে, মারা গেছে।
পুত্রহারা মা-এর অন্তর-ব্যথা অনুভব করে সুলতান। কিন্তু কোনও উপায় নাই। খলিফার হুকুম। অক্ষরে অক্ষরে তামিল করাই তার একমাত্র কর্তব্য। তার ইশারায় কয়েক মুহুর্তের মধ্যে ঘানিমের বাড়ি-ঘর ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিলো। মা আর বোনকে উলঙ্গ করে সদর রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে রাখলো। তিন দিন তিন রাত্রি। তারপর শহর থেকে তাড়িয়ে বের করে দিলো।
এবার ঘানিমের কাহিনী শুনুন জাঁহাপনা। বাগদাদ শহর ছেড়ে বন জঙ্গল ভেঙে উধ্বশ্বাসে ছুটে চলে ঘানিম। খাওয়া নাই নাওয়া নাই অবিশ্রান্ত একটানা পথ চলে চলে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে। উসকুখুসকু চুল, খালি পা, পরণে শুধু একটা ইজের মাত্র। পথে যারা দেখলো, ভাবলো পাগল। এইভাবে এক গ্রামের মসজিদে ঢুকে লুটিয়ে পড়লো। নামাজ পড়তে এসে মৃত-প্রায় যুবককে দেখে গ্রামবাসীদের দয়া হয়। কেউ বললো, ছেলেটার বোধহয় অসুখ করেছে। কেউ বলে, না না, না-খেতে পেয়ে ঐ অবস্থা হয়েছে। একজন দু’খানা রুটি আর মধু এনে খাওয়ালো। শরীর ঠকঠক করে কাঁপছিলো। জুরে গা পুড়ে যাচ্ছে। একজন একটা ছেড়া জামা এনে পর্যালো। একটু সুস্থ বোধ করলে গ্রামবাসীরা জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁ গো বাছা, কোথা থেকে আসছো?
ঘানিম কোনও জবাব দিলো না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। সবাই ভাবলো, জুরে বেৰ্ছশ হয়ে গেছে। তখনকার মতো আর কোন প্রশ্ন না করে যে যার কাজে চলে গেলো।
এইভাবে ঐ মসজিদের বারান্দায় একটা মাস কেটে গেলো। গ্রামবাসীরা অনুগ্রহ করে কিছু খাবার দিয়ে যায়। তাই খেয়ে মসজিদের খোলা বারান্দায় পড়ে থাকে। দিনে মাছি আর রাতে মশার কামড়। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো। এদিকে জুরও ছাড়ে না। অবশেষে গ্রামের মাতব্বাররা ঠিক করলো, এইভাবে এখানে পড়ে থাকলে ছেলেটা মারা যাবে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসা দরকার।
একদল উট যাচ্ছিলো বাগদাদ শহরে। গ্রামবাসীদের অনুরোধে উটের মালিক রাজী হলো। বললো, ঠিক আছে, আমরা ওকে বাগদাদের সদর হাসপাতালের ফটকে নামিয়ে দেব।
গ্রামবাসীরা ঘনিমকে উটের পিঠে ভালো করে বেঁধে দিলো। কিছু দূরে আসার পর উটের পিঠে বাধা ঘানিমকে দেখে বোেরখা ঢাকা দুটি পথচারী মেয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, আচ্ছা মা, দেখো তো, উটের পিঠে ঐ ছেলেটা—যদিও খুব গরীব সরীব, কিন্তু আমার ভাইজান ঘানিমের মতো দেখতে না?
মা বললো, কি জানি বাপু, কেঁদে কেঁদে চোখ আমার অন্ধ হয়ে গেছে। অত দূরে কি আর নজর যায়! তোর ওসব মনের ভুল ফিৎনা ঘানিম কি আমার বেঁচে আছে?
দামাসকাসের সুলতান ওদের দু’জনকে শহর থেকে বহিষ্কার করে দিলে ওরা বাগদাদের পথ ধরে চলতে থাকে। মনে ক্ষীণ আশা, চলতে চলতে একদিন তারা বাগদাদে পৌছবে। ঘনিমকে খুঁজে পাবে আবার।
সারা রাত পথ চলার পর ভোরবেলা উটের দল শহরে পৌছয়। মালিক দেখলো, এখনও হাসপাতালের দরজা খোলেনি। ঘানিমকে দরজার পাশে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ঘানিমের তখনও চৈতন্য নাই। কোথায় সে ছিলো, এখনই বা কোথায় এসেছে কিছুই বুঝতে পারে না। দেওয়ালে হেলান দিয়ে মরার মতো পড়ে থাকে।
রাত্রির আঁধার কেটে গেলো। সবে রাস্তাঘাটে লোকজন বেরুতে শুরু করেছে। পথচারীদের মধ্যে কেউ হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। লোকটার চেহারার সঙ্গে ঘানিমের কেমন মিল খুঁজে পায়? আবার ভাবে, দূর তা কি করে হবে? ঘানিম এখানে আসবে কি করে? একটু পরে বাজারের এক নামজাদা দোকানের মালিক ওকে দেখতে পায়। তার কিন্তু কোনও সংশয় হয় না। কতদিন তার দোকানো গেছে সে। কত আলাপ পরিচয়। কত সওদা করেছে। সে ভাবে, হায় আল্লাহ, ওকে যদি হাসপাতালে ভর্তিও করা হয় রোগের হাত থেকে বাঁচলেও খলিফার রোষ থেকে রেহাই পাবে না। মৃত্যু তার অনিবার্য। ওকে বাঁচাতে হবে। যেভাবেই হোক বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে। জেনে শুনে ওকে এইভাবে ফেলে রেখে গেলে আল্লাহর দরবারে সে কোনও কৈফিয়ৎ দিতে পারবে না। তার নিজের কাধে ঘানিমের দেহভার নিয়ে কোনরকমে আস্তে আস্তে বাড়িতে নিয়ে এলো দোকানী। বিবিকে ডেকে বললে, আজ থেকে এই মেহেমান আমাদের বাড়িতে থাকবে। খুব অসুস্থ। একে সুস্থ সবল করে তোলার দায়িত্ব তোমার।
দোকানী মালিক গরম জল করে ঘানিমের সারা শরীর মুছিয়ে দিলো। নতুন জামা কাপড় এনে পর্যালো। এক গেলাস দুধ এনে খাওয়ালো। এবার ঘানিম একটু সুস্থ বোধ করে। মনে হয় জুরের তোড়টা খানিক কমেছে। ধীরে ধীরে তার সব মনে পড়তে থাকে। বাগদাদ শহর। তার ব্যবসা। তার মা বোন ফিৎনা। তার কুৎ-আল-কুলুব—তার ভালোবাসা।
এই সময়ে রাত্রির অন্ধকার কাটতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
বিয়াল্লিশতম রজনীর দ্বিতীয় যামে আবার গল্প শুরু হয়।
এক গেলাস গরম দুধ খাওয়ার পর ঘানিম কিছুটা সুস্থ বোধ করে। একে একে আবার সব মনে পড়তে থাকে। তার মা বোন। তার ভালোবাসা-কুৎ-আল-কুলুব।
এদিকে কুৎ-আল-কুলুবকে অন্ধকার ঘরে বন্দী করে রেখেছেন খলিফা। দ্বারে প্রহরারত সেই বৃদ্ধ বুড়ি দাসী। প্রায় একটা মাস কেটে গেছে। খলিফা নানা কাজের ঝামেলায় এসব ঘটনা একেবারেই ভুলে গেছেন। একদিন প্রাসাদে ঢুকছেন, এমন সময় করুণ কান্না ভেসে এলো তার কানে। খলিফার তখন স্মরণ হয়, প্রায় এক মাস আগে কুৎ-অলকে তিনি অন্ধকার ঘরে কারারুদ্ধ করে রেখেছেন। একেবারে ভুলে গেছেন। কেউ মনেও করিয়ে দেয়নি। ধীরপায়ে দরজার পাশে দাঁড়ান। কুৎ-আল-কাঁদছে, ঘানিম, তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে কেন ঘানিম। না হয় আমি সুলতানের কবরখানায় মাটি চাপা পড়েই মরে থাকতাম। এ জীবনে আজ বেঁচে থেকেই বাকি ফয়দা পেলাম। তুমি আমার সঙ্গে সহবাস করোনি সে কথা তো খলিফা বিশ্বাস করলেন না। তবে কেন তুমি নিজেকে অত সংযত করে রাখলে? আলাদা শয্যায় রাত কাটালে। জানি না তুমি বেঁচে আছো কিনা, বেঁচে থাকলেও তোমার রেহাই নাই। খলিফার চর সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। যেখানেই থাকো একদিন না একদিন তোমাকে ধরে শূলে চড়াবেনই। তুমি তার মেয়েছেলের ইজ্জৎ রাখার জন্যে নিজেকে বঞ্চিত করে কি যে দারুণ সংযম দেখালে! আমি মেয়েমানুষ, আর কেউ বুকুক আর নাই বুকুক আমি বুঝি ঐভাবে অতগুলো নিঃসঙ্গ রাত্রি তোমার কি দুঃসহ যন্ত্রণায় কেটেছে। কিন্তু কি তার ইনাম পেলে ঘানিম? প্রাণদণ্ডের হুলিয়া! আর তোমার মা বোনের বে-ইজৎ? এই তোমার পুরস্কার? তুমি দুঃখ করো না ঘানিম, তোমার সঙ্গে আর আমার কোনওদিন দেখা হবে না। তবে দেখা হবে। আর একবার আল্লাহর দরবারে। শেষ বিচারের দিন। সেদিন তুমি এর যোগ্য পুরস্কার পাবে।
এই প্রথম খলিফা উপলব্ধি করলেন, ঘানিম নির্দোষ। নিজের ঘরে ফিরে এলেন। হুকুম করলেন, কুৎ-অলকে নিয়ে এসো।
রোরুদ্যমানা কুৎ-অল এসে দাঁড়ালে খলিফা অনুতপ্ত কণ্ঠে বললেন, আমাকে মার্জনা করো সুন্দরী, অনেক মিথ্যা সন্দেহ করে তোমাকে বহুৎ কষ্ট দিয়েছি। আমার মনে হচ্ছে, আল্লাহর দরবারে একটা বড় গুনাহ করে ফেলেছি। কুৎ-অল, তুমি তখন কেঁদে কেঁদে কি সব বলছিলো? যে আমার মেয়েছেলের ইজ্জত রক্ষা করেছে। আমি তার ঘরের মা-বোনের ইজৎ নষ্ট করেছি? কে সে?
–ধর্মাবতার সে সে-ই ঘানিম। এক মাসের ওপর আমার সঙ্গে সে এক ঘরে রাত কাটিয়েছে। শক্ত সমর্থ জোয়ান পুরুষ। আমার মতে রূপসী মেয়ের পাশে পাশে থেকে নিজেকে ঠিক রাখা কতটা শক্ত আপনি নিশ্চয় অনুমান করতে পারেন হুজুর। কিন্তু একদিনের তরেও তার পদস্থালন হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি আমিই তাকে প্রলুব্ধ করেছি নানাভাবে। কিন্তু যখনই সে শুনেছে আমি আপনার ভোগ্য, তারপর থেকে অসাধারণ সংযমে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সে। আপনার প্রতি এই অসীম শ্রদ্ধার সে উপযুক্ত পুরস্কার পেয়েছে। তার মা বোনের ইজৎ আপনি ধূলায় লুটিয়ে দিয়েছেন। তাদের মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু আপনি রাখেননি।
খলিফা কোনও জবাব দিতে পারেন না। মাথা নিচু করে দু’হাতে মুখ ঢাকেন।—সত্যি, কুৎ-অল বড় মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। সব ক্ষতি অর্থ দিয়ে পূরণ করা যায়। কিন্তুইজৎ একবার খোয়া গেলে তার ক্ষতিপূরণ আর কিছুতেই হয় না। তবু বলো, কুৎ-অল, যতটুকু পারি। আমি করবো। তোমরা যা চাও তাই আমি দেব।
আমার নিজের জন্যে কিছুই চাইবার নাই, জাঁহাপনা। শুধু আর্জি, ঘানিম নির্দোষ। ওকে কোনও সাজা দেবেন না।
–কিন্তু সাজা দেব কাকে? সারা দামাসকাসে সারা বাগদাদ-এ। তার কোন হদিশ পাওয়া যায়নি। আমি দেখছি, তাকে যদি খুঁজে পাই, যদিও তুমি আমার বড় আদরের বাঁদী, তার হাতেই তোমাকে তুলে দেব।
—জাঁহাপনা, যদি অনুমতি করেন আমি তাকে একবার খুঁজে দেখতে পারি।
–আমার কোনও অমত নাই কুৎ-আল। আজ থেকে ঘানিম তোমার। তাকে যদি খুঁজে পাওয়া যায় আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের শাদী দিয়ে দেব।
খুশিতে কুৎ-অল-এর মন নেচে ওঠে। সঙ্গে হাজার খানেক দিনার নিয়ে ঘানিমের সন্ধানে বাগদাদের পথে বেরিয়ে পড়ে। প্রথম দিন সারা শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত জনে জনে জিজ্ঞেস করেও কোন সন্ধান পেলো না। পরের দিন সে বাজারের বড় বড় দোকানে ঢুকে খোজ করলো। এই সব দোকানে সে তার সওদা বিক্রি করতো। কিন্তু তারাও কেউ কিছু বলতে পারলো না। পরদিন সে গেলো জহুরীদের দোকানে। জনে জনে জিজ্ঞেস করতে করতে এক বৃদ্ধ জহুরী বললো, মা, কয়েকদিন আগে এক বিদেশীকে আমি অসুস্থ অবস্থায় সদর হাসপাতালের ফটক থেকে তুলে নিয়ে এসেছি। এখন সে আমার বাড়িতে আছে। তবে খুব দুর্বল। খুলে কিছুই বলতে চায় না, তবে মনে হয় কোনও ভালোবাসার ব্যাপারে ঘা খেয়েছে। পয়সাকডি সব খুইয়ে সর্বস্বাস্ত হয়েছে। তবে দেখে মনে হয় খানদানী ঘরেরই ছেলে।
কুৎ-অল অধৈর্য হয়ে ওঠে। বলে, দেখুন, আপনার তো এখন কাজের সময়। দোকানপাট ফেলে যেতে পারবেন না। তা যদি আমার সঙ্গে কাউকে দেন—আপনার বাড়িটা সে চিনিয়ে দিতি
শেখসাহেব একটি ছোট্ট বাচ্চাকে সঙ্গে দিলো। ছেলেটি তারবাড়ি চেনে। কুৎ-অলকে সে পৌঁছে দিলো তার বাড়ি। দরজায় কড়া নাড়তেই শেখসাহেবের বিবি দরজা খুলে দেয়। কুৎ-আল-কুলুবকে দেখে চিনতে পারে। মাটি ছুঁয়ে সালাম জানায়। কুৎ-অল তাকে দু’হাত বাড়িয়ে তুলে ধরে।–মা, শুনলাম আপনার ঘরে এক অসুস্থ বিদেশীকে আশ্রয় দিয়েছেন। আমি তাকে একবার দেখতে চাই।
—কিন্তু তাকে দেখেই বা কি করবে। মা। জুরের ঘোরে বেন্থশ হয়ে পড়ে আছে। সাধ্য মতো চিকিৎসাপত্র করাচ্ছি। কিন্তু জ্বর ছাড়ে না। চেহারা একেবারে কঙ্কালসাড় হয়ে গেছে।
–তা হোক। তবু আমাকে একবার নিয়ে চলুন, আমি দেখবো।
শেখ-এর বিবি কুৎ-অলকে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। একটা পালঙ্কে শুয়েছিলো ঘানিম। জুরে বেহুশ। প্রথম দর্শনে কুৎ-আল-এর সন্দেহ হয়। না না, এ কেমন করে হবে ঘানিম। ঘানিমের কি সুন্দর স্বাস্থ্য রূপ জৌলুস দেখেছে সে। তার সঙ্গে এর মিল কোথায়? যাই হোক, শেখের বিবিকে বলে, ওরা যেন কোন অযত্ন না হয় মা। এই নিন রাখুন। এই টাকাটা। শহরের সবচেয়ে বড় হেকিমকে ডেকে দেখান। যত দামী ওষুধ দরকার হয় দিন। বাজারের সেরা ফল দুধ ওকে খেতে দেবেন। আরও টাকা আমি দিয়ে যাবো।
কুৎ-অলের সঙ্গে ছিলো হাজার খানেক দিনার। সবটাই সে শেখ-স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে সেদিনের মতো প্রাসাদে ফিরে যায়। সারা রাত ঘানিমের মুখটা কল্পনা করে, আর কল্পনা করে সেই রুগ্ন হাড় জিরজিরে যুবকের মুখ। দুজনের মুখ এক করে মেলাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোথায় যেন খেই হারিয়ে যায়। এক করতে পারে না। এই একটা মাসের মধ্যে মানুষের চেহারা এত পাল্টে যেতে পারে?
পরদিন সকালে সে বাজারে যায়। সেই বৃদ্ধ জহুরীর সঙ্গে দেখা করে। উদ্দেশ্য ছেলেটি সম্পর্কে আরও যদি কিছু তথ্য সংগ্বহ করা যায়।
শেখ বললো, মাজননী, গতকাল তুমি চলে যাওয়ার পর দুটি গরীব ভিখিরি মেয়েছেলে এসেছিলো আমার দোকানে। দেখেই মনে হলো বিদেশী। নতুন এসেছে শহরে। তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, শুধু ভিক্ষে করার জন্যে এই বিদেশে এসেছো? তা মা, জবাবে যা বললো, শুনে মনে হলো, তুমিও যাকে খুঁজছো তারাও তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
—কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তারা?
—ঐ যে বললে না? ঘানিম-ইবন-আয়ুব?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, তারা কেন খুঁজে বেড়াচ্ছে? কোথায় তারা? কোথা থেকে এসেছে? শেখ বলে, কেন খুঁজছে তা তো বলতে পারবো না, মা। তবে কোথায় আস্তানা গেড়েছে বলতে পারি। একটু এগুলেই তো ধরমশালা দেখতে পাবে, তারই দাওয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা এসেছে দামাসকাস থেকে?
—দামাসকাস থেকে। তবে তো ওরা ঘানিমের মা আর বোন ফিৎনা।
শেখ বললো, তা হতে পারে। তুমি যদি চাও, ডেকে দিতে পারি।
—একবার ডেকে পাঠালে ভালেই হয়।
শেখ ডাকলো, এই ফুলফুল! ফুলফুল!
সেই ছোট্ট বাচ্চাটা এসে দাঁড়ালো, দেখতো ঐ মুসাফিরখানার দাওয়ায় দুটি মেয়ে বসে আছে—ডেকে নিয়ে আয়।
বাচ্চাটা ছুটতে ছুটতে চলে গেলো। একটু পরে বোেরখা ঢাকা দুটি মেয়ে এসে দাঁড়ালো কুৎ-অল-এর সামনে।
তাদের পরিচয়পত্র জেনে বুঝলো, তার অনুমান ঠিকই। তারা দুজনে ঘানিমের মা আর বোনই বটে।
জহুরীর হাতে দিনারের একটা থলে তুলে দিয়ে কুৎ-আল-কুলুব বললো, আমার অনুরোধ, এদের দু’জনকে আপনারবাড়ি নিয়ে এসে আব্দর যত্নে রাখুন। এই নিন। এতে হাজার খানেক দিনার আছে। আরও যা লাগে সব খরচা আমি দেব। কিন্তু একটু লক্ষ্য রাখবেন, যেন কোনও অযত্ন না হয়।
জহুরী বিগলিত হয়ে বলে, এ-তো আমার কাছে হুকুম। কিছু চিন্তা করো না, মা। ওরা আদরে থাকবে।
এই সময় রজনী অতিক্রান্ত দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
পরদিন তেতাল্লিশতম রজনী।
আবার গল্প শুরু করে শাহরাজাদ।
কুৎ-অল জহুরীর হাতে ধরে বললো, এই টাকা পয়সা রইলো। আপনি মেহেরবানী করে ওদের খাওয়া পরার যথাযোগ্য ব্যবস্থা করবেন।
পরদিন স্বচক্ষে দেখবার জন্য কুৎ-আল-কুলুব সোজা জহুরীরবাড়ি গিয়ে হাজির হলো। শেখের বিবি তো তাকে মহা খাতির যত্ন করে অভ্যর্থনা করলো। তারপর ঘানিমের মা আর বোনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো। ছিন্ন ময়লা বেশবাস পরিত্যাগ করে আজ তারা নতুন পোশাক পরেছে। গোসল করে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়েছে। কুৎ-অল লক্ষ্য করলে, ফিৎনা দেখতে বেশ সুন্দরী। দীর্ঘদিনের পথশ্বম, অনাহার অনিদ্রার ফলে ওর আসল চেহারা অনুমান করতে পারেনি। এই কটা দিনেই কেমন সুন্দর চেকনাই লাবণ্য ফুটে উঠেছে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে তাদের সঙ্গে নানা কথা হলো। শেখ-গৃহিণী অবাক হয়। খলিফার পিয়ারী। অথচ এতটুকু অহংকার নাই। যাবার আগে কুৎ-আল জিজ্ঞেস করে, রুগী কেমন আছে?
—ঐ সেই একই রকম।
-কী খেতে দিচ্ছেন?
–হেকিম তো শক্ত কিছু খেতে দিচ্ছেন না। দুধ, মুরগীর ঝোল, আঙুরের, বেদোনার রস-এই সব।
—আর ওষুধপত্র?
-সে তো লম্বা ফিরিস্তি। ঘন্টায় ঘণ্টায় খাওয়াতে হচ্ছে। হেকিম বলেছে দিন কয়েকের মধ্যে বাছা আমার চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
—তা চলুন, একবার দেখে যাই।
কুৎ-অল ঘানিমের মা বোনকে সঙ্গে নিয়ে রুগীর ঘরে ঢোকে। ঘানিম চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। ঘরের এক পাশে বসে ওরা আবার নানা কথায় মশগুল হয়ে ওঠে। এক সময় ঘানিমের মা জিজ্ঞেস করে। কিছু মনে করে নামা, আমি তোমার মায়ের মতো, কালকেও তোমাকে দেখলাম; আজকেও এখানে দেখছি, কে মা তুমি? আমাদের জন্যে এত করছে?
কুৎ-অল হাসে। শুধু বলে, আমার নাম কুৎ-আল-কুলুব।
এই একটিমাত্র নামেমাচ্চারণে যাদুমন্ত্রের মতো কাজ হয়। পলকে উঠে বসে ঘানিম। তাকিয়ে
দেখে সামনে দাঁড়িয়ে তার ভালোবাসা।—আকুলভাবে দু’হাত বাড়িয়ে আর্তনাদ করে ওঠে, কুৎ-আল-কুলুব-?
ঘানিমের গলার আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে কুৎ-আল। এ কণ্ঠ তার খুব চেনা।-ঘানিম, ঘানিম তুমি, সোনা?
—হ্যাঁ আমি ঘানিম।
কুৎ-আল আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। অচৈতন্য হয়ে যায় ঘানিমের মা আর কোনও। একটু পরে কুৎ-অল নিজেকে সংযত করে বলে, অবশেষে আল্লাহর দোয়ায় তোমাকে ফিরে পেলাম! আর এই দেখো, তোমার পাশে তোমার মা বোনও এসে গেছেন।
তারপর কুৎ-অল সব বৃত্তান্ত খুলে বললো। বললো, খলিফা আমার কথা বিশ্বাস করেছেন। তোমার তিনি সন্ধান করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমার সঙ্গে আমার শাদী দিয়ে দেবেন।
এ কথা ঘানিম বিশ্বাস করতে পারে না। এত দিন সে দুঃখশোকে তাপে মৃত-কল্প হয়েছিলো, এবারে আনন্দ সংবাদে আত্মহারা হয়ে বুঝি প্রাণ সংশয় ঘটবে। একি কথা শোনালো কুৎ-অল। খলিফা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কুৎ-আল-এর সঙ্গে তার শাদী হবে? কুং-আলোর হাতে একটা চুমু দেয় ঘানিম।
কুৎ-অল বলে, তোমরা একটুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি আসছি।
কুৎ-আল আর দাঁড়ায় না। সোজা চলে আসে প্রাসাদে। তার নিজের জমানো টাকা থেকে একটা থলে ভর্তি করে নিয়ে এসে শেখ-এর হাতে দেয়। বলে, মেহেরবানী করে ঘানিমের মা বোনের জন্যে চার পরস্ত জমকালো দামী পোশাক কিনে নিয়ে আসুন। যত দাম লাগে লাগুক। তার জন্যে ভাববেন না। সেই সঙ্গে নেবেন খানকুড়ি রেশমী রুমাল।
এর পর শেখেরবাড়ি ফিরে এসে ঘানিমের মা আর বোনকে ভালো করে গোসল সেরে নিতে বলে। শেখের বিবির হাতে একটা মুঠো মোহর গুজে দেয়।-চাকরকে বাজারে পাঠান। ভালো দেখে মুরগী, মাংসের চাপ, শব্জী, আঙুর, আপেল, বেদানা আর খানিকটা দামী সরাব নিয়ে আসতে বলুন। আজ আমি নিজে হাতে খানা পাকাবো। আপনাদের সবাইকে খাওয়াবো।
চাকরটা বাজার করে নিয়ে এলো। নানারকম সুন্দর সুন্দর খানা বানালো কুৎ-অল। সবাইকে নিজে হাতে পরিবেশন করে খাওয়ালো। সারাটা দিন খুব হৈ হল্লা করে কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলা প্রাসাদে ফিরে এলো। পরদিন সকালে উঠে আবার সে শেখেরবাড়ি এসে হাজির। সারা দিন ধরে খানাপিনা করে আবার ফিরে যায় প্রাসাদে। এইভাবে পর পর চারটে দিন খুব আমোদ করে কাটে। ভালো ভালো খানাপিনা করে ঘানিমের মা আর বোন-এর যেমন চেকনীই খোলে, তেমনি ঘানিমও বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। পরদিন কুৎ-অল নিজে হাতে সাজিয়ে দেয়। ফিৎনা আর তার মাকে। নতুন সাজপোশাক কিনে এনেছিলো শেখ। সেই দামী দামী পোশাক পরালো দুজনকে। ঘানিম তার মা আর সুন্দরী বোন ফিৎনাকে সঙ্গে নিয়ে কুৎ-আল খলিফার প্রাসাদে এসে হাজির ठूश।
খলিফা তখন তার খাসমহলে বিশ্রাম করছিলেন। ঘানিম, তার মা আর বোন ফিৎনাকে একটা ঘরে বসিয়ে রেখে কুৎ-অল এলো খলিফার কাছে।
-জাঁহাপনা, আমি ঘানিমের সন্ধান পেয়েছি। তার মা আর বোন ফিৎনাও এসেছে বাগদাদে। ওদের সবাইকে নিয়ে এসেছি।
খলিফা খুশি হন।—ঠিক আছে, ওদের নিয়ে এসে আমার কাছে।
ঘানিম, তার মা আর বোন এসে কুর্নিশ জানিয়ে দাঁড়ালো। খলিফা বললেন, তুমি ঘানিম?
–গোলাম হাজির জাঁহাপনা।
খলিফা বললেন, গোলাম কেন, তুমি আমার ভাই। কাছে এসো। ভুল করে আমি তোমাদের অনেক দুঃখ কষ্ট দিয়েছি! তোমার মা বোনের ইজ্জৎ ধ্বংস করেছি। জানি না। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কি দিয়ে হবে?
ঘানিম বললো, ও কথা বলবেন না, হুজুর। আমি আপনার বান্দা। বান্দা কখনও মালিকের ন্যায় অন্যায় বিচার করতে পারে না।
খলিফা অবাক হন। বাঃ চমৎকার কথা বলে তো ছেলেটি! আদর করে পাশে বসান। বলেন, আমি ঠিক করেছি ঘানিম, আমার পিয়ারের বাঁদী কুৎ-অল-এর সঙ্গে তোমার শাদী দেব।
—হুজুরের হুকুম তামিল করার জন্য বান্দা সর্বদাই প্রস্তুত, জাঁহাপনা।
খলিফা বলেন, আরও একটা প্রস্তাব আছে ঘানিম। একদিন তোমার মার আর এই বোন ফিৎনাকে আমি বে-ইজৎ করেছিলাম। টাকা পয়সার বিনিময়ে সবই পাওয়া যায়। কিন্তু ইজৎ একবার খোয়া গেলে আর ফেরৎ পাওয়া যায় না। সে দিক থেকে আমি অসহায়। কোনও ধন-দৌলত দিয়েই তার ক্ষতিপূরণ করতে পারবো না। সেই কারণে ভেবেছি, তোমার বোন ফিৎনাকে শাদী করে আমি তাকে বেগমের মর্যাদা দেব। হয়ত বা এতে কিছু সান্ত্বনা পাবো। এখন তুমি পাত্রী পক্ষ, তোমার কি অভিপ্রায়, বলো।
হঠাৎ এইরকম একটা অভাবনীয় প্রস্তাবে ঘানিম হতভম্ব হয়ে যায়। এক মুহূর্ত মুখে কথা সরে না। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আপনার মতো মহাপ্ৰাণ মহাপুরুষই একথা উচ্চারণ করতে পারেন। না হলে, যে কারণেই হোক, হাজার হাজার মানুষের কাছে যাকে একদিন বেইজিৎ করা হয়েছে, তাকে আজ। আপনার হারেমের বেগম করতে চান? এত বড় সম্মান, এত বড় মর্যাদা পাওয়ার কি সে যোগ্যা?
খলিফা বলেন, আমার দোষে সে যে বস্তু একদিন হারিয়েছে তা তো আর তাকে ফেরৎ দিতে পারবো না ঘানিম। তাই আজ তাকে আমি বেগমের মর্যাদা দিয়ে সামান্য একটু ক্ষতিপূরণের সান্তুনা পেতে চাই।
ঘানিম বলে, ফিৎনা আপনার বাদী হয়ে থাকবে, জাঁহাপনা।
খলিফার হুকুমে তখুনি কাজীকে ডেকে এনে দু’খানা শাদীর কবুলনামা তৈরি করা হলো। একখানা ঘানিম। আর কুৎ-আল-কুলুব-এর আর একখানা খলিফা আর ফিৎনার জন্যে। দেন-মোহর হিসাবে খলিফা ফিৎনাকে দিলেন এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা। আর ঘানিম কুৎ-এর কানে কানে বললো, আমার দেন-মোহর বাকী রইলো। আজ রাতে দেব, কেমন?
কুৎ-অল-এর সারা মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে, অসভ্য কোথাকার।
সেই রাতে মহা ধুমধাম করে দুই জোড়ের শাদী হয়ে গেলো। সারা বাগদাদ শহর আলোর মালায় সাজানো হলো। নাচ গান, হৈ হল্লা, খানাপিনীয় মেতে উঠলো শহরবাসীরা। সেই রাতে প্রাসাদের দুই মহলে দুই বাসর শয্যায় খলিফা-ফিৎনা আর ঘানিম-কুৎ-অল মধুযামিনী যাপন করলো।
ঘানিম-কুৎ-অলের জন্যে খলিফা একখানা সুরম্য ইমারাৎ বানিয়ে দিলেন। ঘানিম দরবারের এক উচ্চ পদে বহাল হলো। মা এবং বিবি কুৎ-অলকে নিয়ে সুখে স্বচ্ছন্দে ঘরসংসার করতে থাকলো!
শাহরাজাদ বলে, জাঁহাপনা, ঘানিম। আর কুৎ-আল-কুলুব-এর কাহিনী শুনলেন। যদি ইচ্ছা করেন, এবার আপনাকে শোনাতে পারি উমর অল-নুমান আর পুত্র দু-আল-মাকান-এর এক বিচিত্র কাহিনী।
বাদশাহ শারিয়ার বলে, বলো, আমি শুনবো।