শাম্ব – (কালকূট) – সমরেশ বসু

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

…..মহর্ষি হেসে বললেন, ‘চোখে পড়লে তাে আপনি জানতেই পারতেন। ওপরে শান্ত জলরাশি, অথচ তলের গভীরে খরস্রোতের মতাে সেই পাপের ধারা বহে চলেছে। তির্যগযোনিসভূত অনার্যরাজের কন্যা, জাম্ববতী তনয় শাম্ব তার কারণ।

কৃষ্ণ অধিকতর বিস্ময়ে বললেন, ‘শাম্ব ? তার বিষয়ে যদুবংশে কোনাে মালিন্য নেই। আমার এই রূপবান সন্তানটি সকলের প্রিয়। 

মহর্ষি বিদ্যুপে কুটিল: হেসে বললেন, হ্যাঁ, শাম্ব সকলের প্রিয়, কিন্তু সে প্রিয়তম পুরষ আপনার ষােল হাজার রমণীর! যে-ষােল হাজার রমণীকে উদ্ধার করে, আপনি ভর্তাস্বরপ তাদের গ্রহণ করেছেন, যাদের প্রতি প্রেমবশতঃ স্যমন্তক – মণি আপনি ধারণ করতে পারেন নি, সেই ষােল হাজার রমণী শাম্ব সঙ্গলাভে ব্যাকুল। শাম্বই তাদের ধ্যানজ্ঞান। এ কি পাপ নয় ?

কৃষ্ণ এক মুহুর্ত দ্বিধাগ্রস্ত হলেও পরমুহুর্তেই দঢ়স্বরে বললেন, হ্যাঁ, পাপ, কিন্তু আপনার অভিযােগ সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। মহর্ষি, আপনি ত্রিভুবনখ্যাত, সীমাহীন আপনার অভিজ্ঞতা। তবু বলি, আমার পুত্র ও প্রেয়সীদের বিষয়ে এই অভিযােগ আমি বিশ্বাস করি না। শাম্বর সদাচার বিশ্বস্ততা পিতৃভক্তি প্রশ্নের অতীত। আমার ষোল সহস্র স্ত্রী সহচরী রমণীদের বিষয়েও আমার মনে কোনাে দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব নেই।

মহর্ষি গম্ভীর হয়ে উঠলেন, তাঁর অন্তরের কোপানল বর্ধিত হলাে। বললেন, ‘আমি ত্রিভুবনখ্যাত, আমার অভিজ্ঞতা সীমাহীন। কিন্তু বাসুদেব, আপনার অন্তর্দষ্টি গভীর ও ব্যাপক, অতুলনীয়। যে-কোনাে বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সকলের সাধনার বস্তু। রমণীর চরিত্র আর মন সম্পর্কে আপনি এমন দ্বিধাহীন হচ্ছেন কেমন করে?

‘কারণ আমি সত্যাশ্রয়ী।’ কৃষ্ণ বললেন, মহর্ষি, আপনি জানেন, এই ষােল হাজার রমণী দ্বারকার যদচ্ছ বিচরণকারিণী। আমাদের বংশের পুত্রগণ ব্যতীত, যাদবশ্রেষ্ঠগণের অনেকেই এই রমণীদের প্রার্থনা করে থাকেন, যথোচিত সমাদরের দ্বারা সঙ্গলাভও করে থাকেন। তা কোনাে দুষণীয় বিষয় না। এদের মধ্যে আপনি বাদ দেবেন, রক্সিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, গান্দরী (ধতরাষ্ট্র-পত্নী নন), হৈমবতী, শৈবা, প্রস্রাসিনী, ব্ৰতিনী এই আটজনকে। এই রমণীরত্নগণ আমার মহিষী। ষােল হাজার রমণীরত্নও স্বর্গের অপ্সরাতুল্য একান্ত আমার দ্বারাই রক্ষিত। তাদের রক্ষণাবেক্ষণের সকল দায় দায়িত্ব আমার। আমি তাদের গতিবিধি আচরণ সবই জানি।• • • • • • • 

…….প্রমােদকনিনে বিশাল সুমিষ্ট স্বচ্ছ জলাশয়।

নারদ দুর থেকে দেখলেন, কৃষ্ণ তার মহিষী ও ষোলসহস্র রমণীগণসহ জলকেলিতে সুখে-মগ্ন। বাসুদেবকে ঘিরে জল মধ্যে নানা রমণী নানা ক্রীড়াকৌতুকে, মরালীর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ কৃষ্ণকে স্পর্শের জন্য ব্যাকুল, কেউ জল মধ্যে বিহার আকাঙক্ষায় মীনসমূহ যেমন জলমধ্যে নিমগ্ন বক্ষের চারপাশে খেলা করে সেইরুপ করছিল। কেউ কেউ সুরাসব পানে অতি প্রমত্তা হয়ে নানারপ প্রণয় কথা উচ্চারণ করছে। অন্যান্য বান্ধবীদের পৈষ্ঠী ও সুরাসবের পাত্র এগিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেই আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বাসুদেবকে অনুভব করছে। স্বভাবতই প্রমােদকানন ও জলাশয়ে রমণীর উচ্চহাস্যে প্রগলভ কথাবার্তায় প্রমত্তা। জলাশয়ও তাদের কেলি উদ্দামে অতি উচ্ছাসে তরঙ্গায়িত।

কৃষ্ণ স্বয়ং অতি উদার ও প্রমত্ত বাঞ্ছায় প্রিয় রমণীগণের সহবাসে সকলের ইচ্ছাপূরণ ও আহমাদিত করছেন। এই অতি প্রেমােচ্ছল জলকেলিতে বৃক্ষের পাখীরা নানা স্বরে রব করছে। বিচিত্র বর্ণের পতঙ্গসমূহ কাননের শােভা বর্ধন করছে। রমণীগণের সঙ্গে মরালীরাও জলাশয়ের অন্যপ্রান্তে নিজেদের মধ্যে কেলি করছে।

নারদ দেখলেন, সুরাসব পানে অতি প্রমত্তা রমণীগণের অগের বসনভূষণ সকলই শিথিল ও খলিতপ্রায়। নিজেদের নগ্নতা বিষয়ে তাদের কোনাে ক্ষেপ নেই। থাকবার কথাও না। কারণ রৈবতকের এই প্রমােদ কাননে ও জলাশয়ে একমাত্র পুরুষ কৃষ্ণ ছাড়া কারােরই উপস্থিতির কোনাে উপায় নেই। কৃষ্ণের প্রমােদকানন ও জলকেলি থান কৃষ্ণ ছাড়া সকলের অগম্য এ কথা দ্বারকায় সর্বজনবিদিত। কিন্তু তার অর্থ এই না, কৃষ্ণ কোনাে প্রয়ােজনে সেখানে কারােকে ডেকে আনতে পারবেন না। বিলাস অবকাশেও অনেক সময় কর্মজীবনের জরুরী প্রয়োজন ঘটতে পারে।

নারদ দেখলেন, এই তাঁর সেই প্রকৃষ্ট সুযােগ উপস্থিত। রমণীরা সরাসব পানে ও যৌবন সম্ভােগেচ্ছায় অতি প্রমত্তা, হাস্যে লাস্যে কৌতুকে কেলিতে প্রমােদকানন মখরিত। তিনি নগরের প্রাসাদে ফিরে গেলেন। প্রাসাদের কাছাকাছি কুঞ্জমধ্যে শাম্বকে তাঁর সহচরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় খুজে পেলেন। রপবান শাম্বকে রমণীর সােহাগে অধিকতর রুপবান দেখাচ্ছিল। নারদ কিছুটা দ্বিধা ও সংকোচ করে বললেন, ‘শাম্ব, তোমাকে সুখে বাধা দিতে চাই না। বাসুদেব এখনও তাঁর রৈবতকের প্রমাদকাননে রয়েছেন। সেখানে তিনি তােমাকে স্মরণ করেছেন।

শাশ্ব তৎক্ষণাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলেন। মহর্ষি বাক্য কখনাে মিথ্যা হবার নয়। পিতা স্মরণ করেছেন শোনা মাত্র তিনি দ্রুতগতি হয়ে, প্রমােদকাননে উপথিত হলেন। কৃষ্ণ এমন অসময়ে, তার প্রমোদকাননে কেলিস্থলে শাম্বকে দেখে অবাক হলেন। কিন্তু তাঁর ষােলসহস্র রমণীগণ, রুপবান শাশ্বকে দেখে উল্লাসে মেতে উঠলাে। তাদের সকলের আরক্ত সিক্ত চোখ মুখ কামনায় উদ্বেল হয়ে উঠলাে। কামেচ্ছাসে তারা সকলে নির্বাক হয়ে থাকতে পারলাে না। কৃষ্ণের উপস্থিতি সত্ত্বেও শাম্বের রুপ নিয়ে তারা প্রগলভ গুঞ্জনে মেতে উঠলাে। | নারদ বুঝলেন, এটা প্রথম ধাপ। রমণীরা এখনাে তাদের যৌবনপ্রস্ফুটিত দেহ জলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। অবিশ্যি সকল রমণীর মধ্যে তিনজন কৃষ্ণের নিকটবর্তী হয়ে অধােবদন ছিলেন। তাঁরা জাম্ববতী, রকিণী, সত্যভামা। তাঁরা অবাক ও গম্ভীর হয়ে ছিলেন। মত্ততা দূরের কথা, কোনাে প্রকারের বিকার তাঁদের ছিল না। নারদ এতক্ষণ অন্তরালে ছিলেন। এবার কৃষ্ণের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন।

মহর্ষিকে দেখা মাত্র তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য সকল নারী কুল থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু ফল হলো বিপরীত। নারদকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে রমণীগণ শাম্বকে তাদের প্রস্ফুটিত যৌবন দেখাতেই অত্যুৎসাহী হয়ে উঠলাে। তাদের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ বিবিধ ভঙ্গিসহকারে শাম্বর সামনে এমনভাবে উচ্ছিত হলাে যে, সকলের কামােচ্ছাস অত্যন্ত প্রকটিত হলাে। অতিমাত্রায় সুরাসবপানে, মত্ততাপ্রসূত, তারা শাম্বর প্রতি অতিপ্রার্থিনী হয়ে তাদের উজ্জল রপলাবণ্যরাশি অনাবৃত করলাে।  নারদের সঙ্গে কৃষ্ণের একবার দৃষ্টিবিনিময় হলাে। পরমুহর্তেই মর্মাহত বাসুদেব ক্রোধে ও গ্লানিতে জলন্ত চোখে রমণীদের দিকে তাকালেন। নারদকে তাঁর আর কিছুই জিজ্ঞেস করার ছিল না। বলবারও ছিল না। মহর্ষি যা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তা তিনি অতি নির্মম ভাবেই করেছেন। এখন তিনি পরিণতি দেখবার জন্যই দাঁড়িয়েছিলেন। কৃষ্ণ রমণীদের প্রতি কঠিন দৃষ্টিপাত করে ধিক্কার দিয়ে অভিশাপবাণী উচ্চারণ করলেন, “তােমরা আমার রক্ষিত হয়েও অতি নিকৃষ্ট আচরণ করেছ। অতি প্রমত্তা হয়ে তোমরা যেমন পণ্যাঙ্গনাদের ন্যায় ব্যবহার করেছাে, আমার মত্যুর পরে, তোমরা তস্করদের দ্বারা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হবে।’

কৃষ্ণের অভিশাপ যাঁদের ওপর বর্ষিত হলাে না তাঁরা জাম্ববতী, রুক্সিণী এবং সত্যভামা। অন্য সমস্ত রমণীগণ মুহুর্তে তাদের অপরাধ অনুভব করে আর্তস্বরে বাসুদেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাে। প্রমোদকাননের জলকেলি, হাস্য মুখরিত লীলাক্ষেত্র সকলই বিষাদে ডুবে গেল। কৃষ্ণ রমণীদের বললেন, ভবিষ্যতে দালভ্য ঋষির কাছে তােমাদের সম্যক জীবনধারণের উপায় জানতে পারবে।…….

….. লক্ষণীর আসন্ন স্বামী-বিচ্ছেদ-কাতর প্রাণে কোনাে যুক্তি মানতে পারছে না। অশ্রুসজল চোখে, ব্যথায়, অভিমান ক্ষরিত স্বরে বললেন, ‘রতিকোশাস্ত্রবিদ হে দ্বারকামােহন, সেই রমণীদের কামোচ্ছসিত আচরণের অপরাধই বা কী? আমি জানি তুমি কদাচ সেই রমণীদের নিজের রুপের দ্বারা কামােদ্রেক করাে নি। কিন্তু সর্বজ্ঞ বষ্ণিসিংহ কি জানতেন না, মাতৃগণ ব্যতীত দ্বারকার সকল রমণীকুলের তুমি অতি আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ? এই ষােল হাজার রমণীকে নির্বিচারে গ্রহণের জন্য তিনি নিজেকে অনাচারীজ্ঞানে অতি পুণ্যের স্যমন্তক মণি ধারণ করতে পারনি। মুষল ও লাঙ্গলধারী দুর্দান্ত যদবীর বলভদ্রকেও তিনি সেই স্যমন্তক মণি ধারণ করতে দেন নি, কারণ বলভদ্রও সর্বদাই সুরাসবপানে প্রমত্ত থাকেন। তবে তােমাকে কেন তিনি কামেচ্ছসিত রমণীদের কারণে অভিশাপ দিলেন ?……

Leave a Reply