সহস্র এক আরব্য রজনী – ৯ (ইহুদী হেকিমের কিসসা)

›› আরব্য রজনী  ›› ১৮+  

ইহুদী হেকিমের কিস্সা

বাদশাহ যখন ক্রোধ প্রকাশ করে কুঁজোটির মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত লােকগুলাের শাস্তির চিন্তা করছেন তখন বৃদ্ধ ইহুদী হেকিম বলল-“জাঁহাপনা, এবার আমাকে কিছু বলার জন্য মেহেরবানী করে সুযােগ দিন। আশা করি আমার কি আপনাদের মনে দাগ কাটতে পারবেই।

বাদশাহ অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুমতি দিলেন।

বৃদ্ধ ইহুদী হেকিম তার কিসসা শুরু করতে গিয়ে বলল‘ জাহাপনা, কিসসাটি আমি কিশাের বয়সে শুনেছিলাম। আমি তখন দামাস্কাসে বাস করি। হেকিমি বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করছি। ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ শেষ করে আমি এদিকে ঝুঁকি।

এক সকালে স্থানীয় সুবেদার পেয়াদা পাঠিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। বিশাল ইমারতের লম্বা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে সুসজ্জিত একটি ঘরে ঢুকলাম। দেখি মেহগনি কাঠের কারুকার্য মণ্ডিত পালঙ্কে এক কিশাের শুয়ে। রােগশয্যায়। আমি সমবেদনার স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম– কি হয়েছে বাছা?’

সে নীরবে, চোখের ইশারায় কি যেন বােঝাতে চেষ্টা করল। আমি হাত দেখতে চাইলে সে বাঁ-হাতটি বাড়িয়ে দিল। এরকম অশিষ্ট আচরণে আমি খুবই ক্ষুব্ধ হলাম। ভাবলাম সম্রান্ত ঘরের যুবক, সাধারণ সৌজন্যবােধটুকুও শেখেনি। বাঁ-হাতের নাড়ি দেখে দাওয়াই দিয়ে এলাম। তারপর দিনও গেলাম। পরদিনও যেতে হ’ল। দশদিন চিকিৎসা করে তার রােগ কিছু নিরাময় করা গেল। সুবেদার ইনাম দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করলেন। আর দামাস্কাসের প্রধান হাসপাতালে চাকুরী দিয়ে কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিলেন। প্রতিদিনই একবার করে আমার রােগীটিকে দেখতে যাই। কিন্তু একটি ব্যাপার আমার মনের কোণে বার বার উকি দিতে লাগল— সে রােজই কেন বাঁ-হাতটি এগিয়ে দেয়? সত্যি কি সৌজন্যবােধের অভাবই এর জন্য দায়ী নাকি অন্য কোন গুঢ় কারণ এর পিছনে রয়েছে? দশদিন পরে গরমজলে গামছা ভিজিয়ে তার গা মুছিয়ে দিতে বললাম। সুবেদার অনুরােধ করলেন এ-কাজটিও যেন আমি  উপস্থিত থেকে সম্পন্ন করি। তার পাজামা কামিজ সব খুলে ফেলতেই আমার আঁখিতে প্রথম ধরা পড়ল— তার ডান হাতটি কাটা। আর সারা গায়ে চাবকের দাগে ভর্তি।

আমি বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। যুবকটি বল—‘হেকিম সাহেব, খুবই অবাক হচ্ছেন, তাই না? অবাক হবার কথাই বটে এ কিন্তু আমার জন্মলগ্ন থেকে ছিল না। সে অদ্ভুত কিসসা অবশ্যই বলব। তবে এখন নয়, পরে।

যুবক আমাকে নিয়ে ওপর তলার এক নিরিবিলি ঘরে গেল। রসুইকারকে খবর পাঠাল ভেড়ার কাবাব করে সেখানে পাঠিয়ে দিতে।

খেতে খেতে একথা সে কথার পর আমি তাকে বললাম‘আপনার প্রতিশ্রুত সে কাহিনী এখন বলবেন কি?

যুবকটি বাঁ-হাতে ভেড়ার কাবাবের থালাটি কাছে টেনে নিয়ে বলেন—“শুনুন তবে আমার কাহিনী বলছি- মসুল নগরে আমার জন্ম হয়েছিল। খানদানি পরিবার। আমার আব্বা আর চাচারা দশ ভাই। আমার আব্বা সবার বড়। আমার দাদামশাই নিজেই দশ লেড়কাকেই শাদী দিয়ে ঘর-সংসার পেতে দিয়ে যান। আমার বাবা ছাড়া আমার চাচাদের কারােরই কোন বাচ্চাটাচ্চা হয়নি। তাই আমি ছিলাম চাচাদের চোখের মণি। আদরের দুলাল।

এক জুম্মাবারের ঘটনা। সেদিন আমার আব্বা আর চাচারা মসুলের বৃহত্তম মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেন। আমিও তাদের সঙ্গে যাই। নামাজের পর অন্যান্য সবাই মসজিদ ছেড়ে নিজের নিজের ঘরে ফিরল। আমার আব্বা আর চাচারা কেবল রয়ে গেলেন। চাচারা বাণিজ্য করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত মিশরে যাওয়াই সাব্যস্ত করলেন। নীলনদের তীরে সে দেশের প্রধান নগর ও বন্দর। দুনিয়ার বহুত দেশ ঘুড়ে বেড়িয়ে তারা বুঝেছেন, মিশরের মত মনােরম দেশ তামাম দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি আর নেই। সেখানে গেলে নাকি মনে হয় দুনিয়ার দুঃখকষ্ট ভুলে ভিনমুলুকে অবস্থান করছি।

বেহেস্তের মত সুন্দর এক দেশ চাক্ষুষ করার জন্য আমার দিল ছটফটানি শুরু করে দিল। আব্বাকে আমার ঐকান্তিক ইচ্ছার কথা জানালাম। প্রথমে আমাকে এত দূরে পাঠাতে রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত আমি আশাহত হ’ব ভেবে দামাস্কাস পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসব, এ শর্তে রাজি হলেন।

আমাদের জাহাজ মসুলি বন্দর থেকে দামাস্কাসের উদ্দেশে যাত্রা করল। আলেপ্পো নগর হয়ে পৌছলাম দামাস্কাস নগরে। জানা-অজানা গাছপালা আর ফুল ফলের বাগিচায় ভরা বেহেস্তের মত সুন্দর দামাস্কাস নগর। তারই পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। কল্লোলিনী নীলনদ। আমি এক সরাইখানায় মাথা গোঁজলাম আর চাচারা বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে নগরে ঘােরাফেরা করতে চলে গেলেন। তারা মসুল থেকে আনা সমানপত্র বেচলেন। আবার দামাস্কাস থেকে দুপ্রাপ্য বহু কিছু সওদা করে জাহাজ বােঝাই করলেন।

আমার চাচারা কাজ মিটিয়ে যাত্রার উদ্যোগ নিলেন। আমার দামাস্কাস ছেড়ে যেতে মন চাইল না। রয়ে গেলাম। তারা আমার মুনাফার বখরা মিটিয়ে দিয়ে গেলেন।

আমি নীলনদের লাগােয়া সুন্দর একটি বাড়ি ভাড়া করলাম। ভাড়া দু’ দিনার। এক বিকালে নদীর দিকে মুখ করে আমি বারান্দায় বসে সরাব পান করছি। দেখলাম, এক রূপসী যুবতী আমার সামনে এসে দাড়াল। অষ্টাদশী বলা যাবে না—ষোড়শী।

তার নাকাবের ফাক দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে, সাধ্যমত তার নজর এড়িয়ে ফুলের মত সুন্দর মুখটিকে দেখার লােভটুকু সামলাতে পারলাম না। মুহুর্তের মধ্যেই সে বােরখাটি খুলে পাশে রাখল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ার জোগাড় হ’ল। রূপের আভায় আমার আমাকে সচকিত করে তুলল। কোন মানুষের মুখ এত সুন্দর হতে পারে ইতিপূর্বে কল্পনাও করতে পারি

নি। আমাকে অবাক করে দিয়ে রূপসী বলল – “কি গাে ভাল মানুষ, একা একা বসে যে? বিবি কোথায় ?

—“বিবি পাব কোথায় ? শাদী হলে তাে বিবি পাশে থাকবে।’

–সে কী গাে! এমন জোয়ান বয়স। দেহে যৌবন বন্দী হয়ে রয়েছে। আর বলছ কিনা, শাদী হয় নি!কথা বলতে বলতে আমাকে লক্ষ্য করে আঁখির বাণ ছুঁড়ে মারল। এবার বলল- “মেয়েছেলে ছাড়া রাত কাটাও বলছ কি! এমন এক নাগর পেলে সব মেয়েই মনে করবে যে আসমানের চাঁদ হাতে পেয়েছে।

আমি খুবই বিব্রত বােধ করতে লাগলাম, একে নতুন জায়গা একেবারেই ভিনদেশ। তার ওপর এমন রূপসী এক যুবতী যাকে কোনদিন চোখেও দেখিনি। সে যদি প্রথম পরিচয়ের মুহুর্তেই এমন সব কথা বলে তবে যেকোন যুবাই মিইয়ে যেতে বাধ্য! আমি সামান্য সরে গিয়ে জড়ােসড়াে হয়ে বসলাম।

মেয়েটি কিন্তু অধিকতর সাহসিকতার পরিচয় দিল। আচমকা আমার একটি হাত চেপে ধরে সুন্দর ভঙ্গিতে চোখ-মুখ বিকৃত করে বলে উঠল— কী ন্যাকামি রে। মন বলছে খাই খাই, আর মুখে বলছে সাধ নেই।

কথাটি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই এক ঝটকায় আমাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। গলা জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। ব্যস, আছাড় মেরে নিজে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বুকের কাপড়টুকু পাশে পড়ে গেল। আর পায়ের কাপড় উঠে গেল হাঁটু ছাড়িয়ে উরুর ওপরে —নিতম্বের কাছাকাছি। আমার শিরা-উপশিরায় রক্তের গতি অকস্মাৎ বৃদ্ধি পেল। এক অভূতপূর্ব মাদকতা ভর করল আমার দেহ-মনে। আমি কি করব ভেবে ওঠার আগেই তার তুলতুলে হাত দুটো দিয়ে আমাকে সাড়াশির মত আঁকড়ে ধরল। যেকোন পুরুষের পক্ষেই আকাঙিক্ষত তার যৌবনের জোয়ারলাগা বুকে আমার প্রশস্ত বুকটি একেবারে লেপ্টে গেল। কী যে রােমাঞ্চ জাগল আমার মনে, আর আগুণের বন্যা বয়ে চলল শিরায় শিরায়। অনাস্বাদিত পুলকে আমি বিমােহিত হয়ে পড়লাম। এবার সে তার স্পঞ্জের মত নরম, আপেলরাঙা ঠোট দুটোকে ধীরে ধীরে নামিয়ে আমার ঠোট স্পর্শ করল। অপূর্ব কৌশলে আমার নিচের ঠোটটিকে কামড়ে ধরল। উন্মাদিনী প্রায় দিল এক কামড় বসিয়ে। সে-ও যেন মুহূর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। মুক্তোর মত ঝকঝকে তার দাঁতের চাপে আমার ঠোট যে কখন কেটে গেছে তা উপলব্ধি করার মত বােধশক্তি সে মুহূর্তে আমার মধ্য থেকে সম্পূর্ণরূপে অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছিল, অস্বীকার করার উপায় নেই। আমিও যেন তখন উন্মাদদশা প্রাপ্ত হয়েছিলাম। এক ঝটকায় তার কোটিদেশ থেকে ফিন ফিনে কাপড়ের টুকরােটি খুলে ছুড়ে ফেললাম মেঝেতে। তারপর? তারপর কি হল সে-কথা কারাে কাছে মুখফুটে বলার নয়।’

-আর? তার রূপ সাগরে একেবারে তলিয়ে গেলাম। তার যৌবনের উন্মাদনা আমাকে গ্রাস করে ফেলল। সে-ও আমার যৌবনদীপ্ত সুঠাম দেহের দলন, পেষণ, চোষণ ও সম্ভোগসুখ লাভ করে পরম তৃপ্তিতে কানায় কানায় মনকে ভরে নিতে লাগল। তার শরীরের একইঞ্চি অংশও আমার জীবের লেহন থেকে বাদ গেলনা। তার মুখ থেকে যোণি, ঘাড় থেকে বগল, বাহু, উরু কিছুই বাদ দিলাম না। সেও আমার পুরুষাঙ্গটিকে পরম মমতায় হাত দিয়ে আদর করল, মুখে নিয়ে চোষন করল। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গসুখ লাভ করে তৃপ্তিটুকু একেবারে নিঃশেষে নিঙড়ে নিয়ে এক সময় বিছিন্ন হলাম।

সে-রাত্রের স্মৃতি, জীবনের প্রথম সম্ভোগ-সুখের কথা কোনদিন আমার মন থেকে মুছে যাবে না। শুনেছি, জীবনের প্রথম সহবাসের রাত্রির কথা নাকি সবারই অন্তরের অন্তঃস্থলে আমৃত্যু জাগরুক থাকে। হতেই হবে, কারণ বেহেস্তে সুখের ছড়াছড়ি হলেও সেরাত্রে আমি যে সুখ ও তৃপ্তি লাভ করেছিলাম তার চেয়ে বেশী কিছু সেখানে যে নেই হলফ করে আমি বলতে পারি। ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরে অনেক বেলা পর্যন্ত আমি বিছানা আঁকড়ে পড়েছিলাম। আমার সে রাত্রের বেগম সে লেড়কিটিও অচৈতন্যের মত পড়েছিল।

আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি সে বিবস্ত্র হয়ে আমার গলায় একটি হাত তুলে দিয়ে অকাতরে ঘুমােচ্ছ। আমি বিমুগ্ধ নয়নে তার দেহপল্লবটিকে এবার খুটিয়ে খুটিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। এমন যৌবনের মাতনলাগ রূপসীযুবতীর দেহকে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কুরেকুরে খেয়ে আমার সম্ভোগসুখ লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল সে কি ঘুমের ঘােরে দেখা খােয়াব, নাকি বাস্তব?।

আমার মনময়ুরী, আমার কলিজা রূপসীটি এক সময় চোখ মেলে তাকাল। আমি পাশে বসে বুভুক্ষুর মত তার যৌবনভরা নগ্ন দেহটিকে নিরীক্ষণ করছি বুঝতে পেরে অকস্মাৎ তার মধ্যে লাজশরম ভর করল। রাত্রে স্বেচ্ছায় নিজেকে সঙ্গ দিয়েছিল সেই দিনের আলােয় যেন লাজে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। অতর্কিতে হাত দুটোকে নিজের বুকের ওপর তুলে নিয়ে যন্ত্রচালিতের মত কাপড়টিকে কোমরে জড়িয়ে নিল।

রূপসী নিজেকে একটু সামলে নেওয়ার পর আমি তার দিকে দশটি সােনার মােহর বাড়িয়ে দিলাম। সে ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়ে বলল

–‘মেহবুবা আমার, মােহর নিয়ে আমি কি করব? তুমি যেমন আমার যৌবনসুধা পান করে তৃপ্তি লাভ করেছ তেমনি তােমার ওই সুঠাম দেহ আমাকে কম তৃপ্তি দেয় নি। এ সুখ যে পরস্পরে দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমেই একমাত্র পাওয়া সম্ভব। তুচ্ছ মােহরে প্রশ্ন তাে এর মধ্যে আসতে পারে না। তুমি আমার কলিজার সমান বুঝতে পারাে নি?’

এবার দরজার দিকে এগিয়ে গেল আমার মেহবুবা। আমিও দু’পা এগােলাম। সে আমার মাথার দু’পাশে হাত রেখে আমান মুখটিকে নিজের মুখের কাছে নিয়ে গেল। চুম্বন করল। আলতে করে দুগালে হাত বুলিয়ে সােহাগ করল প্রাণভরে। তারপর আমার দু’কাধে তার হাত দুটোকে রেখে সুরেলা কণ্ঠে উচ্চারণ করল – ‘আমার মেহবুব, আমার দিলকা কলিজা, তিনদিন পর আবার আমাদের দেখা হবে, দৈহিক মিলন ঘটবে। বটুয়া থেকে কয়েক দিনার বের করে আমার হাতে গুজে দিতে গিয়ে বলল–মেহবুব আমার, একটি কথা বলছি, আমায় ভুল বুঝে আমাকে কষ্ট দিও না যেন। আগামী দিনের যাবতীয় খরচ আমি করব। এবার সে বটুয়া থেকে কয়েকটি দিনার বের করে আমার হাতে জোর করে খুঁজে দিয়ে বলল—এগুলাে তােমার কাছে রেখে দাও মেহবুব। যা কিছু দরকার মনে করবে, কিনে রেখাে।

আমি তার কথায় প্রতিবাদ করে অসন্তোষ উৎপাদন করলে উৎসাহী হলাম না। দিনার ক’টি হাত পেতে নিতে গিয়ে বলা – “তা-ই হবে মেহবুব। সে ঠোটের কোণে দুষ্টুমিভরা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে ঘন থেকে বেরিয়ে গেল।

সে বিদায় নেওয়ার পর এক-একটি দিন যেন আমার কানে এক-একটি বছরে পরিণত হ’ল। আমার বুকের ভেতরটি যেন ফাক হয়ে গেছে। যাবার সময় যেন গােপনে আমার কলিজাটি চুরি করে নিয়ে গেছে। চার-চারটি দিন যে আমি কিভাবে অস্তহীন হাহাকার। হাহুতাশের মধ্যে কাটিয়েছিলাম তা বর্ণনা করার মত ভাষা আমার নেই।

চতুর্থ সন্ধ্যার কিছু আগে নিজেকে অপরূপ সাজে সজ্জিত কর আমার প্রাণ-প্রেয়সী আমার বারান্দায় হাজির হ’ল। বারান্দায় পা দিয়েই সে বিদ্যুৎগতিতে গায়ের ওড়নাটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তা কামাতুর মনের তাড়নায় সে জ্বলে পুড়ে খাক হচ্ছে। তার মন্মােহিনী রূপের আগুন আমার গায়েও তারই মত জ্বালা ধরিয়ে দিল। আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। তাকে এক ঝটকা কোলে তুলে নিলাম। ক্ষুধাতুর নেকড়ের মত একলাফে তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। শুইয়ে দিলাম পালঙ্কের ওপর। সে আমার কণ্ঠলগ্ন অবস্থাতেই আমার ঠোট দুটোকে কামজ্বালায় কামড়ে ধরল।

তারপর সারারাত্রি আমরা যে কিভাবে কাটিয়েছি তার একমাত্র সাক্ষী ওই উৎপীড়িত পালঙ্কটি। তার যদি ভাষা প্রকাশের উপায় থাকত তবে যথার্থ বর্ণনা দিতে পারত। আর আমি? অসম্ভব। উন্মত্তপ্রায় অবস্থায় আমরা যে কিভাবে সারাটি রাত্রি নির্মম অবস্থায় কাটিয়েছিলাম তার বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে বাস্তবিকই সাধ্যাতীত। পূব-আকাশে রক্তিম ছােপ দেখা দিলে সে আমার কাছ থেকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় নিতে বাধ্য হ’ল; আমার জীবনের দ্বিতীয় সহবাসরাত্রি কাটিয়ে সে বিদায় নিল। যাবার সময় সে বিদায়চুম্বন সেরে বলে গেল ‘মেহবুব আমার, চারদিনের দিন সন্ধ্যায় আবার আমি তােমার সঙ্গসুখ লাভের প্রত্যাশা নিয় এসে হাজির হব।

সত্যি এবারও চুতুর্থদিন সন্ধ্যার আগে সে আমার গরীবখানায় হাজির হল। মনমৌজী সাজে সে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে দেখলাম। সামান্য কিছু খানাপিনা সেরেই আমি তাকে জাপ্টে ধরে পালঙ্কের ওপর শুইয়ে নিলাম। তার চোখের তারার ভাষায় সে আমাকে বুঝিয়ে দিল তােমার যৌবনের সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে ছিড়েফুঁড়ে খাও। সম্ভোগের মধ্য দিয়ে আমাকে একেবারে শেষ। করে দাও মেহবুব। আমি তাকে বিছানায় চিৎ করে ফেলে ইচ্ছামত ঠাপাতে থাকলাম। তার দুই স্তনকে দুহাতের মুঠিতে নিয়ে জোড়ে জোড়ে টিপতে লাগলাম। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে পড়ে রইলাম। উভয়ের নগ্নদেহ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। তার মন আকুল হ’ল কাছে আসার, আরও কাছে আসার জন্য। কিন্তু আমি যে তাকে। সজোরে বুকে চেপে ধরে একেবারে আমার সঙ্গে লেপ্টে নিয়েছি। আর কি করে সম্ভব?

সকাল হল। বিদায় মুহূর্তে সে আমার কঁাধে তার হাত দুটো রেখে প্রশ্ন করল – ‘মেহবুব আমার, সত্যি করে বল দেখি, তিন দিন আমাকে সম্ভোগ করে তােমার কেমন লাগল?

‘হঠাৎ তােমার মুখে এ প্রশ্ন কেন মেহবুবা? তােমাকে কাছে পাওয়ার পর আমার কাছে বেহেস্তের সুখও তুচ্ছ বােধ হচ্ছে। আমার যৌবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি তােমার যৌবনের জোয়ারলাগা দেহভােগের মাধ্যমে। তােমাকে ছাড়া বাঁচার কথা আমি যে কল্পনাও করতে পারিনি। তােমার চেয়ে রূপসী পৃথিবীতে  অন্য কেউ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’

সে ঠোট টিপে হেসে বল্ল- আমার চেয়ে সুন্দরী দেখনি? সামনের দিন দেখতে পাবে। তাকে দেখলে তােমার চোখ দুটো ঝলসে যাবে।

কথা বলতে বলতে আমার হাতে কুড়িটি মােহর দিয়ে বলল — ‘আজ থেকে চতুর্থদিন আবার আমার দেখা পাবে। আর একটি কথা, নতুন যে মানুষকে নিয়ে আসব তার আপ্যায়নের ত্রুটি হয় না যেন।’

সে এবারও কথা রেখেছে। চতুর্থদিন সন্ধ্যার আগে সে আমার দরজায় হাজির হল। সঙ্গে একটি লেড়কি বয়স তার চেয়ে কম। সে ঠিকই বলেছিল। সত্যি এক অপরূপাকে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। বেহেস্তের পরীদের তৈরীর পর অবশিষ্ট সৌন্দর্যটুকু নিয়ে এসে যেন এর গায়ে লেপে দেওয়া হয়েছে।

আমি সরাবের গ্লাসটি খালি করে ঠোট থেকে নামালাম। আমার মেহবুবা আমার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে বলে উঠল – ‘কি মিঞা, তােমার জন্য এমন রূপসীকে নিয়ে এলাম। একটু সােহাগটোহাগ কর একে। এমন রূপ যৌবনের একত্র সমাবেশ ঘটেছে এর দেহে, মনে দোলা লাগছেনা? একটু আধটু চেখে দেখ, মালুম হবে।

আমি যে এমন বােকার হদ্দ তা আগে জানতাম না। তার কথা শেষ হতে না হতেই বলে উঠলাম – “তা তুমি যদি নেহাৎই বল। তবে একবারটি রসাস্বাদন করে দেখতে পারি।

—“চমৎকার। পুরুষ মানুষের মত কথাই বটে। আজ রাত্রে একে সম্ভোগ করে অধিকতর সুখ লাভ কর। এতে আমার আনন্দই হবে।’

আমার মেহবুবা মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল। আর আমি নবাগতা রূপসীকে নিয়ে পালঙ্কের ওপরে শুলাম। আমি বিছানায় শুয়েই উদ্ভিন্ন যৌবনা নতুন মেয়েটিকে সম্ভোগের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হব নাই বা কেন? তাকে প্রথম দর্শনেই আমার রক্তে যে মাতন লেগে গেছে। বুকের ভেতরে কলিজাটি শুরু করে নয়েছে রীতিমত নাচন কোদন। আর তারই অত্যুগ্র কামনা আমার জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক-চৈতনাকে নির্মূল করে দিয়েছে। সে মেঝেতে শুয়ে ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে পড়ে রইল। আর আমি পালঙ্কের ওপরে নবাগতা রূপসীকে নিয়ে হিংস্র নেকড়ের মত সম্ভোগে মেতে ওঠলাম! তার ষােল বছরের দেহটাকে ছিড়েখুড়ে খাওয়ার জন্য উন্মাদের মত আচরণ করতে লাগলাম। তার ছোট ছোট সদ্য প্রস্ফুটিত স্তনজোড়াকে দেখে আমি পাগল হয়ে গেলাম। লাল লাল বোটাগুলোকে চুষতে লাগলাম, কামড়ালাম, তার সদ্য গজানো হালকা যৌনকেশে মুখ ঘষতে লাগলাম, যোনির ঠোটে চুষলাম, জীব দিয়ে যোনির ভিতরে চুষে দিলাম। তারপর আমার ঠাঠানো পুরুষাঙ্গকে সেই কচি যোনিতে পুরো ঠুকিয়ে জোড়ে জোড়ে ঠাপাতে লাগলাম।

কতক্ষণ ধরে এবং কিভাবে আমি কামতৃষ্ণা নিবৃত্ত করেছিলাম সবকিছু আমার পরে আর মনে পড়ে নি। কতক্ষণ পরে ক্লান্তদেহে ঘুমের কোলে ডুলে পড়েছিলাম তা-ও বলতে পারব না।

সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন দেখি আমার বাঁ-হাতটি রক্তে জবজব করছে। দেখামাত্রই আমার মনে হয়েছে বুঝি বা সুমের ঘােরে খােয়াব দেখছি। যখন আমার ভেজা বালিশটি ঘাড়ের কাছে চপচপ করতে লাগল তখন আমার দ্বিধা কেটে গেল। আমি যেন অতর্কিতে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এ-তাে খােয়াব নয়, সম্পূর্ণ সত্য। সম্ভোগক্লান্ত মেয়েটিকে জাগাবার জন্য তার মাথা ধরে ব্যস্ত হাতে সজোরে নাড়া দিতেই আমার শরিরের সব কটি স্নায়ু একসঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল। তার ছিন্ন মুণ্ডটি বালিশ থেকে গড়িয়ে বিছানায় পড়ে গেল। এমন এক পৈশাচিক দৃশ্যের মুখােমুখি হতে হবে খােয়াবের মধ্যেও কোনদিন ভাবতেও পারি নি। মাথা ঝিমঝিম্‌ করছে, শরীর হিম হয়ে আসছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল – ‘হায় “আল্লাহ! এখন আমি করি কি?’

আমি উন্মাদের মত পালঙ্কের ওপর থেকে নিচের দিকে উঁকি দিলাম। বড়-লেড়কিটির বিছানা শূন্য। ঘরের দরজা খােলা, ভেজানাে। উদ্ভ্রান্তের মত এক লাফে পালঙ্ক থেকে নামলাম। দরজা খুলে বাইরে বেরােলাম। না সে উধাও। কোথাও সে নেই। বাইরে যাবার দরজার ছিটকিনি খােলা। দরজা ভেজানাে। যে উপযাচক হয়ে পর পর তিন দিন সম্ভোগ সুখে আমার দেহ মনকে তৃপ্তি দিয়েছিল সেই আজ আমার কলিজাটিকে টুকরাে টুকরাে করে দিয়ে গেছে। কিন্তু আমি এখন করি কি? পালঙ্কের ওপর পড়ে থাকা যুবতীর লাশটিকে কি করে সামাল দেব। শরীর অবশ হয়ে পড়তে লাগল। লােক জানাজানি হয়ে গেলে প্রথমে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে সাদর অভ্যর্থনাসহ গারদে নিয়ে ভরবে।

কী উটকো বিপদ ঘাড়ে চাপল। সবই নসীবের ফের। নইলে এমনটি হবে কেন? মৃতার সাকিন তাে দূরের কথা, এমন কি নাম পর্যন্ত আমার জানা নেই। কোতােয়ালের কাছে কি যে জবাবদিহি করব তা ভেবেই আমি পৌনে মরা হয়ে গেলাম। আমার মাথায় চট করে একটি ফন্দি খেলে গেল। এক দৌড়ে একটি খন্তা এনে উন্মাদের মত ঘরের মেঝেতে গর্ত খুঁড়তে লাগলাম। তারপর আপদটির লাশ, তার কাপড়চোপড়, বালিশের ওয়াড় ও বিছানার চাদর প্রভৃতি যা কিছুতে রক্তের ছােপ লেগেছিল সবই গর্তে ঢুকিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিলাম।

তারপর নিজে সাফসুতরা হয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে বললাম – “আমি জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি। কাজ মিটলেই ফিরে আসব।’ এক বছরের ভাড়া আগাম মিটিয়ে দিলাম। আমার একাজের স্বপক্ষে যুক্তি ছিল, আমি ঘর ছেড়ে দিলে অন্য কেউ ঘরটি ভাড়া করবে। তখনই আমার কুকর্মের কথা ফাস হয়ে যাবে। এতে পুরাে একটি বছরের জন্য তাে অন্ততঃ নিশ্চিত হওয়া গেল।

কায়রাে পৌছেই আমার চাচাজীদের সঙ্গে মােলাকাত হয়ে গেল। আমাকে দেখেই তারা উল্লসিত হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কায়রাে পৌছেতেই আমার পকেট ফাকা হয়ে গেল। চাচাজীরাই আমার সার্বিক দায়িত্ব নিলেন।

কায়রােতে কিছুদিন থাকার পরই চাচাজীরা কাজকাম মিটিয়ে স্বদেশে ফেরার উদ্যোগ করল। আমি আরও কিছুদিন থেকে কায়রাে ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলাে ঘুরে ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। তারা আমার পকেটে দিনারের গােছা পরে দিয়ে স্বদেশের অভিমুখে যাত্রা করল।

আমি পর পর তিন বছর দামাস্কাসের বাড়িওয়ালাকে বাড়িভাড়া মিটিয়ে দিলাম।

তিন তিনটি বছর পেরিয়ে যাবার পর ভাবলাম ইতিমধ্যে নির্ঘাৎ ব্যাপারটি চাপা পড়ে গেছে। সবাই ভুলে গেছে। এবার দামাস্কাসে গিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করলাম। প্রথমেই শােবার ঘরে গেলাম। ঘরময় ধুলাে ছড়ানাে রয়েছে দেখলাম। কিন্তু ঘরে যা কিছু ছিল সবই জায়গামত ঠিকঠাকই রয়েছে। বিছানাটি সামান্য উল্টাতেই আমার সর্বাঙ্গে অবাঞ্ছিত শিহরণ অনুভব করলাম। একটি জড়ােয়া হাঁসুলী। সে রূপসীর গলায় দেখেছিলাম বটে। শােয়ার পূর্বমুহূর্তে হয়তাে গলা থেকে খুলে রেখেছিল।

কায়রােতে তিন বছর কাটাতে গিয়ে চাচাদের দিয়ে যাওয়া দিনার প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল। এ অবস্থায় এতখানি সােনা হাতে পেলে মন তত চাঙা হয়ে উঠবেই। ভুলেও কি তখন ভাবতে পেরেছিলাম সবই ডাইনীর কারসাজি! হারটি জোব্বার জেবে ঢুকিয়ে দিলাম। ঘরে তালা বন্ধ করে বাজারে গেলাম। আজই বেচে না দিলে নতুনতর কোন বিপদ এসে ঘাড়ে চাপতে পারে।

আমি এক জহুরীকে হারটি দিলাম। সে উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর আমাকে বসিয়ে রেখে মহাজনের ঘরে গেল। একটু বাদে ঘুরে এসে বল্ল-হারগাছা নকল সােনা আর ঝুটো মুক্তোর তৈরি। যদি আসল হ’ত এক হাজার দিনার দাম পেতেন। কিন্তু বর্তমানে এক হাজার দিরহাম বড়জোর এর দাম পেতে পারেন।

আমি তাতেই রাজি হয়ে গেলাম। বাম—“আমার একটু তাড়া আছে। মেহেরবানি করে তাড়াতাড়ি দামটা মিটিয়ে দিন।

কিসসার এ-পর্যন্ত বলার পর বেগম শাহরাজাদ দেখলেন, বাইরের বাগিচায় পাখির কিচির মিচির শুরু হয়ে গেছে। ভােরের পূর্বাভাস। তিনি কিসসা বন্ধ করলেন।

আঠাশতম রজনী

রাত্রি একটু গভীর হলে বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে এলেন। বেগম শাহরাজাদ কিসসা শুরু করতে গিয়ে বলেন—“জাহাপনা, সে-ইহুদী হেকিম তার কিস্সা বলে চলেছে–‘আমি ব্যস্ততা প্রকাশ করায় জহুরীর সন্দেহ হল। সে ভাবল, হারগাছা চোরাই মাল না হয়েই যায় না। হয় কারাে গলা বা সিন্দুক থেকে কেঁপেছে নয়তাে কারাে হারিয়ে যাওয়া মাল কুড়িয়ে পেয়েছে। জহুরী আমাকে মুখে কিছুই বলল না। আমাকে আগের মতই বসিয়ে রেখে আবার মহাজনের ঘরে যাবার নাম করে বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই ইয়া দশাসই চেহারার এক সিপাহী এসে কোন কথা না বলে আমার হাতে কড়া পরিয়ে দিল। টেনে হিচড়ে কোতােয়ালের কাছে নিয়ে গেল।

কোতােয়ালের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি কাপা কাপা গলায় কোনরকমে উচ্চারণ করলাম-“হুজুর এ-হারগাছা আমি এক মেয়েকে মহব্বতের স্মারক হিসেবে উপহার দিয়েছিলাম। নসীবে বেশী দিন সে টিকল না। দুনিয়া ছেড়ে বেহেস্তে চলে গেল। তারপর আমার হারগাছা আমার হাতেই ফিরে আসে।

-কোন্ দোকান থেকে, কত দাম দিয়ে কিনেছিলে, বল তাে!’

—“হুজুর, সে কথা আজ আর ঠিকঠাক স্মরণে নেই। তবে হাজার দুই দিরহাম হয়ত নিয়েছিল। আর কায়রাের এক জল্পীর কাছ থেকে কিনেছিলাম।’

আমার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই কোতােয়ালের হাতের চাবুকটি আমার পিঠে বার কয়েক আছড়ে পড়ল। আমি কোমরভাঙা সাপের মত দেহটিকে যন্ত্রণায় বার বার মােচড় মারতে লাগলাম। চাবুকের ঘা মারতে মারতে কোতােয়াল বলল—‘গাঁজাখুরি গল্প। শােনাচ্ছ, তাই না? তােমার কেনা হারগাছার দাম কত তা তােমারই জানা নেই!এবার জানতে পারবে এর দাম কত। এখনও সময় আছে, কোথেকে এটি এনেছ, বল?” আবার চাবুকের ঘা পড়ল।

আমি যন্ত্রণাকাতর দেহটিকে বার বার কোকড়াতে কোকড়াতে কাদোকাদো স্বরে বল্লাম—বিশ্বাস করুন, আমি এটি চুরি করিনি।

আবার চাবুক সক্রিয় হ’ল। পরপর কয়েকটি ঘা বসিয়ে দিয়ে কোতােয়াল হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন—এত দামী হার তাের কাছে, এল কি করে হারামজাদা ? এ তাে রাজা, বাদশা আর উজিরের ঘরে ইড়া থাকার কথা নয়।’

চাবুকের ঘা খেয়ে খেয়ে আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল—এক মহাজনের গদি থেকে হারগাছা আমি চুরি করেছি।’ মিথ্যে বলা ছাড়া সে-মুহূর্তে আমার উপায় কিছু ছিল না।

চুরির ব্যাপারটি স্বীকার করে নেয়ার কারণ হচ্ছে, চুরির দায়ে বড় জোর আমার একটি অঙ্গ খােয়াতে হবে। কিন্তু হত্যার ব্যাপারটি ফাস হয়ে গেলে নির্ঘাৎ গর্দান যাবে। তখন প্রাণদণ্ডই হবে আমার একমাত্র শাস্তি।

কোতােয়ালের নির্দেশে সিপাহীরা আমার ডান হাতটি কেটে ফেলল। এমন একটি মজার খবর বাতাসে ভর করে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। বাড়িওয়ালা সাফ জবাব দিলেন—‘তােমাকে নিয়ে নগর তােলপাড় হচ্ছে। আমার বাড়ি থেকে মানে মানে কেটে পড়। আজই অন্য কোথাও চলে যাও ভাই।

আমার কাতর মিনতিতে বাড়িওয়ালা একটু নরম হলেন। বাড়ি ধোঁজার জন্য দিন কয়েক সময় দিলেন।

কি করি, কোথায় যাই? কার কাছে গিয়ে আশ্রয় পাই? কাটা হাত নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়াও তাে সম্ভব নয়। তামাম দুনিয়ার লােক জানে, চুরি করলে ডান-হাত কাটা যায়। আঁখি দুটো দিয়ে পানির ধারা নেমে এল। বানিয়ে কোন একটি কিসসা দাঁড় করালে কি মুলুকের কেউ বিশ্বাস করবে আমার কথা? অবশ্যই না।

কি যে করি ভেবে পেলাম না। আমার হাত কাটার ব্যাপারটি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। বাসা খুঁজতে বেরনােরও সমস্যা রয়েছে। আমাকে কে-ই বা আশ্রয় দেবে? আল্লাহর ওপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ঘরের কোণেই পড়ে রইলাম।

আমি তন্ময় হয়ে আমার নসীবের কথা ভেবে চলেছি। এমন সময় অকস্মাৎ কাঁটামারা বুটের গম্ভীর আওয়াজে সচকিত হয়ে তাকালাম। দেখলাম, আমার সামনে সেনাবিভাগের প্রধান দাড়িয়ে রয়েছেন। সুবেদারের নির্দেশে আমাকে বন্দী করলেন।

হাতকড়া পরিয়ে সুবেদারের দরবারে আমাকে হাজির করা হ’ল। একদল লােক সেখানে ভিড় করে অপেক্ষা করছে। কার জন্য? হয়ত বা আমারই জন্য। তাদের ভিড়ে আমার বাড়িওয়ালা এবং সে জহুরী দু’জনও রয়েছেন।

সুবেদার সাহেব গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন—কোতােয়াল তােমার বিরুদ্ধে অভিযােগ দাঁড় করিয়েছে, তুমি নাকি এ-জহুরীর দোকান থেকে হারছড়া চুরি করেছ? কিন্তু জহুরীর কথা তাে সত্য নয়। হারটি তাে আমার মেজো লেড়কির। আমার বড় লেড়কির সঙ্গে সে বেড়াবার নাম করে তিন বছর আগে এক বিকেলে ঘর থেকে বেরিয়েছিল। সে-যাওয়াই তার অন্তিম যাওয়া। তারপর সে আর ঘরে ফেরে নি। তুমি যদি সাচ বাৎ বল তবে আর তােমাকে কোন শাস্তি দেব না, কথা দিচ্ছি। আজ হারছড়া ফিরে পেয়ে অনুমান করছি সে আর দুনিয়ায় নেই।’ কথা ক’টি বলেই সুবেদার আমার হাতকড়া খুলে দিতে বলেন। আমি ধরেই নিলাম, মৃত্যু আমার শিয়রে। কেউ-ই আমার জান রক্ষা করতে পারবে না।

সুবেদার অন্যান্য সবাইকে দরবারকক্ষ ছেড়ে চলে যেতে বলেন। এত বড় একটি ঘরে কেবল আমরা দুজন, আমি আর সুবেদার রয়ে গেলাম। তিনি আমাকে নিচু গলায় বললেন—“বেটা আমাকে ব্যাপারটি কি, বল তাে? আমার বিশ্বাস, তােমার দ্বারা কোন ন্যক্কারজনক কাজ করা সম্ভব নয়। তােমার চোখ-মুখ বলছে, তুমি অভিজাত ঘরের ছেলে। আমি যদি তােমার রক্ষাকর্তা হয়ে পিছনে দাঁড়াই তবে কেউ-ই তােমার গায়ে কাঁটার আঁচড়টি কাটতে পারবে না। অতএব তুমি নির্ভয়ে যা কিছু ঘটনা, বলতে পার। সে কাহিনী যত মর্মান্তিকই হােক না কেন তুমি আমার কাছে ব্যক্ত কর।

আমি শিশুর মত হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। ডুকরে ডুকরে কেঁদে বললাম—“আপনি আমাকে শাস্তি দিন আর না-ই দিন আমি সব কিছু আপনাকে খুলে বলবই। অন্ততঃ নিজের স্বার্থের তাগিদে আপনাকে সব বলতে চাই। আমি চাই সব কিছু বলে নিজের থেকে পাথরের বােঝাটি হাল্কা করতে।

আমি তিন বছর আগেকার সে ঘটনাটি বলতে শুরু করন সবার আগে বললাম প্রথম লেড়কিটির কথা। আমার সঙ্গে তিন বাস করে সে যা কিছু করেছিল, কিছুই গােপন করলাম না। এরপর কবে এবং কেন দ্বিতীয় লেড়কিটিকে এনেছিল তা-ও বলল আমাদের পালঙ্কে শুতে দিয়ে নিজে ঘরের মেঝেতে বিছানা – শুয়েছিল তা-ও বাদ দিলাম না। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে গভীর ও ছােট লেড়কিটিকে হত্যা করে সে বাড়ি থেকে চম্পট দিয়েছিল ও বল্লাম।

সুবেদারের দু’আখির কোল বেয়ে পানির ধারা নেমে এল। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন—‘বড় লেড়কিটিও আমার লেড়কি। কৈশােরে পা দিয়েই সে দ্রুত খারাপ হয়ে যেতে থাকে, উচ্ছঙ্খলতার চূড়ান্ত বলতে পার। ঘরে কাউকে না বলে বাইরে কাটাতে শুরু করে। মানা করলে পাত্তা দিত না। বহু শাসন বহু কঠোর শাস্তি দিয়েও কিছুতেই তাকে বশে রাখা যায় নি। চরিত্রবান ছেলেই হােক না কেন তাকে সে পাঁকে টেনে নামাতো। ভাবলাম, শাদী-নিকা দিলে বুঝি তার চারিত্রিক দোষগুলি নে যাবে। কোন ফলই হল না। বরং বছর দুই যেতে না যেতেই স্বামীটি সামান্য রােগভােগে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। কামজ্ঞ নির্বাপিত করার অপূর্ব সুযােগ এল তার হাতে। মিশরের মেয়ে যা কিছু খারাপ স্বভাব সবই সে রপ্ত করে নিয়েছিল। এবার ত নিঃসন্দেহ হলাম। মিশর থেকে ফিরে এসে তােমার কাধেই ভর করেছিল। সে পর পর তিন রাত্রি তােমার ঘরে, তােমার সঙ্গে সহবাস করেছে!

আমি ক্ষুব্ধ হলাম যখন দেখলাম সে তার মেজোবহিনকেও পথে নামিয়েছে। আমি সর্বদা মেজো মেয়েটিকে সতর্কতার সাথে পাহারা দিতে লাগলাম। আসলে মিশরের লেড়কিদের মত উচ্ছিঙ্খল লেড়কি তামাম দুনিয়া চক্কর মেরে এলেও অন্য কোন দেশে পাওয়া যাবে না। নিজের কামতৃষ্ণা নিবৃত্ত করতে প্রয়ােজনে নিজের লেড়কাকেও খুন করতে পারে।

আমার মেজো লেড়কির বয়স ছিল খুবই কম। উঠতি বয়স কামপ্রবৃত্তি কি সবে সে বুঝতে শিখেছে। এ বয়সে মেয়েদের বিশেষ করে তাদের অভিভাবককে একটু চোখ কান খুলে রাখতেই হত কিন্তু আমার পক্ষে তাে অন্দরমহলে পড়ে থেকে লড়কি সামলানাে সম্ভব নয়। তার ওপর বড় লেড়কির কায়দা-কৌশলের সঙ্গে আমি সত্যি পেরে উঠছিলাম না। তাই মেজো লেড়কিটি নিয়ে সে মাঝে-মধ্যেই অন্যত্র রাত্রিবাস করত।

একদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরতেই দেখি বড় লেড়কি হাউমাউ করে মরাকান্না জুড়ে দিয়েছে। আমি কঁাদার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলল—“আমি তাকে নিয়ে সন্ধ্যায় বাজারে কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম। ভিড়ের মধ্যে কোথায় এ যে সে হারিয়ে গেল কিছুতেই হদিস করতে পারলাম না। আজ তােমার কথায় বুঝতে পারছি, সে তােমার সঙ্গেই সে-রাত্রি কাটিয়েছিল।

আজ আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, আমার মেজো লেড়কিটিকে খুন করার জন্যই বড় লেড়কিটি তাকে তােমার ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। আদতে তার রূপ-সৌন্দর্য তার বাহিনী সহ্য করতে পারছিল না। জ্বলন্ত ঈর্ষার বশেই সে এ-কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিল।

সুবেদার সাহেব এবার চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–বেটা, এখন বুঝতে পারছি, বিনা অপরাধেই তােমাকে ডান হাতটি খােয়াতে হয়েছে। আমি তার জন্য অনুতপ্ত। যা ঘটেছে তা তাে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তুমি নতুন করে জীবন শুরু কর।’

-“আপনার অনুতাপ জ্বালার কথা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এ রকম একটি কাটা হাত নিয়েও তাে আমার পক্ষে নিজের মুলুকে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার কথা লােকে বিশ্বাস করবে কেন?”

‘আমারও ইচ্ছে নয় তুমি এ-জায়গা ছেড়ে অন্যত্র যাও। বেটা, আমার তিন লেড়কি, একটিও লেড়কা নেই। আমার ছােট লেড়কিকে শাদী করে এখানেই সংসার-জীবন যাপন কর, আমার ইচ্ছা। সে সুন্দরী। সচরাচর এমন রূপ দেখা যায় না।

আপনার মর্জি অনুযায়ীই আমি চলব। তবে মুলুকে আমার আব্বাজী নাকি বেহেস্তে গেছেন। আমার প্রাপ্য বিষয়-সম্পত্তির একটি বিহিত করতে চাই।’

—“চমৎকার। আজই আমি একজন উচ্চপদস্থ কর্মীকে সেখানে পাঠাচ্ছি। তােমার যা কিছু প্রাপ্য বুঝে নিয়ে আসবে। ও নিয়ে তুমি ভেবাে না বেটা।

আমি এবার সুবেদারের ছােট লেড়কিকে শাদী করে সংসারজীবন শুরু করলাম। বিবি আমার মনের মতই হয়েছে। আমাকে নিজের কলিজার মতই মনে করে।

ইহুদী হেকিম বলতে লাগল–জাঁহাপনা, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত সে-যুবকের মুখের কিসসা শুনতে লাগলাম। একমাত্র সুবেদারের উদার, বুদ্ধিমত্তা ও ন্যায় বিচারের ফলেই সে বার আমি নিশ্চিত যমের দুয়ার থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।

সুবেদার তার জামাতার রােগ নিরাময়ের পর প্রচুর দিনার আমাকে উপহার দিলেন। প্রচুর অর্থের মালিক হয়ে গেলাম আমি। তা দিয়ে দেশ দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। নানা মুলুক ছুঁড়ে আমি আপনার মুলুকে হাজির হলাম। তারপর শাদী করে এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি।

—“জাহাপনা, কে বা কারা যে আমার বাড়ির সিঁড়িতে উজেটিকে ফেলে রেখে গিয়েছিল তার হদিস পাওয়া যায় নি।

চীনের সুলতান এবার মুচকি হেসে বললেন—“তােমার কিত্সাটি মন্দ জমাও নি হেকিম। তবে কুঁজোটির মৃত্যুর ঘটনার কাছে তােমার কিসসা কোণঠাসা হয়ে পড়তে বাধ্য। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তোমাদের কাউকেই ছেড়ে দেওয়া চলে না। মৃত্যু তােমাদের অপরিহার্য।

Leave a Reply