সহস্র এক আরব্য রজনী – ৮ (খ্রীস্টান যুবক ও বাবুর্চির কিসসা)

›› আরব্য রজনী  ›› ১৮+  

খ্রীস্টান যুবকের কিসসা

খ্রীস্টানটি তার কিসসা শুরু করতে গিয়ে বলল—“জাঁহাপনা, আপনি দীন দুনিয়ার মালিক। আমি এক বিদেশী, খ্রীস্টান। আমার জন্মভূমি কায়রাে। বিভিন্ন দেশ ছুঁড়ে শেষ পর্যন্ত আপনার সুলতানিয়তে এসে থিতু হলাম। শুরু করলাম কারবার। দালালীর কারবার। আমার আব্বাজীও এ কারবারই করতেন। বলতে পারেন এটি আমাদের বংশগত কারবার। আব্বাজী বেহেস্তে গেলে আমিই কারবারের সর্বেসর্বা হলাম।

এক সকালে গাধার পিঠে চেপে এক যুবক আমার কাছে এল। সুদর্শন যুবক, তার চোখে-মুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে আগন্তুক যুবকটির দিকে তাকালাম। সে কামিজের জেব থেকে এক মুঠো ক্ষীরার বীজ বের করে আমার সামনে ধরে বলল–এখন দর কত যাচ্ছে, বলুন তাে?

—‘একশ দিরহাম।

-“ঠিক আছে, আপনি তবে খান-অল-জয়ালী বিজয় দরওয়াজের কাছে চলুন। আমি অপেক্ষা করব।

ক্ষীরার বীজগুলি আমার সামনে রেখে সে বিদায় নিল। আমি ক্ষীরার বীজগুলাে নিয়ে এক মহাজনের কাছে গেলাম। সে একশ দশ দিরহাম দর দিয়ে কিনতে রাজি হল, আমার দশ দিরহাম করে লাভ হবে।

আমি খ্রীস্টানটির কাছ থেকে পঞ্চাশ মন বীজ কিনে ফেললাম। যুবকটি বলল, আপনি তবে প্রতিমনে দশ দিরহাম করে দালালি পেয়ে যাচ্ছেন। মাল নিয়ে যান। আপনার দালালির পাঁচ শ’ দিরহাম কেটে বাকি সাড়ে চার হাজার আপনার কাছেই জমা রাখবেন। আমি সুবিধামত সময়ে গিয়ে বাকি সেগুলাে নিয়ে আসব।

সেদিন আমার মােট এক হাজার দিরহাম রােজগার। পাঁচশ’ পাই বীজের মালিক যুবকটির কাছ থেকে আর পাঁচশ’ পাই মহাজনের কাছ থেকে।

প্রায় এক মাস পরে যুবকটি এলে তার প্রাপ্য সাড়ে চার হাজার দিরহাম তাকে দিতে চাইলাম। সে আরও কিছুদিন পরে নেবে বলল। তার কাছে নাকি রাখার একটু অসুবিধা।

প্রায় এক মাস পরে যুবকটি এল। আমি দিরহামগুলাে নিতে বললে সে আরও কিছু দিন আমার কাছেই জমা রাখতে বলল।

আরও মাস খানেক পরে একদিন আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে দেখেই চিৎকার করে বলল—এখন আর নামh না। জরুরী কাজে যাচ্ছি। সন্ধ্যার দিকে এ পথেই যাব। তখন দিরহামগুলাে নিয়ে যাব।

আমি সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার পর থেকেই দিরহামগুলাে নিয়ে অপেক্ষায় বসে রইলাম। কিন্তু সে ফিরল না। এর এক মাস পরে হঠাৎ একদিন সে উদয় হল। আমি

দিরহামের থলেটি এনে তার সামনে রাখলাম। এবারও সে নিল না এরও বেশ কিছুদিন কেটে গেল। এক বিকেলে টাটুর পিঠে চরে হাজির হল। চকমকে পােশাক পরিহিত। আমি দিরহামগুলাে এনে তাকে দিতে চাইলাম। বললাম—“পরের গচ্ছিত ধন-দৌলত যে কী দুশ্চিন্তার ব্যাপার তা ভুক্তভােগী ছাড়া কেউ জানে না। এগুলাে নিয়ে আমাকে চিন্তামুক্ত কর।

কিছু মনে করবেন না, আর কদিন দয়া করে ধৈর্য ধরুন। নিরুপায় হয়ে তার অনুরােধ রক্ষা করতে সম্মত হলাম। সেই যুবকটিকে খানাপিনা করতে অনুরােধ জানালাম।

সে খুব হাসলো, পরে রাজি হলো একটা শর্তে।–খেতে পারি। কিন্তু আজ যা খরচ হবে, সব আমার; আমার টাকা থেকে খরচ করতে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে, তাই হবে। তাকে বাড়িতে আদর যত্ন করে বসিয়ে বাজারে গেলাম আমি। ভালো দামী সরাব আর মাংস নিয়ে এলাম খানিকটা। সেই সঙ্গে কিছু ফল আর মিষ্টি। খানাপিনার ব্যবস্থা মোটামুটি ভালোই হলো। টেবিলে খানা সাজিয়ে তাকে ডাকলাম। বেশ আগ্রহ নিয়ে খেলোও সব। কিন্তু দেখে অবাক লাগলো, সমস্ত খাবারই সে বাঁ হাত দিয়ে খেলো। আমি ভাবলাম, হয়তো দুর্ঘটনায় ডান হাতটা জখম হয়ে থাকবে।

খাওয়া শেষ হলে লক্ষ্য করাম, বা হাতখানা ধুলো সে ডান হাতখানার সাহায্য ছাড়াই। আমার কৌতূহল আর চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, আচ্ছা মালিক, আপনার ডান হাতখানার কী হয়েছে। কোন দুর্ঘটনায়.

গায়ের আলোয়ানখানা সরিয়ে আমাকে দেখালো। তার ডান হাতখানা কৰ্ত্তী থেকে কাটা। ছেলেটি বললো, আজ যে আমি আপনার বাড়িতে এসে বা হাত দিয়ে খেলাম। এতে আপনি অপমানিত হবেন না; আশা করি। তার কারণ, ডান হাত দিয়ে খাওয়ার কোন উপায় আমার নাই। আর এই হাতটা কাটার পিছনে এক অদ্ভুত কাহিনী আছে।

তখন ছেলেটি তার কাহিনী বলতে লাগলো।

বাগদাদ শহরে আমার জন্ম। আমার বাবা ছিলেন। ওখানকার এক লক্ষপতি সওদাগর। যখন আমার উঠতি বয়স, সেই সময় থেকেই বাবার ব্যবসা বাণিজ্য বেশ মোটামুটি বুঝতে শিখলাম। সারা বছরই আমাদের বাড়িতে তীর্থযাত্রী, মুসাফীর এবং বিদেশী সওদাগরদের আগমনে ভরে থাকতো। বাবা মারা যাবার পর আমি তার ব্যবসা বাণিজ্য সম্পত্তির ষোল আনা মালিক হলাম। যার কাছে যা পাওনা ছিলো আদায়পত্র করে সব টাকায় কাপড়ের ব্যবসা আরম্ভ করলাম। বাগদাদ আর মসুল ছিলো কাপড়ের জন্যে বিখ্যাত। নানারকম পোশাক আশাক কিনে উটের পিঠে চাপিয়ে একদিন কাইরে যাত্রা করলাম। খোদার মেহেরবানীতে কয়েকদিন বাদে নিরাপদেই এসে পৌঁছলাম কইরোয়।

শহরের কাছে এক সরাইখানায় উঠলাম। কাপড়ের গাঁটগুলো রাখার জন্যে একটা ঘর ভাড়া করা হলো। সামানপত্র নামানোর পর নফরটাকে পয়সা দিয়ে বললাম, একটু কিছু খাবার নিয়ে আসতে। খানাপিনা সেরে একটু জিরিয়ে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে শহরের পথে বেরুলাম। বেন-আল-কাসিরেন ফুর্তি করার জায়গা। সন্ধ্যাবেলায় নাচ গানে জমে ওঠে। বেশ। মেয়েমানুষ আর মদের আখড়া। নতুন জায়গার নতুন স্বাদ। সন্ধ্যাটা কাটলো বেশ। পথের ক্লান্তি কেটে গিয়ে চাঙ্গা হলো শরীর। সরাইখানায় ফিরে এসে সুখ-নিদ্রা হলো সেদিন।

সকালে উঠে নফরকে বললাম, চল বাজারে বেরুতে হবে। সবরকম কাপড় চোপড় কিছু কিছু করে নিয়ে একটা গাঢ়রী বঁধ। দেখি, কী বাণিজ্য করা যায়।

শহরের প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র কাইজারিয়াৎ জিরজিস। এইখানেই সব বড় বড় দোকানপাট। দেশবিদেশের সওদাগররা আসে বাণিজ্য করতে। একটা দালালকে ধরে বললাম, আমি বাগদাদ আর মাসুলের বাহারী সাজপোশাক এনেছি। কী দাম পাওয়া যাবে, একটু দেখবে?

দালালটা বললে, ঠিক আছে, চলুন আমার সঙ্গে। ভালো মহাজন ঠিক করে দিচ্ছি। মাল পছন্দসই আর দামে বনলে সওদা হয়ে যাবে।

কিন্তু আমার নসীব খারাপ, অনেকগুলো বড় বড় মহাজনের গদি ঘুরেও একখানা জামা কাপড় বিক্রী করতে পারলাম না। তারা যে দামে কিনতে চায় সে দামে আমারই কেনা নাই। তার উপর রাহা খরচ, দালালী এবং আমার মুনাফা আছে।

দালালটা বললো, মুনাফা বের করার একটাই উপায় আছে। এখানে এসে সব সওদাগররাই যা করে আপনাকেও তাই করতে হবে। আপনি এক কাজ করুন, মালগুলো ধারে বেচে দিন। ধারে দিলে একটু বেশী দামে নেবার অনেক দোকান পাবেন। তাতে আপনার মোটামুটি ভালোই মুনাফা থাকবে। মাল দেওয়ার সময় ওরা আপনাকে হুণ্ডি করে দেবে। এক মাস পরে প্রতি সোমবার আর বৃহস্পতিবার ওরা কিস্তি দেয়। সপ্তাহে এই দুদিন এসে কিস্তি আদায় করবেন, আর বাকী কটা দিন-আনন্দ ফুর্তি করে কাটাবেন। এখানকার শহর আর নীল নদের শোভা আপনার ভালোই লাগবে।

আমি বললাম, বাঃ, খাসা হবে।

দালালকে সঙ্গে করে আমার সরাইখানায় এলাম। আমার ভাড়া করা গুদামে যতো মাল ছিলো সব তাকে দেখলাম। সেইদিনই সব মাল বিক্রী হয়ে গেলো। বেচে নগদ কিছু পেলাম না বটে, কিন্তু তার বদলে হুণ্ডির কাগজ করে দিলো দোকানীরা।

খুব খুশি মনে সরাইখানায় ফিরে এলাম। এখন একটা মাস শুধু খাওয়া দাওয়া, স্মৃর্তি করা, আর ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ নাই। প্রতিদিন সকালে উঠে মাখন, রুটি আণ্ডা, আপেল, বেদনা, আঙুর, মিষ্টি দিয়ে নাস্ত করে নীলের ধারে বেড়াতে যাই। আবার দুপুরে এসে মাংস পরোটা সন্তজী দিয়ে খানা সারি। তারপর বিকাল থেকে শুরু হয় সরাব। সন্ধ্যাবেলায় বেন-আলি কাসবেন পাড়ায় মৌজ করে মেয়েমানুষের নাচগানে মেজাজটা শেরিফ হয়ে ওঠে। অনেক রাতে আবার সরাইখানায় ফিরে আসি।

এইভাবে এক মাস কাটলো। এবার শুরু হলো আমার কিস্তি আদায়। প্রতি সোম আর বৃহস্পতিবার। বাজারে গিয়ে আমি এক এক দিন এক একটা দোকানে বসি। আমার দালালটা খুব চৌকস। দোকানে দোকানে ঘুরে সে আমার কিস্তির পাওনা টাকা পয়সা আদায় করে এনে দেয়া! একদিন কাইজারিয়াৎ জিরজিস–এর একটা বড় রেশম কাপড়ের দোকানে বসেছি। দোকানের মালিক, আমারই সমবয়েসী হবে, আমার সঙ্গে ইয়ার দেস্তের মতো ঠাট্ট মজাক করতো! আমার চেহারা নাকি মেয়েদের খুব পছন্দসই। তারা একবার পেলে আর আমাকে ছাড়বে না-এইরকম আদি রসাত্মক চুলবুলানী ধরিয়ে দিতো আমার দেহ মনে।

এরই মধ্যে বােরখায় আপাদমস্তক টেকে এক জেনানা এসে আমার সামনে বসল। কাপড় কিনতে আগ্রহী। তার গা থেকে সুরভুর করে দামী আতরের খুসবু বেরিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছে। বােরখার নাকাবটি এতই পাতলা যে তার মধ্য দিয়ে কাঁচা হলুদের মত তার গায়ের রঙ যেন ঠিকরে বেরােচ্ছে। ছুঁচলাে নাক। হরিণীর নত ডাগর ডাগর চোখ কপালের ওপর দু-চারগাছ কোকড়ানাে চুল তার মুখের সৌন্দর্যকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। একটু আগেই -দাকানির কথা আমার কলিজায় আদি রসের সঞ্চার ঘটিয়েছে। তার পর-মুহূর্তেই বেহেস্তের পরীটি মুখােমুখি এসে বসল। এক শহমায় তার দিকে তাকাতেই আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম। কলিজাটি উথালি পাথালি শুরু করে দিল। একটু পরেই নিঃসন্দেহ হলাম, সে-ও আমার দিকে কম ঝুঁকে পড়েনি।

নাকাবটি সামান্য সরিয়ে আচমকা আঁখি বাণ আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। আমার কলিজাটি অকস্মাৎ যেন ডিগবাজী খেয়ে ধীরে ধীরে আবার সােজা হ’ল।

এক সময় অভাবনীয় মিষ্টি-মধুর স্বরে সে দোকানিকে বল্ল —সােনার জরির কাজকরা ভাল মসলিন দেখাতে পারেন?

দোকানি একের পর এক শাড়ী তার সামনে রাখতে লাগল একটি হাতে তুলে নিয়ে দাম জিজ্ঞাসা করল। দাম শুনে বল—“কিন্তু আমার সঙ্গে তাে এত দিনার নেই। আমি বরং এটি নিয়ে যাচ্ছি। বাকি দিনার পরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

‘কিছু মনে করবেন না। এতগুলাে দিনার দাম, ধারে বেচা যাবে না। মহাজন সামনেই বসে। দুঃখিত, দাম নিয়ে এসে পরেই না হয়’

—“ছিঃ ! এরকম আচরণ করছেন! এতদিন ধরে হাজার হাজার দিনার লেনদেন হয়েছে। কোনদিন বাকি ফেলে রেখেছি, বলুন? শাড়ীটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এবার বল্ল—“আসলে আপনারা শুধু সামানপত্র কেনাবেচাই করেন। আসল নকল খদ্দের চিনতে পারে না।

তার যৌবনভরা দেহপল্লবটিকে এক ঝটকায় টুল থেকে তুলে নিয়ে ক্রোধমত্তা সিংহীর মত গটমট করে চলে গেল।

ব্যাপারটি আমার কাছে মােটেই সৌজন্যের পরিচায়ক বলে মনে হল না। মেয়েটি খুবই অপমানিত হয়েছে। লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে আমি তার পথ আগলে দাঁড়ালাম। মুখ কাচুমাচু কনে বললাম- দেখুন, যা ঘটার তা তাে ঘটেই গেছে। আপনি চলুন শাড়ীটি নিয়ে যান।

—দেখুন, দোকানির আচরণ বাস্তবিকই শিষ্টতা বহির্ভূত এবার নাকাবের ফাঁক দিয়ে দু’চোখের বাণ ছুঁড়ে বলল— কেবলমাত্র আপনার দিকে তাকিয়েই যেতে পারি।

আমি অপরিচিতা হরিণীটিকে দোকানে নিয়ে গিয়ে এগার দিরহাম মূল্যের শাড়ীটি দোকানির কাছ থেকে নিয়ে হাতে তুলে দিলাম। বিনিময়ে দোকানিকে একটি রসিদ লিখে দিলাম।

এবার মুচকি হেসে মেয়েটিকে বললাম-“প্রতি বৃহস্পতিবার আমি এ তল্লাটে আসি। মন চাইলে শাড়ীটির দাম দিতেও পারেন নইলে আমার তরফের উপহার মনে করতে পারেন।

মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁত ক’টি মেলে ধরে অপূর্ব সুন্দর ভঙ্গিমায় হেসে লেড়কিটি বলল—এত সুন্দর আপনার ব্যবহার যে, আর বলার নয়। এমন মহানুভব মানুষ আজকাল সচরাচর চোখেই পড়ে না। খােদাতাল্লার দোয়ায় আপনার হয়ত অনেক ধন দৌলত আছে। তবুও যে আমাকে একবার মাত্র দেখেই আমার চরিত্র সম্বন্ধে ধারণা করতে পেরেছেন সে আপনার অপরিমিত অভিজ্ঞতার জন্যই হয়ত সম্ভব হয়েছে। যদি মেহেরবানী করে গরীবের কুটীরে একবারটি পায়ের ধূলাে দেন তবে ধন্য হব।

আমার ভেতরে কামস্পৃহা ত চড়াক করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সাহসে ভর করে বলেই ফেল্লাম–‘সুন্দরী, আমাকে বাড়িতে আমন্ত্রণই যখন জানাতে পারলেন তখন আর বিভেদের প্রাচীরটুকু অক্ষুন্ন রেখে আমার কলিজাটিকে কেন মিছে পীড়া দিচ্ছেন ? ওড়নার নাকাবটি সরিয়ে ফেলে ওই কমলবদন দেখে মনপ্রাণ শান্ত করার সুযােগ দিলে জীবন সার্থক জ্ঞান করব।’

মেয়েটি নাকাব তুলে নিয়ে ঠোট টিপে টিপে হাসতে লাগল। হঠাৎ চার চোখের মিলন ঘটে যাওয়ায় শরমে তার মুখাবয়বটি সিদুরে মেঘের মত রক্তাভ হয়ে উঠল। আকস্মিক শরমে চোখ নামিয়ে নিল কিন্তু আড়চোখে আমাকে দেখার লােভ সামলাতে পারল না। ঠোটের কোণের দুষ্টুমিভরা হাসির রেখাটুকু মুহূর্তের জন্যও মিলিয়ে যায়নি।

আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন এক অনাস্বাদিত ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। হৃদস্পন্দন দ্রুততর হ’ল। রক্তের গতি বৃদ্ধি পেয়ে গেল মুহুর্তের মধ্যে।

লেড়কিটি আবার মুখ খুলল-“আমার ঠিকানা দোকানির কাছেই পেয়ে যাবেন। আশা করি অবশ্যই আমার বাড়ি আসছেন কি বলেন?

আমি কিছু বলার আগেই সে শাড়ীটি হাতে নিয়ে দোকান ছেড়ে রাস্তায় নেমে গেল। আমি তার ফেলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলাম।

সারাটি দিন সে-অপরূপার ডাগর ডাগর চোখের মন-পাগল করা চাহনি, বিচিত্র ভঙ্গিতে ভ্রু-নাচানো, ঠোটের কোণের কামােদ্দীপক হাসি—আমার মনকে পীড়া দিতে লাগল।

সরাইখানায় পৌছে রাত্রে খানাপিনা করতে আর মন চাইল না। শুয়ে পড়লাম। ঘুম এল না। মন-প্রাণ যদি সুস্থির না-ই থাকে তবে ঘুম তাে আসতে পারে না। মাঝ-রাত্রি পর্যন্ত নিদারুণ অস্থিরতার মধ্যে বিছানায় পড়ে ছটফট করলাম। বাকি রাত্রিটুকু কাটালাম অস্থিরভাবে পায়চারি করে।

কাকডাকা ভােরে গােসল সেরে ঝকমকে দামী পােশাক পরে নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে বদর-অল-দীন-এর দোকানে গেলাম। আমার পােশাককে কেন্দ্র করে বদর রঙ্গ-তামাশায় মেতে উঠল।

আমার আকাঙিক্ষতা সে অপরূপা গুটিগুটি পায়ে দোকানে কল। সে কিন্তু ভুলেও দোকানির দিকে চোখ ফেরাল না। সর্বক্ষণ আমার মুখের দিকে দৃষ্টি বদ্ধ রাখল। কুশল বার্তাদি আদান-প্রদান হল আমার মধ্যে। তারপর উঠতে উঠতে বল—“আপনার কোন লােক আছেন, একবারটি আমার সঙ্গে বাড়ি যেত? আপনার প্রাপ্য দিনার কটি তার হাতে দিয়ে দিতাম।

-“আপনি কেন সে শাড়ীটির জন্য এমন উতলা হচ্ছেন, বুঝছি না এত ব্যস্ততা কিসের? পরে যা হয় দেখা যাবে। সামান্য ক’টা দিনারের অজুহাতে হয়ত দেখবেন কোনদিন আপনার ঘরে গিয়ে হাজির হয়েছি।’

ফিক করে হেসে উঠল লেড়কিটি। দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে ধরল বিচিত্র ভঙ্গিতে। থলি খুলে এগারশ দিরহাম আমার হাতে গুজে দিয়ে বল্ল– ‘অজুহাতের দরকার হবে না। যখন দিল চায় চলে যাবেন। চলি। দোকান থেকে বেরিয়ে সােজা হাঁটা জুড়ল। একটি ব্যাপার কিন্তু আমার কাছে সুস্পষ্ট হ’ল। দিরহামগুলাে আমার হাতে দেওয়ার সময় তার হাতের আঙুলগুলাে প্রয়ােজনের তুলনায় একটু বেশিসময়ই আমার হাতের তালু স্পর্শ করেছিল। তার কি হ’ল। কতটুকু কি পেল আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে মুহুর্তের স্পর্শেই আমার শরীরের শিরা উপশিরাগুলাে ঝনঝনিয়ে উঠেছিল। স্পন্দন দ্রুততর হয়ে পড়েছিল। কোন নারীর সামান্য স্পর্শে যে সুখ-উৎপাদন করতে পারে তা আমার অন্ততঃ জানা ছিল না। বুঝতে বাকি রইল না মনময়ুরী জালে আটকা পড়েছে।

মনে মনে হাসলাম। আমিও দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। তার পিছু নিলাম। কিন্তু অকৎসাৎ সে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। মনটি অস্বাভাবিক বিষিয়ে উঠল। এমন সময় তেরাে-চোদ্দ বছরের একটি মেয়ে আমার সামনে এসে মুচকি হেসে বলল—মেহেরবানি করে আমার মালকিনের ঘরে একবারটি বার পায়ের ধূলাে দেবেন? তিনি আপনার কি জরুরী কিছু কথা বলতে আগ্রহী।

বহুত আচ্ছা। চল, এখনই যাওয়া যাক।

একটি দোকানের পাশে তাঁর সঙ্গে দেখা। চোখে ইশারা করে জানালাে পাশের এক নিরিবিলি জায়গায় আমাকে যেতে হবে। আমি তার নির্দেশিত প্রাচীরের ধারে চলে গেলাম। পরমুহুর্তেই সেও সেখানে হাজির হল। সে বােরখার নাকাব সরিয়ে মিনতির দৃষ্টিতে তাকাল। বলল-“আঃ তােমাকে দেখামাত্র আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন এক অভাবনীয় রােমাঞ্চ অনুভব করছি। শিরায় শিরায় জেগেছে মাতন। আমার রাত্রের ঘুম তুমি কেড়ে নিয়েছ পরদেশী। কেন এমন হল? তুমি কি যাদুবিদ্যা জান? তােমার যৌবন আমাকে মাতাল করে দিয়েছে। মেহবুব, আমার মধ্যে কেন তুমি এমন কামাগ্নি জাগিয়ে তুলেছ?

-“আমার অবস্থাও ঠিক একই রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে মেহবুবা। তােমার আঁখি-বাণ আমার কলিজাটিকে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। কেন? কেন আমি এমন—

আমাকে মুখের কথা শেষ করতে না দিয়েই সে বলে উঠল ‘মেহবুব। তুমি যাবে আমার ঘরে? তােমাকে বুকের মধ্যে না পাওয়া পর্যন্ত আমার কলিজা ঠাণ্ডা হবে না। আজ নয়। কাল বিকেলে একটি খচ্চরের পিঠে চেপে আমার ঘরে এসাে। জিজ্ঞেস করবে সিনডিক রবাক-এর ঘরের ঠিকানা।

আমি ঠোটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললাম–মেহবুবা, অবশ্যই যাব। নইলে যে আমার কলিজাও শান্তি পাবে না।’

পরদিন দুপুর পােরােতে না পেরােতেই আমি একটি রুমালে পঞ্চাশটি সােনার মােহর বেঁধে আমার মনমযুরীর খােজে বেরিয়ে পড়লাম। লাল রঙের একটি বাড়ির সামনে আমি খচ্চরের পিঠ থেকে নামলাম।

আমি দু’পা এগিয়ে দরজার কড়া নাড়লাম। দুটো খুবসুরৎ লেড়কি এসে দরজা খুলে আমার সামনে দাঁড়াল। এক নজরে দেখেই মনে হল তারা যেন বেহেস্ত থেকে সবে দুনিয়ায় নেমে এসেছে। নতুবা পরীদেরই কেউ হবে হয়ত।

ঠোটের কোণে হাসির রেখা টেনে রূপসীদের একজন বলল ‘আসুন হুজুর। আমাদের মালকিন আপনার পথ চেয়ে সকাল থেকে বসে। রাতভর আপনার সুরতের চিন্তায় কাটিয়েছেন। আপনি তার খুশী উৎপাদন করুন হুজুর।

আমি অপরূপাদের পিছন পিছন সুন্দর বাড়িটির ভেতরে ঢুকে গেলাম। সদর-দরজা থেকে শুরু করে উঠোন, বারান্দা, ঘরের মেঝে সবই বহুমূল্য শেতপাথরের তৈরী। তারা আমাকে নিয়ে সুসজ্জিত একটি ঘরে মেহগনি কাঠের একটি কুর্শিতে বসাল।

কিসসার এ পর্যন্ত বলা হলে বেগম শাহরাজাদ দেখলেন প্রাসাদের বাইরে ভােরের আলাে দেখা দিতে শুরু করেছে। তিনি এবার কিসসা বন্ধ করলেন।

ছাব্বিশতম রজনী

সন্ধ্যার কিছু পরে বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে প্রবেশ করলেন। উপস্থিত হলেন বেগমের কামরায়।

বেগম শাহরাজাদ তার কিস্সার পরবর্তী অংশ শুরু করতে গিয়ে বললেন- জাহাপনা, কায়রোর সে-খ্রীস্টান দালাল তা কিসসা বলে চললেন। অধীর আগ্রহে, একাগ্রচিত্তে সুলতান তার কাহিনীর পরবর্তী অংশ শুনতে লাগলেন। খ্রীস্টান দালালটি এবার বলল— “জাহাপনা, সেই যুবকটি বলতে লাগল আমার জান আমার কলিজা সে-রূপসী মণি-মুক্তার গহনায় নিজেকে সাজিয়ে তুলে ধীর-পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। পরণে তার অতিমিহি ঢাকাই মসলিম। তবু মনে হ’ল সে যেন একেবারেই নগ্না। তার নিটোল স্তন দুটো খুবই স্বচ্ছ। আর নিতম্ব, উরু, জংঘা সবই পরিষ্কার আমার আঁখি দুটির সামনে ধরা দিচ্ছে। নগ্না এক নারীর মুখােমুখি যেন আমি দাঁড়িয়ে।

ঠোটের কোণে অত্যাশ্চর্য এক হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে আমার মেহবুবা, আমার পেয়ারের বেগম আমার পাশে, একেবারে গা-ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। তার আঠারাে বছরের যৌবনভরা দেহে উষ্ণ উপস্থিতি ঢাকাই মসলিনে ঢেকে রাখতে পারল না।

আমি নীরব চাহনি মেলে তার যৌবনকে চাক্ষুষ করতে লাগলাম। কি করব, কি বলব সহসা গুছিয়ে উঠতে পারলাম না সেই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করল।

আচমকা আমার মুখটিকে তার উষ্ণ-নিটোল বুকে চেপে ধরল। আমি যেন মুহূর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। এতদিন শুধু ভেবেই এসেছি, কি এমন অমৃতভাণ্ড নারীর উন্নত স্তন দুটো যার ক্ষনিক স্পর্শ লোভে পুরুষরা ছোক ছোক করে বেড়ায়? আজ বুঝলাম, কেবল অমৃতই নয়। তাতে রয়েছে আকর্ষণীয় মাদকতা গুণ। পর মুহুর্তেই যে তার পথের পাঁপড়ির মত সুন্দর ঠোট দুটোকে নামিয়ে এনে আমার ঠোটে রাখল। আহারে! কী সে সুখ, কী যে স্বস্তি তার বিচার করার ভাষা আমার জানা নেই। আমার ঠোট-ওর ঠোট—মধু বিনিময় তৃপ্তি! আমি কি করব, কিসে যে বেশী সঙ্গসুখ অনুভব করতে পারব সে বােধশক্তি হারিয়ে ফেললাম। সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। উন্মাদিনীর মত তার বুকের সঙ্গে আমার প্রশস্ত বুকটকে চেপে ধরল। আমি তার কাঁধের ওপর দিয়ে হাত দুটোকে চালিয়ে দিয়ে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে তাকে চেপে ধরলাম। আমার একেবারে বুকের সঙ্গে সে লেপ্টে রয়েছে। আমি আমার মুখ নামিয়ে তার গলায় চুম্বন করলাম, স্বচ্ছ পোষাকের উপর দিয়েই তার খাড়া খাড়া স্তনে, স্তনের বোটায় চুমু দিলাম, হালকা কামড়াম, প্রান ভরে তার শরিরের খুশবু নিলাম। তবু মনে হল, আরও, আরও কাছে তাকে পাওয়ার জন্য মন প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সে আবেশে জড়িত, কামাতুর চোখ দুটো মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আবেগ-মধুর স্বরে বলল ‘মেহবুব। আমার আজকের এ-সন্ধ্যা আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত। ওগাে পরদেশী, তুমি আজকে কি সুখ, কী অবর্ণনীয় তৃপ্তি আমাকে দিলে তা আমি তােমাকে বােঝাতে পারব না!

আমি তার আপেলরাঙা কপােলে আলতাে করে একটি চুম্বন দিয়ে বললাম—‘সুন্দরী, আমার অবস্থাও তােমারই মত। আজ এই প্রথম মহব্বতের স্বাদ পেলাম। মহব্বত যে কী মধুর বস্তু তা আজই প্রথম উপলব্ধি করলাম। ওগাে সুখদায়িনী, আমার কলিজা আজ অমৃতের স্বাদ পেয়ে ধন্য হল। সে আমার পৌরুষের চিহ্ন সম্বলিত লােমশ বুকে মাথা গুজে আবার মধুর স্বরে বলল-“আমি এর আগে কোনদিন কোন পুরুষের কাছ থেকে মহব্বত পাইনি। আমার শাদী হয়েছিল। এক বুড়া আমার জীবনে এসেছিল। অগাধ ধন-দৌলতের মালিক। কিন্তু নারীকে প্রকৃত সুখ আস্বাদন করানাের মত ছিল না বলতে, কিছুই ছিল না। আমার কাছে সে ছিল অভিশাপ মাত্র। আজ তুমি আমাকে। পেয়ার মহব্বতে ভরিয়ে দাও, আকুল প্রাণকে শান্ত-স্নিগ্ধ কর, তৃপ্ত কর আঠার বছরের অতৃপ্ত মনকে। আমিও আমার সযত্নে রক্ষিত সম্পদ তােমাকে উজাড় করে দেব। আমার এ-দেহ আর এ মন সবই তােমার মেহেবুব।

রাত্রে পানাহার করলাম পাশাপাশি বসে। তারপর আমরা জানালার ধারে গিয়ে বসলাম। পাশের বাগিচা থেকে ফুরফুরে বাতাস এসে আমাদের কামােন্মাদ দেহ দুটোকে স্নান করিয়ে দিতে লাগল। শীতল বায়ুর স্নান। এক সময় আমরা কখন যে আরও কাছাকাছি হতে শুরু করেছিলাম তা বলতে পারব না। কখন যে আমি তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম তা-ও যেন নিজেরই অজান্তে ঘটেছিল। উভয়ে এবার নতুন খেলায় মশগুল হয়ে পড়লাম।

আমরা একে অন্যের কাছে হারিয়ে যেতে লাগলাম। তার দেহবল্লবী ছাড়া পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্রও হুস ছিলনা। আমরা একে অন্যের দেহ নিয়ে খেললাম। আমি তার স্তনদুটোকে দলাই মলাই করতে থাকলাম, সে সুখে অস্থির হয়ে উঠল। আমি তার মধুমাখা সমস্ত দেহটিকে চেটে পুটে খেতে লাগলাম। তার গলা লেহন করলাম, তার বাহু, বোগল চেটে দিলাম। তার নাভির ফুটোয় জিব দিয়ে সুরসুরি দিলাম। তার তলপেট, তার মধুর গহীন কুন্জবনে মুখ ডুবিয়ে দিলাম, আর যোনির ভিতরে আমার জিব দিয়ে তার রসসুধা পান করলাম।

কখন যে মােমবাতিটি গলতে গলতে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে বলতেই পারি নি। আর কতক্ষণ যে আমরা পরম প্রিয় অন্ধকারের মধ্যে কাটিয়েছিলাম তা-ও সঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারবনা। কতক্ষণ যে সে আমার বাহুলগ্না হয়ে ছিল তার হিসাব কার ছিল না। আমার জীবনে এমন মধুঝরা রাত্রি আর কোনদিনই আসে নি।

এক সময় রাত্রি পােহাল। ভােরের আলাে জানালা দিয়ে ঘরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। বিছানা ছেড়ে নেমে এলাম।

আমি আমার পরম সুখদায়িনী মেহবুবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার উদ্যোগ নিলাম। আমাকে দুবাহুর বন্ধনীতে জড়িয়ে ধরে আবেগভরা কণ্ঠে বলল-মেহবুব, আবার কবে তােমাকে আমার মাঝে ফিরে পাব? কবে তােমার যৌবন আমার যৌবন দেহটিকে সুখদান করবে?

‘আজই। আজ রাত্রেই আবার আমরা মিলিত হব।’

সরাইখানায় এসে গোসল করে নাস্তা খেলাম। তারপর ভাবলাম তাগাদায় বেরুতে হবে। কিছু টাকা চাই। আজ রাতে যাবো। আবার আমার প্রিয়ার কাছে। সুতরাং নাস্তা সেরে বাজারের পথে বেরুলাম। আদায়পত্র করে সরাইখানায় ফিরে এসে দেখি আমার টেবিলে বিরাট জামবাটীতে ভর্তি ভেড়ার মাংসের কোর্মা এবং অনেকখানি ভালো ভালো মিঠাই-মণ্ডা রাখা আছে, বাজারে বেরুবার আগে বলে গিয়েছিলাম বাজারের সবচেয়ে সেরা দোকান থেকে সে যেনো এই খাবারগুলো নিয়ে এসে রাখে। আজ সন্ধ্যাবেলায় আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো। আমার প্ৰেয়সীর বাড়ি। রুমালের খুঁটে আবার পঞ্চাশটি স্বর্ণমুদ্রা বেঁধে খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে সেই ছোকরার খচ্চরের পিঠে চেপে আবার গিয়ে নামলাম তার বাড়ির গেটে।

সে দিন দেখলাম আগাগোড়া বাড়িটা ঝাড়পোছ করা হয়েছে। আরও সুন্দর করে সাজানো-গোছানো হয়েছে ঘর দোর। আমাকে আরও ভালো ভাবে আদর অভ্যর্থনা করার সব ব্যবস্থাই ভারি চমৎকার মনে হলো আমার।

আমাকে দেখা মাত্র ছুটে এসে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে সে আদর করতে থাকলো, সোনা, সারাটা দিন কী ভাবে যে কাটিয়েছি, কী বলবো। তোমাকে না দেখতে পেলে আমি আর এক মুহূর্ত বাঁচবো না।

টেবিলে খানা পিন্যা সাজানো হলো; আমার প্রিয়া আমার সাকী আমায় সরাবের পাত্র মুখে তুলে ধরলো। আমি একটা চুমুক দিলাম। এক টুকরো মাংস তুলে নিয়ে আমার মুখে পুরে দিলো। আমি গিলে ফেললাম।

সুরার নেশায় যত না নেশা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি নেশা ধরায় প্রিয়ার বাহুডোর। মনে হয় ‘এ জগতে তুমি ছাড়া আর কিছু নাই কেহ নাই গো’।

সারাটা রাত দুজনে দু’জনের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে রইলাম। সকাল হতেই উঠে পড়ি। আমার খচ্চর আসবে। সরাইখানায় যেতে হবে। তারপর আবার তাগাদায় বেরুতে হবে। আবার চাই টাকা। পঞ্চাশটি সোনার মোহর। সন্ধ্যাবেলা রুমালের খুটে বাঁধা মোহরগুলো বালিশের তলায় রেখে ফিরে এলাম সরাইখানায়।

সারারাতের অনিদ্রা অত্যাচারের ফলে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। সে দিন আর সকালে তাগাদায় বেরুতে পারলাম না। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমুলাম। বিকালের দিকে স্নান টান সেরে তৈরি হলাম। নফরটাকে পাঠালাম দোকানে। মুরগীর বিরিয়ানী, চাপ, হালওয়া, আপেল, আঙ্গুর বেদানা নিয়ে এলো সে। সন্ধ্যার আগে খচ্চর নিয়ে এলো ছেলেটা। খাবার-দাবার সঙ্গে নিয়ে পৌঁছলাম প্ৰেয়সীর বাড়ি। সাদর অভ্যর্থনা করে পালঙ্কে বসালে সে। দু’জনে মিলে খানা পিনা সারলাম। তারপর সারা সন্ধ্যা অনেক আদর-সোহাগ-এর পর্ব চললো। রাত বাড়ে। দেহের উত্তেজনাও বাড়তে থাকে। একে অনের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। মোমবাতি গলে গলে ফুরিয়ে যায় এক সময়। আবার নতুন মোম জ্বলে ওঠে। তাও এক সময় শেষ হয়। আবার। আবার। এইভাবে রাত্রি অবসান হয়। অনিদ্ৰা-অবসন্ন দেহটা টেনে নিয়ে ফিরে আসি সরাইখানায়। রুমালের খুঁটে বাধা পঞ্চাশটা সোনার মোহর রেখে আসি ওর বালিশের তলায়।

এই ভাবে রাতের পর রাত তার বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে দিন কাটতে থাকে। অবশেষে একদিন সকালে উঠে বুঝতে পারলাম, আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি! আমার সম্বল বলতে আর কানা-কড়িও নাই।

কি করবো, কোথায় যাবো, কোথায় টাকা পাবো।–সেই চিন্তা আমাকে পাগল করে তুললে। বাজারে গিয়ে লাভ নাই। সেখানে আমার কোনও কিছু পাওনা নাই। একটু এগুতেই দেখলাম, কতকগুলো ছেলে এক জায়গায় জড়ো হয়ে কি যেন দেখছে। কাছে গিয়ে দেখি, একটা তাগড়াই ঘোড়ার পিঠে এক সিপাই। লড়াই এর সাজে সজ্জিত। এমন দৃশ্য শহরের সাধারণ মানুষ সচরাচর দেখতে পায় না! তাই এতো ভীড়। আমিও ওদের সামিল হয়ে পড়লাম। ভীড়ের চাপে পড়ে সিপাই-এর গায়ে গিয়ে লেপটে পড়ি। সেপাই-এর জেরে আমার হাত ঠেকলো শক্ত মতো বটুয়া আছে বুঝতে পারলাম। জানি না কি হতে কি হয়ে গেলো, টুক করে তুলে নিলাম সেটা। হয়তো আমার হাতে পয়সা কড়ি ছিলো না বলেই লোভটা সামলাতে পারলাম না। কিন্তু বিপদ এড়াতে পারলাম না। পর মুহুর্তেই সিপাইটা চিৎকার করে উঠলো, আমার টাকা? আমার বটুয়া?

আশে পাশের যারা ভীড় করে দাঁড়িয়ে ছিলো, সকলের মুখের ওপর একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো সে। আমি ভীড় ঠেলে বেরোবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তা আর হলো না। সিপাই-এর দস্তানা পরা হাতের প্রচণ্ড এক ঘুসিতে পড়ে গেলাম। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছি আমি। বুঝতে পারলাম, সিপাইকে ছেকে ধরেছে। সবাই। —কেন মারলে ওকে। একটা অসহায় ছেলের গায়ে হাত তুললে কেন?

সিপাই বললো, লোকটা চোর। আমার জেব থেকে টাকার থলে তুলে নিয়েছে।

একজন রুখে এলো, মিছে কথা। খানদানী চেহারার ছেলে, দেখছেনা! ও তোমার জেবে হাত ঢোকাবে? তোমার ভুল হয়েছে।

সিপাই তখনও বলছে, না, আমি ভুল করিনি। ও-ই নিয়েছে আমার বটুয়া।

কিছু লোক আমার পক্ষে সিপাইকে ডাঁটছে। আবার কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করে চলে যাচ্ছে। এমন সুন্দর একটা ছেলে—চুরি করেছে!

কেউ আবার মন্তব্য করে, কি যে দিন কাল হলো, মানুষের মুখ দেখ চেনার উপায় নাই—কে কেমন?

জনতার আক্রেশ ক্রমশই বাড়তে থাকে। সিপাই প্ৰায় কোণ ঠাসা হয়ে পড়ে। এমন সময়, আমার নসীব খারাপ, সেই পথ দিয়ে দারোগা সাহেব যাচ্ছিলো। এমন একটা জমায়েৎ দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার, এতো জটিল কিসের?

জনতার একজন এগিয়ে এসে নালিশ জানালো, এই সিপাইটা এই ছেলেটাকে মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছে।

সিপাইটা বললো, আমীর সাহেব, লোকটা চোর। আমার জেব থেকে টাকার বটুয়া তুলে নিয়েছে।

দারোগার প্রশ্ন, তুমি কি হাতে নাতে ধরেছো?

–জী না।

—আর কেউ দেখেছে তোমার জেবে হাত ঢোকাতে? জনতা নিরুত্তর। সিপাইটা বললো, না।

—তবে? কী করে বুঝলে, ও তোমার জেব মেরেছে?

–আমার জেবে একটা নীল রঙের বটুয়া ছিলো। আর তার মধ্যে কুড়িটা সোনার মোহর ছিলো, হুজুর।

দারোগা বললো, ওকে তাল্লাসী করে দেখো।

আমার পকেট থেকে সেই নীল রঙের বটুয়া পাওয়া গেলো। দারোগা সাহেব নিজে বটুয়া খুলে দেখলো। হ্যাঁ কুড়িটাই মোহর আছে।

দারোগা সাহেব ক্রুদ্ধ। আমাকে জেরা করতে লাগলো, সত্যি করে বলো, চুরি করেছো?

আমি আর কি বলবো। মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তখন আমি যাই বলি না কেন, কোন সুফল হতে পারে না; আমার অস্বীকারে দারোগার ক্ৰোধ বাড়বে বই কমবে না। তাই কোন জবাব না দিয়ে চুপ কবে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু তাতে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো সে। —এখনোও বলো, তুমি চুরি করেছ কি না।

আমি বললাম, জী হুজুর।

দারোগা তখন তার লোকজনকে বললো, ওর হাত দু’খানা কেটে ফেলো। চুরি করার একমাত্র সাজা হাত কেটে ফেলা। আমার ডান হাতটা কাটা হয়েছে। এবার বা হাতটাও কাটা হবে। এমন সময় সেই সিপাইটা দারোগার কাছে আমার বা হাতটা না কাটার জন্যে আজি পেশ করলো। সিপাই-এর দৌলতেই এ হাতটা রক্ষা পেয়ে গেছে।

দারোগারা চলে যাবার পর উপস্থিত জনতার কয়েক জন আমাকে, দয়াপরবশ হয়ে, হেকিমি দাওয়াখানায় নিয়ে গেলো। ওষুধপত্র লাগিয়ে বেঁধে দিলো হেকিম। অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে শরীরের। বেশ দুর্বল হয়ে পড়লাম। কে একজন এক পাত্র সরাব এনে দিলো আমাকে। এক চুমুকে টেনে নিলাম। একটু পরে চাঙ্গা হলো শরীরটা। ডান হাতের ওপর রুমালটা জড়িয়ে নিয়ে দাওয়াখানা থেকে পথে নামলাম।

আমার ‘ভালোবাসার’ কাছে যাবো। কিন্তু এই হাত নিয়ে তার কাছে দাঁড়াবো কি করে? কী বলবো তাকে? ভেবে কিছু কুল কিনারা করতে পারলাম না। এক পা এক পা করে কখন যে তার বাড়ির সামনে এসে পড়েছি, বুঝতে পারিনি।

আমাকে দেখে ছুটে এলো সে। সন্ধ্যা বেলায় আসার কথা, অথচ সকালেই এসে গেছি। অপ্রত্যাশিত পাওয়ার আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠলো আমার প্ৰেয়সী। আমি বিষণ্ণ বিবশ হয়ে ঘরে গিয়ে পালঙ্কে শুয়ে পড়লাম। সে আমার পাশে এসে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো—কি হয়েছে, সোনা, তোমাকে এমন শুকনো-শুকনো দেখাচ্ছে কেন? অন্যদিন কেমন সেজেগুজে আসো। কিন্তু আজ তোমার জামাকাপড়ও কেমন কুচকে গেছে, মাথার চুলগুলো এলো মেলো—কী হয়েছে বলতো?

আমি বললাম, শরীরটা ভালো নেই, বড্ড মাথা ধরেছে।

—টিপে দেবো?

আরো কাছে এগিয়ে আসে সে। আমার মাথাটা তুলে নেয় ওর কোলে।

আমি বলি, না, থাক। তেমন কিছু না। ও এমনি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েমানুষের চোখে ফাকি দেওয়া যায় না। ও বললো, না সোনা, তুমি লুকিয়ে রাখছো। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। তোমাকে এমন মন-মরা হয়ে থাকতে কখনও দেখিনি। আমার কাছে খুলে বলো, সোনা। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে।

—কিছু ঘটেনি। আমার শরীরটা ভালো নাই। তুমি এখন যাও, আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

আমার বলার ঝাজে আহত হলো সে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। —বুঝেছি, আমাকে আর ভালো লাগছে না তোমার। এই ক’দিনেই আমি ফুরিয়ে গেছি তোমার কাছে।

আমি মহা ফাঁপরে পড়লাম। কি বলে, কি করে ওর কান্না থামাই। কি করে বোঝাই, ওসব কিছু না, ভালোবাসাতে কোন চিড় খায়নি।

—তোমার ওসব কথা মনে এলো কি করে? তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে ভালোবাসিনি সোনা।

—না না না। ও কথা বলে আমাকে বোঝাতে পারবেনা। তোমার চোখ দেখে আমি বুঝেছি। আমার ওপর আর কোনো আসক্তি নাই তোমার। তোমাকে খুশি করার মতো আর কিছুই নাই আমার।

আমার কোন কথাতেই কান দিলো না সে। সারাটা দুপুর, সারাটা বিকাল কেঁদে ভাসালো। সন্ধ্যার আগে অন্য দিনের মতো খাবার সাজানো হলো। আমার কাছে এসো।

আমি বললাম, আমার খিদে নেই। তুমি খেয়ে নাও। আমি পরে খাবোখন।

এই কথায় ভীষণ রেগে গেলে সে। —খাবে তো শিগ্‌গির উঠে এসো। না হলে সব উল্টে দেবো, বলছি।

অগত্যা বাধ্য হয়ে খাবার টেবিলে যেতে হলো। বাঁ হাত দিয়ে খাবার তুলে মুখে দিতেই অবাক হয়ে সে প্রশ্ন করে, সেকি? তোমরা ডান হাতে কি হয়েছে? দেখি?

আমার রুমালে বাধা হাতটা তুলে ধরলে সে। আমি বললাম, একটা ফোড়া উঠেছে, তাই বেঁধে রেখেছি।

সে বলে, ঠিক আছে, আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি। খাওয়ার পর ছুরি দিয়ে মুখটা ছাড়িয়ে দেবো, দেখবে পুজ রক্ত বেরিয়ে গেলে, আরাম পাবে।

আমি বলি, সবে উঠেছে, এখনও পাকেনি। আমার চোখে জল এসে গেলো। যার কাছে হলদায়ের কোন কথা গোপন রাখিনি, আজ তার কাছে অনগাল মিথ্যে বলে যাচ্ছি আমি। আমার চোখে জল দেখে সে মনে করলে ফোঁড়ার ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েছি। বললো, একটু সরাব খেয়ে নাও, ব্যথাটা কমে যাবে।

একপাত্র সরাব তুলে ধরলে আমার মুখে। এক চুমুকে খেয়ে নিলাম। আরও এক পাত্ব ভরে দিলো—পরে আরও এক পাত্র। নেশা বেশ ধরে গেলো। ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়ে এলো চোখ। আমাকে ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো। মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমে গলে গেলাম।

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই ডান হাতটা তুলে দেখলাম। আমরা ঘুমের সুযোগে সে হাতটা খুলে দেখে আবার বেঁধে রেখেছে। হেকিমের হাতের বাধা থেকে সে বাধা অন্য রকম। লজ্জায় দুঃখে। ওর মুখের দিকে আর তাকাতে পারি না। ও কিন্তু কিছু বললো না, কিছু প্রশ্ন করলো না। শুধু এক পেয়ালা সরাব আমার মুখের সামনে তুলে ধরলো। কোন কথা না বলে এক চুমুকে খেয়ে নিলাম সবটুকু! বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, এবারে চলি, অনেক বেলা হয়ে গেলো।

সে এবার পথ রোধ করে দাঁড়ালো, না, যাওয়া হবে না। কোথায় যাবে তুমি?

—যেদিকে দু-চোখ যায়! আমার দুর্ভাগ্যের সঙ্গে তোমাকে আর জড়াতে চাই না! ভাগ্যের অন্বেষণে বেরুবো। দেখি, কি হয়।

সে বললো, এখন তোমার হাতের এই অবস্থা। ভালো করে সেবা শুশ্রুষা দরকার; অন্য কোথাও গেলে তা হবে না। এখানেই থাকতে হবে তোমাকে।

আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ওর বুকের মধ্যে মুখ গুজে ছোট ছেলের মতো কেঁদে উঠলাম, —আমি চোর। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছি।

ও আমার মুখে হাত চাপা দিলো, চুপ, কেউ শুনে ফেলবে। আমি কাল রাতেই তোমার হাত খুলে দেখেছি! চুরি করার একমাত্র সাজা হাত কেটে দেওয়া! কিন্তু আমি ভেবে পেলাম না, সোনা, তুমি কেন চুরি করতে গেলে?

–আমার আর কিছুই নাই! সব শেষ করে দিয়েছি।

মেয়েটি কোন কথা বলতে পারলো না। সব দোষটিই তার। প্রতি সন্ধ্যায় সে এসেছে। সারারাত মাস্তি করেছে। মদ মাংসে অনেক পয়সা গেছে। তাছাড়া রোজ পঞ্চাশটা করে মোহর দিয়ে গেছে তাকে। এই ভাবে ব্যবসার সব টাকা পয়সা খুইয়ে সে পথের ভিখিরী।

–তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। এখানেই থাকো। আমার জন্য তোমার আজ এই অবস্থা।  ব্যবসা-বাণিজ্য ডকে তুলে আমাকে নিয়ে মত্ত হয়ে গিয়েছিলে! বোকার মতো দুহাতে পয়সা উড়িয়েছো, আমিও তোমাকে পেয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তোমার কিসে ভালো হবে, তা আমার দেখা উচিত ছিলো। তা না, আমি তোমাকে সব কাম কাজ ভুলিয়ে আমার কাছে ধরে রেখেছিলাম। আজ তুমি সর্বস্বান্ত, শুধু আমার জন্যে। আর আমার জন্যেই তোমার হাতটা গেছে। এই দুঃখ আমি কোথায় রাখবো, সোনা। কি দিয়ে এর প্রায়শ্চিত্ত করবো।

আমি ওকে বুকে টেনে নিই। তোমার কি দোষ? আমি তো আর ছেলেমানুষ নই। আমার নিবুদ্ধিতার ফল আমাকে ভোগ করতে হবে।

—না না না। সে হতে পারে না। তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারবে না। দুনিয়াতে এমন কোন শক্তি নেই, তোমার থেকে আমাকে আলাদা করে রাখবে। আমি আজই এখুনি সব ব্যবস্থা পাকা করে দিচ্ছি। তোমাকে আমি শাদী করবো। আমার যা আছে সব তোমাকে দেবো, তুমি আবার ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। আমরা সুখে দুঃখে ঘর সংসার করবো।

আমি হতবাক হয়ে রইলাম। সত্যিকারের ভালোবাসা না থাকলে এ কথা কেউ বলতে পারে না। অথচ ওকে আমি গোড়া থেকেই ভুল বুঝেছিলাম। টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছিলাম।

মৌলভী আর সাক্ষী ডাকা হলো! সেই দিনই সন্ধ্যাবেলায় আমরা শাদী করলাম। ও তার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি টাকাকডি আমার নামে দান-পত্র করে দিলো।–তোমার মানেই আমার। এই বিশাল সম্পত্তির বোঝা আমি আর বইতে পারছি না। আজ থেকে তুমি আমার আইনসম্মত স্বামী। তোমার হাতেই সব তুলে দিলাম। আর আমার শাদীর দেন মোহর? সে তো তুমি সোনা, অনেক দিন ধরে জমা করে দিয়েছে আমার কাছে।

রাতের খানা পিনা শেষ করে আমাকে নিয়ে গেলো। সে তার সিন্দুকের কাছে! এক এক করে সব দেখালো, তার টাকা পয়সা। হীরা জহরৎ, অলঙ্কার। আমার দেওয়া মোহরগুলো দেখলাম, তেমনি রুমালের খুঁটেই বাধা আছে। সে বললো, আজ থেকে এইসব তোমার। এই নাও চাবি।

আবার আমি নতুন জীবন পেলাম। হাসি গানে ভরে উঠলো আমাদের জীবন। নতুন করে ব্যবসা বিবির মুখে অনেক হাসি হল্লার মধ্যেও, এক করুণ বেদনার ছাপ অনুভব করতাম আমি। অনেকরাতে ঘুমের ঘোরে। প্রলাপ, বকতো, আমার জন্যে—শুধুই আমারই জন্যে ডান হাতটা গেলো। আমার মতো হতভাগীর মরণ হয় না-কেন…

আমি তাকে জাগিয়ে তুলি, সোনা, কি সব ভুল বকছো। আমার একটা হাত গেছে, তার জন্যে তুমি দিন রাত অতো কষ্ট পাও কেন? আর একটা হাত তো আমার আছে? আর সব চেয়ে বড়ো।–তুমি তো আছো। আমার যদি এ হাতটাও কাটা যেতো, তোমাকে যখন সারা জীবনের মতো পেয়েছি, আমার কোন দুঃখ থাকতো না। আমি হয়তো প্ৰাণেই বাঁচতম না, যদি তুমি আমাকে না। এমনিভাবে কাছে টেনে নিতে। কোন মন খারাপ করো না, সোনা। যা গেছে তা গেছে। যা আছে, যা পেয়েছি তাই নিয়ে হেসে খেলে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবো আমরা।

কিন্তু সারাটা জীবন আর একসঙ্গে কাটাতে পারলাম না। কি কালব্যাধিতে ধরলো তাকে—কত বড় হেকিম দেখলাম, কত দামী দামী দাওয়াই পত্র খাওয়ালাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগলো সে। যতই তাকে হৈ চৈ করে মাতিয়ে রাখতে চেষ্টা করি, ততই যেন সে আরও মুষড়ে পড়ে। বুঝতে পারলাম, আমার হাতটা কাটা যাওয়ায় যে-আঘাত পেয়েছে সে, তা আর সামলাতে পারছে না।

ঘুসঘুসে জ্বর হতে লাগলো। সারাদিন রাত ছাড়ে না। খুক খুক করে কাশে। বুকে ব্যথা! একদিন কাশতে কাশতে রক্ত উঠলো মুখ দিয়ে। হেকিম বললো, ক্ষয় রোগ। সারা বুকটা বাঝরা করে ফেলেছে। বাঁচানো শক্ত।

বাঁচানো গেলোও না। এর মাসখানেক বাদে একদিন সকালে আমাকে শোকের সায়রে ভাসিয়ে দিয়ে বেহেস্তে চলে গেলো সে।

তার মৃত্যুর পর তার সমস্ত ধন সম্পত্তি আমার হাতে এলো। এতো অর্থ নিয়ে আমি কী করবো? টাকা পয়সা বা হীরে জহরৎ ছাড়াও আর যে সব জিনিসপত্র ছিলো সেগুলো এক এক করে বিক্রী করে দিলাম। পঞ্চাশ মণ ক্ষীরার বীজ ছিলো ঘরে। আপনাকে দিয়ে বিক্রী করালাম। দিনের পর দিন কথা দিয়েও আপনার কাছে টাকাটা নিয়ে যেতে পারলাম না। তার কারণ আমি তখন অন্যান্য জিনিসপত্র, জমিজমা, বিষয়আশয় সব বেচে দেবার ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। এতোদিনে সব কাজ শেষ হয়ে গেলো। আজ আমার সময় হয়েছে তাই আপনার কাছে এসেছি। কিন্তু আমার একটা নিবেদন আছে। আমার এখন অনেক টাকা। এতো টাকা নিয়ে আমি কি করবো, ভেবে পাচ্ছি না। আপনার কাছে যে টাকাটা গচ্ছিত আছে সেটা আমি আর ফেরৎ নিতে চাই না, ওটা আপনাকে দিলাম। আপনি ব্যবসা বাণিজ্য করে ধনবান হোন, এই আমি চাই।

যুবক বললো, এই হলো আমার জীবনের কাহিনী। এই জন্যে আজ আমি আপনার বাড়িতে বা হাত দিয়ে খানা খেলাম।

তারপর, জাঁহাপনা আমি সেই যুবককে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম, তোমার এই অনুগ্রহ আমার চিরকাল মনে থাকবে।

সে বললো, ওসব কিছু মনে রাখার দরকার নাই। আজ আমি এতো বিত্তবান, আপনার ঐ সাড়ে চার হাজার দিরহাম আমার কাছে কিছুই না। আপনি যদি আমার সঙ্গে ব্যবসায় আসেন, খুব খুশি হবো। আমি এখন বাগদাদে কারবার শুরু করেছি। আপনি তো শুনলেন বাগদাদ আমার জন্মভূমি। কাইরো এবং আলেকজান্দ্রা থেকে মাল নিয়ে গিয়ে বাগদাদে বিক্রী করছি। দারুণ মুনাফা। আপনি আমার সঙ্গে আসুন, তাহলে কারবারটা আরও বড় করে বাড়াবো।

আমি তো হাতে স্বর্গ পেলাম। কাইরো আর আলেকজান্দ্রা থেকে মালপত্র নিয়ে গিয়ে বাগদাদে বিক্রী করে মোটা লাভ করতে লাগলাম। সে আমাকে লাভের আধাআধি বাখরা দেয়। এইভাবে আমাদের কাজ-কারবার বেশ ভালোই চলছে। এখন আবার এসেছি মালপত্র কিনতে। কাল রাতে একটু মৌজ করে আস্তানায় ফিরছিলাম। পথের মধ্যে কুঁজের মরা লাশটা নিয়ে ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি, হুজুর।

এই সময় শাহরাজাদ দেখলো, রাত শেষ হয়ে আসছে। গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।

সাতাশতম রজনী।

শাহরাজাদ শুরু করে। শুনুন জাঁহাপনা : সেই খ্ৰীষ্টান দালাল তার কাহিনী শেষ করে বললো, আমার বিশ্বাস, হুজুর, কুঁজোর এই মৃত্যুর জন্যে কোন ব্যক্তি বিশেষের হাত নাই। নিয়তি লেখা ছিলো, তাই সে মারা গেছে।

সুলতান মাথা নেড়ে বলে, না না, ওসব ছেদো কথায় আমাকে ভোলাতে পারবে না। আমি তোমাদের সবাইকে এক এক করে ফাঁসী দেবো। আমার দরবারের এমন মজার বয়স্যকে তোমরা হত্যা করেছে, তোমাদের কাউকে ছাড়বো না।

এবার সুলতানের রসুইকর বল- জাহাপনা যদি অনুমতি করেন তবে আমি আমার কাহিনী শুরু করি।

-“ঠিক আছে। তােমার বক্তব্যও তবে শােনাই যাক।

– ‘শুনুন জাঁহাপনা। আমর কিসসা শুনে যদি আপনার মেজাজ শরিফ হয়, আমার কথা সত্য বলে মনে করেন তবে যারা আপনার চোখে অপরাধী মনে হচ্ছে আশা করি সবাইকে মাফ করে দেবেন।

সুলতান মুখের গাম্ভীর্যটুকু অবাহিত রেখেই বললেন-“আচ্ছা, পরের কথা পরেই না হয় ভাবা যাবে। কিসসা শুরু কর। সত্যি যদি মজার ব্যাপার কিছু থাকে তখন বিচার-বিবেচনা করে দেখব।”

 

বাবুর্চির কিসসা

বাবুর্চি তার কাহিনী শুরু করলো। শুনুন জাঁহাপনা :

গত রাতে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে শাদীর নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, অনেক গুণী-জ্ঞানী লোকের সমাগমে আসর। জমজমাট। কোরান পাঠ শেষ হলে খানার টেবিল সাজানো হলো। নানারকম মাংসের হরেক রকম মুখোরোচক খানা, সজীর বিরিয়ানী হালওয়া ফল ইত্যাদি। এর মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু একটা খানা ছিলো রসুনের বিরিয়ানী। যাকে আমরা বলি ‘জিরবাজা’। রসুনের সঙ্গে নানারকম মশলা পাতি ও শাকসব্জী দিয়ে চালের তৈরী এই বিরিয়ানী বিয়ে শাদী উৎসবের এক বাহারী খানা। আমরা—অভ্যাগত নিমন্ত্রিতরা সবাই খুব তৃপ্তি করে খেতে লাগলাম। শুধু একজন বললো, আমাকে মাফ করবেন, আমি ঐ রাসুনের ‘জিরবাজা’ খাবো না।

আমরা বার বার অনুরোধ করলাম, একটু খেয়ে দেখুন, অপূর্ব হয়েছে।

—আমি জানি, খেতে খুব ভালো হয়। কিন্তু আমি খাবো না, তার কারণ আছে। এই ‘জিরবাজা’ খাওয়ার জন্যে আমাকে একবার অনেক আক্কেল সেলামী দিতে হয়েছে। না, আপনারা খান, আমি খাবো না!

আমরা আর তাকে খাবার জন্যে পীড়াপীডি করলাম না। শুধু জানতে চাইলাম, কী হয়েছিলো, কী কারণে তাকে আক্কেল সেলামী দিতে হয়েছিলো।

যুবকটি বললো, আমি হলফ করেছি, ‘জিরবাজা’ কখনও খাবো না আমি। আর যদি কখনো খাই, তার আগে এবং পরে চল্লিশবার সোডা, চল্লিশবার পটাশ এবং চল্লিশবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

গৃহস্বামী হেসে বললো, এ আর এমন কি কথা, এই কে আছিস, সাহেবের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা কর।

সঙ্গে সঙ্গে নফর। চাকররা জল, সোডা, সাবান ইত্যাদি নিয়ে এলো।

আমরা অবাক হলাম। প্রথমতঃ খুব ধীর মন্থর গতিতে খাচ্ছিলো সে, এতৎসত্ত্বেও, অন্যান্য সবই খেলো, কিন্তু ঐ রাসুনের ‘জিরবাজায় হাত দিলো না। অথচ আমরা বুঝলাম, খাওয়ার লোভটা ষোল আনা আছে।

আমরা অবাক হলাম। প্রথমতঃ খুব ধীর মন্থর গতিতে খাচ্ছিলো সে, আর দ্বিতীয়তঃ তার বুড়ো আঙুলটা কাটা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হায় আল্লাহ, আপনার বুড়ো আঙুলটা কাটা কেন? না জন্মের থেকেই ঐ রকম? না কোন দুর্ঘটনা ঘটেছিলো?

যুবকটি বললে, তা এক রকম দুর্ঘটনাই বলতে পারেন? তবে কোন রকম যন্ত্রে কেটে যায়নি।

বাঁহাতটা তুলে দেখালো। দেখলাম, সে হাতের বুড়ো আঙুলটাও একই ভাবে কাটা। এরপর পা দু’খানা দেখালো সে। কি আশ্চৰ্য্য, পায়ের বুড়ো আঙুল দু’টোও কাঁটা। এইসব দেখে তখন খানাপিনা আমাদের মাথায় উঠেছে। হাঁ করে চেয়ে আছি। ওর দিকে? একজন জিজ্ঞাসা করলো, কী ব্যাপার? কী করে আপনার হাত পায়ের বুড়ো আঙুলগুলো কাটা গেছে? আর কেনইবা খানা খেতে বসার আগে এতোবার করে হাত ধুলেন। জানতে ইচ্ছে করছে। যদি আপত্তি না থাকে, বলুন।

আমার বাবা খলিফা হারুন-অল রসিদের সময় বাগদাদের এক নামজাদ সওদাগর ছিলো। সুরারসিক হিসাবে বাবার খুব নাম ডাক। দুনিয়ার যেখানে যতো সেরা সরাব তৈরি হতো, বাবা আনাতেন, এবং ইয়ার দোস্ত নিয়ে মৌজ করতেন। গান-বাজনার শখ ছিলো খুব। দেশ বিদেশের নামকরা বাঈজীরা আসতো মুজরো করতে। বাবা এসব ব্যাপারে দরাজদিলের মানুষ ছিলো। কিন্তু তার ফলে যা হয়, তার মৃত্যুর পর দেখলাম, পৰ্ব্বত-প্রমাণ ঋণের বোঝা এসে চেপেছে আমার ঘাড়ে। বাবার শেষকৃত্য সমাধা হতে না হতেই দরজায় এসে দাঁড়ালো পাওনাদাররা। আমি তাদের প্রত্যেককে বললাম, পিতৃঋণ রাখবো না। যেমন করে হোক পরিশোধ করবোই। তবে ভাই, সময় দিতে হবে। তোমরা প্রতি সপ্তাহে আসবে। ব্যবসায় যা লাভ হবে, নিয়ে যেও।

কেনা বেচার ব্যবসা শুরু করলাম। প্রতি সপ্তাহে যা লাভ হয়, খরচ খরচা বাদ দিয়ে দেনা শোধ করি। এইভাবে একদিন সব দেনা শোধ করে দিলাম। এর পর থেকে যা লাভ হতে লাগলো তা দিয়ে মূলধন বাড়িয়ে কারবারটা আরও বড় করে ফেললাম।

একদিন আমার দোকানে বসে আছি, দেখলাম জমকালো সাজে। সেজে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে একটা খচ্চরের পিঠে চেপে এসে দাঁড়ালো আমার দোকানের পাশে। খ্রিস্তার সামানু পিছনে দু’জন খোজা পাহারাদার। বাজারে ঢোকার জন্যে সে খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো। একজন খোজাকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে ঢুকতে যাবে এমন সময় খোজাটা বললো, মালকিন, বাজারের এই পথটা দিয়ে ঢুকবেন না। জায়গাটা ভালো না। কিন্তু তার কথা কানে তুললো না সে। হন হন করে ভিতরে ঢুকে গেলো। একটার পর একটা দোকান ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলো। কিন্তু কারো দোকানই আমার দোকানের মতো তেমন সাজানো গোছানো নয়। শেষে আমার দোকানোর সামনে এসে দাঁড়ালো সে। বললো, দামী দামী শাড়ি কি আছে, দেখান তো।

কি মিষ্টি কণ্ঠ। কি অপূর্ব চেহারা। চোখ ফেরানো যায় না। আমি শশব্যস্ত হয়ে দোকানের সেরা সেরা কাপড় দেখাতে থাকি। কিন্তু একটাও পছন্দ হলো না তার। বললো, আর কিছু নাই।

আমি বললাম, একটু অপেক্ষা করুন, এখুনি পাশের দোকানগুলো খুলবে। ওদের যা আছে তাও এনে দেখাবো। যদি পছন্দ হয়, নেবেন।

অন্য দোকান না খোলা পর্যন্ত আমার দোকানেই বসে রইলো সে। স্বভাবতই দুচারটে কথাবার্তাও হলো। মেয়েটি বেশ রসালো কথাবার্তা বলতে পারে।—তা মেয়েদের পোশাকের দোকান করেছেন, আর মেয়েরা কি পছন্দ করে কি চায় তা জানেন না?

আমি বিনীতভাবে বলি, জী আমার বয়স অল্প, অভিজ্ঞতা কম, পুঁজিপাটা তেমন নাই—তাছাড়া মেয়েদের সঙ্গে তো মেলামেশা করিনি কখনও, কি করে জানবো তারা কি চায়। চোখের বাণ ছুঁড়লো সে।—কেন, বিয়ে শাদী করেননি?

—জী না, তেমন সময় সুযোগ এখনও হয়ে ওঠেনি।

এই সময় পাশের দোকানগুলো খুলে গেলো। অনেক দামী দামী বাহারী শাড়ি এনে দেখলাম তাকে। তার থেকে বেছে বেছে খান কয়েক শাড়ি পছন্দ করলো সে। প্ৰায় পাঁচ হাজার দিরহাম দাম হবে। সে বললো, এগুলো বেঁধে দিন।

কাপড়গুলো বেঁধে তার খোজা নফরের হাতে দিতেই দোকান থেকে বেরিয়ে খচ্চরের পিঠে চেপে চলে গেলে সে। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। টাকার কথা বলতে পারলাম না। সেও দিলো না, বা বললো না, কবে দিয়ে যাবে। অথচ অন্য দোকানের মাল। তাদের বলে এলাম, এক সপ্তাহ বাদে টাকা দেবো।

এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। কিন্তু না এলো মেয়েটি, না পাঠালো দাম। অথচ চেহারা-চরিত্র, বেশভুষা, আদব কায়দা দেখে মনে হয়েছিলো বড়ঘরের দুলালী। কিন্তু আমার টাকাটার কি হবে? ঠিকানাপত্রও কিছু জানি না যে গিয়ে তাগাদা করবো। পাশের দোকানদাররা টাকার তাগাদ করলো। আমি আর এক সপ্তাহের সময় নিলাম।

আমার জোর বরাত, পরের সপ্তাহের শেষ দিনে সে আবার এলো আমার দোকানে। আমার হাতে একটা সোনার অলঙ্কার তুলে দিয়ে বললো, স্যাকরার কাছে এটা বেচে আপনার দামটা নিয়ে নিন। আর আমাকে আরও কয়েকটা কাপড় দেখান।

সোনার জিনিসটা বেচে আমার কাপড়ের দাম হয়ে গেলো। টাকাটা দিয়ে পাশের দোকান থেকে আরও দামী দামী কতকগুলো কাপড় এনে দেখালাম তাকে। কতগুলো শাড়ি পছন্দ করলো। দশ হাজার দিরহাম দাম হলো। কিন্তু সেদিনও সে দাম দিয়ে গেলো না। বা কবে দিয়ে যাবে তাও বলে গেলো না। আমিও বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। দাম চাইতে পারলাম না। এতো ভারি মুসকিল হলো। গতবারে ছিলো পাঁচ হাজার এবারে বাকী বেড়ে হলো দশ হাজার। আর যদি না আসে? যদি না দিয়ে যায় দাম? তাহলে? তাহলে তো দেনার দায়ে আমার দোকান-পাট লাটে উঠবো!

রাতে শুয়ে ঘুম আসে না। যদি মেয়েটা আর না আসে? গল্প কাহিনী শুনেছি, ঠগদের কত বিচিত্রভাবে প্রতারণা করার কায়দা। মেয়েটা তার সুন্দর রূপ যৌবন আর বাদশাহী চালবোল দিয়ে আমার হাতে হারিকেন ধরিয়ে গেলো না তো?

এক এক করে চার সপ্তাহ কেটে গেলো। টাকার তাগাদায় অস্থির করে তুলেছে আমাকে। আর পারা যায় না। রূপের মোহে ভুলে একি করলাম আমি। এখন আমার দোকানের মাল জলের দামে বেচে দেনাশোধ করতে হবে। এবং সেই ভাবেই নিজেকে তৈরি করছি, এমন সময় মেয়েটি একদিন এলো। আমি হাতে স্বৰ্গ পেলাম। একটা থলে আমার সামনে এনে রাখলো। বললো, দাডি-পাল্লা নিয়ে এসে। ওজন করে দেখুন, কত আছে।

হিসেব-পত্র করে দেখলাম, যা দাম তারচেয়ে বেশ বেশী আছে। আমাকে বললো, ওটা আপনার কাছে রাখুন। খুশিতে ভরে গেলো মন। আহা, এই মেয়েটাকে আমি ঠগ জোচ্চোর ভেবেছিলাম! এমন সুন্দর রূপ যৌবন—এমন নবাবী চালচলন আর কখনও দেখিনি কোন মেয়ের। বুকের মধ্যে কি যেন অভাব বোধ করতে লাগলাম। মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, বিয়ে শাদী করবেন না?

আমি বলি, তেমন ভাগ্য কি আর করে এসেছি।

—কেন, আপনার এমন সুন্দর চেহারা-মেয়েরা দেখে তো পাগল হয়ে যাবে।

কিন্তু আপনি ছাড়া কোন মেয়েই তো এমন আপন করে কথাবার্তা বলে নি কখনও!

মেয়েটি মুখ টিপে হাসলো। আমার বুকে আগুন ধরে গেলো। ওর রূপের এক দারুণ আকর্ষণ আমাকে টানতে লাগলো। নিজেকে আর বুঝি ধরে রাখতে পারি না।

দোকান ছেড়ে উঠে বাইরে এলাম। মেয়েটি বসে রইলো। ওর খোজা নফরটাকে আড়ালে ডেকে এনে এক মুঠো দিনার গুজে দিলাম ওর হাতে। বললাম, তোমার মালকিনকে আমার খুব ভালো লেগেছে। ভালোবেসে ফেলেছি। এখন তোমাকে আমার হয়ে তার কাছে মহব্বৎ জানতে হবে।

সে খুব হাসলো। বললো, আমাদের মালকিন আপনার প্রেমে মশগুল হয়ে পড়েছে! আপনাকে দেখার জনো, আপনার সঙ্গে দু’টো কথা বলার জন্যেই শুধু সে আসে আপনার কাছে। এতো যে শাড়ি কাপড় কেনা, সে সবই অছিলা। যা শাড়ি গহনা আছে তার, রোজ একখানা করে পরলে, সারা জীবনে একবারের বেশী দু’বার পরতে হবে না কোন শাড়ি। শুধু আপনাকে দেখতেই সে আসে এখানে।

আমি যখন খোজাটার সঙ্গে কথা বলছিলাম, মেয়েটি বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে গেলো একবার। একটু পরে যখন আবার দোকানে এলাম মেয়েটি হেসে জিজ্ঞেস করলো, কী শলাপরামর্শ হলো?

—শলাপরামর্শ কিছু না। আপনার নফরটাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, কোথায় থাকেন। আপনারা?

–তার জন্যে অতোগুলো পয়সা দিতে হলো?

খোজাটাকে যে বকশিস দিয়েছি, তাও ওর চোখ এড়ায়নি। আমি বললাম, ও কিছু না। ওকে একটু খুশি রাখার জন্যে দিলাম। আপনি আমার এতো বড় খদ্দের। সে যাতে অন্য দোকানের পয়সা খেয়ে ভাগিয়ে নিয়ে না যায়।

মেয়েটি এবার ভুরু কুঁচকে হাসলো।-কেন, আমি চলে গেলে আপনার খুব ক্ষতি হবে নাকি?

—ক্ষতি না হোক, লাভতো কিছু হবে না। লাভ করার জন্যেই তো দোকান সাজিয়ে বসা।

মেয়েটি এবার উঠে দাঁড়ালো।—অনেক দেরি হয়ে গেছে, আজ চলি। পরে আর একদিন আসবো।

আমি বললাম, একটা কথা বলবো বলবো করেও বলার সাহস হয়নি। আপনার খোজাকে বলেছি। আমার হয়ে সে আপনাকে বলবে। আপনি যেন তার কোন অপরাধ নেবেন না।

—ঠিক আছে। কিন্তু এমন কি কথা যা সামনাসামনি বলতে পারলেন না?

মেয়েটি আর জবাবের জন্যে দাঁড়ালো না খচ্চরের পিঠে চেপে চলে গেলো।

রোজই ভাবি, সে অথবা তার নফর আসবে। কিন্তু কেউ এলো না। কি জানি কি হলো অহরহ তার কথাই ভাবি। রাতে শুয়ে ঘুম হয় না। কিছু খেতে ভালো লাগে না। কাজ কমে মন বসতে চায় না।

আরও কয়েক দিন পরে খোজাটা এসে খবর দিলো, তার মালকিন অসুস্থ। আমি জানতে চাইলাম, কিন্তু তোমার এই মালকিনিটি কে?

-খলিফা হারুন-অল-রাসিদের পেয়ারের বেগম জুবেদার পালিত কন্যা সে। বেগমসাহেবা তাকে দত্তক নিয়ে মানুষ করেছে। বড়, আদরের দুলালী। তার কোন আদর আব্দারই এড়াতে পারে না। কিছুদিন আগে সে তার মাকে বলেছিলো, মা, এইভাবে এক-একা ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতে আর ভালো লাগছে না, তুমি যদি মত করো। তবে খোজাদের নিয়ে একটু বাইরে বেরিয়ে আসতে পারি।’ বেগমসাহেবা মেয়ের কথা ঠেলতে পারেনি। প্রথম দিন বাজারে এসে আপনার কাছ থেকে পোশাক আশাক কেনাকাটা করে নিয়ে গেলো। মা মেয়ের পছন্দসই সওদা দেখে খুব খুশি হলো। তারপর থেকে বাইরে বেরুনোর আর কোন বাধা রইলো না। কয়েকদিন আগে শাহজাদী বেগমসাহেবকে তার মনের ইচ্ছার কথা বলেছে। আপনাকে দেখে তার খুব পছন্দ হয়েছে জেনে বেগমসাহেবা বলেছে, আমি নিজে ছেলেকে দেখবো। আগে-আমার যদি পছন্দ হয় তবেই শাদী দিয়ে দেবো। এখন সাহেব, আপনি বলুন, বেগমসাহেবার সঙ্গে দেখা করতে চান কিনা?

আমি বললাম, আমি তো পা বাড়িয়েই আছি। এখন বলো, কিভাবে, কবে, কোথায় তার সঙ্গে দেখা হতে পারে।

খোজা বললো, আজি সন্ধ্যায় আপনি টাইগ্রীসের ধারে বেগম জুবেদা সাহেবার যে বড় মসজিদ। —ওখানে নামাজ পড়তে যাবেন। নামাজ শেষ করে ওখানেই গুয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। তারপর যা করার আমি করবো।

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললাম, ঠিক আছে।

খোজা বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।

সন্ধ্যাবেলায় টাইগ্ৰীসের উপকূলের সেই মসজিদে গেলাম নামাজ পড়তে। নামাজ শেষ করে রাতের মতো। ওখানেই শুয়ে পড়লাম। ভোর হতে দেখি একটা ছোট্ট পানসি নৌক এসে ভিড়লো মসজিদের ঘাটে। বাক্স আর খোজা ক্রীতদাসে ভর্তি নৌকা থেকে কয়েকটা বাক্স নামানো হলো ঘাটে। ক্রীতদাসেরা সেগুলো নিয়ে গিয়ে রাখলো মসজিদের এক পাশে। একটু পরে দেখলাম, আমার পরিচিত সেই খোজা এবং তার পাশে আমার মানসী সেই শাহজাদী। আমার পাশে বসলো। তার ফন্দী মতলব সব বুঝিয়ে বললে আমাকে। তারপর আদর করলো অনেক। অনেকক্ষণ ধরে। পরে বললো, এবার তোমাকে বাক্সে পুরে তালা বন্ধ করে নিয়ে যাবো।

আমি বাক্সের ভিতরে গিয়ে বসলাম। আমাকে তালা বন্ধ করে নৌকায় নিয়ে গিয়ে তুললো খোজা। আবার যখন বাক্স খুলে বার করা হলো, দেখলাম, আমি এসে পড়েছি প্রাসাদের হারেমে। দামী পোশাক আশাক এনে দিলো সেই খোজা। নতুন সাজে সাজিলাম। একটা সোফায় বসানো হলে আমাকে। এমন সময় ঘন্টা বেজে উঠলো। দেখলাম, হারেমের কুড়িজন ক্রীতদাসী দুটি সারিতে ভাগ হয়ে মাথা হোঁট করে দাঁড়িয়ে পড়লো। সবারই বয়স কুড়ির কাছাকাছি। সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী। ক্ষীণ কটি উন্নত বক্ষা।

দুই সারি ক্রীতদাসীদের মাঝখান দিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলো বেগম জুবেদা। চোখ ঝলসানো সাজপোশাক-এ সজ্জিতা। রত্নালঙ্কারের ভারে নুয়ে পড়েছে তার দেহ।

আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার কাছে এসে ইশারায় বসতে বললে আমাকে। তারপর আমার নাম, ধাম, বংশগোত্র, পেশা সব এক এক করে জেনে নিলো। আমার জবাবে খুশি হলো সে। বললো, তাহলে আর সময় নষ্ট করে লাভ নাই। দশ দিনের মধ্যে শাদীর সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলবো।

তারপর আমার দিকে চেয়ে জুবেদা বললো, শোনো, সাহেব, মেয়ে আবার বড় আদরের দুলালী। তোমার সঙ্গে তার শাদী দেবো। কিন্তু একটা কথা, তাকে কোন কষ্টদিও না। সে আমি সহ্য করতে পারবো না। দশ দিন পরে তোমাদের শাদী হবে। এই দশ দিন তুমি এই প্রাসাদেই থাকবে। দশ দিন ধরে প্রাসাদের এক মনোরম কক্ষে আরামেই কাটালাম। এর মধ্যে আমার মানসীর সঙ্গে দেখা হলো না একবারও। কিন্তু পরিচারিকারা আমার দেখাশুনা করতো। তাদের মারফতে সব খবরাখবর পেতে থাকলাম।

জুবেদা খলিফার সম্মতি পেলো। তিনি যৌতুক হিসাবে দশ হাজার সোনার মোহর পাঠালেন আমাকে। জুবেদা দিলো পঞ্চশ হাজার দিনার। কাজী এবং সাক্ষী এলো। শাদীর কবুলনামা লেখা হলো। সারা প্রাসাদ আনন্দ মুখর হয়ে উঠলো। শাহজাদীর সঙ্গে শাদী হয়ে গেলো আমার।

উজির আমির ওমরাহরা সবাই আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলো সেদিন। প্রকাণ্ড সামিয়ানায় খানাপিনার সে কি বিরাট আয়োজন। এরে আগে কখনও চোখে দেখিনি। কত সব সুন্দর সুন্দর খাবার, বিরিয়ানী, মাংস, চাপ, হালওয়া, ফল, মিষ্টি, সরবৎ-এলাহী ব্যাপার। আমিও ওদের পাশে বসে খেলাম। নানারকম খানার মধ্যে আমার অত্যন্ত প্রিয় জিরাবাজা দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। খেলাম খুব তৃপ্তি করে। বোধ হয় লোভে লোভে বেশ কিছুটা বেশীই খেয়ে ফেলেছিলাম। খানাপিনা শেষ করে রুমালেই হাতটা পুছে ফেললাম। এতো খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো যে, উঠে গিয়ে হাত মুখ ধোয়ার কষ্টটা আর স্বীকার করতে মন চাইলো না তখন।

তারপর জনানারা আমাদের নিয়ে কী সব স্ত্রী আচার করল আনন্দ করে। তারপর নিয়ে যাওয়া হল ফুলশয্যার সজ্জিত ৰাসর ঘরে।

একদল পরিচারিকা আমার সদ্য শাদী করা বিবিকে নিয়ে এল। প্রচলিত প্রথানুযায়ী তাকে একেবারে বিবস্ত্র করা হল। সবার সামনে তার শরীরের যৌবনচিহ্নগুলিকে আমার কাছে তুলে ধরাতে সে যেন শরমে মরে যাচ্ছিল। তার গালদুটো হঠাৎ পাকা আপেলের মত লাল হয়ে উঠল। সে হাত দুটো দিয়ে নিজের শরীরের গােপন জায়গাগুলিকে চাপা দেওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বরাত ভাল যে, পরিচারিকারা তাকে উলঙ্গ অবস্থায় পালঙ্কে শুইয়ে দিয়ে বাসরঘর ছেড়ে গেল।

আমি আর আমার মন-ময়ূরী বিবি ছাড়া ঘরে তৃতীয় কোন প্রাণী নেই। আমরা পাশাপাশি গা-ঘেঁষাঘেঁষী করে শুয়ে। আমি এক ঝটকায় তার যৌবনের জোয়ার লাগা বিবস্ত্র দেহটিকে বুকে টেনে নিলাম। ব্যস, শরীরের সর্বশক্তি নিয়োেগ করে অকস্মাৎ সে আমাকে একটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। বিকট আর্তনাদ বেরিয়ে এল – মরে গেলাম। মেরে ফেলল। কী উৎকট গন্ধ। আর পারছিনা — মরে গেলাম।

আমি ব্যস্ত হয়ে বল্লাম-কি? কি হ’ল মেহবুবা?”

রসুন! জঙ্গলীটি রসুন খেয়ে এসেছে। কী উৎকট গন্ধ গা বমি বমি করছে আমার। আজ-জঙ্গলী-বনমানুষকে আমি শাদী করে জীবনসঙ্গী করেছি। আমি ঘূণাক্ষরেও জানতে পারি নি অসভ্য জঙ্গলীটি এমন করে রসুনের ভক্ত। হতচ্ছাড়াটি ভুলেও আগে বলে নি তার এ কু-অভ্যাসের কথা।

আমি তাকে প্রবােধ দিতে গিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলাম। থামিয়ে দিয়ে সে খেকিয়ে উঠল–‘একটি কথাও বােলােনা। রসুন যদি খেয়েই থাক তবে কেন গরম পানি দিয়ে ভাল করে হাত মুখ ধােও নি?’ কথা বলতে বলতে সে রুমালে মুখ ঢেকে ডুকরে ডুকরে কাদতে লাগল।

রাগে গরগর করতে করতে ঘরের এক পাশ থেকে একখানা বেতের চাবুক এনে সপাংসপাং করে এলোপাথাড়ী পেটাতে লাগলো আমাকে। যন্ত্রণায় ছটফট করে পালাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। চাবুকের একটাবাড়ি এসে লাগলো আমার দুই জঙ্ঘার মাঝখানে। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গালিচার উপর লুটিয়ে পড়ে গেলাম।

অনেকবাদে জ্ঞান হলো আমার। চোখ খুলে দেখলাম, শাহজাদী তখন চাবুক হাতে পালঙ্কে বসে রয়েছে। একেবারে রণরঙ্গিণী মূর্তি। চারপাশে ক্রীতদাসীরা ঘিরে আছে আমাকে। শাহজাদী হুকুম করলো, ওকে নিয়ে যাও। কোটালের হাতে তুলে দিয়ে বলো, লোকটা রসুন খেয়ে হাত সাফা করেনি। আমার নাকে গন্ধ লেগেছে। কোটাল শোন ওর হাতখানা– যে হাত দিয়ে ও ‘জিরাবাজা’ খেয়েছিলো কেটে ফেলো।

শাহজাদীর রায় শুনে তখন আমার বুকে কাঁপুনি ধরে গেলো। শাহজাদীর সহচরীরা আমার ওপর দয়াপরবশ হয়েই বোধহয়, অনুরোধ জানাতে লাগলো, এবারের মতো। ওঁকে মাফ করে দিন! এবার তো প্রথমবার। পরে আবার যদি কখনও এমন হয়, তখন যা খুশি সাজা দেবেন।

আমার তো আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। এতো লঘু দোষে এমন গুরু দণ্ড? ‘জিরাবাজা’ খেয়ে হাত না ধোয়ার জন্যে এই সাজা?

শাহজাদী বললো, ঠিক আছে, তোমরা যখন বলছে এবারের মতো। ওর হাতখানা না হয় কাটবো না। কিন্তু তা বলে বেকসুর ছেড়ে দিতে পারবো না। এমন একটা চিহ্ন করে দেবো যার ভয়ে, বাছাধন আর জীবনে ‘জিরবাজা’ খেতে চাইবে না।

এই বলে সহচর দাসীদের সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। শাদীর প্রথম রাতে, বাসর শয্যায় আমি পড়ে রইলাম একা।

দশদিন পরে ফিরে এলো আমার কাছে। সঙ্গে সহচরী ও দাসীবৃন্দ। তর্জনী নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে লাগলো, কি, কেমন? আর জিরাবাজা’ খাবে কখনও? দাঁড়াও, আজ তোমাকে এমন শিক্ষা দেবো যাতে আর রসুনে কখনও হাত না ঠেকাও।

তারপরইশারা করতেই ক্রীতদাসীরা আমাকে জাপটে ধরে জোর করে গালিচার উপর শুইয়ে ফেললো। শাহজাদী হুকুম করলো, রসি দিয়ে হাত পা বেঁধে ফেলো ওর।

আমার হাত পা বাঁধা হলো। একজন একখানা চকচকে ধারালো ছুরি দিয়ে আমার হাতের আর পায়ের বুড়ো আঙুলগুলো কেটে ফেললো। তাই আপনারা আজ আমাকে এইরকম দেখছেন।

আমি সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। সে আমার ক্ষতস্থানে রক্ত বন্ধ করার ঔষুধপত্র লাগিয়ে বেঁধে দিয়েছিলো। যখন জ্ঞান ফিরে এলো আমি চিৎকার করে উঠলাম, আল্লাহ সাক্ষী আর কখনও ‘জিরবাজা’ খাবো না। আর যদি কখনও খাই, খাওয়ার আগে এবং পরে চল্লিশবার সোডা, চল্লিশবার পটাশ আর চল্লিশবার সাবান দিয়ে হাত সাফ করবো।

সুতরাং বন্ধুগণ, আপনারা আমার অপরাধ নেবেন না।

আপনারা যখন আমাকে বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন, আমি তখন খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ আমি তার কাছে হলফ করেছি। যদিও আজ সে বেঁচে নাই, তবু আল্লাহর নামে কসম খেয়েছি-আমি ও জিনিস আর মুখে তুলবো না। এই জিরাবাজার’ জন্যে আমার বুড়ো আঙ্গুলগুলো হারিয়েছি একদিন।

বাবুর্চি বলতে থাকে, শুনুন জাঁহাপনা, এরপর সেই বাগদাদের তরুণ সওদাগরকে প্রশ্ন করলাম, এর পর আপনার বিবির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কিরকম রইলো?

যুবকটি বললে, আমি যখন আল্লাহর নামে দিব্যি করলাম, আর কখনও জিরাবাজা’ খাবো না, তখন সে বেশ নরম হলো। আমাকে ক্ষমার চোখে মেনে নিলো। এর পর আমরা একসঙ্গে সহবাস করেছি। অনেক দিন-রজনী।

এইভাবে প্রাসাদ পরিবেশে কাটলো বহুদিন। শাহজাদী—আমার বিবি বললো, এখানে তো অনেকদিন কটালে। ঘরজামাই হয়ে থাকবে নাকি চিরকাল? তার চেয়ে বাইরে কোথাও একটা ইমারাৎ কিনে নাও। আমি টাকা দিচ্ছি।

পঞ্চশ হাজার সোনার মোহর দিয়ে একটা বিরাটবাড়ি কিনলাম। শাহজাদীর ব্যক্তিগত ব্যবহারের সামানপত্র এবং তার যাবতীয় বিষয়সম্পদ নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে। সুচারু সুন্দর করে সাজালাম সারা বাড়িটা। কিন্তু এত সুখ আমার কপালে সইলো না। বছর না ঘুরতেই সে মারা গেলো। শোকে দুঃখে ভেঙে পড়লাম। উদাসী মন বিবাগী হলো।বাড়ি ঘরদোর, বিষয় সম্পত্তি সব বেচে দিয়ে একদিন পথে বেরিয়ে পড়লাম। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। কোথাও মন টিকে না। অবশেষে সুদূর পরবাসে আপনাদের এই দেশে এসে বাসা বেঁধেছি। আল্লাহ জানেন, এখানেই বা কতদিন থাকবো।

জাঁহাপনা, বাবুর্চি বললো, এই হলো সেই বাগদাদের তরুণ সওদাগরের কাহিনী। এর পর সেই নিমন্ত্রণবাড়ি থেকে বেরিয়ে সবাই যে যার ঘরের দিকে চললাম। আমি ফিরে গেলাম আমার বাড়ি। রাত্রি তখন দ্বিতীয় প্রহর পার হয়ে গেছে। তারপর এই কুঁজোটার মরা লাশ নিয়ে যা যাকাণ্ড ঘটে গেছে সে তো আপনার সবই জানা।

চীনের বাদশাহ গভীর মুখে বললো, হুম, তোমার গল্প কিন্তু এমন কিছু আহা মারি নয় হে, বাপু। এর চেয়ে এই কুঁজোর মরার ব্যাপারটা আরও অনেক বেশী অদ্ভুত। তোমাদের দু’জনের কারো কাহিনীই আমাকে অবাক করতে পারেনি। কিন্তু কুঁজোর মরার ঘটনা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেছি! সুতরাং তোমাদের কারো নিস্কৃতি নাই। সবাইকে ফাঁসীতে ঝুলাবো।

Leave a Reply