উজির জাফর খলিফা হারুণ-অল রসিদ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে উজির সামস-অল-দিন ও নূর-অল-দিন এর কিসসা শুরু করতে গিয়ে বললেন—জাহাপনা, কোন এক সময় মিশরে মহাধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ এক সুলতান রাজত্ব করতেন। তার বৃদ্ধ উজির ছিলেন একজন যথার্থই জ্ঞানী, বিভিন্ন বিষয়ে তার পারদর্শিতা ছিল অনন্য।
উজির সাহেবের দুই যমজ পুত্র ছিল। তাদের একজনের নাম ছিল সামস-অল-দিন আর দ্বিতীয় জন ছিল নুর-অল-দিন। তাদের রূপ ছিল অসাধারণ। চোখ ফেরানাে দায়। যেন তারা বেহেস্তের দূত।
মর্তে নেমে এসেছে আদমির সুরত নিয়ে। এক সময় বৃদ্ধ উজির দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। সুলতান দুই ভাইয়াকে উজিরের পদে বহাল করলেন।
সকালে দু ভাইয়া দরবারে যাবার পথে পরস্পরের মধ্যে আলাপ করছিল। বড় ভাইয়া বলল-“আমাদের বয়স হয়েছে। এখন আমাদের শাদী করে বিবি ঘরে আনা দরকার। আর মিছে দেরি করলে গুড়া বাচ্চাদের মানুষ করে যেতে পারব না। বিদ্যাশিক্ষা, নােকরি আর শাদী দিয়ে ঘর-সংসার পেতে দিয়ে যেতে পারব না।
-শাদী? তােমার মর্জি মাফিকই কাজ হবে।
-শাদীর পর তাে এমনও হতে পারে ভাইয়া, আমার লেড়কি হ’ল আর তােমার হ’ল লেড়কা। তখন তাে আমার লেড়কির সঙ্গে তােমার লেড়কার শাদী দিতে হবে, তখন?
—“আমার লেড়কাকে তােমার লেড়কির জন্য তবে কত সােনার দিনার দিতে হবে?
‘আমি আগেই ঠিক করে রেখেছি পুরাে তিন হাজার সােনার দিনার আমি তােমার লেড়কার কাছ থেকে নেব। তিনটি বড় গাঁও জায়গীর আর তিনটি খামারও দাবী করব আমি। সাফ কথা শােন, তােমার লেড়কা যদি এতে রাজি না হয় তবে আর আমাদের মিছে কথাকাটাকাটি করে লাভ নেই। প্রসঙ্গটি এখানেই চাপা দিয়ে দেওয়া ভাল।’
-“ভাইয়া, তুমি মিছেই তিক্ততা সৃষ্টি করতে চাইছ। ও ভাইয়া আর বহিন মিলে ঘর বাঁধবে এতে আবার দিনারের কচকচানি আসে কি করে, বুঝছি না তাে।
-“তা হােক গে, আগে দেনা-পাওনার ব্যাপারটিরই ফয়সালা হয়ে যাওয়া উচিত। ঠিক আছে, আমি কসম খাচ্ছি তােমার লেড়কার সঙ্গে আমার লেড়কির শাদী দেব না। কিছুতেই দেব না। আমার লেড়কি টাইগ্রিসের জলে ভেসে আসবে নাকি?’ রাগে গস গস্ করতে করতে সামস-অল-দিন বলল। বড় ভাইয়ার আচরণে নুর-অল-দিনও রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। সে-ও রীতিমত উত্তেজিত স্বরেই বড় ভাইয়ার উদ্দেশ্যে কথাটি ছুড়ে দিল—“আরে রামরাম। আমার ছেলেও রূপেণ্ডণে সবার সেরাই হবে। তখন তােমার মত কত মেয়ের বাপ পিছন পিছন ঘুর ঘুর করবে, দেখে নিও। এখন ব্যাপারটি চাপা দাও।
বড় ভাইয়া বলল—“তাের দেমাক দেখে অবাক হচ্ছি। ঠিক আছে, কাল সুবহে তাে আমি সুলতানের সঙ্গে বেরােচ্ছি, তখন আমি তাের ঔদ্ধত্য ও কার্পণ্যের কথা সুলতানের কানে তুলবই। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
পরদিন ভােরে নবাব উজির সামস-অল দিনকে নিয়ে নীল নদের তীরে এলেন। পালকী চেপে ভ্রমণ শুরু করলেন। গিজায় পিরামিড দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা। এদিকে বড় ভাইয়ার আচরণে নূর-অল-দিন খুবই ক্ষুব্ধ হ’ল। মনস্থ করল, এ-সুলতানিয়তেই আর থাকবে না। অন্যত্র গিয়ে নােকরি জোগাড় করে নেবে। সে নােকরকে দিয়ে নিজের ছাই রঙের খচ্চরটি তৈরী করিয়ে নিল।
নােকরটি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল—“হুজুর, আপনার আদেশ আমি এক্ষুণি পালন করছি। কিন্তু কোথায় যাবেন, মেহেরবানি করে এ-অধমটির কাছে বলবেন কি?
—“কোথায় যে যাব তা আমিও ঠিক জানি না। তবে সবার আগে কালিব নগরে যাব। সেখানে দু’তিন দিন থাকার পর যেদিকে দু’চোখ যায় খচ্চরটিকে নিয়ে যাত্রা করব। মিছে আমার পাত্তা জানার চেষ্টা করিস নে। এ-স্বার্থপর, হিংসা, দ্বেষ আর রেষারেষির মধ্যে আমার আর এক মুহূর্তও থাকার ইচ্ছে নেই।’
নূর-অল-দিন তার বাহন ছাই রঙের খচ্চরটির পিঠে চেপে অজানা উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। দুপুরের দিকে বুলবেশানগরে হাজির হ’ল। ইতিমধ্যেই কায়রাে নগর পেরিয়ে এসেছে। একটি সরাইখানার দরজায় খচ্চরটিকে ছেড়ে দিয়ে খাওয়া দাওয়া করার জন্য ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর অত্যাবশ্যকীয় কিছু সামগ্রী -কেনাকাটা সেরে আবার খচ্চরের পিঠে চেপে বসল। এবার হাজির হ’ল জেরুজালেম নগরে। নূর-অল-দিন পথশ্রমে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বিশ্রাম না নিলে আর চলছে না। খচ্চরটির পিঠ থেকে গালিচা আর কম্বল নামিয়ে তাকে চরতে দিল। কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের ঘােরে তার
বড় ভাইয়াকে খােয়াবের মধ্যে দেখল। তারা দুজনে গলা ছেড়ে ঝগড়া করছে দেখল। আচমকা তার ঘুম ভেঙে গেল। হুড়মুড় করে উঠে বসল। তার মন-প্রাণ অস্বাভাবিক বিষিয়ে উঠল। সে বড় ভাইয়া আত্মীয় কুটুম্বদের ছেড়ে এসেছে বটে কিন্তু তাদের চিন্তা তার মাথা থেকে কিছুতেই নামছে না দেখে যারপর নাই বিস্মিত হ’ল।
সকাল হ’ল। নুর-অল-দিন আবার গাধার পিঠে চাপল। সন্ধ্যার কিছু আগে আলেপ্পো নগরে গাধা দাঁড় করাল, একটি সরাইখানার সামনে গাধাটিকে বেঁধে সে ভেতরে ঢুকে গেল। খানাপিনা সেরে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম থেকে উঠে জায়গাটিকে ঘুরে ঘুরে দেখল। খুবই ভাল জায়গা। মনে ধরে গেল।
দুপুরের কিছু আগে আবার সে যাত্রা শুরু করল। কোথায় যাচ্ছে, কোথায় গিয়ে নামবে একমাত্র আল্লাহ-ই জানেন। সংসারের স্বার্থপরতা দ্বেষ আর হানাহানি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসে আজ সে যাযাবর জীবন সম্বল করেছে। পথই আজ তার একমাত্র অবলম্বন। এবার সে সুবিখ্যাত নগর ও বন্দর বসরাহতে পৌছল। স্থানীয় ও বহিরাগত বহু সওদাগর প্রতিদিন এখানে জড়াে হয়, দ্রব্যসামগ্রী কেনা বেচা করে।
নূর-অল-দিন একটি ছােট্ট সরাইখানায় ঢুকে খানাপিনা সারল। সরাইখানার মালিক খানসাহেবের এক কর্মচারীকে নিয়ে সে এবার নগর পরিভ্রমণে বেরল। পাহাড়ী পথ ঘন ঘন চড়াই-উত্রাই। অনভ্যস্ত পা দুটো সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। নগরের কেন্দ্রস্থল অসমতল হলেও খুব বেশী উঁচু-নিচু নয়।
নুর-অল-দিন খচ্চরটির পিঠে চড়ে বসরাহ নগর দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল। সরাইখানার বালক কর্মীটি পাশে পাশে পায়ে হেঁটে চলেছে। বসরাহ-র উজির নিজের বাড়ির জানালা দিয়ে শহরের শােভা দেখছেন। অকস্মাৎ সুদর্শন যুবক নূর-অল-দিনকে দেখে তার রূপে মুগ্ধ হলেন। এক নােকরকে বললেন—এক ছুটে দেখে আয় তাে খচ্চরটির পিঠে কে যাচ্ছে? আর সঙ্গের ওই লেড়কাটিকে ডেকে নিয়ে আসবি।’
সরাই-বালকটি এলে উজির নুর-অল-দিন-এর পরিচয় জানতে চাইলেন! সে কিছুই বলতে পারল না। তবে খানসাহেবের সরাইখানায় আজই প্রথম এসেছেন, তার সঙ্গের সমানপত্তর বহুমূল্যবান। নবাব, বাদশাহ বা সুলতানই কেবল সেগুলাে ব্যবহার করতে পারেন।
উজির খানসাহেবের সরাইখানার ঠিকানাটি নিয়ে সরাইবালকটিকে বিদায় দিলেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই উজির সরাইখানায় এসে খানসাহেবের সঙ্গে মােলাকাৎ করলেন। উজিরের আগ্রহে খানসাহেব অতিথি নূর-অল-দিন’কে ডেকে আনলেন।
নূর-অল-দিন উজিরকে অভ্যর্থনা করে ঘােড়া থেকে নামিয়ে সরাইখানায় নিয়ে গেল। একটি ছােট্ট খাটিয়া পেতে বসতে দিল।
কথা প্রসঙ্গে উজির বললেন—সে কী বাছা! তুমি আমাদের দেশের মেহমান। আর তুমি কিনা এরকম একটি ভাঙাচোরা সরাইখানায় পড়ে থাকবে, হতেই পারে না, আমার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করবে চল। তােমার কোন আপত্তিই শুনব না।
নূর-আল-দিন বহুভাবে আপত্তি করল। ধােপে টিকল না। অনন্যোপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত উজিরের বাড়িতে তাকে আতিথ্য গ্রহণ করতেই হল।
খানাপিনা সেরে গল্প করতে বসে প্রসঙ্গক্রমে উজির তাকে বলল—“বাছা, তােমার মনের কথা খােলসা করে বল তাে—এত পথ পাড়ি দিয়ে তুমি আমাদের দেশ এ বসরাই নগরে এলে কেন? নিছকই দেশভ্রমণের তাগিদে, নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে?
—না কোন বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এখানে অবশ্যই আসিনি। নিছকই ঘুরে ঘুরে দেশ দেখতে দেখতে এখানে এসে পড়েছি! মিশরের সুলতানের উজির ছিলেন আমার আব্বাজী। তিনি বেহেস্তে গেলে আমরা দু’যমজ ভাই উজিরের পদে বহাল হই। কিন্তু সংসারের স্বার্থপরতা, লােভ, নীচমনােবৃত্তি প্রভৃতি দেখে বিতৃষ্ণায় আমার মন-প্রাণ বিষিয়ে ওঠে। ভাবলাম কি, এ জায়গা তাে আমার জন্য নয়। চারদিকে স্বার্থপর মানুষের ভিড়ে আমার প্রাণ তাে ওষ্ঠাগত হয়ে উঠছে। বিরক্ত হয়ে খচ্চরটিকে নিয়ে হারা উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরে ঘুরে নিত্য নতুন দেশ দেখে বেড়াব, এই তাে চাই। ব্যস, একদিন সত্যি সত্যি কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেলাম।
নূর-অল-দিন-এর যুবক বয়সেই ঘর-সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা জেগেছে দেখে উজির সবিনয়ে বলেন-…এ কী কথা ! আজ বয়স কম, রঙিন স্বপ্নে মসগুল হয়ে পড়েছ। কিন্তু চিরদিন তাে আর এমনােভাব স্থায়ী হবে না। তারপর একদিন দেহের তাকতও কমতে থাকবে। পথ চলার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে। তখন কিন্তু তােমার নিজের দেহকেই এক বাড়তি বােঝা বলে মনে হবে, জেনে রাখ। তুমি সুন্দরের পিয়াসী, খুবই সত্য। কিন্তু এ-সুন্দরকে তাে চিরদিন সুন্দর বলে মনে হবে না। বিতৃষ্ণা জন্মাবে। তামাম দুনিয়া ছুঁড়ে কুঁড়ে না বেড়িয়ে এক জায়গায় বসেই সব সৌন্দর্যকে উপভােগ করা সম্ভব। বৃদ্ধ উজির খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি। অমিত বুদ্ধির আধার। এমন সুদর্শন এক যুবককে পেয়ে তার মনে অদম্য উৎসাহ জাগল। মনস্থির করে ফেললেন, নিজের লেড়কিকে এর হাতে তুলে দেবেন। শাদী দিয়ে সুলতানকে অনুরােধ করে শেষে দরবারে একটি নোকরি জোগাড় করে দেবেন।
উজির নিজের প্রাসাদের সুসজ্জিত কক্ষে মেহমান নূর-অল-দিনের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এক সকালে বৃদ্ধ উজির নুর-অল-দিনকে বলেন—“বাছা, বুড়াে হয়েছি। আর নােকরি করার মন নেই, তাই উজিরের পদ খেকে এবার বিদায় নেব ভাবছি। সুলতানকে বলে আমার পদে তোকে নিয়ােগ করার ব্যবস্থা করব। তার আগে আমার বেটির সাথে তােমার শাদীর ব্যাপারটি মিটিয়ে নিতে চাই। আমার বেটিকে তো দেখেছই। সে যে খুবসুরৎ তা আমি নিজমুখে না-ই বা বল্লাম বিচারের ভার আমি তােমার হাতেই দিচ্ছি। তারপর যদি মন চায় আমার বেটিকে শাদী করে তােমার জীবন-সঙ্গিনী করে দিতে পরবে।
কথাটি শুনে নুর-অল-দিন-এর খুবই শরম হ’ল! শির নিচু করে দাড়িয়ে রইল। এক সময় সঙ্কোচে লজ্জাতুর কণ্ঠে বলল—এতে এ আর কি বলার থাকতে পারে? আপনি ভাল বুঝে যা হয় করুন।
নূর-অল-দিন -এর সম্মতি পেয়ে বৃদ্ধ উজিরের মনে আনন্দ আর ধরে না। খুশীতে একেবারে ডগমগ। প্রাসাদের অন্দর মহলেও খুশীর জোয়ার বয়ে চলল।
উজির খুবই জাঁকজমকের সঙ্গে তার বেটির শাদীর আয়ােজন করলেন। আত্মীয়-বন্ধুরা কবজী ডুবিয়ে খানাপিনা করল। দামী সরাবের বন্যা বয়ে চলল।
নিমন্ত্রিত মেহমানরা বিদায় নিলে উজির নূর-অল-দীনকে হামামে পাঠালেন। সঙ্গে দুজন নফর গেল। হামামে যাওয়ার ব্যাপারটি সে দেশের প্রচলিত প্রথা। জামাতা বাবাজীকে হামাম থেকে গােসল সেরে বেরিয়ে লেড়কির আব্বাজীর হাত থেকে নতুন পােশাক পরতে হয়। তারপর সুসজ্জিত থচ্চরের পিঠে চেপে নগর পরিভ্রমণে বেরােবেন।
নুর-অল-দীন খচ্চরের পিঠে চেপে নগর পরিভ্রমণ করে ফিরে এল। উজির অপেক্ষা করছেন। জামাতা বাবাজীকে অভ্যর্থনা করে মহলে নিয়ে গেলেন।
বেগম শাহরাজাদ দেখলেন ভােরের আলাে ফুটতে আর বিলম্ব নেই এবার কিসসা বন্ধ করলেন।
রাত্রে আবার বাদশাহ শারিয়ার এলেন। বেগম শাহরাজাদ ‘ শুরু করলেন—জাহাপনা, সে উজির তার জামাতা নূর-অল-দিনকে অভ্যর্থনা করে অন্দরমহলে নিয়ে ফুলমালায় সুসোভিত একটি ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
নূর-অল-দিন দেখল তার বিবি সােনার জরিবুটি দেওয়া পােশাক পরে সুসজ্জিত পালঙ্কের ওপর অপেক্ষা করছে।
আজ তার জীবনে সবচেয়ে মধুর রাত্রি। সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত। আজই প্রথম চরম আনন্দের স্বাদলাভে জীবন ধন্য হবে। নূর-অল-দীন সদ্য শাদীকরা বিবিকে পাশে বসিয়ে দেশবিদেশের বহু চটকদার গল্প শােনাল।
রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর। নূর-অল-দিন তার বিবিকে বুকে টেনে নল। একে অন্যের মধ্যে নিঃশেষে বিলীন হয়ে গেল। একে অন্যের দেহের সকল অঙ্গের সাথে পরিচিত হল। নেড়ে চেড়ে দেখল। দুদেহ মিলে এক ও অভিন্ন। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যের অস্তিত্বের কথা কল্পনাও করা যায় না।
ছােট ভাইয়া নূর-অল-দীন যখন সদ্যবিবাহিতা বিবিকে নিয়ে আনন্দে মসগুল হয়ে দিন কাটাচ্ছে তখন তার বড় ভাইয়া সামস-অল-দীন সুলতানের সঙ্গে গীজের পিরামিড দেখে বাড়ি ফিরল। দেখে, নূর-অল-দীন বাড়িতে অনুপস্থিত।
নফবের মুখে সামস-অল-দীন শুনল, কদিন আগে তার ছােট ভাইয়া খচ্চরের পিঠে চেপে কোথায় গেছে। ব্যস আর বাড়ি ফেরে নি। কোথায় গেছে, কবে ফিরবে কিছুই নাকি বলে যায় নি।
সামস-অল-দীন ছােট ভাইয়ার শােকে মুহ্যমান হয়ে পড়ল। তার বুঝতে কিন্তু বাকি রইল না যে, রাগের মাথায় সেদিন যেসব অসঙ্গত কথা বলেছে তারই ফলে তার ভাইয়া ঘর-সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেছে। নিজের কাজের জন্য খুবই মর্মাহত হ’ল সে।
উপায়ন্তর না দেখে সামস-অল-দীন সুলতানের কাছে সবকিছু খােলসা করে বললেন, সুলতান ব্যাপারটিতে মনে খুবই ব্যথা পলেন।
ব্যথিত মর্মাহত সুলতান বহু দেশের দরবারে দূত পাঠিয়ে নুর-অল-দীন-এর খবরাখবর নিতে লাগলেন। বৃথা চেষ্টা। দূতরা এক এক করে খালি হাতে ফিরে এল। দূতদের কেউ-ই কিন্তু বসুরাহ রাজ্যে যায় নি। কেন যে তারা একটিমাত্র রাজ্য বাদ দিল এ নিয়ে কারাে মনেই কোন সন্দেহের উদ্রেক হয় নি।
ছােট ভাইয়ার খোঁজ না পেয়ে সামস-অল-দীন বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল। একমাত্র নিজের দোষেই সে তার প্রাণপ্রতী ভাইকে হারিয়েছেন। তার শােক ক্রমে মন থেকে মুছে যেতে যেতে এক সময় একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। স্বাভাবিকতা ফিরে পেল।
সামস-অল-দীন বিয়ে শাদী করে ঘর বাঁধল। তার জীবনে আবার হাসি আনন্দের জোয়ার নেমে এল।
আল্লাহর মর্জি মানুষের বুঝা ভার। তা নইলে ছােট ভাইয়া নূর-উল-দীন-এর শাদীর রাতেই বড় ভাইয়া সামস-অল-দীন-এর বিয়ে কি করে সম্ভব হল? আরও আছে নূর-অল-দীন-এর বিবি যে-রাত্রে অন্তঃসত্ত্বা হ’ল সে রাত্রেই সামস-অল-দীন-এর বিবিও গর্ভে সন্তান ধারণ করল! আশ্চর্য ব্যাপার নয় কি? একমাত্র আল্লাহ খেয়ালের ফলেই এমনটি সম্ভব হতে পারে।
নূর-অল-দীন-এর শাদীর ব্যাপার স্যাপার মিটে গেলে বৃদ্ধ উজির তাকে নিয়ে সুলতানের দরবারে হাজির হলেন। সুদর্শন নূর-অল-দীন’কে প্রথম দর্শনেই সুলতানের মধ্যে স্নেহের উদ্রেক ঘটল বৃদ্ধ উজির প্রস্তাব দেওয়া মাত্রই তিনি তাকে উজিরের পদে বহাল করতে সম্মত হলেন।
সুলতানের নির্দেশে বৃদ্ধ উজির তার জামাতা নুর-অল-দীনকে উজিরের কাজকর্ম সব বুঝিয়ে দিলেন।
নূর-অল দীন উজিরের পদলাভ করলেন। সেই সঙ্গে সুন্দর বাসস্থল, আসবাবপত্র, নফর, খচ্চর ও ঘােড়া প্রভৃতি প্রয়ােজনীয় যা কিছু দরকার সবই পেল।
যথাসময়ে নুর-অল-দীন-এর এক লেড়কা জন্মগ্রহণ করল আবার ঠিক সেদিনই তার দেশের বাড়িতে তার বড় ভাইয়ার একটি লেড়কী জন্মায়। নূর-অল-দীন তার লেড়কার নাম রাখল হাসান বদর-অল-দীন।
এদিকে সুলতানের দরবারে নূর-অল-দীন-এর খুবই সুখ্যাতি সে যেমন কাজকর্মের দিক থেকে বিচক্ষণ তেমনি ব্যবহারও খুবই মধুর। সবার সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলে। সুলতান তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার বেতন বাড়িয়ে দিলেন বেশ কিছু দিনার। হবে নাই বা কেন? রাজস্বও যে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
উজির যখন মারা গেলেন তখন হাসানবদর-অল-দীন-এর ওমর মাত্র চার সাল। উজিরের মৃত্যুতে সে পদে আসীন হয় নূর অল-দীন। উজিরের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সর্বদাই কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে হয় তাকে। তা সত্ত্বেও বেটার শিক্ষা দীক্ষার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলত।ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলা বিষয়ে অত্যন্ত অল্পকালের মধ্যেই প্রভূত জ্ঞানলাভ করল। তার ওমর যখন বারাে সাল হ’ল তখন মৌলভী নূর-অল-দীন-কে
বলল—’তােমার বেটাকে আমার আর কিছু দেবার নেই। আমার বিদ্যা সবই ওকে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছি।
নুর-অল-দীন তার বেটা হাসানকে নিয়ে সুলতানের দরবারে হাজির হ’ল। তাকে দেখে সুলতান চমৎকৃত হলেন। তার রূপগুণে তিনি যারপর নাই মুগ্ধ হলেন। তিনি উজির নূরকে ডেকে বললেন—“আমার হুকুম, তুমি রােজ দরবারে আসার সময় তােমার বেটা হাসানকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। উজির নূর সােল্লাসে বলল—জী হুজুর। অবশ্যই নিয়ে আসব, – আপনার হুকুম তামিল করব, কথা দিচ্ছি।
প্রতিদিন হাসান বাবার সঙ্গে দরবারে যায়। সুলতান আদর করে সারাক্ষণ তার পাশে বসিয়ে রাখে। এইভাবে সুলতানের সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। শুধু সুলতানের নয়, সারা দরবারের আমির ওমরাহ-সবারই পরম প্রিয়পাত্র হয়ে পড়ে সে।
এইভাবে সুখের সমুদ্রে সাঁতার কেটে দিন গড়িয়ে চলছিলো। হঠাৎ একদিন নূর-আল-দীন অসুখে পড়লো। কঠিন অসুখ। অনেক বড় বড় হেকিম ডাকা হলো। অনেক দাওয়াই দিলো তারা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেষে হেকিমরা জবাব দিয়ে গেলো। তাদের বিদ্যায়। আর কিছু করার নাই। এবার আল্লাহ ভরসা।
পুত্র হাসানকে কাছে ডেকে নূর বললো, বাবা, আমার ডাক এসেছে। যেতে হবে। তোমরা অবশ্য প্ৰাণপণে চেষ্টা করলে-যদি আরও কিছু কাল ধরে রাখা যায়। কিন্তু তা হয় না। আমি যে কদিনের জন্য তাঁর কাছ থেকে ছুটি করে এসেছিলাম তোমাদের এই হাসি-খেলায়, তা আমার ফুরিয়ে এলো। এবার যেতে হবে। আমরা মায়াবদ্ধ প্রাণী। এ সংসারে এসে ভাবি এই আমাদের চিরকালের আবাসস্থল। কিন্তু তা তো একদম ভুল, বাপজান। পথ চলতে চলতে সরাইখানায় যেমন দু’টো দিন কাটিয়ে যাই, এও তো তেমনি। আসল ঠিকানায় তো সবাইকে একদিন পৌঁছতে হবে। সেখানে পৌঁছে গেলে আর কোন দুঃখ তাপ কিছুই থাকে না। শোকতাপ দুঃখ-দুৰ্দশা যা পাওয়ার তা এ সংসারেই পাবে। তার কাছে পৌঁছতে পারলে খালি সুখ আর সুখ। নূর-আল-দীন চুপ করলো। একটানা অনেক কথা বলে ফেলেছে। দুর্বল শরীরে হাঁপ ধরে যায়। একটু পরে আবার বললো, বাবা, আমার যা করার ছিলো সবই প্রায় নিখুঁতভাবে আমি সমাধা করেছি। শুধু একটি কাজ বাকি রয়ে গেলো। তোমাকে তার ভার দিয়ে যাচ্ছি, তুমি আমার হয়ে সেটুকু করে নিও। খুব ভালো করে মন দিয়ে শোনো। কাইরোতে আমার বড়ভাই সামস-আল-দীন সেখানকার সুলতানের উজির। আমিও সেখানকার আর এক উজির ছিলাম। কিন্তু তুচ্ছ একটা কারণে দাদার সঙ্গে আমার একদিন কলহ বাধে। আমি রাগ করে দেশত্যাগ করে এই বসরা হতে চলে আসি।
নূর একটু দম নেবার জন্য থামলো। হাসানকে বললো, কাগজ কলম নিয়ে এসো।
হাসান একটা সোনার দোয়াত কলম আর তুলেটি কাগজ নিয়ে এসে বসলো। নূর যা বলে গেলো হুবহু লিখে নিলো হাসান। বসরাহতে কবে সে এসেছিলো, কবে তার শাদী হয়েছিলো, সুলতানের দরবারে উজিরের পদ, হাসানের জন্ম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী সন তারিখ সহ বিস্তারিত বিবরণ লিখে নিলো সে। তারপর নূর বলতে লাগলো তার বংশ পরিচয়। তার বাবার তরফ আর মায়ের তরফ। তাদের শাখা প্রশাখা-যে যেখানে থাকে সব ঠিকানাপত্র। তারপর বললো, ভালো করে কাগজখানা রেখে দিও। সময়ে কাজে দেবে। আমার মৃত্যুর পর তুমি তোমার স্বদেশ কইরোতে যেও একবার। আমার বড়ভাই তোমার চাচা ওখানকার উজির। তার সঙ্গে দেখা করে বলবে, এ জীবনে তার সঙ্গে আর দেখা হলো না আমার! আমাকে যেন মাফ করে সে।
নূর-আল-দীনের গাল বেয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কাগজখানা পড়ে শোনায় হাসান। নুর ঘাড় নেড়ে জানালো ঠিক আছে। বাবার মোহর একে দিলো কাগজটার ওপর। তারপর ভাঁজ করে একখানা মোমকরা কাপড়ে জড়িয়ে বাধলো। এইভাবে রাখলে নষ্ট হবে না। সহজে। বাইরের সাঁতসেতে হাওয়া ঢুকতে পারবে না। এবার কাপড়ে জড়ানো কাগজখানা তার পাতলুনের কোমরবন্ধনীর মধ্যে ঢুকিয়ে সূচী সুতো দিয়ে সেলাই করে দিলো। আর হারাবার ভয় থাকলো না।
এরপর একটা দিন মাত্র বেঁচে ছিলো সে। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে সারা শহর ভেঙে পড়লো। হাজার হাজার নরনারী কালো পোশাক পরে শোকমিছিলে সামিল হলো। সুলতান শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়লো। তার ডান হাতখানা আজ চলে গেলো।
যথাযোগ্য শাহী মর্যাদায় সমাহিত করা হলো তাকে। হাসান আজ পিতৃহারা। শোকের সায়রে ভাসতে থাকে। দু’নিয়নে জলের ধারা। বাবার সেই কথাগুলো মনে করে নিজেকে কিছুটা সাত্মনা দিতে পারে। এ দুনিয়াটা পান্থশালা, দুদিনের জন্যে আসা এখানে। সবাইকেই তো একদিন সব ফেলে চলে যেতে হবে।
দু’মাসব্যাপী মৌন হয়ে শোক পালন করলো হাসান। তারপরও সে বড় একটা করে সঙ্গে কথা বলে না। বাবার শোকে সে মূহ্যমান। সুলতান তাকে খবর পাঠালো। তার দরবারে উজির করবে তাকে। কিন্তু হাসানের কোন হাঁশ নাই। ঘর ছেড়ে বেরোয় না। সে; নাওয়া খাওয়া একরকম বন্ধ করে দিয়েছে। দিনে দিনে শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে গেলো তার শরীর। সুলতান বারবার লোক পাঠায়। কিন্তু হাসান গেলো না। তার মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই ঘোরাফেরা করে। তাকে যেতে হবে কাইরো। তার বাবার শেষ আদেশ।
সুলতান কুপিত হলো।—কী ওর এতো বড় স্পর্ধা! আমার হুকুম অমান্য করে সে। ধরে বেঁধে নিয়ে এসো তাকে। আমি তাকে শায়েস্তা করবো।
সুলতানের পরোয়ানা নিয়ে ছুটলো সিপাই বরকন্দাজ। শহরবাসীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। সর্বনাশ! না জানি, কী সাজা দেবে তাকে সুলতান। হাসানের এক বিশ্বস্ত নফর এসে খবর দিলো, শিগ্গির পালিয়ে যান হুজুর। সুলতান ক্ষেপে গেছে। আপনাকে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়েছে। এখুনি পাইক বীরকন্দাজ এসে পড়বে।
হাসানের চৈতন্য হয়। তাই তো, সুলতানের আদেশ অমান্য করেছে সে। তার পরিণাম তো মারাত্মক। হয়তো তার গর্দান যাবে। সুলতান ভেবেছে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য জ্ঞান করে তার ডাকে সে সাড়া দেয়নি। কিন্তু কী করে বোঝাবে সে, তার বাবার মৃত্যু কত বড় শেল হেনেছে তার বুকে।
হাসান বললো, আমাকে কিছু টাকাকড়ি দাও, জলদি করে।
নফর বললো, টাকা পয়সা বের করার সময় নাই। আপনি আর এক পলক দেরি করবেন না, হুজুর। বেরিয়ে যান। এখান থেকে। না হলে জানে বাঁচবেন না। সুলতানের লোক এসে পড়বে এখুনি। আপনাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়েছে। আপনার ঘরবাড়ি বিষয় আশয় সব বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছে সে। আপনি পালান।
হাসান কি করবে বুঝতে পারে না। এক মুহূর্ত। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। নিজের গায়ের দামী শালখানা ফেলে দিয়ে নফরের কাঁধের ময়লা চাঁদরখানা টেনে নিয়ে মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে সারা দেহটা ঢেকে নিলো। আপাতভাবে দেখে মনে হয়, কোন দীন ভিখারী। খিড়কীর দরজা দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লো।
প্রথমে ঠিক করলো বাবার গোরস্তানে গিয়ে আজকে রাতের মতো আশ্রয় নেবে সেখানে। তারপর কাল সকালে ভাববে কী করে কইরোর পথে রওনা হওয়া যায়।
বাবার কবরের পাশে বসে ভাবছে এমন সময় সেখানে এলো এক জু। বসরোহর নামকরা ধনী সওদাগর। এক অদ্ভুত হাসিতে নেচে উঠলো তার চোখ —হুজুর এখানে? আহা কী দশা হয়েছে আপনার। একেবারে চেনা যায় না। তা সবই ভাগ্যের খেলা। আজ যে উজির কাল সে ফকির এই তো মালিকের খেলা।
হাসান সত্য গোপন করে বানিয়ে বললো, আজ দুপুরে আমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, বাবা বলছেন, আমার কবরের পাশে যাস। তোকে একটা কথা বলবো। তাই এসে বসে আছি এখানে।
জু বললো, আপনার বাবা বড় সজ্জন ছিলেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। অনেক দিন ধরে আপনাকে একটা ব্যবসার কথা বলবো বলবো করেও বলার সময়-সুযোগ পাইনি। আপনি তো জানেন, আপনার বাবার বড় জাহাজের কারবার আছে। আপনার বাবার কাছ থেকে একখানা জাহাজ কিনবো এইরকম একটা কথাবার্তা আমার হয়েছিলো এক সময়। কিন্তু তারপরই তিনি অসুখে পড়লেন। ব্যাপারটা ওখানেই থেমে গেলো। এখন আপনি যদি ইচ্ছা করেন, আমাকে বিক্রী করতে পারেন একখানা জাহাজ। আমি আপনাকে এক হাজার দিনার দাম দিচ্ছি।
সওদাগরের কথায় না করতে পারলো না হাসান এক এক করে এক হাজার দিনার গুণে দিলো সওদাগর। তার সঙ্গে একটা সাদা কাগজ আর কলম তুলে দিলো হাসানের হাতে। বললো, নামকে ওয়াস্তে একটা রসিদ করে দিন হুজুর।
হাসান লিখে দিলে : আমি মৃত উজির নূর-আল-দীনের একমাত্র পুত্র হাসান বদর-আল-দীন আপনার নিকট হইতে এক সহস্ব দিনার গ্রহণ করিয়া আমার পিতার (বর্তমানে আমার) একখানি সওদাগরী জাহাজ বিক্রয় করিলাম। বন্দরে প্রথম যে জাহাজ নোঙর করিবে সেই জাহাজই আপনি পাইবেন।
নাম স্বাক্ষর করে জুয়ের হাতে তুলে দিলো হাসান। ‘হুজুরের অশেষ কৃপা—হুজুর আমার মা-বাপ।’ এইরকম অনেক সৌজন্য দেখিয়ে বিদায় নিলো সে। বাবার সমাধির পাশে বিষণ্ণ মনে বসে রইলো সে। রাত্ৰি গম্ভীর হতে হতে গভীরতর হয়। এক সময় ঘুমে ঢুলে পড়ে সে।
চাঁদ তখন মাথার ওপরে। হাসানের সারা দেহে চাঁদের আলোর লুটোপুটি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। দিনের বেলার আতঙ্কভােব আর নাই। এক অপরূপ প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখে।
নিঃঝুম নিস্তব্ধ গােরস্থানে গভীর রাত্রে প্রেতাত্মাদের আগমন ঘটে। আর আসে জীন ও পরীরা। তখন এক জিনিয়াহ সেখানে হাজির। খুবসুরৎ হাসানকে দেখে তার মনে পুলকের সঞ্চার ঘটে। সে নিজেও খুবসুরৎ দেখতে। হাসানকে দেখামাত্রই সে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু তখন তার ঘুম ভাঙল না। ভাবল, একটু ঘুড়ে এসে একে জাগিয়ে গল্পগুজব করবে। আবার পাখা মেলল। আকাশ পথে টুঙতে গিয়ে অন্য এক জিনিয়াহর সঙ্গে তার দেখা হয়। সে কায়রাে নগর থেকে আসছে। কুশলতাদি আদানপ্রদানের পর জিনিয়াহ তাকে নিয়ে গােরস্থানে এল একটি জিনিস দেখাবার লােভ দেখিয়ে।
হাসান-এর যৌবনভরা দেহের রূপ সৌন্দর্য দেখে জিনিয়াহও মুগ্ধ হয়ে গেল। জিনি বলল—“উজির নূর-অল-দীন-এর বেটা হাসান নাকি তামাম দুনিয়ার যুবকদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু এ-যুবকও তাে খুবসুর-ই বটে। কমতি কিসে? আর কায়রাের উজির সামস-অল-দীন-এর বেটিকেও দেখেছি। কী সুরৎ! হুরী পরীর-মত দেখতে। এর শাদী যদি কোন দিন হয় তবে একমাত্র সে-লেড়কিকেই এর পাশে মানাবে।
‘আমি সে-লেড়কিকে কোনদিন চোখে দেখি নি। তার কথা শুনি নি কোনদিন।
—“তবে বলছি শােন, এমন রূপ-যৌবনের আকর লেড়কিটি খুবই হতভাগিনী উজিরের খুবসুরৎ লেড়কি দেখে সুলতানের মাথা বিগড়ে যাওয়ার জোগাড়। উজিরকে একদিন বললেন—’শােন, তােমার বেটিকে আমি শাদী করতে চাই। তুমি রাজি হয়ে যাও।
চমকে উঠে উজির বলল,—“জাঁহাপনা, আমার গােস্তাকী মাফ করবেন। আপনার তাে আর অজানা নয় আমার ছােট ভাইয়া নূরঅল-দীন বিবাগী হয়ে ভিনদেশে পাড়ি দিয়েছে। আমাদের মধ্যে একদিন কথা হয়েছিল, আমার বেটির সঙ্গে তার বেটার শাদী দেব। আমি জেনেছি, তার বেটা বসরাহতে আছে। জোয়ান মরদ হয়েছে। আমার ভাই কিছু দিন আগে বেহেস্তে গিয়েছে। আমি যদি কথার খিলাপ করি তবে আমার গুনাহ হবে, ঠিক কিনা? ছােট ভাইয়া বেহেস্তে গিয়েও স্বস্তি পাবে না। জাঁহাপনা আমাকে সত্যরক্ষা থেকে বঞ্চিত করবেন না। আপনি সুলতান, আপনি মন করলে তামাম দুনিয়ার খুবসুরৎ লেড়কির হাট বসিয়ে দিতে পারেন প্রাসাদের সামনে।
উজিরের কথায় সুলতান রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তাকে প্রত্যাখ্যান করে উজির রীতিমত অপমান করেছে। কোথায় সানন্দে বেটিকে সুলতানের হাতে তুলে দিয়ে বাপ-বেটির জীবন ধন্য করবে, তা না করে মুখের ওপরে প্রত্যাখ্যান। ক্রোধােন্মত্ত সুলতান রাগে গস গস্ করতে করতে তার এক হতকুৎসিত সহিসের সাহায্যকারীকে তলব দিলেন। একেবারে অষ্টাবক্র চেহারা। সােজা হয়ে কোনদিনই সে দাঁড়াতে পারে নি। ভাঙাচোরা কিছু হাড়গােড় জোড়া দিয়ে যেন তার চেহারাটিকে গড়ে তােলা হয়েছে।
সুলতানের তলব পেয়ে অষ্টাবক্র লােকটি হস্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে কুর্নিশ সেরে দুরু দুরু বুকে দাঁড়াল। ভেবেছে, নির্ঘাৎ কোন অমার্জনীয় কসুর করে ফেলেছে। নইলে খােদ সুলতানের দরবারে তার ডাক পড়বে কেন?
তাকে দেখেই সুলতান বললেন-“আজ রাত্রেই তােমার শাদী হবে, তৈরী থেকো।
শাদীর কথা শুনে অষ্টাবক্র লােকটি মূৰ্ছা যাবার উপক্রম হ’ল। তার বুকের ভেতরে কলিজাটি বার বার মোচড় খেতে লাগল। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে, বারকয়েক ঢােক গিলে বলল—‘জাহাপনা, আমার রূপ নিয়ে সবাই মস্করা করে। নসীবের ফের ভেবে মুখবুজে হজম করি সব অপমান নির্যাতন। আজ আপনিও
সুলতান ধমকের সুরে বললেন— বাজে কথা রাখ। আমি পরিচারক-পরিচারিকাদের বলে দিচ্ছি তােমাকে গােসল করিয়ে শাদীর পােশাকে সাজিয়ে দিতে। ঝটপট তৈরী হয়ে নাও, আজ রাত্রেই শাদী হবে।
সুলতানের প্রাসাদে হাসি-আনন্দে তুফান বয়ে চলল। অষ্টাবক্র লােকটির শাদী হবে, আনন্দের ব্যাপারই বটে। মেয়েরা তাকে বরবেশে সাজাতে গিয়ে কত রকমেরই যে মস্করায় মেতে উঠল বলে শেষ করা যাবেনা।
কিসসার এ-পর্যন্ত বলে বেগম শাহরাজাদ থামলেন। ভােরের পূর্বাভাস লক্ষিত হ’ল। বাদশাহ শারিয়ার প্রফুল্ল চিত্তে বিবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্দরমহল ত্যাগ করলেন।
একুশতম রজনী, বাদশাহ শারিয়ার যথা সময়ে অন্দরমহলে বেগমের কাছে এলেন। বেগম শাহরাজাদ কিসসা শুরু করলেন—“জাহাপনা, তারপর সে-জিনিয়াহ কি বলল শুনুন—সে-যুবতীর তুল্য রূপসৌন্দর্য দুনিয়ার কারােরই নেই, কথাটি কিন্তু বাড়িয়েই বলছ তুমি। আমি তাে বিশ্বাসই করতে পারছি নে, তােমার সে সিৎ-অল-হুসনএর চেয়ে এ-যুবতী বেশী সুন্দরী। না, কিছুতেই তা সম্ভব নয়।
—-“আমার কথা বিশ্বাস কর এক তিলও বাড়িয়ে বলি নি, তার তুল্যা সুন্দরী তামাম দুনিয়া ছুঁড়ে এলেও দ্বিতীয় কাউকেই পাবে না। আমি তার উপযুক্ত একটি পাত্রের খোঁজেই ঘুড়ে বেড়াচ্ছি। তােমার এ-যুবকের সঙ্গে কিন্তু চমৎকার মানাবে। শােন আমার সাফ কথা। হতচ্ছাড়া ওই অষ্টাবক্র লােকটি ওর জীবন বরবাদ করে দিক এটি আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারব না। তুমি যদি রাজি থাক তবে সুন্দর এ-যুবকটিকে নিয়ে আমরা কায়রাের পথে উড়ে যাই আফ্রিদি বলল। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হাসান’কে বয়ে নিয়ে জিনিয়াহ আর আফ্রিদি কায়রাের পথে উড়ে চলল। বাতাসের মত তীব্র গতিতে তারা আকাশ পথে অগ্রসর হতে লাগল।
কায়রাে নগরে উজিরের প্রাসাদে শাদীর তােড়জোড় চলেছে। শানাই বাজছে। খানাপিনা চলছে হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে। মৌলভী শাদীর ব্যবস্থাদিতে ব্যস্ত। নচ্ছার অষ্টাবক্র লােকটি দামী পােষাক গায়ে চাপিয়ে গম্ভীর মুখে বসে। দামী আতরের খুসবু বেরােচ্ছে তার গা থেকে। জিনিয়াহ রাস্তার ধারের একটি আবছা অন্ধকার বেদির ওপর ঘুমন্ত হাসানকে শুইয়ে দিল। এক সময় তার ঘুম ভেঙ্গে একটি লােককে দেখে চমকে উঠল। আতঙ্কে জড়ােসড়াে হয়ে চিৎকার করার জন্য মুখ খুলতে যাবে অমনি দৈত্যাকৃতি লােকটি মুখের কাছে নিয়ে ইশারায় তাকে থামতে বলল।
দৈত্যাকৃতি লােকটি এবার হাসান-এর হাতে একটি জলন্ত মোমবাতি ধরিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে এল সুলতানের প্রাসাদে। অনুচ্চ কন্ঠে বলল—নিমন্ত্রিত মেহমানদের ভিড়ে মিশে যাও। আমাকে ভয় করাে না। আমি এক জীন। তােমার মঙ্গলের জন্যই এখানে তােকে নিয়ে এসেছি। এটা কায়রাে নগরের সুলতানের মহল। এক শযতান কুঁজো, অষ্টাবক্র লােকের সঙ্গে উজির সামস-অল
ও লেড়কির শাদী হবার কথা। তারই রােশনাই চলেছে। গিয়ে দেখ, ফুলের মত ফুটফুটে লেড়কিটি কেঁদে কেঁদে চোখ বুলিয়ে ফেলেছে। তুমি মেহমানদের ভিড়ে মিশে যাও হতচ্ছাড়া অষ্টাবক্রটি যখন খচ্চরের পিঠে চাপবে তখন তুমি মােমবাতি হাতে তার কাছাকাছি থাকবে। তােমাকে সবাই বরাত ভাববে। বরের লােক ভেবে মান্য করবে তােমাকে।
এক সময় দেখবে জেনানারা ওড়না পেতে ধরবে তােমার সামনে তুমি কামিজের পকেটে হাত চালিয়ে দেবে। দেখবে হাতে এক মুঠো সােনার মােহর উঠে আসবে। মায়া করবে না। মেহগুলাে তাদের ওড়নায় ছুঁড়ে দেবে। এমন ভাব দেখাবে যেন এ মােহর তােমার কাছে খুবই তুচ্ছ বস্তু। যতবার পকেটে হাত দিবে ততবারই মুঠো ভরে মােহর উঠে আসবে পকেট কখনই খালি হবেনা। হামাম থেকে প্রাসাদের দরজা পর্যন্ত খইয়ের মত মহর ছিটাতে থাকবে। এবার হতচ্ছাড়া ওই অষ্টাবক্রটিকে নিয়ে যাবে সুসজ্জিত একটি ঘরে। একমাত্র বর ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু তােমাকে সে-ঘরে যেতেই হবে। একটু উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়ােগ করবে। তবেই সহজে আজ হাসিল করতে পারবে। কিছু সােনার মােহর ছড়িয়ে দিলেই সে উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে। কথা কটি বলেই জিনিয়াহ অদৃশ্য হয়ে গেল।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বরবেশে অষ্টাবক্র লােকটি খচ্চরের উপর চাপল। তাকে ঘিরে নাচতে নাচতে চলল একদল নাচনেওয়ালি। গলায় মুক্তোর মালাটি দেখে মনে হচ্ছে যেন কনঠুর গলায় মুক্তোর মালা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসান বাতি হাতে এগিয়ে গিয়ে খচ্চরটির লাগাম দখল করে ফেলল। হাসানের যৌবনভরা রূপ-সৌন্দর্য দেখে সবাই তাে একেবারে থ বনে গেল। প্রাসাদের দরজায় যেতেই একদল জেনানা ওড়না পেতে ধরল হাসান-এর সামনে। জিনিয়াহর পরামর্শমত সে বার বার পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুঠো মুঠো সােনার মােহর বের করে তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে ছিটোতে লাগল। যেন একটি মােহর তার কাছে খুবই তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার।
প্রাসাদের অন্দরমহলে যেতেই হাসান অষ্টাবক্র লােকটির হাত ধরে টানতে টানতে সুসজ্জিত একটি ঘরে ঢুকে পড়ল। মুঠোমুঠো মােহর ছিটোতে পারলে কোন কাজই অসাধ্য নয়। একদল লেড়কি অষ্টাবক্র লােকটিকে নিয়ে ফুলমালায় সুসজ্জিত একটি মঞ্চের ওপর বসাল। বরবেশে বসে থাকা তার দিকে কারােই নজর নেই। নয় থেকে নব্বই সব বিবিরা লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে রূপযৌবনের জোয়ারলাগা হাসানকে বার বার দেখতে লাগল। চোখ সরাতে চায় না কেউ। একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে সবাই নারাজ। যেন বিরাট লােকসান হয়ে যাবে। সবার মুখেই এক কথা—এমন সুন্দর একটি জোয়ান হাতের কাছে রয়েছে অথচ এমন কদাকার অষ্টাবক্ৰটির হাতে ফুলেরমত সুন্দর তরতাজা মেয়েটাকে তুলে দিচ্ছে। এর চেয়ে গলায় কলসী বেঁধে পানিতে ফেলে দেওয়া ঢের ভাল ছিল!
এমন সময় সে-ঘরে বৃদ্ধ মৌলভী আর শাদীর পাত্রী সিৎ-অল হুসন প্রবেশ করলেন। একটি সুসজ্জিত আসনে রূপ-সৌন্দর্যের আকর উদ্ভিন্ন যৌবন পাত্রী হুসনকে বসানো হ’ল। তার রূপের আভা চোখ ঝলসে দেয়। যেন সারা বিশ্বের সৌন্দর্য রাশি কুড়িয়ে এনে জড়াে করা হয়েছে এর দেহপল্লবটিতে। এর রূপের জৌলুষের কাছে বেহেস্তের হুরী পরীদের সৌন্দর্যও বুঝি হার মানবে। মসলিনের ওড়নার নিচে যত্নে পাট করা রেশমের মতো তার ঘন চুলের অরণ্যে লুকিয়ে আছে এক মুকুলিত যৌবনের যাদু। তার উন্নত বক্ষের ওপর আলতােভাবে দোল খাচ্ছে মখমলের ওড়নাটি : মনে হবে মুকুলিত যৌবনচিহ্ন দুটো ওড়নার আড়াল থেকে যেন বার বার উঁকি দিচ্ছে। জানাচ্ছে নিজেদের সজীব উপস্থিতি। সেদিকে আচমকা চোখ পড়ায় হাসান-এর বুকের ভেতরের কলিজাটি আছাড়ি পাছাড়ি করতে থাকে। সুসংখ্য হিরে জহরৎ খচিত মাথার টিকলিটি যেন বাতাসের চাপে মৃদু মৃদু দোল খাচ্ছে। তার রূপের আভায় ব্যবহৃত অলঙ্কারাদির সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে। মন-পাগল করা এমন রূপ হলান আগে কোনদিন দেখেনি।
হাসান মঞ্চের পাশে একটি কুরশি পেতে বসে। হুসন নিজের কুরশি ছেড়ে উঠে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এল। কোন পুরুষের মধ্যে যে এমন রূপের ঝিলিক থাকতে পারে তা এর আগে কোনদিন প্রত্যক্ষ করা তাে দূরের কথা কারাে মুখে শােনেও নি কোনদিন। সে তার বাবার মুখে শুনেছিল, তার চাচার বেটা নাকি এরকম চাদের মত সুন্দর দেখতে। কিন্তু এ কোন যুবক। এ-ই তার চাচার বেটা নয় তাে? হুসন-এর হাত দুটো নিসপিস করতে লাগল। এক অভাবনীয় অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসল। অস্থির হয়ে অকস্মাৎ যুবক হাসান-এর কাঁধে নিজের নিটোল হাত দুটো রেখে মিষ্টি-মধুর : স্বরে বলে উঠল–‘আমার মেহবুব! এ-ই আমার স্বামী, আমার কলিজা। তার চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল। এবার অপেক্ষাকৃত ভারি গলায় উচ্চারণ করল—হায় আল্লা! মনের মত এমন সুন্দর পাত্র হাতের মুঠোয় থাকতে তুমি কিনা আমাকে ওই বাঁদর মুখে হতচ্ছাড়া অষ্টাবক্ৰটির হাতে সঁপে দিচ্ছ। আমার ওপর মেহেরবানি কর, মুখ তুলে তাকাও।’
এদিকে অষ্টাবক্র লােকটির লম্ফঝখ দেখে কে। সে রাগে গস্ গস করতে করতে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। তার কাণ্ড দেখে লেড়কি-বিবিরা তাে হেসে গড়াগড়ি যাবার উপক্রম।
প্রথা অনুযায়ী পাত্রী এবার প্রদক্ষিণ-পূর্ব শুরু করল। সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হবে সুপ্রশস্ত ঘরটিকে। হসন প্রতিবারে ঝলমলে পােশাক পাল্টে এসে ঘরটিকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। উপস্থিত যুবতীরা হুসন’কে প্রয়ােজন অনুযায়ী প্রদক্ষিণের কাজে সাহায্য সহযােগিতা করতে লাগল। প্রতিবার প্রদক্ষিণ সেরে হাসান-এর মুখােমুখি করে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াল। নাচনেওয়ালিরা বিচিত্র অঙ্গ ভঙ্গি করে নাচতে লাগল। বর-কনের মধ্যে কাম প্রবণতা জাগিয়ে তােলাই তাদের নাচের একমাত্র উদ্দেশ্য। কামভাব জাগিয়ে তুলে। তাদের উত্তেজিত করার প্রয়াস।
শাদীর মঞ্চে এবার দু’জন বসে। একজন বরবেশধারী কদাকার সে-অষ্টাবক্রটি আর দ্বিতীয় জন হাসান।
একটু বাদে শাদীর মঞ্চে হাসানকে নিয়ে যাওয়া হল। আর অষ্টাবক্রটি বিষমুখে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। এবার শাদীর মঞ্চে বসে থাকা হাসান-এর কাছে বিবির বেশে সুসজ্জিত হুসন ধীরপায়ে এগিয়ে এল। স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে সােহাগ কামনা করল। আবেগ-মধুর স্বরে বলল—মেহবুব আমার! আমাকে সােহাগে সােহাগে ভরিয়ে তােল। তােমার কোলে তুলে নাও আমাকে। আমার সতের বছরের যৌবনভরা দেহপল্লবটি তােমার হাতে সঁপে দিলাম। আমাকে দলিত মথিত কর। আমার সাড়া অঙ্গে তোমার মুখ দিয়ে লেহন কর। আমার প্রশ্ফুটিত স্তনজোড়াকে তোমার দুহাত দিয়ে পেষণ কর। তুমি একে ভােগ কর, আমাকে দাও সম্ভোগসুখ।
যুবক হাসান-এর শিরা-উপশিরার রক্তের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠল। কেবলমাত্র একখানা চাদরে ঢাকা ছিল হুসনএর যৌবনের জোয়ারলাগা দেহটি। হেঁচকাটানে সেটিকে শরীর থেকে খুলে ফেলে ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের মেঝেতে। ব্যক্ত হাতে নিজের পাতলুনটিকেও খুলে দূরে ফেলে দিল। একটি সাদা ও সাধারণ টুপি মাথায় পরে নিল, হুসন উবু হয়ে বসে তার ইজেরের রশিটি ধরে আচমকা একটি হেঁচকা টান মারল। চোখের পলকে সেটি ছিড়ে গেল। কিন্তু হুসন-এর পক্ষে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হল না। চিৎ হয়ে মখমলের চাদরের ওপর পড়ে গেল।
হুসন সরবে হেসে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। সে সাঁড়াশির বাঁধনে আটকা পড়ল হুসন। সে-ও দু’হাতে জাপটে ধরল তার বহু আকাঙিক্ষত পুরুষটির পেশীবহুল নগ্ন দেহটিকে। হাসির তুফানে হুসনও যােগ দিল। সে তুফানে তলিয়ে গেল উত্তাল-উদ্দাম’ দুই নারী-পুরুষ। পুরুষের বাহুর সকাম আকর্ষণ যে এত মধুর হুসন আগে কখনও বােঝে নি। নিজের কুসুম কোমল-মাংসপিণ্ডদ্বয়কে তার বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দিল। ক্রমে তার দেহ-মন অসাড় হয়ে পড়তে লাগল। হাসান হুসনের সদ্য যৌবন ভরা দেহটাকে কি করবে না করবে দিশা পায় না। কখন মুখে চুম্বন করে, কখনও স্তনদুটোকে মুখে চুষে কখনও গলা, বগল চুষে, হুসনের দেহের কুসুম কোমল ঘ্রান তাকে পাগল করে দিল। হু্সনের নাভি, পেট যোনি উরু মুখ দিয়ে চুষে একাকার করে দিতে লাগল। হুসনও হাসানের পুরুষাঙ্গটি নিয়ে খেলা করতে লাগল, মুখে নিয়ে চুষতে লাগল। অতিশয় আনন্দানুভূতি যে মানুষের মনে এমন করে রােমাঞ্চের সঞ্চার করতে পারে তা সে এই প্রথম বুঝল। ব্যস, তারপরই তারা উভয়েই যেন কোন আনন্দ-সাগরের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পর তারা ক্লান্ত অবসন্ন অথচ প্রসন্নচিত্তে পুরু মখমলের চাদরটির ওপর গা এলিয়ে দিল। উভয়ের শ্বাসক্রিয়া ঘন ঘন চলতে লাগল। কারাে মুখে কোন কথা নেই। নীরবে সদ্য লব্ধ সুখটুকু উপলব্ধি করতে লাগল। অখণ্ড নীরবতা ভঙ্গ করে হাসান নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মত হুসন-এর সরু কটি দেশে আলতাে করে একটি হাত রেখে বল—‘আমি নিঃসন্দেহ, তােমার জীবনে আমিই প্রথম পুরুষ।
হুসন জীবনের প্রথম পুলকানন্দের মাধ্যমেই অন্তঃসত্ত্বা হ’ল। সে মধুযামিনীতে তারা পনেরবার সঙ্গম-সুখ ভােগ করল। তারপরই তাদের চোখগুলাে ক্রমে বিশ্বাসঘাতকতা করতে শুরু করল। ঘুমে বারবার জড়িয়ে আসতে লাগল চোখের পাতা। আর নয়। আর সম্ভব নয়। মানুষের শরীর তো বটে। এত ধকল সইবে কেন? তারা ঘুমে ঢলে পড়ল। গভীর ঘুমে এক সময় আচ্ছন্ন হয়ে দেখছে! জিনি অনুচ্চকণ্ঠে বলল—“আর দেরী নয়, একটু বাদেই ভােরের আলাে ফুটে উঠবে। যুবকটিকে গােরস্থানের যে-জায়গা থেকে তুলে এনেছিলাম সেখানেই আবার রেখে আসতে হবে।
জিনিয়াহ ঘুমন্ত হাসানকে নিজের পিঠে তুলে নিয়ে শূন্যে উঠে গেল। পাখার ঝাপটায় বাতাস কেটে এগিয়ে চলল বাতি সেগােরস্থানের দিকে। জিনি উড়তে থাকে পাশাপাশি কাছাকাছি। হঠাৎ জিনি-র মধ্যে কামভাব জাগ্রত হয়। জিনিয়াহ-র ওপর বলাৎকার করার জন্য উদ্যত হয়। পিঠে তার ঘুমন্ত যুবক হাসান। তাকে তাে আর ফেলে নিয়ে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। অন্য সময় হলে সে তার বাঞ্ছা পূরণে বাধ্য দিত না। কিন্তু জিনি-র কামপ্রবৃত্তি একবার জাগ্রত হলে আর রক্ষা নাই। প্রলয় কাণ্ড ধাঁধিয়ে দেয়। ভয়াল-ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কিন্তু আল্লাহ তাে আর অন্ধ নন। তিনিই পরিস্থিতি সঙ্গীন দেখে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। হঠাৎ দেখা গেল জিনির দেহটি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। তারপরই অতিকায় জ্বলন্ত দেহটি মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল।
দাউ হাউ হাউ করে জ্বলতে লাগল সিরিয়ার অন্তর্গত দামাস্কাস নগরীর এক পথের ধারে। জিনিয়াহও নামল সেখানে। পিঠের ঘুমন্ত যুবকটিকে পথের ধারে শুইয়ে দিল। ব্যস, একেবারে উধাও হয়ে গেল সে। একেই বলে বরাত। হাসান একা পড়ে রইল।
সকাল হলে নগরের দ্বার খুলে দেওয়া হল। শুরু হল মানুষের যাতায়াত। সবাই বিস্ময়ভরা চোখে অনিন্দ্য সুন্দর যুবক হাসান-এর দেহকাস্তি দেখে যারপর নাই মুগ্ধ হ’ল। গায়ে কেবল রাত্রের পােশাক। আর মাথায় অতিসাধারণ একটি টুপি।
এক সময় হাসান-এর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকাল।
সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা এক দেশের পথের ধারে সে শুয়ে। আর তাকে ঘিরে রয়েছে একদল কৌতূহলী নগরবাসী। সে চিৎকার করে বলে উঠল—“আমি কোথায় ? এ কোন দেশ? আমি এখন কোথায় আছি? তােমরাই বা কারা?
পথচারীদের একজন বলল—তােমাকে আমরা এখানে, এভাবেই পড়ে থাকতে দেখেছি। এ নগরের নাম দামাস্কাস। তুমি এখানে এলেই বা কি করে? কে তুমি? থাক কোথায়?
–‘আমিও তাে একই কথা ভাবছি। কাল রাতে আমি তাে কায়রাে নগরে ছিলাম আর এখন দামাস্কাসে?
হাসান-এর কথায় পথচারীরা হাে হাে করে হেসে উঠল। হাসবার মত কথাই বটে। কায়রাে আর দামাস্কাসের মধ্যেকার ফারাকটুকুর কথা ভেবেই তাদের হাসির উদ্রেক হয়েছে। কেউ কেউ তাকে বদ্ধ পাগল ভেবে রসিকতা শুরু করে দিল।
এক প্রবীণ এগিয়ে এসে বলল -“বাপু সত্যি করে বল তাে ব্যাপারটি কি? তােমার কথাবার্তা আমাদের মনে কেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে।
—“গত সন্ধ্যায় আমি বসরাইতে ছিলাম। মাঝরাত্রে ছিলাম কায়রাে নগরে। আর এখন দেখছি, দামাস্কাসের রাস্তার ধারে পড়ে রয়েছি।’ হাসান কথা বলতে বলতে উঠে হাঁটতে লাগল। তার পিছন পিছন চলল একদল ছেলে বিভিন্ন কৌশলে রঙ্গ-তামাশা করতে করতে।
এদিকে কায়রাে নগরের প্রাসাদে সদ্য বিবাহিতা রূপসী-যুবতী সিৎ-অল-হুসন ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখে তার স্বামী হাসান অনুপস্থিত। উদ্ভ্রান্তের মত ঘরের চার দিকে সে তাকাতে লাগল। সে ছাড়া ঘরে দ্বিতীয় কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। তার দু’চোখ বেয়ে পানির ধারা নেমে এল।
সামস্-অল-দীন এসব ব্যাপার কিছুই জানে না। সে সারারাত্রি নিজের প্রাসাদের ছােট্ট একটি ঘরে কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, সুলতান ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সে হতচ্ছাড়া অষ্টাবক্র লােকটার সঙ্গেই তার একমাত্র পরমা-সুন্দরী, আদরের দুলালী হুসূন-এর বিয়ে দিয়ে গায়ের ঝাল মিটিয়েছেন। তাই সে বেটির কথা বিশ্বাসই করতে চায় না। বিশ্বাস করার মত কথাও নয় যে, এমন একটি গাঁজাখুরি গল্পকে সত্যি বলে মেনে নেবে। মনে ধন্ধ জমাট বাঁধল।
সমস্-অল-দীন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল—কী সব বাজে বকছিস বেটি! তা-ই যদি হয় তবে তাের সে খুবসুরৎ বরটি গেল কোথায় ?
এমন সময় প্রাসাদের বাইরের বাগিচায় পাখির কলধ্বনি শােনা গেল। ভােরের পূর্বাভাস। বেগম শাহরাজাদ কিসসা বন্ধ করলেন।
বাইশতম রজনী, বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে এলেন। বেগম শাহরাজাদ তার কিসসার পরের অংশটুকু শুরু করতে গিয়ে বলেন-“জাহাপনা, বৃদ্ধ উজির তার কিসসা বলে চলেছেন আর খলিফা হারুণ-অলরসিদ মন্ত্রমুগ্ধের মত একাগ্রচিত্তে শুনছেন। সদ্য বিবাহিতা হুসন তার স্বামীর খোঁজে ছােট-ঘরের দিকে এগােতেই হতচ্ছাড়া অষ্টাবরে মুখােমুখি হ’ল। অষ্টাবক্রের চোখে মুখে ভীতির ছাপ ফুটে উঠল। সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাপতে লাগল। তার মনে হল হতচ্ছাড়া জিনি বুঝি আসছে। উজিরের সুন্দরী লেড়কিকে তাে পেলই না। তার ওপর সারা রাত্রি যে অত্যাচার তাকে সইতে হয়েছে তা সারা জীবন মনে থাকবে। এ-জন্মের মত শাদীর সাধ তার মিটে গেছে।
হুসন স্বামীকে না পেয়ে কোন কথা না বলে পিছন ফিরে হাঁটতে লাগল। এমন সময় সেখানে এল উজির সামস-অল-দীন। তাকে দেখেই অষ্টাবক্র কাপতে কাপতে করজোড়ে বলে উঠল–‘জিনি মহাশয়, দোহাই তােমার, আর আমাকে শাস্তি দিও না। কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন ভুলেও বিয়ের আসর মুখাে হ’ব না।’
সামস-অল-দীন ধমকের সুরে বল-চুপ কর হারামজাদা! জিনিটিনি কাউকে আমি চিনি না। আমি সুলতানের উজির।
অষ্টাবক্র লােকটি এবার উজিরকে চিনতে পেরে তড়পানি শুরু করে দিল-ও আপনি? আমি আরও ভাবলাম বুঝি সেই জিনি। চলে যান এখান থেকে। আপনি আর সুলতান একজোট হয়ে আমাকে মিছিমিছি এমন হেনস্থা করেছেন। আমার জীবনটিই একেবারে বরবাদ করে দিয়েছেন। বেশ তাে ছিলাম। শাদীর লােভ দেখিয়ে—পালান এখান থেকে। জিনি আফ্রিদি এসে পড়লে মজা কাকে বলে আপনাকেও টের পাইয়ে দেবে!
উজির বলল-“এসাে, এদিকে এসাে।
—ক্ষেপেছেন মশাই! জিনি আফ্রিদির আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আমি এক পা-ও এখান থেকে নড়ছি না। সারারাত্রি ধরে যে শাস্তি ভােগ করেছি ভাবলে এখনও আমার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। রােদ ওঠা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকব।’
এবার উজির তার কাছে জানতে চাইল—“আফ্রিদি তাকে কিভাবে হেনস্তা করেছে, কি কি বলেছে।
অষ্টাবক্র তাকে সারা রাত্রির ঘটনা এক এক করে সবই খুলে বলল।
উজির এবার পুবদিককার একটি জানালা খুলে দিয়ে বলল—‘শােন, সকাল হয়ে গেছে অনেক আগেই। ওই দেখ, ঝলমলে রােদ। এবার তুমি এখান থেকে পালাও।
ব্যস, অষ্টাবক্র এবার এক দৌড়ে বাইরে চলে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে একেবারে সুলতানের সামনে এসে দাঁড়াল। সুলতানকে তার সারারাত্রির দুর্ভোগের কথা সবিস্তারে বল।
আবার এদিকে উজির সামস-অল-দীন তার বেটি সিৎ-অন হুসনর কাছে ফিরে এল। বলল-“বেটি, সব কিছু শুনে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। আমি কি তবে পাগলই হয়ে গেলাম। এমন তাজ্জব ব্যাপার তাে বাপের জন্মে কোনদিন শুনিনি। আসল ব্যাপারটি কি খুলে বল তাে শুনি।
‘আব্বাজান, এ আবার খুলে বলার কি আছে? সে-সুদর্শন যুবকটি গত রাত্রে সবারই মন কেড়ে নিয়েছিল। তার সঙ্গেই আমি গতরাত্রি কাটিয়েছি। তুমি আমার আব্বাজান, বলতে শরম লাগছে, তবু বলছি, গতরাত্রেই আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি। এবার প্রমাণস্বরূপ তার স্বামীর বাদশাহী টুপি, পাতলুন আর মােহরের থলি প্রভৃতি দেখিয়ে বলল-“আব্বাজান, সবকিছুই তার।
উজির বাদশাহী টুপিটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন—’বেটি, এ টুপি তােত বসরাহর আমিররা ব্যবহার করে বলে জানি।
এবার পাতলুনটি হাতে তুলে নিয়ে ব্যস্ততার সঙ্গে তার কোমরের সেলাইটি খুলে ফেললেন। একটি তুলােট কাগজ বেরিয়ে এল। কাগজটির ভাজ খুলেই উজির সামস-অল-দীন সােল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন—‘বেটি, এই দেখ আমার নুর-অল-দীন-এর – স্বাক্ষর যুক্ত দলিল! উজির টাকার থলেটিতে এক হাজার সােনার মােহর দেখতে পেল। সে বণিকের দেওয়া স্বর্ণমুদ্রা এগুলাে। সে জাহাজ ক্রয়ের দলিল এটি, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে হাসান-অল-দীন-এর কাছ থেকে একটি জাহাজ ক্রয় করেছে বণিকটি। সবকিছু প্রমাণ পেয়ে ও দলিলটি পড়ে সামস্-অল-দীন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবার জোগাড় হলেন। কথা বলতে বলতে সে হঠাৎ বুক চাপড়ে কান্না জুড়ে দিল—“ভাইয়া, আমার ওপর অভিমান করে তুমি বিবাগী হয়ে ভিনদেশে পাড়ি দিয়েছিলে। জন্মের মত চলে গেলে। আজ তুমি আমাদের সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে!’ এবার লেড়কির দিকে ফিরে বললেন—বেটি হাসান বদর-অল-দীন তােমার চাচাতাে ভাইয়া। ওর সঙ্গেই তােমার শাদী হওয়ার কথা ছিল।
সামান্য খুবই তুচ্ছ একটি ব্যাপার নিয়ে আমাদের মধ্যে মতবিরােধ হয়েছিল। ব্যস তাতেই আমার ভাইয়া দেশ ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেল। যাক বেটি, আঠার বছর পর আমার বাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার কী যে আনন্দ হচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমি এক হাজার সােনার মােহর ওর কাছে বিয়ের যৌতুক হিসেবে চেয়েছিলাম, তাই সে রেখে গেছে।
উজির আর বৃথা কালক্ষয় না করে ব্যস্ত পায়ে সুলতানের দরবারে উপস্থিত হল। তুলােট কাগজটি তার হাতে দেয়। সবকিছু তার বর্ণনা করে। সবকিছু শুনে সুলতান একে আল্লাহর লীলা বলে মনে করেন।
উজির আবার ফিরে আসে মেয়ে হুসনর কাছে। কিন্তু তখনও হাসান ফিরে আসে না। এদিকে বেলা বাড়তে থাকে। উজির উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তবে কি চলে গেছে?
হুসন বলে, কিন্তু বাইরে সে যাবে কি করে আব্বাজান! ঘুম থেকে উঠে তাকে দেখতে না পেয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম। সে বাইরে কোথাও গেছে। কিন্তু দরজাগুলো সব যেমন বন্ধ করা হয়েছিলে-তেমনি বন্ধই ছিলো। আমি নিজে হাতে দরজাগুলো খুলেছি। তার খানিকবাদে তুমি এলে আমার কাছে।
উজির ভাবলো, এও আল্লাহরই এক লীলা। এর অর্থ উদ্ধার করা মানুষের কর্ম নয়।
এই সময়ে শাহরাজাদ দেখলো রাতের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।
তেইশতম রজনী। আবার কাহিনী শুরু হলো; শাহরাজাদ বললো, জাঁহাপনা, আপনার তো খেয়াল আছে নিশ্চয়ই, জাফর গল্প শোনাচ্ছে আর খলিফা মাঝে মাঝে তারিফ করে উঠছে।
উজির বুঝতে পারলো তার ভাইয়ের ছেলে-তার জামাত উধাও হয়ে গেছে। কবে ফিরবে: কে জানে। কিন্তু দুনিয়ার সব কিছু এতো দ্রুত বদলায় যে আজকের মানুষকে দু’বছর বাদে চেনা দায় হতে পারে। তাছাড়া কত রকমের ঠগ জোচ্চোর আছে—তাদের কত রকম ফন্দী, কে ধরতে পারে। একটিমাত্র রাত—তাও সারাক্ষণ নয়—তার মধ্যে কতটুকু সময়ই বা হুসন তাকে কাছে পেয়েছে? তাকে যদি সে পরে ঠিকঠাক চিনতে না পারে, দোষ দেওয়া যায় না। তাই শাদীর বাসর সজ্জা ভেঙে ফেলার আগে তার একটা নিখুঁত চিত্ব ফুটিয়ে তুলে বিস্তারিত বিবরণ লিখে রাখার সিদ্ধান্ত করলো। দোয়াত কলম নিয়ে একখানা তুলেটি কাগজে ঘরের খুঁটিনাটি সব জিনিসপত্রের হুবহু বৰ্ণনা লিখে নিতে লাগলো। কোনখানে মঞ্চ—কী ভাবে কী কী জিনিস দিয়ে তাকে সাজানো হয়েছিলো, ঘরের কোথায়, কোথায় ছিলো ঝাড়বাতি, কোথায় মোমবাতি, কোথায় ছিলো ফুলদানি, কোথায় ছিলো টেবিল, কোথায় কখানা চেয়ার ইত্যাদি সব বিবরণ লিখে গেলো। উজির। লেখা শেষে কাগজখানা ভাঁজ করে পাতলুন, টুপী, ইজের বটুয়া সব চাঁদরের সঙ্গে সিন্দুকে ভরে রাখলো। মেয়েকে বললো দরকার হলে কাগজখানা পড়ে দেখো, মা। কাজে লাগতে পারে।
সিৎ-অল যা ভেবেছিলো তাই। শাদীর প্রথম রাতেই সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলো। নয়মাস পরে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিলো সে। ছেলের বাবার মতো সেও অনিন্দ্যসুন্দর। ধাত্রী এসে বাচ্চাকে গোছল করিয়ে, কাজল পরিয়ে নাড়ী কেটে ধাইমার কোলে তুলে দিলো। নাম রাখা হলো আজীব–অর্থাৎ আজব, মানে চমৎকার।
যখন আজীবের বয়স সাত, কইরোর এক নাম করা মাদ্রাসায় ভর্তি করা হলো তাকে। প্রতিদিন সে সেজেগুজে দাদামশায়ের এক পুরোনো বিশ্বস্ত নফরের সঙ্গে মাদ্রাসায় যায়। দুপুর বেলায় খানা খেতে আসে। আবার ফিরে যায়। আসে। সেই বিকেলে। কিন্তু পাঁচটা বছর পরে মাদ্রাসার পাঠে ইতি করে ঘরে ফিরে আসতে হয় তাকে।
আজীব ভীষণ দুরন্ত ছিলো। তার সহপাঠীদের মানুষ বলেই গণ্য করতো না। সব সময় তার অহঙ্কার ভাব। সে উজিরের নাতি। কথায় কথায় সহপাঠীদের শুনিয়ে দিতে সে কথা। যাই হোক, এই ভাবে পাঁচ বছর কেটে গেলো। একদিন ছেলেরা দল বেঁধে মৌলভীর কাছে নালিশ করলো। মৌলভী সাহেব বড় সদাশয় ব্যক্তি। তিনিও পছন্দ করতেন না। আজীবের ডেপোমী। ছেলেদের শান্ত করে বললেন, তোমরা এখন চুপচাপ থাকে। কাল আমি এর বিধি ব্যবস্থা করবো। যাতে আর কখনও সে তোমাদের পিছনে না লাগে। কাল যখন তোমরা সবাই খেলার সময় এক জায়গায় জড়ো হবে, তোমাদের মধ্যে কেউ একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘আজ একটা ভারি মজার খেলা দেখাবো আমি। কিন্তু তার আগে তোমরা সবাই চেঁচিয়ে তোমাদের মা বাবার নাম বলবে-যাতে প্রত্যেকে শুনতে পায়। যদি কেউ তার মা বাবার নাম না বলতে পারে, তবে সে জারজ। তার সঙ্গে আমরা আর কখনও খেলবে না।’
পরদিন সকালে যথারীতি আজীব মাদ্রাসায় গিয়ে পৌঁছলো। খেলার সময় ছেলেরা তাকে ছেকে ধরে বললো—আজি আমরা একটা মজার খেলা খেলবো। কিন্তু তার আগে ভাই সবাইকে তার মা বাবার নাম বলতে হবে। যে বলতে পারবে না তাকে আমরা খেলায় নেবো না। কী, সবাই রাজি।
রাজি-রাজি-রাজি বলে সবাই সমস্বরে আওয়াজ তুললো।
–আচ্ছা তা হলে আরম্ভ করা যাক।
একটি ছেলে সামনে এগিয়ে এসে বললো, আমার নাম নবী, মার নাম নবীহাহী। আর আমার বাবার নাম ঈজ-আল-দীন। আর একজন এসে বললো, আমার নাম নাবীজ, আমার মায়ের নাম জামিলাহ, বাবার নাম মুসতাফা। এইভাবে একে একে প্রায় সকলেই সবার মা-বাবার নাম বলতে লাগলো। যখন আজীবের পালা এলো, গর্বভরে সামনে এসে বলতে লাগলো, আমার নাম আজীব, আমার মার নাম সিৎ-অল-হুসন আর আমার বাবা মিশরের উজির সামস-আল-দীন।
তৎক্ষণাৎ সব ছেলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠে।—দুয়ো দুয়ো, কিছু জানো না। তিনি তোমার বাবা কি করে হবেন?
আজীব ক্রুদ্ধ হয়।–তোমাদের ডাণ্ডা মেরে মাথা গুডিয়ে দেবো। উজিরই আমার বাবা।
ছেলেরা সবাই প্রতিবাদ করতে থাকে।–না না না। কিছু জানো না তুমি। উজির তোমার বাবা নন। তিনি তো তোমার মায়ের বাবা তোমার দাদু। দুয়ো, বাবার নাম বলতে পারে না। তোমার সঙ্গে আর কেউ খেলবো না।
ছেলেরা কেউ বা মাথায় টোকা মেরে পালায়, কেউবা জামা ধরে টানে আবার কেউ চিমটি কেটে চম্পট দেয়। আজীব এক অতোগুলো ছেলের টিটকিরিতে নাস্তানাবুদ হয়ে ওঠে। এক পাশে গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে থাকে, ব্যাপারটা কী?
মৌলভী সাহেব কাছে এসে সস্নেহে বলেন, ওরা ঠিক কথাই বলেছে, বাবা। উজির সাহেব তোমার বাবা নন। উনি তোমার দাদু হন। তুমিও জানো না—আমরাও জানি না তোমার/বাবা কে? সুলতান তোমার মার সঙ্গে এক কুঁজো বামনের শাদী দিয়েছিলেন। কিন্তু সে কখনও তোমার মার সঙ্গে সহবাস করেনি। সে অবশ্য গল্প বলে বেড়ায় শাদীর রাতে বাসরঘরের সব দরজা-জানলা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও নাকি জীন এসে তোমার মার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে গেছে। আচ্ছা তুমিই বলো, বাবা এসব গাঁজাখুরি গল্প না? সুতরাং তোমার সহপাঠীরা যা সব বলে ঠাট্টা বিদ্রহ্মপ করছে তা মোটেই অন্যায্য নয়। ওরা তোমাকে জারজ বলেছে, আমি শুনেছি। যার বাবার ঠিক নাই তাকেই তো আমরা জরজ বলি। সে দিক থেকে তারা তো কিছু অন্যায় বলেনি? রাস্তার একটা নামগোত্রহীন ক্রীতদাসকে আমরা অতো অবজ্ঞা অশ্রদ্ধা করি কেন? কারণ ওর মা-বাবার ঠিক নাই। তাই বলছি, বাবা দেমাকটা একটু কমাও, একটু নরম হয়ে মিলেমিশে চলো দেখবে সবাই তোমাকে ভালোবাসবে, মাথায় করে রাখবে।
আজীব কিন্তু মৌলভীর উপদেশে কর্ণপাত করলো না। মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হলো, তার মা-সিৎ-অল-হুসন-এর সামনে–মা, কে আমার বাবা। কী তার নাম? বলো।
ছেলের এই মূর্তি কখনও দেখেনি সে। চোখের জলে বুক ভেসে গেলো তার। বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, কে আবার, উজির তোমার বাবা।
—না না, মিথ্যে কথা। উজির সামস্-আল-দীন আমার বাবা না। সে তোমার বাবা। আমার বাবা কে বলো?
সিৎ-অল চুপ করে থাকে। উত্তর দিতে পারে না। আজীব কিন্তু নাছোড়বান্দা। চিৎকার করেবাড়ি ফাটিয়ে ফেলে, বলবে কিনা বলো? যদি না বলো, এক্ষুণি আমি তারোয়াল দিয়ে গলা কেটে ফেলবো। আমার।
সিৎ-অল আঁতকে ওঠে।-না না, বাবা, না। অমন কথা মুখে এনে না। বলছি, তোমার বাবার কথা বলছি, শোনো।
মা যত কাঁদে ছেলে আরও বেশী কাঁদে। হুসনর প্রাণ হুহু করে যায়। আজ বারোটা বছর তুষের আগুন জুলছে তার বুকে। মুখ ফুটে বলতে পারে না কাউকে। আজ পেটের সন্তান আজীবকে বুকে জড়িয়ে ধরে, তার দুঃখের কাহিনীর কিছুটা বলতে পেরে, ভার কিছুটা লাঘব হয়।
উজির-এর কাছে খবর পৌঁছয়, আজীব অশান্ত হয়ে উঠেছে। সে তার জন্ম পরিচয় জানতে চায়। তাড়াতাডি ছুটে আসে হুসনর মহলে। দেখে মা বেটা দুজনে আকুল নয়নে কেঁদে চলেছে।
—কী হয়েছে মা, তোমরা কাঁদছো কেন?
হুসন বললো, আজ মাদ্রাসা থেকে ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, ‘মা আমার বাবা কে? আমি কী উত্তর দেবো, আব্বাজান? মাদ্রাসার ছেলেরা তাকে অনেক মন্দ কথা বলেছে। তাই বোধহয় ওর মনে আঘাত লেগে থাকবে।
নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে উজির বলতে থাকে, সেই সব অতীত কাহিনী। তার ছোট ভাই নূর-আল-দীন কী কারণে দেশত্যাগী হয় এবং বসরা হয় গিয়ে কবে সে সেখানকার উজিরের কন্যাকে শাদী করে। তারপর হাসানের জন্ম, নূর-এর লোকান্তর এবং শাদীর রাতে হাসানের অলৌকিক আবির্ভােব এবং শাদীর রাত শেষে তার রহস্যজনক অন্তর্ধান-সব সবিস্তারে বর্ণনা করলে সে। অবাক বিস্ময়ে শুনতে থাকে আজীব।
—আমার বাবা কবে ফিরে আসবে, দাদু?
উজির এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কান্নায় ভেঙে পড়ে-তা তো বলতে পারবো না ভাই। চলো আমরা বসরাহ-য় যাই। তাকে খুঁজে নিয়ে আসি।
উজির সুলতান সমীপে হাজির হয়ে নিবেদন করলো সব বৃত্তান্ত।
—হজুর, এ ধরনের গুঞ্জন বে-ইজতের ব্যাপার। এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যেতে পারে না। একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার।
সুলতান বললো, এক কাজ করো, উজির। কিছুদিনের জন্য ছুটি দিচ্ছি। তোমাকে। যাও, একবার খোঁজ করে দেখে এসো তাকে। আমার মনে হয়, বসরাহতেই বা তার কাছাকাছি কোথাও আছে সে। আমি তার নামে হুলিয়া করে দিচ্ছি। আমার হুলিয়া সঙ্গে থাকলে যে কোন দেশের সুলতান তোমাকে তার সন্ধান দেবার সাধ্যমতো ব্যবস্থা করবে। এবং যেখানে খুশি তুমি যেতেও পারবে।
সুলতানের বদ্যান্যতায় মহা খুশি হলো উজির। আভুমি আনত হয়ে কুর্নিশ করে দরবার থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। হুসন ও আজীবকে সঙ্গে নিয়ে সেই দিনই বসরোহর পথে বেরিয়ে পড়লো। অনেকদিন পরে তারা এসে পৌঁছলো দামাসকাস শহরে। কাইরো থেকে দামাসকাস। ‘. . যতোটা পথ দামাসকাস থেকে বাসরাহও ততোটা। এখনও অর্ধেক বাকী। পথের ক্লান্তি কাটাবার জন্য সেখানে দু’টো দিন বিশ্রামের সিদ্ধান্ত করে উজির। শহরের প্রবেশ তোরণের সামনে তাবু গাড়লো সে।
উজিরের সঙ্গে যতো নফর চাকর এসেছিলো সবাই দামাসকাস দেখার জন্য ব্যাকুল হলো। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে শহর পরিক্রম শুরু করলো উজির। সেখানাকর নানারকম মনোহারী জিনিসপত্র সওদা করলো ওরা। নিজেদের দেশের কিছু কিছু বাহারী জিনিস বিক্রিও করলো কেউ কেউ। শহরের বনেদী হামাম-এ গোছল করলো। ওখানকার বহুপ্রাচীন মসজিদ উম্যাদ-এ নামাজ পড়লো। লোকে বলে দোমাস্কাসের এই মসজিদ দুনিয়ার সেরা। এতো প্রাচীন, এতো বিশাল মসজিদ নাকি আর কোথাও নাই।
সবাই যখন এই সব করছে, আজীব তখন শহরের পথে পথে নানা রঙের মজার মজার জিনিসের সন্ধান করে চলেছে। উজিরের পুরাতন ভূত্য খোজা সাইদ রয়েছে তার পাশে পাশে। তার হাতে একখানা লম্বা লাঠি।
দামাস্কাসের দামাল ছেলেরা আজীবের পিছনে পিছনে ধাওয়া করে। এমন খুবসুরৎ লোড়কা জীবনে দেখেনি। তারা। কিন্তু আজীবের বা সাইদের এসব ভালো লাগে না। একটু স্বচ্ছন্দে পথ চলার যো নাই। সাইদ লাঠি উচিয়ে ভয় দেখায়—’হট যাও, হট যাও হিঁয়াসে!’ কিন্তু ভিড় আরো বাড়তেই থাকে। শুধু ছেলেরাই না, শহরের হাজার হাজার মেয়েপুরুষ দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। আজীবের অসাধারণ রূপের কথা চাউর হয়ে গেছে সারা শহরে। কেউ বলে, এমন রূপের বাহার কোন মানুষের হয় না। নিশ্চয়ই কোন বেহেস্তের দূত মাটিতে নেমে এসেছে। আবার কেউ বলে আসমানের শুকতারার মতো আলো ঠিকরে পড়ছে তার শরীর থেকে।
ভিড় ক্রমশই বাড়তে থাকে। জনতার চাপে আজীবের দেহে আঘাত লাগতে পারে আশঙ্কায় সাইদ চিৎকার করে ওঠে। —কী; হচ্ছে কি? তোমরা কি ছেলেটাকে পিষে মেরে ফেলবে নাকি? এতো দেখবার কি আছে? আসমানের চাঁদ মাটিতে নেমে এসেছে বুঝি। যত্তোসব.
কিন্তু কেউ তার কথায় কৰ্ণপাত করে না। সাইদ তখন লাঠি নিয়ে তাড়া করে। কিন্তু এভাবে আর কঁহাতক পারা যায়। দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ওঠে। এইভাবে ওরা এক সময় এক খাবার-এর দোকানের সামনে এসে পড়ে। সাইদ ভাবে, জনতার হাত থেকে রক্ষা পেতে গেলে দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়া ছাড়া বোধহয় আর গতি নাই।
এই খাবারের দোকানের সঙ্গে আপনাদের একবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। হাসান বদর-আল-দীন একদিন চেংড়া ছোঁড়াদের তাড়া খেয়ে এই দোকানেই আশ্রয় নিয়েছিলো। তারপর থেকে সে আর এ দোকান থেকে চলে যায়নি। দোকানের মালিক তাকে আদর করে। আশ্রয় দিয়েছিলো। পরে তাকে নিজের ছেলের মর্যাদায় দোকানের কাজে বসিয়ে তার হাতেই চাবি তুলে দেয়। আজ বারো বৎসর এই দোকানেই আটকে পড়ে আছে হাসান। মালিক আজ তিন বছর হলো দেহ রক্ষা করেছে। এখন সেই পুরোপুরি মালিক। সে-দিন নানারকম খাবারের মধ্যে একটা খুব মুখোরোচক খাবার বানিয়েছিলো সে। বেদোনার হালওয়া। সারা দামাসকাস শহরের আর কোন দোকানে এ খাবার পাওয়া যায় না। দামাসকাস শহরেই বা বলি কেন, তামাম দুনিয়ার কেউ এ খাবার বানাতে পারবে না। শুধু একজন ছাড়া। সে তার মা। ছোটবেলায় প্রায়ই সে এই হালওয়া তৈরি করে খাওয়াতো তাদের। মা-র কাছ থেকেই তার শেখা।
আজীবকে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসানের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে তার নিখুঁত চেহারা-রূপ। এ ছেলে তো কোনো সাধারণ ঘরের না।–খোকা ভেতরে এসো, না! এসো, ভেতরে এসে বসে। তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে! তোমার চাঁদের মতো সুরৎ দেখে আমার কেমন যেনো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোথায় যেনো তোমাকে দেখেছি, বাবা। কিছুতেই মনে করতে পারছি নে। অথচ মনে হয়, খুবই চেনা, খুবই আপনার। ভেতরে এসে বসো, বাবা। তোমাকে একটু মিষ্টি-মুখ করাতে চাই। আমি নিজে হাতে বানিয়েছি।
হাসানের কথা শুনে আজীবের ভালো লাগে। সাইদের দিকে চেয়ে বলে, দেখো, বাবা-সাইদ, মনে হয়, লোকটা বড় দুঃখী। বোধহয় আমার মতো একটা ছেলে ছিলো তার। হয়তো বা সে বেঁচে নেই। অথবা থাকলেও তার কাছে নেই। চলো লোকটা যখন অতো করে ডাকছে ভেতরে গিয়ে বসি। সে যেমন তার ছেলের জন্যে পাগল আমিও তো তেমনি আমার বাবাকে খুঁজতেই পথে বেরিয়েছি। তার কথা শুনলে আল্লাহ খুশি হবেন। তিনি হয়তো আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেবেন।
কিন্তু সাইদ সঙ্গে সঙ্গে না না করে ওঠে। ওরে সব্বোনাশ উজিরের ছেলে হয়ে তুমি এই বাজারের দোকানের খাবার খাবে, তা ককখনো হয় না। উজির জানতে পারলে আমার গলা কেটে ফেলবে। তোমার কিছু ভয় নাই। তোমাকে এই লোকগুলো যারা ঘিরে ধরেছে তাদের আমি এক্ষুণি লাঠি-পেটা করে ভাগিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু তাই বলে তুমি দোকানের ভিতরে গিয়ে বসবে।–তা হতে পারে না। তোমার কত মান ইজ্জত। উজিরের ছেলে তুমি। একটু তুচ্ছ মেঠাইওলার দোকানে বসে যা তা খাবে, তা হয় না।
সাইদের কথা সবই শুনতে পায় হাসান। চোখে ভরে আসে জল। কাকুতি মিনতি করে বলে, মেহেরবানী করে একটিবার আমার দোকানে তোমার পায়ের তুলে দাও, মালিক-। আমি মনে একটু শান্তি পাবো। আমাকে এইটুকু অনুগ্রহ করো, বাবা। আল্লাহ তোমাকে সুখে রাখবেন। তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করবেন।
সাইদ বলে, সে হয় না দেকানি। আমার মালিক তোমার দোকানে বসে বারোজনে যা খায়। সে জিনিস খেতে পারে না। কত বড় ঘরের ছেলে সে। তার বনেদীয়ানা নষ্ট হয়ে যাবে, না!
হাসান এবার সাইদের মন ভিজাতে বলে, তোমার বাইরেটা বুনো নারকেলের মতো অতো শক্ত হলে কি হবে, আমি বুঝেছি, ভেতরটা ধবধবে সাদা মিষ্টি শাসে ভরা।
হাসানের কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো ঝুনো নারকেল সাইদ।-আচ্ছা! তাই নাকি? :, বেশ মজার কথা বলতে জানো তো!
হাসান যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। বাদশাহ সুলেমানের সমস্ত সঞ্চিত ধনরত্ন হাতের মুঠোয় পেলেও এতো আনন্দ হতো না তার। অপলক নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে আজীবকে। দেখে দেখে যেনো আর আশ মেটে না।
দু’খানা তামার রেকবী করে বেশ খানিকটা বেদনার হালওয়া এনে রাখলো আজীবের সামনে! —আজ আমার বড় আনন্দের দিন, তোমাকে মিষ্টিমুখ করাতে পারছি। আজকের দিনটা আমার চিরকাল মনে থাকবে, বাবা। যতো দিন বাঁচবো।
আজীব আর সাইদ প্রাণভরে তৃপ্তি করে খেলো। বেদানার দানাগুলোর সঙ্গে চিনি, দুধ, বাদাম, পেস্তা, মনাক্কা এবং আরও অনেক কিছু দিয়ে তৈরি এই বেদানার হালওয়া। এমন সুন্দর মিষ্টি গন্ধ-সারা দোকান ঘরটা ভরপুর হয়ে গেছে। সবটুকু চেটেপুটে খেলো দুজনে। আজীব মহা খুশি। বাঃ বেড়ে মজার জিনিস। আমাদের হালুইকররা তো বানাতে পারে না, বাবা-সাইদ?
সাইদ বলে, আমি বুড়ো হয়ে মরতে চলেছি। অনেক সুলতান বাদশাহর নেমস্তন্ন খেতেও গেছি তোমার দাদুর সঙ্গে। কিন্তু কই, কোথাও তো এমন খাবারের নামও শুনিনি কখনও!
খাওয়াদাওয়া শেষ করে আজীব বললো, বড় চমৎকার তোমার হালওয়া দোকানি। তা তুমি নিজে একটু খাও। সারা দিন রাত শুধু খেটেই চলেছে, একটু বসো আমাদের পাশে, গল্প করি।
হাসান পিস্তার বরাকী বানাচ্ছিলো। হাতটা ধুয়ে এসে আজীবের পাশে বসলো।—ঠিক আছে আজ আর কোন কাজ নয়, বলো, আজ তোমার কথাই শুনবে শুধু!
আজীব বললো, জানো আমিও বড় দুঃখী। আমার বাবা কোথায় চলে গেছে সেই কবে, আর ফেরেনি। আমি আমার মা আর দাদু দেশে দেশে খুঁজে বেড়াচ্ছি তাকে। হয়তো এমনি করে খুঁজতে খুঁজতে সারা দুনিয়াটাই ঘুরে বেড়াতে হবে। জানি না, খোদার কি ইচ্ছা! তুমিও একটু আল্লাহর কাছে দেয়া মাঙ্গো না, দোকানি। আমার বাবাকে যেনো আমরা তাড়াতাডি খুঁজে পাই। আজীবের চোখে জল এলো। হাসানও রুদ্ধ করতে পারে না তার অশ্রু। এই দশা দেখে সাইদের বুকটা টনটন করে ওঠে। ভাবে, শুধু মেঠাই মণ্ডাতে পেট ভরলেও প্ৰাণ ভরে না।
যাইহোক, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর নয়, এবার তারা উঠে পড়ে তাবুর পথে রওনা হয়ে পড়ে।
আজীব চলে যেতেই হাসানের প্রাণ হাহাকার করে ওঠে। সব যেন কেমন ফাঁকা শূন্য হয়ে যায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে। চটপট দোকানের বাঁপ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দামাসকাসের প্রধান তোরণ দ্বারের কাছে চলে আসে। সামনে অদূরে দেখতে পেলে ওরা দুজনে চলেছে। চলার গতি মন্থর করে ওদের পিছনে পিছনে অনুসরণ করতে থাকে। হাসানের কিন্তু কখনও মনে হয়নি, আজীব তার নিজের ঔরসের সন্তান।
সাইদের সন্দেহ হয়, কে যেন তাদের পিছন পিছন ধাওয়া করে আসছে। হঠাৎ পিছন ফিরে দু’পা পিছিয়ে এসে হাসানকে প্রশ্ন করে, আমাদের পিছনে পিছনে আসছে। কেন, তুমি? কী মতলব তোমার?
হাসান বলে, শহরের বাইরের একটু কাজে যাচ্ছি। তা তোমরাও এই পথে যাচ্ছে দেখে একটু পা চলিয়ে কাছে এলাম। একই যখন পথ, একটু গল্পসল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।
সাইদ কিন্তু ক্ষেপে গেলো তার কথায়—তুমি কি ভেবেছো একটু হালওয়া খাইয়ে আমাদের মাথা কিনে নিয়েছে? মনে হচ্ছে, এখনি বমি করে দিই।
কিন্তু আজীব দেখলো, সাইদের এই কথায় হাসানের মুখা কালো হয়ে গেলো! বললো, তা আসুক না, কি হয়েছে? খোদার তৈরি পথে সব সাচ্চা মুসলমানেরই সমান অধিকার। ওর পথে ও চলবে, আমাদের কি ক্ষতি? তবে যদি সে আমাদের তীবুর দিকেও যেতে থাকে তা হলে মজা টের পাইয়ে দেবো বাছাধনকে।
প্রধান তোরণ দ্বার পর হয়ে ওরা হাসাবার দিকে পা বাড়ালো। হাসাবার সমতলে তাবু গেড়েছে ওরা। হাসানও বঁদিকে বেঁকে ওদের পিছু নিলো। এবার আজীব রেগে আগুন। তা হলে তো সাইদ ঠিকই বলেছে। লোকটার মতলব খারাপ। একটা পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুঁড়ে মারলো হাসানকে। অব্যৰ্থ লক্ষ্য। পাথরটা গিয়ে আঘাত করলা হাসানের কপালে। আর সঙ্গে সঙ্গে হাত চেপে বসে পড়লো পথের উপর। রক্তে ভেসে যেতে লাগলো। ওর সারা মুখ। আজীবের হাত ধরে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে তাঁবুতে এসে পৌঁছলো সাইদ।
নিজের হঠকারিতার জন্যে নিজেকেই দোষারোপ করতে লাগলো হাসান। কেন-বা সে তার দোকান বন্ধ করে তাদের পিছু ধাওয়া করতে গেলো। ওরা তো তাকে বারণ করেছিলো। সে তো তা শুনলো না, মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে তাদের পিছু নিলো কেন? ফিরে এসে আবার দোকান খুলে বেচাকেনা করতে লাগলো হাসান। আজ তার মা-র একটা কথা বারবার মনের মধ্যে নাড়া দিতে লাগলো। নিয়তি কখনো এড়ানো যায় না।
দুদিন দামাসকাসে কাটাবার পর তৃতীয় দিনের শেষে তাঁবুগুটিয়ে আবার বসরোহর পথে যাত্রা করলো সামস-আল-দীন। চলার পথে হীম, হামাহ, আলেপ্পো, দিয়ার, বাকর, মরিদীন, মসুল প্রভৃতি নানা ছোট বড় গ্রাম-শহর পেরিয়ে চললো। অবশেষে একদিন বসরা হয় এসে পৌঁছলো তারা।
সব আগে গিয়ে উঠলো সুলতানের দরবারে। যথাযোগ্য শাহী কায়দায় কুর্নিশ জানিয়ে নিজের পরিচয় দিলো সুলতানের কাছে।
—আপনার পূর্বতন উজির নূর-আল-দীনের বড়ভাই আমি। মিশরের উজির পদে বহাল আছি।
সুলতানও খুব খাতির যত্ন করে বসালে তাকে। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলো। বললো, নূর-আল-দীন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আমি তার কথা আজও ভুলতে পারি না। সে আমার বড় প্রিয় ছিলো। তার কাজে কামে, আচারে ব্যবহারে আমি কেন, আমার সালতানিয়তের প্রতিটি মানুষ মুগ্ধ ছিলো। তার মতো মানুষ লাখে একটা মেলে। আর তার হীরের টুকরো ছেলে-হাসান, সে আমার চোখের মণি ছিলো। তাকেও হারিয়েছি। আমি আজ তেরো বছর। কোথায় যে চলে গেলো-কেউ বলতে পারে না। তার মা—নূর-আল-দীনের বিধবা বিবি এখনও এই বসরাহতেই পড়ে রয়েছে। ছেলের প্রতীক্ষায়। যদি কখনও সে ফিরে আসে—সেই আশায়। নূর-আল-এর শ্বশুরও বিচক্ষণ উজির ছিলো আমার দরবারে। অনেক আগেই সে দেহ রক্ষা করেছে।
হাসানের মা-র কথা শুনে তাকে দেখার জন্য ব্যগ্র হলো সামস-আল-দীন। লোকজন সঙ্গে দিয়ে সামস-আল-দীনকে হাসানের মা-র কাছে পৌঁছে দিলো সুলতান।
প্রশস্ত প্রাঙ্গণ পেরিয়ে নূর-এর প্রাসাদোপম বিরাট ইমারাৎ। নানা বিচিত্র রঙের মারবেল পাথরে তৈরি। সদর দরজায় ঢুকতেই সোনার ফলকে উৎকীর্ণ করা নূর-আল-দীনের নামের ফলক চোখে পড়লো। সামস-আল-দীন নামটার উপর হাত বুলিয়ে কি যেন অনুভব করলো। চোখ জলে ভরে এলো।
চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করলো সামস-আল-দীন। হাসানের মা-র রুদ্ধদ্বারে করাঘাত করতে খুলে গেলো। হাসান উধাও হওয়ার দীন থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে শোকানলে জুলছে সে। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা তাজিয়া সাজিয়ে রেখেছে। তার ধারণা, হাসান-তার আদরের দুলাল আর বেঁচে নাই। তাই তার স্মৃতি হিসাবে এই তাজিয়াটা তৈরি করিয়েছে। সারা দিন রাত তাজিয়াটার সামনে বসে ছেলের কথা ভাবে সে।
হাসানের মা-র এই শোকগাথা শুনে দরজার সামনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সামস-আল-দীন। একটু পরে হাসানের মা উঠে এসে স্বাগত জানায়। ভিতরে এসে বসে সামস-আল-দীন। প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে পরে আগাগোড়া সমস্ত কাহিনী সবিস্তারে বললো তাকে। কীভাবে তার কন্যার শাদীর রাতে সে বাসর ঘরে ঢোকে, কীভাবে তার সঙ্গে শাদী হয়। এবং কীভাবে তার সঙ্গে রাত্ৰিবাস করে সকাল হওয়ার আগেই রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধান হয়—সব কাহিনী। তারপর আজীবকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই নাও তোমার নাতি—আমার নাতি। এই-ই এখন আমাদের একমাত্র শুকতারা। একে বুকে জড়িয়ে মনের শোকতাপ কিছুটা হাল্কা করো।
সামস-আল-দীনের কথায় বুঝলো তার ছেলে হাসান তাহলে বেঁচেই আছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে। তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে।
আজীব এগিয়ে এসে দাদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েকাঁদতে থাকে। সামস-আল-দীন বলে, এখন তো। কান্নার সময় নয়, মা। অনেক কাজ বাকী আমাদের। নাও, তৈরি হয়ে নাও, আর দেরি না, এখুনি আমরা রওনা হয়ে যাবো মিশরের পথে। হাসানকে খুঁজে বের করতেই হবে।
হাসানের মা চটপট তৈরি হয়ে নিলো। সামান-পত্ব বাধা-ছাঁদা হয়ে গেলো। পথের খানাপিনা যোগাড় যন্তর করলো। জনকয়েক নফরদাসী নিয়ে সামস্-অল-দীনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো পথে।
বাসরাহ ত্যাগ করার আগে সুলতানের কাছে বিদায় নিতে গেলো তারা। নানারকম সুন্দর সুন্দর বাহারী জিনিস উপহার দিলো সুলতান। মিশনের সুলতানের জন্যেও দিলো আরও অনেক মূল্যবান উপটৌকন। এর পর আজীব, হুসন, হাসানের মা আর নফরচাকিরদের সঙ্গে নিয়ে বাসরাহ ছেড়ে ফিরে চললো সামস্-আল-দীন।
কয়েকদিন পরে আবার তারা এসে পৌঁছলো দামাসকাসে। দু’একদিন একটু জিরিয়ে নেবার জন্যে আবার তারা তাঁবু গাড়লো ঐ একই জায়গায়। সামস-আল-দীন বললো, এখানে কয়েকটা দিন থাকবো আমরা। সুলতানের জন্যে কিছু কেনাকাটা করবো। এখানকার বাজারে।
পরদিন উজির গেলো বাজারে—সওদাগরী দোকানে। আজীব তখন আব্দার ধরলো, বাবা সাইদ চলো আমরা শহরে এদিক ওদিক একটু ঘুরে আসি। মজার মজার কত কি দেখা যাবে। তা ছাড়া ওই হালুইকর লোকটা কেমন আছে তাও একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। আহা, লোকটাকে সেদিন অমন করে ঘায়েল না করলেই হতো। কি সুন্দর মেঠাই খেতে দিয়েছিলো আমাদের।
সাইদ বললো, যা বলবে, মালিক।
আজীব আর সাইদ দামাসকাসের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে। কত সুন্দর সুন্দর সাজানো গোছানো দোকানপাট কত মজার মজার উট, গাধা, আর ঘোড়ার মিছিল। সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। সূর্য পাটে বসেছে। দেখলো দলে দলে মুসলমানরা চলেছে বানু য়ুমায়াদ মসজিদে সন্ধ্যাকালীন নামাজ পড়তে। আজীবের চিনতে অসুবিধা হলো না, সেই হালুইকরের দোকানের সামনে এসে পড়েছে তারা। দোকানের বাইরে থেকেই দেখতে পেলো, আজও সে সেই বেদনার হালওয়া বানিয়েছে। খুশবুতে ভরে গেছে চারপাশ। দোকানের ভিতর উকি দিয়ে দেখলো দোকানি আছে কিনা। তার মাথার ঘাটা শুকিয়েছে কিনা, তাও একবার দেখতে চায় সে। দেখলো, ঘা শুকিয়েছে কিন্তু দাগটা মিলায়নি।
-কেমন আছো গো, হালুইকর। সারাটা পথ তোমার কথাই ভাবতে ভাবতে আসছি। আমাকে চিনতে পারছে তো! আহা, সেদিন জব্বর লেগেছিলো তোমার।
হঠাৎ আজীবকে সামনে দেখে হাসান কেমন হতভম্ব হয়ে পড়ে। জল ভর্তি গামলাটা হাত থেকে পড়ে যায়। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। মাথাটা বঁই বঁই করে ঘুরতে থাকে। জীভটা কেমন আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। কী যেন বলতে গিয়েও বলতে পারে না। মুহুর্তমাত্র। তার পরে নিজেকে সংযত করে বলে, ভিতরে এসো, মালিক। যদি মেহেরবানী করে আজকেও একটু মিষ্টি-মুখ করো খুব খুশি হবো। আল্লাহ জানেন কেন, সেদিন তোমাকে দেখা অবধি দিন রজনী তোমার কথা মন থেকে সরাতে পারি না। কী যাদু আছে তোমার ঐ চোখে। ঘুমের ঘোরেও তোমার ঐ চোখ দু’টো ভেসে ওঠে আমার সামনে। তোমাদের পিছু ধাওয়া করা আমার খুব বোকামী হয়ে গিয়েছিলো। স্ত্ৰে জন্যে পরে আমাকে অনেক অনুতাপও করতে হয়েছে।
আজীব বলে, তুমি তো ভারি সাংঘাতিক লোক! আদর করে ডেকে মেঠাইমণ্ডা খাইয়ে আবার আমাদের জানে ভয় ধরানোর জন্যে পিছু ধাওয়া করেছিলে! কিন্তু কেন? আজ আর তোমার দোকানে ঢুকবো না। আগে হলফ করো আমাদের পিছু নেবে না, তবে তোমার হালওয়া খেতে পারি। না হলে আর ককখনো আসবো না তোমার দোকানে। আমরা এবার এক হাপ্ত থাকবো দামাসকাসে। আমার দাদু সুলতানকে ভেট দেবার জন্যে হরেক রকম বাহারী সওদা করবে।
—আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, বাছা। আর কখনও তোমাদের পিছু নেবো না। এসো ভিতরে এসো।
আজীব আর সাইদ খুব মৌজ করে খেতে থাকলো সুন্দর মিষ্টি আর মধুর সেই বেদানার হালওয়া। আজীব বললো, ও হালুইকর, কই তুমিও এসো, তুমিও খাও আমাদের সঙ্গে। আল্লাহর কাছে দেয়া মাঙ্গো, যাতে আমার বাবাকে খুঁজে পাই।
হাসান ওদের সামনে এসে বসলো; অপালক ভাবে আজীবকে দেখতে থাকে। কোন কথা বলতে পারে না। তার একভাবে চেয়ে থাকার ভঙ্গটা ভালো লাগে না আজীবের। একটু বিরক্ত হয়েই বলে, হাঁ করে কি আমন দেখছো, বলে তো। আমার মুখে কি বেদনার হালওয়া মাখানো আছে~~ চেটে চেটে খাচ্ছে? দোহাই বাপু, তোমার চোখ দুটো সরাও। গিলে খাবে নাকি আমার মুখটা।
হাসান হাসে। রাগ করে না।
এছাড়াও হাসান আরও সুন্দর সুন্দর ছড়া, শায়ের শোনাতে লাগলো। আজীব আর সাইদকে। কথা আর কবিতায় ভুলিয়ে রাখলে তাদের খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরেও প্রায় এক ঘণ্টা। তারা বুঝতেই পারে না, কিভাবে এতোটা সময় কেটে যায়। মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে দুজনে। একটা বাটিতে ঈষৎ গরম জল এনে নিজে হাতে আজীবের হাত ধুইয়ে দেয়। তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দেয় হাত আর মুখ। কুলুঙ্গী থেকে গুলাবজলের পিচকারীটা নামিয়ে এনে পিচকারী করে দেয় তার গায়ে। তারপর দু’ গ্লাস সরবত এনে সামনে রাখে।–নাও, খাও।
সুন্দর সুমিষ্ট গুলাবের সরবৎ। খেয়ে মন ভরে যায় দুজনের। খাওয়াদাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে তারা, অনেক দেরি হয়ে গেছে।
তাঁবুতে ফিরে দেখে মা দাদী সবাই চিন্তিত হয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে। বিদেশ বিভূঁই জায়গা-কি জানি কি হয়। আজীব ছুটে গিয়ে প্রথমে মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। তারপর দাদীকে। দাদী তো কেঁদে আকুল। বলে, এতক্ষণ কোথায় ছিলি, ভাই?
—বাজারে দাদী।
—তবে তো খিদে পেয়েছে খুব। আয়, খেতে দিই।
উঠে গিয়ে একটা সুদৃশ্য চীনামাটির পিরিচে করে খানিকটা বেদানার হালওয়া এনে রাখে আজীবের সামনে। বসরাহতে প্রায়ই করে খাওয়াতো সবাইকে। খেয়ে সবাই তারিফ করতো তাকে। এমন সুন্দর মেঠাই শহরের কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যেতো না। বানাতে পারতো না কেউ। হাসানের মারি এটা নিজস্ব আবিষ্কার বলা যায়। সাইদকেও বলে, তুমিও তোমার মনিবের সঙ্গে বসে যাও, খেয়ে দেখো, আমার তৈরি বেদনার হালওয়া কেমন লাগে। তোমাদের মিশরে কেন, দুনিয়ার কোথাও কেউ বানাতে পারবে না এ জিনিস।
হতভাগ্য খোজা সাইদ হাসতে চেষ্টা করে।–জী আজ্ঞে এখন দেবেন না। হুজুরের সঙ্গে বসে খাবো, তাকি হয়?
আজীব খানিকটা হালওয়া মুখে পুরে এগাল ওগাল করতে থাকে। কিন্তু বিচ্ছিরি স্বাদ। চিনি কম, খুশবু নাই। কেমন এক অদ্ভুতভাবে মুখবাদান করে আজীব বলে, এ কেমন হালওয়া, দাদী, একদম ভালো হয়নি।
-কী বলছিস, দাদু। আমি বানাতে জানি না? এক সময়ে এই বেদানার হালওয়া খেয়ে তোর বাবা কি তারিফ করতো। কেমন করে কি কি মসলাপাতি দিয়ে আমি বানাই-সব শিখে নিয়েছিলো আমার কাছে। পরে আমাকে করেও খাওয়াতো মাঝে মাঝে। তা আমার চেয়ে খারাপ হতো না। তাই বলে আমার হালওয়ার নিন্দে তো শুনিনি তার কাছে। তুই তার ব্যাটা হয়ে আমার নিন্দে করছিস আজ?
আল্লা সাক্ষী, দাদামা, আমি কোন বানিয়ে বলছি না। সত্যিই তোমার মেঠোঁই-এ মিষ্টি কম হয়েছে। আর সেই খুশবু কোথায়—নাকে লাগলেই জিভে জল আসে? তাহলে তোমাকে সত্যি কথাটা বলেই ফেলি, দাদী। কিন্তু খবরদার মা আর দাদু যেনো জানতে না পারে। তাহলে একেবারে কোতল করে ফেলবে। আমি আর বাবা-সাইদ এইমাত্র বাজারের একটা হালুইকরের দোকানে খেয়ে এসেছি। এই বেদানার হালওয়া। এই—সা চমৎকার খেতে, কী বলবো তোমাকে। গন্ধ পেলে মরা মানুষ উঠে বসে খাবে। এখনো মুখে লেগে আছে তার স্বাদ। তাই তোমারটা আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, ওর কাছে একেবারে পানসে। তুমি বোধ হয়, ঠিক ঠিক মশালা-পাতি যা লাগে, দিতে পারেনি।
তখন দাদীমা রেগে আগুন হয়ে সাইদকে বললো…
এই সময় প্রায় সকাল হয়ে যাচ্ছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
দুনিয়াজাদ বললো, তোমার বলার কি মিষ্টি কায়দা, দিদি! আর কী করেই বা বলো এমন সুন্দর কিসসা।
শাহরাজাদ বলে, এখনো তো গল্পটা শেষ হয়নি। কাল রাতে বাকীটা যখন শুনবে, আরও ভালো লাগবে। নাও, এখন ঘুমিয়ে পড়ে।
শারিয়ার ভাবে, মেয়েটার গল্পগুলো সব শুনতে হবে। তারপর ওকে মারবো। তারপর দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে ওরা। দরবারের সময় হলে উঠে শাহজাদার সাজে-সজ্জিত হয়ে দরবারে যায়। এক এক করে হকুমতের সব কাজ সমাধা করে দিনের শেষে আবার অন্দর মহলে ফিরে আসে শারিয়ার। রক্তে ধরেছে গল্প শোনার নেশা। শাহরাজাদও প্রতীক্ষায় ছিলো তারই।
চব্বিশতম রজনী। ওদের দৈনন্দিন কাম কলা শেষ হবার পর নিচের কাপেট থেকে উঠে আসে দুনিয়াজাদ। বলে, এবার তোমার কাহিনী শোনাও, দিদি।
শাহরাজাদ বলতে থাকে : শুনুন, জাঁহাপনা, তখন আজীবের দাদীমা আগুন হয়ে সাইদকে বললো, হতভাগা কোথাকার এই ভাবে ছেলেটার সর্বনাশ করেছে? এতো বড় স্পর্ধা তোমার কি করে হলো, একটা তুচ্ছ হালুইকরের দোকানে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়েছিলে তাকে। মান ইজ্জত কিছুই গ্রাহ্য করেনি। এতো বড়ো শয়তান তুমি।
সাইদ বেমালুম অস্বীকার করে। —না দাদীমা, ওর কথা ধরবেন না। হালুইকরের দোকানে যাইনি। আমরা দোকানটার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছি শুধু।
কিন্তু হাঁদা গঙ্গারাম আজীব এর গুঢ়াৰ্থ বুঝলো না। চিৎকার করে তাবু মাথায় করলো। —হেই আল্লাহ, কি বলে শোনো, আমরা বলে যাইনি দোকানে। আমরা দোকানে বসলাম। দোকানী কত আদর করে বেদানার হালওয়া খেতে দিলো। আমি খেলাম, তুমিও খেলে। আবার বলে দোকানে যাই-ই নি। একেবারে সব ভুলে মেরে দিয়েছে? তোমার মাথাটা একেবারেই গেছে বাবা-সাইদ। হেকিম দেখাও। দাদীমা ওর কথা শুনো না, আমরা সত্যিই গিয়েছিলাম। আর পেট পুরে খেয়েছিও দুজনে।। আঃ, কী সুন্দর হালওয়া দাদী, কী তার বাস, আর কী তার স্বাদ। গন্ধেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়।
হাসানের মা এবারে উজিরের কাছে ছুটে যায়। নালিশ জানায়, ঐ কালো কুৎসিৎ খোজটা কি সাংঘাতিক কাণ্ড করেছে, আপনি একবার শুনুন।
হাসানের মার কাছ থেকে সব শোনার পর উত্তেজিত হয়ে সাইদকে ডেকে পাঠায় উজির। উইিকেত যা শুনেছি, সব ঠিক? আজীবকে নিয়ে তুই হালুইকরের দোকানে গিয়েছিলো।
—জী হুজুর, না।
ভয়ে কুঁকড়ে গেলো সাইদ। কিন্তু আজীব বলে ডাহা মিথ্যে কথা, দাদু। ও আর আমি দু’জনেই খেয়ে এসেছি। হালুইকরের দোকানে। পেট পুরে বেদনার হালওয়া খাওয়ার পর আবার এক গেলাস করে গুলাবের সরবৎও খেতে দিয়েছিলো আমাদের। ভারি সুন্দর। দিল ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
সাইদ কিন্তু তখনও বলে, না তারা সেখানে যায়নি, বা খায়নি।
উজির বলে, ঠিক আছে, এক্ষুণি প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। এখানে বোস। আমার ভাইয়ের বিবি যা বানিয়েছে পেট ভরে আজ খেতে হবে তোকে। একটুও নষ্ট করতে পারবি নে। তাতেই বোঝা যাবে, খেয়েছে কি খাওনি।
সাইদ প্ৰাণপণে পেটে পুরে নেবার চেষ্টা করলো। যতটা সম্ভব। কিন্তু প্রথম গ্রাসটাই গিলতে পারলে সে। বমি করে ফেললো। পেটে আর জায়গা থাকলে তো ঢুকবে। মিথ্যে করে আবার একটা গপ্পো বানিয়ে বলে, গতকাল নফরদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোগ্রাসে অনেক কিছু খেয়ে ফেলেছিলো সে। তাই আজ সারাটা দিন পেটের গোলমাল চলছিলো। বদহজম।
কিন্তু উজির বুঝতে পারলো, আগাগোড়া পুরোটাই মিথ্যে বলে যাচ্ছে! অন্য একটা নফরকে ইশারা করতেই দোমাদম পেটাতে শুরু করলো সাইদকে। পিটুনির ঠেলায় কবুল করলো, হ্যাঁ, সে আর আজীব হালুইকরের দোকানে খেয়ে এসেছে। এবং তার কথা থেকে এও বেশ বোঝা গেলো, সেই বেদনার হালওয়া সত্যিই অপূর্ব। তার কাছে দাদীমার হালওয়া এককথায় অখাদ্য’।
উজির হো হো করে হেসে উঠলো। কিন্তু হাসানের মা আরও আহত, আরও গম্ভীর হয়ে গেলো। তার অহঙ্কারে আঘাত লেগেছে। —মিথ্যেবাদী। বিশ্বাস করি না, আমার চেয়ে ভালো বেদোনার হালওয়া কেউ বানাতে পারে। আমার হাতের জিনিস খেয়ে দুনিয়াশুদ্ধ লোক বাহবা দিয়েছে এতোকাল। আর ওরা বলছে আজ, আমার হালওয়া মুখে তোলা যায় না। যা, নিয়ে যা একটা বাটি, নিয়ে আয় দেখি, তোর কেমন সে হালওয়া। আমার স্বামীর বড়ভাই খেয়ে বিচার করবেন, কারটা ভালো।
সুতরাং সাইদ একটা চিনেমাটির বাসন আর আধলা দিনার নিয়ে রওনা হয়। হালওয়া আনতে। দোকানে এসে হালুইকরকে বললো, দেখো ভাই, আমাদের বাড়ির একজন খানদানি আদমি তোমার ঐ বেদানার হালওয়া খাবে। আমাকে এই বাটিটায় আধ দিনারের মতো দাও। বাড়িতেও আজ এই হালওয়া বানানো হয়েছে। দু’টো একসঙ্গে খেয়ে যাচাই করা হবে, কোনটা বেশী ভালো। সেই জন্যে বলছি, ভালো জিনিস দিও আমি আর খেয়ে দেখতে চাই না, কারণ তোমাকে আমার বিশ্বাস আছে।
–ঘাবড়াও মাৎ। এমন জিনিস দেবো, খেয়ে তাক লেগে যাবে। এ জিনিস এক আমার মা ছাড়া সারা দুনিয়ায় কেউ বানাতে জানে না। আজ সে এখন অনেক দূর দেশে থাকে।
বাটিটা ভর্তি করে হালওয়া দিয়ে তার উপরে ছিটিয়ে দিলো একটু গুলী/বজল। সাইদ নিয়ে এসে দিলো দাদীমার হাতে।
বাটিটা হাতে নিয়েই চোখে দেখার জন্য একটুখানি তুলে মুখে দিলো সে। আর তৎক্ষণাৎ আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেলো হাসানের মা।
হালওয়ার এক টুকরো জিভে ঠেকাতেই বুঝতে পারলো, এ আর কারো নয়, তার পুত্র হাসানের নিজের হাতের জিনিস। উজির এবং আর যে যেখানে ছিলো, ছুটে এলো। জলের ঝাপটা দেওয়া হলো চোখেমুখে। একটু পরে জ্ঞান ফিরলো। বললো, এ হালওয়া আমার ছেলে হাসানের তৈরি। দুনিয়াতে সে ছাড়া এর কৌশল আর কারো জানা নাই। আমি নিজে হাতে তাকে শিখিয়েছি। আর আমি কারো কাছ থেকে শিখিনি। নানা রকম খাবার তৈরি করা আমার শখ ছিলো। নানা রকম মাল-মশলা দিয়ে বানাতে বানাতে একদিন হঠাৎ তৈরি হয়ে গিয়েছিলো এই বেদনার হালওয়া। আমি শুধু তাকেই শিখিয়েছিলাম, আর কাউকে নয়।
উজিরের তখন অবস্থা কাহিল। হারানো মণি খুঁজে পাওয়ার অদ্ভুত এক আনন্দে কাঁপয়ে জ্বর এসে গেলো তার। —শেষে আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন।
কিন্তু তখন কী করা যায় কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারে না উজির। একটু ভেবে সাইদকে বললো, জনা-বিশেক নফর সঙ্গে নিয়ে এক্ষুণি যাও সেই দোকানে। যেমন করে পারো বেঁধে ছেদে তুলে নিয়ে আসবে তাকে। কিন্তু দেখো, তার যেনো কোন চোট না লাগে।
উজির নিজে একটা ঘোড়ায় চাপলো। মিশরের সুলতানের দেওয়া পরোয়ানাখানা সঙ্গে নিয়ে ফামাসকাসের কাইরেনি হুকুমদারের দপ্তরে গিয়ে পৌঁছালো। হুকুমদার আদর অভ্যর্থনা করে বসালে তাকে। জিজ্ঞেস করলো কাকে আপনি কয়েদ করতে চান?
—এই বাজারের এক হালুইকরকে।
—এ আর এমন বেশী কি কথা, আমি এক্ষুণি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। জনা কয়েক সিপাই বীরকন্দাজ পাঠিয়ে দিলো তখনি। তাদের বলে দিলো, উজির সাহেবের লোকজন সেখানে গেছে, তোমরা গিয়ে দেখো, যদি দরকার হয়। সাহায্য করবে তাদের।
সামস-আল-দীন তখন হুকুমদারের দপ্তর থেকে সোজা তাঁবুতে ফিরে এলো।
একদল লোক লাঠি-সোটা কোদাল গাইতি নিয়ে হাজির হলো কালুইকরের দোকানের সামনে। নিমেষে ভেঙে চুরমার করে দিলো সব। মেঠাই মণ্ড যা তৈরি হয়েছিলো সব ছুঁড়ে ফেলে দিলো তারা। তারপর হাসানকে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে কাঁধে তুলে নিয়ে চলে আসতে থাকলো। নফরের পিঠে চেপে আসতে আসতে ভাবে হাসান, খানিকটা বেদনার হালওয়া যে এমন বেদনাদায়ক হতে পারে স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
হাসানকে যখন উজিরের সামনে নামানো হলো, তখন সে কান্নায় ফেটে পড়লো।–কী আমার গুনাহ, হুজুর?
—তুমি তৈরি করেছিলে সেই বেদানার হালওয়া?
—জী হুজুর। কেন, বে-আইনী কোনো কাজ করেছি আমি?
–বে-আইনী? তাতে আর কী শাস্তি তোমার হতে পারে। তার চেয়ে ঢের ঢের বেশী শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।
একজন নফরকে একটা বড় কাঠের বাক্স কিনে আনতে বললো| উজির। হাসানকে সেই কাঠের বাক্সে ভরে উটের পিঠে চাপিয়ে কইরো নিয়ে যেতে হবে।
উজির ভাবে, এখন ওর মা, হুসনকে কিছু বলা হবে না। মিশরে পৌঁছনোর পর জানাবে সব।
তাঁবু গোটানো হলো। উজির তার দলবল নিয়ে কইরোর পথে রওনা হয়ে পড়লো। দিনের পর দিন তারা চলতে থাকে। আহারের সময় হলে হাসানকে নামানো হয় কিছুক্ষণের জন্য। খানাপিনা শেষ হলে আবার বাক্সে পুরে চাপানো হয়। উটের পিঠে। এইভাবে আরও কয়েকদিন কাটে। হাসানকে মাঝে মাঝে নামিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে উজির। —তুমি নিজে হাতেই কি বানিয়েছিলে সেই বেদনার হালওয়া?
হাসান জবাব দেয়, জী হুজুর।
উজির তখন হুকুম দেয়, লোকটাকে বাক্সে পুরে আবার উটের পিঠে চাপাও।
অবশেষে তারা কইরোর সীমানায় এসে পৌছয়। শহরের এই শেষ প্রান্তে জায়দানিয়াহ ময়দানে সেনা বাহিনীর ছাউনি। উজিরের নির্দেশে ময়দানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো তার দলবল। হাসানকে নামিয়ে আনতে বললো। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নামিয়ে উজিরের সামনে দাঁড় করানো হলো। পিছমোড়া করে বাঁধা হাসান। বুঝতে পারে না সে, কী তার অপরাধ। আর কী সাজাই বা তাকে পেতে হবে। মাথা হোঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে উজিরের সামনে। উজিরের নির্দেশে একজন ছুতোর মিস্ত্রি এলো। উজির বললেন, এই লোকটার মাপে একটা কাঠের ক্রুশ বানাও। জলদি। তারপর সেই ক্রুশে তার হাত পা কোমর গলা রশি দিয়ে বেঁধে একটা মোষের গাডির পিছনে বেঁধে দাও।
হাসান কেঁদে ওঠে, একি করছেন হুজুর।
উজির হুঙ্কার ছাড়ে, আমি তোমাকে ক্রুশে গেঁথে মারবো। এখন তোমাকে গাডির পিছনে বেঁধে ছেচড়াতে ছেচড়াতে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। শহরবাসীরা আগে দেখুক তোমাকে। তারপর ক্রুশে গাঁথা হবে তোমাকে।
–কিন্তু আমার কি অপরাধ?
—অপরাধ? তুমি সেই বেদানার হালওয়াতে ঠিকমতো মরিচের গুড়ো মেশাওনি। এই তোমার অপরাধ।
এই কথা শুনে নিজের গাল নিজে থাবড়াতে থাকে হাসান।–হায় আল্লাহ, এই একটা তুচ্ছ ব্যাপারে একেবারে ফাঁসীর হুকুম। এই জন্যে আপনি আমাকে এতোদিন ধরে হাত পা বেঁধে বাক্সে পুরে রেখেছেন? সারা দিনে দানা পানি বলতে গেলে নামে মাত্র একবার দিয়েছেন? এতো অত্যাচার করেছেন, এতো কষ্ট দিয়েছেন তাতেও আপনার সাধ মিটলো-না। তাতেও আমার অপরাধের সাজা হলো না? এরপর আমাকে ক্রুশে গেঁথে মারলে তবে আপনার মনস্কামনা পূর্ণ হবে?
—ঠিক, ঠিক, ধরেছে। তবেই আমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। ঠিক মতো কেন দাওনি তুমি মরিচের গুড়ো? কেন দাওনি? সেজন্যে এই-ই তোমার যোগ্য সাজা!
হাসান মাটির উপর বসে পড়ে। দু’ চোখে জলের ধারা। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে ভেবে আকুল হয়।
একটু পরে উজির প্রশ্ন করে, কী, ভাবছ কী?
–নাঃ, কিছু না। শুধু ভাবছি, আপনার মতো মাথা মোটা লোকগুলো দেশের শির-মণি হয়ে আছে বলেই দুনিয়ার আজ এই দশা। আপনার মতো গর্দভের হাতে যদি দেশের শাসনভার না থাকতো তাহলে আমার মতো নির্দোষ নিরীহ লোকের এইরকম তুচ্ছ কারণে এইভাবে জান খোয়াতে হতো না। ইহঁ! অপরাধ কী? না, ঠিক মতো মরিচের গুড়ো মেশানো হয়নি—বেদনায় হালওয়ায়। এই না হলে কাজীর বিচার।
উজির তখন গম্ভীর চালে মাথা দুলিয়ে বলে, আমাকে তো দেখতে হবে, আবার যাতে তোমার কাজে তুমি ফাকি না দাও!
—কিন্তু, হাসান বলে, লোকটাকে বাঁচিয়ে রাখলে তবে তো বোঝা যাবে-পরে সে তার কাজে ফাকি দেবে কি দেবে না?
উজির বলে, সে হয় না। তোমার তো আর একদিনের দোষ না। রোজই তুমি এই বেদানার হালওয়া বানিয়েছে আর রোজই লোককে ফাকি দিয়েছে। ঠিক মতো মরিচের গুড়ো মেশাওনি। প্রত্যেক দিনের অপরাধ তিলতিল করে জামে এখন পাহাড় হয়ে গেছে। তা একদিনের ফকির জন্যে যদি এক ঘা বেতের সাজা হয় তবে তুমিই ভেবে দেখো, এক সঙ্গে জমা হলে এতো কালের অপরাধের সাজার পরিমাণ কী দাঁড়ায়। মৃত্যুদণ্ড তো কমই হলো, আমার হিসাবে আরো বেশী সাজা পাওয়া উচিৎ তোমার।
হাসান ভাবে, প্রতিবাদ করে, কথা কাটাকাটি করে কোন লাভ নাই। শুধু বলে, উন্মাদের সঙ্গে তর্ক করা যায় না।
হাসান আর উজিরের মধ্যে যখন এইসব তর্ক বিতর্ক চলছিলো, ছুতোর তখন তার কাজ করে চলেছে। আর মাঝে মাঝে হাসানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আহা, বেচারা, আর একটু বাদেই ক্রুশটা তৈরি হয়ে যাবে। তখন কি আর ও অমনিভাবে উজিরের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করতে পারবে?
সন্ধ্যা নেমে এলো। হাসানকে আবার সেই কাঠের বাক্সে ভরা হলো। উজির গর্জে ওঠে, কাল তোমাকে ক্রুশে গাঁথা হবে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো, উজির। অন্য দিনের মতো আজ আর তাড়ফানি নাই হাসানের। বাক্সের মধ্যে ভরার পরই নেতিয়ে পড়লো। তার পর যখন দেখলে সে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, লোকজনদের বললো, এবারে চলে আমার ইমারতে।
ঘরে ফিরে আসার পর এই প্রথম সিৎ-অল-হুসন আর হাসানের মা-র কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বললো, উজির।
প্রথমে সে গেলো কন্যা হুসন-র ঘরে। মেয়েকে আদর করে বললে, বেটা, এতো দিন তোর দুঃখ কাটলো। এবারে তোর মুখে হাসি দেখবো। ওঠামা, উঠে বোস, ভালো করে সাজগোজ কর। আমি তোদের বলিনি। হাসানকে আমি খুঁজে পেয়েছি। তাকে নিয়ে এসেছি। সঙ্গে করে। নে, ওঠ। আনন্দ করা। শাদীর রাতে যেভাবে বাসর সাজানো হয়েছিলো, মনে আছে?
আছে আব্বাজান। —ঠিক ঠিক সেই ভাবে সাজাতে হবে। আবার আজ হুবহু সেই ভাবে যেখানে যেমনটি ছিলো। যদি অসুবিধে হয়, সিন্দুক খুলে কাগজখানা বের কর। সব নিখুঁত করে লেখা আছে।
আনন্দের ঢেউ খেলে গেলে হুসন-র মনে। নফরদাসী লোকজন ডাকা হলো তখুনি। হুসন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করে তাদের দিয়ে বাসরঘর সাজাতে লাগলো। ঠিক যেমনটি সাজানো হয়েছিলো শাদীর রাতে। যদি কোন ভুলচুক হয়ে যায়। সেজন্যে সিন্দুক থেকে বাবার লিখে রাখা সেই কাগজখানা বের করলো। চেয়ার টেবিল খাট পালঙ্ক যেখানে যা ছিলো ঠিক তেমনি করে সব সাজানো হলো। শাদীর রাতে যারা উপস্থিত ছিলো তারা যদি দেখে, তো তাজ্জব বনে যাবে।
সব সাজানো গোছানো হয়ে গেলে উজির সিন্দুক খুলে বের করলো হাসানের সেই পাতলুন, ইজের, টুপী আর মোহরের বটুয়া। চেয়ারের উপর রাখলে টুপী। আর টুপীর নিচে রাখলে সেই বটুয়া—যার মধ্যে আছে এক হাজার সোনার মোহর আর সেই ইহুদী সওদাগরের লেখা একখানা চিরকুট। খাটের বাজুতে রাখলো পাতলুন ঠিক শাদীর রাতে যেমনটি রেখে ছিলো হাসান। আর এলোমেলো বিছানার উপর ফেলে রাখলে তার দড়ি ছোড়াইজেরখানা। সব শেষে উজির নিজে হাতে পাতলুনের কোমর বন্ধনীর ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো সেই নূর-আল-দীনের সই করা ঠিকুজী পত্বখানা। সূচসুতো দিয়ে সেলাই করে দিলো—ঠিক যেমনটি ছিলো তেমনিভাবে। তারপর হুসনকে বললো, মা, ঠিক শাদীর রাতে হাসানের সঙ্গে পালঙ্কশয্যায় শোবার আগে যে অবস্থায় ছিলে তেমনি বিবস্ত্রা হয়ে শয্যায় শুয়ে পড়ে তুমি। হাসানকে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে এলে সেদিন যেভাবে তাকে আদর অভ্যর্থনা করে কাছে নিয়েছিলে ঠিক তেমনিভাবে গ্রহণ করো। হুসন-র ঘর ছেড়ে হাসানের কাছে চলে গেলো। উজির। সেই কাঠের বাক্সর ভিতরে হাসান তখন ঘুমে অচৈতন্য। উজিরের ইশারায় নফররা টেনে বের করলে তাকে। কিন্তু ঘুমে গলে গেছে সে। পরনের কামিজ পাতলুন সব খুলে ফেলে উলঙ্গ করা হল। শুধু একটা দামী রেশমীর কোর্তা আর মাথায় একটা সাদা পাড়ের টুপী পরিয়ে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে রেখে এলো হুসনা-র ঘরের মেজেয়-গালিচার উপর।
এক সময় হাসানের ঘুম ভাঙ্গে। চোখ মেলে অবাক হয়। সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি। আবার চোখ বন্ধ করে। না, স্বপ্ন তো নয়। এই তো সেই ঘর। সেই পালঙ্ক। সেই হুসন শুয়ে আছে। ঠিক যেমনটি সেই শাদীর রাতে দেখেছিলো। সব-সব হুবহু একই রকম। কিন্তু তা কি করে হয়! সে তো কতকাল আগের কথা! নাঃ, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। উঠে দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে থাকে। পায়ের আঙুল দিয়ে টিপে গালিচার মসৃণতা অনুভব করে। না না, তা কি করে হয়? এই বাসর-শয্যা এই ঝাড়বাতি, এই ফুলদানি, এই আতরের খুশবু এ যেমন সত্যি তেমনি সে যে পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় একটা কাঠের বাক্সে বন্দী হয়েছিলো তাও তো আরো সত্যি। কিন্তু দুটোর মধ্যে আশমান-জমিন ফারাক। কী করে সম্ভব হতে পারে?
একবার মনে হয়, সে বুঝি পাগল হয়ে গেছে। তা বিচিত্র নয়। উজির তাকে যে অত্যাচার করেছে এবং যে সাজা দেবার ফরমান দিয়েছে, তাতে যে কোন সুস্থ লোকই পাগল হয়ে যেতে পারে?
হঠাৎ চোখ পড়লো, চেয়ারের উপরে রাখা তার বাহারী সেই বসরোহর টুপী। সোনার পাতে মোড়া। নানা কারুকার্যকরা। টুপীটো তুলে দেখলো, হাঁটা ঠিক তেমনি রাখা আছে সেই মোহরের থলিটা। খুলে দেখলো, সব ঠিক আছে। সেই ইহুদী সওদাগরের চিরকুটটা দেখে মনে পড়লো, একখানা জাহাজ কেনার পাল্টা রসিদ করে দিয়েছিলো সে। ওপাশে খাটের বাজুতে রাখা পাতলুনটা তুলে নিলো। হ্যাঁ, এও তারই। কোমর বন্ধনীতে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো, সেই তুলেটি কাগজে লেখা, তার বাবার সই করা, সেই কুলজীপত্বখানা-ঠিক যেমন ছিলো তেমনি আছে। যতই দেখতে থাকে ততই কেমন গোলমাল হয়ে যায়। হিসাব মেলাতে পারে না কিছুতেই।
এবার হুসূন-এর দিকে চোখ ফেরাল। হ্যা, কিছুমাত্রও ভুল হয়নি তার। এ তার সে বহু আকাঙ্ক্ষিতাই বটে। তার সে-মেহবুবা। তার জীবনের প্রথম আনন্দ-সুখ প্রদায়িনী। গুটি গুটি এগিয়ে গেল পালঙ্কের দিকে। কাছে, একেবারে পালঙ্কের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার যৌবনের জোয়ারকে নতুন করে চাক্ষুষ করতে লাগল।
হাসান দুরু দুরু বুকে পালঙ্কের ওপর উঠে বসল। মেহবুবার গালের কাছে হাতটি নিয়ে গিয়েও আবার টেনে নিয়ে এল। হুসন ঘুমের ভান করে বিছানায় আগের মতই এলিয়ে পড়ে বইল। দু’চারটে ছােট ছােট কোকড়ানাে কুচকুচে কালাে চুল হুসন-এর কপালের ওপর পড়েছে। এগুলাে তার ঘুমের সৌন্দর্যকে আরও অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।
হাসান বিস্ময় বিস্ফারিত কামাতুর চোখ দুটো মেলে হুসন-এর “আধফোটা পদ্মের মত মুখটির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর দ্বিধাজড়িত হাত দিয়ে আলতাে করে তার কপালের ওপর জড়াে হওয়া চুলগুলােকে সরিয়ে দিল। হাসান-এর হাতের ছোঁয়া পেয়ে হুসন ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। এমনই কোন এক সুযােগের প্রতীক্ষায় ঘুমের ভান করে পড়েছিল এতক্ষণ। এবার আড়মােড়া ভেঙ্গে উঠে বসল। হাত বাড়িয়ে হাসানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগ-মধুর স্বরে বল—মেহবুব, অমন করে কি দেখছ? কি আছে আমার মুখে ? সারারাত ধরে তাে প্রাণ ভরে খেলে। এতেও আশ-মেটেনি তােমার? আরও মন চাইছে? কিন্তু আর কি করে সম্ভব, বল তো? ভাের হয়ে এল যে। আমার যা কিছু সম্পদ আঠারাে বছর ধরে কামাতুর মানুষগুলাের কাছ থেকে আগলে আগলে রেখেছিলাম সবই তাে তােমাকে উজাড় করে দিয়েছি। কথা বলতে বলতে কামৰিকারে দু’হাতে তাকে বুকের মধ্যে সজোরে চেপে ধরে বলল—“আমার দেহের গােপন সম্পদগুলাে তােমার মনকে কি তুষ্ট করতে পেরেছে বল তাে মেহবুব? এবার আচমকা নিজের ঠোট দুটো দিয়ে হাসান-এর ঠোট দুটো আঁকড়ে ধরল। আলতাে একটি কামড় দিয়ে বলল—‘সারা রাত্রি ধরে আমাকে ময়দা ডলার মত পেশাই করেছ। কামড়ে কামড়ে ঠোট দুটোতে রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দিয়েছ। আর যেটুকু বাকি ছিল পূরণ করে দিলাম, এবার পিয়াস মিটেছে তাে?’
সােনা মানিক আমার, এখন আর নয়। ভােরবেলা লােকে দেখে ফেলে লজ্জার ব্যাপার হবে। আমার যা কিছু সম্পদ সবই তাে তােমার কাম-জ্বালায় শান্তিবারি সিঞ্চন করার জন্যই। সবই তাে তােমার। শুধু তােমার, থাকবেও শুধু তােমারই জন্য।
হাসান এবার হুসন-র বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল—“আমি কি তবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? হালুইকর সেজে দোকানদারি করেছিলাম খােয়াবের মধ্যে ? সন্ধ্যাবেলা ফুটফুটে একটি লেড়কা আর তার নফর কে আমার নিজের হাতে তৈরী হালুয়া খাইয়েছিলাম। ব্যস, খানিক বাদে একদল মার্কা লােক এসে আমার দোকানটি ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। আমাকে পিঠমােড়া করে বেঁধে উজিরের তাবুতে নিয়ে গেল। উজিরের হুকুমেই নাকি তারা আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন হালিয়েছে। উজিরের অজুহাত হালুয়াতে নাকি মরিচ পরিমাণ মত দেওয়া হয় নি। হুসন তার একটি হাত টেনে নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে বলল—হাতদুটো আবার কেটেটেটে যায় নি তাে?
হাসান তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বলল তােমার মাথাটাথা খারাপ হ’ল নাকি! খােয়াবের মধ্যে হাত বাঁধলে কাটাকাটি হয় নাকি কখনও। সত্যি সত্যি বাঁধলে না হয় সম্ভাবনা থাকত তারপর আরও আছে। পিঠমােড়া করে বেঁধেও খুশী হতে পারে নি। আবার বলে কিনা ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করবে।’
হুসন আঁতকে উঠে বলল—“ওমা, সে কি কথা গাে! আমার সােনা মানিককে মারবে, কার এমন সাধ্য!’
—“আরে তুমিও যেমন! বলছি না, সবই খােয়াবের ব্যাপার।’ —“হ্যা গাে, ঠিকই বলেছ। খােয়াবের মধ্যে অনেক কিছুই হতে পারে বটে।আচমকা কপালের দিকে হাসান-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে হুসন বলে উঠল—“হ্যা গা, তােমার কপালে কিসের দাগ দেখা খাচ্ছে যেন?’
কপালে হাত বুলাতে বুলাতে হাসান বলল—তাই তাে, তবে তাে খােয়াব টোয়াব মিথ্যে! ছেলেটির পিছন পিছন হাঁটার সময় সে রেগে গিয়ে একটি পাথর ছুড়ে মেরেছিল। অব্যর্থ লক্ষ্য। কপালে লেগে কেটে গেল। খুন ঝরল বহুত। দাওয়াই লাগিয়ে ক্ষতটি শুকোতে হয়। মুহূর্তকাল নীরবে ভেবে এবার সে । বলল—কী ঝকমারিতেই না পড়া গেল। একবার ভাবি খােয়ব, আবার মনে হয় কিছুতেই খােয়াব হতে পারে না। সবকিছু কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
—“আমার কথা শােন সােনা মানিক, ওসব উদ্ভট ব্যাপার স্যাপার নিয়ে ভেবে মিছে মনটিকে বিষিয়ে তুলাে না। কথা বলতে বলতে হুসন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মন-প্রাণ উতলা করা হুসনএর আঠার বছরের নিটোল স্তন দুটোর ফাকে মুখ গুজে পরমতৃপ্তির স্বস্তিতে এলিয়ে পড়ে রইল। না, আর কিছুই ভাবতে পারছে না সে। ভাবা সঙ্গতও নয়। অতীতের জের হিসাবে বর্তমানকে কল্পনা করে মন-প্রাণ বিষিয়ে তােলা নিতান্তই বােকামি।
পরম স্বস্তিতে হাসান-এর চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। কখন যে | ঘুমের ঘােরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারে নি।
ঘুম ভাঙার পর হাসান যখন চোখ মেলে তাকাল তখন সূর্য গুটি শুটি আকাশের গা-বেয়ে অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে। চোখ মেলে তাকিয়েই সামনে উজিরকে দেখতে পেল। সচকিত হয়ে তার দিকে সভয়ে তাকাল। উজির সেই অত্যাচারী উজির।
উজির সামস-অল-দীন একটি কুর্শিতে বসল। এবার মুচকি হেসে বলল–বাপজান, তুমি আমার ছােট ভাইয়া নূর-অল-দীনএর বেটা। তােমাকে আমি বহুত দুঃখ দিয়েছি। তুমি যে আমার বেটির স্বামী আর আজীব-এর আব্বা সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই আমাকে কিছু চাতুরীর আশ্রয় নিতেই হয়েছে। গতকাল রাত্রে তােমার টুকরাে টুকরাে কথাবার্তা শুনে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি। আসলে আমার ভাইয়া নুর-এর সঙ্গে আমার সামান্য ভুল বােঝাবুঝির জন্যই এতসব কেলেঙ্কারী হয়েছে।
উজির দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই আজীব ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকল। হুসন হেসে বলল–বেটা, তাের আব্বাজীর কথা জিজ্ঞেস করছিলি না? এই যে তাের আব্বাজী।
আজীব দেখল, সে হালুইকর। কি ভাবল, কে জানে? তারপরই ছুটে গিয়ে হাসান-এর গলা জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসান-এর মা-ও সেখানে উপস্থিত হল। বেটা মেরে লাল!’ বলে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল।
এ-পর্যন্ত বলে বেগম শাহরাজাদ কিস্সা বন্ধ করলেন।