পৃথা – (কালকূট) – সমরেশ বসু

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

……সেই সংহিতা যুগেও বুদ্ধিজীবীরা একটি বিষয় ভালােই জানতেন। পুরুষ-রমণীর পক্ষে রিপু দমন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। আর তার ফলে, রিপু বশীভূত রমণী পুরুষের ফলোৎপাদনক যদি সমাজে যথার্থ রূপ গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা না যায়, তবে তার পরিণতি শুভ হতে পারে না। এই চিন্তা থেকেই, সমস্ত রকমের দৈহিক মিলনকে, আর সেই মিলন সস্ভুত সন্তানদের বৈধ করণের জন্য, আট রকমের বিবাহ পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছিল। আর দ্বাদশ প্রকারের সন্তান জন্মকেও সমাজে স্থান দেওয়া হয়েছিল।

সেইসব বিবাহ পদ্ধতি আর সন্তান ধারণের পদ্ধতির বিবরণে আমি পরে আসছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পন্থাও দেখছি গ্রহণ করা হয়েছিল। যেমন, স্বামী অথবা নিকট সম্পর্কের আত্মীয় আত্মীয়ার নির্দেশ, অনুবর্তন হলো ক্ষেত্রজ সন্তানের। মহাভারতের আদি খণ্ডে দেখছি,স্বায়ম্ভব মনু নির্দেশ করছেন, মানুষেরা নিজের বীর্য ভিন্ন, অন্যের কাছ থেকেও ধর্মদায়ক শ্রেষ্ঠ সন্তান লাভ করতে পারে। কোনাে ব্যক্তি কোনাে কন্যাকে বিয়ে করার জন্য শুল্ক দিয়ে অনেকদিনের জন্য বিদেশে চলে গেলে, সেই কন্যা শুষ্কদাতার উপকার করার জন্যেই, অন্য পুরুষের দ্বারা গর্ভধারণ করে, সন্তানের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু তার জন্যে সেই কন্যাকে নিয়মানুসারে কেউ বিবাহ করতে পারবে না। একমাত্র কন্যার পিতা যদি আগের বরপক্ষকে শুল্ক ফিরিয়ে দেন, তবে কন্যাকে অন্য পাত্রে বিবাহ দিতে পারেন (মহাভারত-অনু)।

কোনােকন্যাকুমারী অবস্থায়পুত্রবতী হলে, পুত্রসহই তার বিবাহের ব্যবস্থা বিধিসম্মত করা হয়, এবং বিবাহিত স্বামীকেই সেপুত্রকে নিজের ঔরসজাত পুত্রের মতােই লালন পালন অবশ্য কর্তব্য। এটা হলো আসলে কানীন পুত্রকে মেনে নেওয়ারই একটি নির্দেশ। মহাইতিবৃত্ত,মহাভারতের বনপর্বেরপাতা খুলে দেখেছি,বেদের উল্লেখ করে, স্পষ্টই বলা হয়েছে, অবিবাহিকগণ, যাকে ইচ্ছা তাকেই কামনা করতে পারে বলেই তাকে বলা হয়। কন্যা হচ্ছে স্বতন্ত্র।। পরতন্ত্র নয়। স্বেচ্ছুরিরে কাজ করাটাই স্বভাবসিদ্ধ ব্যাপার। আর বিবাহার্দি নিয়মগুলাে, মানুষের শুধু কল্পনা মাত্র। আমি যে-রমণীর সন্ধানে চলেছি, তঁারসম্পর্কে এখানে একটি বিশেষ সংকেত পেলাম।…..

…..যেমন, স্বামীর অবর্তমানে দেবরকে পতিত্বে বরণ করা বিধেয় ছিল। স্বামীরভর্তা ধর্মানুসারে ভর্তা হতে পারতেন। অতিথির মনােরঞ্জনার্থে গৃহস্বামিণী আত্মসমর্পণ করতেন। প্রত্যেক রমণীর ঋতু রক্ষা অবশ্য পালনীয়। কোনাে রমণী কোনাে পুরুষকে ঋতু রক্ষা করতে অনুরােধ করে যদি ব্যর্থ হতো, তবে সেই পুরুষ দ্রুণহত্যা পাতকের জন্য নিরগামী হতো। তারপরেও দেখছি, অতীতের বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : রমণীগণ অনাবৃত ছিল। তারা ইচ্ছামতোগমন ও বিহার করতে পারতো। কারাের অধীনতায় তাদেরকালক্ষেপকরতেহতো না। কৌমারাবধি এরা পুরুষ থেকে পুরুষান্তরে আসক্ত হলেও অধর্ম হতাে না। এসব আচরণব্যবহারধর্ম বলে প্রচলিত ছিল। তপস্বাধ্যায় সম্পন্ন মহর্ষিগণ এই প্রামাণিক ধর্মের সবিশেষ প্রশংসা করতেন।

সর্বাপেক্ষা বিস্ময়ের বিষয় হলাে, বেদবি মহাত্মারা একথাওবলে গেছেন,ঋতুস্নানথেকে ষােল দিনেরমধ্যে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করলে অধর্ম হয়। যােল দিন পরে সংসর্গ করল কোন অধর্ম হয় না। এর সঙ্গে যে নারী দেহে সন্তানােৎপাদনের একটি বৈজ্ঞানিক তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। আধুনিক কালে, অভিজ্ঞ নরনারী মাত্রেই জানেন, ঋতুস্নানের পর দশদিনের মধ্যে সাধারণত, সন্তান ধারণের জন্য,নারীর ডিম্বানুটি বেঁচে থাকতে পারে। দশ দিনও অনেক বেশিই গণ্য করা হয়। সাধারণত ঋতুস্নানের পর,নারীর জরায়ুতে আবির্ভূত ডিম্বানুটি বাহাত্তরঘণ্টারও সামান্য বেশি কিছু সময় বেঁচে থাকে। সেই সময়ে স্বামী সংসর্গ ঘটলে নারী সন্তানসম্ভবা হয় ।

এখানে দেখছি, বেদবিৎ মহাপুরুষরা ঋতুস্নান থেকে যােল দিন পর্যন্ত, অন্য পুরুষের সংসর্গ নিষেধ করেছেন। যার একটিই মাত্র যুক্তি থাকতে পারে, অন্য পুরুষে সংসর্গ সম্ভব, কিন্তু অন্য পুরুষের সন্তান ধারণ নিষিদ্ধ।

যাইহােক, সমস্ত ব্যাপারগুলো থেকে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে, কোনাে ক্ষেত্রেই রমণীর সতীত্ব, পদমর্যাদা, সমাজ প্রতিষ্ঠা,কোনােকিছুই ক্ষুন্ন বা মান হতাে না। অর্থাৎ দৈহিক শুচিতা সম্পর্কে কোনাে গুরুত্ব আরােপ করা হতাে না। এটাই হলাে সংহিতা যুগের একটা বৈশিষ্ট্য। সেই যুগে নরনারী নির্বিশেষে সকলের কর্তব্য বলতে বােঝাততা, অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন, যাজন, দান, তপ, সত্য, ক্ষমা, অলােভ, অনালস্য, অনসূয়া, ধৈর্য, ধৃতি, অহিংসা, সমদর্শিতা, সরলতা, দক্ষতা, মৃদুতা, লজ্জা, স্থিরতা, অদীনতা, অক্রোধ, অপক্ষপাতিত্ব, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, তিতিক্ষা, অসৎসরত, ত্যাগ, সন্তোষ, প্রিয়বাদিতা, শৌর্য, বীর্য, নির্ভিকতা। দৈহিক শুচিতার কথা বিশেষ ভাবে কিছুই নির্দিষ্ট করা ছিল না।

রূপই যে নারীর শ্রেষ্ঠ গুণ, এটা সেই যুগেও স্বীকৃত ছিল। দ্বিতীয় গুণ, শীল, তৃতীয় সত্য, চতুর্থ সরলতা, পঞ্চম সৎকর্ম, যষ্ঠ মাধুর্য, সপ্তম অন্তরে বাহিরে শুদ্ধতা, অষ্টম পিতৃভাব, নবম শুশ্রুষ,দশম সহিষ্ণুতা, একাদশ রতি, দ্বাদশ পাতিব্ৰত্য। পাতিব্ৰত্যকে যদি সতীত্ব জ্ঞান করি, তা হলে নারীর বিবিধ গুণের মধ্যে এটি হলাে দাদ্বশ গুণ।

ভারত ইতিহাসেই, সংহিতা যুগের বিবরদেখচ্ছ, সেই যুগে রমণীগণ গাে-গণের মতাে স্বজাতির শহ হি পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ করলেও, তারা অধর্মে লিপ্ত হতো না। সর্বজনভােগ্য নিত্য ধর্ম বলেই বিবেচিত হত। কার্কের প্রভাবে, পরবর্তীকালে, স্ত্রী জাতিকে, গৃহপালিত জলষ্ঠায় কেবল গৃহস্বামী ভােগ্যা রূপে রূপান্তরিত করার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল।

মহাভারতের উদ্যোগ পর্বের, পাতা উল্টে দেখছি, “কামশূন্য জীব কখনও জন্মায়নি, জন্মাবেনা। এমনকি,জীবন্মুক্ত মহাত্মারাও কামার্ত হলে, প্রতিনিবৃত্তি না।” ভীষ্ম শরশয্যায় থেকে, কৃষ্ণকে স্তব করতে গিয়ে বলেছিলেন, “র অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সমুদয় কামময়, যিনি সমস্ত জীবকে কামদে উন্মত্ত করে থাকেন, সেই কামাত্মাকে নমস্কার।”•••

যে-সব প্রাণীর দেহ পঞ্চভূত বিশিষ্ট, তারা সদাকামেরই সাধ্য ও বাধ্য। পঞ্চেন্দ্রিয় কামের আধার। যেমনুকে নিয়ে আমাদের সমাজে নানা নিষেধ প্রচলিত আছে, দেখছি, সেই মনুও বলছেন, মাংস ভােজন, মদ্য পান, স্ত্রী পুরুষ সংসর্গে দোষ নেই। এ সব ব্যাপারে জীবদের প্রবৃত্তি স্বভাবসিদ্ধই আছে। তবে নিবৃত্ত করতে পারলে মহাফল পাওয়া যায়।

সংহিতার যুগে ফিরে গিয়ে দেখলাম, একটা সময় কাল পর্যন্ত, রমণী জাতির যৌন স্বাধীনতা পুরুষদের মতােই অবাধ আর সমভাব ছিল। কিন্তু কাম প্রবৃত্তির এই অবাধ স্বাধীনতাকে একটা সংহত একমুখী করে তুলতে না পারলে, শৃংখলা রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ে ছিল।

অবশ্য মানব সমাজের ইতিহাসে, আমি আধুনিক জ্ঞানীদের কাছে যে-পাঠ পেয়েছি, তাতে দেখেছি, প্রাচীন মাতৃতাম্বিক-সমাজেই একমাত্র রমণী পুরুষের অবাধ যৌন সম্পর্ক ছিল বাহুল সাংস্কৃত্যায়নের, ‘ভােলগা থেকে গঙ্গার’ মাতৃতান্ত্রিক সমাজের চিত্র দেখেছি। দেখেছি, কারােরই পিতৃপরিচয় ছিল মাতৃপরিচয়ও গ্রাহ ছিল না। অতএব মা ও কন্যা, একটি পুরুষ্ঠেয় সংসর্গ লাভের জন্য, পরস্পর লড়াই করে, একজুন, আর একজনকে হত্যা করে, সেই পুরুষকে লাভ করছে। সংহত যুগ বলে যে সময়কে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা আদি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কথাই মনে পড়িয়ে দেয়।

মাতৃতান্ত্রিক সমাজে, পুরুষরা যখন দৈহিক বলে বলীয়ান হয়ে, নানা রকম সম্পদ আহরণ করতে আরম্ভ করেছিল, সেই সম্পদের দাবীদার কেউ ছিল না। রমণীরা যখন তাদের সন্তানদের জন্য সেই সব সম্পদ দাবী করলাে, পুরুষ জিজ্ঞেস করলাে, কে তােমার সন্তানের জন্মদাতা? তুমি তাে স্বেচ্ছাবিহারিণী। তােমার সন্তানের জন্য আমার সম্পদ দাবী করতে হলে, তােমাকে কেবল আমারই অশায়িনী, হতে হবে।
পুরুষের উৎপাদিত সম্পদ বণ্টনকে কেন্দ্র করেই, বিবাহ প্রথার প্রচলন করতে হয়েছিল। তখনই নারীকে একজন পুরুষের স্ত্রী রূপে বন্দী হতে হলো। কিন্তু পুরুষ কখনও সে-জোয়াল নিজের ঘাড়ে নিল না। সে অন্যান্য রমণীকেও ভােগ করতে লাগলো। এবং সকলের সন্তানকেই তার সম্পদেরভাগীদার হিসাবে মেনে নিল। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে, সেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরিবর্তন একদিনে হয় নি, বহুকাল লেগেছিল। এই বিবাহ প্রথার মধ্যে একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাচ্ছি।……

…..সংহিতা যুগে উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন। তাঁর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। তবে ইনি উদ্দালকের ঔরসে বা (ত্রে জন্মান নি। জন্মেছিলেন পিতার এক শিষ্যের ঔরসে। একদিন তিনি পিতামাতার পাশে বসেছিলেন। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে, তঁার মায়ের হাত ধরে তুলে নিয়ে বললেন, ‘চল আমরা যাই। পিতার সামনেই মাকে একজন তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে, শ্বেতকেতু দারুণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন! উদ্দালক পুত্রকে সেই অবস্থায় দেখে রূপল্টন, ‘বৎস রাগ করাে না। এটি হলাে নিত্য ধর্ম। এ ভূমণ্ডলক্ষ্যে সমস্ত রমণীরাই অবারিত। গাে-গণ যে রকম ব্যবহার করে, প্রজাগণও স্ব স্ব বর্ণে সে রকম আচরণ করে থাকে। শেতকেতু তা মানতে পারেন নি। তিনি সেই কাল থেকে নিয়ম করে দিয়েছিলেন, এখন থেকে সেবাণী ভর্তাকে অতিক্রম করে ব্যভিচারিণী হবে, তার ঘাের দুর্যোয় জ্বলহত্যা সদৃশ পাপ হবে। আর যে-পুরুষ’কৌমারূব্ৰহ্মপরিণী পতিব্রতা প্রণয়িনী ভার্যাকে পরস্ত্রী রূপে সম্ভোগ করবে, তারও সেই পাপ হবে।…..

…..বেদবিৎ জ্ঞানী জন্মান্ধ দীর্ঘতমা বিদ্যাবলে প্ৰদ্বেষী নামে এক রূপসী তরুণী ব্রাহ্মণীকে পত্নীরূপে লাভ করেছিলেন। কয়েকটি সন্তানের জন্ম দেবার পরে, তিনি নিখিল গোধর্ম অধ্যয়ন করে, নিঃশঙ্ক চিত্তে প্রকাশ্যে মৈথুনাদি করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। আশ্রমবাসী মুনিগণ দীর্ঘতমাকে মর্যাদা অতিক্রম করতে দেখে, রাগ করে তাকে আশ্রম থেকে বের করে দিয়েছিলেন।….

…..চন্দ্র অবশ্য কোনাে কথাই শােনবার পাত্র ছিলেন না। নিজের সুন্দর রথে যেতে যেতে সুন্দরী তারাকে দেখে রথে তুলে বলপূর্বক রমণ করতে লাগলেন । দেবগুরু বৃহস্পতি বার বার স্ত্রীকে প্রার্থনা করলেনও, মমোহিত চন্দ্র কিছুতেই তারাকে পরিত্যাগ করলেন না।…..

……আমি দেখছি, অনেক মুনি-ঋবির জন্ম অদ্ভূত ও অলৌকিক যেমন ধরা যাক, দ্রোণ। দ্রোণের পিতা মহর্যি ভরদ্বাজ গঙ্গা ধারে বাস করতেন। একদিন তিনি গঙ্গা স্নানে গিয়েছেন। গিয়ে দেখলেন, ঘৃতাচী নাম্নী এক অপ্সরা গঙ্গায় স্নান করে, দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ বাতাস এসে, ঘৃতাচীর শরীর থেকে সমস্ত বস্ত্র উড়িয়ে নিয়ে গেল। মহর্ষি ঘৃতাচীর মতাে সুন্দরী যুবতী অপ্সরাকে বিবসনা দেখে তখনই তার সঙ্গে বিহারের বাসনায় কাতর হয়ে পড়লেন। আর ঘৃতাচীর সামনেই ব্রহ্মচারী মহর্ষি ভরদ্বাজের রেতঃস্থলন হয়ে গেল। রেতঃস্খলন হবা মাত্র, মহৰ তা দ্রোণী মধ্যে স্থাপন করলেন, এবং ল থেকেই ধীমান দ্রোণ উৎপন্ন হলেন।….

……ইতিহাসের এক অধ্যায়ে দেখছি, পরাশর মুনি, বিদেহরাজকে বলছেন, ‘জন্মনিবন্ধন মহর্ষিদের অপকৃষ্ট হবার কোনাে সম্ভাবনা নেই। তারা তপােবলেই আত্মার উৎকর্ষ সাধন করে থাকেন। বিশেষতঃ তাদের পিতারা, যে-কোনো স্থানে তাদের উৎপাদন করে, তপােবলে তাদের ঋষিত্ব বিধান করেন। আমার পিতামহ বশিষ্ঠ, বিভাগুরুপুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ, বেদ, তাণ্ড্য, কৃপ, কাক্ষীবান, কমঠ, সবক্রীত, দ্রোণ, আয়ু, মতঙ্গ, মদ ও মাৎস্য প্রভৃতি মহর্ষিগণ অপকৃষ্ট যােনিতে জন্মগ্রহণ করেন, তপোবলে ঋষিত্ব লাভ করে বেদবিদগ্রগণ্য ও দমগুণ সম্পন্ন হয়েছিলেন। যােনি’ শব্দের ধাতুগত অর্থ ‘উৎপত্তিস্থান’ এখন অপকৃষ্ট যােনি বলতে যদি অল্প বা অনামা স্ত্রীলােকদের বােঝায় তা হলেই প্রয়ােজন হয়ে পড়ে, দ্রোণী বা কুম্ভযোনি ইত্যাদি বস্তুর নামের সাহায্য নেওয়া। দ্ৰোণী শব্দের অর্থ কী, আগেই তা বলেছি। যে-কোনাে ভাষ্যে, যে-ভাবেই ব্যাখ্যা করা হােক, পরনারীর দৈহিক মিলন ব্যতীত লোকসৃষ্টি একষ্টি অসম্ভব বিষয়। এর কোনাে সত্যাসত্যই নেই, এবং এটিএকুষ্টি মিথ্যা কথন মাত্র। অথবা, সাধারণ মানুষকে বিপথগাটিকরার জন্যই, মহাভারত বা পুরাণে যারা প্রক্ষিপ্ত অংশ প্রবরিয়েছে, তারাই এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির মূলে।…..

….‘পুরুষ ব্যতীত, স্ত্রীজাতি গর্ভধারণ করিতে পারে না। স্ত্রী জাতি ব্যতীত পুরুষও কখনও সন্তান উৎপাদনে সক্ষম নয় ! স্ত্রীলােকের ঋতুকালে, (ঋতুস্নানের সময় থেকে ১৬ দিন ) পুরুষের পরস্পর সহযােগ দ্বারাই সন্তান-সন্ততির জন্ম হয়। বেদ ও স্মৃতিশাস্ত্রে নির্দিষ্ট আছে, পিতা হতে অস্থি, স্নায়ু ও মজ্জা, মাতা হতে ত্বক, মাংস ও শােণিত সমুৎপন্ন হয়ে থাকে। কুম্ভা’ শব্দের অর্থ ইবেশ্যা। অগস্ত্য ও বশিষ্ঠের জন্ম কুম্ভা যােনিতে। কালক্রমে, কুম্ভার আকারটি কেটে দিয়ে, কেবল কুন্ত করা হয়েছিল। জন্মের সঙ্গে প্রতিভার কোনাে সম্পর্ক নেই। পরশিরের কথায় তা প্রকাশ পেয়েছে। অবশ্য পরাশর স্বয়ং স্বপাক অনার্য কন্যার গর্ভজাত সন্তান। ব্যাসের জন্মের কথা আগেই বলা হয়েছে। ব্যাসের পুত্র শুকদেব ম্লেচ্ছ কন্যা শুকীর গর্ভজাত। এরকম অনেকের কথাই বলা যায়, যারা হনযােনিতে জন্মেও ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ কোনাে বংশধারায় জন্মানাে। প্রতিভা ও জ্ঞান, এবং তপােবলের দ্বারাই ব্রাহ্মণত্ব লাভ করা সম্ভব ছিল।

এইসব ইতিবৃত্তীয় ঘটনা থেকেই, আমরা বুঝতে পারছি, নরনারীর মিলন ব্যতিরেকে, সন্তান জন্ম সম্ভব না। অতএব, অযযানিসম্ভব৷ বা ইত্যাদিও একান্তই অবাস্তব ও অলৌকিক। এসব অলৌকিক বিষয়ের দ্বারা, আমরা আমাদের ইতিহাসকেই কলঙ্কিত করেছি কানীন পুত্র, ক্ষেত্রজপুত্র, এসব কিছুই অলৌকিক বলে বর্ণনা করা হয় নি। কিন্তু কোনাে এক অতীতকালে, কার্নীনিপুত্র বা ক্ষেত্রজ পুত্র জন্মের জন্য, আদৌ কোনো সমাজ ও সমাজ বিগর্হিত কাজ বলে গণ্য হতাে না। কালে, ওকলির প্রয়ােজনে সেই ভয় ৰা সমাজ বহির্ভূত কাজ মনে করা নরনারীর মিলন ব্যতিরেকে, কোনো সন্তানই উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না। বর্তমান যুগে অবশ্য ভ্রণকে, ঋতুকালীন স্ত্রীলােকের জরায়ুতে প্রবশ করিয়ে, সন্তান ধারণের বৈজ্ঞানিক চেষ্টাটি সফল হয়েছে। কিন্তু কোনাে পুরাণের কোথাও, প্ৰজাসকল উৎপত্তির এমন সংকেত দেওয়া হয়নি। পুরাণের ‘পঞ্চকন্যার ইতিহাস একমাত্র কুন্তীই এদের মধ্যে কানীন পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। এবং ক্ষেত্রজ পুত্রেরও। কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রেই কোনাে অলৌকিকতা ছিল না।….

…..সেইকালে কন্যাকেও দত্তক রূপে গ্রহণ করা হতাে। রাজা কুন্তিভােজের পালিতকন্যা বলেই, পরে পৃথার নামকরণ হয় কুন্তী। কুন্তীর যৌবনকালের একটি বর্ণনায় পাচ্ছি, তিনি ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। দীর্ঘনয়না, রূপ-যৌবনশালিনী, স্ত্রী-সুলভ গুণবতী, গম্ভীরস্বভাবা, মহাব্রতা ও ধর্মশীলা। অনেক নৃপতিই সেই তেজস্বিনী নারীকে পত্নীরূপে পাবার জন্য বিশেষ উৎসুক ছিলেন।….

…..কুন্তী যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন, তখনই রাজা কুন্তিভােজের গৃহে আবির্ভূত হলেন মুনি দুর্বাসা। কিছু স্থূল বুদ্ধি বা মতলবী ব্যক্তি, দুর্বাসার উপস্থিতির সময়ে, কুন্তীকে নিতান্তই বালিকা বলে বর্ণনা করেছেন। অথচ স্বয়ং দুর্বাসার ‘দেবী!’ বা ‘চারুহাসিনী’ এরকম বহুতর সম্বােধনেই বােঝা যায়, কুন্তী তখন যৌবনে পদার্পণ করেছেন।….

……দুর্বাসা কেন কুন্তিভােজের গৃহেই সহসা একদিন আগমন করলেন তার কোনাে ব্যাখ্যা নেই। সম্ভবতঃ দুর্বাসা জানতেন, কুন্তিভােজের গৃহে একটি পরম রূপসী কন্যা আছে, এবং সে নাকি মুনি ঋষিদের সেবায় বিশেষ যত্নশীল। অতএব তার মতাে একজন পরম রূপবান, সূর্যসদৃশ তেজস্বী মহর্ষিই বা কেন কুন্তীর সেবা গ্রহণ করবেন না? সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, তিনি রাজা কুন্তিভোজের কাছে এসে প্রথমেই বললেন, “হে মহারাজ কুন্তিভােজ, আমি ভিক্ষা গ্রহণ করে তােমার গৃহে কিছুদিন থাকতে ইচ্ছা করি। কিন্তু আমি যখন তােমার গৃহে বাস করব, তখন তুমি বা তােমার অন্য কোনাে লােক, আমার অভিপ্রায়ের বিপরীত কোনো আচরণ যেন না করে। এতে যদি তুমি সম্মত হও, তা হলে আমি কিছুকাল তােমার গৃহে বাস করবাে। তবে আমার ইচ্ছানুসারে। কিন্তু সব সময়ে যেন, আমার গৃহে শয্যা, আসন প্রভৃতি ব্যবহার্য বস্তু সুশৃংখল ভাবে প্রস্তুত থাকে। এর কোনো অন্যথা যেন না হয়।”
দুর্বাসার এসব কথা থেকে মনে হয়, তিনি আগে থেকেই কিছু ভেবে এসেছিলেন। অন্যথায় যেথানে তাকে একবার ‘মধুরভাষী ইচ্ছে সেখানে এমন শপথ গ্রহণ করানাের কারণ কী ?

কোনো সন্দেহ নেই, কুন্তীর রূপ মাধুর্যের কথা ঋষি মুনির সেবার কথা তিনি পূর্বেই অবগত ছিলেন, পরে তার মতো কোপন স্বভাবের লােকের স্বভাবতই মনে হতে পারে, সাধারন মুনি ঋষিরা যদি সেই অপরূপ কন্যার সেবা পেয়ে থাকে আমি কেন পাবাে না? এবং আমার পাওয়াহওয়া চাই সকলের থেকে অনেক বেশি বিশিষ্ট। কুন্তিভােজ নিজেই দুর্বাক্ত কথা শুনে মনে মনে ভাবছেন, “এই মহর্ষি দুর্বাসা যথেচ্ছাচারী ও কোপন স্বভাব, তঁাকে গৃহে রেখে, তঁার অভিপ্রায় অনুযায়ী সেবা করা অতি কঠিন কাজ।”…সব জেনেও তিনি কুন্তীর কথাই দুর্বাসাকে বলেছিলেন, “হে মহর্ষি, আমার পৃথা নানে যশস্বিনী কন্যা আছে। যে আপনার সেবা করবে। আমার মনে হয় আমার সেই কন্যার শীলবৃত্ত দ্বারা আপনি সন্তুষ্ট হবেন।”
দুর্বাসাকে ঐ সব বলে, অন্তঃপুরে এসে কুন্তীকে বােঝালেন, “বৎসে! এক মহাতপস্বী ব্রাহ্মণ আমার গৃহে বাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।•••আমি একমাত্র তােমার প্রতিই নির্ভর করে, তার সেবার ভার নিয়েছি।•••তুমি সর্বদা একাগ্রচিত্ত হয়ে এই মহর্ষির আরাধনা করবে। আমি তােমার বাল্যকাল থেকেই,তােমার অসাধারণ সেবার মনােভাব অবগত আছি। ব্রাহ্মণগণ, গুরুবর্গ, বন্ধুবৰ্গ, মিত্রবর্গ, সম্বন্ধিবর্গ এবং মাতৃবর্গ, এমনকি দাসদাসীগণের প্রতিও তােমার অসাধারণ সানুকম্প দৃষ্টি আছে।•••হে শােভনাঙ্গী! তােমার সাধ্বিবৃত্তির জন্য সমস্ত ভৃত্যজনও তােমার প্রতি আকৃষ্ট।”…

এত কথা বলে, কুন্তিভােজ কুন্তীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, “দুস্কুলে সস্তৃত কন্যারা প্রায়শঃ বালস্বভাব প্রযুক্ত, বিপরীত আচরণকারিণী হয়ে থাকে। হে পৃথে, তুমি শ্রেষ্ঠ রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেছবং তােমার দেহ সৌন্দর্যও অসাধারণ। তুমি বংশ-রূপ-গুণ এই সমস্ত দ্বারা শােভিত।•••হে কল্যাণি ! এই মহাতপস্বী কোপন স্বভাব ব্রাহ্মণকে সেবায় সন্তুষ্ট করতে পারলে, তুমি কল্যাণ লাভ করতে পারবে।”

কুন্তী কী দুর্বাসাকে আগে দেখেছিলেম গুম নিশ্চয়ই শুনেছিলেন। তিনিরজাকুন্তিভােজের কথায়অনুয়ই সেইসম্মতিদিয়েছিলেন। এমন কি, তিনি পালক পিক-এমন কথাও বলেছেন, “আমি যখন এই ব্রাহ্মণের সেবায় রত হব, তখন উনি যদি নিয়ম রক্ষা না করে, ভােরবেলা, সন্ধ্যাবেলা গভীর রাত্রে, যখন খুশি আগমন করলেও আমি একটুও রাগ করবো না। উনি কোনাে নিয়ম না মানলেও, আমি কখনও ওঁর সেবা ছেড়ে অন্যত্র যাবাে না। আমি যা করলে উনি সন্তুষ্ট হবেন, আমি তাই করবে। আপনি ব্রাহ্মণকে যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমি তা পালন করবাে।” দুর্বাসাকে বলা হয়েছে, প্রজ্বলিত বহ্নিস্বরূপ। {সূর্য?) এর পরিচর্যা করা আর আগুনের মধ্যে প্রবেশ করা,একই কথা। একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই এই কোপন স্বভাব মহর্ষিকে সার্থক সেবা করতে পেরেছিলেন। কৃষ্ণকে তিনি কিছুতেই বিব্রত বা ক্রুদ্ধ করতে পারেন নি। কুন্তীর কাছে তার প্রতিজ্ঞার কথা শুনে তাকে দুর্বাসার কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, “এই আমার কন্যা। চিরকালই সুখে লালিতা। যদি কোনাে অপরাধ ঘটে, আপনি ক্ষমা করবেন। দুর্বাসা বললেন, “তথাস্তু।…..

….কুন্তী আর আপত্তি করতে পারলেন না। দুর্বাসাকে অথর্ববেদবিহিত মন্ত্র সব দান করলেন। কিন্তু হঠাৎ এমন একটি বর কেন দুর্বাসা তাকে দিলেন? আরও অনেক প্রকারের বর তিনি কুন্তীতে দিতে পারতেন। দেবতাদের ভৃত্যের মতাে আহ্বৱান করার শক্তিযুক্ত বর দান করার অর্থ কী?

এখানে এসে, ইতিবৃত্তের পাতায় আমি সঙ্গে সন্ধানে লিপ্ত হচ্ছি। তার আগে, ইতিবৃত্তে প্রক্ষিপ্ত অলৌক্তিসংবাদে, ব্রাহ্মণের বিচিত্র মতিগতির কথা কিছু বর্ণনা করতেই। কারণ এরাই আমাদের প্রাচীন ইতিবৃত্তকে, ব্রাহ্মণ্য মহিমার দ্বার ( মূখত!) এমন ভাবে মিথ্যায় আচ্ছন্ন করে রেখেছেন, যাতে সত্য কখনও প্রকাশ না পায়। আর ব্রাহ্মণরা যে কী ভয়াবহ শক্তিশালী ছিলেন,তারমাণেরজন্য যা মনে এসেছে, তাই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। অথচ আমরা জানি, ব্রাহ্মণ কোনাে জাতি ছিলেন না। প্রতিভা জ্ঞান ও তপােবলে, জারজ পুরুষও ব্রাহ্মণত্ব লাভ করতেন।….

….দীর্ঘতম ভাসতে ভাসতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যান। বলি নামে এক রাজা ছিলেন। অসাধারণ ধার্মিক। তিনি গঙ্গায় স্নান করতে এসে মুনিকে ভেলায় ভেসে যেতে দেখে, নিজের গৃহে নিয়ে আসেন এবং তিনি যে ভগবান দীর্ঘতম, দেখেই চিনতে পারলেন। বলি ছিলেন অপুত্রক। তিনি দীর্ঘতমাকে অনুরােধ করলেন, তরুহুর্তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করার জন্য। দীর্ঘতম সম্মত হলেম,রজি বলি তার পট্টমহিষী সুদেষ্ণাকে ঋষির নিকট গমন করতেধললেন। সুদেষ্ণা দেখলেন, ঋষি অন্ধ ও বৃদ্ধ। তখন তিনি নিজে গিয়ে এক শূদ্র। পরিচারিকাকে পাঠিয়ে দিলেন। সেইদৗসীর গর্ভে দীর্ঘতম, জেনেশুনেই এগারােটি পুত্রোৎপাদন করলেন, পুত্ররা যখন সবাই অধ্যয়নরত হয়েছে, রাজা বলিযুবই সুশি হলেন। কিন্তু দীর্ঘতনা বললেন, “এরা তােমার হয় নি। শূদ্রাযোনিতে আমি এদের উৎপন্ন করেছি । সুতরাং ঐরা আমারই পুত্র। আমাকে অন্ধ আর বৃদ্ধ দেখে, তােমার মহিষী সুদেষ্ণা আমার কাছে আসেন নি।” রাজা বলি সে-কথা শুনে খুবই দুঃখিত হলেন। সুদেষ্ণাকে নানা রকম অনুনয়পূর্বক, দীর্ঘতমার কাছে পাঠাতে সক্ষম হলেন। দীর্ঘ তমা সুদেষ্ণাকে ভােগ করলেন না। তার গায়ে হাত বুলিয়েই বলে দিলেন, “তােমার অত্যন্ত তেজস্বী পাঁচ পুত্র হবে। তারা অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড, ও সুহ্মা বলে পরিচিত হবে। তাদের নামানুসারে অঙ্গ বঙ্গাদি দেশ প্রসিদ্ধ হবে।”…।

অতএব ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা হলাে, দেবতা, ঋষিগণ যেভাবে পুত্ৰ উৎপাদন করেন, তা লৌকিক বিধি নয়। তা দিব্যবিধি। এরূপ দিব্যবিধিতে কোনাে রূপ দোষের বা পাপের সম্ভাবনা নেই। কারণ, অনেক তির্যক যােনিতে সর্বদা এরূপ জন্ম ঘটেছে। যেমন, কচ্ছপ, ময়ুরী, বলাকা, এর পুরুষ সম্বন্ধ ব্যতিরেকেই গর্ভ ধারণ করতে পারে। তা তাে বুঝলাম। কিন্তু কচ্ছপ, ময়ুরী তাে মানবী নয়। এবিষয়ে আমি ইতিপূর্বেই জেনে এসেছি,দেব-দানব মানব, যেকোনাে জাতির মানুষের, নরনারীর দৈহিক মিলন সম্ভুত ছাড়া সম্ভব না। এইসব অবাস্তব অলৌকিকতায় বিশ্বাসী পণ্ডিতবর্গের প্রতি অভিযােগ করা প্রহসন মাত্র। কারণ তারা বিশ্বাস করেন, ঋস্ত্রিীলোকের গায়ে হাত স্পর্শ করলেই, স্ত্রীলােকটি সন্তান সম্ভব হয়। কুন্তীর সঙ্গে সূর্যের সহযােগিতায় কর্ণের জন্মও সেই রকমই এরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। আর সেই সুর্য যে আকাশ থেকেই নেমে এসেছিলেন, সে-বিষয়েও এইসবপণ্ডিতেরনেকোনাে সন্দেহ নেই। হে সূর্য!তুমি আকাশ থেকে নেমে, এখন এই সব পণ্ডিতের দেহ স্পর্শ করে যাও।

একমাত্র, এই কারণেই, কুন্তীযগন কুমারী অবস্থায় রজস্বলা হলেন, তখন খুবই লজ্জিত হৰ্পে অনন্তর তিনি প্রাসাদ মধ্যে রমণীয় শয্যায় উপবেশন পূর্বক সূর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। দেখলেন, কবচ কুণ্ডল যুগলমতি দিব্য জ্যোতি সূর্যদেব। তখনই ব্রাহ্মণের সেই মন্ত্রের কথা তার মনে পড়লো। তিনি সেই মন্ত্রের দ্বারা সূর্যকে আহ্বান করলেন। করে ফ্যাসাদে পড়ে গেলেন। কারণ, সূর্য সত্যি এসে উপস্থিত হলেন। বললেন, “হে কল্যাণ, আমি মন্ত্র প্রভাবে, তোমার নিতান্ত তাধীন হয়ে আগমন করেছি। বলে, আমাকে কী করতে হবে।”

কুন্তীর কী দুরবস্থা! সূর্য যতই তঁাকে বর দিতে চান, তিনি কিছুতেই তা গ্রহণ করতে পারছিলেন না। কিন্তু সূর্য পরিষ্কারই বলে দিলেন, আমি জানি, তুমি কবচ-কুণ্ডলমণ্ডিত, আমার ন্যায় সন্তান উৎপাদন করাই তােমার অভিলাষ । তুমি সম্মতি দিলেই আমি সেই অভিলষিত পুত্র উৎপাদন করবাে। কুন্তী দেখলেন, এ ভারি গর্হিত কাজ। বাবা মা জানবেন না। অথচ আমার সন্তান হবে। তখন কী করবাে? সূর্য বললেন, “তােমার কন্যকাবস্থা নষ্ট হবে না। তুমি যেমন সন্তান চেয়েছে, সেই রকমই আমি উৎপাদন করব। আর তুমি যে কবচকুণ্ডলসহ বীর সন্তান চেয়েছে, তাই আমি দান করবাে।” কুন্তী সম্মত হলে, সূর্যদেব তার নাভিদেশ স্পর্শ করা মাত্র, হিনি তেজঃপ্রভাবে অচেতন হয়ে শয্যাতলে পড়ে রইলেন। এরপর স্বীয় তেজঃপ্রভাবে কুন্তীকে মােহিত করে, যােথ বলে গর্ভাধান করলেন। কিন্তু তার কন্যকাবস্থা দূষিত করলেন। বলাবাহুল্য, এই অলৌকিক, অবাস্তব, %ি কাহিনী আর যারাই বিশ্বাস করুন, বাস্তব ইতিবৃত্তে যার বর্মী, এবং প্রকৃতই নারীর প্রতি শ্রদ্ধা পােষণ করেন, তাঁদের মধ্যেও নানা কৌতূহল ও ইচ্ছা জাগে, অথচ তার ঠোর সমস্ত রকম দায় দায়িত্ব গ্রহণের দ্বারা, নিজেদেরবশিষ্ট্যকে প্রতিষ্ঠা করেন। নারীকে যারা নিতান্ত দেহ শুচিতার বিচারে কেবল পুত্রোৎপাদনের যন্ত্র মনে করেন, তারাই ঐসব অলৌকিক অসম্ভব অবাস্তব ব্যাপারকে লােক মধ্যে প্রচার করে, মানুষকে সত্য সন্ধানে বঞ্চিত করেন।

এখন, ইতিবৃন্তের ধুলাচ্ছন্ন পাতার অন্তরালে, কুন্তীর সেই আরাধ্য পুরুষটিকে কেমন করে আবিষ্কার করা যায় ? কুন্তী চরিত্রের দ্বারা, আমি মােহিত। আমি দেখছি,শৈশবের সেই বালিকা, তার তারুণ্যে এসেই, এমন এক তেজঃপুপর্ণ তপস্বীর, সমস্ত রকম স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারেও অসুখী হন নি, রাগ করার যথেষ্ট কারণ থাকলেও, রাগ করেন নি, এবং যিনি কুন্তীর কাছে রাত্রে, ভােরে, সন্ধ্যায় যখন খুশি আসতেন, কখনও গঙ্গাজল দিতেন, নিন্দা করতেন, তবু কুন্তী তঁার বাধ্য থাকতেন, এ সবই কি কুন্তীর বাল্য থেকে প্রাপ্ত, দুঃখের মধ্য থেকে, নতুন জীবনকে জানার ধৈর্য ও সাহসের পরিচয়
? আমি তােদেখছি, দুর্বাসাকে যে যাই বলুন, অন্তরে তিনি মোটেই কোপন স্বভাব ছিলেন না। বরং মধুরভাধী ছিলেন। দেখতেও ছিলেন, অসাধারণ তেজবহ্নি স্বরূপ সুপুরুষ। পরাশরের তুলনায় তিনি আরও অনেক বেশি গুণসম্পন্নই দেখছি। পরাশয় যদি সত্যবতীকে গর্ভবতী করে কন্যকাবস্থা দূষিত না করে থাকেন, ইনিইবা কুন্তীর কন্যকাবস্থা দূষিত করবেন কেন ? কুন্তিভােজ রাজার গৃহে, দুর্বাসার প্রথম আবির্ভাষ যেন একটি সংকেত দেয়, তিনি কুন্তীর সেবা পাবার জন্যই কসেছিলেন। এবং তিনি কুন্তীভােজকে দিয়ে এমন সব কথা আদায় করে নিয়েছিলেন, স্বভাবতঃই মনে হয়, তার মনে কোনে ভিসন্ধি ছিল। থাকলেও তা তেমন অপরাধের কিছু নাইসার নিশ্চয়ই এমন কোনাে গুণাবলী ছিল স্বয়ং কৃষ্ণপংএই মহর্ষির তুষ্টি বিধানের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। দুর্বাসার মতাে বহ্নিকান্তিমান পুরুষকে দেখে মুগ্ধ হওয়া কি খুবই আশ্চর্যের ? তিনি বৃদ্ধ বা কুরূপ ছিলেন না। কুন্তীও আর দশটি কন্যার মতাে, মনের দিক থেকে সাধারণ কন্যা ছিলেন না সূর্যদেবের মুখ দিয়ে কুন্তীকে বসানাে হয়েছে, “তােমার পিতামাতা অন্যান্য গুরুজন তােমার প্রভু নহেন।” তা যে ছিলেন না, দুর্বাসা আগেই সেবার দায়স্বরূপ,কুন্তীর প্রতি যথেচ্ছাচারের বিষয়টি স্থির করে নিয়েছিলেন।…..

……যদিও ইতিহাসের অপরিচ্ছন্ন অস্পষ্টতায়, আমি বাস্তব দৃশ্যটি দেখতে পাচ্ছি না, তথাপি আমি যেন কুন্তীর অন্তরের মধ্যে দুর্বাসাকেই অঙ্কিত দেখছি। কিন্তু ইতিহাস এ বিষয়ে এমনই নীরবতা অর্লেন করেছে, আমি সুস্পষ্ট রূপে কিছুই দেখছি না। O৭ এই অবস্থায়, আমি স্বর্গলােকের এক রাজ্যের ক্ষুধন্তি সূর্যকে অশ্বনদীর তীরে দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছিাত্রী ও সখীগণ সহ কুন্তীও সেখানে বিচরণ করছিলেন। সঁহলাই দুজনের সঙ্গে চারি চক্ষের মিলন। চক্ষের মিলনই তঁাদে ই মিলনে আকৃষ্ট করলো। কিন্তু কুন্তী তখন রজস্বলা কুমান পরস্পরের মধ্যে মিলনে, সন্তান জন্ম অবশ্যম্ভাবী। অথচ হজমঞ্জতখন দুজনের প্রতি প্রেমাবিষ্ট। স্বভাবতঃই ধাত্রী ও সখীদের সাহায্যই, কুন্তী রাজা সুর্যকে রাজঅন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন।

কুন্তীর সঙ্গে, কুমারী অবস্থায় যার মিলন হয়েছিল, তা যে অন্তঃপুরেই হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্ত ঘটনাটিকে এমন রূপ দেওয়া হয়েছেযে, কুন্তীৰ্তার রমণীয়প্রাসাদেরশয্যায় উপবেশনপূর্বক নবােদিত সূর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করামাত্র, সূর্যের কবচকুণ্ডলযুগল মণ্ডিত দিব্যমূর্তি দর্শন করলেন । দুর্বাসাও ছিলেন সুধাধবল প্রাসাদে। স্বর্গ রাজ্যের অধিপতি সূর্য হয়তাে কুন্তী রূপৈশ্বর্যের কথা শুনেই, কুন্তিভােজ রাজার রাজ্যে এসেছিলেন। সাক্ষাৎ যদি ধরে নেওয়া হয়, অশ্বনদীর তীরেই হয়েছিল, এবং সেখানেই দুজনে দুজনকে দেখে মুগ্ধহন, তাহলেও,কুন্তীর সেই সাহসছিল, প্রেমিককে তিনি অন্তঃপুরে নিয়ে যাবেন। আমি ইতিপূর্বেই দেখেছি, কুন্তীর প্রতি সকলেই তুষ্ট। বলছেন, স্বয়ং রাজা কুন্তিভােজ। এমন কি প্রাসাদের দাসদাসী ভূতসকলও তার প্রতি আকৃষ্ট ছিল। অতএব, কুন্তীর পক্ষে রাজা সূর্যকে অন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়া কিছুমাত্র অসুবিধা ছিল না। সেখানে প্রাসাদের ভিতরে, রমণীয় শয্যায়, আহারে ব্যসনে ভূষণে পরস্পরে মধ্যে প্রেম | গাঢ়তর হয়েছিল। দুজনে প্রাসাদ মধ্যে কতােদিন কাটিয়েছেন, এক্ষেত্রে তার কোনাে হিসাব পাওয়া কঠিন !

আমি জানি, ইতিবৃত্তের এই অধ্যায়টিকে অনেকেই সংশয়ে খে দেখবেন অথচ দেখার কোনো কারণ নেই। আশে সূর্য যে মানুষের বেশে নেমে আসতে পারে না, যে-চেনা জীবই তা অনুমান করতে পারে। কিন্তু আমি এক বিষয় ভেবে বিস্মিত হচ্ছি । মুনি পরাশর বা দুর্বাসা, যা জিন তাদের তপোবলে অসাধারণ ব্যক্তি, যাদের ক্ষমতা অসীম, যারা অবিবাহিতা কন্যাদের রমণ করেও তাদের কোকাবস্থা দূষিত করতেন না, তারা কি সেই কন্যাদের গর্ভে স উৎপাদন বন্ধ করার কৌশল অবগত ছিলেন না। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা কি এক্ষেত্রে প্রয়ােগ করতে পারতেন না? তাহলে তাে কোনাে সংকটই থাকতাে না। এর দ্বারা এটিই প্রমাণ হয়, দেহ মিলনে সন্তান উৎপাদন বন্ধ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। অথচ সংহিতা যুগে, কন্যারা বা ঋষিপত্নীরা যদৃচ্ছ পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতাে, তখন বিধান ছিল, ঋতুকালে ষােলদিন পরে, মিলনে কোনাে দোষ হতো না। এর একটাই অর্থ। ঋতুকাল থেকে যােলদিন পরে, পুরুষ মিলনে, নারীর সন্তানসম্ভবা হবার ভয় থাকতো না। বিষয়টি ভাবতে অবাক লাগে। সেই সংহিতা যুগেও মানুষ জানতাে, স্ত্রী জরায়ুতে, ঋতুকালে যে ডিম্বানুর আবির্ভাব ঘটতো, ঋতু স্নানের দশ দিনের আগেই ডিম্বানুটির মৃত্যু ঘটে। অতএব, তারপরে পুরুষের শুক্রকীট জরায়ুতে প্রবেশ করলেও, ডিম্বানুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না বলেই সন্তান ধারণেরও কোনাে উপায় নেই। সংহিতা যুগেই যখন মানুষ এ বিষয়ে জানতাে তখন পৌরাণিক কালের মুনি-ঋষিরা কি জানতেন না? জানতেন। সম্ভবতঃ তাদের কন্যারমণের অভিপ্রায় ছিল, সন্তান জন্মদানই। সেদিক থেকে, যে দুজন কানীন পুত্রের কথা এই মুহূর্তেই মনে পড়ছে, আমাদের প্রাচীন ইতিবৃত্ত, তারা বিশাল ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। একজন কুন্তীর কানীন পুত্র কর্ণ । সংহিতা যুগের কন্যারা (কুমারী) স্বতন্ত্র ছিলেন, এযদৃচ্ছ পুরুষসঙ্গ করতে পারতেন, এ চিত্র আমি আগেই দেখে এসেছি। তখন তা সমাজে প্রচলিত ছিল। গােপন করাতৃপ্রয়ােজন ছিল না। কিন্তু সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে, নতুনযুঞ্জে কুমারীর গর্ভাধান সমাজে
দোষণীয় বলে গণ্য হতাে। কুন্তী গর্ভবতী হওয়া তারই প্রমাণ। কুমারী অবস্থায় পুরুষের যৌন সহচর্য ভােগ করার সাহস তাঁর ছিল। আমি আগেই লিখেছি, অন্যান্য কন্যাদের তুলনায়, তার শৈশবটাই শুরু হয়েছিল ভিন্ন ভাবে। দেখতেও ছিলেন বিশেষ রূপশালিনী। এই সংবাদটি নানা দিকে প্রচারিতও ছিল। কুন্তীর নিজেরও, দেহ মিলনের আকাঙ্ক্ষা বিষয়ে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। ইতিবৃত্তের অস্পষ্টতায়, যা আমি চাক্ষুষ করতে পারছি না, তা হলাে তার সেই প্রিয় সূর্যসম ব্যক্তিটি কে ? স্বয়ং দুর্বাসা ? অথবা স্বর্গরাজ্যের এক অধিপতি সূর্য ? আমার নিজের মনে একটি বিশ্বাস, নানা কারণেই জন্মেছে। কুন্তীর সেই পুরুষ স্বয়ং দুর্বাসাই ছিলেন। নানা যুক্তি দিয়েও এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয়। এবং এই সিদ্ধান্তে আসার, অনেক সংকেতও ঘটনার মধ্য দিয়ে পাচ্ছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কুন্তীর প্রাতঃস্মরণীয় হবার কী কারণ আছে ? এই প্রশ্নের সামনে এসেই আমাকে ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি দিতে হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে কুন্তী সবেমাত্র যৌবন লাভ করেছেন। আর তেজসিম সুপুরুষ তাঁর প্রতি প্রসন্ন। দুর্বাসার মতাে ব্যক্তি যে তাঁর প্রতি আসক্ত, এটাও একটা রমণীসুলভ বড় গুণ। কিন্তু ভবিষ্যতেই আমরা জানতে পারবে। এ ঘটনার জন্য কেন তিনি প্রাতঃস্মরণীয়া ভারতীয় রমণীগণের মধ্যে গণ্য হয়েছিলেন । ……

…..ইতিহাস যুক্তি চায়। মা গর্ভধারণের জন্য, ব্যাসদেবের সঙ্গে মিলিত হতে গিয়ে যেহেতু ভয়ে চোখ বুজেছিলেন, সেই হেতু সন্তান অন্ধ হয়ে জন্মেছিল, এ কথা বিশ্বাস করার কোনাে কারণ নেই। যেমন পাণ্ডুর জন্মের আগেই তঁার জননী ব্যাসদেবকে দেখে, ভয়ে পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিলেন, সেই কারণে গর্ভের সন্তানও পাণ্ডুর বর্ণ হয়েছিল। এওকোনো যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যা না। আপাততঃ ত্রুটির সন্ধান করতে গিয়ে, আমি এই মুহূর্তে কিছু খুজে পাচ্ছি না। তবে, আমি একটা বিষয়ে নিঃসন্দেহ, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু স্বাভাবিক সুস্থ পুরুষ ছিলেন না। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব বিষয়ে,দেখছিকেউকেউৰ্তার বিষয়েওস্নেহান্ধতাকে বােঝাতে চেয়েছেন। এসব হলো ইতিহাসের পাতাকে দূষিত করার চেষ্টা। ধৃতরাষ্ট্র প্রকৃতই অন্ধ হয়ে জন্মেছিলেন। সে ত্রুটি কার ছিল ? অম্বিকার ? না ব্যাসদেবের? যে বিচিত্রবীর্য ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতা ছিলেন (পৈতৃক পরিচয়ের দিক থেকে) সেই বিচিত্রবীর্যের দ্বারা কি তঁার দুই পত্নীকোনোরূপ অসুস্থ হয়েছিলেন ? ইতিহাস বলছে, বিচিত্রবীর্য দুই পত্নীর সঙ্গে অতিরিক্ত দৈহিক সম্ভোগের কারণে, যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। বিচিত্রবীর্য নামের মধ্যে কি বিশেষ কোনো অর্থ আছে? রূপবান সুপুরুষকে কি বিচিত্রবীর্য বলা যেতে পারে ? এই সব জিজ্ঞাসার মধ্যে কিন্তু একটা বিষয় পূচ্চিার। দুই পত্নীর তুলনায়, বিচিত্রবীর্য বয়সে বেশ ছােট ভিজে এবং ছিলেন অত্যন্ত কামুক। ইতিহাসের নীরবতার অর্থ একা, ইতিবৃত্তের অন্তরালের ঘটনাবলীকে প্রতিষ্ঠিত করার । বিচিত্রবীর্য কি অন্যান্য নারীতেও আসক্ত ছিলেন নব্যাধি পৃথিবীর মানব সমাজে এই প্রাচীন অভিশাপ চত্রবীর্য যদি কোনাে ব্যাধি তঁার দুই পত্নীকে দান করে গিয়ে থাকেন, সেটা খুব একটা আশ্চর্যের য় না। আরও দুটি বিষয় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বেদব্যাস যে দাসীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করেছিলেন, সেই বিহুর নিরােগ স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ছিলেন। তার কোনাে শারীরিক ত্রুটি ছিল না। বেদব্যাস এক শূদ্রার গর্ভে তার পুত্র শুকদেবকে জন্ম দিয়েছিলেন। তিনিও সুস্থ ছিলেন। অথচ ধৃতরাষ্ট্র আর পাণু অস্বাভাবিক ত্রুটিপূর্ণ দুটি সন্তান। আরও লক্ষণীয়, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্মের পর, অম্বিকা ও অম্বালিকার বিষয়ে আমি আর বিশেষ কোনাে সংবাদই পাচ্ছি নী যেন, ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুকে জন্মদান করা ছাড়া,তাদের আর কোনাে ভূমিকা ছিল না। হয় তাে বাস্তবিকই তা ছিল না। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন। কিন্তু পুত্রোৎপাদনে অক্ষম ছিলেন না। গান্ধারীর দীর্ঘকাল গর্ভধারণ, পিণ্ড প্রসব, তা থেকে একমাত্র পুত্রের জন্ম, এসব নিয়ে আপাতত আমার কোনাে দরকার নেই। গান্ধারী ছাড়াও, তিনি দাসীর গর্ভে দুটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। বােঝ যায় অন্ধ হলেও সন্তান জন্মদানে তিনি সক্ষম ছিলেন। কিন্তু পাণ্ডু?…..

….শুধু একটি বিষয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কুন্তী আর মাদ্রীর মতাে দুটি যুবতী পত্নীর সঙ্গে, পাণ্ডুর মিলন ঘটে নি। অথবা, যদি ধরেও নিই, মিলন ঘটেছিল, তবু এমন প্রত্যাশা করা যায় না, সেই সময়ের মিলনেই, কুন্তী বা মাদ্রী গর্ভবতী হবেনই।…

……বহু অর্থ ধনসম্পত্তি নিয়ে ফিরে এসে, রাজা হিসাবে দেশ শাসন করার পরিবর্তে, দুই পত্নীকে নিয়ে পাণ্ডু হঠাৎ বনে গমন করলেন কেন? ইতিহাস এ বিষয়ে একেবারে নীরব। অথচ, এখন রে হঠাৎ বনে গমন একেবারেই যুক্তিহীন। অথবা, বুঝতে কতদ্ভিনা নগরী ও প্রাসাদে এমন কোনাে ঘটনা ঘটেছিল রাজ্য ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ কারণটি যদি দিই, তবে কি বুঝবাে পাণ্ডু বৈরাগ্যবশতই বনবাসে থেকেছিলেন ? তারপরেই দেখছি, সেই অতি পুরুষ অসার একটি কাহিনী। কিমদ্দক নামে এক ঋষি, বন্য হরিণীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত ছিলেন। বলা হয়েছে, হরিণীটি কিমদ্দক ঋষিপত্নী। কোনাে নাম নেই। ঋষির কুটিরে স্নেহছু জায়গা নেই সেই হেতু জঙ্গলের মধ্যে স্বামীস্ত্রীহরিণের বেশ ধরে রমণে লিপ্ত হয়েছিলেন। আবার সেই অযৌক্তিক কাহিনীর অবতারণা। ভূতের গল্পের মতে, ভূতের নানা প্রাণীর বেশ ধারণ ।

কিন্তু ভৌতিক কাহিনী আর ইতিহাস এক বস্তু না। কোনাে মুনি-ঋষিই কখনও কোনাে প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারেন না। তবে পশুমৈথুন সম্ভব হতে পারে। কিমদ্দক হয় তত কোনো হরিণীর সঙ্গে মৈথুনে লিপ্ত হয়েছিলেন। পাণ্ডু মৃগয়ায় বেরিয়ে, সেই অবস্থায় দুজনকেই তীর বিদ্ধ করে হত্যা করেছিলেন। কিমদ্দক পাণ্ডুকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, পাণ্ডুও যখন স্ত্রী সঙ্গমে লিপ্ত হতে যাবেন, তখন তাঁর মৃত্যু ঘটবে। ইতিহাসে অভিশাপের ঘটনাগুলােকে ঐশী শক্তির দ্বারা প্রমাণিত করার চেষ্টা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, অভিশাপের মধ্যে কোনাে ঐশী শক্তি নেই ! অলৌকিকতাও নেই। যা আছে, তা হলাে, সেই যুগে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জ্যোতিষী বা অন্য কোনাে গুণের প্রভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। কিন্তু কিমদ্দক মুনির হরিণ বেশে মৈথুন, পাণ্ডুর মৃগহত্যা, অভিশাপ, সবটাই অবাস্তব বােধহয়। কাহিনীটি আগাগােড়া সাজানো। এবং অবশ্যই তার উদ্দেশ্যও রয়েছে। পাণ্ড যখন কুন্তী ও মাদ্রীর মতাে দুই হস্তিনীর মধ্যে বিশাল সুহীর ন্যায় বনে মহানন্দে ভ্রমণ করছিলেন, তখন হস্তিনায় জ্বিন্ধে কি হয়। ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে দাসী বা বৈশ্যা পত্নীর গর্ভে য়ুযুর জন্ম হয়। গান্ধারীর গর্ভে দুঃশলা নামে এক কন্যারয় হয়। হস্তিনা নগরে এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল তার দাসীর গর্ভে ছেলে হলো। গান্ধার প্রসব করলেন কন্যা। আর হস্তীর ন্যায় বিশাল তেজস্বীপুরুষ পাণ্ডু দুই পীরজভ একটি সন্তান উৎপাদন করতে পারলেন না?

যদি নাম, এসব ঘটনা ঘটার আগেই, কিমদ্দক মুনির অভিশাঞ্জের ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে, তা হলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু যুযুৎসু আর দুঃশলার জন্মও বিদুয়ের বিয়ের পরে, অভিশাপের ঘটনাটি ঘটলাে। প্রকৃতপক্ষে অভিশাপের ঘটনাটি হয় প্রক্ষিপ্ত। অন্যথায় স্বয়ং ব্যাস দেব কুরুবংশের রাজাকে ক্লীব দেখাতে চান নি বলেই এরকম একটি কাহিনীর অবতারণা করেছে। কোনো সন্দেহ নেই, পাণ্ডু যতােই বলশালী পুরুষ হােন, তিনি ছিলেন অসুস্থ। কেবল মৃত শুক্রের ধারক ছিলেন না। তার এমন কোনাে ব্যাধি ছিল,যে ব্যাধির কারণে নারী সঙ্গমে লিপ্ত হলেই, মৃত্যু ছিল অবধারিত। অভিশপ্ত হবার আগে দুই পত্নীকে গর্ভবতী করার মতো সময় তিনি অনেক পেয়েছিলেন। কিন্তু পারেন নি। ইতিহাস অলক্ষ্য থেকে, নীরবেই তার প্রমাণ দিচ্ছে। ভবিষ্যতে কুন্তীর, শ্বশুরকুলের লাঞ্ছনার কথাতেই তার প্রমাণ রয়েছে। শ্বশুরকুলের লাঞ্ছনা বলতে তিনি ভীমকে, বেদব্যাসকে, যুদ্ধ বা দ্রৌপদী লাঞ্ছনার জন্য দায়ী করেন নি। শ্বশুরকুলের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রকেও ধরা হয়েছে। কুন্তী বিয়ের পর, হস্তিনা নগরের প্রাসাদেই পাণ্ডুর অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি স্বয়ংবর সভায় যে-বীর পুরুষকে মাল্যদান করেছিলেন, স্বভাবতই তার প্রত্যাশা ছিল, স্বামী সহবাসের দ্বারা অচিরাৎ সুখী হবেন। তঁার কন্যকাবস্থার পুত্রকে হেতু নিজে লালন-পালন করতে পারেন নি, সেই হেতু তিনি স্বাভাবিক কারণেই, দেহে মনে অতি পুত্রার্থিনী হয়েছি। অথচ সেই প্রত্যাশিত মিলন ঘটেনি। তারপরেই আবার মন্ত্রের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থ। তঁাকে অবাক করেছিল। দুঃখও গিয়েছিল। ভেবেছিলেন, বাহক কন্যা, মাদ্রীকেই হয়তো মহার্জশি পচ্ছন্দ করেন। কিন্তু কুন্তী দেখেছিলেন পাণ্ডু মাদ্রীর সঙিৰ সহবাসে লিপ্ত হন নি। পাণু যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন।সে এসে, হস্তিনা ত্যাগ করে বনে গমন।

কুন্তী বনবাসকালেই প্রথম নিশ্চিত বুঝতে পারলেন, বাইরে থেকে যে-পুরুষকে তিনি সূর্যসম উজ্জ্বল বলশালীদেখিয়ে ছিলেন, প্রকৃত পক্ষে তিনি এক দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। মুগয়ায় গিয়ে যিনি অক্লেশে ব্যাঘ্ৰ সিংহ হত্যা করেন, সেই তিনি স্ত্রী সহবাসে অক্ষম। “শ্বশুরের দ্বারাও লাঞ্ছিত হয়েছি” কুন্তীর এই কথার একটিই অর্থ হয় । ভীষ্ম বেদব্যাস, এমন কি তঁার ভাসুর ধৃতরাষ্ট্রও জানতেন, পাণ্ডুর বিবাহ অনুচিত। তাঁর স্ত্রী গ্রহণ করা নিষ্ফল হবে। এসব জেনেও তারা পাণ্ডুকে কুন্তীর স্বয়ংবর সভায় যেতে নিষেধ করেন নি। উপরন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শল্য-ভগ্নী মাত্রীরও ক্ষতি করেছিলেন। পাণ্ডুর সঙ্গে বনবাসকালে, কুন্তী মাদ্রী প্রকৃতপক্ষে বৈধব্য জীবন যাপন করেছিলেন। আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি; কিমকের ঘটনা একটি কল্পিত অবাস্তব কাহিনী মাত্র। পাণ্ডু কুন্তীর কাছে সত্য প্রকাশে বাধ্য হলেন। তিনি কুন্তীকে বললেন, “মহারানী আমি আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতােই জন্ম থেকে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হলে আমার মৃত্যু অনিবার্য। আমি বৃথাই বীরত্ব প্রদর্শন করি। এখন থেকে আমি সাত্ত্বিক জীবন-যাপন করবে। আমি আমার সমস্ত রাজপােশাক হস্তিনায় পাঠিয়ে দেবাে।

তিনি জানতেন,রকোনােসন্তানাদিহবেনা। হস্তিনায় থেকে, তাকে দেখতে হবে, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র কুরুসিংহাসনে বসবে। তার চেয়ে পত্নীদের নিয়ে বনগমন শ্রেয়। সেখানেই তাকে ভাবতে হবে, ভবিষ্যতের জন্য কী করা যায়। অথবা, তিনি তখনই ক্ষেত্রজ সন্তানের কথাভেবেছিলেন। হস্তিনায় থেকে, ক্ষেত্রজ সন্তান পাওয়া তার পক্ষে নিশ্চয়ই কঠিন ছিল। আর কেউ বাধা না দিলেও, ধৃতরাষ্ট্র ও তঁার সঙ্গীরা বাধা দিতেন। কেন না, ইতিহাসে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, কুন্তী ও মাদ্রীর পরে, আর কোনাে রানীই ক্ষেত্ৰজ সন্তানের জন্ম দেন নি। এর একটাই কারণ। সমাজে সেই সময়ে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অতএব, হস্তিনায় থাকলে, পণ্ডুি ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করতে পারতেন না। অথচ, তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন, তার ক্ষেত্রজ পুত্ররা, তার নামে সিংহাসনের দাবীদার হবে। রাজা হবে।……

ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্য শতশৃঙ্গ পর্বতে যেতে হলো কেন? শতশৃঙ্গ পর্বতে অনেক মুনি ঋষিগণ তপস্যা করতেন। পাণ্ডু কঁাদের সহায়তা চেয়েছিলেন। সেই সব মুনি ঋষিরা যেন
ক্ষেত্রেপাদনের সম্মতি দেন, এটাই ছিল তার লক্ষ্য। তাদের সঙ্গ পাণ্ডুর বিশেষ হৃদ্যতা জন্মালাে। তঁারাপাণ্ডুর মনােগতষীর কথা জেনে, বললেন, “যার পুত্র নেই, তিনি পিতৃঋণে জ্বর থাকেন। অতএব পিতৃঋণ পরিশোধের জন্য তাঁর পুজােঞ্জন অবশ্য কর্তব্য। পতৃঋণ অবশ্যই পরিশোধ করতেই কিন্তু পাত্রর নিজের পক্ষে যখন পুত্রোৎপাদন সম্ভৰ শতিনি প্রাচীন মতানুসারে ক্ষেত্রজ পুত্র লাভ করতে পারেমব্রাক্ষণরা যখন এই নিদান দিলেন, তখন পাণ্ডুর মনে আর কোনাে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলাে না। তিনি প্রথম অনুরােধ নিয়ে কুন্তীর কাছে গেলেন।

কুন্তী কানীন পুত্রের জননী। তিনি জানতেন, সমাজে সেটি একটি গর্হিত অন্যায় কাজ, সেই কারণে তিনি পুত্র স্নেহ থেকে বঞ্চিত। ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনও অরুচিত। কুন্তী প্রথমে বললেন, “মহারাজ, আপনি আমার সঙ্গেই সহবাসে লিপ্ত হােন। আপনার সঙ্গে আমিও স্বর্গে যাবে।” বস্তুতপক্ষে এ কথা কুন্তী আদৌ বলতেই পারেন না। পুত্র লাভের জন্য, স্বামী প্রাণ হারাবেন, তিনি তা কখনও চাননি। বরং তিনি বহু পূর্বের কুরু বংশেরই রাজা ব্যুষিতাশ্বের জীবনের ঘটনা বলেছিলেন। ব্যুষিতাশ্ব আপন শক্তিতে বিশাল রাজ্য সৃষ্টি করে, সহসা অপুত্রক অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। তার মহিষী ভদ্র প্রাণত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আকাশবাণী শুনেছিলেন, ব্যুষিতাশ্ব বলেছিলেন, তিনি স্বয়ং তঁার শবদেহে আবির্ভূত হয়ে, স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করবেন। ব্যুষিতাশ্ব ভদ্রার গর্ভে তিনজন শা ও চারজন মদ্রের জন্ম দিয়েছিলেন। কুন্তী এই কাহিনী শুনিয়ে, পাণ্ডুকে বললেন, “আপনি এভাবে আমার গর্ভে পুত্রোৎপাদন করে, আমার সতীত্ব রক্ষা করুন।” পাণ্ডু জানতেন, ঘটনাটি অবাস্তব। অতএব, তি বৈাঝাবার জন্য বললেন, “রাজা বুষিতাশ্ব ছিলেন দেবতুলমানুষ। তিনি যা পারতেন, আমি তা পারি না।” এই বলে কুন্তীকে সংহিত। যুগের কথা শোনালেন, নারী পুরুষ-যক্তি স্ব জাতিতে মিলিত হলে কোনাে দোষ হতো না। উত্তরঙ্গতে (সাইবেরিয়ায়) এখনও সে ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। আমি তখন তার নিজের জন্মের কথাও শােনালেন। কুন্তী শেষ পর্যন্ত সম্মত হলেন। শুধু সম্মত হলেন না। কুমারী অবস্থায়, দুর্বাসার সেবার জন্য তিনি যে বর হিসেবে বিশেষ মন্ত্রপ্রাপ্ত হয়ে, যে-কোনো দেবতাকে ডেকে নিজের অভিলাষ পূরণ করতে পারেন, সে-কথাও বলতে ভুললেন না। কিন্তু কর্ণের জন্মের কথা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করলেন না। জীবনে কোনাে কালেই স্বামীর কাছে তিনি তা প্রকাশ করেন নি।…..

…..এইখানে এসে, ইতিহাসের ধূলাচ্ছন্ন পাতায় আমাকে বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করতে হচ্ছে। কুন্তীর জীবনের এটা একটা বড় বেদনাদায়ক ঘটনা, কোনাে সন্দেহ নেই। কন্যকাবস্থায় পুত্র জন্ম দিয়ে, তাকে ত্যাগ করতে হয়েছিল। আজ স্বামী বর্তমান থাকলেও, অন্য পুরুষের দ্বারা তাকে গর্ভধারণ করতে হবে। পুত্রের জন্ম দিতে হবে। ইতিহাসের পাতায় নানা কথার সৃষ্টি করা হয়েছে। সে সব যে একান্তই সত্য, তা ভাবার কোনাে কারণ নেই। যেমন, কুন্তী পাণ্ডুকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ দেবতাকে ডেকে তিনি গর্ভধারণ করবেন। কুন্তী পাণ্ডুকে ভালবাসেন, অথবা করুণা করেন, সেটা ভাববার বিষয়। তবে পাণ্ডুর অনুরােধ রক্ষার্থে, তিনি ক্ষেত্রজ পুত্রের জননী হতে স্বীকৃত হয়েছেন। কুন্তীর ব্যক্তিত্ব যে-ভাবে প্রকাশিত হয়েছে, বােঝা যায়, তিনি কোনাে দেবতার সঙ্গে মিলিত হবেন, তা তারই ইচ্ছাধীন। এবং আরও একটি বিষয় আমি দেখছি, কুন্তীর্যেখনই কোনো পুরুষের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয়েছেন, সেখত পাণ্ডুর উপস্থিতি নেই। পাণ্ডুর কোনাে ভূমিকাও নেই তার একটিই মাত্র ভূমিকা। পুত্রটি হবে তার ক্ষেত্রে। পরিচিতহবে তারই সন্তান রূপে।

কর্ণকে বাদ দিলে, কুন্তী এবার দ্বিাধন্সন্তানের জননী হবে। এই সন্তানটি দেখছি, ধর্মের অংশে জন্মঅর্থাৎ, কুন্তীধর্মকে আহ্বান করে, স্বামীর ক্ষেত্রে, ভবতী করতে অনুরােধ করছেন। কে এই ধর্ম ? ইতিহাসের পাতা থেকে ধুলার আস্তরণ সরালেই, এই ধর্মাত্মাকে আমি দেখতে পাই। যিনি এই ধর্মাত্মাকে জন্ম দিয়েছিলেন, তিনি সেই ধর্মাত্মার মায়ের গর্ভে তাকে উৎপাদন করে বলেছিলেন, “হে কল্যাণি। তােমার গর্ভে যে শ্রেষ্ঠ পুরুষ আসছেন, তিনি পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান ও ধর্মাত্মা হবেন।” এ ধর্মাত্মা দাসীপুত্র হলেন তার পিতা এক মহৎ ব্যক্তি। তিনি নিজেই তার এই পুত্রের সম্পর্কে আরও বলেছেন,এ পুত্ৰ ধৰ্মার্থকুশল ধীমান, মেধাবী, মহামতি, সূক্ষ্মদর্শী, স্থিরমতি পুরুষ। এই ধর্মজ্ঞের সময়ে, তার মতাে ধর্মজ্ঞ কেউ ছিলেন না। তাকে কেউ কখনও অধর্ম আচরণ করতে দেখে নি। কুন্তীএপুরুষটির প্রতি, একদিক থেকে মনে মনে আসক্ত ছিলেন। ভীষ্ম এই যুবকের শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ঠিক যেমন, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুকে শিক্ষিত করেছিলেন। এইধৰ্মাত্মা ধনুর্বেদ, গজশিক্ষা, নীতিশাস্ত্র এবং ইতিহাস পাঠ, সব বিষয়েই বিশেষ শিক্ষিত ছিলেন। এই পুরুষের নাম বিদুর। ইনিই ধর্ম। আমি জানি, ইতিবৃত্তের প্রচ্ছন্ন ধারাকে যারা বুঝতে অক্ষম, তাদের কাছে ধর্ম যে স্বয়ং বিহুর, এ তত্ব মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু বহু ঘটনার দ্বারাই এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কুন্তীর এই দেবর, বিদুর তিনি খণ্ডা’ বলে সম্বোধন করতেন । শূদ্রা জননীর গর্ভস্রাহ্মণের ঔরসে জাত সন্তানকে বলা হয় পারসব’।
পাথলেই রাজ্যে বিদুরের কোনাে অধিকার ছিল না। পারসকাছে ‘খন্ড়া’ প্রয়ােগ দেখা যায়।
কুন্তীর বিদুরকে হস্তিনায় সংবাদ দিয়ে শতশৃঙ্গ পর্বতে আহ্বানের ঘটনার পরে, যে-সকল ঘটটেছিল, তার কিছু উল্লেখ করলেই সমস্ত বিষয়টির ঐতিহাকিস্তবতা প্রমাণিত হবে।….

….অতঃপরেও কেউ কেউ কুন্তীর সঙ্গে বিছুরের মিলন, যুধিষ্ঠিরের জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবে। ইতিহাসের প্রচ্ছন্ন সংকেত যারা বুঝতে পারেনা, তারা অলৌকিক কিছু ছাড়া জীবনকে ভাবতে পারে না। তারা জ্ঞানকে বিসর্জন দেয়। অজ্ঞতাকে ভক্তিবলে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। স্বয়ং মহাভারতকার প্রকৃত ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন নি, এমন কথা আমি বলতে পারি না। কুন্তীর কন্যকাবস্থায় গর্ভধারণযেতৎকালীন সমাজে কলঙ্কজনক, যার ফলে, কুন্তীকে সন্তান পালনের গােপন ব্যবস্থা করতে হয়েছিল, সে-কথাও ঐতিহাসিক ব্যক্ত করেছেন। পরবর্তীকালে ইতিহাসের ওপর যারা কলম চালিয়েছেন, তাঁরা তাদের সমসাময়িক সমাজের কথা ভেবে, প্রকৃত ঘটনার মধ্যে কতগুলো অলৌকিক কাহিনী আরােপ করেছেন। তাঁরা ভয় পেয়েছেন। কুম্ভীর ক্ষেত্রজ পুত্রের কাহিনীর এমন একটা অলৌকিকতা দান করেছেন, যেন ওসব দেবদেবীর ব্যাপার। সাধারণত নরনারীর জীবনে ওসব ঘটতে পারে না।….

…..কুন্তী যে তঁার পারসব দেবরটির প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট ছিলেন, তঁাকে শ্রদ্ধা করতেন, তঁাকে যথার্থ ‘ধর্ম’ বলে বিশ্বাস করতেন, সেঘটনা আমি দেখেছি। পাণ্ড যখন কুন্তীকে ক্ষেত্রজপুত্ৰ উৎপন্ন করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন,এবং কুন্তী সম্মত হয়েছিলেন,তুইকির তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলেন। এবং শতশুরু পর্বত থেকে, অনুচর দ্বারা তিনি বিদুরকে ডেকে পাঠিয়েছিলেkবিদুরকে তিনি সবই খুলে বলেছিলেন। পুত্রার্থিনী হয়েমি বিদুরকে প্রার্থনা করেছিলেন ? বিদুরের মতাে নীতিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি,কুন্তীর দুঃখের কথা জানতেন। কুন্তীর প্রার্থনা মতে, তিনি গির্ভসঞ্চার করেছিলেন। কিন্তু কুন্তী কি সুখী হতে পেরেছিকৈ? কেমন করেই বা পারবেন? একবার দেহদান করাও যা, শতবার করাও তাই এবং বিদ্যুরের প্রতি তার যতাে আকর্ষণই জন্মাক, সেই পারসব দেবরটিকে চিরকালের জন্য নিজের কাছে রাখা সম্ভব ছিল না। বিহুর বিবাহিত ছিলেন। তা ছাড়া রাজকার্যে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। অতএব কুন্তীর কাছ থেকে তিনি বিদায় নিয়েছিলেন।…..

…..কুন্তীও পাণ্ডুর অভিপ্রায় মনে মনে অনুমােদন করলেন। এখানে, ইতিবৃত্তের পুরাতনধারাটিকেই অনুসরণ করতে হচ্ছে। শতশৃঙ্গপর্বতে অনেক বিদ্বান বিচক্ষণ নানা বিদ্যায় পারদর্শী ঋষিরা ছিলেন । তঁদেরও কুন্তীর প্রতি যথেষ্ট আকর্ষণ ছিল। প্রচলিত উপাখ্যান অনুযায়ী, কুন্তী বলশালী পুত্রের জন্য বায়ুকে আহ্বান করেছিলেন। এবং সেই বায়ু ‘মৃগারােহণপূর্বক’ আগমন করেছিলেন। মহাবল বায়ুর মতো একজন দেবতা ব্যক্তি হরিণের পিঠে চেপে আসেন কেমন করে ? যেহেতুক্ষেত্রজপুত্রসেই সময়ে অপ্রচলিত, অতএব জন্মদাতা পিতার পরিচয় গােপন করাহয়েছে। যেমন হয়েছে, পরবর্তীকালেও, দ্রৌপদী আর শিখণ্ডির ক্ষেত্রে। পাণ্ডবদের তত তবু ক্ষেত্রজ পুত্র বলা হয়েছে। দ্রৌপদী যেহেতু যজ্ঞস্থল থেকে আবির্ভূত হয়েছিল, সেজন্য তার আর এক নাম যাজ্ঞসেনী। যাই হােক, আমি কুন্তীর জীবনের বাস্তব ইতিহাসকে অনুসন্ধান করতে চাই। আমি আগেই দেখেছি,ভৌম-স্বর্গলােকে বিভক্ত রাজ্য গুলোতে এক একজন অধিপতি ছিলেন। বায়ুএকজন সেই রকমই স্বর্গলােকের রাজ্যের রাজা। এখানে এসেই ইতিহাসের ধুচ্ছিন্ন পাত দৃষ্টিকেও আচ্ছন্ন করে । শতশৃঙ্গেরই কোনাে অমিবলশালী ঋবিই কিভীমের পিতা? অথবা, কুন্তী কোনাে অনুকর্মলােকে বায়ুর কাছে পাঠিয়ে তাকে আহ্বান করেছিলেম কর্ণ ও যুধিষ্ঠিরের জন্মের ইতিহাস অনুর্ঘ, সম্ভবতঃ শতশৃঙ্গের কোনােঅমিতবলশালী,বিদ্বান ঋষুিংককুন্তীআহ্বানকরেছিলেন। কারণ স্বৰ্গলােকের পথের যে কু ই, দ্রুতগামী রথে এলেও, অনেকদিন সময় লেগে যাবার্থক। ব্যতিরেকে, পথ যে তেমন প্রশস্ত ছিল, এমন নয় ও অত্যন্ত দুর্গমই ছিল। অশ্বারােহণে এলেও, অনেক দিন লেগে যেতাে। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের জন্মের এক বছর পরেই ভীমের জন্ম হলো। যুধিষ্ঠিরের জন্মের পর। মাত্র দুমাস কিছুদিন সময় পরেই কুন্তী অাবার গর্ভবতী হয়েছিলেন। অবশ্য অনুচর পাঠিয়ে, বায়ুকে আহবান করলে, শতশৃঙ্গ পর্বত পৌছুতে দু মাস কিছুদিনে হয়তাে সম্ভব ছিল। তবে, কুন্তী ইতিপূর্বে, অপরিচিত অজ্ঞাত পুরুষের সঙ্গে সহবাস করেন নি। দুর্বাসা বা বিদুর উভয়ের সঙ্গেই তঁার পরিচয় ছিল। দুর্বাসার সেবা করেছিলেন এক বৎসর। এই প্রচ্ছন্নতার মধ্য দিয়েই,তৃতীয়পাণ্ডব অর্জুনেরও সম্ভবতঃ কোনাে বিশিষ্ট ঋষিপুরুষের, যিনি ব্রাহ্মণ পরশুরামের মতােই ছিলেন অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ, ঔরসে জন্ম হয়েছিল। কুন্তী যাকে শতশৃঙ্গ পর্বতেই দেখেছিলেন। ইন্দ্রকে আহ্বান করার বিষয়টি আমি সম্পূর্ণ কল্পনা জ্ঞানে অস্বীকার করতে চাই না। কেন না, এ কথা সত্যি, কুন্তীর রূপ সততা ব্যক্তিত্ব সকল শ্রেষ্ঠ মানুষ ও দেবতাকেই আকর্ষণ করতে। কিন্তু পরবর্তীকালে, পাণ্ডুর মৃত্যুর পরে, শতশৃঙ্গের ঋষিরা যেভাবেপাণ্ডুর ক্ষেত্রজপুত্রদের হস্তিনায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন, তার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সংকেত রয়েছে। শতশৃঙ্গে বিদ্বান, ধীর, শ্রেষ্ঠ ঋষিগণ পাণ্ডবদের হস্তিনায় পৌছে বিশেষ প্রয়ােজন বোধ করেছিলেন।…..

…..কুন্তী স্বস্তি বােধ করলেন। কিন্তু সুখ ও শান্তি তার জীবনে ছিল না। যৌবনে তিনি দৈহিক সুখ একবারই ভােগ করেছিলেন। সেই সুখভােগ ঘটেছিল তার কন্যকাবস্থায় । কিন্তু চরম দুঃখও তার জন্য ভােগ করতে হয়েছিল, সন্তান ত্যাগ করে। পরবর্তীকালে, পশুর অনুরােধে, ক্ষেত্রজ সন্তান ধারণ করতে গিয়ে, বিহুর সহবাসে তিনি প্রসন্ন ছিলেন। পরে আরও দুটিনিয়ােগের ক্ষেত্রে, তিনি করেছেন, কর্তব্যজ্ঞানেই করেছেন। তিনটি সন্তান জন্ম দেবারপরেও, পাণ্ডুকুন্তীকে আর একবার নিয়ােগ করে, আর একটি সন্তান চেয়েছিলেন। তখন কুন্তী অসম্মত হয়ে বলেছিলেন, ‘ধর্মবেত্তারা আপৎকালেও চতুর্থ প্রসব প্রশংসা করেন না। চতুর্থ পুরুষ সংসর্গে নারী স্বৈরিণী হয়। আর পঞ্চম পুরুষ সংসর্গ করলে বেশ্যা হয়। আপনার তা অজানা থাকার কথা নয়। তবু কেন আমাকে আবার আপনি নিয়ােগ করতে চাইলেন ? পাণ্ডু কুন্তীর কথা শুনে, নিরস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কুন্তীর মনে একটা বড় কষ্ট ছিলই। তিনি জানতেন, প্রথম পুরুষ সংসর্থের কুমারীত্ব অটুট থাকলেও, চারজন পুরুষের সংসর্গ তিনি করেছিলেন। অন্তরে তিনি স্বৈরিণী ছিলেন, এবং য৷ যতকা প্রকাশ করতে পারেন নি, ততকাল মনে কষ্ট পেয়েছে…….

Leave a Reply