হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে – প্রচেত গুপ্ত

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

…..এখন অন্যরকম হয়ে গিয়েছে দেবরূপ। যেটুকু যা দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তার মধ্যে অনন্যাকে শরীরে পাওয়ার জন্য ছটফটানি থাকে। এখন আর শুধু দু’জনে মুখােমুখি বসলাম, সিনেমা দেখলাম, রেস্তোরাঁয় খেলাম-এ সন্তুষ্ট নয়। অনন্যার শরীর দেবরূপকে হাতছানি দেয়।

পুরুষমানুষকে হাতছানি দেওয়ার মতােই অনন্যার সৌন্দর্য। লােকে বলে, মেয়েটার গায়ের রং কালাের দিকে। সেই রংয়ে যেমন জৌলুস আছে, | তেমন একধরনের আদিমতাও আছে। যারা প্রশংসা করে তাদের অনন্যা বলে “ওসব কথা বাদ দাও। আমি কালাে। এটা সরাসরি বলতে পারছ। না। নানা উপমা সাজিয়ে মিথ্যে প্রশংসা করছ। কালােকে বাপু কালােই বলাে না।”

অনন্যা মুখে যা-ই বলুক, সত্যি সে সুন্দরী। টিকলাে নাক আর থুতনি। চোখে-মুখে এক ধরনের তীক্ষ্ণ ভাব। ঘাড় লম্বা। বড়-বড় চোখ | দুটো বুদ্ধিদীপ্ত। সেখানে যৌন আবেদনও রয়েছে। সেই আবেদন উগ্র নয়, কিন্তু নজর এড়ায় না। চেহারা রােগা-পাতলা হলে কী হবে, বুক দুটো সেই তুলনায় বড়ই। সব মিলিয়ে আকর্ষক। সকলে তাই বলেও। আধুনিক মতে সুন্দরী মেয়ে ফর্সা হলে সাজগােজ করতে হয়, সুন্দরী মেয়ের গায়ের রং কালাে হলে সেই হ্যাপা কম। এই তত্ত্ব কতটা সত্যি কে জানে, তবে অনন্যার বেলায় সত্যি। সে যা-ই পােশাক পরুক, তাকে মানিয়ে যায়। চোখে কাজল দিয়ে লম্বা বিনুনি করলে মনে হয় ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে।…….

………আবার জিনস টপ, পনিটেলেও ঝকঝকে লাগে। অফিসের পােশাকেও সে স্মার্ট, কনফিডেন্ট। শাড়ি পরে বিয়েবাড়ি গেলে অবিবাহিত ছেলেরা নড়েচড়ে বসে। তবে রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে অনন্যার মাথাব্যথা নেই। যার রূপ থাকে তার বােধহয় এমনটাই হয়। পাত্তা না দেওয়াটাও একধরনের চাপা অহংকার হয়তাে। যা আছে, তা নিয়ে মাথা ঘামানাের দরকার কী? তবে শুধু অহংকার নয়, একধরনের শক্তপােক্ত আত্মসম্মান আর সাহসও আছে অনন্যার। স্কুলজীবন থেকেই ছেলেদের প্রেমে ঢুলুঢুলু চোখ, গদগদ চিঠি, নাছােড়বান্দা ঘ্যানঘ্যানানি, ট্রামে-বাসে অসভ্যতা দেখে আসছে। এখনও হয়। খুব চেনা লােক নােংরা কথা বলে মােবাইলে মেসেজ করে, বাসে কেউ অছিলায় গায়ে হাত দিতে যায়, অফিসে কেউ রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে চায়। কীভাবে এসব এড়িয়ে চলতে হয়, আর পাঁচজন মেয়ের মতাে অনন্যারও খুব ভাল করেই জানা আছে। কখনও কড়া চোখ, কখনও তাচ্ছিল্য, কখনও চাপা ধমক। তেমন হলে চড়ও কষিয়ে দিতে হতে পারে। সেই অভিজ্ঞতাও আছে। একবার নিউ মার্কেটে একজনকে চড় মেরেছিল। বয়স্ক মানুষ। বুকে হাত দিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাচ্ছিল। বুকে হাতটা অনন্যার কাছে বড় ছিল না, বড় ছিল অত বড় একটা মানুষ মেয়ের বয়সির সঙ্গে এই অসভ্যতা কেন করবে? রূপ নিয়ে যেমন নির্লিপ্ত তেমন শরীর নিয়ে ছুঁৎমার্গও আছে। অনন্যার। এই ব্যাপারে সে পুরনােপন্থী।…….

……….দেবরূপও সেটা জানে। দেবরূপকে সবটুকু দেওয়ার জন্য অনন্যা মাঝে-মাঝে উন্মুখ হলেও তার এই থমকে যাওয়াকে মনে-মনে পছন্দই করেছে। কিছুদিন হল অবস্থা বদলেছে। একমাস বা দু’মাস অন্তর একবার হলেও বন্ধুর গেস্টহাউজে অনন্যাকে নিয়ে যেতে চায় দেবরূপ। প্রতিবার অনন্যা রাজি হয় এমন নয়, তারপরেও সব মিলিয়ে বারতিন তাে গিয়েছেই। দেবরূপের জোরাজুরি যেমন থাকে, এক-আধবার নিজেও টান বােধ করেছে। তবে সে প্রথম দিকে। পরে তার মনােভাব বদল হয়েছে। অনন্যার মনে হয়েছে, শুধু প্রেমিকার সঙ্গে শরীরী মিলন নয়, এই যৌনতার মধ্যে দিয়ে দেবরূপ একধরনের টেনশন রিলিজ করতে চায়। অনন্যার মায়াই হয়েছিল। বেচারি, কেরিয়ারের চাপে নাজেহাল হয়ে রয়েছে। ভালােবাসাবাসির একটা সময়ের পর খানিকটা যেন উন্মত্তের মতােই হয়ে ওঠে ছেলেটা। শরীর নিয়ে ধস্তাধস্তি করে। বুকে, পেটে, তলপেটে মুখ ঘষে। জোরে চেপে ধরে কোমর, কাঁধ। খামচাখামচিও করে অল্পবিস্তর। এই আদরে প্রেম যতটা না থাকে, স্বার্থপরতা থাকে বেশি। কখনও-সখনও তাকে খানিকটা নির্মমও মনে হয় অনন্যার। ভাল না লাগলেও সহ্য করে অনন্যা। দায়িত্ব ভেবেই করেছে। এতে যদি ছেলেটা কিছুটা হালকা হয়, হােক। তার কাছেই তাে আসছে। ……সতেরাে দিন আগের ঘটনা। সেদিন অনন্যা দেবরূপের সঙ্গে শেষবার গেস্ট হাউজে গিয়েছিল। শরীরের ভালবাসা সেদিন খুব খারাপ দিকে মােড় নেয়। দেবরূপের সঙ্গে কুৎসিত ভাবে কথা কাটাকাটি হয়।…..

…..আধাে আলাে আধাে ছায়া মাখা ঘরে এসি চলছিল ফিসফিস করে। টপ, শার্ট খুলে শীত-শীতই করছিল অনন্যার। দেবরূপ যখন ছাড়ল অনন্যা চাদর হাতড়াতে-হাতড়াতে বলল, “ইস! আজ কিন্তু ভুল হয়ে গেল।”

দেবরূপ নগ্ন অনন্যাকে এক ঝটকায় নিজের উপর টেনে নিয়েছিল ফের। মুখের ওপর মুখ রেখে বলেছিল, “কীসের ভুল?”
অনন্যা দেবরূপের গায়ের চাদর টেনে নিয়ে আগে কোমরটুকু ঢাকল। বলল, “বুঝতে পারছ না কী ভুল? আজ প্রােটেকশন ছিল না। তুমি তাে বলে নিয়ে এলে, আমি তৈরি হয়ে আসতে পারিনি।” “আবার কীসের তৈরি! জামা-টামা খুললেই তাে তৈরি।”
অনন্যা হাত বাড়িয়ে দেবরূপের নাক নেড়ে দিয়ে বলল, “আবার খারাপ কথা? বলছি না, আজ প্রােটেকশন ছাড়াই ছিলাম দু’জনে।”
দেবরূপ হেসে বলল, “ইস, আমাকে বিশ্বাস করাই তােমার ভুল হয়েছে।”
অনন্যা কোমরের চাদর বুক পর্যন্ত টানতে গেল। পুরােটা পারল না। ডান স্তনের পাশটা দেখিয়ে বলল, “সত্যি তুমি কিন্তু খারাপ হয়ে যাচ্ছ। দেব। দেখাে, এখানটা কেমন লাল করে দিয়েছ। দেখাে একবার। জ্বালা করছে। আগের দিন বাড়ি ফিরে তলপেটে আঁচড় পেয়েছিলাম।”
দেবরূপ অনন্যাকে নিজের বুকের উপর থেকে নামিয়ে বেডসাইডে টেবিল হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট নিল, দেশলাই নিল। সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বলল, “ওসব লভ বাইটস। মেয়েদের শরীরে থাকা ভাল।”
অনন্যা আবার উঠে পড়ে দেবরূপের বুকে থুতনি রাখল। গাঢ় গলায় বলল, “আমার শরীর তােমার ভাল লাগে দেব?”
দেবরূপ ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিল, “অদ্ভুত প্রশ্ন! ভাল না লাগলে বারবার আসি কেন? আর তােমার? তােমার ভাল লাগে না?”……..

……….অনন্যা নিজের ঘরে এসে পােশাক ছেড়ে নাইটি পড়ল। আলাে নিভিয়ে শুয়ে পড়ল বিরক্তি নিয়ে। দোপাটি-সমস্যার সমাধান হল না। সমস্যা গভীর হবে। কালই মায়ের কাছ থেকে ঘটনা শুনে শিউরে উঠেছিল। অঞ্জলি তার মেয়েকে এসে জানায়, দোপাটি আজকাল মাঝে-মাঝেই ঘরে শুধু ব্রা আর প্যান্টি পরে থাকছে। প্রথমদিন ছাদে ওঠার সময় দরজার ফাঁক দিয়ে হঠাৎই চোখে পড়ে যায়। দোপাটিকে প্রায় নগ্ন দেখে অঞ্জলি থমকে দাঁড়ান। ভুরু কুঁচকে যায় তার। এ কী! মেয়েটি এভাবে ঘরে হাঁটাচলাও করছে!তবে সেদিন দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন অঞ্জলি। মনে হয়েছিল, হয়তাে ভুল বুঝেছেন। দোপাটি জামা-কাপড় বদলাচ্ছে। দরজা ভাল করে বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছে। দুদিন পরে আবার এক ঘটনা। দরজার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে ফের। অঞ্জলি একটু এগিয়েই যান। নিচু হয়ে দেখেন। চমকে ওঠেন। দরজা বন্ধ না করেই মেয়েটা খাটের উপর শুয়ে রয়েছে। বই-টই কিছু একটা পড়ছে। গায়ে শুধু ব্রা আর প্যান্টি! পাশ থেকে দেখলে মনে হবে, কিছুই নেই। শােওয়ার ভঙ্গি স্বাভাবিক। যেন এভাবে থাকতেই তার পছন্দ। অঞ্জলি অবাক হয়েছিলেন, বিরক্তও হলেন। এ কী অসভ্যতা! এত বড় মেয়ে রােজ এই ভুলটা করে কী করে? তারপরেও দরজায় নক করতে গিয়ে থমকে যান। ডেকে কী বলবেন? জামাকাপড় পরে থাকো? এটাও কি বলা যায়? ঠিক আছে, আর একদিন দেখলে মাথা ঠান্ডা করে বলতে হবে। অন্তত দরজাটা যেন ভিতর থেকে আটকে রাখে।…….

……..মেয়েটা কি সেই মােবাইলেই কথা বলছে আর হাসছে? সেদিন দোপাটির ঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিলেন অঞ্জলি। দরজার ফাঁকে চোখ রাখেন। ঘরে যে-পাশে জানলা সেদিকটায় দাঁড়িয়ে আছে। দোপাটি। আজও সে প্রায় নগ্ন। কালাে রঙের ব্রা আর মেরুন রঙের প্যান্টি ছাড়া গায়ে কিছু নেই। জানলাটা আধখােলা। দোপাটি একটা পাল্লার আড়ালে নিজেকে খানিকটা ঢেকে রেখেছে, খানিকটা রেখেছে উন্মুক্ত। জানলার ঠিক ওপাশে ফ্ল্যাটবাড়ি। বাড়ির কোনও না-কোনও ফ্ল্যাট থেকে নিশ্চয়ই এই ঘর দেখা যায়। পুরােটা না হলেও খানিকটা তাে বটেই। অঞ্জলি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তার সারা শরীর দিয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। শয়তান মেয়েটা কি কাউকে নিজের উদোম শরীর দেখাচ্ছে!
মুহুর্তখানেক সময় নিয়েছিলেন অঞ্জলি। তারপর দু’হাতে দরজা খুলে ঢুকে পড়েন ঘরে। প্রায় ছুটে গিয়ে জানলার পাল্লা বন্ধ করেন, এলােপাথাড়ি মারতে থাকেন দোপাটিকে। চড়, কিল, চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানাে কিছুই বাদ দেন না। | এই প্রথম দোপাটি একটুও বাধা না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে মার খায়। অঞ্জলি একসময় হাত চালানাে থামান। হাঁপাতে থাকেন। হুঙ্কার দিয়ে বলেন, “বল, কী করছিলি? কাকে শরীর দেখাচ্ছিলি বল?”।
দোপাটি শান্ত ভাবে বলে, “একটা কথাও বলব না। তুমি এবার যাও মামি। না হলে বিপদে পড়বে।”…….

…….অনন্যার সৌন্দর্যে একই সঙ্গে স্নিগ্ধ এবং আদিম ভাব থাকায়, তার প্রতি পুরুষমানুষের মনযোেগ বেশি। এটা একটা সময় পর্যন্ত নিশ্চয়ই অনন্যাকে ক্লান্ত এবং বিরক্ত করেছিল। এই মনযােগ ব্যাপারটাকে কখনওই সে না পেরেছে উপভােগ করতে, না পেরেছে অহংকারের বিষয় করে তুলতে। স্কুল কলেজের কত বান্ধবীই তাে পুরুষের নজর নিয়ে গর্ব করত। অর্যমা বলত, “আমার বুক তেমন বলেই তাে ছেলেরা দেখে। কেউ যদি না দেখত আমি তাে দুঃখই পেতাম। ভাবতাম, হায় রে! এই বুক লইয়া তবে আমি কী করিব?” এই কথা বলত আর হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ত।
তীর্ণা ছিল আর এককাঠি বেশি। বলত, “পুরুষ মানুষের একটু-আধটু ছোঁয়া আমার বাপু ভালই লাগে। আমার শরীর তাে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না। চরিত্র নষ্ট হয়, শরীর হয় না,” তারপর নাটুকে কায়দায় হাত ছড়িয়ে বলত, “গল্প-উপন্যাসে পড়িসনি, নারীশরীর পুরুষ ছাড়া যে ডুকরে মরে।”……..

……..দোপাটি চাপা গলায় খিলখিল করে হাসল। মালব্য কিছু একটা বলল। দোপাটি বলল, “আপনি যদি আমাকে পড়ান তাহলে আবার একদিন…” আবার চাপা হাসি। দোপাটি ফিসফিস করে বলল, “আমাকে আপনার কেমন লাগল? ছাত্রী হিসেবে ভাল না…?”
মালব্য আবার কিছু বলল। আবার হাসল দোপাটি।
কিছু একটা আওয়াজ হল। টেবিলে বই খাতা পড়ার মতাে। সব চুপ। মালব্য নিচু গলায় কিছু বলল। অল্প কিছু পর দরজা ফাঁক হল। অঞ্জলি নিজেকে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরলেন। মিশে যেতে চেষ্টা করলেন। তাঁকে যেন দেখা না যায়। দোপাটি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার গায়ে দরজা থেকে চিরে আসা আলাে পড়েছে। অঞ্জলির মাথার ভিতরটা ঝনঝন করে উঠল। দোপাটির গায়ে কিছু নেই! ম্যাক্সি ধরনের কিছু একটা গুটিয়ে কোমরের কাছে ধরা। দরজাটা টেনে দিয়ে খুব নিশ্চিন্তে সে তিনতলায় ওঠার অন্ধকার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল নগ্ন অবস্থাতেই।……….

Please follow and like us:

Leave a Reply