তুষার চিতায় – দেবকুমার বসু

›› সম্পুর্ণ গল্প  ›› ১৮+  

উৎসঃ নষ্টনারী গ্রন্থ

রবিবার সকালে একটু বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকার উপায় নেই। মেয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাকে নিয়ে আটটার মধ্যে টালিগঞ্জে পৌঁছে দিতে হয় টিউটোরিয়ালে। দশটার সময় আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হয় বাড়িতে। দু ঘণ্টার জন্যে বাড়ি ফেরা যায় না। সময়টা কোথাও কাটাতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, খুব কাছেই অম্বরের বাড়ি। ওর বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।

অম্বরের সঙ্গে পরিচয় খুব বেশিদিনের নয়। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে ও মানুষকে আপন করে নিতে পারে। আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বের সেতু তৈরি হতে বেশি সময় নেয়নি। সাধারণত পরিণত বয়সে চট করে বন্ধুত্ব হয় না। পরিচিত যে-কেউই হতে পারে। কিন্তু অম্বরের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম বলা যায়। পরস্পরকে আমরা সত্যিই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ। করেছি।

অন্য এক বন্ধু মারফৎ ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পার্ক স্ট্রীটের একটি পানশালায়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে যে-যার কাজকর্ম সেরে জনা আটেক বন্ধু ও পরিচিত ব্যক্তি মিলিত হই ওই পানশালায়। পান করতে করতে শুধুই খােশগল্প হয় না সেখানে। হঠাৎ হঠাৎ এমন এমন প্রসঙ্গ এসে পড়ে, সাধারণত যা মদের টেবিলে একেবারেই বেমানান। বিদেশী সাহিত্য থেকে শুরু করে নাট্যচিন্তা, আর্টফিল্ম, নিধুবাবুর টপ্পার দু-একটি কলি ঢুকে পড়ে সকলের অজান্তে। ঠিক সময়ে পানশালায় উপস্থিত না হতে পারলে, পাছে কিছু হারাবার সম্ভাবনা। থাকে, সেটা মাথায় রেখে সকলেই সময়ের ব্যাপারে খুবই সতর্ক। | দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম অম্বরের বাড়িতে। অম্বরের বাড়িতে ইতিপূর্বে কয়েকবার সান্ধ্যকালীন আড্ডায় মিলিত হয়েছি। সাতসকালে ওর বাড়িতে এই প্রথম এলাম। ডােরবেল টিপতে অম্বর নিজেই দরজা খুলল। আমাকে দেখে মুহূর্তে ওর মুখমণ্ডল খুশির আলােয় জ্যোতির্ময় হয়ে উঠল। বিস্ময় এবং উচ্ছাসে একাকার হয়ে ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। পরমুহূর্তেই হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল ভেতরে। একটা সােফায় আমাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার শ্যামল, দারুণ সারপ্রাইজ আজ আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল !

ওকে জানালাম আগমনের কারণ। মাত্র দেড় ঘণ্টা থাকব শুনে ওর মুখের আলাে একটু ম্লান হল। অবশ্য মুহূর্তের জন্যে। জিজ্ঞেস করল, কী খাবে বল। নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট করে আসনি ?

আমি বললাম, তুমি ব্যস্ত হয়াে না। আমি ব্রেকফাস্ট করেই এসেছি।

ও বলল, তা বললে হয় নাকি? টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ করি। আমিও খাব।’

আমর অপত্তি অগ্রাহ্য করে ও টোস্টারে স্লাইজ পাউরুটি ভরে দিল। হট প্লেটে জল বসিয়ে ডিম ছেড়ে দিল। চট করে পাশের ঘরে গিয়েই ফিরে এল। হাতে একটা রামের বােতল। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই দুটো কাচের গ্লাসে রাম ঢেলে , একটা গ্লাস আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও, শুরু কর। আমি রুটিতে মাখন ডিমগুলাে ছাড়িয়ে বসছি।

আমি মদ আপত্তি জানিয়ে বললাম, ‘সাতসকালে মদ্যপানের কি দরকার। টোস্ট-ই তাে যথেষ্ট ছিল। সেন্টার টেবিলে গ্লাস দুটো রেখে ও বলল, সকাল থেকে আমার দুটো হয়ে গেছে একটা কমােডে বসে, আর একটা দাড়ি কাটতে কাটতে। মদ্যপানের ব্যাপারে আমার কোনও সময়-অসময় নেই।

ও ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্রেকফাস্ট রেডি করতে।

আমি লক্ষ্য করলাম, ঘরের আসবাবপত্রের কোনও ছিরিছাঁদ নেই। এক কোণায় দুটো পুরনাে সােফার সামনে একটা সেন্টার টেবিল। ঘরের মাঝখানে একটা খাবার টেবিল না চারপাশে গােটা ছয়েক চেয়ার। জানালায় রাখা জলের কুঁজো। সােফার উল্টোদিকের কোণে মেঝেয় রাখা টোস্টার আর হট প্লেট। একটা দেওয়াল আলমারির কাচের পাল্লা দুটো খােলা। একটা পাল্লার তিনটে কাচের মধ্যে একটা ভাঙা। আলমারিতে ঘি-এর শিশি, জেলি মাখন, কয়েকটা কাচের গ্লাস, কাপডিশ ইত্যাদি বিক্ষিপ্তভাবে রাখা।

আমি রামের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরালাম। অম্বর রুটিতে মাখন লাগিয়ে ডিমের খােসা ছাড়াচ্ছে। খােসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, রাতে অন্তত দুবার উঠতে হয় প্রাকৃতিক তাড়নায়। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঝটপট এক পেগ মেরে দিয়ে শুয়ে পড়ি। যদি কখনও তিনবার উঠতে হয় তাহলে তিন পেগ চেপে যায়। | আমি বললাম, এটা খুব বাজে অভ্যেস। তুমি এতটা অ্যাডিকশন চেক করার চেষ্টা কর।

অম্বর প্লেটে করে টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ এনে টেবিলে রাখল। গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, এ জীবনে সেটা আর সম্ভব নয়। মদ আমাকে নিরন্তর খেয়ে চলেছে। নাও, গরম গরম টোস্ট আর ডিম খেয়ে নাও। | আমি জিজ্ঞেস করলাম, তােমার বউ মেয়েকে দেখছি না ! ওরা কোথায় ?

অম্বর বলল, আমরা পরিবারের তিনজন তিনটি গ্রহ। যে-যার নিজের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। সশব্দে হেসে আবার বলল, ‘ওপরে আছে। শীলা এখন মাকে রান্নার যােগাড় দিচ্ছে। আর মেয়ে টিভির সামনে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।

একটা অস্বাভাবিক ভিত্তিহীন সম্পর্কের আভাস পেলাম আমি। অম্বরের মতন দিলখোলা হাসিখুশি পরিণত একজন ব্যক্তির ভেতরে কোথায় যেন সূক্ষ্ম খুঁজের একটা স্পর্শ করেছে। আমি বললাম, “তােমাদের এতবড় বাড়িতে সবাই ওপরে, তুমি একটি নিচের তলায় এক একা—

অম্বর আমাকে কথা শেষ করতে দিল না। বলল, ‘সেচ্ছা নির্বাসন বলতে পার। সকলের সঙ্গে থেকেও আমি একা। ওপরে দাদা বৌদি মা ছোটভাই বউ মেয়ে মােটমুটি একটা আলাদা পরিবার। একমাত্র মা ছাড়া কারাে সঙ্গেই আমার বিশেষ কথা হয় না। প্রতিদিন দু-বেলা মা-ই আমাকে খেতে দেয়। সংসার খরচের টাকাটা অবশ্য শীলাই দেয় মাসকাবারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অম্বরের বুক ঠেলে। আমি বিষন্ন বােধ কালাম। অম্বর বলল, ‘পঁচিশ বছর আগে একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গিয়ে আমার জীবন কলঙ্কিত হয়। সেই কলঙ্কের কালি আজীবন আমাকে কলুষিত করে চলেছে। আর আমিও নিরন্তর সেই কালি ধৌত করার চেষ্টা করে আসছি মদের প্রলেপ দিয়ে। সন্ধ্যায় তােমাদের সঙ্গে দেখা হবার আগে দুপুর দেড়টার সময় আমি লাঞ্চ করতে বেরই। লাঞ্চ করি তিনটেয়। তার আগে পাঁচ পেগ ড্রিংক করি। সাড়ে তিনটেয় অফিসে ফিরে দু ঘণ্টা কাজ করি। সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়ে তােমাদের সঙ্গে দেখা হবার আগে অন্তত তিন পেগ পেটে চলে যায়। তারপর তােমাদের সঙ্গে বসে চার-পাঁচটা হয়ে যায়। রাতে বাড়ি ফিরে যতক্ষণ জেগে থাকি, ততক্ষণ চলতেই থাকে। রাতে যতবার উঠব ততবার এক পেগ করে মেরে দিই। সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা ঢেলে কমােড়ে গিয়ে বসি। তারপর দড়ি কাটতে কাটতে একটা। কাগজে চোখ বােলাতে বােলাতে একটা। স্নান সেরে তৈরি হতে হতে আরও একটা। এরপর খেয়ে-দেয়ে অফিস। অফিসে টেবিলের ড্রয়ারে একটা বােতল রাখা থাকে। হঠাৎ ইচ্ছে হলে একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক আনিয়ে একটু ঢেলে নিই। মােটামুটি প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই কালি খােবার কাজে মদকে ব্যবহার করে যাচ্ছি। কথা শেষ করে ম্লান হাসল অম্বর। আতঙ্কিত উদ্বেগে আমার মন ভারাক্রান্ত হল। অম্বর বলল, কালিটা বড্ড গাঢ়। মাঝখান থেকে মদ আমার শরীরটাকে দ্রুত চিতার দিকে টেনে নিয়ে চলেছে।

আমি বললাম, সব বুঝেও তুমি আত্মাহুতি দিচ্ছ কেন ?

ও বলল, একটা তুষার-চিতার জন্য। যেখানে পােড়ার পর শরীরটা হিমশীতল হয়ে যাবে। শান্ত হব—শান্তি পাব।

আমি বললাম, বুঝলাম না।

ও বলল, আমার জীবনটা পঁচিশ বছর আগেই থেমে গিয়েছে। আর টানতে পারছি না। বাঁচার সাধ নেই এতটুকু। একমাত্র তােমাদের উপস্থিতি আর সঙ্গের জন্য ব্যাকুল হই।

আমার ভেতরটা হু-হু করে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল অম্বরের মত সেদিন বিদায় নেবার আগে আমাদের কথা ফুরিয়ে গেল।

দশদিন নার্সিংহােমে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেচে গেল অম্বর। ভলকে ভলকে লিভাত পচা রক্তবমি করেও বেঁচে গেল ও। নার্সিংহােমে গিয়ে তাকাতে পারিনি ওর মৎস নির্বাসিত একটি মানুষের ক্ষীণ দুটি চোখ হাতছানি দিয়ে মৃত্যুকে ডাকছে যেন। ডাক্তার অম্বরকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে—চিরতরে মদ বন্ধ না করলে তিনমাসের বেশি বাঁচবে না। কিন্তু অম্বর উল্টো পথ ধরে লাগাতার মদ্যপান করে একমাসের মধ্যে নিজের চিতা সাজাবার ব্যবস্থা করে দিল।

আমরা ওর বন্ধু এবং পরিচিতরা কেওড়াতলায় যাবার আগে মিলিত হলাম এত বাড়িতে। অম্বরের মা ওর মাথার কাছে বসে আছড়াচ্ছেন আর বুক ভাসাচ্ছেন চোখ জলে। বাড়ির আর সকলকে দেখে মনে হল, এরা এ-বাড়ির লােক নয়। পাড়ায় কেউ অসুস্থ গেলে যেমন দেখতে যায় অনেকে—এদের দেখেও ঠিক সেরকম মনে হল। সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম অম্বরের বউ আর মেয়েকে দেখে। চোখ একেবারে খটখটে শুকনাে। মদ হেসে হেসে সকলের সঙ্গে কথা বলছে। ওর বৌদি সজল চোখে শাশুড়িকে সামলাবার চেষ্টা করছেন। শ্মশান থেকে ফেরার দুদিন পরে ডাকযােগে খামবন্ধ একটা চিঠি আসে অফিসের ঠিকানায়। খামের বাঁদিকে পরিষ্কার হস্তাক্ষরে লেখা : অম্বর সান্যাল, শান্তি পারাবার, পরলােক।

চিঠিটা পেয়ে চোখ ফেটে জল আসছিল। ঝাপসা চোখের সামনে খুলে ধরলাম অম্বরের সুদীর্ঘ পত্র। অম্বর লিখেছে :

‘প্রিয় শ্যামল, 

আমার মৃত্যুর দিন প্রায় ঠিকঠাক হয়ে এসেছে। এই চিঠি লিখে খামবন্ধ করে টিকিট লাগিয়ে অফিসের বেয়ারার কাছে দিয়ে যাব। আমার মৃত্যুর পরের দিন খামটা পােস্টে দেবার নির্দেশ পালন করবে বেয়ারাটা। তুমি যখন এ-চিঠি পাবে তখন আমি সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছি। | আমার জীবনের কেলেঙ্কারির আভাস দিয়েছিলাম তােমাকে। সেই কেলেঙ্কারি এবং তার পরিণতির কথা তােমাকে জানাই। | পঁচিশ বছর আগে আমি সাতাশ বছরের এক বিবাহিত যুবক। দুবছর বিবাহিত জীবন কেটে গিয়েছে। শীলা তখন অন্তঃসত্ত্বা। পেটে আট মাসের বাচ্চা নিয়ে ও তখন বাপের বাড়িতে। নিচের তলার বড় ডুইং আর মাঝারি বেডরুম তখন শীলা আর আমার দখলে। ছিল। ওপরতলার ঘরগুলাে বরাবর আকারে ছােট, সংখ্যায় বেশি। ওপরে চারটে বেডরুমের একটিতে দাদা-বৌদি-বাচ্চা। একটিতে আমার ছােটভাই ভাস্কর। বাবা তখন বেঁচে। বাবা-মায়ের একটা ঘর। আর একটা ঘরের কেউ দাবিদার ছিল না। প্রয়ােজনে যে-কেউ ব্যবহার করতে পারত। রান্নাঘর বাথরুম পায়খানা একটা করিডরের শেষ প্রান্তে।

শীলা বাপের বাড়ি যাওয়ার পর পুরাে নিচের তলাটা আমাকে যেন হাঁ করে গিলতে আসে। তখন কালে-ভদ্রে মদ্যপান করতাম। শীলার অবর্তমানে সপ্তাহে দু-একদিন পান করতাম। অফিস বেরুবার আগে একবার ওপরে যেতাম খেতে। মা এবং বৌদি দুজন দুপাশে থেকে আমার খাওয়ার পরিচর্যা করত। সংসারে বরাবরই আমার রােজগার ছিল বেশি। মায়ের হাতে তখন সংসার খরচের জন্যে পর্যাপ্ত টাকা আমিই দিতাম। আমার ব্যাপারে তখন সকলেরই একটু নেকনজর ছিল। রাতে খাবার বেড়ে বৌদি আমাকে হাঁক দিত।

এক রবিবার ছুটির দিনে বেলা দশটা নাগাদ ড্রইংরুমে বসে কাগজ পড়ছি। হঠাৎ একটি অষ্টাদশী এক হাতে ফুলঝাড়, অন্য হাতে ন্যাতা বালতি নিয়ে ঘরে ঢুকল। বুঝতে অসুবিধে হল না, কাজের ঝি। মেয়েটিকে আগে কোনওদিন দেখিনি। মেয়েটির শরীরে আমার চোখ আটকে গেল। এমন ঠাসাঠাসি যৌবন—মুহূর্তে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। কালাের ওপর সুশ্রী মুখ। খোপা দেখে বােঝা যায়, চুল ছেড়ে দিলে পাছা ছাড়িয়ে যাবে। অনম্ৰ বুক দুটি আর নিতম্বের বক্রতা ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছে। মেয়েটি লাজুক হেসে বলল, দাদা, আপনি একটু পাশের ঘরে যান, আমি ঘরটা পােস্কার করব।

আমার মাথায় তখন পােকা কিলবিল করছে। কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না নিজের মধ্যে। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, পাশের ঘরে গেলে তােমাকে দেখব কী করে! এত রূপযৌবন তুমি কোথায় পেলে ! তােমাকে দেখে তাে চোখ ফেরাতে পারছি না। কোনও কথা না বলে মেয়েটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মাথা নিচু করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তােমাকে তাে কোনওদিন দেখিনি। তুমি কি এ বাড়িতে নতুন ঢুকেছ ? মেয়েটি বলল, হ্যা। দুদিন হল। মা একমাসের জন্যি তেৰ্থ করতে গেছে। বদলিতে আমি কাজ করছি। জিজ্ঞেস করলাম, তােমার নাম কি ? জবাব দিল, ‘ঐজ্ঞে পারুল।

আমি এগিয়ে গিয়ে ওর হাত থেকে ঝাড় আর বালতিটা নিয়ে মেঝেয় রাখলাম। তারপরেই সােজা ওর বুকে হাত দিলাম। ও একটু বাধা দেবার চেষ্টা করল মাত্র। আমি সজোরে ওকে বুকে চেপে পিষে ফেললাম আমার শরীরের সঙ্গে। মুখ নামিয়ে চুমু খেলাম। ওর ঠোটে। | হঠাৎ খেয়াল হল, দরজাটা হাট করে খােলা। দরজাটা বন্ধ করে ফিরে এলাম ওর কাছে। জড়িয়ে ধরে পাশের ঘরে গিয়ে আমাদের বিছানায় শুইয়ে দিলাম ওকে। আর মিলিত হলাম ওর সঙ্গে। ‘ সমস্ত ব্যাপারটাই ঘটল একটা ঘােরের মধ্যে। বুঝতে পারলাম, পারুল দারুল। তৃপ্ত। ও আমাকে জড়িয়ে রাখল দু বাহুর বন্ধনে।

সেদিন দুপুরেই ও লুকিয়ে এল আমার ঘরে। বাড়ি যাবার নাম করে নিচে নেস পড়ে আমার ঘরে। আমার শােবার ঘরে দুজনে নগ্ন হয়ে সঙ্গমে মিলিত হলাম। আস যৌনক্ষুধায় দুজনেরই পাগল-পাগল অবস্থা। ও রাতেও আসতে চাইল। আমি সাহস দিলা ওকে।

যৌন তাড়নায় আমরা কেউ কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলিনি। খুব মনোেযােগ চিল বারবার একই খেলায় মেতে উঠেছিলাম আমরা। রাতে নিঃসাড়ে ও এল আমার ঘরে। প্রথম লক্ষ্য করে দেখলাম, ওর সিঁথিতে বাসি সিঁদুরের আভাস। জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন বিয়ে হয়েছে তােমার ?

ও বলল, দু বছর। বর নেয় না। মা-র কাছে থাকি। জিজ্ঞেস করলাম, কেন ? তােমার এত ভালাে চেহারা ও বলল, ‘খেতে দিতে পারে না। ছ’মাস রেখেছিল, তারপর পাট্টে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, “ছেলেপুলে হয়নি ?’ বলল, একটা ছেলে হয়েছিল। মরা।’

আর বিশেষ কিছু বলার বা জানার ছিল না। দুজনে দুজনকে নগ্ন করে স্বাধীন সঙ্গমে। মিলিত হলাম। সারারাতে কতবার মিলিত হয়েছিলাম, হিসেব ছিল না। কাক-ভােরে। নিঃশব্দে দরজা খুলে বিদায় দিই ওকে। | টানা একমাস পারুল আমার শয্যাসঙ্গিনী ছিল। রবিবার ও ছুটির দিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যেত সঙ্গমলীলা। বিছানায় শীলার অনুপস্থিতি ভুলিয়ে দিয়েছিল পারুল। যে-যৌনসুখ আমি পারুলের কাছে পেয়েছিলাম, শীলার তুলনায় তা আশাতিরিক্ত। কিন্তু তখনও জানতাম না, আমার জীবনে পারুলই শেষ নারী।। | তীর্থ সেরে ফিরে এসে পারুলের মা কাজে যােগ দিল। পারুলের অভাবে আমার | পাগল-পাগল অবস্থা। দীর্ঘ রাত কাটতে চায় না কিছুতেই। সেইসময় শীলা এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিল। আরও দুমাস পরে বাচ্চা নিয়ে ফিরে এল শীলা। | এক রবিবারের সকালে কাগজে চোখ বােলাচ্ছি। পাশে শীলা মেয়েকে স্তন্যপান করাচ্ছে। হঠাৎ মা, পারুলের মা আর পারুল—তিনজন ঘরে হাজির। সঙ্গে সঙ্গে আমার | ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হল। বিপদের গন্ধ পেলাম। উদ্বেগে সারা শরীর টানটান। প্রথমে কথা বলল মা, বউমা, তুমি মেয়েকে নিয়ে ওপরে যাও। অমুর সঙ্গে আমার একটু কথা আছে। শীলা আমার দিকে একবার তাকাল। গণ্ডগােলের আঁচ মুহূর্তে জানান দিল ওকে। ও দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, যা বলার আমার সামনেই বলুন। একটা কেলেঙ্কারির দুর্গন্ধ পাচ্ছি। আমি জানতে চাই কী হয়েছে। মা তাকাল পারুলের মায়ের দিকে। তুমিই বল পারুলের মা। ওকথা মুখে আনতে আমার ঘেন্না হচ্ছে। পারুলের মা পারুলকে দেখিয়ে বলল, ‘ওর পেট হয়েছে। মেজদাদাবাবু ওর পেট করে দিয়েছে। আমি এর বিচার চাই।

ঘাড় থেকে আমার মাথাটা নেমে যেতে চাইছে। শীলা কোনও কথা না বলে মেয়েকে নিয়ে ওপরে চলে গেল। আমার কী বলা উচিত, বুঝে পেলাম না। রগের দু-পাশ দপদপ করতে লাগল।

মা বলল, পারুলের মা এ-নিয়ে পাড়া মাথায় করবে। মান-সম্মান নিয়ে আর থাকা যাবে না। যা ব্যবস্থা করার কর। গলার দড়ি আমার জুটে যাবে।

হনহন করে বেরিয়ে গেল মা। পারুল কথা বলল, মা, তােমাকে তাে বলছি, দাদাবাবুর একার দোষ নয়।

ঝাজিয়ে উঠল পারুলের মা, তুই চুপ করবি ? এসব ভদ্দরনােকেদের আমার জানা আছে। আমি এর বিচার চাই।

আমার ঘড়ঘড়ে গলা, কী চাই, বল।

পারুলের মা বলল, ইচ্ছে হলে জেবনভাের রেখে দাও। তােমার মেয়েমানুষ হয়ে থাক। বাচ্চাকে মেনে নাও। নইলে খালাস করিয়ে দাও। আর দশহাজার ট্যাকা ।

এক বন্ধুর নার্সিংহােমে চিঠি লিখে আর দশহাজার টাকা দিয়ে ওদের বিদায় দিলাম। যাবার আগে পারুল কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওর মা সে-সুযােগ না দিয়ে ওকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল। | এরপর আমার মানসিক অবস্থা আন্দাজ করতে পার। সারাদিন ঘরে বসে রইলাম। স্নান, খাওয়া-দাওয়া কিছুই হল না। কেউ আমার কাছে এল না, কেউ আমাকে ডাকল না। সন্ধ্যার পরে বেরিয়ে এক বােতল মদ কিনে আনলাম। যতক্ষণ জ্ঞান ছিল, মদ গিলেছি। শীলা আর আমার কাছে আসেনি। মেয়েকে নিয়ে ওপরেই থেকে গেল। | পরদিন পাথর-ভার মাথা নিয়ে চৈতন্য এল অনেক বেলায়। মা দেখা করতে এল আমার সঙ্গে। আমি মা-র দিকে তাকাতে পারলাম না। নিঃশব্দে মা চোখের জল মুছে গেল অনেকক্ষণ। অবশেষে কোনওরকমে বলল, বউমা আর তোের সঙ্গে থাকবে না। পারলে তুই নিজেকে স্বাভাবিক করে নে। অদৃষ্ট—সবই অদৃষ্ট। | মা বেরিয়ে গেল। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি বােধ হয় স্বাভাবিক হতে পারিনি। শীলার সাহায্য, সমবেদনা ও সহযােগিতা পেলে হয়তাে সেটা সম্ভব হত। কিন্তু বদলা নেবার জন্য শীলা যা করল—সেটা ক্ষমার যােগ্য কিনা, তা বিচার করার অধিকার অবশ্যই আমার ছিল না।

ও প্রকাশ্যে আমার ছােটভাই ভাস্করের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল। প্রথম প্রথম বাচ্চাকে মায়ের কাছে রেখে ভাষ্করের সঙ্গে বেরুতে শুরু করল। সিনেমা, রেস্তোরাঁ ভিক্টোরিয়ায় ঘুরে এসে ইচ্ছে করে আমাকে শােনাবার জন্যে মায়ের কাছে গল্প করত। মা বিরক্ত হত, কিন্তু শাসন করত না। আমি মদে ডুবতে শুরু করলাম। এরপর ভাস্কর সরাসরি জানিয়ে দিল, ও বিয়ে করবে না। শীলার সঙ্গে প্রকাশ্যেই এর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হল। আমি নিচের ঘরে একা নিজের মতন থাকি—রাতে শীলা ভাবের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। শীলা আমাকে সাতপাক ঘুরে বিয়ে করেছিল । ও ভাস্করের বউ হয়ে গেল।

বেশ কয়েকবছর পরে, যখন ব্যাপারটা সকলের চোখে সয়ে গেল, তখন আমার সঙ্গে আলটপকা একটা দুটো করে কথা শুরু করল। একটা অন্যায়ের জবাবে ও যে আর একটা অন্যায় খােলাখুলিভাবে করে যাচ্ছিল—সেটা বােধ হয় তখন উপলস্তি কত পেরেছিল।

একদিন রাতে ও হঠাৎ আমার ঘরে এল। মেয়ে তখন ঠাকুমার কাছে শুতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আমি তখন নেশার ঘােরে বেশ টালমাটাল। ও বলল, এখন থেকে মাঝে মাঝে আমি তােমার কাছে থাকব। মেয়ে বড় হচ্ছে, তার চোখে আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক অক্ষুন্ন থাকা উচিত। | আমি কোনও জবাব না দিয়ে গ্লাসে মদ ঢাললাম। ও আমার বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমি বিছানায় গেলাম না। সােফার ওপর ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাতে ও একবার এসে ডাকাডাকি করেছিল। আমি আমল দিইনি।। | এরপরে রাতে ও আর কখনও আসেনি। পরবর্তীকালে মেয়েকে ভরসা করে একটি নতুন জীবনের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মেয়ের বােধবুদ্ধি হবার সঙ্গে সঙ্গে নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য আমার বিরুদ্ধে কুৎসা করে মেয়ের মনকে কলুষিত করে দেয় শীলা। আমার জীবনের শেষ আশা-ভরসা তখনই বিলীন হয়ে যায়। | তখন থেকেই বেঁচে থাকার সমস্ত আকর্ষণ হারিয়ে যায় আমার কাছে। আত্মহননের পথে চব্বিশ ঘণ্টা মদে ডুবে থাকার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে যায়।

আমার মৃত্যুতে বন্ধুরা কষ্ট পাবে ঠিকই কিন্তু তাদের কষ্ট দিয়ে আমি শান্তির পথ খুঁজে নিতে চেয়েছি। তােমরা আমাকে ক্ষমা করাে। ভালাে থেকো।

ইতি

তােমাদের মৃত অম্বর।

Leave a Reply