কালিন্দী – বানী বসু

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  ›› পৌরাণিক কাহিনী  

……কালীকেও নামতে হয় নৌকা বেঁধে। —আমার নাম পরাশর। নামটা শােনা আছে কি? —ওরে বাবা। পরাশর মুনি নাকি? গালের ভাঁজে হাসি খেলে যায়, তিনি বলেন—সে-ই। মুনি, ঋষিও, কিন্তু তুমি যে বললে না? সেই সন্ন্যাসী নই বাপু। তােমার পারের কড়ি আমি এইখানেই হিসেব করে দিয়ে দিই। বলি কন্যে, আমাকে এত মােহিত করলে কেন? কাছে এস, তােমাকে একটি অলােকসামান্য পুত্র উপহার দেব। সে তােমার ইহকাল পরকাল সব পারাপারের কড়ি হয়ে থাকবে।

লজ্জায়, সংকোচে গা মােড়াতে থাকে কালী। কটাক্ষ হেনে বলেবা রে বা! খােলা চর, চারদিক ঘিরে বহতা নদী, নৌকায় নৌকায় কত যাত্রী আসে যায়, মাঝি মাল্লা, ছি! সব দেখতে পাবে যে! কেমনতরাে মানুষ আপনি?

পরাশর সােজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন—ওই দ্যাখাে, শীতের বেলা। এখনও নদী থেকে কুহেলি সরেনি। ঘন কুয়াশায় ঢাকা জল হল অন্তরীক্ষ, কেউ কিছু দেখতে পাবে না। বলে কেঁচড় থেকে বার করলেন একটি তাপূর্ব স্ফটিকের পাত্র। বলি, ও মেয়ে তােমার গায়ে বড় আঁশটে গন্ধ, যাও দেখি মাটি মেখে একটু ঘষেমেজে চান করে এসে দেখি, তারপর এই সুরভিসার সর্বাঙ্গে মাখাে, গা দিয়ে পদ্মগন্ধ বেরবে।

সন্ধে হয়ে আসছে। এখন দিন ছােট, রাত বড়। ঘাটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রানির প্রদীপ নিবু নিবু, কালীর দেখা নেই, ত্রস্ত পায়ে সে ফিরে যায়, রাজার কাছে কেঁদে পড়ে।

কী হল? মেয়ে কি কুয়াশায় পথ হারাল? তা রাজা ডিঙি নিয়ে জলে নামতে যাবে দূর থেকে একটি ছিপছিপে নৌকা যেন আপনি ভেসে ভেসে ঘাটে এসে লাগল। কালীনামল, যেন একটি রক্তমুখী নীলা। তার তনুদেহের বিভঙ্গ যেন আজকত গল্প বলতে চায়। জেলেপাড়ার আঁধার পথ দিয়ে কুটিরে ফিরতে থাকে কালী, তার দুপাশে তার বাবা মানীলােৎপলের গন্ধে পাগল হয়ে যায়।

কালী কি দেবী হয়ে গেল? না অপ্সরী উর্বশী? এমন মনমাতানাে পদ্মগন্ধ সে কোথা থেকে পেল? তাদের প্রশ্নের জবাবে কালী বলে—মহামুনি পরাশরের সঙ্গ করেছি। তার আশীর্বাদ এই সৌরভ, আর…….

…..পায়ের আঙুলের দিকে দৃষ্টি রেখে রানির শিক্ষামহলে ঢােকে দেবব্রত। সতেরাে আঠারাে বছরের দীর্ঘদেহী ধীর তরুণ আর যােলাে বছরের দীর্ঘাঙ্গী কালনাগিনীর মতাে ধীবর কন্যা। দেখবামাত্রই বাঁধভাঙা খিল খিল হাসিতে ভেঙে পড়ে সে। তার আয়ত্ত করছে, শিক্ষা করছে রাজপুরীর সমস্ত নিয়মকানুন আচার-বিচার, সভ্যতা-ভব্যতা। প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষাগুরুও আছে। কেউ পুরুষ, কেউ নারী। কিন্তু দেবব্রতকে তত্ত্বাবধান করতেই হয়। রাজার আদেশ। তিনি এই বন্য কুসুমকেই ফুলদানে বসাচ্ছেন। এই হরিণীকে গাভির মতাে রাজপুরীর মাখা জাবনায় অভ্যস্ত করতে চাইছেন। নাগিনীর বিষ দাঁত ভেঙে দিয়ে বিটুকু পাত্রবদ্ধ করতে চাইছেন রাজবাড়ির শত্রুদের জন্য। শত্ৰু কি শুধু বাইরে? রাজবাড়ির সর্বত্র, সভায়, অন্দরমহলে, রন্ধনশালায় সর্বত্র শত্রু। রাজমহিষীকে তাদের চিনতে হবে। কূটবুদ্ধিতে তাদের বশ করতে হবে। প্রয়ােজন হলে গরল প্রয়ােগ। কিন্তু দেবব্রতকে দেখলেই উছলে ওঠে কালিন্দী। তার চলায় লাগেনাচের ছন্দ। তার চোখের ভাষা বদলে যায়। এবং খলখল ছলছল বাঁধভাঙা ঝরনার মতাে সেহাসে।

রাজশিশুর চিহ্নমাত্র নেই। দাসীরাই বা কোথায় গেল? হঠাৎ কোথা থেকে উচ্ছ্বসিত হাসির শব্দ ভেসে আসে। শব্দ তানুসরণ করে দেবব্রত দেখে দীপ জ্বেলে সন্ধ্যার গায়ে গা মিলিয়ে নীলাম্বরী পরনে কালিন্দী জানলার ধারে দাঁড়িয়ে হাসছে। হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। পাগল না কী?

দেবব্রত গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে আপনি তাে জানেন, আমি প্রগলভতা পছন্দ করি না। যা রাজবংশের উপযুক্ত নয় তা আমি সযত্নে বর্জন করে চলি।।

—সেক্ষেত্রে তাে প্রথমে আমাকে বর্জন করতে হয় কুমার। উত্তরে আরও গম্ভীর গলায় দেবব্রত বলে—বধূরা বংশের বাইরে থেকেই আসে।

তবে বন্ধুদের প্রগলভতাও সহ্য করতে হবে। জোর করে গাম্ভীর্যের ছদ্মবেশ পরে রয়েছ কেন? আমি যতদূর জানি তােমার মাও খুব রসিক। রঙ্গব্যঙ্গে নিপুণ ছিলেন। তার পুত্র হয়ে তুমি এমন আড়ষ্ট গদ্যময় আমি ভাবতেই পারি না। এ সমস্ত তােমার চাল। দেবব্রত একটি কথারও উত্তর দিচ্ছে না। কালিন্দী বলল—

—ভেবেছিলাম কোনওদিন বলব না। দেবব্রত তাড়াতাড়ি বলল—যা ভেবেছিলেন ভালােই ভেবেছিলেন। না-ইবা বললেন।

না, না, আজ আমি বলবই। আমি তােমাকে চেয়েছিলুম। আর তুমি আমাকে চেয়েছিলে। এটা তাে ভােরের আলাের মতাে সত্য ছিল আমাদের কাছে। মাঝখান থেকে এই বুড়াে শান্তনু আর তার এই বুড়ােটে রাজসভা, আর এক বােকা অথচ নিজেকে চালাক ভাবে এমন জেলেদের সর্দার কোথা থেকে আসে? কেন আসে? দেবব্রত শিউরে উঠে বলল—চুপ, চুপ।

—আজ চুপ করবার দিন নয় কুমার। আজ আমি বলবই। কালী আর কথা বলে না। খালি তার দু চোখ মেলে নির্নিমেয়ে চেয়ে থাকে কুমারের চোখের দিকে। তাদের দুজনকে ঘিরে সন্ধ্যার ছায়া ক্রমশ আরও গাঢ় হয়। প্রদীপের শিখা তাকে দেয় শুধু একটা চিকন লাবণ্য। আলােকিত করতে পারে না রানির এই একার ঘর। দেবব্রতর পা দুটি যেন মাটিতে প্রােথিত। তার নড়বার চড়বার শক্তি নেই। কালী তার দিকে চেয়ে থাকলেও কুমার চেয়ে আছে কালীরও পেছনে যে বাতায়ন যার বাইরে বিশাল কালাে অমাবস্যার আকাশ তারায় তারায় ক্রমশভরে উঠছে সেই দিকে।

—যতই আমার দিকে না চাও, চাপা গলায় হিসহিস করে উঠল কালী—তােমার কথাও রইল। আমার কথাও থাক। আজ আমাকে একটি পুত্র দিয়ে যেতেই হবে।

দেবব্রত কি এখন বলবে—হে ধরিত্রী দ্বিধা হও। আমি তােমার মধ্যে প্রবেশ করি!

এ সব কি সত্যি নাকি সে দুঃস্বপ্ন দেখছে! | কালিন্দী বলল—জরগবশান্তনুর পুত্র লাভ হয়েছে। দেখেছ তাে? সে কোনওদিন কোনও সিংহাসনের যােগ্য হবে না। কোনও ধীবরপাড়ার সর্দার হওয়ার আহ্বাও তার থাকবে কিনা সন্দেহ। কীটের মতাে একটা প্রাণ। তুমি আমাকে পুত্র দাও। সেই পুত্র কুরু সিংহাসনের, কুরু রাজ্যের অধিপতি হবে। | এবার আর পারলনা দেবব্রত। গম্ভীর গলায় বলল—একদিন আপনি শংকা প্রকাশ করেছিলেন, আমি নয়, আমার পুত্র যদি সিংহাসন চায়! তখনই আমি আমার সেই ভীষণ প্রতিজ্ঞা করি। মনে পড়ছে? হাসি ফুটে উঠল কালীর মুখে।

বলল—সমস্ত মনে রেখেই বলছি। আমি জানি তুমি অন্যদিকে যতই ধীমান হও শেষ পর্যন্ত একজন মূঢ় ক্ষত্রিয় পুত্র, যারা দেওয়া কথাকে মানুষের প্রাণ-মন-প্রেম সব কিছুর থেকে বড় করে দেখে। দেবব্রত, তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে, তুমি সিংহাসন চাইবে না। চাইছ না। প্রতিজ্ঞা করেছিলে বিবাহ করবে না। করছ না। তােমার পুত্র কোনওদিনসিংহাসনের অধিকার চাইতে আসবেনা। যে পুত্র আসবে, সেভােশান্তনু-পুত্র হবে।ওইতােমরা ক্ষেত্রজনা কীবলনা! আইন পড়াতে গিয়ে আচার্য আমাকে পড়িয়েছেন সব। ক্ষেত্রজ, কানীন। সব, সব। এবার বল। | দেবব্রত বলললজ্জা নেই আপনার? আইনের কুটিল গতি শেখাচ্ছেন? নীতি নেই? আদর্শ নেই? খলখল করে হেসে উঠল সত্যবতী।

—নীতি? আদর্শ? একজন স্বাধীন অরণ্যকুমারীর সাধ, আশা সব চুর্ণ করে বৃদ্ধ শকুনের হাতে নিজের প্রেমিকাকে তুলে দেওয়া কোথাকার নীতি? কোন আদর্শ?

গ্রীবা উঁচু করে সে বলল—চলে যাও, সত্যব্রত দেবব্রত। আর কোনওদিন তােমাকে চাইব না। কোনওদিন তােমাকে ডাকব না। যদি না পারি তাে আমার নাম সত্যবতী নয়। আর জেনে রেখ, শান্তনু- সত্যবতীর বংশ টিকবে না। আর সেই মহা বিপর্যয়ের কারণ হবে তুমি, কেবল তুমি।………

…….ভিল্ল জানত না তার আর তার বউয়ের জীবনের হিসেবনিকেশ একরকমের নয়। হতে পারে না। সে চায় ধনসম্পদ, খাতির খয়রাত আর তার চেয়েও বেশি তার এতদিনের অসম্মানের ক্ষতিপূরণ। কিন্তু তার বউ যেনাকি একদা এক সুন্দরপানা রাজপুরুষকে দেখে উতলা হয়েছিল বেপথুহৃদয়ে তার সবটুকু সমর্পণ করেছিল। করে, জীবনে প্রথম জেনেছিল সে মােটেই কোনও যে সে রমণী নয়, বন্ধ্যা নয়, তার গর্ভ উৎকৃষ্ট শস্যশালিনী। তার দেহছবিটুকুও মােটেই ফেলনা নয়। এই করেই সে চাদের টুকরােটি কোলে পেয়েছিল। তার নিজেরই যদি এত বড় ভাগ্য হয়ে থাকতে পারে, তাে তার কন্যেরও জুটবে রূপবান। মনমান রূপে শৌর্যে রাজপুত্তুর।…..

…..রানি তাে আর জিনতত্ত্ব অবগত ছিল না। এ নাতি যে কোনওমতেই এই দাদামশাইয়ের মতাে হতে পারে না, তা সে জানত না। এনাতির মা হল ধীবর রানি আর তথাকথিত রাজা উপরিচর বসুর কন্যা। ভিল্লর এখানে কোনও রােল নেই। এই শিশুর মধ্যে এসে মিশেছেন, জল, জঙ্গল, আর তপােবনা কালীর জল, রানির জঙ্গল আর পরাশরের তপােবন।….

…..কিন্তু কয়েকদিন কয়েকটা ছােটখাট কাজে কুমারের মহলে যাবার প্রয়ােজন হয়েছিল। সত্যবতীর বড় অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। দালানটুকু পার হয়েছে কিনা হয়েছে এক দল তরুণী ছুটে বেরিয়ে গেল। তাদের কারুরই বেশবাসসস্তৃত নেই। বিভ্রান্ত হয়ে সে সােজা ঢুকে পড়ে একেবারে বিচিত্রবীর্যর ঘরে। তার ছেলে সুষ্ঠু একটি অধােবাস পরা আশপাশে দু-তিনটি তরুণী তারাও অর্ধনগ্না। রানিকে দেখে যে মেয়েগুলি হরিণীর মতাে ছুট লাগাল। মাঝখানে বিচিত্রবীর্য নির্বাক। সত্যবতী বলল এ কী কুমার? এখন তােমার ব্যাকরণনা কীসের যেন একটা পাঠ নেবার কথা না?……

…..কিন্তু যে সব আশীর্বাদ বিচিত্রবীর্যের কাজে লাগলে তাে? তার দাদা চিত্রাঙ্গদ ছিল চরিত্রলক্ষণে রাগপ্রধান, আর সে হল কামপ্রধান। দাদাটি গেল গন্ধবদের সঙ্গে মস্তানি করতে গিয়ে। ভাইটি, এপিক বলছে, দুই সুন্দরী জায়া পেয়ে সম্ভোগে এমনি গা ভাসিয়ে দেয় যে তার ক্ষয় রােগ ধরে যায়। সম্ভোগে তার গা আগেই ভেসেছিল। এখন তার লাম্পট্য বােধহয় সীমা ছাড়াল। ………

……..কৃষ্ণ, তােমার ছােটভাই বিচিত্রবীর্য নিঃসন্তান মারা গেছে। তােমার দুই ভ্রাতৃবধূ বৎসহীন, হাহাকার করছে, রাজ্যটিও তাই, অনাথ একেবারে। কৃষ্ণ, তুমি তাদের একটি করে পুত্র দাও | না না না আমাকে শেষ করতে দাও | ক্ষত্রিয়দের আইন বলছে কোনও রাজপুরুষ নিঃসন্তান মারা গেলে, উপযুক্ত কোনও ব্যক্তি তার বধূকে সন্তান দিতে পারে। এ ব্যভিচার নয়, সম্পূর্ণ ধর্মসঙ্গত নৈব্যক্তিক প্রক্রিয়া একটি। এই ক্ষেত্রজ পুত্র মৃত পিতার উত্তরাধিকার পায়। সমাজ, বিধি এবং ধর্ম এই নিয়ােগপ্রথা সমর্থন করছে।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল কৃষ্ণ, তারপরে নিশ্বাস ফেলে বলল— তাহলে একবছর সময় দিন, আমিও প্রস্তুত হই, আর বধূরাও প্রস্তুত হােক।

—তা হয় না বাছা, ভেবে দেখাে সদ্য সদ্য না হলে কি গর্ভটি আর যথার্থ ক্ষেত্র থাকবে? বিলম্ব হলে, যতই ধমর্সম্মত হােক সমাজে নিন্দা হবে। আজ রাতেই সম্পন্ন করতে হবে। বধূ ঋতুস্নান করেছে, তাকে কৃতার্থ করাে বৎস।। কৃষ্ণ বলল- তবে তাই হােক।……

Please follow and like us:

Leave a Reply