ছায়াপথ – দেবকুমার বসু

›› সম্পুর্ণ গল্প  ›› ১৮+  

উৎসঃ নষ্টনারী গ্রন্থ

দুজন নারীর দোসর হয়েছিল অভিরূপ। ঠিক ‘দোসর’ বা ‘সখা’ বলাটা বােধহয় ঠিক হবে না। রক্ষিতার পুংলিঙ্গকে কী বলে? রক্ষিত বলা যায় কি! রক্ষিতা বা কেপ্ট’ বলতে একটা যৌনতার গন্ধ পাওয়া যায় তার সঙ্গে একটা অর্থনৈতিক ব্যাপারও জড়িত থাকে। যে নারী রক্ষিতা, সে অর্থের দাবীদার তার পুরুষের কাছে। তার প্রয়ােজনের অর্থ সে পাতে তার দেহের বিনিময়ে। অনেকটা বেশ্যাবৃত্তির পর্যায়েই পড়ে ব্যাপারটা। কিন্তু তফাতটা হচ্ছে—সে বিশেষ একজন পুরুষের বাঁধা মেয়েমানুষ। অন্য কাউকে দেহদান করলে সে চুক্তিভঙ্গের দায়ে পড়বে। | অভিরূপ ছিল মেয়েমানুষের কেপ্ট। প্রথমে ওকে রেখেছিল তনুশ্রী সেনগুপ্ত। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের দুনম্বর পজিশন তনুশ্রীর। মােটা অঙ্কের মাইনে ছাড়াও ফ্ল্যাট, গাড়ি এবং নানাবিধ সুযােগ-সুবিধা পায় ও কোম্পানি থেকে। বছরে একবার বিদেশ যাওয়া ওর বাঁধা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তনুশ্রী ডাকসাইটে সুন্দরী। ডানা কাটা পরী বললে কিছু ভুল বলা হয় না। পঁয়তাল্লিশ বছরে ওর যৌবন পাক্কা পঁচিশে বাঁধা। দেহের প্রতিটি খাঁজে ও বক্রতায় যৌন আবেদন চোখে বেঁধার মতন প্রকট। লাস্যময় কটাক্ষ পুরুষের রক্তে ম্যারাথন ছােটায়। | কুড়িবছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তনুশ্রীর। সম্বন্ধ করা বিয়ে। ওর চেয়ে আট বছরের বড় স্বামী ছিল কোটিপতি। ব্যক্তিত্বের সংঘাতে সম্পর্ক ভেঙে যায় মাত্র ছ’মাসের মধ্যে। আর বিয়ে করেনি ও। | অভিরূপকে ও প্রথম দেখে দশবছর আগে পার্ক স্ট্রীটের এক অভিজাত পানশালায় বেসামাল অবস্থায়। তখন অভিরূপের বয়স সাতাশ আটাশের বেশি না। অপর্যাপ্ত পৌরুষ ওর চেহারায় প্রকট। কামতাড়িত লােভী মেয়েমানুষ ওকে দেখলেই মজে যাবে। মজে গিয়েছিল তনুশ্রীও। ওকে কজা করতে দু দিনের বেশি সময় নেয়নি তনুশ্রী। তিনদিনের দিন ওকে ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে খাটিয়েছিল কলুর বলদের মতন। খুশি হয়েছিল তনুশ্রী। ছেলেটা করিতকর্মা। রতিক্রিয়ায় একেবারে পাক্কা ঝানু মাল। উল্টেপাল্টে লাগাতার সুখ দিয়েছে। | ছোঁড়াটা। | অভিরূপ বড়লােক বাপের খামখেয়ালি বহেমিয়ান ছেলে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া অভিরূপের মুখে অক্সফোর্ড ইংরিজির ফুলঝুরি ছােটে। প্লে-বয় অভিরূপের কপালে কুড়ি থেকে পঞ্চাশ বছরের মেয়েমানুষ জুটে যায় অহরহ। তাই, বিয়ে করার মতন বােকামিটা করেনি ও। ডিক্সনারী আর পাঁজির পার্থক্যটা প্রথম থেকেই বুঝেছিল ও। ডিক্সনারীর অবস্থান আবহমান—পাঁজির প্রয়ােজন শেষ বছর ঘুরলেই। নিয়ে এসাে নতুন পাঁজি!

তনুশ্রী ওর জীবনে ডিক্সনারী হয়নি। গৃহপালিত পশুর মতন ওর গলায় একটা অদৃশ্য। ডল পরিয়ে দিয়েছিল। তনুশ্রীর ইচ্ছে নয়-অসংখ্য নারীগমনে অভিরূপের ক্ষয় হােক। ০ব পৌরুষ আর যৌবনটাকে পুরােপুরি একা ভােগ করতে চায় তনুশ্রী। কাউকে ভাগ দেবার পক্ষপাতী নয় ও। শাসন এবং শােষণ যা করার ও একাই করবে।

অভিরূপের সঙ্গে তনুশ্রীর একটি অলিখিত চুক্তি হয়—অভিরূপ তনুশ্রীর কেনা পুরুষ। অভিরূপের যাবতীয় প্রয়ােজন মেটাবার দায় তনুশ্রীর। বিনিময়ে অভিরূপ নিয়মিত যৌন সুখ দেবে একমাত্র তনুশ্রীকেই।

এই প্রথা চালু হল ঠিকই কিন্তু দেখা গেল তনুশ্রী তার প্রাপ্য যৌনতা থেকে বঞ্চিত হয়। না বটে, তবে অভিরূপের বিশেষ কোনও চাহিদা নেই তনুশ্রীর কাছে। কী চাইবে অভিরূপ! এর তাে কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। বড়লােক বাপের ও হল চতুর্থ পুত্র। ওর পরেও একজন আছে। ও বাদে বাকি চার ভাইয়ের মধ্যে দুজন নিয়মিত বাবার ব্যবসা দেখে। বাকি ডজন বাপের টাকাতেই আলাদা আলাদা ব্যবসা করে। সবকটা ব্যবসাই ইমপাের্ট এক্সপাের্টের। প্রত্যেকের ব্যবসাই বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। অভিরূপ মাঝে-মধ্যে বাবার অফিসে। যাতায়াত করে। ওর নিজস্ব একটা চেম্বার আছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেটি ফাকা পড়ে। থাকে। মনােযােগ দিয়ে ব্যবসা করলে অন্য ভাইদের চেয়ে ও কিছু কমতি যেত না। সেটা বােঝেন ওর বাবা। ন’মাসে ছ’মাসে হুট বলতে এক একটা ডিল করে ও কোম্পানিকে বিশ। পঁচিশ লক্ষ টাকা পাইয়ে দেয়। অভিরূপ প্রয়ােজন মতন টাকা পায় বাবার কাছ থেকে। ওদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব গাড়ি আছে। কী চাইবে ও তনুশ্রীর কাছে!

ঠিক এই কারণেই তনুশ্রীর মনটা খচখচ করে। অভিরূপ ওকে দিতে কিছু ঘাটতি রাখে। নি। অন্য নারীতে ও গমন করে না। অবশ্য তার প্রধান কারণ, তনুশ্রীকে ছেড়ে অন্য নারীর কাছে যাবার ওর প্রয়ােজন হয় না। যৌনতার ব্যাপারে তনুশ্রীরও দেবার শেষ নেই। অপার । রহস্য দেখে অভিরূপ তনুশ্রীর মধ্যে। স্বার্থ ও শর্তের ব্যাপারটা একটু একটু করে। ভালােবাসার দিকে মােড় নিতে থাকে তনুশ্রীর মধ্যে।

তনুশ্রীর আপন বলতে একমাত্র মা ছাড়া আর কেউ নেই। ওর কাছেই থাকে ওর ফ্ল্যাটে। অভিরূপের সঙ্গে ও মাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ওর মা জানেন, অভিরূপের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা। কেননা অভিরূপ যখন তখন থেকে যায় তনুশ্রীর ফ্ল্যাটে। রাতে ওরা এক বিছানায় শােয়। তনুশ্রীর মায়ের ইচ্ছে—ও অভিরূপকে বিয়ে করুক। শেষ জীবনে মেয়েদের অবলম্বন হিসেবে একজন পুরুষ দরকার—বিষয় সম্পত্তি যা-ই থাক না কেন। এটা তনুশ্রীর মায়ের বিশ্বাস। কিন্তু বিয়ের বন্ধনে তনুশ্রী আর জড়াতে চায় না। ওর বিশ্বাস, বিয়ে না করলেও অভিরূপ ওকে ছেড়ে যাবে না। এই বিশ্বাসের কারণ একটাই— অবচেতনে ও অভিরূপের ভালােবাসার জালে বাঁধা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু ও বােঝেনি ভালােবাসা’ নামে কোনও শব্দ অভিরূপের অভিধানে ছিল না কোনওদিন।

বছরখানেক পরে অভিরূপ একটি কু-চক্রের কবলে পড়ে। তারা ওকে দিয়ে একটি বাণিজ্যিক ছবি প্রযােজনা করাতে চায়। ও ছবিটা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওর পরিকল্পনা শুনে তনুশ্রী সায় দিতে পারেনি। ফিল্ম লাইন সম্পর্কে তনুশ্রীর একটা চাপা ভয় ছিল। ওর ধারণা। ফিল্ম লাইনে সুন্দরী যুবতীরা একটু মুখ দেখাবার জন্যে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই যৌবন-সাগরে ওর অভিরূপ না-হারিয়ে যায়। শর্ত আরােপ করে তাে ও অভিরূপকে বাঁধতে পারেনি। ওর দিক থেকে ভালােবাসার জোরে ও অভিরূপকে বেঁধেছে। তাই ভয়টা ওরই বেশি। কিন্তু অভিরূপ ওর সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়তে রাজি নয়। অনেক চেষ্টা। করেও ও অভিরূপকে টলাতে পারল না।। | অভিরূপ ওর বাবাকে রাজি করিয়ে দশ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিল। এ ব্যাপারে ওর দই দাদার তীব্র আপত্তি ছিল। কিন্তু তাদের আপত্তি শেষ পর্যন্ত টেকেনি। ছেলের প্রতি বাবার দুর্বলতা কাজ করেছিল বেশি।

একজন নামকরা চিত্রপরিচালক ওই চক্রের নাটের গুরু ছিলেন। টালিগঞ্জের একটি স্টুডিওতে ওঁর স্থায়ী অফিস-ঘর ছিল বারােমাসের জন্যে। ভদ্রলােকের মেয়েমানুষের দোষ ছিল যােল আনা। বেশ কিছু কাহিনীকার ও সাহিত্যিককে তিনি টুপি পরিয়েছেন কারসাজি। করে। ভদ্রলােক চিত্র পরিচালনার ব্যাপারটা যদিও ভালাে বুঝতেন, আসলে তিনি ছিলেন একটি লম্পট ও পাক্কা জোচ্চোর। সেই ভদ্রলােকের পাল্লায় পড়ল অভিরূপ।

তিনমাসের মধ্যেই ওর টাকাটা ধাঁই-পুটপাট হয়ে গেল। তথাকথিত ছবির কাজ হয়েছিল মাত্র সিকিভাগ। চিত্রপরিচালকের চুক্তিতে এমন কারসাজি ছিল, যা অভিরূপের মতন সরল খামখেয়ালি ছেলের পক্ষে বােঝা কঠিন। ওকে আরও দশ লক্ষ টাকা দিতে বলেন পরিচালক মশাই। ও আবার বাবার কাছে টাকা চাইতে দাদারা এবার রুখে দাঁড়াল। অশান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে আচমকা ওর বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাক হল এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রাণ হারালেন তিনি। | এক মাসের মধ্যে বাকি ভাইরা জোট বেঁধে অভিরূপকে আলাদা করে দিল। বিষয়সম্পত্তি ও ব্যবসার ভাগীদার হিসেবে ও নগদে প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকা পেল। ভাইয়েরা স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসার সঙ্গে অভিরূপকে জড়াতে রাজি ছিল না। কিন্তু ওকে ঠকায়নি একটি পয়সাও। ওর প্রাপ্য ওকে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় করেছিল এবং বাবার আকস্মিক মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছিল ওকেই।।

সিনেমার পেছনে আরও টাকা ঢেলে আর নিজের কাপ্তেনি সামলাতে দুবছরের মধ্যেই। অভিরূপ নিঃস্ব হয়ে গেল। বরাবর যারা বড়লােকি চালে মােসাহেব নিয়ে ফুটানি করে— তারা একটা সময় পর্যন্ত পরিচিত মহল থেকে মােটামুটি ভালাে টাকা সংগ্রহ করতে পারে। সেইভাবে অভিরূপ কাটিয়ে দিল মাস ছয়েক। তারপর ধীরে ধীরে সকলের চোখে ওর স্বরূপ খুলে গেল একদিন। বিভিন্ন মহলে তখন ওর প্রচুর দেনা। কপর্দকশূন্য অভিরূপ তখন পুরােপুরি নির্ভরশীল হয়ে উঠল তনুশ্রীর উপর। বাবা মারা যাবার পরও পাকাপাকি ভাবেই তনুশ্রীর কাছে থাকত। এবার ওর যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নিতে হল তনুশ্রী কেই।।

প্রথম থেকেই তনুশ্রী অভিরূপকে নিজের কেপ্ট হিসেবে রাখতে চেয়েছিল। প্রায় তিনবছর পরে একগাদা দেনা মাথায় নিয়ে অভিরূপ পুরোপুরি কেপ্ট হয়েগেল তনুশ্রীর। কিন্তু ততদিনে তনুশ্রী গলা অবধি ডুবে গেছে অভিরূপরের প্রেমে।

অভিরূপের সমস্ত দেনা মিটিয়ে দিল তনুশ্রী। নিজের ব্যবহারের গাড়িটা সব সময়ের জন্য অভিরূপের হেপাজতে দিয়ে দিল। ওকে অফিসে পৌঁছানাে এবং ফেরানাের দায়িত্ব পড়ল অভিরূপের ওপর। তনশ্রীর চাকরি জীবনে যে সঞ্চয় এবং রােজগার ছিল, তাকে অপর্যাপ্তই বলা যায়। কাপের সমস্ত দায় নিজের কাধে নিতে পেরে স্বস্তি বােধ করেছিল তনুশ্রী। খুশি হয়েছিল। কিন্তু একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল অভিরূপ। এই প্রথম জীবনের পরাজয় কাটা নৈরাশ্যের রূপ নিচ্ছিল ওর ভেতরে। সব সময় বিষন্ন দেখাত ওকে। . একদিন সকাল থেকে অভিরূপ এত বেশি মদ্যপান করে বসল, যা প্রায় আত্মহত্যার মিল। তনুশ্রী ওকে একটা নামী নার্সিংহােমের ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি করায় বাধ্য হয়ে। কোমায় প্রায় ঢুকতে ঢুকতে বেঁচে গেল অভিরূপ। নিজের বা অন্য কারাে জীবনের প্রতি ওর কোনও ভালােবাসা ছিল না। সন্দেহ হয় তনুশ্রীর। সুযােগ সন্ধান বুঝে জিজ্ঞাসাবাদ করে ও জেনেছিল, অভিরূপ আত্মহত্যার চেষ্টাই করেছিল।

বিষাদে ডুবে যায় তনুশ্রী। অভিরূপের কোনও অভাব ও রাখেনি। নিজে পছন্দ করে ওর পােশাক-আশাক কিনে দেয়। রাতে নিজে হাতে ওর পছন্দ মতন এক-আধটা পদ রান্না করে খাওয়ায়। সেলারে নানাবিধ পানীয় সাজানাে থাকে ওর জন্যে। অফিস থেকে বেরিয়ে দুজনে নিয়মিত পার্ক স্ট্রীটের একটা অভিজাত পানশালা অথবা কোনও-না-কোনও নামী ক্লাবে সময় কাটায়। কখনও কখনও বাইরে রাতের আহার সেরে ফেরে। এছাড়াও মাসের প্রথমে পাঁচহাজার টাকা ধরিয়ে দেয় ওর হাতে। এত করেও অভিরূপের বিষন্ন মুখ দেখতে ভালাে লাগে না তনুশ্রীর। ওকে বােঝায়—বাকি জীবনের সুখ-দুঃখ ও ভাগ করে নিক তনুশ্রীর সঙ্গে। কিন্তু অভিরূপের বুঝি পৌরুষে বাধে। | বিছানায় অভিরূপের দাপট আগের চেয়ে কিছুটা ক্ষীণ হয়ে গেলেও তনুশ্রী মানিয়ে নেয়। ও নিজেও আগের মতন অতটা ধকল নিতে পারে না। আসলে শাসন ও শােষণের ব্যাপারটা তনুশ্রীর কাছে ভালােবাসায় রূপান্তরিত হয়েছিল। সেই ভালােবাসার তাগিদেই তনুশ্রী তখন অভিরূপের জন্যে যে-কোনও ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। কিন্তু অভিরূপের ভেতরে সেইসব অনুভূতি আদৌ কাজ করেনি।

তিনমাস ভালােভাবেই কেটে গেল। পুজোর ছুটিতে দুজনে বেড়াতে গেল বম্বে গােয়। এয়ার প্যাসেজ, হােটেল ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করল তনুশ্রী। প্রমােদ ভ্রমণের বদলে ওদের বেড়ানােটা হনিমুনকেও টপকে গেল। কিন্তু বেড়িয়ে ফেরার সাতদিনের মধ্যেই অভিরূপ দ্বিতীয়বার আত্মহত্যার আয়ােজন করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল তনুশ্রীর কাছে। আলমারিতে অভিরূপের জামা-কাপড়ের মধ্যে। লুকিয়ে রাখা তীব্র বিষের শিশি হাতে পড়ে যায় তনুশ্রীর। অভিরূপকে জড়িয়ে কান্নায়। ভেঙে পড়ে তনুশ্রী। কান্না-জড়ানাে স্বরে বলতে যাকে, কী পাপ করেছি আমি, যে ছেড়ে। যেতে চাইছ! তােমাকে ছেড়ে আমি কিছুতেই বাঁচব না। যদি মরতেই হয় তাহলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে মর। একা রেখে যেও না আমাকে—একা রেখে যেও না। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে তনুশ্রী। হতভম্ব অভিরূপ কোনও জবাব দিতে পারে না।

তনুশ্রী সাতদিন অফিস কামাই করে বাড়িতে বসে রইল অভিরূপের সঙ্গে। মনােরােগ। বিশেষজ্ঞকে দেখাতে চাইলে অভিরূপ রাজি হল না। ক্রমশ তনুশ্রীর ধারণা বদ্ধমূল হল— আত্মহত্যার কবল থেকে অভিরূপকে ঠেকানাে যাবে না। অনেক ভেবে দেখল তনুশ্রী, অভিরূপকে ছেড়ে ওর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিল তনুশ্রী মরতে হলে দুজনে একসঙ্গে মরবে। | অভিরূপকে অনেক বােঝানাের চেষ্টা করে বিফল হয় তনুশ্রী। অভিরূপের স্পষ্ট জবাব—ওর বাঁচার কোনও ইচ্ছে নেই। বাঁচা মরা দুই-ই সমান ওর কাছে। উদ্দেশ্যহীন একটা জীবনকে ও আর বইতে পারছে না। পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে ও মৃত্যুকে আহ্বান করে। জীবনের কোনও মানে নেই ওর কাছে।

তনুশ্রীরও জীবনের কোনও মানে থাকে না অভিরূপকে বাদ দিয়ে। ওরা ঠিক করে ফেলল, যুগলে আত্মহত্যা করবে।

একদিন সকাল থেকে দুজনে এলােমেলাে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এয়ারপাের্ট থেকে। ডায়মন্ডহারবার। আবার ডায়মন্ডহারবার থেকে এয়ারপোের্ট। চলমান গাড়িতে চলতে লাগল মদ্যপান। সন্ধ্যা ঘনাবার আগে দুজনে গিয়ে ঢুকল এয়ারপাের্ট হােহাটেলে। মদের সঙ্গে বাদাম খাবার মতন দুজনে ঘুমের বড়ি খেতে শুরু করল। একটা সময় দুজনেরই চোখে। অন্ধকার নামতে শুরু করল। কোনওরকমে দুজনে দুজনকে ধরে গাড়িতে গিয়ে বসল। গাড়ি স্টার্ট করে গিয়ার দিতেই প্রায় অচৈতন্য অভিরূপ ঢলে পড়ল গাড়ির সীটে। বেশি দূর যেতে পারেনি। একটা গাছে ধাক্কা মেরে স্থির হয়ে গেল গাড়িটা। স্থির তনুশ্রী অভিরূপও।

লােক জানাজানি হতে দেরি হল না। ভিড় জমে গেল ওদের গাড়িটা ঘিরে। পুলিশ এসে মৃতপ্রায় দুজনকে তুলে নিয়ে দ্রুত ঢুকিয়ে দিল আর. জি. কর হাসপাতালে। দুজনকে বাঁচাতে হিমসিম খেতে হচ্ছিল ডাক্তারদের। পাম্প করে মদের সঙ্গে মিশে যাওয়া ঘুমের ওষুধ বের করতে লাগল ডাক্তাররা। জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি ঝুলে রইল দুজনে।

পুলিশ আইডেন্টিফাই করে খবর দিল তনুশ্রীর অফিসে ও বাড়িতে। খবর পেল অভিরূপের ভাইয়েরা। হাউমাউ করতে করতে ছুটে এল তনুশ্রীর মা। অভিরূপের ভাইয়েরাও উপস্থিত হল। দুদিন পরে জ্ঞান এল তনুশ্রীর। তিনদিন পরে অভিরূপের।

তনুশ্রীর অফিস থেকে ব্যবস্থা করে ওকে নিয়ে গেল বড় নার্সিংহােমে। অভিরূপের  ভাইয়েরাও ওকে তুলে নিয়ে গেল অন্য একটি নার্মিত চিকিৎসা শুরু হল। ইনটেনসিভ কেয়ারে  চিকিৎসা শুরু হল দুজনের।

বেঁচে গেল দুজনেই। বেশ কিছুদিন নার্সিংহােমে থেকে বাড়ি ফিরল তনুশ্রী। অভিরূপকে ফিরে আবার জায়গা দিল ওর দাদারা। বাড়িতে আশ্রয় দিল বৌদিরা। ওরা সম্পর পরস্পরের ঠিকানা হারিয়ে ফেলল। তনুশ্রীর কাছে অভিরূপ মৃত। অভিরূপের কাছেও তনুশ্রী তাই। তবু তনুশ্রীর হৃদয়ে জেগে রইল ভালােবাসা।

ভালােবাসার ব্যাপারে অভিরূপের কোনও অনুভূতি ছিল না। ওর সঙ্গে আত্মাহুতি দিতে নয়েছিল তনুশ্রী, শুধুই ভালােবেসেছিল বলে। কিন্তু সেসব সূক্ষ্ম মানসিক ব্যাপার ওর মাথায় ঢােকে না। নারীসঙ্গটা বােঝে—নারী-মন বােঝে না।।

কিছুদিন স্বাভাবিক জীবন কাটাবার পর আবার পােকা নড়তে শুরু করে অভিরূপের। মাথায়। নারীসঙ্গর জন্য ছটফট করতে থাকে। হােটেল ক্লাবে যাতায়াত শুরু করল আবার। একটা হােটেলে চন্দ্রিমা নামে একটি যুবতী যেচে আলাপ করল ওর সঙ্গে। সেই একই ব্যাপার। কামনা করলেই মেয়ে জুটে যায় ওর কপালে। চন্দ্রিমার বয়স বছর ত্রিশের মতন। এ-ও আরেক রূপের হাট। উপছে পড়া যৌবন ও বিলােতে চাইল অভিরূপকে। প্রথম দিন আলাপের পরেই চন্দ্রিমা ওকে হােটেলের একটি ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা পাকাপাকি চন্দ্রিমার দখলে। আগে ঘরটা ছিল ওর মায়ের। তখন গান গেয়ে গেয়ে নাচত এই হােটেলে। এখন সেই জায়গাটা পেয়েছে চন্দ্রিমা। চন্দ্রিমা গান গায় নেচে নেচে।

সেই ঘরে চন্দ্রিমা বুকে তুলে নিল অভিরূপকে। অভিরূপের শরীরের নিচে শুয়ে তৃপ্ত। হল ও। রাতে ফিরতে দিল না অভিরূপকে।। | অভিরূপের জীবন আবার বদলে যেতে শুরু করল। অফিস বাড়ির সঙ্গে আবার সম্পর্ক ছিন্ন হল ওর। নতুন ঠিকানা হল সেই হােটেল। কিছু বােঝার আগেই ও চন্দ্রিমার কেপ্ট হয়ে গেল। একটা ছন্নছাড়া বেকার যুবকের না-চাইতেই সব জুটে যেতে লাগল। ওর থাকার। জায়গা হল হােটেলে। নিয়মিত মদ্যপান ও অবাধ সঙ্গম চলতে লাগল চন্দ্রিমার সঙ্গে। | একদিন চন্দ্রিমা অভিরূপকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে চন্দ্রিমার মা নন্দার সঙ্গে পরিচয় হল অভিরূপের। নন্দাকে দেখে বােঝা যায়, এককালে বহু পুরুষের মাথা। ঘুরিয়েছে। এখনও যৌবন যাই-যাই করেও যেতে পারেনি। সাত-আট বছরের একটি ফুটফুটে মেয়েকে দেখিয়ে চন্দ্রিমা বলেছিল, ওর মেয়ে রুনি। অভিরূপ জানত না, চন্দ্রিমা বিবাহিতা। এখন দেখল, শুধু বিবাহিতাই নয়—মা-ও বটে। কোনও পুরুষমানুষের দেখা পেল না অভিরূপ। সে-কথা জিজ্ঞেস করতে চন্দ্রিমা জানাল—ওরা তিনজনই থাকে এ বাড়িতে। চন্দ্রিমার সঙ্গে ওর বরের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে পাঁচ বছর আগে।

তিনমাস যেতে-না-যেতেই চন্দ্রিমা অভিরূপকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এতদিন পরে অভিরূপও একটা স্থায়ী ঠিকানায় নিজেকে বাঁধতে চাইল। সমস্যা একটাই—ও কিছ কত না। কিন্তু চন্দ্রিমা ওকে বােঝাল—ওর যা রােজগার তাতে হেসে খেলে চলে যাবে ওদের। | অভিরূপ জানত না, মাথার ওপর একজন পুরুষ প্রহরী রাখার তাগিদেই না আর চন্দ্রিমা পরিকল্পনা মাফিক বাঁধতে চায় ওকে। চন্দ্রিমাকে বিয়ে করে অভিরূপ ওর বর এবং রুনির বাবা হয়ে গেল। | অল্পদিনের মধ্যেই অভিরূপ বুঝে গেল, চন্দ্রিমার আসল রােজগারটা হােটেল থেকে আসে না। হােটেলে নেচে গেয়ে যা পায়—চন্দ্রিমার খরচ তার চেয়ে অনেক বেশি। মা মেয়ে দুজনেই শরীর বেচে সেই অতিরিক্ত টাকাটা আয় করে। | যেহেতু ও চন্দ্রিমার কেপ্ট, তাই এ ব্যাপারে ওর বলার কিছুই থাকে না। কিন্তু ও ভেবে। পায় না, চন্দ্রিমা ওকে বিয়ে করল কেন! নন্দা আর চন্দ্রিমা প্রকাশ্যেই যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে অর্থ উপার্জন করে।  অভিরূপ একদিন বলেই ফেলল চন্দ্রিমাকে, তােমরা যে বেশ্যাবৃত্তি কর সেকথা আগে বলনি কেন? ঘেন্না হয় তােমাদের দেখে।

সরােষে চন্দ্রিমা বলেছিল, আমরা কিছু একটা করি। রােজগার করি। তুমি কী কর? বেশ্যার দয়াতেই তাে সব জোটে তােমার।

জোঁকের মুখে নুন পড়ার অবস্থা হয় অভিরূপের। ও আর কথা বাড়ায় না। শুধু বুঝে যায়নন্দার জায়গায় চন্দ্রিমা পৌঁছলে চন্দ্রিমার জায়গায় রুনি পৌঁছে যাবে। | একদিন সন্ধ্যায় হােটেলের ঘরে টিভি চালিয়ে মদ গিলছিল অভিরূপ। বছর পঞ্চাশের একজন সমর্থ পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এল নন্দা ও চন্দ্রিমা। মা ও মেয়ে একসঙ্গে একই পুরুষের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হতে পারে—এ ধারণা ছিল না অভিরূপের। ও ঘর থেকে। বেরিয়ে গেল। | ঘরের ভেতরের দৃশ্যটা কল্পনা করে ঈর্ষা বােধ করে অভিরূপ। ইতিপূর্বে কোনও নারীঘটিত ব্যাপারে কোনও পুরুষের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়নি ও। এই প্রথম ওর মধ্যে ঈর্ষার জন্ম হয়। ঈর্ষাবােধ রূপান্তরিত হয় অধিকার বােধে। অধিকার আছে বলেই ঈর্ষার জন্ম হয়েছে। চন্দ্রিমা ওর স্ত্রী। তাকে অন্য পুরুষ ভােগ করছে। যে-নারীতে তার অধিকার, সেনারী অন্যের ভােগ্যা হয়েছে। ঈর্ষা থেকে অধিকার বােধের জন্ম হল।

তনুশ্রীর সঙ্গে মেলামেশার সময় ঈর্ষাবােধ বা অধিকার বােধ ওর ছিল না। কারণ, তনুশ্রী দ্বিচারিণী ছিল না। এখন ওর তনুশ্রীর কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। তনুশ্রীকে ও কোনওদিন ভালােবাসেনি। এই মুহূর্তে ও তনুশ্রীর প্রতি দুর্বলতা বােধ করে। দুর্বলতা থেকে ভালােবাসা জন্মায়।  চিনচিন করে বুকের গভীরে। তনত্রী ওকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলে মরতে চেয়েছিল ওর সঙ্গে। কেন? এই কেন’র উত্তর একটাই। ভালােবাসা।

অভিরূপ ভাবে, ও কি ফিরে যাবে তনুশ্রীর কাছে। কিন্তু আর কোনও নারীর বােঝা হয়ে মতে চায় না। জীবনের কোনও মানে খুঁজে না-পেয়ে ও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। এর জীবনের মানে খুঁজে পেলেও আর কি ফেরা যায় তনুশ্রীর কাছে! সেটা যে বড় অপমানের হবে। শুধুমাত্র ভালােবাসার দোহাই দিয়ে তনুশ্রীর ভরসায় বাকি জীবন। অভানাের কথা ভাবতে পারে না ও। তাহলে ও কী করবে! চন্দ্রিমার কাছে থাকা সম্ভব নয়। নত্রীর কাছেও ফিরতে পারবে না। তাহলে ও কোথায় যাবে? কোনও পথই কি আর ওর জন্যে খােলা নেই!

অনেক রাত পর্যন্ত হােটেলের লনে বসে থাকে অভিরূপ। একসময় ওর সামনে দিয়ে সন্স ও চন্দ্রিমা বেরিয়ে যায় সেই পুরুষটির সঙ্গে। ও ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সেই ঘরটার টিকে-যেটা কিছুক্ষণ আগেও বেশ্যালয় ছিল। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ও।

ধীরে ধীরে রাত ফুরিয়ে যায়। ভাের হয়। নতুন দিন শুরু হয়। ঠিক অন্যান্য দিনের মতােই। শুধু একটি ব্যতিক্রম। অভিরূপের দিন শেষ। বন্ধ দরজা খােলেনি। পুলিশ এসে সেই ঘরের দরজা ভেঙে অভিরূপের ঝুলন্ত শরীরটা নামিয়ে আনে। ওর এতদিনের অভিলাষ এবার পূর্ণ হল।

Please follow and like us:

Leave a Reply