অন্তর্জলী যাত্রা – কমলকুমার মজুমদার

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

…..বিবাহের প্রথম অধ্যায় নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইল। মৎস্যক্ৰীড়া কড়ি খেলা পর্যন্ত হইল, পুরাতন উর্ণনাভের মত হাতখানি ক্রীড়াচ্ছলে, কখন বা কড়ি সন্ধানকালে, যশােবতীর দেহের সর্বত্রে কর্ষণ করিল। তিনি ভীত হইলেন না, নিঃশ্বাসের গতির সমতার কোন ব্যতিক্রম ঘটিল না; নবােঢ়া বধুর মত ক্লান্ত হইয়াও তিনি যে সহজ হইয়াছিলেন, এমতও নহে। কৃষ্ণুপ্রাণ গঙ্গাতীরের বাসর পরিত্যাগ করিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে গিয়া বলিলেন, “কি বলব, আমার মনে হয় আমরা যেন সত্যযুগেই আছি, মায়ের কি শক্তি!”….

….যশােবতীর সাহায্যে প্রবীণ হাতখানি শক্তিলাভ করিল, যেন আপনা হইতে উঠিয়া তাঁহার অবগুণ্ঠন উন্মােচন করিয়াই সেখানে স্থির হইয়া রহিল। এই দেহের অথৈ সৌন্দর্য যেমন বা সন্ন্যাস লইয়াছে। স্তম্ভিত বৃদ্ধকে মুহূর্তের মধ্যেই চরিত্রবানকরিল, সীতারাম আমিত্ব-অহঙ্কার বর্জিত, কিন্তু মানুষের দন্তপাতি অদৃশ্য হইলেও, জিঙ্ক অক্ষয় হইয়া আপন স্থানে বসিয়া থাকে, রস উপলব্ধি করে। উদ্ভিন্নযৌনার হেমদেহ স্পর্শে বৃদ্ধের গায়ে যেন মাংস লাগিল। সীতারাম কি যেন বলিলেন। যশােবতী তাহা সঠিক বুঝিয়ে না পারিয়া নূতন করিয়া ঘােমটা রচনা করিবার জন্য দুই হাতে বসন প্রান্ত উত্তোলন করা মাত্রই প্রাচীন হাতখানি তাহার বক্ষে আসিয়া দারুভূত হয়, শতাব্দীক্লিষ্ট বল্কলসদৃশ অঙ্গটি দেখিয়া যশােবতী এককালে অন্ধকার-শঙ্কিত, উৎখাত হইলেন। তাঁহার দীর্ঘশ্বাসের আঘাতে বৃদ্ধের হাতখানি ক্রমে যেমন বা নামিয়া গেল। | “বউ বউ” মর্মান্তিক শব্দ হইল। যশশবতী মুখখানি নিকটে আনিলেন, এখন বৃদ্ধের চোখদুটি আয়ত হইল, কহিলেন, “ঘােমটা…না না।”…..

…..বৈজুনাথ চাঁদোয়ার একপার্শ্বে এখন, খড় চড় চড় করিয়া উঠিল, বৃদ্ধ সীতারামকে আচম্বিতে দুই হাতে তুলিয়া দাঁড়াইবার কালে, তাহার একটি হাত যশােবতীর কোমল অঙ্গ স্পর্শ হয়। এইভাবে বৃদ্ধকে নির্বোধের মত তুলিয়া লওয়াতে চাঁদোয়ায় বৃদ্ধদেহটি আবৃত হইয়া পড়িয়া সাক্ষাৎ বিঘ্ন উৎপাদন করে,…..

……..অনন্যউপায় তিনি স্বামীর কাপড়টি, আলগােচে লইয়া নৌকার পাশে যে অল্প আড়াল ছিল, সেখানে বসিয়া কাপড়টি কাচিলেন এবং একার্য সম্পাদনের মধ্যে বার বার উঠিয়া স্বামীকে দেখিয়াছিলেন। নিজের পট্টবস্তু অশুদ্ধ হওয়াতে ভাল মত ভিজাইয়া তীরে উঠিয়া স্বামীর কাপড়টি নৌকায় মেলিয়া দিয়া দেখিলেন, স্বামী শয্যায়, এবং কোথাও কেহ নাই; সত্বর জলের নিকটে আসিয়া গামছাখানি কোনমতে অঙ্গাচ্ছাদন করিয়া আপনার কাপড়খানি কাচিয়া মেলিয়া দিয়া পুনৰ্ব্বার গঙ্গার মাটি ভালভাবে গাত্র মার্জনার পর, স্নান সমাপন করত তীরে উঠিয়া, আপনকার বক্ষ সংলগ্ন গামছাপ্রান্ত খুলিয়া নিঙড়াইতে লাগিলেন, এ সময় তাঁহার দেহ বক্র হয়।

বৈজুনাথ এই বস্তুসংস্কার দেখিল; স্নানলীলা দেখিতে দেখিতে সে উজ্জ্বল হইয়া গেল, ক্ষীণমধ্যা অপূৰ্ব্ব ললিতপদ বন্ধনে দেহ তাহাকে, চণ্ডালকে, যেন ঝুমুযযাচিত করিল। ভেড়ীর পিছনে সে দণ্ডায়মান, একটি পা শীতকাতর কম্পিত ! নিঃশ্বসে, সখর বৃক্ষপত্র সরিয়া যায়, এবং একারণে চক্ষুদ্বয়ের মধ্য দিয়া জিয়া বাহির হইয়া পড়িতেছিলওআর স্থির থাকিতে পারিল না, জন্তুর মত সেই স্থান বাহিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল। মাটি ধ্বসিল, জীয় শক্তি সঞ্চয় করিয়া ভেড়ী পথে উঠিয়া দাঁড়াইয়া, আপনার গতি সংযত করিতে না পারিয়া, এইপার্শ্বের কলমকাটা পথ বাহিয়া,—“মাভৈঃ মাভৈঃ গর্জন করিতে করিতে নামিয়া আসিয়া, গঙ্গার তীরে কর্দমের উপর পড়িয়া গেল; তাহার, সম্মুখের হস্ত দুইখানি কর্দমে, সে পশুর মত তাঁহার, যশােবতীর, দিকে চাহিয়া স্থির। যশােবতী এখন বিমূঢ়, সমস্ত দেহ যেন তাঁহার বক্ষে আশ্রয় করিয়াছে, দুই হস্ত সেখানে স্থাপন করত লজ্জায়, শঙ্কায়, ত্রাসে সঙ্কুচিত হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। এবম্প্রকার অঘটনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বৈজুনাথ কাদা ভাঙ্গিয়া পশুর মতই থপ থপ করিয়া আসিতেছে, লােলজিহ্বায় জোনাকির আলাে। ভূততাড়িতের মত তিনি পলাইতে উদ্যতা হইলেন।

বৈজুনাথ উঠিয়া এক লক্ষে আসিয়া তাঁহার গামছাপ্রান্ত আকর্ষণ করিল, তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘুরিয়া গেলেন; সে অতর্কিতে তাঁহার একটি হাত ধরিল এবং নিজের হস্তের গামছা মাটিতে ফেলিয়া একটি লাথি মারিয়া—কেননা এনীচ কাৰ্য্যে সম্ভবত বসুন্ধরা বাধাদান করিয়াছিলেন—ইহার পরক্ষণেই যশােবতীর সুন্দর রূপলেখা, নশ্বর দেহখানি দুই হস্তে তুলিয়া ধরিল। | যশােবতী প্রথমত আপনার বিবস্ত্র অবস্থার নিমিত্ত, দ্বিতীয়ত যে তাঁহার দেহ পরপুরুষের বন্ধনে উপলব্ধি করিয়া এককালে লজ্জায়, ক্ষোভে, নিশ্চয় দুঃখে, নিশ্চিত ব্যথায়, কাতরতায়—নিৰ্বাপিত, বিন্দুমাত্র, চেতনাহীন হইয়া গিয়াছিলেন। সহসা স্বীয় দেহের মধ্যে অসম্ভব বিস্ফোরণের শব্দ শুনিতে পাওয়া মাত্রই, পলকেই এ দুযোগময়ী অজ্ঞানতা নিশ্চিহ্ন হয়, এবং ক্রমে অধীরতায়, ক্রোধে, অপমানে, মুখ দিয়া দেখিতে, কান দিয়া বলিতে, নাসিকা দ্বারা শুনিতে চাহিলেন।

বৈজুনাথ মুখখানি তুলিয়া মুখখানি এমত ভাবে ঘুরাইল যেন সে আপনার দৃষ্টিপথকে পরিষ্কার করিয়া লইতেছে, যেহেতু তাহার ভ্রম হইয়াছিল মনে হয়, কেননা সে, যশােবতীর অনাবৃত দেহে, স্পষ্টতই শুভ্র সুদীর্ঘ উপবীত দেখিয়াছিল, যেমন পান্না ভৈরবীর অঙ্গে সে ইতঃপূৰ্বে দেখিয়াছে—ফলে সে বড় দ্বিধায় পড়িল, একদা আপন মনে প্রশ্ন করিল, এই কি কনে বউর সাধনা…?…..

Leave a Reply