প্রমীলা প্রসঙ্গ – ডঃ অতুল সুর

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

প্রমীলা কেন পুরুষ ভজে ?

……….মেয়ের এক যৌনবুভুক্ষা নিয়েই ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছিল। সেই আদিম যৌনক্ষুধার জন্যই মেয়েরা পুরুষের সঙ্গ চায়। আদিম যৌনক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যই যদি মেয়েরা এরূপ করে, তাহলে প্রশ্ন জাগে মেয়েরা পুরুষের আধিপত্য না মেনে সেটা করতে পারে কিনা। আর আমরা যদি মনে করি মেয়েদের আদৌ কোনো সহজাত আদিম যৌনক্ষুধা নেই, তবে পুরুষের আধিপত্য মেনে নিয়ে তাদের দাম্পত্যজীবন যাপনের প্রয়ােজন হয় কেন?…….

……… নারী কেন পুরুষ-ভজনা করে, এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের প্রথমেই যেতে হবে সৃষ্টির সেই প্রথম দিনে, যেদিন সৃষ্ট নারী প্রথম পুরুষকে ভজনা করেছিল। এ সম্বন্ধে খ্রীস্টান পুরাণের সঙ্গে হিন্দু পুরাণের মতানৈক্য আছে। খ্রীস্টান পুরাণ অনুযায়ী ঈশ্বর পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করে তাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বর্গের উদ্যানে বিচরণ করতে। তবে তিনি চাননি তাদের মধ্যে যৌনতৃষ্ণার উন্মেষ ঘটুক। সেজন্য তিনি নিষেধ করে দিয়েছিলেন তারা নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল যেন না খায়। কিন্তু নারী তাে চির-কৌতূহলী। এক অদম্য কৌতূহলী মন নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করেছে। তার সমগ্র সত্তাকেই আচ্ছন্ন করে আছে এই কৌতূহলী মন। সেই সহজাত কৌতূহলের বশীভূত হয়েই প্রথম নারী ইভ আস্বাদন করেছিল সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল। পরিণামে যা ঘটেছিল তা সকলেরই জানা আছে। সেটা তাে অভিশাপ হয়েই দাড়িয়েছিল। স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পতন, যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ও প্রজাসৃষ্টি। ………কিন্তু হিন্দু পুরাণে প্রথম নারী এরকম কোন নিষেধাজ্ঞা দ্বারা শৃঙ্খলিত হয়নি। সৃষ্টির সূচনাতেই তার স্রষ্টা কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিল “তােমরা উভয়ে রমণে প্রবৃত্ত হয়ে প্রজাসৃষ্টি কর।….

………হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী আদিতে স্রষ্টার নিজের কোনাে যৌন-সত্তা ছিল না। স্রষ্টা হচ্ছেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। তিনি প্রথম সৃষ্টি করেছিলেন সনৎকুমার, সনন্দ, সনক, সনাতন ও বিভু নামক পাঁচ ঋষিকে। তখন স্ত্রীপুরুষ বিভেদ ছিল না বলে তাদের থাকতে হয়েছিল উর্বরেত হয়ে। সে অবস্থায় তাে প্রজাসৃষ্টি হয় না। তাই ব্ৰহ্মা নিজেকে দু’ভাগে বিভক্ত করলেন। তার এক অংশ পুরুষ ও অপর অংশ নারী হল। পুরুষের তিনি নাম দিলেন মনু, আর নারীর নাম দিলেন শতরূপা। তারা ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করল-“পিতঃ, কোন্ কর্মের দ্বারা আমরা আপনার যথােচিত সেবা করব ? ব্রহ্মা বললেন, ‘তােমরা মৈথুন কর্ম দ্বারা প্রজা উৎপাদন কর। তাতেই আমার তুষ্টি।’ তখন থেকে মৈথুন কর্মের প্রবর্তন হল। মনু ও শতরূপার পুত্রকন্যা থেকেই মানবজাতির বিস্তার হল।…….

………প্রসঙ্গত আগের অনুচ্ছেদে আমরা নারীদেহে বিশেষ যৌন হরমােন  থাকার কথা বলেছি। নারীদেহে এসব যৌন হরমােন থাকার দরুন নারীমনে শুধুমাত্র যে যৌনমিলনের বাসনা শাশ্বত থাকে, তা নয়। নারীর সমস্ত দেহগঠনের ওপর এবং বিশেষ করে নারীদেহের আনুষঙ্গিক (secondary) বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ওপরও এর প্রভাব বিস্তারিত হয়। এই প্রভাবের দরুনই নারীদেহ পুরুষদেহ থেকে পৃথকভাবে গঠিত হয়। তবে কতকগুলি গ্রন্থি বা glands-ও—এই বৈশিষ্ট্য রচনায় সাহায্য করে। প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যৌনযন্ত্রের। সন্তান ছেলে না মেয়ে সেটা প্রকাশ পায় তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। সেটা যােনি-চিহ্ন থেকেই বুঝতে পারা যায়।……তারপর যখন আনুষঙ্গিক লক্ষণসমূহ ( secondary characters) প্রকাশ পায়, তখন তারা বুঝতে পারে যে তারা পরস্পরের সমকক্ষ নয়। মেয়েদের এ-সকল আনুষঙ্গিক লক্ষণ হচ্ছে মাসিক রজঃনিঃসরণ, স্তনের স্ফীতি এবং সন্তান-প্রজননের পর সেই স্ফীত-স্তন দুগ্ধভাণ্ডারে পরিণত হওয়া, মুখমণ্ডলে কেশের অভাব ইত্যাদি। অপরপক্ষে, পুরুষের এরূপ মাসিক রজঃনিঃসরণ হয় না, স্তনের স্ফীতি ঘটে না এবং মুখমণ্ডল কেশাচ্ছন্ন হয়।……..

…….স্মৃতি-পূর্ব যুগে মেয়েদের পুরুষ-ভজন সম্বন্ধে কিন্তু সে-বিধিনিষেধ ছিল না। জ্ঞাতিত্বের কথাই আমরা প্রথম ধরছি। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এক সূক্ত থেকে বােঝা যায় যে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার বিধবা ঐ দেবরের সঙ্গেই স্ত্রীরূপে বাস করত। সেখানে বিধবাকে বলা হচ্ছে : ‘তুমি উঠে পড়, যে দেবৃ তােমার হাত ধরেছে, তুমি তার স্ত্রী হয়েই তার সঙ্গে বসবাস কর। অথর্ববেদের একজায়গাতেও ঠিক অনুরূপ কথা ধ্বনিত হয়েছে। এককথায়, ঋগ্বেদের যুগে দেবর-ভজনার রীতি প্রচলিত ছিল। বস্তুত ভাবীর সঙ্গে দেবরের যে যৌন-ঘনিষ্ঠতা থাকত, তা ঋগ্বেদের বিবাহ-সম্পর্কিত সূক্তও ইঙ্গিত করে। উক্ত সূক্তে দেবতাগণের নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, তারা যেন নববধূকে দের প্রিয়া ও অনুরাগের পাত্রী করে তােলেন। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অপর একস্থানেও বর্ণিত হয়েছে যে, বিধবা ভাবী দেবৃকে তার দাম্পত্যশয্যায় নিয়ে যাচ্ছে। ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদ, এই দুই গ্রন্থেই স্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ‘দেবৃ’ বা ‘দেবর’ বলা হয়েছে। এই শব্দদ্বয় থেকেও ভাবীর সঙ্গে দেবরের এইরূপ সম্পর্ক সূচিত হয়। কেননা, ‘দেবর’ মানে দ্বি-বর বা দ্বিতীয় বর। এককথায়, মেয়েদের দেবরকে ভজনা করা সেযুগের রীতি ছিল।

এই সম্পর্কে স্বভাবতই আমাদের পরবর্তীকালের ‘নিয়ােগ-প্রথার কথা মনে পড়ে। কিন্তু নিয়ােগ-প্রথাটা ছিল স্বতন্ত্র প্রথা। বৈদিক যুগে ভাবীর ওপর দেবরের যে যৌন-অধিকার থাকত, তা সাধারণ ও সর্বকালীন রমণের অধিকার। আর পরবর্তীকালের নিয়ােগ-প্রথা ছিল মাত্র সন্তান-উৎপাদনের অধিকার। সন্তান-উৎপাদনের পর এ অধিকার আর থাকত না। আরও লক্ষ্য করবার বিষয় হচ্ছে এই যে, বিধবা ভাবীর ওপর দেবরের এই যৌন অধিকার অবিকৃত থাকার দরুন ঋগ্বেদে বিধবা-বিবাহের কোনো উল্লেখ নেই, যা পরবর্তীকালের গ্রন্থসমূহে দেখতে পাওয়া যায়। বেদে ব্যবহৃত জ্ঞাতিবাচক কয়েকটি শব্দ থেকেও আমরা বুঝতে পারি যে স্ত্রীলােকের একাধিক স্বামী থাকত।………

………..অজাচারের সামিল হচ্ছে ব্যভিচার। নারী যখন নিজ স্বামী ব্যতীত অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হয়, তখন সেরূপ সংসর্গকে ব্যভিচার বলা হয়। স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে বলা হয়েছে, যতরকম ব্যভিচার আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত ও কদর্য হচ্ছে গুরুতল্প বা গুরুপ্রীগমন। অথচ প্রাচীন ভারতে এটা আকছার ঘটত। গুরুর অনুপস্থিতিতে গুরুপত্নীরা পুত্রস্থানীয় ও ব্রহ্মচর্যে রত শিষ্যদের প্রলুব্ধ করত তাদের সঙ্গে যৌনমিলনে রত হতে। এ-সম্বন্ধে মনস্তত্ত্ববিদরা কী বলবেন জানি না, তবে ষাট বৎসর পূর্বে বিলাতের এক পত্রিকায় একজন বিখ্যাত অভিনেত্রীকে বলতে দেখেছিলাম : I can think nothing more horrible than a woman proposing to a man’. কিন্তু বাস্তব জীবনে এরূপ horrible জিনিসই ঘটে। শিষ্যদের কাছে গুরুপত্নীদের যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা তারই উদাহরণ। ঋগ্বেদেও আমরা পড়ি, যমী তার সহােদর ভ্রাতা যমকে প্রলুব্ধ করছে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত হবার জন্য।……..

………এরূপ সমাজে যে-সব মেয়ের যৌনক্ষুধা প্রবল, তাদের ক্ষেত্রে যা ঘটত তা সহজেই অনুমেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রামনারায়ণ তর্করত্ন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেটা খােলাখুলিই বলেছিলেন। রামনারায়ণ তঁার ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকের চতুর্থ অঙ্কে পিতা-পুত্রের সংলাপের ভেতর দিয়ে সেটা বলেছেন। পুত্র তিন বৎসর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। হঠাৎ খবর এল তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। পুত্র আশ্চর্য হয়ে পিতাকে যখন একথা বলছে, তখন পিতা বলছেন, “বাপু হে! তাতে ক্ষতি কি? আমি তােমার জননীকে বিবাহ করে তথায় একবারও যাই নাই, একেবারে তােমার সাক্ষাৎ হয়। কুলীনকন্যাদের যখন স্বামী ব্যতীতই গর্ভ হত, তখন মেয়ের মায়েরা কী কৌশল অবলম্বন করে সেই সন্তানের বৈধতা পাড়াপড়শীর কাছে জানাত তা বিদ্যাসাগরমশাই তার ‘বহুবিবাহ নিবন্ধে বিবৃত করেছেন।

কিন্তু দেখা যায়, মহাভারতীয় যুগে কুমারী মেয়েদের যৌনসংসর্গ অনুমােদিত হত। বােধহয় তার আগের যুগেও হ’ত। কেননা, ছান্দোগ্য উপনিষদে আমরা দেখতে পাই, মহর্ষি সত্যকামের মাতা জবালা যৌবনে বহুচারিণী ছিলেন। মহাভারতে এরূপ সংসর্গের একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। পরাশর-সত্যবতীর কাহিনী সুবিদিত। সত্যবতী যৌবনে যমুনায় খেয়া-পারাপারের কাজে নিযুক্ত থাকত। একদিন পরাশমুনি তার নৌকোয় উঠে, তার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে যৌনমিলন প্রার্থনা করে। সত্যবতী তখন পরাশরকে বলে—‘নৌকোর মধ্যে আমি কী ভাবে যৌনকর্মে রত হব, কেননা তীর হতে লােকেরা আমাদের দেখতে পাবে। পরাশর তখন কুজঝটিকার সৃষ্টি করেন ও তারই অন্তরালে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত হন। এর ফলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম হয়। কুন্তীও কুমারী অবস্থায় সূর্যের সঙ্গে মিলনের ফলে কর্ণকে প্রসব করেন। মাধবী-গালব উপাখ্যানেও আমরা দেখি যে, প্রতিবার সন্তান-প্রসবের পরও মাধবী কুমারী ছিল। ওই যুগের সমাজে বিবাহের পূর্বে যে মেয়েদের যৌনসংসর্গ অনুমােদিত হত এবং এরূপ যৌনসংসর্গের জন্য মেয়েরা তাদের কুমারীত্ব হারাত না, তা কুমারী মেয়েদের সন্তানদের বিশিষ্ট আখ্যা থেকে বুঝতে পারা যায়। এ-সম্বন্ধে কৃষ্ণ কর্ণকে বলেছেন, “কুমারী মেয়ের দু’রকম সন্তান হতে পারে—(১) কানীন ও (২) সহােঢ়। যে সন্তানকে কন্যা বিবাহের পূর্বেই প্রসব করে, তাকে বলা হয় কানীন’। আর যে মেয়ে বিবাহের পূর্বে গর্ভধারণ করে বিবাহের পরে সন্তান প্রসব করে, সে-সন্তানকে বলা হয় ‘সহােঢ়। মহাভারতের অপর একজায়গায় ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, কুমারী মেয়ের দু’রকমের সন্তান হতে পারে। যে সন্তানকে সে বিবাহের পূর্বে প্রসব করে, তাকে বলা হয় কানীন, আর যে সন্তানকে সে বিবাহের পরে প্রসব করে, তাকে বলা হয় অবােঢ়। এসব থেকে বুঝতে পারা যায় যে, মহাভারতীয় যুগে কুমারী কন্যার পক্ষে গর্ভধারণ করা বিশেষ নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল না।………

……..আদিবাসী সমাজে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌনাচার অনুমােদিত। যৌথ ঘুমঘরগুলিতে ছেলেমেয়েরা একত্রে রাত্রিযাপন করে। এগুলি তরুণ-তরুণীদের যৌনচর্চায় দক্ষতা অর্জনের সংস্থা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যপ্রদেশের গােণ্ডদের মধ্যে প্রচলিত ঘুমঘরগুলিকে ‘ঘােটুল’ বলা হয়। মুণ্ডা ও বিরহােড়রা এগুলিকে ‘গিতিওড়া’ বলে। আসামের গারাে জাতিরা এগুলিকে ‘লােকপাণ্ডে বলে। নাগাদের মধ্যে এগুলিকে বলা হয় ‘মােরাং’। যৌথ ঘুমঘরগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে মুরিয়াদের ভেতর প্রচলিত ঘােটুল। মুরিয়াদের মধ্যে বিদ্যমান ঘােটুল পূর্ণবিকশিত ঘুমঘরের প্রতীক। ঘেটুলের ভিতরটায় নানারকম চিত্র অঙ্কিত ও খােদিত থাকে। অনেকস্থলেই এসকল চিত্র যৌন-অর্থব্যঞ্জক। কোনাে কোনাে ঘােটুলে প্রকাণ্ড আকারের পুরুষাঙ্গবিশিষ্ট এক তরুণ একটি তরুণীকে আলিঙ্গন করে ধরে আছেএরূপ চিত্রও অঙ্কিত থাকে। ঘােটুলের মধ্যে যৌনজীবন অনুসৃত হলেও, প্রকৃত বিবাহের বয়স এলে তাদের অপরের সঙ্গে নিয়মানুগ বিবাহ করতে হয়। ঘােটুলের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, কী সুন্দরী কী কুৎসিতা—সকল মেয়েই যৌনচর্চায় সমান অধিকার পায়। তবে তরুণ-তরুণীদের একই জুড়িদারের সঙ্গে তিনদিনের বেশি শুতে দেওয়া হয় না। …….

…….বারাঙ্গনাদের সম্বন্ধে বিশদ আলােচনা করেছেন বাৎস্যায়ন তার কামসূত্রে। বাৎস্যায়ন বারাঙ্গনাদের ছয় শ্রেণীতে ভাগ করেছেন ; যথা— (১) পরিচারিকা, (২) কুলটা, (৩) স্বৈরিণী, (৪) নটী, (৫) শিল্পকারিকা ও (৬) প্রকাশবিনষ্টা। এদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য আছে। কোনাে বারাঙ্গনা-দুহিত। বিবাহিতা হয়ে যদি একবৎসর নিজ পতির কাছে ‘সতী’ হয়ে থাকে, এবং তারপর নিজের ইচ্ছেমত যৌনাচারে প্রবৃত্ত হয়, কিন্তু প্রাক্তন স্বামী এলে তার সঙ্গে একরাত্রি বাস করে তার পরিচর্যায় রত হয়, তবে সেরূপ নারীকে পরিচারিকা বলা হয়। ভরতনাট্যশাস্ত্রে পরিচারিকার অবশ্য অন্য সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যে নারী স্বামীর ভয়ে অপরের গৃহে গিয়ে অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে কুলটা’ বলা হয়। যে নারী নিজ স্বামীকে গ্রাহ
করে নিজ গৃহে বা অন্য গৃহে অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে ‘স্বৈরিণী’ বলা হয়। যে নারী নাচগান করে, অথচ বেশ্যাবৃত্তিও করে, তাকে ‘নটী’ বলা হয়। রজক, তন্তুবায় প্রভৃতি শিল্পীর ভার্যা যখন পতির অনুমতি নিয়ে বিত্তবান লােকের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে ‘শিল্পকারিকা’ বলা হয়। যে নারী স্বামী জীবিত থাকাকালীন বা তার মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে অপরের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাকে প্রকাশবিনষ্টা’ বলা হয়।……

……..পুরুষের আধিপত্য মানা তাে দূরের কথা, বিনা-পুরুষেই নারী যেভাবে তার যৌনাচারের অনুশীলন করতে পারে, তা হচ্ছে হস্তমৈথুন (masturbation) ও সমরতি-কামনা ( lesbianism)। এ-দুটোই হচ্ছে পুরুষবিমুখী অভ্যাস। হস্তমৈথুন হচ্ছে যােনিগহ্বরকে অঙ্গুলি-সঞ্চালন দ্বারা উত্তেজিত করে যৌনসুখ উৎপাদন করা। আর সমরতি-কামনা হচ্ছে এক নারীর অপর নারীর সহিত প্রণয়ীর সম্পর্ক স্থাপন করে কামাসক্ত হওয়া।…….

দেবলােকে প্রমীলা

……..সুরাপায়ী, দেবতা হলেও, যৌনজীবনে ইন্দ্র, ইন্দ্রাণীর প্রতি অমনােযােগী ছিল না। এর কারণ মনে হয় ইন্দ্রাণী এক বিশেষ রকম রমণ-পদ্ধতিতে অভিজ্ঞ ছিল। এটা আমরা জানতে পারি বাৎস্যায়নের কামসূত্র থেকে। নাগরিক সমাজের লােকেরা কিভাবে তাদের যৌনজীবনকে সুখময় করে তুলত, তার পরিচয় দিতে গিয়ে, বাৎস্যায়ন তার ‘কামসূত্র’-তে মানুষ যতরকম পদ্ধতিতে (coital postures )রতিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হতে পারে তার এক বিবরণ দিয়েছেন। বাৎস্যায়ন এক বিশেষ রকম পদ্ধতিতে রমণের নাম দিয়েছেন ‘ইন্দ্রাণিক রতি। তিনি বলেছেন, যেহেতু ইন্দ্রাণী শচী এই বিশেষ পদ্ধতিতে রতিক্রিয়া করতে ভালবাসতেন, সেইহেতু এই পদ্ধতির নাম ‘ইন্দ্রাণিক রতি।…..

……কিন্তু শচী পতিপরায়ণা হলেও, ইন্দ্র একান্তভাবে স্ত্রীপরায়ণ ছিলেন না। অন্য দেবতাদের মতাে ইন্দ্র ব্যভিচারী দেবতা ছিলেন। অজাচারী হবার জঠও তিনি একবার উদ্যত হয়েছিলেন। তাঁর ব্যভিচারের সর্বজনবিদিত দৃষ্টান্ত হচ্ছে গৌতম ঋষির অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী অহল্যাতে উপগত হওয়া। অহল্যা ইন্দ্রকে চিনতে পেরেও সে-সময় কামার্তা ছিল বলে দুর্মতিবশত ইন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গমে রত হয়েছিল।…..

……সূর্যও পরস্ত্রীতে উপগত হত। মহাভারত অনুযায়ী সূর্যের ঔরসে ও কুন্তীর গর্ভে কর্ণের জন্ম হয়। আবার রামায়ণ অনুযায়ী ঋক্ষরজার গ্রীবায় পতিত সূর্যের বীর্য থেকে সুগ্রীবের জন্ম হয়।..

…….সূর্যের অন্দরমহলে ঘটেছিল এক অজাচারের ( incest) ঘটনা। যম সূর্যের পুত্র। ঋগ্বেদ অনুযায়ী যমী তার যমজ ভগিনী। ঋগ্বেদে দেখি, যমী তার যমজ ভ্রাতা যমের কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করছে। কাহিনীটি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম সূক্তে আছে। সেখানে যমী যমকে বলছে, “চল আমরা এক নির্জন স্থানে গিয়ে সহবাস করি, কেননা বিধাতা মনে মনে চিন্তা করে রেখেছেন যে তােমার ঔরসে আমার গর্ভে আমাদের পিতার এক সুন্দর নপ্তা (নাতি) জন্মিবে।’ যম তার উত্তরে বলে, ‘তােমার গর্ভসহচর তােমার সঙ্গে প্রকার সম্পর্ক কামনা করে না।যেহেতু তুমি সহােদর ভগিনী, তুমি অগম্যা। যমী তার উত্তরে বলছে, যদিও মানুষের পক্ষে এরূপ সংসর্গ নিষিদ্ধ, দেবতারা এরূপ সংসর্গ ইচ্ছাপূর্বক করে থাকে। তুমি আমার প্রতি অভিলাষযুক্ত হও, এস এখানে আমরা উভয়ে শয়ন করি। আমি তােমার নিকট আমার নিজ দেহ সমর্পণ করে দিই। যমের উক্তি : ‘তােমার ভ্রাতার এরূপ অভিলাষ নেই। উত্তরে যমী বলে, “তুমি নিতান্ত দুর্বল পুরুষ দেখছি।…..

……..দেবগুরু বৃহস্পতি নিজেও সাধু চরিত্রের দেবতা ছিলেন না। তিনি কামলালসায় অভিভূত হয়ে নিজ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী মমতার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বলপূর্বক তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিলেন।..

……দ্বাপরে বিষ্ণু কৃষ্ণ হয়ে যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন তার অন্তঃপুরে যােব হাজার একশত স্ত্রী ছিল। ( বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী যােল হাজার একশত, যােল হাজার নয়)। সাধারণ লােকের ধারণা, এরা সকলেই গােপকন্যা। কিন্তু সে-ধারণা ভুল। বিষ্ণুপুরাণ (৫১১১১৪) অনুযায়ী তারা নানা দেশ থেকে অপহৃতা নারী ছিল। পুরাণে লিখিত আছে যে, একই সময় পৃথক পৃথক ভাবে কৃষ্ণ সেইসকল কন্যার ধর্মানুসারে বিধি অনুযায়ী পাণিগ্রহণ করেছিলেন, যাতে সেই কন্যাগণ প্রত্যেকে মনে করেছিল যে কৃষ্ণ শুধুমাত্র তাকেই বিবাহ করলেন। তাছাড়া, প্রতি রাত্রেই তিনি তাদের প্রত্যেকের ঘরে গমনপূর্বক বাস করতেন। (নিশা চ জগৎস্রষ্টা তাসাং গেহেযু কেশবঃ)।…..

…….কালিদাসের কুমারসম্ভব’ অনুযায়ী শিব ও শিবানীর রমণক্রিয়া দেখবার জন্য অগ্নিদেবের একবার কৌতূহল হয়েছিল। সেজন্য অগ্নি পারাবতাকারে সেই রমণক্রিয়া দেখতে এসেছিল। শিবানী অগ্নিদেবকে দেখে রমণক্রিয়া হতে নিবৃত্ত হন। শিব তখন ক্রোধবশত বীর্য অগ্নিদেবের প্রতি নিক্ষেপ করেন। অগ্নিদেব সে-বীর্যের তেজ সহ্য করতে না পেরে তা গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। আর একবার শিবানীকে দেখে ফেলবার জন্য কুবেরের এক চক্ষু বিনষ্ট হয়েছিল।……

বিবাহের মঞ্চে প্রমীলা

…..বাঙালি সমাজে একসময় ‘দেবরণ প্ৰথাও প্রচলিত ছিল। দেবরণ হচ্ছে শালীবরণের বিপরীত প্রথা। শালীবরণে স্ত্রীর কনিষ্ঠা ভগিনীদের ওপর জ্যেষ্ঠ ভগিনীপতির যৌন অধিকার থাকে। আর দেবরণে জ্যেষ্ঠ ভাবীর ওপর দেবরের অধিকার। পঞ্চপাণ্ডব যখন বীরভূম জেলার একচক্রা নগরে এসে বাস করেছিলেন, তখন তারা পঞ্চাল রাজকন্যা দ্রৌপদীকে এই প্রথা অনুযায়ীই বিবাহ করেছিলেন।……..

Please follow and like us:

Leave a Reply