রাজকন্যা সুকন্যা একলা একলা বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। মানুষের সঙ্গ আর তার ভাল লাগে না ; চেনা-অচেনা কোনো পুরুষ তাকে দেখলেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, সেই দৃষ্টির মধ্যে আছে লোভ। আর মেয়েরা তাকে ঈর্ষা করে। সুকন্যার কোনাে বন্ধু নেই, তার জন্য দায়ি ওঁর রূপ। এমন রূপ বুঝি মানুষের হয় না!
সুকন্যার বিয়ের ব্যাপারেও দারুণ গােলযােগ। দেশ-বিদেশ থেকে রাজকুমারেরা এসে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে, সবাই সুকন্যাকে চায়। সুকন্যা যেন শুধু একটা লােভনীয় ভােগবস্তু। সুকন্যা এর প্রতিশোধ নেন নিষ্ঠুরভাবে! রাজকুমারদের লড়াইতে নামিয়ে তিনি কৌতুক বােধ করেন। কারুকেই বিয়ে করতে তার মন চায় না।
সুকন্যার বাবার চার হাজার স্ত্রী। এমন ভােগী রাজা আর ভূ-ভারতে নেই। ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে সর্বক্ষণ উৎসবের মাতামাতি দেখে দেখে ভােগ বিলাসের প্রতি সুকন্যার ঘেন্না ধরে গেছে।
রাঙজা শৰ্ষাতি তার সমস্ত স্ত্রী এবং প্রচুর লােক-লস্কর নিয়ে বনে এসেছেন বিহার করতে, সুকন্যাকেও সঙ্গে আসতে হয়েছে। কিন্তু তিনি দূরে দূরে থাকছেন।
বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সুকন্যা এক জায়গায় একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখতে পেলেন। একটা বড় গাছতলায় একটা উইপােকার ঢিবি জমে আছে, তার মধ্যে দুটো হীরের টুকরো জুলজুল করছে। এখানে হীরে এল কী করে? সুকন্যার মাথার চুলে যে সোনার কাটা ছিল সেটা দিয়ে তিনি খুচিয়ে খুঁচিয়ে হীরে দুটো তােলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে দুটো সহজে উঠতে চায় না, উপরন্তু সেই ঢিবির মধ্যে থেকে খুব ক্ষীণ ভাবে যে একজন মানুষের গলর আওয়াজ ভেসে আসছে। সুকন্যা তা গ্রাহ্য করলেন না। তিনি আরও জোরে খেচতে লাগলেন। তখন সেই হীরের মতন উজ্জল চোখ দুটি থেকে রক্ত গড়াতে লাগল। তা দেখে ভয়ে পালিয়ে গেলেন সুকন্যা ! একটা জলাশয়ের ধারে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন কারুকে কিছু বললেন না।
পরদিন একটা সাংঘাতিক অলৌকিক কাণ্ড হল। রাজা-রানি, পাত্র-মিত্র, সৈনা-সামন্ত সকলের মল মুত্র বন্ধ হয়ে গেল। প্রাত্যহিক এই স্বাভাবিক কৃত্যটি সম্পর্কে এমনিতে কেউ কিছু খেয়ালই করে না, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেলেই টের পাওয়া যায় যে এটা শরীরের পক্ষে কতটা প্রয়োজনীয়। পর পর সবাই অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন।
তখন প্রবীণ মন্ত্রীরা রাজাকে বললেন, দৈব ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো ঋষি ছাড়া এরকম শাস্তি দেওয়া আর কারুর সাধ্য নয়। শোনা যায়, মহর্ষি ভৃগুর পুত্র চ্যবন এই বনে তপস্যা করেন। অনেককাল অবশ্য তাকে কেউ দেখেন না, কোনাে কারণে তিনি রুষ্ট হননি তো?
সকলকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হল, কেউ কোনো ঋষিকে সেই বনে দেখেছে কি না বা তার প্রতি অসন্মানজনক ব্যবহার করেছে কি না। সকলেই বললেন, না।
সুকন্যা তখন জানালেন যে এক জায়গায় একটা উইটিবির মধ্যে জােনাকির মতন কিছু জ্বলতে দেখে তিনি কৌতূহলবশে চুলের কাটা দিয়ে বিধিয়েছেন, তাতে রক্ত গড়াতে দেখেছেন। জােনাকির কি রক্ত আছে?
রাজা দৌড়ে গেলেন সেই গাছতলায়। লোকজনেরা সন্তর্পণে সেই উইটিবি ভাঙল। তার মধ্যে বসে তাই এক অতি কুৎসিত চেহারার, অতি বৃদ্ধ ঋষি ইনিই ভৃগুতনয় চ্যবন, কতকাল যে এখানে এক ঠাইতে বসে আছেন তার ঠিক নেই, উইয়ের ঢিবি এঁর শরীর ঢেকে দিয়েছিল।
রাজা হাতজোড় করে ঋষির কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, আমার মেয়েটি বড় অস্থিরমতি, লঘু। বললেন, সে একটা দোষ করে ফেলেছে। আপনি ক্ষমা করুন।
সুকন্যার চুলের কাটার খোচায় চ্যবন ঋষির দু চোখই অন্ধ হয়ে গেছে। তিনি ধীর স্বরে বললেন, রাজা, আমার চক্ষু নষ্ট হয়েছে সেটা এমন কিছু বড় কথা নয়, আমার দিব্য চক্ষু আছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় ক্ষতি এই যে আমার ধ্যান নষ্ট হয়ে গেছে। তােমার মেয়েকে আমি কয়েক পলক মাত্র দেখেছি, ওই রূপ আমার হৃদয় ঝলসে দিয়েছে। দর্প ও অবজ্ঞার বশে তােমার মেয়ে যা করেছে, তার অন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে। কে এই বুড়ােকে বিয়ে করতে হবে। দেখ, রাজি থাক তাে বল, তাহলে তােমাদের শাপমুক্ত করব। | অরাজি হবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। রাজা নিজেই তখন পেটের ব্যথায় কাতর। রানিদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেছে। রাজা সেই দন্ডেই লােল চর্ম বৃদ্ধ ঋষির হাতে রমণীশ্রেষ্ঠা সুকন্যাকে তুলে দিলেন।
সুকন্যা প্রথম কয়েকদিন খুব কান্নকাটি করলেন বটে কিন্তু এক পক্ষকাল কেটে যাওয়ার পর তার অন্যরকম অনুভূতি হল! বনের মধ্যে পাতার কুটিরে ফলমূল খেয়ে থাকা, জলাশয় থেকে জল তুলে আনা, বৃদ্ধ স্বামীর সেবা করা, এ যেন অনেকটা রূপকথার গল্পের মত! রাজার দুলাল এখন সামান্য বনবাসি। এক সময় শত শত দাস-দাসী তার সেবা করত, আজ স্বামীর পা টিপে দেবার সময় অন্যমনস্ক হলে তিনি বকুনি খান। এই ভূমিকাটা তার বেশ পছন্দই হল।
সুকন্যার ধারণা ছিল জঙ্গলের মুনি ঋষিরা বুজি সব সময় শক্ত শক্ত সংস্কৃতে কথা বলেন, তা তাে নয়, ঋষি চ্যবন প্রকৃত ভাষা বেশ ভালই জানেন আর অনেক রসের গল্প শোনান। শাস্ত্র বচন ঝেড়ে সুকন্যাকে কাবু করার বদলে আদি রসাত্মক কাহিনী শুনিয়ে তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। তবে চ্যবন ঋষি বড়ই বুড়ো হয়ে পড়েছেন, কাম কলায় অভিজ্ঞ হলেও শরীর এখন আর উত্তপ্ত হয় না। শরীর এমনই জিনিস যে শত ধ্যানের পূণ্য হলেও আর যৌবন ফিরে পাওয়া যায় না।
ভালই দিন কাটছিল। সুকন্যা আস্তে আস্তে প্রকৃতি-কন্যা হয়ে উঠলেন। তিনি গাছপালার সঙ্গে কথা বলেন, পাখির ডাকের সঙ্গে গলা মেলান। রাজবাড়িতে থাকার সময় লোকজনদের ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা আর স্তুতিবাক্য শুনতে শুনতে তার কান পচে গিয়েছিল, এখানে, এই নির্মল বাতাসে, নির্জনতায়, তিনি যেন অমৃতের স্বাদ পেতে লাগলেন।
এই অঙ্গলের মধ্যে তাঁর পােশাক পরারও প্রয়োজন হয় না সব সময়। তাঁর স্বামী অন্ধ, অন্য কেউও দেখবার নেই। স্নানের সময় তিনি নগ্ন হয়ে জলকেলি করেন।
একদিন স্নান সেরে সুকন্যা সেই অবস্থায় উঠে আসছেন। এমন সময় দেখলেন তীরে দুটি যুবক দাড়িয়ে আছে। তারা যথেষ্ট রূপবান ও ভদ্র পােষাক পরিচ্ছদ পরনে, তবে দু জনকে দেখতে হুবহু এক রকম, খুব সম্ভব জমজ।
লােক দুটি ঠিক দুৰ্বৃত্তও নয়। সুকন্যাকে দেখা মাত্র ঝাপিয়ে পড়ল না। চক্ষু দিয়ে তাঁর রূপের বন্দনা করতে লাগল। সুকন্যা ভাবলেন, এরা নিশ্চয়ই তার আগেকার ব্যর্থ প্রেমিক দুই রাজপুত্র, এখনাে হাল ছাড়ে নি, খুঁজতে খুঁজতে এই পর্যন্ত চলে এসেছে। বিরক্তিতে অধর একটু কুঁচকে গেল! যুবকদের মধ্যে একজন বলল, হে ভাবনী, তুমি কার ঘরণী বা কার বালা? এই গহীন অরণ্যে একা রয়েছ কেন? সুকন্যা বললেন, বনের মধ্যে কারুর একা থাকার স্বাধীনতা নেই বুঝি?
অন্য যুবকটি বলল, তােমার এই দেবদূর্লভ রূপ, এ তাে জগত জয় করবার জন্য! তােমার তাে একা থাকার কথা নয়! কেউ কি তােমাকে এখানে নির্বাসনে পাঠিয়েছে।
সুকন্যা বললেন, না, আমি স্বেচ্ছায় এখানে আছি! আপনারা যেখানে খুশি যেতে পারেন, আপনাদের সঙ্গে আমি এই অবস্থায় আর বাক্যালাপ করতে চাই না।
একজন যুবক বলল, আপনি আপনার রূপের এই অপমান করছেন কেন? শ্রেষ্ঠ বস্তু, মণি-মাণিক্যের অলঙ্কারগুলাে তৈরি হয়েছে কেন, যদি তা আপনার অঙ্গে না ওঠে? চলুন, আমাদের সঙ্গে চলুন, আমরা আপনাকে এই বসুন্ধরার চেয়েও সুন্দর করে সাজাব।
সুকন্যা বললেন, ভাল ভাল পােশাক, হারে মুক্তোর গয়না এক সময় আমার অনেক ছিল, অনেক দেখেছি। সব আমার ঘেন্না ধরে গেছে। আপনারা আমার পথ ছাড়ুন। আমি মহারাজ শর্যাতির মেয়ে, যােগী শ্রেষ্ঠ চ্যবন আমার স্বামী।
দুই যুবক প্রায় হাহাকার করে উঠল, চ্যবন আপনার স্বামী? হায় হায়, সে যে সাত বুড়াের এক বুড়ো। এ খুব অন্যায়, ঘাের অন্যায়! আপনার মতন সুন্দরী চ্যবনের হাতে পড়ে জীবনটা নষ্ট করবে? এ হয় না। আপনি ওকে ত্যাগ করে আমাদের দুজনের যে-কোনো একজনকে বরণ করুন। আপনি চ্যবন ঋষির অভিশাপের ভয় পাবেন না। ও সব আমাদের গায়ে লাগে না!
সুকন্যা বললেন, আপনাদের মতন শত শত রাজকুমারকে আমি এর আগে প্রত্যাখ্যান করেছি। আপনারা তাদের তুলনায় এমন কিছু আহামরি নন। আমার এই বুড়াে বর আর পাতার ঘরই পছন্দ।
একজন যুবক বলল, তা হলে আর একটা প্রস্তাব শুনুন। আমরা নানারকম চিকিৎসা জানি। আমরা আপনার স্বামীর যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারি, তাকে রূপবান করে দিতে পারি। তার দৃষ্টিশক্তিও ফিরে আসবে। তার বদলে আপনি:….
অন্য যুবকটি বলল, বদলে দরকার নেই। চিকিৎসার বিনিময়ে আমরা কিছু চাই না। তবে আপনার স্বামী রূপ-যৌবন ফিরে পেলে আপনি আমাদের তিনজনের মধ্য থেকে যে-কোনাে একজনকে স্বামী হিসেবে বেছে নেবেন। রাজি। দেখুন, এটা অন্যায় কিছু বলিনি।
সুকন্যা বললেন, আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি যৌবন ফিরে পেতে রাজি কিনা সেটা আগে জানা দরকর।
আশ্রমে ফিরে এসে সুকন্যা চ্যবন ঋষিতে সব খুলে বললেন। চ্যবন ঋষি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলো, যৌবন ও সাস্থ্য ফিরে পেতে কার না ইচ্ছে হয়। আমারও লোভ হচ্ছে। কিন্তু তার বদলে তােমাকে হারাতে হবে। কী করি বলতাে?
সুকন্যা জিজ্ঞেস করলেন, কেন আমাকে হারাতে হবে কেন? আমি “এদের পছন্দ করর না।
চ্যবন বলেন, ওই ছােকরা দুটি দেবতাদের চিকিৎসক। ওর নাম অশ্বিনীকুমার দ্বয়। ওরা নানারকম জাদু জানে। ওদের মায়ার তুমি আর আমাকে চিনতে পারবে না! তবু চল, পরীক্ষা করে দেখা যাক। সুকন্যা বুঝলেন যে যৌবন ফিরে পাওয়ার প্রস্তাবটা তার স্বামীর খুব মনে ধরেছে।
বাইরে এসে অশ্বিনীকুমারদের সুকন্যা তাঁর সম্মতি জানালেন। ওরা দুজন চ্যবন ঋষির হাত ধরে ধরে সেই জলাশয়ের কাছে নিয়ে গেল। তারপর তিনজনে একসঙ্গে ডুব দিয়ে ফের উঠে আসতেই সুকন্যা দেখলেন যমজের বদলে এয়ী: তিনজনের এক রকম রূপ, এক পোষাক, এক রকম মুখশ্রী।
সুকন্যা আবার তার শাড়িটি খুলে নগ্ন হলেন। কয়েকটি মুহূর্ত তিনি সেই তিন যুবকের সামনে দাড়িয়ে থেকে তারপর এগিয়ে গিয়ে একজনের বুকে হাত রেখে বললেন, ইনিই আমার স্বামী! সঙ্গে সঙ্গে চাবন ঋষি বললেন, সুকন্যা, তুমি ধন্য! অশ্বিনীকুমার দুটি তো অবাক। তারা দু জনে চাবন ঋষির দিকে ফিরে তাকাল। একজন বলল, ঋষি, আশা করি, আপনি আমাদের সঙ্গে ছলনা করেননি! অন্যজন বলল, আপনি আপনার স্ত্রীকে আগে থেকে কিছু শিখিয়ে দিয়েছিলেন? কিংবা কিছু ইঙ্গিত করেছেন?
চাবন ঋষি বললেন, তারে ছি ছি, সে রকম কী আমি করতে পারি? সে তাে জুয়াচুরি: না, না, আমি সে রকম কিছুই করিনি। সুকন্যার কাণ্ড দেখে আমি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেছি।
ওরা তখন সুকন্যাকে বলল, আমরা হার স্বীকার করছি। কিন্তু আপনি বলুন তাে, কী করে আপনি আমাদের মধ্যে থেকে ঠিক ঠিক আপনার স্বামীকে চিনে নিছেন?
সুকন্যা বললেন, এ তো খুব সােজা। আপনারা তাে অনেক মেয়ে দেখেছেন, অনেক ভোগ করেছেন: আমি যেই শাড়িটা খুলে ফেললুম, অমনি আপনাদের দু জনেরই চোখে ফুটে উঠল চকচকে লােভ আর উনি তো বহুদিন কোনো যুবতী মেয়ে দেখেননি, তাই ওঁর চোখে ফুটে উঠল দারুণ বিস্ময়! আমি লােভী চোখ অনেক দেখেছি, ওরকম বিশ্ময় ভরা চোখ আগে দেখিনি। তাই ওই চোখ দুটিই আমার পছন্দ হল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অশ্বিনীকুমার দুটি বলল, সুকন্যা, আপনি সত্যিই ধন্য: নিন, শাড়িটা পরে নিন। এখন থেকে আপনাকে আমরা অন্য চােখে দেখব, আপনাকে বৌদি বলে ডাকব। চাবন ঋষি বললেন, শুকন্যা, ওদের কিছু ফল-মূল খেতে দাও!
সুত্রঃ স্বনির্বাচিত একশো গল্প