প্রথম প্রবাহ – সৌরভ মুখােপাধ্যায়

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  ›› পৌরাণিক কাহিনী  

……….যাত্রাসঙ্গীদের বসিয়ে রেখে রাজা অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। গিরিকার কক্ষে গিয়ে দেখলেন, সদ্য শৃঙ্গার সমাপ্ত করে রানি শয্যাপার্শ্বে দণ্ডায়মান।
“আর্যপুত্র!” গিরিকা অগ্রসর হয়ে বসুর হাত নিজের দুই তালুর মধ্যে নিলেন। রাজা অনুভব করলেন, তীব্র তাপে যেন দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁর তালু!
এতক্ষণে রাজা নিবিড় নিরীক্ষণে দেখতে পেলেন রানী গিরিকাকে। এমনিতেই অলােকসামান্যা সুন্দরী এই গিরিকা। বিপুলজঘনা, গুরুপয়ােধরা, ক্ষীণকটি। মদির কটাক্ষ খেলে যায় বিলােল নেত্রে। আজ কিঞ্চিৎ বেশিই প্রসাধন করেছেন, তাতে দ্বিগুণ হয়েছে শরীরী আবেদন। অতি সংক্ষিপ্ত কাঁচুলির ফাঁকে গভীর বিভাজিকার হাতছানি। দ্রুত উঠছে পড়ছে দৃঢ়পিনদ্ধ বক্ষোদ্বয়, সূক্ষ্ম ওড়নার অন্তরালে সে উত্থানপতন আরও মােহময় হয়ে উঠেছে। নীবিবন্ধ কি আজ অতীব বিপজ্জনকভাবে নিম্নগামী করে রেখেছেন গিরিকা, লােভন নাভিবিন্দুর থেকে অনেক নিচে? আর এ কী আশ্চর্য রক্তাভা দুই ঠোঁটে! যেন স্বয়মাগতা হয়ে রাজার অধর গ্রাস করতে চলে আসছে!

গিরিকা তীব্র আশ্লেষে বসুকে আলিঙ্গন করলেন। তপ্ত শ্বাস পড়ছে। ঘন ঘন। “আর্যপুত্র… আর্যপুত্র… আহ!” | রাজার রােমরাজি শিহরিত হয়ে উঠল। গিরিকার দুই আবেশ-আনত। মুদ্রিত চক্ষু, অর্ধ-উন্মুক্ত উৎসুক ওষ্ঠাধর, পীনপুষ্ট দেহলতার উষ্ণ নিপীড়ন তাঁর রক্তস্রোত চঞ্চল করে তুলছে। অদূরে কুসুমরঞ্জিত শয্যার আহ্বান। বসুর সমস্ত ইন্দ্রিয় তুঙ্গস্পর্শী সুখানুভূতির জন্য অস্থির হতে লাগল।
হঠাৎ যেন কশাঘাত খেলেন রাজা বসু। এ কী! এ কোন মােহকূদ্ধে ঝাঁপ দিতে চলেছেন তিনি! কয়েকশত পারিষদ-কর্মী-রক্ষী-সেবক অপেক্ষা করে রয়েছে তাঁর জন্য, যাত্রার আয়ােজন পূর্ণ প্রস্তুতুকেও বয়ে যেতে চলেছে। এই প্রকট দিবালােকে এখন তিনি প্রথম গির দাস হয়ে অন্তঃপুরে সঙ্গমলীলায় রত হবেন ! ধর্মপথগামী রার্ডধির যে-উচ্চ ভাবমূর্তি দীর্ঘ সাধনায় অর্জিত হয়েছে, ক্ষণিকের ইন্দ্রিয়তাড়নায় তা কলুষিত হয়ে যাবে? এই কি দেব-আশীর্বাদধন্য কর্তব্যনিষ্ঠ সৎপন্থানুসারী। রাজার যােগ্য কাজ? প্রজারা কি ঘৃণা করবে না, পারিষদরা কি ব্যঙ্গ করবে না অপ্রকাশ্যে, ঋষিরা কি ধিক্কার দেবেন না এই অকালকামাসক্তিকে?

প্রবল দ্বন্দ্বের পর নিজেকে প্রবৃত্তির কবল থেকে উদ্ধার করলেন চেদিরাজ। কোমল অথচ নিশ্চিত ভঙ্গিতে গিরিকার হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত করলেন নিজেকে, বললেন, “এখন নয়, রানি। এ যে যাত্রার সময়। এখন কি এমন করতে আছে? সংযত হও, অপেক্ষা করে। আমি মৃগয়া থেকে শীঘ্রই ফিরব। তারপর তােমার সব অভিলাষ পূরণ হবে।”
স্ফুরিতাধরা গিরিকা তীব্র অভিমানে বললেন, “আসঙ্গ-আতুর রমণীকে তৃপ্ত করাও কি পতিধর্ম নয়, স্বামিন ?”
“আমি তর্ক করব না, প্রিয়ে। শুধু বলি, একটু অপেক্ষা করাে, এইমাত্র। স্থানকাল বিচারে ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখাই সভ্য সমাজের শিক্ষা, বিশেষত রাজ্যপ্রতিপালকদের তাে এ বিষয়ে অধিকতর সচেতন থাকতে হয়, তুমি জানাে।”
“আমি কিছু জানি না। আমার সর্ব রােমকূপে দহন, রাজা! শান্ত করাে, জুড়িয়ে দাও, প্রভু। আমি অপেক্ষায় অপারগ… ওহ… ওহ!” ।

রাজার হাত টেনে নিয়ে উন্মুক্ত স্তনচূড়ায় স্থাপন করতে চাইলেন গিরিকা, কিন্তু ইতিমধ্যে রাজা নিজেকে শক্ত করেছেন, তিনি হাত। ছাড়িয়ে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন। একটিবারও পিছন ফিরলেন না।
প্রস্তরমূর্তির মতাে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন রানি গিরিকা। তারপর ধীরে ধীরে নিজের কেশদামে গ্রথিত যুথীমালাটি খুলে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে ছিড়তে লাগলেন।……….

……….কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে তাঁর মন? কিসের অস্থিরতা? যতবার সেটি উপলব্ধি করছেন রাজা বসু, ততই লজ্জিত হচ্ছেন। গোপনে। তাঁর চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে এক উদ্ধতযৌবনা নারীর শরীর। সে শরীরের প্রতি বক্ররেখায় তীব্র কামনার উদ্ভাস। আহ, সেই তপ্তকোমল প্রত্যঙ্গের সুখস্পর্শ! অদূরেই প্রস্তুত ছিল শুভ্র শয্যা। যদি মৃগয়া স্থগিত করে দিতেন মুহুর্তের সিদ্ধান্তে, তবে এতক্ষণে এই অরণ্যের পরিবর্তে সেই প্রশস্ত শয্যায় রানি গিরিকার সুগৌর বরতনুর অনাবৃত উচ্চাবচগুলি…
আহ! সে মৃগয়ার কি তুলনা আছে! শিকার করেও অতুল সুখ, শিকার হয়েও ততােধিক!
রাজার অন্তর এক গােপন দাহে ধিকিধিকি জ্বলতে লাগল। মাদক কল্পনা একদিকে তপ্ত করতে লাগল তাঁর স্নায়ুমণ্ডলীকে, অন্যদিকে কামাসক্তা রমণীর সুরত-আহ্বান উপেক্ষা করে আসার অনুতাপ! যে-লােকলজ্জা তাঁকে তখন বাধা দিয়েছিল, রাজার ইচ্ছা হচ্ছিল সে লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে এই মুহুর্তে ধাবিত হন নগরীর দিকে। বিনা বাক্যব্যয়ে ঝড়ের মতাে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে বন্ধ করে দেন। শয্যাকক্ষের দ্বার! যা ভাবে ভাবুক সারা বিশ্ব!…….

………ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে রাজার দেহে মনে প্রশান্তি সঞ্চারিত হল। এল ক্লান্তির আবেশ। এক অশােকবৃক্ষের নিচে বসলেন তিনি, অল্পক্ষণের মধ্যেই জুড়ে এল চোখ, শয্যায় শুয়ে গাঢ় তন্দ্রায় অভিভূত হয়ে পড়লেন। তার ঘােরে স্বপ্ন ছেয়ে এল। মদালস নয়নে, ফুরিত অধরে, উদগ্র দুই বক্ষে হিল্লোল তুলে কে যেন ডাকে! সর্ব অঙ্গ দিয়ে সর্ব অঙ্গকে নিপিষ্ট মর্দিত করার আহ্বান জানায়… কে? নুপুরের মধুর ঝিনিঝিনিতে কার কামনামদির ছন্দ? তীব্র শরীরী সুগন্ধ এসে রাজাকে আতুর করে। তােলে, শিহরিত হয় আনখশির, সুপ্তিজাল ছিড়ে যায় পলকে।
কে? কে তুমি? রাজা উঠে বসতে গিয়েও যেন স্তম্ভিত হয়ে যান। নূপুরধ্বনি তা হলে স্বপ্ন ছিল না, এই মাদক দেহসুরভি একান্ত বাস্তব! মায়া নয়, কল্পনা নয় ! তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক শরীরিণী বিদ্যুৎলতা, বনবিতান যেন আলাে হয়ে গিয়েছে তার রূপের ছটায়। রাজ-অবরােধে অনেক সুন্দরী দেখেছেন রাজা বসু, তাঁর পত্নী গিরিকাই তাে অনুপমা রূপসী, কিন্তু এই যুবতীর রূপ যেন অপার্থিব! শরীরের ইন্দ্রজালে পুরুষকে বিমূঢ় করে দেওয়ার সমস্ত উপকরণ যেন পুঞ্জীভূত হয়ে আছে এর ডৌলে ডৌলে। বসুর চোখে পলক পড়ছিল না। | তাঁর মুগ্ধচকিত মুখভঙ্গি দেখেই বােধ হয়, হেসে ফেলল অপরূপা রমণী। তাতে যেন দ্বিগুণ ঝলমল করে উঠল তাঁর অনিন্দ্য আনন, তার সঙ্গে চোখেও ঝলমল মদির কটাক্ষ। বেণুগুঞ্জিত স্বরে সে বলল, “আমি অদ্রিকা। স্বর্গগণিকা। আপনার পরিচয়, ধীমান?”
স্বর্গের গণিকা! রাজা বসুর বাক্য সরছিল না। এমন যৌবনেজি লাস্যময়ী রূপের আগুন, স্বর্ণের বারাঙ্গনা ছাড়া আর হবেই বা কার, ঠিকই! মর্তমানবের ইন্দ্রিয়ে চকিতে ছড়িয়ে পড়ল সেই আগুন। হয়তাে মানবী বলে জানলে কোনওভাবে সংযত রাখতে পারতেন নিজেকে, কিন্তু দেবভােগ্যা স্বৰ্গবেশ্যার মধ্যে যে-অমােঘ কুহকী আকর্ষণ, তা প্রতিহত করার সাধ্য নেই, এমনকী, রাজর্ষি উপরিচর বসুরও! বিশেষত, আজ সারাদিন তাঁকে তুষের আগুনের মতাে দগ্ধ করছে অচরিতার্থ কামস্পৃহা… ।

শুক্তিনিন্দিত দন্তরাজিতে মােহিনী হাসি এঁকে অদ্রিকা আবার বলে উঠল, “আপনি কে, কান্তিমান ? এই নদীতে আমি প্রতিদিন স্নান ও অঙ্গমার্জনা করি, কখনও তাে আপনার দেখা পাইনি এই উদ্যানে! আজ আপনার এই দেবতুল্য অবয়বের কল্যাণে শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এ বিতানের শােভা। আপনার পরিচয় দিন অনুগ্রহ করে। আপনি অবশ্যই কোনও রাজবংশজাত, সম্ভবত রাজাই স্বয়ং, যদি আমার খুব ভ্রম না হয়। তবে প্রাসাদ থেকে এত দূরে এ বিজন অরণ্যে নিদ্রা কেন আপনার ?” | গণিকার সমক্ষে কোন পুরুষই না ঈষৎ প্রগম্ভ হয়! রাজা বসু তরল স্বরে বললেন, “আমি রাজাই বটে। কিন্তু কী করব, প্রাসাদ-অন্তঃপুরে মন স্থির থাকতে চায় না! পুরুষের চাহিদা কি কেবল অন্তঃপুরে তৃপ্ত হয়, সুন্দরী ?
অদ্রিকা অপাঙ্গদৃষ্টিতে ইঙ্গিত হেনে বলল, “কেন ? রাজ-অবরােধে সুন্দরীর কি অভাব ঘটল?”

রাজা শ্বাস ফেলে বললেন, “সুন্দরী কাকে বলে তা তাে আজ জানলাম বরবৰ্ণিনী! আজ আমার চক্ষুর নবজন্ম হল!”
গণিকা ও কামার্ত পুরুষের লঘু বাক্য বিনিময় যেমনটি হয়ে থাকে, তেমনটিই চলল। তবে বেশিক্ষণ নয়। অগ্নি ও পতঙ্গের মধ্যে বেশি ছলচাতুরির অবকাশ থাকে না, পতঙ্গও পতনে ব্যাকুল, অগ্নিও গ্রাসে উন্মুখ। ফলে অচিরেই অদ্রিকার দুই বাহুলতা রাজা বসুকে বেঁধে ফেলল। অভিজ্ঞ গণিকা তার শীলিত-সােহাগি স্বরে রাজার কানে কানে বলে উঠল, “আজ তােমার সব ক্ষুধা আমি তৃপ্ত করব রাজন। স্বর্গের সঙ্গে মর্তের কী তফাত, আজ তুমি জানবে।”
রাজা উন্মত্তের মতাে অত্রিকার স্বচ্ছ বক্ষ-আবরণীটি একটানে খুলে ফেললেন। উষ্ণ রক্তধারা উছুল হয়ে উঠেছে তাঁর শিরায় শিরায়, কঠোর আশ্লেষে তিনি পেষণ করতে লাগলেন স্বর্গরমণীর যৌবনপুষ্ট অদ্রিকা অতি মােলায়েম ভঙ্গিতে তাঁকে নিবৃত্ত করল। প্রশমিত করল তাঁর অতি-তাড়িত অস্থিরতার আস্ফালন। মর্ত মানবকে সে শেখাতে। লাগল ধীরে ধীরে শৃঙ্গে আরােহণের পদ্ধতি। কীভাবে প্রতি অঙ্গ ব্যবহার করতে হয়, কর্ণমূল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত! শুষ্পশয্যা হয়ে উঠল রাজার পাঠশালা। দীর্ঘ, দীর্ঘতর হল সুখানুভূতির প্রহর। এমন অচিন্ত্য আহ্লাপ্লাবনে এর আগে কখনও ভাসেননি চেদিরাজ। নন্দনগণিকা তাঁর শরীরে শরীর সমর্পণ করেও যেন সম্পূর্ণ ধরা দেয় না, যেন শেষ হয় না মিলনের পুলক! রাজার মুখ থেকে অনর্গল সুখ শীৎকার হতে থাকে, অদ্রিকার তৃপ্ত আর্তনাদের সঙ্গে তা একাকার হয়ে যায়। স্বৰ্গ যখন এসে। মর্তের মুঠিতে ধরা দেয়, তা বুঝি এমনই অনন্ত মুহূর্ত হয়ে ওঠে!………..

………কাছ থেকে যৌবনবতী নাইয়াকে খুঁটিয়ে দেখলেন পরাশর ঋষি।। একটু বেশিই দেখলেন যেন। তাঁর শ্বাস দ্রুত হল সহসা। বক্ষপঞ্জর দুলে। উঠল। অপলক চোখে যেন লেহন করলেন তরুণী মল্লাহীর দেহসুষমা।……….

…….পরাশর বললেন, “ঋষিমুখে এই অতীত কৌলীন্য প্রচারিত হবে। আর তােমাকে কেউ নীচবংশীয়া বলে হেয় করবে না জেনাে। শুধু আমার একটি ইচ্ছা তােমাকে পূরণ করতে হবে।”

সত্যবতী নতমুখে বলে, “কী ইচ্ছা মুনির ?”

পরাশর দীর্ঘলম্বিত শ্মশ্রুর মধ্যে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে করতে বললেন, “তােমাকে দেখে, তােমার সান্নিধ্যে এসে আমি স্মর-উত্তেজনায় বড়ই কাতর হয়েছি। প্রথম রিপুর তাড়ন অসহ হয়েছে আমার। যতক্ষণ না এই কামনার উপশম হয় ততক্ষণ অবধি আমার মন আর সাধনায় সন্নিবিষ্ট হবে না। অতএব হে সুন্দরী, তােমার কাছে আমার প্রবৃত্তির তৃপ্তি ভিক্ষা করি। আমার সঙ্গে সংগম করাে, কল্যাণী!”

সত্যবতী দাঁড় টানা বন্ধ করল। তরণী এখন মধ্য নদীতে। চারিপাশে নীরন্ধ্র কুয়াশার বেষ্টন। যেন নৈশ অন্ধকার নেমে এসেছে, শুধু রংটি সাদা। দু-পাশের তীর থেকে কেউ যে দেখে ফেলবে, এমন সম্ভাবনা নেই। সত্যবতী দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন। ঋষি পরাশর অদ্ভুতকর্মা বলে শােনা যায়, নানা গুপ্ত অলৌকিক ক্ষমতা ও মায়াবিদ্যার অধিকারী। রূপে কুৎসিত, জটাজুটধারী প্রৌঢ়, এর সঙ্গে রমণক্রিয়ায় বিবমিষাউদ্রেক হতে পারে। কিন্তু সন্তোষবিধান করতে পারলে হয়তাে বা জাগতিক লাভ হবে বিস্তর। বস্তুত, নদীর ঘাটে ঋষিকে দেখেই সত্যবতীর মনে এই লাভালাভের অঙ্কটিই ঝলসে উঠেছিল প্রথমে। ঋষির চোখে লালসার স্ফুরণ নজর এড়ায়নি তার। এমনই যে কিছু ঘটবে, সে বুঝে নিয়েছিল চকিতে। তখন থেকেই দ্রুত পরিকল্পনার জাল বুনে চলেছে তার মস্তিষ্ক।

ঋষি যা চাইছেন, দিতে সে বাধ্য। স্বেচ্ছায় না দিলে ধর্ষিতা হতে হবে। হ্যাঁ, শীর্ণ তপস্বীকে বাধা দেওয়ার মতাে পেশীবল আছে তার। কিন্তু সে ক্ষেত্রে অভিশাপ অনিবার্য! অতএব, দেহদানই অবশ্যম্ভাবী। তবে এই দানের বিনিময়ে প্রতিদান আদায় করে নিতে হবে পূর্ণমাত্রায়। দেহের শুচিতা নিয়ে বাস্তবিকই আর মাথাব্যথা নেই সত্যবতীর। যে-পুরুষের জন্য এ দেহ-মনের সমস্ত মধু সযত্নে সঞ্চিত করে রেখেছিল সে, তার কাছে মিলেছে শুধুই প্রত্যাখ্যান আর অপমান!

আর কীসের পবিত্রতা, আর কীসেরই বা সতীত্ব? রং এই দেহের মুল্যে যদি অভীষ্ট-সিদ্ধির পথে দু-এক ধাপ অগ্রসর হওয়া যায়, সেই ভাল!…….

………আজ এই কুহেলি-আচ্ছন্ন নদীবক্ষে, পরাশর ঋষির কামস্পৃহা তর্পণের মাধ্যমে কি মিলতে পারে কোনও পথ ?

ঋষি অধীর হয়ে উঠছেন। একেবারে দেহসংলগ্ন হয়ে এসে সত্যবতীর মুখে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, “আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না হে সুস্তনী ! কামাবেগে কম্পমান আমার অঙ্গ তােমার ওই বরতনুর অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হওয়ার জন্য উথালিপাথালি হচ্ছে, আমার সত্নসঞ্চিত ব্রহ্মরেতঃ সহসা স্থৈর্য হারিয়ে সবেগে উৎসারিত হতে চাইছে তােমার তপ্ত-সিক্ত কুমারীগর্ভের উদ্দেশ্যে! আর কালক্ষেপ নয়, এসাে…” বলতে বলতেই পরাশর সত্যবতীর বক্ষবন্ধনীতে হাত রাখলেন।

সত্যবতী চোখেমুখে অসহায় ভীতি ও অপার লজ্জা ফুটিয়ে তুলে বললেন, “তিষ্ঠ, তিষ্ঠ জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ! আপনার ইচ্ছা পালনেই আমার কৃতার্থতা, কিছু একটু ভেবে দেখুন, আমি তাে অনূঢ়! এই অক্ষতযােনিতে আপনি অভিগমন করলে আমার তাে সবই শেষ হয়ে যাবে ঋষিবর… আমি অশুচি হয়ে পড়ব, সকলে আমায় ধিক্কার দেবে, আমার যে বিবাহই হবে না আর! এমন অবস্থার চেয়ে কি আত্মনাশ করাই শ্রেয়।

পরাশর থমকে গেলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন, “আমি অভয় দিলাম। আমার তপােলদ্ধ পুণ্যফলের প্রভাবে তুমি এই রমণপূর্বের কুমারীদেহ ফিরে পাবে আবার। শুধু তাই নয়, তােমার যৌবন হবে দীর্ঘ, জরার গ্রাস হবে বহুবিলম্বিত, এমন বরও দিচ্ছি।”

“কিন্তু ব্রহ্মবীর্য তাে বিফলে যাবে না প্রভু!” সত্যবতীর স্বর এখনও কাতর, “কুমারী অবস্থায় আমার গর্ভসঞ্চার হলে সেই লােকলজ্জা কীভাবে নিবারণ হবে? সন্তানটিকে নিয়েই বা কী করব আমি?”

আবার বিধান দিলেন পরাশর। গর্ভসঞ্চারের লক্ষণ পেলেই দশ মাসের তপােবনবাস নির্ধারিত থাকবে সত্যবতীর জন্য। পল্লিবাসী জানবে, দৈবাদিষ্ট এক ব্রত পালনে অজ্ঞাতবাসে রয়েছে দাসরাজের দুহিতা। নির্জন এক যমুনাদীপে ঋষিপত্নীদের তত্ত্বাবধানে যাপিত হবে গর্ভধারণকাল, তারপর সন্তানপ্রসবমাত্রই সেই সন্তানের দায়িত্ব নেবেন। প্রাজ্ঞ ঋষিবৃন্দ। কালক্রমে সেই সন্তান হয়ে উঠবে অমিতজ্ঞানী ত্রিকালদর্শী শাস্ত্রবিদ ও কাব্যরচয়িতা। আর সেই গােপনবাসের সময়টুকুতে কী ঘটছে, তা জানবে না কোনও জনপদবাসী। লােকলজ্জার সম্ভাবনা নেই।

“এবার তাে এসাে,” বলে পুনরায় কাঁচুলিতে টান দিলেন অনঙ্গপীড়িত পরাশর মুনি।

কিন্তু সত্যবতী এখনও দুই হাতে তাঁকে নিবারণে ব্যস্ত। এখনও সমর্পণের লগ্ন আসেনি। আরও দুটি কথা আছে তার। রমণের প্রাক্কালেই কামজর্জর পুরুষ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে উদার হয়ে ওঠে, বুঝেছে সে। অতএব আরও দুটি যাজ্ঞা পূরণ করেই নেবে সত্যবতী।

“কী? কী যাজ্ঞা, বলাে কন্যে! প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন উদগ্র উৎসুক পরাশর। “তােমার সমস্ত অভিলাষ পূর্ণ করতে প্রস্তুত, শুধু দ্রুত ব্যক্ত করাে, আমার আর বিলম্ব সহ্য হচ্ছে না!”

সত্যবতীর চোখের তারায় অদ্ভুত বর্ণবিচ্ছুরণ! ভুলে যেতে চেয়েও ভুলতে না পারা কোনও জ্বালা, অন্তরের গহনে লুকানাে কোনও ক্ষত বুঝি মুহূর্তে প্রকট হয়ে ওঠে। একবার দন্তে অধর দংশন করে নিয়ে সে বলে, “প্রথম প্রার্থনা, প্রভু… আমার এই দেহ থেকে যেন মৎস্যগন্ধ দূরীভূত হয় চিরতরে, এমন উপায় করে দিন!”

ঋষি হাসেন। “অতি সহজ। তােমার ওই দশ-মাস তপােবনবাসের সময় নিয়মিত কয়েকটি ওষধির নির্যাস লেপন কোরাে সর্বাঙ্গে; বিশেষ গুণসম্পন্ন বিরল ভেষজ ওগুলি, আমি বলে দেব সন্ধান। শুধু যে মৎস্যগন্ধ যাবে তাই নয়, অতুলনীয় মাদক এক স্থায়ী স্বাদুগন্ধ নির্গত হবে তােমার তনু থেকে। সেই স্বর্গীয় কমলসৌরভ বিস্তৃত থাকবে যােজনদূরত্ব অবধি, মৎস্যগন্ধার বদলে যােজনগন্ধা বলে চিনবে তােমায় লােক।” | তৃপ্তির শ্বাস নিয়ে সত্যবতী চারুদর্শনে হাসলেন। তারপর বললেন, “ব্যস, আর একটিমাত্র। সেইটিতে সম্মত হলেই এ অধম নারীতনু আপনার। আমি স্বয়ং সমস্ত আবরণ সরিয়ে আপনার সর্ব-অভিলাষ পূরণে রত হব। শেষ প্রার্থনা, ঋষিশ্রেষ্ঠ!”

“বলাে, বলাে!” চাপা গর্জন করে উঠলেন পরাশর, “অদেয় কিছু না।

“হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে তাে আপনার যাতায়াত আছে, তাই

“বিলক্ষণ! প্রায়ই নানা ধর্মীয় পরামর্শহেতু রাজা শান্তনু আমাকে স্মরণ করেন।”

সত্যবতী এক পল স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর ঋষির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কয়েকটি কথা বলে। তার দেহ এখন ঋষির দেহের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে রয়েছে, ঋষির অঙ্গের শিহরণও টের পায় সে। বাক্য সমাপ্ত হলে ঋষি কুঞ্চিত করে বলেন, “এই মাত্র ? কোনও সমস্যা নেই ললনে! তুমি যেমনটি চাও তেমনই আমি ব্যবস্থা করে দেব, চিন্তা কোরাে না।”

আহ! সত্যবতী আজ বড় তৃপ্ত। এই তুচ্ছ দেহের সমর্পণের বিনিময়ে এত বিপুল মূল্য যে পাওয়া যাবে, কে ভেবেছিল! এত শতবৰ এই যমুনা নদীতে যাত্রীদের পারাপার করিয়েছিল সে কি তার অঙ্গযমুনাতে একটি যাত্রীকে একবার খেয়া পার করিয়েইতো সারা জীবনের পারানি মিলে গেল তার!

“নাও, নাও হে ব্রাঙ্গী!” মুনি আর বাক্যবিনিময়ে রাজি নন। সত্যবতীরও আর দ্বিধা নেই কোনও লাজনত মুখে একে একে সমস্ত বস্ত্র উন্মোচন করল সে। উদ্ভাসিত হল তার লােভন শরীরের দৃঢ় অথচ কোমল সমস্ত বাঁক। পরাশর উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দীর্ঘ তপস্যাজীবনের নারীসংসর্গরহিত যত অবদমিত অভিলাষ, আজ বেগবতী গিরিনদীর মতাে স্ফুরিত! সত্যবতীর অনাঘ্রাত কৌমারীতনু প্রৌঢ় মুনির পেষণে-পীড়নে-দংশনে-মর্দনে জর্জরিত হতে থাকল। চতুর্দিকে কঠিন কুয়াশার আস্তরণ, তার মধ্যে যমুনার স্থির জলে ভাসমান ক্ষুদ্র তরণীটি দুলে দুলে উঠছিল বারবার। | উপবাসী তপস্বীবরের ক্ষুধার্ত রমণ-আস্ফালনে সত্যবতীর দেহও কাঁপছিল থরথর। যদি কামান্ধ পরাশর একবার ভাল করে তার মুদ্রিত চোখদুটি দেখতেন, তিনি লক্ষ করতেন, তাদের কোণে কোণে অশ্রুবিন্দু! হ্যাঁ, দীর্ঘ সঙ্গমকালটুকুতে একবারও চোখ খােলেননি সত্যবতী। এ তার জীবনের প্রথম রতিলীলা। বহু সুখকল্পনা ছিল এই ক্ষণটুকু ঘিরে। কী হতে পারত, আর কী হল!……..

 

……….আরও একটি রজনী প্রভাত হল। আরও একটি হতাশার দিন শুরু। স্বর্ণখচিত মহার্ঘ পালঙ্কে নবনীকোমল শয্যায় একা বসে বসে পূর্ববাতায়নের দিকে তাকিয়ে থাকেন ভরতসম্রাজ্ঞী সত্যবতী। নৈশ শৃঙ্গারের অবশেষ লেগে রয়েছে অঙ্গে। নিশাবসানের প্রথম বালার্কচ্ছটা এসে | পড়েছে মুখের উপর। কিন্তু সে মুখে শুধুই ক্ষুব্ধ আশাভঙ্গের রেখা প্রকট।

বিশাল শয্যার অন্যপ্রান্তে রাজা শান্তনু এখনও ঘুমে অচেতন। শুভ্রকেশ বিস্ত, নাসাগর্জন শােনা যাচ্ছে, ঈষৎ ফাঁক হয়ে রয়েছে ঠোঁটদু’টি। সুষুপ্ত অবস্থায় মানুষের মুখ অদ্ভুত দেখায়। প্রাজ্ঞজনেরা বলেন, নিদ্রাবস্থায় নাকি প্রকৃত চরিত্রটি ফুটে ওঠে মুখমণ্ডলে। সত্যবতী দেখছেন, অবিকল এক নাবালকের মতাে মুখভঙ্গি এখন মহান হস্তিনাধিপতি শান্তনুর। সত্যবতীর ওপ্রান্তে শ্লেষজড়িত ধিক্কারের ভাব ফুটে ওঠে। পকেশ নাবালক! হ্যাঁ, নাবালকই তাে! শিশু যেমন বিপুলায়তন মিষ্টান্নমােদকের জন্য নাছােড় বায়না করে, কিন্তু সেটি পাওয়ার পর সম্পূর্ণ ভক্ষণ করার সাধ্য নেই, অল্প একটু কামড় দেওয়ার পরই অবহেলায় ফেলে দেয় ধুলায়, রাজা শান্তনুও তাই। অন্তরে কাম লম্পঝম্প করছে বিস্তর, কিন্তু বৃদ্ধ শরীর আর সহায়তা করে না। উচ্ছ্বতযৌবনা সুন্দরীকে শয্যায় তাে এনেছেন, কিন্তু সেই তরঙ্গায়িত যৌবনসমুদ্রে ভাসতে গিয়ে কেবলই ডুবে যাচ্ছে তাঁর জরাজীর্ণ ভেলা প্রতিটি বাসকরজনী তাই অতৃপ্তির ক্ষোভে মলিন হয়ে যাচ্ছে সত্যবতীর।

অথচ, প্রচেষ্টায় কোনও ফাঁক রাখছেন না রানি! শয্যায় আসার পূর্বে নিপুণ হাতে প্রসাধিত করছেন নিজেকে। রাজপুরীর অভিজ্ঞ সেবিকাদের সহায়তায় সেই সজ্জা হয়ে দাঁড়ায় এমনই মাদক যে, স্বয়ং মদনদেবই বিহ্বল হয়ে পড়বেন! তদুপরি অতি সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করেন, যাতে আবৃত হয়েও প্রলােভনের ইশারা ছড়ায় দেহের প্রতিটি চড়াই উত্রাই! স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে রতিক্রীড়ায় লিপ্ত করেন বিগতযৌবন রাজাকে। তীব্র অনঙ্গজারিত হয়ে রাজাও প্রাথমিকভাবে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখান, ক্ষিপ্রহস্তে নির্বস্ত্র করে ঝাঁপিয়ে পড়েন সত্যবতীর বরতনুর উপর! দংশনলেহন-মর্দনাদিও চলে কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু অনতিপরেই খররৌদ্রপীড়িত বল্লরীর মতাে নির্জীব হয়ে পড়তে থাকে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। দার্ঢ্য হারায় পৌরুষ। শত প্রয়াসেও আর ফেরানাে যায় না হত উদ্যম, শিথিলতনু শান্তনুকে অমােঘভাবে গ্রাস করে নেয় নিদ্রা! আর সত্যবতী? শিরায়শিরায়-রােমকূপে প্রবাহিত অগ্নিজ্বালা নিয়ে কঠিনমুখে বসে থাকেন শুধু। জানালার বাইরে নক্ষত্ৰমণ্ডিত কৃষ্ণ আকাশ, আর শয্যাপ্রান্তে সুপ্ত পতির নাসিকাধ্বনি, এই নিয়ে কেটে যায় রাত্রির পর রাত্রি।

প্রভাতে নিদ্রাভঙ্গের পর, প্রতিদিনই, সসংকোচে মার্জনা ভিক্ষা করেন বৃদ্ধ রাজা। কখনও নানাবিধ অজুহাতও দেন। রাজকার্যের চিন্তায় অতি মগ্ন থাকায় নাকি মনঃসংযােগ করতে পারেননি, কিংবা বৈকালিক মৃগয়াজনিত ক্লান্তির কারণেই, অথবা নিছকই একটি নাছােড় শিরঃপীড়া তাঁকে জ্বালিয়েছিল, ইত্যাদি প্রভৃতি। নবােঢ়ার স্বাভাবিক সংকোচশত প্রথমে কয়েকদিন নতমুখে ব্রীড়ার অভিনয় করেছেন সত্যবতী, কিছু কৃত্রিম স্তোকও দিয়েছেন। কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না!

বাস্তবিকই যদি কোনওদিন সক্ষমতার শীর্ষ স্পর্শ করতে না পারেন প্রবীণ নৃপতি? যদি দাম্পত্যজীবনের সব ক’টি রাতই কেটে যায় এমন বহূরম্ভ-লঘুক্রিয়ায় ? বৎসরান্তে যখন শূন্য থেকে যাবে সত্যবতীর গর্ভ,………

রানি আজ স্বয়ং এমন মােহময়ী সজ্জায় সজ্জিত হয়েছেন যে, যােগমগ্ন মহাতপস্বীর মনও বিচলিত হতে বাধ্য। চীনাংশুক-আবৃত তাঁর কাঁচুলি আজ উতুঙ্গ। বিভাজিকায় অভ্রচূর্ণ চিকচিক করছে। গভীর নাভিদেশ সুরভিচর্চিত। সর্বাঙ্গের ত্বকে লিপ্ত হয়ে রয়েছে অপরূপ সুগন্ধি | ভেষজনির্যাস। স্বাভাবিক পন্নগন্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও শতপুষ্পের সুবাস! সূক্ষ্ম কটিবস্তুটুকু যেন স্খলিত হওয়ার অপেক্ষাতেই উৎসুক। কবরীতে পুষ্পমালিকা বিজড়িত, কণ্ঠে পুষ্পহার, মণিবন্ধেও কুসুমকঙ্কণ। যেন এক যৌবনপীড়িতা বনদেবী অধর স্ফীত করে ডাক দিয়েছেন!

শান্তনু প্রথমে বিস্মিত, পরে অভিভূত হলেন। বললেন, “আজ এ কী চমৎকার!”

সত্যবতী অতি কোমলভাবে বৃদ্ধ রাজার অঙ্গে চম্পকাঙ্গুলি বােলাতে থাকেন। মধ্যে মধ্যে লঘু চুম্বন করেন তাঁর কর্ণমূলে, কণ্ঠমণিতে, উন্মুক্ত বক্ষে। জাদু-ধূমের প্রভাব সঞ্চারিত হচ্ছে শান্তনুর স্নায়ুকোষে, তিনি প্রবল উচ্যুসে আলিঙ্গনবন্ধ করতে চান পত্নীকে। কিন্তু সত্যবতী চতুরা ছলনাময়ীর মতাে দূরে সরে যান। নিবৃত্ত করেন উত্তেজিত শান্তনুর প্রাথমিক উদ্যম। ধীরে, আর্যপুত্র, ধীরে ! আজ সমস্ত রাত আমাদের ক্রীড়া চলবে। এ তাে সবে আরম্ভ, প্রাণাধিক! অতি মৃদু তালে রাজার অঙ্গমর্দনসংবাহন শুরু করেন রানি। শান্তনুর অঙ্গ শিহরিত হতে থাকে, আশ্লেষে ছটফট করেন প্রৌঢ় রাজা, আবার সর্ব-উদ্যমে নিপিষ্ট করতে চান সত্যবতীর উষ্ণ দেহ, কিন্তু সত্যবতী কেবলই গাঢ় স্বরে বলেন, “অধৈর্য। নয়, আর্যপুত্র ! ধীরে… ধীরে…”

এই হল রাজকািজের পরামর্শ। অতি দ্রুত যেন তুঙ্গে উপনীত না হন রাজা! যেন আকস্মিক ও তীব্র উত্তেজনার বিস্ফোরণ না হয়, ক্রমশ শমিত হতে হতে ধাপে ধাপে বর্ধিত হয় কামােন্মাদনা। পূর্বক্ৰীড়া দীর্ঘতর হলে, তবেই মিলবে কাঙ্খিত ফল। এবং, অবশেষে ঠিক যে-মুহূর্তটিতে রাজা অধীর হয়ে মিলনে রত হবেন, তাঁর মুখে দিতে হবে একটি সুমিষ্ট তাম্বুল, ওই তাম্বুলেই আছে দীর্ঘ সুরক্ষমতাপ্রদায়ী জড়িবুটি। চর্বনের সঙ্গে-সঙ্গেই প্রভাব শুরু হবে, রমণকাল প্রলম্বিত হবে স্বাভাবিকের চেয়ে বহুগুণ! একটি রাত্রির জন্য নপুংসককেও নাকি পুরুষসিংহে রূপান্তরিত করতে পারে এই ওষধি, এমনই বলেছেন কবিরাজ।

মাজার-মূষিক খেলায় মেতেছেন সত্যবতী। যেন জন্মদাত্রী স্বর্গগণিকার সমস্ত কলাবিদ্যা আজ ভর করেছে তাঁকে। রাজা যতই কাতরভাবে চুড়ান্ত মুহূর্তটি যা করছেন, ততই মােহ ছলনায় তাঁকে ভুলিয়ে কালক্ষয় করে চলেছেন। সে কৌশল-ক্রীড়া শেষ হল মধ্যমে। সত্যবতী উন্মুক্ত করলেন দুর্গদুয়ার। ওষধি-প্রাণিত রাজা শান্তনুও তাঁর বার্ধক্যজড়িমা ভুলে সতেজ গতিমান অশ্ব হয়ে উঠেছেন! রতিভঙ্গিমার। বৈচিত্র্যে সত্যবতী দ্বিগুণতর উৎফুল্ল করে তােলেন তাঁকে। অনর্গল সুখআর্তনাদে কেঁপে ওঠে শয্যা। নখরে-দশনে পরস্পরকে ছিন্ন করেন মিথুনযুগল।

আজ বসন্ত সার্থক হল!

তৃপ্ত রাজা ঘুমিয়ে পড়ার পরও কিন্তু বহুক্ষণ জেগে থাকেন সত্যবতী। রতি-সুখের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কছে সন্তানলাভের চিন্তা আজকের এই পূর্ণ সঙ্গমের ফলে, এই প্রথম, পতির শুক্ৰবীজেন্দ্র স্বাদ পেল তাঁর শস্যোমুখ ভূমি। কিন্তু শান্তনু বৃদ্ধ হয়েছেন, যদি বীর্য ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে থাকে? কবিরাজ আশ্বাস দিয়েছে অবশ্য, ভেষজের গুণে ক্ষীণরেতঃ পুরুষের শুক্রেও সঞ্চারিত হবে জাদুশক্তি। কিন্তু যদি ভাগ্য দুর্বিপাকে এই একটিবারের মিলনে ব্যর্থ হয় সে তেজ ? যদি না হয় কাঙিক্ষত গর্ভাধান ? | ভাবতে থাকেন সত্যবতী। রাজভিষেকের সাবধানবাণীটিও স্মরণে উদিত হয় তাঁর। একটি রজনীতে অতিরিক্ত সুরতক্রিয়াতে যেন উদ্বুদ্ধ না করা হয়ে রাজাকে! কৃত্রিম পন্থায় জাগরুক যে-পৌরুষ, তাতে অতি-শ্রম সহ্য হবে না। হয়তাে বা অভাবিত কোনও বিপর্যয় দেখা দেবে। সত্যবতী জানতে চেয়েছিলেন, এমনভাবে ওষধি-প্রযুক্ত রমণবিলাস কতবার সম্ভব, কত ঘন ঘন? বৈদ্য মাথা নেড়েছিলেন। রাজার যা বয়স, তাতে তিন মাসে একবার। তার অধিক ওষধি প্রয়ােগ হলে সমূহ ক্ষতি। অর্থাৎ আগামী তিনমাসের মধ্যে আর এ কার্যে সম্মত হবেন না কবিরাজ। তিন। মাস! ছয়টি পক্ষকাল! সত্যবতী অস্থির হয়ে ওঠেন। ঈশ্বর না করুন, এই তিনমাসের মধ্যে যদি আকস্মিকভাবে অসুস্থ, শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন বৃদ্ধ। শান্তনু ? কিংবা, আহ দুর্ভাগ্য, যদি মৃত্যুই হয় তাঁর ? সত্যবতী তাে স্পষ্টই জানেন, তাঁর সময় অতি সংক্ষিপ্ত, এর মধ্যেই সিদ্ধ করে নিতে হবে অভীষ্টটুকু।

যামগুলি অতিক্রান্ত হতে থাকে। সত্যবতীর নাসারন্ধ্র স্ফীত হয়, কুঞ্চিত হয় যুগল, দৃঢ় হয় চিবুকের পেশি। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, দ্রুত। চন্দ্র তখন অস্তে বসেছে, এমন সময়ে সত্যবতী নিদ্রিত রাজার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কোমল স্বরে ডাকলেন, “প্রিয়তম!”

রাজা চোখ মেলে বিস্মিত হলেন। সত্যবতীর মদির নেত্রে আবার স্পষ্ট এক আহ্বান ফুটে উঠেছে যেন! ঈষদোন্মুক্ত ওষ্ঠাধারে যেন পুনর্মিলনের ইঙ্গিত!

“আজ আপনি দুর্মদ যােদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, আর্যপুত্র!”— অস্ফুটে উত্তেজক বাক্য বলতে থাকেন সত্যবতী— “আমার যৌবন আজ ধন্য। হয়েছে আপনার রণােন্মত্ততায়। কিন্তু এখনও তাে রজনী অবসান হয়নি, হে ধনুর্ধর, আর-একবার আমি সেই যুদ্ধ প্রার্থনা করি!”
শান্তনু একটু ইতস্তত করলেন। পূর্বের অনেক রাত্রির বিফলতা-স্মৃতি জেগে উঠল। বললেন, “দ্বিতীয়বার! এক রাত্রে দ্বিতীয়বার ? সম্ভব হবে কি?

অধীর কামার্ত কণ্ঠে সত্যবতী বললেন, “অবশ্যই হবে, অবশ্যই! আজ আপনার শিরে আছে অনঙ্গদেবের অজেয় আশীর্বাদ! আজ আপনার জয়ধ্বজা বার বার উডউনি হবে দেখবেন!”

হাসলেন হস্তিনাধিপতি। “যুদ্ধার্থীকে বিমুখ করা ভরতবংশীয়দের রীতি নয়, বরারােহে! এসাে, আবার তােমার দুই তপ্ত জঘনের উদ্বেল তরঙ্গশীর্ষে আরােহণ করি !”

সত্যবতী বললেন, “না প্রভু! এবার হােক বিপরীত বিহার। আরােহীর ভূমিকা পরিবর্তিত হােক। আপনার পৌরুষাের্মিই আন্দোলিত করুক আমার এ ক্ষুদ্র তরণী !”

“তরণী বাইতে তুমি অবশ্য বেশ পটু, কৌতুকভরে সত্যবতীকে চুম্বন করে শান্তনু তাঁর ক্ষীণকটিদেশ আকর্ষণ করে তুলে নিলেন নিজের উপর। হ্যাঁ, এখনও ওষধি তার গুণ হারায়নি, অনুভব করলেন রানি! এখনও দিব্য অটুট রয়েছে শান্তনুর প্রবর্ধিত রমণ সামর্থ্য। প্রলম্বিত হয় সুখমুহুর্ত। নিশার অন্তিম যামের উত্তাল তরঙ্গভঙ্গ ভাসিয়ে নিয়ে যায় দুই নরনারীকে।

কবিরাজের বাক্যগুলি মনে পড়ে সত্যবতীর। বেশি ঝুঁকি হয়ে গেল কি? অতিরেক না হয়। স্বল্প-ব্যবধানে মিলন ডেকে আনতে পারে বিপদ! শঙ্কিত চক্ষে দু’-একবার রাজার মুখমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করেন। নাহ, সুখের স্বেদবিন্দু জমেছে মাত্র ! আশ্লেষে নিমীলিতনয়ন, ওষ্ঠে তৃপ্তির আভাস। কোনও অসুস্থতার লক্ষণ নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে মৈথুনের গতিছন্দে মিশে যান সত্যবতী। | দ্বিতীয়বারের বর্ষণে পুনরায় সিক্ত হয় শস্যক্ষেত্র। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে এক পরম নিশ্চিন্তি অনুভব করেন রানি। রমণীরা নাকি বুঝতে পারে, কোন মিলনে উপ্ত হয় বীজ! ব্যর্থ হবে না তাঁর প্রয়াস, আশা দৃঢ়তর হয় রাজমহিষীর।

জবাকুসুমশঙ্কাশ দিবাকর যখন পূর্বদিগন্তে আবির্ভূত হলেন, তৃপ্ত ক্লান্ত সত্যবতী তখন গাঢ় নিদ্রায় ডুবে গিয়েছেন। স্বপ্নের ঘােরে তিনি এক আশ্চর্য শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। রাজপ্রাসাদে আনন্দবাদ্য বাজছে। রাজপুত্র জন্মেছে… হস্তিনাপুরের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী… রাজা শান্তনুর পুত্র! রাজপথে আনন্দ-উদ্বেল জনতার কোলাহলও যেন কানে আসে ওই! রাজমাতার জয় ! সত্যবতী স্পষ্ট শুনছেন!………….

 

……….অম্বিকা। চম্পকবরণী যুবতী, দীর্ঘদেহিনী, কুঞ্চিত ঘনকৃষ্ণ কেশদাম, “আয়তলােচনা। পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যের জোয়ার উপচে পড়তে চায় উদ্ধত স্তনভারে। মাধবীনিশির আধাে-অন্ধকার শয্যায় উদ্দাম হয়ে ওঠে তার আগ্রাসী যৌবন। যেন অনন্ত বাসনার মূর্তিমতী রূপ! | আর অম্বালিকা? তার বর্ণ ঈষৎ শ্যাম, কিন্তু নিটোল সর্বাঙ্গসুন্দর সুমধ্যম তনুলতা। নীলাভ তরঙ্গায়িত সাগরের মতাে তার চুলের ঢেউ, রক্তাভ উন্নত নখর, স্থল নিবিড় নিতম্বদ্বয়। ক্ষীণ কটি ও গভীর নাভিকে মধ্যে রেখে স্থূল সুবর্তুল উরজ আর পীন শ্রোণিদেশ উচছুসিত হয়ে উঠেছে দুই প্রান্তে। রতিলীলায় সেও অগ্রজার মতােই বুভুক্ষু, যৌবনের তাপে দগ্ধ করে দিতে চায় রমণসঙ্গীকে। কে বেশি মাদক? কার দেহের স্বাদ অধিকতর কমনীয় ? মধুযামিনীকে উন্মাদপুলকে ভরিয়ে দিতে কার পারঙ্গমতা বেশি ?

বিচিত্রবীর্য এর উত্তর খুঁজে পান না কিছুতেই। যখন এই দুই পূর্ণযৌবনা রমণীকে তাঁর শয্যায় নমসহচরী করে পাঠানাে হয়েছিল, তখন তিনি কৈশােরােত্তীর্ণ সদ্য। বিপন্ন বােধ করেছিলেন যথেষ্ট। সচরাচর এমন ঘটে না যে! বয়সে প্রায় দ্বিগুণ, এই দুই পরিণতদেহিনী তাঁর পত্নী! নাবালক বিচিত্রবীর্য ঘটনার বিড়ম্বনায় রাজমুকুট পরেছেন বটে, কিন্তু তাতে তেমন সমস্যার মুখে দাঁড়াতে হয়নি। রাজকার্য চালান মহান অগ্রজ ভীষ্ম, নেপথ্যনির্দেশ আসে মাতা সত্যবতীর কাছ থেকে, সহায়তা করার জন্য তৎপর রয়েছে অমাত্যের দল। বিচিত্রবীর্যের কাজ সামান্যই। মুকুটটি পরে সিংহাসনে গম্ভীর মুখে বসে থাকা। কিন্তু শয্যা তাে আর রাজসভা নয়। সেখানে সহায়ক নেই, পরামর্শ দেওয়ার জন্য অমাত্য নেই, দায়িত্বভার নিজ স্কন্ধে নিয়ে শ্রম লাঘব করার জন্য কোনও ভীষ্ম উপস্থিত নেই।

রুদ্ধদ্বার কক্ষ, কুসুমশােভিত একটি রাজকীয় শয্যা। এবং অপরপ্রান্তে যৌবনকাতর ত্রিশাের্ধ ললনা। সপ্তদশবর্ষীয় কিশাের স্বামীটি তখন বয়ঃসন্ধিজাত দেহতাড়না সম্পর্কে অল্পবিস্তর অবগত বটে, কিন্তু রতিকলার নানা খুঁটিনাটি বিশদে জানার সুযােগই হয়নি। সুকুমার মুখশ্রীতে জমে উঠত বিড়ম্বনার স্বেদবিন্দু, হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠত বিচিত্রবীর্যের। যেন রণক্ষেত্রে প্রবল পরাক্রমী অজেয় শত্রুর সম্মুখে, একাকী অথচ নিরস্ত্র !

তারপর ? এই তাে কেটে গেল কতগুলি বছর। অম্বিকা অম্বালিকা দু’জনেই পরম যত্নে কিশাের স্বামীটিকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে রমণ অভিজ্ঞ করে তুলেছে রীতিমতাে। যেমন বয়ােঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহওঁ পরিণত হয়েছে বিচিত্রবীর্যের, তেমনই তুঙ্গস্পর্শী হয়ে উঠেছে নারীসঙ্গের সামর্থ্য। প্রবৃত্তির পাবকে অনর্গল ইন্ধন নিক্ষেপের ফলে তার লেলিহান জিহ্বা আরও আগ্রাসী হয়েছে। এখন আর পত্নীদের বয়স্কা বলে মনে হয় না তাঁর, বরং তার যৌবনমত্ত পৌরুষের তীব্র নিষ্পেষণে দুই রমণীই পরাভূত হয়ে যায়। বিচিত্রবীর্য এখন দক্ষ সাঁতারুর মতাে কখনও ডুবে কখনও ভেসে অবলীলায় পেরােতে শিখেছেন মিলনরজনীর গহিনতম প্রহরগুলি।

এক রাতে অম্বিকা, পরের রাতে অম্বালিকা। এক অভিজ্ঞতার রেশ কাটতে না কাটতেই অন্য অভিজ্ঞতায়। এর তপ্ত স্তন বিভাজিকা, ওর উষ্ণ জঘনমণ্ডল। এর ওষ্ঠ, ওর অধর। এর আশ্লেষে নখরাঘাত, ওর রুদ্ধ শীৎকার। দুই নারী যেন একাকার হয়ে যায়! অক্লান্ত রমণ করে চলেন হস্তিনাধিপতি বিচিত্রবীর্য। মাতার আদেশ, অবিরত বুনে যেতে হবে  বীজ। কর্ষণ করে যেতে হবে নিয়ত। বিচিত্রবীর্য একনিষ্ঠভাবে বীর্য বপন করতে থাকেন। ক্রমে এক রাতের ব্যবধানটুকু মুছে যায়। দ্বিপ্রহরিক শয্যায় এক নারী, নৈশ যাপনে অন্যটি। দিন রাত্রিকে ভাগাভাগি করে দিতে হয়। প্রচ্ছন্ন প্রতিযােগিতায় যেন মেতেছে দুই সহােদরা, দুই সপত্নী। দু’জনেই আরও বেশি করে পেতে চায়। দু’জনেই চায় একে অন্যকে ছাপিয়ে যেতে। কে দিতে পারে বেশি রতিসুখ? বেশি সময় ধরে ? ভঙ্গিমাবৈচিত্রে কে অধিক পারদর্শী? বিচিত্রবীর্যও ক্ষত্রিয়নন্দন। নারীর কাছে পরাজিত হবেন না তিনিও। রমণক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তিনি ঔষধ সেবন করেন গােপনে। ক্রমে দুই নারীর টানাটানি বাড়তে থাকে। একবার রতিযুদ্ধ সাঙ্গ হওয়ার পরেও স্বামীকে শয্যাতে ধরে রেখে , দ্বিতীয়বারের জন্য আহ্বান জানান দুই নারীই। চতুঃষষ্টিকলার বিবির বিকাশে ক্রমশ জটিলতর ও দীর্ঘায়িত হতে থাকে সঙ্গমপর্ব। বিচিত্রবীঞ্জে বলবর্ধক ঔষধের মাত্রা বাড়াতে হয়। কিন্তু মাতা সত্যবতীর যাজ্ঞা পূর্ণ হল কই?

বর্ষ-বর্ষ দুই নারীতে অবিশ্রান্ত অভিগমন করলেন বিচিত্রবীর্য, অথচ নিষ্ফলাই রয়ে গেল দু’টি ক্ষেত্র। ব্যর্থ হয়েই রইল বীজ। সত্যবতী ব্যকুল হয়ে ওঠেন। ভর্ৎসনা করেন পুত্রবধূদের। নিশ্চয়ই তারা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না তাঁর পুত্রের পৌরুষ। নতমুখে আরক্তিম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অম্বিকা, অম্বালিকা। শ্বমাতাকে কী করে বােঝাবে, তাদের প্রযত্নে কোনও ত্রুটি নেই। সন্তানলাভের জন্য তারা প্রতিযােগিতা করে রীতিমতাে। যার গর্ভে আগে পুত্র আসবে সেই যে ভবিষ্যতের রাজমাতা— এ তাে জানা আছে তাদের। তাই একটি ঋতুস্নানও তারা ব্যর্থ হতে দেয় না। দ্বন্দ্বের তীব্রতা এমনই জায়গায় পৌঁছেছে যে, একইসঙ্গে ঋতুমতী হয়ে পড়ার পর উর্বরতম লগ্নে মিলনপ্রার্থী হয়ে দুজনে একই শয্যায় আহ্বান করেছে বিচিত্রবীর্যকে! একই সঙ্গে এয়ী রমণে মিলিত হয়েছে, কয়েদণ্ডের ব্যবধানে স্বামীর বীজ ধারণ করেছে দু’জনেই। যাতে দু’জনেরই সম্ভাবনা সমান থাকে। কিন্তু হায়… বিধি দু’জনের প্রতিই সমান অকরুণ! মিলনের সুখটুকু মিলেছে, সার্থকতা নয়।

বিংশতিবর্ষ অতিক্রম করলেন বিচিত্রিবীর্য। সত্যবতী ক্রমে অধীর ও পরে হতাশ হতে থাকেন। আবার যেন নিয়তির ক্রুর পাশা তাঁকে ঠেলতে-ঠেলতে পরাভবের প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এবার বিচিত্রবীর্যের রেতঃবীর্যে ক্রমশ কমবে গর্ভাধান-ক্ষমতা। বিংশতি বর্ষ… বিংশতি বর্ষ তাে পেরিয়ে গেল। সত্যবতীর মনে সংশয়কীট দংশন করতে থাকে। যথেষ্ট আগে থেকেই তাে কর্ষণের সুযােগ দেওয়া হল বিচিত্রবীর্যকে, তবু তাে ফসল এল না। তবে কি মিথ্যা বলেছিল বৃদ্ধ রাজভিষক?………..

 

………পুরােহিত কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন। অতঃপর বিনীতভঙ্গিতে বললেন, “মহান রাজা শান্তনুর পিণ্ড ও পরিবারধারা বজায় রাখার দায়িত্বটি পলিন করুন, হে বীর্যবান ভীষ্ম। মাতা সত্যবতী যদি অনুমতি করে তবে আপনার প্রিয় ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের দুই রানির গর্ভে আপনি স্বয়ং পুত্র উৎপাদন করুন। আপনি জ্ঞানী এবং শাস্ত্রবিৎ, এ ধরনের পেকালে বংশরক্ষার মহান উদ্দেশ্যে ক্ষেত্রজ সন্তানের প্রযত্ন করা যে ধর্মসম্মত, তা নিশ্চয়ই জানেন। যেহেতু আপনার প্রয়াত পিতৃদেবের কাছে আপনি কথা দিয়েছিলেন যে, ভরতবংশ ও সাম্রাজ্যকে আপনি সর্বতােভাবে রক্ষা করবেন, আপনার এই কার্যটি সর্বাংশেই সেই সত্যপালনের সমার্থক হবে। মাতা সত্যবতীর কাছে করা ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞাটি মাত্র একবার লঙঘন করলে কোনও পাপ হবে না। পুত্রজন্মের পর পুনরায় আপনি ব্রহ্মচারী জীবনে ফিরে যাবেন নাহয়।”

সত্যবতী ভীষ্মের দিকে তাকিয়ে রইলেন আবার। হৃদয়ের মধ্যে একটি কীট যেন দংশন শুরু করেছে। দুই বিধবা পুত্রবধূর পূর্ণযৌবনা শরীর দু’টি অকস্মাৎ ভেসে উঠল মনশ্চক্ষে। সত্যই, অশেষ রূপসম্পন্না, আবেদনময়ী দুই বধু, অম্বিকা ও অম্বালিকা। দেহের প্রতিটি ভৌলে, প্রতিটি শিখরে অতৃপ্ত যৌবনক্ষুধা এখনও জাগ্রত তাদের। তদুপরি তাদের গর্ভ এখনও শূন্য। পুত্রকামনায় অধীয় হয়ে রয়েছে দুইজনে। বিশেষত পতির প্রয়াণের পর আর যে পুত্রলাভের আশা নেই, এই চিন্তায় বিবশ তারা। ভীষ্মের মতাে প্রবল ও মহান পুরুষের সন্তানধারণের প্রস্তাব পেলে তারা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে মুহুর্তমধ্যে।

আর ভীষ্ম ? তিনি ?

সত্যবতীর কূট চক্রান্তে যাঁর যৌবন চলে গেছে নারীস্পর্শরহিত, যাঁর প্রবল পৌরুষ গুমরে মরেছে শর্তাক্রান্ত ব্রহ্মচর্যের কারায়, আজ এ প্রৌঢ় বয়সে দুই উদ্ভিন্নযৌবনা ভ্রাতৃবধূর গর্ভদান প্রস্তাব ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়ায় জারিত করছে তাঁকে? তাঁর কল্পদৃষ্টিতে কি উদ্ভাসিত হচ্ছে না দুই মিলনপ্রার্থিনী কামিনীর দেহবল্লরী? কল্পিত আশ্লেষ দৃশ্য তপ্ত করছে না তাঁর শ্বাস? একটিবার মাথাটি হেলিয়ে দিলেই সাদরে উন্মােচিত হয়ে যাবে দু’-দুইটি কোমল নারীদেহ আস্বাদনের পথ… সত্যবতীর চোখের সামনে দিয়ে গর্বিত পদক্ষেপে তিনি হেঁটে যাবেন অম্বিকা ও অম্বালিকার শয্যাকক্ষের দিকে। কোনও লােকাপবাদ বা ধর্মচ্যুতি হবে না তাঁর ব্রহ্মচর্যভঙ্গে, এই তাে বিধান দিচ্ছেন পণ্ডিতবর্গ!

সত্যবতী অস্থির হয়ে ওঠেন। ভীষ্মকে অন্য নারীর বাহুডােরে তিনি কল্পচক্ষেও দেখতে পারবেন না। অম্বিকার অনাবৃত দেহে ভীষ্মের পেশল শরীর সংলগ্ন হচ্ছে, অম্বালিকার বরতনু পিষ্ট হচ্ছে ভীষ্মের পৌরুষপীড়ণে! আহ আহ। না না না! সহ্য হচ্ছে না সত্যবতীর। ভাবনাটি পর্যন্ত সহ্য হচ্ছে । অন্তরাত্মা দগ্ধ হয়ে ছটফট করতে থাকে।

এ কী পরিহাস, কুটিল নিয়তির! অম্বার শয্যায় যাতে দেবব্রতর স্থান না হয়, সেই উদ্দেশ্যে তাকে শপথের পাশে বাঁধলেন সত্যবতী, আর এত যুগ পরে সেই অম্বার ভগিনীদ্বয়ের শয্যাতেই তাকে আহ্বান করে নিয়ে যেতে হবে!………….

 

……….শয্যার কোমল আবরণটির উপর ধীরে ধীরে হাত বােলাচ্ছিলেন অম্বিকা। এই শয্যা, এই রাজকীয় পালঙ্কের উপরে কুসুমনিন্দিত শয্যা, কত রভসরজনীর সাক্ষী! এখনও তরুণ বিচিত্রবীর্যের সেই প্রথম দিনের অপ্রস্তুত মুখখানি মনে পড়ে। কৈশােরােত্তীর্ণ স্বামীটি বুঝেই উঠতে পারছিলেন না, মধ্যযৌবনের আগ্রাসী অগ্নিশিখার মতাে এই দ্বিগুণবয়স্কা পত্নীটিকে কীভাবে পরিতৃপ্ত করবে? সংকোচে স্নায়ুচাপে ভালাে করে অম্বিকার মুখের দিকে তাকাতেই পারছিলেন না বিচিত্রবীর্য। এদিকে অম্বিকাকে স্পষ্টই বলে দেওয়া হয়েছে যত দ্রুত সম্ভব গর্ভধারণ করে বলবান পুত্রের জন্ম দেওয়াই তার দায়িত্ব। তাই নববধুর প্রথম স্বামীসংসর্গে যে-স্বাভাবিক লাজনম্রতা থাকার কথা, অম্বিকা দ্রুত তা বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। তার দাম্পত্যে সবই যেন বিপরীত ! যে-ব্যক্তি স্বয়ম্বর থেকে তাকে হরণ করল, সে বিবাহ করল না। বয়সে বহু কনিষ্ঠ এক বালকতুল্য রাজা, সেই নাকি তার স্বামী ! কোথায় স্বামীই অগ্রসর হয়ে তার অবগুণ্ঠন লাজাঞ্চল মােচন করবে, ব্রীড়ানত মুখখানি তুলে ঘরে সংকোচ হরণ করবে সযত্নে, তার বদলে পত্নীকেই নিতে হচ্ছে স্ব-উদ্যোগ! অপটু, দ্বিধাগ্রস্ত, স্বামীর জড়তা কাটিয়ে শয্যায় আকর্ষণ করে আনতে হচ্ছে। সঠিক অর্থে বলতে গেলে, অম্বিকাই হরণ করেছিল বিচিত্রবীর্যের কৌমার্য। পূর্ণ স্ফুরিত যৌবনমত্ত দেহের পাকস্পর্শ দিয়ে তাকেই গলাতে হয়েছিল কিশাের স্বামীটির অজ্ঞতার বরফ। অন্ধকারে পথ দেখাতে হয়েছিল শরীরকে প্রদীপ করে। তারপর ধীরে ধীরে বিচিত্রবীর্য দক্ষ যােদ্ধা হয়ে উঠল। দুই পত্নী নিয়ে রমণসাগরে সাঁতার দিতে লাগল অবলীলায়।……

……“কী কৃত্য মাতঃ ?” অম্বিকা কৌতুহলী হয়েছিল। | “মন দিয়ে শােনাে বাছা। তােমাকে সন্তানধারণের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

“সন্তান ধারণ ?” বিস্ময়ে বারােধ হয়ে গিয়েছিল অম্বিকার।

“হ্যাঁ বৎস। পতির মৃত্যুর পরেও নিয়ােগ-প্রথার মাধ্যমে পত্নীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন স্মৃতিশাস্ত্র অনুমােদিত। বিধবা ভ্রাতৃবধুর পুত্রোৎপত্তির অধিকার দেওয়া আছে দেবরকে। আজ রাতে তােমার এক দেবর তােমার শয্যাকক্ষে আসবেন ও তােমাতে উপগত হবেন। তিনিই তােমার গর্ভে দান করবেন ভরতবংশের উপযুক্ত উত্তরাধিকারী এক শত্রুমর্দনকারী রাজচক্রবর্তী লক্ষণসম্পন্ন সুসন্তান।” | দেবর! অম্বিকার বিমূঢ় অবস্থা কাটতে চাইছিল না। দেবর অর্থে স্বামীর ভ্রাতাকে বােঝায়। বিচিত্রবীর্যের তাে আর কোনও ভ্রাতা নেই। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদ তাে বহু পূর্বেই গতায়ু হয়েছেন। দেবর শব্দটি অম্বিকার বিহ্বল মস্তিষ্কের অলিন্দে প্ৰহেলিকার মতাে ধুম নির্গত করতে থাকে। দেবর, দেবর..

অকস্মাৎ তার মুখে রক্তোচ্ছ্বাস দেখা দেয়। আপাত অসম্ভব একটি সম্ভাবনা ঝিলিক দিয়ে ওঠে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে। ঠিক। ঠিকই তাে! যাঁর মুখ আচম্বিতে ভেসে উঠল অম্বিকার মানসপটে তিনিও তাে দেই। স্বামীর ভ্রাতাই তাে। অম্বিকা অনুভব করে, নিজ অজ্ঞাতসারেই তার রােমরাজিতে বিদ্যুৎ খেলে গেল একবার। উরুদ্বয় যেন থরথরিয়ে উঠল। বক্ষ কম্পিত হল। তপ্ত হয়ে উঠল শ্বাস। তিনিই কি? তিনিই? দেবর বলতে তাঁকে ছাড়া আর কাকেই বা বােঝায় ? আহ ভাগ্য। এমন ভাগ্য হবে অম্বিকার ? অম্বিকা উত্তেজনায় হর্ষে রােমাঞ্চে স্থান-কাল ভুলে চোখ বন্ধ করে ফেললেন।…….

……..এখন এই মৃদু আলােকিত শয়নকক্ষে পুষ্পস্তীর্ণ শয্যায় শায়িত অম্বিকা অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছে। ঠিক মধ্যমে তিনি আসবেন, বলেছেন রাজমাতা। না, পরিচয়টি শেষ পর্যন্ত খুলে বলেননি। কিন্তু অম্বিকা নিশ্চিত মনে জানে তাঁর পরিচয়। চক্ষু মুদ্রিত করে সে উপাধানে মাথা রেখে শুয়ে রইল। সত্যবতীর কথাগুলি এখনও কানে বাজছে তার, “কৌসল্যে দেবরস্তে হস্তি সােহদ্য ত্বানুপ্রবেক্ষ্য তি। অপ্রমত্তা প্রতীক্ষৈনং নিশীথে হি আগমিষ্যতি৷৷” শ্বদেবী বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই দেবর কিন্তু একটি রাতের জন্যই। মাত্র একটি রাতই তিনি তার শয্যার অতিথি। ফলে অম্বিকাকে থাকতে হবে অপ্রমত্ত। অর্থাৎ কোনও মােহবদ্ধতা যেন তাকে গ্রাস না করে। কেবলই এক পবিত্র কর্তব্যসম্পাদন, এই মানসিকতা নিয়েই এক রাত্রির দেহ সমর্পণ— একথা যেন মনে রাখে সে। চোখ বুজেই মৃদু হাসে অম্বিকা। অপ্রমত্তা! অতই কি সহজ, মাতা, অপ্রমত্ত থাকা! যিনি আজ নিশিবাসরে অম্বিকার যৌবনসুধা পান করতে আসছেন, তার স্পর্শ পেয়ে কোনও রমণী অপ্রমত্তা থাকতে পারে! একটিবার, জীবনে একটিবার তাঁর হাতের স্পর্শ পেয়েছিল। অম্বিকা, সেই কবে, স্বয়ম্বর মণ্ডপে।……….

……..অবশেষে পদশব্দ শােনে অম্বিকা। শয্যাগৃহের দ্বার খুলে যাওয়ার শব্দও। এসেছেন, তিনি এসেছেন। অম্বিকার বুকের মধ্যে কল্লোলধ্বনি ওঠে, শাঞ্জিত অবস্থা থেকে উঠে বসে সে দ্বারের দিকে তাকায়। আগন্তুক তখাঁর বন্ধ করছেন, এগিয়ে আসছেন শয্যার দিকে।

কোমল অথচ স্পষ্ট আলােতে সেই ব্যক্তির অবয়ব পরিস্ফুট হয়। অম্বিকা আর্তনাদ করে ওঠে। এ কী ? এ কে? কে এ!

দীর্ঘ ও বিপুলাকার শ্রীহীন এক বল্কলধারী পুরুষ, মাথায় প্রাচীন জটার ভার, সর্বাঙ্গে কটু গন্ধ, বিকট অপরিচ্ছন্ন শ্মশুগুফজালে মুখাকৃতি কুৎসিত হয়ে রয়েছে, চক্ষুদ্বয় রক্তাভ।

অম্বিকার সমস্ত উত্তাপ মুহুর্তে হিম আতঙ্কে পরিণত হয়। কাতর কণ্ঠে বলে, “কে? কে আপনি?”
গম্ভীর রুক্ষ কণ্ঠে উত্তর আসে, “আমি পরাশরনন্দন দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। তােমার গর্ভসংক্রমণার্থ আমাকে আহ্বান করে এনেছেন মাতা সত্যবতী। প্রস্তুত হও, কল্যাণী।”

অম্বিকা সংকুচিত এ ভঙ্গিতে শয্যার একপ্রান্তে সরে যায়। কম্পস্বরে বলে, “কিন্তু… কিন্তু আমাকে যে বলা হয়েছিল আমার এক দেবর….

তপস্বী ঈষৎ হাসেন কি না বােঝা যায় না। শুধু তাঁর কর্কশ কণ্ঠটি শােনা যায়। “আমিও তােমার দেবর হে পৌরব-বধু। আমি মাতা সত্যবতীর কানীনপুত্র, ঋষি-ঔরসজাত। নির্জন দ্বীপে তপস্যা করে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছি, অবশেষে এই অচ্ছত্র রাজ্যকে উত্তরাধিকারী দেওয়ার দায়িত্ব আমার স্কন্ধে অর্পণ করে ডেকে পাঠিয়েছেন গর্ভধারিণী। আমি মাতার কাছে শপথবদ্ধ ছিলাম, যে-কোনও প্রয়ােজনে সাহায্য করব। তাই আজ এই প্রয়ােজনটুকুর স্বার্থে তােমার শয্যায় এসেছি। অধিক বাক্যব্যয়ের অবকাশ নেই, মধ্যরাত্রির শুভলগ্ন বয়ে যায়, তুমি সঙ্গম দান করাে অম্বিকা। বসন উন্মােচন করাে, আমার অঙ্কে স্থাপন করাে নিজেকে।

দয়া করুন প্রভু, “আ… আমি… আমি বড় ভীত হয়েছি। আমি প্রস্তুত নই।” অম্বিকার সারা শরীর কাঁপছে, সে হাতজোড় করে মিনতি জানায়।

ব্যাস নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলেন, “সে তাে স্বাভাবিক। আমার এই বিকটদর্শন ঘাের-কৃষ্ণ তনু, সস্বেদ গাত্রমল, অসহ্য দেহগন্ধ, কুৎসিত বেশবাস, পিঙ্গল জটাজুটের জঙ্গলে কীটেরা বাসা বেঁধেছে। এ সমস্ত যে তুমি প্রসন্নভাবে নিতে পারবে না, সে কে আর না জানে! আমি তাই মাতাকে বলেইছিলাম, ভ্রাতৃবধূ যেন অপ্রমত্তা থাকেন, যেন নির্বিকার ব্রতপালনের মানসিকতা নিয়ে এই কর্মে সম্পৃক্ত হন।”

“এ যে অসম্ভব, মহাত্মন, অম্বিকা কাতর কণ্ঠে বলে, “এমন ভয় ও বিতৃষ্ণা জয় করা সামান্য নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। রমণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে মানসিক সমর্থন লাগে, তা নিতান্ত দেহের ক্রিয়া নয়। আপনি শাস্ত্রবিদ। আপনাকে আর কী বােঝাব! আপনার এই করাল রূপ আমাকে আতঙ্কিত করেছে, আপনার সঙ্গে আমি মৈথুন করব কী করে!

“বৃথা তর্ক, হে সুন্দরী। মাতা সত্যবতী দ্বারের বাইরে অপেক্ষা করছেন। আমি কথা দিয়ে এসেছি তাঁকে, আজকের এই একটিমাত্র সঙ্গমেই তােমার গর্ভধারণ হবে। অতএব তুমি স্বেচ্ছায়ই হােক, অনিচ্ছাতেই হােক, নিজেকে সমর্পণ করাে। কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়সুখের উদ্দেশ্যেই নরনারীর সঙ্গম হয়, তা নয়। প্রজনার্থং মহাভাগাঃ— অনেক ক্ষেত্রে সুখের উর্ধ্বে উঠে কেবল বংশরক্ষার পবিত্র দায়ও পালনীয়। আজ তুমি সেই কৃত্য সম্পাদন করছ ধরে নাও। এসাে, আর বিলম্ব নয়।”

সবল দুই হাতে অম্বিকার কোমল শরীরকে আকর্ষণ করে আনলেন। দ্বৈপায়ন। অম্বিকার সকরুণ মিনতি গ্রাহ্য না করে তাকে শুইয়ে দিলেন। শয্যায়, টান মেরে খুলে দিলেন সমস্ত বসন। অম্বিকার মুখের কাছে যখন তার বিকট মুখটি নেমে এসেছে, জটাজুট গুল্মজাল সমেত। তীব্র উৎকট দুর্গন্ধে প্রায় শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে অম্বিকার। আশৈশবের রুচির উপর এ কী কুঠারাঘাত! ঘৃণায় ভয়ে ধিক্কারে চোখ বন্ধ করে নিস্ক্রিয় অসহায়ভাবে পড়ে থাকে কাশীরাজের কন্যা, বিবমিষা দমন করতে থাকে প্রাণপণে। মুদ্রিত চোখের প্রান্ত থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। নিজেকেই কঠিন বিদ্রুপ করতে থাকে সে। হায়, কী অসম্ভব আশা করে অর্ধরাত্রি যাপন করলে তুমি, হতভাগিনী, কী আকাশকুসুমস্বপ্নে বিভাের হয়ে, আর শেষে কী ফল পেলে! ধিক!

মৃতবৎ মুদ্রিত নয়ন, আড়ষ্ট নারীদেহটিকে অবাধে রমণ করতে লাগলেন ব্যাস। তাঁরও কোনও বিকার নেই। যান্ত্রিক কর্তব্যপালনের ভঙ্গি। যথা নিযুক্তস্মি তথা করােমি। এ কর্মে তাঁর কোনও স্বার্থ জড়িত নেই, পুত্র উৎপাদন করেই তিনি আবার চলে যাবেন নিজ সাধনা ক্ষেত্রে, বংশধরদের কাছে কোনও আশা-প্রত্যাশার বন্ধন থাকবে না। শুধু মাতার আদেশ পালন করার জন্য একটি নারীর গর্ভে বীর্য নিক্ষেপ, এইমাত্র। প্রাকৃতিক প্রয়ােজনে যেমন মলমূত্র ত্যাগ করে মানুষ, আর ফিরেও তাকায় না, এও সেরকমই।………….

……….কিন্তু শেষ হাসিটি হাসতে পারবেন তাে? অম্বিকার শয্যাগৃহের বাইরে অপেক্ষমাণ রাজমাতার হৃদস্পন্দন এখন ক্রমবর্ধমান। তীব্রতর হচ্ছে উদ্বেগ। তাঁর তৃণীর শূন্য করে যাবতীয় অস্ত্র নিঃশেষ করে ফেলেছেন সত্যবতী। এই তাঁর শেষতম সংগ্রাম। পুত্র দ্বৈপায়ন আশ্বস্ত করেছে যদিও, আজকের একটিমাত্র সংগমেই সে বীজ বপন করবে অম্বিকার জঠরে, তবু কেন যে সত্যবতীর দক্ষিণ ভ্র বারবার কেঁপে উঠছে অজানা আশঙ্কায় ! না, বিশ্বাস করেন না তিনি ছলনাময়ী নিয়তিকে আর। যতবার তিনি নিশ্চিত জয়ের স্বাদ ওষ্ঠে গ্রহণ করেছেন, ততবারই ঠিক পরের মুহুর্তে নিয়তি চূর্ণ করে দিয়েছে সে পানপাত্র। দ্বৈপায়ন তাঁর অন্তিম ভরসা, কিন্তু কে জানে কোনও দুয়ে অন্ধকার থেকে কোনও অভাবিত দুর্দৈব এসে সেই আশপথে কণ্টক বিছিয়ে দেবে কি না!

দ্বার খােলার শব্দ। চতুর্গুণ হয়ে ওঠে সত্যবতীর হৃৎপিণ্ডের গতি। ওই যে পরাশরপুত্র বেরিয়ে আসছেন শয়নকক্ষ থেকে। সত্যবতী দু’-এক পা এগিয়ে এলেন। খােলা দ্বারের অভ্যন্তরে দৃষ্টি গেল তাঁর। অনুজ্জ্বল আলােকেও তিনি দেখতে পেলেন শুভ্র শয্যায় মর্দিত পুষ্পদলের উপরে জ্যেষ্ঠা বধু অম্বিকার এলায়িত শরীর পড়ে আছে। নগ্ন, মথিত, মৃতদেহের মতাে নিশ্চল। নিশ্চয় তীব্র মৈথুনের পর শ্রমক্লান্ত। আশান্বিত হলেন শ্মশ্রুমাতা। তবে নিশ্চয়ই সার্থক হতে পেরেছে তাঁর যােগী পুত্র। দুরন্ত যৌবনবতী বুভুক্ষু অম্বিকাকে এমন পরিশ্রান্ত করে দেওয়া মুখের কথা নয়। অবশ্যই প্রবল পৌরুষ দিয়ে তার উপবাসী কামনাকে তৃপ্ত করেছে দ্বৈপায়ন। অর্থাৎ সফল হবেই তার বীর্যক্ষেপণ। যাক, শেষ পর্যন্ত হস্তিনার রাজপদ সুরক্ষিত রইল সত্যর রক্তদ্ধারকদের জন্যই। এই পৌত্রটি রাষ্ট্রকে ধারণ করে থাকবে। সত্যবতী ইতিমধ্যে এর নামও ঠিক করে ফেলেছেন ধৃতরাষ্ট্র।

“বলাে পুত্র!” উৎসাহিত সত্যবতী দ্বৈপায়নের দিকে তাকান, “অম্বিকার গর্ভে সর্বগুণান্বিত রাজ উত্তরাধিকারীর জন্ম তুমি নিশ্চিত করে এসেছ তাে? রাষ্ট্রধারণকারী সন্তান ?”

যােগী বেদব্যাস কয়েক মুহূর্ত নীরব রইলেন। তারপর শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, “মাতঃ ! এই মিলনের ফলে আপনার যে-পৌত্রটি জন্ম নেবে সে হবে মাতঙ্গের তুল্য বলবান।

আহ শান্তি! শান্তি! সত্যবতী উল্লসিত হয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, অকস্মাৎ তাঁর ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাঁকে থামিয়ে দিল।

“তােমার কণ্ঠস্বর এমন বিমর্ষ গম্ভীর কেন, পুত্র ?”

“কারণ, প্রবল শক্তিধর হওয়া সত্ত্বেও এই শিশু আপনার আকাঙ্খা পূরণ করবে না, জননী। রীতি বিধান অনুযায়ী সিংহাসনে বসার উপযুক্ত সে হবেই না।”

“কী বলছ!” সত্যবতী আকুল হয়ে ওঠেন, “অর্থ কী এ কথার ?” 

“সন্তানটি হবে জন্মান্ধ। সঙ্গমকালে ওর মাতা বীতস্পৃহায় চক্ষু মুদ্রিত করে ছিল, তাই শিশুটিও পৃথিবীর আলাে দেখার অধিকারী হবে না আমৃত্যু। এবং চিরচক্ষুহীন ব্যক্তি রাজপদে অভিষিক্ত হয় না কখনও, এটাই যে রীতি, মাতা। আপনি বংশধর পেলেন, কিন্তু উত্তরাধিকারী নয়।”

সহসা সত্যবতীর মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ চমকাল। উন্মত্তের মতাে চিৎকার করে উঠলেন তিনি, “না, দাঁড়াও। ভাগ্যের প্রতি আমি অতীতে বহুবার পরিবর্তন করেছি!”

ব্যাস আবার বাইরে তাকালেন। সত্যবতী তাঁর হস্তধারণ করে উত্তেজিত স্বরে বললেন, “এখনও তােমার করণীয় আছে, হে মহান পুত্র আমার। সব আশা শেষ হয়নি। বিচিত্রবীর্যের দ্বিতীয় স্ত্রী অম্বালিকাকে প্রস্তুত করছি আমি, স্বল্পক্ষণ অপেক্ষা করাে। আমি কঠোরভাবে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে রাখব, যাতে কোনওক্রমেই সে রমণকালে চক্ষু মুদ্রিত না করে। দৃষ্টিমান একটি পুত্র তাকে তুমি উপহার দাও, যাতে তার উপর ন্যস্ত করা যায় কৌরবরাজত্বের শাসনভার।”

ব্যাস উদাস চোখে তাকালেন। আর একবার ? বেশ। তাতেই যদি চরিতার্থ হয় জননীর যাজ্ঞা, তবে তাই হােক। তাঁর কাজ আজ্ঞাপালন। নিরাসক্ত হৃদয়ে যন্ত্রের মতাে তিনি কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করবেন। যদি এই দ্বিতীয় বধূটি স্বাভাবিকভাবে সহন করতে পারে তাঁকে, তবে স্বাভাবিক সন্তানের জননী হবে সে। নচেৎ আবার আসবে ত্রুটিযুক্ত শিশু। এতে তাঁর কোনও নিজস্ব সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ জড়িত নেই। হ্যাঁ, মাতার সার্থতাঠেই তাঁরও সার্থকতা এইটুকুই।

নির্বিকার মুখে বললেন দ্বৈপায়ন, “যথা আজ্ঞা, মাতঃ।”…………

………“বলাে, বৎস বলাে? আকুল স্বরে জানতে চান মাতা, আজ কি সার্থক হয়েছে মিলন?”

মিলন ? ব্যাস যেন ঈষৎ লজ্জাশীল ভঙ্গিতে উত্তর দেন, “তা হয়েছে। আজ বড় তৃপ্তি হয়েছে আমার।”

উল্লসিত কণ্ঠে সত্যবতী বলেন, “সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টকে সহবাস করতে পেরেছ তাে পুত্র আমার ? কোথাও কোনও অনুপপত্তি ছিল না তাে? সঙ্গিনীটি অসহযােগিতা করেনি তাে?”

“না মাতঃ। রমণীটি আজ শয্যাকক্ষের দ্বার থেকেই আমাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে শয্যায় নিয়ে যায়। তারপর স্বয়ং অগ্রণী হয়ে আমাকে নানাবিধ কলাবিদ্যার দ্বারা প্রসন্ন করে। চুম্বন আলিঙ্গন সংবাহনাদির মাধ্যমে আমার স্মরােদ্দীপনা জাগরুক করে তােলে। তার নিটোল বিক তনুর সুখম্পর্শে উত্তেজিত হয়ে আমি পূর্ণ আনন্দে সম্ভোগে প্রবৃত্ত হই। অসহযােগিতা তাে দূরের কথা, আমার সর্ব অভিলাষ সনিষ্ঠভঙ্গিতে পূরণ করে সে। উপরন্তু তার নিবিড়তর সাহচর্য আমাকে দিয়েছে চুড়ান্ত সুখমুহূর্তের বারবার পুনরাবৃত্তি। আজ প্রকৃতই আমার রেতঃস্খলন কেবলমাত্র যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ ছিল না। প্রীতিসংযােগে তা হয়ে উঠেছিল মধুর দাম্পত্যযাপনের সমান।”………

……….শ্বাস রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন ভীষ্ম। নিস্পন্দ, নির্বাক। বােধ হয় গগনবিদারী এক একটি কুলিশ সম্পাতের অভিঘাতেই, এক একবার মৃদু শিহরিত হয়ে উঠেছে তাঁর লৌহস্তম্ভের মতাে ঋজু পেশল স্ত্রীর। সত্যবতী স্নায়ুরােগগ্ৰস্তার মতাে অনর্গল বলে চলেছেন, “দ্যাখাে, আমার দিকে চেয়ে দ্যাখাে, গঙ্গানন্দন! আমার অঙ্গ স্পর্শ করে দ্যাখাে। ঋষি পরাশরের আশীর্বাদে প্রলম্বিত যৌবন আমার, এখনও অটুট আমার যুবতীসম্পদ। কেশে রজতরেখা দেখা দিয়েছে কিন্তু এই দ্যাখাে আমার ক্ষীণ মধ্যদেশ, পীনপুষ্ট শ্রোণী। বক্ষে এখনও তপ্ত তুঙ্গ কামনার ঢেউ। এখনও উর্বরতা ছেড়ে যায়নি যােজনগন্ধার গর্ভ। আমি নিশ্চিত বলছি তােমাকে। বলাে, বলাে দেবব্রত, আমার তনুষ্পর্শে উষ্ণ হচ্ছে না তােমার পৌরুষ? উচ্ছ্বসিত হতে চাইছে না দীর্ঘদমিত বীযজ্রোত? নাও, প্রিয়তম, আমাকে নাও। তােমার ওই চিরনিঃসঙ্গ শয্যায় আমাকে সবলে নিক্ষেপ করাে, নিপিষ্ট মথিত করাে, কর্ষণ করে, উৎপন্ন করাে কাঙ্খিত শস্য… যে হবে ভবিষ্যৎ হস্তিনার ভরসা। অনেক ভ্রান্ত প্রচেষ্টার পর আমি আজ স্পষ্ট বুঝেছি, গাঙ্গেয়, তােমার বীজ ও আমার ভূমি ছাড়া উপযুক্ততম অঙ্কুর কিছুতেই পাবে না এ বংশ। এ নগরী। এই হল দৈবের লিখন, যা আমরা পড়তে পারিনি এতদিন। শপথভঙ্গের ভয় পাচ্ছ, শান্তনব? পাপের আশঙ্কায় সংকুচিত? আমি অভয় দিচ্ছি তােমায়, যার কাছে তােমার শপথ, তার কাছেই শপথমুক্তি হােক আজ। বন্ধনকারিণী স্বয়ং নিষ্কৃতি দিচ্ছে… আর কী অধর্ম, আর কী ভয়?”………

One thought on “প্রথম প্রবাহ – সৌরভ মুখােপাধ্যায়

Leave a Reply