হে প্রবাসী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

………..পাশের অন্য ঘরে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে একটি বাচ্চা। বিছানায় শুয়ে বাচ্চাটি কেঁদেই চলেছে, কেঁদেই চলেছে। স্বামীটি পাজামা পরা, খালি গা। সে মশারি খাটাবার জন্য পেরেক ঠুকতে ব্যস্ত। স্ত্রটি একবার ঘরের বাইরে যাচ্ছে আর আসছে। স্ত্রীটি গােলগাল ও পাঁচ ফুটের কম। কিন্তু তার পােশাক বিশ্বর নিশ্বাস কেড়ে নেয়। তার শাড়িটি বিছানার ওপর নদীর মতন ছড়ানাে। ব্লাউজ নেই। শায়াটি টেনে তুলে বুকের ওপর বাঁধা। ওপর দিকে তার স্তনের অর্ধেক এবং নিচের দিকে তার হাঁটু থেকে নগ্ন। এরকম শায়াসজ্জা কখনও দেখেনি বিশ্ব। স্ত্রীলােকটির নিচের দিকটা সে বেশি দেখতে পাচ্ছে না, ওপরের দিকে যা দেখেছে তাই যথেষ্ট। এর আগে কোনওদিন সে আলাে নিভিয়ে জানলার কাছে দাঁড়ায়নি। এ সময় সে এদের চেনে না।……….

………মেয়েটি নিজের ঘরের দরজায় খিল দেয়। তার স্বামীর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে এক টান দিয়ে ফেরত দেয় সঙ্গে-সঙ্গে। তারপর ঠিক এক লহমার মধ্যে সে তার শাড়ি, ব্লাউজ, ব্রা, শায়া খুলে ফেলে। ঠিক যেন ঝড়ের বেগে। আবার স্বামীর কাছ থেকে সিগারেট নেয়, ধোঁয়া গড়িয়ে যায় তার নগ্ন বুকে।

বিশ্ব প্রথমে মাথা নিচু করে ফেলে, তার শরীর কাঁপে, সে ভয়ও পায়, তার একুশ বছর বয়সে এই প্রথম একজন বাস্তব, জ্যান্ত, মাত্র কুড়ি ফুট দুরত্বে নগ্ন নারী। এই দৃশ্যটির জন্য সে ঠিক আট বছর ধরে প্রতীক্ষা করে আছে। যেন স্বপ্ন না হয় এই ভেবে সে আবার মাথা তুলল, খুব আস্তে-আস্তে। এইটুকু রাত্রেই গলির জীবন একেবারে নির্জন, সে দেখল একটু আগের ম্যাডােনা এখন সমুদ্র থেকে উঠে আসা উর্বশী, মেয়েটি নিজেই ধরে আছে তার একটি স্তন, তার সরু কোমর, তার নাভি। আরও একটু দেখবার জন্য বিশ্ব তার জানলার বেদিতে উঠে দাড়াল।………..

………কান্নার শিশুকে যে মুহূর্তে শান্ত করে দিয়েছিল সেই মেয়েটিই নিজের ঘরে এসে বিদ্যুতের মতন নগ্ন হয়ে গেল, পূর্ণ আলােয় সে তার স্তন, কোমর, যােনি ও ঝকঝকে উরু মেলে ধরল বিশ্বর দিকে, মেয়েটি জানে না, সে এক নবীন যুবাকে নিয়ে গেল কোথা থেকে কোথায়!

বিশ্ব দেখেনি, ওই মেয়েটির স্তনদ্বয় খানিকটা অতিরিক্ত পৃথুলা। লক্ষ করেনি ওর তলপেটের ফাটা ফাটা দাগ। যে রূপের ঝাপটা লেগেছিল তার চোখে, তাতে তার মনে হয়েছিল, সুধাসাগর সেঁচে অকস্মাৎ আবির্ভূত হয়েছিল ওই নারী। তার একুশ বছর জীবনের প্রথম দৈব উপহার। আজই বিকেলে তার বীরত্ব ও মৃত্যুকে এড়াবারও কৃতিত্বের জন্য এই উপহার তার প্রাপ্য ছিল।…………

………পরদা সরিয়ে বিশ্ব ফিরে এল মন্ডপে। এখন সে ইচ্ছে করলে হঠাৎ গানের রেকর্ড চালিয়ে সকলের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। দয়াবশত সে ইচ্ছে করল না। যেখানে পুরােহিতের বসবার কথা, সেখানে বিশ্ব বসল কুশের আসন পেতে। ভেতরটা ঝলমল করছে আলােয়। আর হােয়াইট শার্টিনের শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেবী সরস্বতী। পায়ের তলায় পদ্ম ও বিসদৃশ রকমের বড় রাজহাঁস। হাতে বীণা। তার চোখ ঠিক বিশ্বর দিকে। বিশ্ব যেদিকেই মাথা ঝোকায়, মূর্তির চোখ সেদিকেই যায়। এত আলাে, এত স্তব্ধতা, এত বেশি রকমের রাত্রি, তার মধ্যে বিন্ধুর কাছাকাছি আর কেউ নেই। শুধু এই এক মাটির নারী। তার গর্জনতেলমাখা ঠোট, তার নিথর নিবদ্ধ চোখ, মাথায় কোঁকড়ানাে চুল, রক্তাভ হাতের পাঞ্জা, নকল মুক্তোর শােভিত কুচযুগল তার কোমরের নিখুঁত খাঁজ ও উরু। | বিশ্বর সমস্ত শরীরে একটা আঁকুনি লাগল। একবার চকিতে তার মনে পড়ল ঘাটশিলায় বেড়াতে গিয়ে দেখা ছােটমাসির বান্ধবী দময়ন্তী নামের এক নারীকে, তার বুক ব্যথা করতে লাগল।

বিশ্বর মনে হল, এই নিখিল বিশ্বে তার আর কেউ নেই। যদি কাল সকালেই সে মরে যায়, তার জন্যে কেউ কাদবে না। সেজন্যই বেঁচে থাকা সব কিছুকে ছিনিয়ে নেওয়ার লােভ জাগল তার। সে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে সেই গর্জনতল-মাখা ঠোটে চুমু খেল। তারপর মুখটা সরিয়ে নিয়ে দেখল তখনও সেই মূর্তির মুখ হাসি-হাসি, তখনও তার চোখে চোখ।

কেউ দেখার নেই. জেনেও বিশ্ব ভয়ে ভয়ে একবার তাকাল পেছনে। পরদা ফেলাই আছে। বিশ্বর সারা শরীরের মধ্যে আগুনের ফুলকি ছােটাছুটি করছে। এবার সে নিবিড় আলিঙ্গন করে চুমু খেল সরস্বতীর ঠোটে। বুকে হাত রাখল। বাতাবী লেবুর মতন বুক। বিশ্ব নিজের মুখ রাখল সেখানে। তারপর পাগলের মতন চুমু খেতে লাগল কোমরে, উরুতে, আর সেই জায়গায়।………

……..

হালকা নীল অরণি বন, খানিক দূরে নদী
উর্বশী উরুর মতাে রৌদ্রমাখা জল….

এই পর্যন্ত লিখে বিশ্ব থামল। উর্বশীর উপমাটি দিয়ে সে খুব রােমাঞ্চিত। অনেকদিন আগে সে অভিধানের মধ্যে একটি দু-অক্ষরের অসভ্য কথা দেখে শিউরে উঠেছিল। ছাপার অক্ষরের মধ্যে যেন ঝকঝক বুলেট থাকে। হঠাৎ এসে বুকে লাগে। ওইরকম একটা সাংঘাতিক কথা দিব্যি অভিধানের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে শুয়ে আছে। সেই রকমই উর্বশীর উরু, একটু আগেও মনের মধ্যে ছিল না। এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, পারস্য-হুরিকার মতন ঝকঝকে উর্বশী এইমাত্র জলের মধ্যে নগ্ন করলেন তার উরুদেশ…বিশ্ব নিজের পা-জামার দড়ি আলগা করে দিল…রােদুর দিয়ে উর্বশী মাজছেন তার উরু। আশ্চর্য, এই সঙ্গেই বিশ্বর মনে পড়ল চাইবাসার হাটে সে দেখেছিল এক সাঁওতাল রমণী, এক ঝলকের জন্য হঠাৎ তার উন্মুক্ত উরু, সম্পূর্ণ নিস্পৃহভাবে ছেকাছেনি ভাষায় কথা বলতে বলতে সে চলে গেল রােবাে নদীর দিকে।..উর্বশীর রং কি সাঁওতাল রমণীর মতন শ্যামলিম, না, তা হতে পারে না, যাকগে, ওই যা ঠিক আছে।………….

…….রুচিরা দেবী কী সাংঘাতিক সুন্দরী, তাকালেই বুক কাপে, উনি কি লক্ষ করেছেন আমি প্রায়ই ওঁর দিকে গােপনে তাকিয়ে থাকি? কখনও উনি একটা হাত উঁচু করলে যদি ওর বগলে কচি ঘাসের মতন নােম দেখা যায়, মাথার ভেতরটা কীরকম অবশ অবশ হয়ে যায়।……..

Leave a Reply