……হারেমে ঢুকেই আমি বুঝলুম, এখানে সৌন্দর্য আছে, সােয়াস্তি নেই। এখানে উন্মত্ততা থাকলেও সুখ নেই। এখানে যৌন থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ। সকল থাকতেও যেন এ এক বুভুক্ষু হুবীর দেশ, হারেম।…..
……পূর্ব আমিরদের যতদিন বান্দা ছিলুম, জেনানা মানুষের মুখ আমি খুব কম দেখতুম! মেয়েরা হাটতে বােরখা পড়ে। হারেমে আমি দেখলুম বােরখাহীন ঝাঁকে ঝাঁকে সুন্দরী মেয়েছেলে। খােজাকে লজ্জা বা সঙ্কোচের কিছু নেই। মিহি মসলিনের ওড়না গায়ে সালােয়ার কামিজ পরা বাদীরা অবাধে ঘুরে বেড়াতে হারেমের মধ্যে। মাঝে মাঝে ননীর মত নরম দেহের বেগমেরা দেখা দিতেন। একপাল বাদী তঁাদের ঘিরে ঘিরে চলত।……
……বাদীরা তাে খোজা নয়। পুরুষের পুরুষত্ব নষ্ট করে তাকে খােজা করা যায়। কিন্তু বাদীর নারীত্ব তাে নষ্ট হয় না। অথচ নারীত্বের সার্থকতা হারেমের মধ্যে তাদের নেই। শুধু বাদীদের কেন, সমস্ত বেগমদেরও নেই। বছরের পর বছর কেউ ফুলের মত সুন্দর যৌবন নিয়ে পড়ে আছেন, ভ্রমর নেই। সে যন্ত্রনা নারী ছাড়া আর কে বুঝে। তাই প্রতি সন্ধ্যাতে হারেমে ভারে ভারে সিরাজী আসতো। পান করে চূড় হয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন বেগমেরা। নেশা না হলে উন্মাদের মত ব্যবহার করতেন। বাদীদের জাপটে ধরতেন, সুখ না পেলে চাকাতেন। তারপর হুহু করে দিতেন।
বাদীদের তাই দেখতুম, প্রতি সন্ধ্যায় যেমন করে হােক নেশায় বুদ করে বেগমদের বেহুস করবার চেষ্টা করে তারা। নইলে কপালে লেখা নির্ঘাৎ লাঞ্ছনা। কিন্তু বেগমদের বেহুস করলেই কি সব হত? তাদের নিজেদের যন্ত্রনা নেই। সুতরাং তারাও ভারে ভারে মদ খেত, পাগলামী করত, যে খােজাদের বলিষ্ঠ দেহ ছাড়া আর কোন রমণী-রমণ ক্ষমতা নেই, তাদের বিরক্ত করতাে, লােভ দেখাতাে, আড়ালে টানতাে।……
……খাস বেগম মহলের বাদী ছিল সাকী। ঘােড়শী, তন্বী। যেন হিন্দুস্থানের এক টুকরাে লিকলিকে চাবুক।…..
……শাহের মনে ছিল তখন দারুণ চিন্তা। বেগমের ননীর মত দেহের স্পর্শে, দুগ্ধ ফেননিভ শয্যায়, রেশমে মােড়ানাে গদিতেও তার নিদ্রা ছিল না। সিরাজীতে নেশ ধরত না।……
……একথার উত্তর আমি কিছুটা পেয়েছিলাম। মেয়েদের কাম্য সুস্থ পুরুষ। সৌন্দর্য পরের কথা। পুরুষের সান্নিধ্য থেকে আজীবন বঞ্চিত হারেমের বাঁদীরা। অথচ জৈবিক দেহের তাগাদাকে অস্বীকার করবে কি দিয়ে। তাই সামনে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। খােজাকে বিরক্ত করে সন্ধ্যার আড়ালে। খােজার আর কিছু না থাক, পুরুষের মত দেহটা আছে তাে। সেই পুরুষ দেহের আলিঙ্গনেও অনেকটা তৃপ্তি। তারপর আরো কিছু পেতে চায়। যখন পায় না তখন উন্মাদের মত ব্যবহার করে। রক্তের কামড় কখনো কখনো এমন উন্মাদ করে দেয় ওদের যে, নিজেরা নিজেরাই সিরাজীর নেশায় উন্মত্ত হয়ে জড়াজড়ি করে। জড়ানাে কণ্ঠে আদর করে দাবী করে, কামনা জাগায়। কি অদ্ভুত অসঙ্গতি, মানুষের নিজের ব্যবস্থায়।……
……ইতিমধ্যে বালক আব্বাস ফুটে উঠছিলেন যৌবনের পথে। ফুটে উঠছিলেন কি, তাকে জোর করে ফুটিয়ে তুলছিলেন হারেমের রমণীরা। ইন্ধন জোগাচ্ছিলেন স্বয়ং ধাত্রী। বার বছর বয়স না হতেই সিরাজীর নেশাতে তাকে রপ্ত করালেন ধাত্রী সাহেবা। সুরসুরি দিয়ে দেহে যৌবন জাগাবার চেষ্টা করলেন। প্রতি রাত্রিতে একটা যৌবনপুষ্ট পুরুষ দেহের প্রয়ােজন বােধ করতেন তিনি।……
……..আমি খােজা। খােলা তরােয়াল হাতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতুম। তবু ভেতরের কথাবার্তা আমার কানে আসতাে। ধস্তাধস্তির শব্দ শুনতুম। কখনো উন্মত্ত অবস্থায় ধাত্রী সাহেবার হুকুম এলে ভেতরে যেতুম ! দেখতুম, একখণ্ড পূর্ণ যৌবন নগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। নেশাগ্রস্ত বালক শা’ উদগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নারীর অদৃশ্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে। তার চক্ষু লাল। দেহ কম্পমান, বিহবল, দিশেহারা শা’ আব্বাস। ধাত্রী আমাকে দেখে চিৎকার করে বলতেন : এই আফ্রিকার উল্লুক শা-কে শিখিয়ে দে, কি করে পুরুষ হতে হয়। আমি নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকতুম। আমার এই পুরুষত্বহীন খােজা দেহের মধ্যেও আন্দোলন দেখা দিত। হঠাৎ মনে হত, উন্মাদ হয়ে যাই। ঝাপিয়ে পড়ি। কিন্তু আমি কেন। গােলাম—হুকুমের চাকর, বান্দা, খােজা, কর্তব্য ছাড়া আমার জীবনে আর কিছু নেই।
আমাকে নিশ্চুপ দেখে ধাত্রী সাহেবা গালাগাল দিনে, বিদ্রুপ করতেন। উঠে আমাকে লাথি মারতেন। তারপর সেই বিহবল শা’কে নাগিনীর মত জড়িয়ে ধরে শয্যার উপর জড়াজড়ি করতেন।.…..
……আর সন্ধ্যার আগমণের সঙ্গে সঙ্গেই উন্মত্ত ধাত্রীর বাহু নিষ্পেষণে যন্ত্রণা পেতে লাগলেন শাহ আব্বাস।
এর পরিণতি কি, আমি জানতাম। একটা শিশু গাছকে বড় হবার আগেই মুচড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রাণরসের পাত্রকে ফুটো করে দেওয়া হচ্ছে। রােজ রােজ চুইয়ে পড়ছে রস। পাত্র অল্প দিনের মধ্যে নিঃশেষিত হবেই। যত তাড়াতাড়ি হয় শুধু সেই অপেক্ষা।
ইদানিং নাদিরের বেগমেরা নিজেরা বড় বেশী আসতে আরম্ভ করেছেন হারেমে। ক্ষমতা পেলে তাকে ঘিরে স্তাবক জমে। স্তাবকের স্তুতিতে নিজের শক্তি সম্পর্কে লোকের ভ্রান্তি জন্মে। অসীম বিলাসের দিকে নজর যায়। পশুপালক নাদিরের লেগেছিল সেই বিলাসের নেশা। সুন্দরী ইরাণী রমণীদের প্রতি তার দৃষ্টি যাচ্ছিল। ক্ষমতাশালী নাদিরকে সন্তুষ্ট করে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তাকে দলে দলে সুন্দরী উপঢৌকন দিচ্ছিল স্বার্থপর নিচু লােকেরা। কারাে বা উপহার ভাল লাগছিল নাদিরের। গ্রহণ করছিলেন। কারাে বা উপহারকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছিলেন। কিন্তু নাদিরের মন কেড়ে নিয়েছিল সিরাজা। এদেশের একটি সদ্য প্রস্ফুটিতা যুবতী রমণী।……
…… তা, হ্যারে আগা, ঐ যে শা’য়ের পাশে দাড়িয়ে ডবগা মাগিটা, ও কে রে?
আমি বললুম : শাহের দাই।
হেসে সিরাজাই বললেন : দাই। আমি ভাবি বেগম বুঝি। তা দাইটা বুঝি শা’টাকে খুব চটকাচ্ছে ?…..
……..সমস্ত বেগম মহল আমাকে ঘুরিয়ে দেখাও।
আমি জানি, এ নির্দেশের অর্থ কি। ঘুরে ঘুরে সমস্ত বেগমদের নাদির দেখবেন। যদি কারাে এখনাে যৌবন অটুট থাকে, চোখে মদির দৃষ্টি থাকে, বক্ষে উন্নত স্তনযুগল থাকে, যদি তার মুখলাবণ্য শাহের মন আকর্ষণ করে, তবে তাকে তিনি বেগমের মর্যাদা দেবেন, হারেমের বেগম মহলে থাকতে দেবেন। কখনো কোনদিন খেয়াল হলে নিশিথে আসবেন অভিসারে। বুভুক্ষু কোন বেগম হয়তো একদিনের জন্যও একটা পুরুষ দেহের স্পর্শ লাভ করে তার নারী-জীবন সার্থক করবেন। বাকি জীবন সিরাজী পান করে প্রতি সন্ধ্যাতে উন্মাদ হবেন। পুরুষের আকাঙ্ক্ষায় পাগল হয়ে বাদীদের চাবুক কষবেন, হয়তো অক্ষম খােজাদের ধরে পীড়ন করবেন সাহচর্য দেবার জন্য। হায়রে বড় মানুষের জীবন!……..
…….নাদির আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেগম মহল দেখলেন। অধিকাংশ বেগমকেই তাঁর পছন্দ হল না। সঙ্গে সঙ্গে স্বাদীরা তাদের নামিয়ে নিয়ে গেল বাদী মহলে। দু-এক জন যৌবনবতী বেগম ওড়না ফাক করে নাদিরের দিকে তাদের সম্পূর্ণ মুখটা ভাল করে মেলে ধরলেন। কারাে বা চোখে আকৃতি ভরা দৃষ্টি ফুটে উঠল। নৈবেদ্যের মত সমস্ত রূপের ডালি তারা শাহের ভােগের জন্য উৎসর্গ করতে উন্মুখ: শাহ তাদের গ্রহণ করে ধন্য করুন। দু একজন বেগমকে শাহ রাখলেন। রাখলেন শাহ তৃতীয় আব্বাসের বালিকা বধুকে। তার দেহের উপর সবেমাত্র নতুন পাতার মত রং ধরছিল । একটা ধৃত পাখির মত নাদিরকে দেখে কঁপছিলেন তিনি। নাদির তাকে হারেমে থাকবার অনুমতি দিলেন।
কি ভাবলেন নাদির তিনিই জানেন। হয়তাে ভাবলেন, একদিন এ-ফুল ফুটে উঠলে অত্যন্ত মনােরম হবে। পাগল করা গন্ধ ছড়াবে। সেইদিন নিজের ফুলদানিতে নিয়ে তুলবেন একে।
হায় ! শাহী মহলের রমণীরা ফুল ছাড়া আর কি? যখন ফুটে উঠেন, যখন তারা খােসবাই ছড়াতে পারেন, তখন তাদের আদর। শাহের ফুলদানীতে তার আশ্রয় পান। শুকিয়ে গেলে মূল্য নেই, ছুড়ে ফেলে দেন বাইরে, নিচে বাদীদের মহলে। আবার সেখানে যদি কোন ফুল গন্ধ নিয়ে ফুটে উঠে, সে চলে আসে শাহী হারেমে।………..
………রূপের মােহ জগজ্জয়ী বীরও কি অস্বীকার করতে পারেন ? সিরাজাই বেগমের রূপের জালে নাদির আবদ্ধ। সারা রাত কাটালেন তিনি বেগমের মহলে। সেদিন বেগমের সাজসজ্জা দেখেছিলুম আমি। নীল নয়নের পাতায় তিনি একে দিয়েছিলেন কাজল-সুর্মার রেখা। দীর্ঘ বিনুনী পাকিয়ে তাতে গুজে দিয়েছিলেন বসরার গােলাপ। উত্তুঙ্গ বক্ষযুগল কাচুলীতে সুন্দর করে বেঁধেছিলেন। হিন্দুস্থানের মসলিনের ওড়না পরেছিলেন। যেন একটা কাচের পােক, যার মধ্যে দিয়ে সব দেখা যায়। দেখা যায় মােমের মত নরম ত্বক, মসৃণ নিতম্ব প্রদেশ, সুডৌল বাহু, সব।…….
………উনি মহম্মদ শাহের বেগম। তার পাশে দাড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েতো নয়, যেন কোন ভাস্করের পাথর কুঁদে তৈরী করা একটি মূর্তি। নিখুত। ঘন কালো কৃষ্ণবর্ণ কেশ শিশুনীতে আবদ্ধ হয়ে বিলম্বিত বিষধর একটি সাপ মত কোমর ছাড়িয়ে নিতম্ব প্রদেশের বহু নিম্ন পর্যন্ত ঝুলছে যেন হিন্দুস্থানের এই অপরাহুর স্নিগ্ধ রং তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। মসৃণ ত্বক। বিন্দুমাত্র তার কোথাও সামান্যতম চর্মস্ফুটের কলঙ্গও নেই। ঘন কালো দুটি তুলিতে আঁকা ভুরু। সুতীক্ষ্ণ নাসিকা। দাড়িম্বের দানার মত রঙিন ওষ্ঠ। সর্বত্র সামঞ্জস্য রক্ষা করে একটি পরিমিত মুখমণ্ডল। যেন সারি সারি দীর্ঘ ঝাউপাতার মত নেত্রপল্লব! তার মধ্যে হিন্দুস্থানের আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘের মত চোখের দুটি মণি। যৌবনের সমস্ত রসে যেন সে মণিদুটি ভরপুর। না দীর্ঘ, না হ্রস্ব, অত্যন্ত পরিমিত সুন্দর গ্রীবা। উন্নত স্তন যুগল সালোয়ার ঠেলে উর্ধে উকি দিয়ে আছে। সেই স্তনাগ্রে কামিজের উপর দুটো মূল্যবান পাথর জ্বলজ্বল করছে। সুডৌল বাহু ! চম্পক ফুলের কলিব মত অ সুরগুলি। সুন্দর পরস্পর সন্নিবিষ্ট ঘাদ্বয়। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখ ঈষৎ উথিত নিতম্ব দেশ। পদ্মের পাপড়ির মত পায়ের আঙ্গুল । এরকম পরিমিত একটি নারীদেহ আমি পূর্বে কখনো কল্পনা করতে পারনি।……..