গিয়ােভানি বােকাসিও-র ডেকামেরন টেলস এর বাংলা অনুবাদ।
দশম এবং শেষ দিন আরম্ভ হল। কিং প্যানফিলাে এদিনের গল্পের বিষয়বস্তু কি হবে তা বলে দিয়েছে, প্রেমের বা অন্য ব্যাপারে ব্যক্তিবিশেষের ঔদার্য বা দানশীলতার কাহিনী শােনাতে হবে।
শেষ দিন বলেই হয়তাে অন্য দিন অপেক্ষা সকলে একটু দেরি করে শয্যাত্যাগ করলাে। বাইরে এসে সকলে দেখল উঁচু গাছগুলি শীর্ষ কচি সূর্যকিরণে ঝিকমিক করছে। আকাশে দু’চার টুকরাে মেঘ, রাঙা ছাপ আর নেই, শুভ্র হাঁসের মতাে ভেসে বেড়াচ্ছে।
শিশিরভেজা ঘাসে বেড়িয়ে ফুল তুলে মৃদুস্বরে প্রার্থনাগীত গাইতে গাইতে সকলে ফিরে এসে দিনটি পালন করবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল। তারপর যথারীতি প্রাতরাশ দিয়ে দিনের অনুষ্ঠান পর্ব আরম্ভ হল। এদিন প্রথম গল্পটি নেফাইলকে বলতে বলা হল।
প্রথম গল্প
একজন শৌর্যবান নাইট স্পেনের রাজার অধীনে চাকরি নিল। রাজার মনে হল নাইটের প্রতি ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন নন এবং তিনি তা প্রমাণ করে দিলেন। পরে রাজা নাইটকে পুরস্কৃত করলেন।
শেষ দিনের প্রথম গল্পটা কিং আমাকে বলতে বলায় যদিও আমি নিজেকে গর্বিত মনে করছি কিন্তু শংকিত। বিষয়বস্তু নতুন। আমার প্রথম গল্পটা যদি জমাতে না পারি তাহলে কি হবে ভেবে আমি শংকিত আছি। কাল রাত্রে তােমরা সকলে আমার গানের প্রশংসা করেছিলে, আজ হয়ত নিন্দা করবে।
ভাই, গল্প ভালাে না লাগলে নিন্দা কোরাে না তাহলে আমি কেঁদে ফেলব। যাই হােক গল্প যখন বলতেই হবে তখন আরম্ভ করি।
আমাদের ফ্লোরেন্স শহরে অনেক বীর নাইট ছিল যাদের মধ্যে একজনের কথা আমি বলবাে। তার নাম রুজ্জিয়েরি ডি ফিজিওভানি। তার সময়ে তার তুল্য শৌর্যবান নাইট আর দ্বিতীয়টি ছিল না। সে যথেষ্ট ধনবান ছিল, চাকরি না করলেও চলতাে। কিন্তু তার মনে হল দেশে কেউ তার উপযুক্ত মর্যাদা দিচ্ছে না তাই সে ইটালি ত্যাগ করে স্পেন চলে গেল এবং সে-দেশের রাজার অধীনে চাকরি নিল। রাজা অবশ্য তাকে সসম্মানে গ্রহণ করে উপযুক্ত পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। তখন স্পেন শাসন করছিলেন কিং অ্যালফ্রেঞ্জো।
রুজ্জিয়েরির জীবনধারা আচার-আচরণ সবই রাজকীয় ছিল। নিজ বীরত্ব ও শৌর্য প্রকাশ করে সে অচিরে সারা স্পেনে খ্যাতির উচ্চ আসনে নিজের স্থান করে নিল। সকলে স্বীকার করতাে, হা একজন : নাইটের মতাে নাইট বটে।
কিছুদিন ওদেশে থাকার পর রুজ্জিয়েরি লক্ষ্য করলাে যে রাজা তাদের কাজের প্রশংসা করেন, খাতিরও করেন যথেষ্ট, প্রাপ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেন না কিন্তু দানের ব্যাপারে তার প্রতি যেন কৃপণ। রাজা অ্যালফঞ্জো অতি সাধারণ ও অযােগ্য ব্যক্তিদের ক্যাসেল, জমিদারী, ভূসম্পত্তি ও অর্থ দান কবছেন কিন্তু তাকে কিছুই দিচ্ছেন না। সে ভাবলাে রাজা তাকে অবহেলা করছেন না ঠিকই কিন্তু তার চোখে তার গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে। সে তাে একজন ফালতু ব্যক্তি নয় তবে তাকে কেন অন্যান্যদের মতাে পুরস্কার দেওয়া হবে না। সে পুরস্কারের সামগ্রী অথবা অর্থর জন্য লালায়িত নয় কারণ তার যথেষ্ট আছে, সে চায় স্বীকৃতি।
সে ঠিক করলাে রাজার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে স্বদেশে ফিরে যাবে। রাজার কাছে গিয়ে সে তার অভিলাষ জ্ঞাপন করলাে। রাজা তার ইচ্ছা পূরণ করলেন, যে চাকরি করবে না তাকে তিনি কেন আটকে রাখবেন? রুজ্জিয়েরিকে রাজা একটি উৎকৃষ্ট অশ্বতর উপহার দিলেন। এমন মজবুত ও দর্শনীয় অশ্বতর সাধারণত দেখা যায় না। সেটি পেয়ে রুজ্জিয়েরি অসন্তুষ্ট হল না কারণ তাকে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করতে হবে এবং অশ্বতরটি তাকে বহন করতে পারবে।
রুজ্জিয়েরিকে বিদায় দিয়ে রাজা তার এক বিশ্বস্ত ভৃত্যকে ডেকে আদেশ দিলেন যে সে যেন পুরাে প্রথম দিন রুজ্জিয়েরির সঙ্গে যায় কিন্তু রুজ্জিয়েরি যেন তার উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে। তাকে যে রাজা প্রেরণ করেছেন এমন সন্দেহ যেন রুজ্জিয়েরি করবার অবকাশ না পায়। তার কাজ হবে রাজার সম্বন্ধে কজিয়েরি যেসব মন্তব্য করবে সেগুলি সে যেন মুখস্থ করে রাখে এবং সেগুলি ফিরে এসে রাজাকে বলতে হবে। তবে দ্বিতীয় দিন সকালে রুজ্জিয়েরিকে ফিরে আসতে বলবে। যাে হুকুম বলে ভৃত্য বিদায় নিয়ে আস্তাবলে থেকে ঘােড়া নিয়ে রুজ্জিয়েরিকে অনুসরণ করলাে এবং পরে তার পথের সাথী হল। পরিচয় ও উদ্দেশ্য গােপন করে রুজ্জিয়েরির পাশাপাশি চলতে লাগল।
দুজনেই নানা বিষয়ে গল্পগুজব করতে করতে চলেছে। অ্যালফঞ্জো যে অশ্বতরটি উপহার দিয়েছে নাইট তারই পিঠে চড়ে চলেছে। অশ্বতরটি সত্যিই বেশ ভালাে, নাইটের পছন্দ হয়েছে।
চলতে চলতে যখন দুপুর শেষ হয়ে এসেছে, বিকেল হতেও দেরি নেই সেই সময় কতকগুলি গাছ একত্রে দেখতে পেয়ে নাইট বলল, এখানে নেমে গাছের ছায়ায় একটু বিশ্রাম নিই আর আমাদের বাহকরা তাদের প্রাকৃতিক কাজগুলাে সেরে নিক। এছাড়া ওদেরও একটু বিশ্রাম দরকার।
ওদের সঙ্গে একটি করে অতিরিক্ত অশ্ব ছিল। অনেক দূর যেতে হবে তাে তাই এই ব্যবস্থা। দূর দেশে যেতে হলে সঙ্গে সকলে একাধিক বাহক ও মালবাহী জন্তু নিয়ে যায়। সেই স্থানে নাইটের অশ্বতরটি ব্যতীত বাকি জন্তুগুলি মল ও মূত্রত্যাগ করলাে।
ওরা আরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম সুখ উপভােগ করে যে যার বাহনে চেপে যাত্রা শুরু করলাে। রাজার ভৃত্যও নাইটের কথাগুলি মনােযােগ দিয়ে শুনছে, রাজামশাইকে বলার যােগ্য কথাগুলি মনে গেঁথে নিচ্ছে। যেতে যেতে পথের পাশে একটা ছােট নদী দেখা গেল। জীবগুলিকে জলপান করানাে প্রয়ােজন।
জীবগুলিকে ওরা ছেড়ে দিল। সব জীবগুলি নদীতে নেমে জল পান করলাে কিন্তু নাইটের অশ্বতরটি জলে নেমে তার প্রাকৃতিক ক্রিয়া দু’টি সম্পন্ন করলাে। তাই না দেখে নাইট বলল, তুই ব্যাটা দেখছি সেই লােকটির মতাে যে তােকে আমাকে উপহার দিয়েছে। ভৃত্য সঙ্গে সঙ্গে বাক্যটি মুখস্থ করে নিল কারণ মন্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই মন্তব্য দ্বারা রাজা অ্যালফফ্লোকে অশ্বতর বলা হল যা নাকি শালীনতা বর্জিত গালি ব্যতীত কিছু নয়।
পরদিন সকালে ওরা যখন টাসকানি যাবার উদ্দেশ্যে নিজ নিজ বাহনে উঠল তখন ভৃত্য নিজের
পরিচয় জানিয়ে নাইটকে বলল, মহারাজার আদেশ, আপনাকে রাজধানীতে ফিরে যেতে হবে। প্রতিবাদ
করে রুজ্জিয়েরি ভৃত্যর সঙ্গে চললাে।
রাজধানীতে ফিরে নাইট তার আবাসে বিশ্রাম নিতে গেল এবং মহারাজার আদেশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। সে ভাবল মহারাজা এবার তার ভুল বুঝতে পেরে তাকে পুরস্কার দেবেন। ওদিকে ভৃত্য রাজসমীপে গিয়ে নাইটের সমস্ত বক্তব্যই পেশ করেছে এমনকি মহারাজাকে অশ্বতরর সঙ্গে তুলনা করে নাইট যে কথাটি বলেছে সেই কথাটিও।
পরে অ্যালফঞ্জো রুজ্জিয়েরিকে ডেকে পাঠালেন এবং সহাস্যে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, নাইট শুনলুম তুমি আমাকে অশ্বতরের সঙ্গে অথবা অশ্বতরকে আমার সঙ্গে তুলনা করেছ! যা ভালাে বুঝেছ বলেছ কিন্তু আমাকে বা আমার অশ্বরতরটিকে এমন বিশেষণে ভূষিত করার কারণটা জানতে পারি কি?
রুজ্জিয়ের বিব্রত না হয়ে সরল ভাষায় জবাব দিল, মহামহিম আপনাকে আমি এইজন্য অশ্বতরের সঙ্গে তলনা করেছি যে অশ্বতরটি যেখানে যে কাজটি করবার তা করে নি, আপনিও সেই রকম উপাত্ত ব্যক্তিদের অবহেলা করে অন্যস্থানে দান করছেন। এইটেই আমার বলার উদ্দেশ্য।
অ্যালফঞ্জো বললেন, রুজ্জিয়েরি আমি তােমাকে অবহেলা করছি না। তােমার বীরত্ব আমার অজ্ঞাত নয় কিন্তু আমি কাউকে দান করছি না। যাদের ভাগ্যে আছে তারা পাচ্ছে, তােমার ভাগ্যে নেই তাই তুমি পাচ্ছ না। দেবার মালিক আমি নই, তিনি আর একজন, ওপরে বসে আছেন। তােমার ভাগ্য যে এখন সুপ্রসন্ন নয় তা আমি এখনি প্রমাণ করে দিচ্ছি।
রুজ্জিয়েরি বলল, মহারাজ আমি আপনার কাছে থেকে কোনাে সম্পত্তি বা অর্থ পেতে লালায়িত নই কারণ আমার যা আছে তা আমি আর বাড়াতে চাই না কিন্তু আমার ক্ষোভ হল যে আমি আপনার , কাছ থেকে কোনাে স্বীকৃতি পাইনি। তবে আপনি যা বললেন তা আমি মেনে নিচ্ছি এবং আমি এখন দেখতে চাই আমার ভাগ্য আমার অনুকূলে কিনা।
অ্যালফেঞ্জো তখন নাইটকে একটা বড় ঘরে নিয়ে গেলেন। সেই ঘরে আগে থেকেই দু’টি বড় সিন্দুক রাখা ছিল। দুটোই তালাবন্ধ। ঘরে আরও লােক রয়েছে। রাজা নাইটকে বললেন, এই দুটি সিন্দুকের মধ্যে একটিতে প্রচুর রত্নালংকার আছে আর একটিতে আছে শুধু মাটি। আমি তােমার হাতে চাবি দিচ্ছি। তুমি নিজে যে সিন্দুকটি হচ্ছে তার তালা খােলাে। যেটি খুলবে সেটি তােমার প্রাপ্য।
তদনুসারে নাইট একটি সিন্দুক খুলল এবং সেটি মাটিতে পূর্ণ। মাটি নিয়ে নাইট কি করবে, তাই সে নিরাশ হয়ে সিন্দুক বন্ধ করে দিল।
রাজা হেসে বললেন, তাহলে রুজ্জিয়েরি আমি ঠিক বলেছি কিনা। কিন্তু আমি তােমার গুণমুগ্ধ তাই ভাগ্যদেবীর ইচ্ছা অবহেলা করে আমি তােমাকে কিছু দিতে চাই। তুমি আমার রাজ্যে পাকাপাকি ভাবে বাস করলে তােমাকে একটা ক্যাসেল দিতে পারতুলম কিন্তু তা আমি দেব না। অপর সিন্দুকে যা আছে সব তােমার, তুমি এসবই সঙ্গে করে তােমার দেশে নিয়ে যাও। আমি যে বীরত্ব স্বীকার করেছি তা তােমার স্বদেশবাসীরাও জানতে পারবে। আর দেখ আমি তােমাকে বঞ্চনা করবার জন্যে অপর সিন্দুকটিতে মাটি ভর্তি করে রাখি নি।
এরপর রাজা একজন পরিচারককে বললেন, সিন্দুকটা খুলে দিতে। সিন্দুকটির মধ্যে নানারকম স্বর্ণ ও রত্নালংকার ও স্বর্ণমুদ্রা রক্ষিত ছিল।
রুজ্জিয়েরি তখন প্রীত হয়ে মহারাজাকে যথােপযুক্তভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিদায় নিল।
দ্বিতীয় গল্প
গিনাে ডি তাকচো কুনি-র অ্যাবটকে বন্দী করে তার পেটের পীড়া সারিয়ে দিয়ে তাকে মুক্তি দেবে। কুনির অ্যাবট রােম নগরীতে ফিরে পােপ বনিফেসের কাছ থেকে গিনাের মুক্তির ব্যবস্থা করে তাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করতে অনুরােধ করবে। গিনােকে পােপ নাইট হসপিটালারস উপাধি মঞ্জুর করবেন।
নাইটের প্রতি রাজা অ্যালফঞ্জোর বদান্যতার সকলেই প্রশংসা করলাে। সকলে এবং কিং স্বয়ং নেফাইলের গল্পটির প্রশংসা করলেন। এবার গল্প বলার জন্যে কিং এলিসাকে মনােনীত করলেন।
এলিসা রাজাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, রাজা যে তার প্রজা বা কোনাে ব্যক্তিকে কিছু দান করবেন বা সম্মানিত করবেন এতে নতুনত্ব কিছু নেই বরঞ্চ স্বাভাবিক; কিন্তু বর্তমানে অমাদের গির্জার প্রশাসকদের নৈতিক চরিত্রের এতদূর অধঃপতন হয়েছে যে, তাদের কাছ থেকে দান বা সম্মান তাে দূরের কথা সামান্য সৌজন্যও আশা করা যায় না। তথাপি এমন সচ্চরিত্র, নিষ্ঠাবান ও উদার কিছু যাজক আছেন যিনি দান করতে পারেন, পাপীকে ক্ষমা করতে পারেন এবং তার জন্য উচ্চ সম্মানও ভিক্ষা করতে পারেন। আমি এমনি একজন যাজক বা অ্যাবটের কথা বলবাে। তােমরা মন দিয়ে শােনাে।
সান্টা ফিয়ােরের কাউন্টের কোপানলে পড়ার ফলে দুর্দান্ত দস্যু গিননা ডি তাকচোকে সিয়েনা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। গিনাে র্যাডিচোফানিতে এসে শক্তি সঞ্চয় করে রােমের প্রধান গির্জার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোেষণা করে শহরে নিজের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করলাে। শহরের আশপাশ দিয়েও কারও যাবার উপায় ছিল না কারণ গিনাের সহচরদের পাল্লায় তাদের পড়তেই হতাে এবং পথিকদের সর্বস্ব তারা লুট করে নিত, সময় সময় তাদের প্রাণও দিতে হতাে। পথটি মােটেই নিরাপদ ছিল না।
সেই সময়ে রােমের প্রধান যাজক ছিলেন পােপ অষ্টম বনিফেসে। পৃথিবীতে অন্যতম ধনী যাজক বলে পরিচিত কুনি-র অ্যাবট পােপের আতিথ্য গ্রহণ করলেন। ইনি উদরপরায়ণ অর্থাৎ পেটুক ছিলেন, প্রচুর খেতেন এবং পােপও তার রসনা তৃপ্ত করতে কার্পণ্য করেন নি, ফলে বেচারা উদরাময়ে আক্রান্ত হল। বৈদ্যরা বলল এ উদারময় দুরারােগ্য। তবে উনি যদি সিয়েনা কুণ্ডে গিয়ে সেখানে অবগাহন ও সেখানকার জল পান করতে পারেন তাহলে আরােগ্য লাভ করতে পারেন।
কুনির অ্যাবট তখন পােপের অনুমতি নিয়ে সঙ্গে অনেক লােকজন ও পথে যাতে অসুবিধা না হয়। এজন্য যথােপযুক্ত সম্ভার নেওয়া হল। র্যাডিচোফানির কাছে যে কুখ্যাত দস্যু গিনাের পাল্লায় পড়তে হতে পারে এ আশংকা অ্যাবট গ্রাহ্য করলাে না। অনেকগুলি ঘােড়া ও প্রচুর মালপত্তর নিয়ে অ্যাবট যাত্রা করলাে। কে জানে সিয়েনা কুণ্ডে কতদিন থাকতে হবে, সেখানে যাতে কোনাে অসুবিধা না হয়। এজন্যে এই বিরাট আয়ােজন।
এদিকে গিনাের গুপ্তচর খবর এনেছে মস্ত বড় এক শিকার আসছে। গিনাের আড্ডার কাছে একটা গিরিপথ পার হতে হয়। গিনেনা সেইখানে কুনির অ্যাবটকে আক্রমণ করে সকলকে বন্দী করে নিজের ঘাটিতে নিয়ে এলাে।
কুনির অ্যাবটকে বন্দী করে আনবার জন্যে গিনাে তার দক্ষিণহস্তস্বরূপ একজন সহকারী পাঠিয়েছিল। তাকে বলে দেওয়া হয়েছিল অ্যাবটের প্রতি যেন কোনাে দুর্ব্যবহার করা না হয়, এমনকি অ্যাবটের লােকজন কোনাে বাধা না দিলে তাদের প্রতিও যেন নির্দয় ব্যবহার না করা হয়।
গিনাের সহকারী অ্যাবটকে বিনীতভাবে বলল, আপনাকে গিননা তার দুর্গে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে, আপনি আমার সঙ্গে দয়া করে চলুন, আপত্তি করবেন না, বাধাও দেবেন না। আপনাকে ও সকলকে আমরা নিরাপদে নিয়ে যাবাে।
এমন একটা আদেশ শুনে অ্যাবট ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, তােমরা বাধা দিয়াে না, পথ ছেড়ে দাও। গিনাের আতিথ্য গ্রহণ করবার আমার ইচ্ছাও নেই বা তার সঙ্গে আমার কোনাে দরকারও নেই।
একথা শুনে গিননার অনুচর শ্রদ্ধার সঙ্গে তবে একটু গলা চড়িয়ে নিবেদন করলাে, মহাশয় আপনি।
এমন একটা স্থানে পড়েছেন যেখানে আমার ঈশ্বর ব্যতীত আর কাউকে ভয় করি না। এখানে আপনাকে
আমাদের ইচ্ছানুসারে চলতেই হবে, উপায় নেই। অতএব আমাদের অনুরােধ রক্ষা করলে আপনার কোনাে বিপদ ঘটবে না।
অ্যাবট লক্ষ্য করলাে যে, ইতিমধ্যে গিনাের দস্যুরা তার সমস্ত দলটাকে ঘেরাও করে মালপত্রসমেত গিননার দুর্গর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আপত্তি করে লাভ নেই। অ্যাবট গিনাের অনুচরের কথামতাে তাকে অনুসরণ করে চললাে।
অ্যাবটকে একটা প্রাসাদের সামনে ঘােড়া থেকে নামিয়ে ছােট একটা ঘরে তাকে নিয়ে গিয়ে আটক করে রাখা হল। ঘরটি মােটেই আরামপ্রদ নয় অথচ অ্যাবটের লােকজনদের ভালাে ঘরে রাখা হল, তাদের আহারের সুব্যবস্থা করা হল এবং সমস্ত লুণ্ঠিত মালপত্র একটি ঘরে রাখা হল। সেগুলি যাতে কেউ স্পর্শ করে সেজন্যে সেখানে রক্ষী মােতায়েন করা হল।
কিছুক্ষণ পরে গিনাে স্বয়ং অ্যাবটের সঙ্গে দেখা করতে এলাে কিন্তু পরিচয় গােপন করে বলল, গিনাে আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে। আপনি তার মহ্য “ন্য অতিথি। গিননা জানতে চায় আপনি কোথায় যাচ্ছেন এবং যাওয়ার উদ্দেশ্য কি? জানালে গিনাে কৃতজ্ঞ হবে।
অ্যাবট এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে এখানে মাথা গরম করে কোনােই লাভ হবে না বরঞ্চ এদের কথা শুনলে উপকার হতে পারে। সে তার মানসম্মান আপাতত মুলতুবি রেখে পেটের পীড়ার কথা বলল এবং আরও জানাল যে, আরােগ্য লাভের আশায় সিয়েনার কণ্ডে যাচ্ছে। সেখানকার কণ্ডের জলে স্নান করলে ও জল পান করলে রােগ সেরে যাবে এমন আশা তার আছে।
গিনাে সব জেনেশুনে গেল। সে ভাবল দেখা যাক কুণ্ডর জল বিনা অ্যাবটের পেটের পীড়া সারিয়ে দেওয়া যায় কিনা। অ্যাবটের ঘরটি সব সময়ে নজরে রাখার ব্যবস্থা করে গিনাে নির্দেশ দিল ঘরের অগ্নিকুণ্ডে যেন সর্বদা আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়। অ্যাবট তার ঘরে সারাদিন একা রইল। সেদিন তাকে উপবাসে রাখা হল, কোনাে আহার দেওয়া হল না।
পরদিন সকালে গিনাে স্বয়ং ধবধবে সাদা কাপড়ে মুড়ে মাত্র দুই চাকা সঁাকা রুটি নিয়ে আর এক গ্লাস করনিগলিয়া সুরা নিয়ে এলাে। এই সুরা অ্যাবটের ভাণ্ডার থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে।
গিনো তখনও তার পরিচয় প্রকাশ করে নি। সে অ্যাবটকে বলল, মহাশয় গিনাে একদা চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করেছিল। তার মতে সে আপনাকে যে আহার পাঠিয়েছে, পেটের পীড়া ও ব্যথা আরােগ্য করবার এর চেয়ে উৎকৃষ্ট পথ্য তথা ওষুধ আর কিছুই নেই। আপনি হৃষ্টচিত্তে এই আহার গ্রহণ করে দেখুন কয়েকদিনের মধ্যে আপনি সম্পূর্ণ আরােগ্য লাভ করবেন।
এসব শুনে অ্যাবট মনে মনে বিরক্ত হলেও কিছু বলল না কারণ তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছিল। পেটে দাবানল জুলছিল তাই আর কোন কথা না বলে সামান্য হলেও রুটি ও সুরা খেয়ে নিল। খাবার পর কিছু বিরক্তি প্রকাশ করলাে, কয়েকটা প্রশ্নও করলাে এবং জিজ্ঞাসা করলাে গিননা কেন দেখা করছে না? তার সঙ্গে দেখা করা দরকার।
প্রশ্নগুলি অবান্তর তবুও গিননা সেগুলির যথাসম্ভব উত্তর দিয়ে বলল, গিননা অন্যত্র ব্যস্ত আছে, প্রথম সুযােগেই সে নিশ্চয় আপনার সঙ্গে দেখা করবে। এই কথা বলে গিননা বিদায় নিল। গতদিনের মতাে অ্যাবটকে একা উপবাসে থাকতে হল। পরদিন সকালে গিননা সেই দু’চাকা সঁাকা রুটি আর সুর নিয়ে হাজির।
এইভাবে কয়েকদিন চললাে। ইতিমধ্যে গিননা অ্যাবটের অজ্ঞাতে ঘরে বেশ কিছু পরিমাণে শুকনাে বরবটি রেখে গিয়েছিল। গিনাে দেখল অ্যাবট সেগুলি খেয়ে নিয়েছে এবং হজমও হয়েছে। গিনাে তখন জিজ্ঞাসা করলাে, আপনার পেট কেমন? উন্নতি কিছু হয়েছে? কি মনে করছেন ?
অ্যাবট উত্তরে বলল, দেখ বাপু সত্যি কথা বলতে কি গিননার দাওয়াই আমার রােগ সারিয়ে দিয়েছে। আমার এখন খুব খেতে ইচ্ছে করছে। তবে কি জান আমি যে পর্যন্ত না গিনাের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছি সে পর্যন্ত মানসিক শান্তি পাচ্ছি না এবং আমি যে সম্পূর্ণ রােগমুক্ত সেকথাও স্বীকার করবাে না।
গিনাে কিছু না বলে বিদায় নিল। ফিরে গিয়ে যে অ্যাবটের পরিচারকদের সহায়তায় এবং অ্যাবটের নিজস্ব ও প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্তর দিয়ে একটি ঘর সুন্দরভাবে সাজাল। এরপরই সে একটি নিত ভােজসভার আয়ােজন করলাে।
অ্যাবটকে তার এই নতুন ঘরে আনা হল। এখানে এসে সব দেখে এবং কয়েকজন অনুচরের সঙ্গে মিলিত হয়ে অ্যাবট দারুণ খুশি। মনে মনে স্বীকার করলাে, দস্য হলেও গিনাের সবদিকে নজর আছে কিন্তু এমন মানুষ দস্যু হল কি করে? অনুচরদের কাছ থেকে অ্যাবট শুনল যে তাদের বেশ আরামেই রাখা হয়েছিল। তাদের কোনাে অভিযােগ নেই।
সেইদিনই ভােজসভায় অ্যাবট ও তার অনুচরদের উত্তম খাদ্য ও পানীয় পরিবেশন করা হল। তখনও পরিচয় গােপন রেখে গিননা সব তদারকি করলাে। এরপরও কয়েকদিন ধরে অ্যাবট ও তার অনুচরদের উত্তম খাদ্য ও পানীয় পরিবেশন করা হল।
গিনো তার ভৃত্যদের আদেশ দিল অ্যাবটের লুষ্ঠিত সমস্ত সামগ্রী একটি বড় ঘরে সাজিয়ে রাখতে যাতে সবগুলি দেখা যায় আর ঘরের সামনে অ্যাবটের সমস্ত ঘােড়া ও ভারবাহী অশ্বেতর ও গাধাগুলি প্রাঙ্গণে জমায়েত করা হল।
অ্যাবটের সঙ্গে দেখা করে গিননা জিজ্ঞাসা করলাে, এখন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ বােধ করছেন কিনা এবং ভ্রমণ করতে পারবেন কিনা।
অ্যাবট বলল, নিশ্চই। হৃতস্বাস্থ্য ফিরে তাে পেয়েছিই উপরন্তু আরও উন্নতি হয়েছে। বলতে কি এখন তার দেহে ষাঁড়ের তুল্য শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। গিননা তাকে ছেড়ে দিলেই সে অবলীলায় ঘােড়া ছােটাতে পারবে।
যে ঘরে অ্যাবটের সমস্ত সামগ্রী সাজানাে হয়েছিল গিনাে অ্যাবটকে সেই ঘরে নিয়ে গেল এবং প্রাঙ্গণে রক্ষিত ঘােড়া ও ভারবাহী জন্তুগুলি দেখিয়ে বলতে আরম্ভ করলাে :
মহাশয় আমিই গিনাে যাকে আপনি একজন দুষ্ট দস্যু বলে জানেন যদিও আমার সম্রান্ত বংশে জন্ম এবং আমি ইচ্ছে করে দস্যু হই নি। প্রথমত দারিদ্র্য ও পরে সামাজিক পরিবেশ ও অত্যাচার আমাকে দস্য হতে বাধ্য করেছে এবং আমি আজ রােমের শত্রু বলে চিহ্নিত। যেহেতু আমি আপনাকে একজন বিশিষ্ট ও ভদ্ৰব্যক্তি বলে মনে করি এবং যেহেতু আপনাকে আমি রােগমুক্ত করেছি সেহেতু আপনাকে আমি আমার অন্য বন্দীর মতাে মনে করি না এবং সেরকম আচরণও করতে চাই না। এবং আপনার সমস্ত সামগ্রী কেডে নিতেও চাই না। কিন্তু পরের সামগ্রী অপহরণ না করলে আমার দিন চলবে না, তাই আমি আপনার কাছে। প্রস্তাব করছি যে, আপনিই স্থির করুন আপনার এইসব সামগ্রী থেকে আমি কত বেশি বা কত কম রাখতে পারি, পশুগুলি সম্বন্ধেও আপনি একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। আপনার সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেব।
একজন দস্যুর এমন উদার মনােভাবের পরিচয় পেয়ে অ্যাবট আশ্চর্য, অভিভূত এবং আনন্দিত। তার সমস্ত ক্ষোভ দূর হল। অ্যাবট গিনােকে আলিঙ্গন করে বলল এখন থেকে তুমি আমার বন্ধু। আমি তােমার অপরাধ ভুলে যাবাে এবং ভাগ্যদেবীকে ধিক্কার দিচ্ছি এইজন্যে যে, তােমার মতাে হৃদয়বানকে তিনি দস্যু হতে বাধ্য করলেন কেন।
এরপর অ্যাবট শুধুমাত্র ব্যক্তিগত এবং অপরিহার্য সামগ্রী ও নিজের অশ্বটি ব্যতীত সব গিননাকে গ্রহণ করতে বলল, এ সব তােমার বন্ধু। আমি এখন রােগমুক্ত হয়ে এবং শান্ত মনে রােমে ফিরে যাবাে।
রােমে ফেরার পর অ্যাবটের মুখে পােপ তার বন্দী হওয়া, রােগমুক্তি এবং গিনাের বিষয় সবিকছু শুনলেন। অ্যাবটকে কুণ্ডে যেতে হয়নি, গিননা তার রােগ সারিয়ে দিয়েছে শুনে পােপ প্ৰতি হলেন।
এই সুযােগে অ্যাবট পােপকে অনুরােধ করলাে যে তার ইচ্ছা পােপ যেন গিননাকে বিশেষ অনুগ্রহ করেন। গিননাকে যেন পােপ ক্ষমা করেন কারণ গিননা সত্যই একজন দয়াবান ও ক্ষমাশীল ব্যক্তি।
পােপ বললেন, তােমার কথা আমি বিশ্বাস করছি কিন্তু তাকে আমার কাছে আসতে হবে। তদনুসারে গিনাে রােমে এসে মহামান্য পােপের দর্শন লাভ করলাে। পােপ তার আচরণে প্রীত হয়ে অতিথিবৎসল এবং ঈশ্বরের সেবকরূপে “নাইট অফ দি হসপিটালারস” উপাধিতে ভূষিত করলেন।
তৃতীয় গল্প
নাথানের দানশীলতা, উদারতা ইত্যাদির খ্যাতি মিথরিডেনস সহ্য করতে পারে না। নাথানকে হত্যা করবার উদ্দেশ্যে সে নাথানাের প্রাসাদে এলাে কিন্তু তাকে চিনতে পারল না। নিজের পরিচয় গােপন রেখে নাথান মিথরিডেনসকে বলে দিল তাকে কি করে হত্যা করা যাবে। হত্যা করতে গিয়ে মিথরিডেনস নাথানকে চিনতে পেরে হত্যা করতে পারলাে না। লজ্জিত মিথরিডেনস নাথানের বন্ধুত্ব লাভ করলাে।
কুনির অ্যাবটের মতাে নির্লোভ, দানশীল ও উদারহৃদয় যাজকের পরিচয় পেয়ে সকলে তার প্রশংসা করলাে এবং আশা করলাে যে যাজকের মনের পরিবর্তন হবে। কিং এবার ফিলােস্ট্রাটোকে গল্প বলতে বললাে।
ফিলােস্ট্রাটো বলল স্পেনের রাজা ও কুনির অ্যাবটের দানশীলতার কথা তােমরা শুনলে কিন্তু আমি এমন একজনের কথা বলবাে যে তার শত্রুর হিংসা পূরণ করতে নিজের জীবন বিপন্ন করেছিল। তবে সেই শত্রু তার ভুল বুঝতে পেরে একজন পরম মিত্র লাভ করেছিল। তাহলে মূল গল্পটাই আরম্ভ করি :
ক্যাথে অঞ্চলে অভিজাত অত্যন্ত বিত্তশালী অথচ বিনয়ী, করুণাময় ও নিরহংকারী এক ব্যক্তি বাস করতাে, যার নাম ছিল নাথান। এই নাথান বিরাট এক প্রাসাদ তৈরি করালেন, যার অনেক ঘর ও অনেক তােরণ। বিত্ত ও সম্পদ প্রচার করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সেবা করা। যে কোন অতিথি তার বাড়িতে এলে তাকে যেন মর্যাদার সঙ্গে আহ্বান করে সর্বতােভাবে পরিচর্যা করা হয়, তার কোনাে অভাব থাকলে তা সহানুভূতির সঙ্গে শুনে অভাব পূরণের ব্যবস্থা করা হয়। দান যেন এমনভাবে করা না হয় যাতে যে ব্যক্তি ভাবে যে তাকে দয়া দান করা হচ্ছে, যেন ভাবে তার প্রাপ্য তাকে দেওয়া হচ্ছে। নাথান তার পরিচারকদের এমন নিদের্শই দিয়েছিল। সেবাই শ্রেষ্ঠ মানবধর্ম এই ছিল নাথানের নীতি। নাথানের এই প্রকার দানশীলতার কথা দূর দেশে ছড়িয়ে পড়ল। তার বাড়িতে এলে কেউ নিরাশ হয়ে
নাথান এখন বৃদ্ধ হয়েছে এবং বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার উদারতাও যেন বৃদ্ধি পেয়েছে। নাথান চাইত আরও দান আরও মানবসেবা করতে। ঐ অঞ্চলে নিরিডেনস নামে নাথানের তুল্য ধনী এক বাস করতাে। নাথানের এত প্রশংসা শুনতে শুনতে সে বিরক্ত হয়ে নাথানকে হিংসা করতে আরম্ভ করলাে। সে ভাবল তার ও ধনসম্পদ কিছু কম নেই। এখন থেকে সে এমন দান করতে আরম্ভ করবে যে খ্যাতি সে স্নান করে দেবে। তখন যদি প্রশ্ন ওঠে কে বেশি বড় দাতা তখন কেউ আর নাথানের নাম করবে না, মিথরিডেনসের নাম করবে।
নাথানের মতাে মিথরিডেনসও অনেক তােরণ ও ঘরওয়ালা মস্ত বড় একটা বাড়ি তৈরি করালাে। অতিথিদের পরিচর্যার জন্যে অনেক লোেক নিযুক্ত করলাে। অতিথি অভ্যাগতদের প্রতি তার সহানুভূতি থাক আর নাই থাক তাদের বিপুলভাবে আপ্যায়িত করা হতাে। এমনভাবে কেউ অতিথিদের আপ্যায়ন করে না। অচিরে তারও নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল।
মিথরিডেনস একদিন তার বাড়ির চত্বরে বসে আছে সেই সময়ে এক বৃদ্ধা রমণী ভিক্ষা চাইতে একটি ফটক দিয়ে প্রবেশ করলাে। নাথানের মতাে তারও বাড়ির সব ফলক খােলা থাকত এবং যে কোনাে ব্যক্তির প্রবেশ অবাধ ছিল। রমণী মিথরিডেনসের দিকে চেয়ে ভিক্ষা চাইল। লােক মােতায়েন ছিল, রমণীকে ভিক্ষা দিল। রমণী আর একটি ফটক দিয়ে প্রবেশ করলাে, সেখানে তাকে কিছু অর্থ দেওয়া হল। এইভাবে সেই রমণী একের পর এক ফটক দিয়ে প্রবেশ করে ভিক্ষা সংগ্রহ করতে লাগল। এইভাবে সে যখন ত্রয়ােদশ ফটক দিয়ে প্রবেশ করলাে তখন নাথান তাকে অবশ্য ফিরিয়ে দিল না কিঞ্চিৎ রুক্ষস্বরে বলল, বা মেয়ে তুমি তাে বেশ, এক একটা ফটক দিয়ে ঢুকছ আর ভিক্ষা চাইছ? খুব মজা, কেউ তাে তােমাকে ফিরিয়ে দেয় না।
ভিক্ষুক রমণী তখন বলল, আপনার বাড়িতে আমি এই প্রথম ভিক্ষা নিতে এলুম, এরকম ব্যবহার আশাই করিনি। আহা আমাদের নাথান কত উদার ও করুণাময়। তার বাড়িতে এইরকমই ফটক আছে, বত্রিশটা। আমি যখনি যাই তখনি একে একে বত্রিশটি ফটক থেকেই ভিক্ষা করি। নাথানা তাে দুরের কথা তার কোনাে লােকও আমাকে কখনও কোনাে প্রশ্ন করে না, প্রথমবারের মতাে প্রতিবারই আমি ভিক্ষা পাই। আর আপনার বাড়িতে তেরাে নম্বর ফটকেই আমাকে প্রশ্ন করা হল এবং ঘুরিয়ে বলা হল বাকি ফটকগুলিতে ভিক্ষা মিলবে না।
কথাগুলি বলে রমণী পরবর্তী ফটকে না গিয়ে ফিরে গেল কিন্তু তার কথাগুলি মিথরিডেনসের অহমিকায় আঘাত করলাে। সে রেগে গেল এবং চিৎকার করে বলল, এত করেও আমি নাথানের সমতুল্য হতে পারলুম না। এই সামান্য একটা ব্যাপারে সামান্য একটা ভিক্ষুক রমণী যদি আমার প্রতি কটাক্ষ করে যায় তাহলে আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে আমি কি করে নাথানের ঔদার্যের সঙ্গে প্রতিযগিতা করবাে? আমি মূখ। এখন দেখছি লােকটা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ওর সমান হতে পারবাে না, অতিক্রম করা তাে দূরের কথা। লােকটার বয়স তাে অনেক হয়েছে, এখনও মরছে না কেন? এখন দেখছি ওকে এই পৃথিবী থেকেই সরাতে হবে, যথা শীঘ্র সম্ভব এবং কাজটা আমি নিজেই করব।
এইরকম মনস্থ করে মিথরিডেনস তখনি তীরধনু ও তলােয়ার নিয়ে ঘােড়ায় উঠে মাত্র কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে নাথানের প্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করলাে।
মিথরিডেনস সন্ধ্যার মুখে নাথানের প্রাসাদের কাছে পৌছল। সঙ্গীদের বলল তােমরা কেউ আমার বা তােমাদের পরিচয় প্রকাশ করবে না। কাছাকাছি কোথাও আশ্রয় নাও, আমি নাথানের বাড়ি যাচ্ছি।
নাথানের বাড়িতে প্রবেশ করে দেখলাে অতি সাধারণ পােশাক পরে একজন বয়স্ক ব্যক্তি পায়চারি করছে। সেই লােকটিই যে স্বয়ং নাথান তা মিথরিডেনস জানে না কারণ সে কখনও নাথানকে দেখে নি। নাথান একাই ছিল, কাছে কোনাে লােক ছিল না।
মিথরিডেনস ভাবলাে লােকটি বােধহয় নাথানের কোনাে কর্মচারী। তাকে জিজ্ঞাসা করলাে নাথান কি এই প্রসাদে থাকে না অন্য কোনাে বাড়িতে থাকে?
লােকটি বলল, নাথান এই বৃহৎ প্রাসাদের অন্য এক অংশে থাকে, তুমি ইচ্ছা করলে আমি তােমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি তবে এখন তার দেখা নাও পেতে পারাে। মনে হচ্ছে তুমি এখানে সবে আসছ, ক্লান্ত। নাথানের দেখা না পেলেও তােমার কোনাে অসুবিধা হবে না। সযত্নে ও সসম্মানে তােমার থাকার ব্যবস্থা করা হবে।
নাথান মিথরিডেনসকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল এবং তার অজ্ঞাতে তার সমস্ত পরিচারক ও কর্মচারীকে নির্দেশ দেবার ব্যবস্থা করলাে যে তার পরিচয় যেন আগন্তুককে না দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা অবশ্য নাথানের প্রাসাদে প্রচলিত আছে। নাথান নির্দেশ না দিলে কোনাে আগন্তুককে তার পরিচয় বলা হয় না।
একটি উত্তম ঘরে মিথরিডেনসের থাকার ব্যবস্থা হল। তার পরিচর্যার জন্যে তােকও মােতায়েন করা হল। সেই পরিচারক ব্যতীত অন্য কেউ সে ঘরে প্রবেশ করবে না। মিথরিডেনস তার ধরাছড়া খুলে বিশ্রাম নেবার পর তাকে জলযােগ আপ্যায়িত করা হল, ঘােড়াটিকেও আস্তাবলে পাঠান হয়েছে। তাকেও দানাপানি দেওয়া হয়েছে। সকলে নিজ নিজ কাজ নিঃশব্দে করে যাচ্ছে।
মিথরিডেনসের সঙ্গে এমন আন্তরিক ব্যবহার করা হল যে, মিথরিডেনসের মনে হল না সে পরের বাড়ি এসেছে। জলযােগ শেষ হবার পর সেই বৃদ্ধ অর্থাৎ নাথান স্বয়ং মিথরিডেনসের ঘরে এলাে তাকে সঙ্গ দেবার জন্য। তার সঙ্গে নাথান পুত্রবৎ আচরণ করতে লাগল, কথাবার্তাও সেইভাবেই চলতে লাগল অথচ সসম্মানে।
মিথরিডেনস বৃদ্ধের পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে বৃদ্ধ বলল, সে নাথানের সামান্য একজন কর্মচারী মাত্র। বালক বয়সে থেকেই সে নাথানের চাকরি করে আসছে তার পদোন্নতি হয়নি। সকলে নাথানের উচ্চ প্রশংসা করলেও তার মনে ক্ষোভ থেকে গেছে তবে সে তার কর্তব্যে কখনও অবহেলা করে না।
এই লােকটার নাথানের প্রতি ক্ষোভ আছে? মিথরিডেনস ভাবলাে তাহলে সে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে এই লােকটার সহায়তা পেতে পারে? মতলবটা তার মনে ঘােরাফেরা করতে লাগল।
বৃদ্ধ এবার অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এবং কিছু ভূমিকা করে জিজ্ঞাসা করলাে, আপত্তি না থাকলে আমি কি তােমার পরিচয়, কি উদ্দেশ্যে এখানে আগমন এবং নাথানের সঙ্গে কি প্রয়ােজন এসব প্রশ্ন করতে পারি?
মিথরিডেনস প্রথমে শুধু নিজের পরিচয় দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করলাে। লােককে বিশ্বাস করে তার উদ্দেশ্য বলা যেতে পারে। একজনকে হত্যা করতে হলে তার গতিবিধি জানা দরকার। হত্যার উপযুক্ত সময় এবং পালাবার পথ এসব জানতে হবে। তবুও সে বৃদ্ধকে একবার বাজিয়ে নিয়ে বলল, সে নাথানকে প্রচণ্ড হিংসে করে এবং নাথান যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তার খ্যাতি তার পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এজন্যে সে নাথানকে খতম করবার জন্যে এখানে এসেছে। এই কাজের জন্যে সে বৃদ্ধর সহায়তা চায় এবং একটা কথা বৃদ্ধ তাকে সাহায্য না করলেও এসব কথা যেন অতি অবশ্যই গােপন থাকে।
মিথরিডেনসের কুমতলব শুনে বৃদ্ধ নাথান ব্যথিত ও বিচলিত হল তবে মৃত্যুভয়ে ভীত হল না কারণ মনে মনে সে এমনও স্থির করে রেখেছিল যে জীবন দিয়ে যদি কারও উপকার হয় তাহলে সে তাও দেবে।
নাথান আগন্তুকের প্রস্তাব শুনে বিচলিত হলেও তা সে প্রকাশ করলাে না, চোখের একটিও পাতাও পড়ল না। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল, মিথরিডেনস তােমার পরিচয় পেয়ে আমি প্রীতি হলুম। তুমি যে মহান পিতার পথ অনুসরণ করে আরও মহৎ হতে চাইছ তা জেনেও আমি আনন্দিত। তুমি যে দরিদ্রের দুখ মােচন করাে, অভাবীর অভাব দূর করাে এবং জনকল্যাণমূলক অনেক কাজ করাে এসব নিশ্চই ভালাে। জনসাধারণের সেবা করে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার তুল্য আনন্দ আর কিছুতে পাওয়া যায় না। তুমি যে নাথানকে হিংসা করাে এ মােটেই খারাপ নয় কারণ তােমার হিংসাই তােমাকে উদ্বুদ্ধ করবে আরও বেশি এবং আরও বেশি পরিমাণে দান করতে। ফলে তােমার সঙ্গে আরও অনেক ব্যক্তি প্রতিযােগিতা করে আরও দানশীল হবে। তােমার প্রস্তাব আমি অবশ্যই গােপন রাখবাে এবং তুমি কি করে তােমার কাজ হাসিল করবে সে বিষয়ে তােমাকে আমি পরামর্শ দিচ্ছি কারণ নাথানের গতিবিধি আমার চেয়ে ভালাে করে কেউ জানে না। নাথানকে তুমি কোথাও ও কখন নির্জনে অথচ একা পাবে আমি বলি দিচ্ছি ভালাে করে শুনে নাও। এখান থেকে মাত্র আধ মাইল আন্দাজ দূরে পুব দিকে, কাঠের বেড়া ঘেরা একটা জায়গা আছে, নাথান প্রায় প্রত্যহ সকালে একা সেখানে পায়চারী করতে যায়। সঙ্গে কোনাে রক্ষী বা পরিচারক থাকে না। এই ঘেরা জায়গার মধ্যে তুমি নাথানকে যেভাবে ইচ্ছা, তীর বা বল্পমের আঘাতে, তলােয়ারের ঘায়ে বা শ্বাসরােধ করে তাকে হতা করতে পারবে। কেউ দেখতে পাবে না। খুব সহজেই তুমি কাজ সারতে পারবে, হত্যার পর যে পথে এসেছ সে পথে পালাবে না, বাঁ দিকে মানে উত্তর দিকে একটা রাস্তা দেখতে পাবে, সেই পথে তুমি পালাবে কারণ তােমার বাড়ি পৌছাবার পক্ষে ঐ রাস্তাটাই সংক্ষিপ্ত এবং নিরাপদ।
এরপর নাথান মিথরিডেনসের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল। থিরিডেনস জানতেও পারলাে না যে নাথান স্বয়ং তার ঘাতককে নিজের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে গেল। নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে সে একথা কাউকে ঘুণাক্ষরেও বলল না অথচ সে অনায়াসে নিজের রক্ষীদের দ্বারা মিথরিডেনসকে বন্দী এমনকি হত্যা করাতেও পারতাে। আগামীকাল প্রত্যুষেই তার মৃত্যু হবে অতএব দৈনন্দিন কাজকর্মে এক বিরাট পরিবর্তন হবে, এরও কোনাে আভাস নাথান দিল না।
ওদিকে মিথরিডেনস তার সঙ্গীদের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলল।
পরদিন প্রত্যুষে নাথান সেই বেড়াঘেরা জায়গাটির দিকে চললাে তার যমের সঙ্গে দেখা করতে। কোনাে ভাবান্তর নেই, অন্যদিন যেমন যায় আজও তেমনি পা ফেলতে ফেলতে যাচ্ছে।
মিথরিডেনসও ভােরে উঠে সাজগােজ করে সঙ্গে তীরধনু ও কোমরে তলােয়ার ঝুলিয়ে ঘােড়ায় চেপে নাথানকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাে। মনে খুব ফুর্তি। নাথান অবশ্য তার আগে বধ্যভূমিতে পৌছে নির্ভয়ে পায়চারী করছে। আজ শুধু সে মাথায় একটি পাগড়ি বেঁধেছে নয়ত বেশভূষা গতকালের মতাে। যথাস্থানে পৌছে গাছের ফাক দিয়ে দেখল একজন বৃদ্ধ পায়চারি করছে। এ নিশ্চই নাথান।
কাছে গিয়ে বৃদ্ধের মুখ দেখার আগেই সে তার মাথার পাগড়িতে টান দিয়ে গর্জে উঠল, এই দাড়িওয়ালা বুড়াে তাের যম এসে গেছে। নাথান শুধু বলল, ভুলটা দেখছি আমারই, কাকে আর দোষ দেব।
কণ্ঠস্বর শুনে মিথরিডেনস ধোকায় পড়ল তারপর তার দিকে ভালাে করে চেয়ে দেখল। এ সে কাকে দেখছে? এই লােকই তাে কাল তার যত্ন করেছে, কত ভালাে ভালাে কথা বলেছে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করে তার চক্রান্তের কথা কাউকে বলেও নি। বললে আজ আর তাকে ঘাতক হয়ে এখানে আসতে হতাে। , তাকেই নাথান প্রেরিত কোনাে ঘাতক কালই খতম করে দিত। মিথরিডেনস দপ করে নিবে গেল। সে খাপ থেকে তলােয়ার বার করতে যাচ্ছিল, তলােয়ার খাপেই রয়ে গেল। সে তখনি ঘােড়া থেকে নেমে নাথানের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা ভিক্ষা করে বলল, আপনি এত মহান, এত উদার, এত সাহসী, নিজের প্রাণের প্রতিও মায়া নেই। আপনার তুলনায় আমি কীটানুকীট, নরাধম। নিষ্ঠুর এক পাপ কাজ থেকে ভগবান আমাকে বাঁচিয়েছেন, আপনার রক্তে আমার হাত কলংকিত হল না। আপনার মতাে দয়াবান ও মানুষের দরদী বন্ধুকে ভগবানই রক্ষা করেন। এখন আপনি যেভাবে ইচ্ছা আমাকে সাজা দিন।
নাথান তার হাত ধরে তাকে তুলে দাঁড় করিয়ে আলিঙ্গন করে বলল, বৃথা তুমি অনুশশাচনা করছে, তুমি কোনাে পাপ করাে নি। তােমার উদ্দেশ্য তাে প্রশংসার যােগ্য। তুমি চেয়েছিলে মানুষের সেবা করতে সেজন্যে হয়ত আমাকে বাধা মনে করছে, বেশ তত বাধা দূর করে দাও। আমার যা আছে সে সবই লেমাকে দিচ্ছি তুমি মানবদরদী হয়ে মানবের দুঃখকষ্ট লাঘব করা। আমি আর ক’দিনই বা বাচতুম, আমার কোনাে দুঃখও নেই, অভিযােগও নেই।
মিথরিডেনসের কুটিল চক্রান্তকে যে মানুষ এত হালকা করে দিতে পারে সে মানুষ অসাধারণ। সে অনুশােচনায় দগ্ধ হতে লাগল। তার আর কোনাে সম্পদ চাই না কিন্তু যে শিক্ষা নাথান তাকে দিল অর্থের অংকে তার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।
নাথান তাকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাছে কয়েকদিন রাখল। মিথরিডেনস বাড়ি ফেরবার সময় স্বীকার করলাে, যে সম্পদ নিয়ে আমি বাড়ি ফিরছি তার তুলনা যেমন নেই তেমনি আপনারও তুলনা নেই।
চতুর্থ গল্প
প্রেমিকার মৃত্যুর খবর পেয়ে জেনটাইল ডি চারিসেণ্ডি মডেনা থেকে সােজা কবরখানায় এলাে। মৃত মনে করে তাকে কবরখানায় রাখা হয়েছিল। তাকে জেনটাইল বাঁচিয়ে তুলে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিল। প্রেমিকা সন্তান প্রসব করলাে। সন্তানসহ মাকে জেনটাইল প্রেমিকের স্বামী নিচোলুচিয়াের হাতে তুলে দিল।
স্পেনের রাজা বা কুনির অ্যাবট অপেক্ষা নাথান যে অনেক বেশি মহান এ-বিষয়ে শ্রোতাদের কোনাে সন্দেহ রইল না কিন্তু আলােচনা করতে আর সময় না দিয়ে লরেতাকে কিং গল্প আরম্ভ করতে বলল। লরেতা আদেশ পেয়েই হাসিমুখে বলল, তােমরা তাে এতক্ষণ কয়েকটা দানধ্যানের গল্প শুনলে এবার প্রেমের পরাকাষ্ঠার একটি চমৎকার গল্প শােনাে। হাতে পেয়েও প্রেমিকাকে উপভােগ না করে স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার এমন দৃষ্টান্ত বিরল। লরেতা তার গল্প আরম্ভ করলাে :
আমাদের লম্বার্ড প্রদেশের বিখ্যাত শহর বলােনাতে বাস করতাে জেনটাইল ডি চারিসেণ্ডি নামে ধনবান ও ভদ্র এক যুবক। তার নানা গুর ও আচরণ সকলকে মুগ্ধ করতাে। এখন এই যুবক জেনটাইল, শহরের নিচোলুচিয়াে চাচিয়ানিমিচো নামে এক ব্যক্তির পত্নী ক্যাটালিনার প্রেমে পড়ল। জেনটাইল একদিন উপলব্ধি করলাে যে তার প্রেমিকা তার কাছে দুর্লভ, তাকে পাওয়া যাবে না। তখন সে হতাশ হয়ে বিচারকের চাকরি নিয়ে শহর ছেড়ে মডেনায় চলে গেল।
এই সময়ে ক্যাটালিনা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল এবং তার স্বামী নিচোলুচিয়াে শহরে ছিল না। তার জমিদারি তদারক করতে শহরের বাইরে গিয়েছিল কিছুদিনের জন্যে। ক্যাটালিনাও বলােনাতে ছিল না। তাকেও শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে একটি গ্রামের বাড়িতে রাখা হয়েছিল। এই সময়ে ক্যাটালিনা সহসা অজানা এক রােগে আক্রান্ত হল। পল্লবাসী রমণীরা মনে করলাে তার পেটের সন্তানের জন্যেই। এই রােগ হয়েছে। সে অচেতন হয়ে পড়ল। বৈদ্য ডাকা হল, বৈদ্য এসে নাড়ী টিপে বলল মারা গেছে।
তাকে কবর দেবার জন্যে পল্লীবাসীরা তাকে গির্জার কবরখানায় রেখে এলাে। জেনটাইলের এক বন্ধু তাকে এই শােচনীয় সংবাদ শােনাল। খবর পেয়েই জেনটাইল সেই গ্রামে এসে উপস্থিত। সে শােকে অভিভূত।
ক্যাটালিনাকে সে দূর থেকেই ভালবাসত। সঙ্গে একজন সঙ্গী নিয়ে অশ্বারােহণে আসতে আসতে সে মনে মনে বলতে লাগল, প্রেয়সী তােমাকে স্পর্শ করবার সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু আজ আর কোনাে বাধা নেই, তােমাকে আমি একবার স্পর্শ করবাে ও চুম্বন করবাে।
গােপনে সে সেই গ্রামে যখন উপস্থিত হল তখন রাত্রি বেশ গভীর হয়েছে। সঙ্গীকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে জেনটাইল গির্জার সেই কবরখানায় উপস্থিত হল। মৃত প্রেমিকাকে দেখে জেনটাইল শােকে ভেঙে পড়ল এবং প্রথম ও শেষবারের মতাে তার ওষ্ঠ চুম্বন করলাে। চুম্বন করে তার ইচ্ছা হল তার প্রেমিকার বুকে একবার হাত রাখে। বুকে হাত রেখে তার কেমন সন্দেহ হল। হাত আরও একটু চেপে ধরলাে। তারপর বুকে কান পেতে কিছুক্ষণ শুনল। ক্যাটালিনা তাে এখনও বেঁচে আছে।
জেনটাইল তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গীর সহায়তায় ক্যাটালিনাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার মাকে সবই খুলে বলল। স্নেহশীলা ও দয়াবতী মা তখনি ক্যাটালিনার ভার নিলেন। হাতে পায়ে সেঁকতাপ দিয়ে ও অন্যভাবে পরিচর্যা করে তিনি ক্যাটালিনাকে বাঁচিয়ে তুললেন। আসলে তার মৃত্যু হয়নি। বৈদ্যমশাই ভুল করেছিল।
জ্ঞান হবার পর সামনে অপরিচিতা মমতাময়ী মহিলাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলাে, আমি কোথায়?
জেনাটাইলের মা বললেন, তুমি নিরাপদ আশ্রয়ে আছ, ভয় পেয়াে না। তুমি এখনও সুস্থ হও নি। নিশ্চিন্তে শুয়ে থাক। যখন সে সুস্থ হল তখন আবিষ্কার করলাে এ বাড়ি তার চেনা নয় কিন্তু এখানে জেনটাইল এলাে কি করে?
ক্যাটালিনা তখন জেনটাইলের মাকে প্রশ্ন করলাে। যা ঘটেছিল সবই মা তাকে বললেন। সব শুনে ক্যাটালিনা কাদাতে লাগল। তারপর জেনটাইল ও তার মাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল বাৰি। কেটে গেল কাল সকালেই যেন তাকে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
তার অভিপ্রায় শুনে জেনটাইল বলল, ভয় পেয়াে না ক্যাটালিনা। যদিও আমি সুযােগ পেয়েছি কিন্তু আমি তােমাকে এখন স্পর্শ করবাে না। স্বাভাবিক অবস্থায় পেলে কি করতুম বলতে পারি না। তবে আমি বিশ্বাস করি তােমার প্রতি আমার নিঃস্বার্থ ও গভীর প্রেমই তােমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি এবং আমার মা তােমার জীবন ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছি। এজন্যে অবশ্য তুমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছ, তবুও আমি তােমার কাছে যদি কিছু চাই তাহলে আশা করি তুমি আমাকে তা দিতে দ্বিধা করবে না।
ক্যাটালিনা কিন্তু দ্বিধায় পড়ল, জেনটাইল যদি তাকেই চায়? তবুও সে বলল, অবশ্যই আমার সাধ্যের মধ্যে হলে এবং আমার শুদ্ধতা অক্ষুন্ন থাকলে আমার অদেয় কিছু নেই। তােমাদের জন্যেই আমি জীবন ফিরে পেয়েছি।
তাহলে শােনাে, তােমার আত্মীয়স্বজন, তােমার স্বামী এবং বলােনার সকলে জানে যে, তুমি মৃত এবং কেউ আশা করে না যে তুমি আবার তােমার বাড়িতে ফিরে যাবে। সেইজন্যে আমি প্রস্তাব করি যে তুমি আমার মায়ের কাছে থাক। আমি আমার কাজে যােগ দিতে মডেনা চলে যাব অতএব তােমার আপত্তি থাকতে পারে না। আমার একান্ত ইচ্ছা যে যথাসময়ে আমি তােমাকে ও তােমার সন্তানকে উপহারস্বরূপ তােমার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেব। সেদিন আমি ভােজসভার আয়ােজন করবাে। তােমার স্বামী ও শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করবাে।
ক্যাটালিনা বুঝল জেনটাইল অন্যায় কোনাে প্রস্তাব করে নি এবং সে পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ তাই। সে আপত্তি করলাে না তাছাড়া তার প্রসবের সময়ও আসন্ন। জেনটাইলে মা সেবা ও যত্নর ক্রটি করছেন না। এমন যত্ন সে তার স্বামীর বাড়িতে আশা করে না। তথাপি জেনটাইল তার মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্যাটালিনার জন্যে সুবন্দোবস্ত করে গােপনে মডেনায় ফিরে গেল।
ক্যাটালিনা যথাসময়ে সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলাে। জেনটাইলের মায়ের সেবা ও যত্নে মাতা ও শিশু আনন্দে দিন কাটাতে লাগল। মডােনাতে জেনটাইলের কাছেও নিয়মিত খবর যেতে লাগল।
জেনটাইলের চাকরির মেয়াদ শেষ হল। সে বলােনায় ফিরে এলাে এবং একদিন সকালে ভােজসভার আয়ােজন করলাে। শহরের বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানাল, তাদের মধ্যে ক্যাটালিনার স্বামী চিনােলুচিয়া অবশ্যই ছিল।
অতিথিরা একে একে এলাে। জেনটাইল তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল। ভােজসভার উপলক্ষ কি আমন্ত্রিতরা তখনও জানে না। একেই তাে জেনটাইলের ভদ্র আচরণ ও সৌজন্যের খ্যাতি ছিল এবং আজ সে যেভাবে আমন্ত্রিতদের সসম্মানে অভ্যর্থনা জানাল তাতে সকলে তার সাধুবাদ করলাে। ক্যাটালিনা ভােজের টেবিলে ছিল না। সে বাড়ির ভেতরে শিশুকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। জেনটাইল তাকে যথাসময়ে তার স্বামী ও অতিথিদের সমক্ষে উপস্থিত করবে।
অতিথিরা সংখ্যা বেশি ছিল না কিন্তু জেনটাইল সুখাদ্য ও সেরা পানীয় পরিবেশ করেছিল। সকলে তৃপ্ত। ভােজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেনটাইল উঠে দাড়িয়ে বলল, ক্ষমা করবেন। আপনাদের আজ কেন আমার কুটিরে আমন্ত্রণ জানিয়েছি তা আপনারা এখনও জানেন না। যথাসময়েই তা জানতে পারবেন, তবে আপনাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।
জেনটাইল সুকণ্ঠের অধিকারী, বলবার ভঙ্গিটিও আকর্ষণীয় তাই সকলে ওর কথা মন দিয়ে শুনছিল। সে বলল, আমি শুনেছি যে পারস্যে চমৎকার একটি প্রথা আছে। যদি কোনাে ব্যক্তি তার বন্ধুকে সম্মান জানাতে চায় তাহলে সে সেই বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে ভেজে আপ্যায়িত করে। তারপর যে ব্যক্তি বা বস্তু তার সবচেয়ে প্রিয় সেটি বন্ধুর সামনে উপস্থিত করে। বিপরীতও হতে পারে।
বন্ধুর যেটি খুব প্রিয় এমন কিছু সে’ বন্ধুকে উপহারও দিতে পারে। আমার কাছে এমনই মূল্যবান কিছু গচ্ছিত আছে যেটি যার সর্বাপেক্ষা প্রিয় তাকে আমি এমন উপহার দেব।
একটু থেমে জেনটাইল আবার বললাে, তবে তার আগে আমার একটা সমস্যার কথা আপনাদের বলে নিই এবং এ ব্যাপারে আপনাদের মতামত জানতে পারলে আমি আনন্দিত হবে। কোনাে এক ব্যক্তির গৃহে তার একজন অতি অনুগত পরিচারক ছিল। পরিচারক সহসা কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হল। তার মনিব তাকে একবারও দেখল না, শুনল পরিচারক বাঁচবে না কিন্তু তার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই তাকে রাস্তায় নিক্ষেপ করলাে। একজন দয়ালু পথচারী মরণােন্মুখ পরিচারককে নিজ গৃহে নিয়ে গিয়ে সেবা ও যত্ন দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলল। আমি আপনাদের কাছে জানতে চাই যে, সেই মনিব এসে যদি তার পরিচারককে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় তাহলে সেই দয়ালু পথচারী কি তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য?
অতিথির। আলােচনা করে সর্বসম্মত এক সিদ্ধান্তে উপনীত হল। কিন্তু তাদের মধ্যে নিচোলুচিয়াে ভালাে বক্তা বলে তাদের হয়ে উত্তর দেবার ভার নিচোলুচিয়ােকে দেওয়া হল।
নিচোলচিয়াে সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং পারস্য দেশের রীতিটির প্রশংসা করে বলল, আমরা সকলে একমত যে সেই দয়ালু পথচারী সেই পরিচারককে তার মনিবের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য নয়। ইচ্ছা করলে সে পরিচারককে নিজের কাছে রাখতে পারে। কারণ পরিচারকের মনিব তার কর্তব্য করেনি পরন্তু সেই পথচারী নিঃস্বার্থভাবে সেবা করে মৃতপ্রায় লােকটিকে বাঁচিয়ে তুলে তার হৃতস্বাস্থ্য ফিরিয়ে তাকে আবার কর্মক্ষম করে তুলেছে।
নিচোলুচিয়াের বক্তৃতা শেষ হতে সমবেত সকলে তার মত সমর্থন করে বলল, দায়দায়িত্ব যখন তার মনিব গ্রহণ করে নি তখন তার ওপর মনিবের আর অধিকার থাকতে পারে না। সেই দয়ালু। পথচারীই তাকে রাখতে পারে তবে যদি পরিচারক তার মনিবের কাছে ফিরে যেতে চায় সে কথা আলাদা।
জেনটাইল দেখল সে যা করতে চাইছে তাতে নিচোলুচিয়াের সমর্থন রয়েছে। তখন সে সমবেত সকলকে সম্বোধন করে বলল, আমার সমস্যার সমাধান হয়েছে। এবার আমি বলি আপনাদের আজ সহসা কেন আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আমি আমার সেই বন্ধুটিকে দুটি রত্ন উপহার দিয়ে পারসিক প্রথানুসারে সম্মানিত করবাে।
সকলে মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল কে সেই বিশেষ বন্ধু আর সে কী রত্নই উপহার দেবে?
জেনটাইল তখন দু’জন পরিচারিকাকে বাড়ির ভেতর পাঠিয়ে দিল। ক্যাটালিনা সাজগােজ করে শিশুটিকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। পরিচারিকা দু’জন ক্যাটালিনাকে ভদ্রমণ্ডলীর সামনে এনে দাড় করিয়ে দিল। জেনটাইল বলল, মহােদয়গণ এই হল সেই দুটি রত্ন, মা ও তার সন্তান। এদের আমি এক বছর ধরে সযত্নে লালন করেছি অবশ্য আমার মা প্রধান সহায় ছিলেন। | নিচোলুচিয়াে এবং সমবেত সকলে যে ক্যাটালিনাকে চিনত তারা জানে সে তত আকস্মিক ভাবে মারা গেছে? এ কি সেই মেয়ে? সকলে এবং বিশেষ করে নিচোলুচিয়াে তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। অবশেষে নিচোলুচিয়াে আর কৌতূহল দমন করতে পারল না। জেনটাইলকে জিজ্ঞাসা করলাে, এই মহিলা কি বলােনা- বাসিনী নাকি বিদেশিনী?
একজন তাে ক্যাটালিনাকেই প্রশ্ন করলাে, তুমি কি জেনটাইলের পত্নী? কিন্তু ক্যাটালিনা কোনাে উত্তরই দিল না। আর একজন জিজ্ঞাসা করলাে, শিশুটি কি তােমার? ক্যাটালিনা তবুও নির্বাক। তখন সকলে ভাবল মহিলা বােধহয় মূক। আহা এমন সুন্দরী মেয়েটি কথা বলতে পারে না!
জেনাটাইল তাদের মনােভাব বুঝতে পেরে বলল, মহিলা মূক তবে সে শুদ্ধ ও পবিত্র। তাই কোনাে প্রশ্নের উত্তর দেয় নি।
এবার সকলে জেনটাইলকে বলল, তাহলে তুমি মহিলার সঠিক পরিচয় দাও।।
নিশ্চয় দেব। সেইজন্যেই তাে আপনাদের আমি সমবেত করেছি কিন্তু আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনারা আসন ত্যাগ করবেন না।
ক্যাটালিনাকে বসিয়ে সে নিজেও বসে বলতে লাগল। এই মহিলাই হল সেই পরিচারক যার কথা আমি একটু আগে আপনাদের বলেছি। মহিলা তখন সবে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে অচেতন হয়ে যায়। সকলে এবং বৈদ্য ভাবলাে এ মারা গেছে। আর অপেক্ষা না করে, তার কোনাে পরিচর্যা না করে প্রতিবেশীরা ও তার আত্মীয়রা তাকে যথা শীঘ্র সম্ভব গির্জার কবরখানায় রেখে এলাে। আমি মহিলাকে কবরখানা থেকে উদ্ধার করে ওকে আমার মায়ের জিম্মা করে দিয়ে আমার কর্মস্থল মডেনায় চলে যাই। আমার মা ওর যথােপযুক্ত পরিচর্যা করে ওকে বাঁচিয়ে তােলে। আমার মায়ের যত্ন ও ঈশ্বরের অনুগ্রহে মহিলা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে বাঁচিয়ে তােলে। আমার মায়ের যত্ন ও ঈশ্বরের অনুগ্রহে মহিলা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে এবং যথাসময়ে স্বাস্থ্যবান শিশুটির জন্ম দেয়। পরে এর স্বামী তার জমিদারি থেকে ফিরে এসেও স্ত্রীর আর কোনাে খোঁজ নেয় নি বা কবরখানাতেও যায় নি। আমি আপনাদের এবং বিশেষ করে নিচোলুচিয়ােকে প্রশ্ন করেছি যে, সন্তানসহ এই মহিলাকে কি আমি আমার বলে দাবি করতে পারি না? উল্লেখ করি যে, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মহিলা যতদিন আমার বাড়িতে ছিল ততদিন আমি এই শহরে ছিলুম না।
ইতিমধ্যে ক্যাটালিনার চোখে জল এসে গেছে এবং নিচোলুচিয়েও তার পত্নীকে চিনতে পেরে অনুশােচনায় দগ্ধ হচ্ছে।
এখন জেনটাইল শিশুটিকে কোলে নিয়ে এবং ক্যাটালিনাকে সঙ্গে নিয়ে নিচোলুচিয়াের সামনে গিয়ে বলল, বন্ধু ওঠো, আর সংশয় নেই। তােমার সতী পত্নী ও পুত্রকে আমার উপহারস্বরূপ গ্রহণ করে আমাকে ভারমুক্ত করাে। তােমার পত্নীকে কোনাে রকম সন্দেহ করাে না কারণ তুমি জান যে তুমিই এই সন্তানের পিতা এবং তােমার পত্নীকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবে তার চিত্তচাঞ্চল্য ঘটবার কোনাে অবকাশ দিই নি। আমি ওকে আমার ভগিনী মনে করেই আমার বাড়িতে এনেছিলুম এবং সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত আমার কর্মস্থল থেকে বােনায় ফিরেও আসি নি। সে তােমার পরিবারে যেভাবে থাকত আমার মায়ের কাছে সে ঠিক সেইভাবেই কন্যার মতােই ছিল। ক্যাটালিনা এখন তুমি তােমার সন্তানকে নিয়ে তােমার স্বামীর সঙ্গে তার ঘরে ফিরে যাও এবং উভয়ে সুখী হও।
স্বামী স্ত্রীর পুনর্মিলনে সকলে অভিভূত হয়ে জেনটাইল ও তার মায়ের প্রশংসা করতে লাগল। নিচোলুচিয়ে তার পত্নী ও পুত্রকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। নিচোলুচিয়াে এবং জেনটাইল পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হল
পঞ্চম গল্প
আনসালডােকে ভয়াননারা বলল জানুয়ারি মাসের শীতে উষ্ণ মে মাসের তুল্য ফুলফলের একটি উদ্যান করে দিতে। এক জাদুকরের সহায়তায় আনসালডাে ডায়ানােরার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করলাে। ডায়ানােরার স্বামী তখন তাকে অনুমতি দিল আনসালডাের প্রেমাকাঙক্ষা পূরণ করতে। স্বামীর এমন উদারতা শুনে আনসালডাে ডায়ানােরার সঙ্গসুখ উপভােগ করা থেকে নিজেকে সংযত করলাে এবং সেই জাদুকরও তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করলাে না।
সকলে জেনটাইলের চরিত্রের গুণগান করতে লাগল। সুন্দরী যুবতীকে কাছে পেয়েও কোনাে যুবক যে সুযােগ গ্রহণ করে না এমন দৃষ্টান্ত বিরল। কিং আর আলােচনার সুযােগ না দিয়ে এমিলিয়াকে গল্প বলতে আহ্বান করলাে।
এমিলিয়া বলল জেনটাইলের চরিত্র নিশ্চই প্রশংসার যােগ্য কিন্তু এমনও দেখা যায় কোনাে প্রার্থিত নারী উপচিকা হয়ে পুরুষের কাছে এসেছে কিন্তু সে পুরুষও উদারতার পরিচয় দিয়ে সেই নারীকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি এমনই একটি কাহিনী তােমাদের শােনাব। জেনটাইলের তুল্য পুরুষও আছে :
পাহাড়, ঝর্না, স্রোতােস্বিনী ও ফুলে ফুলে ফুলময় লতা গুল্ম ও বৃক্ষরাজিতে শােভিত ফ্রিউলির তুল্য প্রদেশ বেশি নেই। শীতে যেমন তুষারে ভরে যায় আবার গ্রীষ্মে উপত্যকাগুলি ফুলের বন্যায় রঙিন হয়ে ওঠে।
এই উপত্যকায় উডিন নামে একটি ছােট শহর আছে। শহর তাে নয়, যেন একটি ছবি। এই শহরে বাস করতাে সুন্দরী ডায়ানােরা। গিলবারটো নাম ধনী, উদার হৃদয় ও ফুর্তিবাজ এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ও স্ত্রীতে মনের মিল ও প্রেম অত্যন্ত গভীর।
ঐ শহরে আনসালডাে গ্রিডেন্স নামে বিরাট ধনী, সুদর্শন, অশ্ব ও অসিচালনায় দক্ষ আর এক যুবক বাস করতাে। সেই যুবক আনসালডাে ডায়ানােরর প্রেমে পড়ে গেল। সুযােগ পেলেই সে নিজে বা দূতী মারফত ডায়ানােরার কাছে প্রেম নিবেদন করতাে, প্রেমপত্র ও উপহার পাঠাত। ডায়ানােরা সাড়া তাে দিতই না, প্রেমপত্রও উপহারগুলি সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখান করতাে তথাপি আনসালডােকে নিরস্ত করা যেত না। ডায়ানােরাও তার হাত থেকে নিস্তার পাবার কোনাে পথ খুঁজে পাচ্ছিল না।। আনসালডাে বাড়াবাড়ি আরম্ভ করলাে। এর হাত থেকে নিস্তার পেতেই হবে কিন্তু কি করে? ডায়ানােরা একটি পথ বার করলাে। আনসালডাের কাছে সে একটা অসম্ভব প্রস্তাব পাঠাবে।
পরদিন আনসালডোের দূতী যথারীতি একখানি প্রেমপত্র ও উপহার নিয়ে ডায়ানােরার কাছে হাজির। অন্যদিন দূতীকে ডায়ানােরা বসতে বলে না। কিন্তু আজ তাকে বসাল এবং বলল আনসালডাে যে আমার প্রেমে পড়েছে তা আমি জানি। সে আমাকে প্রেমপত্র ও উপহার পাঠায় এবং সেগুলি যে তােমার হাত দিয়েই আবার ফেরত পাঠাই তাও তুমি জান কারণ এসব দিয়ে নারীর হৃদয় জয় করা যায় না আর আমি আমার হৃদয় আমার স্বামীকে দিয়ে বসে আছি। তবুও দেখছি আনসালডাে আমাকে ভুলতে পারছে না তাই আমি ঠিক করেছি ওকে আমি একটা এবং একবার মাত্র সুযােগ দেব। আমি যা চাইব তা যদি সে পূরণ করতে পারে তাহলে আমিও একদিনের জন্যে ওর কাছে আত্মসমর্পণ করবাে।
কৌতূহলী হয়ে দূতী শর্ত জানতে চায়। বলে তাকে কি করতে হবে? সে খুব সাহসী এবং তােমাকে এত ভালবাসে যে তােমার জন্যে সে সিংহর সঙ্গেও লড়াই করতে পারে।
তা নয়, সিংহের নখের ও দাঁতের আঘাতে সে ক্ষতবিক্ষত হােক তো আমি চাই না। কারণ আঘাতে তার মুখ যদি বিকৃত হয়ে যায় তাহলে কোনাে যুবতী তাকে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেবে। যাই হােক শােনাে, শীত আরম্ভ হয়েছে। আর কয়েকদিন পরেই জানুয়ারি মাস, শীত জাঁকিয়ে পড়বে, তুষারপাত আরম্ভ হবে। পাহাড় উপত্যকা সাদা হয়ে যাবে, ঝর্না ও নদী জমে যাবে। আমি চাই এই তুষারাজ্যের মধ্যে আনসালডাে এই উপত্যকায় আমায় সুন্দর একটি ফুলের বাগান করে। দিক। সে বাগানে গাছে গাছে ফুল ফুটে থাকবে, পাকা ফল ডাল থেকে ঝুলবে, পাখি গান গাইবে, প্রজাপতি রঙিন পাখা মেলে উড়বে। আনসালডাে যদি আমার এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে তাহলে আমি তার কাছে অন্তত একদিনের জন্যও আত্মসমর্পণ করবে। এই প্রস্তাব মনে করে আনসালডাে যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখান করে তাহলে সে যেন আমাকে আর বিরক্ত না করে। যদি বিরক্ত করে তাহলে আমি আমার প্রতি এই প্রেম নিবেদন আর গােপন রাখব না, সকলের নিকট প্রকাশ করে দেব।
এই প্রস্তাব অসম্ভব জেনে দূতী ক্ষুন্ন মনে বিদায় নিল। প্রস্তাব শুনে আনসালডাে কিন্তু দমে যাবার পাত্র নয়। আকাশের চাদ পেড়ে দিতে বললেও সে বােধহয় চেষ্টা করতাে। কিন্তু এই শীতে তুষাররাজ্যে যখন সব গাছ নিষ্পত্র, টবের গাছেও ফুল ফোটান যায় না তখন কি করে একটা বাগান সৃষ্টি করা যাবে?
আনসালডাে হতােদ্যম না হয়ে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন কোনাে লােকের খোঁজ করতে লাগল যে এই অসম্ভব সম্ভব করতে পারবে, এজন্যে সে অর্থব্যয় করতে দ্বিধা করবে না। ডায়ানােরার সঙ্গ লাভের জন্যে অর্থ তার কাছে কিছুই নয়।
অবশেষে একজন জাদুকরের সন্ধান পাওয়া গেল, যে বলল সে এমন উদ্যান যথাসময়ে সাজিয়ে দেবে, নকল নয় আসল। বিনিময়ে সে প্রচুর অর্থ দাবি করলাে।
শীতের হাওয়া যখন গায়ে তীরের ফলার মতাে বিধতে আরম্ভ করলাে, পাহাড়গুলাে তুষারের সাদা চাদর মুড়ি দিল, গাছগুলাের ডালে ডালে স্ফটিকের মতাে জমা হল বরফ, তখন উডিন শহরের পাশেই একটি উপত্যকার সমান জমিতে জাদুকর আনসালডােকে নিয়ে গেল। সেখানে পোঁছে আনসালডাে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারল না। এ কি আশ্চর্য ব্যাপার। সত্যিই এক রমণীয় উদ্যান। সবুজ গাছে পাকা ফল ঝুলছে, ফুলে ফুলে চারদিকে রঙে রঙিন, কোকিল ডাকছে, ডালে লেজ ঝুলিয়ে রঙিন পাখি বসে আছে, প্রজাপতি উড়ছে, কাঠবেড়ালি আর খরগােশ | খেলা করছে। অবাক কাণ্ড। নিজের চোখে না দেখলে আনসালডাে বিশ্বাস করতেই পারত না।
আসল না নকল যাচাই করবার জন্যে আনসালডাে দুটো গাছ, দু’রকমের দুটো পাকা রসাল ফল আর কিছু মরশুমী ফুল তুলে সেগুলি গােপনে ডায়ানােরার কাছে পাঠিয়ে দিল। ডায়ানােরা দেখেই চিনল ফল ও ফুল দুই অসময়ের। মাথা খুঁড়লেও এই ফল আর ফুল বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। আগের দিন সে একটা গুজবও শুনেছিল জিন পরীরা একটা বাগান নাকি রাতারাতি বসিয়ে দিয়ে গেছে তাদের শহরের পাশে। ডায়ানােরা ভাবছিল তবে কি আনসালডাে অসাধ্য সাধন করেছে? সত্যিই কি সে তার জন্যে ফুলের বাগান সাজিয়েছে?
আনসালডাে ফল ও ফুলের সঙ্গে ডায়ানােরাকে বাগান দেখাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। নিজের চোখে দেখে যাও এবং হৃদয়ে উপলব্ধি করাে তােমাকে আমি কত ভালবাসি। মনে করিয়ে দিয়েছিল তার শপথের কথা, শীতে মরশুমি ফুল ফোটালে সে তার কণ্ঠলগ্না হবে। হাতে ফল, ফুল ও চিঠি পেয়েই তাে ডায়ানােরা ভয় পেয়ে গেল। অনুতাপ করতে লাগল। সে যদি সত্যিই এমন একটা বাগান এখন দেখতে পায় তাহলে কি হবে? কথা তাে রাখতেই হবে কিন্তু সে মরে গেলেও কি এমন সর্বনাশা কথা রাখতে পারবে।
সেদিন বিকেলেই ডায়ানােরা তার কয়েকজন বান্ধবী নিয়ে সেই আশ্চর্য উদ্যান দেখে চক্ষু ও কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে এলাে। ঘরে ফিরে তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল এমনকি কথা বলতেও যেন ভুলে গেল। বলতে গেলে আহার নিদ্রাও ত্যাগ করলাে।
ডায়ানােরার হঠাৎ এই ভাবান্তর তার স্বামী গিলবারটো লক্ষ্য করলাে। তােমার কি হয়েছে ডায়ানােরা? হাসছাে না, কথা বলছাে না খাচ্ছ না, ঘুমােচ্ছ না, কি হয়েছে? ডায়ানােরা কি জবাব দেবে? জবাব দেবার তাে কিছু নেই। প্রথমে অনরােধ তারপর ভীতি প্রদর্শন। তখন ডায়ানােরা স্বামীকে সব কিছু খুলে বলল।
গিলবারটো তাে প্রথমে ভীষণ রেগে গেল কিন্তু পরে স্থির হয়ে সমস্ত ব্যাপারটা চিন্তা করলাে। তারপর স্ত্রীকে বলল, ডায়ানােরা আমি তােমার কোনাে দোষ দেখছি না। তুমি পতিব্রতা এবং আমাকে গভীরভাবে ভালবাস তাও জানি আর সেইজন্যে লােকটাকে এড়াতে মানুষের অসাধ্য একটা ফরমাস করেছিলে। তুমি ভাবতেও পারাে নি যে, লােকটা অসাধ্য সাধন করবে তুবুও আমি বলবাে তােমাকে ওর কাছে যেতেই হবে। না গেলে লােকটা তােমার ও আমার উভয়ের আরও ক্ষতি করতে পারে। তােমাকে হয়ত কুরূপা করে দিল, আমাকে হয়ত খঞ্জ করে দিল। তুমি যাও, তুমি তাে তাকে তােমার হৃদয় দিচ্ছ না শুধু দেহটাকে দিচ্ছ। আমি স্বামী হয়ে অনুমতি দিচ্ছি।
স্বামীর কথা শুনে ডায়ানােরা কেঁদে ফেলল। প্রথমে রাজি হতে চায় নি কিন্তু সত্যি যে শয়তান এই অসময়ে একটা ফুলের বাগান করাতে পারে, তার পক্ষে তাদের কুকুর বেড়ালে পরিণত করা বা অন্যভাবে ক্ষতি করা মােটেই কঠিন নয়। অতএব পরদিন সকালে সঙ্গে একজন মাত্র পরিচারিকা নিয়ে ডায়ানােরা আনসালডাের বাড়ি গেল।।
আনসালডাে সত্যিই বিস্মিত। ডায়ানাের এত শীঘ্র ধরা দেবে তা সে বিশ্বাস করতে পারছে। না। তার সংশয় ছিল। তাই সে জিজ্ঞাসা করলাে, আমি তাে তােমাকে এত সকালে আশাই করি নি। এই তাে আমি সবে শয্যাত্যাগ করেছি। প্রেয়সী তুমি কি আমার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে? বিলম্ব সহ্য হচ্ছিল না? বলাে বলাে প্রিয়তমা।
ডায়ানােরা চোখে তখন জল টলটল করছে। সে বলল, মহাশয় আমি আপনার প্রতি অনুরক্ত এমন অসম্ভব চিন্তা করবেন না। আমি এসেছি আমার স্বামীর আদেশে। তিনিই আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন যদিও আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম।
আনসালডাে আরও অবাক। পৃথিবীতে এমন উদার স্বামীও আছে যে তার স্ত্রীর প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য পরপুরুষের কাঠে পাঠিয়ে দেয়? এমন মহানুভব ব্যক্তির সম্মান রক্ষা করা উচিত এবং এমন পতিব্রতা সতীর অঙ্গ স্পর্শ করাও উচিত নয়।
আনসালডাে শুধু বলল, তুমি ফিরে যাও, আমি ভুল করেছি। আজ থেকে তুমি আমার ভগিনী এবং আমি তােমাকে সেই মর্যাদাই দেব।
আনসালডােকে ধন্যবাদ দিয়ে ডায়ানাের স্বামীর কাছে ফিরে গিয়ে সব বলল। ওদিকে জাদুকর ডায়ানােরার স্বামীর এবং আনসালডাের উদারতা জেনে সে তার পারিশ্রমিক বাবদ অর্থ গ্রহণ করলাে না। যে রাতারাতি এমন একটা বাগান তৈরি করে দিতে পারে তার কাছে কয়েক হাজার ফ্লোরিন কিছুই নয়।
ষষ্ঠ গল্প
বহুযুদ্ধজয়ী কিং চার্লস দি ওল্ড নামে পরিচিত দুর্ধর্ষ প্রায় বৃদ্ধ এক রাজা এক তরুণীর কাছে পরাজয় স্বীকার করলেন, তার প্রেমে পড়লেন। যখন বুঝলেন এ অসম প্রেম অনুচিত, অন্যায় তখন তিনি সেই তরুণী ও তার বােনের ভালাে পাত্র দেখে তাদের বিবাহ দিয়ে ভারমুক্ত হলেন।
ম্যাডােনা ডায়ানােরার ব্যাপারে আনসালডাে, গিলবারটো বা সেই আশ্চর্য ও নির্লোভ জাদুকর কে বেশি উদার এই নিয়ে সকলে তর্ক আরম্ভ করে দিল। কিং প্যানফিলাে দেখল এদের তর্ক বােধহয় আজ শেষ হবে না তখন তিনি তাদের থামিয়ে দিয়ে ফিয়ামমেত্তাকে বললেন, তােমার গলাই দেখছি সবচেয়ে চড়া। তা এখন তর্ক থামিয়ে আমাদের একটা ভালাে গল্প শােনাও তাে।
ফিয়ামেত্তা বলল গল্প শেষ হলে আমারা যতই চেষ্টা করি তর্ক না করতে কিন্তু তর্ক এড়াতে পারি না এই হল মজা। ওসব কি আমাদের কাজ? তর্কর শেষ নেই। ওসব পণ্ডিতদের কাজ। যাই হােক এবার তােমাদের আমি এমন একটা গল্প বলবাে যা শুনে আমরা তর্কের অবকাশ পাব না। তর্ক করার মতাে কিছু এই গল্পে পাওয়া যাবে না। তােমাদের আর তর্কে না রেখে গল্পটা বলছি :
তােমার সকলে তাে রাজা প্রথম চার্লসের নাম জান। যিনি কিং চার্লস দি ওল্ড নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। যুদ্ধে কখনও পরাজয় স্বীকার করেন নি। তার বড় কৃতিত্ব হল তিনি গিলবেলিনস ও তাদের রাজা ম্যানফ্রেডকে ফ্লোরেন্স থেকে তাড়িয়ে আবার গুয়েলফদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন।
নেরি ডেগলি উবার্টি নামে একজন নাইট ফ্লোরেন্স ত্যাগ করে শহরের অদূরে অলিভ, চেস্টনাট, হ্যাজেল গাছ ঘেরা সুন্দর একটি উপত্যকায় নতুন একটি প্রাসাদ বানিয়ে সেখানে নির্জনে বাস করতে লাগলেন। বাড়িখানা যেমন চমৎকার তেমনি প্রাসাদ ঘিরে চমৎকার একটি বাগান তৈরি করলেন। ফলফুলের নানারকম গাছ লাগালেন আর অগভীর একটি জলাশয় খনন করালেন যাতে তিনি নানা আকারের ও নানা রকমের মাছ ছেড়ে দিলেন। নাইট নেরি স্থির করলেন বাকি জীবনটা তিনি এই বাড়িতে শান্তিতে কাটিয়ে দেবেন। রােজ অশ্বারােহণ করবেন আর উদ্যান পরিচর্যায় মন দেবেন, শরীর ও মন ভালাে থাকবে। বাগানটি যতদূর সম্ভব সুন্দর করবার জন্যই তিনি সর্বাপেক্ষা বেশি সময় দিতেন। তার ইচ্ছা ছিল যে, এই অঞ্চলে তিনি একটি আদর্শ ও সুন্দর বাগান তৈরি করনে। একাজে তিনি সফল হয়েছিলেন। বলতে কি তার এই বাগান বাজার বাগান অপেক্ষাও অনেক রমণীয় ও সুন্দর হয়েছিল। দেশ বিদেশ থেকে লােকও বাগান দেখতে আসতাে।
রাজা চার্লস পরাক্রমশালী হলেও উদার ছিলেন। পরাজিত ব্যক্তিকেও অবহেলা করতেন না, কাউকে হিংসা বা ছােট জ্ঞান করতেন না, কোনাে সম্প্রদায়কে ঘৃণাও করতেন না।
নেরির বাগানের সুখ্যাতি শুনে তিনি স্থির করলেন যে, তিনি তাে আসন্ন গ্রীষ্ম যাপন করতে ক্যাটেলামেয়ারে যাবেন আর নেরির বাগানও সেখানে। একদিন সুযােগ বুঝে তার বাগানে যাওয়া যাবে। ক্যাস্টেলামেয়ার জায়গাটা গ্রীষ্ম ঋতুতে ফ্লোরেন্স অপেক্ষা শীতল।
নেরির রাজনীতিক মতবাদ রাজা চার্লসের বিপরীত কিন্তু তিনি তাে সেসব গ্রাহ্য করেন না। নেরির বাগানের সুখ্যাতি শুনে তিনি বাগানটি দেখতে যাবেন তবে রাজা হিসেবে যাবেন না। সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে যাবেন। নেরিকে খবর পাঠান হল পরিচয় গােপন রেখে রাজা আগামীকাল নেরির বাড়ি যাবেন, বাগান দেখবেন ও তার সঙ্গে ভােজ করবেন। তার সঙ্গে চারজন সঙ্গী থাকবে।
গােপনেই হােক আর প্রকাশ্যেই হােক, রাজা তার বাড়ি আসবেন খবর পেয়ে নেরি আনন্দিত হল। এবং তাকে অভ্যর্থনার জন্য দ্রুত সর্বপ্রকার আয়ােজন করলাে। রাজা কি আহার করতে ভালবাসে জানা না থাকায় চর্বচোষ্য বিবিধ আহার্যের ব্যবস্থা করে রাখল, নানারকম স্বাদু ও দুষ্প্রাপ্য সুরাও সংগ্রহ করা হল। সকালে রাজা নেরির বাগানবাড়িতে এলেন। আজ তিনি রাজা নন, সাধারণ নাগরিক। সারা সকাল বাগান ঘুরে ঘুরে দেখলেন, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন, কয়েকটি বিদেশী অথচ দুষ্প্রাপ্য গাছ দেখে বললেন, গাছগুলির চারা বা কলম যেন তার প্রাসাদের উদ্যানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বেলা বাড়ল। ক্লান্ত রাজা একটা ফোয়ারায় স্নান করলেন। নতুন বেশ ধারণ করলেন। দেখলেন মাছভর্তি জলাশয়ের ধারে গাছের ছায়ায় ভােজের টেবিল সাজান হয়েছে। এই ব্যবস্থা তার খুব মনঃপূত হল। ভাবলেন রাজা না হয়ে সাধারণ মানুষ হলে তিনি যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে পরামানন্দে জীবন কাটাতে পারতেন। বেশ আছে নেরি। সে তার চেয়ে ভাগ্যবান।
ভােজের টেবিলে বসে রাজা চার্লস সঙ্গে যে চারজন সঙ্গী এনেছিলেন তাদের মধ্যে কাউণ্ট গাই ডি মন্টফোর্টকে বললেন তার ডান দিকে বসতে আর নেরিকে বসালেন বাঁ দিকে আর বাকি তিনজন সঙ্গীকে বললেন নেরির নির্দেশ নিয়ে তাদের পরিবেশন করতে।
সুখাদ্য ও সুস্বাদু সুরা পরিবেশিত হল। ধীরে ধীরে আহার ও গল্প বেশ জমে উঠেছে। খােলামেলা এই আন্তরিক পরিবেশে চার্লস ভুলে গেলেন যে তিনি দেশের রাজা। সহজ হতে পেরে তার খুব ভালাে লাগছিল।
এমন সময় বাগান যেন আলােয় ভরে গেল। সুন্দর একজোড়া রাজহংসী যেন সহসা কোথা থেকে উদয় হয়ে রাজার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। রাজহংসী নয়, দুটি অতি সুন্দরী ষােড়শী খিলখিল করে হাসতে হাসতে বাগানে এসে হাজির। এরা কি মানবী না পরী, আকাশ থেকে নেমে এলো? দুজনেরই পরনে সাদা ও হালকা পােশাক, যৌবন ও দেহের তপ্তকাঞ্চন বর্ণ ফুটে বেরােচ্ছে। রাজা মুগ্ধ, খেতে ভুলে গেলেন। একদৃষ্টে রাজহংসী প্রতিম তরুণী যুগলকে দেখতে লাগলেন।
দুটি তরুণীরই হাতে রয়েছে বড় ছাকনির মতাে মাছধরা জাল, আর হাতে একটা করে লাঠি। একটি মেয়ের পিঠে ঝুলছে কিছু ভাজবার চ্যাপ্টা কড়া, অপর মেয়েটির হাতে সরু সরু মােটা এক বাণ্ডিল জ্বালানি কাঠ। রাজা তখনও ব্যাপারটা বােঝেননি কারণ তিনি তরুণী যুগলের রূপসুধা পান করছিলেন।
তার চমক ভাঙল তারা দু’জনে রাজার সামনে এসে যখন তাকে অভিবাদন জানাল কিন্তু তিনি কিছু বলাবার আগেই তরুণীরা জলাশয়ের ধারে চলে গেল। ইতিমধ্যে একজন পাচক এসে জলাশয়ের ধারে উনুন তৈরি করে কাঠ জ্বালিয়ে তাতে কড়া বসিয়ে দিয়েছে। কড়া গরম হলে তেল দেবে আর কি।
তরুণী দুটি তাদের বুক পর্যন্ত জলে নেমে গেল। জলাশয়ের নিচে ছােটবড় অনেক পাথর রাখা হয়েছিল। শত্রুর আগমনে মাছগুলি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। মেয়েরা জানে মাছ কোথায় লুকোয় এইজন্যে তারা একটি লাঠি এনেছে। লাঠি দিয়ে তারা পাথরে খোঁচা দিতে লাগল। মাছ বেরিয়ে পড়ে আর তারা ছাকনি-জাল দিয়ে ধরে মাছটাকে টিপ করে গরম কড়ায় ফেলে দেয়। মাছ ভাজা হয়। আর গরম মাছভাজা পাচক টেবিলে পরিবেশন করে। রাজার মজা লাগে। মেয়েরা খিলখিল করে হাসে, রাজাও হাসে। মেয়েরা মজা পেয়ে রুপাের মতাে চকচকে ছােট ছােট মাছ সােজা খাবার টেবিলে ফেলে দেয়। রাজাও যেন তরুণীদের সমবয়সী হয়ে যান। তিনি মাছগুলিকে তরুণীদের লক্ষ্য করে তাদের দিকে ছুঁড়ে দেন। কিছুক্ষণ এরকম খেলা চলে। সঙ্গে সঙ্গে মশলা মিশিয়ে সেই গরম মাছভাজা ও সরাপান বেশ জমে ওঠে।
এবার তরুণী দু’জন জলাশয় থেকে উঠে জলের ধারে জাল ও লাঠি ফেলে এগিয়ে আসে। জলে ভেজা সেই সাদা পাতলা-পােশাক তাদের খাঁজে খাঁজে সেঁটে বসেছে। যৌবন সুপরিস্ফুট। দু’জনের বুকে দু’টি করে গােলাপী কুঁড়ি। সবই এত স্পষ্ট ফুটে উঠেছে যেন তারা বিবসনা। কিন্তু সরল শিশুর মতােই লজ্জা পাচ্ছে না। এ তাে স্বাভাবিক ব্যাপারে। রাজা তার দৃষ্টি সরাতে পারছিলেন না। তিনি দেশের রাজা, নিজে তরুণ নন, এভাবে বিবসনাপ্রায় তরুণী দেখা শালীনতা বিবর্জিত তা তার খেয়ালই নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না তরুণী দুটি তার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল ততক্ষণ তিনি তাদের দিকে চেয়ে রইলেন।
রাজা লক্ষ্য করলেন তরুণী দু’টি সমবয়সী কিন্তু কে যে বেশি সুন্দরী তা তিনি স্থির করতে পারছেন না। রাগ ভাবছেন তিনি কি তাদের মধ্যে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন? না না এটা অনুচিত। তিনি মাথা ঝেড়ে আবার আহারে মন দেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বৃথা। খাওয়া জমলাে না।
কিছুক্ষণ পরেই বেশ পরিবর্তন ও প্রসাধন করে মেয়ে দুটি ফিরে এলাে। একজনের হাতে রুপাের ট্রে, তাতে নানারকম ফল। মেয়েটি ফল পরিবেশন করলাে। রাজা আবার খেতে আরম্ভ করলেন। মেয়ে দুটিকে প্রায় একই রকম দেখতে হলেও যে মেয়েটি এখন ফল পরিবেশন করলাে সেই মেয়েটিকেই রাজার আগেই ভালাে লেগেছে।
ফল খেতে খেতে রাজা নেরিকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই পরী দুটি কে? এরা কি তােমার কন্যা ?
নেরি বলল, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। ওরা আমারই কন্যা, যমজ, এক ঘন্টার ছােট বড়। যে ফল পরিবেশন করলাে সে বড়, ওর নাম জিনারভা আর অপরটির নাম আইসোেটা।
ইতিমধ্যে ওরা দু’জনে সুললিত কণ্ঠে গান আরম্ভ করেছে। কথা থামিয়ে সকলে সেই গান শুনতে লাগল। গান শেষ করে রাজাকে অভিবাদন জানিয়ে ওরা ঘরে ফিরে গেল।
রাজা জিজ্ঞাসা করলাে, মেয়েদের বিয়ে দেবে না? এখনও ভাবি নি তবে বিয়ে দিতেই হবে, উপযুক্ত পাত্রও খুঁজতে হবে।
এরপর রাজা যতক্ষণ ছিলেন নানারকম গল্পগুজব করলেন বটে কিন্তু খােলা মনে নয়। কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যান। নেরি ভাবে দেশের রাজা তাে, মাথায় কতরকম দুশ্চিন্তা। এতক্ষণ তাে বেশ হাসিখুশি ছিলেন, হঠাৎ বােধহয় কোনাে সমস্যার কথা মনে পড়ে গেছে।
যাই হােক রাজা সপার্ষদ বিদায় নিলেন কিন্তু মনটা নেরির বাগানবাড়িতেই রেখে গেলেন। যদিও জিনার ও আইসােটাকে দেখতে একই রকম তবুও রাজার বেশি পছন্দ জিনারভাকে। এই সুন্দরী ষােড়শীর গালে ছােট্ট একটি তিল পছন্দের কারণ।
রাজা প্রাসাদে ফিরে বেশ বুঝলেন তিনি জিনারভাকে ভালবেসে ফেলেছেন। ভগিনী বা কন্যার মতাে নয়, প্রিয়তমার মতাে। কাজে মন লাগে না, মনস্থির করতে পারেন না। নানা ছলে নেরির বাগানে যান, আসল উদ্দেশ্য জিনারভাকে দেখা। শেষ পর্যন্ত আর স্থির থাকতে পারলেন না, কিছু একটা করার জন্যে চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তিনি একা জিনারভাকে নয় আইসােটাকেও অপহরণ করে নিজের প্রাসাদে নিয়ে আসবেন।
কাউন্ট গাইকে একান্তে কাছে ডেকে সবই বললেন। কাউন্ট তাে শুনে হতভম্ব। একি বলছেন মহারাজ? এই কি রাজার মতাে কাজ? রাজা তাে দুবৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করে, আপনি নিজেই সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন? আপনি ম্যানফ্রেড ও কোনারাডিনকে সহজে কি পরাজিত করলেন? কারণ ঐ দু’জনের নৈতিক চরিত্রের অবনতি হয়েছিল, ওরা নারীলােলুপ হয়ে উঠেছিল। ওদের উৎপাতে দেশে কোনাে বালিকা, কিশােরী, যুবতী এমনকি কয়েক সন্তানের জননীও নিজেদের নিরাপদ মনে করতাে না। মেয়ে দুটি তাে আপনার কন্যার বয়সী তাদের প্রতি আপনার লোেভ অনুচিত। আপনি যদিও তাদের অপহরণ করে আনেন তাহলে কি করে ভাবলেন যে তারা আপনাকে তাদের হৃদয় দান করবে? আপনাকে আমি দীর্ঘদিন থেকে চিনি। আপনিও সব ব্যাপারে আমার সঙ্গে পরামর্শ করেন। আপনি নিজেকে সংযত করুন।
রাজা সেদিন দীর্ঘ রাত্রি পর্যন্ত গভীরভাবে চিন্তা করলেন। পরদিন সকালে কাউণ্ট গাইকে ডেকে বললেন, তােমার পরামর্শ মেনে নিলুম। তুমি জেনে রাখ কাউন্ট আমি যেমন শত্রু জয় করতে পারি তেমনি মনের দুর্বলতাও জয় করতে পারি। আমি আর কন্যাযুগলের কথা চিন্তা করবাে না, তবে আমি মেয়ে দুটিকে ভালবেসেছি, আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে ওদের সৎপাত্রের হাতে অর্পণ করবাে। আমি কয়েকবারই নেরির আতিথ্য গ্রহণ করেছি, সেও আমাকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করছে, তারও প্রতিদান দেওয়া হবে। আমি নেপলস যাচ্ছি, ফিরে এসে নেরির সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে দেব। তুমি নিশ্চিন্ত থাক। মেয়ে দুটিকে আমার মন থেকে দূর করেছি। এখন থেকে আমি ভাববাে ওরা আমার মেয়ে অন্য কোনাে সম্পর্ক নেই।
নেপলস থেকে ফিরে এসে রাজা একদিন দূত পাঠিয়ে নেরিকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন যে, তিনি জিনারভা ও আইসােটার জন্যে অভিজাত বংশের দুটি পাত্র ঠিক করেছেন। একজন ম্যাফেও ডা পালিজি আর অপরজন গুইগ্লিয়েমা ডেলা ম্যাগনা। দু’জনেই সুদক্ষ নাইট ও জমিদার। সমস্ত যৌতুক আমি দেব এবং দুই মেয়েকে কিছু জমিদারিও দেব। আশা করি জিনারভা ও আইসােটার আপত্তি হবে না। দুটি পাত্রই যুবক, সৌম্যদর্শন ও স্বাস্থ্যবান।
নেরির মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। তার মেয়েরা ভাগ্যবতী। এত ভালাে বিবাহ সে কি দিতে পারতাে ?
সপ্তম গল্প
কিং পিটার শুনলেন যে লিজা নামে এক যুবতী এমনই গভীরভাবে তার প্রেমে পড়েছে যে, অসুস্থ হয়ে সে শয্যাগ্রহণ করেছে। তখন রাজা স্বয়ং গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে বললেন এমন প্রেম অনুচিত। তিনি যুবতীকে একটি সৎপাত্রের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে তার কপালে চুম্বন করে বললেন এখন তিনি তার নাইট, বিপদে তাকে রক্ষা করবেন।
কিয়ামমেত্তার গল্প শুনে সকলে রাজার সংযমের প্রশংসা করলাে কিন্তু এ নিয়ে আলােচনা বেশিদূর এগােবার আগেই প্যামপিনিয়াকে রাজা গল্প বলতে বললেন। প্যামপিনিয়া বলল, কিং চার্লসের গল্প শুনে আমার আর এক রাজার গল্প মনে পড়ল। এক্ষেত্রে রাজা প্রেমে পড়েন নি বরঞ্চ বিপরীতটাই ঘটেছিল এবং রাজা সুষ্ঠুভাবে তার মীমাংসাও করে দিয়েছিলেন। গল্পটা বলি, তােমাদের ভালাে লাগলে আমারও ভালাে লাগবে। শােনাে :
ফরাসীদের যখন সিসিলি দ্বীপ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল সেইসময়ে, সিসিলির বিখ্যাত বন্দর পালেরমােতে রীতিমতাে অর্থশালী একজন ভেষজ ব্যবসায়ী ছিল, তার নাম ছিল বারনারডাে পুচ্চিনি। বারনারডাের একটি কন্যা ছিল যার কোমলতা, লাবণ্য ও রূপের তুলনা ছিল না।
ফরাসীদের তাড়িয়ে আরাগনের কিং পিটার সিসিলি দ্বীপের অধীশ্বর হয়েছিলেন। তিনি যে শুধু নামেই সিংহাসনপ্রেমী রাজা ছিলেন না এটা জানিয়ে দেবার জন্যে সেকালের প্রথানুযায়ী পালেরমােতে একটা টুর্নামেন্টের আয়ােজন করলেন। এই টুর্নামেন্টে রাজা ও তার নাইটগণ লৌহবর্মে দেহ আচ্ছাদিত করে ঘােড়ায় চেপে বর্শাযুদ্ধ, অসিচালনা ও লক্ষ্যস্থলে তীরবিদ্ধ করে তাদের শক্তি ও কৌশলের পরিচয় দেবে।
বারনারডাের কন্যা লিজা তার কয়েকজন বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে এই প্রতিযােগিতা দেখতে এসেছিল। অশ্বারােহণে প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে কিং পিটারের বর্শাযুদ্ধে দক্ষতা, কৌশল ও তার শক্তি দেখে লিজা অভিভূত। সে রাজার প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল, বলতে কি সে গভীরভাবে রাজার প্রেমে পড়ে গেল।
প্রতিযােগিতা দেখে লিজা বাড়ি ফিরে এলাে কিন্তু সে রাজাকে এক দণ্ডের জন্যও ভুলতে পারল না। দৈনন্দিন নির্ধারিত কাজ করতেও সে ভুলে যায়। রাজাই তার প্রধান চিন্তা। হা-হুতাশ করে, রাজাকে হৃদয়াসনে বসিয়ে তার কথা চিন্তা করে। তার দুঃখ এই, সে যে রাজাকে ভালবাসে এ খবরও রাজার কানে পৌছবে না এবং পৌছলে তিনি গ্রাহ্যও করবেন না। কোথাকার কে এক লিজার জন্যে রাজার মাথাব্যথার কারণ নেই। তাছাড়া তার এই অসম প্রেমের কথা কাউকে বলতে পারবে না। কারও কানে এ কথা উঠলে সে লিজাকে বিদ্রুপ করবে, ব্যঙ্গ করবে, ধিক্কার দেবে। সে গুমরে গুমরে মরে।
রাজাকে সে চোখে দেখতে পায় না আর সেইজন্যেই তার প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়। কাজকর্মে ও আহারে মন নেই, গান শুনতেও ভালাে লাগে না, রাতেও ঘুম হয় না ফলে লিজা অসুখে পড়ল ও দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগল। অবশেষে সে শয্যা গ্রহণ করলাে।
তার বাবা মা বুঝতে পারে না মেয়ের কি হয়েছে। কোনাে যুবকের সঙ্গেও তাে মেয়ের ভালবাসা হয়নি, কোনাে যুবকের সঙ্গে তারা কথা বলতেই দেখে নি। তাহলে মেয়ের কি রােগ হল? তারা মেয়ের চিকিৎসা করায়, বৈদ্য আসে, ঔষধ খাওয়ান, সেবা যত্ন করেন কিন্তু মেয়ের অবস্থার উন্নতি হওয়া দূরের কথা, অবনতি হচ্ছে। তাদের এখন দুশ্চিন্তা মেয়েকে বাঁচাবে কি করে?
লিজাও মনে করলাে তার আর বাঁচার আশা নেই কিন্তু সে রাজাকে আন্তরিকভাবে ভালবাসে একথাটা রাজার কানে সে তুলে দিতে চায়।
শহরে মিনুচিয়াে ডিআরেজো নামে একজন গায়ক ছিল। রাজার কাছে মিনুচিয়াের অবারিত দ্বার কারণ রাজা মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনতেন। মিনুচিয়াের সঙ্গে লিজা ও তার বাবার বিশেষ পরিচয় ছিল। লিজা তার বাবাকে বলল, মিনুচিয়ােকে একবার ডেকে দিতে। বাবা ভাবলেন মেয়ের বােধহয় মিনুচিয়াের গান শুনতে ইচ্ছে হয়েছে।
মিনুচিয়াে মানুষটি বন্ধুবৎসল। লিজা অসুস্থ, শয্যাশায়ী এবং তার গান শুনতে চায় খবর পেয়েই তারের একটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সে লিজার কাছে এলাে। সে লিজাকে কয়েকটা গান শােনাল।
লিজা বলল, মিনুচিয়াে যদিও তােমার গান শুনতে আমি খুব ভালবাসি কিন্তু তােমার গান শােনাবার জন্যে তােমাকে আমি ডাকি নি, তােমার সঙ্গে আমার অত্যন্ত গােপনীয় একটা কথা আছে।
ইতিমধ্যে গান শেষ হয়ে যাওয়ায় ঘর খালি হয়ে ছিয়েছিল। লিজা বলল, আমি যা বলবাে তা শুনে
তােমার অসম্ভব মনে হবে, আমার অসুখের কারণ এই অসম্ভব ব্যাপারটি। তুমি আমাদের বন্ধু, আমাদের প্রতি তােমার সহানুভূতি আছে এবং স্বয়ং রাজার কাছে তুমি যখন ইচ্ছে যেতে পারাে তাই তােমাকেই বলছি, কিন্তু ভাই আমি তােমাকে যা বলবে তা তুমি কিছুতেই কাউকে বলবে না। তুমি প্রতিজ্ঞা করাে তবে বলবাে।
মিনুচিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাে। লিজা বলল সেদিন টুর্নামেন্টে রাজাকে দেখে আমি ভীষণভাবে তার প্রেমে পড়েছি। আমার অসুখের কারণ এই অসম ও অসম্ভব প্রেম। কিন্তু সকলে তাে আর নিজের মনকে বাঁধতে পারে না। আমি পারি নি তাই আমার এই দুর্দশা। আমি এতদূর অসুস্থ ও শীর্ণ হয়ে পড়েছি যে, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। কিন্তু মরার আগে আমার দুঃখ থেকে যাবে যদি না রাজা জানতে পারেন যে এক হতভাগিনী তাকে ভালবেসে মৃত্যুবরণ করেছে। তােমার কাছে আমার বিশেষ অনুরােধ ভাই যদি এই খবরটুকু তার কাছে পৌছে দাও। আমি জানি আমার কথা শুনে তিনি একটুও বিচলিত হবেন না হয়ত পরিহাসই করবেন; তথাপি আমার ইচ্ছা যদি এই হতভাগিনীর কথা, যে তার জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে তার কথা, যত সামান্যই হােক তাঁর কাছে যেন পৌছায়।
মিনুচিয়াে একজন শিল্পী, তার মনটিও স্পর্শকাতর। সে বলল, বােন আমি শপথ করে বলছি আমি তােমার কথা রাজাকে বলবাে, আমি নিজে বলবাে, কারও মারফত নয়। আমি আজই যাবাে এবং তােমার করুণ কাহিনী শুনে রাজার মনে কি প্রতিক্রিয়া তা তােমাকে আমি যথাশীঘ্র জানিয়ে যাবাে।
ছলছল চোখে মিনুচিয়াের দিকে চেয়ে লিজা বলল, বেশি দেরি করাে না ভাই!
মিনুচিরাে লিজাদের বাড়ি থেকে সােজা কবি ও সঙ্গীত রচয়িতা মাইকো ডা সিয়েনাকে বিশেষভাবে অনুরােধ করে মর্মস্পর্শী একটি প্রেমসঙ্গীত লিখিয়ে নিল। মিনুচিয়ে তাতে হৃদয়গ্রাহী সুর দিল।
কিং পিটার মিনুচিয়াের দরাজ ও সুরেলা কণ্ঠে সেই হৃদয়স্পর্শী গান শুনে অভিভূত। এমন গানও লেখা হয়, সে গান এমন সুরে গাওয়া যায়। রাজার মন উদাস হল। সেদিন রাজসভায় যেতেই তার ইচ্ছা হল না। রাজা জিজ্ঞাসা করলাে এ গান তুমি তাে আমাকে আগে কোনােদিন শােনাও নি মিনুচিয়াে।
মহারাজ, কারণ গানটি সদ্য লেখা এবং সদ্য সুর দেওয়া। আপনাকেই শােনাবার জন্যে এই গান রচিত হয়েছে বলে মিনুচিয়াে সবিস্তারে লিজার করুণ কাহিনী নিবেদেন করলাে।
রাজা মন দিয়ে সব শুনে দুঃখপ্রকাশ করে বললেন প্রেমের ব্যাপারে কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। কত যুবক যুবতীর প্রেম অব্যক্ত রয়ে গেছে। তুমি কি বললে? মেয়েটি মৃত্যুশয্যায়। মরবার আগে সে তােমাকে তার খবর আমার কাছে পৌছে দিতে বলেছে? তা নয়। সাহস করে বলতে পারে নি যে মরবার আগে সে আমাকে একবার দেখতে চায়। শােনাে মিনুচিয়াে তুমি দেরি করাে না। তুমি মেয়েটির কাছে গিয়ে এখনি বলে যে আমি আজই সন্ধ্যায় তার কাছে যাব। শেষবারের মতাে দেখা দিতে নয় যদি তার কিছু মঙ্গল করতে পারি।
এমন ভালাে একটা খবর লিজার কাছে পৌছে দিতে পারবে এ ভেবে মিনুচিয়াে খুব আনন্দিত হল। সে আর দেরি করলাে না, রাজাকে শত শত ধন্যবাদ দিয়ে এবং তার কাছে বিদায় নিয়ে সে তখনি লিজার শয্যাপার্শ্বে এসে এই সুখবর দিল।
আশাতিরিক্ত এমন একটা সুখবর শুনে লিজা তাে প্রথমে বিশ্বাস করে নি। এ কি সম্ভব? রাজা স্বয়ং
তাদের বাড়ি আসবেন? কিন্তু সে জানে মিনুচিয়াে অত্যন্ত সৎ, তার কথা অবিশ্বাস করা যায় না। লিজার ততা আর আনন্দ ধরে না। সে মিনুচিয়ােকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু জিজ্ঞাসা করলাে। সব শুনে লিজার মনে হল তার অসুখ অর্ধেক সেরে গেছে। সত্যিই তাই। যে মেয়ে গত পনেরাে দিন বিছানায় একবারও উঠে বসে নি সে বালিশে ঠেস দিয়ে উঠে বসলাে।
মিনুচিয়াে যাবার আগে রাজাকে যে গান শুনিয়েছিল সেই গানটি লিজাকেও শুনিয়ে দিল। লিজা সত্যিই অনেক সুস্থ বােধ করলাে। তার মুখে আবার হাসি ফুটল। এখন সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। রাজা শুধু দেশের রাজা নয় তার হৃদয়েরও রাজা, সে কি সত্যিই আসবে? তার কি এমন ভাগ্য হবে?
পিটার কিন্তু রাজার মতাে রাজা ছিলেন। তিনি মানুষের ব্যথা বুঝতেন এবং দূর করতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। সন্ধ্যার মুখে তিনি তাঁর দু’জন সঙ্গীকে ডাকলেন, বললেন চলাে হে শহরে একটু বেড়িয়ে আসি। অনেকদিন শহরের অবস্থা দেখা হয়নি। ভেষজ ব্যবসায়ী বারনারভাের বাড়ির অবস্থান তিনি মিনুচিয়াের কাছে আগেই জেনে নিয়েছিলেন।
ঘােড়ায় চেপে যেতে যেতে মাঝে মাঝে ঘােড়া থামিয়ে লােকজনের খবর নেন, তাদের অভিযোেগ শােনেন। এইভাবে যেতে যেতে লিজাদের বাড়ির সামনে এসে থামেন। বারনারভাের বাড়ি ছােট হলেও সামনে চমৎকার একটি বাগান ছিল। বাগানে একটি বড় গাছ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাে। গাছটির পাতা দেখা যাচ্ছে না, ফিকে বেগুনি রঙের ফুলে ফুলে ভর্তি। এ গাছ তিনি আগে দেখেন নি। গাছ দেখেই যেন কৌতূহলী হলেন। ঘােড়া থেকে নামলেন। তারপর একজন সঙ্গীকে বললেন, বাড়ির গেট খুলে বাড়ির মালিককে ডেকে আনাে তাে।
রাজা এসেছেন শুনে বারনারডাে পড়ি কি মরি করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলাে। কি ব্যাপার? কোনাে অন্যায় করেছে নাকি? রাজা ততক্ষণে বাগানের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। লিজার কানেও খবর পৌঁছেছে। সে তাে আনন্দে অধীর। চোখে জল এসে গেল।
বারনারডাে এসে রাজার সামনে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়াতে রাজা তাকে অভয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন এ গাছ সে কোথায় পেল ইত্যাদি খোঁজ নিতে নিতে তার পরিবারের বিষয়ে খোঁজ নিতে লাগলেন। রাজা জানতে পারলেন তার একটি মেয়ে আছে, মেয়েটির এখনও বিয়ে দিতে পারেননি। বর্তমানে সে খুব অসুস্থ তবে আজ দুপুর থেকে তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে, বােধহয় বেঁচে গেল।
রাজ তাে সব জানেন। তবুও তিনি বললেন, তােমার মেয়ের এমন কঠিন পীড়া হয়েছে? চলল তাে তাকে দেখে আসি।
রাজা লিজার ঘরে ঢুকে তার একটি হাত ধরে বললেন, কি হয়েছে তােমার? এই বয়সে এমন অসুখ? কোথায়, তুমি এই বয়সে তােমার নবীন যৌবনে হেসেখেলে বেড়াবে, আমাদের আনন্দ দেবে তা নয়, চব্বিশ ঘণ্টা শুয়ে থাকবে? আমি বলছি তােমার কিছু হয়নি।
রাজা তার হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে লিজার সারা দেহে অপূর্ব শিহরণ, তারা সারা দেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তার দুই চোখ জলে ভরে গেল। এত আনন্দ সে কোথায় রাখবে।
কোনওরকমে জড়তা কাটিয়ে লিজা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলল, মহারাজ একটা বিরাট বােক্স আমার বুকে চেপে বসেছে। সেটা নামাবার অনেক চেষ্টা করে এখনও সে ভার নামাতে পারি নি তবে আপাতত বেশ হালকা বােধ করছি। আপনার আর্শীবাদ পেলে আমি সে ভার নামাতে পারবাে আশা করি।
লিজার সঙ্গে রাজা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে এবং আর-একবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেলেন।
লিজার বাবা-মা ভাবলেন মিনুচিয়াের গান শােনার পর থেকেই মেয়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি আরম্ভ হয়েছে কিন্তু রাজা চলে যাবার পর কয়েক ঘন্টার মধ্যে লিজা যেন তার রােগ ঝেড়ে ফেলে দিল। সে চলাফেরা শুরু করলাে, মুখে আবার হাসি ফুটল, বিশেষ কোনাে খাবারের জন্যে মায়ের কাছে আবদার করলাে। বাবা-মা ভীষণ খুশি। তাদের আদরের মেয়ে জীবন ফিরে পেল।
রাজা সেদিন লিজার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলেন তার প্রতি মেয়েটির প্রেম কামগন্ধহীন ও পবিত্র, তাই লিজা তাকে আকৃষ্ট করেছিল। রাজা রানীকে সব বললেন। এমন মেয়ের জন্যে কিছু করা উচিত। চলাে রানী আমরা দুজনে ওদের বাড়িতে গিয়ে একটা প্রস্তাব করব। আমার সঙ্গে ততা আর বিয়ে সম্ভব নয় বা একটি মেয়েকে আমি আমার প্রিয়পাত্রীরূপে প্রাসাদে এনে রাখতেও পারি না।
রাজা তার কয়েকজন সভাসদকে নিয়ে বারনারডোের বাড়ি এলেন। একটু পরে কয়েকজন সখিকে নিয়ে রানীও এলেন। লিজা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বাইরে এসে রাজা ও রানীর প্রতি যথােচিত সম্মান দেখিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসাল।
একসময়ে লিজাকে একা পেয়ে রাজা বললেন, লিজা তুমি যে আমাদের ভালবাস এজন্যে আমরা প্রীত তাই আমি আজ সঙ্গে রানীকে এনেছি। তােমার এই শুদ্ধ মনকে আমরা যথােপযুক্ত মর্যাদা দেবার মানসে তােমাকে উপহার দেব, আশা করি সে উপহার তুমি গ্রহণ করবে। উপহার হল আমরা তােমাকে তােমার উপযুক্ত স্বামী দেব এবং আমি স্বয়ং তােমাকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে তােমার নাইট হবাে, পরিবর্তে তােমাকে আমি চুম্বন করবাে।
লিজা তাে বিহুল, লজ্জায় লাল হয়ে গেল। রানী তাে রাজার পাশে বসেছিলেন। তিনি লিজাকে বুকে টেনে নিলেন।
রানী বললেন, দুঃখ কোরাে না, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা জানি, বুঝি, অধিকাংশ মানুষই নিজের মন বেঁধে রাখতে পারে না।
রানীর এই কথায় সাহস পেয়ে লিজা বলল, আমি এমন এক ব্যক্তিকে ভালবেসে ফেললুম যে কথা কাউকে বললে সে আমাকে বাতুল বলবে অথচ বুকে এই চাপ নিয়ে আমি গুমরে মরেছি এবং জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলুম। কিন্তু আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনারা আমাকে নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, আমিও আমার দায়িত্ব যথাসম্ভব পালন করবাে কিন্তু আমার প্রেম কোনােদিন অমিলন হবে না। আপনাদের অসীম দয়া আমি ভুলব না।
রানী তার গাল টিপে দিয়ে বললেন, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, সব মানিয়ে নিতে পারবে।
এরপর রাজা লিজার বাবা ও মাকে ডেকে বললেন আমরা তােমার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেছি। পাত্রও ঠিক করেছি। অভিজাত বংশের ছেলে কিন্তু অবস্থা এখন পড়ে গেছে, সেজন্যে তােমাদের কোনাে চিন্তা নেই।
রাজা তখনি লিজার জন্যে মনােনীত পাত্র পার্টিকোন নামে যুবকটিকে ডেকে পাঠালেন আর রানী ইতিমধ্যে লিজাকে অনেক রত্নালংকার উপহার দিলেন।
তারপর একদিন শুভবিবাহ হয়ে গেল। রাজা পার্ডিকোনকে নতুন উপাধিতে ভূষিত করলেন, তাকে কিছু জমিদারী দিলেন। রানী লিজাকে আরও অলংকার, নানা আসবাব ও দামী পােশাক উপহার দিলেন। এসবই বিবাহের যৌতুক।
বিবাহশেষে রাজা লিজার কপালে চুম্বন করে বললেন, এখন থেকে আমি তােমার নাইট। রাজা। ও রানী যেন নিজের মেয়ের বিবাহ দিলেন। এমন উৎসব ও আড়ম্বরের আয়ােজন করা হয়েছিল।
এরকম একটি নয়, কিং পিটার ও তার রানী আরও অনেকের সুখেদুঃখে বিপদে আপদে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং নিঃস্বার্থভাবে তাদের উপকার করেছেন।
রাজাকে ভুলতে পারে নি লিজা, ভােলা কি যায়? তবে সে তার স্বামী পেয়ে সুখী হয়েছিল। তার স্বামীটি তার রাজার মতােই হয়েছে তাই লিজা এত খুশি হয়েছিল।
অষ্টম গল্প
সােফ্রানিয়ার বিশ্বাস তার সঙ্গে জিসিপাসের বিয়ে হয়েছে কিন্তু আসলে টাইটাসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। টাইটাস সােফ্রানিয়াকে নিয়ে রােমে গেছে। পরে জিসিপাসও রােমে যায় কিন্তু তখন তার ভিখারীর অবস্থা। জিসিপাসের ধারণা হল টাইটাস তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জিসিপাস বলে সে একটা খুন করেছে। টাইটাস জানতে পেরে জিসিপাসকে বাঁচাবার জন্যে বলে খুন সে নিজে করেছে। ব্যাপার দেখে আসল খুনী ধরা দেয়। কিন্তু সম্রাট অকটেভিয়ানাস তাদের মুক্তি দেয়। টাইটাস তখন নিজের বােনের সঙ্গে জিসিপাসের বিয়ে দেয় ও সম্পত্তির ভাগ দেয়।
মেয়েরা সকলেই প্রায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আহা পিটারের মতাে এমন রাজা যদি থাকতাে! এরপর ফিলােমেনার গল্প বলার পালা সে আর দেরি না করে আরম্ভ করলাে। সে বলল, আমরা রাজা পিটারের প্রশংসা করছি কারণ তিনি প্রশংসার যােগ্য। রাজার অনেক ক্ষমতা, ইচ্ছে করলে তারা অনেক বড় কাজ করতে পারে কিন্ত সাধারণ লােকও তাদের সীমবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেও ভালাে কাজ করতে পারে যদি তাদের মন থাকে। আমিও এমনই একটা গল্প বলবাে।
অকটেভিয়ানাস সিজার তখন রােম সাম্রাজ্য শাসন করছেন। তখন রােম নগরে বাস করতেন। পিউব্লিয়াস কুইনটাস ফুলভিয়াস। তার এক ছেলে ছিল, টাইটাস কুইনটাস ফুলভিয়াস। ছেলেটি মেধাবী, অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিল। টাইটাসের পিতা ছেলেকে এথেন্স পাঠালেন দর্শনশাস্ত্র পড়বার জন্যে। ঐ শহরে চেমস নামে একজন সজ্জন পণ্ডিত ছিলেন। তার কাছে টাইটাসকে পাঠান হল। তারই বাড়িতে থেকে টাইটাস পড়াশােনা করবে। চেমিসেরও টাইটাসের সমবয়সী একটি ছেলে ছিল, তার নাম জিসিপাস। সেও মেধাবী ও বুদ্ধিমান। ফ্রেমিস টাইটাসকে নিজের ছেলের মতাে যত্ন করে তাকে লেখাপড়া শেখাতে লাগলেন। দুটি ছেলেতে বন্ধুত্ব হল, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, যাকে বলে
অভিন্নহৃদয়। আরও উচ্চতরও দর্শন শেখাবার জন্যে চেমিস দু’জনকে অ্যারিস্ত্রিপাস নামে এক পণ্ডিতের কাছে পাঠিয়েছিলেন।
একদিন দু’জনের পাঠও শেষ হল সেইসময় চেমিসও মারা গেলেন। বলা বাহুল্য শােক সামলে উঠে স্বাভাবিক কাজকর্ম আরম্ভ করতে দুই বন্ধুরই বেশ কিছুদিন সময় লাগল কারণ দু’জনেই চেমিসকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাে।
কয়েক মাস পরে জিসিপাসের বন্ধু ও আত্মীয়রা জিসিপাসকে বিয়ে করতে বলল এবং পঞ্চদশী লাবণ্যময়ী অতীব সুশ্রী একটি মেয়েকে পাত্রী নির্বাচন করলেন। এথেন্সের মেয়ে, নাম সােফ্রানিয়া। বিয়ের একটা তারিখও ধার্য হল।
জিসিপাস তখনও পর্যন্ত মেয়েটিকে দেখে নি কিন্তু বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। টাইটাসকে প্রস্তাব করলাে, চলাে মেয়েটিকে একবার দেখে আসি। টাইটাস রাজি হল ও দুই বন্ধু একদিন সােফ্রানিয়াকে দেখতে গেল। জিসিপাসের মেয়ে পছন্দ হল, তার ভালােই লাগল কিন্তু টাইটাস তাে সােফ্রানিয়াকে দেখে মুগ্ধ, চোখে ও মনে ধরে গেল। বাড়ি ফিরে টাইটাস সােফ্রানিয়ার কথাই চিন্তা করতে লাগল। সে যদি এই মেয়েকে পেত। কিন্তু হায় সে যে এখন বন্ধুর বাগদত্ত, বিবাহের তারিখও ঠিক হয়ে গেছে। যদিও বা আজীবন সে অবিবাহিত থেকে যায় তথাপি বন্ধুবিচ্ছেদে অকল্পনীয়। জিসিপাসই সুখী হােক। সে না হয় দূর থেকেই নীরবে সােফ্রানিয়াকে ভালবাসবে।
দিন যায়। বিয়ের তারিখও এগিয়ে আসে কিন্তু প্রিয় বন্ধু টাইটাসের মধ্যে জিসিপাস পরিবর্তন লক্ষ্য করে। বন্ধুর বিয়েতে সে কোথায় উল্লসিত হবে তা নয়, সে যেন দিন দিন স্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। কি ব্যাপার?
টাইটাস সর্বদা কি ভাবে, আহার করে না, শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, সবেতেই নিস্পৃহ কঠিন রােগে পড়বে। জিসিপাস তাকে চেপে ধরলাে, তােমার কি হয়েছে বলতেই হবে। টাইটাস যতই এড়িয়ে যেতে চায়, জিসিপাস তাকে ততই চেপে ধরে। শেষ পর্যন্ত টাইটাসকে সব স্বীকার করতে হল। দোষ স্বীকার করে বন্ধুর কাছে বার বার ক্ষমা চাইতে লাগল, বলতে লাগল, বিশ্বাসঘাতকতা করবার একটুও ইচ্ছা নেই। কিন্তু মন বাঁধতে পারি নি। কঠিন চেষ্টা করেও নিস্ফল হয়েছি।
বন্ধু টাইটাসের করুণ ও শশাচনীয় অবস্থা দেখে জিসিপাসের খুব কষ্ট হল। ভাবী বধূকে দেখে তারও বেশ ভালাে লেগেছে কিন্তু এখনও এবং একবার দর্শনেই এমন গভীরভাবে প্রেমে পড়ে যায় নি। বন্ধুর জন্যে তারা দয়া হল।
জিসিপাস টাইটাসকে প্রথমেই ভৎসনা করলাে, বলল এমন একটা আবেগ তুমি চেপে রেখেছ কেন? আমাকে তখনি বলে নি কেন? গুরুর কাছে আমরা কি শিক্ষা পেয়েছি? তুমি আমার একমাত্র বন্ধু, তােমার প্রাণ আগে না আমার বিবাহ আগে। মন হালকা করাে। এটা একটা সমস্যাই নয়। সােফ্রানিয়ার তুল্য মেয়ে কি আর এথেন্স শহরে নেই? | তবুও টাইটাস মানতে চায় না তবে শেষ পর্যন্ত জিসিপাসের চাপে সে ফোফ্রানিয়াকে গ্রহণ করতে রাজি হল। টাইটাস যত না আহ্লাদিত হল তার চেয়ে অনেক বেশি লজ্জিত হল। মনকে ঠিক বােঝাতে পারছে না। বন্ধুর ভালবাসার সুযােগ নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাই করা হল।
দুই বন্ধু তাে নিজেদের মধ্যে সমস্যার সমাধান করে নিল কিন্তু কন্যাপক্ষকে তারা কি বলবে?
বিবাহ স্থির হয়েছে জিসিপাসের সঙ্গে এখন সহসা তাদের যদি বলা যায় জিসিপাস বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না, টাইটাসের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হােক, সে ভীষণ একটা কেলেংকারি তাে হবেই, চাই কি কন্যাপক্ষ টাইটাসের সঙ্গে সােফ্রানিয়ার বিয়ে দিতে রাজি নাও হতে পারে। তখন কি হবে? একূল ওকূল দু কূল যাবে।
ঘটনার আকস্মিকতায় টাইটাস তখনও বিভ্রান্ত, সে স্পষ্ট ভাবে কিছু চিন্তা করতে পারছে না। জিসিপাসই ভেবে একটা পথ বার করলাে। বিবাহের জন্যে সােফ্রানিয়াকে ওরা জিসিপাসের বাড়িতে নিয়ে আসবে। বিবাহের প্রাথমিক অনুষ্ঠান জিসিপাসের সঙ্গে সকলের সমক্ষে অনুষ্ঠিত হবে তারপর রাতে জিসিপাস কোনাে কৌশলে তার নিজের শয়নকক্ষে টাইটাস ও সােফ্রানিয়ার শয়নের ব্যবস্থা করে দেবে যাতে ওরা স্বামী-স্ত্রী রূপে শয়ন ও সহবাস করতে পারে। দুই বন্ধুর শয়নকক্ষও পাশাপাশি। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাবার জন্যে মাঝে দরজাও আছে।
বিবাহের দিন এগিয়ে এলাে। টাইটাস এখন তার হৃত স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছে, সুস্থ ও সবল। বিয়ের তারিখে কন্যাকে নিয়ে রীতি অনুসারে কন্যাপক্ষ পাত্রের বাড়ি এলাে। প্রাথমিক অনুষ্ঠান জিসিপাসের সঙ্গেই সম্পন্ন হল। মূল বিবাহ হবে রাত্রে বাসরঘরে যখন বর কনের আঙুলে আংটি পরিয়ে দেবে এবং সহবাস করবে, তখনই বিবাহ সিদ্ধ হবে।
প্রাথমিক বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ হল। লজ্জাবনত কন্যা বরের মুখের দিকে দেখতে পারে নি। সে তাে জানে জিসিপাসের সঙ্গেই তার বিয়ে হচ্ছে। এরপর ভােজপর্ব শেষ হতে সােফ্রানিয়াকে তার স্বামীগৃহে রেখে তার আত্মীয়রা ফিরে গেল। বাড়িতে এখন দুই বন্ধু ও তাদের পরিচারক বা পরিচারিকারা রইল।
যথাসময়ে সােফ্রানিয়াকে পরিচারিকারা শয়নঘরে নিয়ে গিয়ে তার বেশ পরিবর্তন করে তাকে আসন্ন স্বামীসঙ্গর জন্যে প্রস্তুত করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর টাইটাসকে জিসিপাস বাসরঘরে যেতে বলল। টাইটাস আসােয়াস্তি বােধ করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে ঘরে প্রবেশ করতেই হল। ঘর অন্ধকার ছিল। সােফ্রানিয়া জানতে পারলাে না তার পাশে এসে কে শয়ন করলাে, জিসিপাস না টাইটাস।
সেই অন্ধকারে সােফ্রানিয়াকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে জিজ্ঞাসা করলাে, তুমি আমার পত্নী হতে রাজি আছ? সােফ্রানিয়া উত্তর দিল সে রাজি আছে। টাইটাসও বলল, আমিও তােমার স্বামী হতে রাজি এবং এখন থেকে আমরা স্বামী স্ত্রী, বলে তার আঙুলে আংটি পরিয়ে তার ওষ্ঠে চুম্বন করলাে। বিবাহ পাকা হল।
এরপর পরস্পরকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিশিযাপন করলে। বন্ধুর জন্য কিছু করতে পেরেছে এই আত্মপ্রসাদ লাভ করে জিসিপাস পাশের ঘরে পরম শান্তিতে নিদ্রাসুখ উপভােগ করতে লাগল।
রােম থেকে চিঠি এলাে টাইটাসের পিতা পিউরিগাস পরলােক গমন করেছেন। তাকে অবিলম্বে রােমে ফিরে যেতে হবে। সঙ্গে সােফ্রানিয়াকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল। সোেফ্রানিয়াকে নিয়ে টাইটাস যখন রােমে চলে যাবে তখন তাে এথেন্সে জিসিপাসকে নিশ্চই সকলে প্রশ্ন করবে তােমার বৌ তােমার বন্ধুর সঙ্গে কোথায় গেল? এতএব সব কথা সােফ্রানিয়াকে বলতেই হল।
ব্যাপারটা সােফ্রানিয়া মেনে নিতে পারল না। সে বলল তাকে এবং তার বাবা মাকে ও সকলকে জিসিপাস ঠকিয়েছে। লােক জমায়েত হবার আগেই সােফ্রানিয়া কাদতে কাদতে তার বাড়িতে গিয়ে প্রথমে তার মাকে সবই খুলে বলল, জিসিপাসের সঙ্গে নয়, টাইটাসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে।
এই খবর শুনে সােফ্রানিয়ার পিতা ও বাড়ির ও পাড়ার আর সকলে ক্ষেপে গেল এবং তারা সদলে জিসিপাসের বাড়িতে এসে জিসিপাসকে বিশ্বাসঘাতক বলল ও তার বঞ্চনার কৈফিয়ৎ দাবি করলাে।
জিসিপাস দোষ স্বীকার করে বলল বন্ধুর প্রাণ বাঁচাবার জন্যে সে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, তাছাড়া টাইটাস তার চেয়েও অনেক ভালাে পাত্র। সে প্রচুর ভূসম্পত্তি ও সম্পদের মালিক। জিসিপাসের যুক্তিতে কেউ কান দিল না। ওদের সম্ভবত আপত্তি ছিল রােমবাসীর সঙ্গে মেয়ের বিবাহে। বিবাদ যখন চরমে উঠল তখন টাইটাস বলল এভাবে বিবাদ করে ফয়সালা করা যাবে না। চলুন, আপনারা সকলে ও আমরা দুজনে এক মন্দিরে যাই, সেখানে মন্দির প্রাঙ্গণে আমি আমার বক্তব্য পেশ করবাে।
সকলে রাজি হয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে সমবেত হল। সেখানে টাইটাস এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিল। সে বলল, বিবাহ স্থির করবার মালিক আমরা নই। আমাদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর আমাদের বিবাহ স্থির করে রাখেন এবং তারই ইচ্ছায় আপনাদের কন্যার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়েছে। তারপর টাইটাস বন্ধুর ত্যাগ ও নানা গুণের প্রশস্তি পেশ করে বলল সেও সবদিক দিয়ে জিসিপাসের সমতুল্য এজন্যে বঞ্চিত হয়নি। হতে পারে সে রােমবাসী কিন্তু রােমকরাই তাে এখন আপনাদের শাসক। রােম স্বাধীন কিন্তু এথেন্স পরাধীন ইত্যাদি নানাভাবে সে প্রমাণ করলাে যা হয়েছে তা খারাপ হয়নি যদিও তার বন্ধুর জন্যে তার মন ব্যথিত হয়ে আছে ও থাকবে। শেষে বলল, আপনারা উত্তেজনা প্রশমিত করে শান্ত মাথায় ভেবে। দেখুন এখন যখন আপনাদের কন্যার বিবাহ হয়েই গেছে তখন কি আপনারা আমার বাড়িতে না পাঠিয়ে কন্যাকে চিরদিন আপনাদের বাড়ি কুমারী মেয়ের মতাে আটকে রেখে সংসারসুখ থেকে বঞ্চিত করবেন?
শেষ কথা বলে সে বন্ধুর হাত ধরে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে গেল। ভিড়ও পাতলা হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সােফ্রানিয়ার পিতামাতা টাইটাসের যুক্তি মেনে নিয়ে কন্যাকে তার হাতে সমর্পণ করলাে এবং জিসিপাসকে পরিবারের বন্ধু বলে স্বীকার করে নিল।
বন্ধুর কাছে আবার ক্ষমা চেয়ে টাইটাস নববধূ সােফ্রানিয়াকে নিয়ে রােমে নিজ বাড়িতে ফিরে গেল। টাইটাস পরিবার নববধূকে সসম্মানে ও সাদরে গ্রহণ করলাে। জিসিপাস এথেন্সেই রয়ে গেল। কিছু দিন পরে এথেন্সে রাজনীতিক অন্তর্কলহ ও সাম্প্রদায়িক বিবাদের ফলে জিসিপাসকে এথেন্সে ছেড়ে সবকিছু ফেলে বিদেশে চলে যেতে হল, বলতে গেলে তাকে একঘরে করে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল।
সে এখন কপর্দকশূন্য প্রায় ভিখারী। সে রােমের পথ ধরলাে। বন্ধু টাইটাস কি তাকে এখনও মনে রাখে নি?
টাইটাসের বাড়ির সামনে সে যখন পৌছল তখন তার দৈন্যদশার শেষ নেই। অবস্থা চরমে। অনাহারে অর্ধাহারে শীর্ণ হয়েছে, একমাথা রুক্ষ চুল, এক গাল দাড়ি, পােশক ছিন্নভিন্ন, চেনা যায় না। এই বেশে জিসিপাসের বাড়িতে ঢুকতে তার সাহস হল না। রক্ষী নিশ্চই বাধা দেবে এবং বিশ্বাসও করবে না যে এই ভিখিরিটা তার মনিবের বন্ধু। তার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করা যাক, টাইটাস তাে বাড়ি থেকে বেরােবে। তাকে দেখলে নিশ্চই ডেকে নেবে। এ একসময়ে টাইটাস বাড়ি থেকে বেরলাে, তার দিকে ক্ষণিকের জন্যে একবার চেয়ে দেখলেও কিন্তু চিনতে না পেরে নিজের কাজে চলে গেল। টাইটাস কখনও কল্পনাও করে নি যে সে তার প্রিয় বন্ধুকে এমন ভিখারির বেশে দেখবে। কিন্তু জিসিপাস উলটো ভাবল, ভিখিরিকে কে আর বন্ধু বলে স্বীকার করবে! অভিমানে জিসিপাসের চোখে জল এসে গেল। বন্ধুত্বের এই প্রতিদান? টাইটাসের জন্যে সে যা করেছে তা কি টাইটাস ভুলে গেল? সে আর অপেক্ষা করলাে না। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। হতাশ হয়ে আশ্রয়ের আশায় সে অন্য দিকে চলে গেল।
কোথায় আর যাবে? সঙ্গে একটিও মুদ্রা নেই যে কিছু কিনে খাবে। দুর! এরচেয়ে মরে যাওয়া ভালল। ঘুরতে ঘুরতে সে শহরের পাহাড়ী এলাকার একটা নির্জন প্রান্তে এসে বড় একটা গুহা দেখতে পেয়ে সেখানে ঢুকে ক্লান্ত শরীরটা পাথরের ওপর এলিয়ে দিল। রাত্রে যদি কোনাে হিংস্র জন্তু এসে তাকে মেরে ফেলে তাে বেঁচে যায়। একসময়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
শেষ রাত্রে তার ঘুম ভেঙে গেল। দু’জন চোর চোরাই মাল নিয়ে গুহায় ঢুকে বাটোয়ারা নিয়ে তুমুল তর্ক জুড়েছে। অন্ধকারে ওরা জিসিপাসকে দেখতে পায় নি। গােলমালে জিসিপাসের ঘুম ভেঙে গেলেও সে মড়ার মতাে পড়ে রইল কারণ তার অস্তিত্ব টের পেলেই চোরেরা তাকে মেরে ফেলবে। সে চুপ করে সব দেখতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যে চোরেদের তর্ক প্রথমে ঝগড়া ও পরে হাতাহাতিতে পৌছল। দু’জনের মধ্যে বেশি যে ষণ্ডা ছিল সে অপরজনকে হত্যা করে সব চোরাই মাল নিয়ে পালালাে। জিসিপাস ভেবেছিল যদি কোনাে বন্যজন্তু তাকে না খায় তাহলে সে আত্মহত্যা করবে কিন্তু এখন সে একটা সুযােগ দেখতে পেল। সে শহর কোটালকে বলবে সে হত্যাকারী তাহলে বিচারক তাকে নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড দেবে। তবে শহর কোটালের জন্যে তাকে অপেক্ষা করতে হল না। চোর খুজতে কয়েকজন রক্ষী সেই গুহায় এসে হাজির। তখন সকাল হয়ে গেছে। মরা চোরের পাশে জিসিপাসকে দেখতে পেয়ে তারা তাকে ধরে নিয়ে গেল।
বিচারক মার্কাস ভ্যাবাে-র দরবারে তাকে হাজির করা হল। ভ্যারাে তাকে জিজ্ঞাসা করলাে, সে কি চোরকে হত্যা করেছে? জিসিপাস বলল, হা, সে হত্যা করেছে। বিচারক সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন। জিসিপাসকে ক্রসবিদ্ধ করে হত্যা করা হবে, সেকালে এই রীতি চালু ছিল।
ভাগ্যক্রমে টাইটাস কোনাে একটা কাজে সেইসময়ে বিচারালয়ে এসেছিল। বিচারক তখন মৃত্যুদণ্ড ঘােষণা করছেন। কি মনে করে টাইটাস আসামীর মুখের দিকে চাইল। চেনা মনে হচ্ছে। একি? এ তাে তার প্রাণের বন্ধু জিসিপাস। তার এমন দুর্দশা কেন? সে মানুষ খুন করেছে? এই জীর্ণশীর্ণ লােকটা একটা মানুষ মেরেছে? হতেই পারে না। তাছাড়া বন্ধুর প্রতি তার তাে কর্তব্য আছে। আসামী হলেও তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে।
জিসিপাসের সঙ্গে পরে কথা বলার সময় পাওয়া যাবে ও কি ঘটেছিল এবং তার এমন দুরবস্থা কি করে হল সেসবও জানা যাবে কিন্তু অবিলম্বে কিছু না করলে জিসিপাসকে হয়ত বাঁচান যাবে।
টাইটাস তখনি বিচারকের সামনে গিয়ে বলল, মারকাস ভ্যারাে হত্যার অপরাধে আপনি যে লােকটিকে এইমাত্র মৃত্যুদণ্ড দিলেন সে নির্দোষ। তাকে আপনি মুক্তি দিন কারণ আমি স্বয়ং হত্যাকারী। আমার কথা বিশ্বাস করুন।
বিচারক টাইটাসের কথা বােধহয় বিশ্বাস করলেন, ভাবলেন আসামীকে দেখে তাে খুনী মনে হচ্ছে না। তাকে ডেকে বললেন, তুমি যে কাজ করাে নি এবং তােমার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে জেনে তুমি দোষ স্বীকার করলে কেন?
জিসিপাস দেখল টাইটাস তার হয়ে শুধুই ওকালতি করছে না, অপরাধও নিজের ঘাড়ে নিয়েছে। সে বুঝলাে টাইটাস এখন প্রকৃত বন্ধুর মতাে তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে।
বিচারকের দিকে মুখ তুলে সে বলল, হুজুর ও যে কাজ করে নি সেজন্যে মিথ্যা বলছে কেন? ও কেন আমার জন্যে মরবে? আমিই হত্যাকারী। ওকে ছেড়ে দিন।
টাইটাস বলল, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না, দেখছে না ও বিদেশী, কতদিন খেতে পায় নি কে জানে, কথা বলতে বলতে হাঁপাচ্ছে, ও কখনও একটা চোরকে মেরে ফেলতে পারে? ওর দারিদ্র্যের জন্যে ও মরতে চাইছে। দণ্ডটা আমাকেই দিন।
দু’জনের কথা শুনে বিচারক ভ্যারাে বুঝলেন এরা দু’জনেই নির্দোষ। কি করবেন যখন চিন্তা করছেন তখন হুড়মুড়িয়ে বিচারালয়ে ঢুকে পড়ল অ্যামবুসটাস নামে এক দাগী চোর। সে বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলল, হুজুর আমি আপনার সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি। শহরের সকলে জানে আমি একজন দাগী চোর। আজ ভােররাত্রে একটা গুহায় চুরির মাল নিয়ে আমার এক সঙ্গী চোরের সঙ্গে মারামারি হয়। আমিই তাকে হত্যা করেছি। এই লােকটিকে আমি গুহার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছিলুম। সকলে জানে টাইটাস একজন বিশিষ্ট ও সৎ ব্যক্তি। সে তার বন্ধুকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল। আপনি ওদের মুক্তি দিন, এখন তাে জানলেন আমিই হত্যাকারী, আমার প্রাপ্য দণ্ড আমাকে দিন।
এই বিচারের কথা চর মারফত সম্রাট অকটেভিয়ানাসের কানে উঠেছে। তিনি জিসিপাস, টাইটাস ও অ্যামবুসটাসকে তার দরবারে তৎক্ষণাৎ তলব করলেন। সম্রাট তিনজনের বক্তব্য শুনলেন। প্রথম দু’জন তাে নির্দোষ তাদের মুক্তি দিলেন। দু’জনকে বাঁচাতে অ্যামবুসটাস নিজের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে এগিয়ে এসেছিল এজন্যে তিনি তাকেও মুক্তি দিলেন।
এবার টাসটাস বন্ধুর হাত ধরে বলল প্রথমে সে তাকে চিনতে পারে নি। তার তখন তাড়াতাড়ি ছিল, ভালাে করে চেয়ে দেখারও অবকাশ পায় নি। জিসিপাস তাকে তখন ডাকল না কেন? যতই জরুরী কাজ থাক না সে নিশ্চই আগে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতাে। চিনব কি করে? যা একখানা চেহারা করেছে না? যাই হােক এখন আমার সঙ্গে আমার বাড়ি চলল।
টাইটাসের বাড়ি পৌঁছবার পর স্লোফানিয়া জিসিপাসের এমন চেহারা দেখে তাে কেঁদেই ফেলল। ভায়ের মতাে তার সেবা ও যত্ন করতে ত্রুটি করলাে না।
জিসিপাসের দাড়ি কামিয়ে চল ছাঁটিয়ে স্নান করিয়ে নতুন পােশাক পরানাে হল। খাইয়ে দাইয়ে সুস্থ করা হল। কয়েকদিনের মধ্যে জিসিপাস যখন সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠল তখন টাইটাস অগ্রণী হয়ে জিসিপাসকে তার সব সম্পত্তির যুগ্ম মালিক করলাে এবং নিজের বােন ফুলভিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে দিল।
ইতিমধ্যে জিসিপাসের সব কাহিনী টাইটাস ও স্লোফানিয়া শুনেছে। ওরা বলল, এথেন্সবাসীরা ততা তােমাকে নির্বাসন দিয়েছে, অতএব ওখানে ফিরে গিয়ে কি করবে। তুমি ফুলভিয়াকে নিয়ে আমার সঙ্গে থাকো। বন্ধুত্বেরই জয় হলাে। জিসিপাস ওদের সঙ্গেই রােমে থেকে গেল। ফুলভিয়াও খুশি, কাউকে ছেড়ে তাকেও কোথাও যেতে হলাে না।
ইচ্ছা থাকলে সাধারণ একজন মানুষ অপরের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, এই কথা বলে ফিলােমেনা তার গল্প শেষ করলাে।
নবম গল্প
ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে সালাদিন টরেলের আতিথ্য গ্রহণ করলাে। ক্রুসেড যুদ্ধ আসন। টরেললা ক্রুসেডে যাবার আগে স্ত্রীকে বলে গেল, নির্দিষ্ট একটি তারিখের মধ্যে সে ফিরে
এলে তার স্ত্রী আবার বিবাহ করতে পারে। ক্রুসেডে গিয়ে টরেললা বন্দী হল কিন্তু বাজপাখি নিয়ে শিকার করায় তার দক্ষতা সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাে। সুলতান তাকে চিনতে পেরে তাকে ভােজনে তৃপ্ত করলাে। টরেলে অসুস্থ হলে পড়লাে কিন্তু এক জাদুকরের সহায়তায় তাকে রাতারাতি তার বাড়ি পাভিয়াতে চালান করে দেওয়া হলাে, যখন তার স্ত্রীর পুনর্বিবাহ আসন্ন। বিবাহ-সভায় তার স্ত্রী তাকে চিনতে পারলাে। তখন দু’জনে বাড়ি ফিরলাে।
টাইটাস এবং জিসিপাস এই দু’জনের বন্ধু প্রীতির ও পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞতার সকল প্রশংসা করলাে। কিন্তু কিং প্যানফিলাে ওদের আর সময় দিলাে না। শেষ গল্প বলবে ডায়ােনিও, তাই নবম গল্পটা সে নিজেই আরম্ভ করলাে।
ফিলােমেনার গল্প আমাদের সকলের ভালো লেগেছে। বিপদে যারা বন্ধুর জন্যে ঝাপিয়ে পড়ে তারাই প্রকৃত বন্ধু। আমিও এমন দু’জন মানুষের গল্প বলবাে সারা পরস্পরের বন্ধু না হলেও তাদের সেবা, কৃতজ্ঞতা ও বিনা স্বার্থে প্রতিদান দেওয়ার কোনাে অভাব হয়নি।
তােমরা তাে জানাে যে রাজা প্রথম ফ্রেডরিকের শাসনকালে মুসলমানদের হাত থেকে পবিত্রভূমি উদ্ধারের জন্যে ক্রুসেড নামে সেই ধর্মযুদ্ধ আবার আরম্ভ হয়েছিল। ব্যাবিলনের সুলতান সালাদিন, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে সে খুব সাহসী যােদ্ধা ছিল। আর একটা ক্রুসেড আসন্ন দেখে সালাদিন স্থির করলাে ক্রিশ্চানরা যুদ্ধের জন্যে কতদূর প্রস্তুত হয়েছে তা সে ছদ্মবেশে ওদের দেশে গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসবে, তাহলে যুদ্ধের জন্যে সেইভাবে প্রস্তুত হবে।
দেশের লােকেদের তীর্থযাত্রায় যাচ্ছি বলে তিনজন সঙ্গী নিয়ে সালাদিন মিশর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে দু’জন পরামর্শদাতাও নিল। ক্রিশ্চানদের অনেক দেশ ঘুরতে ঘুরতে ওরা ইটালিতে আলসের পাদদেশে লম্বার্ডি পৌঁছল। এবার আলপস পর্বত পার হয়ে ওপারে ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে যাবে। পাভিয়া জেলায় পৌঁছে স্ট্রা গ্রামে টরেলাে নামে এক বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে ওদের পরিচয় হলাে। টিচিনাে নদীর ধারে টরেলাের চমৎকার একটি বাংলাে আছে। সে কুকুর, বাজপাখি ও কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে কয়েকদিন বিশ্রাম উপভােগ ও শিকার করবার উদ্দেশ্যে ঐ বাংলােবাড়ির দিকে অশ্বারােহণে যাচ্ছিল।
টরেলাে আগন্তুকদের দেখে বুঝলাে এরা বিদেশী এবং সম্রান্ত, হয়তাে ধনী। এরা বােধহয় কোনাে বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে, দেখা যাক কি বলে। বাস্তবিক সালাদিন স্বয়ং তখন টরেলাের একজন সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করছিল সন্ধ্যার আগে ওরা পাভিয়া পৌঁছতে পারবে কিনা।
টরেলে নিজেই এগিয়ে এসে উত্তর দিল, সন্ধ্যার আগে তাে নয়ই, আপনার যখন পাভিয়া পৌঁছবেন তখন অনেক রাত্রি হয়ে যাবে। শহরে ঢােকবার তােরণ বন্ধ হয়ে যাবে, শহরে ঢুকতে পারবেন না।
ছদ্মবেশী সালাদিন তখন বলল, আমরা বিদেশী। এ অঞ্চল আমাদের চেনা নয়, দয়া করে আমাদের বলে দিন রাতের মতাে আমরা কোথায় আশ্রয় পেতে পারি।
টরেললা বললাে, নিশ্চই ব্যবস্থা হবে। পাভিয়ার কাছে আমার জানা একটা আশ্রয়স্থল আছে। বলতে কি আপনাদের দেখে আমি আমার এক অনুচরকে সেখানে পাঠাতে যাচ্ছিলুম। ভালােই হলাে আমি সেই লােককে আপনাদের সঙ্গে দিচ্ছি, সে আপনাদের সেই বাসায় নিয়ে যাবে, আপনারা আরামে থাকতে পারবেন।
সবচেয়ে চালাকচতুর অনুচরটিকে ডেকে টরেললা তাকে বুঝিয়ে দিলে কি করতে হবে। তারপর দলবলসহ সালাদিনকে সেই বাসায় নিয়ে যেতে বলল। টরেলাে নিজে একটা স্বপথ দিয়ে ঘােড়া ছুটিয়ে তার সেই বাসায় আগেই পৌছে অতিথিদের অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের জন্যে সমস্ত ব্যবস্থা করে নিজে ফটকে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর সেই অনুচর মনিবের নির্দেশমতাে সালাদিনের সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্প করতে করতে ধীরগতিতে এবং ঘােরাপথে সালাদিনকে সেই বাসায় নিয়ে এলাে। বাসাটি যে তার মনিবের একথা অনুচর একবারও প্রকাশ করে নি।
তাদের আগমন দেখতে পেয়ে টরেলাে তাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল। কাছে আসতে বিনীতভাবে তাদের সাদর সম্ভাষণ জানাল।
সালাদিন খুব চতুর, বুঝল টরেলেও খুব চতুর। পাছে সালাদিন তার আতিথ্য গ্রহণ করতে রাজি না হয় এজন্যে টরেলে প্রথমে তাদের নিমন্ত্রণ জানায় নি। কিন্তু যেভাবে হােক বাড়িতে ডেকে আনার পর অভ্যর্থনা জানালে কোনাে অতিথি তা প্রত্যাখান করতে পারে না। অভ্যর্থনার উত্তরে ধন্যবাদ জানিয়ে সালাদিন বলল, আপনি তাে মশাই বেশ মজার মানুষ। আমাদের ফাদে ফেলে আপনি আতিথ্য গ্রহণ করলেন, বােধহয় ভেবেছিলেন যে আমরা আপনাকে অনর্থক কষ্ট দিতে যেন না পারি। না মশাই তা নয়, আমরা এতদূর ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত যে আমরা প্রত্যাখান করতুম না। আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
ঘােড়া থেকে নামবার পর টরেলের পরিচারকেরা ঘােড়াগুলিকে আস্তাবলে নিয়ে গেল। সেখানে তাদের ঘাস ও দানা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। সালাদিন ও তার পার্শ্বচরদের উত্তর ও আরামপ্রদ ঘরে নিয়ে গিয়ে তাদের সর্বপ্রকার স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা হল। টরেলাে নিজে দাঁড়িয়ে তদারক করলাে।
সালাদিন যেমন বুঝতে পারল যে, তাদের এই আশ্রয়দাতা অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি তেমনি টরেললাও বুঝলাে যে তার অতিথিরা সাধারণ ব্যবসায়ী নয়। নিশ্চয় দেশের নেতৃস্থানীয় এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু কোন্ দেশের তা বােঝা যাচ্ছে না যদিও উত্তম ইটালীয় বলছে। টরেলাে পরে জানতে পেরেছিলাে যে ওরা নাকি সাইপ্রাস থেকে আসছে, ব্যবসায়ী!
পরদিন সকালে টরেললা তার এক অনুচরকে নিজের বাড়ি পাঠিয়ে দিলাে। অতিথিদের উত্তমরূপে ভােজন করাতে হবে, তার স্ত্রী যেন সব আয়ােজন করে রাখে। অতিথিরা অত্যন্ত সম্রান্ত ব্যক্তি, তাদের অভ্যর্থনারও যেন যথােপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়। টরেলাের স্ত্রী যথােপযুক্ত ব্যবস্থা করে রাখলাে এবং ভােজনসভায় যােগ দেবার জন্যে পল্লীর কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকেও নিমন্ত্রণ করলাে। বাড়ি ও যে ঘরে অতিথিরা থাকবে সেসব ঘর উত্তমরূপে সাজিয়ে রাখল।
পরদিন সকালে টরেললা তার অতিথিকে নিয়ে বেরলাে, উদ্দেশ্য বাজপাখি নিয়ে শিকার করা। এ কাজে টরেলাে পাকা লােক। তার তুল্য দক্ষ ব্যক্তি দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া যায় না। সালাদিন তার দক্ষতা দেখে মুগ্ধ। টরেলাের প্রচুর প্রশংসা করলাে।
শিকার শেষে বাসায় ফিরে সালাদিন বলল সে পাভিয়া যেতে চায়। টরেলাে বলল সে নিজেই তাদের পাভিয়া নিয়ে যাবে।
সালাদিন ভেবেছিল টরেলাে বুঝি তাদের কোনাে সরাইখানায় পৌঁছে দেবে। তা নয়, টরেলাে তাদের নিজের প্রাসাদে নিয়ে গেল। অত্যন্ত সমাদরের সঙ্গে তাদের অভ্যর্থনা জানানাে হলাে। সালাদিন এমন উত্তম আদর অভ্যর্থনা কোথাও পায়নি। সে টরেললাকে সাধুবাদ জানালাে।।
টরেলের স্ত্রী আহারের অতি উত্তম ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আহারের পর টরেললা তার স্ত্রীর সঙ্গে সালাদিনের পরিচয় করিয়ে দিল। স্ত্রী সালাদিন ও তার পার্শ্বচরদের অত্যন্ত দামী জরির কাজ করা জামা উপহার দিল। সালাদিনের অনুচরদেরও জামা উপহার দেওয়া হলাে।
টরেলো সেদিন সালাদিনকে ছাড়ল না। রাত্রেও বাড়িতে রেখে দিল। রাত্রে ভােজ্য ও পানীয়ের আরও ঢালাও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরদিন সকালে টরেলাে ওদের যাত্রার আয়ােজন করে দিলো। সালাদিনের ঘােড়াগুলি বদলে আরও তেজী ঘােড়া দিল।
টরেলাে ওদের সঙ্গে গিয়ে খানিকটা পথ এগিয়ে দিল। বিদায় নিয়ে ফেরবার সময় সালাদিনকে বলল, আপনাকে কিন্তু সাধারণ ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে না। আপনি সম্ভবত কোনাে দেশের রাজা বা সুলতান।
সালাদিন হেসে বলল, না, আমরা ব্যবসায়ী এবং সুযােগ হলে আপনাকে দেখাব কি নিয়ে আমরা ব্যবসা করি। টরেলাের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সালাদিন বিদায় নিল। সে ঠিক করলাে যুদ্ধ শেষ হলে এবং সুযােগ পেলে টরেলাের এই আন্তরিক আতিথেয়তার প্রতিদান দিতে হবে।।
ইউরােপের দেশগুলি দেখে সালাদিন অ্যালেকজান্ড্রিয়াতে ফিরে গেল এবং আসন্ন ক্রুসেডের জন্যে প্রস্তুত হতে থাকলাে। টরেলােও স্থির করলাে ক্রুসেডে যােগ দিতে সেও পবিত্রভূমিতে যাবে। বিদায় নেবার সময় টরেলাের তার স্ত্রীকে বলল, আমি আমার বংশের ও নিজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য ক্রুসেড যুদ্ধে যােগ দেবার জন্যে যাত্রা করছি। তােমাকে একটা কথা বলে যাই। আমি নাও ফিরতে পারি। তুমি যদি পুনরায় বিবাহ করা তাহলে যেদিন আমার মৃত্যুর নিশ্চিত খবর পাবে তারপর এক বৎসর একমাস ও একদিন অপেক্ষা করবে, তারপর তুমি বিবাহ করবে। তােমার বিবাহের বয়স এখনও পার হয়নি। তুমি সুন্দরী ও অভিজাত বংশের কন্যা, অনেক ভদ্র ব্যক্তি তােমাকে বিবাহ করতে চাইতে পারে। তােমার ভায়েরা ও আত্মীয়রা তােমাকে পুনরায় বিবাহ করতে বাধ্য করতে পারে।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে তার পত্নী বলল, এমন ঘটনা যেন না ঘটে। প্রার্থনা করি তুমি বংশগৌরব রক্ষা করে আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। তবুও যদি তােমার আমার আর দেখা না হয়, আমি যদি তােমার আগে মারা যাই তাহলে আমার এই আংটিটা রাখ, আমাকে মনে পড়বে।
টরেলের আঙুলে তার পত্নী বেশ বড় একটি আংটি পরিয়ে দিলাে। আংটিটি এমনই যে দূর থেকেও সেটি দেখা যায়। এরপর পরস্পরে আলিঙ্গন ও চুম্বন করে বিদায় নিলাে।
বন্দরে গিয়ে পালতােলা জাহাজ চেপে টরেললা অন্যান্য ক্রুসেড যাত্রীর সঙ্গে পবিত্রভূমি অভিমুখে যাত্রা করলাে। যথাস্থানে পৌঁছে টরেললা ক্রিস্টান অভিযাত্রী দলের সঙ্গে মিলিত হলাে। দুর্ভাগ্যক্রমে এ দলটির সকলে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলাে এবং এই সযােগে সালাদিন তাদের আক্রমণ করে সহজে পরাজিত করে বন্দী করলাে। বন্দীদের বিভিন্ন শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে। | টরেললাকে পাঠান হলাে অ্যালেকজান্ড্রিয়াতে। সে তার পরিচয় গােপন রাখলাে। তার ওপর ভার পড়ল বাজপাখি প্রশিক্ষণের। এই বিদ্যা টরেলাের উত্তমরূপে জানা ছিল। কিছুদিন পরে তার দক্ষতার খবর পেয়ে সুলতান সালাদিন স্বয়ং টরেললাকে তার নিজের বাজপাখি সমূহের প্রশিক্ষণের ভার দিলাে। পরস্পর পরস্পরকে কিন্তু তখনও চিনতে পারে নি।
টরেললা কয়েকবার পালাবার চেষ্টা করেছিলাে কিন্তু সফল হয়নি। এই সময় কিছু জেনােয়াবাসী মুক্তিপণ দিয়ে বন্দীদশা থেকে মুক্তি লাভ করলাে। খবর পেয়ে টরেলাে তাদের হাতে তার স্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠালাে। জানালাে সে বেঁচে আছে। পত্নী যেন তার অপেক্ষায় থাকে। যার হাতে চিঠি দিলাে তার সঙ্গে টরেলাের পরিচয় ছিলাে। তাকে বিশেষভাবে অনুরােধ করলাে চিঠিখানা যেন সে তার কাকা পাভিয়াতে যিনি স্যার পিয়েত্রোর অ্যাবট, তার হাতে পৌঁছে দেয়।
বাজপাখিগুলিকে তদারক করতে এসে সালাদিন প্রশিক্ষক অর্থাৎ টরেললাকে ডেকে পাঠালাে। টরেলাে এলাে, দু’জনে কথাবার্তা আরম্ভ হলাে। সালাদিন তখনও টরেলােকে চিনতে পারে নি। তাকে শুধু ক্রিস্টান বলে সম্বােধন করছে। কথা বলতে বলতে সালাদিনের মনে হচ্ছে এ মুখ কোথায় দেখেছি। তারপর টরেলাের হাসির বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে তার চকিতে টরেললাকে মনে পড়ে গেল। এ তাে পাভিয়ার সেই ধনী ব্যক্তি যার আতিথ্যে সে অভিভূত হয়েছিল। সালাদিন কিন্তু তখনও নিজের পরিচয় দিলাে না। তথাপি সন্দেহ দূর করবার জন্যে সালাদিন জেনে নিলাে যে এই ক্রিস্টান ইটালির লম্বার্ড প্রদেশে অন্তর্ভূত পাভিয়া থেকে এসেছে। তার আর কোনাে সন্দেহ রইলাে না। মনে মনে স্থিল করলাে যে টরেলাের আন্তরিক আতিথ্যের প্রতিদান দেওয়ার একটা সুযােগ পাওয়া গেছে।
সালাদিন প্রাসাদে ফিরে আদেশ করলাে যে পােশাকগুলি সে পাভিয়াতে উপহারস্বরূপ পেয়েছে সেগুলি একটি ঘরে সাজাতে। তারপর টরেললাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, ক্রিস্টান, দেখ তাে এই পােশাকগুলি তুমি আগে কখনও দেখেছে কিনা। টরেলাে পােশাকগুলি চিনতে পারলাে। এগুলি তার স্ত্রী ছদ্মবেশী সেই ব্যবসায়ীকে উপহার দিয়েছিলাে কিন্তু এগুলি যে সালাদিনকেই উপহার দেওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে তার সন্দেহ। উত্তরে টরেলাে বলল, আমি ঠিক বলতে পারবাে না তবে মনে হচ্ছে যে সাইপ্রাসের একজন ধনী ব্যবসায়ী আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তখন এগুলি তাদের উপহার দেওয়া হয়েছিলাে।
এই কথা শুনে সালাদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাে না। টরেললাকে আলিঙ্গন করে বলল, আমিই সেই ব্যবসায়ী। তােমাকে বলেছিলুম সুযােগ হলে আমার পণ্য তােমাকে দেখাব, সে সুযােগ এসেছে। তুমি হলে স্ট্রা-এর টরেলাে।
টরেলাে আর কোনাে সন্দেহ রইলাে না। কিন্তু সালাদিনের মতাে মহামান্য অতিথিকে যথাযােগ্যভাবে আপ্যায়িত করতে পারে নি বলে তার অনুশােচনা হতে লাগল।
সালাদিন বলল, টরেলাে এখন তুমি মুক্ত, তুমি আমার বন্ধু। এরপর সালাদিন টরেললাকে নতুন পােশাক পরিয়ে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, এই খিস্টান ভদ্রলােক আমার বন্ধু, তােমরা আমাকে যে সম্মান দেখাও এঁকেও সেই সম্মান দেখাবে, কোনাে পার্থক্য করবে না।
এসব কথা শুনে টরেলাে নিশ্চিত হলাে। বাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছে, স্ত্রী অ্যাডালিয়েটা তার খবর পেয়েছে। তার মন হালকা হলাে। সুযােগ পেলেই দেশে ফিরবে। কিন্তু ওদিকে আর এক কাণ্ড ঘটেছে। টরেলাে যেদিন মুক্তি পেল সেইদিনই আর একজন টরেলাের মৃত্যু হয়েছে। এ হল ডিগনেসের টরেলাে। তাকে কবরও দেওয়া হলাে। কিন্তু যেহেতু স্ট্রা-এর টরেলাে অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল সেহেতু লােকে ধরে নিলাে শেষােক্ত রেললাই মারা গেছে। এবং এই খবর যুদ্ধ ফেরত সৈন্য মারফত ইটালিতে তার কাকা স্যান পিয়েত্রোর অ্যাবট ও তার পত্নী আডালিয়েটার কানেও পৌঁছল। অ্যাডালিয়েটা তাে শােকে ভেঙে পড়ল।
শােক সামলে অ্যাডালিয়েটা যখন উঠে বসলাে তখন তার ভাই ও আত্মীয়রা তাকে আবার বিয়ে করতে বলল। অনেক সুযােগ্য পাত্রও তার বাড়িতে যাওয়া আসা আরম্ভ করলাে। কিন্তু টরেলাে যে তারিখ নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছে সেই তারিখ পার না হলে অ্যাডালিয়েটা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি নয় এবং তখনও বিয়ে করবে কিনা সেকথাও বলতে পারছে না।
এদিকে আর এক কাণ্ড ঘটলাে। টরেলো তার পত্নীকে যে তারিখ দিয়ে গিয়েছিল তারপর একবছর একমাস ও একদিন পারতাে হতে আর মাত্র সাতদিন বাকি আছে। অ্যাডালিয়েটার ভায়েরা বােনের কথা শুনতে রাজি নয়। তারা একটি ভালাে পাত্র ও বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে। টরেলাে তার কাকাকে যে চিঠি পাঠিয়েছিল সে চিঠি কাকা পায় নি, কারণ যে জাহাজে পত্রবাহক ছিল সেই জাহাজ সালাদিনের লােকেরা আটক করে অ্যালেকজান্ড্রিয়াতে ফিরিয়ে আনে।
এই সময় অ্যালেকজাণ্ডিয়াতে টরেলাের সঙ্গে একজন লম্বার্ডবাসীর কথা হলাে। তার সঙ্গে টরেলের পরিচয় ছিল। সে ইতিমধ্যে একবার ইটালি ঘুরে এসেছে। সে তাে টরেললাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, একি টরেললা তুমি বেঁচে আছাে? পাভিয়াতে তাে গুজব তুমি মারা গেছ। তােমার পরিবারের লােকেরাও জানে তুমি মৃত।
এই খবর শুনে টরেললা শােকে মুহ্যমান হয়ে শয্যাগ্রহণ করলাে। তার স্ত্রীও নিশ্চয়ই এই খবরই শুনেছে। হিসেব করে দেখল যে তার তারিখ শেষ হতে আর মাত্র সাত দিন বাকি আছে। তার শ্যালকরা তাে ছাড়বে না। তারা নিশ্চই তাদের বােনের বিয়ে দিয়ে দেবে এবং তা অ্যাডালিয়েটার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সে আর কি করবে? সাত দিনে পাভিয়া পৌঁছনাে অসম্ভব। সে স্থির করলে অনশনে থেকে সে মৃত্যুবরণ করবে। বন্ধু টরেলাের দেখা না পেয়ে সুলতান উদগ্রীব হলাে। যখন শুনলাে যে বন্ধু অসুস্থ, শয্যাশায়ী এবং কোনাে আহার গ্রহণ করছে না তখন নিজে বন্ধুকে দেখতে এলাে।
সালাদিন বন্ধুর করুণ অবস্থা দেখে বলল, তুমি যদি অসুস্থ তাে আমি এখনি আমার ব্যক্তিগত হেকিমকে ডেকে পাঠিয়ে তােমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি কিন্তু তুমি কিছুই খাচ্ছ না কেন? শুনলুম তুমি জলও খাচ্ছ না। কি হয়েছে তােমার? দেশে ফিরতে চাও, বেশ তার ব্যবস্থা করে দেবাে। আগে সুস্থ হয়ে ওঠো।
টরেলাে কিছুতেই বলবে না তার কি হয়েছে। সুলতান অনেক পীড়াপীড়ি করবার পর আসল কারণ বলল। আর মাত্র তিন চারদিন বাকি। সুলতানের দয়ায় সে যখন দেশে ফিরবে তখন তাে তার স্ত্রীর বিবাহ হয়ে যাবে, সে পতির বাড়ি চলেও যাবে।
এই কথা শুনে সালাদিন বলল, সেজন্যে তুমি চিন্তা কোরাে না বন্ধু, আমি তােমাকে রাতারাতি তােমার বাড়িতে এবং যেখানে বলবে সেখানে চালান করে দেবাে। এমন জাদুকর আমার তাবে আছে।
একথা শুনে টরেললা আশ্বস্ত হলাে। সালাদিন তাকে সরবত খাইয়ে তার অনশন ভঙ্গ করালাে। তারপর বললাে, তােমার তারিখ পার হওয়ার আগেই তােমাকে আমি ফিরিয়ে দেবাে, তুমি খাওয়াদাওয়া শুরু করাে, একটু সুস্থ হয়ে নাও। টরেলাে উল্লসিত হয়ে উঠলাে। এই কয়েক দিনেই সে শীর্ণ ও পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিলাে। তার এই চেহারা দেখলে অ্যাডালিয়েটা কষ্ট পাবে। টরেললা খাওয়া-দাওয়া আরম্ভ করলাে।
সালাদিন তার প্রধান জাদুকরকে ডেকে পাঠিয়ে কি করতে হবে বলে দিল। জাদুকর বললাে, এক রাত্রির মধ্যে সে মালিকের যে কোনাে লােককে চালান করে দেবে।
সালাদিন তখন বন্ধু টরেললাকে দেশে পাঠাবার আয়ােজন করতে লাগল। উত্তম খাট ও বিছানা তৈরি হলাে। খাটের যে চাদর পাতা ছিল তার চারদিকে ঝালর। ঝালরে মুক্তো ঝুলছে। পালকের বালিশ, সিল্কের ওয়াড়। টরেলাে এই খাটে শােবে, খাটসমেত তাকে চালান দেওয়া হবে। সেই খাটে উপহারস্বরূপ অনেক মূল্যবান সামগ্রী দেওয়া হল। অ্যাডালিয়েটার জন্যে রত্নখচিত সােনার একটি মুকুট দেওয়া হলাে।
যাত্রার দিন টরেলোকে উত্তম পােশাক পরানাে হলাে। সন্ধ্যার সময় সুলতান বন্ধুর সঙ্গে অনেক কথা বলল। যুদ্ধ শেষ হলে বন্ধু যেন তার পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে তার দেশে আসে। সুযােগ পেলে সুলতান নিজেও যাবে।
সুলতান বিদায় নেবার পরে একজন হেকিমকে সঙ্গে নিয়ে জাদুকর এলাে। হেকিম টরেললাকে ছােটো গেলাসে এক গেলাস সরবত খাইয়ে দিলাে। একটু পরেই টরেললা ঘুমিয়ে পড়লাে। জাগ্রত অবস্থায় কোনাে মানুষ চালান করা যায় না। ওষুধযুক্ত সরবত খাওয়াবার আগে জাদুকর জেনে নিয়েছিলাে ঠিক কোথায় টরেললা পৌঁছতে চায়। টরেলাে বলে দিয়েছিল স্যান পিয়েত্রো গির্জায় তার কাকা অ্যাবটের পাশের ঘরে তাকে যেন পৌঁছে দেওয়া হয়।
জাদুকরের ক্ষমতা অসীম। সে রাতারাতি টরেললাকে পাভিয়ার সেই বিখ্যাত গির্জায় পাঠিয়ে দিলাে।
ভাের হয়েছে। সরবতের ক্রিয়া তখনও শেষ হয়নি। টরেলাে তখনও ঘুমােচ্ছ। ওদিকে গির্জায় ঘণ্টা বাজা শেষ হলাে। কিছু একটা সামগ্রী নিতে একজন মংক বা সাধু ঘরে প্রবেশ করলাে যে ঘরে টরেলাে তার খাটের ওপর শয়ান ছিলাে। ঘরে খাট দেখে তাে মংক হতচকিত। তারপর দেখলাে দামী আরবী পােশাক পরিহিত একজন ব্যক্তি খাটে শুয়ে ঘুমােচ্ছ। তার চারদিকে রয়েছে অনেক মূল্যবান সামগ্রী।
টরেলাের পরনে একেই তাে ভিন্ন দেশীয় পােশাক তারপর দুই গালে দাড়ি। মংক তাকে চিনতে পারে নি। একি ভৌতিক ব্যাপার! সে ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করতে লাগল। চেঁচামেচি শুনে অ্যাবট ছুটে এলেন। চেঁচামেচিতে টরেলােরও ঘুম ভেঙে গেছে। সে খাটে উঠে বসেছে।
অ্যাবট এবং মংকরা কাছে আসতে সাহস করছে না। ভূত না কোনাে আরবী জিন নাকি? ওদের অবস্থা বুঝতে টরেলাে বলল, ভয় পেয়াে না। কাকা তুমি আমায় চিনতে পারছ না? আমি টরেললা। না, আমি মরিনি, আমি ভূত নই। তােমরা বােধহয় অন্য কোনাে টরেলাের মরার খবর পেয়েছে। কাছে এসাে, খাটে বােসসা, সব বলছি।
অ্যাবট খাটে এসে বসলাে। মংকরাও কাছে এলাে। টরেললা তখন আগাগােড়া সবই বলল। এবার সকলে নিশ্চিন্ত হলাে। ভ্রাতুস্পুত্র নিরাপদে ফিরে এসেছে এই উপলক্ষে অ্যাবট বিশেষ প্রার্থনা করলাে। তারপর উপহারের মূল্যবান সামগ্রীগুলি নিরাপদ স্থানে রেখে দিল। খাটখানিও অন্য ঘরে রাখা হলাে।
অ্যাবটের কাছে টরেললা শুনল তার পত্নী তার মৃত্যুর খবর শুনে কয়েকদিন ধরে নিরন্তর কেঁদেছে, কিছু খেতাে না। সে তার ভায়েদের চাপ সহ্য করতে না পেরে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু মন থেকে সম্মতি দেয়নি। আজই তার বিয়ে, সকালে, এখনও কিছু দেরি আছে।
অ্যাবটের কাছ থেকে টরেললা তার স্ত্রীর সঙ্গে যার বিবাহ ধার্য হয়েছে তার নাম জেনে নিয়ে সকলকে বলে দিল যে সে ফিরে এসেছে একথা যেন কঠোরভাবে গােপন রাখা হয়।
অ্যাবটকে টরেললা বলল, কাকা তুমিই তাে বিবাহ দেবে তাই না? আমি তােমার সঙ্গে গিয়ে দেখতে চাই অ্যাডালিয়েটা এই বিয়ে কিভাবে মেনে নিয়েছে। তার আচরণ আমি লক্ষ্য করতে চাই। বিয়ের আগে আনুষ্ঠানিক পর্ব বরের বাড়িতে হবে। সেখানে অ্যাবট যাবেন। তিনি বলে পাঠালেন যে তিনি সঙ্গে এক ভদ্রলােককে নিয়ে যাবেন। তিনি একজন সারাসেন, প্যারিসে রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। বরপক্ষ সম্মতি জানিয়ে বলল, এ তাে আনন্দের কথা। তাকে আমরা যথাযথভাবে অভ্যর্থনা জানাব।
সেই ঝলমলে জরির পােশাক পরে টরেললা তার কাকা অ্যাবটের সঙ্গে বরের বাড়ি গেল। কনে এসে গেছে। মুখখানি ছলছল করছে, উদাস, কোন দিকে দৃষ্টি নেই। ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাে!
টরেললাকে কেউ চিনতে পারলাে না কিন্তু সকলে তাকে সসম্রমে পথ ছেড়ে দিল। অ্যাড়ালিয়েটা একবারও মুখ তুলে চেয়ে দেখল না, কে এলাে, তার কোনাে কিছুতেই আগ্রহ নেই।
তাকে যেন এখনি বলি দেওয়া হবে। ভালাে করে চেয়ে দেখলে অবশ্য অ্যাডালিয়েটা তার স্বামীকে ঠিক চিনতে পারতাে কিন্তু সে তাে কোনাে দিকেই মুখ তুলে চেয়ে দেখছে না।
টরেলো যখন দেখল যে তার স্ত্রী তার দিকে চেয়ে দেখছে না, তখন সে বরপক্ষের একটি বালককে ডেকে বললাে, তুমি কনেকে গিয়ে বলল যে আমাদের দেশে এক রীতি আছে। যদি এই রকম কোনাে বিবাহ তথা ভােজসভায় কোনাে বিদেশী আসে তাহলে কনে যে পাত্র করে সুরা পান করবে সেই পাত্র ভরে বিদেশীকে সুরা পাঠাবে। বিদেশী সেই সুরার অর্ধেক পান করে সুরাপাত্র ফেরত পাঠাবে, বাকি অর্ধেক কনে পান করবে, এতে মঙ্গল হয়, বিবাহিত জীবন সুখের হয়।
বালকের মুখে এই কথা শুনে অ্যাডালিয়েটা নির্দিষ্ট সুরাপাত্রে সুরা পূর্ণ করে ঢাকা দিয়ে সেটি বালক মারফত পাঠিয়ে দিল। টরেললা অর্ধেক সুরা পান করলাে তারপর সকলের অলক্ষ্যে সেই আংটিটি যেটি বিদায়ের সময় তার পত্নী তাকে দিয়েছিল সেটি সুরাপাত্রে ফেলে দিলাে। বালক সুরাপাত্রটি অ্যাডালিয়েটার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
অ্যাডালিয়েটা ঢাকা খুলে বাকি সুরাটুকু পান করলাে কিন্তু তার ওষ্ঠে কিসের স্পর্শ? আঙুল দিয়ে সেটি তুলতেই দেখল এই আংটি যেটি সে তার স্বামীকে বিদায়ের সময় দিয়েছিল। এবার সে বিদেশীর দিকে চোখ তুলে দেখেই স্বামীকে চিনতে পেরে সব ভুলে টেবিল উলটে দিয়ে স্বামীর কাছে গিয়ে সেইখানেই স্বামীকে বুকে জড়িয়ে ধরলাে। কান্নায় ভেঙে পড়ল। স্বামী-স্ত্রী মিলন হয়ে গেলাে।
যার সঙ্গে অ্যাড়ালিয়েটার বিবাহ স্থির হয়েছিল সে শান্ত চিত্তে ব্যাপারটা মেনে নিল এবং সকলকে ভােজে অ্যাপায়িত করলাে। টরেললা সলকে উপহার বিতরণ করলাে তারপর প্রেয়সীকে নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরলাে।
দশম গল্প
গুয়ালতিয়েরি বা সালুজো-র মার্কুইস প্রজাদের অনুরােধে ও চাপে পড়ে বিয়ে করলাে। খামখেয়ালি শুয়ালতিয়েরি নিজের ইচ্ছা ও পছন্দমতাে এক চাষীর মেয়েকে বিয়ে করলাে। ওদের দুটি সন্তান হল। সন্তান দুটিকে সে অন্যত্র সরিয়ে স্ত্রী বলল তাদের মেরে ফেলেছি। কিছুদিন পরে সে তার স্ত্রীকে বলল আমি তােমার ওপর বিরক্ত। আমি আবার বিয়ে করেছি বলে নিজেরই বড় মেয়েকে দেখিয়ে দিল। ইতিমধ্যে বৌকে এক বস্ত্রে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু গুয়ালতিয়েরি যখন তার স্ত্রীর সহ্যশক্তি এবং বিনা প্রতিবাদে সবকিছু মেনে নেওয়া লক্ষ্য করলাে তখন সে মহাসমাদরে স্ত্রীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনল। সন্তানদের দেখাল এবং স্ত্রীকে তার মাচিওঁনেস বলে ঘােষণা করলাে এবং সকলকে বলে দিল তারাও যেন তার পত্নীকে যথাযােগ্য সম্মান দেখায়।
প্যানফিলাে তার গল্প শেষ করলাে। টরেলাে ও অ্যাডালিয়েটার পরস্পরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। এবং শত্রুর প্রতি সুলতান সালাদিনের উদারতার সকলে প্রশংসা করলাে। এবার শেষ গল্পটি বলবে, ডায়ােনিও। সে বলল, আমি এক মাকুইসের গল্প বলবাে কিন্তু সেই সঙ্গে পরামর্শ দেব ঐ মাকুইসের রীতিনীতি কেউ যেন অনুসরণ না করে। কারণ মার্কুইস নিজে সফল হলেও সকলে সফল না হতেও পারে। তাহলে গল্পটা শুনে তােমরাই বিচার করে কি করবে না করবে।
শুয়ালতিয়েরি যখন যুবক তখন উত্তরাধিকার সূত্রে সে সালুজো-র মার্কুইস হলাে। তখনও সে অবিবাহিত। শিকার আর বাজপাখি নিয়েই সে তার সময় অতিবাহিত করতাে। তার প্রজারা তাকে বিবাহ করে সংসারধর্ম পালন করবার জন্য অনুরােধ করতে লাগল। এমন বাউণ্ডুলের মতাে ঘুরে বেড়ানাের কোনাে অর্থ হয় না। আপনার উত্তরাধিকার না থাকলে এই বিশাল জমিদারি তছনছ হয়ে যাবে, পাঁচজনে লুটেপুটে খাবে। তারা রীতিমতো চাপ দিতে লাগল। তারা বলল, আমরা না হয় উত্তমবংশ থেকে আপনার জন্যে উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে আনব। যে মেয়ে আপনাকে নিশ্চয়ই সুখী করবে।
শুয়ালতিয়েরি বলল, দেখ বাপু তােমরা হয়তাে চেষ্টা করে ভালাে বাপ-মা দেখে আমার জন্যে সুন্দরী একটি মেয়ে খুঁজে আনবে কিন্তু বাপ-মা ভালাে হলেই যে মেয়ে ভালাে হবে তার কোনাে মানে নেই। বিয়ে মানে নানা ঝামেলা। সেই মেয়ে আমার ঝামেলা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে আমি নিজেই মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে করবাে। সে মেয়ে যদি ভালাে না হয় তাহলে তােমাদের দোষের ভাগী হতে হবে না।
প্রজারা বলল, আপনি যদি নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেন তাহলে আমাদের বলার কিছু নেই, সে তাে সুখের ও আনন্দের কথা।
কিছুদিন পূর্বে পাশের এক গ্রামে দরিদ্র এক চাষী পরিবারে একটি তরুণীকে দেখে শুয়ালতিয়েরির মনে হয়েছিল খুব ভালাে। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, পরিশ্রমী। কোনাে দিন মুখ তুলে ওয়ালতিয়েরিকে ভালাে করে চেয়ে দেখেনি। মেয়েটিকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। এ মেয়ে তার সংসারে এসে মার্চিওনেস হতে পারবে।
শুয়ালতিয়েরি একদিন একা সেই কৃষকের বাড়ি গিয়ে হাজির। দরিদ্র কৃষককে সে বলল, সে তার মেয়েটিকে বিয়ে করবে এবং যে কোন একদিন এসে সে মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবাহপূর্ব মিটিয়ে নেবে।
শুয়ালতিয়েরি একদিন তার প্রজাদের ডেকে বলল সে মেয়ে পছন্দ করেছে। শীঘ্রই বিবাহ হবে। বিবাহ উৎসব যাতে সফল হয় সেজন্যে তােমাদের আমি আহ্বান করছি। একথা শুনে সকলে আনন্দ প্রকাশ করে সম্পূর্ণ সহযােগিতা করতে রাজি হল।
যথাসময়ে সকলে বিবাহের আয়ােজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কিন্তু পাত্রী কোথায় আছে সে কথা গুয়ালতিয়েরি প্রকাশ করেনি। প্রজারাও জিজ্ঞাসা করতে পারছে না কারণ তারা বলেছে মাকুইস যাকে ইচ্ছে বিয়ে করুন, তারা কিছু জিজ্ঞাসা করবে না, মতামতও প্রকাশ করবে না। অতএব সকলে চুপচাপ কাজ করতে লাগল।
বিরাট আয়ােজন। আত্মীয়, স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কুটুম্ব, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়াও জমিদারির সকলকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সকলেই ব্যস্ত। প্রজারা একবাক্যে জানিয়ে দিল মাকুইস যাকেই বিয়ে করে আনুন না কেন তারা তাকে। যথাযােগ্য সমাদরে প্রাসাদে অভ্যর্থনা জানাবেন। বিরাট ভােজের বিরাট আয়ােজন সম্পূর্ণ হলাে।
নববধুর পােশাক পরিচ্ছদ ও অলংকার ইত্যাদিও প্রস্তুত। রত্নখচিত সােনার একটি মুকুটও তৈরি করানাে হয়েছে।
এদিকে পাত্রীপক্ষ কিছু জানে না। সেই কবে একদিন মার্কুইস মেয়েটিকে বিয়ে করার ইচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন তারপর আর দেখা নেই। নির্দিষ্ট তারিখে অনেক সঙ্গী নিয়ে মাকুইস পাত্রীর বাড়ি গিয়ে হাজির। পাত্রী তখন মলিন ও সেলাই করা একটি পােশাক পরে পাতকুয়া থেকে জল তুলে আনছিল।
গ্রামে পৌঁছে সঙ্গীদের অপেক্ষা করতে বলে মাকুইস সেই দরিদ্র কৃষকের বাড়ি গেল। জলের পাত্রসমেত পাত্রীকে দেখে মাকুইস তার বাবাকে ডেকে দিতে বলল। বাবা তাে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ব্যাপার দেখে হতভম্ব।
পাত্রীর নাম গ্রিসেল। সে তাে সব শুনে লজ্জায় রাঙা হয়ে গেছে। বাবা এসে সব শুনলাে। বিবাহের সমস্ত আয়ােজন সম্পূর্ণ। মার্কুইস স্বয়ং এসেছেন মেয়েকে নিয়ে যেতে, এর চেয়ে মেয়ের সৌভাগ্য আর কি হতে পারে? আপত্তি করার কোনাে প্রশ্নই ওঠে না।
যদিও বিবাহের সমস্ত আয়ােজন সম্পূর্ণ তথাপি গ্রিসেলডার বাবাকে গুয়াতিয়েরি বলল, আমি তােমার মেয়েকে কিছু প্রশ্ন করবাে। প্রশ্নগুলি শুনে সে যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয় তবেই আমি তাকে নিয়ে যাব।
মেয়েকে ডাকা হলাে। শুয়ালতিয়েরি তাকে বলল, সে নিজে যে সকল কাজ করবে বা গ্রিসেলডাকে যেসব কাজ করতে হবে সবই বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে হবে বা কাজ করতে হবে, কোনাে মতামত প্রকাশ করা চলবে না এবং তাকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখবে। গ্রিসেলডা যদি রাজি থাকে তাহলে শুয়ালতিয়েরি তাকে বিবাহ করবে। গ্রিসেলডা সরল বালিকা, ঘােরপ্যাচ বােঝে না। সে জানে স্বামী সেবাই প্রতিব্রতা নারীর কর্তব্য। সে তার সম্মতি জানাল। সে স্বামীর কোনাে কাজে প্রতিবাদ জানাবে না, কোনাে মতামতও প্রকাশ করবে না। সে তার কর্তব্য করবে।
গুয়ালতিয়েরি তখন গ্রিসেলডার হাত ধরে তার অপেক্ষমান সঙ্গীদের কাছে নিয়ে এসে তার মলিন ও সেলাই করা পােশাক খুলে তাকে সম্পূর্ণ নিরাবরণ করলাে। গ্রিসেলডা কোনাে প্রতিবাদ করলাে না। তাকে নতুন পােশাক ও অলংকার পরানাে হলাে। চমৎকার মানিয়ে গেলাে। কে বলবে গ্রিসেলডা দরিদ্র কৃষককন্যা?
গুয়ালতিয়েরি এবার তার সঙ্গীদের সমক্ষে গ্রিসেলডাকে প্রশ্ন করলাে, তুমি আমাকে তােমার বিবাহিত স্বামী বলে স্বীকার করতে রাজি আছ তাে?
আমি রাজি আছি। আমিও তােমাকে আমার বিবাহিত পত্নী বলে মেনে নেব।
এরপর প্রিসেলকে একটি টাটু ঘােড়ায় চাপিয়ে শােভাযাত্রা করে প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হলাে এবং সাড়ম্বরে বিবাহ অনুষ্ঠান ও ভােজ সমাপ্ত হলাে। এমন জাঁকজমক ও ভােজ সালজোর নরনারী দীর্ঘদিন দেখে নি। | দরিদ্র পরিবার থেকে এলেও গ্রিসেলডা দ্রুত নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিল। সে তাে প্রখর বুদ্ধিমতী ছিল তাই তার কোনাে অসুবিধে হল না। পরিচারিকা ও পরিচারকেরা তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট। শুয়ালতিয়েরিও সন্তুষ্ট। সে মনের মতাে বউ পেয়েছে। গ্রিসেলডাকে এখন দেখলে মনে হবে সে বুঝি কোনাে অভিজাত বংশের কন্যা, সাধারণ এক দরিদ্র চাষী ঘরের মেয়ে নয়। সকলেই ভেবেছিল গুয়ালতিয়েরি তার বন্ধু নির্বাচনে ভুল করেছে কিন্তু এখন সকলে একবাক্যে স্বীকার করে, না ভুল হয় নি।
ওদের প্রথম সন্তানটি হল কন্যা। কন্যা বলে আনন্দের কোনাে অভাব হয়নি। কন্যাটিকে গ্রিসেল নিজেই লালন করতে লাগল, দাসদাসীর সাহায্য নিত না।
এরপর শুয়ালতিয়েরি তার পরীক্ষা আরম্ভ করলাে। গ্রিসেলডার কাজের খুঁত ধরে তাকে বাক্যবাণে অস্থির করে তুলতে লাগল। সব কাজেই গুয়ালতিয়েরি তার দোষ ধরে, যা ইচ্ছে তাই বলে কিন্তু গ্রিসেলডা যেন মূক ও বধির। সে কোনাে উত্তর দেয় না। সে স্বামীকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কর্তব্যে কখনও অবহেলা করে না, এমনকি অভিমানটুকুও করে না উপরন্তু স্বামীর সেবাযত্নেও কোনাে ফাক রাখে না।
শুয়ালতিয়েরি একদিন বেশ রাগত স্বরেই গ্রিসেলডাকে বলল, প্রথম সন্তানটিই তুমি কন্যা প্রসব করেছ। আমার প্রজারা এটা ভালাে মনে নেয় নি। তারা অমঙ্গল আশংকা করছে।
গ্রিসেলডা কোনাে প্রতিবাদ করলাে না। সে বলল, তুমি যা ভাল বােঝাে করাে। আমি চাই তুমি শান্তিতে থাক। মেয়েকে নিয়ে তােমার যা ইচ্ছা করতে পারে আমি কিছু বলব না। আমি যেমন আছি তেমন থাকবে।
শুয়ালতিয়েরি প্রকাশ না করলেও এইরকম উত্তর সে আশা করে নি। মনে মনে সে তার প্রশংসা করলাে। সেইদিনই সে একজন লােককে গ্রিসেলডার কাছে পাঠাল। লােকটি এসে বলল, আমি মনিবের চাকর, তিনি যা বলবেন আমাকে তাই করতে হবে। তিনি আমাকে আদেশ করেছেন আপনারা কন্যাটিকে নিয়ে গিয়ে..ক্ষমা করবেন, আমি বলতে পারছি না।
লােকটি কি বলতে চায় তা গ্রিসেলডা বুঝতে পারল। মেয়েটিকে হত্যা করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। সে একটুও বিচলিত না হয়ে মেয়েটিকে নিয়ে এলাে। তারপর তাকে চুম্বন করে ঘাতকের হাতে তুলে দিয়ে বলল, তােমারও যিনি মনিব তিনি আমারও মনিব, তিনি যে আদেশ দিয়েছেন তা পালন করাে তবে দেখাে এর কচি দেহটা যেন পশুপাখি ছিড়ে না যায়। তবে তিনি যদি এরকম আদেশই দিয়ে থাকেন তাহলে আলাদা কথা।
লােকটি মেয়েটিকে শুয়ালতিয়েরির কাছে নিয়ে গেল। সে লােকটির মুখে গ্রিসেলডার কথা শুনে অবাক। যাই হােক মেয়েকে সে তার এক আত্মীয় এক কাউন্ট অফ পাগানাের পরিবারের বলােনায় পাঠিয়ে দিল। মেয়ে সেখানে সযত্নে লালিত হতে লাগল। এ খবর অবশ্যই গােপন রইল। কেউ জানল না।
কিছুদিন পরে গ্রিসেল একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলাে। ছেলে হওয়াতে সকলেই আনন্দিত। কিন্তু স্ত্রীর কাছে গুয়ালতিয়েরি এমন ভাব দেখাতে লাগল যেন সে একটুও আনন্দিত হয়নি। সে স্ত্রীকে যেমন গালমন্দ করছিল তেমনি করতে লাগল।
এইভাবে কিছুদিন কাটল। শুয়ালতিয়েরি সহসা একদিন গ্রিসেলডাকে বলল, প্রজারা আমার ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছে। তারা বলছে যে গিয়ানুলােল অর্থাৎ তােমার বাবা যে নাকি এখনও জমি চাষ করে, ভেড়া চরায়, তার নাতি আমাদের জমিদার হবে? এ হতে পারে না। মাকুইসের বংশমর্যাদা তাহলে থাকল কোথায়? এসব চলবে না। এ ছেলে আমাদের জমিদার হওয়া তাে দূরের কথা, সালুজোতে থাকলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রজারা বলছে আমার সমতুল বংশের অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে। আমি কোনাে প্রতিবাদ করি নি।
এবারও গ্রিসেলডা একটুও বিচলিত হল না। সে বলল, আপনি কেন বৃথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। আমি তাে আগেই বলেছি আপনার শান্তিতে আমার শান্তি। আপনি যদি ছেলেটিকে তার দিদির পথে পাঠাতে চান বা আবার বিবাহ করতে চান তাে করুন। আমার কিছুতেই আপত্তি নেই। যে কাজ করে আপনি সন্তুষ্ট হবেন আমি সে কাজে আপনাকে কণামাত্র বাধা দেব না।
আগের বারের মতাে এবারও একটি লােক এসে ছেলেকে নিয়ে গেল এবং শুয়ালতিয়েরি সকলের অজ্ঞাতে তাকে বলােনায় তার সেই আত্মীয় কাউন্ট পাগানাের পরিবারে পাঠিয়ে দিল।
গুয়ালতিয়েরির পরিবারের মেয়েরা এ কাজ সমর্থন করলাে না। তারা প্রতিবাদ করতে লাগল কিন্তু গ্রিসেলডার চোখে জল নেই, সে যেমন ছিল তেমনি রইল। গ্রিসেলডার ধৈর্য ও একান্ত পতিভক্তি দেখে অবাক। প্রজারাও এ কাজ সমর্থন করেনি। তারা কেউ কেউ তাকে নিষ্ঠুর বলতেও দ্বিধা করেনি।
শুয়ালতিয়েরি গ্রিসেলডার সঙ্গে যেমন দুর্ব্যবহার করছিল তা হ্রাস পাওয়া দূরের কথা বরঞ্চ বেড়েই চলল। সে ঠিক করলাে এবার চরম পরীক্ষা করতে হবে।
গ্রিসেলডা এবং তার পরামর্শদাতাদের কিছু জাল কাগজপত্র দেখিয়ে শুয়ালতিয়েরি বলল, মহামান্য পােপ আমার পত্নীকে পরিত্যাগ করে আবার বিবাহ করার আদেশ দিয়েছেন। আমিও তাই। করবাে স্থির করেছি। আমি কাউন্ট পাগানের পরিবারের একটি কিশােরীকে বিবাহ করবাে।
প্রজারা ও পরামর্শদাতারা গ্রিসেলডার পক্ষ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানাল, কারণ গ্রিসেল তাদের মন জয় করেছিল। তাদের কাছে গ্রিসেলডা আদর্শ মানবী, দেবী বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। কিন্তু শুয়ালতিয়েরি কারও কথায় কান দিল না। সে গ্রিসেলডাকে বলল, তুমি আর আমার স্ত্রী নও, পােপের আদেশে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তুমি যে সব পণ সঙ্গে এনেছিলে তা ফিরিয়ে নিয়ে তােমার বাপের বাড়ি বা যেখানে ইচ্ছা চলে যাও।
গ্রিসেলডা এবারও একটুও প্রতিবাদ করলাে না। এ যেন স্বাভাবিক ব্যাপার, কিছুই নয়। সে বলল, আপনার প্রজারা সত্যি কথাই বলেছে। আপনার মতাে অভিজাত পরিবারে আমার মতাে মেষপালক পরিবারের মেয়েকে আপনি যে দয়া করে স্থান দিয়েছিলেন এজন্যে আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আপনার সুখেই আমার সুখ। আমি এখনই পিতৃগৃহে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আমি তাে কোনাে পণ আনি নি। আপনি আমাকে উলঙ্গ করে এনেছিলেন, এখন আপনার সকল পােশাক পরিচ্ছদ ও অলংকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই দেব। তবে আমি এমন একটি জিনিস সঙ্গে এনেছিলুম তা আর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। সে তাে আর ফেরানাে যাবে না। তাই আপনার কাছে আমার শেষ নিবেদন নারীর নগ্নতা ঢাকতে আপনি আমাকে একটি বস্ত্রখণ্ড অন্তত ধার দিন। পিতৃগৃহে পৌছেই সেটি আমি ফেরত পাঠিয়ে দেব। তবুও আপনি যদি বলেন যে তােমাকে নগ্ন করে আমার কাছে এনেছিলুম, তুমি নগ্ন হয়েই যাবে, বেশ আমি তাই যাবাে।
শুয়ালতিয়েরি বলল, হ্যা তুমি যাও। কিন্তু বাড়ির মেয়েরা গুয়ালতিয়েরিকে দুর্বাক্য বলতে আরম্ভ করল। তখন শুয়ালতিয়েরি একজন পরিচারিকাকে আদেশ করতে সে একখণ্ড বস্ত্র এনে দিল। গ্রিসেলডা সমস্ত পােশাক ও অকার খুলে নগ্ন হয়ে সেই বস্ত্রখণ্ড দ্বারা দেহ কোনােরকমে আবৃত করে প্রাসাদ থেকে চলে গেল। সকলে যে পরিমাণে গ্রিসেলডার প্রশংসা করলে সেই পরিমাণে শুয়ালতিয়েরির নিন্দা করতে লাগল।
গ্রিসেলডার পিতা গিয়ানুলােলের আশংকা ছিল যে, তার মেয়ে একদিন তার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হবে কারণ বড়লােকের কি খেয়াল হয়েছে গরিবঘরের মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে গেছে, একদিন বিদেয় করে দেবে। তাই হল। গিয়ানুলােল মেয়ের সমস্ত পােশাক এবং শেষ যে জামাটি পবেছিল সেটিও যত্ন করে তুলে রেখেছিল। এখন মেয়ে ফিরে আসায় সেই পােশাকটি বার করে দিল।
গ্রিসেলডা চলে যাওয়ার পরে শুয়ালতিয়েরি ঘােষণা করলাে যে বলােনার অভিজাত কাউন্ট।
পাগানাের পরিবারের একটি কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ স্থির হয়েছে। একটা তারিখও বলল এবং সকলকে অনুরােধ করলাে বিবাহ ও ভােজসভার আয়ােজন করতে। লােকে হাত লাগাল ঠিকই কিন্তু গ্রিসেলডার বিয়ের সময় যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে মেতে উঠেছিল তা এবার অনুপস্থিত। বিবাহের তারিখ ধার্য করে গুয়ালতিয়েরি একদিন গ্রিসেলডাদের বাড়ি গিয়ে তাকে বলল, আমার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে। বাড়িতে নতুন বন্ধুকে নিয়ে আসব কিন্তু নববধূ তার আত্মীয়রা এবং নিমন্ত্রিত মহিলাদের অভ্যর্থনা করে ঘরে আনবার মতাে কোনাে মহিলা নেই। তােমাকেই সেই কাজটি করতে হবে, তুমি আমার সঙ্গে চলাে। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে তুমি আবার তােমাদের বাড়িতে ফিরে আসবে।
গ্রিসেল আদেশ পালন করতেই অভ্যস্ত, প্রতিবাদ করতে নয়। পােশাকগুলির মধ্যে যেটি একটু ভদ্র, সেটা মােটা কাপড়ের এবং কিছু বিবর্ণ হয়ে গেলেও সেইটি পরেই গ্রিসেলা গুয়ালতিয়েরির বাড়িতে এলাে। বাড়িত এসে একাই বাড়ি পরিষ্কার করলাে, ঘরদোর সাজাল, আসবাবগুলিও ঝেড়েমুখে পরিষ্কার করলাে, দেওয়ালে টাঙানাে ছবির কাচ ঝাড়বাতি সবই সাফসুতরাে করা হল। বাড়ির চেহারাই পালটে গেল। তারপর নিমন্ত্রণ পর্ব সমাপ্ত করে নববধূর আগমন প্রতীক্ষা করতে লাগল।
গুয়ালতিয়েরি ও গ্রিসেলভার সেই কন্যা ও পুত্র অতীব যত্নের সঙ্গে লালিত ও শিক্ষিত হয়েছে। বয়স এখন তােরা, পুত্রের বয়স ছয়। কন্যাটি সুন্দরী হয়েছে, মায়ের চেয়েও। প্রথমেই আকর্ষণ করে হরিণের মতাে তার চোখ।
আত্মীয়-কুটুম্ব নিমন্ত্রিত পুরুষ ও নারীতে বাড়ি জমজমাট। তাদের পােশাক ও অলংকার দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় কিন্তু গৃহকত্রীর পরিধানে সেই মােটা কাপড়ের জীর্ণ পােশাকটি।
শুয়ালতিয়েরি একটি চালাকি করলাে। নির্ধারিত তারিখে সে তার মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে বিবাহসভায় উপস্থিত হয়ে মেয়েকে দেখিয়ে বলল, এই আমার কনে, গ্রিসেলডা ভালাে করে দেখ তােমার কি মনে হয়?
খুব ভালাে, মেয়েটি সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী ও কর্তব্যপরায়ণ মনে হচ্ছে, আপনাকে সন্তুষ্ট রাখতে পারবে। গ্রিসেলডা কিন্তু তার মেয়েকে চিনতে পারে নি। এ বাড়ির মহিলারা বলল, গুয়ালতিয়েরি গ্রিসেলডাকে এক প্রস্ত নতুন পােশাক ও অলংকার দাও নয়তাে আমরা ওকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তােমার এ কি রকম আচরণ? গৃহকত্রীর কি মানমর্যাদা নেই। অন্য মেয়ে হলে তােমাকে দেখিয়ে দিত।
শুয়ালতিয়েরি তাদের অনুরােধ সাড়া দেয়নি কিন্তু সে স্বীকার করলাে এই চরম পরীক্ষায় গ্রিসেলডা সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। সে তখন গ্রিসেলডার কাছে এগিয়ে এসে তার এক কাঁধে হাত রেখে বলল। প্রিসেলডা আজ তুমি জয়ী, আমি পরাজিত। তােমার অসীম ধৈর্য ও সহ্যশক্তি দেখে আমি অবাক হয়েছি। এই মেয়েটি আমার বন্ধু নয়, আমাদের কন্যা। আর ছেলেটিও আমাদেরই, বলে গুয়ালতিয়েরি গ্রিসেলডাকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করলাে।
লজ্জায় সংকুচিত গিসেলডা স্বামীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে মেয়ে ও ছেলেকে কাছে টেনে নিল। মাতৃহৃদয় উদ্বেলিত হল। অঝাের ধারায় চোখের জল গাল বেয়ে পড়ে তার বুক ভিজিয়ে দিল।
স্বামী-স্ত্রীর এই পুনর্মিলনে সকলে আনন্দিত। উৎসব অন্য এক রূপ নিল। সকলে বুঝল গুয়ালতিয়েরি স্ত্রীকে পরীক্ষা করবার জন্য অভিনয় করেছিল। মহিলারা গ্রিসেলডাকে সবচেয়ে উত্তম একটি পােশাক পরিয়ে দিল এবং অলংকার। গ্রিসেলডাও যেন নবজীবন লাভ করে এক মহীয়সী রমণীতে পরিণত হল। এবার শুধু হাসির বন্যা। উৎসববাড়ি কলকোলাহলে মুখরিত।
যথাসময়ে শুয়ালতিয়েরি তার শ্বশুরকে জমিজমা ইত্যাদি দিয়ে সসম্মানে উপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলাে। সকলে গুয়ালতিয়েরির জয়জয়কার করতে লাগল। মহিলারা এখন থেকে মেয়েদের কাছে গ্রিসেলডার কাহিনী বলে তার মতাে সহনশীল হবার শিক্ষা দিতে লাগল। গ্রামের রমণীরা মনে করতে লাগল গ্রিসেলডা মানবী নয়, আসলে স্বর্গের কোনাে শাপভ্রষ্টা দেবী, মানবদেহে ধরায় অবতীর্ণ হয়েছে।
প্যানফিলাের মর্মস্পর্শী গল্পটিও শেষ হল আর সূর্যও পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে ঢলে পড়ল। ডেকামেরনেরও দশ দিন শেষ হল, এবার ঘরে ফেরার পালা। পুরুষরা মেয়েদের বাড়ি ফেরার সকল ব্যবস্থা করে দিল কিন্তু সকলে নিজের বাড়ি ফিরল না। তারা মনে করলাে ফ্লোরেন্সে ফিরে যাওয়া এখনও নিরাপদ নয়। তারা কোনাে আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি গেল।
সেদিন লরেতা নৃত্যে ও কিয়ামমেত্তা গানে সকলকে মুগ্ধ করেছিল।