হানড্রেড রোমান্টিক নাইটস্ – গিয়ােভানি বােকাসিও (নবম দিন)

›› অনুবাদ  ›› ১৮+  

গিয়ােভানি বােকাসিও-র ডেকামেরন টেলস এর বাংলা অনুবাদ।

 ডেকামেরনের নবম দিবস আরম্ভ হল। এ দিনের কুইন হল এমিলিয়া। গল্প বলার জন্যে সে নির্দিষ্ট কোন নিয়ম বেঁধে দেয় নি তাই যে যার ইচ্ছামতাে গল্প বলবে।

এমিলিয়াই সবার আগে উঠল। ঘরের বাইরে এসে দেখল পুব দিকে আলাের আভা দেখা দিয়েছে কিন্তু তখনও কয়েকটা তারা আকাশে দীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। পাখিদের কলকাকলি আরম্ভ হয়েছে। মৃদু বাতাস বইছে। এমিলিয়া সকলকে তুলে দিয়ে বলল, চলাে বাইরে চলাে। দেখবে খুব ভালাে লাগবে, প্রকৃতির কি সুন্দর শােভা। রানী স্বয়ং ডাকছে অতএব সকলকে উঠতে হল। হাই তুলতে তুলতে বাইরে এসে তাদের সত্যিই খুব ভালাে লাগল।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা কাজেই একটা বনে পৌছল। বনে হরিণ, খরগােশ আরও কয়েক রকম ছােট প্রাণী নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে মজা লাগছে কাঠবেড়ালিদের কাণ্ড দেখে। আর পাখির বুঝি শেষ নেই, কত রকম আর কত রঙের পাখি। ফুল আর প্রজাপতির মেলা বসেছে। গাছের ফাক দিয়ে কচি সােনালি রােদ। না এলে প্রকৃতির এমন অপূর্ব সৌন্দর্য ওরা উপভােগ করতে পারতাে না। এমিলিয়াকে সকলে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, সুন্দরী তাে, তাই সবকিছু সুন্দর ওর ভালাে লাগে, অপরকেও ভালাে লাগাতে চায়।

গাছ থেকে ফুল তুলে কেউ মালা গাঁথল কেউ বা তােড়া। একজন শুধু নানারঙের কচিপাতা তুলল, ফুলদানিতে রাখবে। মাঝখানে শুধু একটা বড় ফুল দেবে, পাতারও বাহার কম নয়। পাখির গান শুনে, গায়ে বাতাস লাগিয়ে, হাতে ফুলের গুচ্ছ নিয়ে কেউ কেউ মদ স্বরে গান গাইতে গাইতে ঘরে ফিরে বেশবাস পরিবর্তন করে বাগানে এসে দেখল স্টুয়ার্ড টেবিলে সাজিয়ে ব্রেকফাস্ট পরিবেশন করছে।

ব্রেকফাস্টের পর সম্মিলিত নৃত্যগীত হল। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম। ইতিমধ্যেই কুইন রান্নাঘর পরিদর্শন করে এসে বলল, চলাে সবাই চলাে, গল্প বলার আসরের সময় হয়ে এলাে। কুইন বলল, আজ প্রথম গল্প বলবে ফিলামেনা।

 

প্রথম গল্প

রিনুচিয়াে আর আলেসান্দ্রো দুই যুবক ফ্রানসেসকা নামে তন্বী এক যুবতীকে ভালবাসত। কিন্তু যুবতী ওদের দুজনের কাউকেই ভালবাসত না। ওদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে যুবতী একজনকে বলল সে যেন কবরখানায় মড়ার মতাে পড়ে থাকে। আর একজনকে বলল, কবরখানা থেকে একটা মড়া তুলে আনতে। পারলে তাকে সে ভালবাসবে কিন্তু দুজনেই বিফল হল। ফ্রানসেসকাও মুক্তি পেল।

ফিলােমেনা বলল, আমি নিশ্চই খুব ভাগ্যবতী। প্রথম গল্প বলার সম্মান আমাকে দেওয়া হল। যাই হােক প্রেমের শক্তি অসীম, এর গতিও বিচিত্র। কখনও কে যে কার প্রেমে পড়ে বা প্রত্যাখান করে কেউ বলতে পারে না। আবার দেখ প্রেমের জন্যে মানুষ অসাধ্য সাধন করে। আবার দেখ অসাধ্য সাধন করেও অপর পক্ষের মন পাওয়া যায় না। আমার গল্পটা শুনে দেখ তাে তােমাদের কেমন লাগে না কোন্ পক্ষ তােমরা সমর্থন করবে, মতামতই বা কি দেবে। তাহলে আরম্ভ করি:

পিসততাইয়া শহরে একদা এক অতি সুন্দরী বিধবা যুবতী বাস করতাে। ঘটনাচক্রে দু’জন যুবক ফ্লোরেন্স ত্যাগ করে ঐ পিসতােইয়া শহরে বাস করছিল। ঐ দু’জন যুবকই বিধবা যুবতীর প্রেমে পড়ল। একজনের নাম রিনুচিয়াে আর অপরজনের নাম আলসান্দ্রো। দু’জনে পরস্পরের বন্ধু কিন্তু জানত না যে ওরা দুজনেই একই যুবতীর প্রেমে পড়েছে।

যুবতীর নাম ফ্রানসেসকা। যুবক দু’জন ফ্রানসেসকাকে নানাভাবে বিরক্ত করে মারছিল। নানা প্রকার প্রস্তাব পেশ করছিল। নানা প্রলােভন দেখাচ্ছিল কিন্তু কিছুতেই তাকে আকৃষ্ট করতে পারছিল না। যুবতীও দু’জনকে এড়াবার জন্যে নানারকম ফন্দী আঁটছিল কিন্তু কোনােটাই মনঃপূত হচ্ছিল না, কার্যকরী হবে বলে মনে হচ্ছিল না।

শেষ পর্যন্ত একটা ফন্দী মাথায় এলাে যা ওর পারবে না অর্থাৎ যে কাজ সম্পন্ন করা ঐ দু’জন প্রেমিকের দ্বারা সম্ভব হবে না। ওর: জব্দ হবে এবং ওদের বাতিল করা যাবে।

ফ্রানসেকার মাথায় নতুন ফন্দীটা যেদিন এল সেদিন পিসততাইয়াতে সম্ভান্ত বংশের একজন জানাশোনা ব্যক্তির মৃত্যু হল। লােকটি সম্রান্ত বংশের ঠিকই, শহরে সকলে তার নাম জানে ঠিকই কিন্তু বসন্ত রােগের নাম যেমন সকলে জানে, রােগটিকে সকলে ভয় পায় এবং এড়িয়ে চলে এই লােকটিও বসন্ত রােগের মতােই মারাত্মক ছিল। সকলে তাকে এড়িয়ে চলতাে।

কারণ লােকটি যেমন পাজী ও কুচক্রী ছিল ঠিক তেমনি কুৎসিত দর্শন ছিল। হাত পা ও পিঠ এতই বিকৃত ছিল যে সে সােজা হয়ে দাঁড়াতে ও চলতে পারতাে না। তার ওপর মুখটা এতই বিকৃত ছিল যে শিশুরা ভয়ে পেয়ে কেঁদে উঠত। | মৃত্যুর পর তাকে ফ্রানসিসকান গির্জার বাইরে গােরস্থানে কবর দেওয়া হল। এই পাজী লােকটির মৃত্যু ও তাকে কোথায় কবর দেওয়া হচ্ছে এই খবর পেয়ে ফ্রানসেসকা তার এক দাসীকে বলল, তুই জানিস যে বিনুচিয়াে আর আলসান্দ্রো নামে ছোঁড়া দুটো আমাকে দিনেরাত্রে পথেঘাটে জ্বালিয়ে মারছে। ও দুটোকে আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। ঘেন্না করি কিন্তু ওদের তাড়িয়ে দিলেও ওরা আমাকে ছাড়ে না। তা ওরা আমাকে যাতে বিরক্ত করতে না পারে সেজন্যে আমি একটা ফন্দী এঁটেছি। আমি নিশ্চিত জানি-এ কাজ ওরা পারবাে না, আমিও ওদের হাত থেকে মুক্তি পাবাে। তা দাসী জিজ্ঞাসা করলাে তােমার ফন্দীটা কি শুনি। এ বলছি, সেইজন্যেই তাে তােকে ডেকেছি। তুই তাে জানিস ঐ পাজী আর কুৎসিত মানুষটা, স্ক্যানাডিয়াে আজ মরে অনেকের হাড় জুড়িয়েছে। তাকে এতক্ষণে গির্জার বাইরে বােধহয় কবরও দেওয়া হয়েছে। লােকটা একেই তাে কুৎসিত দর্শন ছিল, এখন বােধহয় মরে আরও বিকৃত হয়েছে, সাক্ষাৎ ভূতের মতাে। ঐ চেহারা দেখলে যে কোনাে মানুষ ভয় পাবে, আমরা তাে বােধহয় অজ্ঞান হয়েই যাবাে।

ফ্রানসেসকা তার দাসীকে বলতে লাগল, তুই আগে গােপনে আলসান্দ্রোর কাছে যা। তাকে বলবি যে আমার দিদিমণির মন এতদিনে তােমার দিকে ঝুঁকেছে কিন্তু তােমাকে একটা কাজ করতে হবে। তার আগে শােননা। তুমি তাে জানাে স্ক্যানাডিয়া শয়তানটা আজ মরেছে। তাকে কবরও দেওয়া হয়েছে। তা দিদিমণির কে একজন চেনা লােক স্ক্যানাডিয়াের লাশটা কবর থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে যাবে। লােকটার বােধহয় কোনাে কুমতলব আছে। দিদিমণিকে ভয় দেখিয়ে কিছু টাকাপয়সা বা সম্পত্তি হাতাতে চায়। দিদিমণি তাে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। তােমাকে কি করতে হবে শােনাে। তুমি স্ক্যানাডিয়ার কবরে যাবে ও তার পােশাক পরে মড়ার মতাে পড়ে থাকবে। অবশ্য মাঝ রাত্রে। তারপর সেই লােকটা স্ক্যানাডিয়াে মনে করে তােমাকে দিদিমণির বাড়ি নিয়ে যাবে। তারপর আর কি। লােকটাকে দিদিমণি তাড়িয়ে দেবে আর যতক্ষণ ইচ্ছে বা বাকি রাতটা দিদিমণির কাছে থাকতে পারবে। গুছিয়ে সব কথা আলসান্দ্রোকে বলবি, সে ঠিক রাজি হবে।

তারপর তুই যাবি রিনচিয়াের কাছে, তাকেও বলবি যে, আমার দিদিমণির মন নরম হয়েছে। আজ মাঝ রাতে তােমাকে যেতে বলেছে কিন্তু তার আগে একটা কাজ করতে হবে। স্ক্যানাডিয়ােকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে তা তুমি জাননা। তুমি মাঝরাতের কিছু আগে কবরখানায় গিয়ে তার লাশটাকে কাধে তুলে নিয়ে দিদিমণির বাড়িতে নিয়ে আসবে কিন্তু খবরদার একটা কথাও উচ্চারণ করবে না। লাশটা নিয়ে দিদিমণি কি করবে তা তুমি দিদিমণির মুখ থেকেই শুনতে পাবে কিন্তু খবরদাব.এসব কথা কাউকে বলবে না। তারপর আর কি, তুমি বাকি রাতটা মজাসে দিদিমণির সঙ্গে কাটাতে পারবে। যদি রাজি না হও তাহলে তুমি আর দিদির বাড়িমুখাে হবে না। দিদি তােমার মুখদর্শন করবে না। আরও অনেক ছােকরা আছে, যারা একাজ দিদির জন্যে হাসতে হাসতে করবে। বলে দাও কি করবে? রিনুচিয়া বলবে সে রাজি। শয়তানটার লাশ নিয়ে ঠিক সময়ে হাজির হবে। এ আর এমন কি শক্ত কাজ?

ফ্রানসেকা দাসীকে বলল, তুইও একটু সাজগােজ করে যা! একটু ছলাকলা করবি, ওরা ঠিক রাজি হবে। দেখিস তােকে চুমু খেয়ে বখশিস দেবে। তাের চেহারাটি তাে দিব্যি।

দাসী তার দিদিমণির আদেশ পেয়ে ঐ দুই ছকরার বাড়ি গিয়ে শেখানাে মতাে সবই বলল। তারা বলল এ তাে অতি সামান্য কাজ। ম্যাডােনার জন্যে তারা নরকে যেতেও রাজি আছে। দিদিমণির কাছে ফিরে গিয়ে দাসী বলল, পাগল দুটো রাজি হয়েছে, ওরা ঠিক আসবে।

ফ্রানসেসকা বলল, তুই জেগে থাকিস, রাতে মজা দেখবি।

আলসান্দ্রোর আর তর সইছিল না। সমান্য পােশাক পরে মাঝরাতের আগেই সে কবরখানায় গিয়ে হাজির। কিন্তু কবরখানায় যাবার পথে সে ভয় পাচ্ছিল। সে ভাবছিল এটা কোনাে ফাদ নয়তাে? কথাটি বলে কোনাে আওয়াজ না করে পাজী শয়তানটার পােশাক পরে আমাকে মড়ার মতাে পড়ে থাকতে হবে। কিন্তু ওরা যদি আমার চোখেমুখে খোঁচা মারে? তারপর আমাকে নিয়ে গিয়ে মার দেবে না তাে? তবে এমন নাও হতে পারে। আর হবেই বা কেন? ফ্রানসেসকাকে আমি অনেকদিন ধরে দেখছি, মানুষটা তাে ভালাে। স্ক্যানাডিয়াের লাশটা নিশ্চয় ও কোনাে কাজে লাগাবে। কি করবে না করবে আমার জানার কি দরকার, আমি আমার মেয়েটিকে নিয়ে একবার শুতে পারলে বর্তে যাব। আর আমি যদি এখন ভয় পেয়ে যাই তাহলে ফ্রানসেসকাকে আমি আর মুখ দেখাতে পারবাে না, ফ্রানসেসকাও আমার মুখ দেখবে না। তার চেয়ে চেষ্টা করে দেখাই যাক না।

ফ্রানসেসকার প্রতি তীব্র আকর্ষণই তাকে সাহসী করে তুলল। শেষ পর্যন্ত নির্জন গােরস্থানে সে হাজির হয়ে স্ক্যানাডিয়াের কফিন খুলে তার পােশাক পরে লাশটাকে সরিয়ে রেখে নিজে সেই কফিনে মড়ার মতাে পড়ে রইল। ঘাের অন্ধকার, লাশ কেউ চিনবে না।

আলসান্দ্রো নামে একজন যুবক যে তার আগে গােরস্থানের দিকে রওনা হয়েছে এ খবর রিনুচিয়াের জানবার কথা নয়। সে তার প্রেয়সীর আদেশ পালন করতে মধ্যরাতের কিছু আগে গােরস্থানের দিকে যাত্রা করলাে। তার আবার অন্যরকম ভয়। লাশ চুরি করতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে যায় অথবা যখন লাশটা কাঁধে করে নিয়ে যাবে তখন তাকে পিশাচ মনে করে কেউ যদি ধরে? রিনুচিয়াে কিন্তু সাহসী। সে সব আশংকা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল। বিপদ যখন আসবে তখন তার মােকাবিলা করা যাবে। আজই সে তার প্রেয়সীয় কোমল বুকে শশাবে। সাহস না থাকলে পুরুষ কিসের?

গির্জার ঘড়িতে যখন বারােটার ঘণ্টা পড়ছে বিনুচিয়াে তখন কবরখানায় প্রবেশ করলাে। পায়ের শব্দ পেয়ে আলসান্দ্রো ভীষণ ভয় পেল আর ভয়ের জন্যেই বােধহয় তার গলা দিয়ে কোনাে আওয়াজ বের হবার সম্ভাবনা বাতিল হল।

ঘাের অন্ধকার, মানুষ চেনা যায় না তবুও অনেকের মতাে রিনুচিয়াে স্ক্যানাডিয়াের কবরটা চিনত। হাতড়ে হাতড়ে সে দেখল কফিনের ঢাকা নেই। কাজ সহজ হয়ে গেল। স্ক্যানাডিয়াের লাশ ভেবে সে আলসান্দ্রোকে কাঁধে তুলে ফ্রানসেসকার বাড়ির দিকে যাত্রা করলাে। কবরখানা থেকে বেরােবার সময় দেওয়ালে আলসান্দ্রোর দু’চারবার জোর ধাক্কা লেগেছিল কিন্তু বেচারা যন্ত্রণায় কাতর হলেও টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারে নি।

ওদিকে ফ্রানসেসকা আর তার পরিচারিকা জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। আলসান্দ্রোকে ঘাড়ে নিয়ে রিনুচিয়াে আসছে কিনা সেজন্যে তারা অপেক্ষা করছে। না এলেই মঙ্গল, অনেক ঝামেলা বেধে যাবে। আর দুই মূর্তিমান সত্যিই যদি হাজির হয় তাহলে কি বলতে বা করতে হবে তা সে ঠিক করে রেখেছে। এক ঢিলে দুই পাখি মারবে।

হ্যা ভারি পায়ের শব্দ শােনা গেল। ঐ মূর্তিমান কাধে বােঝা নিয়ে দম ফেলতে ফেলতে আসছে। ফ্রানসেসকা দাসীকে বলল লণ্ঠন জ্বেলে সদর দরজায় যেতে। বুদ্ধিমতী ফ্রানসেসকা সেদিন রাত্রে বিপদ আশংকা করে নগরপালকে অনুরােধ করে ঢাল ও বর্শা হাতে দরজায় দু’জন আরক্ষা মােতায়েন করে রেখেছিল। | অন্ধকারে রিনুচিয়ে তাদের দেখতে পায় নি। রিনুচিয়াে আলসান্দ্রোকে কাঁধে নিয়ে যেই ফ্রানসেসকার বাড়ির সামনে হাজির অমনি দুই রক্ষী বর্শা উঁচিয়ে হুংকার দিয়েছে, কে যায়? আর ঠিক সেই সময়ে দাসীও লণ্ঠন নিয়ে হাজির।

বিনুচিয়ে দারুণ ভয়ে পেয়ে চমকে উঠে ঘাড় থেকে তার বােঝাটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে য পলায়তি স জীবতি মনে করে প্রাণপণে ছুটে পালাল। শেষে কি চোর বলে ধরা পড়ে জেলখানায় ঘানি টানবে। বাঁচলে পরে আরও মেয়ে জুটবে।

আলসান্দ্রোর খুব আঘাত লেগেছিল। বাপরে, মারে, বলে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা এই নীতি অবলম্বন করে সেও চেঁ চেঁ দৌড় মারল।

রক্ষীরা তাদের কিছুদুর পর্যন্ত অনুসরণ করে ফিরে এলাে। ব্যাপার দেখে ফ্রানসেসকা আর দাসীর হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার উপক্রম।

পরদিন যখন স্কানাডিয়াের লাশ যথাস্থানে দেখা গেল না তখন সকলে ধরে নিল লােকটা সত্যিই শয়তান ছিল। তাই মানুষ বেশী শয়তানরা তার লাশ গুম করছে। প্রেমিক দু’জন আর লজ্জায় প্রেমিকার কাছে মুখ দেখাতে পারে নি। ফ্রানসেসকাও বেঁচে গেল।

 

দ্বিতীয় গল্প

একদিন অন্ধকার রাত্রে মঠের কত্রী অ্যাবেসকে ঘুম থেকে তুলে বলা হল একজন নান এক যুবকের সঙ্গে শুয়ে আছে। অ্যাবেস নিজেই তখন একজন যাজককে নিয়ে শুয়েছিল। তাড়াতাড়িতে নিজের মাথার ভেইল মনে করে অ্যাবেস যাজকের পাতলুন মাথায় জড়িয়ে নানকে ধরতে এসে ধরা পড়ে গেল।

মেয়েরা ফিলােমেনার গল্পর খুব প্রশংসা করলাে। তারা বলল, কে বলে মেয়েরা বােকা, বুদ্ধি নেই? দেখলে এক ঢিলে কেমন দুই পাখি মারলাে। ছেলেরা চুপ করে রইল। কুইন এবার এলিসাকে গল্প বলতে বলল।

এলিসা ছেলেদের দিকে চেয়ে বলল, হতাশ হয়াে না। আমার গল্পটা শুনলে তােমাদের মুখে হাসি ফুটবে। তখন বলবে মেয়েদের বুদ্ধি ঐরকমই, ভোতা। একজন মেয়ে আর একজনকে জব্দ করতে গিয়ে নিজেই জব্দ হয়ে গেল। এরকমই একটা গল্প আমি তােমাদের শােনাব। এলিসা তার গল্প আরম্ভ করলাে।

লম্বার্ডিতে একটা কনডেন্ট ছিল। বেশ কিছু সংখ্যক মেয়ে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করবার জন্যে আশ্রয় পেয়েছিল। কঠোর নিয়মকানুন ও পবিত্রতার জন্যে এই কনডেন্টের সুনাম ছিল। নানা বয়সের নান এখানে ছিল। তাদের তদারক করবার জন্যে তাদের মাথার ওপরে একজন অ্যাবেস ছিল। গির্জায় যেমন থাকে অ্যাবেট কনডেন্টে তেমনি অ্যাবেট। প্রত্যেক নানের পৃথক কুঠরি ছিল।

অনেক নানের মধ্যে সদ্যযৌবনা একটা নান ছিল, যেন ফুটন্ত ফুল, লাবণ্যময়ী, হরিণের মতাে চোখ। তার নাম ছিল ইসাবেতা।

একদিন ইসাবেতার এক আত্মীয় একজন সুদর্শন যুবককে সঙ্গে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। যুবক ও যুবতীর চোখের মিলন হল। প্রথম দর্শনে। প্রেম, যাকে বলে পলকে প্রণয়। ইসাবেতার অঙ্গ ভরা রূপ দেখে যে কোনাে যুবক তার প্রেমে পড়বে এবং ঘরে আবদ্ধ একজন যুবতী যে সুদর্শন যুবকের প্রেমে পড়বে এ আর আশ্চর্য কি? পরস্পরের দৃষ্টি বলে দিল আমি তােমাকে ভালবাসি। কিন্তু যুবতীর পক্ষে কনডেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে যুবকের সঙ্গে মিলিত হওযা একেবারেই অসম্ভব তখন যুবককেই পন্থা বার করতে হবে। যেখানে যত নিয়মকানুন কঠোর তেমনি সেখানে কিছু ফাঁক-ফোকর থাকে। এমনি এক ফাকের সুযােগ নিয়ে যুবক রাত্রে তার প্রেয়সীর কুঠুরিতে প্রবেশ করার সুযােগ পেল এবং তারা প্রায়ই মিলিত হতে লাগল। পরস্পরের আলিঙ্গনে তারা অনেক বিদ্রি রজনী যাপন করলাে।

একদিন রাত্রে যুবক যখন ইসাবেতার কুঠুরি থেকে বেরিয়ে উদ্যান অতিক্রম করে কনডেন্ট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন একজন নান তাকে দেখে ফেলল এবং মনে মনে বলল, ইসাবেতা এই তােমার কীর্তি ? দাঁড়াও তােমার ডুবে ডুবে জল খাওয়া বার করছি।

সেই নান ইসাবেতার কথা অন্য নানদের বলল। তারা বলল ঘটনাটা আমাদের অ্যাবেস ম্যাডােনা উসিমবলডাকে এখনি জানিয়ে দেওয়া উচিত। পবিত্র কনডেন্টের মধ্যে এমন পাপ ও দুকর্ম সহ্য করা উচিত নয়। অ্যাবেস অত্যন্ত কড়া, তার পুত চরিত্রের জন্যে তিনি সকল নানের শ্রদ্ধা ও ভক্তি অর্জন করেছেন।

কিন্তু কয়েকজন নান বলল, প্রমাণ ছাড়া অভিযােগ করে লাভ নেই। অ্যাবেসের কাছে ইসাবেতাকে হাতেনাতে ধরিয়ে দিতে হবে। ওর প্রেমিক যখন ওর ঘরে ঢুকবে আমরা তখন অ্যাবেসকে খবর দেব, তখন আর ইসাবেতার পালাবার সুযােগ থাকবে না। কনভেন্ট থেকে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, বেশ হবে। তবে খবরদার ইসাবেতা যেন কিছুই জানতে না পারে। তাহলে সে সাবধান হয়ে যাবে। দু’একজন নান অবশ্য মনে মনে ইসাবেতাকে হিংসে করতে লাগল, আমাদের একজন প্রেমিক জোটে না। এ পরের দিন রাত্রি থেকে কয়েকজন নান লুকিয়ে ইসাবেতার কুঠুরির দিকে নজর রাখতে লাগল এবং একদিন তারা যেন কোথাও একটা শিস শুনতে পেল, যেন কোনাে রাতের পাখি শিস দিচ্ছে। একটু পরেই ইসাবেতা কুঠুরি থেকে বেরিয়ে বাগানে এসে গাছের আড়াল থেকে তার প্রেমিককে নিয়ে নিজের কুঠুরিতে ঢুকলাে।

পাহারাদার নানেরা সব লক্ষ্য করলাে। ওরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাে তারপর কয়েকজনকে ইসাবেতার কুঠুরির বন্ধ দরজার বাইরে পাহারা রেখে কয়েকজন অ্যাবেসকে খবর দিতে গেল। চেক

তারা অ্যাবেসের দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলল, মাদার অ্যাবে শিগগির উঠুন। দেখবেন আসুন ইসাবেতা তার ঘরে একটা ছোঁড়াকে ঢুকিয়েছে।

মাদার অ্যাবেস নিজেই তখন একজন যাজকের দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ। ইচ্ছে করে নিদ্রাজড়িত কণ্ঠে সাড়া দিয়ে বললেন, “তাই নাকি, যাচ্ছি।” মনে মনে বললেন, হাতচ্ছাড়ি মেয়েগুলাে জ্বালালে দেখছি। যাই আবার দেখি কোন ছুঁড়ি কি কীর্তি করছে। | অ্যাবেস খাট থেকে নামলেন। যাজক বা নিজের পরনেও কিছু ছিল না। অন্ধকার ঘরে হাতড়ে হাতড়ে কিছু পরে নিলেন কিন্তু অ্যাবেসের মাথায় ভেইল থাকা চাই। যাজকের ছাড়া পালনটা ভেইল মনে করে মাথায় জড়িয়ে দরজা খুললেন। তারপর একটি মেয়েকে আলাে আনতে বলে বললেন, চল দেখি ইসাবেতা কি করছে।

মেয়েটি একটি মােমবাতি জ্বেলে আনলাে। অ্যাবেস সদলে ইসাবেতার কুঠুরির সামনে এলেন। উত্তেজিত নানেরা সােরগােল তুলে দরজায় এত জোরে ধাক্কা দিল যে ভেতরের ছিটকিনিটা ভেঙেই গেল।

বাইরে সােরগােল শুনে ইসাবেতা ও প্রেমিক সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। দরজায় ধাক্কার শব্দ না শােনা পর্যন্ত ওরা বুঝতে পারছিল না কিসের আওয়াজ। যুবক ইতিমধ্যে তার প্যান্ট জামা পরে নিয়ে তৈরি হয়েছে, বিপদ বুঝলে সে ইসাবেতাকে নিয়ে পালাবে। ইসাবেতাও কিছু পােশাক পরে নিয়েছে। দরজা খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। লজ্জা ও ভয়ে তার মুখ পাংশু। চোখ নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। জানে না তাকে কি শাস্তি দেওয়া হবে।

মােমবাতির আলােয় অ্যাবেস সব দেখল। তারপর ইসাবেতাকে নিয়ে অন্য একটা ঘরে এসে বসলাে। ইতিমধ্যে কনভেন্টের সব নানেরা উঠে পড়ে সেই ঘরে জড়াে হয়েছে।

অ্যাবেস তাে যতদূর সম্ভব কঠোর ভাষায় ইসাবের্তাকে ভৎসনা করছে। ও ঘরে বেশ কয়েকটা মােমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসাবেতা মুখ নিচু করে সব শুনছে এবং দণ্ডের জন্যে অপেক্ষা করছে। নিজে দোষী, কি উত্তর দেবে?

আবেস কি একটা প্রশ্ন করলাে। উত্তর দেবার জন্যে ইসাবেতা মুখ তুলে দেখল অ্যাবেসের মাথার দু’পাশ দিয়ে পুরুষের পালুনের গ্যালিস ঝুলবে। এই দেখেই তার মুখে রক্ত ফিরে এলাে। সাদা মুখ রক্তাভ হল। তার মুখ উদ্ভাসিত হল। সাহস ফিরে এলাে। তার এই ভাবান্তর কেউ লক্ষ্য করলাে না।

অ্যাবে তখন তাকে ধমক দিচ্ছেন। বললেন উত্তর দিচ্ছ না কেন? তােমাদের এই গােপন অভিসার কতদিন চলছে?

ইসাবেতা বলল, ভগবানের দোহাই মাদার অ্যাবেস, আপনি আপনার মাথার ভেইলটা ঠিক করে লাগিয়ে নিন। তারপর আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দেব।

অ্যাবেস ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, তােমার আস্পর্ধা তাে কম নয়। আমার মুখের ওপর কথা বললা? আমার বনেটের সঙ্গে তােমার উত্তর দেওয়ার কি সম্পর্ক?

ইসাবেতার মুখে মৃদু হাসি। অ্যাবেস জ্বলে উঠল। ইসাবেতা গ্রাহ্য করলাে না। এবার একটু জোর দিয়েই বলল, মাদার অ্যাবেস, আমি আবার বলছি আপনি আপনার মাথার বনেট ঠিক না করলে আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবাে না।

অসভ্য ছিনাল মেয়ে অন্যায় করে আবার কথা? তিনি ঝঝিয়ে উঠলেন কিন্তু তিনি মাথায় হাত দিয়ে বনেট পরীক্ষা করতে গিয়ে মাথা থেকে যেটি খুলে এল সেটি গ্যালিস লাগানাে পুরুষের পালুন। এবার মুখ বিবর্ণ হল মাদার অ্যাবেসের। সমবেত নানেরা হাসি চাপবার চেষ্টা করলাে। মাদার অ্যাবেস নিজেই ধরা পড়ে গেল। এরপর তিনি আর কোন্ মুখে ইসাবেতার বিচার করবেন?

মাদার অ্যাবেস উঠ পড়লেন। যাবার সময় বিড়ন্টি করতে করতে বলে গেলেন, কি আর করা

যাবে যা চলছে চলুক। ইসাবেতা এবং আরও কয়েকজন নান যারা গােপনে অভিসার চালাচ্ছিল কিন্তু ধরা পড়ে নি, তারা হাসতে হাসতে নিজ কুঠুরিতে ফিরে গেল। এরপর আর কোনাে বাধা রইল না। যে যার মনমতাে প্রেমিক নিয়ে রাত কাটাতে লাগল তবে প্রকাশ্যে নয়, কারণ তারা লজ্জা বিসর্জন দিতে পারে নি। আর যেসব নান প্রেমিক জোটাতে পারলাে না তারা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে একাই রাত কাটাতে লাগল।

 

তৃতীয় গল্প

ব্রুননা, বুফালমাচো এবং নেলাের চক্রান্তে বৈদ্য সিমােন ক্যালানড্রিনােকে বলল তােমার পেটে গর্ভ হয়েছে। ক্যালানড্রিনাে মুক্তি পাবার জন্যে তিন বন্ধুকে তিনটে মােরগ ও কিছু অর্থ দিল। বৈদ্য সিমােন কালানড্রিনােকে একটা ওষুধ দিয়ে বলল তুমি বেঁচে গেলে।

এলিসার গল্প শুনে কোনাে সখী নানেদের নিন্দা করলাে। কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলাে, বলল, মানুষ তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দমন করলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্ষিধে পেলে যেমন খেতে হয় তেমনি আদি রিপু প্রবল হলে তাকে চরিতার্থ করতে হবে। তাই দেখ না সচ্চরিত্র বিধবা বা কুমারী বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নাসিক ও খিটখিটে হয়ে যায়। পুরুষরাও ব্যতিক্রম নয়।

কুইন এবার ফিলােস্ট্রাটোকে গল্প বলতে বলল। ফিলােস্ট্রাটো বলল, আমাদের পূর্ব পরিচিত ব্রুনাে আর ফিলােস্ট্রাটোর দুষ্টুমির আর তাদের বন্ধু ক্যালানড্রিনােকে জব্দ করার গল্প বলে শেষ করা যায় না। আমি এদেরই একটা গল্প বলবাে। গল্পটা আমি কাল থেকেই ভেবে রেখেছি, না বলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি

ক্যালানড্রিনাে যে অত্যন্ত সরল, বুদ্ধিহীন এবং বন্ধুদের সহজে বিশ্বাস করে এবং তার দুই বন্ধু তাকে নিয়ে যে কাণ্ডকারখানা করে এ তাে আমরা দেখেছি কিন্তু এবার যা করলাে তা অভিনব। চিন্তা করাই যায় না যে, ক্যালানড্রিনাে বন্ধুদের ধাপ্পা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেবে।

ক্যালানড্রিনাের এক পিসি মারা গেল। ক্যানড্রিনােকে দিয়ে গেল পেতলের দুশশা ফার্দিং মাত্র, রুপােরও নয় বা দু’চারখানা স্বর্ণমুদ্রা নয়।

কিন্তু ক্যানলানড্রিনাে ভাবলাে পঞ্চাশ নয় ষাট নয় একেবারে দুশাে ফার্দিং? সে যে অনেক। সে এমন ভাব দেখাতে লাগল যেন দশ হাজার সােনার ফ্লোরিন পেয়েছে। সে ঠিক করলাে ক্ষেতখামার কিনবে। দালাল লাগালাে কিন্তু তারা যে দাম বলল সে দামে ক্ষেতখামার কেনবার ক্ষমতা ক্যালানড্রিনাের নেই অতএব বাতিল হয়ে গেল।

ব্রুনাে ও বুফালমােচোও শুনল যে পিসির দৌলতে ক্যালানড্রিনাের হাতে কিছু অর্থ এসেছে। তারা পরামর্শ দিল, ওহে তােমার স্ত্রীর দৌলতে তােমার তাে ক্ষেতখামার শূকর মুর্গি সব আছে। আবার সম্পত্তি কিনে ঝামেলা বাড়িয়ে কি করবে? তার চেয়ে এসাে টাকাটা আমরা উত্তম পানভােজন করে ফুর্তি করে কয়েকটা দিন কাটাই। এতে তােমার পুণ্য অর্জন হবে, টাকারও সদ্ব্যয় হবে।

কিন্তু ক্যালানড্রিনাে এমন গো ধরলাে যে তাকে রাজি করানাে গেল না। এমনকি একদিন ওদের ডেকে ম্যাকারনিও খাওয়াল না। কিন্তু দুই ধুরন্ধর বন্ধু হতাশ হবার পাত্র নয়।

কয়েকদিন পরে। দুই বন্ধু কাজ করতে করতে আলােচনা করছে বােকাটার অর্থাৎ ক্যালানড্রিনাের ঘাড় ভাঙা গেল না। একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করলাে, কি করা যায় বলাে তাে? এই সময়ে ওদের আর এক পেন্টর বন্ধু নেলাে সেখানে এলাে। সেও ক্যালানড্রিনােকে চিনত। সে বলল তােমরা দুই ধড়িবাজ বােকাটাকে ঘায়েল করতে পারছাে না? তাহলে শােনাে এক কাজ করা যাক।

কি কাজ? তিনজনে মিলে পরামর্শ করে ক্যালড্রিনােকে জব্দ করবার চরম ফন্দি বার করলাে।

পরের দিন সকালে ক্যালানড্রিনাে কাজে বেরােলে যে পথ দিয়ে যায় সেই পথে কিছু দূরে নেলাে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। খানিকটা দূরে বুফালমাচো আর একটু দূরে ব্রুনো।

ক্যালানড্রিনােকে আসতে দেখে নেলে এগিয়ে গিয়ে বলল, গুড মর্নিং।

ক্যালানড্রিনােও দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, গুড মর্নিং। নতুন বছর শুভ হােক। কথা শেষ করে ক্যালড্রিনাে যাবার উপক্রম করলাে কিন্তু নোে স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল।

কি দেখছ নেলাে?

নেলাে বলল, কাল তাে তােমাকে বেশ ভালাে দেখলুম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তােমার যেন কি হয়েছে, কাল রাত্রে কিছু হয়েছিল নাকি, তােমার যেন চোখ বসে গেছে, স্নান মনে হচ্ছে তােমাকে। কি হয়েছে?

ক্যালানড্রিনাের মুখ ম্লান হয়নি কিন্তু নেলাের কথা শুনে সত্যিই ম্লান হল। সে বলল, আমাকে খারাপ দেখাচ্ছে? কি হয়েছে বলাে তাে?

নেতলা বলল, কি হয়েছে তা তাে বলতে পারবাে না তবে তােমাকে কেমন কেমন দেখাচ্ছে। হতে পারে আমি ভুল দেখছি।

নেলাে অন্যদিকে চলে গেল কিন্তু ক্যালানড্রিনাের মাথায় দুশ্চিন্তা ঢুকলাে। সত্যি তার কিছু হয়েছে নাকি? ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলল। খানিকটা গিয়ে বলামােচোর সঙ্গে দেখা। সেও ক্যালানড্রিনােকে জিজ্ঞাসা করলাে, কি হে তােমার শরীর ভালাে আছে তাে? কি রকম মনে হচ্ছে? গাল বসে গেছে।

ক্যালানড্রিনাে বলল, কি জানি আমার কি হয়েছে কিন্তু একটু আগে নেলাের সঙ্গে দেখা হল। সেও একই কথা বলল, কিন্তু আমি তাে কিছু বুঝতে পারছি না।

বুফালমাচো বলল, হয়ত কিছু নয় কিন্তু তােমাকে দেখে তাে আমার মনে হচ্ছে তুমি খুব দুর্বল। এখনি কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। | কালানডিনাের ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। বলল, তবে কি আজ কাজে যাবাে না?

ব্রুনাে কখন এসে ওদের পিছনে দাঁড়িয়েছে ক্যালানড্রিনাে টের পায় নি। সেও বলল, তােমার কি হয়েছে ক্যালানড্রিনাে? তােমার মুখ যেন মড়ার মতাে সাদা, ওকি? তােমার হাত কাঁপছে কেন?

তিন বন্ধুর কথা শুনে ক্যালানড্রিনাের মনে হল সত্যিই তার কিছু হয়েছে বােধহয়। সে বলল, কিছুই। বুঝছি না। ভাই, তােমার যখন দেখছ তখন আমার নিশ্চয় কিছু হয়েছে। এখন কি করি বলাে তাে?

ব্রুনাে বলল, তুমি সােজা বাড়ি ফিরে গিয়ে আপাদমস্তক চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়। তারপর আমার মনে হয় আমাদের চিকিৎসক বন্ধু সিমমানকে দিয়ে তােমাকে পরীক্ষা করানাে উচিত। সেই সঙ্গে তােমার মূত্রটাও পরীক্ষা করা দরকার। আমরা তােমার বন্ধু, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ওরা তিন বন্ধু ক্যালানড্রিনােকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাটে শুইয়ে দিল। ক্যালানড্রিনাে এতই ভয় পেয়ে গেল যে তার মনে হল তার বুঝি শেষ অবস্থা উপস্থিত। সে তার বৌকে ডেকে বলল, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। আমার শরীর আনচান করছে। বন্ধুদের পরামর্শে ভৃত্যকে দিয়ে তার মূত্রের নমুনা সিমােন বৈদ্যর কাছে পাঠিয়ে দিল।

বুফালমাচো ও নেলােকে ব্রুনাে বলল, তােমরা এর কাছে থাক আমি সিমমানের কাছে যাচ্ছি, দেখি সে কি বলে। দরকার হলে তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবাে।

ক্যানড্রিনাে বলল, এই তাে বন্ধুর মতাে কাজ, শােনে সে কি বলে। আমার পেটের মধ্যে কি রকম করছে, ব্রুনাে তুমি যাও আর দেরি কোরাে না। আমার মােটেই ভালাে লাগছে না।

ব্রুনাে তখনি বেরিয়ে পড়ল এবং যে মূত্রের নমুনা নিয়ে যাচ্ছিল তার আগেই পৌছল। ব্রুনাে সিমােনকে তাদের চক্রান্তের কথা বলল। একটু পরেই মূত্রের নমুনা নিয়ে ভৃত্য পৌছল। সিমােন তখনি তা পরীক্ষা করবার ছল করে তাকে বলে দিল, তুমি ফিরে গিয়ে তােমার মনিবকে বলাে, আমি না যাওয়া পর্যন্ত যেন চুপ করে শুয়ে থাকে। কিছু যেন না খায়। আমি তাকে দেখে বলবাে তার কি হয়েছে।

ভৃত্য ফিরে এসে খবর দিল বৈদ্যমশাই এখনই আসছেন। তিনি এসে আপনাকে পরীক্ষা করে ওষুধ দেবেন ও কি করতে হবে বলে দেবেন। দেরি হল না। সিমােনকে সঙ্গে নিয়ে ব্রুনাে এলাে। সিমােন ক্যালানড্রিনাের নাড়ী পরীক্ষা করলাে, পেট টিপে দেখল, জিভ দেখল, চোখের পাতা তুলে দেখল, তারপর গম্ভীর স্বরে শুধু বলল, হুঁ।

বৈদ্য কিছু বলল না। ক্যালানড্রিনাে ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, বৈদ্যমশাই আমি বাঁচব তাে ? শােনাে ক্যালানড্রিনাে আমি যা আশংকা করেছিলুম তাই হয়েছে। তােমার গর্ভ হয়েছে মানে পেটে সন্তান আসছে।

এই কথা শুনেই ক্যালানড্রিনাে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করে উঠল। বলল, জানতুম এমন একটা কিছু হবে, আমার বৌ টেসা এজন্যে দায়ী। রােজ রাত্রে ও আমার ওপর চড়াও হবে, তাহলে এমন তাে হবেই। ওকে নিষেধ করলেও শােনে না।

এ কথা শুনে লজ্জায় টেসার মুখ সিঁদুরের মতাে টকটকে লাল হয়ে গেল। ঘরে অন্য পুরুষরা রয়েছে, তার স্বামী এত বােকা! ছিঃ ছিঃ। সে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ক্যালানড্রিনাের চিৎকার থামে নি। বৌকে তাে একচোট গালাগাল দিলই, শাপশাপান্ত করলাে, এমনকি তার মৃত্যু কামনাও করলাে। তারপর বলল, এখন আমার কি হবে?

ব্রুনাে বুফালমাচো আর নেলাে তখন মুখ ঘুরিয়ে চাপা হাসি হাসছে। সিমােন অতিকষ্টে হাসি চেপে রেখেছে। বৈদ্যর হাত চেপে ধরে ক্যালানড্রিনাে কাতর প্রার্থনা করতে লাগল, আমাকে বাঁচান নইলে আমি মরে যাব। ইস্ বৌয়ের ওপর আমার এত রাগ হচ্ছে না কি বলবাে। যার যা কাজ, ও আমাকে বুকে তুলবে তা নয়, ও পুরুষ হতে চায়। আমি যদি উঠতে পারতুম তাে এখনি ওর ঘাড় মটকে দিতুম।

সিমােন বলল, চুপ করাে, বৌয়ের ঘাড় মটকালে তােমার বিপদ কাটবে না। ঈশ্বরের কৃপায় তােমার রােগ যখন ধরা পড়েছে তখন তার আরােগ্যেরও একটা পথ পাওয়া যাবে। ভাগ্যক্রমে দেরি হয়নি।

ক্যালনড্রিনাে অস্থির হয়ে বলল, তাহলে বলুন আমাকে কি করতে হবে। আমার কাছে এখন দুশাে পাউণ্ড আছে। দরকার হলে সব টাকাটাই আপনাকে দিচ্ছি, আপনি শুধু আমাকে বিপদ থেকে বাঁচান।

ঘাবড়িও না, আমি যখন এসে পড়েছি তখন তােমার ভয় নেই। আমি তােমার জন্যে তরল সােনা আর মুক্তোর ছাই মিশিয়ে একটা ওষুধ তৈরি করে দেব। সেটা তুমি রােজ সকালে খালি পেটে তিনদিন খাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। মুক্তি পাবে কিন্তু খবরদার বৌকে আর বুকে উঠতে দেবে না। এবার শােননা তােমার ওষুধ তৈরি করতে হলে তিনটে মােটা মােরগ লাগবে। তরল সােনা আর মুক্তো এবং আরও কয়েকটা সামগ্রী কিনতে হবে। তুমি আপাতত ব্রুনােকে একশ পাউণ্ড দাও। ও সবকিছু কিনে আমার ঘরে পৌঁছে দেবে। আমি ওষুধ তৈরি করে বিকেলে পাঠিয়ে দেব। তরল ওষুধ, তিন ভাগে ভাগ করে এক গেলাস জলে মিশিয়ে খাবে, খেতে খারাপ নয়। সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনদিন পরে তুমি আবার লাফালাফি করতে পারবে।

ধন্যবাদ, এই নিন একশ পাউণ্ড। বালিশের তলা থেকে টাকা বার করে ক্যালানড্রিনাে সিমােনকে দিল। ডাক্তার টাকা নিয়ে আর তিন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। বন্ধুরা তাে টাকা হাতে পেয়ে উল্লসিত। মানুষ এত বােকাও হয়! একশ পাউণ্ডে শুধু মােরগ নয়, যা ভালাে পাওয়া যায় ওরা চারদিন ধরে মহানন্দে তাই খেল। রসনা তৃপ্ত হল।

সিমােন সেইদিনই সন্ধ্যায় ওধ পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওষুধ আর কি? স্রেফ সরবত তবে সামান্য ওষুধের গন্ধ করবার জন্যে সামান্য একটু তেঁততা মিশিয়ে দিয়েছিল।

তিনদিন পরে সিমােন এসে ক্যালানড্রিনাের জিভ দেখল, নাড়ী টিপে দেখল, পেট টিপল তারপর

বলল, আর কিছু নেই, আপদ বিদেয় হয়েছে। তুমি একেবারে সেরে গেল ক্যালানড্রিনাে। তুমি এখন নিজের কাজকর্ম করতে পারাে, যা ইচ্ছে করতে পারাে তবে খবরদার বৌকে যেন মেরাে না।

ক্যালানড্রিনােকে ধাপ্পা দিয়ে জব্দ করতে পেরে বন্ধুরা খুব খুশি। চারদিন ধরে ওরা খুব ফুর্তি করে নিল।

 

চতুর্থ গল্প

বুয়ােনকনভেনটো জুয়াের আড্ডায় চেচকো ফোরটারিগাে নিজের সবকিছু এবং বন্ধু চেচকো অ্যালিয়েরির সব টাকা হেরে গেল। সে শুধু শার্ট পরে বন্ধু অ্যালিয়েরিকে দস্যু বলে কৃষকদের কাছে ধরিয়ে দিয়ে বন্ধুর পােশাক পরে ও তারই ঘােড়ায় চেপে পালাল। অ্যালিয়েরি শুধু শার্ট পরে দাঁড়িয়ে

বােকা ক্যালানড্রিনাের বােকামি খুব হাসির খােরাক জোটাল। ইস্ মানুষ এত বােকাও হয় আর নিজের বৌকে পাঁচজনের সামনে এমন লজ্জায় কেউ ফেলে দেয় ? এ কি রকম মূর্খ স্বামী রে বাবা। মেয়েরাই গা টেপাটেপি করে বেশি হাসতে লাগল। কুইন নিজেও অনেক চেষ্টা করে হাসি থামিয়ে নেফাইলকে এবার গল্প বলতে বলল।

নেফাইল বলল, আমি একটু অন্যরকম গল্প বলবাে দুই বন্ধুর। দুন্ধুর গল্প, দু’জনেই চতুর। শােননা দু’জনে কি কাণ্ডটাই না করলাে। নেফাইল তার গল্প আরম্ভ করলাে।

সিয়েনাতে দুই বন্ধু ছিল। দু’জনে সাবালক হয়েছে। দু’জনেরই এক নাম, চেচকো। একজন চেচকোর বাবার নাম অ্যাঙ্গুলিয়েরি আর একজনের বাবার নাম ফোরটারিগাে। দু’জনে বন্ধুত্ব থাকলেও পরস্পরকে ল্যাং মারবার চেষ্টা করতাে এবং প্রায়ই দু’জনে ঠোকাঠুকি লাগত তবে এক বিষয়ে দু’জনে একমত। দু’জনেই নিজ নিজ পিতার নিন্দায় মুখর। আর এই এক ব্যাপারে একমত বলেই হয়ত মাঝে মাঝে বিরােধ সত্ত্বেও দু’জনের বন্ধুত্ব টিকে আছে।

চেচকো অ্যালিয়েরি সুদর্শন ও বিনয়ী কিন্তু তার বাবা তাকে প্রতিমাসে যে হাত খরচ দিত তাতে তার চলতাে না, বেশ কষ্ট হতাে। তার পােশাক-আশাক দেখলে তাকে দরিদ্র বলেই মনে হতাে।

আনকোনা গির্জায় একজন নতুন কার্ডিনাল এসেছেন। তিনি পণ্ডিত ও নানা গুণের অধিকারী। অ্যালিয়েরি স্থির করলাে সে আনকোনায় যাবে এবং এই কার্ডিনালের আশীর্বাদ ভিক্ষা করবে যাতে সে তার অবস্থার উন্নতি করতে পারে।

তার ইচ্ছা সে তার বাবার কাছে প্রকাশ করলাে। বাবা তার ইচ্ছা সমর্থন করলাে। কিন্তু এই পােশাক পরে তাে কার্ডিনালের কাছে যাওয়া যায় না। নতুন এবং ভালাে পােশাক চাই। তার বাবা তাকে নতুন পােশাক কিনে দিলেন না। তাকে তার প্রাপ্য ছ’মাসের হাত খরচের টাকা অগ্রিম দিয়ে বললেন এই টাকা থেকেই তুমি যা ইচ্ছে খরচ করাে। ছ’মাস পরে আবার হাত খরচ পাবে।

অ্যালিয়েরি এই টাকা থেকেই এক প্রস্থ পােশাক কিনল আর একটা ঘােড়া কিনল। এবার একজন ভত্য সঙ্গে চাই তা নইলে সসম্মানে ভ্রমণ করা যাবে না। কার্ডিনালের সামনে গিয়ে দাঁড়ান যাবে না। অ্যালিয়েরি যে কার্ডিনালের কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে একজন ভৃত্য খুঁজছে এ খবর চেচকো ফোরটারিগাের কানে উঠল।

সে ভাবল এই সুযােগ। সে তাে অ্যাঙ্গুলিয়েরির ভৃত্য-সঙ্গী হিসেবে তারই খরচে কিছুদিন ঘুরে আসতে পারে। অ্যালিয়েরি তাে বন্ধুকে চেনে তাই প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু ফোরটারিগো কথার জাদুতে তাকে বশ করে বলল, শুধু খাওয়া থাকা বাবদ তাকে একটাও পয়সা দিতে হবে না উপরন্তু সে তার সব কাজ করে দেবে, বন্ধুকে বন্ধু, সহায়ক তাে সহায়তা। হাজার হােক বাল্যবন্ধু তো, অ্যালিয়েরি রাজী হয়ে গেল আর সেই মুহূর্ত থেকে ফোরটারিগােও ফন্দী আঁটতে আরম্ভ করলাে।

দুই বন্ধু একদিন ভােরে যাত্রা করলাে। ফোরটারিগােও একটা ঘােড়া যােগাড় করেছে তবে ঘােড়াটা বুড়াে ও বেতাে। বন্ধুর ঘােড়াটা তাজা ও টগবগে না হলেও ওর ঘােড়ার চেয়ে ভালাে। মাঝে মাঝে পিছিয়ে পড়ে। ব্রেকফাস্টের সময়েই ওরা বুয়ােনকনভেনটো পৌছে গেল।

দিনটা বেশ গরম। কড়া রােদ উঠেছে। পথে রােদে কষ্ট হবে তাই অ্যাঙ্গুলিয়েরি সরাইখানায় একটা ঘর ঠিক করে শােবার ব্যবস্থা করে দিতে বলল। বেলা পড়লে রােদের তেজ কমলে আবার যাত্রা করা যাবে। তারপর সে ফোরটারিগাের সহায়তায় পােশাক পরিবর্তন করে শুতে গেল। ফোরটারিগােকে বলে দিল বিকেলের ঠিক আগে তাকে যেন ডেকে দেয়।

অ্যালিয়েরি যেই ঘুমিয়ে পড়ল ফোরটরিগাে অমনি এক পানশালায় গিয়ে হাজির। কিছু সুরা পান করলাে। তখন জুয়ােখেলা চলছিল। ও লােভ সামলাতে পারল না, জুয়া খেলতে আরম্ভ করলাে এবং দ্রুত সব খােয়াল এমনকি নিজের প্রত্যেকটি পােশাক পর্যন্ত, তার পরনে কিছুই রইল না। তার লজ্জা নিবারণের জন্য কেউ তাকে একটা ছেড়া শার্ট দিল। সেটি গায়ে দিয়ে কোনরকমে লজ্জা নিবারণ করলাে।

কিন্তু হেরে যাওয়া টাকাপয়সা ও পােশাক পরিচ্ছদ উদ্ধার করতে হবে, নইলে সে উলঙ্গ হয়ে থাকবে নাকি ? সরাইখানাই অ্যাঙ্গুলিয়েরি তখন ঘুমােচ্ছ। সে চুপিসাড়ে তার ব্যাগ খুলে তার সমস্ত টাকা চুরি করে জুয়াের আড্ডায় ফিরে এসে আবার হেরে ভুত হয়ে গেল।

বিকেলের কিছু আগে অ্যাঙ্গুইলিয়েরির ঘুম ভাঙল। খাট থেকে নেমে সে পেশাক পরে নিল। একাই পরল কারণ ফোরটারিগােকে ডাকাডাকি করেও পাওয়া গেল না। হতভাগাটা কোথায় গেছে কে জানে ? এইজন্যই ওটাকে আনতে চাই নি। মদ গিলে কোথায় পড়ে ঘুমােচ্ছে কে জানে ?

অ্যাঙ্গুইলিয়েরি ঠিক করলাে হতচ্ছাড়াটাকে ফেলে রেখে সে একাই যাবে। পথে কোথাও একজন ভৃত্য খুঁজে নেবে, করসিগনাননা গ্রামে এমন লােক পাওয়া যাবে। তারপর ঘােড়ার পিঠে জিন চাপিয়ে লাগাম লাগিয়ে মাল বােঝাই করে যাবার জন্যে তৈরি হল। সরাইখানায় সরাইওয়ালার কাছে তার পাওনা মিটিয়ে দেবার জন্য ব্যাগ বার করে খুলে দেখে একটাও পয়সা নেই,সব উধাও।

অ্যালিয়েরি সরাইওয়ালার ওপর চোটপাট আরম্ভ করলাে, এ নিশ্চয় তােমার বা তােমার সরাইখানার কোনাে লােকের কাজ। বার করাে আমার টাকা-পয়সা, নইলে আমি তােমাদের সবাইকে সিয়েনাতে শাসনকর্তার কাছে চালান দেব।

সরাইওয়ালা বলল, এ হতেই পারে না, তার সরাইখানার এ দুর্নাম নেই কারও একটা পয়সা বা ছেড়া রুমালও চুরি যায় নি। তুমি নিজেই ভালাে করে খুঁজে দেখ। আর তখনি ফোরটারিগাে সেখানে এসে পড়েছে। তার মতলব এবার সে অ্যাঙ্গুলিয়েরির পােশাক চুরি করে নিজে পরবে কিন্তু দেখল অ্যালিয়েরি যাবার জন্যে প্রস্তুত এমনকি ঘােড়া সাজানাে হয়ে গেছে। সে বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাে, কিরে অ্যাঙ্গুলিয়েরি যাচ্ছিস নাকি? তাহলে একটু অপেক্ষা করাে, আমার ভালাে জামাটা (ডবলেট) বন্ধক দিয়েছি। সে পাবে আটত্রিশ শিলিং কিন্তু এখন পয়সা মিটিয়ে দিলে তিন শিলিং ছাড় দেবে।

অ্যাঙ্গুইলিয়েরি তার দিকে চেয়েও দেখল না, তার কথাও শুনল না। সে তখন সরাইওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করতে ব্যস্ত। দু’চারজন জড়াে হয়েছে। ওদের মধ্যে একজন অ্যালিয়েরিকে বলল, মশাই থামুন, আমাদের সরাইওয়ালাকে মিছেমিছি দোষ দেবেন না। আসামী হল আপনার এই ন্যাংটো বন্ধুটি, জুয়াে খেলেতে গিয়ে সব খুইয়েছে। এমনকি নিজের জামা কাপড়ও। ঐ তাে আপনার টাকা চুরি করে এনেছে।

ফোরটারিগাে দ্বিতীয় দফায় কত বাজী হেরেছে তাও লােকটি তাে বলে দিল। চুরি যাওয়া অর্থের পরিমাণ মিলে গেল আর অ্যাঙ্গুইলিয়েরি ফোরারিগােকে চেপে ধরলাে। যাচ্ছেতাই করে গালাগাল ও দু’চারটে চড় মেরে বললাে, চল তােকে সিয়েনাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাই, সেখানে তােকে ফাঁসিতে লটকাৰ।

ফোরটারিগাে একটু ঘাবড়াল না। বলল, কথাটা বােঝ, আগেকার কাজ আগে, আমার ডবলেটটা তাে আগে খালাস করতে হবে নইলে আমি রাস্তা দিয়ে কি উলঙ্গ হয়ে যাব নাকি। এখন মেটালে পঁয়ত্রিশ শিলিং-এ হয়ে যাবে নইলে কাল হলে পুরাে আটত্রিশ শিলিং লাগছে। অথচ এটা বিক্রি করলে চল্লিশ শিলিং তাে পাওয়া যাবেই। তিন শিলিং বাঁচবে। এমন সুযোগ কি ছেড়ে দেওয়া যায়? সে টাকাটা বার করাে।

ধূর্ত ফোরটারিগাের কথা শুনে লােকজন ভাবল অ্যাঙ্গুইলিয়েরি বন্ধুর সঙ্গে চালাকি করছে। দু’জনে কথাকাটাটি আরম্ভ হল। ব্যাপারটা লােকজন সঠিক বুঝতে পারল না। তারা ধাঁধায় পড়ল এবং একে একে কেটে পড়ল। তখন অ্যাঙ্গুইলিয়েরি বিরক্ত হয়ে ঘােড়ায় উঠে চলতে আরম্ভ করলাে।

ফোরটারিগাে তার সঙ্গ ছাড়ল না। সে শুধু সেই শার্ট পরেই নিজের বেতাে ঘােড়ায় চেপে অ্যাঙ্গুইলিয়েরিকে অনুসরণ করতে লাগল।

বেশ খানিকদুর যাবার পর রাস্তা নির্জন কিন্তু পাশে ক্ষেতে কয়েকজন চাষী কাজ করছে। ফোরটারিগাে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। ও ভাই ডাকাতটাকে থামাও, দোহাই তােমাদের। আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ব্যাটা পালাচ্ছে।

চাষীরা তাদের চাষের যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে এসে অ্যাঙ্গুইলিয়েরির ঘােড়া থামাল। ততক্ষণে ফোরটারিগােও এসে পড়েছে এবং অ্যাঙ্গুইলিয়েরিকে গাল দিতে আরম্ভ করলাে, ব্যাটা ডাকাত এবার পালাবি কোথায়! দে আমার জামা-কাপড় সব খুলে দে, মালপত্তর সব দে এমনকি ব্যাটা আমার ভালাে ঘােড়াটাও পালটে নিয়েছে। শয়তান।

অ্যালিয়েরি কত বােঝাবার চেষ্টা করলাে আসল দোষী ঐ লােকটাই কিন্তু ফোরটারিগাের কান্না মেশানাে কথা ও তার পাকা অভিনয়ে চাষীরা তার কথাই বিশ্বাস করে অ্যাঙ্গুইলিয়েরিকে ঘােড়া থেকে নামিয়ে তার সব পােশাক পরিচ্ছদ খুলে নিয়ে ফোরটারিগােকে দিল। ফোরটারিগাে সেইসব পরে তার ছেড়া শার্টটি অ্যালিয়েরিকে দিয়ে তারই ঘােড়ায় চেপে ‘কেমন জব্দ বলে’ ঘােড়া ছুটিয়ে চলে গেল।

আইলিয়েরি কি আর করে। সে ছেড়া শার্ট পরে বেতাে ঘােড়ায় চেপে কপর্দকশূন্য হয়ে তাে আর কার্ডিনালের কাছে যেতে পারে না। নিজের শহর সিয়েনাতে এই অবস্থায় ফিরলেও সে হাস্যসম্পদ হবে। তাই সে আপাতত বুয়ােনকনভেনটোতে ফিরে এসে এক প্রস্থ পােশাক ধার করে করসিগনানােতে এসে বাবাকে খবর পাঠাল। বাবা এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন।

অ্যাঙ্গুইলিয়েরিকে ঠকিয়ে ফোরটারিগাে নিষ্কৃতি পায় নি। অ্যালিয়েরি সুযােগ বুঝে প্রতিশােধ নিয়েছিল।

 

পঞ্চম গল্প

ক্যালানড্রিনাে এক যুবতীর প্রেমে পড়ল। ব্রুনাে তাকে মন্ত্রপূত পার্চমেন্টের জড়ানাে কাগজ দিয়ে বলল এটা সেই যুবতীকে ছোঁয়ালে সে তােমার প্রেমে পাগল হয়ে যাবে। ক্যালানড্রিনাের কপাল মন্দ, তার বৌ তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল।

নেফাইলের গল্প ছােট হলেও অন্য ধরনের বলে সবাই বেশ উপভােগ করলাে। মুখ পালটান হল, আর কি। ফিয়ামমেত্তা তুমি উসখুস করছে মনে হচ্ছে, তাহলে তুমিই এবার গল্প বলাে।

ফিয়ামেত্তা বলল, বেশ তাই বলবাে। ক্যালানড্রিনাের বােকামির বুঝি শেষ নেই তবে ভীষণ সরল তাে, তাই বন্ধুদের চাতুরী ধরতে পারে না, বার বার ঠকে। তার গল্প শুনতে মজাও লাগে বেশ। অন্যেরা তার গল্প বললেও, আমিও একটা বলি :

আমাদের শহরে নিকোলাে কোরনাচিনি একজন ধনশালী ব্যক্তি। তার বিস্তর জমিজায়গা আছে। তার মধ্যে ক্যামেরায় তাঁর যে উত্তম জমিটি ছিল সেখানে তিনি একটা প্রাসাদ নির্মাণ করালেন! এই প্রাসাদে কিছু ছবি আঁকাবার জন্যে তিনি ব্রুনাে এবং বুফালমােচোকে নিযুক্ত করলেন। দেওয়ালে ফ্রেসকোও আঁকতে হবে। ফ্রেসকো সময়সাপেক্ষ এবং দু’একজন শিল্পী দ্বারা এ কাজ করা যায় না। তাই দুই বন্ধু নেলাে এবং ক্যালানড্রিনােকেও দলভুক্ত করে নিল। চারজনে মিলে মহা উৎসাহে যত্ন করে ও মন দিয়ে কাজ করতে লাগল।

বাড়িতে পাকাপাকিভাবে বাস করবার জন্যে তখনও কেউ আসে নি। বাড়িটা তদারক ও পাহারা দেবার জন্যে একজন কর্মচারী নিযুক্ত ছিল তবে বাড়ির একখানা ঘরে পালংক ও অন্যান্য আসবাব দিয়ে সাজান ছিল।

বাড়ির মালিক নিকোলোের ছেলে ফিলিপাে মাঝে মাঝে এই ঘরে এসে দু’একদিন বাস করে যেত। সঙ্গে সুন্দরী একটি যুবতীকে নিয়ে আসত। যুবতীর নাম নিকোলােসা। কামালডােলিতে একটা পাজী লােক ছিল, তার নাম ম্যাঙ্গিওন। নিকোলােসা তার রক্ষিতা ছিল। নিকোলােসা ফিলিপাের নজরে পড়ে। ফিলিপপ তাকে ম্যাজিওনাের কাছে চায়। ম্যাঙ্গিননা রাজি হয় কিন্তু বিনিময়ে টাকা চায় এবং শর্ত করে যে সে আবার চাইলে নিকোলােসাকে ফিরিয়ে দিতে হবে অর্থাৎ সে ফিলিপাের কাছে মেয়েটিকে ভাড়া দিল। ফিলিপাের আপত্তি নেই।

নিকোলােসার নজরকাড়া রূপ আছে, দেহ সৌষ্ঠবও মন কেড়ে নেয়। তার পর মেয়েটি সর্বদা উওম সাজ পােশাক পরে। তার দিকে চোখ পড়লে দেখতে ভালাে লাগে, চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। স্বৈরিণী মেয়ে হলেও তার কথাবার্তা ও আচরণ মার্জিত গৃহবধূর মতাে।

একদিন দুপুরে নিকোলােসা হাত পা মুখ ধােবার জন্যে কুয়ােতলায় এসেছে। পরনে শেমিজের মতাে একটিমাত্র পাতলা আবরণ, মাথার চুল পিঠে ভেঙে পড়েছে। আর সেই সময়ে ক্যালানড্রিনােও গেছে কুয়াে থেকে জল আনতে। বােকা হােক আর যাই হােক ক্যালানড্রিনাে তাে শিল্পী। একেই তাে মেয়েটি সুন্দরী তায় শিল্পীর চোখ, সে মেয়ের রূপের প্রশংসা না করে পারে না। স্বামীদের কাছে নিজ স্ত্রীর তুল্য সুন্দরী আর কেউ হয় না। কিন্তু এই মেয়েটির কাছে তার স্ত্রী মােনা টেসা নিষ্প্রভ। ক্যালানড্রিনাে চোখ ফেরাতে পারলাে না।।

ক্যালানড্রিনাে স্বাস্থ্যবান তবে রূপবান নয়। মাথা ভর্তি এলােমেলাে চুল, মুখের তুলনায় দুই কান ও নাক বেশ বড় কিন্তু চোখ অত বড় নয়, ঠোটও পাতলা। অন্য পাঁচজন যুবক অপেক্ষা তার মুখটা যেন অন্যরকম। গায়ে ঢিলে হাতা ঢােল্লা একটা জামা, নানারঙের চৌকো কাপড় সরিয়ে বসিয়ে জামাটা তৈরি। তার ওপর জামায় রঙের ছিটে পড়েছে।

লােকটা বালতি হাতে তার দিকে চেয়ে পাথরের মতাে দাঁড়িয়ে আছে। লােকটাকে দেখে নিকোলােসা কৌতুক বােধ করলাে। সেও ক্যালনড্রিনােকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। ঠোটে পাতলা হাসি। বুল ছােকরা তাকে দেখে মজেছে।

কুয়াের পাড়ে একটা কাক এসে বসলাে। কাকটা রূপসীর জলের বালতিতে ঠোট ডােবাতে যাচ্ছিল। কালানড্রিনাে কাকটাকে তাড়িয়ে দিয়ে নিকোলােসার সঙ্গে আধােআধাে স্বরে দু’চারটে কথা বললাে, যে কথার মাথামুণ্ডু নেই। নিকোলােসার মজা লাগল। মজা করবার জন্যে ক্যালড্রিনাের চোখে চোখ রেখে সে চোখ টিপল। ক্যালানড্রিনোে তাে গলে গেল, সে কৃতার্থ।

এই সময় জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ফিলিপাে রূপসীকে ডাকতে সে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

জল নিয়ে বাড়িতে ফিরে ক্যালনড্রিনাে একটা টুলে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। কাছেই ব্রুনাে ছিল। সে ভাবল বালতি ভর্তি জল এনে ক্যালানড্রিনাে বুঝি ক্লান্ত হয়ে গেছে, বিশ্রাম করছে। কয়েক দণ্ড কেটে গেল কিন্তু ক্যালানড্রিনাের ওঠবার নাম নেই। সে মাঝে মাঝেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছে, কাজ করবার যেন ইচ্ছে নেই।

ব্রুনাে তখন জিজ্ঞাসা করলাে, কি ইয়ার কি হল? কাজ করবে না? তােমার রং তুলি কোথায়?

ইয়ার কি আর বলবাে? আমাকে যদি কেউ একটু সাহায্য করে, তাহলে আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হবে না।

ব্রুনাে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, কি ব্যাপার কি? খুলে বলাে তাে? কিসের যেন গন্ধ পাচ্ছি।

ক্যালনড্রিনাে গলা নামিয়ে বলল, কাউকে বােলাে না যেন ভাই, কুয়ােতলার এমন একটি রূপসীকে দেখলুম যার দেহ থেকে রূপ যেন পিছলে পড়েছে। সে তােমাকে কি বলবাে, যেন জলপরী। তবুও তাে মেয়েটি স্নান করছিল না তাহলে তাে পাগল হয়ে যেতুম।

ব্রুনাে হেসে বলল, এখনই তাে পাগল হয়ে গেছ মনে হচ্ছে। তবে ইয়ার সাবধান, রূপসী ফিলিপপার বৌ নয় তাে?

ক্যালানড্রিনাে বলল, তা হতে পারে কারণ ফিলিপাে তার শয়নঘরের জানালা দিয়ে মেয়েটিকে ডাকতেই সে আমার বুকে বাণ মেরে চলে গেল। হােক ফিলিপাের বৌ, তাকে আমার চাই।

ক্যালনড্রিনােকে নিয়ে মজা করবার একটা সুযােগ পাওয়া গেল ভেবে ব্রুনাে মনে মনে খুব উল্লসিত হয়ে উঠল। বলল, ক্যালানড্রিনাে ভুলে যেয়াে না তােমার বৌ জানতে পারলে তােমার অবস্থা কি হবে।

বৌ এখন আমার মাথায় থাক। কিন্তু..।

আচ্ছা আমি দেখছি, ব্রুনাে বলল, খোঁজ করে দেখি ও সত্যিই ফিলিপের বৌ না আর কিছু। তবে আমি ওকে চিনি, আমি তােমার জন্যে যথাসাধ্য করবাে। কিন্তু ভাই বুফালমাচো তাে জানতে পারবে।

তা জানুক তবে নেলাে না জানতে পারলেই হল। কারণ নেলাের সঙ্গে মােনার একটা আত্মীয়তা আছে কি রকম বােন হয় যেন।

ব্রুনাে বলল, আমিও সেরকম শুনেছি, দেখি কি করা যায়।

মেয়েটি যে কে তা ব্রুনাে ভালােই জানত। ফিলিপপা নিজেই তাকে বলেছে নিকোলােসা তার প্রেয়সী, কিছুদিন ওকে কাছে রাখবে।।

রূপসীকে আর একবার দেখবার আশায় ক্যালানড্রিননা তার কাজ বন্ধ রেখে বাড়ির অন্য দিকে চলে গেল আর সেই সুযােগে বুফালমাচো ও নেলােকে ডেকে ব্রুনাে সব ফাস করে দিল। তিনজনেই উৎসাহিত, ক্যালানড্রিনােকে নিয়ে আবার মজা করা যাবে। কিরকম মজা করা যাবে তাও তখনি ঠিক করে ফেলা হল।

কালানড্রিনাে ফিরে আসতে ব্রুনাে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাে, কি? দেখা পেলে?

ক্যালানড্রিনাে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, কেন আমি তখন কুয়াে থেকে জল আনতে গিয়েছিলুম? দেখা তাে পেয়েছি, কুয়ােতে ডুবে মরলেই ভালাে ছিল।

মরবার চিন্তা কোর না বন্ধু, আমি থাকতে তােমার চিন্তা কি। আমি এখনি গিয়ে দেখছি তােমার জন্যে কি করতে পারি।

ক্যালনড্রিনাে ব্রুনাের দু’হাত ধরে বলল, তাই করাে ভাই। এই বন্ধুরা যে তাকে কতবার চোখের জলে নাকের জলে করেছে সেসব ক্যালানড্রিনাে ভুলে গেল। বন্ধুরাই বুঝি তার একমাত্র ভরসা। সে নিশ্চিন্ত হল ব্রুনাে যখন বলছে তখন একটা ব্যবস্থা করবেই।

ব্রুনাে দেওয়ালে ছবি আঁকছিল। ভারা থেকে নিচে নেমে রং তুলি রেখে হাত ধুয়ে চুলটা আঁচড়ে মুখটা মুছে নিয়ে গিয়ে ফিলিপাের সঙ্গে দেখা করলাে। নিকোলােসাও সেখানে ছিল। ব্রুনাে ক্যালানড্রিনাের পরিচয় দিয়ে বলল, লােকটা শুধুই সরল নয় রীতিমতাে বােকা, কতবার ঠকেছে, নাস্তানাবুদ হয়েছে তবুও সে বন্ধুদের বিশ্বাস করে। তাকে আবার নাস্তানাবুদ মানে ওকে নিয়ে একটু মজা করার সুযােগ হয়েছে। ওরা কি ফন্দী এঁটেছে সে সবই ফিলিপপ ও নিকোলােসাকে বলল। নিকোলােসা বেশ কৌতুক অনুভব করলাে।

ওদের সঙ্গে কথা বলে ব্রুনাে ফিরে এসে ক্যালানড্রিনােকে বলল, যা ভেবেছিলুম ঠিক তাই। সুন্দরী মেয়েটি ফিলিপাের বৌ অতএব আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে কারণ ফিলিপাে যদি টের পায় তাহলে শুধু তােমাকে নয় আমাদেরও বােধহয় হয় টুকরাে টুকরাে করে কেটে আরনাে নদীর জলে ভাসিয়ে দেবে। যাই হােক তুমি এখন বলল সুন্দরীকে তােমার কি বার্তা দেব অবশ্য যদি সুযােগ পাই।

ক্যালানড্রিনাে বলল, আমি যা বলতে চাই সে তাে বন্ধু তুমি আমার চেয়েও ভালাে বলতে পারবে। বলবে ভালবাসা যদি ওজন করে মাপা যায় তাহলে আমি তাকে লােহা ভর্তি হাজার বস্তার সমান ভালােবাসি, আমি তার একান্ত অনুগত ভৃত্য। আমি তার সেবা করে ধন্য হতে চাই, সেই সুযােগ যেন সুন্দরী দয়া করে আমাকে দেয়। নিশ্চয় আমি এসব নিকোলােসাকে বলবাে, তুমি আমার ওপর সব ছেড়ে দাও। আমি আজই তােমার সঙ্গে নিকোলােসার দেখা করিয়ে দেব।

সেদিনের মতাে কাজ সেরে চার বন্ধু খাওয়াদাওয়া করলাে এবং তারপর পায়চারি করবার জন্যে বাগানে গেল। আগে করা ব্যবস্থামতাে ফিলিপপা ও নিকোলােসাও বাগানে এসেছে। ফিলিপাে বুফালমাচোকে একটু তফাতে টেনে নিয়ে গিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করলাে। নিকোলােসা ব্রুনাে ও নেলাের সঙ্গে টুকরাে টুকরাে কথা বলছে আর ক্যালানড্রিনাে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্যে হাত পা নেড়ে নানারকম ক্রিয়াকৌশল করছে বা ছড়া আওড়াচ্ছে কিংবা পাখির ডাক নকল করছে।

এসব দেখে ও শুনে নিকোলােসা খুব কৌতুক অনুভব করতে লাগল। নিকোলােসা তাকে উৎসাহ দিতে লাগল। ক্যালানড্রিনাে ভাবল আর চিন্তা নেই, মাছ টোপ গিলেছে কিন্তু তাকে নিরাশ করে ফিলিপাে তার প্রেমিকাকে নিয়ে ফ্লোরেন্সে যাত্রা করলাে।

ব্রুনাে বলল, হতাশ হােয়াে না, ওরা আবার ফিরে আসছে। তুমি এক কাজ করাে। তােমার সেই তারের যন্ত্রটা আছে না, সেই রিবেক যেটা বাজিয়ে তুমি গান করাে? তুমি করবে কি নিকোলােসার শােবার ঘরের জানালার নিচে রাত্রে রিবেক বাজিয়ে যদি দরদ দিয়ে, কয়েকটা প্রেমসঙ্গীত গাইতে পারাে তাে নিকোলােসা জানালা গলে ঝাপিয়ে তােমার বুকে এসে পড়বে।

তুমি বলছাে? বেশ আমি যাত্রে বিবেক বাজিয়ে গান গেয়ে মাতিয়ে দেব। বুক ফুলিয়ে ক্যালানড্রিনাে বলল।

ব্রুনাে তাে তাকে আরও নাচিয়ে দিল। বলল, সুন্দরী শুধু তােমার বুকে ঝাপিয়ে পড়বে না, তােমার গলা জড়িয়ে ধরে বুকে চেপে তােমাকে মিষ্টি মিষ্টি চুমু খাবে আর তারপর যা হবে সে আমি আর কি বলবাে?

দিন যায় কিন্তু দু’জনে একান্তে দেখা হওয়ার সুযােগ হচ্ছে না। যদিও ক্যালানড্রিনাে মাঝে মাঝে কাজ বন্ধ করে একবার করে গিয়ে দূর থেকে নিকোলােসাকে দেখে আসে। তবে ব্রুনাে আছে সে দূতগিরি করে, মাঝে মাঝে নিকোলােসার হাতে লেখা চিঠি এনে দেয়। ক্যালানড্রিনাে তার রিবেক যন্ত্রটা এনেছে। বাজিয়ে বন্ধুদের গান শুনিয়ে তারিফ আদায় করে।

নিকোলােসা লেখে শিগগির তােমার কাছে যাব। ব্রুনাে বলে, দেখলে তাে তােমার জন্যে আমি কি করলুম, এখন তাে ও তােমার। উৎসাহিত হয়ে ক্যালানড্রিনাে সুন্দরীকে উপহার পাঠায়, হাতির দাঁতের চিরুনি, রুপাের ছােট কৌটো, আংটি, পার্স, ফুল ইত্যাদি। আর এই সুযােগে বন্ধুরা ক্যালানড্রিনাের ঘাড় ভেঙে ভালমন্দ পানাহার করে।

এদিকে দু’মাস কেটে গেল। বাড়িতে ছবি আঁকা ও ফ্রেসকোর কাজ শেষ হয়ে আসছে। এখনও নিকোলাসাকে ক্যানড্রিনাে কাছে পেল না, জড়িয়ে ধরতে পারলাে না। এখান থেকে চলে গেলে সে কি তার প্রেয়সীকে আর দেখতে পাবে? ব্রুনােটা কি করছে? তার কি অন্য কোনাে মলব আছে? সে সেইদিনই ব্রুনােকে কড়া তাগাদা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, তুই বা সুন্দরী আমাকে আর কতদিন ঝুলিয়ে রাখবি?

ব্রুনাে বলল, ঠিক বলেছিস। মেয়েটা আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘােরাচ্ছে। ওকে তাগাদা দিলেই বলে, তােমার বন্ধুর সঙ্গে আমি কালই দেখা করবাে কিন্তু করছে না। দাড়া এবার ওকে আমি জব্দ করবােই। আমি তােকে একটা জড়ানাে পার্চমেন্ট তৈরি করে দেব তাতে মন্ত্র লিখে দেব। তুই কোনাে সুযােগে সেই পার্চমেন্টটা শুধু ওর গায়ে কোথাও একবার সামান্য একটু ঘসে দিবি। তারপর দেখবি ও তাের পায়ে পড়বে।

বেশ তুই তাহলে আমাকে সেই পার্চমেন্ট দে? অত্যন্ত কৌতুহলী হয়ে ক্যালানড্রিনাে ব্রুনােক বলল।

ব্রুনাে বলল, পার্চমেন্ট তৈরি করতে হবে। তুই আমাকে সদ্যোজাত একটা মরা মেষশাবক, তিনটে বাদুড়, তিনটে ধূপ আর তিনটে মােমবাতি গির্জার বেদীতে দুইয়ে আমাকে এনে দিবে, আমি তােকে মন্ত্রপূত পার্চমেন্ট তৈরি করে দেব।

ক্যালানড্রিনাে পরের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা জায়গায় ঘুরে মেষশাবক, বাদুড়, ধূপ আর মােমবাতি ব্রুনােকে এনে দিল।

ব্রুনাে বলল, ঠিক আছে, তুই কাজে যা। আমি আজ কাজে যাব না, তাের জন্যে এগুলাে তৈরি করবাে বলে সে একটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পার্চমেন্ট তৈরি করে তাতে অবােধ্য অক্ষরে ও ভাষায় কি সব লিখে সেটা পাকিয়ে ক্যালানড্রিনাের হাতে দিয়ে বলল, এই নে তৈরি হয়ে গেছে।

ক্যালনড্রিনাে জিজ্ঞাসা করলাে, এবার আমাকে কি করতে হবে?

ব্রুনাে বলল, বিশেষ কিছু নয়। এখন তাে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আমি খবর পেয়েছি ফিলিপাে এখনি কোথাও যাবে, নিকোলােসা একা থাকবে। তুই বাড়ির পিছনদিকে চলে যাবি। এই সময়ে নিকোলােসা দেখতে যায় হাঁস মুর্গির ঘরের দরজা বন্ধ করা হয়েছে কিনা। তুই সেই সুযােগে ওর গায়ে যেখানে হােক এই জড়ানাে পার্চমেন্ট আলগা করে ঘসে দিবি। তখন দেখবি ও তােকে জড়িয়ে ধরবে। জায়গাটাও নির্জন। সন্ধ্যার অন্ধকারে, তুই ওকে নিয়ে যা ইচ্ছে করতে পারবি।

ফিলিপাে এই সময়ে সেখানে এসে ব্রুনাে আর বুফালমােচোকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি একটু ফ্লোরেন্স যাচ্ছি, তােমাদের কিছু দরকার নেই তাে?

সকলে বলল, না দরকার নেই তুমি ঘুরে এসাে। ফিলিপাে কোথাও গেল না। অত বড় বাড়ির একটা ঘরে বসে রইল। একটু পরেই তাে মজা আরম্ভ

খতে হবে তাে ? ওদিকে ব্রুনাে নেলােকে ফ্লোরেন্সে পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে তাের বােনকে নিয়ে আয়। আমরা ক্যালানড্রিনােকে একেবারে হাতেনাতে ধরিয়ে দেব।

নেলাে ােেনা টেসাকে গিয়ে বলল, মােনা তাের, নিশ্চই মনে আছে যে মগনােন নদীর ধার থেকে তাের বর যেদিন এক বস্তা পাথর নিয়ে এলাে সেদিন তােকে কি মারটাই না মেরেছিল। ভুলে যাস নি নিশ্চই। যদি শশাধ নিতে চাস তাে আমার সঙ্গে এখনি চল, হাতেনাতে ধরতে পারবি। তাের বোেকা বর একটা ডাইনির পাল্লায় পড়েছে।

এ কথা শুনে মােন তাে খেপে গেল। সে তখনি পােশাক পরে বেরিয়ে পড়ল। রাগে দাঁত কিড়মিড করতে করতে এবং স্বামীর উদ্দেশ্যে যা ইচ্ছে গাল দিতে দিতে এত জোরে চলতে লাগল যে, নেলাে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে পারছিল না।

ক্যামেরায় প্রাসাদে পৌছাবার পর নেলাে মােনাকে এক জায়গায় লুকিয়ে রাখলাে। বলল, এখানে চুপ করে বসে থাক, তােকে আমি ঠিক সময়ে খবর দেব।

ক্যালানড্রিনাে পার্চমেন্ট হাতে নিয়ে তক্কে তক্কে আছে। নিকোলােসা সন্ধ্যার পর কোনােদিনই বাড়ির পিছনে যায় না। হাঁসমুর্গি দেখবার লােক আছে কিন্তু সেদিন তাে সাজানাে ব্যাপার, মজার নাটক হবে। কি করতে হবে ভালাে করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ক্যালানড্রিনাে দেখল, নিকোলােসা একা বাড়ির পিছনদিকে যাচ্ছে তার বুক কেঁপে উঠল। চুপিসাড়ে তাকে অনুসরণ করলাে। তারপর বাড়ির পিছনে প্রাঙ্গণে পৌছে তার পাকে গিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলাে। নিকোলােসা যেন খুশি হল। ক্যালানড্রিনাে পাকানাে পার্চমেন্টের তার বাহুতে বুলিয়ে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে নিকোলােসা প্রিয়তম’ বলে তাকে জড়িয়ে ধরে পিছনে খড়ের গাদায় ফেলে দিয়ে ঘােড়ায় চড়ার মতাে করে ক্যালানড্রিনাের পেটের ওপর চড়ে বসে তাকে চেপে ধরলাে। ক্যালানড্রিনাে বললাে, আরে ছাড় ছাড় প্রিয়তমা, তােমাকে একটা চুমাে খেতে দাও।

নাে বুফালমাচো আর ফিলিপাে আড়াল থেকে সবই দেখছিল আর নেলাে মােনা টেসাকে ঠিকসময়ে ডেকে এনেছে। ক্যালানড্রিনাের শেষ কথাটা সে শুনতে পেয়েছে এই যে তােমাকে চুমাে খাওয়াচ্ছি বলে তার স্বামীর দুই কান ধরে মাথাটা ঠুকতে লাগল। তারপর তার গাল আঁচড়ে রক্ত বার করে দিল। সেই সঙ্গে গালাগাল, এই তােমার কাজ ? একটা বেশ্যা মাগীকে নিয়ে ঢলাঢলি।

চুপ চুপ ও বেশ্যা নয়। ফিলিপাের বৌ। ক্যালানড্রিনাে বাধা দেবার চেষ্টা করে। কে তার কথা শশানে, মােনা বলে, তাহলে তাে আরও চমক্কার। পরের বৌয়ের সঙ্গে প্রেম করতে লজ্জা করে না, আর আমিই বুঝি তােমার ওপর চড়াও হই ? ঐ ঢলানি মাগী কি করছিল ?

এরপর মােনা তাকে এলােপাথাড়ি মারতে লাগলাে। নিকোলােসসা তাে মােনাকে আসতেই দেখেই উঠে চলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ ধরে প্রহার চললাে। ক্যালানড্রিনাে প্রতিহত না করে চিষ্কার করছে, কে আছ বাঁচাও, এমন কাজ আমি আর করবাে না।

বন্ধুরা ও নিকোলােসা কিছুক্ষণ ধরে মজা উপভােগ করলাে। তারপর ক্রনাে আর বুফালমাচো এসে মােনাকে নিরস্ত করে ক্যালানড্রিনােকে উদ্ধার করলাে। ও দিকে তখন ফিলিপাে নিকোলােসাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেছে।

দুজনকে শান্ত করে ক্রনাে আর বুফালমাচো ক্যালানড্রিনােকে বলল, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেলে, মিছেমিছি মার খেলে। যাক যা হবার তা হয়েছে, এখন বৌকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। এ মুখাে আর হােয়াে না, ফিলিপাে নিশ্চয়ই সব জানতে পারবে। তখন হয়ত তােমাকে খুনই করে ফেলবে।

এই বাবা নাক কান মলছি, এমন কাজ আমি করবাে না, মােনা তুমি আমাকে রক্ষা করাে।

ওরা চলে যাবার পর তিন বন্ধু, ফিলিপপা আর নিকোলােসা খুব হাসাহাসি করলাে। রাত্রে ফিলিপপা তিন বন্ধুকে ভােজে আপ্যায়িত করলাে। মাঝে মাঝে এমন আনন্দ উপভােগ না করলে জীবন নীরস হয়ে যায়। নিকোলোেসা আশংকা প্রকাশ করলাে বাড়ি ফিরে বােকাটা বৌকে মারবে না

তিন বন্ধু হেসে উঠল। বােকার মত অত সাহস হবে না।

 

যষ্ঠ গল্প

এক কুটিরে দুই বন্ধুকে রাত্রি কাটাতে হয়েছিল। এক বন্ধু গৃহস্বামীর কন্যার সঙ্গে নিশিযাপন করলাে, অপর বন্ধু কন্যার মায়ের সঙ্গে। কন্যার সঙ্গে যে বন্ধু হয়েছিল সে পরে গহস্বামীর পাশে চলে যায় এবং নিজের বন্ধু ভেবে বলতে থাকে কন্যাকে কেমন উপভােগ করলাে।ভীষণ গােলমাল। ওদিকে কন্যার মাও বুঝতে পেরেছে সেও ভুল করে স্বামী ভেবে বন্ধুর পাশে শুয়েছে। শেষ পর্যন্ত মা মিথ্যা কথা বলে অবস্থার সামাল দিল।

ক্যালানড্রিনাে বেচারাকে তােমরা আর কত বােকা বানাবে? তবুও গল্পটা সকলের বেশ ভালােই লাগল। কুইন তখন প্যানফিলােকে বলল তুমিও তাহলে এইরকমই একটা জমাটি গল্প বলাে।

প্যানফিলাে বলল, অবৈধ প্রেমের গল্পগুলাে বেশ উপভােগ্য হয়, তাই না? তা ক্যালানড্রিনাের প্রেমিকার নামে আমার আর এক নিকোলােসার নাম মনে পড়েছে, আমি তারই গল্প বলবাে। শােননা তাহলে :

মুগনােন উপত্যকায় রাস্তার ধারে এক বেচারার ছােট একটা সরাইখানা ছিল। লােকটি বেশ ভালাে ছিল। তার কোনাে শত্রু ছিল না। বণিকদের ভােজ্য ও পানীয় বেচে তার দিন চলে যেত। নিজের অবস্থায় লােকটি সন্তুষ্ট ছিল।

লােকটির বৌয়ের চেহারাটি ছিল নজর ধরা। দুই সন্তানের মা। বড়টি মেয়ে, যােড়শী, পুরন্ত গড়ন, মায়ের চেয়ে আকর্ষণীয়, ছােটটি শিশু। সরাইখানায় অতিসাধারণ ভােজ্য ও পানীয় বিক্রয় হতাে কিন্তু খরিদ্দাররা আসত মা মেয়েকে দেখবার জন্যে তবে কেউ অভদ্র আচরণ করে নি।

ফ্লোরেন্সের একটি যুবক ঐ পথে যাওয়া আসা করতাে। ছােকরার চেহারাটি ভাললা, ফুর্তিবাজ, অবস্থাও স্বচ্ছল। সরাইওয়ালার মেয়েটি একদিন তার নজর কেড়ে নিল। মেয়েটিকে তার চাই। ছােকরা মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করলাে এবং যুবকের ভালাে ভালাে কথা শুনে সেও যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হল। দু’জনেই মিলনের জন্যে উন্মুখ হয়ে রইল। যুবকের নাম পিনুচিয়ে আর যােড়শীর নাম নিকোলােসা। দু’জনেই মিলনের জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল।

সুযােগ আর পাওয়া যায় না, ওরাও অধৈর্য হয়ে ওঠে। পিনুচিয়াে তখন ঠিক করলাে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে চলবে না। একদিন ছুতাে করে তাকে সরাইখানার ভেতরে রাত কাটাতে হবে এবং অন্ধকারের সুযােগে প্রেমিকাকে অঙ্গে ধারণ করতে হবে।

পিনুচিয়াের বন্ধু আড্রিয়াননা ব্যাপারটা জানতাে। নিকোলােসাকে সেও দেখেছে। মাকেও দেখেছে। তার আকর্ষণ মায়ের দিকে। মায়ের বয়স তিরিশ পার হলেও এখনও সে তার যৌবনকে ধরে রেখেছে, কোনাে অঙ্গই শিথিল হয়নি, শরীরে কোথাও মেদ জমে নি। বেশ আঁটোসাটো গড়ন, যেন পরিপূর্ণ এক যুবতী।

দুই বন্ধু মিলে সরাইখানায় রাত কাটাবার একটা ফন্দী আঁটল। দুই বন্ধু দুটো মালবাহী টাট্ট ঘােড়া ভাড়া করলাে। ঘােড়া দুটোর দু’পাশে আজেবাজে জিনিস ভরে দুটো করে বস্তা ঝুলিয়ে দিল। তারপর ফ্লোরেন্স থেকে সন্ধ্যার মুখে বেরিয়ে এদিক ওদিক চারদিক ঘুরে রাত্রে সরাইখানায় এসে হাজির হল। যেন অনেক দূর থেকে ক্লান্ত হয়ে এসেছে।

আর খরিদ্দারের আশা না করে সরাইওয়ালা সরাই বন্ধ করবার উপক্রম করছিল। এমন সময় দু’জন অতিথিকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল। দু’জন ওর পরিচিত এবং জানে সম্রান্ত ও স্বচ্ছল পরিবারের

ওরা দু’জনে বলল, রাত্রি হয়ে গেছে, এখন ফ্লোরেন্সে ফেরা যাবে না, রাতে একটু আশ্রয় দিতে হবে। সরাইওয়ালা চিন্তিত হল। বলল, তােমরা আমার পরিচিত, আমার একটি মাত্র ঘর। তা তােমাদের কোনাে রকমে আশ্রয় দিতে পারি কিন্তু খেতে দেব কি?

খাবার যা ছিল তা নিজেদের খাওয়ার জন্য এবং তাও অতি সাধারণ, এমন অতিথিদের সে খাবার দেওয়া যায় না।

পিনুচিয়াে এবং আড্রিয়াননা বলল, খাবারের জন্যে তুমি ভেবাে না। আমাদের সঙ্গে অনেক খাবার আছে। তােমরা সকলে এবং আমরা একসঙ্গে ভােজন করবাে তবে দু’একটা পদ রান্না করে নিলে ভালো হয়।

তাহলে তো কোনাে অসুবিধে নেই। মা ও মেয়ে দু’জনে পুলকিত। সত্যিই ভালমন্দ আহার তাদের জোটে না। ওরা দু’জনে রান্নাঘরে ঢুকল। পিনুচিয়ে কিছু সবজি, চিকেন, ডিম, চিজ ও সুরা বার করে দিল। সকলে মিলে বসে পানাহার ভালােই জমল। নিকোলােসার মা যে তিনটে পদ রান্না করেছিলেন সেগুলি অত্যন্ত মুখরােচক হয়েছিল। এমন ভালাে খাওয়া ও স্বাদু সুরা সরাইওয়ালার পরিবারের অনেক দিন জোটে নি। ওরা তিনজন সুরা বােধহয় একটু বেশি পান করেছিল।

আহার তাে শেষ হল, এবার শােবার পালা। ঘরে তিনটে খাট। একটা খাটে মা তার কোলের বাচ্চাকে নিয়ে শুল। পাশে রইল বাচ্চার দড়িবিহীন দোলনাটা। বাচ্চা রাত্রে তাতে শুয়ে ঘুমােয়, দিনের বেলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। একটা খাটে শুলাে বাবা আর মেয়ে আর একটা খাটে দুই বন্ধু। খাটগুলাে এমনভাবে সাজানাে ছিল যে রাত্রে ঘর থেকে বেরােতে হলে অন্ধকারে হাতড়ে দরজা খুঁজতে হয়, আর এক খাট থেকে অপর খাটে যেতে অসুবিধেও হয় না।

শােবার এইরকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল কিন্তু মেয়ে গিয়ে শুলাে মায়ের খাটে দোলনার পাশে, আর আড্রিয়ানাে শুলাে সরাইওয়ালার পাশে আর পিনুচিয়াে একা কারণ তার খাটখানা সরু ছিল, দুই বন্ধুর কুলতাে না।

সবাই ঘুমিয়ে পড়ল শুধু জেগে রইল পিনুচিয়াে নিকোলােসা। নিকোলােসা খুব চালাক মেয়ে। মা আর বাবাকে নেড়ে দেখল তারা সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে চুপিসাড়ে উঠে পিনুচিয়াকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। পিনুচিয়েও তাকে জড়িয়ে ধরলাে। দু’জনে নীরবে প্রেমসাগরে অবগাহন শুরু করলাে মনের সুখে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে রান্নাঘরে কিছু একটা পড়ার শব্দ হল। নিকোলােসার মায়ের ঘুম ভেঙে গেল। নিশ্চই বেড়ালের কাজ। বেড়ালকে তাড়াবার জন্যে নিকোলােসার মা উঠে রান্নাঘরে গেল। যাবার আগে দোলনাটা খাটের একপাশে নামিয়ে রাখলাে। পাশে একটা চৌকি ছিল তার ওপর রাখলাে।

ওদিকে আড্রিয়ানাের ঘুম ভেঙেছে। তার বাইরে যাবার দরকার হল। ইতিমধ্যে বেড়ালকে তাড়িয়ে ঘরে ফিরে মা শিশুর কাঁথা পালটে তাকে আবার শুইয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়ল। ওদিকে আড্রিয়ান বাইরে থেকে ফিরে এসে অন্ধকারে ভুল করে বধূর পাশে শুয়ে পড়ল। বধু ভাবল বুঝি তার স্বামী তার পাশে এসে শুয়েছে। সে আড্রিয়ানাের গায়ে হাত রাখতেই আড্রিয়ানাে যদিও বুঝলাে সে ভুল বিছানায় শুয়েছে কিন্তু কোনাে কথা না বলে বধুকে জড়িয়ে ধরে তাকে চুম্বন করতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। দুই বন্ধু যা চেয়েছিল তা তারা উপভােগ করেছে। এবার ওরা চিন্তা করলাে যেভাবে তােক অন্ধকারেই হাতড়ে বিছানা পরিবর্তন করা দরকার। নচেৎ ঘুমিয়ে পড়লে সকালে ঘুম ভাঙার পর কেলেংকারি হয়ে যাবে।

আর ঠিক সেইসময় রান্নাঘরে ইঁদুরের হুটোপাটি। পাছে ইদুর এসে শিশুকে দংশন করে এই ভয়ে তার মা শিশুর দোলনা বিছানায় তুলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাে সে এতক্ষণ যাকে জড়িয়ে শুয়েছিল সে তার স্বামী নয়, অতিথি।

কি আর করা যাবে। সব সামলাতে হবে কিন্তু মেয়ে কোথায়? হাত নেড়ে দেখল মেয়ে বাবার বিছানাতেই নেই। ইতিমধ্যে পিনুচিয়ে উঠে সরাইওয়ালার পাশে শুয়ে পড়েবে আর নিকোলােসা হাতড়ে হাতড়ে মায়ের বিছানায় এসে দোলনার পাশে শুয়ে পড়ল এবং অচিরেই ঘুমিয়ে পড়ল আর আড্রিয়ানাে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে পিনুচিয়াের বিছানা খালি দেখে শুয়ে পড়ল।

পিনুচিয়াের তাে দারুণ ফুর্তি। সরাইওয়ালাকে সে তার বন্ধু আড্রিয়াননা ভেবে কিভাবে নিকোলােসাকে উপভােগ করছে বলতে আরম্ভ করলাে। সরাইওয়ালার ঘুম ভেঙে গেল তবুও সম্পূর্ণ সজাগ তাে হয়নি কিন্তু দু-চারবার নিকোলােসার নাম ও শুনতেই চমকে উঠল। ঘুম ভেঙে গেল।

সে তার বৌকে ডেকে বলল, এ ছােকরা কি সব বলছে? এসব খারাপ কথা, তােমার মেয়ে কোথায়?

মা খুব চালাক। সে সব বুঝতে পেরেছে; এখন সামাল দিতে হবে কিন্তু তার কাজ সহজ করে দিল, পিছিয়াে ও আড্রিয়াননা। পিনুচিয়াে বুঝতে পেরেছে সে কাকে কি বলে ফেলেছে তখন সে অভিনয় করতে আরম্ভ করলাে। ঘুমের ঘােরে যেন বিড় বিড় করে কথা বলতে লাগলাে। আড্রিয়ানাে বলল, আরে ভাই তুমি ঘাবড়াচ্ছ কেন। আমার বন্ধু ঘুমের ঘােরে ভুল বকে।

আর মা তার স্বামীকে বলল, কাল তুমি একটু বেশি মদ খেয়েছ তাই কি শুনতে কি শুনেছ নিকোলােসা এই তাে আমার পাশে শুয়ে রয়েছে।

সরাইওয়ালা তখন বলল, তাই বলাে, সত্যিই কাল রাত্রে আমার একটু নেশা হয়েছিল তার জের বােধহয় এখনও আছে।

দুই বন্ধু তখন মনে মনে নিকোলােসার বুদ্ধির প্রশংসা করলাে। যাক সব ভালাে যার শেষ ভালাে।

 

সপ্তম গল্প

টালােনাে ডি ইমােলিস স্বপ্ন দেখল যে একটা নেকড়ে বাঘ তার স্ত্রীকে আক্রমণ করে গলার নলি কেটে দিয়েছে আর আঁচড়ে মুখ বিকৃত করে দিয়েছে। টালানাে স্ত্রীকে সতর্ক করে দিল, বলল, বনে যেও না কিন্তু স্ত্রী শুনল না এবং সেদিনই একটা নেকড়ে তাকে আক্রমণ করলাে।

প্যানফিলাের গল্প শুনে শেষ হল। সকলে বেশ মজা উপভােগ করলাে। মায়ের কি বুদ্ধি! নিজেও সুখে রাত্রি কাটালাে আবার মেয়েকেও বাঁচিয়ে দিল। ওদের মধ্যে কেউ কেউ বলাবলি করলাে এসব শিখে রাখাে, কাজে লাগতে পারে।

প্যানফিলাের পর প্যামপিনিয়া। কুইন তাকেও গল্প বলতে বলল। প্যামপিনিয়া বলল, আমার গল্প মজার নয় হাসিরও নয় তবে অনেকে অবহেলা করলেও স্বপ্ন যে সত্যি হয় আমি সেই রকম একটা গল্প বলবাে। এটা গল্প নয় সত্যি ঘটনা, আমাদের প্রতিবেশী এই ঘটনার নায়ক নায়িকা।

তােমরা কি টালানাে ডি’ ইমােলিসের নাম শুনেছ? সে একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি ছিল। তার সঙ্গে যে রূপবতী যুবতীটির বিয়ে হয়েছিল তার নাম ছিল মার্গারিটা। মার্গারিটা ছিল অত্যন দুর্বিনীত, কারও কথা সে শুনত না, কাউকে গ্রাহ্য করতাে না এমনকি স্বামীকেও পাত্তা দিত না। অত্যন্ত দুর্মুখ ছিল, অপরের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকত। সে মনে করতাে সে ছাড়া আর সকলেই বুদ্ধিহীন। এমন স্ত্রীকে স্বামী সামলাতে পারত না। মার্গারিটা টালানাের জীবন বিষময় করে তুলেছিল। যখন দেখল স্ত্রীকে সে বশে রাখতে পারছে না তখন সে স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে যেত, তর্ক করতাে না তবে স্ত্রীর মস্ত একটা গুণ ছিল, স্বামীকে গ্রাহ্য না করলেও পরপুরুষকে গ্রাহ্য করতাে না, কারও প্রতি সে আসক্ত ছিল না।

টালানাে একদিন রাত্রে স্বপ্ন দেখল সে যেন তার স্ত্রীকে নিয়ে তাদের কোনাে জমিদারিতে গেছে। বাড়ির কাছে সুন্দর একটা বন ছিল। মার্গারিট সেই বনে বেড়াচ্ছে। এমন সময় কোথা থেকে মস্ত একটা নেকড়ে বাঘ এসে মার্গারিটার টুটি কামড়ে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নিজেক মুক্ত করবার জন্যে মার্গারিটা চিৎকার করছে ও হাত পা ছুঁড়ছে এবং যখন মুক্ত করতে পারলাে নিজেকে, তখন তার গলা থেকে গলগল করে রক্ত গড়াচ্ছে আর বাঘের আঁচড়ে মুখ ছিন্নভিন্ন।

পরদিন ঘুম ষ্মেকে ওঠার পর টালানাে তার স্ত্রীকে স্বপ্নের কথা বলল। টালানাে বলল, তুমি তাে আমার কোনাে কথা শােনাে না এবং আমাকে বারবার অগ্রাহ্য করাে কিন্তু আমার বিশেষ অনুরােধ যে বনে যাওয়া দূরের কথা তুমি আজ বাড়ি থেকে বেরিয়াে না। স্বপ্নে আমি বিশ্বাস করি। ক্ষতি হলে তােমারই বেশি ক্ষতি হবে, মৃত্যুও হতে পারে।

মার্গারিটা বৃলল, রাখাে তাে তােমার গাঁজাখুরি স্বপ্ন। তুমি মনে মনে ভাব যে আমাকে বাঘে টেনে নিয়ে যাবে তাই তুমি অমন স্বপ্ন দেখছ। জানি তাে আমি মরলে তােমার হাড় জুড়ােয় কিন্তু জেনে রেখ এ খাণ্ডারনী সহজে মরছে না, তােমার হাড়মাস কালি করে ছাড়ব।

টালানাে বলল, আমি কর্তব্য করলুম এখন তােমার যা ইচ্ছে করাে। তবুও আর একবার বলছি একদিন বনে না গেলে আকাশ থেকে চাদ খসে পড়বে না। মার্গারেট উত্তর দিল, ঠিক আছে, ঠিক আছে একদিন না হয় তােমার কথা শুনব।

কিন্তু মার্গারিটা অন্যরকম চিন্তা করলাে। লােকটা ভীষণ ধূর্ত, ও নিজে আজ নিশ্চই একা বনে যাবে। নিশ্চই কোনাে বেশ্যামাগীর সঙ্গে ফুর্তি করবে তাই আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। বনে গিয়ে দেখতে হবে লােকটা কি করে, মেয়েটাই বা কে? ধরতে পারলে দু’জনের ধুকধুকি নেড়ে দেব। এজন্যে দরকার হলে আমি সারাদিনটাই বনে কাটাবাে।

একটু পরেই টালানাে কোনাে কাজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আর মার্গারিটাও সঙ্গে সঙ্গে অন্য দরজা দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনের পথ ধরলাে।

বনে পৌছে মার্গারিটা এমন একটা ঘন গাছ ঘেরা জায়গা বেছে নিল যেখানে বসে থাকলে তাকে দেখা যাবে না। পরেও এসেছে একটা সবুজ জামা।

সবুজ জামা পরে গাছের পাতায় রং মিলিয়ে বসে থাকলে কি হবে, নেকড়ে বাঘ মানুষের গন্ধ ঠিক টের পায়। সে গুছিয়ে বসতে না বসতে সত্যিই এক নেকড়ে বাঘ কোথা থেকে লাফিয়ে এসে তার টুটি কামড়ে ধরলাে। বাঘ কামড়াবার আগে ভয় পেয়ে মার্গারিটা চিৎকার করে উঠেছিল, বাঁচাও কে কোথায় আছ বাঁচাও। বাঘ যেমন একটা মেষশাবককে টেনে নিয়ে যায় সেইভাবে মার্গারিটাকে বাঘ অবলীলায় টেনে নিয়ে চললাে। ভাগ্যে সেই সময়ে বনে কয়েকজন করে এসেছিল। তারা চিৎকার শুনে ছুটে এসে তাড়া দিতে বাঘ পালিয়ে গেল।

কাঠুরেরা মার্গারিটাকে চিনত। তারা ধরাধরি করে তাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। গলা দিয়ে রক্ত বেরােচ্ছে, নখের আঁচড়ে সারা মুখ ক্ষতবিক্ষত। | সুচিকিৎসা ও টালানাের সেবা ও যত্নের ফলে মার্গারিটা বেঁচে গেল ও ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু তার অমন সুন্দর মুখখানা এমন বিকৃত হয়ে গেল যে, সে লজ্জায় বাড়ি থেকে আর বেরতই না। বাড়িতে কেউ এলে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঢেকে ফেলত। এখন সে মাঝে মাঝে চোখের জল ফেলে আফশােস করে স্বামীর নিষেধ কেন শুনল না। তবে একটা কাজ হয়েছে, সে তার জিদ সংযত করেছে। বিশ্বাস হয়েছে যে স্বপ্ন সত্যি হয়।

 

অষ্টম গল্প

চিয়াকো ভীষণ পেটুক। বিয়ানডেলাে তাকে এক জায়গায় ব্রেকফাস্টের নেমতন্ন করে ঠকাল। চিয়াকে ছাড়বার পাত্র নয়, সেও উপযুক্ত প্রতিশােধ নিল।

প্যামপিনিয়ার গল্প শুনে কয়েকজন মন্তব্য করলাে টালানাে যা দেখেছিল তা স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের মধ্য নিয়ে তার দেবতা তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। কি ঘটতে যাচ্ছে তাকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেক মানুষ জেগে বসে বা শুয়ে এমন প্রত্যাদেশ পেয়ে থাকে। যাই হক ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক সাবধান হতে দোষ কি? লাভ ছাড়া ক্ষতি তাে হয় না।

কুইন এবার লরেতাকে গল্প বলতে বললেন। লরেতা বলল, আমিও একটা ভিন্ন স্বাদের গল্প বলবাে। তাহলে শােনাে ভাই :

ফ্লোরেন্সে চিয়াকো নামে একটি লোেক ছিল। তা এমন লােক তাে কতই থাকে। তবে এই লােকটির একটি বিশেষত্ব ছিল, লােকটি দারুণ পেটুক ছিল। পেটুক-সম্রাট বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। তার যা আয় ছিল তাতে নিজের খরচে একবারই সে পেটভরে খেতে পেত না। তাই রে করতাে কি কোথাও কেউ খাচ্ছে কিংবা ভােজসভা বসেছে সেখানে সে বিনা নিমন্ত্রণেই ঢুকে যেত আর চেনা লােক হলে তাে কথাই নেই, সে তার বাড়িতেই হােক বা ভােজনাগারেই হােক সে বিনা আহ্বানে নির্লজ্জের মতাে ঢুকে পড়ে পাশে বসে বলতাে, কি খাচ্ছ ভাই? বাঃ মাছ ভাজার বেশ গন্ধ বেরােচ্ছে তাে। খান আষ্টেক হবে নাকি? তার কোনাে লজ্জা ছিল না, কেউ টিটকিরি কাটলেও গ্রাহ্য করতাে না।

এহেন চিয়াকো ইস্টার পর্বের আগে একদিন মাছের বাজারে দেখল যে তার বন্ধু বিয়ােনডেলাে ভিয়েরি ডি চার্চি-এর জন্যে একজোড়া বেশ বড় শােল মাছ কিনল।

চিয়াকো এগিয়ে গিয়ে বন্ধুকে বলল, বাঃ বেশ একজোড়া মাছ কিনেছ তাে?

বিয়ােনডেলাে বলল, আরে এত কি দেখছ? কোরসস ডােনাটির জন্যে কাল বিকেলে যে তিনটে মাছ কিনেছি না সেগুলাে এর চেয়ে আরও লম্বা আর পুরুষ্টু। আর তার ওপর চকচকে একটা শংকর মাছ। আজ তাে কোরােসাের বাড়িতে দারুণ ব্যাপার, ব্রেকফাস্টে কয়েকজনকে ডেকেছে। ভেবেছিল ঐ ক’টা মাছে কুলােবে না, তাই আরও কয়েকটা মাছ কিনে পাঠিয়েছি। আমরা বন্ধুরা ভাবে আমি মাছ ভালাে চিনি আর দরদামও করতে পারি তাই আমাকেই ওরা কিনতে দেয়, তা তুমি কোরাসাের বাড়ি যাবে নাকি?

চিয়াকে বলল, এ আবার জিজ্ঞাসা করছাে কি? আমি তাে এখনি মাছভাজার গন্ধ পাচ্ছি। বাড়ি ফিরেই পােশাক পালটে আমি যাব।

চিয়াকো যে ব্রেকফাস্ট করতে আসছে এই খবরটা বিয়ােনডেলাে মাছ পৌছে দেবার সময় কোরসােকে দিয়ে দিল। কোরলাে বলল, সর্বনাশ! কিন্তু সে খুব চতুর ব্যক্তি।

কিছুক্ষণ পরে সাজগােজ করে চিয়াকো তাে কোরসাের বাড়ি হাজির হয়ে দেখল কয়েকজন প্রতিবেশী ও কোরসাে বসে আছে। চিয়াকোকে দেখে জিজ্ঞাসা করলাে : কি খবর চিয়াকো?

এই এলুম আর কি তােমাদের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে।

কোরসাে মৃদু হেসে বলল, এ তাে খুব ভালাে কথা। তাহলে চলাে আমরা সকলে পাশের ঘরে যাই, ওখানে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হচ্ছে।

পাশের ঘরে এসে সকলে টেবিলে বসলাে। চিয়াকোর তাে জিভে জল এসে গেছে। আজ দারুণ খাওয়া হবে। কি বড় বড় মাছ কেনা হয়েছে। আধখানা মাছ তাে খাবই।

প্রথমে এলাে ছােট বাটি ভর্তি পেঁয়াজের স্যুপ। সে তাে চিয়াকোর চক্ষের নিমেষে খাওয়া হয়ে গেল। তারপর বরবাটি আর খুব ছােট মাছের টুকরাে দিয়ে তরকারি। এ পদটাও চিয়াকে সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে ফেলল। তারপর হাত গুটিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, এবার নিশ্চয় বড় প্লেটভর্তি বড় বড় মাছের পিস আসবে।

একজন প্রতিবেশী জল খেয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, কোরসাে চিয়াকোকে আর এক বাটি তরকারি দিতে বলে।

কোরসেও তখন জল খেয়ে মুখ মুছছিল। সে বলল, আরে চিয়াকোর আর সে খাওয়া নেই, দেখলে না এটুকু খেতেই ওর কষ্ট হল। চলো, ওঠা যাক, বারান্দায় বসে একটু গল্পগুজব করা

চিয়াকো হতাশ। মনে মনে বিয়ােনডেলাের মাথা চিবােতে চিবােতে উঠে পড়ে বলল, আমি আর বসবাে না, আমার জরুরী কাজ আছে। বেশ বােঝা গেল চিয়াকো রেগে গেছে। সকলে। টেবিল থেকে ওঠবার আগেই চিয়াকে জোরে জোরে পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর ঘর তথা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পরই বড় বড় প্লেটে বড় বড় পিসের মাছ ভাজা পরিবেশিত হল। মসলা দিয়ে ভাজা সে মাছের স্বাদগন্ধই আলাদা।

এবার কোরেসাে ও আর সকলে খুব হাসাহাসি আরম্ভ করলাে। চিয়াকোকে খুব ঠকানাে গেছে।

চিয়াকো রাগে ফুঁসতে ফুসতে বাড়ি ফিরে ঠিক করলাে এর শােধ নিতেই হবে। বিয়ােনডেলােকে সে জব্দ করবে। সে কেন তাকে ধাক্কা দিয়ে বােকা বানাল?

দু’দিন পরে বিয়য়ানডেলাের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। সে জিজ্ঞাসা করলাে, কি চিয়াকো সেদিন ব্রেকফাস্ট কেমন হল ?

চিয়াকে বলল, কেমন হল? তা তুমি কাল পরশু নিজেই জানতে পারবে। আমাকে উত্তর দিতে হবে না।

বিয়ােনডেলাে কিছু না বলে নিজের কাজে চলে গেল। সে তাে জানে চিয়াকো তার ওপর ক্ষেপে আছে।

বিয়ােনডেলােকে জব্দ করবার মতলব চিয়াকো এঁটে ফেলেছে। তার বাড়ি থেকে কিছু দূরে অন্য একটা পাড়ায় ফিলিপপা আর্জেন্টি নামে ষণ্ডামার্কা, পাজী ও ভীষণ রাগী একজন গুণ্ডা বাস করতাে। লােকটা ছিল ভীষণ বদমেজাজী আর কথায় কথায় তার হাত চলতাে। তার কাছে কেউ লাল সুরা চাইলে ভীষণ রেগে যেত এবং দু’চার ঘা লাগিয়ে দিত।

চিয়াকে তার পাড়ার একটি চতুর ও চটপটে ছেলেকে ডেকে তার হাতে একটা বােতল দিয়ে বলল, যা তাে ফিলিপপার কাছে, তাকে বলবি তােকে বিয়ােনডেলাে পাঠিয়েছে, অন্তত আধ বােতল লাল সুরা দিতে হবে, সে গলা ভেজাবে কিন্তু ফিলিপােকে তাে তুই জানিস। কাছে যাবি না, তফাতে থাকবি যেন তাের নাগাল না পায়। তারপরে বােতল নিয়ে ফিরে আসবি, আমি তােকে বখশিস দেব।

ছােকরা গিয়ে দেখল ফিলিপাে তার বাড়ির দরজার সামনে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। ছােকরা শেখানাে মতাে ফিলিপপাকে বলল, বিয়ােনডেলাে এই বােতল পাঠিয়ে দিয়েছে, বলেছে আধ বােতল লাল সুরা দিতে। বিয়ােনডেলােকে ফিলিপাে চিনত। সে চিৎকার করে বলল, বিয়ােনডেলাে কি রােমের রাজা?

তার এতদূর আস্পর্ধা যে নিজে না এসে মদের জন্যে লােক পাঠিয়েছে, আয় কাছে আয়, ভালাে করে মদ দিচ্ছি।

এই কথা শুনেই তাে ছােকরা আর অপেক্ষা না করেই চম্পট দিয়েছে। ফিরে এসে সব বনে চিয়াকোকে বােতল ফেরত দিয়ে বখশিস নিয়ে চলে গেল।

চিয়াকে এবার বিয়ােনডেলাের বাসায় গিয়ে তাকে বলল, ওহে আমি লজ্জিয়া পাড়ায় এখন গিয়েছিলাম। ফিলিপে আর্জেন্টি তােমাকে আজ এখনি দেখা করতে বলল, বােধহয় মাছ কিনতে দেবে।

উত্তম সংবাদ, আমি এখনি যাচ্ছি, আমারও কিছু লাভ হবে। যাই তাহলে। ওর মেজাজ কেমন দেখে এলে?

ভালই তাে দেখে এলাম, তুমি নির্ভয়ে যাও, চিয়াকো বলল। বিয়ােনডেলােকে ফিলিপােব বাড়ির পথ ধরতে দেখে চিয়াকো মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে এলাে।

এদিকে বিয়ােনডেলােকে দেখেই ফিলিপাে সিঁড়ি থেকে নেমে এসে, তাের এতদূর আস্পর্ধা ? নিজেকে কি ভাবিস রে ব্যাটা, বলেই বিয়ােনডেলাের গালে সশব্দে দুটো চড় সপাটে কসিয়ে দিল।

আরে আরে এর মানে কি ?

এর মানে এই, বলে ফিলিপাে ওর মুখে এমন জোরে এক খুসি বসাল যে বিয়ােনডেলাের দু’টো দাঁত ভেঙে গেল। তাকে তাে ফিলিপাে যাচ্ছেতাই করে গালাগাল দিল এবং আরও দু’চার ঘা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফলে দিয়ে বলল, আর কখনও লাল মদ চেয়ে পাঠাবি না।

কয়েকজন লােক এসে না পড়লে বিয়ােনডেলাে আরও মার খেত। তারা তাকে রাস্তা থেকে তুলে শুসা। করে তার বাড়ির পথ ধরিয়ে দিল। সে যে মদের জন্যে কোনাে লােক পাঠায় নি এ কথাটাও বলার সুযােগ পায় না।

চিয়াকোটা এমন পাজী যে বিয়ােনডেলাে বাড়ি ফেরার পথে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। তার বিপর্যস্ত চহারার দিকে চেয়ে চিয়াকে জিজ্ঞাসা করলাে, কি বিয়ােনডেলাে তােমাকে ফিলিপে কেমন সুধা পান হলাে?

বিয়ােনডেলাে বেচারা জবাব দিল, তােমাকে কোরসসা যেমন মাছ খাইয়েছিল তার চেয়ে বেশি ববং ক নয়। বিয়ােনডেলাে এরপর চিয়াকোকে ঘাটাতে সাহস পায় নি।

 

নবম গল্প

দুই যুবক বন্ধু জ্ঞানী সলােমনের উপদেশ চাইল। একজন জিজ্ঞাসা করলাে সে কি করে মানুষের ভালবাসা অর্জন করবে আর অপরজন জিজ্ঞাসা করলাে সে কি করে তার জেদী ও একগুয়ে স্ত্রীকে শায়েস্তা করবে। প্রথমজনকে সলােমন বললেন, ভালােবাসা আর দ্বিতীয়জনকে বললেন গুজব্রিজ নামে সেতুতে যেতে।

লরেতার গল্প শেষ হল। ছেলেমেয়েদের দল চিয়াকো আর বিয়ােনডেলাের শঠতার আলােচনাও শেষ করলো। কুইন দেখল আটজন ছেলে-মেয়েরই গল্প বলা শেষ হয়েছে। এবার ডায়ােনিও গল্প বলতে পারে। কিন্তু কুইন ঠিক করলাে নবম গল্পটা নবম কন্যাই বলবে। পরের মানে আজকের শেষ ও দশম গল্পটা ডায়ােনিও বলবে। কালকেও শেষ গল্প ডায়ােনিওই বলেছিল।

কুইন এমিলেয়া বলল, আমরা নারীরা কোমল ও দুর্বল। আমাদের পুরুষের শাসন মেনে বাস করতে হয়। মেয়েরা যতদিন তাদের প্রতি আরােপিত বিধান মেনে চলে ততদিন সংসার সুখের হয়। কিন্তু নারী যদি নিয়ম ভেঙে বিদ্রোহ করে বা আদেশ মানতে না চায় তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। তবে আমাদের পুরুষদেরও দায়িত্ব আছে। আমরা উভয়ে যদি সামাজিক ও মানবিক সব বিধান মেনে চলি তাহলে আমবা পুনে বাস করতে পারি নচেৎ গােলমাল। আমি যে গল্পটা বলছি তা থেকে আমরা উভয়েই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।

তােমরা সকলেই জান যে জ্ঞানী ব্যক্তি বলতে আমরা সলােমনের নামই উল্লেখ করি। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন সলােমনের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই উপদেশ নেবার জন্যে ও বিচারের জন্যে সারা পৃথিবী থেকে নরনারী তার কাছে যেত।

লাজাজোর এক ধনী ও অভিজাত পরিবারের সন্তান মেলিসাস কোনাে বিষয়ে সলােমনের উপদেশ শােনবার জন্যে জেরুজালেম যাত্রা করলাে।

এই উদ্দেশ্যে সে আন্টিয়ােক ত্যাগ করে কিছু দূর যাবার পর লক্ষ্য করলাে আরও একজন যুবক তারই মতাে অশ্বারােহণে একই পথে যাচ্ছে। তখন মেলিসাস তার সঙ্গে আলাপ করলাে। তার নাম যােসেফ। দু’জনে তখন গল্প করতে করতে পথ চলতে লাগল।

যােসেফের পরিচয় জেনে নিয়ে তাকে মেলিসাস জিজ্ঞাসা করলাে সে কোথায় এবং কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। যােসেফ বলল সে তার স্ত্রীর বিষয়ে পরামর্শ চাইতে সলােমনের কাছে যাচ্ছে। তার স্ত্রী অত্যন্ত জেল ও দুর্বিনীত। এমন স্ত্রীকে সে কি করে শায়েস্তা করবে এই উপদেশ নিতেই সে সলােমনের কাছে যাচ্ছে।

এবার জিজ্ঞাসা করলাে, মেলিসাস তুমি কোথায় যাচ্ছ?

মেলিসাস বলল, আমিও সলােমনের কাছেই যাচ্ছি তবে আমার সমস্যা ভিন্ন। আমি ধনী। বন্ধুদের বিপদে সাহায্য করি, তাদের ভােজ্য পানীয়ে আপ্যায়িত করি কিন্তু তাদের মধ্যে আমি একটিও বন্ধু পেলুম না। তারা আড়ালে আমাকে বােকা ভাবে, উপহাস করে তাই আমি সলােমনের কাছে জানতে যাচ্ছি কি করে প্রকৃত বন্ধু পাবাে অথবা মানুষের সহানুভূতি আকর্ষণ করতে পারবাে কারণ এত করেও লাভ কিছু হচ্ছে না। আমি মনে খুব ব্যথা পাচ্ছি। কারও ভালবাসা পাচ্ছি না।

দু’জনে বন্ধুত্ব হয়ে ভালােই হল, দু’জনে একই পথের যাত্রী, উভয়ের উদ্দেশ্য একই। পথ অনেকটা, দু’জনে একসঙ্গে থাকলে কষ্ট কিছু লাঘব হবে।

চলতে চলতে দীর্ঘপথ একদিন শেষ হয়, ওরা নিরাপদের জেরুজালেম এসে পৌছায়। সলােমনের বিরাট দরবার। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক নরনারী এসেছে। তাদের পরপর ডাক পড়ছে, যে আগে এসেছে তাকে আগে ডাকা হচ্ছে। দু’দিন অপেক্ষা করার পর তৃতীয় দিন সকালে তাদের ডাক পড়ল।

প্রথমে ডাক পড়ল মেলিসাসের। সােমন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তার সমস্যা কি? মেলিসাস সংক্ষেপে তার সমস্যা বলে উপদেশ ভিক্ষা করলাে। সলােমন উত্তর দিলেন তুমি তােমার বন্ধুদের ভালবেসে যাও।

মেলিসাসকে সভায় আর থাকতে দেওয়া হল না। এত ভিড় যে যাদের কাজ হয়ে গেছে তাদের আর বসবার জন্যে তাে নয়ই, দাঁড়াবার জায়গাও দেওয়া যায় না। মেলিসাস সভা থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে বিশাল প্রাঙ্গণে অনেকের সঙ্গে বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

মেলিসাসের পরে ডাক পড়ল যােসেফের। যােসেফ তার স্ত্রীর কথা বলল। সলােমন তাকে উপদেশ দিলেন গুজব্রিজ সেতুতে যাও। সলােমনের কাছে সমস্যা সংক্ষেপে বলতে হয়, তিনিও যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে, একটি বা দুটি শব্দে উত্তর দেন। কারণ সময়ের অভাব।

যােসেফ বাইরে এসে দেখল তার বন্ধু মেলিসাস তার জন্যে অপেক্ষা করছে। দুই বন্ধু উপদেশ শুনে

কিন্তু ধোঁকায় পড়ল। মেলিসাস ভাবল সে তাে বন্ধুদের ভালােবেসেই যাচ্ছে তাহলে উনি নতুন কি উপদেশ দিলেন? আর যােসেফ গুজব্রিজ সেতুতে যাও-এর অর্থ ওরা বুঝতে পারল না। তবুও জ্ঞানী ব্যক্তি যখন উপদেশ দিয়েছেন নিশ্চই ওরা আলাে দেখতে পাবে। অতএব দুই বন্ধু নিজ নিজ গন্তব্যস্থানের পথ ধরলাে।

কয়েকদিন চলার পর ওরা একটি নদীর ওপর সুন্দর একটি সেতুর ওপর এসে পৌছল। সেতুটি সরু। মানুষ ছাড়া মালবাহী অশ্ব অশ্বতর গর্দভের ভিড়ে সেতুর ওপর জট বেঁধেছে, এখন পার হওয়া সম্ভব নয়। দুই বন্ধু অপেক্ষা করতে লাগল।

ভিড় ক্রমশ পাতলা হয়ে এলাে। ওরা যখন নিজ নিজ অশ্বে ওঠবার উপক্রম করছে সেইসময় দেখল যে একটি অশ্বতরর পিঠে তার মালিক মাল বােঝাই করেছে, কিন্তু ভয় পেয়ে থােক বা যে কারণে হােক জন্তুটি এক পাও এগােচ্ছে না। মাঝে মাঝে চিহিহি আওয়াজ করছে, কান নড়ছে কিন্তু একটি পাও এগােচ্ছে না। মালিক অনেক চেষ্টা করছে, দড়ি ধরে টানছে কিন্তু জন্তুটি পাথরের মূর্তির মতাে নিশ্চল। মালিক তার জন্তুটিকে কিছু ঘাস খেতে দিল। গায়ে, মাথায় হাত বােলাল কিন্তু তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন যে পাদমেকং ন গচ্ছামি।

তখন অশ্বতরর মালিক রেগে গেল। একটা লাঠি বার করে প্রথমে আস্তে কয়েক ঘা কিন্তু তাতেও যখন

কাজ হল না তখন আরও জোরে বেশ কয়েক ঘা। তবুও অশ্বতর নড়বেন না। তখন মালিক ক্ষেপে গিয়ে নিষ্ঠুরের মতাে মারতে লাগল। অশ্বতর চার পা তুলে লাফাতে লাগল, চিৎকার তাে করছেই আর সেতুর এধার থেকে ওধারে যাচ্ছে কিন্তু সামনের দিকে এগােচ্ছে না।

মালিকের এই নিষ্ঠুর আচরণ আর সহ্য করতে না পেরে দুই বন্ধু মালিককে ভৎসনা করতে লাগল, বলল, তুমি কি অবলা জীবটা মেরে ফেলবে নাকি হে।

মালিক বিরক্ত হয়ে বলল,মশাই আপনারা দয়া করে চুপ করুন। আপনারা আমাদের অশ্ব চেনেন, আমিও আমার অশ্ব এই পাজী খচ্চরটাকে চিনি। আমাকে আমার কাজ করতে দিন। কথা শেষ করে মালিক জন্তুটাকে আরও দু’ঘা দিয়ে কান দুটো মুচড়ে দিতেই জন্তু গুটিগুটি চলতে লাগল।

দুই বন্ধুও ঘােড়ায় উঠে চলতে আরম্ভ করলাে। সেতুর ওপর উঠে দেখল একজন লােক সেতুর একধারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। তাকে ওরা জিজ্ঞাসা করলাে সেতুটির নাম কি? লােকটা উত্তর দিল, মহাশয় এই সেতুর নাম গুজব্রিজ।

যােসেফ তখন বন্ধুকে বলল, এবার আমি বুঝতে পারলুম কেন সলােমন আমাকে গুজব্রিজ সেতুতে আসতে বলেছেন। কিন্তু ভাই আমি তাে আমার স্ত্রীকে ঠিকমত মারতে শিখি নি, এখন শিখলুম।

আরও কয়েকদিন চলবার পর যােসেফ তার গ্রাম আস্টিওতে পৌছল। মেলিসাসকে যােসেফ অনুরােধ করলাে তার আতিথ্য গ্রহণ করে তার বাড়িতে দু’চার দিন কাটিয়ে যেতে। মেলিসাস রাজি হল।

দীর্ঘদিন পরে স্বামী বাড়ি ফিরলে পত্নী যেমন উল্লসিত হয় এ ক্ষেত্রে পত্নী তাে উল্লসিত হলই না উপরন্তু সঙ্গে একজন অতিথি এসেছে দেখে রীতিমতাে বিরক্ত হল।

যােসেফ মেলিসাসের সঙ্গে পত্নীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে বলল, মেলিসাসকে জিজ্ঞেস করাে রাত্রে ও কি খেতে ভালবাসে, ওকে সেইমতাে রান্না করে দিয়ে। স্ত্রী অতিথিকে জিজ্ঞেস করলাে বটে কিন্তু রান্না করলাে নিজের ইচ্ছামতাে। যােসেফ বিরক্ত হল। অতিথিকে অপমান করা হল।

যােসেফ স্ত্রীকে বকাবকি আরম্ভ করলাে। স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলল, ইস বাবুলাট এলেন, সঙ্গে আবার তল্পিদার এনেছেন। তার লকলকে নােলা দেখে রাঁধতে হবে। আমি পারবাে না, যা পেরেছি রেধেছি, ইচ্ছে হয় খাও না হয় ফেলে দাও।

এ কথা শুনে মেলিসাস তাে অপ্রস্তুত এবং অপমানিত বােধ করলাে কিন্তু সঙ্গত কারণেই সে নিজে কিছু বলল না। যােসেফ কিন্তু রেগে গেল। সে তার স্ত্রীকে বলল, আমি অনেক দিন বাড়ি ছাড়া, ভেবেছিলুম আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তােমার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু ভালাে করেই দেখেছি তা হয়নি। অতএব আমাকে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে এবং দেখবাে তাতে তােমার মতিমতির পরিবর্তন হয় কিনা।

যােসেফ মেলিসাসের দিকে ফিরে বলল, বন্ধু তাহলে এবার দেখা যাক সলােমনের মূল্যবান উপদেশ প্রয়ােগ করে কাজ হয় কিনা। তুমি চলে যেয়াে না, বাধা দিয়াে না কারণ সেই অশ্বতরর মালিকের কথা ভুলে যাও নি, যে বলেছিল আমার খচ্চরকে আমি চিনি।

মেলিসাস বলল, আমি তােমার অতিথি, তােমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার কথা বলার ইচ্ছে নেই।

যােসেফ তখন ওক গাছের একটা সরু ডাল ভেঙে এনে স্ত্রীর শয়নঘরে প্রবেশ করলাে কারণ স্ত্রী তখন শুতে যাচ্ছিল। স্ত্রীর উদ্দেশে কটুকথা সরবে উচ্চারণ করতে করতে ঘরে ঢুকে স্ত্রীর চুল ধরে টেনে মেঝেতে ফেলে গাছের ডাল দিয়ে মারতে আরম্ভ করলাে। মরে গেলুম, বলে স্ত্রী তাে কান্না আরম্ভ করে দিল কিন্তু স্ত্রীর কান্নায় কান না দিয়ে সে স্ত্রীকে প্রহার করেই চলল। তার পরিধেয় ছিন্নবিচ্ছিন্ন, মারের চোখে কয়েক জায়গায় কেটে রক্তও বেরিয়ে পড়ল। স্ত্রী এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেল, লােকটা ক্ষেপে গেছে, খুন করবে নাকি?

সে তখন ছেড়া জামা দিয়ে কোনরকমে নিজের লজ্জা নিবারণ করতে করতে কাতর স্বরে বলতে আরম্ভ করলাে, ওগাে আর মেরাে না, দয়া করাে আমি আর এমন কাজ করবাে না।

যােসেফ বলল, ঠিক বলছিস? ভগবানের নামে দিব্যি করে বল এবার থেকে আমার সব কথা শুনবি। কান মল নাকখত দে।

স্বামীর সব কথা পালন করে সে খাটে উঠে উপুর হয়ে পড়ে কাদতে লাগল।

মেলিসাসকে যােসেফ বলল, কালই বােঝা যাবে সলােমনের উপদেশে কাজ হল কিনা। চলাে আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়ি।

স্ত্রী সারারাত আর ওঠে নি, কঁদতে কাঁদতে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন ঘুম থেকে উঠে বাড়িঘর পরিষ্কার করে স্নান সেরে উত্তম পােশাক পরে স্বামী ও অতিথির সামনে এসে সুপ্রভাত জানিয়ে বিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাে, ব্রেকফাস্ট কি খাবেন?

ওরা দুই বন্ধু যেমন বলল ঠিক সেইভাবে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে স্ত্রী সযত্নে পরিবেশন করলাে। যাবার সময় যােসেফ যা আদেশ করেছিল স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে সে সব পালন করছিল। এসময় বন্ধুকে যােসেফ বলল, হাজার-হােক সলােমন মহাজ্ঞানী তার উপদেশের মূল্য আছে, তার বলে দেওয়া দাওয়াই প্রয়ােগ করে কাজ হয়েছে।

মেলিসাস আর কয়েকদিন পরে লাজাজোতে ফিরে গেল। একদিন সে তার বুদ্ধিমান বন্ধুকে সলােমনের কথা এবং কি উপদেশ দিয়েছে সে কথা বলল।

বন্ধু সব শুনে বলল, সলােমন ঠিক উপদেশই দিয়েছেন। তুমি তােমার বন্ধুদের বা অন্য ব্যক্তিরও উপকার করেছ, তাই প্রচুর পরিমাণে মুখরােচক খাদ্যপানীয় খাইয়েছে। এসব ঠিক কিন্তু তুমি যা করেছ তা ভালবেসে নয়, তােমার অর্থ ও সম্পদ জাহির করবার জন্যে। তুমি বন্ধুদের ভালবাস, প্রতিদানে নিশ্চয় ভালবাসা পাবে।

এরপর যােসেফের স্ত্রী যেমন শান্ত হল এবং সংসারে সুখ ও শান্তি ফিরে এলাে, তেমনি মেলিসাসও বন্ধুদের প্রতি সহানুভূতি ও ভালবাসা প্রকাশ করতে লাগল। সে ভালবাসা পেল।

 

দশম গল্প

প্রতিবেশী পিয়েত্রা ফাদার জিয়ানিকে বিশেষ ভাবে ধরে পড়ল তার বৌকে জাদুবলে ঘােটকীতে রূপান্তরিত করে দিতে কিন্তু লেজ লাগবার সময় শর্ত ভেঙে পিয়েত্রো যেই কথা বলেছেলেজ চাই নাঅমনি জাদুবল কেটে গেল।

এমিলিয়া গল্প শেষ করলাে। ছেলেরা খুব হাহাসি করলাে কিন্তু মেয়েরা মুখ গােমড়া করে রইল। এ কিরকম কথা, বৌকে শায়েস্তা করবার জন্যে চোরের মার মারতে হবে? ছেলেরা বলল, বান্ধবীরা তােমরা রাগ করছাে কেন: চোরকেই মার খেতে হয়, তােমরা তাে চোর নও, তবে রাগ করছ কেন?

এবার শেষ গল্প বলবে ডায়ােনিও, তাকে আগেই সে কথা বলে দেওয়া হয়েছিল। তাই ডায়ােনিও আগে একটু ভূমিকা করে বলল, এই সবুজ ঘাসের ওপরে যদি একপাল সাদা ধবধবে পায়রা এসে বসে দেখতে খুব ভালাে লাগবে কিন্তু সেই পায়রার দলের মাঝে যদি একটা কালাে কাক এসে বসে তাহলে সাদা পায়রার ঔজ্জ্বল্য আরও বাড়বে, তেমনি বুদ্ধিমানদের দলে যদি আমার মতাে একজন বােকা থাকে তাহলে বুদ্ধিমানদের ধার পরীক্ষা হয়ে যায়। তা আমি বােকার মতােই বােকা লােকের গল্প বলছি দেখ তােমাদের ভালাে লাগে কিনা।

কিছুদিন আগে বারলেতায় ফাদার জিয়ানি ডি বারলাে নামে একজন যাজক বাস করতাে। অবস্থা ভালাে ছিল না, গরিবই বলতে হবে। গির্জা থেকে যে সামান্য বেতন পায় তাতে চলে না অতএব অতিরিক্ত রােজগার করা দরকার। তার একটা ঘােটকী ছিল। সে ঘােটকীয় পিঠে পাল বােঝাই করে দোকানে দোকানে মাল খালাস করে কিছু বােজগার করতাে। আর আপলিয়ার চারদিকে যখন মেলা বসততা তখন সেই ঘােটকীর পিঠে সওদা বােঝাই করে মেলায় বিক্রি করে কিছু লাভ করত।

এইভাবে দোকানে মাল বিলি করা ও মেলায় মেলায় ঘােরার সময়ে পিয়েত্রো ডা ট্রেস্টানি নামে একজনের সঙ্গে আলাপ হল। পিয়েত্রোও মাল টানার কাজ করতাে কিন্তু তার ঘােড়া ছিল না, ছিল একটা গাধা। দু’জনে একই পথের পথিক তাই ঘনিষ্ঠতা হতে দেরি হয়নি তায় অবস্থা তাদের সমান। পিয়েত্রো বারলেতায় এলে ফাদার জিয়ানি তাকে তার গির্জার ঘরে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়িত করতাে।

পিয়ােত্রোর অবস্থা আরও খারাপ। ট্রেসান্টিতে ছিল ছােট্ট একটা কুঁড়ে তারই একধারে গাধাটা রাখতাে আর ছােট ঘরে যে ছােট তক্তাপােষ ছিল তাতে সে তার বৌকে নিয়ে শুত। বৌটির চেহারাটি ভালাে, স্বাস্থ্যবতী, পুরন্ত যৌবন, পরিশ্রমী।

ফাদার জিয়ানি মিতের বাড়ি এলে সেও জিয়ানিকে যথাসাধ্য আপ্যায়িত করতাে। একবার পিয়েত্রোর বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। সঙ্গে জিয়ানি আছে। জিয়ানির সে রাতে বাসায় ফেরার উপায় নেই কিন্তু মিতের বাড়িতে থাকবার জায়গা কোথায়?

ঠিক হল ফাদার জিয়ানি গাধার আস্তাবলে নিজের ঘােটকীটি নিয়ে বিচালি বিছিয়ে শশাবে। পিয়েত্রোর বৌ জেমাতা একথা শুনে স্বামীকে বলল, সে কি? তুমি ফাদারের বাসায় গেলে ফাদার তােমায় কত যত্ন করে আর উনি কিনা আস্তাবলে বিচালি বিছিয়ে শশাবেন? তা হয় না। আমি বরঞ্চ আমার বান্ধবী জিটার বাড়িতে গিয়ে শুচ্ছি, তুমি আর ফাদার ঘরে তক্তাপােষে শােও।

এ কথা শুনে ফাদার জিয়ানি বলল, জেমাতা তুমি আমার জন্যে ব্যস্ত হােয়াে না। আমার অমন শশায়া অভ্যাস আছে, তাছাড়া আমি তাে রাত্রে মন্ত্র পড়ে আমার ঘােটকীকে যুবতী করে নিয়ে তাকে নিয়ে আরামেই শুই। সকালে আবার ওকে ঘােটকী করে পিঠে মাল বােঝাই করে রাস্তায় বেরােই। আমার জন্যে ভেবাে না।

পিয়েত্রোর যুবতী বৌ ফাদারের কথাগুলাে অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে স্বামীকে বলল, ফাদারের সঙ্গে তাে খুব বন্ধুত্ব, গলায় গলায় ভাব। তাই যদি হয় ফাদারের কাছ থেকে ঘােটকী থেকে মানবী থেকে ঘােটকী করা জাদুমন্ত্রটা শিখে নাও না? তাহলে দিনের বেলায় তুমি আমাকে ঘােটকী করে পিঠে মাল বােঝাই করে বাজারে বেরােবে আর গাধাটার পিঠেও মাল থাকবে, তাহলে আমাদের ডবল আয় হবে আর বাড়ি ফিরে তুমি আমাকে আবার তােমার বৌ করে নেবে, কেমন হবে? বলাে না গাে ফাদারকে।

পিয়েত্রোও একজন ছােটখাটো যাজক তাহলেও তার বুদ্ধি সীমাবদ্ধ। সরল এবং বুদ্ধিহীন, সাধারণ বুদ্ধিটুকুও নেই। সেও স্ত্রীর প্রস্তাব সমর্থন করে ফাদার জিয়ানিকে বারবার অনুরােধ করতে লাগল। মন্ত্রটা শিখিয়ে দিতে।

আসলে মন্ত্র বলে তাে কিছুই নেই আর ঘােড়াকে ফাদার মানুষ করতেও জানে না তাই পিয়েত্রোর অনুবােধ এড়িয়ে যেত কিন্তু একদিন রাতে পিয়েত্রো তার বাসায় জিয়ানিকে এত বেশি কাকুতিমিনতি করতে লাগল যে জিয়ানি আর এড়াতে না পেরে বলল, বেশ, অন্যদিনের মতাে কাল ভােরে উঠে আমি তােমাদের দেখিয়ে দেব কি করে জেমাতাকে ঘােটকী করা যাবে। কিন্তু ব্যাপার কি জান? সর্বাপেক্ষা কঠিক কাজ হল লেজ লাগিয়ে দেওয়া।

সে রাত্রে পিয়েত্রো আর জেমাতা উত্তেজনায় ঘুমােতে পারল না। কখন ভাের হবে, জাদুবিদ্যা প্রত্যক্ষ করবে। নানারকম অনুমান করতে লাগল তারা কিন্তু ফাদারের বিদ্যার ওপর তাদের এতই অগাধ বিশ্বাস যে রাতে শুতে যাবার আগে তারা একবারও তাকে অনুরােধ করলাে না যে আপনি আপনার ঘােটকীকে কি করে মানবী করবেন আমাদের দেখান অথবা রাত্রে আস্তাবলে গিয়ে একবারও দেখে এলাে না যে ফাদার সত্যিই কি তার ঘােটকীকে মানবী করে পাশে নিয়ে শুয়ে আছেন।

পরিদন ভোের হবার আগেই ফাদার, পিয়েত্রো ও জেমাতা উঠে পড়ল। ওরা সেই আস্তাবলের একটা দিক একটু পরিষ্কার করে সমবেত হল।

ফাদার জিয়ানি পিয়েত্রোকে বলল, মিতে এ বড় কঠিন কাজ, দেবতারা কুপিত হয়ে আমাকে শাপ দিতে পারেন তবুও আমি যা করছি তা শুধু তােমার জন্যেই করছি। তবে আমি যা বলবাে আমার প্রত্যেকটি কথা তােমাদের বিশেষ করে তােমাকে অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে তবেই তুমি সফল হবে।

তখনও ঘরে আলাে আসে নি। ফাদার জিয়ানি একটা লণ্ঠন জ্বেলে পিয়েত্রোকে বললেন, এটা ধরে দাঁড়াও আর শােননা, ভালাে করে শােনাে আমি যাই করি না কেন তুমি আমার কোনাে কাজের প্রতিবাদ করবে না আর খবরদার চুপ করে থাকবে। একটাও কথা বললে বিশেষ করে লেজ লাগাবার সময়, তাহলে জাদুবল কেটে যাবে, এখনও ভেবে দেখ পারবে কি না।

জেমাতা বলল, এ আর শক্ত কি? কিছুক্ষণ কথা বলে আমরা থাকতে পারব না? খুব পারবাে। ফাদার এবার বলুন আমাকে কি করতে হবে? পিয়েত্রোও বলল, সে জিয়ানির আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।

জিয়ানি এবার জেমাতাকে বলল, তুমি তােমার সব পােশাক ছেড়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হও, শিশুর মতাে। জেমাতা এত লজ্জাবতী যে স্বামীর সামনে পােশাক বদলায় না সে বিনা বাক্যব্যয়ে সব পােশাক খুলে উলঙ্গ হয়ে ফাদারের সামনে দাঁড়াল। ফাদার বঁলল, বেশ এবার তুমি দু’হাত আর দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে ঘােড়ার মতাে হও। মুখ বুজে থাকবে, যাই করি না কেন একটিও কথা বলা দূরের কথা টু শব্দটি পর্যন্ত করবে না।

জেমাতা তখনি ঘােড়ার মতাে হল এবং বলল সে কোনাে শব্দ উচ্চারণ করবে না।

এরপর তাে ফাদার জিয়ানি এক কাণ্ডই আরম্ভ করলাে। তার যে এত রত তা কে জানত? জিয়ানি প্রথমে জেমাতার মাথায় মুখে, গালে ঠোটে হাত বােলাতে বােলাতে অনুচ্চ স্বরে মন্ত্রপাঠের সুরে বলতে লাগল, ঘােটকীর মাথা যেন এমন সুন্দর হয়। তারপর তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলতে লাগল। ঘােটকীর ঘাড়ে যেন কোমল কেশর হয়। হাত ও পায়ে হাত বুলিয়ে এমন সুন্দর পা ও ক্ষুর হয় যেন। তার বক্ষযুগল বেশ করে টিপতে টিপতে বলল এমন কোমল চুচুক হয় যেন। পেট, তলপেট, উরু, কোনাে স্থান বাকি রইল না। সর্বত্র হাত বুলিয়ে ও টিপে বলতে লাগল ঘােটকীরও অঙ্গগুলি যেন এমন হয়। এই কাজ করতে করতে জিয়ানি নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, তার পেীকৃষ জেগে উঠেছে।

এবার লেজ গুজে দিতে হবে বলে জিয়ানি তার জামা গুটিয়ে জাগ্রৎ পৌরুষ পশ্চাৎদিক থেকে প্রবেশ করাবার চেষ্টা শুরু করলাে। আর একটু হলেই সফল হতাে কিন্তু ঠিক তখনি পিয়েত্রো বলল, ও কাজটা আমাকে করতে দাও, লেজটা আমিই গুজে দিই।

জিয়ানি কিন্তু নিজেকে সংযত করতে পারল না। পিয়েত্রোকে ধমক দিয়ে বলল, মুখ সব পণ্ড করলি, কথা বললি কেন? শুধু তাে লেজটা প্রবেশ করানাে বাকি ছিল। এখন আমার জাদুল কেটে গেল। শেষ মুহূর্তে তুই সব ভেস্তে দিলি।

পিয়েত্রো ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলল, না তা নয়, আমি বলতে যাচ্ছিলুম যে আমার ঘােটকীর লেজ চাই না। একথা বললে যে জাদুবল পণ্ড হয়ে যাবে তা আমি আশা করি নি।

ততক্ষণে জিয়ানির উদ্দেশ্যে সিদ্ধ হয়েছে। সে তার শার্ট ঠিক করতে করতে বলল, কি আর করা যাবে, তােমাদের বরাত মন্দ, আমাকে এখন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

জেমাতাও তখন উঠে দাঁড়িয়ে স্বামীকে বকতে লাগল। তুমি আর একদণ্ড চুপ করে থাকতে পারলে না? আমি তাে একটুও শব্দ করিনি। আমাদের ভাগ্যটাই মন্দ, আমি ঘােটকী হলে, আমি আর গর্দভ উভয়ে মাল বইতুম, দুটো পয়সা ঘরে আসত। মূখ কোথাকার? বললে লেজ চাই না, লেজ ছাড়া কোনাে ঘােটকী দেখেছ? ফাদার, আমাকে কি আর ঘােটকী করতে পারবেন না?

না জেমাতা আর সম্ভব নয়। জাদুবলে কেটে গেলে আর প্রয়ােগ করা যায় না, সাজা পেতে হয়। প্রায়শ্চিত্ত করে দেখি যদি মুক্তি পাই।

আহা ফাদার আমি দুঃখিত। আমার কিন্তু দোষ নেই। আমার কোনাে কাজের দ্বারা যদি আপনার শাস্তি মাপ হয় তাে আমাকে বলবেন আমি যথাসাধ্য করবাে।

জিয়ানি বলল দরকার হলে বলবাে। জেমাতা তার পােশাক পরতে লাগলাে আর পিয়েত্রো তার গাধাটি নিয়ে ধান্দায় বেরল।

গল্প শুনে তাে লজ্জায় মেয়েদের সারা মুখ লাল। তারা হেসে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে, গা টেপাটেপি করে। সে এক কাণ্ড। কেউ আবার ডায়ােনিওেকে অসভ্য বলেও সম্বােধন করলাে। নবম দিনের দশম গল্প শেষ হল। পালাক্রমে সাতজন রাণী হয়েছে আর রাজা হয়েছে দু’জন, বাকি আছে শুধু প্যানফিলো। শেষ দিনে, দশম দিনে রাজা হওয়া প্যানফিলাের ভাগ্যে ছিল। কুইন তখন তার মাথাতেই মুকুট পরিয়ে দিয়ে বলল, কাল তুমি আমাদের রাজা।

প্যানফিললা বলল, তােমাদের সকলকে ধন্যবাদ। তােমরা সকলে গত ন’ দিন ধরে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছ তবে শেষ দিনের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়ল, আমি ভয় পাচ্ছি। তােমাদের তুল্য আমি অমন ভালােভাবে সবকিছু চালাতে পারবাে কিনা। তােমরা সকলে আছ, তােমাদের সহযােগিতা থেকে বঞ্চিত হবাে না অতএব বলতে পারি যে শেষ দিনটাতে তােমাদের আনন্দ দিতে পারবাে।

গত দিনে তােমরা যার যেমন ইচ্ছে গল্প বলেছ কিন্তু আমি আবার আগেকার রীতি চালু করতে চাই। শেষ দিনে আমাদের গল্প বলার বিষয়বস্তু হবে প্রেমের বা অন্য ব্যাপারে যারা ঔদার্য বা দানশীলতার পরিচয় দিয়েছেন এমন কিছু ব্যক্তির কথা আমরা শুনতে চাই। মানুষের কথা শুনতে আমরা সকলে ভালবাসি আর এই ধরনের গল্প থেকে অনেক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতেও পারবাে।

প্যানফিলাের প্রস্তাবে সকলে সমর্থন জানাল, বলল ভালােই হবে, আমরা সকলে উপযুক্ত গল্প ভেবে রাখবাে।

সূর্য অস্ত যেতে তখনও একটু দেরি ছিল তাই সকলে অন্য দিনের মতাে দল বেঁধে বাগানে বেড়াতে আরম্ভ করলাে। কেউ গান আরম্ভ করলাে।

সেদিন রাত্রের আহারে বিশেষত্ব কিছু না থাকলেও রান্না উৎকৃষ্ট হয়েছিল। পাচক বােধহয় নতুন কিছু মসলা দিয়েছিল। সকলে তৃপ্তি করে আহার করলাে। আহারের পর কিছুক্ষণ গল্প গুজব হল। সেদিন শেষ গানটি শােনাল নেফাইল, সুরেলা গলায় দরদ দিয়ে চমৎকার একটি প্রেমসঙ্গীত।

সকলে নেফাইলের গান শুনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে লাগল। তারপর যে যার শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাে। নিদ্রাদেবীর আরাধনা করতে হবে তাে!

।। ডেকামেরনের নবম দিবস শেষ হল।।

Leave a Reply